২৪. সুড়ঙ্গটা এঁকেবেঁকে

ছুটিতে-ছুটতে সন্তু দেখল, সুড়ঙ্গটা এঁকেবেঁকে যে কতদূর গেছে, তার কোনও ঠিক নেই। মাঝে-মাঝে আলো, মাঝে-মাঝে অন্ধকার। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল, কেউ তাকে ধরবার জন্য ছুটে আসছে কি না। কারুকে দেখতে পেল না।

সুড়ঙ্গের পাশে পাশে দু একটি খুপরি-খুপরি ঘর আছে। একটা ঘরে ঢুকে পড়ল সন্তু। ঘরের ভেতরটায় আবছা অন্ধকার। একটুখানি চোখ সইয়ে নিয়ে ঘরটার দিকে ভাল করে তাকাতেই সে আঁতকে উঠল। অজান্তেই তার মুখ দিয়ে অ! অ? শব্দ বেরিয়ে এল।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরপর চারটি ইয়েতি। সাধারণ মানুষের প্ৰায় দেড়গুণ লম্বা। যেন তারা দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিশ্রাম করছে। সন্তু ভয় পেতে না চাইলেও ধক-ধক করতে লাগল তার বুক। সে এক পা এক পা পিছিয়ে যেতে লাগল। এবং পড়ে গেল হোঁচটি খেয়ে।

কিন্তু ইয়েতিরা তাকে তাড়াও করল না, হাত বাড়িয়ে ধরবারও চেষ্টা করল না। তারা দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে।

পড়ে গিয়েও সন্তু হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বেরিয়ে এল। ঘরের বাইরে। তখনই সে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল খুব কাছেই, সুড়ঙ্গের একটি বাঁকে। সন্তুকে যারা ধরবার চেষ্টা করছে, নিশ্চয়ই তারা। পালাবার সময় নেই, এসে পড়বে এক্ষুনি।

তখন, বলতে গেলে এক মুহুর্তের মধ্যে দুটো-তিনটে চিন্তা খেলে গেল সন্তুর মাথায়। তাকে বাঁচতে হবে-বাঁচতে গেলে ঐ ঘরটার মধ্যেই আবার ঢুকতে হবে-দেয়ালে পিঠি দিয়ে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা ইয়েতি নয়। সঙ্গে-সঙ্গে সে দৌড়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়েই একটা ইয়েতির পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।

তারপরই সেই ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তিনজন লোক। তাদের মুখে হলুদ মুখোশ, এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে রিভলভার। টর্চের আলো ফেলে তারা দেখতে লাগল। ঘরের ভেতরটা। একজন ঢুকেও পড়ল ঘরের মধ্যে।

বাইরের একজন ইংরেজিতে বলল, ছেলেটা গেল কোথায়? এইদিকেই এসেছে।

ভেতরের লোকটি বলল, আওয়াজ শুনলাম, মনে হল এই ঘরেই ঢুকেছে।

আর-একজন বলল, না, আমার মনে হয় ছেলেটা ওপরে উঠে গেছে।

ভেতরের লোকটি বলল, এখানে তো দেখছি না—

বাইরের একজন বলল, একবার ওপরে যাওয়া উচিত, ওপরে নানারকম আওয়াজ হচ্ছে কিন্তু–

লোকগুলো জুতোর দুপদাপ শব্দ করে এগিয়ে গেল সুড়ঙ্গের সামনের দিকে।

এই সময়টুকু সন্তু নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল। তার খালি ভয় হচ্ছিল, তার পা দুটো ওরা দেখতে পেয়ে যাবে কি না। লোকগুলো চলে যেতেই তার শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল, সে ধাপ করে পড়ে গেল মাটিতে।

ঘরটার মেঝেতে খড় ছড়ানো আছে। ইয়েতির মতন পোশাকগুলোতেও খড় ভরাই; পোশাকগুলো যাতে কুঁচকে না যায়, সেইজন্য খড় ভরে সোজা করে রাখা আছে। সন্তু একটু সুস্থ হবার পর পোশাকগুলোতে হাত ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখল। প্রথম দেখেই সন্তু এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে সে ভাল করে তাকায়নি। নইলে চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারা যেত। ওদের চোখের জায়গায় কিছুই নেই। শুধু দুটো গর্ত।

সন্তুর একবার ইচ্ছে হল, সে এই একটা পোশাকের মধ্যে ঢুকে পড়ে ইয়েতি সেজে থাকবে। তা হলে ওরা আর তাকে কিছুতেই খুঁজে পাবে না! কিন্তু পোশাকগুলোর তুলনায় তার চেহারা অনেক ছোট। তাছাড়া—সন্তুর আর-একটা কথা মনে পড়ল, ওপরে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে, কাকাবাবু তো তার মতন আর ছুটে পালাতে পারবেন না। কাকাবাবুকে ওরা এতক্ষণে মেরে ফেলেছে! যাই হোক না কেন, তাকে একবার ওপরে যাবার চেষ্টা করতেই হবে।

ঘরটা থেকে খুব সাবধানে বেরুল সন্তু। দুপাশে উঁকি দিয়ে দেখল, কেউ নেই। লোকগুলো তাহলে ওপরেই উঠে গেছে বোধহয়। সুড়ঙ্গটা দিয়ে পা টিপে টিপে খানিকটা গিয়ে সন্তু বুঝতে পারল, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। সুড়ঙ্গটার দুপাশ দিয়েই মাঝে-মাঝে দু-একটা শাখা-প্ৰশাখা বেরিয়ে গেছে। এর আগে ছুটে আসবার সময় সে কখন কোনটা দিয়ে এসেছে, তা এখন আর বোঝবার উপায় নেই।

আবার আর-একটা ঘর চোখে পড়ল একপাশে। সে-ঘরটার কোনও দরজা নেই। ভেতরে কী রকম যেন একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। একটু উঁকি দিয়ে দেখল। সন্তু। ঘরটার ভেতরে একটা খাঁচার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো জ্যান্ত মুগ, তাছাড়া পাশাপাশি দুটি রেফ্রিজারেটর, মেঝের এক কোণে স্তুপাকার আলু আর পেয়াজ। এটা এদের ভাঁড়ারঘর। সন্তুর মনে পড়ল, ওপরে গম্বুজের বাইরে একদিন মুর্গির পালক আর রক্ত দেখতে পেয়েছিল। এরাই ওখানে একদিন একটা মুগনিয়ে গিয়ে মেরে তাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

সেখানে বেশিক্ষণ রইল না। সন্তু, তাকে ওপরে যেতেই হবে। আবার সুড়ঙ্গপথে এগোতে লাগল সে। যেদিকে আলো দেখছে, সেদিকেই যাচ্ছে, তা ছাড়া পথ চেনার আর কোনও উপায় নেই।

আর-একটা ঘরের কাছাকাছি গিয়ে থমকে যেতে হল সন্তুকে। সে-ঘরের ভেতর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর জোরে-জোরে নিশ্বাস টানার শব্দ।

সে-ঘরটাতেও কোনও দরজা নেই। ঐ ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হবে সন্তুকে। ভেতরের লোকরা যদি তাকে দেখে ফেলে? সন্তু পেছন ফিরে তাকল, আবার ঐ দিকে যাবে? কিন্তু সামনের দিকটাতেই বেশি আলো, খুব সম্ভবত ঐ দিকেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি।

দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে শব্দটা শুনতে লাগল সন্তু। কীরকম যেন কুঁ-কুঁ আওয়াজ হচ্ছে, তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতন। মনে হয় কোনও অসুস্থ লোক। এটা কি ওদের হাসপাতাল-ঘর? তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই, অসুস্থ লোকেরা তাকে দৌড়ে ধরতে পারবে না।

সাহস করে ঘরটায় উঁকি মোরল সন্তু। আবার বুকটা কেঁপে উঠল তার। ওখানে কারা বসে আছে, মানুষ না ভূত? শুধু জাঙ্গিয়া-পরা দু জন লোক দরজার সোজাসুজি দেয়ালের কাছে বসে আছে, দেখে মনে হয় যেন মানুষের কঙ্কাল। তারা নিশ্বাস ফেলছে আর কু কুঁ শব্দ করছে বলেই বোঝা যায় তারা বেঁচে আছে।

লোক দুটির চোখের দৃষ্টি স্থির, তারা চেয়ে আছে সন্তুর দিকে। একজনকে দেখে মনে হয় চিনেম্যান, অন্যজন কোন জাত তা বোঝবার উপায় নেই। তার মুখে লম্বা ঝোলা দাড়ি।

সন্তু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ? লোক দুটি কোনও উত্তর দিল না, একভাবে চেয়েই রইল। ওদের দেখে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল সন্তুর। ওরা যেন দারুণ অসহায়, বুকের মধ্যে শুধু প্ৰাণটা ধুকপুক করছে। ওরা নিশ্চয়ই এই গুপ্তচরদের দলের লোক নয়। এই রকমই একজন চিনেম্যানের মৃতদেহ সন্তু দেখেছিল গম্বুজের বাইরে।

এক পা এগিয়ে এসে সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, কে? আপনারা কে? আপনাদের কী হয়েছে?

লোক দুটির কথা বলার কোনও ক্ষমতা নেই। এই লোক দুটিকেও না খেতে দিয়ে আস্তে-আস্তে মেরে ফেলা হচ্ছে। প্ৰাণ একেবারে বেরিয়ে গেলে তারপর ওদের দেহ ওপরে বরফের ওপর ফেলে রেখে আসা হবে। তখন কেউ ওদের খুঁজে পেলেও ভাববে, বরফের রাজ্যে পথ হারিয়ে ফেলে ওরা না খেতে পেয়ে মরেছে।

কিন্তু সন্তু এসব কথা জানে না। সে ওদের কোনও রকম সাহায্যও করতে পারছে না। এখানে দেরি করাও অসম্ভব, তাকে ওপরে যেতেই হবে কাকাবাবুর কাছে।

সে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। লোক দুটো যেন আরও জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগল। তারপর। বেশ খানিকটা এগিয়েও ওদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল সন্তু। সে দুহাতে কান চেপে ধরল।

ক্রমেই সুড়ঙ্গের সামনের দিকে আলো বাড়ছে, মানুষের গলার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে। কান থেকে হাত সরিয়ে সন্তু ভাল করে শোনবার চেষ্টা করল। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেউ যেন কাকে খুব ধমক দিচ্ছে। ঐ আওয়াজটা আসছে ওপরের দিক থেকে। লোহার সিঁড়িটা তা হলে ঐ দিকেই হবে।

এক-একা অতজন শত্রুর মধ্যে উপস্থিত হয়ে সন্তু কী করবে, তা সে জানে না। কিন্তু কাকাবাবু ওখানে আছেন, তাকে তো যেতেই হবে। এক পা এক পা করে সে এগোতে লাগল। এবার খানিকটা দূরে দেখা গেল নীল রঙের আলো। ঐখানে কাচের বাক্সের মধ্যে গোল যন্ত্রটা আছে, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। ক্রমশ ওপরের কথাগুলোও শোনা যেতে লাগল স্পষ্ট।

একজন কেউ বলছে, ওপন দা ডোর-তোমার ভাইপো এখানে আছে। দরজা না খুললে তাকে মেরে ফেলব!

শুনেই সন্তু বুঝতে পারল, ভাইপো মানে তার কথাই বলা হচ্ছে। কাকাবাবু তা হলে এখনও বেঁচে আছেন। ওরা কাকাবাবুকে মিথ্যে বলছে যে, সন্তু ধরা পড়েছে। তবে কি এখন সন্তুর ওখানে যাওয়া উচিত? সন্তুকে ধরতে পারলে তো। ওদের এখন সুবিধেই হবে। কাকাবাবুকে ভয় দেখিয়ে দরজা খোলাতে পারে। এখন তার পক্ষে লুকিয়ে থাকাই ভাল।

আর-একটু এগিয়ে সন্তু আরও কথা শোনবার চেষ্টা করল। কাকাবাবুর গলার আওয়াজ সে শুনতে পাচ্ছে না। কেইন শিপটন একাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনেক কথা বলছে, তার মধ্যে একটা যন্ত্রে হাত দিতে বারবার নিষেধ করছে। কাকাবাবুকে। যন্ত্রটা কোথায় আছে!

সন্তু একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, এরই মধ্যে লোহার সিঁড়ি দিয়ে চারজন মুখোশধারী আবার নেমে এল নীচে। সন্তু পেছন ফিরে ছুটি লাগাবার আগেই তাদের টর্চের আলো এসে পড়ল তার গায়ে।

সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু শুয়ে পড়ল মাটিতে। ওদের হাতে রিভলভার আছে, ওরা দেখামাত্র গুলি করবে। সন্তু এটা শিখে রেখেছে যে মাটিতে শুয়ে পড়লে সহজে গায়ে গুলি লাগে না।

লোকগুলো দৌড়ে আসতে লাগল তার দিকে। তাদের মধ্যে একজন হুকুম দিল, ডোনট শুট! গেট হিম অ্যালাইভ।

এই কথা শোনামাত্ৰই সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় লাগাল। গুলি না করে ওরা তাকে জ্যান্ত ধরবে। আসুক তো কেমন ওরা দৌড়ে ধরতে পারে!

লোকগুলো টর্চের আলো ফেলে রেখেছে সন্তুর ওপর। সন্তু চায় একটা অন্ধকার জায়গা। ডানদিকের আর একটা শাখা-সুড়ঙ্গ দেখে সন্তু বেঁকে গোল সেদিকে। সেদিকটা অন্ধকার। এটা যদি বন্ধ গলি হয়, তা হলে আর সন্তুর নিস্তার নেই। তবু তাকে ঝুঁকি নিতেই হবে।

একটুখানি যেতে-না-যেতেই সন্তুর মুখে টর্চের আলো পড়ল। সামনে দিয়ে দু। তিনজন তেড়ে আসছে। লোকগুলো এরই মধ্যে এদিকে এসে পড়েছে। পেছনে ফিরে সন্তু উল্টোদিকে ছুটতে গিয়েই দেখল বাঁকের মাথায় টর্চ জেলে দাঁড়িয়ে আছে আরও দুজন!

ফাঁদে পড়া ইদুরের মতন সন্তু একবার এদিকে আর একবার ওদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। সে কিছুতেই ধরা দিতে চায় না, কিছুতেই না। অথচ আর কোনও উপায় নেই, পালাবার পথ নেই। এই সুড়ঙ্গটার পাশে কোনও ঘরও নেই। দুদিক থেকে এগিয়ে আসছে দু দল মুখোশধারী। সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, না, আমায় ধরতে পারবে না, কিছুতেই না।

আর তখনই ওপরে বিরাট জোরে একটা শব্দ হল। এত জোর শব্দ যেন কানে তালা লেগে যায়। একটা প্ৰচণ্ড বিস্ফোরণে যেন সব কিছু হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। এই সুড়ঙ্গের দেয়াল থেকেও দু চারটে পাথরের চলটা ছিটকে গেল চারদিকে।