গলা শুনে মেজর চমকে গেলেন। এই ঘন জঙ্গলে মহিলা কী করে আসবেন? যদি কোনও সাহসিনী জঙ্গল দেখতে গাড়িতে চেপে আসেনও, তিনি ওই নীল চ্যাটার্জিদের হাতে পড়ে বিপদ ডেকে আনবেন। মেজরের মনে হল, ভদ্রমহিলাকে সতর্ক করে দেওয়া তাঁর কর্তব্য।
তিনি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই খাঁচায় মাথা ঠুকে গেল। বেশ ব্যথা পেলেন। সেটা একটু সামলে উঠে খেয়াল করলেন আর মহিলার গলা শুনতে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ এ-তল্লাটে উনি নেই। তিনি যে খাঁচায় বসে আছেন সেটা কেন যে খেয়ালে ছিল না, থাকলে ওই মহিলাকে তিনি বাঁচাতে পারতেন। আর তখনই সারাওটাকে তীব্র গতিতে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখলেন তিনি। ওর মাথা নিচু করা, শিং তাঁর দিকে সোজাসুজি।
সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করলেন মেজর, এই, কী হচ্ছে? অ্যাাঁ। পাজি, ছুঁচো, বদমাশ। আমাকে ঢ়ুঁস মারতে আসা হচ্ছে? মেরে বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে দেব তোমার। সম্ভবত সেই চিৎকার শুনে একেবারে তাঁর গায়ের কাছে এসে হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সারাও। বিপুল বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে।।
মেজর চিৎকার করল, অ্যাই, কে আছ? কাম হিয়ার, জলদি। এবার কালো কাপড় তুলে একটা মুণ্ডু উঁকি মারল। তার মুখে কৌতুক। অ্যাই। হয় ওকে, নয় আমাকে এখান থেকে বের করে দাও, কুইক!
কেন?
কেন! একটা মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কেন? রাস্কেল।
গালি দেবেন না বলে দিলাম।
আলবৎ দেব, একশোবার দেব। তোর থেকে ওই সারাওটা বেশি বুদ্ধিমান।
তা হলে থাকুন ওর সঙ্গে। লোকটা কালো কাপড় ফেলে চলে গেল।
মেজর হতাশ হলেন। আপাতত তাঁর কিছুই করার নেই। অর্জুন অথবা অমল সোম নিশ্চয়ই তাঁকে এক সময় উদ্ধার করবে। ততক্ষণ বসে না থেকে শুয়ে পড়াই ভাল। মেজর পা ছড়িয়ে পাশ ফিরে শুলেন ডান হাতের কনুইয়ে মাথা রেখে। সারাটা একমনে তাকে দেখে যাচ্ছিল। জন্তুরা সম্ভবত মানবচরিত্র ভাল বোঝে। একটু পরে সেও শুয়ে পড়ল মেজরের কোল ঘেঁষে। মেজর মনে মনে বললেন, গুড বয়।
অর্জুন দ্বিতীয়বার চিৎকার করতে দেয়নি ঘোষালকে। একবার গলা ফাটানোর পরই সে তার মুখে রুমাল গুঁজে দিয়েছিল, বাঁধার কাজটা সুন্দর করেছিল। ওরা আশঙ্কা করেছিল ঘোষালের চিৎকার শুনে নীল ওপরে ছুটে আসবে। কিছুক্ষণ প্রস্তুত হয়ে থেকেও যখন তেমন কিছু হল না, তখন ওরা সামনের দিকে এগোল। ঘোষালকে দুটো পাথরের খাঁজে এমনভাবে ফেলে রাখল, যাতে সে কোনওভাবে বেরিয়ে আসতে না পারে।
ঢালের কাছে গাছের আড়ালে পৌঁছবার আগেই গাড়ির আওয়াজ কানে এল। ওরা অবাক হয়ে ওপর থেকে দেখল, দামি গাড়িটা তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়াল। নীল, অমল সোম বা মেজরকে দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির দরজা ড্রাইভার খুলে দিলে ওরা চমকে উঠল।
নিম টি এস্টেটের মিসেস ব্যানার্জি এরকম জায়গায় কেন এলেন। তিনি কি তাঁর ভাইয়ের এই সব কারবারের কথা জানতে পেয়ে বাধা দিতে এসেছেন? ভদ্রমহিলা গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ামাত্র সুন্দর বলল, উনি হলেন মেমসাব। নীল সাহেবের দিদি।
অর্জুন বলল, এবার আমাদের নীচে যাওয়া উচিত। চলো।
ওরা আর-একটু নীচে নেমে এল। এবার সেই ন্যাড়া জায়গাটা পেরিয়ে যেতে হবে। আর সেটা করতে গেলে ওদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা শতকরা পঁচানব্বই ভাগ। অর্জুন সুন্দরকে বলল, একসঙ্গে যাওয়া উচিত হবে না। তুমি ওই দিক দিয়ে ঘুরে যাও। অমলদাব কাছাকাছি থেকে সঙ্কেতে জানিয়ে দিয়ে সেটা। যাও। সুন্দর দ্রুত সরে গেল।
এক দৌড়ে ফাঁকা জায়গাটা পার হতেই অর্জুন দেখতে পেল মিসেস ব্যানার্জি সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে খুব অবাক হয়েছেন মহিলা। কিন্তু মুখে কিছু না বলে তাকিয়ে আছেন দেখে অর্জুনই প্রথম কথা বলল, আপনি এখানে?
প্রশ্নটা আমিই করছি। আপনি সেদিন ডিটেকটিভ অমল সোমের সঙ্গে আমার বাগানে গিয়েছিলেন, তাই তো? কিন্তু এখানে কী করছেন? ওটা তো ইন্ডিয়া নয়, ভুটান। পাহাড় থেকে দৌড়ে নামলেন, কিছু হয়েছে কি? মিসেস ব্যানার্জি জিজ্ঞেস করলেন।
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নইলে আমরা এখানে আসব কেন? আপনার ভাই…। অর্জুন এবার নীলকে আসতে দেখল। এখনও একটু দূরে রয়েছে সে।
হ্যাঁ বলুন, আমার ভাই কী করেছে?
উনি খুব মূল্যবান এবং নিষিদ্ধ প্রাণী এখান থেকে ধরে চালান দিচ্ছেন বিদেশে। এটা গুরুতর অপরাধ। অর্জুন বলল।
তাই নাকি? ঠিক আছে, ও যাতে কাজটা না করে, সেটা আমি দেখব। ও এখানে এসেছে খবর পেয়েই আমি চলে এলাম। এবার আপনারা ফিরে যেতে পারেন। মিসেস ব্যানার্জির কথা শেষ হওয়ামাত্র নীল পাশে এসে দাঁড়াল, এই লোকগুলো আমার পেছনে লেগেছে দিদি, এদের চলে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।
মিসেস ব্যানার্জির গলা ওপরে উঠল, তোমার সাহস খুব বেড়ে গেছে নীল। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। যাও, এই ছেলেটিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো।
নীল বাধ্য হল মেনে নিতে, ঠিক আছে, চলুন।
কিন্তু আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন অর্জুন আপত্তি করল।
তারা ওদিকেই আছে। আসুন। নীল কঠিন মুখে বলল।
মিসেস ব্যানার্জি জিজ্ঞেস করলেন, নীল, তোমার বন্ধু কোথায়?
ওপরে আছে। ইডিয়টটার জন্যেই ঝামেলা বাড়ল। নীল ইশারা করতে অর্জুন হাঁটতে লাগল। দিদির কথা নীল নিশ্চয়ই মান্য করবে। পেছনে নীল আসছে এবং ওর সঙ্গে অস্ত্র আছে। সে ঠিক করল নীল তাকে কোথায় নিয়ে যায়, দেখবে। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটছিল ওরা। মাঝে-মাঝে বুনো ঝোপ। হঠাই সে ফাঁদটাকে দেখতে পেল। গাছপাতায় গর্তের মুখ কখনও ঢেকে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এখন তার খানিকটা সরে যাওয়ায় ফাঁদ বলে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সে দাঁড়াতেই পেছন থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। ব্যালান্স রাখতে পারল না অর্জুন। টলমলিয়ে শুকনো ডালপালায় পা পড়তে শরীর নীচেব দিকে নেমে গেল। অন্ধকারে অনেকটা যাওয়ার পর সে আছাড় খেয়ে পড়তেই গলা শুনতে পেল, হাড়গোড় ভাঙেনি তো? অমল সোমের গলা।
অমলদা।
হ্যাঁ। আমার মতো তোমাকেও ট্র্যাপে ফেলেছে ওরা। বাইরের সাহায্য ছাড়া ওপরে ওঠার কোনও সুযোগ নেই।
মিসেস ব্যানার্জি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নীল ফিরে আসামাত্র বললেন, এসব আমার ভাল লাগছে না। ওরা এখানে আসছে জানতে পারলে…
জানতে পারলে কী করতাম? কালকের মধ্যেই এক লট পাঠাতে হবে।
অ্যাট লিস্ট ওদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করে ম্যানেজ করা যেত। মিসেস ব্যানার্জি মাথা নাড়লেন, কজন এসেছে?
তিনজন। তিনটেকেই কবজা করেছি। আমেরিকায় যেটা থাকে, সেটাকে খাঁচায় রাখা আছে। ওকে বের করে ওই গর্তে ফেলতে পারলে চিন্তা থাকবে না। এ-জীবনে আর বের হতে পারবে না ওপরে। হাজার চিৎকার করলেও সাড়া দিতে কেউ আসবে না এখানে।
তোমার বন্ধু কোথায়?
প্রশ্ন শুনে নীলের খেয়াল হল। সে চিৎকার করে ডাকল। তিনবারেও ওপর থেকে সাড়া এল না। নীল বিরক্ত হয়ে বলল, ওকে আমি ঠিক ম্যানেজ করতে পারছি না। হয়তো পাহাড়ের ভেতরে কোথাও চলে গিয়েছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন।
ওকে ছাড়া তো চলবে না। যাও, খুঁজে নিয়ে এসো।
নীল বাধ্য হয়েই পাহাড়ে উঠতে লাগল। তার হাতে অস্ত্র। মনে-মনে সে ঘোষালকে গালাগাল দিচ্ছিল। এবার কাজটা হয়ে গেলে ঘোষালকে কাটাতে হবে। সে ওপরে উঠে এল। অনেকবার ডাকাডাকি করার পরও যখন সাড়া পাওয়া গেল না, তখন সে রিভলভারের ট্রিগার টিপল। পাহাড় কেঁপে গেল আওয়াজে, পাখিরা উড়ল কিন্তু ঘোষালের সাড়া পাওয়া গেল না। পাথরের খাঁজে পড়ে-থাকা ঘোষাল নিজের নাম এবং গুলির শব্দ শুনতে পেয়েও সাড়া দিতে পারছিল না মুখ বন্ধ থাকায়। নীল তার খুব কাছে এগিয়ে এসেছে। সে প্রবলভাবে নড়াচড়া করতেই পায়ের যন্ত্রণা বেড়ে গেল।
ঝটপট শব্দ কানে গিয়েছিল নীলের। সে সতর্ক চোখে চারপাশে দেখতে লাগল। ঠিক তখনই কিছু একটা তীব্র গতিতে ছুটে এসে তার কপালে আঘাত করল। চেষ্টা করেও মাথা সরাতে পারল না নীল। মুহূর্তেই পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। দু হাতে মাথা চেপে হাঁটু মুড়ে বসে পড়তেই আর একটা পাথরের টুকরো তার কানের ওপর আঘাত করল। সে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। রিভলভার পড়ে গেল একপাশে। নীল জ্ঞান হারাল।
সুন্দর দ্রুত দৌড়ে এল কাছে। তার খুব আনন্দ হচ্ছিল। নীলের পরনের জামা ছিড়ে ফেলে তাই দিয়ে দুটো শত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল সে। পা দুটোও বাদ দিল না। তারপর রিভলভার তুলে নিল। এটা কী করে ব্যবহার করতে হয় সে জানে না। একটু ভেবে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রাখল সেটা।
এত সব কাণ্ড ঘটে গেল ওপরে, কিন্তু ক্যাম্পের কাছে থাকা নীলের কর্মচারীরা তা টের পায়নি। তারা মেজরের কাণ্ডকারখানা নিয়ে হাসাহাসি করছিল। সুন্দর নীচে নেমে আড়ালে থেকে তাদের দেখল। সে অমল সোম বা অর্জুনকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ওঁদের খবরটা দিলে এখনই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সে চিৎকার করে ডাকবে কি না ভাবছিল, ঠিক তখনই নাক ডাকার আওয়াজ পেল। যে খাঁচাটার কাছে সে দাঁড়িয়ে ছিল, শব্দ বের হচ্ছে সেখান থেকেই। ওটা যে নাক ডাকার শব্দ তা, প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি সুন্দর। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলে কাপড়টা তুলতেই দেখল, পা ছড়িয়ে বসে মেজর ঘুমোচ্ছেন। তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে রয়েছে সেই রং করা পাহাড়ি ছাগলটা।
সুন্দর খোঁচা মারতেই মেজর হকচকিয়ে সোজা হলেন। ঠোঁটে আঙুল চেপে তাঁকে শব্দ করতে নিষেধ করল সুন্দর। তারপর কাপড়ের আড়ালে-আড়ালে খাঁচার মুখটায় চলে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মেজর দ্রুত বেরিয়ে এসে বললেন, ধন্যবাদ।
কথা বলবেন না। লোকজন কাছেই আছে।
মেজর ওকে অনুসরণ করে কিছুটা দূরে চলে আসামাত্র সেই ফুলটার কথা মনে করতে পারলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওই গাছটার কাছে যাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, তুমি বুঝতে পারছ না সুন্দর। ওই ফুলটার রহস্য আছে। ওটা আমাকে পেতেই হবে। এই রকম রহস্যের জন্যে পৃথিবী তোলপাড় করি আমি।
যে মানুষটা একটু আগে খাঁচায় বসে নাক ডাকছিল, সে পৃথিবী কী করে তোলপাড় করে, বুঝতে পারল না সুন্দর। সে জিজ্ঞেস করল, ফুল কোন গাছে আছে?
ওই ওপাশে। অত বড় গাছে মাত্র একটাই ফুল। কিন্তু এত উঁচুতে আর ডাল খুব সরু বলে আমি উঠতে পারিনি। বাট আই মাস্ট ট্রাই এগেইন।
মেজরকে অনুসরণ করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা যেতেই মেজর দাঁড়িয়ে পড়লেন, হু ইজ শি? মিসেস ব্যানার্জি বলে মনে হচ্ছে, উনি এখানে কেন?
তা তো বলতে পারব না। তবে কাছে না যাওয়াই ভাল।
কিন্তু উনি তো খুব বিদুষী মহিলা। ভাইয়ের অন্যায় সমর্থন করেন না।
সমর্থন না করলে ভাই এত অন্যায় করার সাহস পায় কী করে?
ঠিক। কিন্তু উনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি গাছটার কাছে যেতে পারব। মুশকিল হয়ে গেল! ওই যে গাছটা দেখছ, ওর মগডালে ফুল ফুটেছে।
মেজরের কথা শুনে সুন্দর এপাশ ও-পাশে ঘুরে ঘুরে ফুলটাকে দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়ে কাছাকাছি একটা গাছে উঠে গেল। বেশ কিছুটা ওঠার পর দূরের গাছের মগডালে ফুলটাকে দুলতে দেখল। এমন ফুল সে কোনও দিন দেখেনি। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা খেলল। সে গুলতি বের করে টিপ করল। সাঁ করে ছুটে গেল ছোট্ট পাথরটা। বোঁটার একটু ওপরে আঘাত করতেই ফুলটা টুক করে খসে পড়ল নীচে।
মিসেস ব্যানার্জি উদ্বিগ্ন হয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন গাছের ওপর থেকে একটা ফুল খসে পড়ল নীচে। বেশ বড়সড় এবং নধর ফুল, যা তিনি কখনও আগে দেখেননি। ফুলটা এত টাটকা যে, বোঁটা খসে পড়ার কোনও কারণ নেই। তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে ওটাকে তুললেন। তারপর মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করলেন।
সুন্দর ঘাবড়ে গেল। মেমসাহেব যে ফুলটা কুড়িয়ে নিতে পারেন, তা ওর মাথায় আসেনি। এখন যদি তিনি ফুলটা না দেন, তা হলে মেজর তাকে…।
সে দ্রুত গাছ থেকে নেমে এল, আমি ফুলটাকে পেড়ে ফেলেছি।
পেড়ে ফেলেছ? কোথায়? মেজর উত্তেজিত।
মেমসাব তুলে নিয়েছেন। ওঁর সামনে পড়েছিল।
সর্বনাশ! মেজর আর দাঁড়ালেন না। সুন্দর আপত্তি করছে জেনেও দৌড়ে গেলেন সামনে। মিসেস ব্যানার্জি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে দেখলেন দাড়িওয়ালা মোটাসোটা একটি মানুষ তাঁর দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে।
এক্সকিউজ মি ম্যাডাম।
আপনি?
আমি আপনার বাগানে মিস্টার সোমের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমি একজন অভিযাত্রী। আপনার হাতে যে ফুলটা রয়েছে, তার সন্ধানে এখানে এসেছি। অনুগ্রহ করে ফুলটা আমাকে দিন। হাত বাড়ালেন মেজর।
এটা কী ফুল?
আমি নাম জানি না।
আপনি এখানে ফুলের সন্ধানে এসেছেন?
হাঁ।
আপনার সঙ্গীরা?
ওদের আসার উদ্দেশ্য আলাদা। দিন।
আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
খাঁচায়। আপনার ভাই আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। ক্রিমিন্যাল অফেন্স।
কী করে বেরিয়ে এলেন?
সেটা বলা যাবে না। দিন ফুলটা।
আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমার ভাই এখনই ফিরে আসবে।
আপনার ভাই একজন ক্রিমিন্যাল। আপনি তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? মেজর চিৎকার করলেন, আপনার স্বামী খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন।
তাঁর সঙ্গে আমার ভাইয়ের কোনও রক্তের সম্পর্ক ছিল না। বেশ অহঙ্কারী গলায় বললেন মিসেস ব্যানার্জি। মেজর ফাঁপরে পড়লেন। একজন মহিলার ওপর জোর খাটানো যায় না। হঠাৎ তাঁর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, মিসেস ব্যানার্জি। এটা একটা অসাধারণ ফুল, প্যারিসের একটি বিখ্যাত পারফিউম ওই ফুল থেকে তৈরি হয়। দশ আউন্সের দাম দেড়শো ডলার। দারুণ গন্ধ।
মিসেস ব্যানার্জি ফুলটার দিকে তাকালেন। তারপর সেটাকে নাকের নীচে নিয়ে এসে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলেন। দ্বিতীয়বারেই তাঁর চোখ বন্ধ হল। মেজর লক্ষ করলেন ওঁর পা টলছে। মাটিতে পড়ার আগেই তাঁকে ধরে ফেললেন মেজর। ধীরে-ধীরে ঘাসের ওপর বসে পড়ে দু হাতে মাথা চেপে ধরলেন মহিলা। আর ঠিক তখনই পেছনে হই-হই আওয়াজ উঠল। মেজর চমকে পেছনে তাকালেন। কালো গোলার মতো কিছু ছুটে আসছে। কোনওমতে তিনি সরে দাঁড়াতেই সেটা মিসেস ব্যানার্জির শরীর ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আর্তনাদ করে উঠলেন মেজর। ছুটে যাওয়া সারাওয়ের পায়ের চাপে ফুলটা থেতলে গিয়েছে পুরোপুরি। ঘাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বলা যায়। কোনও মতেই তাকে আর ফুল বলা যায় না।
পেছন-পেছন যারা ছুটে আসছিল, তারা এবার মেজর এবং সুন্দরকে দেখে থমকে গেল। মেজর চিৎকার করলেন, কে ওকে তাড়া করেছিল? কে? এগিয়ে এসো। আমি ধড় থেকে মুণ্ডুটা ছিড়ে ফেলব। শয়তানের দল সব।
সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো উলটো দিকে দৌড়াল। রুমাল পেতে মেজর ফুলের অবশিষ্টাংশ তোলার চেষ্টা করলেন। আর তখনই চিৎকার ভেসে এল। চাপা অস্পষ্ট মানুষের গলা। একাধিক। সুন্দর ছুটল।
ফরেস্ট বাংলোয় বসে কথা হচ্ছিল। ডি এফ ও সাহেব, থানার বড়বাবু, রেঞ্জারও আছেন সঙ্গে। ঘোষাল স্বীকার করেছে। নীল মুখ খোলেনি, কিন্তু ঘোষালের স্টেটমেন্ট তাকে বাঁচাতে পারবে না। অমল সোম বলছিলেন, সবচেয়ে অবাক হয়েছি মিসেস ব্যানার্জির ভূমিকা দেখে। তিনি যে ভাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, আমি কল্পনা করিনি। তবে এবারে আমরা শেষ পর্যন্ত কী করতে পারতাম, তাতে সন্দেহ আছে। যা কিছু কৃতিত্ব, তা সুন্দরের। কী বলো অর্জুন?
অর্জুন বলল, হ্যাঁ। ও না থাকলে আমরা হয়তো আর ফিরতাম না।
ডি এফ ও জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়? আমি তাকে ফরেস্টে চাকরি দিতে চাই। ওর মতো লোক আমাদের দরকার।
অর্জুন বলল, সে এখন বুক ফুলিয়ে বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। কিন্তু অমলদা, আপনি লক্ষ করেছেন, জঙ্গল থেকে ফেরার পর মেজর একদম চুপ করে গিয়েছেন। একটাও কথা বলছেন না।
একটু দূরে বসা মেজর শব্দ করে নিশ্বাস ফেললেন, পরশমণি পেয়েও যে হারায়, তার দুঃখ তোমরা বুঝবে না হে। তবে মিসেস ব্যানার্জির কথা বলছিল মিস্টার সোম, ফুলেও যে বিষের গন্ধ থাকে, সেটা আর একবার প্রমাণিত হল, তাই না?