জাদুর দেশে জগন্নাথ – ১

জাদুর দেশে জগন্নাথ – শৈলেন ঘোষ

ওর নাম যদি জগন্নাথ হয়, তবে ওর বন্ধুর নাম মানিক।

অবিশ্যি মানিক বললে অনেকেই তাকে চিনবে না। কেননা, মানিক ওর ভালো নাম। ওর ডাক-নাম মাকু। মানিককে কেউ মাকু বলে ডাকলে রাগে জ্বলে যায় জগন্নাথ। ও বুঝেই পায় না, এমন একটা সুন্দর নাম অমন কুচ্ছিত হয়ে যায় কী করে! ভীষণ খারাপ লাগে জগন্নাথের। ওর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, তোমরা ওকে মাকু বলে ডাকবে না। ওর নাম, মানিক, বুঝলে!

বুঝবে কে? বুঝবে তো মুখের এই ঠোঁট দুটো। কিন্তু তারাই যদি বেঁকে বসে থাকে! এই ঠোঁট দুটোই যদি এঁকে-বেঁকে মানিককে মাকু বলে মুখের ফাঁকে নাচতে থাকে! তবে কী করা! যাই বল, ঠোঁটের কেরামতি আছে। নইলে, ঝকমককান্তি মানিকের ঘষা-কাঁচের মতো এমন ম্যাড়মেড়ে বেহাল অবস্থা হয়!

সে যাই বলুক, ওকে মানিক বলেই ডাকে জগন্নাথ। ডাকতে ভালো লাগে। যেমন ভালো লাগে মানিককে, তেমনি ভালো লাগে ওর নামটা। মাঝে-মাঝে জগন্নাথের মনটা যখন দুঃখে ভার হয়ে যায়, ঠিক তখনি হঠাৎ যদি মানিকের মুখটা ওর চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে, তখন যেন আবার আলোয় ভরে যায় ওর মন। মানিকের রঙিন আলোয়! তখন যেন আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে মানিককে। আর ভাবতে ইচ্ছে করে, ওর নামটা যদি জগন্নাথ না হয়ে সোনা হত! মানিক যদি জগন্নাথকে সোনা বলে ডাকে! বেশ হয়! জগন্নাথ সোনা, আর ও মানিক!

কিন্তু তা তো হয় না। হবে কেমন করে? জগন্নাথের মনের কথা তো আর মানিক জানে না। নিজের মনের কথা বলতে ভারি লজ্জা করে জগন্নাথের। মানিক যদি হাসে! হয়তো, যখন খুব ছোট্ট ছিল জগন্নাথ, তখন তোমাদের মতো জগন্নাথের মা-ও হয়তো ছেলেকে কোলে নিয়ে ‘সোনা-সোনা’ বলে কত আদর করেছে। কিন্তু মায়ের সেই আদরের সোনা-ডাক কোনোদিনই জগন্নাথের নাম হল না। কেউ ডাকেনি ওকে সোনা বলে

সত্যি, জগন্নাথ নামটা কেমন যেন! নাম শুনলে হাসি পায়! তোমাদের আর দোষ দেব কী! নিজের নাম শুনলে জগন্নাথের নিজেরই হাসি পায়! অবিশ্যি নামটা যে খুব খারাপ, তা কেউ বলতে পার না। তবে হ্যাঁ, একটু সেকেলে-সেকেলে! তবু যতই হোক ঠাকুরের নাম তো! তাই বলে যেন ভেবে বসো না, ঠাকুরের মতো আমাদের জগন্নাথও জবুথবু! ঠাকুর-জগন্নাথ কেন যে অমন হাত-পা খুইয়ে চুপটি করে বসে থাকেন, তা জানে না ও। শুধু জানে, ঠাকুর ঠাকুরই। তিনি যা করেন, সবার ভালোর জন্যেই করেন।

জগন্নাথ ঠিক তোমাদের মতো। মানে, তোমাদের চেয়ে কিছুতেই বড়ো হবে না। মানিকও তাই। মাথায় অবিশ্যি মানিক একটু ঢ্যাঙা। কিন্তু তাই বলে যেন মনে করো না, মানিক জগন্নাথের চেয়ে বড়ো। তোমরা প্রথম চোটে দেখলে ভাববে, মানিকের বুঝি বয়সের গাছ-পাথর নেই। ওকে দাদা বলা উচিত।

আসলে কী জানো, এক-একজন এমনি হয়। বয়সের নামে খোঁজ নেই, কিন্তু গতরখানি মা-দুর্গার অসুর। অবিশ্যি মানিককে অসুর কেউ বলছে না। ওকে অসুর না বলে বরঞ্চ জগন্নাথকে কেউ যদি বলে হাড়গিলে, তবে, একটুও রাগ করবে না জগন্নাথ। করবে কেন? যা রোগা-প্যাঁটকা চেহারা! সত্যি বলতে কী, ছেলেরা যদি হাড়ে-মাসে একটু শক্ত-সমর্থ না হয়, তো কেমন যেন ফ্যাকলা-ফ্যাকলা লাগে। ছেলেদের ধকল সামলাতে হয় কত! স্বাস্থ্য না-থাকলে দুর্দশার একশেষ! এই ধরো না, জগন্নাথকেই একবার যা ফ্যাসাদে পড়তে হয়েছিল! কী পিটুনিই খেয়েছে। খেয়েছে মানে কী আর যার-তার হাতে, একেবারে খোদ মানিকের হাতে! অবাক হয়ে ভাবতে বসলে তো? ভাবছ বোধ হয়, যাকে এত ভালো লাগে, তার হাতেই মার খেল!

মানিককে কস্মিনকালেও চিনত না জগন্নাথ। মানিকের সঙ্গে ভাব হওয়ার আগে ওর বন্ধু ছিল কোয়া। কোয়া জগন্নাথের কুকুর। কোয়া যখন খুব ছোট্ট, সবে হাঁটতে-চলতে শিখেছে, তখন ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিল জগন্নাথ

সেবার খুব শীত। যাকে বলে শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। রাত হয়েছে। কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চারিদিক। চোখের দৃষ্টিতে দেখাও যায় না কিছু। কোয়া রাস্তায় পড়ে-পড়ে কোঁকাচ্ছিল। আর মাঝে-মাঝে ঠান্ডাটা যখন দুষ্টুমি করে ওর গায়ে চিমটি কেটে দিচ্ছিল, তখন বেদম চেঁচিয়ে শীতটাকে ধমক মারছিল। কী সুন্দর দেখতে কুকুরটাকে। গায়ের রংটা ভেলভেটের মতো কুচকুচে কালো। কানের পাশ দুটো সাদা ধবধবে। গোলগাল, নাদুস-নুদুস। কুকুরটার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল জগন্নাথ। ওইটুকুন একটা কুকুরছানার কষ্ট দেখে ওরও ভারি কষ্ট লাগল। ভেবেছিল, আশেপাশে হয়তো ওর মা-ও আছে। গায়ে যে হাত দিয়ে একটু আদর করবে, সে আর সাহস হল না। বলা যায়, খ্যাঁক করে তেড়ে এসে কামড়ে দিলে! যতই হোক, ছেলে তো!

কিন্তু বড্ড মায়া লাগছিল জগন্নাথের। ঠান্ডায় ভারি কষ্ট হচ্ছে কুকুরটার। অত কী, জগন্নাথই ঠকঠকিয়ে কাঁপছে। তা কুকুরকে কী আর দোষ দেব! ও তো এইটুকুনি একটা বাচ্চা প্রাণী। এই হাড়কাঁপুনি শীত সহ্য করা কী আর ওর কম্ম! আহা!

‘আ-তু-তু-তু’, হাত বাড়িয়ে ডাক দিল জগন্নাথ।

ল্যাজটা নেড়ে দিল কুকুরটা। চোখ দুটো পিটপিটিয়ে নেচে উঠল। ও যেন উঠে বসবার চেষ্টা করল। জগন্নাথ আবার ডাক দিল, ‘তু-তু।’

সত্যিই, উঠে বসে জোরে-জোরে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

 ওর গালটা টিপে দিয়ে এত আদর করতে ইচ্ছে করছে জগন্নাথের। হাত বাড়াল জগন্নাথ। বাচ্চাটা মুখ বাড়িয়ে জগন্নাথের হাতে মাথা ঠেকাল। জগন্নাথ ওকে কোলে তুলে নিল। জগন্নাথের কোলের মধ্যে গোল্লা পাকিয়ে সেঁদিয়ে গেল বচ্চাটা। ঠান্ডায় জগন্নাথের কোলের মধ্যে ও যেন ডুবে যেতে চাইছে। জগন্নাথ আদর করে ওর মুখখানা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মা কোথায়?’

বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে, চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোয়া, কোয়া!’ কোয়া! কোয়া! কী যে বলতে চাইছে কুকুর ছানা জগন্নাথ আর বুঝবে কী করে! তাই আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলছিস?’

কুকুর ডাকল, ‘কোয়া, কোয়া!’

‘খিদে পেয়েছে?’

 ‘কোয়া, কোয়া!’ ‘যাঃ বাববা!’ হেসে ফেলল জগন্নাথ, ‘কী মজা দেখ, যা-ই জিজ্ঞেস করি, কোয়া! কোয়া!’

জগন্নাথ হেসে ফেলতেই কুকুরটাও ওর হাতটা চেটে দিল। জগন্নাথ বলল, ‘হাত চাটলে কী করব। খাবার দাবার কিছু নেই। আমার হাতও ফোক্কা, ট্যাঁকও টুনটুন। তোর না কী?’

‘কোয়া, কোয়া,’ চিৎকার করে উঠল জগন্নাথ। দু হাত দিয়ে লুফে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘কোয়া, কোয়া! কে রাখল তোর এমন নাম?’

জগন্নাথের বুকটা জড়িয়ে ধরেই কুকুরছানা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোয়া–কোয়া! যেন আনন্দে উপছে উঠছে তার মনটা

জগন্নাথও খুশিতে চেঁচিয়ে ওরই মতো করে ডাকল, ‘কোয়া–কো–য়া। আমিও তোকে কোয়া বলেই ডাকি। চ, শুবি চ।’

শোবে আর কোথায়! শোবে তো এখানেই। যেখানে ও শুয়েছিল। এই রাস্তায়।

রাস্তার ওপরই শুইয়ে দিল জগন্নাথ কুকুরছানাটাকে। ছানাও লক্ষ্মীটির মতো শুয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়াল জগন্নাথ। তারপর পথ হাঁটল।

জগন্নাথ একটুখানি পথ হেঁটেছে কি হাঁটেনি, এই দেখ, কুকুরছানাটাও পিছু হাঁটছে। একেবারে জগন্নাথের পায়ে-পায়ে। প্রথমটা টেরই পায়নি। কিন্তু হঠাৎ যখন আলটটকা কুকুরছানার মাথাটা ওর পায়ে ঠেকল, জগন্নাথ চমকে উঠেছে। ফিরে দেখেছে। অমনি কুকুরটা ল্যাজ নাড়তে শুরু করে দিল।

জগন্নাথ চেঁচাল, ‘এই কোথা যাচ্ছিস? পালা, পালা।’

থমকে দাঁড়িয়ে ছানাটা চেয়ে রইল জগন্নাথের চোখের দিকে, আর জোরে-জোরে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

জগন্নাথ ওকে তুলে নিল। ‘ওরে, তুই তো ভারি দুষ্টু’ বলতে-বলতে যেখানে ও শুয়েছিল, সেখানে নিয়ে চলল। তারপর নিজের জায়গায় ফিরিয়ে এনে কুকুরকে শোয়াতে-শোয়াতে বলল, ‘ফের দুষ্টুমি করলে কান। মলে দেব। চুপটি করে শুয়ে থাকবি!’ বলে জগন্নাথ নিজে ফিরে দাঁড়াল। কুকুরছানা ডেকে উঠল, ‘কিউ– কোয়া।’

জগন্নাথ আবার হেসে ফেলল। মনে-মনে ভাবল, ‘না, বেশি আদর না দেওয়াই ভালো। যতই হোক কুকুর তো! একবার পেয়ে বসলেই মুশকিল, মাথায় উঠবে।’

জগন্নাথ হাঁটতে লাগল। এবার একটু জোরে-জোরে। কুকুরও ছুটে এল নড়ে-নড়ে। জগন্নাথ ছুট দিল। কুকুরও ছুটল। ছুটল বটে, কিন্তু জগন্নাথের তো লম্বা পায়ের লম্বা ছুট, ওই ছোট্ট কুকুর কেমন করে পাল্লা দেবে! কাজেই কুকুর খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটতে-ছুটতে কুঁকয়ে-কুকিয়ে কাঁদতে লাগল। জগন্নাথের ছোটা হল না। দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবল, ব্যাপারটা কী! কুকুরটারও কি আমার মতো মা নেই! বুকটা চমকে উঠল জগন্নাথের।

সত্যি মা নেই। কুকুরের নেই। জগন্নাথেরও নেই।

জগন্নাথ জ্ঞানে কখনো মাকে দেখেনি। কেমন, মায়ের আদর কেমন, জগন্নাথ জানে না। অন্যের মাকে দেখলে ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। জগন্নাথ ভাবে, ওর মা-ও কী আর সকলের মায়ের মতো অমনি।

অমনি কিনা জানে না জগন্নাথ। শুধু জানে তার মা নেই। মাঝে-মাঝে যখন চুপটি করে ভাবে মায়ের কথা, ভাবে, ওই গাছগাছালি মাঠের দিকে চেয়ে, কিম্বা রাতের আঁধারঘেরা আকাশের দিকে চেয়ে, তখন কেমন আনন্দ-খুশিতে ওর মনটা আর ছোট্ট এই বুকটা দুলে ওঠে। ও বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, মায়ের গল্প বলো।’

বাবার কাছে গল্প শুনতে-শুনতে ওর মায়ের মুখটি যেন স্বপ্নের মতো ভেসে উঠত ওর চোখের পাতায়। মায়ের পরনে নীল রঙের শাড়ি। পায়ে ঝুমুর-ঝুমুর মল। হাতে বালা। কপাল-জোড়া টকটকে লাল সিঁদুরের ফোঁটা।

কিন্তু আর কিছু জানে না জগন্নাথ। জানে না, ও যখন ছোট্ট ছিল, ওর কপালে মা আদর করে চুমু খেয়েছে। কি না। কিম্বা নিজঝুম রাতে গুনগুন গান গেয়ে ওর চোখের তারায় স্বপ্ন-সোনা ঘুমের জাদু ছড়িয়ে দিয়েছিল কি না!

কুকুরটা আবার ডেকে উঠল, ‘কোয়া, কোয়া।

জগন্নাথের হাসি পেয়ে গেল। ইচ্ছে হল কুকুরের সঙ্গে মজা করে। ছুটল জগন্নাথ। কুকুরটাও পিছু নিল। লুকিয়ে পড়ল জগন্নাথ। কুকুরটাও দেখতে পেল। লাফ দিল জগন্নাথ। কুকুরটাও লাফিয়ে উঠল। হেসে উঠল জগন্নাথ। কুকুরটাও ডেকে উঠল। খুশির ডাক। তারপর জগন্নাথের কোলের ওপর লাফিয়ে ওঠার জন্যে দু-পা বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। জগন্নাথ লুফে নিল দু হাত বাড়িয়ে কুকুরছানাকে। নিজের কাঁধের ওপর বসিয়ে বলল, ‘চ তুই আমার সঙ্গে। তোকে পোষ মানাব।’

কুকুরছানা কী বুঝল কে জানে। জগন্নাথের ঘাড়ে বসে কান চেটে দিল। জগন্নাথ হাঁটতে লাগল। তারপর শুরু করে দিল। জগন্নাথ গাইতে জানে। তবে কী আর তেমন। ওর বাবা গান গান গাইত। যুদ্ধের গান। কদম-কদম পা ফেলে ওর বাবা সৈনিকদের যে-গানটা গাইত, সেই গান। একটাই গান জানত ওর বাবা। জগন্নাথও জানে সেই একটা গানের আধখানা। সেই আধখানা গানই কদম-কদম পা ফেলে এখন ও গাইতে গাইতে চলবে। চলবে কুকুরকে কাঁধে নিয়ে।

কোথায় চলবে?

তা কেউ জানে না। এই রাতের অন্ধকার অথবা ওই ভোরের আকাশ, কেউ ওকে বেঁধে রাখবে না। রাখতে পারে না। কেননা, কেউ নেই ওর। ও একা। যার কেউ নেই, তাকে কে বাঁধতে পারে?

অবিশ্যি জগন্নাথ আগে ভাবত, ওর কেউ নেই। এখন আর ভাবে না। আগে তো জগন্নাথ আরও ছোট্ট ছিল, তাই ভাবতে-ভাবতে ওর চোখ দুটি ছলছল করে বুজে আসত! এখন? চোখে জল আসে না। এখন ও জানে যে পথ চলে গেছে সামনে দিয়ে এ পথ দিয়ে ও যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে। কেউ বকবে না। আর সবার মতো এ-পথটাও জগন্নাথের নিজের। খুব আপনার। এ-পথ ছাড়া ওর আর কিছু নেই। কেনই বা বলি কিছু নেই? বরঞ্চ এতদিন বলা যেত ওর কিছু ছিল না। আজ আছে। একটা কুকুরছানা, কোয়া। আপাতত কোয়া ওর কাঁধে চড়ে চলবে–চলবে–চলবে। চলবে কোথায়, কোন দেশে কেউ জানে না।

কোয়া নামটা জগন্নাথ ভালোই রেখেছে। কিন্তু ভালো নামটা রাখতে জগন্নাথকে তো আর মাথা ঘামাতে হয়নি। কুকুরছানা নিজেই ডাকল ‘কোয়া, কোয়া’, আর অমনি ওই কোয়া ডাকটা নাম হয়ে জগন্নাথের মুখ ফুটে বেরিয়ে এল। এতে জগন্নাথের বাহাদুরিটা কী আছে! এখন তাকে অবশ্য মাথা ঘামাতে হচ্ছে, অন্য কথা ভেবে। কথাটা হচ্ছে, এখন কুকুরকে সে খেতে দেবে কী! নিজে না হয় দুদিন পেট কোলে করে বসে থাকা যায়, কিন্তু কুকুর? কুকুর তো আর শুনবে না। তাছাড়া কুকুরের কাছে ওরও তো একটা মান-সম্মান আমাদের এ গ্রীষ্ম যাচ্ছে, বর্ষাকাকে খড়-কুটোর বাসায় আছে! যতই হোক কুকুর এখন তার অতিথি। খাতির-যত্ন ঠিক-ঠিক না হলে লোকে নিন্দে করবে না। আর কুকুরই বা কী ভাববে!

সত্যি কথা বলতে কী, এর-ওর কাছে হাত পাততে জগন্নাথের ভীষণ ঘেন্না লাগে! সে কি ভিখিরি! যারা দুবেলা হাত পেতে ভিক্ষে করে বেড়ায়, তাদের দু-চক্ষে দেখতে পারে না জগন্নাথ। লোকগুলোর হাত আছে, পা আছে, খেটে খেতে পারে তো! চেয়ে খেতে লজ্জা করে না!

না-খেতে পেলেও জগন্নাথ মুখ বুজে পড়ে থাকবে, তবু কাউকে কিছু বলবে না। তবে ও পারে, খুব খাটতে পারে! খাটতে পারে বলেই, এর-তার বাড়িতে কাজ খুঁজে বেড়ায়। হয়তো কারো বাড়িতে ক-বালতি জল তুলে দিল, কিম্বা ফুল-বাগানে মাটি কেটে দিল। আর না হয় তো, কেউ বললে, ছাগল চরাতে মাঠে চলল। যদি কিছু না জোটে রাস্তা থেকে ছেঁড়া-ফেলা কাগজ কুড়িয়ে, থলে ভরতি করে, বাজারে ছেঁড়া কাগজের খরিদ্দারকে বেচে এল। এতে ওর লজ্জা নেই। এ-কাজ করতে ওর ভালো লাগে। ওর বাবা বলেছে, কাজ ছাড়া কে বাঁচতে পারে। আকাশের ওই সূর্যটা সারাদিন ধরে আলো দিচ্ছে, সে কাজ করছে। আমাদের এই পৃথিবীটা সারা বছর, সারাক্ষণ সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। সে-ও কাজ করছে। তাই দিন হচ্ছে, রাত আসছে। গ্রীষ্ম যাচ্ছে, বর্ষা ফিরছে। মাঠে ফসল ফলছে। শরৎ আসছে, পুজো হচ্ছে। আর চেয়ে দেখলেই চোখে পড়বে, গাছের ফাঁকে খড়-কুটোর বাসায়, মা-পাখি ছানার মুখে খাবার দিচ্ছে। কাজের কি শেষ আছে! আর ওই দেখ না, জগন্নাথের কাঁধে বসে কোয়া কেমন চলতে-চলতে দোল খাচ্ছে! দোল খেতে খেতে কেমন ফসকে গড়িয়ে পড়ছে। মাটিতে ডিগবাজি খাবার আগেই আবার কেমন জগন্নাথের কাঁধটা খামছে ধরছে! এটাও তো কাজ!

কাজ কিনা কে জানে। তবে জগন্নাথের কাঁধে চেপে দুলতে দুলতে চলতে একটুও ভয় করছে না কোয়ার। উলটে মজাই লাগছে। যতই হোক নিজেকে তো আর কষ্ট করতে হচ্ছে না। ঠিক এই মুহূর্তে ও যদি কুকুর না হয়ে মানুষ হত, তাহলে এতক্ষণে হয়তো ‘হ্যাট হ্যাট’ করে চেঁচিয়ে উঠত। আর জগন্নাথও তাহলে কোয়াকে পিঠে নিয়ে ছুটত। ঘোড়দৌড়ের মতো কুকুর কাঁধে মানুষ-দৌড়!

ঘোড়া মানুষকে পিঠে নিয়ে ছোটে, সেটার না হয় মানে বুঝি। কিন্তু এখন মানুষ একটা কুকুরছানাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে, এর কি কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছ? না, হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ছ?

শীতটা জব্বর পড়েছে। পেটে কিছু না পড়লে, সে তবু কথা শুনবে। কিন্তু এই কনকনে ঠান্ডা, সে তো আর বাগ মানবে না। শীতকে এখন যদি জগন্নাথ বলে, ‘ও বুড়ি, শীত বুড়ি, তুমি এখন ঘরে যাও তো, কোয়ার বড় কষ্ট হচ্ছে’ তা হলে পত্রপাঠ বুঝি শীতবুড়ি জগন্নাথের কথায় সুড়সুড় করে ঘরে সেঁদিয়ে পড়বে! আর সঙ্গে-সঙ্গে ফুরফুর করে বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করবে। সে-গুড়ে বালি। ভগবান মুখ দিয়েছেন কথা বলতে, মন দিয়েছেন ভাবতে, ভাবো না যা খুশি। তাতে শীতও যাচ্ছে না, বসন্তও আসছে না। আপাতত কোয়া নামে ওই কুকুরছানাকে কাঁধে নিয়ে লটর-পটর করে, এই শীতের মধ্যে, জগন্নাথকে হাঁটতেই হবে। একটাই শুধু ভয়। কুকুরটার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। বুকে সর্দি বসলে সে আর এক ফ্যাসাদ। ও তো আর এখন একা নয়। সঙ্গে কোয়া। একা হলে ওর কিছু ভাবনা ছিল না। রাস্তা-ঘাটে যেখানে তোক একটা মাথা গোঁজবার মতো ঠাঁই পেলেই নিশ্চিন্ত। আচ্ছা, কোয়াও কি জগন্নাথের মতো হারিয়ে গেছে?

একে বলে কপাল। তা ছাড়া কী বলি! জগন্নাথ যদি হারিয়ে না যেত, তাহলে কি আর কোয়ার জন্যে এমন করে ভাবতে হত! সেই ছোট্ট বাড়িটা ওদের। এখনও চোখের ওপর স্পষ্ট ভাসছে জগন্নাথের। সামনে পলাশ-গাছ। বসন্তের দিনে ফুলে-ফুলে গাছ ভরে যেত বকুল-গাছের নীচ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে কতদিন ও বাবাকে বলেছে, ‘আঃ! কী মিষ্টি গন্ধ বাবা।’ বকুল-গাছের পাতার আড়াল থেকে নীল আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে এত ভালো লাগত জগন্নাথের।

ওর বাবা ছিল সৈনিক। দলের নায়ক। দু-দুবার যুদ্ধে গেছল ওর বাবা। দুরন্ত মরুভূমির যুদ্ধে ওর বাবা শত্রুকে ঘায়েল করে পেয়েছিল বীরচক্র। হয়েছিল একটা গোটা দলের নায়ক। সত্যিই বীরের মতো বুক। ফুলিয়ে জগন্নাথের বাবা যখন শত্রুর ঘাঁটির দিকে এগিয়ে চলত, দেখে মনে হত, মরতে ভয় নেই নায়কের। থমকে দাঁড়াতে জানে না নায়ক।

সত্যিই তাই। থমকে দাঁড়াতে জানে না বলেই একবার শত্রুর কামানের মুখোমুখি পড়ে গেছল নায়ক আর তার গোটা দলটা। সেবার যুদ্ধ হয়েছিল গভীর জঙ্গলে। জঙ্গলের যুদ্ধে লুকিয়ে-ছাপিয়ে শত্রুকে খতম করা যেমন সহজ, তেমনি ভয় তো নিজেদেরও অনেক। কারণ জঙ্গলের ঝোপ-ঝাড় থেকে কখন শত্রু আচমকা আক্রমণ করে বসবে, সে তো কেউ জানে না। কোথায় শত্রু-সৈন্য ঘাপটি মেরে বসে আছে, তার টের পাওয়াই মুশকিল।

সেদিন সেই যুদ্ধের রাতে চাঁদ উঠেছিল। জঙ্গলে অসংখ্য গাছ মাথা তুলে চাঁদের আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও-কোথাও যেখানে যুদ্ধের আগুনে গাছের পাতা ঝলসে ঝরে পড়েছে, কিম্বা বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত গাছ লুটিয়ে পড়েছে, সেখানে মুঠো-মুঠো চাঁদের আলো ছড়িয়ে-ছড়িয়ে পাতাবাহারের আলপনা এঁকেছে। আর ছায়া-ছায়া গাছের পাতা সেই আলপনার ওপর ঝুনঝুনি বাজিয়ে নাচছে। বেশ কিছুটা দূরে এই জঙ্গলের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। নদীর ওপারে শত্রু-ঘাঁটি। নদীটার ড় এপার ওপার খুব চওড়া না-হলেও, খুব গভীর। কেউ যদি স্রোতের টানে বেসামাল হয়ে পড়ে, তা হলে তার রক্ষে নেই। অতল জলে হাবুডুবু খেতে-খেতে নির্ঘাত মরবে। নদীর ওপর একটা কাঠের তৈরি সাঁকো। এই-পারের জঙ্গলের রাস্তা ওই সাঁকোর ওপর দিয়ে ওপারের জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। হুকুম হয়েছে, সে-রাত্রে নদী পেরিয়ে ওপারের শত্রু-ঘাঁটি আক্রমণ করতে হবে।

জঙ্গলে রাতের নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা ভেঙে-ভেঙে ঝিঁঝির ডাক এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসছে। মাঝে-মাঝে পাতার ফাঁকে-ফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ। চাঁদের আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে জোনাকিরা নেচে বেড়াচ্ছে।

বীর নায়ক এগিয়ে চলেছে আগে-আগে। তার পেছনে দলের আর সকলে। কী সাবধানে পা ফেলছে ওরা। আলতো-আলতো ডিঙ্গি মেরে। হঠাৎ যদি অজানা কোনো শব্দ কানে আসে, নায়ক থমকে দাঁড়ায়। সঙ্গে-সঙ্গে নায়ক ইশারা করলেই ওরাও থামছে। আবার হাঁটছে। লক্ষ্য নদীর ওপর ওই কাঠের সাঁকো। শত্রু টের পাবার আগেই ওই সাঁকো পেরুতে হবে। কোনো কথা নেই কারো মুখে। শুধু ওই কজন জওয়ানের নিশ্বাসের শব্দ। ওদের পায়ের চাপে ঝোপ-ঝাড়ের ডাল-পালায় হঠাৎ-হঠাৎ যে শব্দটুকু উঠছে তাতেই যেন জঙ্গলের বুকেও চমক লাগছে।

হঠাৎ খসখস! কীসের যেন আওয়াজ শোনা গেল। হাঁটতে-হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নায়ক। দাঁড়াল সৈনিকের দল। ঝটপট শুয়ে পড়ল বুকের ওপর ভর দিয়ে। জমাট নির্জনতা। নেকড়ে বাঘের মতো ওঁত পেতে ওরা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল। না, কিছুই নজরে পড়ল না। আর কোনো খসখসানিও শোনা গেল না। তবু এখনই দাঁড়িয়ে হাঁটতে-হাঁটতে এগোলে চলবে না। তাই বুকের ওপর ভর দিয়েই ওরা এগোতে লাগল। মাত্তর একটুখানি গেছে, ওই দেখ একটা ভালুক! হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না, এই ভালুক-মহারাজই ওদের ভড়কি দিয়েছে। যখন ভালুক দেখা গেছে, তখন নিশ্চয়ই আরও ভয়ংকর কোনো জন্তুও থাকতে পারে এই জঙ্গলে। কথায় বলে বাঘ-ভালুকের জঙ্গল। তা বললে কী হবে! জন্তুর ভয়ে তো আর সৈনিক পালাবে না। যুদ্ধও থামবে না। সৈনিক এগিয়ে যাবে।

নায়ক এবার উঠে দাঁড়াল। নায়কের সঙ্গে আর সকলে। বন্দুকের নল উঁচিয়ে পা ফেলল।

আর-একটু এগোতেই কাঠের সাঁকোটা ওদের নজরে পড়ল। নায়ক দেখল, নদীর জলে ভাঙা-ভাঙা ঢেউয়ের গায়ে জ্যোৎস্নার আলো বিন্দু-বিন্দু লক্ষ-লক্ষ মুস্তার মতো দোল খাচ্ছে।

নায়কের নির্দেশে থমকে দাঁড়াল গোটা দলটা। গাছের আড়ালে-আড়ালে আড়ি পাতল। সাঁকো পেরুবার আগে সব কিছু আর-একবার ভালো করে দেখে নিতে হবে। দেখতে হবে সামনের পথ পরিষ্কার কি না, শত্রু কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কি না। থমথম করছে চারিদিক। শুধু ছলছলিয়ে নদীর জল উপছে পড়ছে পাড়ে-পাড়ে। নজরে পড়ল, একটা হরিণ-ছানা আর তার মা মুখ নীচু করে জল খাচ্ছে! চুকচুক! ওরা ভারি নিশ্চিন্ত। জানে না, একটু পরে এই জঙ্গল তোলপাড় করে বাঁচা-মরার লড়াই শুরু হয়ে যাবে। সৈনিকের দল গাছের আড়াল থেকে সতর্ক পা ফেলে বেরিয়ে এল। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে দেখলে। সজাগ কান। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওরা। নায়কের সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয় চলল সৈনিকের দল।

কিছুটা এগোতেই নাগালের মধ্যে পেঁছে গেল সাঁকোটা। ওই তো দেখা যাচ্ছে। এবার অত্যন্ত সাবধানে উঠে দাঁড়াল। ওদের সন্ধানী চোখের দৃষ্টি নদীর ওপারে স্টিথর হয়ে চেয়ে রইল।

গুড়ুম–গুড়ুম!

ও দিক থেকে আচমকা গুলি ছুটল।

 ‘ক্যাঁচক্যাঁচ’, একটা পেঁচা ডেকে উঠে ঝটপট উড়ে পালাল। ঝটর-পটর ডানা ঝাঁপটা দিয়ে আর কিচির মিচির করতে-করতে পাখি–পাখি, অসংখ্য পাখি নিজেদের বাসা ছেড়ে চাঁদের আলোয় ছোটাছুটি লাগিয়ে দিল। এতক্ষণে হয়তো সেই হরিণ-ছানা আর তার মা প্রাণপণে ছুট দিয়ে পগারপা। সৈনিকের দল এই আচমকা আক্রমণে প্রথমটা হকচকিয়ে গেছল। কিন্তু তারপরেই ঝুপঝাপ মাটির ওপর শুয়ে পড়ল। এখানে কোথাও-কোথাও নদীর জলে কাদা প্যাঁচপ্যাঁচ করছে। আবার কোথাও-বা কাঁটা-ঝাড়।

আবার গুড়ুম–গুড়ুম!

এবার এদিক থেকে উত্তর গেল, কড়-কড়-কড়-ডু-ড! গুড়ুম গুড়ুম!

তারপর গুড়ুম–গুড়ুম!

কড়-কড়-ডু-ড়।

গুড়ুম!

ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই।

যুদ্ধ লেগে গেল। নিস্তব্ধ, নির্জন জঙ্গল চকিতে গোলা-বারুদের আগুনে ঝলসে উঠল। আকাশের চাঁদের আলো, মিশকালো বারুদের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল।

নায়কের হুকুম, যেমন করেই হোক নদীর ওই সাঁকো তাদের দখলে আনতে হবে। বন্দুকের গুলির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দিয়ে তারা এগোবার চেষ্টা করছে। শুরু হয়ে গেল মুখোমুখি লড়াই। এক তিল মাটির জন্যে গুড়ুম–গুড়ুম!

গাছে-গাছে আগুন লেগে গেছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুন মাথায় নিয়ে চুপচাপ ঝলসে-ঝলসে পুড়তে লাগল বনের গাছগাছালি। নায়ক এগিয়ে গেল সাঁকোর দিকে। ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে। নায়কের সঙ্গে এগিয়ে চলল সৈনিকেরা। ওরা আর থামবে না। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে ওরা পৌঁছে যাবে নদীর ওপারে!

হ্যাঁ, ওই তো সটান সাঁকোর ওপর উঠে এসেছে। এবার নির্ঘাত ওরা পৌঁছে যাবে সাঁকোর ওপারে।

আনন্দে চিৎকার করে নায়ক হেঁকে উঠল, ‘আগে বাড়ো।’

 আগে এগিয়ে চলল সৈনিকের দল।

গুড়ুম–গুড়ুম!

 চারিদিক থেকে গুলি ছুটে-ছুটে আসছে। তবু ওরা তিরের মতো ছুটে চলল–নায়কের সঙ্গে সাঁকোটা জয় করতে। ওরা চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড আওয়াজ করে কী যেন ফেটে পড়ল–দুম!

আগুন–আগুন। যেদিকে চাও আগুন। কুণ্ডুলি পাকিয়ে, ঘন কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ওই ধোঁয়ার কুণ্ডুলি শূন্যে মিলিয়ে যেতেই নজরে পড়ল, সাঁকোটা ভেঙে গুঁড়িয়ে মুখ থুবড়ে নদীর ওপর পড়ে আছে। শত্ৰু উড়িয়ে দিয়েছে সাঁকোটা। সেইসঙ্গে ছিটকে গেছে নায়ক আর তার গোটা দলটা। কে মরল, কে বাঁচল তখন আর ভাববার সময় নেই। বিপদ দেখে ভয় পেলেও চলবে না। তাই যারা বেঁচে রইল, তারা স্থিরহয়ে নায়কের আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

নায়ক নেই। ওই সাঁকোটা বোমার ঘায়ে ধবংস হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নায়কও নদীর জলে ছিটকে পড়েছে। নায়ক আর আদেশ দেবে না ওদের। শুধু নদীর জলে ভেসে যাবে।

নায়ক সাঁতার জানে। নদীর জলে ভাসতে-ভাসতে ভীষণ কষ্ট করে, সাঁতার কাটতে লাগল। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নায়কের রক্তে নদীর জল রঙিন হয়ে উছলে উঠল। নায়ক কি বাঁচবে না?

জলে ভাসতে-ভাসতে অনেকদূরে চলে গেছে নায়ক। রক্ষে এই, শত্রুর নজর পড়েনি তার দিকে। তাহলে হয়তো গুলির পর গুলি ছুঁড়ে ওর বুকখানা ঝাঁঝরা করে দিত।

ভাসতে-ভাসতে অনেকক্ষণ পর নদীর পাড়ে গিয়ে যখন তার দেহটা এলিয়ে পড়ল, তখনও ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। মাথা ঘুরছে নায়কের। মাথা আর তুলতে পারল না। অজ্ঞান হয়ে গেল!

আর কিছু জানে না নায়ক। জানে না, কখন তাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল দলের লোকেরা।

বেঁচে গেল নায়ক। ঘরেও ফিরে এল। কিন্তু আর তাকে কোনোদিন যুদ্ধে যেতে হল না। কেননা, নায়কের ডান-পা সাঁকো-জয়ের যুদ্ধে গুলির আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সে-পা কাটা গেছে।

যুদ্ধের নায়ক, জগন্নাথের বাবা এখন খোঁড়া! কিন্তু এর জন্যে জগন্নাথের বাবার মনে কোনো খেদ নেই। কারণ বাবা জানে, দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে-করতে যে মরে, সে তো বীর! তবু তার ভাবনা একটাই? এই খোঁড়া পা নিয়ে ছেলেটাকে সে মানুষ করবে কী করে! জগন্নাথ এখনও ছোটো। বাবার খোঁড়া পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে জগন্নাথ, আর ভাবে, একদিন সে-ও যুদ্ধে যাবে। তার বাবার পা যারা খোঁড়া করে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে ও লড়াই করবে

সহজে মুষড়ে পড়ার মানুষ ছিল না জগন্নাথের বাবা। পা নেই তো কী হয়েছে। তার এই চওড়া বুকখানা তো আর দুমড়ে ভেঙে পড়েনি। এই হাত দু-খানার তাগদ যতদিন আছে, সে কাকে ভয় পায়! সে যোদ্ধা। অনেক ঝড়ঝাঁপটা তার এই মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। অসংখ্য গোলাবারুদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে। তোয়াক্কা করেনি মরতে। বিপদ মাথায় নিয়ে এগিয়ে গেছে। বিপদকে জয় করে বাঁচার মধ্যে যে আনন্দ, সেই আনন্দকেই যেন খুঁজে বেড়ায় জগন্নাথের বাবা। ও জানে, তার ছেলেও একদিন বিপদকে জয় করতে শিখবে। বীরের ছেলে, সে-ও হবে বীর!

.

একটা গাড়ি কিনল জগন্নাথের বাবা, আর একটা ঘোড়া। কী সুন্দর হালকা নীল রঙের গাড়িটা! ঘোড়াটা যেমন সুন্দর, তেমনি ডগমগিয়াল। ঘোড়ার গায়ের রং বাদামি। তাই সে ঘোড়ার নাম রেখেছে, বাদামি। গাড়ির সামনে ঘোড়া জুতল জগন্নাথের বাবা। তারপর নিজে বসল কোচোয়ান হয়ে। সোয়ারি নিয়ে গাড়ি ছোটালে, ‘হ্যাট হ্যাট। ঘোড়া ছুটল, টগবগ টগবগ।

পা গেছে বলে বসে-বসে, কপাল চাপড়ে হা-হুঁতোশ করার লোক ছিল না জগন্নাথের বাবা। ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া খাঁটিয়ে, উত্তরপাড়ার লোক দক্ষিণপাড়ার পৌঁছে দিয়ে, ছেলেকে মানুষ করতে লাগল।

গাড়ি ছুটছে। দেখে মনে হয়, রাজপথে রাজার রথ ছুটছে। ঝকমক গাড়ি, টগবগ ঘোড়া। যার যখনই দরকার পড়ছে, তখনই জগন্নাথের বাবার কাছে ছুটছে। কেউ যাচ্ছে মামার বাড়ি, কেউ চলেছে দেশের বাড়ি, কেউ চলেছে হাওয়া খেতে, কেউ-বা যাচ্ছে বিয়ে খেতে। আর গাড়ি যখন ছুটত না, তখন জগন্নাথের বাবা জগন্নাথকে কোলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে শহর ঘুরতে বেরুত। পা গেছে তো কী হয়েছে? সারাদিনে খুঁটিনাটি হাজারটা কাজ করত জগন্নাথের বাবা ওই ঘোড়ার পিঠে চেপে। খোঁড়া পায়ে পথ চলতে ঘোড়া তার বন্ধু হয়ে গেল।

একবার জগন্নাথের বাবার ডাক পড়ল বিয়েবাড়িতে। কী করতে হবে? গাড়ি করে কনেকে বরের সঙ্গে বরের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। কাল বিয়ে হয়েছে, সানাই বেজেছে। আর আজ সানাই থেমেছে, কনে গাঁটছড়া বেঁধে, মা-বাবার মায়া কাটিয়ে পরের ঘরে পর হয়ে চলে যাবে।

ফুল-পাতা দিয়ে গাড়ি সাজানো হল।

ঘোড়ার মাথায় রঙিন-পালকের সাজ পরানো হল। ঘোড়ার গলায় রেশমি কাপড়ের ঝিলিমিলি ঝুলিয়ে দেওয়া হল। ঘোড়ার গলায় ঘুঙুর–ঝনঝন বাজতে লাগল।

জগন্নাথের বাবাও সাজল। যতই হোক, নতুন বিয়ের বর-কনে আজ তার গাড়িতে চেপে বাড়ি যাবে। সে না সাজলে, বিয়ে-বিয়ে মানাবে কেন? তাই জগন্নাথের বাবা চুরিদার পাজামাটা পরে নিল, আর সঙ্গে নিল রুপো বাঁধানো লাঠিটা। পা যেদিন থেকে গেছে সেদিন থেকে লাঠিটাই ওর চলার সাথি।

ভারি মানিয়েছে কিন্তু জগন্নাথের বাবাকে!

‘হ্যাট-হ্যাট,’ বর-কনেকে নিয়ে গাড়ি ছুটল। অমনি ইংরেজি-বাজনার ব্যাগপাইপ বেজে উঠল, প্যাঁ-অ্যাঁ অ্যাঁ, ভ্যাঁপ্পো-ভ্যাঁপ্পো! সহিস হাঁকল, ‘সামনেসে হট যাও।’

ঘোড়া ছুটছে, টগবগ, টগবগ। গাড়ি ঘুরছে, চটপট, ঝটপট।

আলোর রোশনাই ঝকমক-ঝকমক।

ছুটতে-ছুটতে গাড়ি রাস্তার খানা-খন্দে যখনই টাল খাচ্ছে, কনের গা-ভরতি সোনার সাজ টুংটাং করে বেজে উঠছে।

ছুটতে-ছুটতে ঘোড়া যখনই কদমে পা ফেলছে, গলার ঘুঙুর ঝমঝম করে নেচে উঠছে। বর-কনের ঘর যাত্রা বেড়ে লাগছে দেখতে!

খানিকটা এসে, শহরটা শেষ হতেই, মাঠ পড়ল। তখন তো সাঁঝ নেমেছে, তাই মাঠ ধু-ধু গা-ছমছম! লোকে বলে, বদনাম আছে এ- মাঠের। এ-মাঠ পেরুতে দুগগা নাম জপতে হয়। এ-মাঠে ভয় আছে।

 ভয় আছে না ঘেঁচু আছে। জগন্নাথের বাবার ওসব থোড়াই কেয়ার। বুক ফুলিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সামনেসে হটো।

সামনেসে হটো, সত্যিই তো, চেঁচায় কেন সহিস? সামনে ওরা কারা? কপাল ভরতি রক্তের ফোঁটা। কানে দুলছে রুপোর মাকড়ি। হাতে ঘুরছে লোহার বালা।

‘হা-রে-রে-রে,’ করে হাঁক পেড়ে লাফিয়ে পড়ল গাড়ির সামনে। ঘোড়া চিঁহিঁহিঁ করে দুপা তুলে, দাঁড়িয়ে পড়ল পথের মাঝখানে। তারপর ‘মার মার’ করে সেই রক্তের ফোঁটাপরা লোকগুলো লাঠি ঘোরাতে লাগল।

জগন্নাথের বাবার বুঝতে বাকি রইল না, এরা কারা। নতুন কনের সোনার সাজ এরা লুঠ করবে। এরা লুঠেরা। নিমেষের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে জগন্নাথের বাবা। বুঝেছে, বর-কনেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে নিজের রুপো-বাঁধানো লাঠিটা হাতে নিয়ে ‘তবে রে শয়তান’ বলে গাড়ির ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ল। তারপর এক পায়ে খাড়া। লুঠেরার দল হুংকার দিয়ে উঠল। হুংকার দিতে-দিতে লাঠি ঘোরাতে লাগল। অমনি জগন্নাথের বাবার হাতের লাঠি সাঁই-সাঁই করে গর্জে উঠেছে। তিরের বেগে লাঠি পড়ল কারো ঘাড়ে, কারো মাথায়। কেউ ছিটকে পড়ল মাটিতে, কারো মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরল। কেউ পড়ে-পড়ে বেদম মার খেল। বাকিরা যে-যেদিকে পারল মারল ছুট। ঘোড়া চার পা তুলে লাফিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করে দিল চিঁহিঁহিঁ। জগন্নাথের বাবা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া গাড়ি নিয়ে কদম-পায়ে ছুট দিল। জগন্নাথের বাবা লাঠি ঘোরাতে-ঘোরাতে হাঁক পাড়ল, ‘সামনেসে হটো হটো’।

কোথায় গেল ইংরিজি-বাজনার ভ্যাঁগ্লো ভ্যাঁপ্পো আর কোথায় গেল সেই রং-বেরঙের আলোর রোশনাই! বাজনদার আর আলোর বাহক দে চম্পট! আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

কী সাহস জগন্নাথের বাবার! মানুষটার একটা পা। এক পায়ে এ যে ভেলকি দেখাল জগন্নাথের বাবা। গাড়ি ছুটছে। গাড়ির ভেতর বসে-বসে বর কাঁপছে ঠকঠক করে। কনে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। লুঠেরা তাদের গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারেনি। কী বাহাদুরি জগন্নাথের বাবার।

গাড়ি যখন বরের বাড়ি পৌঁছল, তখন জগন্নাথের বাবার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। বর-কনেকে ঘরে তুলে দিয়ে যখন বিদায় নেবে, তখন কনের জ্ঞান এসেছে। ছুটে এসে জগন্নাথের বাবার পায়ের ওপরে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে ফেলল। জগন্নাথের বাবা দুহাত দিয়ে কনেকে তুলে নিল। মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘বোকা মেয়ে, কাঁদছিস কেন? আমি থাকতে তোর গায়ে কে হাত দেবে! জানিস, আমি সৈনিক। যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার পা গেছে। পা থাকলে প্রাণ নিয়ে কেউ পালাতে পারত! কাঁদিস না মা। যা, ঘরে যা। তোদের আর ভয় নেই।’ বলতে-বলতে জগন্নাথের বাবারও চোখ ছলছলিয়ে উঠল। মাথায় হাত রেখে কনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে, নিজের চোখের জল চোখে নিয়ে, গাড়ি ছুটিয়ে বাড়ি ফিরল।

আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে জগন্নাথের বাবা। ঘোড়াকে রোজকার মতো দলাই-মালাই করে, দানাপানি দিয়ে ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। জগন্নাথ ঘুমিয়ে পড়েছে। এত ক্লান্তির মধ্যেও মনটা তার আজ ভারি তৃপ্ত। ভারি হালকা। মনে হচ্ছে, আজ যেন সত্যিকারের একটা কাজের মতো কাজ করতে পেরেছে। জগন্নাথের বাবা। ওই লুঠেরাদের সে শায়েস্তা করেছে। ওদের শয়তানি টুকরো-টুকরো করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ওই খোঁড়া মানুষটা।

কখন যে ঘুম আপনি এসে চোখের পাতায় ডুব দিল, বুঝতে পারে না জগন্নাথের বাবা। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। এখন ওই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে মনে হবে, ওর মতো এমন সুখী মানুষ বুঝি আর দুটি নেই। যতক্ষণ বুকের কাছে ওই ছেলেটা রয়েছে, ততক্ষণ কাকে ভয় করে সে! ভাবনা শুধু ছেলেটার জন্যে। এখনও সমর্থ হয়ে উঠতে তার অনেক দেরি। থাক দেরি, তবু নিশ্চিত জানে, এ ছেলে একদিন বড়ো হয়ে উঠে তার খোঁড়া বাপের দুঃখ ঘোচাবে। কোন বাপ না ছেলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখে? কে না ভাবে, তার ছেলে পাঁচজনের একজন হবে? জগন্নাথের বাবাও ভাবে। জগন্নাথের বাবাও স্বপ্ন দেখে। দেখে সেই ঝলমল আর সুন্দর দিনের ছবি। একদিন জগন্নাথের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনবে। তার শূন্য ঘরে আলো ফুটবে। কত আনন্দ, কত খুশি–

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল জগন্নাথের বাবার। চোখের ভেতরটা এত জ্বলে উঠল কেন? চোখ মেলেই উঠে পড়েছে। হকচকিয়ে গেছে!

এত ধোঁয়া এল কোত্থেকে ঘরের ভেতরে! তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। ঘরের দরজা খুলতেই চমকে গেছে। একি! দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে যে আস্তাবলে, আগুন লেগেছে তার সাধের ঘোড়ার গাড়িতে। চিৎকার করে উঠল, ‘আগুন। সেই চিৎকার শুনে আস্তাবলের ঘোড়াও চিহি-চিহি ডাক ছেড়ে লাফালাফি লাগিয়ে দিল। আগুনও লাফিয়ে-লাফিয়ে তার ঘরের দিকে ছুটে আসছে। বুকটা দুর-দুর করে শিউরে উঠল। ঘরে যে তার ছেলে ঘুমুচ্ছে! তাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু তার আগেই ওর মাথার ওপর লাঠি পড়ল, ধাঁই! ছিটকে পড়ে গেল ওই লম্বা-চওড়া মানুষটা। ওর ঘাড়ের ওপর কে যেন পা তুলে চাপ দিল। চেয়ে দেখল জগন্নাথের বাবা। দেখল, সেই লুঠেরাদের সর্দার।

অত সহজে হেরে যাবার মানুষ নয় সে! একটা পা গেছে তার। কিন্তু হাত দুটো তো নুলো হয়ে যায়নি। দু-হাত দিয়ে জাপটে ধরেছে সর্দারের ঠ্যাংটা। তারপর প্রচণ্ড শক্তিতে চাপ দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে সর্দারকে ছিটকে ফেলে দিল সাত হাত দূরে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে কোঁকাতে লাগল সর্দার।

জগন্নাথের বাবা ছুটে ঘরে ঢুকে গেছে। ছেলেকে নিমেষের মধ্যে পিঠে তুলে নিল। এক পায়ে লাফ দিতে দিতে ঘরের বাইরে। ততক্ষণে দুরন্ত আগুন ঘরের মধ্যে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।

ভেবে পাচ্ছে না, এখন কী করবে সে! লুঠেরার লাঠির ঘায়ে তার মাথা দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তাকাবার আর ফুরসত নেই। ও বুঝতে পেরেছে, ওই লুঠেরার দলই এই নিশুতি-রাতে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। হয়তো এবার তারা ওদের দুজনকেও মেরে ফেলবে। না, জগন্নাথকে মরতে দেবে না সে। ছেলেকে লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু কোথায়?

ওই যে লুঠেরার দল। সামনে একটু দূরে ওরা দাঁড়িয়ে। ওদের হাতে বন্দুক! না, ভয় পেল না। কারো কাছে কোনোদিন মাথা হেঁট করেনি জগন্নাথের বাবা। বুক ফুলিয়ে, ওদের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবল, এখন বোকার মতো মুখোমুখি লড়াই করলে নিশ্চিত বিপদ! তাই ও চিৎকার করে ডাক দিল তার ঘোড়াকে, বাদামি।’

বাদামিও তার হাঁক শুনে ডাক ছাড়ল, চিহি-চিহি-হি! ঘোড়া চোখের পলকে ছুটে এল তার কাছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে বাবা এক পায়ে ভর দিয়েই লাফিয়ে উঠল ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া সেই ধোঁয়ার কালো ছায়ার আড়ালে ছুট দিল। লুঠেরার দল চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাগলো, ভাগলো!’ সর্দার হুংকার দিল, ‘মার ডালে, মার ডালো!’

ঘোড়া তখন ছুটতে-ছুটতে রাস্তায় নেমেছে। সর্দারের হুকুম পেয়ে লুঠেরার দলও ঘোড়ার পিছু ছুট দিয়েছে। ওরা চেঁচাল, ‘থামো, থামো, নইলে জান যাবে।’

থামবে না জগন্নাথের বাবা! ওদের হুকুম তামিল করবে একজন সৈনিক? ও ভয় পাবে ওই নীচ লুঠবাজদের?

গুড়ুম–গুড়ুম! গুলি ছুটল।

ওই অত বড়ো বিশাল দেহটা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ঘোড়া। ওর পায়ে বন্দুকের গুলি লেগেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে জগন্নাথের বাবাও হুড়মুড়িয়ে পড়ল মাটির ওপর। তাড়াতাড়ি উঠতে গেল। পারল না। কে যেন তার মাথায় বাড়ি মারল। মাথা ঘুরে গেল। নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল সেইখানে। ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, বাবা।’ বাবা সাড়া দিল না। বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছে!

কিছুই করতে পারল না জগন্নাথও। নিমেষের মধ্যে ওই লুঠেরার দল ছুটে এসে, ছোঁ মেরে ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। জগন্নাথ কিছু বোঝবার আগেই ওরা ওকে একটা বস্তার মধ্যে পুরে ফেলল। জগন্নাথ ঘাড়ে-গর্দানে এক হয়ে বস্তার মধ্যে হাঁসফাঁসিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। কিন্তু কে শুনছে সে চিৎকার!

জগন্নাথের বাবা পড়ে রইল অজ্ঞান হয়ে রাস্তায়। আর বস্তায় বেঁধে ওরা জগন্নাথকে ধরে নিয়ে এল নিজেদের আস্তানায়।

চেঁচাতে-চেঁচাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে জগন্নাথ। আর যেন গলা ওর কথা বলতে পারছে না। ও যেন ঝিমিয়ে পড়ল।

এ কোথায় নিয়ে এল ওরা জগন্নাথকে। অন্ধকার রাত। বোঝাই যায় না। ওরা বস্তাটা ধপাস করে আছড়ে শান বাঁধানো মেঝের ওপর ফেলল। লাগল জগন্নাথের। লেগেছে মাথায়। তবু একটুও শব্দ বেরুল না ওর মুখ দিয়ে।

 বস্তাবন্দি হয়ে মেঝের ওপরই পড়ে রইল জগন্নাথ সেই অন্ধকার রাত্রে। জগন্নাথ আসলে কিছুই বুঝতে পারেনি। বোঝবার সময়ই-বা পেল কই? তাছাড়া সব কিছু বোঝবার মতো সময়ও তার হয়নি। এখনও। সব কিছু কেমন যেন ওর ঘুম-জড়ানো চোখের ওপর আচকা ঘটে দোল, কী সে হল, কেন য়েতাদের বাড়িতে আগুন লাগল আর বাবা যে কেন জগন্নাথকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুটছিল, এসব ‘কেন’র কিছুই উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না জগন্নাথ। শুধু ওর বাবার মুখখানা যখনই হঠাৎ-হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছিল, তখনই বস্তাটা ছিঁড়ে ফেলার জন্য ওর ছোট্ট হাত দুটি আঁকপাক করে টানাটানি লাগাচ্ছিল। টানলে কী হবে! বস্তা ছিঁড়ছে না। সে-শক্তি তার নেই। ওর যেন দম আটকে আসছে।

কখন অজানতে অন্ধকার রাতটা কেটে গেল। জগন্নাথ বুঝতে পারল, এখন সকাল হয়েছে। কেননা, কাক ডাকছে। হঠাৎ যেন মনে হল, কারা ফিসফিস করে কথা বলছে!

হ্যাঁ, কথাই বলছিল লুঠেরার দল। ওরা জগন্নাথের বস্তাটা টেনে তুলে নিল। এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চলল জগন্নাথকে। ও আর একবার সেই বস্তার মধ্যে তেড়েমেড়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল, পারল না। বুকটা ওর কেঁপে উঠল, ভয়ে। হাঁপাতে লাগল জগন্নাথ!

ওকে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এল লুঠেরার দল। মস্ত চত্বর। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গাটা। পাঁচিলের একদিকে একটা লোহার ফটক। সেই চত্বরের মাঝ-বরাবর ওরা বস্তাটা ছুঁড়ে ফেলল। তারপর বস্তার মুখটা খুলে, জগন্নাথকে টেনে বার করল। জগন্নাথের চোখ দুটি এতক্ষণ অন্ধকারে বন্ধ ছিল। হঠাৎ খোলা আলো চোখে পড়তেই ঝলকে উঠেছে চোখ দুটি। চাইতে পারছে না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল জগন্নাথ। পা দুটি টলছে তার।

জগন্নাথের চোখের দৃষ্টি ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল আলোয়। ও দেখল, একটু দূরে, একদল লোক তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখগুলো লাল টকটক করছে! জগন্নাথ বুঝতে পারল না এরা কারা। শুধু এইটুকু বুঝল, কাল রাত্রে ওরাই তার বাবার মাথায় লাঠি মেরে রক্ত বার করে দিয়েছে। বুঝল, ওরাই জগন্নাথকে ধরে এনেছে। কিন্তু এখন যে সে কী করবে, সেটাই ঠিক করতে পারছে না। বুঝতে পারছে না, এখান থেকে ছুটে পালাবে কি না। পালাবেই বা কোথা? চারপাশের পাঁচিল এত উঁচু, লাফালেও নাগাল পাবে না। তাছাড়া লাফানোর কথা এখন ওঠেই না। ওর বলে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছে! তবু সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতেই পা ফেলবার চেষ্টা করল।

হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, কাড়া-নাকাড়া বাজলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি একটা ভয়ংকর শব্দ করে বাজনা বেজে উঠল। জগন্নাথ চমকে চাইতেই দেখল, সামনে একটা ষাঁড়! তার দিকে শিং উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটা থতমত খেয়ে গেছে জগন্নাথ। নিমেষের মধ্যে নিজেকে সামলে জগন্নাথ সেই দোমড়ানো-মোচড়ানো শরীরটা সিধে শক্ত করে নিল। ষাঁড় ছুটে এল জগন্নাথের দিকে। জগন্নাথ হকচকিয়ে গেছে। বুঝল তার বিপদ। তখন আর কিছু ভাববার সময় নেই তার। ও লাফ দিয়ে সরে গেল। ষাঁড়টা জগন্নাথকে মারতে গিয়ে নিজেই মারল এক গোঁত্তা পাঁচিলের গায়ে। আর বলব কী, সঙ্গে-সঙ্গে ওই কাড়া-নাকাড়ার শব্দটা যেন দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠল। ষাঁড়টাও রেগে কাঁই! চার পা তুলে ভীষণ দাপাদাপি শুরু করে দিল। ওই পাগলা ষাঁড়কে সামাল দেবার সাধ্যি আছে জগন্নাথের! আবার তেড়ে আসছে ষাঁড়! দিল গুঁতিয়ে! না, এবারও সামলে নিয়েছে জগন্নাথ। কিন্তু এ কী! হঠাৎ জগন্নাথ ষাঁড়ের পেছনে ছুটল কেন?

এক লাফ মারল সে! ছেলের কী সাহস দেখা! লাফ দিয়ে সে ষাঁড়ের পিঠের ওপর বসে পড়েছে! বসেই ষাঁড়ের ল্যাজে পাক মেরেছে! আর কে দেখে! ষাঁড় তিড়িং-বিড়িং ঠ্যাং ছুড়ল এদিক ওদিক ছুট মারল। চত্বরের চারপাশে চরকি খেতে লাগল। তখন ষাঁড়ের সামনে যাবে কে? গুতিয়ে নাড়িভুড়ি বার করে দেবে না! জগন্নাথ কিন্তু ছাড়বার পাত্তর নয়! পিঠে বসে, ষাঁড়ের ল্যাজে পাক দিতে-দিতে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল শিবঠাকুরের বাহনটিকে! ঠ্যাংই ছোড়ো আর লাফই মারো, জগন্নাথ ছাড়ছে না! এ তো দেখি উলেটো বিপত্তি! কোথায় জগন্নাথকে ঠান্ডা করার জন্যে ষাঁড়কে আনা হল, এখন তো জগন্নাথই ষাঁড়কে জব্দ করে ছাড়ছে। এবার যদি ষাঁড় কেটে পড়তে না পারে, তো নির্ঘাত ষাঁড়-বাবাজির প্রাণ বেরুবে! কিন্তু কাটবে কোন দিকে! এদিক-ওদিক সব দিকে ছুট মেরে ষাঁড় যখন কিছু কূল-কিনারা করতে পারল না, তখন মারল টু ওই লোহার ফটকে। ফটক ভাঙল না। জগন্নাথ ভাবল, এই তো তাল। ল্যাজটা এবার আরও জোরে দিয়েছে। পেঁচিয়ে। ষাঁড় আবার হুড়মুড়িয়ে ফটকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তবুও ফটক ভাঙল না। তবে আর একবার দে নাচিয়ে! ষাঁড় থাক-প্রাণ যাক প্রাণ করে ফটকের ওপর এমন ছিটকে পড়ল যে ফটক ধড়মড় করে মাটির ওপর চিৎপাত! আর দেখতে, ষাঁড়ও ল্যাজ তুলে ভাঙা ফটক টপকে মার ছুট! জগন্নাথ ছুটন্ত ষাঁড়ের ল্যাজ মুড়িয়ে আরও জোরে ছোটার জন্যে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাট, হ্যাট।’

ষাঁড় জগন্নাথকে পিঠে নিয়ে তিরের মতো ছুটতে লাগল।

লাল টকটকে চোখওলা মানুষগুলো তো তাই দেখে থ। তাদের কিছু বোঝার আগেই ষাঁড় পগারপার। আর এমনই বরাত, হাতের কাছে একটা বন্দুকও রাখেনি কেউ! কে আর ভেবেছিল বন্দুক লাগবে? ভেবেছিল, ষাঁড়ের গুঁতোতেই ছেলের পিণ্ডি চটকে যাবে! কিন্তু এখন নিজেরাই ভোঁতা মুখে থোঁতা হয়ে বসে থাকো!

কিন্তু বসে থাকার জন্যে তো আর জন্মায়নি ওই লুঠেরার দল। যখন দেখল, সত্যিই ষাঁড়ের পিঠে চেপে ছেলেটা ভাগছে, তখন তারাও ‘ধর ধর’ করে তাড়া লাগাল। কিন্তু ধরবে কে? আর কাকেই বা ধরবে। একটা পুঁচকে ছেলের পাল্লায় পড়ে ষাঁড়-বাবাজি নাস্তানাবুদ। ঈশ কী ঘেন্না! ঘেন্না যত পাচ্ছে, ষাঁড়ের গোঁ তত বাড়ছে। গোঁ তো গোঁ, ষাঁড়ের গোঁ! মোচড় খেয়ে ল্যাজই ছিডুক, কী হোঁচট খেয়ে থুবড়ে মরুক, উনি থামবেন না! দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটবেন।

ষাঁড়ের সঙ্গে ছুটে লুঠেরার দল পারবে কেন? তারা একেবারে বেপাত্তা! এখন ভাবছে, ছেলেটা যাক ক্ষতি নেই। ষাঁড়টা ফিরলে বাঁচি!

আর ফিরেছে! বাঁটকুলে ষাঁড় বেঁটে ঠ্যাং-এ দৌড় মেরে, রাস্তাঘাট, দোকান-মাঠ ছাড়িয়ে-ছুড়িয়ে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চোঁচা পিটটান!

 নিশ্চিন্ত হল জগন্নাথ। লোকগুলোকে আর দেখাই যাচ্ছে না। জগন্নাথ ভাবল, এখন থামা যায়, ষাঁড়ের পিঠ থেকে নামা যায়। তাই পেছনবাগটা আর একবার ভালো করে পরখ করে জগন্নাথ ষাঁড়ের ল্যাজের থেকে হাত সরিয়ে প্যাঁচ মারা থামাল। কিন্তু কই, ষাঁড় তো থামল না? যেমন ছুটছিল তেমনিই ছুটছে। জগন্নাথ ভাবলে, এ তো দেখি উলটো ঝাট! ষাঁড়টা শেষে খেপে গেল নাকি! তাই ষাঁড়ের মেজাজটা ঠান্ডা করার জন্যে ও নরম সুরে তাল দিল, ‘আ-আ! থাম-থাম!’

ষাঁড়ের বয়ে গেছে। সে যেমন ছুটছিল, তেমনিই ছুটছে। জগন্নাথ থামবার জন্যে যতই ‘আই-আই’ করে, ষাঁড় ততই পাঁই-পাঁই ছোটে। এবার কিন্তু ভয় পেয়ে গেল জগন্নাথ! দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ষাঁড় বুঝি আর থামবেই না। তা হলে এখন কী করা যায়! এ তো আর ছাগল-ভেড়া নয় যে, ধমক দিয়ে সামলে নেবে! এর নাম ষাঁড়! বিগড়োলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে বিগড়েই গেছে! এখন কী করবে জগন্নাথ। ওর পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়বে নাকি। কিন্তু হাত-পা ভাঙলে?

 একে বলি ভাগ্য! কেননা, পড়বি তো পড়, সামনে রাস্তার গায়ে, একটা গাছ। একটা ডাল নিচু হয়ে ঝুলে আছে। রাস্তায় ওপর। চট করে মাথায় বুদ্ধি এসে গেল জগন্নাথের। করেছে কী, গাছের নীচ দিয়ে ষাঁড়টা যেই ছুটতে যাবে, জগন্নাথ অমনি ঝপাং করে একটা ডাল ধরে ফেলেছে। ধরেই পড়েছে ঝুলে ষাঁড়ের পিঠ থেকে গাছের ডালে! ঝুল-ঝুল বাদুড়-ঝোলা! কিন্তু এ কী! তবুও তো ষাঁড় থামল না। ল্যাজ উঁচিয়ে যেমন ছুটছিল তেমনিই ছুটছে। ছুটতে-ছুটতে নিশ্চিন্দিপুর! পেছন ফিরে একবার দেখলেও না যে, পিঠ থেকে লাফ মেরে তার সওয়ার জগন্নাথ ঠ্যাং-ঝোলা হয়ে গাছে দোল খাচ্ছে!

ষাঁড় তো গেল, সে না হয় হল, কিন্তু এমনি করে বাঁদরের মতো ডাল জাপটে জগন্নাথ আর কতক্ষণ থাকতে পারে? কষ্ট তো হচ্ছে বটেই। তা ছাড়া ওর তো আর জানতে বাকি নেই, ষাঁড় খুঁজতে সেই পাজি লোকগুলো এক্ষুনি এসে পড়বে! তাই চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে তরতর করে গাছের মগডালে উঠে পড়ল। পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইল। এখানে আর ওকে খুঁজে পেতে হচ্ছে না!

রাস্তাটা নাক-বরাবর সিধে চলে গেছে। ডাইনে বাঁয়ে অনেকদূর অবধি স্পষ্ট দেখা যায়। সুতরাং কেউ যদি এদিকে আসে, অনেক দূর থেকেই জগন্নাথ দেখতে পাবে। ষাঁড়ের হাত থেকে এখন সে না হয় নিস্তার পেল। কিন্তু কে ভরসা দিতে পারে যে, ওই লুঠেরাদের খপ্পর থেকে জগন্নাথ রক্ষা পাবে! এই সময় যদি একটা বন্দুক থাকত জগন্নাথের কাছে! তাহলে লুঠেরাই আসুক, কী ভূতেরাই আসুক, গুড়ুম–গুড়ুম! জগন্নাথের কাছে সব ঠান্ডা! ওর বাবা যখন যুদ্ধ করত, বন্দুক ছিল। জগন্নাথ কতবার সেই বন্দুক হাত দিয়ে দেখেছে। বন্দুকের ভেতর চোখ রেখে কেমন করে শিকার টিপ করতে হয় তা ও জানে।

বলো, এইভাবে গাছের ডালে বসে থাকা যায়? অনেকক্ষণ তো কাটল, তবু তো প্রভুরা এখনো এলেন না! তবে কি তাঁরাও ষাঁড়ের মায়া ত্যাগ করে, ঘরের ভেতর নাকডাকতে শুরু করে দিয়েছেন? হুঃ! গেছে তো ভারি একটা ষাঁড়! ওরা অমন ইচ্ছে করলে, একশো-দুশো ষাঁড় নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডশুরু করে দিতে পারে। সে না হয় ঠিক আছে। একশো-দুশোর জায়গায় পাঁচশো-ছশো ষাঁড় আসুক। ষাঁড় নিয়ে যত পারে ষণ্ডাষণ্ডি করুক, কিন্তু এখন যে জগন্নাথের দফা-রফা হয়ে যাচ্ছে। ভেবেই পাচ্ছে না জগন্নাথ, কখন বাবার কাছে ফিরে যাবে। তাছাড়া কোন রাস্তা দিয়ে যে ও ফিরে যাবে, তাও বুঝতে পারছে না। এ কোথায় যে এসে পড়েছে সে, কে জানে!

না, এখনও যখন এল না, মনে হচ্ছে আর কোনো ভয় নেই। ভয় থাক আর নাই থাক, জগন্নাথ আর গাছের ডালে এমন হনুমানের মতো বসে থাকতে পারছে না। কী ঝকমারি! ভালোরে-ভালো, কাল সারারাত বস্তাবন্দি হয়ে কোনোরকমে প্রাণটি নিয়ে বেঁচে ছিল। তারপর ষাঁড়ের গুঁতো! আর এখন? এ আবার কোন গাড্ডায় পড়ল বলো?

‘এই জগন্নাথ।’

বুকটা ধড়াস করে উঠেছে। কেউ ডাকল নাকি তার নাম ধরে! চোখ ফিরিয়ে এদিক-ওদিক দেখলে জগন্নাথ। কিন্তু কেউ নেই তো!

‘এই জগন্নাথ!’

সত্যিই তো, আবার ডাকল! আর কথা আছে। গাছ থেকে দুড়দাঁড়িয়ে লাফ মেরে দে লম্বা! জগন্নাথ টেনে ছুট মারল।

ছুটুক। কিন্তু ছুটবে কোথায়? বিপদ যখন আসে তখন তো আর একদিক থেকে আসে না। সাঁড়াশির মতো দাঁত খিঁচিয়ে চারদিক থেকে তেড়ে আসে! তা না হলে জগন্নাথ ওই লুঠেরাদের ভয়ে যতক্ষণ গাছের ডালে বসে ছিল, ততক্ষণ তাঁদের টিকিটি দেখা যায়নি! যেই না ও গাছ থেকে নেমেছে অমনি একেবারে সামনা সামনি! এই রে! কে জানে ওরা জগন্নাথকে দেখতে পেল কি না! কিন্তু জগন্নাথ তো দেখে ফেলেছে। আর দেখতে আছে? জগন্নাথ দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দে ছুট! |

বলব কী, সঙ্গে-সঙ্গে আবার সেই ডাক। এবার যেন একটু ব্যস্ত হয়ে ডাকল, ‘এই জগন্নাথ, পালাচ্ছিস কেন? দাঁড়া, দাঁড়া!’

 এ কী রে! এ যে একটা বাঁদর!

বাঁদর! তাই তো, তাই তো! বাঁদর-মহারাজই তো গাছের ডালে আগ বাড়িয়ে ডাকছে! এ আবার কোন দেশি বাঁদর রে বাবা, কথা বলে!

জগন্নাথ জানে, যে পালায় সে বাঁচে, সুতরাং, এখন তার পিছুই ডাকো আর সামনে হাঁকো, কিছুই সে দেখল না ছুট-ছুট-ছুট

অমন করে ছুটে পালালে কার নজরে না-পড়ে। ঠিক দেখতে পেয়েছে লুঠেরার দল। আর কথা আছে! ওরাও দিয়েছে ছুট জগন্নাথের পিছু। কিন্তু যেতে তো হবে এই গাছের নীচ দিয়ে! যাক না একবার! গাছের ওপর বাঁদর-মহারাজ! তিনি তো কোমর বেঁধে তৈরি। হাতে তার ভাঙা ডাল। তাই যেই না প্রথম জন গাছের নীচ দিয়ে ছুটে গেল, ধাঁই! মাথায় গাছের ডালের ঘা পড়ল। ধপাস! লোকটা পড়ে গেল। যেই না দ্বিতীয় জন ছুটে জগন্নাথকে ধরতে গেল, ঠকাস! ঘাড়ে লাঠি পড়ল। মটাস! ঘাড় ভাঙল। তারপর বাঁদর-মহারাজ আনতাবড়ি সাঁই-সপাসপ, ধাঁই-ধপাধপ করে গাছের ওপর লাঠি ঘুরিয়ে লাঠালাঠি শুরু করে দিল। আরে সববনাশ! দেখো, দেখো, কী বেদম ঠেঙানি দিচ্ছে!

ঠেঙানি খেতে-খেতে বাঁদরের কাছে লুঠেরার দল যখন হেরে গো-হারান হয়ে গেছে, তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালা, পালা, পালা! পিটুনির ঠেলায় বাপ বলতে তর সইল না! কারো হাড় ভাঙল। ঘরে ফিরে ভাঙা হাড়ে মালিশ করতে বসল। কারো গা কাটল। কাটা ঘায়ে মলম-পটি বাঁধতে লাগল।

লুঠেরার দল ভেগে পড়তেই, বাঁদর গাছ থেকে মেরেছে লাফ। লাফ মেরেই জগন্নাথের পিছু ছুটল। ডাক দিল, ‘জগন্নাথ জগন্নাথ। দাঁড়া, দাঁড়া

জগন্নাথ চেয়েই দেখল না। ছুটতে-ছুটতে জগন্নাথও চেঁচাল, ‘বাবা, বাবা!’

ছেলে বিপদে পড়ে বাবাকে হাঁক পেড়ে ডাকছে, এ তো আর কোনো আশ্চর্য কথা নয়। কিন্তু একটা বাঁদর জগন্নাথের নাম ধরে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ছুটছে, এ দেখলে তো লোকে তাজ্জব বনে যাবে!গেলে আর কী করা! ওই তো ডাকছে। কেউ তো আর কানে তুলো গুঁজে বসে নেই যে, শুনতে পাবে না!

বাঁদরের সঙ্গে ছুটে জগন্নাথ পারবে কেন? ওরা যেমন ছুটতে পারে, তেমনি লাফ মেরে হাঁটতে পারে। কাজেই জগন্নাথ যতই ছুটুক, বাঁদর ঠিক ধরে ফেলবে।

ধরে ফেলবে বলি কেন, ওই তো ধরেই ফেলেছে। জগন্নাথের একদম কাছাকাছি এসে পিছন থেকে বাঁদর চেঁচাল, ‘এই জগন্নাথ।’

জগন্নাথ চেঁচানি শুনল না।

 বাঁদর তখন জগন্নাথের মুখের সামনে লাফ মেরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কোথা যাচ্ছিস?’

 জগন্নাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাঁপাচ্ছে। বাঁদরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! ভাবল, এতক্ষণ কি তা হলে বাঁদরটাই তার নাম ধরে ডাকছিল! কিন্তু বাঁদর কথা বলতে পারে, এমন কথা তো ও কস্মিনকালেও শোনেনি।

বাঁদর ব্যস্ত-গলায় আবার বলল, ‘পালাতে হবে। এক্ষুনি ওরা এসে পড়বে। আমার পিঠে চাপ।

জগন্নাথ ভাবল, যাঃচ্চলে! বাঁদরটা তো বেশ স্পষ্ট-স্পষ্ট কথা বলছে! মুখের ফাঁকে ফসকাচ্ছে না, আটকাচ্ছেও না। আর এতই যখন গায়ে পড়ে ভাব করতে চাইছে, তখন বাঁদরের সঙ্গে কথা বলতে তার কোনো কিন্তু-কিন্তু না-করাই ভালো। তাই বলল, ‘তুই কোন দেশি বাঁদর রে, কথা বলছিস?’।

বাঁদর উত্তর দিল, ‘বাঁদর আমি বিদেশি, তবে কথা বলছি এ-দেশি। আমি লেখা-পড়া জানা বাঁদর কিনা!

জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল, ‘তুই লেখাপড়া জানিস?’

 ‘নির্যস! আর, জানি বলেই তো তোকে পিঠে চাপতে বলছি।’ উত্তর দিল বাঁদরটা। জগন্নাথ বলল, ‘আমি তোর চেয়ে বড়ো। আমার ভার সামলাবি কী করে? তুই মুখ থুবড়ে পড়লে, আমি মরব যে।

বাঁদর উত্তর দিল, ‘আমার পিঠে চাপলে তোর পড়ার ভয় নেই। তবে না-চাপলে চ্যাঁক-চুক হয়ে যাবার যথেষ্ট কারণ থেকে যাচ্ছে!

বাঁদরের কথা শুনে জগন্নাথ ফ্যালফেলিয়ে গেল। কেননা, চ্যাঁক-চুক কথাটা তো সে কোনোদিন শোনেনি। কথাটার যে কী মানে তা-ও সে জানে না! না-জানলেও জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না। তাহলে বাঁদরের কাছে মুখ থাকে না। বাঁদর বিদেশি হয়েও যে-কথাটা জানে, জগন্নাথ এ-দেশি হয়েও সে-কথাটা জানে না, এ-কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে লোকে থুথু করবে! তাই জগন্নাথ ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বাঁদরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর পিঠে চাপলে বাবাকে খুঁজে পাব?

বাঁদর বলল, ‘দেখা যাক, মঙ্গলে ক্ষুধা, বুধে পাঁউরুটি! নে তো, এখন পিঠে বস।’

এ- কথা বলতেই হবে, কথা-বার্তায় বাঁদরটা জগন্নাথকে কাত করে দিয়েছে। কারণ ‘মঙ্গলে ক্ষুধা, বুধে পাঁউরুটি’ এ সব কথা জগন্নাথ শোনেইনি কোনোদিন। তাই আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না-করে ওর পিঠের ওপর উঠে পড়ল!

বাঁদর বলল, ‘আমার গলাটা হাত দিয়ে যথেষ্ট জড়িয়ে ধরবি।’

জগন্নাথ যথেষ্ট জড়াল কি না বলা যথেষ্ট শক্ত, কিন্তু দেখা গেল বাঁদরটা ওকে পিঠে নিয়ে লাফিয়ে, খানাখন্দ পেরিয়ে বেমালুম বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। জগন্নাথ যেন হালকা ফুস, একটা চড়াই পাখি!

জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস রে বাঁদর?’

বাঁদর উত্তর দিল, ‘আজ একাদশী? সব কথা বলতে নেই, শুনতেও নেই। পেটের যেমন উপোস, মুখেরও তেমনি হা-হুঁতাশ!’

জগন্নাথ চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো গোল্লা-গোল্লা করে বলল, ‘অ!’

 বাঁদরটা আবার বলল, ‘তবে আমাকে তোর বাঁদর বলা উচিত নয়। কেননা, বাঁদর আমার নাম নয়। অসভ্য, অশান্ত, অবাধ্য, ইত্যাকার বিভিন্ন প্রকারের বালক-বালিকাদের বাঁদর বলে। আমি আসলে মাংকি।’

জগন্নাথের মুখ ফসকে আবার ফুট করে বেরিয়ে এল, ‘অ!’।

 লাফাতে-লাফাতে ছুটতে-ছুটতে হঠাৎ বাঁদরটা একটা পেয়ারা গাছের নীচে ঝুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছ থেকে একটা পেয়ারা ছিঁড়ে জগন্নাথকে বলল, ‘খা।’

জগন্নাথ মুখটা বিচ্ছিরি করে বলল, ‘খেতে ইচ্ছে নেই।’

বাঁদর বলল, ‘খেয়ে নে। এখনও অনেকটা যেতে হবে!’

‘কেন, আমাদের বাড়িটা কি এখনও অনেক দূরে?’ জিজ্ঞেস করল জগন্নাথ।

সিধে সাফ-সাফ উত্তর না দিয়ে, বাঁদরটা বেঁকা মুখে কেমন ‘হুঃ! হুঃ!’ করে হেসে দিল। তারপর জগন্নাথকে পিঠে নিয়ে আবার লাফ মারল।

বাঁদরের হাসি দেখে জগন্নাথের খুবই সন্দেহ হয়েছে। জগন্নাথ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমায় নামিয়ে দাও, তোমার মতলব খারাপ।’

জগন্নাথের চেঁচানি শুনেই বাঁদরটা কেমন চুপসে গেল। জগন্নাথকে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘তুই বিশ্বাস কর, রামছাগলের দিব্যি করে বলছি, সেরকম আমার কোনো অসৎ অথবা অন্যে ইচ্ছাও নেই, অনিচ্ছাও নেই। তবে কী জানিস, তোর বাবাকে তো আমি খুঁজে দিতে পারব না, তাই তোকে আমার তাল-ফুলুড়ি মামার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। মামার তো অফুরন্ত বুদ্ধি, মামা টুসকি মারতে-মারতে বলে দেবে কোনদিকে তোদের বাড়ি।’

 জগন্নাথ বাঁদরের কাকুতি-মিনতি শুনে ঠান্ডা হলেও ওর কেমন যেন কান্না-কান্না পাচ্ছিল। কতক্ষণ বাবাকে দেখেনি। আর এমন করে, বাবাকে হারিয়ে, বাঁদরের পিঠে চেপে তাকে তাল-ফুলুড়ি মামার কাছে যেতে হবে, এ-কথা ভাবতে-ভাবতে ওর পিঠটা যেন টনটন করে উঠল। জগন্নাথ পিঠটা টানটান সিধে করতেই বাঁদর বলল, কী রে, উচ্চিংড়ির মতো অমন চিংকিড়ি, চিংকিড়ি করছিস কেন?’

জগন্নাথ এবার মরিয়া হয়ে গেল। পেয়ারাটায় তেড়েমেড়ে একটা কামড় দিয়ে বলল, ‘ছাই-ভস্ম কী যে বলছিস তুই, কিছুই মানে বুঝছি না।’

বাঁদর জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মানে?’

 ‘চিংকিড়ি, চিংকিড়ি!’

‘এই রে, সমূহ আকুপাংচার! তুই যদি চিংকিড়ি কথাটার মানে না বুঝিস, তা হলে তো তোর দারুণ বিপদ! তাল-ফুলুড়ি মামা তো তোকে তাল ঠুকে থ্যাবড়া করে দেবে।’

‘তাহলে থাক, তোমার মামার কাছে গিয়ে কাজ নেই। বিরক্ত হয়েই জগন্নাথ উত্তর দিল।

বাঁদর বলল, ‘দেখ, তুই মিছিমিছি হুজ্জতি করছিস। আমি তোর হিতের জন্যেই তোকে পিঠে নিয়ে মামার কাছে যাচ্ছি। এতে কি আমি দুটো পয়সা পাব? না, আমার সোনার সিংহাসন হবে? তোকে দেখে আমার মনটা দুঃখু-দুঃখু পাচ্ছিল বলেই এই ঝক্কি আমি নিয়েছি। নইলে আমার অত কী দায় পড়েছে! যাই হোক, এবার আমায় ভালো করে বাগিয়ে-বুগিয়ে ধর, মামার বাড়ি এসে গেছে।’

এসে গেছে বলতেই জগন্নাথ ঝটপট মুখের ভেতর থেকে পেয়ারার ছিবড়েগুলো থুঃ থুঃ করে ফেলে দিল। এতক্ষণ ধরে চিবুচ্ছিল। বাঁদরটা থপাস করে একটা বাড়ির ছাতের ওপর লাফ দিল। জগন্নাথ একটু টাল খেয়ে সামলে নিতেই বাঁদরটা বলল, ‘এবার নাম।

জগন্নাথ কি অতশত বুঝেছে! ভালোমানুষটির মতো বাঁদরের পিঠ থেকে নেমে যেই ছাতে পা দিয়েছে। অমনি সড়াত! ছাত ফুটো হয়ে জগন্নাথ নীচের দিকে গোঁত্তা খেল। তারপর পা ফসকে আলুর দম। ছাত থেকে সটান ডিগবাজি!

কী কাণ্ড দেখো! জগন্নাথ যে পড়ল, তা দেখে বাঁদরটা কোথায় ভয় পাবে, তা না ব্যাটা তেওঁটের মতো হেসে উঠেছে! এমন ন্যাকা বাঁদর জন্মে কেউ দেখেছে! ছেলেটার হাত ভাঙল, না পা মচকাল সেদিকে খোঁজখবর নেই, বেহায়ার মতো চিল্লিয়ে-চিল্লিয়ে হাসছে।

কিন্তু এ কী ব্যাপার!

কী ব্যাপার!

জগন্নাথের হাতও ভাঙল না, মাথাও ফাটল। পা হড়কে সটান একটা ঘরের মধ্যে পড়ল। পড়ল ঠিকই, কিন্তু অবাক কথা–একটুও লাগল না! মনে হল, একটা নরম গদির ওপর বসে পড়েছে জগন্নাথ। নিজের চোখ দুটো কচলিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখতেই জগন্নাথ হাঁদাগঙ্গারাম! দেখে কী, সে একটা দোলনার ওপর বসে-বসে দোল খাচ্ছে! আর একটা লোক তার সঙ্গে দুলে-দুলে নাড়ি টিপে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন অদ্ভুত আর উদ্ভুট্টি গোছের লোক জগন্নাথ এর আগে আর কক্ষনো দেখেনি। লোকটার মাথার চুলগুলো শজারুর কাঁটার মতো খাড়া-খাড়া। কান দুটো অনেকটা গাধার কানের মতো লম্বা। ঠোঁট দুটো থ্যাবড়া বন মানুষ! নাক নিয়ে কথা না-বলাই ভালো। কারণ তিনি আছেন কি নেই, বোঝাই দায়! হাতের নোখগুলো কতদিন কাটেনি যেন। ময়লা জমে কী যাচ্ছেতাই নোংরা হয়ে আছে। কিন্তু সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, জগন্নাথ দেখে কী, লোকটার ছেঁড়া তাপ্লিমারা প্যান্টের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটি ল্যাজ উঁকি মারছে। আর ছাগলের যেমন ল্যাজের ডগায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লোম থাকে, তেমনি গুটিকয় লোম ফিরফির করছে।

জগন্নাথ মনে-মনে ভাবল, মানুষেরও ল্যাজ হয়!

 হঠাৎ লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘হয়, হয়। চেঁচাননার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার মুখ দিয়ে ভক-ভক করে এমন বিটকেল গন্ধ বেরিয়ে এল! একেবারে জগন্নাথের নাকে! আর একটু হলেই ওয়াক থু!

সামলে নিল জগন্নাথ। ভাবল, লোকটা ওর মনের কথা কী করে জানতে পারল! লোকটা তুকতাক জানে নাকি!

আসলে জগন্নাথের মনের কথাটা ও মোটেই জানতে পারেনি। জগন্নাথ তো বোকা নয়। তাই যেই লোকটা আবার কথা বলেছে, জগন্নাথ বুঝে নিয়েছে। লোকটা বলল, ‘হয়, হয়, নানান কারণে অসুখ হয়। যেমন ধরা যাক ক্লাসের পড়া না করলে, ইসকুল যাবার ভয়ে, অসুখ হয়! খুব ঠকঠকানি শীতের দিনে চান করতে ভয় থাকলে অসুখ হয়। কিংবা গরমের দিনে নিমপাতার ঝোল মেখে ভাত খেতে বললে, অসুখ হয়। অথবা অথবা–অথবা’ বলতে-বলতে লোকটা গন্ধওলা মুখটা হাঁ করে জগন্নাথের দিকে এগিয়ে এল। জগন্নাথের গাটা ঘিনঘিনিয়ে উঠেছে। তিড়িং করে লাফ মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল জগন্নাথ। চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমার অসুখ করেনি, আমার অসুখ করেনি।’

চিৎকার করতেই হঠাৎ পেছন থেকে এমন এক ঝাঁপটা খেয়েছে জগন্নাথ যে, হুমড়ি খেয়ে টলে পড়ল! বেচারা কুপোকাত! পেছন ফিরে চেয়ে দেখে আঁতকে উঠেছে! আরি ব্যস! ইয়া পেল্লায় একটা পাখি! পাখি বলবে না পাখিটাকে দানো বলবে, বুঝে উঠতে পারছে না জগন্নাথ! দেখলেই শিউরে উঠতে হয়। কেননা, এত বড়ো পাখি জগন্নাথ দেখেইনি জন্মে! কী তাগড়াই চেহারা! প্রায় জগন্নাথের মাথার সমান ঢেঙা। ভয়ংকর হিংসুটে চোখ দুটো! ঠোঁটটা বেল-পাড়া-আঁকশির মতো বেঁকে চেপটে আছে মুখের সঙ্গে। পায়ের নোখগুলো বেঁকাতেড়া। গুনছুঁচের মতো খোঁচা-খোঁচা! আর খুব ঝড় উঠলে তালগাছের পাতাগুলো যেমন ঝটাপটি খেয়ে হাঁসফাঁস করে, তেমনি তার ডানা দুটো জগন্নাথের ঘাড়ে ঝাঁপটা মেরে ঝটপটাচ্ছে! জগন্নাথ তাই দেখে চিৎকার করে উঠল! জগন্নাথের চিৎকার শুনে পাখিটা ক্যাঁক-ক্যাঁক করে মারল এক ধমক। জগন্নাথের পিলে চমকে উঠেছে। থমকে গেল জগন্নাথ। আর তাই দেখে, লোকটার দাঁত ছরখুট্টে সে কী হাসি, হে-হে-হে! তার বত্রিশপাটি দাঁতের দিকে জগন্নাথের চোখ পড়তেই নাক সিঁটকুলে। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, দাঁতে ছাতলা পড়েছে! মাছি ভ্যান-ভ্যান করছে! লোকটা বোধহয় সাতজন্মে চান করে না, দাঁত মাজে না।

হাসতে-হাসতে লোকটা টপাস করে জগন্নাথকে জড়িয়ে ধরল। জগন্নাথ কিছু বোঝবার আগেই, খোঁচা খোঁচা নোখ দিয়ে এমন কাতুকুতু দিতে আরম্ভ করল যে, জগন্নাথের প্রাণ যায়? নোখের খোঁচা খেয়ে জগন্নাথের যেমন লাগছে, আঃ, আঃ। কাতুকুতু খেয়ে তেমনি হাসছে, হাঃ হাঃ! হাসতে-হাসতে, কাঁদতে কাঁদতে বেচারা মাটিতে গড়াগড়ি! তাই দেখে পাখিটার কী নাচন-কোদন দেখো!

মশাই, চিল চেঁচিয়ে পাখি বাড়ি মাথায় করছে! আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায়!

হাসতে-হাসতে কিংবা কাঁদতে-কাঁদতে জগন্নাথ যখন নাস্তানাবুদ, মানে, দম প্রায় ফেটে পড়ে, ঠিক সেই সময় বাঁদরটা প্রায় লাফ মেরে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই লোকটাকে জাপেটে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, করছেন কী, করছেন কী, তাল-ফুলুড়ি মামা! ছেলেটার যে বাবা হারিয়ে গেছে! আপনার কাছে এসেছে বাবার খোঁজ করতে!’

সঙ্গে-সঙ্গে সেই তাল-ফুলুড়ি মামা নামে লোকটা জগন্নাথকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘সে-কথা আগে বলবি তো! রামোচন্দর, রামোচন্দর, আমি যে ছেলেটাকে ছুঁয়ে ফেললুম!

‘মামা, চুলে কোনো দোষ হবে না, ছেলেটা যে জগন্নাথ।’

ততক্ষণে জগন্নাথ কাপড়-জামা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়াল। অমনি পাখিটা আবার খ্যাখ্যা করে হেসে উঠেছে! হাসতে-হাসতে এমন বিচ্ছিরি গলায় ‘জগন্নাথ’ বলে ডাকল যে, তাই শুনে জগন্নাথের গা-পিত্তি জ্বলে গেল! মনে হল ঠাস করে চড়িয়ে দেয়!

হয়তো দিত চড়িয়ে। কিন্তু হঠাৎ তাল-ফুলুড়ি মামার কানের দিকে নজর পড়তে ওর চক্ষু চড়কগাছ! মামার কান দুটো, যেমন গাধা কিংবা গোরু-ভেড়ার কান নড়ে, তেমনি নড়তে শুরু করে দিয়েছে। একী রে! মানুষের কান নড়ছে! জগন্নাথ তো কোনোদিন মানুষের কান নড়তে দেখেনি! মানুষের কান নড়ে নাকি!

তাল-ফুলুড়ি মামা কান দুটো তেমনি নাড়তে-নাড়তে বাঁ হাতটা ঝাঁ করে ডান দিকে ছুঁড়ে তারপর ডান হাতটা ধাঁ করে বাঁ দিকে টানল। টেনেই ঝপ করে একটা কৌটো কোত্থেকে বার করে ফেলল। কৌটোটা ছোট্ট। কিন্তু কোত্থেকে যে বার করল, জগন্নাথ বুঝতে পারল না। সেটার দিকে তাকিয়ে তাল-ফুলুড়ি মামা জগন্নাথকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাবার বয়স কত?

জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘জানি না।’

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা হাতের কৌটোটা ডুগডুগি বাজানোর মতো নেড়ে দিল। কৌটোর ভেতরে টুং টুং করে ঘন্টা বেজে উঠল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোর বাপ কতটা লম্বা?’

জগন্নাথ বলল, ‘জানি না।’

 ঘন্টা বাজল টুং টুং।

‘কতটা বাঁটকুল?

‘জানি না।’

 টুং টুং!

 ‘কতটা খায়?

 এবার যেন জগন্নাথ রেগেমেগে মরিয়া হয়েই উত্তর দিল, ‘যতটা খিদে পায়!’

তাই শুনে হঠাৎ তাল-ফুলুড়ি মামা বাঁদরের মাথায় ঠকাস করে গাঁট্টা মেরে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘মনকি!’ মনকি!’

মনকি মাথায় হাত বুলুতে বুলুতে জিজ্ঞেস করল ‘কন কী? কন কী?’

‘দেখ, দেখ,’ বলে কৌটোটা বাঁদরের চোখের সামনে তুলে বলল, ‘ছেলেটার নাম যদি জগন্নাথ হয়, তবে ওর বাবার নাম বাবা! ওর বাবা যদি এইখানে থাকে, তাহলে ওদের বাড়িটা ওইখানে। ওদের বাড়িটা যদি ওইখানে হয়, তবে রাস্তাটা এইখানে।

মানে বুঝলি?’

বাঁদর বললে, ‘আজ্ঞে মামা, মানে তো বোঝবার জন্যে নয়। মানে তো মানে-বইয়ে লেখা আছে। মুখস্থ করার জন্যে।’

কৌটো দেখে জগন্নাথের মনও তো আগের থেকেই ঠুক-চুক করছিল। তার ওপর মামার কথাগুলো শুনে আর থাকতে পারে! পড়ি-মরি আগবাড়িয়ে ছুটে এসে বলল, ‘কই দেখি?’

তাল-ফুলুড়ি মামা চট করে কৌটোটা ওপর বাগে তুলে ধরে বলল, ‘অমনি অমনি! একি মগের মুল্লুক! ভারি স্যায়না ছেলে দেখছি।’

পাখিটাও নিজের গলা মামার মতো করে পোঁ ধরল, ‘ভারি স্যায়না ছেলে দেখছি!

মামা জিজ্ঞেস করল, ‘ট্যাঁকে টাকা আছে? কৌটো দেখতে পাঁচ সিকের পুজো লাগবে।’

আসলে তখন পাঁচ সিকে ছেড়ে জগন্নাথের ট্যাঁকে এক সিকেও ছিল না। পয়সা-কড়ি নিয়ে কি সে বেরিয়েছে! হঠাৎ বিপদে পড়ে তাকে এখানে আসতে হয়েছে। তা-ও বাঁদরের কথায়। তাই জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল, ‘কৌটোটা এখন দেখে, পুজোটা পরে দিলে চলবে না?’

কথাটা শুনে তাল-ফুলুড়ি মামার সঙ্গে সেই ঢ্যাপসা-ঢুসকো পাখিটাও এমন খ্যাল-খ্যাল করে হেসে উঠল যে, জগন্নাথের মনে হল তখনই তাকে পটকে দেয়। অবশ্য বাঁদরটা হাসেনি। কিন্তু তাই বলে জগন্নাথের জন্যে যে সে দয়ায় গলে পড়ছে, তার মুখ দেখে এ-কথাও কেউ বলতে পারে না। কেননা, বাঁদরের মুখ তো! দয়া-মায়া, হাসি-কান্না, সে মুখ দেখে বোঝা যায় না। জগন্নাথ তবু রাগটা মনের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, ‘দেখুন, আমি তো পয়সা-কড়ি সঙ্গে আনিনি। বাড়ি ফিরে পাওনা-গণ্ডা আমি সব মিটিয়ে দেব।’

মামা জিজ্ঞেস করল, ‘ধার?’।

অমনি পাখিটা বলে উঠল, ‘এখানে ধারে কারবার নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল।

 এবার সত্যিই জগন্নাথ ভীষণ চটে গেছে। তেড়েমেড়ে পাখিটাকে বলল, ‘তুই চুপ কর তো! তখন থেকে খালি ভাংচি দিচ্ছে। আঃ গেল যাঃ!’

পাখিটা ঝুঁটি ফুলিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘এই, তুই-তোকারি করছিস কেন রে! কালকের ছেলে, ছোটো-বড়ো জ্ঞান নেই! গুরুজনদের মান্যি করতে জানিস না!’

জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘আহা রে, কী আমার গুরুজন! ভারি তো একটা পাখি, সে আবার গুরুজন!’

 ঝগড়াটা আর একটু হলেই দানা বেঁধে উঠত। বাঁদরটা তখন চট করে জগন্নাথ আর পাখিটার সুমুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দুজনকে থামিয়ে-থুমিয়ে বলল, ‘আরে, আরে, করছিস কী! নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি করতে আছে? তারপর জগন্নাথের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘দুর বোকা, খেপছিস কেন? এক কাজ কর, মামার কথাও থাক, তোর কথাও থাক, পাঁচ সিকের জায়গায় পাঁচটা পয়সা দিয়ে দে।’ বলে মামাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী মামা, ঠিক আছে?’

মামা চোখ দুটো স্বগগে তুলে যেন রাজিও নয় আবার গররাজিও নয়, এই ভাব দেখিয়ে বলল, ‘অন্য কেউ বললে আমি কক্ষনো রাজি হতুম না। তুই যখন বলছিস–’

জগন্নাথ তখন বাঁদরকে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘দেখ ভাই, সত্যি বলছি, আমার কাছে একটা কানা কড়িও নেই। বাড়ি ফিরে পাই-পয়সা সব আমি চুকিয়ে দেব।

মামা চিৎকার করে উঠল, ‘না, না, না। নগদা-নগদি ছাড়া আমি কাজ করব না। আমার কাছে আজ নগদ, কাল ধার

সেই কথা শুনে হঠাৎ যে এমন দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে জগন্নাথ খেপে উঠবে, কে বুঝতে পারে! তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে, তাল-ফুলুড়ি মামার তাপ্লিমারা জামাটা টেনে ধরে বলল, ‘আমি বারবার বলছি বাড়ি গিয়ে দাম শোধ করে দেব, আমার কথা গ্রাহ্যি করছেন না! কৌটোটা আমায় দেবেন তো দিন, নইলে কেড়ে নেব।’

খেপে গেলে মানুষের জ্ঞান-গম্যি যে একেবারে লোপ পায়, জগন্নাথকে তখন দেখলে এ-কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। তাল-ফুলুড়ি মামা ওর চেয়ে কত বড়ো, ষণ্ডা-মার্কা চেহারা! জগন্নাথ কখনো মামাকে বাগে আনতে পারে! মামা মেরেছে এক ধাক্কা! জগন্নাথ ছিটকে দুম-পটকা। মামা ডান হাতের কৌটোটা ধাঁ করে বাঁ হাতে নিতেই ফুস! মানে, দেখতে-দেখতে কোথায় লুকিয়ে ফেলল। জগন্নাথের যেন কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গেল! জগন্নাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটার খালি হাতের দিকে। কিন্তু লোকটা দাঁড়িয়ে রইল না। মুখটা খিঁচিয়ে জগন্নাথের দিকে তেড়ে এল। জগন্নাথের কানটা ধরে হিড়হিড় করে টান দিয়ে বলল, ‘চোট্টামি করবার জায়গা পাসনি। ফের এমনি করবি তো পুলিশে দিয়ে দেব। আমায় চিনিস না!