১১. দেরি করে ব্রেকফাস্ট

১১.

সোমবার মে ২৩, ২০১১

সোমবার একটু দেরি করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে দশটা নাগাদ আমি আর একেনবাবু বেরোলাম। ফিলাটেলিস্ট কর্নার আমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে মিনিট দশেকের পথ। একেনবাবুকে বললাম, “আমি বুঝতে পারছি কেন স্ট্যাম্পের দোকানে যেতে চাচ্ছেন, কিন্তু যেটা বুঝছি না, আমাকে কেন দরকার?”

“আপনাকে স্যার একটু অভিনয় করতে হতে পারে।”

“কী অভিনয়?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“না না, তেমন কিছু নয় স্যার।”

“দাঁড়ান দাঁড়ান, এদিকে বলছেন অভিনয় করতে হবে, অথচ পার্ট বলছেন না ব্যাপারটা কী?”

“আঃ, ঘাবড়াচ্ছেন কেন স্যার, চলুন না?”

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম, দোকান তখন সবে খুলেছে। যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দোকানে বসেছিলেন তিনি উঠে এগিয়ে এলেন। আমি একেনবাবুকে চট করে সতর্ক করে দিলাম, “ইনি কিন্তু অন্য লোক।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

“মে আই হেল্প ইউ উইথ এনিথিং?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা দোকানটা একটু দেখতে এসেছি স্যার।”

“নিশ্চয়, দেখুন। আমাদের দোকান ছোটো, কিন্তু স্টক ভালো। কিসে আপনাদের ইন্টারেস্ট?”

“জেনারেল ইন্টারেস্ট স্যার, খুব জেনারেল। আসলে স্যার, আমাদের বাজেট খুব লিমিটেড।

“পাঁচ ডলারের মধ্যে আমাদের অনেক স্ট্যাম্প আছে। কুড়ি, পঁচিশ– এমন কি একশো ডলারের স্ট্যাম্পও বেশ কয়েকটা আছে। বেশি দামের স্ট্যাম্পও জোগাড় করে দিতে পারি। তবে একটু সময় লাগতে পারে।”

.

দোকানটা বাইরে থেকে যতটা ছোটো মনে হয়েছিল ততোটা নয়। ভেতরটা বেশ লম্বা হলের মতো, দু’ধারে ডিসপ্লে-তে অজস্র স্ট্যাম্প। পেছনে কাঁচের আলমারিতে ফাইলের পর ফাইল সাজানো। ইন্ডিয়ার প্রচুর স্ট্যাম্প রয়েছে দেখলাম, দামও বেশি নয়। বেশি দামের মধ্যে একটাই শুধু চোখে পড়ল, পঞ্চান্ন ডলার।

“সত্যি স্যার, এক্সেলেন্ট কালেকশন আপনাদের। আমি তো ভাবিইনি এত স্ট্যাম্প আছে এখানে। আজ তাড়া আছে, আরেকদিন এসে ভালো করে দেখব।”

“বেশ তো, আমরা শুধু রবিবার বন্ধ থাকি।”

বেরোবার পথে একেনবাবু হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করলেন, “ভালো কথা স্যার, আপনারা তো স্ট্যাম্প কেনেন না– তাই না?”

“কেন কিনব না? নিশ্চয় কিনি।”

একেনবাবু এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনলেন স্যার? আপনি যে বলেছিলেন কাস্টমার না থাকলে এঁরা কেনেন না? সেটা ঠিক কথা নয়।”

আমি উত্তরে কী বলব বুঝে উঠতে পারার আগেই দোকানের ভদ্রলোক বললেন, “সেটা বেশি দামের স্ট্যাম্পের বেলায়। পাঁচ দশ ডলারের স্ট্যাম্প আমরা নগদ দিয়ে কিনি। একশো বা তার বেশি দামের স্ট্যাম্প সাধারণত নিলামে বিক্রি হয়। আমাদের চেনাজানা কিছু বড় কালেক্টর আছেন, তাঁরা পছন্দসই স্ট্যাম্পের খবর পেলে অনেক সময়ে আমাদের কাছ থেকে সোজাসুজি কিনে নেন।”

“এবার বুঝেছি স্যার, আসলে এঁর এক বন্ধু কিছুদিন আগে আপনাদের দোকানে একটা দামি স্ট্যাম্প বিক্রি করতে এসেছিলেন, তখন সেটাই বোধহয় আপনারা বলেছিলেন।”

“কবে এসেছিলেন?”

“টাইমটা তো ঠিক বলতে পারব না।”

“কী নাম বলুন তো?”

“মিস্টার অশোক দুবে।”

“ও ইয়েস, লজেন্স ক্যানসেলের ছাপ মারা হাফ-অ্যানা সিন্ডে ডক স্ট্যাম্প। ইট ওয়াজ ইন এক্সেলেন্ট কনডিশন।” তারপর আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “উনি আপনার বন্ধু?”

আমি কিছু বলার আগেই একেনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, স্যার।”

“বাঁচালেন! কয়েকজন ইন্টারেস্টেড, কিন্তু আপনার বন্ধু যে ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা নট-ইন-সার্ভিস, তাই যোগাযোগ করতে পারছি না। ওঁর অন্য কোনও ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?”

“থাকলেও লাভ হত না স্যার, হি ইজ ডেড।” একেনবাবু গম্ভীরমুখে বললেন। “ও মাই গড! সো সরি টু হিয়ার দিস!”

“কবে উনি এসেছিলেন স্যার, মনে আছে?”

“না, ঠিক কবে মনে নেই। শুধু ফোন নম্বরটা লিখে রেখেছিলাম।”

“চলি স্যার।” বলে দোকানদার ভদ্রলোককে প্রায় হতভম্ব অবস্থায় রেখে আমরা বেরিয়ে এলাম।

.

আমার কাছে ব্যাপারটা এখন বেশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। বাইরে বেরিয়েই আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে কি অশোকই বিপাশা মিত্রের ছবির খামটা চুরি করেছিলেন?”

“সেটাই তো আমার সন্দেহ হচ্ছে স্যার। কাল যখন আপনি বললেন, এই দোকানের কেউ আপনাকে ভুল লোক ভেবে বলেছে, আপনার স্ট্যাম্পের খরিদ্দার পাওয়া গেছে–তখনই সন্দেহটা হল।”

“তা বুঝলাম, কিন্তু সেটা অশোকবাবু হতে যাবেন কেন?”

“কারণ, দেবরাজ সিং প্রথম দিন এসে বলেছিলেন, আপনার চেহারার সঙ্গে অশোকবাবুর মিল আছে।”

“কে জানে, আমার কিন্তু সেরকম মনে হয়নি, অবশ্য আমি অশোককে দেখেছি খুব অল্প সময়ের জন্যেই।”

“আমি কিন্তু একটু কনফিউসড স্যার।”

“কেন?”

“আপনি তো স্ট্যাম্পের অনেক খবর রাখেন, সিন্ডে ডক-এর কথা আপনি জানতেন?”

“আমি স্ট্যাম্পের খবর কিছুই জানি না।”

“সে কি স্যার, আপনি যে সেদিন ট্রেসকিলিং ইয়েলো স্ট্যাম্পের কথা বললেন!”

“ওই একটা নামই জানতাম।”

“ইন্টারেস্টিং,”একটু মাথা চুলকোলেন একেনবাবু। “আসলে স্যার, যাঁরা স্ট্যাম্প জমান তাঁরা এসব জানেন। কিন্তু অশোকবাবু জানলেন কী করে? মনে আছে, অশোকবাবু স্ট্যাম্প জমান কিনা জানতে চেয়েছিলাম ইন্দ্রবাবুর কাছে? তিনি তো বললেন, ‘না’।”

“হয়তো ছেলেবেলায় জমাতেন।”

“তা হতে পারে স্যার।” একেনবাবু মাথা নাড়লেন।

“এছাড়া অশোক নিশ্চয় যখন খামটা দেখেছিলেন, ভিতরের চিঠিটাও পড়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল না–তোমাকে অমূল্য ধন পাঠালাম?”

“ইউ হ্যাভ এ ভেরি গুড পয়েন্ট স্যার।”

“আমার কী মনে হয় জানেন, অশোক যখন বিপাশা মিত্রের পার্টিটা অ্যারেঞ্জ করছিলেন, তখন নিশ্চয় বার কয়েক ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন। বিপাশা মিত্র হয়তো এক সময়ে ভিতরে ছিলেন না বা কিছু, তখনই অশোক খামটা পায়। ও ক্রিমিন্যাল নয়,

তবে বড়লোকদের টাকা নিয়ে গরিবদের কাজে লাগানোর মধ্যে বোধহয় কোনও অপরাধ দেখেনি।”

“খুবই সম্ভব স্যার। কিন্তু অশোকবাবুকে খুন করল কে?”

“সেটাই বার করতে হবে। ইন ফ্যাক্ট, সেটা বার করলে, আপনার দুটো কেসই সভজ্ঞ হয়ে যাবে।”

“আপনার কী মনে হয় স্যার, খুনি ওই স্ট্যাম্পের লোভেই অশোকবাবুকে খুন করেছে?”

“তাই তো মনে হয়। অশোকের মানিব্যাগ, ক্রেডিট কার্ড কিছু চুরি যায়নি। চুরি গেছে একটা খাম, যার খবর কারোরই জানার কথা নয় খুনি ছাড়া।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, তার মানে খুনিকে অশোকবাবু স্ট্যাম্পের কথা বলেছিলেন।”

“নিশ্চয়, একজনকে তো বলেইছিলেন।”

“কাকে স্যার?”

“কাকে আবার, ফিলাটেলিস্ট কর্নারের ওই দোকানদারকে!”

“ও হ্যাঁ, ঠিক কথা। বন্ধু ইন্দ্রবাবুকে কি বলেছিলেন?”

“ইন্দ্র তো অস্বীকার করলেন, কোনও চিঠি বা স্ট্যাম্প দেখেছেন বলে। তাছাড়া ওঁর অ্যালিবাই আছে, বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলছিলেন।”

“ট্রু স্যার। তবে কিনা, এই অ্যালিবাই আর থাকে না, যদি ওঁরা সবাই এই মার্ডারের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।”

“সেটা কি সম্ভব?”

“নাথিং ইজ ইমপসিবল স্যার। কাউকেই সাসপেক্ট লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া যায় না। এই দোকানদারকে দেখে আপনার কী মনে হল?”

“মনে হয় ভদ্রলোক ইনোসেন্ট, নইলে আমাদের এই স্ট্যাম্পের কথা বলতেন না, চেপে যেতেন।”

“একটা প্রশ্ন করা হল না স্যার। অশোকবাবু যখন স্ট্যাম্পটা এনেছিলেন, তখন দোকানে আর কেউ ছিলেন কিনা। খুনি হয়তো একজন স্ট্যাম্প কালেক্টর স্যার। অশোকবাবু যখন স্ট্যাম্পটা দেখাচ্ছেন, তখন নিশ্চয় খুনি সেটা দেখেছিলেন। সে ক্ষেত্রে

খুনিকে ধরা সহজ ব্যাপার হবে না।” বলতে বলতে একেনবাবু হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

ইতিমধ্যে আমরা ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি।

“আপনি যান স্যার, আমি একটা কাজ সেরে আসি।”

কী কাজ, কোথায় চললেন, কিছু না জানিয়েই অদৃশ্য হলেন। টিপিক্যাল একেনবাবু!

.

১২.

কলেজে আমার ঘরে ঢোকার মুখে যে অফিস রয়েছে সেখানেই বেভ বসে। সাধারণত, আমি চট করে ‘হায়’ বলে ঘরে ঢুকি। আজকে তা না করে বেভের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালাম। টেবিলের ওপর হাতটা রেখে বললাম, “হ্যালো।”

বেভ কম্পিউটারে কিছু একটা টাইপ করছিল। সেটা থামিয়ে মুখ তুলে উত্তর দিল, “হ্যালো।”

কয়েক সেকেন্ড চলে গেল কী ভাবে কথাটা শুরু করব ভাবতে গিয়ে।

বেভের চোখ ভাসা ভাসা, “ইয়েস?”

হঠাৎই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “একটা পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করতে পারি?”

“পারো, তবে আমার সেক্স-লাইফ নিয়ে কোনও কোয়েশ্চেন নয়।” তারপর একটু দুষ্টু হেসে যোগ করল, “অন্তত আরেকটু পরিচয় না হওয়া পর্যন্ত।”

নো ওয়ান্ডার রামসুন্দর রেড্ডী কেন সতর্ক করেছিল! লাল হচ্ছি দেখে আলতো করে আমার হাতটা ছুঁল বেভ।

“জাস্ট কিডিং, কী কোয়েশ্চেন বলো?”

“কিশোরের কাছে শুনেছি, তোমার আন্ট মিশেল হোবোকেন-এ থাকেন। উনি কি কোনও স্যুপ কিচেনের সঙ্গে যুক্ত?”

“ইয়েস,” বেভের মুখ-চোখের ভাব হঠাৎ পালটে গেল। সহজ খুশিতে ঝকমক করে উঠল। “তুমি আন্টি মিশেলকে চেন? আমি ওর কাছেই বড় হয়েছি। আমার মায়ের মতো।”

“আই নো অফ হার। আমার একজন পরিচিত ওঁকে চিনতেন।”

“হু ইজ হি অর ইজ ইট শি?”

“ইজ নয় ওয়াজ, হি ইজ ডেড।”

“ওয়েট এ মিনিট, তুমি কি সেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ম্যানেজারের কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, অশোক দুবে।”

“ও মাই গড! আন্টি মিশেল এত আপসেট হয়েছে ওঁর মৃত্যুর খবরে… কিছুতেই ভাবতে পারছে না, ওরকম একজন চমৎকার ইয়ং ম্যানকে কে খুন করল!”

“হোপফুলি সেটা জানা যাবে, আমার পরিচিত একজন ভালো প্রাইভেট ডিটেকটিভ অশোকের মৃত্যুর তদন্ত করছেন।”

“সত্যি? খুব ভালো কথা, আন্টি মিশেল শুনলে খুশি হবে। হোবাকেনের পুলিশের উপর ওর একেবারেই ভরসা নেই।”

“ওঁর সঙ্গে একবার হয়তো আমাদের কথা বলার দরকার হতে পারে। উনি কি রাজি হবেন?”

“কেন হবে না, আমাকে আগে থাকতে জানিও, আমি বলে রাখব। আর কিছু?”

“আপাতত আর কিছু নয়।”

“তাহলে কি পরে?” চোখে আবার সেই দুষ্টুমির ঝিলিক।

আমি একটু হেসে আমার ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি, বেভের গলার স্বর হঠাৎ নিচু হয়ে গেল। “থ্যাঙ্ক ইউ ফর স্টপিং বাই, এন্ড সেইং হ্যালো টু মি।”

ঠাট্টা নয়, আন্তরিক ভাবেই কথাটা বলল। কিছু কিছু মেয়ে আছে, যারা ছেলেদের একটু খেলাতে ভালোবাসে– ওয়ান্টস টু প্লে উইথ মেন, কিন্তু মনের ভেতরটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। কে জানে, বেভ হয়তো সে রকম ধরনেরই মেয়ে।

.

বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখলাম একেনবাবু আর প্রমথ ইন্টারনেটে কী জানি দেখছে।

“কী দেখছিস?” কাঁধের ব্যাগটা নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করলাম।

“সিন্ধ ডাক-এর দাম,” প্রমথ উত্তর দিল।

“নামটা সিন্ডে ডক,” আমি বললাম। “ফিলাটেলিস্ট কর্নারে ওই নামটাই শুনেছি।”

“জায়গাটার নাম সিন্ধ, সিন্ডে নয়। আর পোস্টাল সার্ভিসকে বলা হয় ডাক– ডক নয়। তোকে তো সায়েবরা ব্যাপি ডে বলে ডাকে– তোর নাম কি ব্যাপি ডে?”

প্রমথর সঙ্গে তর্ক করার কোনও অর্থ হয় না। সংসারে দু’ধরণের লোক আছে। একদল, যারা ভাবে তারা জানে। আরেকদল, যারা জানে তারা জানে। প্রমথ হল দ্বিতীয় দলের লোক। প্রথম দলের লোকদের তবু যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়, দ্বিতীয় দলের সঙ্গে সে চেষ্টা বৃথা।

চোখে কিছু একটা পড়েছিল, সেটা ধুতে বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে প্রমথকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী আবিষ্কার করলি?”

“কোন আবিষ্কারের কথা জিজ্ঞেস করছিস? আবিষ্কার তো প্রতিদিনই কিছু না কিছু করি।”

“চ্যাংড়ামি করিস না, স্ট্যাম্পের দামের কথা জানতে চাইছি।”

“তেমন দামি নয়। ছাপ-মারা স্ট্যাম্প হলে বড়জোর আট ন’হাজার ডলার। ছাপ-মারাই তো বলেছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ, লজেন্স ক্যানসেল বা ওই জাতীয় কিছু।”

“ওই হল, মানে পোস্ট অফিসে ক্যানসেল হওয়া স্ট্যাম্প, মিন্ট কনডিশন নয়। মিন্ট কনডিশন হলে আরও বেশি হত।”

“কিন্তু আট ন’হাজার ডলার কম হল নাকি?”

“ও, তার মানে তুই হলে ওই টাকার জন্যে একটা লোককে খুন করতিস?”

“আমার প্রশ্ন উঠছে কেন? আমি কোটি টাকা পেলেও কাউকে খুন করব না।”

“শুনুন একেনবাবু, একটু আগে তো আপনি বাপিবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিলেন– কী বিনয়ী, কী ভদ্র! এখন শুনলেন তো নিজের মরালিটি নিয়ে কিরকম বড়াই করছে!”

“যাই বলুন স্যার, আমি কিন্তু কনফিউসড,” একেনবাবু বললেন।

“কনফিউশনটা কিসে?” প্রমথ এবার একেনবাবুকে নিয়ে পড়ল। “সিন্ধ ডাক নিয়ে, ন’হাজার ডলার কম কি বেশি নিয়ে, না বাপি কোটি টাকা পেলেও খুন করবে না– তাই নিয়ে?”

“তা নয় স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে এই নিয়ে একটু কথা হচ্ছিল। ওঁর কাছ থেকে খবর পেলাম, হোবোকেনের কাছে গোটা ছয়েক স্ট্যাম্প ডিলার আছে। নিউ হেরিটেজ হোটেলের কাছাকাছিও আছে অনেকগুলো। তাদের কাছে না গিয়ে এতদূরে অশোকবাবু এলেন কেন?”

“হয়তো এদিকে কারোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন,” আমি বললাম।

“পসিবল স্যার, কিন্তু প্রবাবল নয়। সত্যিই যদি টাকার জন্যে স্ট্যাম্প চুরি করে থাকেন, তাহলে সেই দামি স্ট্যাম্প সঙ্গে নিয়ে নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি করবেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।”

“আপনি কী বলতে চান?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“হয়তো আমরা ভুল দিকে এগোচ্ছি স্যার। যিনি স্ট্যাম্প বিক্রি করতে এসেছিলেন, তিনি অন্য লোক। এই স্ট্যাম্পের সঙ্গে অশোকবাবুর কোনও সম্পর্কই নেই।”

“দাঁড়ান দাঁড়ান, তা কী করে সম্ভব! দোকানদার তাহলে অশোকের নাম করল কেন?” আমি অবাক হয়ে বললাম।

“আই হ্যাভ নো ফ্লু স্যার, আই অ্যাম টোটালি কনফিউসড।”

“তার মানে তো আপনি ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান,” প্রমথ বলল। “যেই তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই আছেন।”

“তাই তো দাঁড়াচ্ছে স্যার।”

“তাহলে এখন কী করবেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“দেখি স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে যদি কোনও খবর পাই।”

“আর কী খবর দেবেন?”

“উনি খোঁজ নিচ্ছেন নিউ ইয়র্কের স্ট্যাম্প ডিলারদের কেউ দিন পনেরোর মধ্যে এই সিন্ধ ডাক স্ট্যাম্প কেনাবেচা করেছে কিনা।”

‘যদি করে থাকে?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“বেচাকেনার ব্যাপারটা ১৩ তারিখে আগে হলে তিনি অশোক, পরে হলে অশোকের খুনি।”

“তার মানেটা কী দাঁড়াল? সিন্ধ ডাক স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে যে ফিলাটেলিস্ট কর্নারে এসেছিল, সে অশোক নয়, অশোকের খুনি? তাই বলতে চান?”

একেনবাবু নির্বিকার ভাবে বললেন, “জানি না স্যার, কারণ কবে এসেছিলেন সেই ডেটা পয়েন্ট মিসিং। কিন্তু ভেরি কনফিউসিং।”

“ফটোটার কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? বিপাশা তো ফটোটার কথাই বলেছিল, স্ট্যাম্পের কথা নয়। ছবিটা যদি স্টাইচেনের হয়, তাহলে তো লক্ষ লক্ষ ডলারের ব্যাপার!” আমি বললাম।

“তাও ঠিক স্যার।”

“তাহলে?”

“সেটা আরেকটা কনফিউইসিং ব্যাপার স্যার। স্টাইচেনের ছবির দাম এখন হয়তো অনেক হতে পারে, কিন্তু ত্রিপুরার মহারাজ যখন ওটা বিপাশা মিত্রের ঠাকুরদার বাবাকে দিয়েছিলেন, তখন তার দাম কি এত ছিল? রঙিন ছবি তো অনেকেই তুলতেন সেকালে। চিঠিতে ‘একটা অমূল্য ধন পাঠালাম’ লিখলেন কেন?”

“ওই চিঠিটা হয় তো একটা ঠাট্টা,” আমি বললাম। “কথাটা মহারাজ হয়তো মজা করেই লিখেছিলেন। আমরা সেটা নিয়ে এত অ্যানালিসিস করছি দেখে উনি স্বর্গে বসে হাসছেন।”

“এটা মোক্ষম বলেছেন স্যার, চিঠিটাকে বেশি ভ্যালু দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু স্ট্যাম্প আর ফটোটা স্যার ফেলনা নয়। ওগুলো যদি দামি হয়, তাহলে চিঠিতে যাই লেখা থাকুক ওগুলো দামিই থাকবে।”

“মানছি, কিন্তু স্ট্যাম্পের ব্যাপারে যদি বা কিছু লিড পেয়েছি, ফটোর ব্যাপারে তো কিছুই পাওয়া যায়নি?”

“তা যায়নি স্যার।”

“আমার একটা নতুন চিন্তা মাথা এসেছে,” প্রমথ ঘোষণা করল।

“কী স্যার?”

“অশোকের খুনি অশোককে খুন করতে চায়নি, চেয়েছিল বাপিকে খুন করতে। দেবরাজবাবু বললেন না, বাপির মতো চেহারা ছিল অশোকের? বাপি ছাত্রদের যেরকম আজেবাজে গ্রেড দেয়, ওর তো শত্রুর অভাব থাকা উচিত নয়। আপনি সেই অ্যাঙ্গেল থেকে ব্যাপারটা দেখুন।”

“আপনি না স্যার, সত্যি!” একেনবাবু বেশ অ্যামিউজড স্বরে বললেন।

আমি প্রমথকে ধমকে বললাম, “আজেবাজে না বকে, একটু সিরিয়াস হ।”

তারপর বেভের সঙ্গে আমার সকালের কথাবার্তা জানিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “একবার এই মিশেলের সঙ্গে কথা বলতে চান?”

“আমি বেভের সঙ্গেও কথা বলতে চাই, খাসা চেহারা মেয়েটার, প্রমথর উত্তর।

“চ্যাংড়ামি করিস না! কি একেনবাবু, বেভকে বলব?”

“বলুন না স্যার, ক্ষতি তো কিছু নেই। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলা হয়নি, ম্যাডাম ক্যাথি ক্যাসেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি মিস্টার ক্যাসেলের মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের একটু সাহায্য চান।”

“কী সাহায্য?”

“সত্যি কথা বলতে কি স্যার, ওঁর কথা পরিষ্কার বুঝলাম না। মনে হয় ভোকাল কর্ডের কোনো সমস্যা আছে। যাই হোক, কাল বিকেলে পাঁচটা নাগাদ ওঁর কাছে যাব বলেছি। ম্যাডাম একটা ঠিকানা বললেন, ধরতে পারলাম না। তবে সতীশবাবু, মানে মিস্টার সতীশ কুমার এর মধ্যে ফোন করে সব ডিটেলস দিয়ে দেবেন বললেন। আপনারা পারবেন আসতে?”

.

১৩.

মঙ্গলবার মে ২৪, ২০১১

ঘুম থেকে উঠে দেখি, একেনবাবু কোথাও বেরিয়েছেন। প্রমথকে জিজ্ঞেস করতেই খ্যাঁকখেঁকিয়ে উঠল, “আমি কি একেনবাবুর গার্জেন, কোথায় যাচ্ছেন, না-যাচ্ছেন তার খবর রাখব?”

“কী ব্যাপার, সাত সকালে মেজাজটা এত গরম কেন?”

“দেখবি আয়,” প্রমথ আমায় টেনে নিয়ে কিচেনে গেল। “দেখছিস?”

কী দেখাতে চায় মাথায় ঢুকল না। “কীসের কথা বলছিস?”

“চিনির কৌটোটা!”

চীনেমাটির কৌটোটা অক্ষত অবস্থাতেই আছে, চিনিও রয়েছে সেখানে।

“ঠিকই তো আছে,” আমি বললাম।

“চামচটা তোল।”

চামচটা তুলতেই প্রমথর অসন্তোষের কারণ স্পষ্ট হল। চামচের মুখে একগাদা চিনি লেপটে আছে। একেনবাবু চায়ে চিনি দিয়ে ঘেঁটে সেই চায়ে-ভেজা চামচটাই আবার চিনির কৌটোতে ঢুকিয়ে রেখেছেন! চা ঘাঁটার জন্যে অন্য চামচ ব্যবহার করেননি। প্রমথর কাছে এটা সিম্পল কেস অফ নেগলিজেন্স নয়, একটা ফেডারেল ক্রাইম।

“বার বার বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, আমি কফি বানাচ্ছি’। না, আমার তাড়া আছে’ বলে নিজে ওস্তাদি করে কফি বানালেন আর দেখ তার পরিণাম।”

“ঠিক আছে, আমি চামচটা ধুয়ে দিচ্ছি।”

“থাক, আমিই ধুচ্ছি। কফি খাবি?” প্রমথ কফি মেকারে জল ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস করল।

“খাওয়ালেই খাব। তা, একেনবাবুর ওঁর তাড়ার কারণ নিয়ে কিছু বললেন?”

“পরিষ্কার করে কি উনি কিছু বলেন? নিউ হেরিটেজ হোটেলে কী একটা কাজ আছে বলে ছুটলেন।”

“নিউ হেরিটেজ হোটেলে আবার কী কাজ?” আমি একটু অবাক হয়েই বললাম। “কোনও ফোন এসেছিল?”

“না।”

“কখন ফিরবেন কিছু বলেছেন?”

“না। এখনও মোবাইল ফোন কেনেননি, সুতরাং কন্ট্যাক্ট করারও উপায় নেই। যাই বলিস, জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপর আমার একটু আস্থা ডেভলাপ করছে। শনির দশাই চলছে ওঁর, মাথাটা একেবারে গেছে! কালকে কি রকম সব উলটো-পালটা কনশান করছিলেন দেখেছিলি?”

আমি অবশ্য মনে করতে পারলাম না কোন কনকুশনের কথা প্রমথ বলছে, কিন্তু এ নিয়ে এখন তর্ক শুরু করার কোনও মানে হয় না। কফি খেয়ে আমি স্নান করতে চলে গেলাম।

স্নান করে বেরিয়ে দেখি প্রমথ কলেজ চলে গেছে। আরেক কাপ কফি নিয়ে একমাস ধরে যে পেপারটা লেখার চেষ্টা করছি সেটা নিয়ে বসলাম। এটা কেউ পড়বে কিনা, বা পড়ে উপকৃত হবে কিনা সেটা বলতে পারব না। তবে এটা জানি, না লিখলে আমার ক্ষতি হবে। ইউনিভার্সিটিতে চাকরি বজায় রাখতে গেলে সায়েন্টিফিক জার্নালে দুয়েকটা পেপার প্রতি বছর বার করতেই হবে, নো চয়েস। লেখাটা নিয়ে লড়াই করতে করতে প্রায় এগারোটা বাজল, কিন্তু কিছুই বিশেষ এগোলো না। “ধুত্তোর বলে যখন কলেজ যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, একেনবাবু এসে হাজির।

“কোথায় গিয়েছিলেন সাত-সকালে?”

“দেবরাজবাবুর সঙ্গে দেখা করতে।”

“এত সকালে?”

“কী করব স্যার, উনি বললেন ন’টার সময় একটা মিটিং-এ যাবেন। সেখান থেকে সোজা বস্টন না কোথায়।”

“কী এমন জরুরি ব্যাপার ছিল আপনার?”

“কয়েকটা জিনিস ক্ল্যারিফাই করলাম স্যার।”

“যেমন?”

“অশোকবাবু ওঁর কাছে টাকা অ্যাডভান্স চেয়েছিলেন কিনা, অশোকবাবুর পার্সোনাল রেকর্ড দেখা যায় কিনা–এইসব আর কী।”

“উত্তর পেলেন?”

“হ্যাঁ স্যার। ইন্দ্রবাবু ঠিকই বলেছিলেন। তবে দশ হাজার নয়, আট হাজার ডলার অ্যাডভান্স চেয়েছিলেন দেবরাজবাবুর কাছ থেকে। ইন্দ্রবাবুও এ নিয়ে তদবির করেছিলেন অশোকবাবুর হয়ে। যেদিন অশোকবাবু মারা যান, সেদিন বিকেলে দেবরাজবাবু অশোককে জানিয়েছিলেন টাকাটা দেবেন। কিন্তু অফিস থেকে নয়, পার্সোনাল লোন হিসেবে। অফিস থেকে এই ভাবে অ্যাডভান্স দিলে, অনেকেই অ্যাডভান্স চেয়ে বসবে। একজনকে দিলে অন্যজনকে ‘না’ বলা যাবে না।”

‘ইন্টারেস্টিং,” আমি বললাম। “ইন্দ্র বলেছিলেন দশ হাজার, কিন্তু দেবরাজ বলছেন আট হাজার। তফাৎটা কেন?”

“হু নোজ স্যার। যাইহোক, অশোকবাবুর পার্সোনেল রেকর্ডের ফাইলটা দেখলাম। ওঁর বাবার ঠিকানা আর ফোন নম্বর টুকে এনেছি। অশোকবাবুর পিসতুতো দিদির ফোন নম্বরও রেফারেন্স হিসেবে রেকর্ডে ছিল। আরেকটা জিনিস রেকর্ডে ছিল সেটা হল, ওঁর কী কী হবি, তার লিস্ট। সেই লিস্টে রিডিং রিলিজিয়াস বুকস আর ফটোগ্রাফি ছিল।”

“ফটোগ্রাফি, দ্যাটস ইন্টারেস্টিং।”

একেনবাবু উত্তরে কিছু বললেন না। তবে দেখে মনে হল, খবরগুলো জোগাড় করে। বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন।

“কত বয়স হয়েছিল ওঁর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“মাত্র ৩৬ বছর। সো স্যাড স্যার–ডায়েড ইন দ্য প্রাইম অফ হিস লাইফ।”

“সত্যিই স্যাড।”

“কিন্তু এই তো জীবন, স্যার–আসে আর যায়!” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিলসফিক্যাল কমেন্ট করলেন একেনবাবু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখন কলেজ যাচ্ছেন স্যার?”

“হ্যাঁ, একটার সময় একটা মিটিং আছে।”

“যান স্যার, যান। আমি একবার তিনটে নাগাদ হয়তো আপনার অফিসে আসব।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বললেন, “দেবরাজবাবু সস্তায় নীলা পাবার একটা সোর্স দিয়েছেন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কিছু কিনতে চাই না।”

“তার জন্যে অফিসে আসতে হবে কেন? বাড়িতে ফিরে আসার পরেও তো আলোচনা করতে পারেন!”

“না স্যার, সাড়ে তিনটের সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দেবব্রজবাবুই করে দিয়েছেন। একশো পঁচিশ ডলারে জেনুইন নীলা, সাইজ অবশ্য ছোটো।”

“কিনে ফেলুন, এতে এত ভাবার কি আছে?”

“ঠিক আছে স্যার, কিন্তু তাও একবার আসব। তারপর তো ম্যাডাম ক্যাথি ক্যাসেলের কাছে যেতে হবে। আপনি আসছেন তো?”

“দেখি।“

“দেখি, আবার কী স্যার! আপনি না এলে কী করে চলবে? প্রমথবাবুর কী একটা কাজ আছে, উনি আসবেন না।”

“ঠিকানাটা পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ স্যার, সতীশবাবু দিয়েছেন। এই দেখুন,” বলে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন।

ওয়েবার অ্যাভেনিউয়ে ‘গোল্ডেন লজ’ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। ওয়েবার অ্যাভেনিউ নিউ ইয়র্ক সিটিতেই, কিন্তু ম্যানহাটানে নয়– ব্রঙ্কসে। জায়গাটা মোটামুটি কোথায় জানা ছিল। ট্রেন বা বাসে যেতে গেলে একাধিক বার চেঞ্জ করতে হবে।

“ওখানে তো গাড়ি নিয়েই যেতে হবে মনে হচ্ছে।”

একেনবাবু চুপ করে রইলেন। আমাকে সঙ্গে নেবার প্রয়োজনীয়তা এবার স্পষ্ট হল।

.

১৪.

অফিসে ঘরে ঢুকে দেখি রামসুন্দর রেড্ডী আমার ঘরে বসে আছে।

“আরে তুমি, কী খবর?”

“হেলেন বলল একটার সময়ে তোমার একটা মিটিং আছে, হয়তো এখনই চলে আসবে। ভাবলাম একটু অপেক্ষা করেই যাই, দেখা হয়ে যাবে।”

আমি টেবিলে ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললাম, “ভালো করেছ। আছ কেমন? অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই।”

.

রামসুন্দর আমার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এসে বলল, “কিশোর রাও তো তোমার বন্ধু, তাই না?”

“একসঙ্গে পড়েছি, কেন বল তো?”

“ও সুইসাইড করতে চলেছে, তোমার ঠেকানো উচিত।”

“সুইসাইড?”

“হ্যাঁ, শুনলাম ও নাকি বেভকে প্রোপোজ করেছে।”

“ইট ইজ নিউজ টু মি, তুমি জানলে কী করে?”

“আই হ্যাভ মাই সোর্সেস, কিন্তু সেটা আন-ইম্পর্টেন্ট। ইট মাস্ট বি স্টপড।”

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? হোয়াই শুড ইট বি স্টড? একজন প্রেম করে যদি কাউকে বিয়ে করতে চায়, তাতে আমরা বাধা দেবার কে? আর দিলেও বা সে শুনবে কেন?”

“হি উইল বি রুইনড, সেইজন্যে।”

রামসুন্দরের মুখের অবস্থা দেখে আমার প্রায় হাসি পেয়ে গেল। আমি বললাম, “শোন, রামসুন্দর, তোমার সাবধানবাণী আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। যদিও কাল বেভের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, বাইরে থেকে যাই মনে হোক, আসলে বেশ সহজ আর খোলামেলা মনের মেয়ে।”

“ও, তার মানে তোমাকেও ও মজিয়েছে,” বেশ তিক্তভাবেই রামসুন্দর কথাটা বলল।

ওর বলার ধরণটা আমার ভীষণ বাজে লাগলো, আমিও একটা কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, তখন বাইরের থেকে দরজায় কেউ টোকা দিল।

দরজা খুলে দেখি বেভ। রামসুন্দর আর কোনও কথা না বলে প্রায় হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বেভ বলল, “আই অ্যাম সরি, জেরাল্ড তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান, দরকারটা জরুরি।”

টেড জেরাল্ড আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড। আমার কয়েকটা ঘর পরেই ওর ঘর। ঘরে যেতেই টেড বলল, “সরি, তোমায় তাড়া দিয়ে নিয়ে এলাম। নেক্সট ইয়ারের মাস্টার রুটিন দু’দিন বাদে পাঠানোর কথা ছিল, এখন বলছে আজকেই তিনটের মধ্যে পাঠাতে হবে। তোমার জন্যে এই ক্লাসগুলো আছে। সই করে দাও, নইলে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হবে।”

চোখ বুলিয়ে দেখলাম, এমন কিছু অসুবিধার নেই, একটু আধটু সময়ের হেরফের করলে হয়তো সুবিধা হত, কিন্তু তারজন্যে টেডকে ক্ষিপ্ত করার কোনও মানে হয় না।

“ফাইন, আর কিছু?”

“নাথিং, থ্যাঙ্কস।”

.

ঘরে ঢুকতে যাব দেখি বেভ নিজের ডেস্ক থেকে উঠে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি ঘুরে বললাম, “আমার কিন্তু একটার সময় মিটিং আছে।”

“আই নো দ্যাট, আমি তোমার অফিস অ্যাসিস্টেন্ট না?”

“ইয়েস,” একটু হেসে ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

“এবার বলো যা বলতে চাও।”

বেভ প্রথমে দরজাটা বন্ধ করল। তারপর বলল, “আমি জানি, রামসুন্দর নিশ্চয় আমার সম্পর্কে অনেক যা-তা তোমায় আগে বলেছে…।”

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “তুমি কী করে জানলে?”

“ইভেন এ ডাম্ব অফিস অ্যাসিস্টেন্ট আন্ডারস্ট্যান্ডস, কেউ যদি চার মাস ধরে কাউকে অ্যাভয়েড করে!”

বেভের এই সোজাসাপ্টা অভিযোগের উত্তরে চট করে কোনও জবাব মুখে এল না। কিন্তু ধাক্কাটা কাটিয়ে বললাম, “দেখ, অফিসে তোমাদের প্রয়োজন আমার খুব অল্প, যেটুকু দরকার সেটা হেলেনই করে দেয়। তাই তোমায় অ্যাভয়েড করার প্রশ্ন উঠছে না।”

“ইউ আর ভেরি কাইন্ড,” বেভ নিচু গলায় বলল, “তোমাকে আমি রেস্পেক্ট করি, যদি কিছু শুনেও থাক কিশোরকে সেটা বলনি বলে।”

আমি আর বেভকে লুকোলাম না। রামসুন্দর শুধু বলেছিল, “তোমাকে এড়িয়ে চলতে, অন্য কিছু নয়।”

“কিন্তু ও অনেক কথা বলেছে অন্যদের, আমার রেপুটেশন ও রুইন করেছে। ইয়েস, আই অ্যাম প্লেফুল, মজা করতে ভালোবাসি, বাট আই অ্যাম নট চিপ, আই হ্যাভ ভ্যালুজ।” ক্ষোভে দুঃখে বেভের গলা প্রায় বুজে এল।

আমার মিটিং আরম্ভ হতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, তাও জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার উপর ওর এত রাগ কেন?”

“বিকস, আই রিফিউস্ট টু স্লিপ উইথ হিম।” বেভের চোখটা জ্বলে উঠল। “ওর ধারণা আমরা সাদা মেয়েরা সব স্লাল্স, হি মেড মি ড্রাঙ্ক, যাতে বাধা না দিতে পারি। বাট আই স্ন্যাপড় হিম।”

‘মাই গড!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“আজ লাঞ্চে একজন বলল, ও নাকি কাউকে দিয়ে কিশোরকে বলবে, আমায় বিয়ে করে দেশে বেড়াতে নিয়ে গেলে, হি উইল গেট বোথ অফ আস অ্যারেস্টেড… ওর বাবা নাকি ইন্ডিয়ার বিগ শট।”

“কীসের জন্য অ্যারেস্ট করবে?”

“তা জানি না। ওর বাবা পুলিশের একজন বিরাট অফিসার। একটা ফল্স চার্জ এনে জেলে পুরবে। আই নো তুমি বিজি, তোমার মিটিং আছে। এভাবে আমার পার্সোনাল প্রব্লেম বলে তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না।” ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। আর দেরি করা যাবে না, আমাকে এবার যেতে হবে। “দ্যাটস ওকে,” বলে দরজার দিকে এগোলাম। ওই দরজাটা খুলে দিল। বেরিয়ে যাবার আগে, নিজের অজান্তেই বেভের কোনুইটা ছুঁয়ে বললাম, “আই অ্যাম সো সরি টু হিয়ার অল দিজ।”

.

মিটিং-এর পরেও আটকা পড়লাম। দুয়েকটা লোক মিটিং শেষ হয়ে গেলেও ঘোঁট পাকাতে ভালোবাসে। তাদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে পেতে প্রায় তিনটে বাজল। ঘরে এসে দেখি একেনবাবু বসে আছেন।

“বুঝলেন, স্যার, প্রমথবাবুর সঙ্গে কথা বললাম। ভেবে দেখলাম নীলা-ফিলা না কেনাই ভালো।”

“এত উত্তম কথা।”

“আসলে কী জানেন স্যার, আমার ফ্যামিলি এগুলো ভীষণ মানে।”

“আপনি মানেন না?”

“আমি মানি না বলব না স্যার, তবে কিনা অতটা মানি না। আর ভাগ্যে কিছু থাকলে নীলা কি আর আটকাতে পারবে?”

“এটাও খাঁটি কথা। তা বউদিকে কী বলবেন?”

“সেটাই সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রমথবাবু তার সমাধান করে দিয়েছেন।”

“কী সমাধান?”

“ওঁর ল্যাবে আর্টিফিশিয়াল নীলার একটা ছোট্ট টুকরো ছিল, সেটা আমায় মানিব্যাগে রেখে দিতে বললেন। সুতরাং ফ্যামিলিকে নিশ্চিন্ত করতে পারব।”

“বাঃ, প্রব্লেম মিটল আবার পয়সাও তো বাঁচল।”

“তা বাঁচল স্যার, আবার ঠিক বাঁচলও না।”

“তার মানে?”

“প্রমথবাবু একটা কন্ডিশনে নীলাটা দিয়েছেন। আমাকে মোবাইল ফোন কিনতে হবে। উনিই তার ব্যবস্থা করবেন। যাই হোক স্যার, নীলা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না এতেই আমি খুশি। ওটার জন্যেই কিছুতে কনসেন্ট্রে করতে পারছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে মাথাটা ক্লিয়ার হতে শুরু করেছে।”

“সেটা তো চমৎকার কথা, কী মনে হচ্ছে?”

“আপনাকে তো বলিনি স্যার, আজ সকালে যখন দেবরাজবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন ইন্দ্রবাবুর সঙ্গে আবার দেখা হল। ওঁর কাছ থেকে সীমা শ্রীমালী এখন কোথায় কাজ করেন জানলাম।”

“সীমা শ্রীমালী? সে আবার কে?”

“কী মুশকিল, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন স্যার? অশোকবাবুর এক্স-গার্লফ্রেন্ড যাঁর কথা ইন্দ্রবাবু সেদিন বললেন। সেদিনই আমার ঠিকানাটা নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু বলছিলাম

স্যার, মাথাটা কাজ করছিল না। মিস সীমা নিউ হেরিটেজ হোটেল ছেড়ে এখন অ্যাম্বাসেডর হোটেলে কাজ করছেন।”

“অ্যাম্বাসেডর হোটেল তো কাছেই।”

“এক্সাক্টলি স্যার। তাই খানিকক্ষণ আগে ওখানে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। আই ওয়াজ লাকি স্যার, মিস সীমা তখন ওখানেই ছিলেন। বেশিক্ষণ অবশ্য কথা বলতে পারিনি, ব্যস্ত ছিলেন। তারমধ্যে যা উদ্ধার করলাম, ওঁদের ছাড়াছাড়িটা হয়েছিল অশোকবাবুর জন্যেই। মাস পাঁচেক আগে মিস সীমার মা যখন এদেশে বেড়াতে এসেছিলেন, অশোকবাবুকে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। অশোকবাবুও ওয়াজ এ হ্যাপি এন্ড জলি পার্সন। কিন্তু মিস সীমার মা দেশে চলে যেতেই অশোকবাবুর ব্যবহার ভীষণ কোল্ড হয়ে গেল। ইট কুড ভেরি ওয়েল বি যে, ইন্দ্রবাবু আর তার ফ্রেন্ডস্রা এর জন্যে দায়ী। ইন্দ্রবাবু সেদিন পরিষ্কার বলেননি, কিন্তু ইন্দ্রবাবুর বাড়িতে যে পোকারের আসর বসত, সেটা এক-পয়সা দু-পয়সার ফ্রেন্ডলি পোকার গেম নয়, মোটা টাকার বাজি ধরে ওরা খেলত। মিস সীমা দুয়েকবার অশোকবাবুর অ্যাপার্টমেন্টে বেড়াতে গিয়ে এসব দেখে খুব আপসেট হয়েছিলেন। আরও আপসেট হয়েছিলেন যখন শুনলেন অশোককেও ওঁরা দলে ভেড়াবার চেষ্টা করছেন। অশোকবাবুকে মিস সীমা বলেছিলেন ইন্দ্রবাবুকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলতে। কিন্তু অশোকবাবু রাজি হননি। মিস সীমার ধারণা অশোকবাবু মাঝে মাঝে ইন্দ্রবাবুকে টাকাও ধার দিয়েছেন পোকারের দেনা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে। আরও বললেন, এড গুয়ান্সিয়াল লোকটা মোটেই সুবিধার নয়।”

“কেন?”

“কেন তা বুঝলাম না স্যার। তবে মিস সীমার লোকটাকে খুবই অপছন্দ। ওই নাকি পোকারের নেশা ধরিয়েছিল সবার। যাই হোক মিস সীমা ভয় পাচ্ছিলেন, অশোকবাবুও হয়তো ওদের খপ্পরে পড়বেন। তাই আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন মা চলে গেলেই ইন্দ্রবাবুকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর, নইলে অশোকবাবুর বাড়িতে উনি যাবেন না। হয়তো তাতেই অশোকবাবুকে বিগড়ে গিয়ে সীমাকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করেন। মিস সীমা তাও সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন, শেষে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেন। অ্যাম্বাসেডর হোটেলে চলে আসার পর অশোকবাবুর ফোন মাঝে মধ্যে পেয়েছেন, কিন্তু মিস সীমা সাড়া দেননি। দায়সারা গোছের মামুলি কথাবার্তা হয়েছে, এইটুকুই।”

“ইন্টারেস্টিং। অর্থাৎ প্রথমে সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন সীমা, পরে আবার সে চেষ্টাই করছিলেন অশোক।”

“আসলে ভালোবাসা যখন চলে যায় স্যার, তখন যেটা থেকে যায়, সেটা হল তিক্ততা। মিস সীমা বেশ কয়েকবার বললেন, “অশোক ওয়াজ ওয়ান্স এভরিথিং টু মি, বাট নট এনি মোর। এরপর স্যার, আর কিছু বলার থাকে না। তাও আমি একবার মিস সীমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইন্দ্রবাবুকে তাড়াতে বলাই কি ওঁর পালটে যাবার একমাত্র কারণ, না আর কিছু থাকতে পারে?” ওঁর উত্তর, ‘অল আই ক্যান সে, সামথিং ওয়াজ নট রাইট উইথ হিম, নট শিওর হোয়াট ইট ওয়াজ।”

“এটা কতদিন আগের ব্যাপার?”

“ভেরি রিসেন্ট, স্যার। মিস সীমা অ্যাম্বাসেডর হোটেলে এসেছেন মাস দুই হল মাত্র।”

“আপনি একটু আগে বললেন, সীমার মা এসেছিলেন মাস পাঁচেক আগে। নিশ্চয় কিছুদিন ছিলেন মেয়ের কাছে। তখন পর্যন্ত অশোকবাবু যদি ফাইন থেকে থাকেন, তাহলে

তো পোকারের ব্যাপারটাই মনে হচ্ছে এই ব্রেক-আপটার মূলে।”

“তাই তো দাঁড়াচ্ছে স্যার, তবু শিওর হওয়া দরকার।”

“বুঝলাম, কিন্তু সেটা হবেন কী করে?”

“ইন্দ্রবাবু তো বটেই, কিন্তু আরও কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলা দরকার স্যার, যাঁরা অশোকবাবুকে চিনতেন। এই দেখুন না, মিস সীমার সঙ্গে দেখা না হলে একটা ইম্পর্টেন্ট জিনিস মিস করে যেতাম। ও আরেকটা জিনিস মিস সীমা বললেন, যেটা ওঁর কাছে ভেরি কনফিউসিং।”

“কী?”

“অশোকবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন বিকেলে উনি মিস সীমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। সীমাকে পাননি, কিন্তু ভয়েস মেল-এ একটা মেসেজ রেখেছিলেন। মেসেজটা ছিল—‘তুমি বিশ্বাস করবে না, আজ কী হয়েছে! আই ‘হিট দ্য জ্যাকপট’! ফোন কোরো। মিস সীমা সেদিন মেসেজ চেক করেননি। যখন চেক করলেন, অশোকবাবু আর নেই। ইনফ্যাক্ট স্যার, মিস সীমা জানতেনও না যে অশোকবাবু টাকা নিয়ে সমস্যায় ভুগছিলেন।”

“ইন্টারেস্টিং,” আমি বললাম, “এখন তো মনে হচ্ছে স্ট্যাম্পটা অশোকই চুরি করেছিলেন। যখন স্ট্যাম্পটা সরিয়েছিলেন তখন তার আসল মূল্য বোঝেননি। যখন জানতে পারলেন, তখন ‘হিট দ্য জ্যাকপট’ই বটে।”

“সেটাই তো মনে হচ্ছে স্যার, অন্য কোনও এক্সপ্লানেশন যদি না থাকে।”

“আরেকটা এক্সপ্লানেশন থাকতে পারে। উনি পোকার খেলতে বসে বিগিনার্স লাকে বিরাট অঙ্ক জিতেছিলেন। ইন্দ্রবাবু ওঁর জেতার কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু এক পয়সা দুপয়সার খেলা বলে কথাটায় কেউ আমল দিইনি।”

“কিন্তু ইন্দ্রবাবু তো বলেছিলেন সেটা দিন কুড়ি আগের ঘটনা!”

“ইন্দ্রবাবু যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সেটা ধরছেন কেন? মনে নেই উত্তরটা দিতে ওঁর একটু ইতস্ততঃ ভাব ছিল।”

“না স্যার, ওটা এক্সপ্লানেশন হতে পারে না। জিতে থাকলেও সেটা অন্তত এক সপ্তাহ আগের ব্যাপার। বৃহস্পতিবার বিকেলে খবরটা মিস সীমাকে দেবেন কেন?”

“দ্যাটস ট্রু,” এই সিম্পল জিনিসটা খেয়াল করিনি ভেবে একটু লজ্জিতই হলাম।

“পুরো ব্যাপারটাই কনফিউসিং,” চোখটা বুজে অস্পষ্ট স্বরে একেনবাবু বললেন।

“আমার আরেকটা একটা জিনিস মনে হচ্ছে যার সঙ্গে পোকার বা গ্যাম্বলিং কোনো কিছুরই সম্পর্ক নেই।”

“কী স্যার?”

“মনে আছে ইন্দ্র বলেছিলেন, সীমা বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছিলেন বলে অশোক পিছিয়ে গিয়েছিলেন?”

“নিশ্চয় আছে স্যার।”

“কেন পিছিয়ে গিয়েছিলেন?”

“কে জানে স্যার, হয়তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ফাঁদে পা দিতে চাননি।”

“ফিজিক্যাল কোনও প্রব্লেম থাকতে পারে কি, যেমন ইম্পোটেন্সি?”

“বিচিত্র কিছুই নয় স্যার।”

“অন্য কারণও থাকতে পারে। দ্য প্রব্লেম কুড ভেরি ওয়েল বি হিজ সেক্সয়াল ওরিয়েন্টেশান। সম্ভবত ইন্দ্র আর অশোক শুধু বন্ধু ছিল না, ওদের সম্পর্ক ছিল আরও অনেক প্রাইভেট। সুতরাং ইন্দ্রকে তাড়ানো বা সীমাকে বিয়ে করা দুটোই আউট অফ কোয়েশ্চেন। কিন্তু এটা সীমাকে কী ভাবে জানাবে, সেটা অশোক বুঝতে পারছিল না।”

আমার এইসব কনকুশানের অবশ্য কোনো ভিত্তি নেই। বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম। একেনবাবু কিন্তু আপত্তি তুললেন না। “ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার, ভেরি গুড পয়েন্ট। অশোকবাবু সম্পর্কে আরও জানতে হবে। কার সঙ্গে কথা বলা যায় বলুন তো?”

“বেভের আন্ট মিশেলের কাছে একবার যেতে চান? আমি বেভকে অলরেডি একটা হিন্ট দিয়ে রেখেছি।”

“হ্যাঁ, স্যার, সে কথাই তো কাল হয়ে গেল।”

“তাহলে ওকে বলে একটা টাইম ঠিক করি। ভালোকথা, বেভ একটু আগে আপনার ইন্ডিয়ান কলিগদের খুব নিন্দা করছিল।”

“কোন কলিগ?”

আমি রামসুন্দর রেড়ীর গল্পটা করে, সে যে তার পুলিশ বাবাকে দিয়ে বেভকে অ্যারেস্ট করাবার ভয় দেখাচ্ছে সেটা বললাম।

“একজন আই.জি রেড্ডীকে আমি চিনতাম স্যার, অন্ধ্রপ্রদেশের। ঘুষখোর বলে বেশ দুর্নাম ছিল। কিন্তু যাই বলুন স্যার, ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসরের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার কল্পনা করা যায় না। অ্যাটেম্পটেড রেপ স্যার, মিস বেভ ফর্মালি কমপ্লেন করলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হবে।”

“নাও হতে পারে। এ বলবে এক কথা, ও বলবে আর এক কথা।”

“এদেশে এরকম অভিযোগ মিছিমিছি একজন লেডি করবেন কেন স্যার?”

“আপনিই তো বলেন, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। চলুন, বেভের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”

.

একেনবাবুকে নিয়ে বেভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

“এঁর কথাই তোমাকে বলছিলাম। ইনিই অশোকবাবুর মার্ডার নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছেন।”

বেভ হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “প্লিজ টু মিট ইউ।”

মেয়েদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে একেনবাবু গলদঘর্ম হন। “মি টু ম্যাডাম, মি টু ম্যাডাম’, বলে কোনও মতে সেটা সারলেন।

“তুমি তো আজ তোমার আন্টের কাছে যাচ্ছ, তাই না?” আমি বেভকে জিজ্ঞেস করলাম।

“ইয়েস, হাউ ডু ইউ নো?”

“কিশোর বলেছে। যাই হোক, ওঁকে কিন্তু একবার জিজ্ঞেস করে নেবে, আমরা যদি ওঁকে অশোক দুবে সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করি, ওঁর আপত্তি আছে কিনা?”

“আমার সঙ্গে একটু আগেই আন্টি মিশেলের কথা হয়ে গেছে। তোমরা কবে যাবে বল?”

“কালকে বিকেলে হবে না, পরশু বিকেল বা সন্ধ্যা হলে কেমন হয়? আপনি কি ফ্রি পরশু?” আমি একেনবাবুকে প্রশ্ন করলাম।

“আমি তো ফ্রি। কিন্তু প্রমথবাবু যদি না পারেন?”

“প্রমথকে আমি ম্যানেজ করব।”

বেভকে বললাম, “পরশু পাঁচটা নাগাদ আমরা যেতে পারি– যদি সেটা ওঁর পক্ষে কনভিনিয়েন্ট হয়।”

“বেশ আমি পরশুর কথাই বলব।”

বেভকে ধন্যবাদ জানিয়ে একেনবাবুকে বললাম, “এখন চলুন, ক্যাথি ক্যাসেলের কাছে যাওয়া যাক। আর দেরি করলে সময় মতো পৌঁছতে পারব না।”

.

১৫.

ক্যাথি ক্যাসেলের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ওয়েবার অ্যাভেনিউ যেখানে শেষ হয়েছে তার একটু আগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের থাকার জন্যে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। এ ধরণের জায়গায় আগে কখনো আসিনি। সতীশ কুমার একেনবাবুকে বলেছিলেন উনি লবিতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন। মিসেস ক্যাসেলের কথা বলতে একটু অসুবিধা হয়। তাই সতীশকেও উনি আসতে বলেছেন। কিন্তু আমরা যখন পৌঁছলাম সতীশ তখনও এসে পৌঁছোননি। তাই অপেক্ষাটা আমরাই করলাম। লবিতে যে রিসেপশনিস্টটি বসেছিল, বেশ হাসিখুশি মেয়ে। তার সঙ্গে কথা বলে গোল্ডেন লজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এখানকার বাসিন্দাদের কাউকে রান্না করতে হয় না, ভাড়ার মধ্যে থাকা খাওয়া দুটোই থাকে। একটা বড় রেস্টুরেন্ট আছে, প্রতিদিন সেখানে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ আর ডিনার সার্ভ করা হয়। হাউজ কিপিং-এর লোক আছে। বাথরুম পরিষ্কার করা, ঘর ভ্যাকুয়াম করা, বিছানা তোলা, চাদর পালটানো, এমন কি লন্ড্রি করাও তাদের দায়িত্ব। সপ্তাহে দু’দিন বুড়োবুড়িদের গাড়ি করে দোকানে নিয়ে যাওয়া তো আছেই, এছাড়া বিল্ডিং-এর মধ্যেই বিনোদনের নানান বন্দোবস্ত লাইব্রেরি, এক্সারসাইজ করার জায়গা, পুল টেবিল, সুইমিং পুল, আর্টস এন্ড ক্র্যাফটস রুম, ইত্যাদি আছে। এখানে থাকতে কত লাগে সেটা অবশ্য মেয়েটি ঠিক জানে না। এইসব কথাবার্তার মধ্যেই সতীশ কুমার এসে গেলেন। সতীশ কুমার এখানে আগেও কয়েকবার এসেছেন। মেয়েটি দেখলাম ওঁকে চেনে।

.

মিসেস ক্যাসেল থাকেন বারোতলায় এক-বেডরুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে। ঘরের দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে অস্পষ্ট গলায় কেউ বললেন, “আসুন, দরজা খোলা।”

বসার ঘরটা আমাদের বসার ঘরের সাইজের মতোই হবে। একটা বড় জানলা। গদি অলা হালকা উইকার সোফাসেট আর কফি টেবিল। দেয়ালে লাগানো টিভি। তার নীচে একটা রাইটিং ডেস্ক ও বসার চেয়ার, পাশে মাঝারি সাইজের বুক-শেলফ। ফার্নিচারগুলো নতুন, বেশ সুন্দর করে সাজানো।

মিসেস ক্যাসেল একজন শীর্ণকায়া বৃদ্ধা। ফুট রেস্টে পা তুলে সোফায় বসে আছেন। সোফার পাশে একটা ওয়াকার। হাতে বই ধরা, কিন্তু দুটো হাতই থরথর করে কাঁপছে। মুখ-চোখ দেখে বোঝা যায় ভদ্রমহিলা বেশ অসুস্থ।

মিসেস ক্যাসেলের কথাগুলো বোঝা সত্যিই কঠিন। সতীশ থাকাতে সুবিধা হল। মাঝেমাঝেই ওঁর সাহায্য লাগছিল কথাবার্তার মর্মোদ্ধার করতে। যেটুকু বুঝলাম সেটা হল, মিসেস ক্যাসেল মাত্র ছ’মাস হল এখানে এসেছেন। আগে থাকতেন নিজের বাড়িতে, নিউ জার্সিতে। ছেলেও সেখানে থাকত। বছর দেড়েক আগে মিসেস ক্যাসেল খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিক কী অসুখ, সেটা অবশ্য স্পষ্ট করে জানতে পারলাম না। দুরারোগ্য এটুকু বুঝলাম। সেই অসুখের জেরে হাসপাতাল ও নার্সিং কেয়ারে বহুদিন থাকতে হয়েছিল। তার আকাশ ছোঁয়া বিল মেটাতে ওঁকে বাড়িটা বিক্রি করতে হয়। সঞ্চয় বলতে এখন কিছুই নেই। মাসে মাসে যা পান, সেটা হল সোশাল সিকিউরিটির টাকা। তাতে এখানে থাকা যায় না। বব ক্যাসেলই এখানে থাকার টাকাটা দিচ্ছিলেন। এখন সে ছেলে আর নেই। ছেলের মৃত্যুতে মায়ের তীব্র বেদনা তো আছেই, তার ওপর যোগ হয়েছে আর্থিক চিন্তা। এ ব্যাপারে একেনবাবু ঠিক কী করতে পারেন, সেটা আমার মাথায় ঢুকছিল না। সত্যিকারের সাহায্য যিনি করতে পারেন, তিনি হলেন বিপাশা মিত্র। একজন বৃদ্ধাকে ভরণপোষণ করাটা ওঁর কাছে কিছুই নয়। বিশেষ করে সেই বৃদ্ধা যখন ওঁর সেক্রেটারির মা। আমি সতীশ কুমারকে একটু নীচু স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম, “বিপাশা মিত্র কি ওঁর সমস্যার কথা জানেন?”

প্রশ্নটা মিসেস ক্যাসেলের কান এড়াল না। বললেন, “আই ডোন্ট ওয়ান্ট চ্যারিটি।”

একেনবাবু মিসেস ক্যাসেলকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ছেলের কোনও লাইফ ইন্সিওরেন্স ছিল না ম্যাডাম?”

“ছিল আর সেটাই হল প্রব্লেম।” উত্তর দিয়ে বৃদ্ধা সতীশকে বললেন, ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়ে বলতে। তারপর ওয়াকার ধরে টুকটুক করে হেঁটে বোধহয় বাথরুমে গেলেন।

সতীশ বললেন, “বব তিনশো হাজার ডলারের একটা লাইফ ইন্সিওরেন্স করেছিল বছর দুই আগে। ক্যাথি ছিল নমিনি। কিন্তু সেই টাকা ইন্সিওরেন্স কোম্পানি দিচ্ছে না।”

“কেন দিচ্ছে না স্যার?”

“কারণ ইন্সিওরেন্সটা করা হয়েছিল ২০০৯ সালের পয়লা জুলাই। ইন্সিওরেন্সের একটা ক্লজ ছিল, যেটা প্রায় সব ইন্সিওরেন্সেই থাকে। ক্লজটা হল যার লাইফ ইন্সিওরেন্স সে যদি দু’বছরের মধ্যে আত্মহত্যা করে, তাহলে ইন্সিওরেন্স কোম্পানি কোনও টাকা দেবে না। বব দু’বছর পার হবার আগেই মারা গেছে। পুলিশ বলছে সম্ভবত সুইসাইড। সুতরাং ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ন্যায্য অজুহাত আছে টাকা না দেবার।”

“আই সি স্যার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমি কী ভাবে ম্যাডামকে সাহায্য করতে পারি?

“আমি জানি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আপনার বিশেষ বন্ধু, সতীশ বললেন। “এই মহিলার কথা বিবেচনা করে তিনি যদি এটাকে হোমিসাইড বলে ইনভেস্টিগেট করেন। খুনি না হয় নাই ধরা পড়ল, কিন্তু সেক্ষেত্রে ক্যাথির সমস্যার সমাধান হয়।”

“সেটা আমি কী করে অনুরোধ করব স্যার, আর করলেও ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট এরকম অন্যায় অনুরোধ রাখবেন কেন?”

সতীশ কথাটা শুনে চুপ করে গেলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশ এটা সুইসাইড বলে ভাবছে কেন জানেন?”

“আমি যতটুকু জেনেছি একটা ফোনের মেসেজ থেকে।”

“কী মেসেজ স্যার?”

“ক্যাথি যখন নীচে ডিনার খেতে গিয়েছিলেন, তখন বব এখানে ফোন করে। মেসেজটা ছিল ‘আমাকে পাবে না, তোমার সব সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছি।”

“দ্যাটস লিটল স্ট্রেঞ্জ স্যার।”

“পুলিশ মনে করছে, এটাই ববের সুইসাইড মেসেজ। ইন্সিওরেন্সের টাকা ছাড়া কী করে সব সমস্যার সমাধান হয়? বব বোধহয় ভুলে গিয়েছিল ইন্সিওরেন্সের দু’বছরের ক্লজ এর কথা।”

“আই সি। আচ্ছা এখানে থাকা কি খুব খরচার ব্যাপার?”

“মাসে সাড়ে তিন হাজার ডলার।”

“সেটা কি স্যার মিস্টার ক্যাসেলের পক্ষে দেওয়া কঠিন ছিল?”

“নিশ্চয় কিছুটা, কিন্তু না দিতে পারার মতো নয়। মুশকিল হল এর পরেও চিকিৎসা সংক্রান্ত আরও অনেক খরচা আছে, যা ববের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হত না।”

“এদেশে তো সরকারের অনেক স্কিম আছে মেডিকেইড না কী সব?” আমি বললাম।

“তাতে এরকম জায়গায় থাকতে পারতেন না। মা কষ্ট করে থাকবে, সেটা ববের পক্ষে নেওয়াটা কঠিন হত। মাকে ভীষণ ভালোবাসত বব। বাইরে প্রকাশ করত না, কিন্তু এ নিয়ে ও খুবই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম।”

“আমি একটু কনফিউসড স্যার,” একেনবাবু বললেন, “কেন মিস্টার ক্যাসেল বললেন, আমাকে পাবে না।”

“ক্যাথি প্রত্যেক দিন ডিনার খেয়ে নিজের ঘরে এসে ববকে ফোন করত। সেইজন্যেই নিশ্চয়। যাই হোক, আমি ভেবেছিলাম আপনি সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু মনে হচ্ছে। পারবেন না। দেখি যদি বিপাশাকে বলে অন্যভাবে কিছু করতে পারি। মুশকিল হল ক্যাথি ইজ ভেরি অ্যাডামেন্ট অ্যাবাউট অ্যাকসেপ্টিং চ্যারিটি।”

“আই অ্যাম রিয়েলি সরি স্যার।”

“না, সরি হবার কি আছে। আসলে ক্যাথির দৃঢ় বিশ্বাস বব আত্মহত্যা করেনি। তাই আপনার কথা মনে হয়েছিল। আপনি হয়তো পুলিশকে অন্যভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করবেন। আপনি বলুন, পুলিশ কী করে শিওর হতে পারে এই একটা টেলিফোন মেসেজ থেকে যে বব আত্মহত্যা করেছে!”

“মিস্টার ক্যাসেলের কোনও শত্রু আছে বলে আপনি জানেন স্যার, যিনি ওঁকে খুন করতে পারেন?”

“মনে হয় না, হি লিভড এ ক্লিন লাইফ।” তারপর একটু থেমে বললেন, “যদ্দুর আমি জানি।”

“কতদিন আপনি চিনতেন স্যার মিস্টার ক্যাসেলকে?”

“প্রায় আট বছর।”

.

মিসেস ক্যাসেল আস্তে আস্তে ফিরে এসে সোফায় এসে বসলেন। একেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন।

“ম্যাডাম, আপনার ছেলের মৃত্যুর ব্যাপারে খোঁজখবর করব এই কথাটা দিচ্ছি। তার বেশি কিছু বলতে পারব না।”

মিসেস ক্যাসেল ঘোলাটে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন একেনবাবুর দিকে। তারপর বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ, আপনাকে কত দিতে হবে?”

“এই খোঁজখবরের জন্যে কিছু দিতে হবে না ম্যাডাম। আপনার ছেলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। খুব ভালো লোক ছিলেন। উই আর ট্রলি স্যাড ম্যাডাম।”

“আওয়ার কন্ডোলেন্সেস,” আমি বললাম।

সতীশ কুমারও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “চলুন আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।”

যখন আমরা নীচে নামছি, একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ম্যাডামের ওখানে এগুলো আলোচনা করতে চাইনি, কিন্তু যেটুকু জানি মিস্টার ক্যাসেল একটা হাইরাইজ বিল্ডিং থেকে নীচে পড়ে গিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ, আমাদের কোম্পানিরই একটা বিল্ডিং। উপরের তলাগুলোতে রিনোভেশন চলছে। বব মাঝে মাঝে ওখানে দেখভাল করার জন্যে যেত।”

“রবিবারও ওখানে কাজ হত স্যার?”

“না, তবে রবিবার গিয়ে কাজকর্ম কী রকম এগিয়েছে দেখার সুবিধা হত। বিপাশা অনেক সময় যেত, আমিও এক আধবার ববের সঙ্গে গিয়েছি।”

“রবিবার ওখানে কারা থাকত?”

“কেউই না। যে কেউ ওখানে ঢুকতে পারে না। সিঁড়ি তালা-বন্ধ থাকে। স্পেশাল চাবি ব্যবহার করে লিফটে ওই তলাগুলোতে পৌঁছনো যায়।”

“চাবিগুলো কার জিম্মায় থাকত স্যার?”

“বব আর বিপাশার কাছে।”

“কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লোকরা ওখানে যেত কী করে?”

“সার্ভিস এলিভেটর ব্যবহার করত। এলিভেটরগুলো রবিবার লন্ড থাকত।”

“বুঝলাম। আচ্ছা স্যার, অশোকবাবু আর মিস্টার ক্যাসেল বেশ বন্ধু ছিলেন তাই না?”

“হ্যাঁ, ওর মৃত্যুও ববকে বেশ অ্যাফেক্ট করেছিল। ইন ফ্যাক্ট, অশোক মারা যাবার পরের দিন সকালে পুলিশ এসে যখন ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও প্রায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল।”

“আপনাকে পুলিশ কোনও প্রশ্ন করেছিল?”

“প্রথমে করেনি। শুধু বব আর বিপাশাকে করেছিল। অশোকের সঙ্গেই ওদের যোগাযোগ ছিল বেশি।”

“তাহলে আপনাকে কেন করল স্যার?”

“পুলিশ জানতে চাইছিল অশোক যেদিন মারা যায় সেদিন রাতে বব আমার সঙ্গে কতক্ষণ ছিল।”

“কতক্ষণ ছিলেন স্যার?”

“প্রায় সাড়ে নটা পর্যন্ত।”

“আপনার বাড়িতে স্যার?”

“না, আমরা অফিসের কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে ডিনার খাচ্ছিলাম।” তারপর হঠাৎ সতীশ কুমারের কী মনে হল, বললেন, “একটা কথা পুলিশকে তখন আমি বলিনি– মনে হয়নি রেলেভেন্ট বলে।”

“কী কথা স্যার?”

“সাড়ে আটটা নাগাদ ডিনার খেয়ে যখন বেরোচ্ছি, তখন ববের খেয়াল হল ওর গাড়ির চাবি অফিসে ফেলে এসেছে। আমি আর উপরে উঠিনি। শুধু ওইটুকু সময়ই আমি ববের সঙ্গে ছিলাম না।”

“কতক্ষণ ছিলেন উনি উপরে?”

“তা প্রায় মিনিট দশেক।”

“আপনাদের লিফট তো খুব তাড়াতাড়ি ওঠে স্যার, অত সময় লেগে গেল শুধু চাবি আনতে?”

“ঠিকই বলেছেন, অত সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু ববকে তো আমি চিনি, উপরে গিয়ে শুধু চাবি নিয়ে আসার পাত্র সে নয়, নিশ্চয় আরও দুয়েকটা টুকিটাকি কাজ সারছিল। ফ্র্যাঙ্কলি, আমি একটু অধৈর্যই হয়ে পড়েছিলাম, উপরে যাচ্ছিলাম ওর খোঁজ করতে। তখন দেখি মেরি, মানে আমাদের যে অফিস পরিষ্কার করে– সে উপরে যাচ্ছে। তাকে বললাম ববকে তাড়া দিতে।”

“তার তাড়া খেয়েই নেমে এলেন?”

“এক্সাক্টলি। তবে বিপাশা অফিসে ছিল বলে বোধহয় সময়টা একটু বেশি লেগেছিল। নেমে এসেই বলল, ‘বেঁচে গেছি, বিপাশা কারোর জন্য অপেক্ষা করছে, মনে হল মেজাজটা ভালো নেই। নইলে হয়েছিল, আটকা পড়ে যেতাম। যাই হোক তারপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে ওর গাড়ির গ্যারাজ পর্যন্ত গেলাম। সেখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আকাহাশির সঙ্গে। গল্প করতে প্রায় সাড়ে ন’টা বেজে গেল। আমার টায়ার্ড লাগছিল। কয়েকটা ব্লক পরেই আমার অ্যাপার্টমেন্ট। আমি ওদের রেখে বাড়ি রওনা দিলাম। যখন একটু এগিয়েছি তখন মনে হল বব আর আকাহাশি তর্কাতর্কি করছে। দুজনেই বেশ উত্তেজিত। হয়তো ওদের কোনও পার্সোনাল ব্যাপার। আমিও ক্লান্ত ছিলাম, তাই দাঁড়ায়নি। বব এখন মারা গেছে বলেই কথাটা এখন মনে হচ্ছে।”

“মিস্টার ক্যাসেলের সঙ্গে মিস্টার আকাহাশির সম্পর্ক কী রকম ছিল স্যার?”

“একটু রাইভ্যালরি ছিল। সেটা ছিল বিপাশার জন্য। মাঝে মাঝে আমাদের মনে হত বিপাশা নিজের লোকেদের থেকে আকাহাশিকে বেশি ট্রাস্ট করে। বব বিপাশার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্টেন্ট বলে সেটা ওর বুকে বাজত বেশি করে।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা স্যার, সেদিন অশোকের কোনও প্রসঙ্গ ওঠেনি?”

“ও হ্যাঁ, আমরা যখন ডিনার খাচ্ছি, তখন বব বলল অশোক একটা ভয়েস-মেসেজ রেখেছে, কিন্তু ও মেসেজটা রিট্রিভ করতে পারছে না। এরকম এক আধ সময় হয় না, তা নয়। আমি বললাম অশোককে একটা ফোন করতে। বব বলল ‘কয়েকবার ধরার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাচ্ছে না। আমার সামনেও ফোন করল, কিন্তু ফোন বেজেই গেল। আমি ববকে বললাম, যদি কোনো ইম্পর্টেন্ট মেসেজ অশোক দিয়ে থাকে, তাহলে একবার দেবরাজকে ধরার চেষ্টা করো না?”

দেবরাজকে যদিও আমরা খুবই ভালো করে চিনি, কিন্তু এই ছোটোখাটো ব্যাপারে তাকে ফোন করতে বব দেখলাম ইতস্তত করছে। শেষমেশ করল। কিন্তু দেবরাজের ফোন সুইচড অফ। এছাড়া আর তো কিছু মনে পড়ছে না।”

“অশোকের মেসেজটা কী ছিল জানেন?”

“না, এ নিয়ে ববের সঙ্গে পরের দিন কোনো কথা হয়নি। তারপর তো পুলিশ এল। দুপুরে ববের বাইরে কাজ ছিল বেরিয়ে গেল। শনিবার ছুটি, আর রোববার তো দুঃসংবাদটা পেলাম।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আপনাকে আর আটকে রাখব না, আমরা চলি।”

যেতে যেতে হঠাৎ একেনবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন। সতীশ কুমার তখনো লবিতে দাঁড়িয়ে আছেন।

“আরেকটা প্রশ্ন স্যার, বিপাশা ম্যাডাম কি বিল-পেমেন্ট নিয়ে ঝামেলা করেন?”

“বিল পেমেন্ট নিয়ে?” সতীশ কুমার প্রশ্নটাতে দেখলাম বিস্মিত। “সে রকম তো কিছু শুনিনি!”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, প্রশ্নটা করা আমার উচিত হয়নি।”

গাড়িতে উঠতে না উঠতেই মোবাইলটা বাজলো। প্রমথর ফোন। এখানে কী হল তার রিপোর্ট শেষ করার আগেই দেখি একেনবাবু ঘুম লাগিয়েছেন।