টোরা আর বাদশা – ১

টোরা আর বাদশা – শৈলেন ঘোষ

কে জানত যে খাঁচার দরজাটা খুললেই পাখিটা অমন আচমকা উড়ে পালাবে/ আজ যে পাখিটা তক্কেতক্কে ছিল, সে-কথা ঘুণাক্ষরেও টোরা জনাতে পারেনি/পাখি পেটে-পেটে কী বুদ্ধি কেঁদে রেখেছে, তা মানুষে জানবে কেমন করে/ পালাবি, পালা, কে বারণ করছে/ তাই বলে টোরার হাতের ফাঁক দিয়ে/ কে বলেছিল ওই ছোট্ট মেয়েটাকে অমন বিপদে ফেলতে/

 অবশ্য টোরার কোনো দোষ ছিল না। সকাল থেকে নতুন মায়ের হুকুম শুনেতে শুনতে যেন আর শরীর বইছে না। ভারি ক্লান্ত। আজ সে ভারি আনমনা। কোন সকালে সে বাদশাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। তারপর ঘর পরিষ্কার করেছে। বাসন মেজেছে। দোকান ছুটেছে। বাদশার জামা কেচেছে। কাজের কি আর শেষ আছে। এত কাজ ওই একফোঁটা মেয়ে যে মুখ বুজে করতে পারছে সেইটাই বাহাদুরি। কাল বাবা বাদশার জন্যে একটা রঙিন ছবির বই কিনে দিয়েছে। কী সুন্দর বইটা। কত ছবি। একটা ছবি অবশ্য বাদশা ওকে দেখিয়েছে। এক পেটমোটা ডোম্বল সর্দার তরোয়াল নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে দুম-ফট/ পা পিছলে আলুর দম/ ছবিটা দেখে কী হাসিই না পাচ্ছিল টোরার। কিন্তু সব ছবি তো আর দেখা হয়নি। হয়তো পাতায়-পাতায় আরও কত মজার মজার ছবি আছে। কখন থেকে ভাবছে বইটা দেখবে, এখনও পর্যন্ত ফুরসুত পেল না। টোরার ভারি ইচ্ছে, অনেক পড়বে সে। অনেক পড়তে-পড়তে ও ছোট্ট ভাই বাদশাকে দেখাবে রাতের অন্ধকারে নীল আকাশের কোন পারে সপ্তঋষি তারার আলো জ্বেলে ধ্যান করছেন। নয়তো কোন পথটি পেরিয়ে-পেরিয়ে চাঁদের দেশে মানুষ যাচ্ছে। কিংবা শীতের ভোরে কোন পাখিটি অনেক পাহাড় অনেক বন পাড়ি দিয়ে এই বনেতে বাসা বেঁধে গান গাইছে/

 সে না হয় হল। বই না হয় না-ই দেখা হল। কিন্তু পাখিটি যে উড়ে পালাল, তার কী হবে/ রোজ সকালে টোরা পাখিকে চান করাবে। খাঁচাটা পরিষ্কার করবে। একবাটি ছাতু দেবে, খাবার জল দেবে। তারপর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আদর করে বলবে, ‘পাখি, পাখি, বলো তো বাদশা-দাদা ঘরে এসো, আমার কাছে একটু বসো।” কিন্তু পাখি ছাতু খাবে আর টোরার দিকে চেয়ে-চেয়ে ল্যাজ নাড়বে/ কথা বলবে না/ কথা বলে না বলে টোরা ধমক দেয়, পাখি অমনি খাঁচার ভেতর ঝটপটিয়ে কপচায়। কিন্তু আজ পাখি ফুড়ত/ অবশ্যি টোরা যে চেষ্টা করেনি, তা নয়/ ধড়ফড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেছল পাখিটাকে/ কিন্তু ফোক্কা/ পাখি পগারপার/ উলটে টোরার হাতে ঠ্যালা খেয়ে খাঁচাটা গোঁত মেরেছে। ছাতুর বাটি ছিটকে ছড়িয়ে নৈরেকার/

নতুন-মা তো আর কালা নয়/ শব্দ শুনেই চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘কী হল রে টোরা?’

 নতুন-মায়ের মুখখানা চোখে ভেসে উঠতেই ভীষণ ভয়ে কেঁপে উঠল টোরার বুকখানা/

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে নতুন মা, ‘কী ফেললি, কী?’

টোরার মুখে রা নেই। খাঁচাটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কাঁপছে সে/

 টোরার মুখে রা না-থাক, নতুন মায়ের চোখে তো আর ঠুলি বাঁধা নেই। ছিটকে-পড়া খাঁচাটার হাঁ-করা দরজটা দেখলে কাণ্ডটা যে কী হয়েছে, সে তো আর জানতে বাকি থাকে না। চিৎকার করে আঁতকে উঠেছে। নতুন-মা, ‘পাখি কোথা গেল?

আমতা-আমতা করে কাঁপা-গলায় উত্তর দিলে টোরা, “উড়ে গেল।”

তারপর যে কী হবে, সেসব টোরার জানা। নতুন-মা চিল-চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবে। টোরাকে বককে বকতে পাঁচশোবার বলবে, ‘আহ্লাদী মেয়ে, আমার হাড়মাস কালি করে দিলে। কাজ তো কত করছ, শুধু অকস্ম/ এবার তোকে দূর করে দেব। দেখি এবার তোকে কে রক্ষে করে/’

টোরা আর একটি কথাও বলবে না। নিজের ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকবে। তারপর বাবা যখন আসবে, টোরাকে ডাকবে। লুকিয়ে-লুকিয়ে আদর করবে। তখন টোরার ভয় ভাঙবে।

কিন্তু আজ তো তা হল না। আজ তো নতুন-মা ওকে শুধু গাল পেড়ে ক্ষান্ত হল না। হঠাৎ টোরার গালে চড় মারল। নরম তুলতুলে গালটা ওর লাল হয়ে গেল। ওর কানটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে সত্যিই বার করে দিল। বার করে দিল ঘর থেকে রাস্তায়। অভিমানে মুখটা ফুলে উঠেছে টোরার/ নিমেষে সে যেন বে-বাক হয়ে গেল/ সত্যিই কি নতুন-মা আজ তাকে দূর করে দিল/

টোরাকে কেউ মারে না। কোনোদিনও না। আজই প্রথম ও মার খেল। মার খেল নতুন-মায়ের হাতে। কেন? ও তো কোনো দোষ করেনি। ও তো ছোট্ট। পাখিটা তো ও আর ইচ্ছে করে আকাশে উড়িয়ে দেয়নি। পাখিটা যে পেটে-পেটে অমন মতলব এঁটে বসেছিল, খাঁচা খুললেই পালাবে, সে আর টোরা জানবে কেমন করে। তাই বলে টোরাকে এমন করে মারবে/ঘর থেকে বার করে দেবে নতুন-মা/ সবাই দেখছে টোরাকে। ভাবছে, না জানি কী অন্যায় করেছে টেরা/ কী লজ্জা/

 না, সবাই জানে টোরা কোনো অন্যায় করেনি। সবাই জানে নতুন-মা টোরাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। রাতদিন হেনস্তা করবে। সৎ-মেয়ে তো/ দু-বেলা নাকে দড়ি দিয়ে খাটাবে। ওর কি এখন খাটবার বয়েস/ আহা/ খাটতে-খাটতে মেয়ের কী দশা হয়েছে এখন/ ওর মা যখন বেঁচে ছিল, তখন কী যত্নেই না ছিল টোরা/ দেখতেও ছিল তেমনি। যেমন গায়ের রং, মুখখানাও তেমনি মিষ্টি। ভারি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে/

টোরাকে ভালোবাসে সবাই। সবাই জানে, লক্ষ্মী মেয়ে টোরা। ভারি নরম। নরম তার মনটি, মনের ভেতরটি/

ঘরের দরজা বন্ধ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এখন কী করবে টোরা ভেবে পাচ্ছে না। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে টোরা। ভয় হচ্ছে, সত্যিই যদি নতুন-মা ওকে আর ঘরে ঢুকতে না দেয়/ তবে যাবে কোথা সে? জানে না টোরা, কোথায় তার আপনজন আছে। কে তাকে আদর করবে বাবার মতো। ভালোবাসবে ছোট্ট ভাই বাদশার মতো।

 খুব ভালোমানুষ টোরার বাবা। নতুন-মা টোরাকে বকলে বাবার মনের ভেতরটা ভীষণ কষ্টে গুমরে ওঠে। বাবা তবু মাকে কিছু বলবে না। বাবা তো জানে কিছু বললেই নতুন-মা চেঁচিয়ে-মেচিয়ে পাড়া মাত করবে। কী দরকার। একটা কথা বললে খ্যাঁক-খাঁক করে যে দশটা কথা শুনিয়ে দেয়, তার সঙ্গে লেগে কী লাভ/ মেয়েকে বকলে দুঃখে বুকটা ভরে যায় বাবার/ আর তাই সেই ভার নামাতে সে মেয়েকেই বুকে জড়িয়ে আদর করে।

সত্যি, বাবার জন্যে টোরাও ভীষণ খারাপ লাগে। আগে বাবা কত গল্প বলত, মুখখানা সব সময় হাসি খুশি। আর এখন? ভারি চুপচাপ বাবা/ খুব মেঘ করলে আকাশটা যেমন অন্ধকার হয়ে যায়, বাবার মুখখানাও তেমনি অন্ধকার/ টোরা সব বোঝে। কিন্তু কী করবে ওই এক-ফোঁটা ছোট্ট মেয়ে/ মাঝে-মাঝে ভাবে, বাবার হাত ধরে চলে যাবে কোথাও। অনেক দূরে। না, পারে না। সে-কথা ভাবলেই ওর ভাইটির কথা মনে পড়ে যায়। বাদশা এত ভালোবাসে তাকে। ভাবতেই পারে না টোরা তার ভাইকে ছেড়ে সে অনেক দূরে চলে যাবে। বাদশা তার সৎ-ভাই। কিন্তু টোরার কোনোদিনই তো সে-কথা মনে হয় না। বাদশাও জানে টোরা তার দিদি। দিদির আবার পর-আপন আছে নাকি/ দিদির সঙ্গে বাদশা ইস্কুলে যায়। ইস্কুলে যাবার আগে দিদি ওকে জামা-প্যান্ট পরিয়ে দেবে। বই-খাতা গুছিয়ে দেবে। জুতোয় ফিতে বেঁধে দেবে। ইস্কুল তো খুব দূরে নয়। তবু দিদির হাত ধরে ইস্কুলে যেতে বাদশার খুব ভালো লাগে। ওইটুকু রাস্তা যেন কত মজার/ দিদির সঙ্গে কথা, শুধু কথা। গল্প আর গল্প। যেন শেষ নেই তার। এ-মজা যেন শেষ হবে না কোনোদিনও। বাদশা দিদির সঙ্গে না খেলে ওর যেন খিদে মেটে না। একসঙ্গে খেলবে, ঘুমুবে, নয়তো রাত্তিবেলা মোমবাতির আলো জ্বেলে দু-জনে গুনগুন করে ছড়া পড়বে, কিংবা গান গাইবে। তারপর যখন মোমের আলো জ্বলতে জ্বলতে বাদশারও মন ছুটে চলে। মার গাড়ির সঙ্গে আলোর ঝিকিমিকি এখবে, রেলকাম নিভে আসবে, আগুনের ছোঁয়ায়-ছোঁয়ায় মোমের ফোঁটা গলতে-গলতে ফুরিয়ে যাবে, তখন হাই উঠবে বাদশার। দিদি বলবে, ‘বাদশা, এবার ঘুমো।’

বাদশা উত্তর দেবে, ‘তুই ভাবছিস আমার ঘুম পাচ্ছে?’

 দিদি বলবে, “অনেক রাত হল।”

বাদশা দিদির দিকে চাইবে অন্ধকারে। তারপর বলবে, ‘রাত কই রে। এখনও রেলগাড়িটা গেল না।’

 রেলগাড়িটা রোজ যায়। রোজ যায় এমনি সময় এই রাতে, ওই দূরের অন্ধকার ছুঁয়ে-ছুঁয়ে। কু/ জেগে থাকলেই বাদশা ছুটে যাবে জানলার ধারে। জানলার গরাদে গাল দুটি ঠেকিয়ে দেখবে। দেখবে, রেলকাম ঝমাঝম করতে-করতে রাতের গাড়ি ছুটছে। অন্ধকারে গাড়ির সঙ্গে আলোর ঝিকিমিকি রোশনাইটাও যখন ছুটতে থাকে, তখন বাদশারও মন ছুটে চলে। মন চলে যায় অ-নে-ক অনেক দূরে। হয়তো কোনো পাহাড়ের দুর্গম চূড়ায়, নয়তো গাছগাছালি ভরা কোনো গহন বনের গভীরে। কিংবা ঢেউভাঙা উচ্ছল কোনো সমুদ্রের তীরে-তীরে।

অবশ্যি কোনোটাই দেখেনি বাদশা। দেখেনি পাহাড়, জানে না সমুদ্র কেমনতর। কে জানে, গহন বনের গভীরে সূর্যের আলো যায় কি না-যায়। ও শুনেছে, পাহাড়ের চূড়া আকাশের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। পাহাড়ের চূড়ায় তুষারের মুকুট সূর্যের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠলে চোখ ঝলসে যায়। সে নাকি ভারি ভালো লাগে দেখতে। ও দিদিকে বলে, ‘দিদি, বড়ো হলে রেলগাড়ি চেপে আমরা দুজনা অনেক দূরে চলে যাব। পাহাড় ডিঙিয়ে, বন পেরিয়ে সমুদুরে পাড়ি দেব। যাবি না তুই?’

টোরা হাসে।

 হাসতে দেখলেই বাদশা দিদিকে জড়িয়ে ধরবে। দিদির হাসিটা এত ভালো লাগে বাদশার।

হাসতে-হাসতেই দিদি বলবে, ‘আমি গেলে মাকে দেখবে কে?’

বাদশা বলে, ‘দিদি, তুই ভারি বোকা/ মা-র কাছে তো রাতদিন বকা খাচ্ছিস, তবু মা-র জন্যে তোর এত ভাবনা/’।

টোরা চাপা সুরে ধমক দেবে বাদশাকে। বলবে, ‘ছিঃ, ও কথা বলতে আছে/ দোষ করলে মা বকবে না?’

 ‘তুই দোষ না করলেও তো মা তোকে বকে। আমি যেন জানি না।’

 ‘চুপ/’ টোরা ভয় পায়। তাড়াতাড়ি বাদশার মুখখানা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে। বলে, ‘মা জানতে পারলে আস্ত রাখবে না’

‘টোরা।’

কে ডাকল এমন আদর করে/ এতক্ষণ সে তো রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। মা তাকে বার করে দিয়েছে। ডাক শুনে চমকে গেছল টোরা। পেছন ফিরে দেখে বাবা।

কী হয়েছে মা?’ বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

টোরা কিছু বলতে পারল না।

 ‘মা বকেছে?’ বাবা আবার জিজ্ঞেস করল।

ঘরের ভেতর থেকে মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘না, মেয়েকে পুজো করবে। ধিঙ্গি মেয়ে আমার পাখিটাকে উড়িয়ে দিলে। রথ দেখতে গিয়ে আমি শখ করে কিনে এনেছিলুম। আমার ময়না। সবে কেষ্ট-কেষ্ট বলতে শিখেছে। তা আমার সাধ-আহ্লাদ করবার জো নেই/ মেয়েছেলের অত নাচন-কোঁদনের কী আছে। কাজের নামে অষ্টরম্ভা। শুধু লোকসান করছে/’।

বাবার বুঝতে বাকি রইল না কী হয়েছে। টোরার হাত ধরে বললে, ‘চ মা।’

বাবার হাত ধরে ঘরে ঢুকল টোরা।

 বাবা মাকে বলল, ‘পাখি গেছে আবার হবে। কিন্তু তাই বলে বাচ্চা মেয়েকে অমন করে ঘর থেকে বার করে দিতে আছে/

‘বাচ্চা’ শুনে ঘরের গিন্নি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘বলি, বাচ্চাটা তুমি দেখলে কোথায়? তোমার আহ্লাদী মেয়ে তোমার কাছেই বাচ্চা থাক। আমার দরকার নেই অমন মেয়ের। তুমি থাকো মেয়েকে নিয়ে। আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব।’ চিৎকার করে পাড়া মাত করলে নতুন-মা।

চিৎকার শুনলে যেন বুক শুকিয়ে যায় বাবার। আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কথা বলে লাভ কী। যে বোঝে না, তার সঙ্গে কথা বললে কথা বাড়বেই শুধু। থামবে না।

টোরার চোখ দুটি ছলছল করছে। নিজের ঘরে গিয়ে জানলায় মুখ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল টোরা। যখন অনেক ব্যথায় ওর মন ভরে যায়, তখন এই জানলাটি যেন আপনজনের মতো ওকে ভালোবেসে আদর করে। আর তখন টোরার চোখের জল গাল বেয়ে উপচে যায়। ভাগ্যিস, এখন বাদশা ইস্কুলে গেছে/ নইলে বাদশা দেখে ফেলে যদি জিজ্ঞেস করত, ‘দিদি তুই কাঁদছিস কেন?’ তখন কিছুই যে উত্তর দিতে পারত না টোরা/ দু-হাতের মুঠি দিয়ে চোখের পাতা আড়াল করলেও কি তখন সে কান্না লুকোতে পারত?

টেরাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। কোনোদিনও না। অনেক দুঃখে যখন ওর বুকে ভার হয়ে যায়, তখনও ঠোঁট দুটিতে মিষ্টি হাসির আলতো-ছোঁয়া লেগে থাকবে। হাসলেই কেমন টোল খেয়ে গাল দুটি ভেঙে যায়/ তখন এত ভালো লাগে মেয়েটাকে। অবিশ্যি এখন তো বড়ো হয়েছে। যখন আরও ছোট্ট ছিল, ছোট্ট হাত দুটি এলোমেলো নাড়তে-নাড়তে ছুটত, ওই সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটতে-ছুটতে নাচত কিংবা হাসত, মনে হত, যেন একটি রঙিন পাখি উড়ছে অথবা গান গাইছে। আচ্ছা বলো, এখন কি ওর কাজ করার বয়েস? এখন তো ও খেলবে, গল্প শুনবে, নয়তো গান শুনবে। নদীর ওপার থেকে যে-গান ভেসে আসে সোনালি রাতে আলোর পাল তুলে। বাদশার মতো টোরারও তো ইচ্ছে যায় ইস্কুলে যেতে, বই পড়তে। কিন্তু সে তো আর হল না

আজ রাত এসেছিল চুপিচুপি। ওই আকাশ উপচে পড়া রাতের তারারা কেমন যেন টোরার অজান্তে আকাশের বুক জুড়ে জেগে উঠেছে। আজ সারাদিন দিদির সঙ্গে কথা হয়নি বাদশার। আজ ও ইস্কুল থেকে ফিরেছে বাবার সঙ্গে। বাদশা সব শুনেছে। শুনেছে পাখিটা উড়ে গেছে। মা দিদিকে মেরেছে। কান ধরে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। কী জানি কেন, দিদির দিকে চেয়ে ওর ভারি দুঃখ হচ্ছিল। ও ভেবে পায় না, কেন যে মা দিদিকে দেখতে পারে না। অথচ দিদি মা বলতে অজ্ঞান। দিদি মাকে এত ভালোবাসে, অথচ মা যেন দিদির ওপর তিরিক্ষি হয়েই আছে। রাগ ধরে মায়ের ওপর। আচ্ছা, সববার মা-ইতো মেয়েকে আদর করে, যত্ন করে। আর বাদশার মা দিন রাত উঠতে-বসতে দিদিকে কেন বকাবকি করে? দিদি তো লক্ষ্মী, দিদি তো কারো সঙ্গে লাগে না। মুখ বুজে তো মায়ের হুকুমই শুনছে সারা দিন

ভাবতে-ভাবতে কেমন অবাক হয়ে যায় বাদশা। ওর ভাবনার সঙ্গে ঘরের অন্ধকারটা মোমের আলোয় যেন কেবলই কেঁপে উঠছে। আজ রাতে বাদশা দিদিকে বলতে পারল না, ‘দিদি, একটা গল্প বল।’ বলতে পারল না, ‘দিদি একটা গান শোনা।’

 আলো নিভে আসছে। বাদশা চুপচাপ শুয়ে ছিল বিছানায়। টোরা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জানলায় রাতের অন্ধকারে চোখ মেলে। টোরা হয়তো ভাবছিল, পাখিটার কথা। কিংবা দেখছিল, অসংখ্য জোনাকির আলোর উড়ন্ত বিন্দুগুলি। ওর জ্বলে উঠে হারিয়ে যায়। হারিয়ে গিয়ে আবার জ্বলে ওঠে। এ যেন অন্ধকারের সঙ্গে আলোর লুকোচুরি খেলা/

হঠাৎ বাদশাই প্রথম কথা বলল, ‘দিদি, শুবি না?’

 দিদি উত্তর দিলে, ‘ঘুম পাচ্ছে না।

 বাদশা আবার বলল, ‘সত্যিই তো, অমন করে মারলে কখনও মানুষের চোখে ঘুম আসে?’

টোরা চেয়ে দেখল বাদশার দিকে একবারটি। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ঘুমুবি না?’

 কোনো উত্তর দিল না টোরা। আবার নিস্তব্ধ, আবার নিঃঝুম চারদিক। থমথম করছে ঘরের ভেতরটা, বাইরের আকাশটা। হঠাৎ গাছের বাসায় হয়তো ঘুমের ঘোরে একটি পাখি ডানা ঝাঁপটাল। চমকে উঠল টোরা। যেন ভয়ে বুকটাও থমকে গেল তার।

‘দেখ দিদি, পাখিটা উড়ে গেছে ভালোই হয়েছে। হঠাৎ যেন দিদিকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললে বাদশা। ‘একটা নিরীহ জীবকে ধরে এনে খাঁচায় রাখার কী দরকার/ বল, আমায় যদি কেউ খাঁচায় বন্দি করে রাখে?

এবারও কোনো উত্তর দিল না টোরা। ওর মন বারবার শুধু ভাবছে একটি কথা। একটি পাখির কথা। সত্যি এমন অকৃতজ্ঞ পাখিটা/ কেন, টোরা কি তাকে ভালোবাসেনি? না, যত্ন-আত্তি করেনি? রোজ নিজের হাতে সে খাবার দিয়েছে। খাঁচার ভেতর হাত গলিয়ে, গায়ে হাত বুলিয়ে কত আদর করেছে। আর পাখিটা কিনা তাকেই ফ্যাসাদে ফেলে, তারই হাতের ফাঁক দিয়ে উড়ে পালাল। যাক, যাক/ টোরার খারাপ হোক, যত পারে হোক/ তাতে তোর কী/ তোর মনের বাসনা তো পূর্ণ হয়েছে, তুই তো মুক্তি পেয়েছিস, তা হলেই হল। এখন টোরাকে কেউ মারুক কি ঘর থেকে বার করে দিক, তাতে তোর তো আর কিছু এসে যাচ্ছে না। মা-দুগ্ন তোকে রক্ষা করেছেন, এই দেখেই টোরার চক্ষু সার্থক/ ভাবতে-ভাবতে টোরার চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ল।

মোমবাতিটা নিভে গেছে। কখন যে বাদশা ঘুমিয়ে পড়েছে, খেয়াল করেনি টোরা। চোখের জল মুছতে মুছতে বাদশার পাশে সেও শুয়ে পড়ল। মনটা খুব খারাপ-খারাপ লাগলেও দিনটা তবু কেটে যায় এক রকম। কিন্তু রাত যখন ঘনিয়ে আসে, যখন সব নিশ্চুপ হয়ে যায়, সাড়া শব্দ শোনা যায় না, তখন যেন দুঃখের ভাবনাগুলো পেয়ে বসে মানুষকে। অন্ধকার রাতটা যেন ভাবনার পালতোলা নৌকো নিয়ে ভেসে যায়। থামতে বলল, কিছুতেই শুনবে না। নৌকো দুলবে। আর দুলতে-দুলতে বয়ে যাবে।

দুলছিল টোরার মনও। দুলতে-দুলতেই টোরার চোখের পাতা দুটি ঘুমের ছোঁয়ায় বুজে গেল। ওর ক্লান্ত মুখখানি ঘুমের আবেশে কেমন শান্ত হয়ে গেছে। এখন আর টোরার কিছু মনে পড়বে না। মনে পড়বে না, নিজের মায়ের মুখখানি। মা তো কবে তাকে একা ফেলে চলে গেছে। মা নেই বলেই এত অপমান তাকে সইতে হয়। ওরও তেমন বলে, আর সবার মায়ের মতো ওরও মা ওকে আদর করুক। ইচ্ছে করে নতুন মায়ের মতো ওর কপালেও কেউ লাল চুমকির টিপ পরিয়ে দিক। রাঙা টুকটুকে পা দুটিতে লাল টকটকে আলতা দিয়ে সাজিয়ে দিক। কে দেবে? ওর ওই ছোট্ট ভাইটি? ধ্যাৎ/

বাদশা কবে যে বড়ো হবে কে জানে/ টোরা ভাবে, বাদশা বড়ো হলে অনেক লেখাপড়া শিখবে। অনেক নাম-যশ হবে। লোকের মুখে মুখে বাদশার নাম শুনতে-শুনতে টোরার বুকখানা গর্বে ভরে উঠবে। কিন্তু সে তো এখনও অনেক দেরি। বাদশা যা ছোটো/ বাদশা যদি টোরার চেয়ে বড়ো হত, তাহলে বেশ হত। তখন যা মজা হত না, টোরা তখন খালি ডাকাডাকি করত, ‘বাদশা-দাদা।

‘বাদশা-দাদা।’ সত্যিই হঠাৎ কে ডাকল না?

 ‘বাদশা-দাদা।’

হ্যাঁ তো, আবার ডাকল/ এত রাত্তিরে কে ডাকছে বাদশাকে? কিন্তু সাড়া দেবে কে? অঘোরে ঘুমোচ্ছে বাদশা। ঘুমিয়ে পড়েছে টোরা। ওই ডাক কি এই ঘুমের ঘোরে ওরা শুনতে পাবে?

শুনতে পেল। ডাক না। রাত-পহরের রেলটা কু বাজিয়ে ঝিকঝিক করতে করতে ছুটে চলেছে। সেই শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বাদশার। চমকে উঠেছে। ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় শুয়ে-শুয়েই ও চেয়ে দেখল জানলাটার দিকে। কান পেতে রইল, যতক্ষণ শোনা যায়, কু-কু ঝিক-ঝিক। ওই শব্দ শুনলেই বাদশার যেন মনে হয়, রেলগাড়িটা বাজনা বাজিয়ে নাচতে-নাচতে লাইনের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। তারপর রাতের অন্ধকারে সেই বাজনার রেশটুকু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে। যেতে-যেতে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল সেই বাজনা। পাশ ফিরল বাদশা। মুখে তুলে দেখল, দিদি ঘুমোচ্ছে। এখন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। না, কিন্তু দিনেরবেলা ও স্পষ্ট দেখছে, কেঁদে-কেঁদে দিদির চোখ দুটি ফুলে গেছে। মা যে কেন এমন নির্দয় হয়, ভেবে পায় না বাদশা। আহা/ অমন করে মারতে আছে? আচ্ছা, না হয় মেরেছে, তারপর তো একটু আদর করবে? তা নয়, দিদির দিকে একবার চেয়েও দেখল না। এ কী রাগ বাবা? রাগের কি শেষ নেই/ না কি রাগ শেষ হয় না?

বাদশা-দাদা।’

 চমকে উঠলে বাদশা। এবার শুনতে পেয়েছে সে। কে ডাকল? বাদশার বুকটা চমকে ধড়ফড়িয়ে উঠল।

‘বাদশা-দাদা।’

আবার ডেকেছে। বাদশা তাড়াতাড়ি উঠে বসল।

 ‘বাদশা-দাদা।’

 আরে, এ কী/ তাদের সেই উড়ে-যাওয়া পাখিটা ডাকছে নাকি/ এত রাত্তিরে পাখি এল কোত্থেকে?

বাদশা চুপি-চুপি ডাকল, ‘দিদি, এই দিদি।

টোরার ঘুম ভেঙে গেল, কী রে?’

বাদশা চাপা-গলায় বলল, ‘পাখি’

টোরা উঠে পড়ল, ‘কই?’

বাদশা উত্তর দিলে, ‘কী জানি। আমার নাম ধরে ডাকল।

বলতে না বলতেই আবার ডেকেছে, ‘বাদশা-দাদা।’

হ্যাঁ, তাই তো। সত্যিই তো তাদের পাখির গলা/ ঠিক তেমনি অস্পষ্ট, ভাঙা-ভাঙা ডাক/ টোরার বুকটা কেঁপে উঠল। বাদশার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ডাকছে বল তো?

বাদশা দিদির চেয়েও আরও আস্তে বলল, ‘মনে হচ্ছে জানলার ধারে ওই জামগাছটায়। যাবি? চ, ধরে আনি।’

ধরতে পারলে তো খুব ভালো। কিন্তু উড়ন্ত পাখিকে ধরবে কেমন করে টোরা জানে না। তাই ছোট্ট ভাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন করে ধরবি?’

বাদশা উত্তর দিলে, ‘চ না, বাইরে গিয়ে দেখি।’

 ‘যাবি কেমন করে?’ ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল টোরা।

 ‘দরজা খুলে।’

‘মা জানতে পারলে?’

 ‘পারলেই বা। আমরা তো চুরি করতে যাচ্ছি না। মায়ের জন্যেই তো পাখি ধরতে যাচ্ছি।’ সাফ উত্তর দিলে বাদশা।

সায় দিতে ভয় করল না টোরার। কেননা, পাখিটা ধরে আনতে পারলে, নতুন-মা যে খুব খুশি হবে, এটা টোরা ঠিক জানে। কিন্তু এও জানে টোরা, এই রাতের অন্ধকারে পাখিটাকে খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। তাই টোরা অনেকটা সন্দেহ-ভরা মনেই জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু বাদশা, অন্ধকার যে/’।

অন্ধকারকে ভয় পায় না বাদশা। তাই দিদিকে সাহস দিয়ে বলল, ‘অন্ধকার তো কী হয়েছে/ তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? হাত বাড়িয়ে ডাকলেই দেখবি, পাখি লক্ষ্মীটির মতো হাতের ওপর নেমে আসবে। আমি বলছি, ওর ঠিক মন কেমন করছে। মন কেমন করছে বলেই তো আমাদের জানলার ধারে কেঁদে বেড়াচ্ছে।’

বাদশার কথা শুনে টোরারও মনটা অভিমানে ঝাপসা হয়ে গেল। হবেই তো। বলো, পাখিটার জন্যে টোরা কি কম করে/ আর তুই এমন স্বার্থপর, কিছু না-বলে না-কয়ে টোরাকে এমন একটা বিপদে ফেললি? তোর তো বোঝা উচিত ছিল, তুই পালালে নতুন-মা টোরাকে আস্ত রাখবে না। কাউকে যে দুঃখ দিতে নেই এ কথাটা বুঝবি কবে? অন্যকে দুঃখ দিলে নিজেকেও যে দুঃখ পেতে হয়, এখন হাড়ে-হাড়ে বোঝ/ যাকগে যাক, যখন সুমতি হয়েছে, যখন আবার ঘরে ঢোকার জন্যে অন্ধকারেই ডাকাডাকি শুরু করেছে, তখন আর কিছু না-বলাই ভালো। তাই টোরা বাদশাকে বললে, ‘চ তাহলে।

পাখিটা আবার ডেকেছে, ‘বাদশা-দাদা।’

ঘরের দরজাটা খুলবে বলে খিলটায় হাত দিল টোরা। বাদশা বললে, ‘দেখিস, মা না উঠে পড়ে। তাহলে সব মজা মাটি/ পাখিটা ধরে চুপচাপ খাঁচায় রেখে দেব। তারপর কাল মা যখন দেখবে, তাক লেগে যাবে। দেখি তখন মা তোকে কেমন না আদর করে/’

টোরার মুখখানা আনন্দে উছলে উঠল। টোরা নিঃশব্দে খিলটা খুলে ফেলল। তারপর বাদশা আর টোরা আলতো পায়ে নিঃসাড়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়লে।

 ‘বাদশা-দাদা। ওদের বাইরে দেখেই পাখিটা যেন দ্বিগুণ খুশিতে ডেকে উঠল। জামগাছের নীচে এসে টোরা চাপা গলায় পাখিটাকে ডাকল, ‘আয়, আয়।

এবার পাখি হঠাৎ ডেকে উঠল, ‘টোরা-দিদি।’

অবাক কাণ্ড/ পাখিটা তো এর আগে কোনোদিনই টোরার নাম ধরে ডাকেনি। আজ হঠাৎ ডাকল কেমন করে/

টোরা আবার ডাকল, ‘আয় টু টু পাখি আয়/

পাখি আবার ডাকল, ‘টোরা-দিদি।

 কিন্তু আশ্চর্য কোথায় যে লুকিয়ে আছে দুষ্টুটা গাছের ফাঁকে, ওদের একদম নজর যাচ্ছে না। ওপরে তাকালেই ওরা দেখছে, পাতার ঝিলিমিলির আড়াল থেকে আকাশটা উঁকি মারছে। আকাশ ভরতি আলোর তারাগুলো যেন এক-একটা অবাক গল্পের ছবি।

“ফুড়ত/”

 টোরা আর বাদশা স্পষ্ট দেখল জামগাছ থেকে পাখিটা উড়ে গেল। ইশ/ এত কাণ্ড করে শেষে এই/ টোরার মুখখানা হতাশায় চুপসে গেল/ কিন্তু বাদশা দমবার পাত্র নয়। বাদশা বললে, “পালাবে কোথায়/ আয় দেখি/’।

পাখি এবার অন্ধকারে উড়তে-উড়তে, ঘুরতে-ঘুরতে দুষ্টুমি করে ডাকল, ‘বাদশা-দাদা, টোরা-দিদি।’

 বাদশা ছুটল পাখির পেছনে/ ডাক দিল, ‘আয় পাখি, পাখি আয়।

টোরা ডাকল, ‘পাখি, পাখি আয়, আয়।

পাখি উড়ছে, বাদশাও ছুটছে।

 পাখিও ডাকছে টোরাও ডাকছে।

আঁধার রাতে অমন করে যে একা-একা ছুটতে নেই, এ-কথা বুঝতে পারেনি টোরা। বোঝেনি বাদশা। বোঝা যায় না। কেননা, টোরা জানে পাখিটার জন্যে নতুন-মা ভারি কষ্ট পেয়েছে। আবার যদি ফিরে আসে পাখি, খুব খুশি হবে নতুন মা। নতুন-মাকে খুশি দেখলেই টোরাও খুশি/ অবিশ্যি বাদশা ভাবছে অন্য কথা/ ভাবছে, একবার পাখিটাকে ধরতে পারলে হয়। মাকে যা কথা শোনাবে না বাদশা/ ছিঃ ছিঃ দিদিকে শুধুমাত্র মারাটা কি ঠিক হয়েছে/ দিদির দোষটা কী শুনি?

সত্যিই পাখিটার লোভে টোরা আর বাদশা কেমন যেন ভুলে গেল সব কিছু। ভুলে গেল, যে-পাখি উড়ন্ত তার পেছনে ধাওয়া করলে তাকে ধরা যায় না। তাই ছুটতে-ছুটতে এমন জেদ বেড়ে গেল যে, খেয়ালই করল না কোথায় চলেছে তারা।

এ কী/ হঠাৎ পাখিটা যেন ওদের সঙ্গে চোর-চোর খেলা শুরু করে দিলে/ হাওয়ায় ভাসছে পাখি। ভাসতে-ভাসতে হঠাৎ-হঠাৎ নেমে আসছে একেবারে ওদরে হাতের নাগালে। যেই বাদশা আর টোরা ধরতে যাচ্ছে, পাখি ভড়কি দিয়ে ফুড়ত করে উড়ে পালাচ্ছে। আশ্চর্য কথা বলে, পাখি নাকি রাত-দুপুরে চোখে দেখে না। কিন্তু এখন ওই উড়ন্ত পাখির কসরতের কাণ্ডকারখানা দেখলে কে বলবে এ-কথা/ উলটে অন্ধকারে টোরা আর বাদশারই চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। ধাঁধা যতই লাগছে, ওদের গোঁ ততই বাড়ছে। যেমন করে তোক পাখি তারা ধরবেই ধরবে।

হাঁপিয়ে গেছে বাদশা। টোরাও হাঁপাচ্ছে। টোরা বাদশাকে চেঁচিয়ে বললে, ‘বাদশা, তুই আর ছুটিস না। দাঁড়া। আমি দেখছি।’

বাদশা উত্তর দিলে, ‘তুই একা পারবি না।’

তাই বাদশাও পাখিটাকে ধরবে বলে হাত পাকাচ্ছে, লাফ মারছে, ভড়কিও খাচ্ছে। উড়ন্ত পাখি ধরা কি আর বাদশার কম্ম। না, বাদশার কম্ম নয়। কিন্তু দিদির মুখ তাকে রাখতেই হবে। দিদির জন্যে কোনো কাজই তার কাছে অসাধ্য নয়/

পাখিটা উড়তে-উড়তে এবার একদম আচমকা মেরেছে এক ঝটকা। মেরেছে একেবারে টোরার হাতের মধ্যে। হয়তো পাখিটা ভেবেছিল টোরার হাতে ঠুকরে দিয়ে পালাবে। টোরা তো থতমত খেয়ে গেছে। কিন্তু ঘাবড়াল না। চোখ-কান বুজে হাতের মুঠি পাকিয়ে ছোঁ মারতেই বাছাধন পাখি হাতের মধ্যে সড়াত/ ধরা পড়েছে/ আর কোনো কথা আছে/ টোরা একেবারে প্রাণপণে চেপে ধরলে পাখিটাকে/ পাখি চিল্লিয়ে ডেকে উঠল, ‘ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ/’ তারপরেই থেমে গেল।

বাদশা তাই না দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল, ‘দিদি’

কিন্তু দিদি? দিদির তো মুখখানি খুশিতে উছলে পড়ল না। হাতের পাখি হাতে নিয়ে টোরা কেমন যেন থমকে গেল। পাখিটা চিৎকার করেই অমন ঠান্ডা হয়ে গেল কেন/ টোরা তাড়াতাড়ি হাতের মুঠিটা খুলে ফেলতেই পাখিটা হাত ফসকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যাঃ টোরার হাতের চাপে পাখিটা মরে গেছে/

কিন্তু পাখিটা মরেছে কি মরেনি, এ-কথাটা বুঝতে না বুঝতেই, হঠাৎ আর এক কাণ্ড/ মরা পাখিটা টোরার হাত থেকে যেই মাটিতে পড়েছে, সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল আকাশে। থরথর করে মাটি কেঁপে যেন সব কিছু ভেঙে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে। গাছের পাতায়-পাতায় এতক্ষণ যে হাওয়া ঝুরুঝুরু বয়ে চলেছিল, সেই হাওয়া হঠাৎ ঝড়ের বেগে লাফিয়ে-লাফিয়ে মাতামাতি লাগিয়ে দিল। সঙ্গে কী ধুলো/ টোরা আর বাদশার চোখেমুখে সেই ধুলো ঝাঁপটা মেরে ঝড়ের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে/ প্রচণ্ড সেই ঝার মধ্যে বাদশা চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘দিদি’

টোরাও অন্ধকারে দু-হাত বাড়িয়ে ডাক দিল, ‘বাদশা। কে কাকে খুঁজে পাবে এই দুর্যোগে/ টোরা আর বাদশা ঝড়ের ধাক্কায় এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। অন্ধকারে অন্ধের মতো হাবুডুবু খেতে লাগল। কখনো বিদ্যুৎ, কখনো বজ্রপাত, প্রচণ্ড ঝড় আর মুঠোমুঠো ধুলো, সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর বিপদে পড়ে গেল টোরা আর বাদশা। চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাদশা, ‘দিদি, আমার কাছে আয়/

দিদি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলে, ‘বাদশা, তুই কোথা?

 বাদশা উত্তর দিলে, ‘আমি এখানে।’

কিন্তু কোনদিকে যাবে টোরা? কোথায় আছে বাদশা? চোখ তো চাইতেই পারছে না। চোখ চাইলেই ঝাঁক ঝাঁক ধুলো উড়ে এসে চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তবু ডাক দিল টোরা, ‘বাদশা, আমি এখানে আছি, আমার কাছে আয়/ আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না/

বাদশা উত্তর দিলে, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি না। তুই কোনদিকে?’

 ‘এই দিকে/

এই ভয়ংকর দুর্যোগে এইদিকে একঝাঁক পাখি ঝড়ের সঙ্গে ঘূর্ণি খেতে-খেতে টোরার মাথার ওপর পাক খাচ্ছে/ কী সাংঘাতিক বিকট দেখতে সেই পাখিগুলোকে। বীভৎস কুচ্ছিত কালো মিশমিশে তাদের গায়ের রং/ বলতে পার, যেন এক-একটা দানব। ঝড়ের আকাশ কালো করে তেড়ে আসছে টোরার দিকে। কালো রাতে তাদের হিংস্র চোখগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ঠোঁট যেন ধারালো ছুরির মতো তীক্ষ্ণ/ হঠাৎ মস্ত মস্ত ডানাগুলো আগুনজ্বালা হাপরের মতো ঝটপটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল টোরার ঘাড়ের ওপর। তারপর ডানা জাপটিয়ে টোরাকে থাবড়াতে লাগল। নোখ দিয়ে খামচাতে লাগল। ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাতে লাগল। টোরা যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ককিয়ে উঠল, ‘বাদশা/’।

ঝাঁকে ঝাঁকে দানব পাখি টোরাকে খামচে-ছিড়ে নাস্তানুবুদ করে ছাড়লে। টোরা ঝড়ের সঙ্গে ঘুরপাক খেতে-খেতে পাখির হাত থেকে বাঁচার জন্যে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কে শুনবে সেই চিৎকার? ঝড়ের দামামা আর পাখিদের কর্কশ চেঁচানি ছাপিয়ে সে-চিৎকার কার কানে যাবে?

পারেনি টোরা। পারেনি পাখির সঙ্গে লড়াই করে ওই দানব পাখির হাত থেকে বাঁচতে। টোরার যেন দম আটকে আসছে। ছুটতে-ছুটতে, লাফাতে-লাফাতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল টোরা। তারপর আর কিছু জানবার কথা নয় ওর। ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল মাটির ওপর।

.

ঝড় থেমে গেছল। হয়তো অনেক আগেই। কত আগে টের পায়নি টোরা। কেননা, যখন ও চোখ চাইল, দেখল কেমন সব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। না আছে ঝড়ের দাপাদাপি, পাখিদের কিচিমিচি। কিন্তু চারদিকে এত কুয়াশা কেন? যেদিকে চায় সে, শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না টোরা। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল টোরা। উঠতে গিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কী ব্যথা সার দেহ জুড়ে। কেটে গেছে, ছড়ে-ছিড়ে গেছে হাত-পা/

কিন্তু এ কোথায় সে? কোথায় এসে পড়েছে টোরা? জায়গাটা যেন ভয়ংকর চুপসি মেরে থমকে আছে। ভীষণ অস্বস্তিতে দম আটকে আসছে। দাঁড়িয়ে পড়ল টোরা। সেই কুয়াশার জালের মধ্যে কানামাছির মতো হাতড়াতে লাগল। পথ কোনদিকে? কোনদিকে যাবে সে?

হঠাৎ যেন চমক দিয়ে ওর মনের ভেতরটা শিউরে উঠল/ বাদশা/ তাই তো, বাদশা কোথা গেল/ ঘন কুয়াশায় চারদিকটা এমন ছেয়ে আছে যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছে। বাদশা?

টোরা নরম-গলায় চুপিসারে ডাকল, ‘বাদশা।

বাদশার সাড়া পেল না।

আবার ডাকল, ‘বাদশা।’

তবুও সাড়া নেই।

 কেন সাড়া নেই/ বুক শুকিয়ে গেল টোরার। কী হবে এখন? এই কুয়াশার মধ্যে বাদশাকে সে কোথায় খুঁজবে? এবার মরিয়া হয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠল, বা-দ-শা–’

এবারও ভোঁ-ভাঁ/ শুধু তার ডাকের সুরটা প্রতিধবনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সেই কুয়াশার মধ্যে। কেঁদে টোরা ফেলল হাউহাউ করে।

তার সেই কান্না শুনে হঠাৎ যেন কারা হেসে উঠল, ‘হো-হো-হো/’

 হাসির শব্দে কান্নাটা আচমকা থমকে বুকের মধ্যে আটকে গেছে টোরার। ভয় পেয়ে গেল টোরা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল/ অমনি সঙ্গে-সঙ্গে বাতাস বইতে শুরু করল। যেন কার জাদুর ছোঁয়ায় সেই গাঢ় কুয়াশাটা ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে টোরা। দেখছে, কুয়াশা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল রাজবাড়ির দরবারের মতো একটা বিরাট ঘর। বহুদিনের পুরোনো। ভাঙা, জীর্ণ। যেদিকে চাও, বড়ো বড়ো থাম। ফেটে গেছে, ইট ঝুলছে। উঁচু উঁচু দেওয়াল। খসে পড়েছে চুনবালি। মাথার ওপর খাড়া মস্ত এক গম্বুজ। মনে হচ্ছে এই বুঝি হুড়মুড় করে ঘাড়ে পড়ে। গম্বুজের নীচে একলা দাঁড়িয়ে টোরা। হঠাৎ বিকট শব্দ করে গম্বুজের ডালাটা যেন খুলে গেল/ হ্যাঁ/ সেই খোলা ডালার ভেতর থেকে ওর চোখের সামনে ভাসতে-ভাসতে বেরিয়ে এল এক বিকট মূর্তি/ কালো অন্ধকারের মতো সে ভয়ংকর/ বীভৎস তার মুখের হাঁটা। হাঁ-এর ভেতর জিবটা তার লকলক করছে। যেন গিলতে আসছে টোরাকে। চোখ দুটো ভাঁটার মতো। হাত-পায়ের নোখগুলো লম্বা আর খোঁচা-খোঁচা/ তার মাথায় ঝাঁকড়া খসখসে একরাশ চুল। পিঠে ছড়িয়ে আছে উড়ন্ত পাখির ডানা। সেটা ঝটপট করে ঝাঁপটা মারছে, হাওয়ার ঢেউ উঠছে সারা ঘরে/ এ যেন এক উড়ন্ত দানব/

আতঙ্কে চেয়ে দেখল টোরা। ‘কে/

‘গর-র-র’ করে গর্জে উঠল দাবনটা। তার গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে থরথর করে কেঁপে উঠল দরবারটা। মনে হল, তার মুখ দিয়ে এক ঝলক আগুন বেরিয়ে এসে টোরার মুখের সামনে ঝলসে উঠল।

টোরা ভয়ে পিছিয়ে গেল/ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘কী চাই তোমার?

তখন সেই দানব তার বিরাট মাথাটা নাড়তে-নাড়তে প্রচণ্ড হুংকার ছেড়ে বললে, “হাতের মুঠিতে চেপে পাখি মেরেছিস তুই/”

টোরা তেমনি ভয়ে জড়সড়ড়া হয়ে বললে, ‘না, আমি ইচ্ছে করে মারিনি। আমি হাত দিয়ে ধরতেই পাখিটা মরে গেল।’

“আমিও যদি আমার পায়ের নোখ দিয়ে তোর গলাটা চেপটে ধরে মেরে ফেলি/ কিংবা খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তোর মাথাটা ফুটো করে দিই। তখন তোর কেমন লাগে/

‘ওটা আমার মায়ের পাখি। দুষ্টুমি করে আমার হাত ফসকে পালিয়েছিল। পাখিটার জন্যে মায়ের মন কেমন করছে বলেই আমি ধরতে গেছলুম।’

মায়ের জন্যে তোর তো ভারি দরদ।’ ধমকে দিলে দানবটা।

মায়ের কষ্ট দেখলে আমি থাকতে পারি না।’ উত্তর দিল টোরা।

দানবটা ভীষণ লাফিয়ে উঠল। সাংঘাতিক তর্জন-গর্জন শুরু করে দিলে। তারপর রক্ত-বর্ণ চোখ দুটো বার করে বললে, ‘আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি পাখিটাকে জীবন্ত দেখতে চাই। তুই যদি পাখির প্রাণ ফিরিয়ে দিতে না পারিস, তোর ভাইকে ফিরে পাবি না।’

টোরা শিউরে উঠল/ তাহলে এই দানবটা বাদশাকে লুকিয়ে রেখেছে/ টোরা বুঝে উঠতে পারছে না, এখন সে কী করবে/ যে-পাখি মরে গেছে, তার প্রাণ সে কী করে ফিরিয়ে দেবে/ তাই টোরা এবার কাকুতি-মিনতি করে বললে, ‘পাখির প্রাণ আমি দেব কী করে? প্রাণ তো ভগবানের। কিন্তু তুমি আমার ভাইকে ফিরিয়ে না দিলে মায়ের কাছে আমি মুখ দেখাব কেমন করে?

এবার প্রচণ্ড চটে গেল দানবটা। বললে, ‘আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। বল, তুই পাখির প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবি কি না।’

টোরা বললে, ‘আমি যা পারি না, তা পারব কেমন করে বলি?’

 ‘বেশ/ তবে তোর মাকে ভুলতে হবে।’

 টোরা চিৎকার করে উঠল, ‘না, মাকে আমি ভুলতে পারি না, পারব না। মা আমার ভালোবাসার।

 ‘মাকে না ভুললে, ভাইকেও ফিরে পাবি না।’

তেমনি আকুল হয়ে টোরা উত্তর দিলে, ‘ভাইকে ফিরিয়ে দাও, ভাই আমার আদরের।

‘আবার ভাই-ভাই করলে আমি তোকে বেঁধে রাখব।

 ‘আমাকে বাঁধ, আমি মেনে নেব। তাহলে তুমি আমার ভাইকে ছেড়ে দেবেতো?’

 দানবটা হুংকার ছাড়লে, ‘ফের ওকথা বললে তোর মুখখানা আমি আগুনে ঝলসে দেব।’

খুব শান্ত-গলায় টোরা উত্তর দিলে, ‘বেশ তো, তোমার যদি তাই ইচ্ছা যায়, ঝলসে দিয়ে আমার মুখখানা। কিন্তু ভাইকে আমার ছেড়ে দিতে হবে।’

দানব আরও রেগে গেল। বললে, ‘তোর ভাইকেও আমি পুড়িয়ে মারব।’

টোরার শান্ত গলাটা ভীষণ শব্দে ফেটে পড়ল। চিৎকার করে উঠল টোরা, না, যে বলে এমন কথা, সে যেন বোবা হয়ে যায়।’

‘তোর এতদূর আস্পর্ধা, আমাকে তুই শাপান্ত করছিস/ তুই পাখি মেরেছিস। তুই খুনি।’ বলে সেই কালো দানবটা হঠাৎ এক মুঠো ধুলো নিয়ে টোরার মুখে ছুঁড়ে মারল। মেরেই হো হো করে হাসতে-হাসতে নৃত্য শুরু করে দিলে।

 টোরার চোখ দুটি ভীষণ জ্বলে উঠেছে। টোরা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কাতরে উঠল, ‘আআ।’

দানবটা বললে, ‘এই তোর শাস্তি। তোর এই মুখে আমি জাদু মেরেছি। এখন তোর ওই মুখ যে দেখবে, সে জন্তু হয়ে যাবে/ তোর মা হবে, তোর ভাই হবে, তোর বাবা হবে/ এমন কী, অজানা অচেনা যে দেখবে সে-ই হবে/ তারপর সেই জন্তু তোকে ছিঁড়ে খাবে’।

 চিৎকার করে উঠল টোরা, ‘না’ টোরার তীক্ষ্ণ গলার স্বর ধবনি-প্রতিধবনি তুলে ওই বিশাল দরবারের গম্বুজে গমগম করে উঠল। এমন সময় হঠাৎ যেন আকুল স্বরে বাদশা ডেকে উঠল, ‘দিদি’

প্রথমটা বুঝতে পারেনি টোরা। তারপর আবার যখন ডেকেছে, সে-ডাক চিনতে ভুল হয়নি টোরার। ও চেঁচিয়ে সাড়া দিলে, ‘বাদশা/

দানব বিচ্ছিরি মুখ খিঁচিয়ে হেসে উঠে বললে, ‘ওই দ্যাখ, ওই তোর ভাই আসছে/ এবার তোর মুখ দেখবে। তারপর তোর ভাই হবে জন্তু/ হা হা হা/’।

ভয়ে কুঁচকে গেল টোরা। প্রথমটা বাদশার ডাক শুনে, খুশিতে ওর চোখের পাতা দুটি নেচে উঠেছিল। কিন্তু তারপর? দিদি বলে বাদশা সেই দরবার-ঘরে ছুটে আসতেই, টোরা, দু-হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে ফেললে। এ-মুখে জাদু মেরেছে দানব পাখি/ এ-মুখ দেখলে তার ভাই জন্তু হয়ে যাবে যে/ না, তার ভাইকে সে জন্তু হতে দেবে না। কিছুতেই না। মুখ চেপেই টোরা ছুট দিল। বাদশাকে পিছনে ফেলে পালাল।

বাদশা টোরাকে ছুটতে দেখে চেঁচিয়ে ডাকলে, ‘দিদি, আমি

টোরা তখন ছুটতে-ছুটতে দরবার-ঘরের বাইরে চলে গেছে। বাদশা দিদির কাছে যাবার আগেই, দরবারের দরজা ডিঙিয়ে দিদি আকাশের নীচে পৌঁছে গেছে। দিদিকে ডাকতে-ডাকতে বাদশাও ছুটল। আর দানবটা ঠ্যাং ছুঁড়ে, ডানা ঝাঁপটিয়ে খুশিতে সিটি মারলে, টি-টি/ সিটি দিতে দিতে দরবারের ধুলো-বালির ওপর নাচন-কোঁদন শুরু করে দিলে। ধুলোয়-ধুলোয় ভরে গেল দরবার-ঘর। সেই ধুলোর সঙ্গে ঝটাপটি করতে করতে কোথায় যে ফুস করে লুকিয়ে পড়ল সেই দানব, আর দেখাই গেল না।

‘ দিদি।’ যত জোর ছিল গলায়, বাদশা চেঁচিয়ে উঠল।

 তবু টোরা দাঁড়াল না। দাঁড়াবেও না। ভাইয়ের জন্যে তার মন ভেঙে খানখান হয়ে গেলেও ভাইয়ের দিকে ও একবার ফিরেও দেখবে না। ও মুখ ঘুরিয়ে ছুটবে। বাদশা যেন ওর মুখখানা দেখে না ফেলে।

 বাদশাও ছুটল দিদির পিছু। প্রাণপ্রণে ছুটেও সে পৌঁছতে পারল না দিদির নাগালে। টোরা ছুটতে ছুটতে এগিয়ে যায়, বাদশা দেখতে-দেখতে হারিয়ে যায়। বাদশা কেঁদে ফেলে, ‘দিদি, দাঁড়া দিদি।

দিদি দাঁড়াবে না।

কাঁদতে-কাঁদতে আবার ডাকে বাদশা, ‘দিদি, দিদি, ফিরে চা।

দিদি ফিরেও চাইবে না।

তখন বাদসার সেই কান্না যেন আকুল হয়ে বেজে ওঠে। বেজে ওঠে গাছের পাতায়, ফুলের রঙে, আকাশের নীলে। সে যেন এক কান্না-ভরা সুরের ঢেউ। সে-সুর বাজতে-বাজতে হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়।

তবু থামল না টোরা। তবু শুনল না সেই কান্নার সুর/ সে ছুটল।

 ছুটতে ছুটতে হঠাৎ কী দেখে এমন আঁতকে ওঠে টোরা? ওর যেন ধাঁধা লেগে গেল চোখে/ ও যেন দেখে সেই সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওর পিছু-পিছু ছুটে আসছে, রাস্তার দু-পাশের ছোটো-বড়ো ঘর-বাড়ি, মস্ত মস্ত গাছ-গাছালি/ লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটছে ওরা, কিংবা, ছুটতে-ছুটতে হাসছে ওরা/

টোরা থমকে গেল/ ও তো কোনোদিন শোনেনি, গাছ ছোটে, ঘর হাঁটে/ এ আবার কেমনতর কাণ্ড/

ভাবতে-না-ভাবতেই আর-এক ধাঁধা। টোরা দেখে গাছগুলো আর গাছ নেই। গাছগুলো সব মানুষ হয়ে গেছে/ মানুষগুলো টোরার পেছনে ছুটে আসছে/

তারা ছুটছে, তাদের ঢলঢলে প্যান্ট পায়ের কাছে ল্যাকপ্যাক, ল্যাকপ্যাক করছে। তারা বুঝি ধরবে টোরাকে/ হ্যাঁ, ওই তো তারা হাত বাড়িয়েছে/ ওই তো, লম্বা, লম্বা হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে টোরার ঘাড়টা খপাত করে ধরে ফেললে/ টোরা আর ছুটতে পারল না। টোরাকে ওরা ঘাড়ে তুলে নিলে/ ঘাড়ে নিয়ে, বিকট চেঁচিয়ে গান গাইতে লাগল, আর ধে-কেটে-ধিন নাচতে লাগল/

টোরার প্রাণ যায়/ সে-রকম নাচ টোরা জন্মে দেখেনি/ কখনো তারা হাত-পাগুলো প্রচণ্ড কাঁপাতে-কাঁপাতে বসে পড়ছে, আবার দাঁড়াচ্ছে। পা ছুঁড়ছে, হাত বেঁকাচ্ছে।

এমন সময় হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেল টোরার চোখের সামনে। হঠাৎ টোরা দেখল কী, মানুষগুলোর মুখ আর মানুষের মতো নেই। এক-একটা হিংসুটে জন্তুর মতো তাদের মুখের চেহারা। গায়ে তাদের লম্বা-লম্বা লোম। হাতের থাবায় খাড়া-খাড়া নোখ/

আঁতকে উঠে চিৎকার করে টোরা বললে, ‘আমায় ছেড়ে দাও/”

 ছাড়ল না তারা। উলটে তাদের ধারালো নোখ দিয়ে যেন টোরাকে ছিঁড়ে কুটোকুটি করে ফেলতে চাইল।

টোরা জানে, এবার তার বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। দানবের অভিশাপ সত্যি-সত্যি ফলে গেল। এই মানুষগুলো ওর মুখ দেখে জন্তু হয়ে গেছে/ ওর মুখ দেখলে যদি মানুষে জন্তু হয়ে যায়, বেঁচে লাভই-বা কী/ আর তাই মিছিমিছি বাঁচবার জন্য টোরার কাঁদতেও মন চাইল না। এই জন্তুগুলোর কথা ছেড়েই দাও/ যে মাকে সে এত ভালোবাসে, সেই মা-ই যখন তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না, তখন আর পরকে কী বলবে/

‘ দিদি/’ ওই বাদশা ছুটে আসছে।

চমকে উঠেছে টোরা। কী হবে? এই অপয়া মুখ সে কেমন করে দেখাবে বাদশাকে? ও কেমন করে চেয়ে দেখবে বাদশার মুখের দিকে?

ওই জন্তু-মুখো মানুষগুলো বাদশার ডাক শুনেই নাচতে নাচতে থমকে দাঁড়াল। ওরা টোরাকে ঘাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। টোরাকে ছেড়ে ওরা বাদশার দিকে ছুটে গেল। যেন-এক-একটা জীবন্ত শয়তান।

 টোরা নিশ্চিত জানত, এই জন্তুগুলোর হাত থেকে তার ভাই আর রেহাই পাবে না। তা হলে এখন তোমরাই বলো, কী করবে টোরা? এখন কেমন করে বাঁচাবে তার ভাই বাদশাকে?

টোরা থাকতে পারল না। চেঁচিয়ে ফেলল, ‘বাদশা, এদিকে আসিস না।

 বাদশা নিশ্চয়ই শুনতে পায়নি। ওই তো বাদশা এদিকেই আসছে/ টোরা চক্ষের নিমেষে লুকিয়ে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে।

বাদশা এখন জন্তুগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল ভয়ে/ কী বীভৎস দেখতে জন্তুগুলোকে। এমন অদ্ভুত জীব বাদশা দেখেইনি কোনোদিন। সামনা-সামনি দেখা তো দূরের কথা, ওর অমন যে নানান ছবির বই আছে, তাতেও দেখেনি। আর দাঁড়ায় বাদশা/ মার ছুট/

কিন্তু পালাতে পারল না বাদশা। জন্তুগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। জন্তুগুলো মারল লাফ। লাফিয়ে পড়ল বাদশার ঘাড়ে। ওকে ধরে ফেলেছে। তারপর ওকে নিয়ে লোফালুফি শুরু করে দিলে। ওঃ/ বাদশার নড়াটা বুঝি হেঁড়ে/ প্রাণ বুঝি যায়-যায়/

লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছে টোরা। ওর বুকের ভেতরটা গুমরোচ্ছে। এখন কেমন করে সে বাঁচাবে তার ছোট্ট ভাইটিকে?

বাদশা যখন আর পারছিল না, হাঁপাচ্ছিল বে-দম হয়ে, আর ওর চোখে-মুখে বিন্দু-বিন্দু ক্লান্তির ছোঁয়া ফোঁটা-ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল, তখন আর চুপ থাকতে পারেনি টোরা। টোরা যেন মুখ ফসকে আপনা থেকেই ডেকে উঠেছিল ‘বাদশা/’

ইশ/ এখন কী হবে/ বাদশা যদি শুনে ফেলে থাকে।

না, খুব রক্ষে/ বাদশা শোনেনি। শুনেছে ওই জন্তুগুলো।

 ওরা দেখতে পেয়েছে, ভয়ে টোরা ওই ঝোপের আড়াল থেকে ছুটে পালাচ্ছে। হ্যাঁ, টোরা ছুটেছে/ আগু পিছু কিছু না ভেবে একেবারে তিরবেগে ছুটেছে। একবার পিছনে ফিরেও তাকাল না। দেখল না, তার পালানো দেখে, জন্তুগুলো হাসতে-হাসতে ডিগবাজি মারছে আর তুড়তুড়ি কাটছে/ ওর পেছনে ছুটছে না, তাড়াও মারছে না।

এক নিশ্বাসে অনেকটা পথ চলে এসেছে টোরা। অনেক ঝোপ ডিঙিয়েছে সে, অনেকটা বন। এতক্ষণ যে চিৎকার ওর কানে তালা ধরিয়ে দিয়েছিল, সে চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। নিস্তব্ধ, নিঃঝুম চারদিক। তাই আর ছুটল না সে। থামল। ওই গাছের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ওর যেন ইচ্ছে হচ্ছিল একটু বসে-বসে কাঁদে। কিংবা ওই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, সে কী পাপ করেছে যে তার কপাল এত মন্দ। এ অলক্ষুনে মুখ নিয়ে সে কোথা যাবে? এই অলক্ষুনে মুখ নিয়ে সে কেমন করে ভাইকে নিয়ে মায়ের কাছে ফিরবে?

যখন কেউ থাকে না নিজের কাছে, যখন মনে হয় ওই আকাশই আপনজন, তখন ভারি ভালো লাগে টোরার। যখন কথা বলার কেউ চাকে না, তখন যেন আকাশই কথা বলে টোরার সঙ্গে। ওই রহস্যঘেরা আকাশ ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। আকাশের তারারা চোখ টিপে ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে/

আঃ। কী মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে/ এ তো ফুল না/ ফুলের মধু না/ কোথা থেকে ভেসে আসছে এই সুগন্ধ বাতাস? এত ভালো লাগছে টোরার। কেমন যেন আনমনা হয়ে সেই গন্ধের পথ চিনে-চিনে এগিয়ে চলল টোরা। সামনে পাহাড়। মস্ত উঁচু পাহাড়ের গায়ে-গায়ে নানা গাছ-গাছালি। গাছ-গাছালির সবুজ পাতায় মিষ্টি হাতের ছোঁয়া বুলিয়ে আদর করছে বুরুঝুরু বাতাস। টোরা পাহাড়ের কাছাকাছি যতই এগোচ্ছে, সে-গন্ধ ততই কাছে আসছে। টোরা পাহাড়ের পায়ের কাছে, পাথরের গায়ে-গায়ে পা ফেলে খুঁজতে লাগল। ও ভাবল, এখানে নিশ্চয়ই কেউ আছে। হয়তো এমন কেউ, যে ওকে ভালোবাসবে। ওর দুঃখ বুঝবে।