০৩. আকাশ পুরনো হয় না

আকাশ পুরনো হয় না

সোনমার্গেও আজ বেশ ভিড়। প্রচুর লোক বেড়াতে এসেছে। বরফের ওপরে স্কেটিং করছে, লাফাচ্ছে, গড়াগড়ি দিচ্ছে অনেকে। বরফের ওপর লাফালাফি করার কী মজা, পড়ে গেলেও একটুও ব্যথা লাগে না, জামা কাপড় ভেজে না। এমনকী শীতও কম লাগে। এখানকার হাওয়াতেই বেশি শীত। একটা মেয়ে-ইস্কুল থেকে দল বেঁধে বেড়াতে এসেছে, এক রকম পোশাক পরা গোটা চল্লিশোক মেয়ে, কী হুড়োহুড়িই করছে সেখানে। আর দুজন সাহেব মেম মুভি ক্যামেরায় ছবি তুলছে অনবরত।

আমরা অবশ্য ওদিকে যাব না। আমাদের খেলাধুলো করার সময় নেই। কাকাবাবু কাশ্মীরের ম্যাপ খুলে অনেকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। তারপর দুটো ঘোড়া ভাড়া করে আমাকে বললেন, চলো।

কাশ্মীরে এসে একটা লাভ হয়েছে, আমি বেশ ভাল ঘোড়ায় চড়তে-পারি এখন! প্রথম দু একদিন অবশ্য ভয় ভয় করত, গায়ে কী ব্যথা হয়েছিল! এখন সব সেরে গেছে। এখন ঘোড়া গ্যালিপ করলেও আমার অসুবিধে হয় না। প্রত্যেক ঘোড়ার সঙ্গেই একটা করে পাহারাদার ছেলে থাকে, আমি আমার সঙ্গের ছেলেটাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যাই।

সেই নির্জন পাহাড়ের ওপর দিয়ে একলা একলা ঘোড়া চালাতে চালাতে নিজেকে মনে হয় ইতিহাসের কোনও রাজপুত্রের মতন। অন্য কারুকে অবশ্য এ কথাটা বলা যায় না, নিজের মনে মনেই ভাবি। যেন আমি কোন এক নিরুদেশের দিকে যাত্রা করেছি।

প্রায় এক ঘণ্টা ঘোড়া চালিয়ে আমরা একটা ছোট পাহাড়ের মাথায় এসে পৌঁছলুম। এখানে কিছু নেই, সব দিক ফাঁকা, এদিকে ওদিকে থোকা থোকা বরফ ছড়ানো, মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই। তিনদিক ঘিরে আছে বিশাল বিশাল পাহাড়-মেঘ ফুড়ে আরও উঁচুতে উঠে গেছে তাদের চুড়া। এক দিকে ঢালু। হয়ে বিশাল খাদ, অনেক নীচে দেখা যায় কিছু গাছপালা আর একটা গ্রামের মতন।

এই পাহাড়টাতেও আমরা আগে একবার এসেছি, দিন আষ্টেক আগে। পাহাড়টা বেশি উঁচু নয়, অনেকটা টিপির মতন-আরও দুটো পাহাড় পেরিয়ে এটায় আসতে হয়। দু চারটি বেঁটে বেঁটে পাইন গাছ আছে এ পাহাড়ে-পাইন গাছগুলোর ওপর বরফ পড়ে আছে, ঠিক যেন বরফের ফুল ফুটেছে। এখানে আবার নতুন করে মাপামাপি করার কী আছে কে জানে। সব দিকেই তো শুধু বরফ ছড়ানো। বরফ না খুঁড়লে কী করে বোঝা যাবে নীচে কী আছে? আর এই বরফের নীচে কি গন্ধক পাওয়া সম্ভব? কিংবা সোনা?

কাকাবাবু ঘোড়াওয়ালা ছেলে দুটোকে ছুটি দিয়ে দিলেন। বললেন বিকেলবেলা আসতে। ঘোড়া দুটো বাঁধা রইল। আমাদের সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ। আর ফ্লাস্কে কফি আছে-আমাদের আর খাবারদাবারের জন্য নীচে নামতে হবে না!

ক্রাচ দুটো নামিয়ে রেখে কাকাবাবু তার ওপর বসলেন। তারপর ওভারকেটের পকেট থেকে একটা হলদেটে, পোকায়-খাওয়া পুরনো বই বার করে দেখতে শুরু করলেন। আমাকে বললেন, সন্তু, তুমি ততক্ষণ চারপাশটা একটু দেখে নাও—একটু পরে কাজ শুরু করা যাবে।

আমার মন খারাপ ভাবটা তখনও যায়নি। একটু ক্ষুন্নভাবে বললাম, কাকাবাবু, এই জায়গাটা তো আগে দেখেছি। আজ আর নতুন করে কী দেখব?

কাকাবাবু বই থেকে মুখ তুলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর খুব নরম গলায় বললেন, তোমার বুঝি খুব ইচ্ছে করছিল। ঐ সিদ্ধার্থদের সঙ্গে বেড়াতে? তা তো হবেই, ছেলেমানুষ-

আমি থতমত খেয়ে বললাম, না, না, আমি কাজ করতেই চাই। এখন কাজ শুরু হবে না?

কাকাবাবু আমার গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, কোনও কাজ শুরু করার আগে সেই জায়গাটা খুব ভাল করে দেখে নিতে হয়। শোনো, দেখার জিনিসের কোনও শেষ নেই। কোনও জায়গাতে গিয়েই কখনও ভাববে না, দেখার কিছু নেই। সেই জায়গায়। খোলা চোখ নিয়ে তাকালেই অনেক কিছু দেখতে পাবে। যেমন ধরে আকাশ। আকাশ কি কখনও পুরনো হয়? কোনও মানুষ সারাজীবনে এক রকমের আকাশ দুবার দেখে না। প্রত্যেকদিন আকাশের চেহারা অন্যরকম। এই পাহাড়ও তাই। কখনও রোদ্দুর, কখনও ছায়-অমনি পাহাড়গুলোর চেহারা বদলে যায় না? একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকো-তাহলেই বুঝতে পারবে।

আমি আকাশের দিকে তােকালাম। আকাশটা আজ সত্যিই খুব সুন্দর। হালকা তুলোর মতন মেঘ বেশ জোরে উড়ে যাচ্ছে। সেই মেঘগুলোর চেয়ে আরও উঁচুতে আবার ঘন কালো রঙের মেঘ–অথচ রোদ্দুরও হয়েছে। রিণিদের সঙ্গে যদি দেখা না হত, বেড়াবার ইচ্ছেটা নতুন করে না জগত-তাহলে এই আকাশের দিকে তাকালে ভালই লগত।

কাকাবাবু বইটা পড়তে লাগলেন, আমি পাহাড়ের উল্টোদিকে একটুখানি নেমে গেলাম। এখানে একটা ছোট্ট গুহা আছে। গুহার মুখটা বেশ বড়, কিন্তু বেশি গভীর নয়। আগে বইতে পাহাড়ের গুহার কথা পড়লেই মনে হত, সেটা হবে অন্ধকার-অন্ধকার, বাদুড়ের গন্ধ আর হিংস্র পশুর বাসা। সেদিক থেকে এই গুহাটা দেখলে নিরাশই হতে হয়। কাশ্মীরে হিংস্র জীবজন্তু বিশেষ নেই। গুহাটা বেশ ঝকঝকে তকতকে। এক জায়গায় একটা ভাঙা উনুন আর আগুনের পোড়া দাগ। মনে হয় এইখানে এক সময় কেউ ছিল। এতদূরে কেউ তো আর পিকনিক করতে আসবে না। বোধহয় কোনও সন্ন্যাসী এখানে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন কোনও সময়।

গুহাটার মধ্যে একটু বসেছি আমনি বাইরে ঝুরঝুর করে বরফ পড়তে লাগল। আমিও ছুটে বাইরে এলাম। বরফ পড়ার সময় ভারী মজা লাগে। ছেড়া ছেড়া তুলোর মতন হালকা বরফ, গায়ে পড়লেও জামাকাপড় ভেজে না-হাতে জমিয়ে-জমিয়ে শক্ত বলের মতনও বানানো যায়। বরফের মধ্যে খানিকটা দৌড়োদৌড়ি করে আমি শীত কমিয়ে নিলাম। তারপরে হাঁটুগেড়ে বসে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ জমিয়ে মন্দির বানাতে লাগলাম একটা।

কাকাবাবুও নেমে এসেছেন। বললেন, এসো এবার কাজ শুরু করা যাক। খানিকটা কাজ করে তারপরে আমরা খেয়ে নেব। তোমার খিদে পায়নি তো?

না, এক্ষুনি কী খিদে পাবে।

বেশ। ফিতেগুলো বার করে।

ব্যাগ দুটো আমি গুহার মধ্যে রেখেছিলাম। সেগুলো নিতে এলাম, কাকাবাবু আমার সঙ্গে সঙ্গে এলেন। গুহার চার পাশটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন, এই গুহাটা আমার বেশ পছন্দ। এইটার জন্যই এখানে আসি।

আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, ককাবাবু, আমরা এই গুহাটায় থাকতে পারি না? তাহলে বেশ মজা হবে।

কাকাবাবু বললেন, এখানে কি থাকা যায়? শীতে মরে যাব। সামনেটা তো খোলা-যখন বরফের ঝড় উঠবে।

কিন্তু সন্ন্যাসীরা তো এই রকম গুহাতেই থাকে।

সন্ন্যাসীরা যা পারে, তা কি আমরা পারি! সন্ন্যাসীরা অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে।

কাকাবাবু ক্রাচ দিয়ে গুহার দেওয়াল ঠুকে ঠুকে দেখতে লাগলেন।

চিন্তিতভাবে বললেন, এই গুহার কোনও জায়গা কি ফাঁপা হতে পারে? মনে তো হচ্ছে না।

আমি কিছু বললাম না। পাথর আবার কখনও ফাঁপা হয় নাকি?

কাকাবাবু আরও কিছুক্ষণ গুহাটা পরীক্ষা করলেন। মেঝেতে শুয়ে পড়ে ঠুকে ঠুকে দেখলেন। তারপর নিরাশ ভাবে বললেন, নাঃ, এখানে কিছু আশা নেই।

কাকাবাবু গুহাটার মধ্যে কী যে পাবার আশা করেছিলেন, তা-ও বুঝতে পারলাম না আমি।

আর সময় নষ্ট না করে আমরা মাপার কাজ শুরু করলাম। এই মাপার কাজটা ঠিক যে পর পর হয় তা নয়। কাকাবাবু ফিতের একটা দিক ধরে থাকেন, আর একটা দিক ধরে আমি নেমে যাই, যতক্ষণ না ফিতেটা শেষ হয়। সেখানে আমি পা দিয়ে একটা দাগ কাটি। কাকাবাবু সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বলেন, এবার ডান দিকে যাও! ডানদিকটা হয়ে গেলে কাকাবাবু হয়তো বলেন, এবার বা দিকে যাও অর্থাৎ, কাকাবাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন, আমি চারদিকে ঘুরতে থাকি। তারপর কাকাবাবু আবার খানিকটা এগিয়ে যান, আমি আবার মাপতে শুরু করি!

সত্যি কথা বলতে কী, এরকমভাবে মাপায় যে কোনওরকম কাজ হতে পারে তা আমার বিশ্বাস হয় না। অবশ্য আমি কতটুকুই বা বুঝি! আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, কাকাবাবু কিন্তু ক্লান্ত হন না। দিনের পর দিন এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতায় ফেরার পর স্কুলের বন্ধুরা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে। এতদিন কাশ্মীরে থেকে কী করলি? আমি যদি বলি, আমি শুধু কাকাবাবুর সঙ্গে পাথর মেপে এলাম–তা হলে কেউ কি সে কথা বিশ্বাস করবে? কিংবা হয়তো হাসবে!

ঘণ্টা দু-এক বাদে আমরা একটু বিশ্রাম নেবার জন্য থামলাম-ৰ পাহাড়টার চুড়া থেকে আমরা অনেকটা নীচে চলে এসেছি। পাহাড়ের নীচের গ্রামটা এখন অনেকটা স্পষ্ট দেখা যায়। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, রুপোর তারের মতন একটা নদী!

কাকাবাবু বললেন, ডানদিকে দ্যাখে। উপত্যকা দেখতে পাচ্ছ?

ডানদিকে আর একটা খাড়া পাহাড়, তার নীচে ছোট্ট উপত্যক। সেই উপত্যকায় অনেকটা বেশ পরিষ্কার জমি। ঠিক যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ। সেখানে কয়েকটা কী যেন জন্তু নড়াচড়া করছে। এত দূরে যে ভাল করে দেখা যায় না।

কাকাবাবু বললেন, ওগুলো কি জন্তু বুঝতে পারছ?

না, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কুকুর। নাকি হরিণ ওগুলো? কাকাবাবুর কাছে সব সময় ছোট একটা দূরবীন থাকে। সেটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ভাল করে দ্যাখো।

দূরবীন চোখে দিয়েই দেখতে পেলাম, কুকুর কিংবা হরিণ না, কতগুলো ঘোড়া সেই উপত্যকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে একটাও মানুষজন নেই।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, কাকাবাবু, ওগুলো কি বুনো ঘোড়া? ওদের কখনও কেউ ধরেনি?

কাকাবাবু বললেন, না। ঠিক তার উল্টো। আমি অবাক হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকালুম। ঘোড়ার উল্টো মানে কি? মেয়ে-ঘোড়া? মেয়ে ঘোড়াকে কি ঘুড়ী বলে? ঠিক জানি না। ইংরেজিতে বলে মেয়ার?

কাকাবাবু, ওগুলো কি তবে মেয়ার?

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, না, তা বলিনি। ওগুলো বুনো ঘোড়া নয়, ওগুলো বুড়ো ঘোড়া। চলতি বাংলায় যাকে বলে বেতো ঘোড়া।

ওগুলো সব বুড়ো ঘোড়া? এক সঙ্গে এত বুড়ো ঘোড়া কোথা থেকে এল? তুমি কী করে জানলে?

আমি আগেও দেখেছি। এই ব্যাপারটা শুধু কাশ্মীরেই দেখা যায়। এইগুলো হচ্ছে ঘোড়াদের কবরখানা। এই সব পাহাড়ী জায়গাতে তো বুড়ো ঘোড়া কোনও কাজে লাগে না, তাই ঘোড়াগুলো খুব বুড়ো হয়ে গেলে এই রকম উপত্যকায় ছেড়ে দেয়। ওখান থেকে উঠে আসতে পারবে না। ওখানেই আস্তে আস্তে মরে যায় একদিন।

-ইস, কী নিষ্ঠুর! কেন, বাড়িতে রেখে দিতে পারে না?

নিষ্ঠুর নয়! বাড়িতে রেখে দিলে তো খেতে দিতেও হয়। এরা গরিব মানুষ, কাজ না করিয়ে কি শুধু শুধু বসিয়ে কারুকে খাওয়াতে পারে? তাই চোখের আড়ালে যাতে মরে যায়, তাই ছেড়ে দিয়ে আসে। নিজের হাতে মারতে হল না। বুড়ো ঘোড়ার কোনও দাম নেই, কেউ কিনবেও না। এদেশে তো কেউ ঘোড়ার মাংস খায় না।তাহলে বাজারে বিক্রি হতে পারত। ফ্রান্সে ঘোড়ার মাংস খায়-

ঘোড়াগুলো ওখানে থেকে মরার জন্য প্ৰতীক্ষ্ণ করছে-একথা ভেবেই আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। যতদিন ওরা মনিবের হয়ে খেটেছে ততদিন ওদের যত্ন ছিল। মানুষ বড় স্বার্থপর! মানুষও তো খুব বুড়ো হয়ে গেলে আর কাজ করতে পারে না। তখন কি তাদের কেউ ওরকমভাবে ছেড়ে দিয়ে আসে?

আমি দূরবীনটা নিয়ে ভাল করে দেখতে লািগলাম। এবার দেখতে পেলাম, ঐ উপত্যকার এখানে-সেখানে অনেক হাড় ছড়িয়ে আছে। আগে যারা মরেছে। যে-ঘোড়াগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলোও খুব রোগা রোগা। খাবার কিছুই নেই বোধহয়। ঘোড়ারা কি আসন্ন মৃত্যুর কথা বুঝতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, নাও, আবার কাজ শুরু করা যাক।

আমি ফিতের বাক্স নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালাম।

এর পরেই একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেল। কাকাবাবু তাড়াতাড়ি ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেই বরফে ক্রাচ পিছলে গেল। কাকাবাবু মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন।

কাকাবাবুকে ধরার জন্য আমি হাতের জিনিস ফেলে ছুটতে যাচ্ছিলাম; কাকাবাবু সেই অবস্থায় থেকেই আমাকে চেঁচিয়ে বললেন, এই সন্তু দৌড়বি না! পাহাড়ের ঢালু দিকে দৌড়তে নেই। আমি নিজেই উঠছি!

আমি থমকে দাঁড়ালাম। কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে। ক্রীচটা নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিতে যেতেই আবার পড়ে গেলেন। এবার পড়েই গড়াতে লাগলেন নীচের দিকে।

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। এবার আমি দৌড়াতেও সাহস পেলাম না। নীচের দিকে তাকিয়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। কাকাবাবু গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছেন— সেই ঘোড়াদের কবরখানার দিকে। কাকাবাবু দুহাত দিয়ে প্ৰাণপণে কিছু একটা চেপে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ধরার কিছু নেই, একটা গাছ বা লতাপাতাও নেই। আমার বুকের মধ্যে ধকধক করতে লাগল। কী হবে? এখন কী হবে? আমি একবার পাঁচ ছটা সিঁড়ি গড়িয়ে পড়েছিলাম আমার বাড়িতে…। কিন্তু এ তো হাজার হাজার সিঁড়ির চেয়েও নিচু…

খানিকটা দূরে গিয়ে কাকাবাবু থেমে গেলেন। সেখানেও গাছপালা কিছু নেই, কী ধরে কাকাবাবু থামলেন জানি না। থেমে গিয়ে কাকাবাবু নিম্পন্দ হয়ে পড়ে রইলেন। এবার আর কিছু না ভেবে আমি দৌড় লাগালাম কাকাবাবুর দিকে। সব সময় তো আর সাবধান হওয়ার কথা মনে থাকে না! দৌড়েই বুঝতে পারলাম, কী দারুণ ভুল করেছি! পাহাড়ের ঢালু দিকে দৌড়তে গিয়ে আমি আর থামতে পারছি না। আমার গতি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে!

কাকাবাবুর কাছাকাছি গিয়ে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। ওঁর হাত ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম, কাকাবাবু!

কাকাবাবু মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, বললাম না, পাহাড়ের নীচের দিকে দৌড়তে নেই! আর কক্ষনো এ রকম করবে না!

সে কথা অগ্রাহ্য করে আমি বললাম, কাকাবাবু, তোমার লাগেনি তো?

তোমার লেগেছে কি না বলো?

না, আমার কিছু হয়নি। তুমি-তুমি এতটা গড়িয়ে পড়লে—

ও কিছু না। ওতে কিছু হয় না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুকে টেনে তুলতে গেলাম। কাকাবাবু আমার হাত ছাড়িয়ে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। কাকাবাবুর একটা পা ভাঙা, কিন্তু মনের জোর অসাধারণ। এমন ভাব করলেন, যেন কিছুই হয়নি।

কিন্তু চোখে হাত দিয়েই কাকাবাবু বললেন, এই যা! আমার চশমা?

চশমা ছাড়া কাকাবাবু চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না। খুব কাছ থেকেও মানুষ চিনতে পারেন না। গড়িয়ে পড়ার সময় কাকাবাবুর চশমাটা কোথাও হারিয়ে গেছে। কাছাকাছি কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।

হারিয়ে গেলে যদি অসুবিধেয় পড়তে হয়, সেই জন্য কাকাবাবুর এক জোড়া চশমা থাকে। আর একটা আছে তাঁবুতে। আমি বললাম, যাক গে, কাকাবাবু, তোমার তো আর একটা চশমা আছে!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু এখন আমি এতটা রাস্তা ফিরব কী করে? তা ছাড়া সেটাও যদি কোনওরকমে হারিয়ে যায়, তা হলে তো সব কাজই বন্ধ হয়ে যাবে! তুমি দাঁড়াও আমি চশমাটা খুঁজে দেখি!

সেই ঢালু পাহাড়ে এক পা উঠতে বা নামতেই ভয় করে—সেখানে চশমা খোঁজা যে কী শক্ত ব্যাপার, তা বলে বোঝানো যাবে না। কাকাবাবু আর আমি দুজনে দুজনকে ধরে রইলাম, তারপর খুঁজতে লাগলাম চশমা। প্রায় পনেরো মিনিট বাদে দেখা গেল, বরফের মধ্যে সেটা গেথে আছে, একটা ডাঁটি ভাঙা-আর কোনও ক্ষতি হয়নি।

হঠাৎ আমার কান্না পেয়ে গেল। কাকাবাবু যদি তখন সত্যি সত্যি পড়ে যেতেন, আমি একলা এখানে কী করতাম? কাকাবাবুকে ফেলে আমি ফিরেও যেতে পারতাম না, কিংবা একলা একলা

আমি আবার বসে পড়ে বললাম, কাকাবাবু, আমার এই কাজ ভাল লাগে না!

কাকাবাবু বললেন, ভাল লাগে না? বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?

আমি উত্তর না দিয়ে মুখ গোঁজা করে বসে রইলাম। সত্যি আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু কাকাবাবুকে আমি তা দেখতে দিইনি।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। তুমি না হয় সিদ্ধার্থদের সঙ্গেই চলে যাও!

আর তুমি কী করবে? তুমি এখানে একলা একলা থাকবে?

হ্যাঁ। আমি থাকব। আমি যে কাজটা আরম্ভ করেছি, সেটা শেষ না করে যাব না।

সিদ্ধাৰ্থদাদের সঙ্গে যাবার কথা শুনে আমার আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু কাকাবাবুকে একলা ফেলে যেতেও ইচ্ছে করে না। কাকাবাবু একলা একলা পাহাড়ে ঘুরবেন— কাকাবাবুকি ভাবছেন, আমি নিজের কষ্টের কথা ভেবে চলে যেতে চাইছি? মোটেই তা নয়! কাকাবাবুর জন্যই তো আমার চিন্তা হচ্ছে।

আমি বললাম, কাকাবাবু আমি তোমার সঙ্গেই থাকব, তোমার সঙ্গে ফিরব। কিন্তু ফিতে মাপার কাজ আমার ভাল লাগে না।

ঠিক আছে, কাল থেকে অন্য একটা কমবয়সী ছেলেকে ঠিক করব–সে ফিতে ধরবে, আর তুমি আমার পাশে থাকবে।

কিন্তু কাকাবাবু, আমরা কী খুঁজছি? কী হবে এই রকম ফিতে মেপে?

কাকাবাবু একটুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সন্তু, তুমি তো এখনও ছেলেমানুষ, এখন সব বুঝবে না। বড় হলে বুঝবে, আমরা যা খুঁজছি, যদি পাই, সেটা কত বড় আবিষ্কার!

তাহলে আরও লোকজন নিয়ে এসে ভাল করে খুঁজলে হয় না?

আমি বিশেষ কারুকে বলতে চাই না। কারণ যা খুঁজছি তা যদি শেষ পর্যন্ত না পাই, লোকে শুনে হাসাহসি করবে। পাবই যে তারও কোনও মানে নেই। সুতরাং চুপচাপ খোঁজাই ভাল, যদি হঠাৎ পেয়ে যাই, তখন সবাই অবাক হবে। তখন তোমাকেই সবাই বলবে বাহাদুর ছেলে?

কাকাবাবু, আমরা আসলে কী খুঁজছি? সোনা?

কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, কী বললে, সোনা? না, না, সোনাটোনা কিছু নয়। পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে কেউ সোনা পায় নাকি? যত সব বাজে কথা।

তাহলে?

আমরা খুঁজছি একটা চৌকো পাতকুয়ো। চৌবাচ্চাও বলতে পারো। কিন্তু সাধারণ চৌবাচ্চার থেকে অনেক গভীর। চলো, আজকের মতন ফেরা যাক।