৫. একেনবাবু এলেন

৫.

একেনবাবু এলেন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে এয়ার ইন্ডিয়ার সকালের ফ্লাইটে। ভাগ্যক্রমে সকালে ক্লাস ছিল না। এয়ারপোর্টে গেলাম ওঁকে আনতে। আজকাল এয়ারপোর্টের ভিতরে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করা যায় না। হয় পয়সা দিয়ে পার্কিং-এ রাখতে হয়, নয় বাইরে যাত্রী বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত এয়ারপোর্টে চক্কর দিতে হয়। কতক্ষণ লাগবে বেরোতে–ইমিগ্রেশন, ব্যাগ চেক-আউট, কাস্টমস, ইত্যাদিতে করে, জানার কোনও উপায় নেই। তাই সেই ঝামেলায় না গিয়ে গাড়ি পার্ক করে টার্মিনাল বিল্ডিং-এর ভিতরেই অপেক্ষা করছিলাম। কাস্টমস ক্লিয়ার করে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে একেনবাবু উৎফুল্ল।

“ভাগ্যিস এলেন স্যার, টেনশনে ছিলাম আপনি আসতে পারবেন কি না।”

“না এলে আর কী হত, শাটল বাস ধরে সোজা চলে যেতেন গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালে। সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে অ্যাপার্টমেন্টে।”

“তা যাওয়া যেত ঠিকই স্যার, কিন্তু গল্পটা তো হত না।”

“হত, কিন্তু একটু পরে হত। তা আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে কলকাতায়?”

“চলছে ঠিকই স্যার, কিন্তু আপনারা না থাকলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগো!”

“আপনাকেও তো আমরা মিস করি। বউদি কেমন আছেন?”

“উত্তরটা দেওয়া কঠিন স্যার।”

“এর উত্তর দেওয়া কঠিন? প্রমথ ঠিকই বলে, আপনি সামথিং!”

“না না স্যার, আসল ব্যাপারটা হল, ফ্যামিলির মনের খবর তো জানা অসম্ভব। তবে একটু চাপে আছি স্যার।”

“কেন?”

“এই যে স্যার ‘ন যযৌ, ন তৗে’। মানে এদিকেও নেই, ওদিকেও নেই..কথাটা ঠিক বললাম কি? আমার আবার সংস্কৃত গুলিয়ে যায়।”

“হাফ-এম্পটি না ভেবে হাফ-ফুল ভাবুন না. এদিকেও আছেন, ওদিকেও আছেন। আপনি তো মাল্টি-ন্যাশেনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি চালাচ্ছেন!”

“এটা মন্দ বলেননি স্যার। না, ওখানেও একটু আধটু হচ্ছে। এবার শ্রেয়াও প্রচুর হেল্প করেছে। আসলে স্যার মিসিং পার্সন খুঁজে পাওয়াটা একার কর্ম নয়।”

“তাহলে আর কি, এখানে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট, ওখানে আপনার বোন শ্রেয়া… দু’দিকেই।

তো পুলিশের হেল্প গ্যারান্টিড!”

“কী যে বলেন স্যার।”

“তা শ্রেয়ার খবর কি?”

“ভালো নয় স্যার, মেয়েটা চাকরি ছাড়তে চাইছে, আপনাদের লাইনে আসতে চায়।”

“হ্যাঁ, সেদিন আমাকেও বলেছিল বটে।”

“আসলে খুব স্ট্রেস-এর মধ্যে আছে স্যার। এই নার্ভের অসুখে মৃত্যু একটা পলিটিক্যাল অ্যাঙ্গেল নিয়েছে।”

“তারে মানে?”

“যে মারা গেছে, তার বাবা শুধু বড়োলোক নয়, এক পলিটিকাল চাঁইয়ের ফাইনান্সিয়ার ছিলেন। শুধু গত ইলেকশনে সেই বড়োলোক বাবা বিরোধী পক্ষেও টাকা ঢেলেছেন। যার ফলে এই মার্কারি পয়জনিং মার্ডারের অ্যাঙ্গেল নিয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুল বা গাফিলতি নয় স্যার, পরিকল্পিত ভাবে হত্যা!”

“আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড। খুন করার তো আরও অনেক সহজ উপায় আছে, তাই না?”

“ট্রু স্যার।”

“যদি না কেউ চায় খুব কষ্ট পেয়ে লোকটা মরুক।”

“এটাও ভালো পয়েন্ট স্যার, ব্যাপারটা খুবই কনফিউসিং।”

.

একেনবাবুর সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ গল্প চালানো যায় না। এর মধ্যেই মার্কিন মুলুক আর ইন্ডিয়ার ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে তুমুল এক প্রস্থ আলোচনা হয়ে গেল। একেনবাবুর ঘোরতর আপত্তি দেশে কেন ওঁর ইনকাম ট্যাক্স কাটছে, উনি তো আমেরিকাতেও ইনকাম ট্যাক্স দিচ্ছেন।

“এটা তো স্যার ডাবল ট্যাক্সেশন হচ্ছে!” আমাকে বললেন।

“ডাবল ট্যাক্সেশন কেন হবে? আপনি আমেরিকায় তো গ্লোবাল ইনকাম-এর ওপর ট্যাক্স দিচ্ছেন দেশের আয়, আমেরিকার আয়… সব কিছুর ওপরে। দেশে কিছু কেটে নিলে আপনি স্বচ্ছন্দে দেশে যে ট্যাক্স দিয়েছেন তা আমেরিকার ট্যাক্স থেকে বাদ দিতে পারেন।”

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান, তার মানে আপনি দেশে যে ইন্টারেস্ট পান, সেগুলো এখানে ট্যাক্সের কাগজ জমা দেবার সময়ে দেখান?”

“আপনি দেখান না? সেটাই তো আইন!”

“কী সর্বনাশ স্যার, আমি তো দেখাই না! ভাবি ওটা দেশের ব্যাপার। তাছাড়া এত অল্প ইন্টারেস্ট পাই ব্যাঙ্ক থেকে।”

“সেই অল্পটুকুই দেখাবেন। তাহলে আর দেশে ট্যাক্স দিচ্ছেন বলে হা-হুঁতাশ করতে হবে না।”

“এটাও ঠিক বলেছেন স্যার। এইজন্যেই দেশে আপনাদের আমি খুব মিস করি!”

একটু চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা “স্যার, আপনার এক ছাত্রী ছিল না, নাসরিন নামে?”

“হ্যাঁ। হঠাৎ তার প্রসঙ্গ কেন?”

“না খুব ভালো ছিলেন উনি। সব সময়ে হিজাব পরে থাকতেন। আপনার কাছে কী একটা পড়া দেখতে এসেছিলেন, নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় আপনার অনুমতি নিয়ে নামাজ পড়তে বসলেন।”

“আপনার মনে আছে সেটা? গল্পটা আমি অনেককেই করেছি।”

“হ্যাঁ, খুব ধার্মিক মেয়ে ছিলেন। আচ্ছা স্যার হিজাব আর নিকাব-এর মধ্যে তফাৎটা কি?”

“নিকাব হল নাক আর মুখ যে কাপর দিয়ে ঢাকা হয়… হিজাবের সঙ্গে মেয়েরা পরে… যারা আরও রক্ষণশীল মুসলিম।”

“তবে টপ-এ তো আছে স্যার বোরখা। চোখও ঢাকা একটা জাল দিয়ে।”

আমি জানি, এই হিজাব, নিকাব আর বোরখার কোনওটাই একেনবাবুর অজানা নয়। কিন্তু বক বক না করে উনি থাকতে পারেন না। প্রমথর সঙ্গে এগুলো করতে গেলেই ধমক খান। কী ভেবেছেন মশাই আপনি, আলতু ফালতু বকে সময় নষ্ট করছেন? আমাদের সময়ের দাম নেই?”

আমি সেটা পারি না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ হিজাব, নিকাব আর বোরখা নিয়ে গবেষণা করছেন কেন?”

“আসলে স্যার, এবার আধার কার্ডটা করালাম। আপনি করেছেন?”

“না।”

“করিয়ে নেবেন স্যার, অধিকন্তু না দোষায়।”

“কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন আধার কার্ড নিয়ে।”

“ও হ্যাঁ স্যার। যখন ছবি তুলতে গেলাম, মুখের ছবি তো নিলই। চোখের তারার ছবিও নিল। তখনই মনে হল স্যার বোরখা পরা মুসলিম মহিলাদের চোখের তারার ছবি তুলবে কী করে, নিকাব থাকলে মুখের ছবিই বা উঠবে কী করে?”

“ভারতে তো মুসলিম পপুলেশন কম নয়। নিশ্চয় এই সমস্যার একটা সুরাহা হয়েছে। বোরখা খুলে বা মুখের ঢাকাটা সরিয়েই নিশ্চয় ছবি তোলা হয়।”

“এক্সাক্টলি স্যার। তবে কিনা মহিলারা সেই ছবি তোলেন। সেটাই আমাকে বললেন যিনি ছবি তুলছিলেন। কী ঝামেলা বলুন তো স্যার?”

“আমার কিন্তু ছবি তোলার থেকে বেশি চিন্তা এঁদের আধার কার্ড দেখে কী করে বোঝা যাবে কার্ডধারীই আসল লোক কি না। সঙ্গে কোনও মহিলা না থাকলে তো পরীক্ষা করার কোনও উপায় নেই!”

“আঙুলের ছাপ থেকে করা যাবে স্যার। তবে হ্যাঁ, সেই যন্ত্রটা থাকতে হবে।”

“আর নেট কানেকশন থাকতে হবে, সেই সঙ্গে সার্ভারও চালু থাকতে হবে। অনেক সময়েই তো শুনেছি সার্ভার ডাউন থাকে।”

“এটা মন্দ বলেননি স্যার। আসার সময়ে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটিতে দেখলাম নিকাব আর বোরখা পরা মহিলাদের আলাদা করে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আইডেন্টিফাই করার জন্য। মুসলিম হবার কী ঝামেলা স্যার।”

“মুসলিম হবার ঝামেলা নয়, ঝামেলা হল ধর্মের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! দেশে হিন্দু মেয়েরাও তো ঘোমটায় মুখ ঢেকে রাখত, রাখত না? এখনও তো কেউ কেউ রাখে।” আমি বললাম।

“ঠিকই স্যার, এটা ভাবিনি। তবে শুনলাম ইউ-এ-ই-তে নাকি একটা যন্ত্র বসিয়েছে যেটা মুখের কাপড় ভেদ করে চোখের তারা বা আইরিস দেখতে পায় … অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং। বিজ্ঞান কিন্তু সমাজ ধর্ম সব কিছুর মুখোশ ভেদ করতে পারে। পারে কি না স্যার, বলুন?”

“নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে ‘না’ বলি কী করে! ভালো কথা, আজ হঠাৎ নিকাব আর বোরখা নিয়ে পড়লেন কেন?”

“আসলে স্যার প্লেনে আসতে আসতে একটা সিনেমা দেখছিলাম। জেল থেকে একটা আর্ট-চোর বোরখা পরে কী ভাবে পালাল… সেই নিয়ে গল্প।”

“বোরখা না পরেও তো লোকে পালাতে পারে!” আমি হেসে ফেললাম। “এটাও ঠিক বলেছেন স্যার।”

এই রকম বকর বকর করতে করতে যখন বাড়ি পৌঁছলাম তখন দেখি প্রমথ ফুল-কোর্স ব্রেকফাস্ট বানিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাওয়ার ডো ব্রেড, সসেজ, বেকন, অমলেট, কফি আর একটা বড় বোল-এ আঙুর, কলা আর মেলনের টুকরো।

ব্রেকফাস্টের আয়োজন দেখে একেনবাবু উত্তেজিত। “অনেক দিন বাদে স্যার সাওয়ার ডো ব্রেড, সসেজ আর বেকন! থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। সত্যি স্যার, প্রমথবাবু আছেন। বলেই এসব জোটে।”

“থাক আপনাকে আর তেল মারতে হবে না, বউদি এখানে নেই, আমাদের হাবিজাবি রান্নাই আপনাকে খেতে হবে।”

“কী যে বলেন স্যার, এগুলো হাবিজাবি?” বলতে বলতে একেনবাবু একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

আজকে কফিটাও দুর্ধর্ষ হয়েছে! সেটা বলতেই প্রমথ বলল, একটা নতুন অ্যারাবিকা কফি বিন ব্যবহার করলাম।”

“আচ্ছা স্যার এই অ্যারাবিকা কফিগুলো কি আরব দেশ থেকে আসে?”

“অ্যারাবিকা হল এক ধরণের কফি বীজ। যেরকম, রোবাস্টা। আপনাকে তো বলেছিলাম একদিন। বলিনি?”

“ও হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে। কী করে যে ভুলে গেলাম স্যার, কে জানে!”

“আপনার ভুলে যাবার কথায় আমার মনে পড়ল… একটু আগে শ্রেয়া ফোন করেছিল। আপনার সঙ্গে কী জানি আলোচনা করতে চায়। আপনাকে মোবাইলে ধরতে পারেনি, তাই ল্যান্ড লাইনে ধরার চেষ্টা করেছে।”

“তাই নাকি! একজন ইন্ডিয়াতে ক’টা বাজে স্যার?”

প্রমথ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “রাত দশটা।”

“ঠিক আছে স্যার, খেয়েই তাহলে ফোন করি।”

প্রসঙ্গত বলি, হোয়াট্সঅ্যাপ চালু হবার পর থেকে একেনবাবু এখন দেশে ফোন করতে এতটুকু ভাবনা চিন্তা করেন না। মনে আছে একটা স্মার্টফোন কিনতে বলায় প্রথম কী রকম হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, “এগুলো স্যার পয়সার শ্রাদ্ধ! এতে কি কথা বেশি শোনা যাবে?”

“তা যাবে না, কিন্তু এতে অনেক অ্যাপ্স থাকবে… নতুন নতুন অ্যাপ্স বাজারে আসবে, অনেক কনভেনিয়েন্ট। প্রমথ বুঝিয়েছিল।”

“না স্যার। ওই যে আমাকে ল্যাপটপ কিনিয়েছিলেন, ঠিক আছে, আর কোনও গ্যাজেট নয়।”

পরে যখন দেখলেন আমারা হোয়াট্সঅ্যাপ দিয়ে কলকাতায় ফোন করছি। তখন পুরোনো বস্তাপচা ফোনটা ফেলে একটা স্মার্টফোন কিনেছেন। একেনবউদিকেও কিনে দিয়েছেন। হিসেব কষে দেখেছেন এতে পয়সার অনেক সাশ্রয় হচ্ছে।

.

ফোন সেরে এসে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং ডেভালাপমেন্ট। যে কিশলয় মারা গেছে, তার নাম কিন্তু আগে অন্য ছিল। বছর পাঁচেক আগে দিল্লীতে ওটা পালটানো হয়েছে।”

“নাম পালটানো হয়েছে? কারণ?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“কারণ হল কুষ্ঠীগত।”

“কী বলছেন মশাই যা-তা!”

“ঠিকই বলছি স্যার। ইন্ডিয়াতে নাম পালটানো খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। প্রথমে স্ট্যাম্প পেপারে পুরোনো নাম আর নতুন নাম লিখে বাড়ির ঠিকানা দিতে হয়। সেখানে একটা কারণ দিতে লাগে কেন নামটা পালটাতে চাওয়া হচ্ছে। কিশলয়ের ক্ষেত্রে কারণটা দেওয়া হয়েছিল কুষ্ঠীগত… কুষ্ঠী অনুসারে নামটা ‘ক’ দিয়ে শুরু হতে হবে।”

“এটাও একটা যুক্তি? তারপর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“এই এফিডেবিটটা দু’জনকে দিয়ে সই করিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল দুটো পত্রিকায় একটা ইংরেজি, আরেকটা হিন্দি। তাতে ছিল, আমি অমুক, এই ঠিকানায় বাস করি, নিজের নাম বদলে অমুক তারিখ থেকে এই নতুন নামে পরিচিত হতে চাই। ব্যাস।”

“এতেই হয়ে যায়? আমার তো ধারণা ছিল একটা ফর্ম আর কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয় সরকারি অফিসে?”

“ঠিকই বলেছেন স্যার, নাম-পরিবর্তনের একটা গেজেট আছে। অফিশিয়ালি সেখানে একটা ফর্ম ফিল-আপ করে নিজের ছবি দিয়ে পত্রিকার বিজ্ঞাপন জমা দিলেই কাজটা হয়ে যায়… আরও দুয়েকটা ছোটোখাটো জিনিস লাগতে পারে। গেজেট-এ নাম উঠলেই আইনত নতুন নাম হয়ে গেল।

“আগে নামটা কী ছিল?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“সংগ্রাম দত্ত।”

“এত বছর বাদে সংগ্রাম দত্তের এইভাবে নাম পালটানোর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়। ডালমে কুছ কালা হয়।”

“ঠিক স্যার, সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই শ্রেয়া দেখছে। নামটা আমার অপরিচিত নয় স্যার, ওর বিরুদ্ধে একাধিক জেনারেল ডায়রি ছিল। একটা এফআইআরও ছিল। নাইট ক্লাবে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ায় একবার অ্যারেস্টেডও হয়েছিল। আমাদের দেশে বড়লোকদের পুত্র স্যার, অবাক হবার কিছু নেই।”

“কিন্তু নাম পালটে লাভটা কী হল, লোকটা তো বদলাল না, ক্রিমিমাল রেকর্ড থাকলে নাম পালটে তো সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।”

“তা যাবে না স্যার, কিন্তু শ্রেয়ার মতো গভীর ভাবে ক’জন তলিয়ে দেখে। বেশির ভাগ পুলিশই কিশলয়ের নামে কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড না পেলে আগের নাম নিয়ে মাথা ঘামাবে না।”

“মাথা ঘামিয়ে লাভই বা কি, এখন তো ওকে শাস্তিও দেওয়া যাবে না, ও এখন যেখানে সেখানে দেশের আইন খাটবে না।” প্রমথ বলল।

“এটা ভালো বলেছেন স্যার।”

“খারাপটা আমি কখন বলি? ভালো কথা, এদেশে তো নাম পালটাতে গেলে শপথ করে বলতে হয় আমার নামে কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। দেশে হয় না?”

“মিথ্যে বলা তো খুব সহজ স্যার আমাদের দেশে… বললেই হয়… কম তো দেখিনি জীবনে।”

“আপনার গলায় একটা হতাশার সুর শুনছি।”

“তা নয় স্যার, শ্রেয়াকে আমি ছোট্ট থেকে দেখেছি, খুব আদর্শবাদী মেয়ে। ঠিক কাজ করতে গিয়ে ও যদি ধাক্কা খায়… যা খাবেই আমি জানি… খুব খারাপ লাগবে স্যার।”

“আপনি গাইড করবেন এখান থেকে।”

“আমি স্যার? দশ হাজার মাইল দূর থেকে?”

“দশ হাজার নয়, আট হাজার মাইল।” প্রমথ শুদ্ধ করে দিল।

“ওই হল স্যার।”

“আপনার তো অনেক চেনাজানা গুণমুগ্ধ ভক্ত আছে, তাঁরা গাইড করবেন।”

“তা করবে। আসলে স্যার, খুব আদর্শবাদী হলে আমাদের দেশে এসব লাইনে চাকরি করা কঠিন। আমার আন্ডারে কাজ করত বিবেক বলে একটি ছেলে। পুলিশে ঢুকেছিল গীতার বাণী পালন করতে… মানে, দুষ্টলোকদের বিনাশ করে ধর্ম সংস্থাপন করবে বলে। আমরা বুঝিয়েছিলাম অতবড় আদর্শ নিয়ে টিকতে পারবে না। মাঝে মধ্যে এক আধটা চোর-বদমায়শকে ধরতে পারলেই যথেষ্ট। কে তাকে বোঝায়! নিত্য নূতন আইডিয়া নিয়ে আসত, যা ওর কাজের মধ্যেও পড়ে না।”

“যেমন?”

“একটা আইডিয়ার কথা বলি। এই তো কিছুদিন আগের কথা। ট্র্যাফিক লাইট কলকাতায় হঠাৎ করে লাল হয়ে যায়। ফলে অনেকেই গাড়ি ঠিক জায়গায় থামাতে পারে না, লাইন ক্রস করে যায়, এমন কি এক আধ সময়ে রেডলাইটও জাম্প করে। বিবেক ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টকে বলল, লালবাতি জ্বালানোর আগে কিছুক্ষণ হলুদবাতি জ্বালানো হোক। তাহলে ড্রাইভাররা সাবধান হবার সুযোগ পাবে।”

“এটাতে আমি সহমত। আমি তো ভেবেই পাই না, কেন লালবাতির টাইমার দেওয়া হয় কতক্ষণ পরে নীল হবে জানানোর জন্যে। অথচ উলটোটা হলেই তো ভালো হত।”

“ঠিক স্যার, কিন্তু বিবেকের প্রস্তাব কেউ কানে তুলল না।”

“কেন বলুন তো… এতে পুলিশের ফাইন করার সুযোগ কমবে বলে, না ফাইনের বদলে ঘুষ কালেকশন কম হবে বলে?”

“কে জানে স্যার?”

একেনবাবুর কথা বলার ধরণে মনে হল, উত্তরটা জানা থাকলেও দিচ্ছেন না।

“আরও একটা আইডিয়ার কথা বলি। বিবেক থানার ভিতরে সিসিটিভি রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। থানায় এনে লোকেদের হেনস্থা করা হচ্ছে কিনা, সেটা কর্তৃপক্ষ দেখতে পারবেন। অবশ্যই ওর প্রস্তাবে কেউ কান দিল না। এদিকে ও এক সাংবাদিক বন্ধুকেও এটা জানিয়েছিল। ফলে সে নিয়ে পত্রিকায় অনেক জলঘোলা হল।”

“বিবেকবাবু এখন কোথায়?”

“জানি না স্যার। যেটা বলতে চাচ্ছি, শুধু আদর্শ মেনে চললে তো হয় না।”

“তার মানে আপনি বলতে চান, পুলিশে যারা আছে, তারা সবাই আদর্শে জলাঞ্জলি দিয়ে কাজ করছে… তাই তো?” প্রমথ এবার চেপে ধরল। “আপনি নিজে তো মশাই বহু বছর পুলিশে চাকরি করেছেন!”

“তা করেছি স্যার, কিন্তু এখন তো করছি না।”

“তার মানে আগে নেতাদের তেল দিয়ে চলতেন, কিন্তু এখন আপনি সৎ এবং আদর্শবান!”

“কী যে বলেন স্যার, তাই কি বললাম? কলকাতা পুলিশেও অনেক সৎ অফিসার আছেন, নইলে চলবে কী করে!”

“তাহলে বোনের জন্য এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন?”

“প্রমথ বাবু না স্যার, সত্যি?” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন একেনবাবু।

“প্রমথর কথা ছাড়ুন, আর কিছু জানলেন শ্রেয়ার কাছ থেকে?”

“আর কিছু নয় স্যার। এখন তো ওখানে মাঝ রাত্তির, কাল সকালে ফোন করলে হয়তো আরও কিছু জানতে পারব।”

.

৬.

দুপুরে একেনবাবু একটা লম্বা ঘুম দিলেন… জেটল্যাগের এফেক্ট। ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি উনি ওঠার তোড়জোর করছেন।

আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “ফার্স্ট ক্লাস ঘুম হয়েছে স্যার। খুব ফ্রেশ লাগছে। প্রমথবাবু কোথায়?”

“প্রমথও আসছে কিছুক্ষণের মধ্যে। ও খুব খুশি, ওর একটা পেপার কেমিক্যাল রিভিউ এ্যাকসেপ্ট করেছে।”

“তা হলে তো সেলিব্রেট করতে হয়।”

“হ্যাঁ আজকে ওকে আর ফ্রান্সিস্কাকে খেতে নিয়ে যাব।”

“বাড়িতেও তো সেলিব্রেট করা যায় স্যার।” বুঝলাম একেনবাবুর দুশ্চিন্তা হয়েছে টাকা খসবে বলে।

“দুশ্চিন্তা করবেন না, দ্য বিল ইজ অন মি।”

“না, না, সে কি স্যার!” একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন। “আমরা সবাই কন্ট্রিবিউট করব।”

এইসব কথার মধ্যেই প্রমথ ঘরে ঢুকল। আমি বললাম, “শোন, আজকে আমরা সবাই বাইরে খেতে যাব।”

“দূর, বাইরে কেন যাব? ফ্র্যান্সিস্কা চিকেন রোস্ট করে আনছে। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে দুয়েকটা ইন্ডিয়ান সাইড ডিশ করতে।”

“এটা তো খুবই ভালো প্ল্যান স্যার,” একেনবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন।

আমি বললাম, “আজ যাচ্ছিস না, ঠিক আছে। কিন্তু খাওয়াটা তোর পাওনা রইল। কেমিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্টে লেখা বেরোচ্ছে, সেলিব্রেট তো করতে হবে। একটা দিন ঠিক করে রাখ, তাদের দু’জনকে খাওয়াব।”

.

ফ্রান্সিস্কা এলে যা হয়। রাত্রের খাওয়া খুবই জোরদার হল। ফ্রান্সিস্কার চিকেন রোস্ট অর্ডিনারি রোস্ট নয়, মেপল গ্লেইজ দেওয়ায় তার স্বাদই আলাদা। সঙ্গে অলিভ অয়েল দিয়ে অ্যাসপারাগস আর ফুলকপি রোস্ট। এগুলোর সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য প্রমথর স্পেশালিটি– রোস্টেড কাজুবাদাম আর ধনেপাতা-কুচি সজ্জিত ভেজিটেবিল পোলাও… ঘি-তে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, পেঁয়াজ লালচে করে ভেজে টুকরো টুকরো নানান সবজি দিয়ে বাসমতি চালের ক্লাসিক। সেইসঙ্গে অবশ্যই রায়তা।

খেতে খেতে কলকাতার গল্প হল। কথায় কথায় শেয়ার প্রসঙ্গ এল। ফ্রান্সিস্কা ভীষণ উৎসাহিত ডিটেকটিভের বোন পুলিশ-অফিসার শুনে।

“আই মাস্ট মিট হার।”

“এখানে পাবে কোথায়?” প্রমথ বলল।

“কেন আমরা দেশে যাচ্ছি না?”

দেশ মানে নিশ্চয় কলকাতা। পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে, বিয়ের প্ল্যানিং বোধহয় ওদের শুরু হয়েছে।

“দেশে গেলেও ওর দেখা নাও পেতে পার, তদন্তের কাজে ও ভীষণ ব্যস্ত!” প্রমথ একটু লজ্জা পেয়ে রহস্য করল।

“কী যে বলেন স্যার, ম্যাডাম যাবেন আর শ্রেয়া দেখা করতে আসবে না?” তারপর হঠাৎ বললেন, “ও হ্যাঁ, স্যার, আসল একটা কথা তো আপনাদের বলা হয়নি। মিনামাতার পসিবিলিটি, মানে কন্টামিনেটেড ফিশ-এর ব্যাপারটাও শ্রেয়া উড়িয়ে দিচ্ছে না।”

ফ্রান্সিস্কা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। কিন্তু গল্পটা ওকে শুনতে হবে। সংক্ষেপে পুরোটাই বলার চেষ্টা করলাম। দুয়েকটা ভুল প্রমথ শুদ্ধ করল। তারপর একেনবাবুকে বলল, “এবার বলুন মশাই, যা বলছিলেন।”

একেনবাবু যা বললেন, তা হল– হাওড়ার দুটো ফ্যাক্টরি বিষাক্ত বর্জ গঙ্গার জলে ফেলছে বলে ধরা পড়েছে, কিন্তু সেগুলোতে মার্কারির পরিমাণ কতটা জানা যায়নি। জানা গেলেও যে খুব একটা লাভ হবে তা নয়, কলকাতার বাজারে নানান জায়গা থেকে মাছ আসে, এমন কি বাংলাদেশ থেকেও। তবে যেটা সবচেয়ে বড় খবর, সেটা হল কিশলয় ছাড়াও আরও এক যুবকের খোঁজ শ্রেয়া পেয়েছে, যে কিছুদিন আগে নার্ভের অসুখেই মারা গেছে, আর ওরা দুজনেই ডাঃ সিনহানিয়ার ডেন্টাল ক্লিনিকে যেত।

“দাঁড়ান দাঁড়ান, তার সঙ্গে মার্কারি পয়জনের সম্পর্ক কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

উত্তরটা প্রমথ দিল, “এক সময়ে ডেন্টাল ফিলিং-এ মার্কারি কম্পাউন্ড ব্যবহার করা হত। তবে এখন লোকে অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। দাঁতের কাজে মার্কারির ব্যবহার, হয় বললেই চলে। কলকাতার কথা অবশ্য জানি না।”

“ঠিক বলেছেন স্যার, শ্রেয়া খোঁজ নিয়ে জেনেছে ডাক্তার সিনহানিয়া দাঁতের ফিলিং-এ অ্যামালগাম, মানে মার্কারি কম্পাউন্ড ব্যবহার করছেন বহু বছর ধরে। তার জন্য যা যা সাবধানতা নিতে হয় সবই নেন। তাছাড়া ইদানীং উনি নাকি মার্কারির সঙ্গে ইন্ডিয়াম ব্যবহার করছেন, তাতে মার্কারি ভেপার বেরোনোর সমস্যা অনেক কমে যায়। এসব টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো আমি ঠিক জানি না।”

“আমি কিছুটা জানি।” প্রমথ বলল, “এ নিয়ে এদেশে ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনেক রিসার্চ করেছে। ঠিকঠাক সাবধানতা নিলে কোনও সমস্যাই নেই। অসাবধান হলে ডেন্টিস্ট নিজেও মার্কারি ভেপারে অসুস্থ হবে। প্রশ্ন হল, কোনও ডেন্টিস্ট কি কলকাতায় নার্ভের অসুখে মারা গেছে?”

“শ্রেয়া যদ্দুর জানে, না।”

“যখন মার্কারি নিয়ে এত সমস্যা ওটা ব্যবহার না করলেই তো হয়?” আমি বললাম।

“ইডিয়টের মতো কথা বলিস না। তাহলে তো জ্বর মাপার থার্মোমিটারও ফেলে দিতে হয়, সেখানেও তো মার্কারি থাকে? কাঁচ ক্র্যাক করলেই বেরিয়ে আসবে।”

“ঠিক, পদ্মপাতায় জলের মতো এদিক ওদিক গড়ায়, ওগুলো নিয়ে ছেলেবেলায় অনেক খেলেছি।”

“সেইজন্যেই তোর নার্ভটা উইক।”

“চুপ কর,” আমি ধমক লাগালাম প্রমথকে। “শ্রেয়া কি ডাঃ সিনহানাইয়ার কথাটা মেনে নিল, কোনও রকম ফ্যাক্ট-চেক না করে।”

“না, না, মানেনি স্যার। আর আপনি যা ভাবছেন, সেটা অবশ্যই সম্ভব হতে পারে।”

.

এর কয়েকদিন বাদে একেনবাবু যে সমাচার দিলেন তাতে আমার আক্কেল গুরুম!

“শ্রেয়া মনে হল আরও অনেকটা পথ এগিয়েছে। এই কিশলয় গ্রিন লিফ-এ চুল কাটত। আর অন্য যুবকটি, যার নাম শঙ্কর, সেও কাটত। অর্থাৎ দুটো মৃত্যুর আরও একটা কমন সোর্স পাওয়া গেছে।”

“কী সর্বনাশ, আমি আর প্রমথও তো গ্রিন লিফ-এ চুল কেটে এসেছি!” আমি বললাম। “ওখানে বিউটিশিয়ানদের হাতে গ্লাভস দেখে সেলুনের মালিককে প্রশ্ন করায় উত্তর দিয়েছিলেন, অনেক টক্সিক কম্পাইন্ড নিয়ে ওঁরা কাজ করেন, তাই সাবধানতা নেন। তার মধ্যে কি কোনও মার্কারি কম্পাউন্ড থাকতে পারে? শুনেই তো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কালকেই একবার ইউনিভার্সিটি হেলথ সেন্টারে যাব, খোঁজ করব মার্কারি পয়জনিং-এর কোনও অ্যান্টিডোট আছে কি না!”

প্রমথও মনে হল একটু চিন্তিত। সাধারণত আমি কিছু বললেই একটা বাঁকা মন্তব্য করে। বলল, “এটা মন্দ বলিসনি। দুয়েকটা অ্যান্টিডোট আছে বলে শুনেছি। কিন্তু একটা কথা একেনবাবু, শ্রেয়ার উচিত আগে যারা ওখানে কাজ করত, তাদের খুঁজে বার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তাদের নার্ভের কোনও অসুখ হয়েছে কি না! এবার গিয়ে তো অনেককেই নতুন দেখলাম, তাই একটু সন্দেহ হচ্ছে।

“আরে না স্যার, বহু লোকই তো ওখানে চুল কাটে। শ্রেয়া খোঁজ নিয়ে দেখেছে গ্রিন লিফ যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করে সেখানে মার্কারি কম্পাউন্ড কিছু নেই।”

“কিন্তু এই যোগাযোগ… মানে সিনহানাইয়ার ক্লিনিক আর গ্রিন লিফ… আপনার কি মনে হচ্ছে কাকতালিয়.. এর সঙ্গে নার্ভের অসুখের কোনও লিঙ্ক নেই?”

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। তবে ইন্টারনেট-এ মার্কারি কম্পাউন্ড খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়ল ডাইমিথাইল মার্কারি… জল রঙের তরল, মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু কী মারাত্বক জিনিস স্যার! দুয়েক ফোঁটা গায়ে লাগলে কয়েক মাসের মধ্যে স্নায়ুরোগ দেখা দেবে… কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোমা এবং নির্ধারিত মৃত্যু। ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

“বুঝলাম। কিন্তু আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, গ্রিন লিফ-এর কেউ এটা ব্যবহার করছে। ছেলেদের খুন করার জন্য। কিন্তু কেন?”

“সেটাই বার করতে হবে স্যার। নার্ভের অসুখে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের চেহারার মধ্যে কি কোনও মিল আছে? কিশলয় আর শঙ্করবাবুর চেহারায় কতটা সাদৃশ্য? ডেন্টাল ক্লিনিককে যদি ক্লিন চিট দেওয়া হয়, তাহলে গ্রিন লিফের কোনও বিউটিশিয়ান কি ওই রকম চেহারার কোনও লোককে এতটাই ঘৃণা করে যে চুল-কাটার সময় বা পেডিকিওর বা ফেশিয়াল করার সময়ে দু-এক ফোঁটা গায়ে দিচ্ছে? কিন্তু সে কাজটাও যদি কেউ করে, সেটা সহজ কাজ হবে না।”

“এটা কেন বলছেন?”

“এটা নিয়ে কাজ করা স্যার বেশ কঠিন। একজন প্রফেসর এটা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নার্ভের অসুখে মারা গেছেন। হাতে গ্লাভস ছিল, সেই গ্লাভস ভেদ করে ওটা শরীরে ঢুকে যায়। এটা যদি কেউ ব্যবহার করে, সে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।”

“অথবা যে খুনগুলো করেছে, সেও এই নার্ভের অসুখে মৃত কোনও যুবক। আনাড়ির মতো অন্যদের খুন করতে গিয়ে নিজেও প্রাণ হারিয়েছে।”

“সেটাও স্যার সম্ভব। শ্রেয়া এখন মৃত যুবকদের আত্মীয়স্বজন, চেনা পরিচিতদের খোঁজখবর করছে। তবে একটা জিনিস আমরা জানি না স্যার, সবাই মার্কারি পয়জনে মারা গেছে কিনা। শুধু জানি কিশলয়বাবুর শরীরে মার্কারি পাওয়া গেছে। সেখান থেকে সবাইকে মার্কারি পয়জনের ভিক্টিম ভাবাটা ভুল হবে স্যার। যাই হোক, গ্রিন লিফ-এ যারা কাজ করছে তাদেরও ইন্টারভিউ করা হচ্ছে। এটা যদি অ্যাকসিডেন্ট না হয়, তাহলে আমরা হয়তো ডেঞ্জারাস এক খুনির সঙ্গে ডিল করছি।”

“এটুকু বলতে পারি, ‘গ্রিন লিফ’-এর ধারে কাছে আমি যাচ্ছি না। এদেশে আসার আগে বাড়িতে এসে চুল কাটত নিতাই, কুড়ি না তিরিশ টাকা নিতো, তাকেই আবার পাকড়াব।”

“তাহলে নার্ভের অসুখে মরবি না, সম্ভবত এইচআইভি-র কবলে পড়বি।” প্রমথ খোঁচা দিল।

“ডোন্ট বি সিলি!” ফ্রান্সিস্কা ধমক দিল।

“ভালো কথা স্যার, আপনি বললেন গ্রিন লিফ-এর মালিককে গ্লাভস নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এঁকে চেনেন? কবে পরিচয় হল স্যার?”

“এই তো এইবার। একজন মুসলিম মহিলা।”

“আপনি শিওর স্যার?”

“হ্যাঁ, কেন এই প্রশ্ন করছেন বলুন তো?”

“কারণ, শ্রেয়া বলছিল গ্রিন লিফ-এর মালিকের নাম বুলবুল চৌধুরী।”

“হিজাব নিকাব পরা একজন মুসলিম মহিলা। চৌধুরী তো মুসলিম পদবীও হয়। তাই না?”

“তা হয় স্যার।”

.

৭.

এর পরের দু’দিন স্কুলের নানান কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সকালে গেছি রাত্রে ফিরেছি। নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত ছিল না। রাত্রে যখন ফিরেছি একেনবাবু তখন দরজা বন্ধ করে নিদ্রা দিচ্ছেন। প্রমথ গেছে ফ্রান্সিস্কার বাড়িতে। ইদানীং ওখানেই মাঝে মাঝে রাত কাটায়। আগে খ্যাপালে লজ্জা পেত। এখন কিছু বললেই বলে, “চুপ কর, শালা!”

যাই হোক, আজ শনিবার, স্কুল নেই। ফ্র্যান্সিস্কা ওর এক বন্ধুর বাড়িতে উইক এন্ড কাটাতে গেছে, তাই সাত সকালে প্রমথও এসে হাজির। একেনবাবুর গলা শুনছি ঘর থেকে…।

“দুটো গ্লাভস পেয়েছিস? খুব সাবধানে কোনও এক্সপার্টকে দিয়ে ওগুলো ডিস্পোজ কর।… হ্যাঁ, আমার সন্দেহ হয়েছিল নামাজ পড়ছে না শুনে।… তা তুই কি করবি?… কাটা কাটা কথাগুলো পুরো শুনতে পারছিলাম না।

একটু বাদেই একেনবাবু বেরোলেন ঘর থেকে।

“কী ব্যাপার?”

“ঘরের মধ্যে থাকব কী করে স্যার, আপনার কফির যা খুশবাই।”

“এতক্ষণ তো দিব্বি ছিলেন ঘরের মধ্যে, কার সঙ্গে এত কথা হচ্ছিল? শ্রেয়ার সঙ্গে?” প্রমথ চার্জ করল।

“আপনার কানকে স্যার কে ফাঁকি দেবে?”

“তা শ্রেয়ার তদন্ত শেষ হল?”

“তা মনে হয় হল। কিন্তু তার আগে গল্প বলি, যেটা বহুদিন বলব বলব করেও আপনাদের বলা হয়নি।”

“এটা আর নতুন কথা কি, গোপন করা তো আপনার স্বভাব!”

“না না স্যার, ফ্যামিলিও বলছিল, আপনারা ওর কাছেও জানতে চেয়েছিলেন আমি এদেশে হঠাৎ কেন এলাম।”

“এখন আর আমরা ইন্টারেস্টেড নই।”

“স্টুপিডের মতো কথা বলিস না। না বলুন, প্লিজ।” আমি বললাম।

.

একেনবাবু একটু চুপ করে শুরু করলেন, “আপনারা মনে হয় সেই সময়ে দেশে ছিলেন না। হঠাৎ করে মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার একটা চল আরম্ভ হয়েছিল। প্রেমের বা কোনও কুপ্রস্তাবে সাড়া না দিলে বা অন্য কোনও কারণে কারোর ওপর রাগ হলেই মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা। এটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে, সেখান থেকে এল পশ্চিমবঙ্গে।”

“ভালো করেই সেটা জানি, নেট-এ পড়েছি, ফেসবুকেও তো ছবি দেখছি। এখনও তো ঘটছে।”

“হ্যাঁ, স্যার। এটার যখন বাড়াবাড়ি শুরু হল, আমি বড় কর্তাদের একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম– প্রত্যেকটা রাস্তার মোড়ে খুব বড়ো বড়ো মাটির পাত্রে জল রাখা। অ্যাসিড মুখে লাগলেই যার মধ্যে মুখ ডোবানো যায়। সেটা সম্ভব না হলে, বালতি বা কিছুতে জলের বন্দোবস্ত রাখা, যাতে চট করে জল নিয়ে মুখটা অন্তত ধুয়ে ফেলা যায়। সেক্ষেত্রে মুখটা সেভাবে পুড়বে না। আমার প্রস্তাবে কেউ কান দিলেন না। কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলার কানে সেটা উঠতে ঠাট্টা করে আবার বিবৃতি দিলেন অ্যাসিডে মুখ পুড়বে না, কিন্তু ডেঙ্গীতে লোকেরা মরবে। খুব উপহাসের পাত্র হয়েছিলাম স্যার।

“এর মধ্যে বেশ কয়েকটা মেয়ের মুখ অ্যাসিডে পুড়ল। আমাদের ওপর চাপ এল দ্রুত দোষীদের ধরার। মুশকিল হল, মেয়েটার হয়তো কাউকে সন্দেহ হয়, কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ রেখে তো কেউ অ্যাসিড ছোঁড়ে না। অনেক সময় প্রেমিক নিজে না ছুঁড়ে আর কাউকে দিয়ে ছোঁড়ায়। এক আধ সময়ে যখন হাতেনাতে ধরতে পারা গেল, তখনও শাস্তি দেওয়া গেল না। খুঁটির জোর আমাদের দেশে বড় জোর। বিশেষ করে সেই খুঁটি যদি হয় শাসক দলের রাজনৈতিক নেতাদের। শেষে যে ঘটনা ঘটল, আমার কাছে সেটা মর্মান্তিক। আক্রান্ত হল আমাদেরই পরিচিত খুব মিষ্টি একটি মেয়ে। ওর বাবা-মাকে চিনতাম, আমাদের আগের পাড়ায় থাকতেন। মেয়েটা বায়োলজিতে মাস্টার্স করছিল। তার ব্যর্থ প্রেমিক দিনের বেলায় রাস্তার লোকের সামনেই মেয়েটির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারল। দোষীকে ধরলাম। কিন্তু ছেলেটির বিরুদ্ধে কেস খাড়া করার অনুমতি দেওয়া হল না। ব্যর্থ প্রেমিক এক মন্ত্রীর ভাগ্নে। লাভের মধ্যে রাতারাতি আমাকে সরিয়ে দেওয়া হল রেকর্ডস সেকশনে। অর্থাৎ বসিয়ে দেওয়া হল কেরানীর কাজে। মনে আছে হাসপাতালে গিয়ে ওকে দেখেছি। কী সুন্দর মুখ ছিল… ঝলসে সেটা বিকৃত হয়ে গেছে। তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি তদন্ত করছি. ওর বাবা-মা অনেক আশা করেছিলেন, দোষী অন্তত শাস্তি পাবে।

“বেশ কিছুদিন অফিসে যাইনি স্যার, ছুটি নিয়ে বসেছিলাম। সেই সময়েই নিউইয়র্কে আসার সুযোগটা এল, ফ্যামিলিই জোর করল সুযোগটা নিতে।”

“সত্যি, এত করাপশন থাকলে আইন থেকে আর লাভটা কি?” আমি স্বগতোক্তি করলাম।

“ঠিকই স্যার।”

“কিন্তু এই গল্পটা হঠাৎ এখন করলেন কেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল। যদিও আমি বুঝতে পারছিলাম প্রমথ উত্তরটা জানে। কারণ আমিও আঁচ করতে পারছিলাম।

“বলছি, স্যার। এই কিশলয় ছিল এক মন্ত্রীর ভাগ্নে, যার নাম ছিল সংগ্রাম। আপনি বলেছিলেন না স্যার, গ্রিন লিফ-এর মালিক হিজাব নিকাব পরা একজন মুসলিম। আমি শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মালিকটি নিয়মিত নামাজ পড়েন কিনা। গ্রিন লিফ-এর বোরখা পরা বিউটিশিয়ানটিও নামাজ পড়েন না। খুব অদ্ভুত না স্যার, ব্যাপারটা? দু’জন গোঁড়া মুসলিম, যাঁরা মুখ ঢেকে আছেন কিন্তু এই আবশ্যিক প্রাত্যহিক কর্মটা করছেন না, তখনই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল স্যার। মনে পড়ল সেই মিষ্টি মেয়েটির নাম ছিল বুলবুলি। পদবি চৌধুরী। নিশ্চয় ভালো নাম ছিল বুলবুল।

আরেকটা জিনিস জানার দরকার ছিল স্যার, কারণ সাবধানতা না নিয়ে ডাইমিথাইল মার্কারি ব্যবহার করলে নিজেদেরও মার্কারি পয়জনিং হবে। এক ফোঁটা গায়ে পড়লে বা লেটেক্স গ্লাভসে পড়লেও মৃত্যু। একমাত্র গ্লাভস যার মধ্যে দিয়ে ডাইমিথাইল মার্কারি ঢুকতে পারে না, সেটা হল সিলভার-শিল্ড-ল্যামিনেট গ্লাভস। সেটার খোঁজ করতে বলেছিলাম শ্রেয়াকে। খুঁজতে খুঁজতে শ্রেয়া একটা তালা-বন্ধ ক্যাবিনেট-এর মধ্যে দুটো সিলভার শিল্ড ল্যামিনেট গ্লাভস পেয়ে গেল। আর পেল ভালো করে সিলকরা ডাইমিথাইল মার্কারির একটা বোতল। সেগুলো দেখানোর পর শ্রেয়ার কাছে বুলবুল চৌধুরি স্বীকার করেছে ও আর অ্যাসিড-দগ্ধ বন্ধু পরিকল্পনা করে হত্যা করেছে কিশলয় আর শঙ্করকে। ওদের একটাই কথা, আমরা সারা জীবন এই লোকগুলোর করে দেওয়া ক্ষত নিয়ে অস্পৃশ্য হয়ে আছি, আর ঘৃণ্য অপরাধ করেও এরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে! না, সরকার কোনও বিচার আমাদের দেয়নি। এটাই আমাদের বিচার, আর কিছু না হোক তীব্র কষ্ট পেয়ে ওরা অন্তত মরুক।”

“তাহলে তো শ্রেয়ার একটা মস্ত ব্রেক হল।” প্রমথ বলল, “ফ্রন্ট পেজ নিউজ।”

“না স্যার। শ্রেয়া ওদের ধরেনি। দেশে থাকতে আমরা স্যার শুধু চোখ বুজে কর্তব্য করেছি, আমার বোনটি অন্য ধাতুর, ওর কর্তা হল বিবেক। কেস রিপোর্ট না লিখে, চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছে। নিউ ইয়র্কেই আসছে। আমাকে বলল, ওর বাপিদার সঙ্গে নাকি এ নিয়ে কথাও হয়েছে।”

শুনে প্রমথ আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল… ভাবটা এত জানা কথাই!

.

[একেনবাবুর এই কাহিনিতে কিন্তু শেষের চমকটা নেই। বাপিবাবুকে বলেছিলাম সে কথাটা। একটু ঘুরিয়ে যদি কাহিনিটা লেখেন। বাপিবাবু রাজি হলেন না। এই একটা গল্পে একেনবাবু আমাদের অবাক করতে চাননি। হাতের তাস দেখিয়েই খেলেছিলেন। আমি অন্য রকম করে লিখব কেন?]