৪০. ক্ষোভ প্রকাশ করলেন প্রেসিডেন্ট

৪০.

ধুত্তোরি, মার্টিন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন প্রেসিডেন্ট। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে হাইজ্যাক করা হবে, খবরটা আগে আগে জানতে পারেনি সি.আই.এ?।

 সি.আই.এ ডিরেক্টর মারটিন ব্রোগান বিচলিত হলেন না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বড় ধরনের আতঙ্কবাদী হামলা হলেই অভিযোগটা শুনতে হয় তাঁকে। শান্ত ভাবে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন তিনি। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সিকিউরিটি এজেন্টদের নাকের সামনে থেকে প্যাসেঞ্জার আর কুসহ হাইজ্যাক করা হয়েছে জাহাজটাকে। যার মাথা থেকেই প্ল্যানটা বেরিয়ে থাকুক, সে যে একটা প্রতিভা তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে সে, যে পদ্ধতির সাথে কারও কোন পরিচয় নেই।

তাকে সমর্থন করে মুখ খুললেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অ্যালান মারসিয়ার

আমাদের আড়িপাতা নেটওয়ার্কও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগাম কোনো খবর সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সিনেটর জর্জ পিটকে তাহলে নিজে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছি আমি, অনুতাপের সাথে বললেন প্রেসিডেন্ট। টেবিলে আবার ঘুষি মারলেন প্রেসিডেন্ট।

নিশ্চিতভাবে এখনও আমরা কিছু জানতে পারিনি, অ্যালান মারসিয়ার বললেন।

ক্রু ও প্যাসেঞ্জারসহ একটা প্রমোদতরীকে গায়েব করে দেয়া সম্ভব নয়, অ্যালান।

এখনও সম্ভাবনা আছে।

 মিথ্যে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা কোরো না! কিসের সম্ভাবনা? বোঝাই তো যাচ্ছে, সুইসাইড মিশন ছিল ওটা। জাহাজ যখন ডোবে, প্যাসেঞ্জাররা সম্ভবত কেবিনের ভেতর বন্দি ছিলেন। সন্ত্রাসবাদীরা পালাবার কোনো চেষ্টা করেনি। তারাও স্বেচ্ছায় ডুবে মরেছে।

অ্যালান মারসিয়ার তবু আশা ছাড়তে রাজি নন। এখনও সমস্ত তথ্য আমরা পাইনি।

ঠিক কতটুকু জানি আমরা? প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট।

উত্তর দিলেন সিআইএ প্রধান মারটিন ব্রোগান। সিআইএ এজেন্টরা পাল্টা ডেল এসটে-তে উরুগুয়ে সিকিউরিট এজেন্টদের সাথে যোগ দিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে রহস্যের সমাধান পাওয়া যায়নি। তবে, ধারণা করা হচ্ছে হাইজ্যাকের জন্য আরব একটা গ্রুপ দায়ী। দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, ল্যান্ডিং বার্জ থেকে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে কার্গো গ্রহণ করতে দেখেছে তারা। দুই জাহাজের ক্রুদেরই আরবিতে কথা বলতে শুনেছে। তল্লাশি চালিয়ে ল্যাল্ডিং বাৰ্জটাকে কোথাও পাওয়া যায়নি, সন্দেহ করা হচ্ছে বন্দরে কোথাও ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে সেটাকে।

কার্গো সম্পর্কে কিছু জানা গেছে? জিজ্ঞেস করলেন অ্যালান মারসিয়ার।

অনেকগুলো ড্রাম দেখেছে তারা, সিআইএ প্রধান জানালেন। আরেকটা তথ্য পেয়েছি আমরা। লেডি ফ্ল্যামবোরা থেকে বন্দর মাস্টারকে জানানো হয়, জাহাজের মেইন জেনারেটরে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে, মেরামত না হওয়া পর্যন্ত তারা শুধু নেভিগেশন লাইট জ্বালাবে। এরপর কী ঘটেছে আন্দাজ করে নিতে পারি আমরা। সন্ধ্যের অন্ধকারে নোঙর তোলে লেডি ফ্ল্যামবোরো, চ্যানেল থেকে বেরোবার সময় ছোট একটা ইয়টকে ধাক্কা দেয়। ইয়টে দক্ষিণ আমেরিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী ও কূটনীতিক ছিলেন। আতঙ্কবাদীদের গোটা পরিকল্পনায় এটাই একমাত্র খুঁত। ইয়টটাকে ডুবিয়ে দেয়ার পর লেডি ফ্ল্যামবোরার কী হয়েছে, কোথায় গেছে বা আছে, কিছুই আমরা জানতে পারিনি।

হে’লা কামিলের ওপর দ্বিতীয়বার হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয় সন্ত্রাসবাদীরা, অ্যালান মারসিয়ার বললেন। অত্যন্ত কাঁচা ছিল অপারেশনটা। সেটার সাথে এটার কোনো সাদৃশ্য দেখছি না।

সিআইএ প্রধান মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থন করলেন। দুটো আলাদা গ্রুপ।

এই প্রথম মুখ খুললেন ডেইল নিকোলাস, দ্বিতীয় হামলার জন্য সরাসরি আখমত ইয়াজিদকে দায়ী করেছিলে তুমি।

হ্যাঁ। আততায়ীরা খুব একটা সতর্ক ছিল না। লাশের সাথে মিসরীয় পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। লিভারের লাশটা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, সে একজন মোল্লা, ইয়াজিদের ফ্যানাটিক অনুসারী।

তোমার কী ধারণা, হাইজ্যাকিংয়ের সাথেও আখমত জড়িত?

তার মোটিভ তো অবশ্যই আছে, সিআইএ প্রধান বললেন। পথের কাটা নাদাভ হাসানকে দূর হলে সরকারকে হটিয়ে গদিতে বসা তার জন্য পানির মতো সহজ হয়ে যাবে।

প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো, টপিটজিন আর মেক্সিকোর ব্যাপারেও একই কথা, শুকনো গলায় বললেন ডেইল নিকোলাস।

দুচারজন সি.আই.এ. এজেন্টকে উরুগুয়েতে পাঠানো ছাড়া আর কী কিছু করার নেই আমাদের? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে খুঁজে বের করার কাজে আমরা সাহায্য করছি না কেন?

কারণটা ব্যাখ্যা করলেন মারটিন ব্রোগান। তারপর জানালেন, উরুগুয়ের সিকিউরিটি চিফরা হয় আমেরিকায় নয়তো ব্রিটেনে ট্রেনিং পেয়েছেন, তাদের তল্লাশিতে কোনো খুঁত থাকার কথা নয়। এরই মধ্যে রিপোর্ট পেয়েছেন তিনি, তারা আয়োজন ও চেষ্টা কোনো ত্রুটি করছে না। উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের আশিটার ওপর সামরিক ও বাণিজ্যিক প্লেন সেই ভোর রাত থেকে সাগরের ওপর তল্লাশি চালাচ্ছে, ওগুলোর সাথে কাজ করছে কম করেও চৌদ্দটা জাহাজ।

যা-ও বা ক্ষীণ একটু আশা ছিল, সেটা নিঃশেষে মুছে যেতে বসেছে দেখে এ রকম মুষড়েই পড়লেন প্রেসিডেন্ট। অথচ এখনও তারা জানতে পারেনি লেডি ফ্ল্যামবোলোর কপালে কী ঘটছে।

আরেকটু সময় নেবে ওরা, বললেন অ্যালান মারসিয়ার। তবে জানতে ঠিকই পারবে।

জাহাজের ভাঙা অংশ আর লাশ অবশ্যই পাওয়া যাবে, দৃঢ়তার সাথে বললেন মারটিন ব্রোগান! পেছনে কোনো চিহ্ন না রেখে অত বড় একটা জাহাজ স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না।

প্রেস জানে? প্রেসিডেন্টের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।

আমাকে জানানো হয়েছে, ঘণ্টাখানেক হলো প্রচার করছে ওরা, ডেইল নিকোলাস বললেন।

কংগ্রেস, যদি জানে, শিকারের তালিকায় তাদের একজন সিনেটর রয়েছেন, নরক ভেঙে পড়বে। বললেন প্রেসিডেন্ট।

সিনেটর পিটের ওখানে উপস্থিতিই কানা-ঘুষা হওয়ার মতো ব্যাপার, নিকোলাস বললেন।

একটা কিছু তো বলতে হবে। কোন সিনেটর ওই জাহাজে গেলেন- এটা নিয়ে কথা উঠবেই, অ্যালান বলে উঠলেন।

আরে, মিসর আর মেক্সিকোর সমস্যার তুলনায় ওটা কিছুই নয়, ডেইল বলে উঠলেন। পশ্চিমা দুনিয়া মিসরকে হারাবে, কারণ ইয়াজিদের মৌলবাদী সরকার আরো ইরানে পরিণত করবে মিসরকে, বললেন ডেইল নিকোলাস তারপর, মেক্সিকো…ধরে নিতে পারি, আমাদের সীমান্তে একটা টাইম বোমা তৈরি হচ্ছে।

তুমি কী পরামর্শ দাও, কী করা উচিত আমাদের? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

কিছু সময় চিন্তা করে ডেইল নিকোলাস বললেন, লেডি ফ্ল্যামবোরো আর তার প্যাসেঞ্জারদের সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু না জানা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা।

কিন্তু যদি নিশ্চিতভাবে কিছু জানা না যায়? আমরা অপেক্ষা করলেও, প্রতিপক্ষ অপেক্ষা করবে না। আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিন মিসর আর মেক্সিকোয় রক্তস্রাত বইয়ে দেবে, বসে বসে তাই দেখব আমরা? তাদেরকে থামানোর পথ কী?

 আততায়ী পাঠিয়ে কিছু করার কথা আমরা ভাবতে পারি না, কারণটা সবার জানা দুনিয়ার মানুষ সেটা সমর্থন করবে না। মাথা চুলকালেন ডেইল নিকোলাস। তবে সবচেয়ে খারাপটার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি আমরা।

কী সেটা?

 মিসরের আশা ছেড়ে দিতে পারি, বললেন ডেইল নিকোলাস। আর আক্রমণ করতে পারি মেক্সিকোকে।

.

৪১.

ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভিজছে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টিভিডিও। মেঘ থেকে খসে পড়ল ছোটো একটা জেট প্লেন, ছুটে এসে সিধে হলো রানওয়ে বরাবর। টারমাক স্পর্শ করার পর কমার্শিয়াল টার্মিনালকে পেছনে ফেলে এক সার হ্যাঁঙ্গারের দিকে এগোল প্লেনটা, হ্যাঙ্গারগুলোর বাইরে অনেকগুলো ফাইটার জেট দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ে সামরিক প্রতীক চিহ্ন নিয়ে উদয় হলো একটা ফোর্ড সিডান, প্লেনটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল পার্কিং এরিয়ায়, জায়গাটা ভিআইপি এয়ারক্রাফটের জন্য আলাদা করা।

একটা হ্যাঙ্গার অফিসের ভেতর দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল হোসে রোয়েস, ভিজে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। প্লেনটাকে থাকতে দেখল, ফিউজিলাজে লেখা রয়েছে নুমা। ইঞ্জিনের আওয়াজ থেকে গেল, এক মিনিট পর প্লেন থেকে নেমে এল তিনজন লোক। বৃষ্টি মথায় করে ছুটল তারা, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল সিডানে। তাদের নিয়ে হ্যাঁঙ্গারে ঢুকল গাড়ি।

অফিস কামরার দরজা থেকে ওদেরকে খুঁটিয়ে লক্ষ করল কর্নেল। তরুণ এক লেফটেন্যান্ট পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। তিনজনের মধ্যে একজন তেমন লম্বা নয়, বুকটা ড্রামের মতো, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, হাত পা যেন বুনো একটা ভাল্লুকের কাছ থেকে ধার করা। চোখজোড়া কুতকুতে, তবে ঠোঁট দুটোর মাঝখানটা চকচকে সাদা, অকারণ ব্যঙ্গের হাসি ফুটে আছে।

রোগা-পাতলা দ্বিতীয় লোকটা চশমা পরে আছে। কোমর সরু, কাঁধ সরু, দেখে মনে হয় একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তার এক-হাতে একটা ব্রিফকেস, বগলে দুটো বই। সে-ও হাসছে, তবে হাসিটা যতটা না ব্যঙ্গাত্মক তার চেয়ে অনেক বেশি সকৌতুক। লোকটা সাদাসিধে এবং অত্যন্ত যোগ্য বলে মনে হলো কর্নেলের।

পেছনের দীর্ঘদেহী তরুণের চুল ঢেউ-খেলানো, লাল রঙের। রোদে পোড়া তামাটে চামড়া, চেহারায় পাথুরে মূর্তির মতো শীতল নির্লিপ্ত ভাব স্থির হয়ে আছে। কর্নেলকে বোকা বানানো সহজ নয়, তরুণের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিই তার পরিচয় ফাঁস করে দিল। হেঁটে আসার সময় বাকি দু’জন হ্যাঁঙ্গারের এদিক ওদিক তাকালেও, এই লোক সোজা চেয়ে রয়েছে কর্নেলের চোখের দিকে, যেন জোড়া ম্যাগনিফাইং গ্লাসের ভেতর দিয়ে দুটো সুর্য কড়া নজর রাখছে তার ওপর।

 দৃঢ়, ঋজু ভঙ্গিতে সামনে এক পা বাড়াল সে, অভিবাদনের পর বলল, ওয়েলকাম টু উরুগুয়ে, জেন্টলম্যান। কর্নেল হোসে রোয়েস অ্যাট ইওর সার্ভিস। এর দীর্ঘদেহী তরুণের সামনে দাঁড়াল সে, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, ফোনে কথা হওয়ার পর থেকে আপনার সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছি, মি. পিট।

এগিয়ে এসে দুই বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়াল পিট, করমর্দন করল কর্নেলের সাথে। আমাদের জন্য সময় দিতে পেরেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ। চশমা পরা লোকটার দিকে ফিরে পরিচয় করিয়ে দিল ও। রুডি গান। আর আমার ডান দিকে ক্রিমিনাল বলে মনে হচ্ছে যাকে, সে হলো অ্যাল জিওর্দিনো।

সামান্য বাউ করল কর্নেল, নিখুঁতভাবে ভাজ করা প্যান্টের পায়ায় ছড়ি দিয়ে মৃদু আঘাত করছে। আগোছাল পরিবেশের জন্য ক্ষমা করবেন, প্লিজ। আসলে হাইজ্যাকিংয়ের পর আমাদের দেশে হামলা চালিয়েছে দুনিয়ার সাংবাদিকরা। ওরা আপনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ভেবে পথ দেখিয়ে এখানে আনা হয়েছে আপনাদেরকে।

 ভালো করেছন, বলল পিট, অপ্রয়োজনীয় কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে মনে মনে বিরক্তি বোধ করল। এখন যদি আপনি…

 হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনাদের বিশ্রাম দরকার, এই তত? সব ব্যবস্থা করা আছে।

বিশ্রাম? আকাশ থেকে পড়ল পিট। আমরা পরিস্থিতি স্পর্কে জানতে চাই, কর্নেল-অ্যাট দিস মোমেন্ট!

 তাহলে এদিকে আসুন, আপনাদের আমি সার্চ অপারেশন সম্পর্কে ব্রিফ করব।

অফিসে ঢুকে ক্যাপটেন ফোরেসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে। বড় একটা টেবিলে বসাল ওদেরকে, টেবিলের ওপর গাদা হয়ে রয়েছে নটিক্যাল চার্ট আর স্যাটেলাইট ফটো। ব্রিফিং শুরু করার আগে কর্নেল বলল, জাহাজে আপনার বাবা রয়েছেন শুনে সত্যি আমি দুঃখিত, মি. পিট। ফোনে কথা বলার সময় সম্পর্কটার কথা আপনি কিছু বলেননি।

কিন্তু তবু আপনি জেনেছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার প্রতি ঘণ্টার যোগাযোগ করছেন।

আপনি শুনে খুশি হবেন, ওয়াশিংটনে যারা আমাকে ব্রিফ করেছে, আপনার প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ।

খুশিটা গোপন রাখতে হিমশিম খেয়ে গেল কর্নেল। কিন্তু দুঃখিত, আপনাকে আমি কোনো ভালো খরব শোনাতে পারছি না। আপনি আমেরিকা ছাড়ার পর নতুন কোনো তথ্য এখনও আমরা হাতে পাইনি। কফি, নাকি ব্র্যান্ডি, মি. পিট?

আমার জন্য কফি।

জিওর্দিনো আর রুডি ব্র্যান্ডি চাইল। টেবিল ছেড়ে উঠে গেল ক্যাপটেন ফোরেস। স্যাটেলাইট ফটোগুলো সাজিয়ে মোজাইকসদৃশ একটা নকশা তৈরি, করল কর্নেল, উপকূলের তিনশো কিলোমিটার এক নজরে ধরা পড়ল ওদের চোখে।

 প্রথম মন্তব্য এল রুডির কাছ থেকে, আপনারা দেখছি আর্থ রিসোর্সের টেক স্যাটেলাইট ব্যবহার করেছেন।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন-ল্যান্ডস্যাট।

 সাগরে জাহাজ দেখানো জন্য ব্যবহর করেছেন পাওয়ারফুল গ্রাফিক সিস্টেম।

বলতে পারেন, ভাগ্যগুণে, জবাব দিল কর্নেল। প্রতি ষোল দিনে একবার পোলার কক্ষপথ পাড়ি দেয় ল্যান্ডস্যাট, উরুগুয়ের সাগর ওটার পথেই পড়ে। এবার ওটা ঠিক সময়মতো এসে পড়েছে?

ল্যান্ডস্যাট সাধারণত জিওলজিক্যাল সার্ভের কাজ করে, বলল রুডি। সাগরের ওপর দিয়ে যাবার সময় ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়, এনার্জি বাঁচাবার জন্য। ফটোগুলো পেলেন কীভাবে?

আমেরিকানরা কি আর এমনি আমার প্রশংসা করেছে! হেসে উঠল কর্নেল। গর্ব করছি মনে হলে ক্ষমা করবেন, প্লিজ। তল্লাশির নির্দেশ পেয়ে কাজ শুরু করলাম, হঠাৎ আমার মনে পড়ল ল্যান্ডস্যাটের কথা। খোঁজ নিতেই জানলাম, ওটার আসার সময় হয়েছে। মার্কিন সরকারকে ফোনে অনুরোধ করলাম, ল্যান্ডস্যাটের ক্যামেরাগুলো যেন চালু করা হয়। স্পটে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা আগে চালু হয়ে যায় ক্যামেরা, বুয়েনস আয়ার্সের রিসিভিং সেন্টারে সিগন্যাল পাঠায়।

 লেডি ফ্ল্যামবোরো আকারের একটা টার্গেট কি ল্যান্ডস্যাট ইমেজে ধরা পড়বে? জানতে চাইল জিওর্দিনো।

ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট যেমন বিশদ দেখাতে পারে, ল্যান্ডস্যাট তা পারবে না, বলল পিট। তবে দেখা যাবে।

 নিজেদের চোখেই দেখুন না, বলল কর্নেল, ল্যান্ডস্যাট ফটো মোজাইকের খুদে একটা অংশের ওপর ম্যাগনিফায়েড ভিউইং লেন্স ধরল সে।

প্রথমে তাকাল পিট। দুটো… না, তিনটে জাহাজ দেখতে পাচ্ছি।

তিনটেকেই আমরা শনাক্ত করেছি।

ঘাড় ফিরিয়ে ক্যাপটেন ফোরেসের দিকে ফিরল কর্নেল, একটা কাগজ থেকে সশব্দে পড়তে শুরু করল সে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। বড় জাহাজটা চিলির, ওর ক্যারিয়ার, নাম ক্যাবো গ্যালাগোস, পাল্টা আরেনাস থেকে ডাকার যাচ্ছে, কয়লা নিয়ে।

উত্তরমুখো জাহাজটা? জিজ্ঞেস করল পিট। ফটোর কিনারায় স্রেফ দেখা দিতে শুরু করেছে?

 হ্যা, বলল ফ্লোরেস এরকম হলেন। ওটাই ক্যাবো গ্যালাগোস। উল্টোদিকে, মাথার কাজে, দক্ষিণমুখো জাহাজটা জেনারেল ব্রাভো। মেক্সিকোতে রেজিস্ট্রি করা ওটা, কন্টেইনার শিপ, সান পারল-তে সাপ্লাই আর অয়েল-ড্রিলিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে যাচ্ছে।

সান পাবলো কোথায়? প্রশ্ন করল জিওর্দিনো।

আর্জেন্টিনার ডগায় ছোট্ট একটা বন্দর নগরী, জবাব দিল কর্নেল। খবরের কাগজে পড়েননি, গত বছর ওখানে তেল খনির শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছিল?

ক্যাপটেন ফোরেস বলল, ও-দুটো মাঝখানে, তীরের কাছাকাছি জাহাজটা, লেডি ফ্ল্যামবোরো।

ট্রেতে করে কফি আর ব্র্যান্ডি নিয়ে হাজির হলো কর্নেলের এইড।

 কাপে চুমুক দিল পিট। এত ছোট, কোন দিকে মুখ বুঝতে পারছি না।

পান্টা ডেল এসটে থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে রওনা হয় লেডি ফ্ল্যামবোরো।

বাকি জাহাজ দুটোর সাথে আপনি যোগাযোগ করেছেন?

 মাথা ঝাঁকাল ক্যাপটেন। ওরা কেউ জাহাজটাকে দেখেনি।

স্যাটেলাইট কখন গেছে?

কাটায় কাঁটায় ০৩: ১০ ঘন্টায়।

তল্লাশি চালাবার জন্য প্লেগুলো আকাশে উঠল কখন?

 ভোরের প্রথম আলোয়। দুপুরে ল্যান্ডস্যাট ফটো পাই আমরা। লেডি ফ্ল্যামবোরোর কোর্স আর স্পিড় হিসাব করে জাহাজ আর প্লেনগুলোকে সেদিকে পাঠাই।

কিন্তু তারা ওটাকে খুঁজে পায়নি?

না।

ভাঙা কোনো অংশও নয়?

জবাব দিল ক্যাপটেন ফোরেস, আমাদের পেট্রল বোট কিছু আবর্জনা দেখতে পায়।

শনাক্ত করা গেছে?

পানি থেকে তুলে পরীক্ষা করা হয়েছে। জিনিসগুলো প্রমোদতরী থেকে আসেনি, এসেছে কোনো কার্গো শিপ থেকে।

কী করে বুঝলেন?

একটা ব্রিফকেস টেনে নিয়ে খুলল ক্যাপটেন, ভেতর থেকে মোটা একটা ফাইল বের করল। সার্চ ভেসেলের ক্যাপটেন আমাকে একটা তালিকা দিয়েছে। একটা মান্ধাতা আমলের চেয়ার, পুরনো একজোড়া লাইফ জ্যাকেট, কাঠের কয়েকটা বক্স, একটাতেও কিছু লেখা নেই, ফুড কন্টেইনার, তিনটে খবরের কাগজ-একটা মেক্সিকোর, আরেকটা ব্রাজিলের

 তারিখ? বাধা দিল পিট।

চোখে প্রশ্ন নিয়ে পিটের দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল ফ্লোরেস, তারপর ওর দৃষ্টি এড়াবার চেষ্টা করল। তারিখ তো দেয়নি।

ভুল হয়ে গেছে, তবে সংশোধন করা হবে, তাড়াতাড়ি বলল কর্নেল।

এগুলো ভাঙা জাহাজের অংশ হতে পারে না, বলল ক্যাপটেন। আবর্জনাই বলা যায়।

নটিক্যাল চার্টে জাহাজগুলোকে সাজাতে পারেন? জিজ্ঞেস করল পিট। যেমন দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইট ফটোতে?

মাথা ঝাঁকিয়ে কাজ শুরু করল ক্যাপটেন। এক মিনিট পর হাতের ডিভাইড়া রখে দিয়ে চার্টের ওপর পেন্সিলের উল্টো দিকটা ঠুকল সে। কাল সকাল ০৩: ১০ ঘণ্টায় এই তিন অবস্থানে ছিল জাহাজগুলো।

টেবিলের সামনে সরে এসে চার্টের ওপর ঝুঁকে পড়ল সবাই।

কোর্স দেখে বোঝা যায়, তিনটে জাহাজই একসময় পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসবে, বলল রুডি গান। পকেট থেকে ছোটো একটা ক্যালকুলেটর বের করে বোম টিপতে শুরু করল সে। আনুমানিক স্পিড় ধরতে পারি-লেডি ফ্ল্যামবোরোর ত্রিশ নট, ক্যাবো গালাগাস-এর আঠারো নট আর জেনারেল ব্রাভোর বাইশ নট…, কণ্ঠস্বর নিস্তে জ হয়ে এল, চার্টের ওপর হিসাবটা লিখছে সে। কয়েক মিনিট পর সিধে হয়ে পিছিয়ে এল এক পা। কয়লা নিয়ে চিলিয়ান জাহাজটা লেডি ফ্ল্যামবোরোকে দেখতে পায়নি, পাবার কথাও নয়। প্রমোদতরীর বো-র চৌষট্টি কিলোমিটার সামনে দিয়ে পুব দিতে চলে গেছে ওটা।

চার্টের গায়ে আঁকা রেখাগুলোর দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে আছে পিট। তবে মেক্সিকান কন্টেইনার জাহাজটা লেডি ফ্ল্যামবোরোর তিন কি চার কিলোমিটার কাছ দিয়ে গেছে।

তবু দেখতে পায়নি, কারণ লেডি ফ্ল্যামবোয়োয় কোনো আলো ছিল না।

ক্যাপটেন ফোরেসের দিকে ফিরল পিট। চাঁদের আকৃতি মনে পড়ে?

 চাঁদ ছিল আধখানা।

মাথা নাড়ল জিওর্দিনো। সরাসরি না তাকালে এই আলোয় দেখতে পাবার কথা নয়।

ধরে নিচ্ছি, এই পয়েন্ট থেকে তল্লাশি শুরু করেন আপনারা? জিজ্ঞেস করল পিট।

 হ্যাঁ, বলল ক্যাপটেন। পুব, উত্তর আর দক্ষিণ দিকে দুশো মাইল জুড়ে তল্লাশি চালিয়েছে পাইলটরা।

কোনো হদিশ নেই?

শুধু কন্টেইনার শিপ আর ওর ক্যারিয়ারকে পাওয়া গেছে।

ফিরতি পথে কিছুদূর এসে, তারপর আবার দক্ষিণ বা উত্তর দিকে যেতে পারে লেডি ফ্ল্যামবোরো।

কথাটা আমরাও ভেবেছি, বলল ক্যাপটেন। ফুয়েল নিতে আসার সময় পাইলটরা সেদিকও খোঁজ করেছে।

তাহলে ধরে নিতে হবে, স্নান গলায় বলল রুডি, নিচের দিকে তলিয়ে গেছে। লেডি ফ্ল্যামবোরো।

শেষ অবস্থান জেনে নাও, রুডি, তাকে নির্দেশ দিল পিট। সার্চ প্লেন আসার আগে কতদূর যেতে পারে হিসাব করো।

কর্নেলের চেহারায় আগ্রহ ফুটে উঠল। কি করতে চান বলবেন আমাকে, মি. পিট? তল্লাশি চালিয়ে আর তো কোনো লাভ নেই।

কর্নেল যেন একটা স্বচ্ছ বস্তু, ভেদ করে গেল পিটের দষ্টি। রুডি যেমন বলল, ধরে নিতে হয় পানির তলায় তলিয়ে গেছে লেডি ফ্ল্যামবোরো। ওখানেই আমরা খুঁজব।

আমি কীভাবে সাহায্যে আসতে পারি?

নুমার রিসার্চ ভেসেল সাউন্ডার-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিল পিট, তারপর বলল, আজ সন্ধ্যায় আসছে ওটা। খুব সুবিধা হয় আপনি যদি একটা হেলিকপ্টারে করে জাহাজে পৌঁছে দেন আমাদের।

মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলো কর্নেল। তারপর বলল, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার সাগর থেকে নির্দিষ্ট একটা মাছকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করছেন আপনি। এতে আপনার সারাটা জীবন লেগে যেতে পারে।

না, শান্ত দৃঢ়তার সাথে বলল পিট। খুব বেশি হলে বিশ ঘন্টা লাগবে।

কর্নেল রোয়েস বাস্তববাদী মানুষ, লাগাম ছাড়া কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয় না। জিওর্দিনো আর রুডির দিকে তাকায় সে, আশা, ওদের চেহারায় সন্দেহ দেখতে পাবে। সন্দেহ নয়, সমর্থন লক্ষ করে অবাক হলো সে। বলল, আপনারা নিশ্চয়ই এই সময়সীমা বিশ্বাস করেন না?

চোখের সামনে একটা হাত তুলে নখগুলো মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল জিওর্দিনো। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সময়সীমা বাড়িয়ে ধরেছে ডার্ক।

.

৪২.

উরুগুয়ের একটা সামরিক হেলিকপ্টার সাউন্ডারের ল্যান্ডিং প্যাডে নামিয়ে দিল ওদেরকে। ঠিক চৌদ্দ ঘণ্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পর লেডি ফ্ল্যামবোরোর সাথে মিল আছে এমন একটা আকৃতির সন্ধান পাওয়া গেল এক হাজার বিশ মিটার পানির নিচে।

পোলার এক্সপ্লোরার-এ ছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ভিউইং সিস্টেম, সাউন্ডারে তা নেই। পেছনে ঝুলে থাকা সোনার সেনসর-এ সেই কালার ভিডিও ক্যামেরা। সাউন্ডারের ইলেকট্রনিক গিয়ার মানুষের তৈরি ডুবে যাওয়া জিনিসের ছবি দূর থেকে তুলতে পারে, ক্লোজ-আপ ছবি তোলার সামর্থ্য তার নেই।

 আবছা হলেও আকৃতিটা একই রকম দেখাচ্ছে, বলল রুডি। পেছনের সুপার স্ট্রাকচার চিমনিটা একদিকে যেন একটু কাত হয়ে আছে। জাহাজের পাশগুলো উঁচু আর সোজা। খাড়াভাবে রয়েছে, খুব বেশি হলে দশ ডিগ্রি কাত হয়ে আছে।

 পজিটিভ আইডেনটিফিকেশনের জন্য ওটার দিকে ক্যামেরা তাক করতে হবে, বলল জিওর্দিনো।

পিট কোনো মন্তব্য করল না। সাউন্ডারের পেছন দিকে টার্গেট সরে যাবার পরও অনেকক্ষণ ধরে সোনার রেকর্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও। বাবাকে জীবিত ফিরে পাবার আশা মুছে যাচ্ছে মন থেকে।

ওর কাঁধে হাত রাখল জিওর্দিনো। দারুণ, পিট। সরাসরি টার্গেটে নিয়ে এসেছে আমাদের।

কোথায় খুঁজতে হবে, আগে থেকে আপনারা জানলেন কীভাবে? চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্ন করল সাউন্ডারের স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্ট।

 আমি ধরে নিই, জেনারেল ব্রাভোর ইনসাইড পাথ ক্রস করার পর লেডি ফ্ল্যামবোরো কোর্স বদলায়নি, বলল পিট। আর ক্যাবো গ্যালাগাসের আউটসাইড কোর্সের সামনে কোথাও সার্চ এয়ারক্রাফটের পাইলটরা দেখতে পায়নি জাহাজটাকে। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিই, ল্যান্ডস্যাট থেকে জানা লেডি ফ্ল্যামবোরোর সর্বশেষ হেডিং থেকে পূর্ব দিকে তল্লাশি চালাব।

 ক্রু রা রিমোট কন্ট্রোল চালিত বাহন, ডিপ রোভার-কে আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করতে পারবে, আপনি অপারেটর হিসেবে থাকছেন? জিজ্ঞেস করল স্কিপার।

পিট বলল, ওকে নিয়ে আমি নিজেই পানিতে নামব।

এক হাজার মিটার, চিন্তিতভাবে বলল স্কিপার। আপনি ওটার ডেপথ রেটিংয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবেন।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মদ কাঁধ ঝাঁকাল পিট। স্নান হাসল জিওর্দিনো।

 সোনার রেকর্ডিংয়ের ভিডিও টেপ দেখছে রুডি, একটা ইমেজ স্থির করল সে, চিন্তিতভাবে পরীক্ষা করছে সেটা। দেখছ, খোলটা একেবারে অক্ষত দেখাচ্ছে। তাহলে লেডি ফ্ল্যামবোরো ডুবল কীভাবে?

পানির ওপরই বা কিছু ভাসছে না কেন? প্রশ্ন।

জাহাজটা ঝড়ের মধ্যেও পড়েনি, বলল পিট।

 বেয়াড়া, অপ্রত্যাশিত কোনো বড় ঢেউ ধাক্কা দেয়নি তো? আবার প্রশ্ন।

 এমন হতে পারে, ডুবো পাহাড়ে লেগে জাহাজটার তলা গুঁড়িয়ে গেছে?

একটু পরই জানা যাবে, শান্তভাবে বলল পিট। দুঘণ্টার মধ্যে ওটার মেইন ডেকে পৌঁছে যাব আমরা।

.

ডিপ রোভারের আকৃতি মঙ্গলগ্রহবাসীদের পছন্দ হবার কথা। গভীর সাগরতলের চেয়ে বাহনটাকে যেন অসীম মহাশূন্যেই বেশি মানাত। দুশো চল্লিশ সেন্টিমিটার গোলকটাকে বড় একটা বৃত্তাকার রিং ভাগ করেছে বসে আছে চৌকো একটা পড-এ, তাতে রয়েছে একশো বিশ ভোল্ট ব্যাটারি। গোলকের পেছন থেকে বেরিয়ে আছে দুনিয়ার সব যন্ত্রপাতি-গ্রাসটার, মটর, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কার্বন ডাই-অক্সাইড, রিমুভার ক্যানিস্টার, ডকিং মেকানিজম, ক্যামেরা সিস্টেম, স্ক্যানিং সোনার ইউনিট ইত্যাদি। তবে যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রোবটকে ঈর্ষাকাতর করে তুলবে গোলকের সামনের দিতে বেরিয়ে থাকা ম্যানিপুলেটরগুলো। ওগুলোকে যান্ত্রিক হাত বলা যেতে পারে।

দু’জন প্রকৌশলী শেষবারের মতো পরীক্ষা করছে ডিপ রোভারকে, পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে পিট আর জিওর্দিনো। গুহা আকৃতির একটা চেম্বারে, ক্রেডলের ওপর বসে আছে ওটা, চেম্বারটাকে বলা হয় মুন পুল। একটা প্ল্যাটফর্মে বসানো হয়েছে ক্রেডলটা, সেটা সাউন্ডারের খোলেরই একটা অংশ, পানির নিচে বিশ ফুট পর্যন্ত নামানো যায়।

প্রকৌশলীদের একজন মাথা ঝাঁকাল। সব ঠিক আছে। আপনারা রওনা হতে পারেন।

জিওর্দিনোর পিঠে মৃদু চাপড় মারল পিট। পেছনে আছি আমি।

ঠিক আছে, আমি ম্যানিপুলেটর আর ক্যামেরার দায়িত্ব নেব, বলল জিওর্দিনো। তুমি ড্রাইভ করবে।

আমার ডিপ রোভারকে অক্ষত ফিরিয়ে আনুন, রাজকীয় ডিনার খাওয়ার বাজি জিতে নিন, ঘোষণা করল সাউন্ডারের স্কিপার।

স্কিপারের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল পিট, নিচে গিয়ে কী দেখবে এই চিন্তা থেকে ওর মনটাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে লোকটা। একজোড়া এয়ারফোন কানে গুজতে খুঁজতে এগিয়ে এল রুডি গান। তোমাদের অডিও লোকেটর বিকন আর কমিউনিকেশন মনিটর করব আমি, বলল সে। তলাটা দেখতে পাবার সাথে সাথে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরতে শুরু করবে তোমরা, যতক্ষণ না সোনারে ধরা পড়ে জাহাজ। তারপর তোমাদের হেডিং জানাবে আমাকে। কী করছো না করছছ সব আমি প্রতি মুহূর্তে জানতে চাই।

রুডির বাগানো হাতা ধরে ঝাঁকি দিল পিট।

ঠিক জানো আমার বদলে তোমার যাওয়াটা উচিত হচ্ছে? বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল রুডি।

আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে, রুডি।

গুড লাক, বিড়বিড় করে বলল রুডি গান, মাই বেয়ে উঠে এল মুন পুল থেকে।

পাশাপাশি দুটো আর্মচেয়ারে বসেছে পিট আর জিওর্দিনো। প্রকৌশলীরা গোলকের অর্ধেক অর্থাৎ চাকরিটা বৃত্তাকার রিংয়ের সাথে জোড়া লাগিয়ে ক্ল্যাম্প এঁটে দিল।

পাওয়ার অন, নিশ্চিত করল জিওর্দিনো।

পাওয়ার অন, নিশ্চিত করল পিট।

রেডিও?

আমাদের সাড়া পাচ্ছ, রুডি? জিজ্ঞেস করল পিট।

লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, জবাব দিল রুডি গান।

 অক্সিজেন?

 টোয়েনটি-ওয়ান-পয়েন্ট-ফাইভ পার্সেন্ট।

 সব কিছু চেক করার পর জিওর্দিনো জানাল, আমরা তৈরি, সাউন্ডার।

টেকঅফের অনুমতি দেয়া গেল, ডিপ রোভার, স্বভাবসুলভ কর্কশ গলায় বলল স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্ট। মি, পিট, পুরস্কার জিততে হলে গোটা কয়েক গলদা চিংড়ি আনতে হবে।

ডিপ রোভারের পাশে দু’জন ডাইভার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, তাদেরকে নিয়েই ধীরে ধীরে সাগরে নামল প্ল্যাটফর্ম। ঘিরে ধরল পারি, তারপর ডেকে ফেলল বাহনটাকে। মুখ তুলে তাকাল পিট, মুন পুল-এর কাঁপা কাঁপা আলোয় ব্যালকনিতে দাঁড়ানো মূর্তিগুলোকে ভাঙাচোরা লাগল চোখে। ওশেনোগ্রাফারদের গোটা দলটা রুডি গান-এর চারদিকে ভিড় জমিয়েছে, ডিপ রোভার থেকে পাঠানো রিপোর্ট শোনার আশায়। অ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর পিট যেন একটা মাছ।

 গোলকটা পুরোপুরি ডুবে যাবার পর ক্রেডল থেকে সেটাকে মুক্ত করল ডাইভাররা। তাদের একজন হাত তুলে ও.কে, সঙ্কেত দিল। হাত নেড়ে সাড়া দিল পিট। থ্রাস্টার ঠেলে নাম বরাবর সামনে ত্রিশ ফুটের মতো সরিয়ে আনল ডিপ রোভারকে। দিক নির্ণয়ের জন্য কমপাস বেয়ারিং অ্যাডজাস্ট করার পর থ্রাস্টার ঠেলে নামতে শুরু করল নিচের দিকে।

 ক্ষীণ আলো থাকায় চারদিকের পানি নীলচে সবুজ দেখল, আরও গভীরে নামার পর বদলে গিয়ে ছাই আর সীসা হয়ে উঠল পানির রং। ছোটো একটা নীল হাঙর, লম্বায় এক মিটার হবে, নির্ভয়ে এগিয়ে এল সাব-এর দিকে, ওটাকে ঘিরে একবার চক্কর দিল, আকর্ষণীয় কিছু না দেখে নিঃসঙ্গ অভিযানে হারিয়ে গেল কাছের গভীরতায়।

 ওরা কোনো গতি অনুভব করছে না। শব্দ বলতে শুধু রেডিওর ঘড়ঘড় আওয়াজ। ডিপ রোভারের নিজস্ব আলোর বাইরে ঘোর অন্ধকার।

চারশো মিটার পেরিয়ে যাচ্ছি, রিপোর্ট করল পিট।

চারশো মিটার, রুডি আওড়াল। সাধারণত গোলকের ভেতর হাসি-ঠাট্টার জোয়ার বয়ে যায়, সময় কীভাবে কেটে যায় টেরই পায় না ওরা। আজকের কথা আলাদা, ডার্ক বা জিওর্দিনো একদম চুপ। প্রয়োজনেও দুএকটা শব্দ ছাড়া কেউ কথা বলছে না।

দেখছ? জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো।

দু’জন একইসাথে দেখতে পেয়েছে মাছটাকে। পানির গভীরতায় যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিত দর্শন প্রাণী। লম্বা, ঈল আকৃতির শরীর, কাঠামোর কিনারায় নিওন সাইনের মতো আলো জ্বলছে। হাঁ করা স্থির চোয়াল কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয় না, ভেতরে এবড়োখেবড়ো দাঁত। চোয়ালের ভেতর তোমার একটা হাত ঢুকে গেলে কেমন লাগবে?

জিওর্দিনো কিছু বলার আগে রুডি গান বলল, বিজ্ঞানীদের একজন জানতে চাইছেন, কী নিয়ে কথা বলছ তোমরা?

ড্রাগন ফিশ, বলল পিট।

উনি বর্ণনা পেলে খুশি হন।

ওপরে উঠে এঁকে দেখাব, অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলল পিট। আটশো মিটার ছাড়িয়ে যাচ্ছি।

সাবধান, তলার সাথে আবার ধাক্কা খেয়ো না। তোমাদের অক্সিজেনের কী অবস্থা?

সব ঠিক আছে।

 কাছাকাছি পৌঁছে গেছ, তাই না?

অধোগতি কমিয়ে আনল পিট। সামনের দিকে ঝুঁকে নিচে তাকাল জিওর্দিনো, পাথর খুঁছে। নিচে নেমে এসেছি আমরা, গোষণা করল সে। গভীরতা, ওয়ান থাউজেন্ড ফিফটিন মিটারস।

সাগরতলের পাথুরে মেঝে তিন মিটার দূরে তাকতে ডিপ রোভারকে থামাল পিট। সোনার ঘুরছে।

ওয়ান-ওয়ান-জিরো ডিগ্রি বা কাছাকাছি কোথাও পাবে জাহাজটা, বলল।

তিন সেকেন্ড পর জবাব দিল পিট, দুশো বিশ মিটার দূরে সোনার টার্গেট, বেয়ারিং ওয়ান ওয়ান টু ডিগ্রি।

আমি শুনছি, ডিপ রোভার।

অ্যালের দিকে ফিরল পিট। চলো দেখা যাক।

কম্পাসে চোখ রেখে দিক নির্দেশ দিল জিওর্দিনো, পাওয়ার বাড়িয়ে সামনে এগোল পিট।

বাম দিকে দুপয়েন্ট সরো, বেশি হয়ে গেল….হ্যাঁ, ঠিক আছে সোজা এগোও।

ভাবাবেগের লেশমাত্র নেই পিটের চোখে। ওর মুখ যেন পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। বুক ভরা ভয়, না জানি কী দেখতে হবে। মনে মনে প্রার্থনা করছে, বাপের লাশ পানিতে ভাসছে, এই দৃশ্যটা যেন ওকে দেখতে না হয়। শিউরে উঠে এক সেকেন্ডের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল ও।

ডান দিকে কী যেন দেখতে পাচ্ছি, বলল জিওর্দিনো।

সামনের দিকে ঝুঁকল পিট। একটা ড্রাম। দুশ লিটারের। আরও কয়েকটা রয়েছে, ওটার বাম পাশে।

চারদিকে শুধু ড্রাম আর ড্রাম, বলল জিওর্দিনো।

 গায়ে কোনো মার্কিং নেই? জানতে চাইল রুডি।

 স্প্যানিশ ভাষায় স্টেনসিল করা। সম্ভবত ওজন আর ভলিউম সম্পর্কে তথ্য।

সামনের একটার কাছাকাছি যাচ্ছি, বলল পিট। ভেতরে যা-ই থাকুক, বেরিয়ে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। ড্রামটার কয়েক ইঞ্চি দূরে থামল ডিপ রোভার। উজ্জ্বল আলোয় ওরা দেখল, ড্রেইন হোল থেকে গাঢ় কী যেন একটা জিনিস বেরিয়ে আসছে।

তেল? জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো।

মাথা নাড়ল পিট। অন্য কিছু মনে হচ্ছে। তেল লাল হয় না। মাই গড! তেল নয় রং!

পাশে ওটা কী, সিলিন্ডার আকৃতির?

তুমি বলো।

আমার ধারণা, প্লাস্টিক শিটের রোল ওটা।

বোধ হয় ঠিকই ধরেছ।

পরীক্ষার জন্য সাউন্ডারে তোলা যেতে পারে, কী বলল? স্থির হও। ম্যানিপুলেটর দিয়ে ধরি।

ডিপ রোভারকে স্থির করল পিট। গুটানো পাস্টিক যান্ত্রিক দুই হাতের মধ্যে চলে এল। ডিপ রোভার নিয়ে পরিষ্কার পানিতে উঠে এল পিট। কয়েক সেকেন্ড পর জিওর্দিনো বলল, জাহাজটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

জাহাজের খোল থেকে সাত মিটার দূরে ডিপ রোভারকে থামাল পিট। তারপর ধীরে ধীরে ফোরডেকের দিকে এগোল। আরে, একি! হঠাৎ বলল ও। রুডি, লেডি ফ্ল্যামবোঝোর রং কি?

দাঁড়াও। দশ সেকেন্ড পর জবাব দিল রুডি গান, খোল আর সুপার স্ট্রাকচার হালকা নীল।

এই জাহাজটার খোল লাল, ওপর দিকটা সাদা।

সাথে সাথে কিছু বলল না রুডি। তারপর তার ক্লান্ত গলার শোনা গেল, দুঃখিত, পিট। আমরা বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে বুদ্বুদ বেরোতে দেখছি।

 না। জিওর্দিনো বলে, খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ আগে ডুবেছে, এটা এমন একটা জাহাজের লাশ।

নেগেটিভ, রেডিওতে ভেসে এল এবার স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্টের কণ্ঠস্বর। গত ছমাসে আটলান্টিকের এদকিটায় শুধু লেডি ফ্ল্যামবোরো নিখোঁজ হয়েছে।

কিন্তু এটা লেডি ফ্ল্যামবোরো নয়, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল জিওর্দিনো।

 থামো একটু, বলল পিট। পেছন দিকে গিয়ে দেখি।

জাহাজটার পাশঘেঁষে পেছন দিকে চলে এল ওরা। জাহাজের গায়ে নাম লেখা রয়েছে।

ওহ, মাই গড। আঁতকে উঠল জিওর্দিনো। আমাদের বোকা বানানো হয়েছে।

অবিশ্বাসে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকল না পিট। উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করল সে। রহস্যটা যে ভেদ করা গেছে তা নয়, তবে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। জাহাজের গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা নামটা লেডি ফ্ল্যামবোরো নয়।

নামটা হলো জেনারেল ব্রাভো।

.

৪৩.

যাদের হাতে তৈরি, চারশো মিটার দূর থেকে তারাও এখন আর চিনতে পারবে না লেডি ফ্ল্যামবোরোকে। চিমনিটাকে নতুন আকৃতি দেয়া হয়েছে, বদলে ফেলা হয়েছে প্রতিটি বর্গ ইঞ্চির রং। সামনের চেহারা বদলাবার জন্য মরিচের গুঁড়ো দিয়ে আঁকাবাঁকা দাগ টানা হয়েছে খোলের গায়ে। সুপার স্ট্রাকচার, স্টেটরুমের সবগুলো জানালা আর ডেকগুলো ফাইবার বোর্ড দিয়ে সম্পূর্ণ আড়াল করা, দূর থেকে দেখে মনে হবে ওটা একটা কার্গো কন্টেইনার।

প্রমোদতরীর ব্রিজ সরানো বা লুকানো সম্ভব হয়নি, কাঠের চৌকো কাঠামো দিয়ে আড়াল করা হয়েছে সেটাকে, কাঠামোর ওপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে মোটা ক্যানভাস। রং দিয়ে আঁকা হয়েছে নকল পোর্ট হোল আর হ্যাঁচ কাভার।

পাল্টা ডেল এসটের আলো পেছনে অদৃশ্য হবার সাথে সাথে সুলেমান আজিজের সশস্ত্র লোকজন বন্দি কু আর আরোহীদের কা করতে বাধ্য করে। সারা রাত ধরে চলে জাহাজটার চেহারা পাল্টানোর কাজ। প্রথমে বাধ্য করা হয় জাহাজের অফিসার, প্রকৌশলী, স্টুয়ার্ড, শেফ আর ওয়েটারদের। তরপর ভিআইপি প্যাসেঞ্জারদের ডাকা হয়। প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান আর প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জোকে দেয়া হয় কাঠমিস্ত্রীর কাজ, ব্যক্তিগত স্টাফ আর উপদেষ্টারা তাদেরকে সাহায্য করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আর সিনেটর জর্জ পিটকে দেয়া হয় রং লাগানোর দায়িত্ব।

নির্ধারিত সময়ে জেনারেল ব্রাভোর সাথে মিলিত হলো লেডি ফ্ল্যামবোরো, ইতোমধ্যে কার্গো কন্টেইনার জেনারেল ব্রাভোর প্রায় হুবহু চেহারা পেয়ে গেছে লেডি ফ্ল্যামবোরো। ওয়াটার লাইনের ওপরটা দেখে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে নিঃসন্দেহে। জেনারেল ব্রাভো বলে চালানো যাবে। আকাশ থেকে তাকালে দুএকটা ক্রটি বা অমিল চোখে পড়তে পারে।

আঠারোজন ক্রুসহ ক্যাপটেন হুয়ান ম্যাকাডো, জেনারেল ব্রাভো ছেড়ে চলে এসেছে লেডি ফ্ল্যামবোরোয়, আসার আগে জাহাজটার সবগুলো সিকক আর কার্গো ডোর খুলে দিয়েছে, বাছাই করা কয়েক জায়গায় ছোট ছোট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গর্ত করা হয়েছে খোলের গায়ে। সাগরতলে তলিয়ে গেছে জেনারেল ভ্রাভো।

নতুন সূর্য নিয়ে পূর্ব আকাশ উজ্জ্বল হতে শুরু করল, নতুন চেহারা নিয়ে জেনারেল ব্রাভোর গন্তব্য অভিমুখে যাত্রা শুরু করল লেডি ফ্ল্যামবোরো। আর্জেন্টিনার সান পাবলো বন্দর যখন স্টারবোর্ড সাইডে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, বন্দরটাকে এড়িয়ে দক্ষিণ দিকেই যেতে থাকল জাহাজটা।

সাফল্যের মুখ দেখল সুলেমান আজিজের প্ল্যান। তিন দিন পেরিয়ে যাচ্ছে, দুনিয়ার মানুষ এখনও বিশ্বাস করে লেডি ফ্ল্যামবোরো আটলান্টিকের অতল তলে তলিয়ে গেছে।

চার্ট টেবিলে বসে জাহাজের সর্বশেষ পজিশন চিহ্নিত করছে সুলেমান আজিজ। চূড়ান্ত গন্তব্য পর্যন্ত লম্বা একটা রেখা টানল সে, ক্রস একে চিহ্নিত করল সেটাকে। সন্তুষ্টচিত্তে একটা সিগারেট ধরিয়ে সশব্দে ধোয়া টানল। আরও মোলো ঘণ্টা পর সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারবে সে। তখন জাহাজটাকে এমনভাবে লুকানো সম্ভব হবে যে কেউ আর সেটাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।

নাচের ভঙ্গিতে ব্রিজ থেকে চার্টরুমে এসে ঢুকল ক্যাপটেন ম্যাকাডো, হাতে একটা ট্রে। কফি চলবে তো? বিশুদ্ধ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল সে।

ধন্যবাদ, ক্যাপটেন। তারপর তার মনে পড়ল। ইয়াল্লা, পান্টা ডেল এসটে ছাড়ার পর এখনও কিছু মুখে দিইনি আমি।

আমরা জাহাজে আসার পর থেকে আপনাকে ঘুমাতেও দেখিনি।

এখনও কত কাজ বাকি।

এবার বোধ হয় আমাদের মধ্যে খোলাখুলি আলাপ হওয়া দরকার, বলল ক্যাপটেন ম্যাকাডো। আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বটা সেরে ফেললে মন্দ হয় না।

 আপনি কে আমি জানি, অন্তত জানি কি নামে ডাকা হয় আপনাকে, নির্লিপ্ত, ঠাণ্ডা সুরে বলল সুলেমান আজিজ। তার বেশি কিছু জানার দরকার আছে কি?

 আপনার প্ল্যানটা সম্পর্কে বলবেন আমাকে? জেনারেল ব্রাভোকে ডুবিয়ে দেয়ার পর লেডি ফ্ল্যামবোবোয় উঠতে হবে, এর বেশি কিছু জানানো হয়নি আমাকে। মিশনের পরবর্তী কাজ সম্পর্কে জানতে চাই আমি। বিশেষ করে জানতে চাই, আমাদের দুই জাহাজের কু কীভাবে লেডি ফ্ল্যামবোয়রা ত্যাগ করবে বা কীভাবে আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেবে।

দুঃখিত ব্যস্ত থাকায় আপনাকে জানানো হয়নি।

এখন যদি সময় করতে পারেন ভালো হয়, চাপ দিল ক্যাপটেন ম্যাকাডো।

কফির কাপে ধীরে ধীরে চুমুক দিল সুলেমান আজিজ, মুখোশ পরে থাকায় তার মুখভাব বোঝা গেল না। তারপর ম্যাকাডোর দিকে তাকাল সে। এক্ষুনি জাহাজ ছাড়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার নেতা ও আপনার নেতা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, লেডি ফ্ল্যামবোয়রাকে যতটা সম্ভব দেরি করে ধ্বংস করতে হবে, অন্তত যতক্ষণ না পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তোলার সুযোগ তারা পান।

ধীরে ধীরে শিথিল হলো ম্যাকাডোর পেশি। মুখোশ পরা সুলেমান আজিজের স্থির চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সে। ভাবল, লোকটা ইস্পাতের মতো কঠিন। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই, বলল সে। আরও কফি দেব?

খালি কাপটা ট্রের ওপর রাখল সুলেমান আজিজ। জাহাজ ডোবানো ছাড়া আর কী করেন আপনি।

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে হাত পাকিয়েছি, শান্ত সুরে বলল ম্যাকাডো। আমরা দু’জন একই পেশায় আছি, সুলেমান আজিজ। মুখোশের ভেতর ঐ জোড়া কুঁচকে উঠলেও তা দেখতে পেল না সে, তবে জানে কুঁচকে উঠেছে।

আমাকে খুন করার জন্য পাঠানো হয়েছে আপনাকে? জিজ্ঞেস করল সুলেমান আজিজ, সিগারেটের ছাই ঝাড়ার জন্য শান্তভাবে ঝুঁকল সে, পরমুহূর্তে তার হাতের তালুতে বেরিয়ে এল একটা অটোমেটিক পিস্তল।

 মুচকি হেসে বুকে হাত বাঁধল ম্যাকাডো। শান্ত হোন। আমাকে পাঠানো হয়েছে আপনার সাথে একমত হয়ে কাজ করার জন্য।

ডান আস্তিনের নিচে স্প্রিং-নিয়ন্ত্ৰিত একটা খারে ভেতর পিস্তলটা রেখে দিল সুলেমান আজিজ। আমাকে আপনি চেনেন কীভাবে?

আমাদের নেতারা নিজেদের মধ্যে প্রায় কিছুই গোপন করেন না।

আখমতের ওপর ভরসা রাখা যায় না, রাগের সাথে ভাবল সুলেমান আজিজ। তার পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে বেঈমানি করেছে সে। ম্যাকাডো যে মিথ্যে কথা বলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পথের কাঁটা নাদাভ হাসান অস্তিত্ব হারাবার পর ভাড়াটে খুনিকে আর দরকার হবে না ইয়াজিদের। উঁহু, মেক্সিকান হিটম্যান ম্যাকাডোকে তার পালানোর প্ল্যান জানতে দেবে না সুলেমান আজিজ। এটা কথা ভেবে মনে মনে সন্তুষ্ট বোধ করল সে-ম্যাকাডোকে যখন খুশি খুন করতে পারে সে, কিন্তু তাকে খুন করতে হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ম্যাকাডোকে।

সুলেমান আজিজ জানে কোথায় সে দাঁড়িয়ে আছে। কফির কাপটা ট্রে থেকে তুলে উঁচু করে ধরল সে, বলল, আখমত ইয়াজিদের সাফল্য কামনায়।

 ম্যাকাডোও নিজের কাপটা উঁচু করল। টপিটজিনের সাফল্য কামনায়।

.

তালা মারা একটা স্যুইটের ভেতর প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানের সাথে আটকে রাখা হয়েছে হে’লা কামিল আর সিনেটর পিটকে। কেউই ঘুমাতে পারছেন না। ঘাড়, পিঠ, কাঁধ আর হাত ব্যথা করছে। খিদেতে চো চো করছে পেট।

 লেডি ফ্ল্যামবোরো উরুগুয়ে ছাড়ার পর থেকে কাউকে কিছু খেতে দেয়া হয়নি। বারকয়েক উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে পানি খেয়ে এসেছেন ওরা। তাপমাত্রা দ্রুত নামতে শুরু করায় কষ্ট আরও বেড়ে গেছে ওঁদের।

পরিত্যক্ত একটা বস্তার মতো বিছানার ওপর নেতিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট হাসান। পিঠে একটা ব্যথা আগে থেকেই ছিল, একটানা দশ ঘণ্টা কায়িক পরিশ্রম করার পর সেটা অসহ্য রকম বেড়ে গেছে।

মাঝেমধ্যে নড়াচড়া না করলে হে’লা কামিল আর সিনেটর পিটকে কাঠের মূর্তি বলে ভুল হতে পারত। একটা টেবিলে বসে আছেন হে’লা কামিল, চিবুক ঠেকে আছে হাতের তালুতে। চোখে ক্লান্তি, এলোমলো চুল, কাপড় চোপড়ে ভাজ, তার পরও অদ্ভুত সুন্দর আর আশ্চর্য পবিত্র লাগছে তাকে।

 একটা কাউচে আধশোয়া ভঙ্গিতে রয়েছেন সিনেটর পিট, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সিলিংয়ের দিকে। চোখের পাতা নড়ছে দেখে বোঝা যায় বেঁচে আছেন তিনি।

যদি কিছু একটা করতে পারতাম! হেলা ফিসফিস করে বললেন।

মুখোশ আঁটা শয়তানটাকে কী মনে করেন আপনি? পাল্টা প্রশ্ন করলেন সিনেটর। সব দিকে ওর কড়া নজর। আমাদের না খাইয়ে রেখেছে, যাতে দুর্বল হয়ে পড়ি। সবাইকে এক জায়গায় রাখা হয়নি, ফলে আমরা পরামর্শ করতে পারছি না। সে বা তার আতঙ্কবাদী গ্রুপের কোনো সদস্য দুদিন ধরে আমাদের সামনে আসেনি, তারমানে বোঝাতে চেষ্টা করছে আমরা কত অসহায়।

দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে পারি, বললেন কামিল।

বাইরে অবশ্যই সশস্ত্র গার্ড আছে, চৌকাঠ মাড়ালেই গুলি খেতে হবে।

 যদি একটা লাইফবোট চুরি করতে পারি?

মাথা নাড়লেন সিনেটর।

এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শত্রুরা সংখ্যায় এখন দ্বিগুণ, মেক্সিকো কার্গো শিপের ক্রুরা হাত মিলিয়েছে আতঙ্কবাদীদের সাথে।

নতুন একটা বুদ্ধি দিলেন হেলা, যদি একটা জানালা ভাঙি, তারপর এক এক করে ফার্নিচারগুলো ফেলতে থাকি পানিতে?

ফার্নিচার কেন, বোতলে হাতে লেখা কাগজ ভরেও ফেলা যায়। কিন্তু স্রোত ওগুলোকে সকালের মধ্যে একশো কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেবে। মাথা নাড়লেন সিনেটর পিট। উদ্ধারকর্মীরা সময় মতো একটাও পাবে না।

কেউ আমাদেরকে খুঁজছে না। আমার মতো আপনিও স্বীকার করুন। দুনিয়া ভাবছে, লেডি ফ্ল্যামবোরো ডুবে গেছে, আমাদের সলিল সমাধি ঘটেছে। ইতিমধ্যে সম্ভবত খোঁজাখুঁজির পালা শেষ হয়েছে।

একজনের কথা জানি, যে হাল ছাড়বে না।

 কে? জাতিসংঘ মহাসচিব ও মিসরীয় প্রেসিডেন্ট একযোগে জানতে চাইলেন।

আমার ছেলে- ডার্ক, ছোট্ট করে বললেন সিনেটর পিট।

চেয়ার ছেড়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন হে’লা কামিল, খোঁড়াতে খোঁড়াতে খোলা জানালার সামনে চলে এলেন। সামনে ফাইবার বোর্ডের আড়াল থাকায় বাইরের দুনিয়ার কিছুই দেখতে পেলেন না। আপনি নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে খুব গর্বিত। আমিও জানি, সে ভারি সাহসী ও বুদ্ধিমান যুবক। কিন্তু মানুষ তো। তার পক্ষে আতঙ্কবাদীদের চাতুরি আঁচ করা সম্ভব নয়। হঠাৎ থেকে বোর্ডের একটা খুদে ফুটোর ভেতর তাকালেন তিনি। ওদিকে খানিকটা সাগর দেখা গেল। আরে, ব্যাপার কী, বলুন তো? বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। জাহাজের পাশ দিয়ে ওগুলো কী ভেসে যাচ্ছে?

কাউচ ছেড়ে উঠে এলেন সিনেটর। হে’লা কামিলের পাশে দাঁড়িয়ে ফুটোর ভেতর দিয়ে তাকালেন। নীল সাগরের পানিতে সাদা জিনিসগুলো দেখতে পেলেও তিনিও প্রথমে চিনতে পারলেন না। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তাই তো বলি! এত ঠাণ্ডা লাগার কারণটা বোঝা গেল। ওগুলোর বরফ। নির্ঘাত আমরা দক্ষিণ মেরুর দিকে যাচ্ছি।

সিনেটরের গায়ে ঢলে পড়লেন হে’লা কামিল, তার বুকে মুখ গুজলেন। আর কোনো আশা নেই আমাদের, হাল ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন তিনি। ওখানে আমাদের খোঁজ করার কথা ভাববে না কেউ।

.

৪৪.

কারও ধারণা ছিল না সাউন্ডার এত দ্রুত ছুটতে পারে। ইঞ্জিনের শব্দের সাথে তাল রেখে রিসার্চ শিপের ডেক কাঁপতে শুরু করল, ঢেউগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে ঝাঁকি খেল গোটা খোল। জাহাজটার চারশো হর্স পাওয়ার ডিজেল ইঞ্জিন খুব বেশি হলে চৌদ্দ নট গতিসীমায় পৌঁছাতে পারে, তবে স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্ট আর তার ক্রুরা কীভাবে কে জানে ওটার কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে সতেরো নট।

 লেডি ফ্ল্যামবোরার পেছনে একা শুধু সাউন্ডার লেগে আছে, মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলনেই চলে। আর্জেন্টিনা নেভির যুদ্ধজাহাজ আর ফকল্যান্ডে নোঙর করা ব্রিটিশ ন্যাভাল ইউনিটগুলো পলায়নরত লেডি ফ্ল্যামবোরোকে সামনে থেকে বাধা দিতে পারত, কিন্তু তাদেরকে সতর্ক করা হয়নি।

 লেডি ফ্ল্যামবোয়োকে নয়, সাগরের তলায় জেনারেল ব্রাভোকে পাওয়া গেছে, এই খবর কোড করা মেসেজের মাধ্যমে পিটের কাছ থেকে যথাসময়েই পেয়েছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। হোয়াইট হাউসে জরুরি বৈঠক হয়েছে, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ ও ইন্টেলিজেন্স চিফরা প্রেসিডেন্টকে জোরাল পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইউএস স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স না পৌঁছানো পর্যন্ত এই আবিষ্কার সম্পর্কে চুপ থাকতে হবে।

 কাজেই, রিসার্চ শিপ সাউন্ডার একাই ধাওয়া করছে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে। ওদের মধ্যে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা নেই। নাবিক, বিজ্ঞানী আর ক্রুরা প্রচণ্ড উত্তেজনায় ছটফট করছে। সবাই ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে, যেভাবেই হোক, নাগাল পেতে হবে লেডি ফ্ল্যামবোলোর।

 জাহাজের ডাইনিং রুমে রয়েছে পিট আর জিওর্দিনো। ওদের সামনে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের একটা ম্যাপ মেলে দিয়েছে রুডি গান। ম্যাপের কিনারায় কয়েকটা কফি কাপ বসানো, পিনের কাজ করছে ওগুলো।

তোমার বিশ্বাস দক্ষিণে যাচ্ছে ওরা? পিটকে জিজ্ঞেস করল রুডি।

ইউ আকৃতির একটা বাঁক নিয়ে যদি উত্তরে যেত, সার্চ গ্রিডের মধ্যে ফিরে আসত লেডি ফ্ল্যামবোরো, বলল পিট। আমরা জানি, তা আসেনি। আর পশ্চিমে ঘুরে গিয়ে আর্জেন্টিনা উপকূলের দিকে যাওয়া সম্ভব নয়।

খোলা সাগরের দিকে যেতে পারে।

তাহলে, তিন দিন এগিয়ে থাকায়, ইতিমধ্যে ওরা আফ্রিকার পথে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে গেছে, বলল জিওর্দিনো।

ওদিকে ওরা যাবে না, কারণ তাহলে খুব বেশি ঝুঁকি নিতে হয়, বলল পিট। নাটকের পরিচালক যেই হোক, তার খুলির ভেতর হলুদ পদার্থের কোনো কমতি নেই। পূর্ব দিকে ঘুরে সাগর পাড়ি দিলে শুধু সার্চ প্লেনের নয়, অন্যান্য জাহাজেরও চোখে পড়ে যাবার ভয় আছে। উঁহু, সন্দেহ এড়াবার একমাত্র উপায় তার, জেনারেল ব্রাভোর পথে থাকা।

কিন্তু জাহাজ পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে দেখলে সান পাবলোর বন্দর কর্তৃপক্ষ খবরটা ছড়িয়ে দেবে না?

লোকটাকে ছোট করে দেখোনা। বাজি ধরতে পারি, সান পাবলোর বন্দর মাস্টারকে জানানো হয়েছে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পৌঁছাতে দেরি হবে জেনারেল ব্রাভোর।

আমি বিশ্বাস করি, বলল রুডি। অনায়াসে আরও আটচলিত্মশ ঘণ্টা হাতে পেতে পারে সে।

 বেশ, মেনে নেয়ার সুরে বলল জিওর্দিনো। বাকি থাকল কী? কোথায় যেতে পারে সে? ওদিকে জনবসতিহীন হাজারখানেক দ্বীপ আছে, কোথায় তাকে খুঁজব আমরা?

অথবা…, শব্দটা উচ্চারণ করার পর কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিল রুডি, তারপর বলল, অথবা অ্যান্টার্কটিকের দিতে যেতে পারে সে। তার হয়তো ধারণা ওখানে কেউ তাকে খুঁজবে না।

 এমন হতে পারে, এরই মধ্যে কোনো পরিত্যক্ত খাড়িতে ঢুকে নোঙর ফেলেছে লেডি ফ্ল্যামবোরো, বলল পিট।

আমরা তার চালাকি ধরে ফেলেছি, বলল জিওর্দিনো। পরের বার পাশ কাটানোর সময় ল্যান্ডস্যাট ক্যামেরা চালু থাকবে-লেডি ফ্ল্যামবোয়রীর ওরফে জেনারেল ব্রাভো ধরা পড়তে বাধ্য।

পিটের মন্তব্য শোনার আশায় ঘাড় ফেরাল রুডি গান, কিন্তু সিলিংয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল পিট। এই মুহূর্তে সাউন্ডারে নেই ও, চলে গেছে লেডি ফ্ল্যামবোরোর ব্রিজে, আতঙ্কবাদী লিভারের মাথার ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। কাজটা সহজ নয়। ভিআইপি প্যাসেঞ্জারসহ একটা প্রমোদতরীকে হাইজ্যাক করার তিন দিন পরও যে লোক সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারছে, তাকে পিট নিজের যোগ্য প্রতিযোগী বলে মেনে নিল। শত্রু হলেও, লোকটার প্রতি শ্রদ্ধা জাগল মনে। মৃদুকণ্ঠে মন্তব্য করল পিট,

লোকটা জানে।

 কী জানে? রুডি জিজ্ঞেস করল, প্রসঙ্গটা ভুলে গেছে সে।

স্যাটেলাইট ফটোতে তাকে ধরা হবে।

তার মানে সে জানে সে ছুটতে পারে, কিন্তু লুকাতে পারে না।

আমার ধারণা, লুকোতেও পারে।

 কীভাবে জানতে পারলে খুশি হতাম, হাসিমাখা ব্যঙ্গের সাথে বলল রুডি।

চেয়ার ছাড়ল পিট। আড়মোড়া ভাঙল। হাত-পায়ে মরচে ধরে গেল, যাই, খানিক হাঁটাহাঁটি করে আসি।

তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি, উত্তেজনার অস্থির হয়ে উঠেছে রুডি।

টলে উঠল পিট, টেবিল ধরে জাহাজের ঝাঁকিটা সামলে নিল, তারপর রুডির দিকে ফিরে মুচকি একটু হাসল। লোকটার জায়গায় আমি হলে, যেন এমন এক লোক সম্পর্কে কথা বলছে যাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে ও, জাহাজটাকে দ্বিতীয়বার গায়েব করে দিতাম।

হাঁ হয়ে গেল রুডি গান। নিঃশব্দে, চেহারায় সবজান্তার ভাব নিয়ে, ওপর নিচে মাথা দোলাল জিওর্দিনো। ওরা কেউ কিছু বলার আগেই ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল পিট।

 জাহাজের সামনের দিকে চলে এসে মই বেয়ে মুন পুলে নামল ও। ডিপ রোভারের চারপাশে হাঁটল, থামল সাগরের তলা থেকে তুলে আনা প্লাস্টিক শিটের সামনে দড়ির সাথে ক্লিপ দিয়ে খাড়াভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের টুকরোটাকে, লম্বায় পিটের প্রায় সমান হবে। ঝাড়া মিনিট পাঁচেক জিনিসটা দেখল ও, একবার হাত বুলালো। ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ওর চেহারা, যেন গোপন কী একটা জেনে ফেলেছে।

পেয়েছি!

ফিসফিস করে বলল ও, কয়েক মিটার দূরে ওঅর্ক বেঞ্চের সামনে দাঁড়ানো প্রকৌশলী লোকটাও শুনতে পেল না ওর কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *