অধ্যায় ২
মনসারাম পণ্ডিতের বাবা কুঁড়োরাম বাচস্পতির বয়স এই সাতানব্বই পার হল। না, এমনিতে সব ঠিকঠাকই আছে। খিদে হয়, কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়, ঘুমও দিব্যি আসে। কিন্তু মুশকিল বাঁধিয়েছে আঠেরোটা ছাগল। ইদানীং সেগুলো নিয়েই একটু জ্বালাতন হচ্ছেন কুঁড়োরাম। ঘরের মধ্যে এতগুলো ছাগল একসঙ্গে ঢুকে পড়লে যা হয় আর কী। তারা ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিছানা বালিশে উঠে পড়ছে, লেপ চাদর খেয়ে ফেলছে, তার উপর চ্যাঁ-ভ্যাঁ ডাকাডাকি তো আছেই। আজ প্রাতঃকালে ঘুম ভেঙে সবে বিছানায় উঠে বসেছেন, দেখলেন মুখোমুখি গোদা ছাগলটা বিছানায় দাঁড়িয়েই কী যেন চিবোচ্ছে। ঠাহর করে মনে হল, তাঁর বড় সাধের লাল মলাটের কুমারনাথের গীতাখানা। মুখের ভাব দেখে মনে হয়, গীতার মতো এমন সরেস খাদ্য কখনও খায়নি। আগে ছাগলদের বেয়াদপি দেখলে কুঁড়োরাম চেঁচামেচি করতেন, ছাগলদের তাড়াও করেছেন, বকাঝকা করতেও বাকি রাখেননি। কিন্তু এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ছাগলদের সঙ্গেই যখন বসবাস করতে হবে, তখন মানিয়ে না নিয়ে উপায় কী? কিন্তু তা বলে তাঁর এত আদরের গীতাখানা চিবোবে এত বেয়াদপি সহ্য হয় না। তাঁর তিন ছেলে, মনসারাম, কামাখ্যারাম আর শীতলারাম। তবে আজকাল কারও নামই তাঁর মনে থাকে না। তাই তিন ছেলের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে একটা নাম বানিয়ে নিয়েছেন, ‘কাশীম’। গলা তুলে তিনি হাঁক মারলেন, “ওরে কাশীম, শুনছিস! এ যে বড় অরাজক অবস্থা! দেখে যা বাবা!”
হাঁক শুনে তাঁর মেজছেলে কামাখ্যা গম্ভীর মুখে দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, “বাবামশাই, কিছু বলছিলেন নাকি!”
কুঁড়োরাম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন, “তোমরা সব কোথায় যে থাকো! ওই দ্যাখো, ছাগলটা আমার গীতাখানা চিবিয়ে কী সর্বনাশ করল!”
কামাখ্যা বিচলিত না হয়ে শান্ত গলাতেই বলল, “আপনাকে তো কতবার বলা হয়েছে যে, আপনার ঘরে কোনও ছাগল নেই! আমাদের মোট দুটো ছাগল, দুলালী আর শ্যামলী, আর তারা এখন মাঠে খোঁটায় বাঁধা আছে। আর আপনার গীতা এই তো তাকের উপর রয়েছে।”
“অ! তবে কি আমি ভুল দেখেছি বলতে চাও?”
“যে আজ্ঞে।”
কুঁড়োরাম মুখটা বিরক্তিতে বাঁকা করে বলেন, “ভুল দেখেছি বললেই হল? আঠেরোটা ছাগলকে ভুল দেখতে হলে আঠেরোবার ভুল দেখতে হয়!”
“আঠেরো তো দূরস্থান, আপনার ঘরে একটাও ছাগল দেখতে পাচ্ছি না!”
“ডাক্তার দেখিয়ে চোখে চশমা নাও।”
“সেটা ভেবে দেখবখ’ন।”
কুঁড়োরাম গজগজ করতে করতে আপনমনে বললেন, “আমি নিজে রোজ গুনে দেখেছি, ওই আঠেরোটাই। আমি তো আর অঙ্কে কাঁচা নই যে, গুনতিতে ভুল করব!”
কামাখ্যা নির্বিকার মুখ করে বলল, “আপনি ম্যাট্রিকে অঙ্কে বাইশ পেয়েছিলেন।”
কুঁড়োরাম যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “নাকি?”
“হ্যাঁ। আপনি নিজের মুখেই কবুল করেছেন।”
কুঁড়োরাম জুলজুল করে একটু কামাখ্যার দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আর পাঁচটা বিষয়ে যে লেটার পেয়েছিলাম, সেটা বুঝি কিছু নয়?”
কামাখ্যা তেমনি নির্বিকার মুখে বলে, “না বাবামশাই, আপনি শুধু সংস্কৃত আর বাংলায় লেটার পেয়েছিলেন। তাতে অঙ্কের খামতি পূরণ হয় না।”
“হয় না?” বলে কুঁড়োরাম কিছুক্ষণ মুখখানা তোম্বা করে বসে রইলেন। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা সহবত শেখোনি। বড়দের সঙ্গে কথা কইতে জানো না, কেবল মুখে-মুখে তর্ক করো। আমার কোনও কথাই তোমাদের বিশ্বাস হতে চায় না কেন বলো তো! এই যে সন্ধের পর মাঝে-মাঝে আমি কুঠিবাড়ির কাছারিঘরে বসে জন্মেজয়বাবুর সঙ্গে দাবা খেলে আসি তা নিয়ে তোমরা হাসিমশকরা করো। কুলতলার মাঠে যে সেদিন আমি বেলুনের মতো গোল একটা মানুষকে দেখেছি, সেটাকে তোমরা চোখের ভুল বলে উড়িয়ে দিলে! সেদিন যে জোছনারাতে কয়েকটা রোগা আর লম্বা মানুষ পুব দিকের পোড়ো জমিটায় হুটোপাটি করছিল, সে কথাটাও তোমরা বিশ্বাস করলে না! আর সেইজন্যই আমি আজকাল পারতপক্ষে তোমাদের কাছে কিছু বলি না। অনেক কথাই চেপে রাখতে হয়।”
কামাখ্যা বিনা প্রতিবাদে সব শুনে বলল, “এখন ছাগলগুলোকে কি আর দেখতে পাচ্ছেন বাবামশাই?”
কুঁড়োরাম অসহায় গলায় বলেন, “লোক দেখলে ওরা গা-ঢাকা দেয় কিনা! উঁকি মেরে দ্যাখো তো, বোধহয় খাটের তলায় সব জড়ো হয়েছে।”
কামাখ্যা বাধ্য ছেলের মতো খাটের নীচে উঁকি মেরে দেখে বলল, “আজ্ঞে না বাবামশাই, খাটের নীচে একটাও ছাগল নেই।”
ভারী অবাক হয়ে কুঁড়োরাম বলেন, “নেই? তা হলে তারা গেল কোথায় বলো তো! একটা দুটো তো নয়! আঠেরোটা ছাগল! এতগুলো ছাগল তো আর হাওয়া হয়ে যেতে পারে না!”
কামাখ্যা শান্ত গলাতেই বলে, “বেলা হয়ে যাচ্ছে বাবামশাই, আপনি বরং আহ্নিক সেরে নিন।”
একথা শুনে ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে কুঁড়োরাম বলেন, “আহ্নিক কি আমাকে মনে করাতে হবে নাকি? সে হবেখ’ন। আগে ছাগলগুলোর একটা বিলিব্যবস্থা করো দিকি।”
“একটু আগেই তো আপনি ছাগলের নামে নালিশ করছিলেন, এখনই আবার তাদের জন্য উতলা হয়ে পড়ছেন যে বড়!”
“আহা, তুমি বুঝতে পারছ না, তারা আমাকে জ্বালাতন করে বটে, কিন্তু সঙ্গও তো দেয়! আমার খবরাখবর আর কে নেয় বলো! তোমার গর্ভধারিণী সংসার নিয়ে উদয়াস্ত ব্যস্ত, তোমরাও তো নিজের-নিজের কাজকর্ম নিয়ে ছোটাছুটি করছ, নাতি-নাতনিরা লেখাপড়া করে আর সময় পায় না, আর আমি বুড়ো মানুষটা একলাটি পড়ে থাকি। আমার কি আর যত্নআত্তি কিছু হচ্ছে! আমার কাছটিতে তো কেউ নেই যার সঙ্গে একটু সুখদুঃখের কথা কইতে পারি।”
কামাখ্যা একটু বিস্মিত হয়ে বলে, “বলেন কী বাবামশাই, আমরা কি প্রাতঃকালে এসে আপনাকে প্রণাম করে যাই না? আপনার সকালের জলখাবার থেকে রাতের খইদুধ কি আমার মা যত্ন করে আপনাকে খাইয়ে দিয়ে যান না? আপনি কখন কেমন আছেন বা থাকেন তার খোঁজ কি ঘণ্টায়-ঘণ্টায় বাড়ির সবাই নেয় না? আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে যে, কেবল আপনার খিদমত খাটার জন্যও একজন লোক দিনরাত বহাল আছে, কিন্তু আপনি তাকে কাছেই ঘেঁষতে দেন না, কারণ আপনার সন্দেহ যে, সে আপনার গোপন তবিলের সন্ধান পেয়ে যাবে।”
“আহ! তুমি তো বড্ড বাচাল দেখছি হে! হচ্ছিল ছাগল নিয়ে একটা গুরুতর কথা, তার মাঝখানে গুচ্ছের আজেবাজে কথা এনে ফেললে!”
কামাখ্যা তটস্থ হয়ে বলে, “বাবামশাই, আমি ভেবেছিলাম ছাগল নিয়ে বোধ হয় আপনার সব কথা শেষ হয়ে গিয়েছে।”
কুঁড়োরাম ভ্রূ কুঁচকে ছেলের দিকে খানিক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “আচ্ছা, তুমি ছাগলগুলোকে দেখতে পাচ্ছ না কেন বলো তো? তুমি পাচ্ছ না, তোমার দাদা-বউদিরা পাচ্ছে না, তোমাদের গর্ভধারিণী পাচ্ছেন না, কাজের লোকেরা পাচ্ছে না, তোমাদের হলটা কী?”
কামাখ্যা খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলে, “এর একটা সহজ জবাব আছে বটে, তবে সেটা শুনলে আপনি খুশি হবেন না।”
“ইঃ! যেন আমাকে খুশি করার জন্য তোমাদের ঘুম হচ্ছে না!”
“যদি রাগ না করেন তো বলি, আপনি যে ছাগলদের দেখতে পান সেগুলোকে ইংরিজিতে বলে ভারচুয়াল ছাগল, আসল ছাগল নয়।”
“তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে বল তো?”
কামাখ্যা মাথা চুলকে বলে, “কী যে বলি! তবে মায়াছাগল বললে কেমন হয় তাই ভাবছি।”
কুঁড়োরাম একটু ঝেঁকে উঠলেন, তারপর বেশ প্রসন্ন গলাতেই বললেন, “তুমি কি বলতে চাও যে, আমি দিব্যদৃষ্টি পেয়েছি! তোমরা যা দেখতে পাও না, তা আমি পাই!”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
কুঁড়োরাম একথায় খুশিই হলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কথাটা মন্দ বলোনি। আর না হবেই বা কেন বলো! বহুকাল ধরে পুজোপাঠ, আহ্নিক, সাত্ত্বিক আচরণ, তার তো একটা ফলও আছে! কী বলো?”
“আজ্ঞে সে তো হতেই পারে!”
কুঁড়োরাম চারদিকে টালুমালু করে চেয়ে দেখে নিচ্ছিলেন, একটু লাজুক হাসি হেসে বললেন, “দিব্যদৃষ্টি জিনিসটা মন্দ নয়, বুঝলে! আমারও ক’দিন ধরে কেমন যেন মনে হচ্ছিল, আমি যেন সব অন্য রকম দেখতে পাচ্ছি।”
“তা হলে কি একবার চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন?”
“বলো কী? দিব্যদৃষ্টিতে তো আমি দিব্যি সব দেখতে পাচ্ছি। চশমারও প্রয়োজন হচ্ছে না। ওই যে, পুব দিকের দেয়ালে একটা টিকটিকি খণ্ড ত-এর মতো ঝুলে আছে, দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, তারপর ধরো, ওই যে বাংলা ক্যালেন্ডারে আজ সাতুই ভাদ্র, দিব্যি ঠাহর হচ্ছে, তারপর ধরো না কেন টুলের উপরে কাচের গেলাসে আমার দু’পাটি দাঁত জলে ভেজানো আছে, দেখতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না। এর পরও কি চোখের ডাক্তার দেখাতে চাও?”
“আজ্ঞে না। চোখ আপনার ঠিকই আছে। তবে আমার যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে, তা হলে আমার যেন মনে হচ্ছে আপনি এখন চশমা পরেই আছেন।”
“নাকি?”
“যে আজ্ঞে, চশমা বলেই তো মনে হচ্ছে।”
কুঁড়োরাম চোখ থেকে চশমাটা খুলে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “এটার আর কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, বুঝলে! হরিহর মুহুরির চোখের ব্যামো হয়েছে, পয়সার অভাবে চিকিচ্ছে করাতে পারছে না। সেদিন আমার কাছে পুরনো চশমা আছে কি না খোঁজ করছিল। ভাবছি ওকেই এটা দিয়ে দেব। কী বলো?”
কামাখ্যা ভারী উদার গলায় বলে, “তা দেবেন। তবে কিনা আপনার দিব্যদৃষ্টির চশমা পরে আবার হরিহর মুহুরির দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলে কী হবে, সেটাও একটু ভেবে দেখা দরকার। দ্রব্যগুণ বলেও তো একটা কথা আছে কিনা।”
কুঁড়োরাম একথায় একটু ভাবিত হয়ে পড়লেন। অন্যমনস্কভাবে বললেন, “সেটাও একটা কথা। তা হলে বরং থাক।”
“যে আজ্ঞে।”
কামাখ্যা চলে যাওয়ার পর কুঁড়োরাম বেশ একটু ডগোমগো ভাব নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। বারকয়েক আপনমনে উচ্চারণ করলেন, “মায়াছাগল, মায়াছাগল!”
প্রাতঃকৃত্য সেরে যখন আহ্নিকে বসেছেন তখন হঠাৎ রোমাঞ্চিত কলেবরে টের পেলেন, গুটগুট করে তাঁর ছাগলেরা ফিরে আসছে। আহ্নিক শেষ করার পর দেখলেন, তাঁকে ঘিরে আঠেরোটা ছাগল বসে মায়াভরে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আহ্লাদে চোখে প্রায় জল এসে গেল তাঁর। একটা-দুটো তো নয়, মোট আঠেরোটা ছাগল! যাদের পাপচক্ষু, যাদের দিব্যদৃষ্টি নেই, তারা দেখতে পায় না।
খানিকটা অভিভূত ভাব নিয়ে কুঁড়োরাম ছাগলদের মাঝখানটিতে বসে রইলেন। মায়াছাগল আর দিব্যদৃষ্টি, এদুটি কথা তাঁর মাথার ভিতর যেন ঝুমঝুমি বাজাতে লেগেছে আজ। বড় আনন্দ হচ্ছে।
“বলি ও বুড়োকর্তা, ছাগলগুলো মাথাপিছু কত করে পড়ল বলুন তো! দিব্যি নধর ছাগল মশাই আপনার!”
কুঁড়োরাম তাঁর অভিভূত ভাবটা থেকে ভেসে উঠতে বেশ একটু সময় নিলেন। অনেকটা গভীর জলে ডুবে ছিলেন তো! কোন বেয়াদব হেঁড়ে গলায় রসভঙ্গ ঘটাল, তা রোষকষায়িত নয়নে খুঁজে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, পুবের জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে একটা খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা, গ্যালগ্যালে বোকা হাসিতে ভরা, জুলজুলে চোখের গোলগাল মুখ উঁকি দিয়ে আছে। পিত্তি জ্বলে গেল কুঁড়োরামের। এত বড় বুকের পাটা যে, ছাগলের দাম জিজ্ঞেস করছে!
কুঁড়োরাম ফুঁসে উঠে বললেন, “কে রে আহাম্মক! এ কি এলেবেলে ছাগল পেয়েছিস যে দাম জিজ্ঞেস করছিস?”
লোকটা চোখ বড় বড় করে বলে, “তা বুড়োকর্তা কি ছাগলগুলো বিলেত থেকে আমদানি করলেন নাকি! কিন্তু আমি হলুম গে তিন পুরুষের ছাগলের কারবারি গন্ধেশ্বর, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি সোজা কথা কর্তা? ছাগল আমি খুব চিনি। এ তো নিকষ্যি দিশি ছাগল!”
কুঁড়োরাম খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। তাই তো, আর কেউ তাঁর ছাগলদের দেখতে না পেলেও এই লোকটা পাচ্ছে কী করে? তিনি এবার গলাটা কয়েক পরদা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বাপু হে, তুমি কি আমার ছাগলদের দেখতে পাচ্ছ?”
“তা পাব না কেন কর্তা? ছাগলের গায়ের বোটকা গন্ধ পেয়েই তো জানালায় উঁকি দিলুম।”
কুঁড়োরাম এবার বুদ্ধি খাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“তা হলে বলো তো, এখানে ক’টা ছাগল আছে?”
“সে আর বলা শক্ত কী! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো ছাগলই গুনছিলাম কিনা! তা কর্তা, আপনার মোট আঠেরোটা ছাগল দেখতে পাচ্ছি। একটা কমও নয়, একটা বেশিও নয়।”
কুঁড়োরাম তাজ্জব! এ লোকটারও কি দিব্যদৃষ্টি গজিয়েছে নাকি? জনে-জনে দিব্যদৃষ্টি গজালে দিব্যদৃষ্টির মহিমা কি থাকবে?
কুঁড়োরাম খুবই চিন্তিত হয়ে বললেন, “বাপু হে, এ ছাগল দেখতে পাওয়ার কথাই তো তোমার নয়! এ যে মায়াছাগল! তুমি দেখতে পাচ্ছ কী করে?”
“বুড়োকর্তা, ছাগলের কারবারে চুল পাকিয়ে ফেললুম, এখন মায়াছাগল বলে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তো লাভ হবে না।”
কুঁড়োরাম হাঁ। মাথাটা ভারী গোলমেলে লাগছে। তা হলে এগুলো কি মায়াছাগল নয়? নিতান্তই ছাগল! তাই যদি হবে, তা হলে তাঁর বাড়ির লোকেরা দেখতে পাচ্ছে না কেন? এ তো বড় ধন্দেই পড়া গেল!
লোকটা ভারী আদুরে গলায় বলে, “বলি ও কর্তা, অত ভাবনার কী আছে? মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা করে দিচ্ছি, ছাগলগুলো আমাকে দিয়ে দেন।”
কুঁড়োরাম ভ্রূ কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বলেন, “রোসো বাপু, ছাগল নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আগে সাব্যস্ত হওয়া দরকার যে, এগুলো আদপে ছাগল না অন্য কিছু।”
“বলেন কী বুড়োকর্তা! ছাগল চিনতে কি আর এম এ পাশ করতে হয়! আমি তো ছাগল ঘেঁটেই জীবন পার করে দিলাম।”
কুঁড়োরাম লোকটার দিকে জুলজুল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “তা হলে তুমি বলছ যে, এগুলো নিতান্তই ছাগল! ভাল করে দেখে বলছ তো বাপু?”
“তা নয়তো কী? আপনার কি ওগুলোকে বাঘ বা সিংহি বলে মনে হচ্ছে বুড়োকর্তা? পাঁচটা পাঁঠা, তেরোটা ছাগী, একেবারে সোজা হিসেব। তার মধ্যে দুটো ছাগী গাভীন।”
ছাগল সম্পর্কে লোকটার জ্ঞান দেখে কুঁড়োরাম মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এত জানে! তিনি তো এতদিন ছাগলের সঙ্গে ঘর করেও এত কিছু জানতে পারেননি! তিনি ভারী আহ্লাদের সঙ্গে বললেন, “বাপু গন্ধেশ্বর, তুমি বরং ঘরে এসে একটু বসে যাও। তোমার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।”
গন্ধেশ্বর এক গাল হেসে বলে, “যে আজ্ঞে। সে আর বেশি কথা কী? তবে কিনা ছাগলের বাইরে আমি কিন্তু কিছু জানি না।”
“আহা, ছাগল সম্পর্কে জানা হয়ে গেলে আর জানার বাকি থাকে কী?”
“আজ্ঞে সেটা অবশ্য ঠিক কথা।”
গন্ধেশ্বর জানালা থেকে অদৃশ্য হয়ে ফের দরজা দিয়ে উদয় হল। লোকটা বেঁটেখাটো, বেশ জোয়ান চেহারা, মুখে একটা বোকা-বোকা হাসি আছে বটে, কিন্তু চোখ দু’খানা ভারী ধূর্ত বলেই যেন এক ঝলকে মনে হল কুঁড়োরামের। তবে এসব ছোটখাটো ব্যাপার ধর্তব্যের মধ্যেই ধরলেন না তিনি। ছাগল সম্পর্কে যার এত জ্ঞান সে যে উঁচু থাকের লোক, তাতে সন্দেহ কী! জ্ঞানী মানুষ।
কুঁড়োরাম গলাটা এক পরদা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বাপু গন্ধেশ্বর, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দাও তো! তুমি দেখতে পাচ্ছ, আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু এই ছাগলদের আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না কেন? আমার কাছে কবুল করো তো, তুমিও কি দিব্যদৃষ্টি পেয়েছ?”
গন্ধেশ্বর সরাসরি কথাটার জবাব না দিয়ে হঠাৎ দু’হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে বলল, “বুড়োকর্তা, কাজটা কি আপনি ভাল করলেন?”
কুঁড়োরাম অবাক হয়ে বললেন, “কোন কাজটার কথা বলছ হে!”
“এই যে চেনা নেই, জানা নেই, একটা উটকো অচেনা লোককে ঘরে ঢুকিয়ে ফেললেন, এটা কি ঠিক হল মশাই? আমি যে সব দেখে ফেলছি। সব সুলুকসন্ধান পেয়ে যাচ্ছি! না কর্তা, আমি বরং বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা কয়ে চলে যাই।”
কুঁড়োরাম ভড়কে গিয়ে বলেন, “আহা কী দেখেছ সেটা বলবে তো!”
“কী আর বলব বলুন, আপনার সোনাদানা, আকবরি মোহর, নোটের গোছা কিছুই যে আর আমার কাছে গোপন থাকছে না! আমাকে বিশ্বাস কী বলুন! না, না, এ কাজটা আপনি মোটেই ভাল করলেন না।”
কুঁড়োরাম অবাক হয়ে বললেন, “সত্যিই কি তুমি ওসব দেখতে পাচ্ছ নাকি হে!”
“আজ্ঞে, ওটাই তো আমার রোগ। আমি যে সব দেখতে পেয়ে যাই। তা হলে আমি আসি আজ্ঞে। আপনার সঙ্গে কথা কয়ে বড় ভাল লাগল বুড়োকর্তা!” বলে চোখ ঢাকা অবস্থাতেই উঠে পড়তে যাচ্ছিল গন্ধেশ্বর।
কুঁড়োরাম “আহা, করো কী, করো কী!” বলে তাকে আবার মোড়ায় ঠেসে বসালেন। তারপর বললেন, “ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবে তো!”
গন্ধেশ্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “কী করে বোঝাব বলুন, আপনার যে মোটে বিশ্বাসই হবে না।”
“বলেই তো দেখো বাপু।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গন্ধেশ্বর বলে, “গত আশ্বিনের ঘটনা মশাই, চকবেড়ের হাট থেকে সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরছি। সঙ্গে কেউ নেই। বকডিহির ঝিলের কাছাকাছি আসতেই একটা শ্যামাপোকা কোত্থেকে বোঁ করে উড়ে এসে বাঁ চোখটায় ঢুকে গেল। সে কী যন্ত্রণা বাবা, প্রাণ যায়! চোখ পাউরুটির মতো ফুলে গেল, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। ভয় খেয়ে গেলাম, বাঁ চোখটা কানা হয়ে গেল নাকি! গরিব মানুষ, চিকিচ্চে করানোর মতো মামলোত নেই। কিন্তু দিনসাতেক বাদে, কী বলব মশাই, এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চোখ ফরসা হয়ে গিয়েছে। বেশ দেখতেও পাচ্ছি। কিন্তু একটু যেন কেমন-কেমন, যেন একটু বেশিই দেখে ফেলছি। ধরুন, পরেশবাবু চটের থলিতে কইমাছ নিয়ে যাচ্ছেন, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, যোগেশবাবুর পকেটে একান্ন টাকা আছে, দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, কদমবাবুর জামার নীচে ছেঁড়া গেঞ্জি… দেখতে কোনও অসুবিধেই হল না আমার। তখনই ভয় পেয়ে গেলুম, এই রে এত দেখে ফেললে তো মনে লোভ জেগে উঠবে, তার জেরে হয়তো পাপই করে ফেলব!”
কুঁড়োরাম হামলে পড়ে বললেন, “তারপর কি দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল নাকি?”
গন্ধেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “না বুড়োকর্তা, দিব্যদৃষ্টি অনেক উপরের ব্যাপার। যদি ‘তৃতীয় নয়ন’ বলি, তা হলেও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। দরকারের সময়ে জুতসই শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না মশাই! তবে কাজ চালানোর জন্য ‘তিন নম্বর চোখ’ বলা যায় কি?”
“খুব বলা যায়।”
“তা সেই থেকে আমি বড় একটা কারও ঘরেদোরে ঢুকি না। কোথায় কী দেখে ফেলব কে জানে মশাই! ঢুকতে হলে বাঁ চোখটা চেপে রেখে ঢুকি। এই বাঁ চোখটাই গোলমেলে কিনা।”
“বটে!” কুঁড়োরামের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, “তুমি তো সোজা পাত্তর নও গন্ধেশ্বর!”
গন্ধেশ্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “না মশাই, আমি যে ছাগলের কারবারি সে ছাগলের কারবারিই রয়ে গিয়েছি। তিন নম্বর চোখ হয়েও আমার কিছু সুবিধে হয়নি।”
“বলো কী! কিছু হয়নি বললেই হল! ওই যে আমার ঠাকুরের সিংহাসনের নীচে শ্বেত পাথরের বেদিটা রয়েছে, ওর উপরের পাথরটা আলগা, ওটা সরালেই নীচে আমার তবিল, এ খবর কাকপক্ষীতেও জানে না, কিন্তু তুমি জানলে কী করে?”
গন্ধেশ্বর তাড়াতাড়ি কানে হাত চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, “আর ক’বেন না কর্তা, বাইরের লোককে এত বিশ্বাস করা আপনার একদম উচিত হচ্ছে না।”
“আহা, তুমি বাইরের লোক হতে যাবে কেন? তুমি তো এক রকম ঘরের লোকই হয়ে গিয়েছ। আমার গোপন তবিলের খবর যখন তুমি রাখো, তখন আর তোমাকে পর ভাবি কী করে?”
“হ্যাঁ, সেটা একটা ভাববার মতো কথা বটে!” বলে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাঁক থেকে পাঁচটা টাকা বের করে বলল, “বুড়োকর্তা, এই আগামটা রাখুন। বাকি ঊননব্বই হাজার নশো পঁচানব্বই টাকা নগদ ফেলে দিয়ে দু’-চারদিন পরে এসে ছাগলগুলো নিয়ে যাব’খন।”
কুঁড়োরাম মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “আরে না, না, তোমার ওসব আগাম-টাগাম লাগবে না।”
গন্ধেশ্বর টাকাটা ফের ট্যাঁকে গুঁজে উঠে পড়ল, “তা হলে আজ আসি কর্তা। নগদ টাকাটা নিয়ে ফের এলুম বলে।”
কুঁড়োরাম গদগদ গলায় বললেন, “এসো বাপু, তুমি বড্ড গুণী মানুষ।”
গন্ধেশ্বর বিদেয় হলে কুঁড়োরাম তাঁর ছাগলদের দিকে চেয়ে ধরা গলায় বললেন, “তোদের ভাগ্য বড় ভাল রে! এমন একজন সমঝদার লোকের হাতে যাচ্ছিস।”
লোকটা কতখানি সমঝদার, তা অবশ্য পরদিন সকালেই বোঝা গেল। প্রাতঃকালে সবে ঘুম থেকে উঠে ইষ্টনাম নিতে যাবেন এমন সময়ে ঠাকুরের আসনের দিকে চেয়ে কুঁড়োরাম হাঁ। কাঠের সিংহাসনটা বেদি থেকে নামানো, শ্বেতপাথরের ঢাকনাও সরানো। কুঁড়োরাম হাঁক মারলেন, “কাশীম, কাশীম, কোথায় গেলি রে!”
মেজছেলে শীতলারাম এসে দরজায় দাঁড়াল, “বাবামশাই কি কিছু বলছিলেন?”
কুঁড়োরাম তেতো গলায় বললেন, “এ বাড়িটা কি একটা খোলা হাট হয়ে গিয়েছে? কে এসেছিল বলো তো আমার ঘরে? ওই দ্যাখো আমার ঠাকুরের আসন ওলটপালট করে গিয়েছে।”
শীতলারাম ঘরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে বলে, “এ তো মনে হচ্ছ চোরের কাজ।”
কুঁড়োরাম অবাক হয়ে বলেন, “চোর! বলো কী! দ্যাখো তো ওই বেদির ফোকরটায় হাত ঢুকিয়ে দ্যাখো, কিছু আছে কি না!”
শীতলা গিয়ে ফোকরটায় হাত ঢুকিয়ে একটা পাঁচ টাকার কয়েন তুলে এনে বলল, “এটা ছিল।”
“আর কিছু নেই?”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে আমার তবিল?”
শীতলা কিছুটা অবাক হয়েই বলে, “আপনার তবিল কি এখানে ছিল?”
“তা নয় তো কী! পাঁচ-সাত লাখ টাকার সোনা, নগদও ধরো লাখতিনেক। আকবরি মোহরও বেশ কয়েকটা।”
“বলেন কী?”
“তোমাদের কি কোনও দিকে হুঁশ আছে! সবাই তো ভোঁসভোঁস করে ঘুমোও! এত বড় একটা চুরি হয়ে গেল, কেউ কিছু টের পেলে না!”
শীতলা কামাখ্যার মতো বিনয়ী নয়। সে বেশ কড়া গলায় বলল, “কাল সকালের দিকে আপনার ঘরে নাকি একজন সন্দেহজনক লোক এসেছিল আর আপনি নাকি তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাও বলেছেন?”
“আহা সে তো গন্ধেশ্বর। তার কথা উঠছে কেন?”
“গন্ধেশ্বরটা আবার কে? আপনি তাকে চেনেন?”
“চিনব না কেন, খুব চিনি। সে একজন ছাগলের কারবারি। তবে মানুষটার অনেক গুণ, বুঝলে!”
ভ্রূ কুঁচকে শীতলা বলে, “ছাগলের কারবারি! তো তার সঙ্গে আপনার দহরম-মহরম কীসের?”
“সে তোমরা বুঝবে না। তার তৃতীয় নয়ন ফুটেছে সম্প্রতি। সেই নিয়েই কথা হচ্ছিল।”
“তৃতীয় নয়ন মানে! তিন নম্বর চোখ?”
“হ্যাঁ হে! আর তৃতীয় নয়নে সে অনেক কিছু দেখতে পায়। এই যেমন আমার ছাগলগুলোকে তোমরা দেখতে পাও না, সে কিন্তু দিব্যি দেখতে পেল, তারপর ঘরে ঢুকেই তো বলে দিল আমার কোথায় কী লুকোনো আছে।”
“তা হলে চোরকে আর গোরুখোঁজা করতে হবে না। আপনার গন্ধেশ্বরই চোর।”
ভারী অবাক হয়ে কুঁড়োরাম বললেন, “বলো কী হে! সে তো দু’-একদিনের মধ্যেই আমাকে ছাগলের জন্য টাকা দিতে আসবে।”
শীতলা বেশ ধমকের গলায় বলে, “তার মানে? আপনি কি তাকে ছাগলও বেচতে চান নাকি? কিন্তু আপনি ছাগল পাবেন কোথায়?”
“আহা, আমার মায়াছাগলদের কথাই হচ্ছে।”
“মায়াছাগলও বেচা যায় নাকি? তা হলে আপনার গন্ধেশ্বর বোধহয় সেগুলো মায়াটাকায় কিনবে।”
কুঁড়োরাম বুঝতে পারছিলেন তাঁর কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। জুলজুল করে শীতলার রাগী মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, “তোমাদের মুশকিল কী জানো! তোমরা অল্পবয়সেই বড্ড বেশি বুঝে ফেলো।”
“এখন থেকে আপনি একটু কম বোঝার চেষ্টা করলে ভাল হয়।”