১. একেনবাবুর কীর্তিকলাপ

হাউসবোটে নিখোঁজ – একেনবাবু সমগ্র (তৃতীয় খন্ড) – সুজন দাশগুপ্ত

১.

বেশ কিছুদিন আমি একেনবাবুর কীর্তিকলাপ নিয়ে কিছু লিখে উঠতে পারিনি। আমি লেখক নই। তরতর করে লেখা হাত থেকে বেরোয় না। কষ্টেসৃষ্টে যা লিখি, পরে সেটা পড়ে মনে হয় ছেলেমানুষী। তবে প্রমথ আমার লেখা নিয়ে যেরকম বিদ্রূপ করে, তত বাজে বোধহয় আমি লিখি না। প্রমথ আমার ছেলেবেলার বন্ধু নিউ ইয়র্কে আমরা একটা অ্যাপার্টেমেন্ট শেয়ার করি। অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় বাসিন্দা, যাঁর গুণকীর্তনের চেষ্টা আমি করি, সেই একেনবাবু কিন্তু সবসময়ে আমাকে উৎসাহ দেন, “স্যার, সকলে তো আর আগাথা ক্রিষ্টি বা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় হতে পারেন না, আর আপনি স্যার সাহিত্য লিখছেন না, লিখছেন ঘটনা।”

এ ব্যাপারে প্রমথর একটাই বক্তব্য, মুখে স্বীকার না করলেও একেনবাবু পাবলিসিটি চান, শুধু অজিত বা হেস্টিংস-এর মতো ওঁর কোনও লিপিকার নেই –অক্ষম আমিই একমাত্র ভরসা।

ম্যানহাটানে মুণ্ডুহীন ধর বলে একটা লেখা শুরু করেছিলাম, কিন্তু দু’মাসে দেড়পাতাও এগোল না। তারই মধ্যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে স্যাবাটিক্যাল নিয়ে এক বছরের জন্য কলকাতায় চলে এলাম। আমার মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। আর আমিও নিউ ইয়র্কে একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। চলে এসে অবশ্য নিউ ইয়র্কের কিছু কিছু জিনিস মিস করছিলাম, বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস, স্টারবাক্স-এর কফি, হাগেনডস-এর আইসক্রিম, আর ভিলেজ, অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আশেপাশের রাস্তাঘাট-দোকানপাট। কিন্তু সেটা কয়েক সপ্তাহ মাত্র। তারপর দেখলাম দেশের চিনি-লেবু মেশানো চা কিংবা কামধেনুর মিষ্টির কাছে স্টারবাক্সের কফিই বলুন বা হাগেনডসের আইসক্রিমই বলুন, কোনওটাই দাঁড়াতে পারবে না। যেমন পারবে না প্রমথর রান্না আমার মায়ের রান্নার কাছে। দেশের শাকসজি বা মাছের অমন স্বাদ নিউ ইয়র্কে মিলবে কী করে? নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর অবশ্য বিকল্প নেই। কিন্তু কলকাতার বাংলা দৈনিকগুলোর একটা আলাদা স্বাদ আছে। গরম গরম খবর দিয়ে তথ্যের দিক থেকে না পারলেও, রস-কথনে নিউ ইয়র্কের যে কোনও পত্রিকাকে টেক্কা দিতে পারে। মোটকথা নিউ ইয়র্ককে বলতে গেলে প্রায় ভুলেই গেলাম।

.

কলকাতায় আসার মাস দুয়েকের মধ্যে বাসস্থান নিয়ে একটা সমস্যা হল। আমাদের বাড়িটা বহুদিনের পুরোনো, ঠাকুরদার আমলে তৈরি। আজ ছাত থেকে জল পড়ছে, কাল দেয়ালের পলেস্তারা খসে যাচ্ছে, পরশু মর্চে-ধরা ভ্রু ভেঙ্গে জানলার কবজা খুলে আসছে– একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। তার ওপর মা একলা এত বড় বাড়িতে থাকেন–নিরাপত্তার দিক থেকেও সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। এইসব ভেবে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রমোটারদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এবার এসে দেখলাম প্ল্যানট্যান সব অ্যাপ্রুভড হয়ে গেছে। চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হবে। আমরা পাব দুটো বড় ফ্ল্যাট। তবে সেটা কমপ্লিট হতে সাত-আটমাস লেগে যাবে। ওই সময়টা আমাদের অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে হবে। প্রমোটার ভদ্রলোকই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করে দিলেন গড়িয়ার কাছাকাছি। অ্যাপার্টমেন্টটা নতুন, আমাদের প্রোমোটারই তৈরি করেছেন। বাড়ির বেশির ভাগ জিনিসপত্র গুদামজাত করে অল্প কিছু জিনিস নিয়ে আমি আর মা সেখানে এসে উঠলাম।

.

গড়িয়ার এই অঞ্চলটার সঙ্গে আমার একেবারেই পরিচিতি নেই। অত্যন্ত সরু রাস্তা, কাঁচা ড্রেনগুলোকে সবে পাকা করা শুরু হয়েছে। জাম্বো সাইজের মশায় জায়গাটা অধ্যুষিত। অল্প জমির উপর গায়ে গায়ে লাগানো সব বাড়ি, যার অনেকগুলো ভেঙ্গে এখন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং হয়ে গেছে। বেশির ভাগ জমিই বোধহয় জবরদখলি ছিল। সেইজন্য রাস্তাঘাটের ব্যাপারে কোনও প্ল্যানিং নেই, এঁকেবেঁকে নানান দিকে ছড়িয়ে আছে। সাইকেল রিকশার ক্ষেত্রে তাতে অসুবিধা নেই, কিন্তু এখন সেখানে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট গাড়ি চলে। দু’দিক থেকে গাড়ি এলেই সর্বনাশ! বেশ কিছুক্ষণ কসরত এবং দুই ড্রাইভারের মধ্যে বিস্তর আলোচনার পর গাড়ি পাস করতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে সাউথ এন্ড পার্কের সুন্দর পাড়া ছেড়ে এখানে এসে থাকাটা খুবই পীড়াদায়ক।

আমাদের প্রতিবেশী কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হল। বিজয়বাবু আর তাঁর স্ত্রী থাকেন আমাদের উলটো দিকের ফ্ল্যাটে। বিজয়বাবুর বয়স বছর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে। মেদবহুল শ্যামবর্ণ দেহ। চুলে একটু একটু পাক ধরেছে। ভদ্রলোক কথা খরচা করতে ভালোবাসেন না। আর একটা মুদ্রাদোষ আছে, কথায় কথায় ‘ওর নাম গে’ বলার। প্রথমদিন আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ওর নাম গে, থ্রি সি-তে?”

ঝট করে প্রশ্নটা ধরতে পারিনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে আবার বললেন, “থ্রি সি-তে তো?”

এবার বুঝলাম অ্যাপার্টমেন্ট থ্রি-সি-তে এসেছি কিনা জানতে চাইছেন। বললাম, “হ্যাঁ।”

“ব্যাচেলার?”

প্রশ্নের পারম্পর্য বুঝলাম না, তাও উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।”

“একা?”

ইচ্ছে হল বলি, তাতে আপনার কী মশাই?” কিন্তু নতুন জায়গায় এসে প্রথমেই প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হল না। বললাম, “না, মায়ের সঙ্গে থাকি।”

“বেশ। ওর নাম গে, আসি,” বলে ভদ্রলোক হনহন করে চলে গেলেন।

ভেরি স্ট্রেঞ্জম্যান।

.

বিজয়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হল, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কথাবার্তায় সপ্রতিভ, সুন্দরী না হলেও চেহারায় একটা অলগা শ্ৰী আছে। বোঝা যায় বয়সে বিজয়বাবুর চেয়ে অনেক ছোটো, নাম দীপা। ছেলেপুলে নেই, স্বামী-স্ত্রীর সংসার। বিজয়বাবুর পেশাটাও জানা গেল ওঁর স্ত্রীর কাছ থেকে। নেতাজি সুভাষ রোডের উপরে পুরোনো বান্টি সিনেমার কাছে বিজয়বাবুর একটা ওষুধের দোকান আছে।

দীপা চলে যাবার মা বললেন, যখন বলে গেল মেয়েটা, ওই দোকান থেকেই আমার ওষুধপত্র কিনিস।

.

আরও দুয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হল। কিন্তু না হলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। এ বাড়ি ছেড়ে গেলে এদের কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ থাকবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। প্রতিবেশীদের মধ্যে যাকে আমার ভালো লাগল, সে হল বারীন। লম্বা, ফরসা, চোখে গোল্ড রিমের চশমা। ব্যাকব্রাশ করা বেশ লম্বা চুল। মুখটা খুবই সুন্দর, কেবল নাকটা একটু থ্যাবড়া। ওইটিই চেহারায় বেমানান। প্রায় আমারই বয়সি। কোনও একটা ইন্সিওরেন্স এজেন্সিতে কাজ করছে। সেটা শুনে আমার সতর্ক ভাব দেখে বারীন আশ্বস্ত করল, “চিন্তা নেই ব্রাদার, আপনাকে পলিসি কিনতে বলব না। সবাইকে ক্লায়েন্ট বানালে, বন্ধু পাব কোথায়?” বলে হা হা করে হাসল কিছুক্ষণ।

কথাটা শুনে লজ্জা পেলাম। মুখে বললাম, “না, না আমি মোটেই তা ভাবছিলাম না।”

উত্তরে বারীনের মুচকি হাসি দেখে বুঝলাম ধরা ঠিকই পড়েছি।

আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের সম্পর্ক তুমি-তে এসে দাঁড়াল। বারীন আমার কলেজের বন্ধু অনিমেষকে খুবই ভালো চেনে। অনিমেষ পালিত স্ট্রিটের যে বাড়িতে থাকে, সেটা যে বারীনের পৈত্রিক বাড়ি সেটা অবশ্য প্রথমে জানতে পারিনি। আসলে বছর পাঁচেক আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়িতে আর পা দেবে না বলে বেরিয়ে এসেছিল, তারপর বারীন আর ওমুখো হয়নি। দু’বছর আগে বাবা মারা গেলেন। বারীন নিজে ওখানে যাবে না, তাই মা-কে দেখভাল করার জন্য বন্ধু অনিমেষকে ওখানে গিয়ে থাকতে অনুরোধ করে। এখন অবশ্য মা-ও নেই। তবে শেষদিন পর্যন্ত অনিমেষ বারীনের অসুস্থ মা-কে দেখাশুনা করেছে। অনিমেষ ছাড়াও আরও দুয়েকটা কানেকশন বেরিয়ে গেল।

কথাচ্ছলে বারীন বলল, “আমি তোমাকে পলিসি বেচলুম না বটে, কিন্তু দীপাবউদি হয়তো বেচে দেবেন, সতর্ক থেকো।”

“দীপাবউদিও ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট নাকি?”

“এই কিছুদিন হল হয়েছে। এখন আমরা ফিয়ার্স কম্পিটিটর। এই যে তোমার সঙ্গে আড্ডা মারছি, দীপাবউদি নিশ্চয় ভাবছে, তোমাকে কবজা করার চেষ্টা করছি।”

আমি বললাম, “তাহলে তো ভালোই হল, আমাকে ইন্সিওরেন্স বেচতে এলে বলে দেব, তুমি অলরেডি কিনিয়ে দিয়েছ।”

“ওরে বাবা, ওটি কোরো না, তাহলে আমার লাইফ হেল করে দেবে।” বলে বারীন আবার হা হা করে হাসলো।

.

বিজয়বাবুদের সঙ্গে বারীনের খুবই বন্ধুত্ব, সেটা অবশ্য ক’দিনের মধ্যেই বুঝলাম। মাঝেমাঝেই সন্ধ্যাবেলায় বিজয়বাবুদের বাড়ি থেকে হই-হুঁল্লোড়ের আওয়াজ আসে, তাতে বারীনের গলাও পাওয়া যায়। এর মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় বারীন এসে বলল, “এই বাপি, কী করছ?”

“বই পড়ছিলাম, কেন বল তো?”

“তাহলে এসো।”

“কোথায়?”

“বিজয়দার বাড়িতে। তুমি নিউ ইয়র্কে থাক শুনে শেখরদা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।”

“শেখরদা কে?”

“আমার বহুদিনের চেনাজানা। ওঁর ছোটো শালা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে। যেই বললাম তুমি ওখানে পড়াও, শেখরদা আর শীলা দুজনেই চেপে ধরল, এক্ষুনি আলাপ করিয়ে দাও। সুতরাং দেরি নয়, এসো আমার সঙ্গে।”

ওর ব্যস্ততা দেখে আমি হেসে ফেললাম, “তা আসছি, কিন্তু ছেলেটি যখন নিউ ইয়র্কে যাবে, আমি তো তখন এখানে?”

“হু কেয়ার্স! আর কিছু না হোক, আচ্ছা তো হবে!”

বুঝলাম, এটা একটা ছুতো, আমাকে ওখানে টেনে নিয়ে যাবার অজুহাত খুঁজছে বারীন।

.

খানিকবাদে বিজয়বাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম কয়েকটি অপরিচিত মুখ। বারীনের শেখরদা বেশ দিলখোলা লোক। আমাদের থেকে বয়সে খুব একটা বড় নন। কিন্তু হাবেভাবে মনে হয় জ্যাঠামশাই! আপনি ফাপনি নয়, সোজা তুমি দিয়েই শুরু করলেন। তারপর বললেন, “কী চটলে নাকি?”

“কেন বলুন তো?”

“এই যে “তুমি’ বলছি।”

আমি হেসে বললাম, “আমি আপত্তি করলে আপনি শুনবেন?”

“শুনতে চেষ্টা করব, তবে মাঝে মাঝে ভুল হবে। আসলে এখানে আপনি বলার মতো রয়েছে শুধু বিজয়দা। তাও বিয়ের ব্যাপারে আমি বিজয়দার থেকে সিনিয়র, বুঝলে? আমাদের বিয়ে হয়েছে এইটিন ইয়ার্স। দাঁড়াও দাঁড়াও, সেখান থেকে আবার শীলার বয়স হিসেব করার চেষ্টা কোরো না, বিয়ের সময় শীলার বয়স ছিল মাত্র ষোলো। তারপর চোখ টিপে বললেন, বিয়েটা বে-আইনী বুঝতেই পারছ।”

“ক্রেডল স্ন্যাচার!”

এতক্ষণ নজরে পড়েনি। ঘরের কোণে জিনস আর হালকা-সবুজ টপ পরা একটা মেয়ে বই মুখে দিয়ে বসেছিল। বেশ মিষ্টি চেহারা। বড় বড় চোখ, ঘন কোঁকড়া চুল, গাঢ় করে লিপস্টিক মাখায় ঠোঁটটা একটু পুরু লাগছে। বয়স ষোলো-সতেরোর মধ্যেই হবে। মন্তব্য করেই আবার বইয়ে চোখ রাখল।

শেখরদা আমাকে বললেন, “আমার মেয়ে, ভাস্বতী।”

আমি হাতটা একটু তুলে ‘হ্যালো’ বললাম।

“হ্যালো,” অত্যন্ত দায়সারা ভাবে উত্তর দিয়ে মেয়েটা আবার বইয়ে মুখ গুঁজল।

.

এই বয়সে বাবা-মায়ের বন্ধুদের পার্টিতে কেউ উৎফুল্ল হয়ে আসবে আশা করি না। কিন্তু ভাস্বতাঁকে মনে হল একটু বেশি চুপচাপ। যতক্ষণ ছিলাম বই মুখে দিয়ে বসে রইল। যে বইটা পড়ছিল, সেটা আমারও আছে। অক্সফোর্ড প্রেস-এর এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ইণ্ডিয়ান সিনেমা, পাঁচ-ছশো পাতার একটা বিশাল বই। নিশ্চয় সিনেমার পোকা। সেই সূত্র ধরেই বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম, তারপর হাল ছেড়ে দিলাম। ও-ও বোধহয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

বারীন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভাস্বতী এখন এ জগতে নেই। সিনেমা ভালোবাসে বলে কী কুক্ষণে ক’দিন আগে বইটা ওর জন্মদিনে দিয়েছিলাম!”

বইটা সস্তা নয়। হার্ড কভারের এই বইটা আমিই সেল-এ প্রায় ৫০ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম। এখানেও নিশ্চয় কয়েক হাজার টাকা দাম হবে। ইন্সিওরেন্স বেচে বারীন মনে হয় ভালোই টু-পাইস কামাচ্ছে।

“উপহারটা তো ভালোই দিয়েছ।”

“যা বলেছ। শীলা এখন আমাকে শাসাচ্ছে। আগে যদিও বা দুয়েকটা কথাবার্তা বলত, এখন বইটা মুখেই পড়ে থাকে।“

.

ভাস্বতীর মা শীলা অবশ্য তার উলটো। শেখরদার মতোই হইচই করতে ভালোবাসে। “আমিও কিন্তু তোমাকে আপনি, টাপনি বলতে পারব না, যতই প্রফেসর হও।” প্রথমেই ঘোষণা করল শীলা। “আর তুমিও আপনি আজ্ঞে করবে না, নাম ধরে ডাকবে। এই শর্ত যদি মানতে না পারো, তাহলে আর কথা বোলো না।”

এর পর আর আপনি বলা যায় কী করে?

.

চেহারার দিকে থেকে শেখরদা আর শীলা– দু’জনেই মডেল হবার উপযুক্ত। শীলার দুয়েকটা ছবি, মনে হল বিজ্ঞাপনে বোধহয় দেখেওছি। একটু আমতা আমতা করে কথাটা জিজ্ঞেসই করে ফেললাম।

শীলা শেখরদাকে দেখিয়ে বলল, “ওকে বলো না, আজেবাজে মেয়েদের ছবি না দিয়ে বউয়ের ছবি দিতে!”

“শেখরদা একটা অ্যাড-এজেন্সিতে কাজ করেন, বারীন বলল।

শীলাকে কেন দেখেছি মনে হচ্ছিল পরে অবশ্য বুঝলাম। একটা বাংলা চ্যানেলে শীলা মাঝে মাঝে খবর পড়ে।

.

আড্ডাকে জমিয়ে তোলার জন্য খাদ্য ও পানীয়ের আয়োজনও দেখলাম প্রচুর। গরম গরম শিঙাড়া, মিটরোল, আর চিকেন টিক্কার পাশে সাজানো রয়েছে হুইস্কি, আর রামের বোতল।

পানীয়-সেবন আগে থেকেই চলছে। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে গ্লাস।

দীপাবউদি বললেন, “দেশের হুইস্কি আপনার কেমন লাগবে জানি না। ট্রাই করতে পারেন। ফ্রিজে বিয়ারও আছে। কী দেব আপনাকে?”

যেটা খেতে ইচ্ছা করছিল সেটা হল গরম শিঙাড়ার সঙ্গে চা। কিন্তু গৃহকত্রীকে তার জন্য বিব্রত করতে চাইলাম না।

“না, আমার কিছু লাগবে না।”

শীলা আমার দিকে কটাক্ষ হেনে বলল, “গুডবয়, মদ্যপান কর না– ঠিক?”

“তা ঠিক নয়, আজ ইচ্ছে করছে না।”

“তাহলে কোল্ড ড্রিংক নাও।”

টেবিলের এক কোণে কয়েকটা সফট ড্রিংক-এর বোতল ছিল, আগে নজরে পড়েনি। শীলাকে সন্তুষ্ট করতেই তার থেকে একটা তুলে নিলাম।

শেখদা দেখলাম হুইস্কির বোতল আর বরফের পাত্রটা নিয়ে শীলা আর দীপাবউদির গ্লাস দুটো ভর্তি করছেন। নিজের পাত্রে বরফের থেকে হুইস্কিই ঢাললেন বেশি। বারীন রেফ্রিজারেটর থেকে একটা বিয়ারের বোতল বার করে এনে বিজয়বাবু আর নিজের জন্য দুটো গ্লাসে ঢালল।

“আবার তোমরা ড্রিংকস মিক্স করছ?” দীপাবউদি বারীন আর বিজয়বাবুকে ধমকের সুরে বললেন।

“সরি ম্যাডাম,” মুচকি হেসে বাঁ-হাতে দীপাবউদির কোমর জড়িয়ে ডান হাতে নিজের গ্লাসটা তুলে বারীন বলল, “চিয়ার্স।”

“চিয়ার্স।”

“বাপি, শিঙাড়াটা খান,” দীপাবউদি বললেন। “গোপালের শিঙাড়া। ফুলকপির এমন শিঙাড়া আমেরিকাতে পাবেন না।”

খেয়ে দেখলাম সত্যিই চমৎকার! আমেরিকা কেন, কলকাতাতেও এমন খাইনি।

“দীপাবউদিকে ক্রেডিট দিও না। দোকানটা আমার আবিষ্কার।” বারীন বলল।

মিটরোল আর চিকেন টিক্কার স্বাদও মনে রাখার মতো।

খেতে খেতেই বললাম, “নাঃ, এই জায়গাটা সম্পর্কে আমার ধারণাটা পালটাতে হচ্ছে।”

বিজয়বাবু আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। “ওর নাম গে, তার মানে?” এই প্রথম উনি মুখ খুললেন।

“মানে এখানে এসে মশার কামড়ে এত বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম, যে ভালো দিকগুলো চোখে পড়েনি। যেমন, এইরকম খাবার।”

“শুধু খাবার, আমরা বুঝি বাদ?” শীলা হুইস্কির গ্লাসটা গালের পাশে ধরে মধুর হেসে আমার দিকে তাকাল।

বারীন শীলার পাশে বসেছিল। কানে কানে কিছু বলাতে শীলা ব্লাশ করল। কী বলল জানি না, আমি একটু অপ্রস্তুত বোধ করলাম।

শীলা হঠাৎ উঠে এসে আমার কনুইটা ছুঁয়ে বলল, “পালিও না, আমি এক্ষুনি আসছি।” বলে পাশের ঘরে অদৃশ্য হল।

বিজয়বাবু শীলার শূন্য চেয়ারে বসে বারীনকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওর নাম গে, প্রমোটারের সঙ্গে তোমার ডিল ফাইনাল? ক’টা ফ্ল্যাট পাচ্ছো?”

“দুটো। কিন্তু আপনারা আমার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। আমি কোথাও যাচ্ছি না, এখানেই থাকব আর আপনাদের জ্বালাব।”

“বেশ তো, জ্বালাও না।”

“কোম্পানি, বুঝলে বাপি কোম্পানি– সেটাই হল মোস্ট ক্রিটিক্যাল।” শেখরদা একটু ঢুলু ঢুলু চোখে বললেন, মনের মতো লোক না থাকলে, আড্ডা দেওয়া যায় না। আর আড্ডাই জীবন।”

নেশাটা ধীরে ধীরে সবারই চড়ছে।

বারীন ইতিমধ্যে ভাস্বতীর পাশে ধপ্ করে বসে কী একটা বলতে গেল।

“গো অ্যাওয়ে।” মাছি তাড়ানোর মতো করে ভাস্বতী বারীনকে তাড়াল। মেয়েটা ডেফিনেটলি অবনক্সাস।

দীপাবউদি আমার পাশে বসেছিলেন। তিনিও লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। নীচু গলায় আমাকে বললেন, “শীলা একদম বোঝে না, এতদিন ধরে মেয়েটাকে বাড়িতে রেখে বাইরে বাইরে পার্টি করে বেড়িয়েছে, এখন হঠাৎ সঙ্গে এনে নজরদারি করতে চাইলে মানবে কেন?”

আমি এঁদের কাউকেই তেমন চিনি না, সুতরাং চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হল।

শীলা ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। “এই, তুমি এদিকে একটু এসো,” বলে আমার হাত ধরে প্রায় টেনে আমায় জানলার পাশে নিয়ে গিয়ে কাজের কথাটা পাড়ল। ওর ভাই। নেক্সট উইকেই নিউ ইয়র্ক যাচ্ছে। আমি প্রমথর ফোন নম্বর দিলাম যোগাযোগ করার জন্য। প্রমথকে ওর ভাইয়ের যাবার কথাটা জানিয়ে দেব সেটাও বললাম।

“ভুলে যাবে না তো? আমি কিন্তু তোমায় ফোন করব।”

“ভুলব কেন!”

“তাও যদি ফোন করি?”

“নিশ্চয় করবে, কী আশ্চর্য!”

“বেশি গায়ে পড়া ভাববে না তো?”

আমি হাসলাম।

শুনতে পেলাম শেখরদা বারীনকে ডাকছেন, “এই বারীন, কোথায় তুমি?”

বারীন একটু দূরে, বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাস্বতীর সঙ্গে কথা বলছিল। আমরা যেখানে সেখান থেকে বাথরুমের দরজা একটুখানি দেখা যায়। শেখরদা যেখানে সেখান থেকে কিছুই যায় না। ওখানে দাঁড়িয়েই বারীন উত্তর দিল, “আসছি, বলুন।”

“আমাদের বোট-এ আর জায়গা নেই? বাপিকে আসতে বল না?”

“কেষ্টবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।”

আমি শেখরদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”

ইতিমধ্যে বারীন বসার ঘরে ফিরে এসেছে। বারীনই উত্তর দিল, “এই শনিবার একটা হাউসবোট ভাড়া করেছি দু’দিনের জন্য। গঙ্গায় বেড়াব– শুধু আমরা। ইন্টারেস্টেড? তাহলে দেখব আরেকটা জায়গা ম্যানেজ করা যায় কিনা। অবশ্য নো গ্যারান্টি।”

“এখানে হাউসবোট ভাড়া পাওয়া যায়?” আমি একটু অবাক হলাম।

“আগে যেত না, এখন যায়। কেরল থেকে বেশ কয়েকটা এসেছে। চমৎকার বোটগুলো। যাবে কিনা বল?”

“ইচ্ছে খুবই করছে, কিন্তু এ যাত্রায় হবে না। মাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবার কথা আছে।”

“তাহলে তো আর হল না। কিন্তু পরের বার কোনও অজুহাত চলবে না।”