৭. ফিকফিক করে হাসি

অধ্যায় ৭

“মেজবাবুর আজ হল কী? ফিকফিক করে মাঝে-মাঝেই হেসে ফেলছেন যে বড়!”

“তা অবশ্য ঠিক, আমাদের যখন তখন হাসতে নেই। আভিজাত্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। একটু গেরামভারী না হলে প্রজারা মানবে কেন? কিন্তু আজ হাসির একটা ভুড়ভুড়ি হচ্ছে পেটের ভিতর, বুঝলে! সেখান থেকেই হাসিটা অনেকটা ঢেঁকুরের মতো উঠে আসছে। ব্যাটাকে আটকানো যাচ্ছে না।”

“তা অবিশ্যি ঠিক, ঢেঁকুর আটকানো খুব শক্ত। কিন্তু আপনার গোটাগুটি শরীরটাই তো বায়ুভূত, অর্থাৎ আপনি নিজেই তো একটা ঢেঁকুর ছাড়া কিছু নন। তা হলে ঢেঁকুরের আবার ঢেঁকুর হয় কী করে?”

“কথাটা মিথ্যে নয়। তবে সব কি আর নিয়ম মেনে ঘটে? মাঝে-মাঝে সব হিসেব উলটেপালটেও যায়। আহা, আমি কথা কইছি আর সেই ফাঁকে তুমি মন্ত্রীটাকে ওরকম বেমক্কা ঠেলে দিলে কেন? আমার নৌকোটা মারা পড়বে যে!”

“আপনার নৌকোটা না মারলে যে পরের চালে কিস্তি পড়ে যাবে মেজবাবু!”

“তাতে কী, কিস্তি পড়বে বলে কি সৌজন্য ভুলতে হবে নাকি? শ্রেষ্ঠের একটা সম্মানও তো আছে!”

“তা আছে। আপনার খাতিরে না হয় আমি মন্ত্রী সরিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু কিস্তি দিলে আপনার নৌকো যে ঘোড়ার পাল্লায় পড়ে যাবে, তা কিন্তু আগেই বলে রাখলাম। তখন আবার চেঁচামেচি জুড়বেন না যেন।”

“তোমার ঘোড়াটা অমন ছটফট করছেই বা কেন? সুস্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকুক না।”

“ঘোড়াই যদি লাফালাফি না করে তবে দাবা খেলার আর মজা কী?”

“তা লাফালাফি করুক না, বারণ করছে কে? শুধু আমার নৌকোর উপর চড়াও না হলেই হল। আরও তো কত ঘর ফাঁকা পড়ে আছে, দেখছ না? সেসব ঘরে গিয়ে লাফালাফি করতে দোষ কী?”

“খেলার তো একটা প্রথাও আছে মেজবাবু, আপনি আমার প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষকে সুবিধে করে দেওয়াটা তো প্রথার মধ্যে পড়ে না।”

“আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি বেকায়দায় পড়েছ বলেই নৌকোটা মারতে চাইছ এবং সেটাও অন্যায়ভাবে। ঠিক কি না কুঁড়োরাম?”

“যুদ্ধের তো একটা নিয়ম আছে মেজবাবু, সেখানে অন্যায় বলে কিছু নেই।”

“কিন্তু আমি কথা কইছিলাম, সেটা ভুলো না। আর কথা কওয়ার সময়টা যুদ্ধবিরতি বলেই ধরা হয়।”

“আপনি তো সব সময়ে কথা কইতে-কইতেই খেলেন, তা হলে তো গোটা খেলাটাই যুদ্ধবিরতি বলে ধরতে হয়।”

“কথারও হেরফের আছে হে! আমি একটা গুরুতর কথায় ব্যস্ত ছিলাম।”

“গুরুতর? ঢেঁকুর নিয়ে কি খুব গুরুতর কথা হয় মেজবাবু?”

“এ তো আর যার-তার ঢেঁকুর নয় হে!”

“তা অবিশ্যি ঠিক! তালেবর লোকদের ঢেঁকুরও তুচ্ছ করার মতো নয়! তা ঢেঁকুর নিয়ে কি আপনার আর কিছু বলার আছে? তা হলে এইবেলা বলে ফেলুন!”

“ঠিক ঢেঁকুর নয়, আসল ব্যাপারটা ঢেঁকুরের পিছনে ঘাপটি মেরে আছে৷ আচ্ছা, এই যে তুমি রোজই দাবায় আমার কাছে লেজেগোবরে হয়ে হারো, তাতে তোমার আনন্দ হয় না?”

“সত্যি কথা বলতে কী মেজবাবু, আমাকে হারতে হয় বলেই হারি৷ তা তাতে আগে আনন্দও হত বটে, তবে এখন একটু গা সওয়া হয়ে গিয়েছে৷”

“হেরে আনন্দ পেতে শেখো কুঁড়োরাম৷ দেখবে হেরেও মাঝে-মাঝে এমন আনন্দ হবে যে, ঠেলা সামলাতে পারবে না৷ এই আমার যেমন হচ্ছে৷ ওহ, সে কী আনন্দ তা আর কী বলব! বেজায় আনন্দ হে৷ আর ওই আনন্দের চোটে আমার পেটে তখন থেকে এমন ভুড়ভুড়ি কাটছে যে, আভিজাত্য ভুলে আমি ফিকফিক করে হেসে ফেলছি৷”

“বলেন কী মেজবাবু, আপনি হেরেছেন! এমন তাজ্জব কথা জীবনে শুনিনি! তা হারলেন কীসে? আর কোন বাপের ব্যাটার কাছে?”

“আহা, সেসব কথা বরং থাক৷ মোট কথাটা হল, হেরেও যে আনন্দ হয় এটা আমার জানাই ছিল না৷ তাই বলছি হেরে আনন্দ পেতে শেখো কুঁড়োরাম, ওতে ভারী সুখ৷”

“তা হলে আপনার নৌকোটা মেরেই দিই মেজবাবু৷ আর দু’চালের মধ্যেই আপনি মাত হয়ে যাবেন৷ হারার আনন্দ থেকে আপনাকে আজ আর বঞ্চিত করতে চাই না৷”

“আরে না, অত হুড়োহুড়ি করে চাল দিতে নেই৷ দাবা হল কূটবুদ্ধির খেলা, বুঝলে? ভাবো কুঁড়োরাম, অগ্রপশ্চাৎ ভাল করে ভেবে তবে চাল দিতে হয়৷”

“বুঝেছি, খেলাটা আজ আর জমবে না মেজবাবু, আনন্দের ঠেলায় আপনি আজ বেজায় উলটোপালটা চাল দিয়ে যাচ্ছেন৷”

“বলো কী হে! আমার চালে যেদিন ভুল হবে, সেদিন তো সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠার কথা। কিন্তু আমি যত দূর জানি সূর্য আজ পুব দিকেই উঠেছে।”

“না, ঠিক ভুল চাল নয়, তবে বড্ড বেশি উচ্চাঙ্গের চাল।”

“তাই বলো। কথাটা ঠিক। দাবায় আমার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো লোক এখনও জন্মায়নি। তাই তোমার মতো আনাড়ির সঙ্গেই খেলতে হয়।”

***