টোরা আর বাদশা – ২

সামনে একটা মস্ত গুহা। অন্ধকার। সেই মিষ্টি সুবাস এই গুহার ভেতর থেকেই আসছে যেন/ কে আছে গুহার ভেতরে?

ভয়ানক নিস্তব্ধ। ওর নিশ্বাসের শব্দটুকু ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ওর নরম পায়ের ছন্দটুকু পাথরের গায়ে-গায়ে যে শব্দ তুলছে, তা টোরার নিজের কানেই নিতান্ত অস্পষ্ট বেজে যাচ্ছে। টোরা গুহার ভেতরে এগিয়ে গেল।

সামনে আলো। অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল টোরা/ প্রদীপ জ্বলছে। কেবল একটি প্রদীপ। অন্ধকারে একটি শিখা। প্রদীপের আলোয় স্পষ্ট দেখল টোরা এক দেবতার মূর্তি। এই অন্ধকার গুহার ভেতরে এ মূর্তির পায়ের কাছে কে জ্বেলেছে প্রদীপের শিখা/ কে দিয়েছে আলোর ছোঁয়া/

কেঁদে ফেলল টোরা। ওর চোখের পাতা বেয়ে কান্নার ফোঁটাগুলি মুক্তোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো আনন্দে। এই অজানা জায়গায় ও একা। একাকী একটি ছোট্ট মেয়ে। ও জানে না, কী করবে এখন/ ও জানে না, কেমন করে তার ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। জানে না, কেমন করে ভাইকে মায়ের কাছে পোঁছে দেবে। এই দেবতা কি টোরাকে দয়া করবে না? দেবতা কি শুধুই পাথর/

আকুল হয়ে দেবতার পায়ের কাছে প্রণাম করল টোরা। মনে মনে বললে, ‘ঠাকুর, বলো তুমি, ভাইকে কেমন করে ফিরে পাব? বলো ঠাকুর, আমার মায়ের কাছে কেমন করে যেতে পারব? তুমি তো ঠাকুর। তোমার তো অজানা কিছুই নেই। তুমি তো জানো ঠাকুর, আমার এ অলক্ষুনে মুখ যে দেখবে, সে-ই জন্তু হয়ে যাবে/ আমি কী করব? আমি কী করব ঠাকুর?’ বলে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল টোরা/

এ কী/ হঠাৎ প্রদীপটা পিলসুজের ওপর থেকে পড়ে গেল কেন/এই দ্যাখো, প্রদীপ যে মাটিতে পড়ে নিভে গেল/ বুঝতে পারেনি টোরা, অসাবধানে তার আঁচলের ছোঁয়া লেগেছে প্রদীপের গায়ে। তাই পড়ে গেল/ কী হবে।

সঙ্গে সঙ্গে উঃ/কী জমাট অন্ধকার/ কিছু দেখা যায় না/ ওই সুন্দর দেবতার মূর্তিটি পর্যন্ত অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

আর টোরা? টোরা কোথায় গেল? অন্ধকারে সে কোথায় হারিয়ে গেল?

দ্যাখো, দ্যাখো, টোরা হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেছে। অন্ধকারের সঙ্গে অন্ধকার হয়ে মিশে আছে যে/ একী/ ওই প্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে টোরাও যে অদৃশ্য হয়ে গেল/ টোরা নিজে দেখতে পাচ্ছে, সে আছে। কিন্তু তুমি দেখছ, সে নেই। দেখা যাচ্ছে না, তার সেই ফুটফুটে মুখটি। সেই ডাগর-ডাগর চোখ দুটি। লাল টুকটুক ঠোঁট দুটি কিংবা আলতা-ছোঁয়া পা দুটি/ কী হল তার? আবার তার কি অভিশাপ লাগল?

 টোরা কাঁদছে/ তুমি শুনছ টোরা কাঁদছে, কিন্তু দেখছ না তার কান্নার জল। তুমি শুনছ টোরার পায়ের শব্দ, কিন্তু বুঝছ না কোথায় সে চলছে/ তার হাতের চুড়ি বেজে যায় ঠুং-ঠুং, কিন্তু দেখছ না কোথায় সে বেজে পড়ছে/ ডুকরে-ডুকরে কেঁদে ওঠে টোরা, ‘এ আমার কী হল?’।

এই অন্ধকার গুহায়, অজানা দেবতার ঘরে অদৃশ্য টোরা কাঁদছে/

 হঠাৎ কে যেন কথা বলল, ‘কেঁ কাঁদে রে, কে কাঁদে?

 টোরার অদৃশ্য মূর্তি অদৃশ্য চোখে এদিক ওদিক চাইল।

সে-ই আবার বলল, ‘কী তোর নাম?’

 ‘আমি টোরা

 ‘কী করে প্রদীপ নিভল?’

 ‘আমার আঁচল লেগে প্রদীপ নিভে গেল।’

তখন সেই না-দেখা মানুষ গম্ভীর গলায় বললে, ‘যারা অসাবধানী তারাই বারবার ভুল করে।’

টোরা মুখ ফুটে একটি কথাও বলতে পারল না।

আবার সে বললে, ‘তুই অসাবধানী। তোর অসাবধনতার জন্যে খাঁচার থেকে তোদের পাখিটা উড়ে পালাল। তোরই অসাবধানতার জন্যে সেই পাখি তোরই হাতের চাপে মারা গেল। আর এখন তোরই অসাবধনতার জন্যে দেবতার প্রদীপ নিভল। আর সেই পাপে তুই-ও অদৃশ্য হয়ে গেলি/ তুই সবাইকে দেখতে পাবি, কিন্তু তোকে আর কেউ দেখতে পাবে না। তারপর একদিন তোর অদৃশ্য শরীরটা নিয়ে হাওযার সঙ্গে হাওয়া হয়ে নীল আকাশে মিশে যাবি। সেদিন তুই আর কাঁদতেও পারবি না।

 ‘না–চিৎকার করে কেঁদে উঠল টোরা, ‘আমাকে তুমি বাঁচাও। আমি না থাকলে, কে আমার মাকে দেখবে/ কে তার ঘরকন্নার কাজ করে দেবে। কে আমার বাবাকে যত্ন করবে। ভাইকে গল্প বলে ঘুম পাড়াবে।’

‘তোর মা তো তোকে দেখতে পারে না। তবু মায়ের জন্যে তোর এত ভাবনা কেন?’

 ‘কে বললে মা আমায় দেখতে পারে না। মা আমার ভালোর জন্যেই তো আমাকে বকে। কার মা তার মেয়েকে বকে না? আবার ভালোও বাসে না?’

 ‘তোর মা তো পর। ও তো বাদশার মা।’

মা কখনো পর হয়? বাদশা তো আমার ভাই।’

 সেই কণ্ঠস্বর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আর টোরার অদৃশ্য চোখ দুটি ইতিউতি ঘুরে ঘুরে তাকে খুঁজে বেড়াল। কিন্তু তাকে দেখতে পেলে না। না পেয়ে, টোরাই আবার বললে, ‘চুপ করলে কেন? তুমি আমায় বলে দাও কেমন করে আমি ফিরে পাব আমার সব কিছু/’।

হয়তো সেই না-দেখা মানুষের মন টোরার কথা শুনে খুশি হয়েছিল। হয়তো মনে হয়েছিল অনেক দুঃখেও যে অন্যের মাকে আপন করে নেয়, সে লক্ষ্মী মেয়ে। তা দুঃখ ঘোচাতেই হবে। তাই সেই না-দেখা মানুষের কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলে টোরা। সে বললে, ‘তুই যদি আবার সব কিছু ফিরে পেতে চাস, তবে যে তোকে এই প্রদীপ আবার জ্বালতে হবে/

টোরা বললে, ‘আমি জ্বালব।’

‘কিন্তু এ যে বড় শক্ত কাজ। তুই যে ছোটো। তুই তো পারবি না।’

 টোরা ব্যাকুল হয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, আমি পারব। আমি রোজ সন্ধ্যায় আমার ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বেলে দিই।

 তখন সেই কণ্ঠস্বর বললে, ‘তবে শোন। এই গুহার ওপরে যে পাহাড়, সেই পাহাড়ের চূড়ায় তোকে যেতে হবে। সেই পাহাড়ের চূড়ায় খোলা আকাশের নীচে জ্বলছে আর এক প্রদীপ। এই নিভন্ত প্রদীপের শিখাঁটি সেই জ্বলন্ত প্রদীপের শিখায় জ্বালাতে হবে। যদি পারিস, তুই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবি।’

টোরার কণ্ঠস্বর আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘পারব, পারব, পারব।’

আবার সেই না-দেখা মানুষ বললে, ‘বেশ তবে তুলে নে ওই প্রদীপ।’

টোরা অন্ধকারে তার অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে হাতড়ে-হাতড়ে মাটি থেকে সেই প্রদীপটা তুলে নিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এ যে সোনার প্রদ্বীপ/

সে তখন বললে, ‘শুধু প্রদীপ নিলেই তো হবে না।’

‘টোরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘তবে?’

‘জ্বলবে কেমন করে?’

 ‘কেন জ্বলবে না?’

 ‘প্রদীপের শিখা তো শুকিয়ে গেছে। ওকে ভিজিয়ে নিতে হবে/’

‘কেমন করে? কী দিয়ে ভেজাব?’

 ‘ভেজাতে হবে একটি ফুলের কান্নার জলে/’

অবাক হল টোরা। ‘ফুল কাঁদে?’

‘হ্যাঁ, ফুল কাঁদে। যেমন তুই কাঁদিস। একটি ফুলের এক ফোঁটা চোখের জলে এর শিখাঁটি ভিজিয়ে নিলে, তবেই প্রদীপ জ্বলবে।

টোরা হতাশ হয়ে চেয়ে রইল সেই কালো অন্ধকারের দিকে। কালো অন্ধকারে ও আলোর দেবতাকে দেখতে পাচ্ছে না একটুও। ও বুঝতে পারছে না এ কার কণ্ঠস্বর, দেবতার না অন্য কারও। তবু অন্ধকারেই অন্ধের মতো হাত জোড় করে বললে, ‘ঠাকুর, তুমি যখন এত দয়াই করলে, তখন বলে দাও কোথায় কাঁদছে সেই ফুল? কোথায় গেলে তার দেখা পাব?’

তখন সেই কণ্ঠস্বর আবার বললে, ‘যেখানে জলও আছে, স্থলও আছে। হাসিও আছে, খুশিও আছে। পাখিও আছে, ফুলও আছে। শুধু সেখানে নেই টোরা। সেখানেই তোকে যেতে হবে।’

টোরা উঠে দাঁড়াল। প্রদীপটা হাতে নিলে। সে অদৃশ্য, কিন্তু প্রদীপ তো নয়/ তাকে না-দেখা গেলেও এই প্রদীপ তো সবাই দেখতে পাবে, সোনার প্রদীপ দেখলে, কেউ নিয়ে নেয় যদি। ভয় হল। কিন্তু ভয় পেলে তার চলবে না। তাকে বেরিয়ে আসতে হবে গুহার অন্ধকার থেকে বাইরে। তারপর ও হাঁটবে। ওর পায়ের ছন্দে-ছন্দে প্রদীপও দুলে-দুলে এগিয়ে যাবে। মনে হবে, একটি আশ্চর্য সোনার পাখি শূন্যে একা-একা ভেসে যাচ্ছে।

টোরা গুহার অন্ধকার হাতড়ে-হাতড়ে আকাশের আলোয় বেরিয়ে এল। তারপর একটু দাঁড়াল। ভাবল, কোনদিকে যাবে সে কোনদিকে জল আছে, স্থল আছে? হাসি আছে, খুশি আছে? পাখি আছে, ফুল আছে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কেমন যেন অবাক লাগল টোরার। ওর মনে হল, এসব তো সবখানেই আছে/ তা ঠিক। তাহলে? সে কোনখানে যাবে? কেমন করে যাবে?

.

‘টোরা, টোরা, টোরা/’ কে যেন ফিসফিসিয়ে টোরার নাম ধরে কানে কানে ডেকে গেল। ও তো কাউকে দেখতে পেল না। শুধু ওর চারপাশে হাওয়া বয়ে চলেছে ঝুরঝুর করে/ আঃ/ কী মিষ্টি। তবে কি হাওয়ার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কেউ ডাকল তাকে?

টোরা মিষ্টি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি, ডাকছ আমায়?’

 ‘টোরা, টোরা, আমিও তোমার মতো অদৃশ্য। আমার সঙ্গে যাবে তুমি?’

 ‘কোথায়?’

 ‘যেখানে ফুল কাঁদে? কাঁদতে-কাঁদতে ফুলের চোখে জল গড়ায়?’

‘তুমি সেখানে আমায় নিয়ে যাবে?’ আনন্দে টোরার মন নেচে উঠল। উৎসাহে উচ্ছল হয়ে সে জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি কে? তোমায় দেখছি না তো?’

সে বললে, ‘আমি হাওয়ার দোলনা।’

 অমনি টোরার পা দুটি দুলে উঠেছে।

হাওয়া বলল, ‘অবিশ্যি ভয় কিছু নেই। কেননা, আমি তোমায় আমার দোলনায় নিয়ে যাব/’

টোরার চোখ দুটি ভয়ে কুঁচকে গেল। বললে, ‘যদি পড়ে যাই/’।

‘যারা ভয় পায়, তারা পড়ে। পড়তে-পড়তে মরে। কিন্তু তুমি আর পড়বে কী/ তুমি তো অদৃশ্য/’

দুঃখে টোরার গলাটা ভার হয়ে গেল। টোরা উত্তর দিলে, ‘ও হ্যাঁ, আমি তো অদৃশ্য। বেশ তুমি নিয়ে চলো, আমি ভয় পাব না/’

অমনি ঝুরঝুরে হাওয়া ফুরফুর করে বয়ে চলল। সেই হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে টোরা ভেসে যায়, হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় ওই আকাশে।

হাওয়া জিজ্ঞেস করলে, ‘টোরা ভয় পাচ্ছ?’

টোরা বলল, ‘ভালো লাগছে/”

পাহাড়টা পেরিয়ে-পেরিয়ে নদী এল। ওই নীল আকাশের ওপার থেকে চোখ মেলে দেখতে-দেখতে টোরার মনে হল, নদী যেন সবুজ বনের কপালে রূপালি আলোর টায়রা/ ঝিকমিক করছে/

টোরা হাওয়ার দোলনায় ভাসতে-ভাসতে জল দেখল, স্থল দেখল। হাসি দেখল, খুশি দেখল। পাখি দেখল, ফুল দেখল।

দেখল আর অবাক হয়ে গেল। মাটিতে হেঁটে হেঁটে দেখা একরকম। আর আকাশে উড়ে-উড়ে দেখা আরেক রকম। আকাশ থেকে দেখলে মনে হয়, পৃথিবটা যেন একটা খেলাঘর/ কেমন এইটুকু-টুকু হয়ে গেছে সব।

তারপর?

তারপর হাওয়া বলল, ‘টোরা, নামতে হবে।

টোরা জিজ্ঞেস করলে, ‘এইখানে?’

হাওয়া বলল, ‘এই বনে।’

 ‘এই বনে ফুলের কান্না পাব?’

কান্নার জল পাবে।’

তবে নামি।’ সায় দিল টোরা।

 টোরার কথা শেষ হতে না হতেই, হাওয়া হুস-হুঁস করে টোরাকে নিয়ে সেই বনের গভীরে নেমে এল। টোরা বনের ঘাসে পা ফেলে হাওয়াকে বলল, ‘ভীষণ গহন বন।’

হাওয়া বলল, ‘বন যদি না গহন হয়, মজা কিসের?”

টোরা জিজ্ঞেস করলে, বাঘ আছে?’

‘বাঘ আছে, বাঘের মাসিও আছে।’

‘এখানেই কান্না খুঁজতে হবে?’

 হাওয়া উত্তর দিলে, ‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু খুঁজতে-খুঁজতে গভীর বনে হারিয়ে গেলে?’

হারিয়ে গেলেই খুঁজে পাবে।’ বলে হাওয়া হা-হা-হা করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে ঝড়ের বেগে ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘুরতে-ঘুরতে গাছের পাতায়, গাছের ডালে হুটোপাটি লাগিয়ে দিলে। তারপর যে হঠাৎ কোথায় লুকিয়ে পড়ল, টোরা আর দেখতে পেল না।

টোরা চেঁচিয়ে ডাকলে, ‘কোথা লুকালে?’

কে উত্তর দেবে? হাওয়া তখন হাওয়া হয়ে গেছে। আর ঠিক তক্ষুনি টোরার যেন শীত-শীত পাচ্ছে। মনে হল উত্তুরে হাওয়া ঝির ঝির করে বয়ে-বয়ে বনের পাতা ঝরাচ্ছে। গাছের শুকনো পাতাগুলো ঝরতে-ঝরতে যখনই ওর পায়ের ওপর উড়ে আসছে, তখন ওর মনে হচ্ছে এখন সে ভারি একলা। হাওয়াটা যে তাকে এমন একটা না-চেনা, না-জানা জায়গায় একলা ফেলে পালাবে, এটা তো সে ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেনি/ বলো, এখন এই গা-ছমছম বনে একা-একা সে কী করব? কোথায় খুঁজবে ফুলের কান্না?

একদল পাখি পাইন গাছের পাতায়-পাতায় খেলা করছে আর খুব গান গাইছে। এক-একটা পাখি গাইতে গাইতে কেমন শিস দেয়/ কেউ-কেউ নাচে আবার। হাসে আবার। যাই বলো, টোরা কোনোদিন পাখিকে হাসতে দেখেনি/ ওরা তো আর টোরাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাই ভয়ও পাচ্ছে না। খুব হাসছে, খুব গাইছে, ধিনিক-ধিনিক নাচছে

দেখছে টোরা। যতই দেখছে, ভালো লাগছে। আর মনে-মনে ভাবছে, এই বন ভরতি সব পাখি যদি মায়ের জন্যে নিয়ে যেতে পারি না, না, এখন ওসব কথায় না যাওয়াই ভালো। এখন কান্নার কথা। ফুলের কান্না/

হঠাৎ টোরার মনে হল, আচ্ছা পাখিরা তো সারা-রাজ্যি উড়ে বেড়াচ্ছে, ওরা তো জানতে পারে কান্না-ঝরা ফুলের কথা/ আচ্ছা, একবার পাখিদের যদিও ডাকে, যদি জিজ্ঞেস করে?

তাই হ্যাঁ, দেখাই যাকে না। এই ভেবে ভারি মিষ্টি সুরে পাখিদেরই ডাকল টোরা

 গহন বনের রঙিন পাখি,
বল না আমায় বল
কোথায় আমি খুঁজে পাব
 ফুলের চোখের জল?

ওমা/ এ কী হল/ টোরার গলার স্বর শুনে যেন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল পাখির দল/ ভাবল হয়তো, কীরে বাবা/ মানুষের দেখা নেই কোথাও, অথচ মানুষের গলা শোনা যায় কোত্থেকে/ পাখিরা আর থাকে ওখানে? গান থামিয়ে, নাচ থামিয়ে ভোকাট্টা/ এ-গাছে, ও-গাছে যত পাখি ছিল, সব গাছ ছেড়ে, গাছের ডাল ছেড়ে একেবারে টোরার দৃষ্টির বাইরে হাওয়া/

টোরা সেইদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ভাবতে লাগল ‘তাই তো, পাখিরা পালাল কেন?’

এমন সময় এক ঝলক হাওয়া গাছের পাতার ওপর দিয়ে ভেসে গেল। আর ঠিক তক্ষুনি মনে হল, যেন পাতাদের গায়ে কে সুড়সুড়ি দিয়ে দিয়েছে/ এ-পাতা ও-পাতার গায়ে লুটোপুটি খেয়ে খিলখিল করে হেসে কুটোকুটি/ টোরা ভাবল, গাছের পাতাও হাসে/ যখন হাসে, তখন নিশ্চয়ই টোরার কথাও বুঝতে পারবে/ তাই টোরা এবার গাছের পাতাদের ডাকলে,

গহন বনের সুবজ পাতা,
বল না আমায় বল,
কোথায় আমি খুঁজে পাব
ফুলের চোখের জল?

চোখের পলকে তখন এক কাণ্ড। টোরার মুখের কথা তখনও শেষ হয়নি/ দেখে কী, সেই বন ভরতি গাছ, গাছ ভরতি সবুজ পাতা নিমেষের মধ্যে সব ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল। ঝরে পড়ে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা বনে ছোটাছুটি, হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিল। সে এক তাজ্জব ব্যাপার/ গাছ আছে পাতা নেই। ডাল পালা খাঁ-খাঁ/ কঙ্কালসার/ মনে হচ্ছে যেন, কোমরভাঙা একশো দুশো বছরের হাড়-জিরজিরে এক-একটা বুড়ি, কিংবা বুড়ো, লিকলিকে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ল্যাকপ্যাক করছে।

পাতা ঝরল বলে, সেই গহন বন আর গহন রইল না। সারা বন আলোয় আলো হয়ে গেল/ সেই কাণ্ড দেখে বনের যত জীব সবাই তো থ বনে গেছে। যে যেদিকে পারল, দে চম্পট/ আর টোরা? কোনদিকে যাবে, কাকে ডাকবে, কিছুই ভেবে না পেয়ে শুকনো গাছের, শুকনো পাতার দিকে হাঁদার মতো চেয়ে রইল/ পথ যে কোথায়, ঠাওরই করতে পারছে না টোরা। সে যেন সত্যিই অলক্ষুনে/ না হলে এমন হবে কেন? এমন যে পখ-পাখালি, গাছ-গাছালিতে ভরা সুন্দর বন, তার দৃষ্টি লেগে সে-বনও ঝরে গেল/ এখন আর কিছু ভাবতে পারছে না টোরা। এখানে ফুলের চোখে জল পাওয়া তো দূরের কথা। এখন যেন এ-বনের মরুর দশা। যেদিকেই চাও খাঁ খাঁ করছে/

ভারি দুঃখ লাগছে টোরার। সেই সোনার প্রদীপটি হাতে নিয়ে এখন সে এখানে একা/ ডাকলেও কেউ সাড়া দেবে না। সাড়া দিলেও কেউ টোরাকে দেখতে পাবে না।

কেঁদে ফেলল টোরা/ শূন্য এই বনে ওর কান্না কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কেউ জানছে না, কে কাঁদে, কেন কাঁদে। টোরা যেমন হাওয়ার সঙ্গে হাওয়ার মতো অদৃশ্য, টোরার কান্নাও তেমনি হাওয়ার সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে ভেসে ভেসে ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যায়, অনেক কাছে আবার অনেক দূরে। ধীরে-ধীরে পা ফেলে টোরা। ধীরে ধীরে সেই কান্নার সুর যেন একটি মিষ্টি গানের ঢেউয়ের মতো উছলে পড়ে অনেক ব্যথা, অনেক সুরের মুক্তা হয়ে হাহাকার করে ছড়িয়ে পড়ছিল/ এ কি কান্না? না, কান্নার গান? কে বলবে, টোরা কাঁদছিল, না কান্নার ছলে গাইছিল এই শূন্য বনে একা? | এই শূন্য বনে একটু আগে কত না প্রজাপতি রঙিন পাখনা ছড়িয়ে নেচে বেড়িয়েছে। কত না মৌমাছি ফুলের কানে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়েছে। গাছের ডালে বহুরূপী কত রূপের বাহার দেখিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে। হয়তো ছাপ-ছাপ চিতাবাঘ ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে বসে শিকার খুঁজেছে। কিংবা লয়া-লয়া সাপ লতায়-পাতায় জড়িয়ে-মড়িয়ে অঘোরে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে। কিন্তু এখন? সব শূন্য। এখন এই শূন্য বনে টোরার এ কান্না কে শুনবে, শুধু ওই শূন্য আকাশ ছাড়া?

হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁত করে চমকে উঠল টোরার। কেন? কাকে দেখলে টোরা? কে যায় তার চোখের সামনে দিয়ে? এ কী/ এ যে বাদশা/

বাদশা? হ্যাঁ, সত্যিই তো/ কিন্তু ওর এমন দশা কেন? কী হয়েছে তার? কেন গাধার মতো গাড়ি টানছে? কার গাড়ি টানছে? ও কে বসে আছে গাড়ির ওপর/

গাড়িটার দুটো চাকা। মাথা ঢাকা। ঠিক যেন এক্কাগাড়ি। গাড়ির সওয়ার একটা বুড়ি/ দ্যাখো, কেমন ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করে বসে আছে বুড়িটা/ লজ্জা নেই তো একটা ছোট্ট ছেলে গাধার মতো গাড়ি টানছে আর বুড়ি কিনা তার পিঠে চাবুক মেরে হ্যাট-হ্যাট করছে/ এ কী রে/ বাদশাকে কি সত্যিই গাধা পেয়েছে/ ওইটুকু ছেলে বাদশা পারবে কেন ওই একটা ইয়া পেল্লাই গাড়ি টানতে পারছে না বলেই হোঁচট খাচ্ছে। হোঁচট খেলেই, বুড়িটা চাবুক হাঁকড়াচ্ছে/ আর বাদশা ‘বাবা গো’ বলে কেঁদে উঠছে/

যে টোরা এতক্ষণ কাঁদছিল, বাদশাকে দেখে তার চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেল। কী করবে এখন টোরা? কাকে ডাকবে? বাদশা তার এত কাছে থেকেও কত দূরে/ এ দুর্দশা থেকে সে কেমন করে বাঁচাবে বাদশাকে? কী দোষ করেছে বাদশা যে একটা বুড়ি নিষ্ঠুরের মতো তার কাঁধে গাড়ি জুতে আরাম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর হাওয়া খাচ্ছে/ এ কেমন করে হয়? জন্তু-মার্কা মানুষগুলোর হাত থেকে তবে কি এখন বাদশা এই বুড়িটার হাতে পড়েছে।

থাকতে পারল না টোরা। এখন তো আর বাদশার সামনে যেতে টোরার ভয় নেই। টোরা জানে এখন আর বাদশা তার মুখখানা দেখতে পাচ্ছে না, যে দেখলেই জন্তু হয়ে যাবে।

‘আ/’ আর্তনাদ করে উঠল বাদশা। ওর পিঠে বুড়িটা আবার চাবুক মেরেছে। কেননা, ও যে পারছে না। পারছে না গাড়ি টানতে/

টোরা দাঁড়াল না। প্রদীপটা হাতে নিয়েই ছুটে গেল। ছুটে গেল গাড়িটার পেছনে। আহা/ ভাইয়ের কষ্ট সে যে আর দেখতে পারছে না। টোরা পেছন থেকেই তার অদৃশ্য হাত দিয়ে ঠেলা দিল গাড়িটায়। গাড়ির গায়ে টোরার হাতের ধাক্কা লাগতেই গাড়ি হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গেল। বাদশার ছুটতে আর কষ্ট নেই। বাদশা ছুটল আর বুড়িটা দাঁত ছরকুট্টে হেসে উঠল।

বাদশা নিজেই অবাক হয়ে গেল/ বেড়ে মজা তো/ এতক্ষণ যে-গাড়িটা টানতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেই গাড়ি হঠাৎ এত হালকা হয়ে গেল কী করে? কেউ ঠেলছে নাকি পেছন থেকে? কই, না/ সামনে-পিছে ডাইনে-বাঁয়ে, কই, কেউ নেই তো/

আরও জোরে ঠেলল টোরা। আরও জোরে ছুটল বাদশা। ওর পিঠে চাবুক মেরে বুড়িটা আর হ্যাট-হ্যাট করে তেড়ে উঠল না। উলটে সেই দাঁত-খিচুনি বুড়ি, নাক-খিচুনি দিয়ে গাড়ির ওপর সটান দাঁড়িয়ে উঠে নৃত্য শুরু করে দিল/ ব্যস/ এবার উলটো বিপত্তি/ বাদশা পারবে কেন টাল সামলাতে? বাদশা তো বাদশা/ অমন একশোটা বাদশা এলেও কি অমন বিচ্ছিরি বুড়িকে সামাল দিতে পারে? বাদশার হাত ফসকে গাড়ি দুমফট/ আর বুড়িও পা হড়কে চিত-ফট/ বুদ্ধি দ্যাখো বুড়ির/ ওই একটা দুধের ছেলের ঘাড়ে গাড়ি জুতে তুই গাড়ির ওপর নাচানাচি করছিস কোন আক্কেলে/ তোর দয়া-মায়া নেই, না বুদ্ধির মাথা খেয়ে বসে আছিস? ছিঃ, ছিঃ/

তুমি তো বলছ, ছিঃ, ছিঃ/ এদিকে ডিগবাজি খেয়ে বুড়ির যে কোমর গেল/ বুড়ির এমন লাগা লেগেছে না/ মাটিতে চিৎপাত তো হলই তার সঙ্গে চিৎকার শুরু করে দিলে বুড়ি, ‘উরি বাবা রে/’।

বাদশা একদম থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী যে করবে, কিছু ঠাওরই করতে পারল না। কিন্তু বুড়ি, সে তো আর ছেড়ে দেবার পাত্তর নয়/ মাটি খামচে লেংচে-লেংচে উঠে দাঁড়ালে। রক্তচক্ষু ড্যাবডেবিয়ে, খপাত করে বাদশার কানটা ধরে ফেলল। তারপর এমন টান দিলে, এই দ্যাখো, বাদশার কান বুঝি ছিঁড়ে যায়/ সঙ্গে সঙ্গে চিল্লিয়ে উঠেছে, পাজি, হতচ্ছাড়া/ তোর এত বড়ো বুকের পাটা/ তুই আমায় ফেলে দিয়ে মারতে চাস/ তোর আমি মুণ্ডপাত করব।’ বলেই এমন প্যাঁ-অ্যাঁ করে কেঁদে উঠল যে, দেখেশুনে বাদশা ভ্যাবাচাকা। যাচ্চলে/ এত বড়ো বুড়িটা নাকি সুরে কেমন কাঁদছে দ্যাখো/ কাঁদবে না? কোমরে কি কম লাগাটা লেগেছে/ কেঁদে একেবারে পাড়া মাথায় করে চেঁচাতে লাগল, ‘ওগো, তোমরা কে কোথায় আছ গো, এই শয়তান ছেলেটা আমার কোমর ভেঙে দিল গো/’।

অবিশ্যি এখানে আর আসবে কে? কেউ তো আর কাছেপিঠে নেই/ যতই চেঁচাও, ফক্কা/ শেষে বুড়িটা রেগেমেগে বেমক্কা এক চড় কষিয়ে দিলে বাদশার গালে। তারপর কানটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে শুরু করে দিলে/

থাকতে পারল না টোরা। বুড়িটার তো আস্পর্ধা কম নয়। তার ভায়ের গায়ে হাত তোলা/ ছুটে গেল টোরা একেবারে বুড়ির পেছনে। পেছন থেকে বুড়ির নুটি বাঁধা ঝুঁটিটা হ্যাঁচকা মেরে নুড়োনুড়ি করে দিলে। বুড়ি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে, পেছন ফিরে দেখে ভোঁ-ভাঁ/ কেউ তো নেই/ বুড়ি একেবারে হাঁ/ কে তার ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিল/

টোরা তো নেড়ে দিয়েই লুকিয়ে পড়েছে/ সামনে থাকলেই বা কী/ ওকে তো আর দেখতে পেত না। কিন্তু মুশকিল ওই যে, হাতে তার প্রদীপ/ সেটা তো দেখে ফেলতে পারে/

বুড়ি পেছনে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেল, না রেগে গেল, তা জানি না। উলটে বাদশার দিকেই তেড়ে গিয়ে বাদশাকেই গালপাড়া শুরু করে দিলে/ বাদশা বেচারি কী যে হল, কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বুড়ির গাল খেতে লাগল।

টোরা চুপি-চুপি আবার এসেছে বুড়ির পেছনে। এবার বুড়ির কোমরে দিয়েছে এক রামচিমটি/ বুড়ি চিমটি খেয়ে, হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটাল, ‘বাবা গো, মা গো/’ বুড়ি যতই চিল্লাচ্ছে, টোরা ততই খামছে ধরছে/

টোরার এই রামচিমটি বুড়ি কতক্ষণ সহ্য করবে? শেষমেশ ঠ্যাং ছুঁড়ে লাফালাফি শুরু করে দিলে/ থাক পড়ে তোর ঠেলাগাড়ি/ বাদশাকে ঝপাং করে জাপটে ধরে মার ছুট/ বাবা রে বাবা/ এই ল্যাকপ্যাকে-মার্কা বুড়িটার কী শক্তি দেখো। ভেবেছিলাম, বুঝি ফুঁ দিলে ফুস হয়ে যাবে/ ও হরি/ এখন দেখছি সে-গুড়ে বালি/ বাদশাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে দৌড়চ্ছে দ্যাখো, যেন শ্যাওড়াগাছের ডাইনি।

বুড়িটা ছুটতে ছুটতে একটা আঁধার-আঁধার জায়গায় এসে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখলে/ না, জন-মনুষ্যি নেই/ আঁধার জায়গায় মস্ত ঝোপের আড়ালে একটা ঘুপচি-মতো ঘর। বুড়ি চুপি-চুপি ঘরের চাবি খুলে, বাদশার ঘাড়টা ধরে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিলে। তারপর আর একবার ভালো করে বাইরের আঁদাড় পাঁদাড়টা লক্ষ করে নিজেও ঘরে ঢুকে গেল। ভেতর থকে ঘরের হুড়কো এঁটে দিলে/ এদিকে টোরাও হাজির/ সে-ও যে তার পেছনে-পেছনে ছুটে এসেছে, বুড়ি সে-কথা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি/

টোরা ছুটে এল ঠিকই, কিন্তু ঘরে আর ঢুকতে পারল না/ ও ছুটে আসার আগেই দোর বন্ধ/ অবিশ্যি হুট করে ঘরে ঢোকাও তো যাবে না। ওর হাতে প্রদীপ/ প্রদীপ নিয়েই তো যত মুশকিল/ বুড়িটা একবার যদি দেখে ফেলে তা ব্যাস/ তখন কি-আর ছেড়ে কথা বলবে?

হাঁ বুড়ি সত্যিই ছেড়ে কথা বলেনি। বলেনি বাদশাকে। ঘরের মধ্যে তখন তুলকালাম শুরু হয়ে গেছে। কী চিৎকার আর দাঁতখিচুনি/ বাদশাকে ধরে এমন মার দিলে যে, বাদশা ককিয়ে উঠল/ বাইরে থেকে টোরার

তো আর শুনতে কিছু বাকি থাকছে না। ছটফটিয়ে উঠল টোরার মন। এখন সে কী করবে? কেমন করে তার ভাইকে সে রক্ষা করবে?

ছুটে গেল টোরা দরজাটার কাছে। কান পাতলে/ তারপর ওর ছোট্ট হাতে যত শক্তি ছিল সব শক্তি দিয়ে দরজায় ঠেলা দিলে। দরজা কেঁপে উঠল, খট-খট-খট।

নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল বুড়িটা। নইলে চেঁচাতে-চেঁচাতে হঠাৎ অমন থামবে কেন? একদম চুপচাপ/ বুড়ির গলায় আর টু শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে না টেরা/ কীরে বাবা/ বুড়ি ভড়কে গেল নাকি

আবার দরজায় ঠেলা দিলে টোরা।

বুড়ি গলায় খেকরি মেরে ক্যারকেরিয়ে সাড়া দিলে, ‘দরজায় ঠেলা মারে কে র‍্যা?

টোরা সাড়া না দিয়ে আবার ঠেলা দিলে।

বুড়ি দরজার হুড়কো খুললে। শুনতে পেয়েছিল টোরা হুড়কো খোলার শব্দটা। তাই আবার চটপট লুকিয়ে পড়েছে/

দরজা খুলে, একটুখানি ফাঁক করে উঁকি মারলে বুড়ি। বাইরে তো কেউ নেই। কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। দরজা আর-একটু ফাঁক করে গলা বাড়াল/ কই, জন-মানুষের তো চিহ্ন নেই/ তাহলে বোধ হয় বাতাসে ঠেলা মেরেছে। তবু নিশ্চিন্ত হবার জন্যে বাইরে পা বাড়িয়ে রা কাড়লে, ‘দরজা ঠেললি কে? কাকে চাই?’

এখনও কোনো সাড়া নেই/

 বুড়ি এবার দরজা ডিঙিয়ে একেবারে বাইরে বেরিয়ে এসেছে/ দ্যাখো, দ্যাখো, বুড়ির চোখ দুটো দ্যাখো/ কী সাংঘাতিক দেখতে দেখলেই মনে হয়, কুচুটেপনায় ভরতি একেবারে/ আড়চোখে টেরিয়ে-টেরিয়ে ইদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ, বলব কী, টোরার হাতের সোনার প্রদীপটার দিকে তার নজর পড়ে গেছে/ এই রে/ এ কী করল টোরা। আবার অসাবধানীর মতো কাজ করে বসল/

বুড়ি প্রথমটা বুঝতেই পারেনি/ বুঝতে পারেনি ওটা কী/ তারপর কাছে আসতেই সোনা যখন ঝকমক করে চোখের সামনে ঠিকরে উঠল, তখন কি আর বুড়িকে বলে দিতে হবে এটা কী/ বুড়ির তো চক্ষু চড়কগাছ/ আরি ব্যাস? এ যে একটা সোনার প্রদীপ, হাওয়ায় ভাসছে/ এ-কেমনতর আজবকাণ্ড/ বুড়ি তখন করল কী, হাত বাড়াল/ এই সেরেছে/ ধরে ফেলল নাকী/

হুঃ/ অতই সোজা/

টোরার অবিশ্যি প্রথমটা বাদশার কান্না শুনে ভারি মন খারাপ লাগছিল/ কিন্তু বুড়ি প্রদীপটা ধরবার জন্যে হাত বাড়াতেই আর দেখতে হয়। টোরা চটপট হাতটা সরিয়ে নিলে/ বুড়ির হাতে ফোক্কা/

বুড়ি তো থ/ ভাবলে, এ কীরে, এপিকিস উড়াতে উড়তে ভাগে দেখি/

এবার বুড়ি গুটিগুটি পা ফেলে এগিয়ে গেল। একেবারে প্রদীপটার সামনে। তারপর আঙুল দুটো শক্ত করলে। যেমন করে ফড়িং ধরে, তেমনি নিঃসাড়ে আঙুল পাকিয়ে যেই ধরতে গেছে, অমনি ফুড়ত/

আর থাকতে পারল না। এবার বুড়ির চোখ দুটো লোভে জ্বলজ্বল করে উঠল। চোখের তারায় সোনার ছায়া/ বুড়ি এখন মরিয়া/ কাপড়ের আঁচলটা কোমরে বেশ করে জড়ালে। মাথার চুলে নুটি বেঁধে শক্ত করে প্যাঁচ কষল। তারপর ধাঁই ধপাধপ শুরু করে দিলে।

প্রদীপ এদিক যায়

বুড়িও এদিক ছোটে।

প্রদীপ ওপরে ওঠে।

 বুড়িও লেংচি মেরে হাত তোলে।

প্রদীপ মাটিতে গড়ায়।

বুড়িও গড়াগড়ি খায়।

শেষে ঘেমে-নেয়ে, কেশে-হেঁচে বুড়ি একশা/ বুড়ির বুকের ধুকধুকি এই বুঝি ঠান্ডা মেরে যায়/

না, তা হল না। উলটে, টোরার হাত থেকেই যে প্রদীপটা ফসকে গেল/ ফসকে যেতেই মাটিতে পড়েছে। আর দেখতে/ বুড়ি একেবারে প্রদীপটার ওপর হুমড়ি খেয়ে কাঁপিয়ে পড়ল। মারলে ছোঁ/ ব্যাস/ ওই দ্যাখো, প্রদীপ সটান বুড়ির হাতের মুঠোর মধ্যে।

ইস/ এ কী হল/ প্রদীপটাও টোরার হাত ফসকে গেল/ সত্যিই/ এখন তুমিও না-বলে পারবে কি, মেয়েটা অসাবধানী, মেয়েটা বোকা?

না, মোটেই না/ এখন টোরাকে যে বলবে বোকা, আমি বলব সে-ই বোকা/ আমি যদি বলি, প্রদীপটা টোরা ইচ্ছে করে বুড়িকে দিয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে না/

ইচ্ছে করেই তো/ এই দ্যাখো না এবার মজাটা/ প্রদীপটা যেই না হাতে পাওয়া, অমনি সেই পুঁটকি বুড়ির তখন সে কী ধেইধেই নাচুনি/ নাচুক বুড়ি। যত পারে নাচুক। সেই তক্কে টোরা যে তার ঘরে ঢুকে পড়েছে/ সাধ করে কি-আর প্রদীপটা হাতছাড়া করেছে টোরা/

নাচ শেষ করে হাঁপাতে-হাঁপাতে বুড়ি যখন ঘরে ঢুকল, তখন টোরা বাদশার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। টোরাকে যেমন বুড়িও দেখতে পাচ্ছে না, তেমনই বাদশাও দেখতে পাচ্ছে না, দিদি তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে।

 বুড়ি ঘরে ঢুকেই আঁচলে বাঁধা চাবি দিয়ে কাঠের সিন্দুক খুলে প্রদীপটা ঝটপট লুকিয়ে ফেললে। আর মনে-মনে ভাবলে, অ্যাদ্দিনে বোধ হয় কপাল খুলল/

বাদশা আর কাঁদছে না। বুড়িকে দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাদশা। বুড়ি একবাটি তেল আনলে। তারপর বাদশার কাছে এসে ওর গালে ঠাস করে চড় মারল মেরে বলল, ‘দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে ন্যাকামি হচ্ছে/ এই নে, এই তেল দিয়ে আমার কোমর মালিশ কর/ হতচ্ছাড়া ছেলে আমায় এমন ফেলে দিয়েছে যে, কোমরের যন্ত্রণায় আমি মরতে বসেছি/’ বলে আবার বাদশার গালে একটা ঠোনা মেরে মাদুরের ওপর শুয়ে পড়ল। বাদশা তেল দিয়ে বুড়ির কোমর মালিশ করতে বসল। এ-কম্ম কি বাদশা পারে? না, করেছে কোনোদিন? সে-কথা বললে কে শুনছে? না পারলেও উপায় নেই। করতেই হবে।

বাদশা পারছে না। ওর তো আর গায়ে তেমন শক্তি নেই যে খুব জোরে দলাই-মলাই করবে/ বাদশা যতই পারছে না, বুড়ি ততই খ্যান-খ্যান করে খেঁকিয়ে উঠছে।

টোরা এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। তারপর চুপিসারে বুড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল/ হয়তো কিছু ভাবল। ওর মাথায় তখন কী বুদ্ধি খেলছে, ও ছাড়া আর কেউ জানে না। আর তাই বুড়ি যখন আবার বাদশাকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল, টোরা করল কী, দু-হাত দিয়ে বুড়ির কোমরটা তেড়েমেড়ে টিপতে লাগল। বাদশা জানতেও পারল না, পাশে তার দিদি। তার সঙ্গে দিদিও বুজির কোমরে তেল মালিশ করছে।

কী খুশি বুড়িটা/ আরামে কুঁদ হয়ে বললে, ‘এই তো ভাল ছেলের কাজ| লক্ষ্য করে আমার সেবা-যত্ন কর, খেতে দেব, পরতে দেব। তবে হ্যাঁ, বেয়াড়াপনা করলেই কিন্তু মুণ্ডপাত করব।’

টোরা শুনছে বুড়ির কথা।

বুড়ি আবার নিজের মনেই বিড়বিড় করতে শুরু করলে, ‘এমন উদ্ভুটি কাণ্ড কখনো দেখিনি। আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, কিন্তু পিলসুজের পিদিম যে এমন ভড়কি মেরে আকাশে ওড়ে, এই পেখম দেখলুম/ উঃ/ একটা আস্ত সোনার পিদিম/ এখন আমি কী করব, বেচব না রাখব? না, বেচব না, রাখব/ পয়মন্ত প্রদীপ যখন ধরা দিয়েছে, তখন কে জানে, ভাগ্যে আমার আরও কী আছে/’।

বুড়ি এবার আয়েশ তরতাজা হয়ে বললে, ‘বাঃ, ছেলেটা তো বেশ দলাই-মলাই করতে পারে/

 টোরা মনে-মনে বললে দাঁড়াও, তোমার আয়েশ করাচ্ছি/’ বলেই টোরা হঠাৎ বুড়ির কোমরে এমন কাতুকুতু দিয়ে দিলে যে, বুড়ি একেবারে হাসতে-হাসতে যায় আর কী/ বুড়ি খিলখিলিয়ে হেসতে হাসতে চিৎকার করে উঠল, ‘এই ছাড়, ছাড়।

টোরা ছেড়ে দিল। বুড়ির হাসি থামল। দেখেশুনে বাদশা তো একদম হাঁদা/ বাদশা ভাবল, তাই তো, হলটা কী/ বুড়ি এমন পাগলের মতো হাসে কেন?

কাতুকুতুর রেশ জুড়াতে তো আর সময় লাগল না/ এবার দ্যাখো, বুড়ির মুখের ছিরি/ রেগে কাঁই/ রাগটা দপ করে জ্বলে উঠতেই বুড়ি খপ করে বাদশার চুলের মুঠি ধরল। তেড়েমেড়ে বলে উঠল, ‘একরত্তি ছেলে গালা টিপলে দুধ বেরোয়, আমার সঙ্গে ফুককুড়ি/ আমায় তুই কাতুকুতু দিস/ আমি তোর ঠাট্টার যুগ্যি/’ বলে চুলের মুঠি ধরে এমন নাড়ানাড়ি করে দিলে যে, বাদশার প্রাণ বুঝি গেল-গেল/ তারপর বুড়ি বাদশার চুল ছেড়ে খেঁকিয়ে উঠে বললে, ‘কুয়ো থেকে জল তোল, আমি চান করব।’

বাদশা এতক্ষণে কথা বললে, ‘পাতকুয়োর জল অনেক নীচে।’

নীচে থাকবে না তো কি তোমার মাথার ওপর থাকবে?’ বুড়ি তেমনি তিরিক্ষি হয়েই বললে। ‘অত নিচু থেকে জল তুলতে আমি পারব না।’

আর দেখতে/ বুড়ি গলার সুর পঞ্চমে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার মুখের ওপর চাটাং-চাটাং কথা/ হাড়বজ্জাত ছেলে/ পারব না/ তোল জল/’

বাদশা তখন কী করে, অগত্যা কুয়োর কাছে এসে, দড়ি বাঁধা বালতিটা সড়াত করে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিলে। বালতি জলের মধ্যে গোঁত্তা খেয়ে ভরতি হয়ে গেল। ভরতি তো হল, কিন্তু আর টেনে তুলতে পারে না বাদশা/

কিন্তু বাদশা তো জানে না, তার দিদি তার পাশেই দাঁড়িয়ে/ বাদশা বালতি-বাঁধা দড়িটা টানতে-টানতে যখন হিমশিম, তখন হঠাৎ বাদশার মনে হল, দড়ি টানতে এখন তো বেশ হালকা লাগছে/ বালতি যেন আপনা থেকে উঠে আসছে। কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো তার/ অবাক হয়ে গেল বাদশা/

 অবাক হবার তো কিছু নেই/ বাদশার দিদিও যে টেনে তুলছে বাদশার সঙ্গে দড়িতে হাত দিয়ে, এ তো আর সে জানতে পারছে না। বাদশা কেমন জল তুলে, বালতি নিয়ে সটান বুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল/ বুড়ি ততক্ষণে কুয়োতলায় হাজির। মাথায় তেল চাপড়াতে-চাপড়াতে বললে, ‘ঢাল।’

হুশ/ বাদশা বুড়ির মাথায় জল ঢেলে দিল।

বার-বার তিনবার। তিন বালতি জল ঢেলে, যখন চার বালতি ঢালবে, তখন টোরার মাথায় একটা দুষ্টু মতলব জুড়ে বসল। টোরা করল কী, কুয়োর জলে বালতিটা ডুবিয়ে, একেবারে যখন খুব গভীরে নেমে গেল বালতিটা, তখন টেনে তুলল। কুয়োর খুব গভীরে তো পেঁকো-জল/ সেই পেঁকো-জলের জলটুকু ফেলে, পাঁক ভরতি বালতিটা ওপরে তুলে আনল। অবিশ্যি কষ্ট হল খুব/ টেনে তুলেই হুশ/ একেবারে বুড়ির মাথায় ঈশ/ এ যে সেই দোলখেলার ছ্যাররা-র‍্যাররা/ বুড়ির মাথায় পাঁক, মুখে পাঁক/ বুড়ির সববশরীরে পাঁকে পাঁকে পাঁকাক্কার/ ম্যাগো মা/ কী যাচ্ছেতাই গন্ধ/

বুড়ি তো গন্ধের চোটে নাকে আঙুল টিপে এই বমি করে তো সেই বমি করে। বুড়ি ওয়াক থু ওয়াক থু করতে-করতে পাড়া মাত করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হতচ্ছাড়া ছেলে/ আমার গায়ে তুই পাঁক ঢাললি/ আয়, তোকে কুয়োয় পুঁতি।’ বলে বুড়ি যেই বাদশাকে ধরতে যাবে, অমনি টোরা করেছে কী, পেছন থেকে বুড়ির ঠ্যাং ধরে দিয়েছে টেনে/ বুড়ি সড়াত/ একেই তো পাতকো-তলায় শ্যওলা। তার ওপর কুয়োর পাঁক/ আর দেখতে/ বুড়ি ডিগবাজি খেয়ে সেই জলে-পাঁকে জ্যান্ত সাপের মতো কিলবিল করে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি লাগিয়ে দিলে/ ভয়ে বাদশা কেঁদে উঠল, ‘আমি করিনি।’

কিন্তু কে শুনছে সে-কথা/ বলি, বুড়িটা কি চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে/ দেখতে পাচ্ছে না বাদশা তার সামনে দাঁড়িয়ে/

সে আর কে দেখে/ বুড়ি কোঁকাতে-কোঁকাতে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বাদশার ঘাড়ে-পিঠে দে দমাদ্দম। বাদশা কেঁদে উঠল। বুড়ি খ্যানখ্যানে গলায় তেড়ে উঠল, পাজি ছেলে, শয়তানি করার জায়গা পাসনি/ আয় তোকে যমের ঘরে দিয়ে আসি।’ বলে বাদশার কানটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগল। টানতে-টানতে একটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘরে ঠেলেমেলে ঢুকিয়ে দিয়ে, ঘরের দোরে শেকল তুলে দিল। বললে, ‘থাক এইখানে। পড়ে-পড়ে যত পারিস কাঁদ। যমে এসে নিয়ে গেলে তবে ঘরের দোর খুলব।’ বলে বুড়ি গজগজানি আর গাল-পাড়ানির সে কী ছি-চি কাণ্ড/

.

অন্ধকার ঘরে, এক কোণে বাদশা লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে আর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে গজরাচ্ছে, ‘অ্যাঁ-অ্যাঁ। আমায় শুধু-মুধু মারতে এসেছে। নিজে পা পিছলে পড়ে গেল, আবার কথা বলছে/ গায়ের জোর দেখাবার জায়গা পায়নি। দিদি যদি থাকত, তোমার জোর দেখান ঘুচিয়ে দিত।

তা সে-কথা তো আর বুড়ি শুনতে পাচ্ছে না। রেগে ফোঁসফোঁসিয়ে বুড়ি তড়িঘড়ি ক-বালতি জল ঢেলে, গায়ে ল্যাপটানো পাঁক ধুয়ে ফেললে। তারপর চিঁড়ে-মুড়কির ফলার চটকে গপগপ করে গিলতে বসল। গেলা-টেলা হলে, আবার দেরাজের চাবি খুললে। চুপি-চুপি প্রদীপটা বার করে, পাঁশুটে চোখ ড্যাবডেবিয়ে দেখতে লাগল। কী লোভ দ্যাখো বুড়ির চোখ দুটোতে/ দেখতে-দেখতে নিজের মনেই বলল, ‘বলি তোর তো ডানা নেই, ঠ্যাং নেই। তা কেমন করে ফুরফুরিয়ে উড়ছিলি বাছা? দেখিস আবার যেন উড়ে পালাস না/ বলে প্রদীপটাকে আদর করার সে কী বহর ছিরি/ আদর করে নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে চুমু খেলে, ‘সোনা আমার, মানিক আমার।’ আহা/ দ্যাখো কেমন রোশনাই ঝকঝকাচ্ছে প্রদীপের গা বেয়ে/ মুছে-টুছে, আবার দেরাজের মধ্যে যত্ন করে রেখে দিয়ে দেরাজের চাবি এঁটে রাখলে। তারপর নিজের কাপড়ের খুঁটে সেই চাবির তাড়া বেশ করে বেঁধে, চ্যাটাই বিছিয়ে, একটা তেল চিটচিটে বালিস মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল। আঃ/ তখন পাতকো-তলায় পড়ে গিয়ে কোমরে যা লেগেছে না/ ব্যথাটা এখনও টনটনাচ্ছে। বুড়ো হাড় তো/ বুড়ি টনটনে ব্যথা নিয়ে একবার এপাশ একবার ও-পাশ করতে করতে ভাবতে লাগল সোনার প্রদীপটার কথা। তাই তো, এখন সে সোনার প্রদীপটা নিয়ে কী করবে/ বাজারে বেচে আসবে, না প্রদীপ ভেঙে একটা বিছে হার গড়াবে/ হুঃ. খেপেছ/ এ প্রদীপ কখনো ভাঙে, না বেচে/ এ বাবা কপালের ধন। কপাল না ফিরলে এমন ধারা ঘটনা ঘটে কখনন/ এ সব ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছে। তারপরই বুড়ি চোখ দুটো কপালে তুলে বললে, ‘আহা ঠাকুর, তুমি বাঁচালেই আমি বাঁচি।’ বলে, কেঠো-কেঠো হাত দুটো ঠকাস করে কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরকে নমস্কার করল।

হঠাৎ বুড়ির মনে হল, আচ্ছা আমি প্রদীপটা নিয়ে তো পাঁচজনকে ভেলকি দেখাতে পারি। আরে বাবা, এ কী শুধু প্রদীপ/ এ যেন সেই ডানাকাটা উড়ুক্কু পাখি। হাওয়ায় ছেড়ে দাও, ফুরফুর করে উড়তে শুরু করে দেবে। ওঃ/ সে যা হয় না/ যে দেখবে তারই চক্ষু চড়কগাছ/ ধরো, হাটের লোক দেখল। তারপর মনে করো না মাঠের লোক দেখল। শহরগঞ্জের লোক দেখল। তারপর মনে করো, আমার খুব নাম-ডাক হল। পয়সা কড়ি হল। ধরো, এই ভাঙা বাড়িটা মস্ত বাড়ি হয়ে গেল। অনেক ঝি-চাকর হল। হাতি-ঘোড়া হল। আরিববাস/ তখন আমায় দেখে কে/ মখমলের গদির ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে গড়াগড়ি খাব আর হাই তুলব। তখন যদি রাজার ব্যাটা এসেও আমার পায়ে ধরে সাধাসাধি করে, বলে, ‘ঠাকমা, ঠাকমা, প্রদীপটা একবার দেখাও’ ভেবেছ আমি গলে যাব? উঁহু/ সেটি হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, রাজা যদি নিজে এসে কান্নাকাটি করে, তখন না হয় দেখা যাবে কিন্তু তখন কি আমি ছেড়ে কথা বলব/ কেন ছাড়তে যাব/ বলো, আমার ক্ষেমতা রাজার চেয়ে কম কীসে? রাজা, রাজবাড়িতে রাজা/ আর আমি? আমার আছে সোনার পিদিম। ডানা নেই, ঠ্যাং নেই, অথচ হাওয়ায় উড়ছে/ এমন ধন রাজার আছে/ আর দেখতে চাইলেই কি আমি রাজাকে দেখাচ্ছি/ আগে রফা হোক। রাজা যদি বলে অর্ধেক রাজত্ব দেব? ফুস, ওতে, টলব আমি? তারপর যদি বলে, অর্ধেক রাজকোশ দেব? নিতে বয়ে গেছে আমার একটুও নড়ছি না। যদি বলে, হাতি দেব, ঘোড়া দেব, ময়ূরপঙ্খি নাও দেব? আমি সঙ্গে-সঙ্গে হেসে উঠব। তখন যদি রাজা রেগেমেগে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলে ওঠে, তবে তোমার কী চাই? তখন আমি বলতে ছাড়ব, আমার গোটা রাজত্ব চাই। তারপর রাজত্বটা আমার হাতে তুলে দিলে, আমি ফিকফিক করে হাসব আর বলব, সবই ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছে/ তখন কি আর কোমরের এই ব্যথা মালিশ করার জন্যে তোক খুঁজতে হবে? তখন তো খোদ রাজবাড়ির রানিই আমার খাসমহলের দাসী। দাসী যখন পায়ের কাছে নত হয়ে বলবে, মাসি, মাসি, তোমার জন্যে দাওয়াই এনেছি কাসির। তখন আমি গম্ভীর গলায় বলব, কোথাকার দাসী রে তুই? কে বললে আমার কাসি/ তখন দাসী নিশ্চয়ই ঠকঠক করে কাঁপবে ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে তখন দাসী আবার জিজ্ঞেসা করবে, মাতা, মাতা, তোমার ধরেছে বোধ হয় মাথা? তখন আমি ধমকে উঠে বলব, তুই একটা যা-তা। দেখতে পাচ্ছিস না, আমার কোমরে ব্যথা? মালিশ কর। তখন আমি মখমল বিছানো সোনার পালঙ্কে মটকা মেরে পড়ে থাকব, আর দাসী আমার সেবা করবে/ ওঃ/ সে কী আরাম/ বলে যেই না বুড়ি আনন্দে হাত-পা ছুঁড়ে তড়াং করে উঠে বসতে গেছে, ব্যস/ বুড়ির কোমরে লেগেছে হ্যাঁচকা/ উঁহু-হুঁ-হুঁ/ বুড়ি যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল। তারপর চাটাইয়ের ওপর কাতরাতে কাতরাতে আবার বাদশাকে গাল পাড়তে লাগল।

কিন্তু বাদশা? ভাগ্য মন্দ না হলে ও কখনো এই বুড়ির পাল্লায় পড়ে সেই ঢলঢলে প্যান্ট পরা জন্তুমুখো মানুষগুলোর খপ্পর থেকে বাঁচতে গিয়েই তো আজ এই বিপদ। দোষের মধ্যে কী, না জন্তুগুলোর তাড়া খেয়ে বাদশা ভয়েময়ে বুড়ির ঘরে ঢুকে লুকিয়ে পড়েছিল। তাই বলে বুড়িটা তাকে একেবারে চোর ঠাওরাবে/ অবিশ্যি এ-কথা সত্যি, বাদশা বুড়িকে জিজ্ঞেস করে তার ঘরে ঢোকেনি। ঠিক আছে, মানলুম বাদশার দোষ। কিন্তু তাকে চোর ঠাওরাবার আগে, জিজ্ঞেস তো করবি, কী হয়েছে তার। ভালো রে ভালো, সে সব জিজ্ঞেস করা নেই, উলটে কোন আক্কেলে বুড়ি বাদশার ঘাড়ে জোয়াল চড়িয়ে গাড়ি টানায়/ তা বলি, লাজ-লজ্জা বলে তো একটা কথা আছে। না কি বুদ্ধিসুদ্ধিও লোপাট হয়ে গেছে বুড়ির মগজ থেকে। একেই বলে মরণদশা/

বলবেই তো/ তিন কুলে তো বুড়ির কেউ নেই। থাকার মধ্যে এই ভাঙা-ফুটো বাড়িটা আর ছারছ্যারে গাড়িটা। তাও বা কী। এতদিন তো গাড়িটা মুখ থুবড়ে পড়েই ছিল। বুড়ির কাঁখে যে-দিন বাতের ব্যথা ধরল, সেদিন থেকেই চিন্তা। সেদিন থেকেই উনি খোয়াব দেখছেন। আর দেখতে-দেখতে ভাবছেন, আহা রে, একটা যদি ঘোড়া থাকত, তবে গাড়িতে জুতি। গাড়ি চেপে হাওয়া খাই, আরাম করি। মাটিতে পা ফেললে কাঁখে লাগে। ঠ্যাংয়ে-ঠ্যাংয়ে ঠোক্কর লেগে ভারি রাজ্যে তা ঘোড়া ছেড়ে একটা ভেড়াও কি বুড়ির ঘরের ধারে কাছে আসে/ জন্মাবার সময় মা বোধ হয় মুখে মধু দিতে ভুলে গেছল। নইলে মশায়, অমন মুখ হয়/ কাছে-পিঠে কাউকে দেখেছে কি, ব্যস/ আর রক্ষে নেই। মুখে যেন তুবড়ি ফুটছে। তাও যদি জানতুম বুড়ির ঘর ভরতি টাকাকড়ি, গয়না-গাটি ঝনঝন করছে/ তবেই হয়েছে। সে-কথাটি ভুলে যাও। টাকা থাকলেও কি বুড়িকে দেখে তুমি বুঝতে পারবে/ কেননা, তিনি পরেন ছেঁড়া কাপড়। তিনি খান চিড়ে-মুড়কি। আর তিনি শোবেন ছেঁড়া চাটাইয়ে। এক নম্বরের কঞ্জুস। আমায় বলতে হবে কেন, সে তো তোমরা নিজেরাই দেখলে। নিজে গাণ্ডে-পিণ্ডে গিলল, কিন্তু কই, বাদশাকে একটু দিল/ বয়ে গেছে। নিজের নিয়েই বুড়ি মত্ত। নিজের হলেই ইচ্ছে। নিজে খাব, নিজে পরব, নিজে গাড়ি চড়ব। অন্যে মরলে বুড়ির কী/

আর এদিকে বাদশা যে কী করে রক্ষে পেয়েছে সেই জন্তুমুখো মানুষগুলোর হাত থেকে, তা সে নিজেই জানে। ও তো ভেবেই পায় না, অত করে ডাকতেও দিদি কেন একবারও ফিরে তাকাল না। কী বলে দিদি তাকে এই বজ্জাত লোকগুলোর হাতে ফেলে পালাল/ কী কুচ্ছিত তাদের মুখগুলো/ হিংসুটে চোখগুলো যেন লোভে জ্বলছে/

 কিন্তু দিদির যে কোনো দোষ নেই, বাদশা যে তার মুখ দেখলে জন্তু হয়ে যাবে, সে তো আর বাদশা জানে না। না পালিয়ে কী করবে দিদি?

ওই জন্তুমুখো মানুষগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে বাদশাও কী কম চেষ্টা করেছে/ কেননা, ওরা বাদশার চেয়ে অনেক বড়। লম্বা-লম্বা পা ফেলে বাদশাকে ধরা এমন কী শক্ত কাজ/ ভাগ্যিস জায়গাটা ঝোপে-ঝাড়ে ভরতি ছিল। বাদশা ওদের তাড়া খেয়ে এক ফাঁকে ঝুপ করে ওই ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল, তারা দেখতেও পেলে না। তন্নতন্ন করে খুঁজে সেই জন্তুমুখো মানুষগুলো একেবারে হদ্দ হয়ে গেল। তারপর সন্ধে যখন হয়ে গেল, তখন অন্ধকারে শিকার ভোকাট্টা/ বাঁচবার জন্যে, একেবারে বুড়ির ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকে লুকিয়ে পড়েছিল বাদশা। কিন্তু ধরা পড়তে তো আর সময় লাগেনি। বয়েস হলে কী হবে/ সেই অন্ধকার রাত্তিরেও বুড়ির চোখ জ্বলছে। বুড়ি বাদশাকে দেখে ফেলেছে/ তেড়ে উঠল, ‘কে রে, ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে?’

বাদশা প্রথমটা থতমত খেয়ে চমকে উঠেছিল। তারপর বুড়িকে দেখে ওর যেন ধড়ে প্রাণ এল। বলল, ‘আমাকে চোরে তাড়া করেছে/”

বুড়ি কোথায় ওই ছোট্ট ছেলেটার কথায় বিশ্বাস করে ওকে আশ্রয় দেবে, তা নয়, উলটে বলে কী, ‘তোকে চোরে তাড়া করেছে, না তুই নিজে চোর?’ বলে বুড়ি ক্যাঁক করে বাদশার ঘাড়টা খাবলে ধরলে।

বাদশা কাকুতি-মিনতি করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি চোর না, চোর না, আমি বাদশা/”

বুড়ি উত্তর দিল, ‘ঠিক কথা। যারা চোর, তারাই বাদশা। চ, তোকে পুলিশে দেব।’

বাদশা বললে, ‘বিশ্বাস করো, আমি চোর নই।’

 চোরকে কে বিশ্বাস করে? তাই বুড়ি বাদশার ঘাড়টা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করলে, বল, কী চুরি করেছিস? দেখি তোর পকেট/’।

বাদশা পকেট দেখাল। ট্যাঁক দেখাল। হাত দেখাল। কিচ্ছু পেল না বুড়ি। তাহলে আর চটবে না? তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বুড়ি বলল, ‘বল, কোথায় রেখেছিস চোরাই মাল/’

‘চুরি করিনি।’ উত্তর দিলে বাদশা।

 ‘চ তবে/’

‘কোথায়?’

 ‘পুলিশে/

বাদশা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘না, আমায় পুলিশে দিয়ো না। পুলিশ বড়ো মারে।’

বলতেই বুড়িটা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বললে,

আহা মরি, ডালের বড়ি
 শুক্ত দিয়ে খাই,
চোরের ব্যাটা ভয় পেয়েছে
হেসেই মরে যাই/

ছড়া-পড়া বুড়ির ফোকলা দাঁতের দিকে বাদশা হাঁ করে তাকিয়ে রইল ঠায় একদৃষ্টে। হঠাৎ যেন বাদশার মনে হল, বুড়ির চোখের ভেতর একটা কুমতলব কিলবিল করে ঘুরপাক খাচ্ছে।

হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। বুড়ি বাদশার মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘পুলিশে যদি না যেতে চাস, তো আমার সেবা কর। ঘর-কান্নার কাজ করতে পারিস?’

বাদশা জিজ্ঞেস করলে, ‘কী কাজ?’

 ‘বাসন মাজতে পারিস?’

বাদশা উত্তর দিলে, ‘কোনোদিন মাজিনি।

‘বাটনা বাটতে?’

 ‘কোনোদিন বাটিনি।’

 ‘ফল কুটতে?’

 ‘কোনোদিন কুটিনি।’

 ‘জল তুলতে?’

‘কোনোদিন তুলিনি।

 ‘গাড়ি চালাতে?’

 গাড়ির নাম শুনেই বাদশার চনমন করে উঠল। ঠিক কথা/ তখন বুড়ির ঘরের দোরগোড়ায় একটা এক্কা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে বাদশা। ভাবল, সেই এক্কা-গাড়িতে ঘোড়া জুতে ওকে হয়তো হ্যাট-হ্যাট করে চালাতে হবে। আর কিছু না হোক, পুলিশের ঘর করার চেয়ে সে অনেক ভালো। তাই আর দোনোমনো না করে সে ঝট করে বলে বসল, ‘হ্যাঁ, পারি।’

 বললে তো পারি। কিন্তু বুঝতে তো পারেনি, ঘোড়া না আর কিছু। বুড়ি ঘোড়ার বদলে তার ঘাড়েই গাড়ি জুতে, তাকে দিয়েই গাড়ি ঠেলাবে। কী নিষ্ঠুর বুড়ি দ্যাখো/

রাত এল। এতক্ষণ টোরার যে কী কষ্টে সময় কেটেছে, তা ভগবানই জানে/ এতক্ষণ টোরা বোবার মতো চুপচাপ সব দেখেছে। দেখেছে, বুড়িটা নিষ্ঠুরের মতো মারতে মারতে তার ভাইকে ঘরের মধ্যে ফেলে দিয়ে শিকল তুলে বন্দি করে রেখেছে/ দেখেছে, বুড়িটা একলসেঁড়ের মতো নিজে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলেছে, কিন্তু ভাইকে একফোঁটা জলও দেয়নি। দেখেশুনে কী কষ্ট যে হয়েছে টোরার, তা সে-ই জানে। কিন্তু টোরা আর কী করবে/ ওর আর কতটুকু ক্ষমতা বললা/ ও যেন এই রাতটুকুর জন্যেই সময় গুনছিল। ভেবেছিল, এই রাতের অন্ধকারে ওর আদরের ভাইটির কাছে সে যাবে। সে তার চোখের জল মুছিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগে তো প্রদীপটা আবার ফিরে পেতে হবে/ মুশকিল, সেটা যে দেরাজে চাবি এঁটে লুকিয়ে রেখেছে বুড়ি/ তা হলে?

 সারাক্ষণ বুড়ি চাবিটা আঁচলেই বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু রাত্তিরে শোবার সময় বুড়ি সেই চাবি আঁচল থেকে খুলে বালিশের তলায়, মাথার নীচে লুকিয়ে রাখল। সেটা স্পষ্ট দেখেছিল টোরা। দেখলে কী হবে/ এখন সেটা পাবে কী করে টোরা?

টোরা জানে, যদিও বুড়ি তাকে দেখতে পাচ্ছে না, তবু হুট করে কিছু না করাই ভালো। বুড়ি যদি একবার টের পেয়ে যায়, তাহলে সব মতলব ভেস্তে যাবে। বরং ঘুমিয়ে পড়ুক, তারপর যা করবার করবে টোরা।

 অবিশ্যি ঘুম পাড়াবার জন্যে, বুড়িকে তো আর ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে হবে না। বিছানায় শুয়ে পড়ে একবার এপাশ, আর একবার ওপাশ করেই তিনি নিদ্রা গেলেন। বাবা/ নাক ডাকানির বহর দ্যাখো/ যেন বর্ষার জলে কোলা ব্যাঙ গাল ফুলিয়ে ভ্যাঙাচ্ছে/

এই তাল। টোরা চুপচাপ তার অদৃশ্য হাতটা বুড়ির বালিশের তলায় সেঁদিয়ে দিলে। বালিশটা নড়ে গেছে/ এই রে/ টোরা চটপট হাতটা সরিয়ে নিলে বালিশের তলা থেকে। না, তেমন কিছু ভয় পাবার মতো কাণ্ড ঘটল না। বুড়ি শুধু এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে শুল। একটু পরে বুড়ি আবার ঘুমে অচৈতন্য/ এবার আর ব্যাঙের ভ্যাঙচানি নয়। বুড়ির নাকে ভিমরুলের ভ্যানভ্যানানি/

আবার হাত বাড়াল টোরা। আবার হাত সেঁদিয়ে দিল বালিশের নীচে। এবার খুব সামলে। বালিশ যেন না নড়ে/ তা বললে কে শুনছে। বালিশ নড়বেই। নড়ক। তবু রক্ষে, এবার বুড়ির নাকডাকানি থামেনি/ একেবারে মড়ার মতো নেতিয়ে পড়েছে বুড়ি। সেই তকে নিঃসাড়ে চাবিটা বালিশের নীচ থেকে বার করে আনল টোরা। কিছু বুঝতেই পারল না বুড়ি।

দেরাজ খুলে ফেলল টোরা। সামনেই প্রদীপ। হাত বাড়াতেই প্রদীপ ওর হাতের মুঠোয়।

প্রদীপ পেয়েই টোরা তাড়াতাড়ি আবার বন্ধ করে দিলে দেরাজটা। যদি বুড়ির আচমকা ঘুম ভেঙে যায়/ বলা তো যায় না/ বন্ধ করেই চাবির গোছাটা বুড়ির পাশেই রেখে দিল। কারণ বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে বুড়ির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে আর সাহস নেই টোরার। প্রদীপ নিয়ে টোরা ছুটল ভাইয়ের কাছে।

ঘরে বন্দি তার ভাই। দরজায় শিকল তোলা। এত উঁচু, হাত যাবে না টোরার। হাত যে যাবে না, টোরা সে আগেই জানে। তাই কেমন করে ঘরের শিকল খুলবে, সে বুদ্ধি আগেই ঠাউরে রেখেছিল টোরা। টোরা কুয়ো-তলায় ছুটল। বুড়ির চান করার বালতিটা খুঁজে বার করলে। নিয়ে এল সেটা ওই বন্ধ ঘরের সামনে। উপুড় করে তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত বাড়াল। টোরার হাতের নাগালে দরজার শিকল। শিকল খুলে ফেললে। ঘরে ঢুকে গেল টোরা।

ভাই তার ঘরের মেঝের ওপর পড়ে আছে। ঘুমোচ্ছে। নিশ্চুপ, নিঃসাড়। আহা/ কী চেহারা হয়েছে বাদশার। মুখখানা শুকিয়ে যেন এইটুকু হয়ে গেছে।

টোরা থাকতে পারল না। এত অনাদর তো তার ভাইকে কেউ কোনোদিন করে না। এত কষ্ট বাদশা কখনো সইতে পারে/ তাই সে আলতো হাতের ছোঁয়া দিয়ে ভায়ের কপালের চুলগুলি সরিয়ে দিল। একটি চুমু খেল ওর কপালে। তারপর কান্নার জল ছলছলিয়ে উপছে গেল টোরার দু-চোখে।

তারপর আপন মনে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘বাদশা, তুই আর আমায় দেখতে পাবি না রে। অসাবধানে ঠাকুরের প্রদীপ নিভিয়ে ফেলে আমি যে অদৃশ্য হয়ে গেছি। আমায় আর কেউ-ই দেখতে পাবে না। আমি যতদিন না ফুলের কান্না খুঁজে পাব, যতদিন না সেই কান্নার জল দিয়ে প্রদীপ জ্বালতে পারব, ততদিন যে আমি অসহায়/ আমার যে সব হারিয়ে গেছে বাদশা। কে জানে, আমি কোথায় সে-ফুল পাব, যে কাঁদে।’

হঠাৎ এত হাওয়া আসে কেন ঘরের দরজা ঠেলে? ঝড় উঠল নাকি বাইরে?

না তো। হাওয়া শুধুই বয়ে যায়। যেতে-যেতে যেন কথা কয়/

চমকে উঠল টোরা। সত্যিই তো। হাওয়া যেন টোরার কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায়, ‘ওই তো ফুল কাঁদছে, ওই তো ফুল কাঁদছে/’।

টোরা আপন মনেই জিজ্ঞেস করে, ‘কই তো ফুল কাঁদছে?’

হাওয়া হু-হুঁ শব্দে বইতে-বইতে বললে, ‘চোখ থাকলেই দেখতে পাবে, দেখতে পাবে, দেখতে পাবে।

টোরা তখন দু-চোখ মেলে ঘরের অন্ধকারে ফুল খুঁজতে লাগল।

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে টোরা। ওর চোখের তারা দুটি স্থির হয়ে চেয়ে রইল বাদশার চোখের দিকে।

অমনি হাওয়া খিলখিল, খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বললে, ‘হ্যাঁ, ঠিক দেখেছ, ঠিক দেখেছ। ওই তো ফুল, কান্না ফুলের/’

ঠিক তক্ষুনি টোরার যেন মনে হল, বাদশার কান্নার জল, অন্ধকারে ঝলমল করে একটি একটি মুক্তার মতো গড়িয়ে-গড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

টোরা বললে, ‘ও তো আমার ভাই, বাদশা/

হাওয়া উত্তর দিলেঃ

যার মনে পাপ নেই,
দ্বেষ নেই, দোষ নেই,
 রাগ নেই, রোষ নেই,
তার নাম রং/
 যার রঙে আলো আছে,
হাসি আর খুশি আছে,
 সুর-ভরা বাঁশি আছে,
তার নাম ফুল।

 ‘সত্যি।’ বুকের আনন্দ চেপে রাখতে পারল না টোরা হাওয়ার কথা শুনে।

হাওয়া বললে, ‘সত্যি, সত্যি, সত্যি/’ বলতে-বলতে হাওয়া দোর ডিঙিয়ে, ঘর ছাড়িয়ে নাচতে লাগল।

আর টোরা? খুশিতে হাত বাড়িয়ে বাদশার চোখের জল সোনার প্রদীপে ভরে নিল। ভরে নিয়ে বাদশার চোখ দুটি মুছে দিল। তারপর শেষবারের মতো ওর মুখটি দেখতে-দেখতে আনমনা হয়ে যায় টোরা। নরম গলায় ডেকে ওঠে ‘বাদশা।’

 ঘুমন্ত বাদশা চমকে উঠেছে। চোখের ঘুম তার ছুটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল। কে ডাকল তাকে? এ যেন তার দিদির গলা/ বাদশাও ডাক দিল, ‘দিদি।

বাদশার ডাকে কে সাড়া দেবে/ ততক্ষণে দিদি ঘর ছেড়ে বাইরে। সে যখন ফুলের চোখের জল পেয়েছে, তখন এই অন্ধকার রাত্তিরেই তাকে যেতে হবে ওই পাহাড়ের চূড়ায়। মন্দিরে। এ প্রদীপ তাকে জ্বালাতেই হবে। নইলে সে যে কিছুই ফিরে পাবে না।

‘দিদি’ ব্যাকুল হয়ে ঘর থেকে ডাকতে-ডাকতে বেরিয়ে এলে বাদশা। কিন্তু দিদির দেখাও পেল না। দিদি সাড়াও দিল না।

আবার চেঁচাল বাদশা, ‘দিদি, আমি এখানে।’

 ডাকতে-ডাকতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে বাদশা।