অধ্যায় ৩
গয়াবুড়ির সঙ্গে বীরবাহুর বনিবনা হয় না মোটেই। বীরবাহু গেরামভারী লোক, তার কর্মচারীরা তো বটেই, বন্ধুরা অবধি বিরুকে সামলে চলে। সে কুঠিবাড়িতে এলে গোটা বাড়িটাই তটস্থ। বাদ শুধু গয়াবুড়ি। ভয় তো খায়ই না, উলটে তার শাসন আর খবরদারিতে বিরু অতিষ্ঠ… “ও বিরু, খেতে বোস, ও বিরু চান করতে যা, ও বিরু, রাত হয়ে গিয়েছে বাবা শুয়ে পড়, ও বিরু, তুই হাঁফাচ্ছিস কেন, একটু জিরো তো!’…”
মাঝে-মাঝে বিরু কথা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখেছে, লাভ হয়নি। কথা বন্ধ করা তো এক তরফে হয় না! দু’তরফই লাগে। কুঠিবাড়িতে এলেই বিরুর এই এক জ্বালাতন। শুতে, বসতে, খেতে, ঘুমোতে সর্বদাই গয়াবুড়ির খবরদারিতে থাকতে হয় তাকে। গয়াবুড়ির বয়স কত কেউ জানে না, গয়াবুড়ি নিজেও নয়। তবে বীরবাহু জন্মাবধি গয়াবুড়িকে দেখে আসছে। জন্মেও এই গোঁজেরহাটের বাইরে যায়নি গয়াবুড়ি, কুঠিবাড়ির বাইরেও সে কদাচিৎ যায়। একবার বীরবাহু গয়াবুড়ির হাত থেকে খানিক রেহাই পাওয়ার জন্য তাকে নিজের খরচে কাশীবাস করতে পাঠাতে চেয়েছিল। শুনে গয়াবুড়ির সে কী চেঁচামেচি, “কোন পাপ করিছি রে যে আমাকে কাশীতে পাঠাতে চাস? কখনও কোনও অধর্ম করতে দেকেছিস আমায়? বাবা বিশ্বনাথ আমার মাথায় থাক, পাণ্ডাদের ঝ্যাঁটার বাড়ি খেতে যাব কোন দুঃখে…” বিরু হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বুড়িকে আর পারতপক্ষে ঘাঁটায় না। তবে মানুষটার কোনও বায়নাক্কা নেই। সারাদিন, উদয়াস্ত এই কুঠিবাড়ির উপর থেকে নীচ এবং আনাচকানাচ টুকটুক করে ঘুরে-ঘুরে বেড়ায় আর আপনমনে বকবক করে। এই বাড়ির উপর বড্ড মায়া বুড়ির। এই কুঠিবাড়িই তার কাশী, গয়া, বৃন্দাবন।
তাই কোনও বেগোছ দেখলে বুড়ি রুখে দাঁড়ায়। আজ সকালেই এক কলসারাইয়ের মিস্তিরি এসেছে। বেঁটেখাটো মজবুত চেহারা। গয়াবুড়ি তার কাছে এসে আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বলল, “অ্যাই মিনসে, তুই না গত আষাঢ় মাসে দোতলার জানালার খড়খড়ি সারিয়ে গেলি!”
লোকটা নির্বিকার গলায় বলে, “সে আমি নয় গো মাসি।”
“তোর নাম গ্যানা নয়?”
“না গো মাসি, আমি গুণেন।”
“আরও কথা আছে বাছা, জষ্টি মাসের ঝড়ে দক্ষিণের বাগানে আম গাছটা উপড়ে দেয়াল খানিকটা ভেঙে পড়েছিল, দেয়াল সারাতে তো রাজমিস্তিরি সেজে তুই-ই এসেছিলি বাছা! বেশ মনে আছে তখন নাম বলেছিলি, গণেশ।”
“আমি কোন দুঃখে গণেশ হতে যাব গো মাসি! তুমি বুড়ো হয়েছ, ভুলভাল দেখছ।”
“শুধু তাই নয় বাপু, গত চোত সংক্রান্তির আগের দিন দুর্গাপদধোপার ভাইপো বলে এসে এ বাড়ির বত্রিশখানা চাদর নিয়ে হাওয়া হয়েছিল কে বল তো! সেবার তো নাম বলেছিলি, গজপতি।”
অখণ্ড মনোযোগে কল সারাতে সারাতে লোকটা বলে, “তোমার ভীমরতি হয়েছে গো মাসি!”
“ভীমরতি হোক আমার শত্তুরের। বলি তুই কি বিশ্বকর্মা? দুনিয়ার সব মেরামতির কাজ একটা মিস্তিরিই করছে জন্মে দেখিনি বাবা! তা তুই যদি এমন চৌখস মিস্তিরিই হলি, তা হলে তোর চোখ চারদিকে বনবন করে ঘোরে কেন রে? কুদৃষ্টি দিস নাকি? আড়ে-আড়ে চোখ রাখছিস কোথায় কী আছে?”
এত কথাতেও লোকটা চটল না। মিটিমিটি হেসে বলে, “না মাসি, আমি মিস্তিরি মানুষ, অন্যদিকে চোখ দিলে কি চলবে? তোমার বয়স হয়েছে মাসি, এবার চোখের ডাক্তার দেখাও।”
“ওরে আমি ভুল দেখলে অনেকের সুবিধে হয়, সে আমি জানি। কিন্তু শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আজও আমার চোখে চালসে ধরেনি, বুঝলি? বলি তোর মতলবটা কী? চুরি-ডাকাতি করতে ঢুকেছিস নাকি?”
“ও কথা শোনাও পাপ।”
“এঃ বড্ড ভালমানুষ দেখছি!” বলেই গয়াবুড়ি দোতলার দিকে মুখ তুলে তার খনখনে গলায় চেঁচাল, “বলি ও বিরু! শুনছিস! ওরে ও বিরু!”
দোতলার জানালার পাল্লাটা খুলে বীরবাহু বাজখাঁই গলায় হুংকার দিল, “কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?”
“চেঁচাই কি আর সাধে বাছা! দ্যাখ না, এই লোকটা বারবার হরেক রকম মিস্তিরি সেজে ঘোরাফেরা করছে। কখনও ছুতোর, কখনও রাজমিস্তিরি, কখনও কলসারাইয়ের কারিগর, যেন বহুরূপী। কী মতলব, তা বুঝতে পারছি না। দিনকাল তো ভাল নয়।”
বিরু ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “তোমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, মিস্তিরির পিছনে লেগেছ! যাও না ঘরে বসে একটু হরিনাম করোগে না!”
গয়াবুড়ি অবাক হয়ে বলে, “হরিনাম করব! হরিনাম করব কেন রে? আমার কি অন্তিম সময় ঘনিয়ে এয়েছে!”
বীরবাহু এবার একটু নরম হয়ে বলে, “বাড়ি পাহারা দেওয়ার লোক তো রয়েছে, তোমার অত খবরদারির দরকার কী? বরং ঘরে গিয়ে একটু জিরোও। বয়সের কথাটাও তো খেয়াল রাখতে হয়!”
“বয়সের খোঁটা দিচ্ছিস কেন রে? বয়স হয়েছে তো কী, বয়স কোলে করে বসে থাকলে কি আমার চলবে! যখন রাতবিরেতে বড় কর্তাবাবু তলব করে বাঘা গলায় কৈফিয়ত চাইবেন তখন কী বলব, বল তো! জন্মেজয় ভঞ্জকে তো দেখিসনি! এই তোর চাইতেও এক বিঘত লম্বা, আর ওই সদর দরজাটার মতোই চওড়া বুকের পাটা।”
“তোমার মাথাটাই গিয়েছে। জন্মেজয় ভঞ্জ যে পঞ্চাশ বছর আগেই গত হয়েছেন, সে খেয়াল আছে?”
“ও মা! গত হয়েছেন তো কী হয়েছে, তা বলে কি যাতায়াত নেই নাকি! এই তো কাল নিশুত রাতে ডেকে পাঠিয়ে কত কথাই বললেন। বললেন, ‘ওরে গয়া, বিরু শিকারি বলে এ কাদের ধরে নিয়ে এসেছে বল তো! শিকার করবে কী, এরা তো বন্দুক ধরতেই জানে না! গতকাল আসমানির চরে একান্নবার গুলি চালিয়ে একটা পাখিও মারতে পারেনি। আর পারবেই বা কী করে! কোনওটার হাত কাঁপে, কোনওটার বাতব্যাধি, কোনওটা চোখে কম দেখে, কোনওটা নুলো! ছ্যা ছ্যা! এসব বুড়োধুড়ো লোককে দিয়ে কি শিকার হয়! তার উপর দিনরাত গান্ডেপিন্ডে গিলছে, ওতেই তো হাতের টিপ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। ওই গুঁফো শিকারিটা তো কাল রাতে দেড় সের মাংস খেয়েছে। কী নোলা বাবা!’ ”
বীরবাহু রেগে গিয়ে “তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি!” বলে জানালার পাল্লাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল।
গুণেন মিস্তিরি আড়ে-আড়ে সবই লক্ষ করছিল, কাজ করতে করতেই ভালমানুষের মতো বলল, “বুঝলে মাসি, কর্তাবাবুদের দোষ কী জানো? ওরা এই তোমার-আমার মতো মনিষ্যিদের কথা কানেই তুলতে চান না। তুমি তো ভাল ভেবেই বলেছ, আর কথাটা তো কিছু খারাপও বলোনি। আমি একটা উটকো লোক বই তো নয়। মিস্তিরি সেজে কত চোরছ্যাঁচোড় তো হামেশা লোকের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে। আর আমাকেই বা বিশ্বাস কী বলো! না, না, আমার তো মনে হয় বিরুবাবু কাজটা ঠিক করেননি। তোমার কথাটা ওঁর ভেবে দেখা উচিত ছিল।”
গয়াবুড়ি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তবেই বোঝো বাবা, যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর। এই তুই ভালমানুষের ছেলে, তাই বুঝলি, আর কি কেউ বোঝে?”
গুণেন দুঃখ করে বলে, “বাবুমশাইরা না বুঝলেও আমরা বুঝি, তুমি কেমন বুক দিয়ে কুঠিবাড়ি আগলে পড়ে আছ। গোঁজেরহাটের কে না তোমার কথা জানে বলো! না, না, এটা বিরুবাবুর ভারী কাঁচা কাজ হয়েছে। বিচক্ষণ হলে উনি তোমার কথাটা ওজন করে দেখতেন। শত হলেও বড়লোকের পুরনো বাড়ি বলে কথা। সোনাদানা, মোহর, হিরে, জহরত তো কম থাকার কথা নয়! কী বলো!”
গয়াবুড়ি ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর বলিস না বাছা, এই দ্যাখ চাবির গোছা আঁচলের খুঁটে বেঁধে বয়ে বেড়াচ্ছি। কত ওজন জানিস? দেড় সের! চাবির বোঝা বইতে-বইতেই আমার পিঠ কুঁজো হয়ে গেল। তবু কি কৃতজ্ঞতা বলে কিছু আছে!”
“বড় মানুষদের ওইটেই দোষ কিনা, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চাঁদমারি। তোমাকে তো দেখছি উদয়াস্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছ! হাঁফ ছাড়ার সময় নেই।”
ফোঁস! আবার একটা দীর্ঘশ্বাস। গয়াবুড়ির আজ দীর্ঘশ্বাসের গাদি লেগে গিয়েছে। ধরা গলায় বলে, “দুঃখের কথা আর বলিস না বাবা! এই নিয়েই আছি। তা হ্যাঁরে, তোর মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন বল তো! কিছু খাসনি নাকি!”
গুণেন অবাক হয়ে বলে, “তাই তো! খাইনি নাকি? কাজে মজে থাকলে সব বিস্মরণ হয়ে যায় কিনা। তবে আবছা মনে পড়ছে দুপুরের দিকে যেন এক মুঠো ছাতু আর জল খেয়েছিলাম গো মাসি।”
“ওমা, তবে তো তোর খিদে পেয়েছে বাছা! দাঁড়া তো, সকালে যে লুচি আর মোহনভোগ হয়েছিল তার কয়েকখানা লুচি বোধহয় এখনও পড়ে আছে। যাই, নিয়ে আসি।”
হঠাৎ এ সময়ে গুণেন তার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যেন কথাটা শুনতেই পায়নি।
গয়াবুড়ি কলাপাতায় মুড়ে খানদশেক লুচি আর এক থাবা মোহনভোগ এনে বলল, “নে বাছা, এটুকু মুখে দিয়ে একটু পিত্তদমন করে নে।”
গুণেন ভারী গদগদ হয়ে বলে, “মা-মাসিদের নিয়ে ওটাই অসুবিধে, বুঝলে মাসি! তাদের কাছে কিছু লুকোনো যায় না। মুখ দেখেই সব বুঝতে পেরে যায় কিনা।”
গয়াবুড়ির গলায় যেন আদর ঝরে পড়ছে। বলল, “খা বাবা, খা।”
তা খেল গুণেন। রসিয়ে-রসিয়েই খেল। রাজা-মহারাজাদের বাড়ির রান্নার বাহারই আলাদা। ঠান্ডা লুচি থেকেও গাওয়া ঘিয়ের সুবাস আসছে, আর মোহনভোগ মানে তো আর গরিবদের সুজি বা হালুয়া নয়, তাতে কাজু, কিসমিস, পেস্তা, কেশর, জায়ফল মিলেমিশে মারদাঙ্গা ব্যাপার। জিব থেকে পেট অবধি যেন আলো জ্বলে উঠল। আর চাবির গোছারও যে এমন সৌন্দর্য থাকতে পারে সেটাও এতদিন জানা ছিল না তার। গয়াবুড়ির আঁচলে বাঁধা এক থোলো চাবির দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে-চেয়ে তার যেন আশ মিটছিল না। বড়-বড় নিরেট চাবি সব। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। এই সব চাবি দিয়ে যে সব দরজা বা সিন্দুক খোলা হয় সেগুলোকেও প্রণাম করতে ইচ্ছে যাচ্ছিল গুণেনের। তবে তাড়াহুড়োরও কিছু নেই। সবুরে মেওয়া ফলে। প্রণাম সময় সুযোগমতো করে আসা যাবে।
ঠিক এই সময়টায় কে যেন রসভঙ্গ ঘটাতে কাছেপিঠে থেকেই ভারী মিঠে গলায় বলল, “গয়াবুড়ি কি খাল কাটছ নাকি!”
গয়াবুড়ি মগ্ন হয়ে গুণেনের খাওয়া দেখছিল। বাহ্যজ্ঞান নেই বললেই চলে। তাই কথাটা খেয়াল করল না। কিন্তু গুণেনের তো তা নয়। তাকে নিজের গরজেই চারদিকটা খেয়াল রাখতে হয়। সে তটস্থ হয়ে এক গাল হেসে বলল, “উরে বাব্বা, রাখোহরিবাবু যে! তা বাবু, খবর-টবর সব ভাল তো?”
রাখোহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তোর খবর তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে।”
গয়াবুড়ি চটকা ভেঙে রাখোহরিকে দেখে বলে, “কিছু বলছিলি বাপু!”
“এই বলছিলুম, তুমি কি খাল কাটছ?”
“মরণ! খাল কাটব কেন রে?”
“কুমির ঢোকাবে বলে! আরও একটা কী যেন কথা আছে! ও হ্যাঁ, এ তো দেখছি কালসাপকে আদর করে বসিয়ে সাঁটিয়ে দুধকলা খাওয়াচ্ছ।”
গয়াবুড়ি ভারী চটে গিয়ে বলে, “ছিঃ ছিঃ! ও কী কথা রাখু, খিদের মুখে বেচারা একটু খাচ্ছে! ওরকম বলতে হয়!”
“বলি কি আর সাধে! দিনকাল ভাল নয়। ভালমন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে তো আমারই গর্দান নিয়ে টানাটানি! এ কি তোমার চেনা লোক?”
গয়াবুড়ি অম্লানবদনে বলে, “ও মা! চেনা নয় তো কী? এ হল আমার বোনপো।”
“তোমার তো তিন কুলে কেউ নেই বলেই জানি! হঠাৎ বোন এল কোত্থেকে? সেই সঙ্গে আবার একটা হদ্দমুদ্দো বোনপোও?”
“সে আছে বাছা, লতায়পাতায় সম্পর্ক, তবে ফ্যালনা নয়। তোর অত কথায় কাজ কী? নিজের কাজে যা না। তোকে দেখে বেচারির খাওয়াটাই চমকে গিয়েছে।”
“তা তো চমকানোরই কথা কিনা। শাকের আড়াল থেকে মাছ উঁকিঝুঁকি মারছে তো!”
“তুই লোককে বড্ড খুঁড়িস বাপু। সাতে নেই পাঁচে নেই, বেচারা সারাদিন মুখে রক্ত তুলে কল মেরামত করছে, অমনি খুঁত ধরতে শুরু করলি! এটা বাপু, তোর ভারী অন্যায়। মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে দ্যাখ তো, কেমন বেচারা-বেচারা ভাব! একে কি চোরছ্যাঁচড় বলে মনে হয়!”
“মনে হচ্ছে, বোনপোকে পুষ্যি নিয়ে ফেলেছ!”
“আ মরণ! পুষ্যি নিতে যাব কেন রে? তবে গুণেনের উপর আমার একটু মায়া পড়ে গিয়েছে বাপু। যখন কথা কয় শুনে কান জুড়িয়ে যায়। বাক্যিতে যেন গুড় মাখানো! কথা কইতে ক’জন জানে বল তো! যাকে কইলি, কথা যদি তার গায়ে চিটে গুড়ের মতো লেগেই না রইল তবে তা কীসের কথা রে!”
রাখোহরি আঁশটে মুখে বলে, “অনেকে ওই গুড় বেচেই খায়, জানো তো! তা হলে গুড়েই মজেছ!”
গয়াবুড়ি একটা ঝামটা মেরে বলে, “মজেছি বেশ করেছি। এখন বিদেয় হ’ তো। তোকে দেখে বেচারা বড্ড ঘাবড়ে গিয়েছে।”
বাস্তবিকই গুণেন খাওয়া থামিয়ে লজ্জা-লজ্জা ভাব করে মিটিমিটি হাসছিল। সে জানে রাখোহরি কর্তাবাবুর পেয়ারের লোক। সে যে কাজ ফেলে লুচি-মোহনভোগ সাঁটাচ্ছে এ খবর রটতে কতক্ষণ। আর তাতে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে! তার মতো মানুষকে অনেক কথা মাথায় রেখে চলতে হয়।
রাখোহরি গুণেনের দিকে চেয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলে, “হ্যাঁরে গুণেন, কোন মন্তরে গয়াবুড়িকে বশ করলি বল তো! আমরা তো দিনরাত গয়াবুড়ির মুখনাড়া শুনে মরছি। বলি তান্ত্রিক ধরেছিস নাকি!”
গুণেন লজ্জায় অধোবদন হয়ে বলে, “কী যে বলেন রাখোবাবু, মাসির বাইরেটাই যা একটু শামুকের খোলার মতো শক্ত, মনটা বড্ড নরম। আমার মুখ শুকনো দেখে বড্ড বেজাহান হয়ে পড়লেন কিনা।”
“ওরে, চারদিকে কি শুকনো মুখের অভাব আছে? শুকনো মুখের তো আর আকাল পড়েনি! আজ অবধি কারও শুকনো মুখ দেখে গয়াবুড়িকে টসকাতে দেখিনি। তুই-ই প্রথম।”
রাখোহরি বিদেয় হলে গুণেন আবার ভারী মন দিয়ে লুচি-মোহনভোগ সাঁটাতে সাঁটাতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “এ বাড়িতে কি ভূত আছে মাসি?”
গয়াবুড়ি অবাক হয়ে বলে, “ভূত! ও মা, ভূত থাকবে কোন দুঃখে?”
গুণেনমিস্তিরি নির্বিকার গলায় বলে, “না, এই বলছিলুম, পুরনো বাড়ি তো, ইঁদুর, বাদুড়, ভূতেদের খুব সুবিধে। একটু স্যাঁতস্যাঁতে আর অন্ধকারমতো জায়গায় ওঁরা থাকেন ভাল। একটু ভ্যাপসা আর সোঁদা গন্ধ থাকলে তো কথাই নেই। দমচাপা ঘরদোর হলে তো আরও চমৎকার!”
“তোর কথা শুনে তো মনে হয় ভূতেদের সঙ্গে তোর নিত্যি ওঠাবসা! তা এ বাড়িতে তুই ভূতের কী দেখলি?”
“না, এই বলছিলাম আর কী, কাল যখন নতুন পাইপ বসাচ্ছিলাম, তখন তো সন্ধে নেমে গিয়েছে, তখন বেশ লম্বাচওড়া বাবুমতো লোক যেন ওই গাবগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমার কাজ দেখছিল। দিব্যি চেহারাখানা, মাঞ্জাও দিয়েছিলেন ভাল। চওড়া ধাক্কাপেড়ে ধুতি, গায়ে সুতোর কাজ করা গরদের পাঞ্জাবি, কাঁধে কাশ্মীরি চাদর। তা আমি বললুম, ‘বাবু, দূরে দাঁড়িয়ে কেন, কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না কাছে এসে দেখে যান!’ তা শুনে হঠাৎ বাবু ভুস করে উবে গেলেন।”
গয়াবুড়ি ভ্রূকুটি করে বলে, “মরণ! ও ভূত হতে যাবেন কোন দুঃখে রে? ও তো বড়কর্তা জন্মেজয় ভঞ্জ। কাল রাতে তো বড়কর্তাই এসে আমাকে তলব করে বলল, ‘ওরে গয়া, নতুন মিস্তিরি লেগেছে দেখলাম। তা একটু নজর রাখিস বাপু। কে কোন মতলবে বাড়িতে ঢোকে তার ঠিক কী? তুই-ই আমার ভরসা, বিরুর তো কোনও হুঁশই নেই।’ ”
গুণেন মিস্তিরি মন দিয়ে কাজ করতে করতেই বলে, “পরশু দুপুরবেলা যখন খেটেখুটে একটু জিরোব বলে ওই শিমুল গাছটার নীচে বসেছি, তখন দেখি যেন ফস করে শূন্যি থেকে একটা দশ-বারো বছরের রোগাপানা মেয়ে বেরিয়ে এসে সজনে গাছটার তলায় এক্কাদোক্কা খেলতে লাগল। দেখে একটু অবাক হলুম, এ বাড়িতে এরকম বয়সের মেয়ের থাকার কথা নয়! তাই জিজ্ঞেস করলুম, ‘ও মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথা?’ সে আমার দিকে চেয়ে একটু হেসেই আচমকা ফের শূন্যির মধ্যেই ঢুকে গেল।”
“আর তুই বুঝি ধরে নিলি ভূত? দূর, ও তো সাতকড়ি পুরুতের মেয়ে লক্ষ্মী। সারাদিন বাড়িময় হুটোপাটি করে বেড়ায়!”
গুণেন হাতের কাজ থেকে মুখ না তুলেই বলে, “আমার কী মনে হয় জানো মাসি?”
“কী মনে হয় রে মুখপোড়া?”
“না, এই বলছিলুম যে, মানুষের বয়স বেশি হয়ে গেলে ওপারটাও দেখতে পায় কিনা, তাই বোধহয় এপার ওপার একাক্কার হয়ে যায়। এই তোমার যেমন হয়েছে গো মাসি।”
“ওরে অলপ্পেয়ে, তুই কি বলতে চাস আমার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে? নাকি আমি মতিচ্ছন্ন?”
“তাই বললুম নাকি!”
“তবে কী বললি রে হতভাগা?”
গুণেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “ভাল কথাই বলছিলুম গো মাসি। বলছিলুম যে, তোমার চোখ খুলেছে। দূরদৃষ্টি এসে গেছে। বয়সকালে অনেকের হয়। তখন ইহলোক-পরলোক দুটোই দেখতে পায়। তাই বলছিলুম যে, ওতে একটা মুশকিলও হয় কিন্তু। দুটো লোক নিয়ে ভজঘট্ট পাকিয়ে যায় কিনা। এই তোমার যেমন হয়েছে। কথাটা কী খারাপ বললুম, তুমিই বলো।”
“কী জানি বাছা, তোর কথার প্যাঁচ আমি ধরতে পারছি না। তবে ভাল কথা বলেই মনে হচ্ছে যেন।”
“আমার একটা দোষ কী জানো মাসি, ভাল কথা ছাড়া অন্য কথা আমার মুখে আসতেই চায় না। অনেক চেষ্টা করে দেখেছি, খারাপ কথা পেট পর্যন্ত আসে, কখনও-কখনও গলা অবধিও উঠে পড়ে, কিন্তু তারপর অনেক যুদ্ধ করেও তাদের গলার উপর তুলতে পারিনি। কী মনে হয় জানো? আমার গলায় বোধহয় একটা ছাঁকনি দিয়েই ভগবান পাঠিয়েছেন, তাতেই খারাপ কথাগুলো আটকে যায়। সেই জন্যই তো সারা জীবন কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদই হল না আমার। ঝগড়া লাগার আগেই কী করে যেন হেরে বসে থাকি।”
“ওরে বাবা! তা হলে তো তুই মিটমিটে ডান! অমন গুড় মাখানো কথা শুনেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল।”
গুণেন ভারী লজ্জার হাসি হেসে বলে, “তা এই বলছিলুম কী, গুড় মাখানো কথা কি খারাপ মাসি? কথা কইলুম, কিন্তু যাকে কইলুম তার গায়ে কথাটা যদি চিটেগুড়ের মতো লেপটেই না রইল তবে সে আর কীসের কথা! শুধু কথা কয়ে গেলেই কি হয়? তার কি আর কায়দা নেই? কথায় গুড় না মেশালে আঠা হয় না কিনা। হড়কে যায়।”
“ওম্মাগো, কোথায় যাব! তুই তো দেখছি ভারী বজ্জাত!”
গুণেনের ভাবখানা এমন যেন নিজের প্রশংসা শুনছে, লাজুক একটু হেসে বলে, “তা মাসি বলছিলুম কী, চারদিকে কি বজ্জাতের অভাব দেখছ?”
গয়াবুড়ি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তা কথাটা বড় মন্দ বলিসনি বাছা। চারদিকে যেন বজ্জাতের হাট বসে গিয়েছে! যার সঙ্গে দেখা হয় সেই-ই বজ্জাত। দুনিয়াটা তবু কী করে চলছে তাই ভাবছি।”