১. ভুসিরাম ধরা পড়ে গেল

অধ্যায় ১

ভুসিরাম মঙ্গলবার শেষ রাতে ধরা পড়ে গেল। পড়ারই কথা কিনা। চূড়ান্ত দুঃসাহস না থাকলে কেউ কি ভুলেও কর্নেল বীরবাহু ভঞ্জর কুঠিবাড়িতে লুটপাট করতে ঢোকে? বিশেষ করে যখন শীতের ছুটি কাটাতে জনাচারেক শিকারি বন্ধু, দুটো গ্রে হাউন্ড কুকুর, আটটা বন্দুক, দুটো পিস্তল, চারজন বিশ্বস্ত এবং অনুগত অনুচরকে নিয়ে স্বয়ং বীরবাহু কুঠিবাড়িতে বহাল রয়েছেন। আর কে না জানে যে, বীরবাহুর মতো এমন ডাকাবুকো, রাগী, মারমুখো লোক পরগনায় বিশেষ নেই! তার উপর কুঠিবাড়ি তো নয়, দুর্গ বললেই হয়। সারা বছর অন্তত পাঁচজন হাট্টাকাট্টা লোক বাড়ি পাহারা দেয়। মশা-মাছি গলবার উপায় নেই। মতিভ্রম না হলে কেউ ও-বাড়িতে ঢোকে?

হ্যাপাও তো কম নয় রে বাপু! আট ফুট উঁচু, পেরেক আর কাচ বসানো দেয়াল না হয় কষ্টে ডিঙোনো গেল, না হয় পাহারাদারদের চোখেও ধুলো দেওয়া গেল, না হয় কুকুরদেরও বিভ্রান্ত করার ব্যবস্থা হল, না হয় বীরবাহু আর তার বাহিনীকেও ঘোল খাওয়ানো গেল, কিন্তু তারপরেও কথা আছে বাপু। এত করার পরও তো জন্মেজয় ভঞ্জ রয়েছেন। তাঁর চোখে ধুলো দিতে পারে এমন মনিষ্যি তো এখনও জন্মায়নি। আর জন্মেজয় ভঞ্জকে পরগনার কে না চেনে? না, চেনা বলতে তেমন চেনা নয় বটে, কারণ জন্মেজয় বছরপঞ্চাশ আগেই গত হয়েছেন। কিন্তু গত হলে কী হয়, তিনি গেলে তো! যখন তখন যেখানে সেখানে ফস করে উদয় হয়ে পড়ছেন, কটমট করে রক্ত-জল-করা চাউনিতে লোককে ভিরমি খাওয়াচ্ছেন, লোকে নিশুত রাতে মাঝে-মাঝে তাঁর অট্টহাসিও নাকি শুনতে পায়।

ভুসিরাম তবু কেল্লা প্রায় মেরেই দিয়েছিল। রণপায়ে উঠে দেয়াল ডিঙোনো, ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে শিকারি কুকুরদের ঘুম পাড়ানো, দরোয়ানদের ক্যারাটের প্যাঁচ-পয়জারে কাবু করে বেঁধে ফেলা, এসব তার কাছে জলভাত। তোশাখানার দরজা অবধি পৌঁছেও গিয়েছিল সে। শুধু দরজাটা ডিঙোনোর ওয়াস্তা। তা সেটাও ভুসিরামের বাঁ হাতের খেল বই তো নয়! নামডাক তো লোকের এমনিতে হয় না। গুণ থাকলে তবেই হয়। আর একথা কে না জানে যে, ভুসিরামেরও নামডাক এমনিতে হয়নি। আশপাশের দশটা গাঁয়ের লোক ভুসিরামের নাম শুনলে যে কপালে হাত ঠেকায়, তা তো আর বিনা কারণে নয়! গোঁজেরহাটের মনসাপণ্ডিত অতি বড় শুদ্ধাচারী হয়েও একদিন বলে ফেলেছিলেন, “তস্কর হলেও ভুসিরামকে পল্লির অলংকার বলতে হয়।” দারোগা কোদণ্ড গজপতি স্বীকার করেছিলেন, “না, ভুসিরামের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।” গাঁয়ের কবি পটল পাল লিখেছেন, “ভুসিরাম, ভুসিরাম, রাম রাম ভুসি ভুসি, তুমি খাও কলা মূলা মোরা সব আঁটি চুষি। তবু বলি রাম রাম, তবু বলি ভুসি ভুসি, তোমার এলেম হেরি গোঁজেরহাট খুশি খুশি।”

তা ভুসিরাম যখন কার্যোদ্ধারের মাত্র এক পা দূরে, দরজাটা ফাঁক করাটা মাত্র বাকি, ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ প্রায় তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে কে যেন মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “তুমি তো গুণী মানুষ হে!”

এসব পরিস্থিতিতে চমকাতে নেই বলে ভুসিরাম চমকাল না। তবে তার পেটের মধ্যে একটু গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছিল। বহুদিনের অভ্যেসে আর শিক্ষায় নিজেকে সে সামলাতে পারল বটে, কিন্তু লজ্জাও হল। কেউ যে তাকে নিঃসাড়ে নজরে রেখেছে, এটা সে টের পায়নি। একটা শ্বাস ফেলে সে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে দেখল, পিছনে একজন ছোটখাটো, রোগা চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে মুখটা ভাল বোঝা যাচ্ছে না বটে, তবে মনে হল মুখে একটু হাসি-হাসি ভাব।

ভুসিরাম বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলে, “কাজের সময়ে লোককে বিরক্ত করা কি ঠিক?”

লোকটা তাড়তাড়ি জিব কেটে বলে, “তাই তো! বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে বাপু। তবে কিনা ভাল কাজকর্ম দেখলে আমি বাপু নিজেকে সামলাতে পারি না।”

ভুসিরাম বিরক্ত হয়ে বলে, “ভাল কাজের কী দেখলেন মশাই? কাজ ভাল হলে কি আপনার মতো আনাড়ির কাছে ধরা পড়ি?”

“আহা, ধরা পড়েছ বলে ধরে নিচ্ছ কেন হে? তুমি হলে জাতশিল্পী। বড়-বড় গাইয়ে, বাজিয়ে, বড়-বড় আঁকিয়ে বা লিখিয়েরা যখন কাজে মজে যান তখন তাঁদের বাহ্যজ্ঞান থাকে না বলেই শুনেছি। তবে এত মেহনত না জলে যায়!”

ভুসিরাম লোকটাকে একটা রদ্দা মেরে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে হাতের কাজটা সেরে নেবে বলে তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু একথাটা শুনে থমকাল। বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “তার মানে?”

“তার মানে বুঝলে না? যে জিনিস খুঁজছ, তা তোশাখানায় নেই।”

তোশাখানায় কী আছে তা ভুসিরামও জানে না। তবে দামি জিনিসই থাকার কথা। কিন্তু লোকটা কোন জিনিসের কথা কইছে, তা আন্দাজ করার জন্য সে একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, “নেই? তা হলে সেটা গেল কোথায়?”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “ও বস্তু হাতে পেলে যে সাত পুরুষ ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুলে বসে খাওয়া যাবে এ কে না জানে! তাই জিনিসটা সরিয়ে কানাকুঠুরিতে পাচার করা হয়েছে বলে কানাঘুষো শুনছি। আমি অবিশ্যি কানাকুঠুরির হদিশ জানি না। তুমি জানো নাকি বাপু? তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই যে, আমি ভঞ্জবাবুর বন্ধু সেজে এসেছি বটে, কিন্তু আমিও জিনিসটার জন্য তক্কে-তক্কে আছি।”

ভুসিরাম বড্ড ধন্দে পড়ে গেল। একটু দোনোমনো ভাব এল তার। বলল, “কানাকুঠুরি তো অন্দরমহলের ভাঁড়ারঘরের নীচে।”

লোকটা ভারী খুশি হয়ে বলে, “বাহ! এই তো গুণী মানুষের রাজলক্ষণ। তবে আর দেরি কেন বাপু, কার্যোদ্ধারে নেমে পড়লেই তো হয়! আমার কাছে খবর আছে, ও জিনিসের খোঁজে আরও কেউ-কেউ ছোঁকছোঁক করে বেড়াচ্ছে।”

ভুসিরাম গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু হাতের কাজ ফেলে অন্য কিছুতে হাত দেওয়া আমি পছন্দ করি না।”

“আহা, সে তো ঠিক কথাই হে! তা হলে তুমি বরং কাজটা সেরেই নাও। তোশাখানায় এখনও যা খুদকুঁড়ো পড়ে আছে, তা কুড়িয়েবাড়িয়ে বড় মন্দ হবে না। একটু হিসেব করে চললে ওতেও জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আসল জিনিসটা সরিয়ে নিয়েছে বটে, কিন্তু দু’-চারখানা মোহরটোহর অবশ্য এখনও পড়ে আছে। ও নিয়ে অবশ্য কর্তার মাথাব্যথা নেই। মনে হয়, ছিঁচকে চোরদের জন্যই মায়া করে ফেলে রেখেছেন।”

কথাটা খুব প্রেস্টিজে লাগল ভুসিরামের। সে হিসহিস করে রাগের গলায় বলল, “কে ছিঁচকে চোর?”

“আহা, কথাটা গায়ে মেখো না বাপু। তোমাকে বলা নয়। কর্তার খাস কাজের লোক গয়ারামের কাছেই শুনেছি, তোশাখানার দেয়ালে নোনা ধরেছে, সারানোর জন্য মিস্তিরি লাগানো হবে। তাই রোজই সব দামি জিনিস সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কিনা।”

ভুসিরাম একটু ভড়কে গেল, কথাটা সত্যি হলে তো তার এক গাল মাছি! সে বলল, “আপনি এত কথা জানলেন কী করে? আপনি কে?”

লোকটা ভারী আহ্লাদের হাসি হেসে বলে, “তেমন কেউকেটা কেউ নই রে বাপু, পিতৃদত্ত নাম হল রাখোহরি প্রামাণিক। একটু-আধটু বন্দুকটন্দুক চালাতে পারি বলে কর্তা বীরবাহু বড্ড স্নেহ করেন। সেই সুবাদেই যাতায়াত। তা বলে ভেবে বোসো না যে, আমি তোমার শত্তুর।”

ভুসিরাম মৃদু হেসে বলে, “তা ভাবলে কি এতক্ষণ আপনি দু’পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন?”

“সে কথা সত্যি। তুমি আহাম্মক হলে এতক্ষণে রদ্দা খেয়ে আমার চিৎপটাং হওয়ার কথা। আনাড়িদের সঙ্গে কাজ করে সুখ নেই। এই তোমার মতো বুঝদার পেলে কাজ করে আনন্দ আছে। তা হলে বরং তুমি হাতের কাজটা চটপট সেরে ফেলো, তারপর না হয় বড় কাজে হাত দেওয়া যাবে! ততক্ষণে অবশ্য ভোর না হয়ে যায়!”

ভুসিরামের লোকটাকে মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না, বিশ্বাস হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু মনটার মধ্যে একটা দোনোমনোও হচ্ছে। তোশাখানার দরজা খসাতে আরও খানিকক্ষণ গা ঘামাতে হবে। এত পরিশ্রম যদি বৃথা যায়! সে বলল,“আপনার খবর পাকা তো?”

রাখোহরি মাখো-মাখো গলায় বলল, “তোমার কি ধারণা যে, এই নিশুত রাতে আমি তোমার উপকার করব বলে ঘুরঘুর করছি? নিজের ধান্দা না থাকলে কেউ একটা চোরকে তেল দেয়? আমি বন্দুকে পাকা বটে, কিন্তু দরজা খসানোর বিদ্যে জানা নেই। তাই ভাবছিলাম, যদি তেমন গুণী কাউকে পাওয়া যায়। ভগবানের আশীর্বাদই হবে, তাই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখন তোমার ইচ্ছে।”

ভুসিরাম অবশ্য ঠান্ডা গলায় বলে রাখল, “দেখবেন, কোনও গড়বড় হলে কিন্তু মুশকিল আছে।”

রাখোহরি আহ্লাদের গলাতেই বলল, “তা আর বলতে!”

‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কথাটা জানা থাকলেও নিয়তির ফেরে মানুষ কার্যকালে বিস্মরণ হবেই কি হবে। ভুসিরামের ঘাড়েও লোভের ভূতটা সওয়ার হল। আর সে একটা অজ্ঞাতকুলশীল, উটকো লোকের পিছু-পিছু, যেন ঘোরের মধ্যে গিয়ে ভাঁড়ারঘরে সেঁধোবার পরই বুঝতে পারল বড্ড আহাম্মকি করে ফেলেছে। ঘরের নিরেট অন্ধকারে পা দিয়ে একটু চোখ সইয়ে নিতে যেতেই লোকটা “‘এই যে, এদিকে…”’ বলে তার হাত ধরে এমন একটা হ্যাঁচকা টান মারল যে, ভুসিরাম সামলাতে না পেরে মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেল কেউ বাইরে থেকে টেনে দরজা বন্ধ করে হুড়কো টেনে দিল। ভুসিরাম অভিজ্ঞ লোক। কখন ফাঁদে পড়েছে তা বুঝতে পারে। এখনও পারল। ভাঁড়ারঘরের দরজা পুরু শাল কাঠের, তাতে লোহার পাত বসানো। বাইরে মজবুত হ্যাসবোল্ট। তবু দরজাটা খোলার একটা চেষ্টা করা যেত, কিন্তু উপুড় হয়ে পড়ার সময় তার যন্ত্রপাতির থলিটা হাত থেকে খসে গিয়েছিল, সেটা এখন হাওয়া হয়েছে। রাখোহরি যে-ই হোক, সে যে পাকা লোক তাতে সন্দেহ নেই।

তখনও ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি। বীরবাহুর পেল্লায় চেহারার স্যাঙাৎরা এসে দোর খুলে তাকে নারকোলের দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে কর্তার সামনে যখন দাঁড় করাল, তখন লজ্জায় সে অধোবদন। এরকম কাঁচা একটা চালে জব্দ হওয়ার মতো খাটো বুদ্ধির লোক তো সে নয়! তবে কি তার বিনাশকাল এসে গেল! বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ বলে কী একটা কথা আছে না!

কে যেন বলে উঠল, “আছে।”

ভারী অবাক হয়ে ভুসিরাম কথাটা কে বলল তা বুঝবার চেষ্টা করছিল। থতমত ভাবটা কেটে যাওয়ার পর বুঝতে পারল কথাটা তার উদ্দেশে বলা নয়, উপেনবাবুর পেটের গণ্ডগোল বলে সকালে দইচিঁড়ে খাবেন, তাই গয়ারামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাড়িতে দই আছে কি না। জবাবে গয়ারাম বলল, “আছে।”

সিংহাসনের মতো পেল্লায় একটা চেয়ারে বিরুবাবু বসা, চেয়ারের সর্বাঙ্গে কারুকাজ। বিরুবাবুর দু’পাশে আরও দুটো করে চেয়ারে তাঁর চার শিকারি বন্ধু বসে আছেন। শুঁটকো উপেন হাজরা, গাট্টাগোট্টা খগেন মাল, গম্বুজের মতো লম্বা, সিড়িঙ্গে গিরিধারী মাঝি আর বেঁটে ও গুঁফো বলাই জানা। সবাই কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। থাকারই কথা। মাপজোখ করে নিচ্ছেন আর কী। সবারই হাতে গরম চায়ের কাপ। দামি চায়ের সুবাস ভারী ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কথা কে শুরু করবেন তা বুঝতে পারছিল না ভুসিরাম। ধীরেসুস্থে চা শেষ করে একে-একে সকলেই সামনের বেঁটে টেবিলটার উপর চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন।

বিরুবাবুর চেহারাখানা যেমন দশাসই, তাঁর গলার আওয়াজেও তেমন কামানের গর্জন। গেলাসের জলে আচমনটা সেরে নিয়ে ফরসা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে তিনি কামানটা দাগলেন, “তোর কিছু বলার আছে?”

ভুসিরাম নতমস্তকেই বলল, “আছে বিরুবাবু।”

“বলে ফ্যাল।”

“আমাকে গুলি করে মেরে দিন।”

উপেন হাজরা হঠাৎ আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, “বলিস কী! গুলি! গুলির দাম কোথায় ঠেলে উঠেছে জানিস! আম্বা কম নয় তো তোর! কোথাকার নবাবপুত্তুর এলি তুই যে, গুলি খেয়ে মরার শখ!”

ভুসিরাম একটু থতমত খেয়ে সামলে নিয়ে বলল, “তা হলে বরং ফাঁসিই দিন। সেই ভাল।”

হঠাৎ খগেন মাল হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “কেন রে, তুই কি ক্ষুদিরাম না ভগৎ সিংহ যে ফাঁসিতে ঝুলতে চাস? ব্যাটার দেখছি শহিদ হওয়ার মতলব!”

গিরিধারী মাঝি একটা আড়মোড়া ভেঙে বললেন, “ফাঁসির হাঙ্গামার কথাটাও ভাবুন। গাছে ওঠো রে, দড়ি টাঙাও রে, ফাঁস বাঁধো রে, দড়ি টানাটানি করো রে। সক্কালবেলায় এত হুড়যুদ্ধু করা কি পোষায় মশাই! আমরা এত মেহনত করব আর তুই দিব্যি আরাম করে ফাঁসিতে ঝুলে দোল খাবি, এ কি ছেলের হাতের মোয়া?”

বিরুবাবু তীক্ষ্ণ চোখে তাকে নিরীক্ষণ করতে করতে ফের কামান দাগলেন, “তোর নাম কী?”

ভুসিরাম ধরা গলায় বলে, “আজ্ঞে, ভুসিরাম।”

গুঁফো বলাইবাবু বরাবর কানে একটু খাটো। ডুকরে উঠে বললেন, “আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ, ভুসিমাল একটা নাম হল? কে রেখেছে তোর এ নাম বল তো!”

“আজ্ঞে ভুসিমাল নয়, ভুসিরাম। আমার বাবা ছিলেন ঘাসিরাম, আমি ভুসিরাম।”

বলাইবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “তবে তুই সার্থকনামা। ভুসিমালই বটে! কোন আক্কেলে ধরা পড়ে এই সক্কালবেলাটা আমাদের মাটি করলি বল তো! চুরি করেছিস ঠিক আছে, তারপর ভদ্রলোকের মতো সরে পড়বি তো! দাঁত কেলিয়ে কোন লজ্জায় সুমুখে দাঁড়িয়ে আছিস রে বেহায়া! আজ সকালে আমাদের ময়নাডাঙার জলায় পাখি শিকার করতে যাওয়ার কথা। তোর জন্য সব ভেস্তে গেল। ভুসিমালই বটে রে তুই!”

একবুক অভিমানের সঙ্গে ভুসিরাম বলল, “আমাকে বরং এক বাটি বিষ দিন, এ অপমান আর সহ্য হয় না।”

উপেনবাবু বিদ্রুপের গলায় বললেন, “ব্যাটা যেন সক্রেটিস এলেন। তার জন্য এখন বিষ আনতে বাজারে ছোটো! তারপর যত্ন করে জামাইআদরে বিষ বেড়ে দাও! সঙ্গে আচার,পাঁপড়ভাজা?”

গিরিধারীবাবু বললেন, “আর বাটিটার কথাও ভাবুন, যে বাটি করে বিষ বেড়ে দেওয়া হবে সেই বাটিটা কি আর ব্যবহার করা চলবে? ভুল করে যদি সেই বাটিতেই কাউকে মাংস বা পায়েস বেড়ে দেওয়া হয় তা হলে তো সর্বনাশ!”

খগেনবাবুও সায় দিয়ে বললেন, “অবশ্যই। বিষ ডেনজারাস জিনিস মশাই। জেনেশুনে বিষ পান করতে স্বয়ং রবি ঠাকুর নিষেধ করে গিয়েছেন।”

ভুসিরাম কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “কর্তাবাবু, মারুন, কাটুন, যা হয় কিছু করুন। আমার বড্ড জ্বলুনি হচ্ছে।”

গুঁফো বলাই বাঘা গলায় ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ ! তুই আমাদের হুকুম করার কে রে! মারব না কাটব, সেটা আমরা ঠিক করব। তুই বলার কে? মারতে-কাটতে মেহনত হয় না বুঝি! ওসব কি মাগনা হয়?”

ফাঁপরে পড়ে ভুসিরাম হাতজোড় করে বলে, “তা হলে আমার বাঁধনটা খুলে দিন আজ্ঞে, আমি আজ গলায় দড়ি দেব বলে নিজেই ঠিক করে রেখেছি।”

খগেন মাল ফুঁসে উঠে বললেন, “কোন আইনে? গলায় দড়ি দিলেই তো হবে না, তারও তো নিয়মকানুন আছে রে বাপু। ফস করে গলায় দড়ি দিলেই হল? পেনাল কোড ঘেঁটে দেখিস, গলায় দড়ি দিলে দশটি বছর ঘানি টানতে হবে।”

বিরুবাবু এতক্ষণ ভ্রূকুটিকুটিল চোখে চেয়ে ছিলেন, এবার হঠাৎ কামানের আওয়াজ ছাড়লেন, “গয়ারাম, এর বাঁধন খুলে দে।”

গয়ারাম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ভুসিরামের বাঁধন খুলে দিল।

বিরুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মালপত্র কিছু কি সরাতে পেরেছিল রে গয়ারাম?”

“আজ্ঞে না, কর্তা।”

বিরুবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, “তা হলে সারারাত বাড়ির মধ্যে ঢুকে করছিল কী? হাডুডু খেলছিল নাকি?”

“আজ্ঞে না কর্তা, ভাঁড়ারঘরে আটকা পড়ে কান্নাকাটি করছিল।”

“অপদার্থ আর কাকে বলে! ঠিক আছে, কান ধরে দশবার ওঠবোস করিয়ে ছেড়ে দে।”

চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে,অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে, কৃতকর্মের জন্য হা-হুতাশ করতে করতে ভুসিরাম নিজের কান ধরে দশবার ওঠবোস করল।

বিরুবাবু হাতের একটা তাচ্ছিল্যসূচক নাড়া দিয়ে গোরু তাড়ানোর গলায় বললেন, “যা, যা, বিদেয় হ।”

কোমরের গামছাখানা খুলে চোখ মুছতে মুছতে ভুসিরাম কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সে স্পষ্ট দেখছিল, দুনিয়ার সব রং উবে গিয়ে চারদিকটা সাদা-কালো হয়ে গিয়েছে। ঘাস কালো, গাছ কালো, আকাশ সাদা। তার লাল গামছাখানা অবধি কালচে মেরে গিয়েছে। রং দিয়ে অবিশ্যি ভুসিরামের আর কোনও প্রয়োজনও নেই। সে যে এক রাত্রিতে বাঘ থেকে বেড়ালে নেমে এসেছে তা বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে না। এই গতকালও তাকে দেখলে গোঁজেরহাটের লোকেরা পথ ছেড়ে দিয়েছে, হেঁ হেঁ করে দেঁতো হাসি হেসে হাত কচলাতে কচলাতে কুশল প্রশ্ন করেছে, সে কারও দিকে চেয়ে একটু হাসলে সে ধন্য হয়ে গিয়েছে, ধোপা নাপিত কখনও পয়সা নেয়নি, দোকানিরা আদ্দেক দাম নিয়েছে। ভেবে চোখে বড্ড জল আসছে তার, সেই জলে গামছাখানা সপসপ করছে ভিজে।

বিরুবাবু তাকে ক্ষমা করলেও সে নিজেকে ক্ষমা করে কী করে!

সে সোজা গিয়ে হরিপদর দোকান থেকে এক গোছ পাটের দড়ি কিনে ফেলল। হরিপদ আহ্লাদের গলায় বলল, “দড়ির দরকার পড়ল কেন হে! বলি গোরু কিনেছ নাকি?”

জবাব দেওয়ার মতো মনের অবস্থা নয়, তাই ভুসিরাম শুধু বলল, “হুঁ।”

হরিপদ বলল, “গোরু কেনা খুব ভাল। বাড়িতে লক্ষ্মীশ্রী আসে। তোমার উন্নতি দেখে আমরা তো সবাই বলাবলি করি, ভুসিরাম গোরু তো গোরু, একদিন হাতি কিনে ফেলবে। চারদিকে এখন তো শুধু তোমারই জয়জয়কার ভায়া! এক সময়ে মদনগুন্ডা কিছু নাম করেছিল বটে, তারপর তপন মস্তানও কিছুদিন তড়পেছিল, দূর দূর, তোমার কাছে ওরা তো নস্যি!”

ঘোর অন্যমনস্কতার মধ্যেই সে বলল, “হুঁ।” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এই হরিপদই আগামীকাল কী নজরে দেখবে তাকে? হয়তো ভুসিরামের দিকে তাকিয়ে তাকে একটা শুঁয়োপোকা বলেই মনে হবে হরিপদর। কিংবা কেন্নো অথবা মশা মাছি বা আরশোলা।

হরিপদ দাম নিতে চাইছিল না, কিন্তু ঋণ রেখে মরার ইচ্ছে নেই বলে সে জোর করেই দাম গছিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

হাতে গলিয়ে দড়ির গোছাটা কাঁধে ফেলে ভুসিরাম গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে হাজির হয়ে গেল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। খালি পেটে মরাটা ঠিক হবে বলে তার মনে হল না।

গাঁয়ে এখনও তার খুব খাতির, কারণ এখনও খবরটা জানাজানি হয়নি। তবে তারও তো বিশেষ দেরি নেই। গাঁয়ে এসব খবর রটতে মোটেই দেরি হয় না। মিঠাইয়ের দোকানের মালিক জয়লালও তাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে একখানা চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে বসতে দিল। গদগদ গলায় বলল, “আজ বড্ড সরেস মন্ডা আছে, খানকতক চলুক, ততক্ষণে কচুরি আর আলুর তরকারি নেমে যাবে। গরম নিখুঁতিও আছে ভায়া, তারপর তোমার পছন্দের ছানার পায়েস তো রয়েইছে।”

ভুসিরাম একটা বড় শ্বাস ফেলল। কথায় বলে ফাঁসির খাওয়া। তা আজ না হয় ফাঁসির খাওয়াই খাবে সে। এর পর তো আর খাওয়াদাওয়ার বালাই-ই থাকছে না। যদি বেঁচেও থাকে তা হলে এই জয়লালই তাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেবে আগামীকাল। হয়তো আঁশটে মুখে বলবে, ‘এখানে সুবিধে হবে না বাপু,অন্য জায়গায় দ্যাখো।’ কিংবা অনিচ্ছের সঙ্গে ন্যাতানো কচুরি আর ঠান্ডা জিলিপি এগিয়ে দেবে।

নাহ, বেঁচে থাকার আর কোনও অর্থই নেই।

জয়লাল বলল, “তা ভুসিভায়া, কাঁধে দড়ির গোছ দেখছি যে! বলি বাঁধাছাঁদার ব্যাপার আছে নাকি? বিছানা বেঁধে তীর্থদর্শনে যাচ্ছ না তো! নাকি কাউকে গাছে বেঁধে কচুয়াধোলাই দেবে!”

ভুসিরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হুঁ।”

খেতে গিয়ে সে টের পেল, কী খাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। রবারের মতো কী একটা জিনিস চিবোচ্ছে সে, পেটেও যাচ্ছে বটে, কিন্তু ঠিক কী খাচ্ছে সেটা ঠাহর হচ্ছে না। না হোক, তাতে আর কী যায় আসে! খেতে হয় বলেই খাওয়া। তবে দুঃখ এই যে, তার এই শেষ খাওয়াটা তেমন জমল না।

পকেটে হাত দিতেই হাঁ হাঁ করে উঠল জয়লাল, “করো কী, করো কী হে ভুসিদাদা! তোমার কাছে পয়সা নিলে যে পাপ হয়ে যাবে!”

ভুসিরাম ছলছলে চোখে চেয়ে থেকে বলল, “আজ আমার মুখ চেয়ে পাপটা হজম করে নাও ভাই।”

বলে জয়লালের হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।

গোঁজেরহাটের জাগ্রত কালী হলেন ভৈরবেশ্বরী কালী। দেড়শো বছরের পুরনো মন্দিরে নিয়মিত পুজো হয়। যোগেযাগে ভিড়ও হয় খুব। পঁচাশি বছর বয়সি পুরুত অনঙ্গমোহন ভুসিরামকে দেখেই আঁতকে উঠে বললেন, “বাবা ভুসিরাম, খবরটবর সব ভাল তো! তা এই সক্কালবেলায় মন্দিরে কেন বাবা? বাড়িতে কি বেস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজো আছে? তা কষ্ট করে নিজে আসবার দরকার কী ছিল, আমাকে ডেকে পাঠালেই তো হত!”

ভুসিরাম ঠাকুরমশাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে আগে ভূমিষ্ঠ হয়ে মা কালীকে একটা পেন্নাম ঠুকল। পাপতাপ বিস্তর করা আছে। মরলে অধোগতিই হওয়ার কথা। তারপর মাথা তোলা দিয়ে বলল, “ঠাকুরমশাই, আজ দিনটা কেমন তা পাঁজি দেখে একটু বলুন তো।”

“পাঁজি দেখার দরকার নেই, আজ শুক্লা চতুর্দশী, দিন বড় ভাল বাবা। আজ কি কোনও শুভ কাজে বেরিয়েছ নাকি? তা আজ সর্বকর্মের পক্ষেই প্রশস্ত। পরস্ব অপহরণ হোক বা দ্রব্যাদি অপসারণ হোক সব কাজেই সিদ্ধি।”

ভুসিরাম থমথমে মুখে বলে, “ওসব নয় ঠাকুরমশাই, মৃতে দোষ আছে কি না সেইটে দেখে দিন।”

অনঙ্গমোহনের চোয়ালটা হঠাৎ ঝুলে পড়ল। কাঁপা হাতে পাঁজিখানা নিয়ে একটু উলটে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন, “মৃতে ত্রিপাদ দোষ হয় বলে মনে হচ্ছে।”

“সেটা কি খুব খারাপ জিনিস?”

অনঙ্গমোহন আমতা-আমতা করতে লাগলেন, জুতসই জবাবটা ভেবে পাচ্ছেন না।

অধৈর্য হয়ে ভুসিরাম বলল, “কিছু মূল্য ধরে দিলে মৃতে দোষ নাস্তি করা যাবে কি না সেইটে দেখুন।”

অনঙ্গমোহন ভারী উদার গলায় বললেন, “তা যাবে না কেন? খুব যাবে।”

ভুসিরাম ট্যাঁক থেকে একান্ন টাকা বের করে প্রণামীর থালায় রেখে বলল, “মন্তরটা একটু খেলিয়ে উচ্চারণ করবেন ঠাকুরমশাই, কাজ যেন হয়।”

অনঙ্গমোহন ঘাড় কাত করে বললেন, “খুব হবে বাবা, খুব হবে। মৃতে অমৃতযোগ করে দেব’খন।”

“তাই দেবেন।” বলে ভুসিরাম উঠে পড়ল। আর দেরি করা ঠিক হবে না। ঘটনাটা চাউর হওয়ার আগেই ঝুলে পড়া ভাল। গোঁজেরহাটের যেসব মানুষ আজও তাকে এত খাতির করে তারাই আর কিছুক্ষণ পরে তাকে হয়তো বক দেখাবে, টিটকিরি দেবে, চাই কি সিটিও মারতে পারে। এর পর হয়তো তাকে বিদ্রুপ করে পটল পাল কবিতা লিখবে, গুণেন বাউল গান বাঁধবে, মনসাপণ্ডিত ‘কুলাঙ্গার, পল্লির কলঙ্ক’ বলে গালাগাল করবেন, দারোগা কোদণ্ড গজপতি হয়তো বলবেন, “ভুসিরাম যে এমন গোমুখ্যু, তা তো এতদিন বুঝতে পারিনি।” মনশ্চক্ষে এবং মনঃকর্ণে সে তার ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছিল।

গোঁজেরহাটের উত্তরে মাইলটাক হাঁটলেই কুমিরমারির জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে কেতুগড়ের ভাঙা রাজবাড়ি।

রাজবাড়ির পশ্চিমে জলার ধার ঘেঁষে খুব জুতমতো একটা বট গাছ আছে। চারদিকে বটের ঝুরি নেমে দিব্যি আড়াল হয়ে আছে ভিতরটা। ওই বটবৃক্ষে ফাঁসি লটকালে কাকপক্ষীও টের পাবে না। এমনিতেই জনশূন্য জায়গা, তার উপর ভূতের আস্তানা বলে বদনাম আছে। আর কিছুক্ষণ পর সেও অবশ্য তাদের দলে নাম লিখিয়ে ফেলবে। এইসব ভাবতে ভাবতে জোর কদমে হাঁটা ধরল ভুসিরাম। পনেরো মিনিটের রাস্তা বারো মিনিটে পেরিয়ে গেল সে। জঙ্গলের ভিতরে বেশ ঘোলাটে অন্ধকার, দিনমান বলে বোঝা যায় না।

বেশ অনেকটা ভিতরে ঢোকার পর ভাঙা রাজবাড়িটা দেখা গেল। রাজবাড়ি বলে আর চেনার উপায় নেই। আগাছায় প্রায় সবটাই ডুবে আছে। শুধু দরবারের আধভাঙা গম্বুজটা এখনও জেগে রয়েছে। ভুসিরাম বট গাছের নীচে ঘাসের উপর বসে একটু জিরিয়ে নিল। এখন আর তেমন তাড়া নেই। সামনেই পরলোক। ঝুলে পড়লেই হয়। শেষ সময়টা ধীরেসুস্থে কাটানোই ভাল।

জিরোনোর পর সে সাবধানে বট গাছের একটা নিচু ডাল ধরে উপরে উঠল। খুব বেশি উপরে ওঠার দরকারও নেই। নীচের দিকে একটা সুবিধেমতো ডাল পেয়ে দড়ির একটা মুড়ো তাতে বেঁধে ফেলল কটকটে করে। অন্য মুড়োটায় গোল করে ফাঁস তৈরি করতেও বেশি গা ঘামাতে হল না। খুব মন দিয়ে কাজ করছিল বলে চারদিকটা তেমন খেয়াল করেনি। হঠাৎ আশপাশ থেকেই কে যেন ভারী মিঠে আর মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “ভায়া কি চললে নাকি?”

না, ভুসিরাম চমকাল না, তবে লোকটার নির্লজ্জ বেয়াদপি দেখে সে তাজ্জব! ভুসিরাম গাছের উপর থেকেই বলল, “রাখোহরিবাবু, আপনার কিন্তু লজ্জা হওয়া উচিত।”

রাখোহরি ভারী অপ্রস্তুত ভাব করে তেমনি মিঠে গলাতেই বলল, “লজ্জা হচ্ছেও। খুবই লজ্জা হচ্ছে হে! কিন্তু দড়িটা কি ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে?”

“কেন বলুন তো! কোনও ভুল হয়েছে?”

“আমার তো নীচে থেকে দেখে মনে হচ্ছে গেরোটা ঠিকমতো এঁটে বসেনি। ও হল ফসকা গেরো। তুমি ঝুলে পড়লে দড়ির গিঁটও আলগা হয়ে খুলে পড়বে!”

“বটে! দড়ি সম্পর্কে আপনি কী জানেন মশাই?”

“আহা, আমার যে দড়িরই কারবার। আমার কারখানার দড়ি যে সারা দেশে চালান যায়! আমি জানব না তো কে জানবে? আরও একটা কথা আছে বাপু।”

“কী কথা?”

“ফাঁসি দিতে হলে কেউ কি এই গাছ বাছে? দেখছ না গায়ে-গায়ে বটের ঝুরি নেমেছে। বডি যে ঝুল খাবে তার তো ফাঁকই নেই! শেষে মাঝপথে বডি আটকে ত্রিশঙ্কু অবস্থা না হয়! তোমার ভালর জন্যই বলছি।”

“আমার ভাল ভেবে আপনার আর কাজ নেই। আপনি এখন বিদেয় হন তো! আমার হাতে এখন গুরুতর কাজ রয়েছে দেখছেন না!”

“আহা আমি তো কাজের কথাই বলছি। সুষ্ঠুভাবে কাজটা যাতে সমাধা হয় সেই উদ্দেশ্যেই বলা। এই জন্যই লোকের ভাল করতে নেই।”

“কথাটা বলতে আপনার লজ্জা করল না! আপনি কি লোকের ভাল করার মতো মানুষ? আজ সকালের কথা কি বিস্মরণ হয়ে গিয়েছে? আপনার বিস্মরণ হলেও আমি কিন্তু ভুলছি না। সারাজীবন মনে রাখব যে, আপনি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন!”

“আহা তোমার সারা জীবন আর কতক্ষণ! তুমি পটল প্লাক করলে তো আর মনে রাখারাখির ঝঞ্ঝাটও থাকছে না কিনা।”

ভুসিরামকে কথাটা স্বীকার করতে হল। বলল, “তা বটে!”

“তাই বলছিলাম, আটঘাট বেঁধে কাজ করা ভাল।”

“দেখুন মশাই, এই অন্তিম সময়টা সকলের কাছেই খুব গুরুতর। এই সময়টায় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, মনটাও ফুরফুরে রাখা দরকার, ঠাকুর দেবতার নামও তো খানিক স্মরণ করতে হবে নাকি বলুন। তা এই গুরুতর একটা ব্যাপারের মাঝখানে আপনি হঠাৎ উদয় হয়ে ভ্যাজরভ্যাজর করে যাচ্ছেন কেন বলুন তো! এতে মনটা চটকে যায় কি না ভেবে দেখুন।”

রাখোহরিকে স্বীকার করতে হল যে এদিকটা সে ভেবে দেখেনি। আরও বলল, “এই জঙ্গলে নাকি ফাঁসিতে লটকানোর জন্যই একটা আলাদা গাছ আছে।”

ভুসিরাম বলল, “আপনার পছন্দ করা গাছে আমি ফাঁসিতে লটকাতে যাব কেন মশাই? আমার কি মান সম্মান নেই নাকি!”

রাখোহরি বলে, “তা থাকবে না কেন? তবে কিনা সেটা পারিজাত গাছ। তাতে লটকালে সাক্ষাৎ স্বর্গবাস। আর সত্যি কথা বলতে কী বাপু, তোমার কাজকর্ম আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। লোকমুখে শুনছি বটে যে, তুমি একজন কেউকেটা লোক, কিন্তু সেই প্রাতঃকাল থেকে দেখে যাচ্ছি, তুমি একটার পর একটা কাঁচা কাজ করে যাচ্ছ! এমনকী এতক্ষণের চেষ্টায় ঠিকমতো ফাঁসিতেও লটকাতে পারলে না! পাকা লোক হলে কখন ফাঁসিতে লটকে এতক্ষণে বাড়ি গিয়ে পান্তা খেতে বসে পড়ত!”

“দেখুন মশাই, মানুষের অভিজ্ঞতা হতে সময় লাগে। আমি তো আর রোজ রোজ গলায় দড়ি দিয়ে বেড়াই না! এইটেই আমার প্রথম ফাঁসি। ভুলচুক তো হতেই পারে! তা নিয়ে এত কথা কীসের মশাই?”

রাখোহরি একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলে, “দুঃখ কখন হয় জানো? যখন একজন সত্যিকারের গুণী মানুষকে কাঁচা ভুল করতে দেখি। এই তোমার কথাই ধরো। মাঝরাতে রণপায়ে চড়ে দেওয়াল ডিঙোনো থেকে গোটা অপারেশনটাই আমি নিজের চোখে দেখেছি বলেই বলছি, একদম নিখুঁত। যেন উঁচুদরের এক শিল্পীর কাজ। যেন কেউ পাকা হাতে স্কেচ এঁকে যাচ্ছে। কাঁচা ভুলটা করলে আমাকে বিশ্বাস করে আহাম্মকের মতো কানাকুঠুরিতে ঢুকে। তারপর তোমার যে হেনস্থাটা হল, তাও নিজের চোখেই দেখা। হাতি পাঁকে পড়লে দুঃখ হয় কি না বলো!”

ভুসিরামের বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ধরা গলায় বলল, “তা তো বটেই! তবে এসব ভেবে আর লাভ কী বলুন। আমি তো রওনা হয়েই পড়েছি!”

“আহা, রওনা হতে বারণ করছে কে? আরামসে রওনা হয়ে পড়ো। কিন্তু ফের একটা কাঁচা ভুল করতে যাচ্ছ বলেই বলছি। গুণী মানুষ যখন মরে তখন মরার ভিতরেও নিজের ছাপ রেখে যায়। আর পাঁচটা এলেবেলে লোকের মতো দাঁত ছরকুটে, আখাম্বা আহাম্মকের মরার মতো মরলে কি ভাল দেখাবে বাপু? এই যে তুমি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে যাচ্ছ এর মধ্যে আর্ট কোথায়? সিগনেচার কোথায়? শিল্প কোথায়? মরবার পর যদি লোকে শতমুখে না বলে যে, ‘হ্যাঁ, ভুসিরাম একটা মরার মতো মরেছে, বাপের ব্যাটার মতো দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে,’ তা হলে আর কী হল?”

ভুসিরামের লোকটাকে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে একটা কী যেন আছে! একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। সে দোনোমনো ভাব নিয়ে কিছুক্ষণ গাছের উপর বসে রইল। একটু ভাবল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে এল নীচে। গামছায় মুখের ঘাম মুছে ঘাসের উপর রাখোহরির পাশটিতে বসে বলল, “আপনার মতলবটা কী তা একটু বলবেন?”

“মতলব একটা ছিল বটে, কিন্তু তোমাকে বলে লাভ কী বলো তো! একটু বাদেই তো তুমি পটল তুলবে, মরুনে মানুষকে দিয়ে কি কোনও কাজ হয়?”

ভুসিরাম মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “তা বটে।”

কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। তারপর রাখোহরি হঠাৎ তার মধুমাখানো গলায় বলল, “তোমার গড়িমসি দেখে মনে হচ্ছে, এবেলায় আর গলায় দড়ি দেওয়ার ইচ্ছে নেই!”

ভুসিরাম একটু গরম হয়ে বলল, “আমার মরা নিয়ে আপনার এত গরজ কীসের?”

“না, এই ভাবছিলুম কর্তাবাবুকে গিয়ে এখন কী বলি! তিনি যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন, তারই বা কী হবে!”

“কর্তাবাবুটি আবার কে?”

“চিনলে না? কর্নেল বীরবাহু হে! আজ সকালে যিনি তোমাকে একেবারে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন।”

ভুসিরাম একটু গরম হয়ে বলে, “তাঁর খবরে আমার কী কাজ মশাই?”

“আহা, তিনি যে তোমার জন্যই বসে আছেন হে!”

ভুসিরাম চিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠে বলল, “কেন, জুতোপেটা করা আর নাকে খৎ দেওয়ানোটা বাকি রয়ে গিয়েছে বুঝি!”

“দূর-দূর, ওসব নয়। খারাপটাই বা ধরে নিচ্ছ কেন?”

“তাঁর সঙ্গে ইহজন্মে আমার আর দেখা হবে না। বুঝলেন? জীবনে এত অপমান হইনি মশাই। ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়!”

রাখোহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তা হলে আসল কথাটা তোমাকে খুলেই বলতে হয়। এই কিছুক্ষণ আগে কর্তাবাবু আমাকে তাঁর খাসমহলে ডেকে নিরিবিলিতে বললেন, ভুসিরাম ছোকরাটাকে সকালে বড় বেইজ্জতি করা হয়েছে রে রাখু! কিন্তু ওর ভালর জন্যই করা। আমি সাজা না দিলে আমার পাইকরা ওকে হাটুরে মার মারত। ওকে একবার ডেকে আনতে পারিস? ওরকম ডাকাবুকো, বুদ্ধিমান একটা ছেলেরই এখন বড্ড দরকার আমার। যেমন তেজালো চেহারা তেমনি সাহস। আজ অবধি কুঠিবাড়িতে ঢোকবার এলেম আর কেউ দেখায়নি। ওকে বলিস সকালে যা হয়ে গিয়েছে, তা যেন মনে না রাখে।”

ভুসিরাম চোখ গোল-গোল করে রাখোহরির দিকে চেয়ে ছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “রাখোহরিবাবু, আপনার চেয়ে একটা কেউটে সাপকেও আমার বেশি বিশ্বাস হয়, তা কি জানেন?”

রাখোহরি মাথা নেড়ে বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক। তবে কিনা আমার দিকটাও তো একটু ভাবতে হবে বাপু! আমি কর্তার নুন খাই, তাঁর পয়সায় আমার প্রতিপালন হয়, ঠিক কি না! তা হলে তুমিই বলো সেই আমি চোখের সামনে কুঠিবাড়িতে একটা জলজ্যান্ত চোরকে দেখেও কীভাবে পাশ ফিরে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে পারি? তবে চার-চারজন পাইককে যেভাবে তুমি রাম পটকান দিলে তাতে তোমাকে সাপটে ধরার মতো আহাম্মকি আমি করতে যাইনি। তত দম তো আমার নেই! আমি রোগা-ভোগা লোক। তাই একটু কৌশল করতে হয়েছিল বটে। মারি অরি পারি যে কৌশলে। এখন ভাল করে ভেবে দেখলে আমাকে বোধহয় তোমার তত খারাপ লোক বলে মনে নাও হতে পারে।”

ভুসিরাম আবার একটা ঘাস তুলে নিয়ে তার ডাঁটিটা চিবোতে চিবোতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, “আপনি কেমন লোক তা দিয়ে এখন আমার কাজই বা কী? আজকের পর থেকে তো আপনার সঙ্গে আমার আর কোনও কাজ কারবার নেই মশাই! দেখাসাক্ষাতেরও ব্যাপার নেই। আমি তো রওনা হয়েই পড়েছি।”

“আহা, রওনা হতে তো আর ট্রেন বা বাস ধরতে হচ্ছে না! ধীরে-সুস্থে বেশ গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলেই হল। তাড়াহুড়ো করতে গেলে অনেক সময়ে ভুলভালও তো হয়ে যায়! এই তো সেদিন জগদানন্দবাবু হুড়োহুড়ি করে কাশী যেতে গিয়ে কালাহান্ডির ট্রেনে উঠে পড়লেন। আর খগেনবাবুর তো আরও কেলেঙ্কারি, সাঁচী যাবেন বলে বেরিয়ে শেষে করাচিতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাই রওনা হওয়ার আগে সব দিকটা খেয়াল রাখতে হয়।”

ভুসিরাম আবার একটা বড় করে শ্বাস ফেলল। তারপর করুণ গলায় বলল, “দেখাদেখির আর কী আছে বলুন। গোঁজেরহাটের লোক যখন জানতে পারবে যে, কুঠিবাড়িতে চুরি করতে ঢুকে আমি বুরবকের মতো ধরা পড়ে, কান ধরে ওঠবোস করে মান ইজ্জত খুইয়ে এসেছি, তখন লজ্জায় তাদেরও মাথা হেঁট হয়ে যাবে। এর চেয়ে বিরুবাবু আমাকে গুলি করে মারলে বেঁচে যেতাম।”

রাখোহরি হঠাৎ ভারী খুশি হয়ে বলল, “তা তার আর ভাবনা কী? হাতের নাগালেই তো বিরুবাবু রয়েছেন, আর বন্দুকেরও কোনও অভাব নেই। শুভস্য শীঘ্রম। চলো তো, উঠে পড়ো। খুব দয়ার শরীর বিরুবাবুর, কাকুতিমিনতি করলে রাজি হয়ে যাবেন…” বলে হাত ধরে একরকম জোর করেই ভুসিরামকে তুলে ফেলল রাখোহরি।

ভুসিরাম বিরক্ত হয়ে বলে, “অন্যের কাজ ভন্ডুল করা, অন্যের কাজে বাগড়া দেওয়া ছাড়া কি আপনার আর কিছু করার নেই? কাল রাতে তোশাখানার দরজা ফাঁক করার মুখেই আপনি এসে গোলে হরিবোল করে দিলেন। আর এখন এত মেহনত করে গাছে দড়ি বেঁধে শান্তিতে যেই গলায় দড়িটা পরতে যাচ্ছি, অমনি আপনি এসে আগড়মবাগড়ম বকে দিলেন সব গুলিয়ে! গুরুতর কাজের সময় কাউকে এভাবে বিরক্ত করা কি উচিত?”

“ওরে বাপু, ফাঁসিতে মরার চেয়ে গুলিতে মরা অনেক বেশি প্রেস্টিজের ব্যাপার। চলো চলো, আর দেরি নয়, কে জানে বাপু, বারবেলা না পড়ে যায়, অশ্লেষা বা মঘা এসে হাজির হওয়াও বিচিত্র কী!”