ইতিমিচি সাহেব – ২

ছেলেটি যেন এই কথায় কষ্ট পেল। সে বলল, ‘ওকথা কেন বলছেন? আমি জানি আপনার সব কথা সত্যি। আজগুবি কথাকে বানিয়ে-বানিয়ে সত্যি বলে চালিয়ে দেওয়া খুব সোজা। তবুও সেটা আজগুবি। কিন্তু সত্যিকথাকে আজগুবি বলে চালালেও সেটা কোনোদিনই মিথ্যে হয় না।’

ছেলেটির মুখে এ-কথা শুনে তাঁর চোখ ছলছল করল। অবশ্য ছেলেটি তা দেখতে পেল না। কারণ সে তো পিঠের ওপর বসে আছে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন। বললেন, ‘তবে বলি/’

ছেলেটি বলল, ‘হ্যাঁ বলুন।

‘তারপর একদিন আমাদের দেশে যুদ্ধ এল। কতদিন ধরে শুনে আসছি, শত্রুরা আমাদের দেশ আক্রমণ করবে। কিন্তু যুদ্ধ যে কী, আমি তা জানতুম না। জানার মতো আমার তো তখন বয়েস হয়নি। কিন্তু একদিন গভীর রাত্রে ঝাঁকে-ঝাঁকে শত্রুপক্ষের উড়োজাহাজ উড়ে এল। আমি দেখলুম আকাশ থেকে মাটিতে বোমা পড়ছে বুক-কাঁপিয়ে। আগুন জ্বলে উঠেছে চারিদিকে। আমি শুনতে পেলুম অসংখ্য মানুষের চিৎকার, কান্না। আমি দেখতে পেলুম, ভীষণ আতঙ্কে আমার বাবা-মা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। তারা আমাকে বাঁচাতে চায়। তারপর শুনতে পেলুম, সেই পাকাধানের খেতের ওপর দিয়ে মেশিনগানে গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে ঘড়ঘড় করে দানবের মতো ট্যাংক ছুটে আসছে। আমার বাবা আমার মা আমাকে নিয়ে ছুটল। তারা ভুলে গেল, আকাশের ওই উড়ন্ত দানবগুলোর কোনো দয়া নেই। তারা শুধু ছিনিয়ে নিতে পারে প্রাণ। নিরীহ মানুষের শেষ সম্বল।

‘অনেকটা ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল আমার বাবা। আমার মা-ও। হাঁপাচ্ছে তারা। কী করবে তারা ভেবে পাচ্ছে না। দানবের কালো হাত এক্ষুনি হয়তো গুঁড়িয়ে ফেলবে আমাদের। সেই আতঙ্কে শিউরে উঠছে তারা। আমার মা শিয়রে হাত দিল। তারপর কেঁদে ফেলল।

 বাবা চাপা-গলায় বললে, ‘আঃ/ এখন কান্নার সময় নয়। বিপদের সময় বল-ভরসা হারালে ছেলেকে বাঁচাব কেমন করে? এসো, যতক্ষণ পারি ছুটে চলি।’ বলে, বাবা এক হাতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, আর এক হাত মায়ের হাতে রেখে আবার ছুটল

‘এবার আমি নিশ্চিত দেখতে পেলুম, ওই যুদ্ধদানবগুলো আকাশে অনেকখানি গোল হয়ে ঘিরে-ঘিরে বোমা ফেলছে। আমাদের পালাবার আর পথ নেই। সামনের ধানখেতের মধ্যে আমাকে আড়াল করে আমার আমার-বাবা লুকিয়ে পড়ল। বাঁচার শেষ চেষ্টা।

‘কিন্তু হঠাৎই বোমার শব্দ থেমে গেল। মনে হল, আকাশের ওই দানবগুলো বোধ হয় নিস্তার দিল কিছুক্ষণের জন্যে। তখন সেই ধানখেতের জলকাদা ডিঙিয়ে বেরিয়ে এলুম আমরা। আর একটু এগিয়ে গেলে, মনে হয় যেন একটা উঁচু জমিতে আমরা দাঁড়াতে পারব। অনেকটা লুকিয়ে-ছাপিয়ে আমরা সেইদিকেই এগিয়ে গেলুম। পৌঁছেও গেছি। সামনে একটা গর্ত দেখা গেল। বাবা তাড়াতাড়ি সেই গর্তের মধ্যে আমায় লুকিয়ে ফেলল। তারপর সেই গর্তের পাশে নিজেরা মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে লুটিয়ে রইল।

‘আমিও ভয়ে বোবা হয়ে গেছি। এই ভীষণ অন্ধকার গর্তটার মধ্যে বসে থাকতে-থাকতে যেন আমার দম আটকে আসছিল। আমি ডাকলুম, ‘মা।’

‘কী বলছ বাবা?’ মা চুপিসারে জিজ্ঞেস করল।

আমি বললুম, ‘আমার কাছে এসো।’

মা বলল, ‘এই তো বাবা, কাছেই আছি।’

আমি বললুম, ‘এখানে ভীষণ অন্ধকার।’

বাবা হাত বাড়িয়ে আমার মাথাটা ছুঁয়ে বলল, ‘ভয় কোরো না বাবা। আমরা এখানেই আছি।’

‘আমি চুপটি করে গর্তের মধ্যেই বসে রইলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লুম জানি না।

কী ঘুম যে পেয়েছিল আমার/ যখন জেগে উঠলুম, তখন রোদ উঠে গেছে। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লুম। দাঁড়ালুম। মুখ বাড়ালুম। তারপর শিউরে উঠলুম। এ কী/ আমার মা, বাবা কাউকে দেখছি না তো/ কোথা গেল তারা? আমি চিৎকার করে লাফ মারলুম গর্তের ভেতর থেকে বাইরে। দেখতে পেলুম, গর্তের বাইরে এবড়ো-খেবড়ো জুতোর ছাপ। দেখতে পেলুম, খালি পায়ের চিহ্ন আর ধস্তাধস্তির খাবলা-ওঠা মাটি। আমি বুঝতে পারলুম আমার মা-বাবার কী হয়েছে/ বুঝতে পারলুম, ওই যুদ্ধ-পিশাচগুলোর শিকার হয়েছে। তারা। আমি দিশেহারা হয়ে ছুটলুম। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলুম আর কেঁদে উঠলুম, ‘মা-মা আ/ বাবা-আ-আ/’

‘আমি খুঁজে পেলুম না তাদের। আমি অনেকদিন ধরে তাদের খুঁজে বেড়ালুম। কতদিন, তা বলতে পারব না। তারপর আমি নিজেই একদিন হারিয়ে গেলুম

 ‘একদিন হঠাৎ-ই এক ভদ্রলোকের নজরে পড়ে গেলুম। হয়তো আমার চেহারা দেখে, অথবা আমায় রাস্তার ছেলের মতো একা-একা ঘুরতে দেখে তাঁর দয়া হল। লোকটি অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলেন আমাকে। শেষমেশ লোকটি আমার কাছে এলেন। ভদ্রলোকটিকে কাছ থেকে দেখে মনে হল বেশ কেতাদুরস্ত। বয়সে যে খুব বেশি, তা মনে হল না। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম ছাড়া আমি আর কিছুই বলতে পারলুম না। লোকটি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোকে কাজ দেব।

‘আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী কাজ?’

 ‘তিনি বললেন, ‘জাহাজের কাজ?

 ‘আমি চমকে তাঁর মুখের দিকে তাকালুম।’

 ‘তিনি বললেন, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? হ্যাঁ রে, আমার অনেক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ আছে। আমি তো গোল্ড মার্চেন্ট, মানে সোনার ব্যবসায়ী। ব্যবসার জন্যে আমায় প্রায় জাহাজে চেপে দেশ-বিদেশে যেতে হয়। সেই কারণেই আলাপ আর কি/’

‘জাহাজের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। জাহাজ, সমুদ্র, দিনের পর দিন ভেসে চলা সবই কেমন যেন রোমাঞ্চে-ভরা রহস্যময়। আমি সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে বললুম, ‘ঠিক আছে।’

‘তখন তিনি বললেন, ‘বেশ তাহলে চ আমার সঙ্গে। কালই আমি জাহাজে চেপে আর এক দেশে যাব। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তোর পরিচয় করে দেব।’

পরের দিন সত্যিই আমি জাহাজে চাপলুম। আশ্চর্য কথা এই, আমি যখন জাহাজের ভেতরে ঢুকলুম, দেখলুম কী বিরাট সেই জাহাজ। নীচে ইঞ্জিন চলছে, কত বড়ো বড়ো মেশিন। ওপরে কত থাকবার কেবিন, ডেক। একেবারে এলাহি কাণ্ড। কিন্তু ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে যখন সমুদ্রের দিকে তাকালুম, তখন মনে হল, এই অনন্ত সমুদ্রের বুকে এই বিরাট জাহাজটা যেন একটা খড় কিংবা কুটো। জাহাজের একটা কেবিনে ছিলেন সেই সোনার ব্যবসায়ী। আমি অবশ্য ছিলুম ডেকে। ব্যবসাদার বলেই বোধ হয় তাঁর কেবিনটাও ছিল ভারী ছিমছাম। ডেকে তো আমি একা নই, আরও কত লোক। আমি ছোটো বলে আমাকে কেউ কেয়ারই করত না। তাই আমি বড়ো একা। আমি অবাক হয়ে যাই, অত যাত্রীর কেউ একজনও এসে আমার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। নাই করুক। আমার একা-একা এই সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকতে খুব ভালো লাগত। ভেসে চলে জাহাজ। আর নতুন অচেনা দেশের কথা ভেবে আমার মনে দোলা লাগে।’

এই পর্যন্ত বলে ইতিমিচিসাহেব থামলেন। তাঁর পিঠের ওপর ছোট্ট বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?’

 ছেলেটি বলল, ‘না, না, ঘুমুব কেন? শুনছি। বলুন/’

ইতিমিচিসাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সেই সোনার ব্যবসায়ী দিনে অন্তত পাঁচ-সাতবার আমায় তাঁর কেবিনে ডাক দিতেন। এটা-ওটা কত কথা বলতেন। বোধ হয় দেখতেন আমার মনখারাপ লাগছে কি না। তাই মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করতেন, কী রে, কেমন লাগছে?’ যেহেতু আমার খারাপ লাগছে না, সেইকারণে আমার খারাপ লাগছে এ-কথা তো বলতে পারি না

‘কথা ছিল, সোনার ব্যবসায়ী ভদ্রলোক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে একটি কাজ জুটিয়ে দেবেন। কিন্তু এখনও তিনি তা করেননি। ইতিমধ্যে একদিন আমাদের জাহাজ এক নতুন পোর্টে এসে ভিড়ল। সেই পোর্ট থেকে আর এক ভদ্রলোক উঠলেন। এবং তিনি সোজা ওই সোনার ব্যবসায়ীর কেবিনে ঢুকে কী যে কথাবার্তা শুরু করলেন, আমি জানি না।

‘সেই নতুন ভদ্রলোকটি আসার পর আরও তিনদিন কেটে গেল। অবশ্য ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমার তেমন আলাপ না-হলেও প্রায়ই দেখতুম তিনি আমায় দূর থেকে লক্ষ করছেন। এমন সময় হঠাৎ একদিন আমার ডাক পড়ল সেই সোনার ব্যবসায়ীর কেবিনে। এ আর এমন কী কথা/ ডাক তো রোজই পড়ে। আজ কিন্তু তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি, তিনি একা নন, সেই নতুন ভদ্রলোকটিও রয়েছেন। ঘরে ঢুকতেই সেই সোনার ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি বললেন, ‘শোনো ইতিমিচি, আমি তোমাকে জাহাজের যে-ক্যাপ্টেনের কথা বলেছিলুম, ইনিই সেই ক্যাপ্টেন। তোমার কাজ পাকা হয়ে গেছে। তুমি কালই ওঁর সঙ্গে চলে যাবে। কাল ভোরবেলাতেই জাহাজ নতুন পোর্টে পৌঁছুবে। উনি তোমাকে নিয়ে যাবেন। ঠিক আছে?’

‘আমি ঘাড় নাড়লুম। সেই ভদ্রলোকটির দিকে তাকালুম। এতদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দূর থেকে চোখাচোখি হয়েছে। আজ একেবারে কাছ থেকে দেখলুম। আমার কেমন ভালো লাগল না ভদ্রলোকটিকে।

‘সোনার ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমি কথা শেষ করে বেরিয়ে এলুম। বেরিয়ে আসতেই তিনি কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এখন কেবিনের মধ্যে তিনি আর সেই নতুন ভদ্রলোকটি। যাকে আমি জেনেছি জাহাজের ক্যাপ্টেন বলে। হয়তো দুজনের মধ্যে এখন কিছু গোপন কথাবার্তা হবে। কিন্তু কী সে-কথা/ আমাকে নিয়েই কি? আকাশ-পাতাল কিছুই ভেবে পেলুম না। ঠিক একদিন আগে এরকম একটা সন্দেহজনক ঘটনা আমার যেন সব কিছু গোলমাল করে দিল। যেতে-যেতে আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম। লোকটা কি সত্যিই জাহাজের ক্যাপ্টেন, না, অন্য কেউ? তাকে আর একবার দেখার জন্যে আমার মনটা ছটফট করে উঠল। তাকে অন্তত আর একবার চোখের দেখা দেখতে পেলেও মনটা শান্ত হয়। সুতরাং আর অন্য কিছু না-ভেবে, সোনার ব্যবসায়ী সেই ভদ্রলোকের কেবিনের দরজায় ঠেলা দিলুম। কিন্তু দরজা খুলল না। ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমার কানে এল, দুজনে ভেতরে তখন অস্পষ্ট স্বরে ফিসফিস করে কথা বলাবলি করছে। আমার তখনই ঝট করে মাথায় এল, কী কথা হচ্ছে, শুনলে তো হয়/ আমি কৌতূহল সামলাতে পারলুম না। কেবিনের দরজায় কান ঠেকালুম। এতক্ষণ যে-কথাগুলো খুবই অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল, কানে আড়ি পাততেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি শুনতে পেলুম সেই সোনার ব্যবসায়ী এবং অন্য লোকটির আলোচনা।

 ‘সোনার ব্যবসায়ী লোকটির গলা, ‘দেখুন, আমাদের সমস্ত কাজ খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।’

 ‘অন্য লোকটি উত্তর দিল, ‘আমি স্যার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

‘ছেলেটি আমার পরিচয় জানে, আমি একজন সোনার ব্যবসায়ী বলে। ঘুণাক্ষরে না-জানতে পারে আমরা ডাকাত।’

‘সে জানার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

 ‘কাল পোর্টে জাহাজ ভেড়ার পর একদম সময় নষ্ট করবেন না। ছেলেটিকে নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে জাহাজ ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন।

‘স্যার, যদি শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে যেতে না চায়?’

 ‘ভয় নেই। আমি এতদিন যা দেখেছি, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, ছেলেটি ধূর্ত নয়।’

‘আমারও তাই মনে হয়েছে।’

‘আপনি পোর্ট থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে সিধে রেল স্টেশনে হাজির হবেন। আপনি জানেন, সেখান থেকে সকাল আটটা নাগাদ একটা ট্রেন ছাড়ে। সম্ভবত তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে। তবু আপনি সঠিক সময় আর প্ল্যাটফর্ম নম্বরটা একবার চেক করে নেবেন। আমাদের গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছুলে ছেলেটি একটু ভয় পেতে পারে। কারণ চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলে-ঘেরা এই জায়গাটা দেখলে ছোটোদের ভয় পাওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। সময় নেবেন না। স্টেশনে পৌঁছেই জঙ্গলে ঢুকে পড়বেন। ওখান থেকে আমাদের আস্তানা যাবার সোজা পথটা কখনোই ধরবেন না। পথটা চিনে ফেললে, ভবিষ্যতে পালাতে পারে। আস্তানায় পৌঁছাবার আগে জঙ্গলে হাঁটতে-হাঁটতে ও আপনাকে হাজারটা প্রশ্ন করতে পারে। এমনও হতে পারে ছেলেটি জঙ্গলে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। ওকে সব সময় বলবেন, আপনি জাহাজের ক্যাপ্টেন। বলবেন, সমুদ্রের জাহাজে চাকরি করতে গেলে, জঙ্গলে ট্রেনিং নিতে হয়।’

ঠিক এই সময় সেই নতুন লোকটি একটু সন্দিহান গলায় বলল, ‘যদি স্যার এ-কথাটা বিশ্বাস না করে? যদি জিজ্ঞেস করে জাহাজ তো জলে ভাসে, ট্রেনিংটা জঙ্গলে কেন?’

 ‘সোনার ব্যবসায়ী হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আরে মশাই ছোটোদের ছেলেমানুষ বলে কি এই বড়োমানুষি প্রশ্ন করবে বলে?

‘অন্যজন বলল, ‘তা অবশ্য ঠিক।’

 ‘তবে যদি ছেলেটি একান্তই বেঁকে বসে, তবে এই নিন, এই পিস্তলটা। আপনার কাছে রাখুন। মনে হয় না দরকার লাগবে, তবু তৈরি থাকাই ভালো। আমার এই ছেলেধরার উদ্দেশ্যটা আজ আর আপনার কাছে গোপন রাখব না। যেহেতু আপনি আমার ঘনিষ্ঠ অনুচর। আমার উদ্দেশ্য এইসব ছোটোদের খুব কম বয়সে ধরে নিয়ে গিয়ে ডাকাত তৈরি করা। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এরা যখন পাকা ডাকু হয়ে উঠবে, তখন আমাদের দল হবে ভারী। আর আমাদের কাজও তখন হবে হালকা। এই ডাকুদলকে কাজে লাগিয়ে আমরা আরামে আর নিরাপদে দিন কাটাতে পারব। ওরা ডাকাতি করবে, আর আমরা ওদের ওপর করব সর্দারি। আমাদের জীবনের ভয় কমবে, অথচ বাড়বে অর্থ। ছেলেটি যেন ঘুণাক্ষরেও টের না-পায় আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদের জঙ্গলের আস্তানায় পৌঁছেই, ও সব কিছু আঁচ করার আগেই, ওকে অন্ধকার ঘরটায় বন্দি করে ফেলবেন। তারপর যা করার আমি গিয়ে করব। আমার যেতে হয়তো দু-চারদিন দেরি হবে। কারণ এ-কদিন আরও কজন ছেলেকে ধরে আমাদের আস্তানায় চালান করার জন্যে আমি বিশেষ ব্যস্ত থাকব। সুতরাং যতদিন না আমি যাই, ততদিন খুব সাবধান। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে স্যার।’

 ‘আমি ভীষণ ভয়ে আঁতকে উঠলুম। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, আমার পায়ের থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। হঠাৎ কেবিনের দরজা খোলার শব্দ আমাকে সজাগ করে দিল। আমি চকিতে লুকিয়ে পড়লুম কেবিনের আড়ালে। আমি কাঁপছি। লোকটা বেরিয়ে চলে গেল। আমার দৃষ্টি তার মুখের দিকে নয়, তার প্যান্টের পকেটে। কেননা, আমার মনে হয়েছিল পিস্তলটা প্যান্টের পকেটে রাখা ছাড়া, এখন সে অন্য কোথাও রাখতে পারে না। বুঝতে পারলুম, সোনার ব্যবসা করার মিথ্যে পরিচয় দিয়ে লোকটা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটা ডাকাত। এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলুম, আমি ভয়ংকরের কবলে পড়েছি। লোকটার ওপর আমার যেমন ঘৃণা হল, তেমনি রাগ। রাগে বুকের ভেতরটা আমার ফুঁসতে লাগল। আমি ঠিক করলুম আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ধরে আনার আমি প্রতিশোধ নেব এবং আজই। সুতরাং আমার ওই পিস্তলটা চাই।

‘চাই বললেই তো আর আমার হাতে সেটি কেউ তুলে দিচ্ছে না। আমাকে সেটি ছিনিয়ে নিতে হবে। আমি ছেলেমানুষ বলে অবিশ্যি একটা বিশেষ সুবিধা আছে। এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করলেও চট করে কেউ সন্দেহ করে না। সেই সুযোগটাই আমায় কাজে লাগাতে হবে। মনে-মনে মতলব আঁটলুম ওই লোকটার সঙ্গে আলাপ করতে হবে এবং ফাঁক বুঝে পিস্তলটা গাপ করতে হবে। এই ভেবেই আমি কেবিনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে, আমার রাগ আর ভয় দুটোকেই মুখ থেকে মুছে ফেললুম। দিব্যি সহজ হয়ে ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলুম।’

আবার ইতিমিচিসাহেব থামলেন।

ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘থামলেন কেন?

 ‘বোধ হয় তোর ভয় করছে, ইতিমিচিসাহেব উত্তর দিলেন।

 ‘ভয় করবে কেন?’

মনে হচ্ছে।’

‘ধ্যাত/ আপনি বলুন তো/’।

ইতিমিচিসাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এখন উঠতে-বসতে আমার ভাবনা পিস্তলটা হাতাব কেমন করে/ অনেক ভেবে ঠিক করলুম, যার কাছে পিস্তলটা আছে, তার কেবিনেই আমি যাব। তার সঙ্গে আলাপ করব। সেই তর্কে সে পিস্তলটা কোথায় রেখেছে সেটারও হদিস করে নেব। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। আমি ছুটলুম তার কেবিনে।

‘কেবিনের বাইরে হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে ভদ্রলোক যেন একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর চোখের পলকে নিজেকে সামলে নিল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যালো, এসো, এসো।’

‘আমিও ঠোঁটে হাসি টেনে বললুম, ‘এসে পড়লুম। সারাদিন একা তো। আপনার কাছে গল্প শুনতে এলুম। আপনি তো জাহাজে চেপে অনেক দেশ ঘুরেছেন।’

‘তা ঘুরেছি। তবে তোমাকে বলার মতো আমার গল্প তেমন জানা নেই।’

 ‘একটাও না?’ আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘সমুদ্র, জাহাজ?’

 ‘জাহাজ সমুদ্র/’ সে যেন তোতলাতে লাগল।

 ‘আমি বললুম, ‘আপনি জাহাজের ক্যাপ্টেন অথচ সমুদ্রের গল্প জানেন না?’

‘সে চট করে কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি কিছু গল্প জান না?’

‘আমি উত্তর দিলুম, ‘আমি ম্যাজিক জানি।’

 ম্যাজিক/’ লোকটা যেন অবাক হয়ে গেল।

 ‘হ্যাঁ।’

 ‘একটা দেখাবে নাকি?’ সে জিজ্ঞেস করল।

 ‘আপনার পকেটে একটা টাকা হবে? একটা টাকার ম্যাজিক দেখাব।’

 ‘লোকটা বলল, ‘দেখছি আছে নাকি।’ বলে লোকটা প্যান্টের পকেটে হাত পুরল। এবং যে-পকেটে পিস্তলটা ছিল, সেই পকেটটাই হাতড়াতে লাগল। আমি পিস্তলটা দেখতে না পেলেও বুঝতে পেরেছি, এই পকেটেই সেটি আছে। আমি হুট করে বলে বসলুম, ‘কী আছে আপনার পকেটে?’

‘লোকটা থতমত খেয়ে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল। তারপর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? কেন?’

‘দেখছি পকেটটা ঝুলে আছে। মনে হয় কোনো ভারী জিনিস পকেটে রেখেছেন। এক্ষুনি ছিঁড়ে যাবে।’

‘লোকটা বলল, ‘না, তেমন কিছু না।’ বলেই সে দু-পকেটের দু-পাশটা একটু নেড়েচেড়ে বলল, ‘না, টাকা নেই। কটা খুচরো পয়সা পড়ে আছে।’

‘আমি বললুম, ‘তাহলে আর কী করা?’ বলে আমি আর কথা না-বাড়িয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলুম। এবং এখন আমি নিশ্চিত যে, পিস্তলটা প্যান্টের পকেটেই আছে।

‘আমার ছটফটানি কমল না। কিন্তু পিস্তলটা যে কেমন করে হাতানো যায় সেটা আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। আমি জানি, এরপর লোকটা পিস্তলটা পকেট থেকে বার করে তার স্যুটকেসের মধ্যে লুকিয়ে ফেলবে। তখন মুশকিল। অবশ্য তখন স্যুটকেসটা হাতাতে পারলেও কাজ হয়। তখনই আমার মনে হল, এ কাজটা করতে গেলে আমায় গভীর রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। তখন লোকটা ঘুমিয়ে পড়বে, আমিও সহজে কাজটা হাসিল করতে পারব। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা সমস্যার কথা আমার মনে উঁকি দিয়ে উঠল, লোকটা রাতে যখন শোবে তখন তো সে কেবিনে দরজা এঁটেই শোবে/ ঢুকব কেমন করে?

‘এই কথাটা মনে হতেই, সঙ্গে-সঙ্গে একটা মতলব আমার মাথায় এসে গেল। আমি আবার ছুটে গেলুম সেই লোকটার কাছে। দেখলুম, সে তখন কাগজ-কলম নিয়ে কী লিখছে। আমায় দেখে লেখা থামিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলে, কী ব্যাপার? আবার?’

‘আমি বললুম, ‘আপনাকে একটা কথা বলতে এলুম।’

‘কী কথা?’।

কাল তো ভোরবেলাতেই আমরা পোর্টে পৌঁছে যাব?’

‘হ্যাঁ, সকাল ছটা।’

‘এখন থেকে তো আমিই আপনার সঙ্গী।

‘সে যেন আমায় একটু মিথ্যে তারিফ করেই বলল, ‘সঙ্গীটি আমার খুবই ভালো।’

‘কী করে বুঝলেন?’।

‘যে-সঙ্গীকে ভালো লাগছে, তাকে খারাপ বলি কেমন করে?’

আমিও সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিলুম, ‘আমারও খুব ভালো লাগছে আপনাকে।

 ‘তাই নাকি?’

‘আজ রাতটা আপনার কেবিনেই আপনার সঙ্গে থাকব। গল্প শুনব।’

‘লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল আমার এই প্রস্তাবে। আমার মুখের দিকে চট করে তার চোখদুটো বুলিয়ে নিয়ে বললে, ‘গল্প শুনবে?’

হ্যাঁ, যতক্ষণ ঘুম না-আসে।’

 ‘ঠিক আছে।’ সে সায় দিল।

 ‘সে এত সহজে রাজি হয়ে গেল দেখে, আনন্দে আমার হাত-পাগুলো কেমন যেন শিরশির করে উঠল। আমি বললুম, ‘আমার তাহলে জিনিসপত্তরগুলো এখানে নিয়ে আসি?’।

‘লোকটার মনে ইচ্ছে না-থাকলেও, আমার কাছে সেই অনিচ্ছা লুকিয়ে রেখে খুব সহজভাবেই বলল, ‘হ্যাঁ, নিয়ে এসো।’

‘আমি ছুটলুম এবং আমার সম্পত্তি বলতে দু-একটা যা জামা-প্যান্ট ছিল, নিয়ে চলে এলুম। কিন্তু আসল ব্যাপারটাই এতক্ষণ আমার মনে আসেনি। আমি যদি পিস্তলটা তার প্যান্টের পকেটে না পাই, যদি সেটা স্যুটকেসেই রাখে, তবে সুটকেসটা নিয়ে আমি যাব কোথায়/ এই জাহাজেই তো আমায় থাকতে হবে/ স্যুটকেসটা চাবি দেওয়া থাকলে, সেটা ভেঙে পিস্তলটা বার করতে গেলে সময় তো লাগবেই। তখন যদি ধরা পড়ি/ সুতরাং এই জাহাজেই এমন একটা জায়গা খুঁজে রাখতে হবে, যেখানে আমি লুকিয়ে থাকতে পারব। এই উদ্দেশ্যে তখনই আমি জাহাজের এ-কোণ, ও-কোণ ঘোরাঘুরি করতে লাগলুম। এ তো খুবই স্বাভাবিক যে, আমাকে এভাবে ঘুরতে দেখলে লোকে সন্দেহ করবেই। সুতরাং আমি যতদূর সম্ভব, সেই লুকিয়ে থাকার গোপন জায়গাটা খুঁজতে-খুঁজতে এর-তার সঙ্গে কথা বলে আমার মতলবটা গোপন রাখার চেষ্টা করলুম। কিন্তু এত করেও একটা লুকিয়ে থাকার মতো জায়গা আমি পছন্দ করতে পারছি না। হঠাৎ আমার খেয়াল হল, কদিন আগে, জাহাজের গায়ে একটা খুব মোটা চেন ঝুলে থাকতে দেখেছি। ওই চেনটা জাহাজের নোঙর করার সময় কাজে লাগায় ওরা। আমার মনে হল, বিপদে পড়লে, জলের ওপর জাহাজের গায়ে ঝুলে থাকা ওই চেনটা ধরে আমিও ঝুলে-ঝুলে লুকিয়ে থাকতে পারব। আমায় কেউ দেখতে পাবে না। তারপর জাহাজ পোর্টে ভেড়বার আগেই আমি জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাতে পারব।

সমস্ত ব্যবস্থা ঠিকঠাক রেখে আমি রাতে লোকটার কেবিনেই শুয়ে পড়লুম। সত্যি কথা বলতে কী, লোকটার সঙ্গে গল্প করার মতো আমার মনের অবস্থা তখন মোটেই ছিল না। আমি ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে ভাবছিলুম, লোকটা কখন ঘুমুবে/ যখন দেখলুম, সে কিছুতেই ঘুমুচ্ছে না, তখন আমি নিজেই ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে রইলুম। দেখি, খানিক বাদে লোকটা সত্যি-সত্যিই নাক ডাকাতে শুরু করে দিল। আমি নিঃশব্দে উঠে পড়লুম। অত্যন্ত সতর্ক হাতে কেবিনের দরজাটা খুলে রাখলুম। কারণ লোকটার যদি অতর্কিতে ঘুম ভেঙে যায়, আমার পালাবার পথটা তো পরিষ্কার রাখতে হবে/ লোকটা তার প্যান্টটা কোথায় খুলে রেখেছে, সেটা আমি আগেই দেখে রেখেছি। সুতরাং প্রথমেই আমি নিঃসাড়ে, তার প্যান্টের পকেটেই হাত পুরে দিলুম। যাঃ/ আমি যেটা ভয় করছিলুম ঠিক তাই হল, পিস্তল পকেটে নেই। এখন যে সেটা স্যুটকেসেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আর কার সন্দেহ থাকে/ আমি স্যুটকেসটাই হাতে নিয়ে ধীর পায়ে ডিঙি মেরে কেবিনের দরজা ডিঙিয়ে পালাতে গেছি, আর ঠিক সেই সময়েই আচমকা চিৎকার, ‘হলট’। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুকের ভেতরটা চমকে ধক করে উঠল। ঝটপট পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখি, লোকটা আমার পেছনে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিশ্চল হয়ে থমকে রইলুম। লোকটা যে মোটেই ঘুমোয়নি, নিজের কাছে পিস্তলটা রেখে আমার ওপর যে সে নজর রাখছিল, এখন সেটা বুঝতে আমার কোনো কষ্ট হল না। আমি আরও বুঝতে পারলুম, বড়োদের বুদ্ধির কাছে, আমি সত্যিই ছেলেমানুষ/ ধরা তো পড়েই গেছি/ সুতরাং ভয় পেয়ে আর লাভ কী/ বাঁচা-মরার ভাবনা না ভেবে, অন্য ভাবনা আমার মাথায় এসে গেল ঠিক তক্ষুনি। লোকটা চোখের পলক ফেলার আগেই, আমিই স্যুটকেসটা ধাঁই করে ছুঁড়ে দিলুম লোকটার মুখের ওপর। ছুঁড়ে দিয়েই কেবিন থেকে দে-ছুট/ গভীর রাত বলে সবাই ঘুমুচ্ছে। কিন্তু জাহাজ সে তো থেমে নেই। সে তো যথারীতি গভীর সমুদ্রে ঢেউ তুলে দ্রুত ভেসে চলেছে। লোকটা প্রথম চোটের ধাক্কাটা সামলেই বেরিয়ে এসেছে। আবার চিৎকার করে উঠল, ‘হলট।’ তখন কে আর তার কথার ধার ধারে। আমি থামলুম না। তার পিস্তল থেকে গুলি ছুটল, দুম/ লক্ষ্য তার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য তার সফল হয়েছে। তার চিৎকারে আর পিস্তলের আওয়াজে ঘুমন্ত সেই জাহাজটা হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। শুরু হয়ে গেল, হইচই, হুল্লোড়/ আমি কোনোরকমে সকলের চোখকে ধুলো দিয়ে যেকানে জাহাজর চেনটা ঝুলছে সেই জায়গাটায় এসে পড়লুম। তারপর ঝটপট সেই মোটা চেনটা ধরে, তরতর করে জাহাজের কিনারায় পা দিয়ে ঝুলে পড়লুম বাইরে, গভীর সমুদ্রের জলের ঠিক ওপরে। আমি এখন মৃত্যুর মুখোমুখি পৌঁছে গেছি। বুঝতে পারছিলুম, এখন জাহাজের ওপর তোলপাড় চলছে। এবং আমাকে খুঁজে বার করার জন্যে এখন গোটা জাহাজটা তন্ন-তন্ন করে নিশ্চয়ই তল্লাশি চালাচ্ছে সবাই। শেষ পর্যন্ত আমার কী হবে, আমি জানি না।’

ইতিমিচিসাহেবের পিঠের ওপর বসে এগোতে এগোতে সেই ছেলেটি এবার যেন খানিকটা উত্তেজনায় বলে উঠল, ‘তারপর কী হল আপনার?’

ইতিমিচিসাহেব হেসে ফেললেন। বললেন, ‘ভাবছিস বোধ হয় মরে গেলুম?’

 ‘তবে কী হল?’ সে তেমনি উত্তেজিত স্বরেই জিজ্ঞেস করল।

ইতিমিচিসাহেব বললেন, ‘না, মরিনি। তবে সেই ঝুলন্ত অবস্থায় আমি যে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, সেটা আমি হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছিলুম। আমার নিজের ভারটাই আমার নিজেরই কাছে তখন ভীষণ অসহ্য লাগছিল। আমি পারছি না। তবু প্রাণপণে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছি। আমার মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো এখুনি গভীর সমুদ্রে হাত ফসকে পড়ে তলিয়ে যাব। তখন কী হবে/ সাঁতার আমি জানি বটে, কিন্তু কতক্ষণ?

‘সেই ঝুলন্ত অবস্থাতেই আমার যেন হঠাৎ নজরে পড়ল, দূরে সমুদ্রের কিনারে দু-একটা বিন্দুর মতো আলোর রেখা চিকচিক করছে। আমার চোখে ধাঁধাঁ লেগে গেল। আমি কি ঠিক দেখছি/ তবে কি সমুদ্রের কিনারা দিয়ে জাহাজটা বয়ে চলেছে/ হ্যাঁ, ঠিক তাই। এখন আমি নিশ্চয়ই ঝাপসা দেখছি না। আলোর স্পষ্ট বিন্দুগুলি আমার চোখের তারায় উছলে উঠছে। তাহলে জাহাজটা বোধ হয় পোর্টের কাছাকাছি এসে পড়েছে। আনন্দে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলুম। আর ঠিক তখনি কী যে হল, সেই লোহার চেন ফসকে আমি সমুদ্রের জলের ওপর ছিটকে পড়লুম। অতল সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে বাঁচার তাগিদে সাঁতার কাটতে লাগলুম। সমুদ্র-জলে ভাসতে-ভাসতে আমি দেখবার চেষ্টা করলুম, জাহাজটা এখন কোথায়/ জাহাজ আমায় পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এখন তীরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি জাহাজের ঢেউ আর সমুদ্রের জল মাথায় নিয়ে ভেসে-ভেসে এগিয়ে চললুম তীরের দিকে। সেই শয়তানদের হাত থেকে বাঁচলুম বটে, কিন্তু এখন সমুদ্রের হাত থেকে কেমন করে বাঁচব, জানি না। কেননা, যতই আমি তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সমুদ্রের ঢেউ ততই উত্তাল হয়ে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে, কখনও আমি পাঁচতলা, সাততলা ওপরে উঠে যাচ্ছি, আবার ঢেউয়ের সঙ্গে ঘুরপাক খেতে-খেতে নীচে নামছি। আতঙ্কে ভাবছি, আর বোধ হয় বাঁচা হল না আমার।

‘আমি এমনি করেই এগিয়ে এসেছিলুম, সমুদ্রতীরের অনেকখানি কাছেই। মনে হচ্ছিল, অন্ধকারটা অনেকখানিই কেটে গেছে। ভোরের আলো ফুটছে সমুদ্রের বুকে। আমি নিশ্বাস নিচ্ছি ভোরের বাতাসে। তারপর কেমন যেন ধীরে-ধীরে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আমি আর সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর বাঁচার জন্যে ছটফট করত পারছি না। আমার যেন দম ফুরিয়ে আসছে। আমি বোধ হয় হারিয়ে গেলুম। আর কিছুই মনে নেই।’

এমন সময় হঠাৎ ছেলেটি ইতিমিচিসাহেবকে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি আপনি হারিয়ে গেলেন?’

ইতিমিচিসাহেব হেসেই বললেন, ‘তুই একদম বোকা, হারিয়ে গেলে এখন তোকে পিঠে নিয়ে কে হাঁটত?’

ছেলেটিও হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তারপর কী হল’?

 ‘তারপর? তারপর হয়তো অনেকক্ষণ কেটে গেছে। হঠাৎ আমি চোখ চাইলুম। আমার মুখের ওপর সূর্যের তাপ। আমি যে এখন জলের ওপর হাবুডুবু খাচ্ছি না, সেটা বুঝতে পারলুম। উঠতে গেলুম, কষ্ট হল। আমার দেহের অর্ধেকটা বালির নীচে চাপা পড়েছে। এমন অবস্থা কী করে হল, বুঝতে পারছি না। তারপর কোনোরকমে বালি সরিয়ে, আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলুম। তখন আবার সমুদ্রের গর্জনটা ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার কানে। আমি বুঝতে পারলুম, আমি পড়ে আছি সমুদ্রসৈকতে। ওই ঢেউয়ের সঙ্গে ঘুরপাক খেতে-খেতে হয়তো আমি এখানেই আছড়ে পড়েছি। তারপর–

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। ইতিমিচিসাহেবের কথা শেষ হবার আগেই ছেলেটি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে চিৎকার করে উঠল।

থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন ইতিমিচিসাহেব। দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর তিনিও ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল রে?’

ছেলেটি তেমনি ছটফট করে বলল, “আমায় নামিয়ে দিন আপনার পিঠ থেকে। এ আমার চেনা জায়গা/’

 ইতিমিচিসাহেব বললেন, ‘এখানে তোদের বাড়ি?।

তেমনি অস্থির হয়ে সে বলল, ‘না।’ তারপর ইতিমিচিসাহেবের পিঠ থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়ল। তাঁর হাতটা চেপে ধরে ছুটতে-ছুটতে বলল, ‘আপনি আসুন আমার সঙ্গে।’

এতক্ষণ একটি নদীর বাঁধ ধরেই হাঁটছিলেন ইতিমিচিসাহেব। তিনি এতক্ষণ খেয়াল করেননি যে, নদীর চারদিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গল-ঘেরা সেই নদীর বাঁধের ওপর দিয়েই ছেলেটি তাঁর হাত ধরে ছুটল। ইতিমিচিসাহেব কিছু বলার আগেই ছেলেটি একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল। যেন এক অজানা উত্তেজনায় সে ভীষণ হাঁপাচ্ছে। মাটিতে উপুড় হয়ে বসে পড়ল। তারপর সেই অন্ধকার রাতে, আবছা চাঁদের আলোয়, চোখের দৃষ্টিটাকে মাটির ওপর স্থির রেখে তীক্ষ্ণভাবে কী যেন দেখতে লাগল।

ইতিমিচিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখছিস?’

 ছেলেটি কান্না-ভরা গলায় উত্তর দিল, ‘আপনিও দেখুন/’ বলে ইতিমিচিসাহেবের হাত ধরে টান দিল। ইতিমিচিসাহেবও বসে পড়লেন।

সে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘দেখতে পাচ্ছেন?

 ‘হ্যাঁ, ‘রক্ত’

‘এবার আসুন আমার সঙ্গে।

 ‘কোথায়?’

কাছেই।’ বলে ছেলেটি একটু এসে আবার দাঁড়াল।

ইতিমিচিসাহেব দেখতে পেলেন, দূরে একটা ভাঙাচোরা কোঠাবাড়ি। জঙ্গলের গাছ-পালার আড়াল থেকে খানিকটা দেখা যাচ্ছে।

ছেলেটি রোষে গুমরে উঠে বলল, ‘ওরা ওইখানেই থাকে/

ইতিমিচিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারা?

ছেলেটির মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। প্রতিহিংসায় চোখদুটো জ্বলে উঠল। তার গলার স্বরটা চাপা গর্জনে ফুঁসে উঠল, ‘ওরাই তো, ওরাই তো আমার বাবাকে, আমার মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।’

ইতিমিচিসাহেবের বুকের ভেতরটা কে যেন মুচড়ে দিল মুহূর্তে। তিনি প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠলেন, ‘কেন?’

‘ওরা যে খুনি, লুটেরা।’ বলতে-বলতে ছেলেটির গলা কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপা-গলায় সে বলল, ‘আশ্চর্য লাগছে ভাবতে, আপনার গল্প শেষ হবার আগেই আমার গল্প এসে গেছে। সেদিন তখন গভীর রাত। আমরা ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাবা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। শুনতে পেলেন, পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর আর্তনাদ। দেখতে পেলেন, ওই দুশমনের দল তাদের সর্বস্ব লুঠ করে পালাচ্ছে। তাদের হাতে বন্দুক। বাবা ভয় পেলেন না। দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে তিনি তাদের পেছনে ধাওয়া করলেন। তারা গুলি ছুড়ল। সেই ভীতু পলাতকের দল বাবাকে আঘাত করতে পারল না। ভয় পেলেন না বাবা। তাদের তিনি ধরবেনই এবং নিশ্চিত বিপদকে তুচ্ছ করে তিনি একজনকে ধরেও ফেললেন। তার হাতেও বন্দুক ছিল। কিন্তু বন্দুকটা কাজে লাগাবার মতো, তখন আর তার ক্ষমতা নেই। বাবা তার ঘাড়টা ধরে টান মারতেই সে একটা ভীত মেষশাবকের মতো চিৎকার করে উঠল, তার সঙ্গীদের সাহায্যের জন্যে। কিন্তু সেই কাপুরুষের দল সঙ্গীর বিপদে সাড়া দিল না। তারা পালাল দিগবিদিকজ্ঞান হারিয়ে। তবু এই দুশমনটা বাঁচার তাগিদে বাবার সঙ্গে লড়াই শুরু করে দিল। কিন্তু বাবার এক প্রচণ্ড ঘুষিতে সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ছুটে গিয়ে বাবা তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভীষণ রোখ চেপে গেছে বাবার। মনে হল, বুঝি-বা লোকটাকে মেরেই ফেলেন। রক্ষে, ঠিক এই সময়েই পুলিশ এসে পড়েছিল। লোকটাকে পাকড়াও করে নিয়ে চলে গেল পুলিশ।

‘আসলে এতেই হল ওই দুশমনদের বাবার ওপর আক্রোশ। তাদের সে-আক্রোশের কথা আমরা জানতে পারিনি। আমরা জেনেছিলুম, গোটা দলটাকে পাকড়াও করার জন্যে পুলিশ জোর তল্লাশি চালাচ্ছে। জেনেছিলুম, যে-লোকটা ধরা পড়েছে, সে কবুল করে ফেলেছে সবকিছু। সুতরাং তাদের দিন এগিয়ে এসেছে। ধরা তারা পড়বেই।

 ‘কিন্তু ঘটনা ঘটল উলটো। একদিন গভীর রাত্রে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অতর্কিতে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল এই শয়তানের দল। নিঃশব্দে তারা আমাদের শোবার ঘরে গিয়ে, ঘুমন্ত আমার মাকে, বাবাকে আর আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। তারপর ধরে নিয়ে এসেছিল ওই ভাঙা বাড়িটায়। ওইখানে তিনদিন আমাদের ফেলে রেখেছিল। তারপর যে কী করেছিল তার সাক্ষ্যি তো ওই-রক্তই।’ বলে ছেলেটি কেঁদে ফেলল।

ইতিমিচিসাহেব উত্তেজনায় হঠাৎ নিজেই ছেলেটির হাত চেপে ধরলেন। বললেন, ‘কাঁদিস না। তুই এখানে একটু দাঁড়া আমি আসছি।

ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা যাচ্ছেন?’

 ‘সেই দুশমনের চেহারাগুলো একবার দেখতে যাচ্ছি/”

 ‘আপনাকে খতম করে ফেলবে/’।

 ‘খতম হওয়ার আগে আমি বুঝতে চাই, আমি সত্যিই ভূত, না, মানুষ/

ছেলেটি কোনো কথা বলল না। ইতিমিচিসাহেব অন্ধকারে একাই এগিয়ে গেলেন। একটু গিয়েই ক্ষণেক থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘এখান থেকে যাস না কোথাও। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি। সাবধান ওরা তোকে দেখতে পায়/

ছেলেটি এবারও মুখ খুলল না।

ইতিমিচিসাহেব চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ভাঙা বাড়িটার দিকে এগিয়ে চললেন। যেতে-যেতে তিনি বুঝলেন, দুশমনের আস্তানা গড়ার এটা উপযুক্ত জায়গাই বটে।

এই ঘন-জঙ্গল-ঘেরা অন্ধকারে দৃষ্টি যতই সতর্ক হোক, পাশে যদি কেউ ওত পেতে বসে থাকে, টের পাওয়া খুবই মুশকিল। সুতরাং বিপদ প্রতি পদে-পদে। এতক্ষণ ছেলেটির মুখে তার দুর্ভাগ্যের যে-কথা তিনি শুনলেন, তা শুনে তিনি যে শুধু মনে মনে জ্বলে উঠেছেন, তা-ই নয়/ প্রতিজ্ঞা করেছেন, তিনি দুশমনের মুখোমুখি দাঁড়াবেন, তাদেরও রক্ত দেখবেন। সুতরাং এই অন্ধকারটা, অথবা অন্ধকারে এই ভয়াবহ জঙ্গলটা এখন তাঁর বুকের মধ্যে ভয়ের কামড় ফোঁটাবার ফুরসত পাচ্ছে না। তিনি ভাঙাবাড়ির সামনে পৌঁছে গেলেন। দেখলেন, বাড়ির মধ্যে একটা অস্পষ্ট আলো। তিনি পিছনদিকে চলে গেলেন। পিছনে বাড়ির দেওয়ালে একটা ফাটল দেখতে পেলেন। ফাটল দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তিনি ফাটলে চোখ রেখে উঁকি মারলেন। দেখতে পেলেন, চারজন লোক মুখোমুখি বসে জমিয়ে গল্প করছে। আর থেকে-থেকে হো-হো করে হেসে উঠছে। তাদের চেহারা দেখলে মনে করা খুবই শক্ত তারা লুটেরা বা দুশমন। অবশ্য চারজনের পাশেই চারটি বন্দুক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই অন্ধকার রাতে, জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙাবাড়িতে বন্দুক নিয়ে যারা গজাল্লি করছে, তারা নিশ্চয়ই ধোয়া তুলসীপাতা নয়/ দেখতে-দেখতে হঠাৎ ইতিমিচিসাহেবের চোখটা যেন ধাঁধিয়ে গেল। ওই চারজন লোকের মধ্যে একজনকে যেন তাঁর খুবই চেনা লাগছে/ লোকটাকে যেন কোথায় তিনি দেখেছেন তাঁর মাথাটা ঘুরে গেল/ এ যে সেই লোকটা/ সেই যে সোনার ব্যবসায়ী বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল জাহাজে করে। তিনি আরও ভালো করে দেখলেন। আরও খানিকক্ষণ। হ্যাঁ, এবার তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর চিনতে কোনো ভুল হল না। লোকটার চেহারায় অবিশ্যি বয়সের ছাপ পড়েছে। পাক ধরেছে চুলেও। ধরবেই/ কেননা, যখন কার কথা এখন তাঁর মনে পড়েছে, তখন ইতিমিচিসাহেব কত ছোটো। খুব বেশি হলে তখন ইতিমিচিসাহেবের বয়স ছিল এগারো। এখন কদিন পরে তিনি চল্লিশের ঘরে পা দেবেন। সুতরাং তখন লোকটার বয়েস যদি খুব বেশি ধরি তিরিশ, তাহলে এখন তারও তো প্রায় ষাট হতে চলল। কিন্তু দেখে বোঝা ভার। যদিও বয়েস হয়েছে, তবুও বলতে পারা যায় না, শরীরটা ভেঙে পড়েছে। এখনও বেশ শক্তপোক্ত তরতাজাই লাগছে। তাহলে ইনিই সেই কীর্তিমান দুশমন/ ইনিই এখানে সেই ছোট্টো ইতিমিচিকে ধরে আনার মতলব এঁটেছিলেন।

তাকে চিনে ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে ইতিমিচিসাহেবের দেহের রক্ত যেন একসঙ্গে টগবগ করে ফুটে উঠল। সেই অন্ধকারে ভাঙাবাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে রাগে তিনি ফুঁসতে লাগলেন। অবশেষে ঠিক করলেন লোকটার সামনে তিনি যাবেন। দরজাটার কাছে এলেন আবার। আলতো-হাতে ঠেলা মারলেন দরজায়। অবশ্যই দরজা বন্ধ। শয়তান কি আর অতই মুখ যে, রাতদুপুরে ঘরের দরজা হাট করে খুলে, খোশগল্প করবে। তাহলে এখন ইতিমিচিসাহেব কী করেন? জোরে দরজায় ঠেলা মারবেন, না, অন্য কোনো পথের খোঁজ করবেন?

ইতিমিচিসাহেব তাই করলেন। খুঁজতে লাগলেন, ভিতরে ঢোকার অন্য পথ। কিন্তু ভাঙাবাড়ির চারকোণে চক্র মেরেও তিনি কোনো পথেরই হদিস করতে পারলেন না। সুতরাং ঝুটমুট চোরের মতো ঘুরঘুর না করে, বুকে সাহস এনে তিনি দরজাতেই ধাক্কা দেবেন ঠিক করলেন।

ইতিমিচিসাহেব তাই করলেন। খুঁজতে লাগলেন, ভিতরে ঢোকার দরজা।

এমনই সময় হঠাৎ হাঁটতে গিয়ে একটা গর্তের মধ্যে তাঁর পা পড়ে গেল। তিনি হোঁচট খেলেন। গর্তটা তিনি একদম ঠাওর করতে পারেননি। গাছ পাতায় এমনভাবে ঢাকা পড়ে আছে যে, খেয়াল করাই শক্ত। ঠিক বাড়ির গায়ে লাগোয়া গর্তটা দেখে তাঁর কেমন যেন সন্দেহ হল। এটা কোনো সুড়ঙ্গ নয়তো/ দুবৃত্তদের পালাবার পথ/ এটা মনে হতেই তিনি ভাবলেন, তাহলে তো একবার পরখ করে দেখতে হয়/

কিন্তু এই অন্ধকারে সুড়ঙ্গ পরখ করা কেমন করে সম্ভব? এ-কথা জেনেও তিনি অন্ধকার মানলেন না। প্রথমে তিনি গর্তটার মধ্যে উঁকি দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিজের পাদুটিকে এগিয়ে দিলেন গর্তের গহ্বরে। কোমরটা ভেঙে তিনি ঘাড় হেঁট করলেন। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চললেন। হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই এটা সুড়ঙ্গ। কেননা, এগিয়ে চলতে তিনি কোনো বাধা পাচ্ছেন না। অবিশ্যি ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। সুতরাং হাতড়ে-হাতড়ে তাঁকে হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে। এবং অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে ঢুকে পড়ছেন।

হং, শেষমেশ সত্যি-সত্যিই তিনি সেই ভাঙাবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে পারলেন। ইতিমিচিসাহেব ওই দুশমনদের মুখোমুখি দাঁড়াবার আগে আর একবার উঁকি মারলেন। তিনি এখন পরিষ্কার চিনতে পারছেন সেই ভুয়ো সোনার ব্যবসায়ীকে। তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। চার দুশমনের কেউ টেরও পেল না। গল্পে মশগুল তারা। এই তক্কে তিনি তাদের পাশে রাখা একটা বন্দুক তুলে নিলেন নিঃশব্দে। তাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, ‘হ্যালো, গোল্ড-মার্চেন্ট/’

 চার দুশমনের বুকের ধুকধুকি আঁতকে উঠল। চমকে তাকাল সেই রাতের অতিথিটির দিকে। দেখল, অতিথিটি তার হাতের বন্দুক তাক করে তাদের দিকে চেয়ে হাসছে/ প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েই চার দুশমন প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা বন্দুক তুলতে গেল। ইতিমিচিসাহেব আবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘খবরদার/ বন্দুক নেবার চেষ্টা কোরো না, খতম করে ফেলব/

তারা থমকে ইতিমিচিসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।

ইতিমিচিসাহেব তেমনি হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘আমাকে মারবার দরকার হবে কি? আমি তো আপনার খুবই চেনা। চিনতে পারছেন না আমাকে?’

ইতিমিচিসাহেবকে তার পক্ষে এখন চেনা কেমন করে সম্ভব/ তাঁর বয়সও হয়েছে, একটি-দুটি চুলে পাকও ধরেছে, গলার স্বরও ভারী হয়েছে। তাছাড়া সেই ছেলেবেলার মুখখানা তাঁর এখন দাড়ি-গোঁফে ঢাকা পড়ে গেছে। তাঁর গলার স্বরটাও আর সেই ছেলেমানুষি সুরে ফিনফিন করছে না। অনেকটা গম্ভীর। চেহারাটাও ভারিক্কি হয়েছে। সুতরাং শত চেষ্টা করলেও তাঁকে এখন চেনা যাবে না। দুশমন তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে। ইতিমিচিসাহেব হো-হো করে হেসে উঠলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চেনা যাচ্ছে? আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। মনে পড়ছে না, সেই ছোটো-ছেলেটির কথা? জাহাজে চাকরি করে দেবার লোত দেখিয়ে যাকে নিয়ে আপনি ভাগছিলেন? হ্যাঁ, আমিই সেই ছোটোবেলার ইতিমিচি, এখন আপনার যম।’

 সেই লোকটি বোবা-মুখে ইতিমিচিসাহেবের চোখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল। তারপর কাঁপা-গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাও তুমি?’

‘যদি বলি আপনার রক্ত/’ উত্তর দিলেন ইতিমিচিসাহেব।

লোকটা বোধ হয় এতক্ষণ মনে-মনে আঁটছিল কী করবে। তাই মুহূর্তে গলা ফাটিয়ে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল। ইতিমিচিসাহেব থতমত খেয়ে গেছেন। আচমকা তো আর ঠিক সেই তক্কে চার দুশমন দরজা খুলে মারল ছুট।

ইতিমিচিসাহেবের চোখে যেন ধাঁধা গেলে লেদা। তিনি যদিও নিজেকে চোখের পলকে সামলে নিয়ে বন্দুক তুলে তাক করেছিলেন, কিন্তু তার আগেই তারা হাওয়া। তিনি ধাওয়া করলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে সাবধান করলেন, ‘দুশমন, পালালে গুলি করব/’

কিন্তু সে-কথা কখনও শোনে তারা/ তারা ছুটল জঙ্গল-ঢাকা সেই নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে। ইতিমিচিসাহেবও বাঁধের ওপর ছুটে এলেন। তিনি আন্দাজেই একটি গুলি ছুড়লেন। নিস্তব্ধ বনটা বন্দুকের শব্দে যেন শিউরে উঠল। তাদের কারো গায়েই যে লাগেনি, এটা ইতিমিচিসাহেব খুব ভালোই বুঝেছিলেন। আর একবার বন্দুক ছুড়লেন। এবার তিনি শুনতে পেলেন, নদীর জলে ঝপ করে যেন কী আছাড় খেয়ে পড়ল। তিনি দাঁড়ালেন না। কারণ তিনি বুঝলেন, নির্ঘাত গুলি খেয়ে নদীর জলে ডুবেছে এক দুবৃত্ত। তিনি চেঁচালেন, ‘দুশমন, তোমরা আমার নিশানার মধ্যে আছ। সুতরাং মিথ্যে পালাবার পথ খুঁজছ/ দাঁড়াও, নইলে সবকটাকে খতম করে ফেলব।’ এখন তিনি প্রায় তাদের কাছাকাছি চলে এসেছেন। সেই দুবৃত্তের দল বুঝতে পারল, তাদের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পেয়েও দাঁড়াল না। কিন্তু তারা যখন বুঝল, ছুটে আর রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়, তখন সেই দুশমন-সর্দার, মানে সেই নকল সোনার ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হয়েছিল, হয়তো বা বয়সের ভারে সে ক্লান্ত, তাই বুঝি সে ইতিমিচিসাহেবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু না, ছুটতে-ছুটতে ইতিমিচিসাহেব তার মুখোমুখি হতেই, লোকটা একেবারে অতর্কিতে ইতিমিচিসাহেবের মুখের ওপর ঘুষি চালিয়ে দিল। ইতিমিচিসাহেবে টাল খেলেন। তাঁর হাতের বন্দুকটা নিশান থেকে ছুটে গেল। তবু কেমন আশ্চর্য সাহসে বন্দুকের গুলি তিনি ছুঁড়তে পারলেন। ছুঁড়েই তিনি গড়িয়ে পড়লেন নদীর জলে ওই বাঁধের ওপর থেকে। শুনে মনে হচ্ছে, না-জানি কী মস্ত ঘটনা কিন্তু ঘটে গেল চোখের পলকে। সেই ভারী বন্দুকটা এরই মধ্যে ইতিমিচিসাহেবের হাত থেকে ছিটকে গেছে এবং তিনি জলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তিনি জানতেও পারলেন না, সেই দুশমন সর্দারটার কী হল/

বাঁধের ঢালু দেওয়ালে গড়াতে-গড়াতে যদিও ইতিমিচিসাহেবের হাত পা কেটেছে, তবু মারাত্মক কিছু হয়নি। তিনি নদীর স্রোত কাটিয়ে আবার বাঁধে উঠতে পারলেন ঠিকই, কিন্তু জলে ভিজে ভারী অস্বস্তি লাগছে তাঁর। তিনি উঠে প্রথমেই বন্দুকটা খুঁজলেন। কিন্তু সে কী আর পাওয়া যায়/ সেটাও বোধ হয় নদীর জলে ডুবেছে। তবু তিনি তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে-খুঁজতে তিনি চমকে উঠলেন। দেখলেন, বন্দুকের গুলি সেই দুশমনের বুকেই লেগেছে। দুশমন মাটির ওপর মুখ গুঁজে পড়ে আছে। দেখে ইতিমিচিসাহেবের বুকখানা যেন দশ হাত ফুলে উঠল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, না আর দরকার নেই বন্দুকের। তিনি আনন্দে উদবেল হয়ে ছুটে গেলেন সেই ছেলেটির কাছে। গেলেন, যেখানে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু থমকে গেলেন ইতিমিচিসাহেব/ কই এখানে তো ছেলেটি নেই/ ইতিমিচিসাহেব এধারে-ওদারে ঘুরে ফিরে দেখলেন। না, তবু দেখতে পেলেন না। তখন চাপা গলায় তার নাম ধরে ডাকলেন, ‘রিগি।’ তিনি সাড়া পেলেন না। তিনি আরও একটু দূরে, আরও একটু দ্রুত হেঁটে গেলেন। খুঁজলেন, এবারও দেখতে পেলেন না। আবার ডাকলেন, তবুও সাড়া পেলেন না। তিনি তখন কেমন যেন, ভয় পেলেন। তবে কী দুশমনের হাতে ধরা পড়ল। তিনি তখন ভয়াত-কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলেন, ‘রি– গি/ দুশমন খতম হয়েছে। তুমি কোথায় গেলে? রিগি/’।

‘আমি হারিয়ে গেছি/’ যেন একঝলক হাওয়ার শব্দে ভেসে এল সেই ছেলেটির কণ্ঠ।

চমকে তাকালেন ইতিমিচিসাহেব। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কী বলছ রিগি?’

 ‘ঠিক বলছি সাহেব/’ আবার হাওয়ার শব্দে ভেসে এল তারই উত্তর, তখন ওই যে দেখলেন একঝলক রক্ত, আমার মা-বাবাকে আমার কাছ থেথে কেড়ে নিয়ে, এখন বলি, ও রক্ত আমার। আমি মৃত। আমাকেও হত্যা করেছে ওই দুশমন। এতদিন আমার আত্মা ওই দুশমনের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ছটফট করে ঘুরেছে খালি। আজ আমি তৃপ্ত। আজ আমি জেনেছি, আমার সাহসী বন্ধু সে কাজটা করেছে। আজ আমার ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা ছাড়া আর তো কিছুই দিতে পারব না আপনাকে। এর জন্যে যে-দুঃখ, সে তো আমারই। আজ শুধু বলে যাই, সত্যিকারের বন্ধু আপনি, সত্যিকারের মানুষ। আমার সঙ্গে আর দেখা না হলেও মনে রাখব বন্ধু আপনাকে। আপনার সাহসকে আপনার ভালোবাসাকে।’ বলে হারিয়ে গেল সেই শব্দ।

নিমেষে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়ল ইতিমিচিসাহেবের বুকের ওপর। সমস্ত বিশ্বাসটা যেন তাঁর খান খান হয়ে গেল একমুহূর্তে। তিনি আর কথা বলতে পারেন না। কী যে করবেন, তা-ও ভেবে পান না। ধীর পায়ে তিনি এগিয়ে যান সেই রক্ত-চিহ্নের সামনে। নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন সেইদিকে চেয়ে। তারপর মাথা হেঁট করেন। হঠাৎ যেন দু-ফোঁটা চোখের জল উপছে পড়ে ছড়িয়ে গেল সেই রক্তের ওপর।

অভিমানে তাঁর গলাটা সেই মুহূর্তে আকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তবে কেন এসেছিলি? তবে মিথ্যে কেন দুদণ্ডের এই হাসি, এই আনন্দ/ এই ভালোবাসা?’

উত্তর পাননি ইতিমিচিসাহেব।

কিন্তু হঠাৎ একটি পাখির ডাক শুনতে পেয়েছিলেন ইতিমিচিসাহেব। চমক ভাঙল তাঁর। চোখের জল মুছে আকাশের দিকে তাকালেন। এ কী/ আকাশে যে ভোরের আলো ফুটেছে। সেই আলো নদীর জলে ভাঙা ভাঙা ঢেউয়ের ওপর দোল খাচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সেই জলের দিকে। নদীর জলে নিজের মুখের ছায়া দেখলেন। তারপর আঁজলা ভরে জল নিয়ে সেই মুখে ছড়িয়ে দিলেন। আবার হাঁটলেন। হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেলেন।