মেজর চিৎকার করতে করতে বাইরে ছুটে গেলেন। রেগে গেলে মেজরের মুখে অদ্ভুত কথার খই ফোটে, কিন্তু আজকের শব্দাবলী অর্জুন কখনও শোনেনি। এই অবস্থায় কারও হাসা উচিত নয় বলেই সে গম্ভীর হওয়ার ভান করল। কে তুই? আমি কাতলা মাছ আর তুই বাচ্চা পুঁটি, তা কি জানিস! মেজরের গলা তখনও ভেসে আসছিল।
এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেউ যদি তার মোটর বাইকটা নিয়ে উধাও হয় তা হলে বিপদের শেষ থাকবে না। সে মিসেস দত্তের দিকে তাকাল। যেটুকু আলো এখানে চুইয়ে এসেছে তাতে ভদ্রমহিলাকে রীতিমত অস্বাভাবিক। দেখাচ্ছে। ভয়ে নার্ভাস হয়ে একদম কুঁকড়ে গিয়েছেন উনি। শরীর কাঁপছে, চোখে শূন্য দৃষ্টি।
হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে আসা হাসির ধাক্কায় বাংলোটা যেন কেঁপে উঠল। একটা হেঁড়ে গলার সঙ্গে আর-একটি ভদ্র হাসির শব্দ হল। পায়ের শব্দ কাছে এল। মেজর চিৎকার করে বললেন, দ্যাখো-দ্যাখো কে এসেছে। মিস্টার ব্যানার্জি নিজের বাইক নিয়ে চলে এসেছেন আর আমরা ভাবছিলাম কেউ তোমারটা চুরি করে পালাচ্ছে।
অর্জুন কোনওমতে নেমে আসতেই ভানু ব্যানার্জির মুখোমুখি হলে সে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি? এখানে আসবেন তা তখন তো বলেননি?
নাঃ। পরে ঠিক করলাম। তোমরা যেভাবে এলে তাতে মন সাড়া দিচ্ছিল না।
আপনি নিশ্চয়ই সিঁড়ির গোড়ায় মৃতদেহটাকে দেখেছেন?
হ্যাঁ। মিসেস দত্ত কোথায়?
আততায়ীদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই মনে হয় উনি ওপরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এইভাবে বসে থেকে সম্ভবত খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এক্ষুনি নামানো দরকার ওঁকে। অর্জুনের কথা শেষ হওয়ামাত্র ভানুবাবু এগিয়ে গেলেন।
মিনিট চারেকের চেষ্টায় সবাই মিলে মিসেস দত্তকে নামাতে পারল। ভদ্রমহিলা দাঁড়াতে পারছেন না। চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হল না তাঁর পক্ষে। ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। ভানু ব্যানার্জি বললেন, একটু গরম দুধ খাইয়ে দেওয়ার দরকার। তিনি বৃদ্ধ কর্মচারীটিকে মদেশিয়া ভাষায় কিছু বলতেই সে ছুটে গেল। নারী তার সঙ্গী হল। একটু বাদেই গরম দুধ এসে গেল, সঙ্গে পানীয়। চা বাগানের মালিক অথবা ম্যানেজারের বাংলোয় এসব সচরাচর থাকেই। ভানু ব্যানার্জির নির্দেশমতো দুধে সামান্য পানীয় মিশিয়ে নারী মিসেস দত্তকে খাইয়ে দিল একটু একটু করে। ভদ্রমহিলা এবার চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেললেন। ওরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।
সোফায় পা ছড়িয়ে বসে মেজর বললেন, এখন তো সমস্যা বাড়ল। দরজায় একটা ডেডবডি আর ভেতরে হাফডেড ভদ্রমহিলা। কী করা যায়?
অর্জুন চিন্তা করছিল, এক্ষুনি পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার। অন্তত মৃতদেহটাকে ওঁরা নিয়ে যাবেনই। আর মিসেস দত্তকে কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত অথবা কোনও ডাক্তারকে এখানে আনতে হবে।
ভানু ব্যানার্জি বললেন, ওঁর যা অবস্থা তাতে গাড়ি ছাড়া নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এই বাগানের ডাক্তার এবং ক্লার্করা তো অনেকদিন চলে গিয়েছেন। এক কাজ করি, আমি বাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। থানায় খবর দিয়ে আমার বাগানের ডাক্তারকে তুলে নিয়ে ফিরে আসছি। ততক্ষণ ভদ্রমহিলা শুয়ে থাকুন।
মেজরের সম্ভবত প্রস্তাবটা পছন্দ হল না। তিনি দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, আপনি চলে যাবেন? আমার আবার ডেডবডিতে ভীষণ অ্যালার্জি আছে।
ভানু ব্যানার্জি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অ্যালার্জি? আপনি শব্দটা ঠিক বলছেন?
হাত বোলান বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন মেজর, হোয়ট ড়ু ইউ মিন? আমি ভয় পাচ্ছি? নো, নেভার। এই তো বছর পাঁচেক আগে একেবারে নরখাদকদের দেশে গিয়েছিলাম। একটা গ্রামে ঢুকে দেখি চারদিকে মানুষের কাটা মুণ্ডু। বডিটা খেয়ে নিয়ে মুণ্ডগুলি সাজিয়ে রেখেছে স্মারকচিহ্ন হিসাবে। আমি ভয় পেয়েছি? নো। তবে খারাপ লেগেছে। খুব খারাপ। কেন জানেন?।
কেউ প্রশ্ন করল না। মেজর একটু অপেক্ষা করে বললেন, মানুষের কাটা মুণ্ড প্রিজার্ভ করলে সেগুলো ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যায়। এই যে আমার এতবড় মাথাটা একসময় ছোবড়া ছাড়ানো নারকোলের মতো হয়ে যাবে।
ভানু ব্যানার্জি ওঁর এই পরিচয় জানতেন না। সসঙ্কোচে বললেন, আমি খুব দুঃখিত। আপনাকে আমি কিন্তু একটুও আঘাত করতে চাইনি।
মেজর উঠে দাঁড়ালেন, ওকে, ওকে! অর্জুন চলল, আমরা তিনজনই বেরিয়ে পড়ি। যে কারণে তুমি এসেছিলে সেটা তো এখন বাহুল্য হয়ে গেছে। তাই না?
অর্জুন মাথা নাড়ল, ভানুদা আপনি আর দেরি করবেন না।
ভানু ব্যানার্জি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে মেজর আবার সশব্দে বসে পড়লেন। একটু বাদে বাইকের শব্দ হল এবং একটু একটু করে মিলিয়েও গেল। হঠাৎ অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি একটানা কতদিন না খেয়ে থেকেছেন?
মেজর হাতটা ওপরে তুলে পাঁচটা আঙুল ছড়িয়ে দিলেন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বেড়াতে গিয়ে পড়ে পা ভেঙেছিল। একাই ছিলাম। দু-পাশে পাহাড়, খাদ্যের মধ্যে আমি আর শনশন হাওয়া। সঙ্গের খাবার দুদিনেই শেষ। তার পাঁচদিন পরে একটা হেলিকপ্টার এসে আমাকে উদ্ধার করে।
তাহলে আজকের রাত্রে না খেলে আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।
খাব না কেন? যদি এখানে থাকিও, কোনও অসুবিধে নেই। এদের কিচেনে খাবারের স্টক তত খারাপ নেই।
মেজর কথা শেষ করতেই বৃদ্ধ এসে দাঁড়াল, মেমসাহেব বোলাতা হ্যায়।
অর্জুন তড়াক করে উঠে বেডরুমের দিকে ছুটল। মেজর পেছনে।
মিসেস মমতা দত্ত এখনও শুয়ে আছেন, তবে ইতিমধ্যে তাঁর মুখে রক্ত ফিরে এসেছে কিছুটা। অর্জুন সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দুর্বল গলায় বললেন, সরি।
না, না। ঠিক আছে। আপনি কথা বলবেন না। আমরা ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করেছি। এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, অর্জুন বলল।
ঘুম আসবে না। আমি আর পারছি না। এবার আমাকে সারেন্ডার করতেই হবে। আমার জন্য একটার পর একটা লোক খুন হয়ে যাচ্ছে..। এক ফোঁটা জল চোখের কোল থেকে উপচে নেমে এল গাল বেয়ে।
অর্জুন বলল, আপনি এত ভেঙে পড়বেন না। ডাক্তার আসুক, তিনি অনুমতি দিলে আমরা কথা বলব। নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করা যাবে।
মিসেস মমতা দত্ত চোখ বন্ধ করতে অর্জুন ফিরে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে মেজর কথাবার্তা শুনছিলেন। সঙ্গী হয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন, খুব স্যাড ব্যাপার।
এখন ঘড়িতে রাত নটা। বাড়ির সব দরজা খোলা। আততায়ীরা যদি আবার ফিরে আসে তা হলে এবার যা ইচ্ছে তাই করে যেতে পারে। কোনও রকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা এখানে নেই। মিসেস দত্ত কোন সাহসে এখানে একা আছেন তাই বুঝতে পারছিল না অর্জুন। সে উঠে সদর দরজা বন্ধ করতে গেল। অন্তত ভেতরে ঢোকাটা যেন সহজ না হয়। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সে অস্বস্তিতে পড়ল। লোকটার মৃতদেহ সিঁড়িতে পড়ে আছে। মৃত হলেও মানুষ তো! ওকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করতে তাই অস্বস্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা উপেক্ষা করল অর্জন।
ফিরে আসামাত্র মেজর বললেন, পেছনের দরজাটা বন্ধ করা উচিত। অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর কিচেনের পাশ দিয়ে পেছনে চলে এল। দরজাটা খোলাই ছিল। স্পষ্টত এদিক দিয়েই আততায়ীরা পালিয়েছে। মিসেস মমতা দত্তের সঙ্গে কথা বললে লোকগুলোর পরিচয় জানতে অসুবিধে হবে না। এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পুলিশের কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। যারা চায় না মিসেস মমতা দত্ত বাগান আঁকড়ে পড়ে থাকুন, তারাই কাজটা করিয়েছে। অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে অর্জুনের মনে হল এই কেসে কোনও আকর্ষণ নেই। সে কয়েকপা হেঁটে অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াল। বাংলোটাকে এখন আলোর জাহাজ বলে মনে হচ্ছে। যারা টেলিফোনের লাইন কেটেছে, তারা দয়া করেই আলোটাকে রেখে দিয়েছে। চারপাশের অন্ধকারের মধ্যে বাংলোর এই আলোটা যেন বড্ড চোখে ঠেকছে।
হঠাৎ মাথার ভেতরে দ্বিতীয় একটা চিন্তা চলকে উঠল। আততায়ী কি সত্যি বাইরের লোক? একটা অ্যাম্বাসার গাড়ির কথা ভানু ব্যানার্জিকে বলেছিলেন পুলিশ অফিসার। যে অ্যাম্বাসাডারটিকে শিলিগুড়ির পথে দেখে সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন অমল সোম, তার মালিকদের কি হাত আছে এইসব খুনজখমে? কিন্তু তাই বা কী করে হবে? হরিপদ সেনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই অ্যাম্বাসাডার গাড়িটির সম্পর্ক থাকতে পারে বলে একটা আলাদা ধারণা তৈরি হয়েছিল সে সময়। অর্জুনের গায়ে এটা ফুটল। হৈমন্তীপুর এবং শিলিগুড়ির মধ্যে একই দল চলাফেরা করছে না তো! হরিপদ সেনের কালাপাহাড় রহস্য তা হলে তো অন্যদিকে বাঁক নেবে।
অমলদা বলেন, কখনও আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না। ভাল সত্যসন্ধানী নিজের কল্পনাকে পেছনে বাখেন, তা না হলে পথ ভুল হতে বাধ্য। এতকিছু ভাবার তাই কোনও মানে হয় না। বাংলোর দিকে পা বাড়াবার আগে অর্জুনের মনে পড়ল সেই লাইনগুলো, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, বিশাল বিল, শিবমন্দির, হৈমন্তীপুরে এসব আছে নাকি? এই বাংলোর দুই কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেই তা অবশ্য জানা যাবে। সে পেছনের দরজাটা বন্ধ করতেই দেখল বৃদ্ধ কিচেনে ঢুকছে। সে হাত তুলে লোকটাকে দাঁড়াতে বলে কাছে এগিয়ে গেল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, মেমসাহেব কি ঘুমিয়েছেন?
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে না বলল।
অর্জুন লোকটিকে দেখল, তুমি কতদিন আছ এই বাগানে?
আমার জন্মই এখানে। আমার ঠাকুদাকে দালালরা ধরে এনেছিল হাজারিবাগ থেকে।
সেখানে তুমি গিয়েছ?
না। কেউ নেই তো, কাউকেও চিনি না। গিয়ে কী হবে।
এই বাগানের চারপাশে যে জঙ্গল, তা তোমার ছেলেবেলায় ছিল?
এখন কী জঙ্গল দেখছেন, ছেলেবেলায় কেউ ওই জঙ্গলে ঢুকতেই সাহস পেত না।
এই জঙ্গলের মধ্যে কোনও বিল আছে?
বিল? বৃদ্ধ ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।
বিল মানে বড় পুকুর, জলাশয়…। ঠিক প্রতিশব্দ পাচ্ছিল না অর্জুন, না পেয়ে বলল, সাহেবরা যাকে লেক বলে।
লেক? না, না, এখানে লেক থাকবে কী করে। আমি তো কোনওদিন দেখিনি। জঙ্গলে দুটো ঝরনা আছে, শীতকালে শুকিয়ে যায়। বৃদ্ধ এবার বুঝতে পারল।
হতাশ হল অর্জুন। কালাপাহাড়ের সম্পত্তি তো বিলের পাশে থাকার কথা। সে আর কথা বলল না। বাইরের ঘরে পৌঁছে দেখল মেজর দুপা ছড়িয়ে সোফায় চিত হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। মুখ হাঁ করা। চট করে মনে হবে বীভৎস এক মৃতদেহ। নাক ডাকছে না। সে গলায় শব্দ করে সোফায় বসতেই মুখ বন্ধ হল। পা গুটিয়ে নিয়ে মেজর চোখ বন্ধ করেই বললেন, একটু ভাবছিলাম।
অর্জুন হাসি চাপল, আগে আপনার এমন ভাবার সময়ে প্রচণ্ড নাক ডাকত।
এখন ডাকে না। হেঁ হেঁ। নাক ডাকা বন্ধ করার একটা কায়দা বের করেছি।
সে কী? আপনি তো মিরাক্যাল করেছেন। পৃথিবীতে কেউ এর ওষুধ জানে না।
ওষুধ আমিও জানি না। কায়দা জানি। মেজর কাঁধ নাচালেন।
আরে, বলুন বলুন। বিশাল আবিষ্কার এটা।
সরি। এটা আমার ব্যাপার।
অর্জুন হাল ছেড়ে দিল। যার একবার নাক ডাকে তার বাকি জীবনে নিঃশব্দে ঘুম হয় না। এই নাক ডাকা নিয়ে কতরকমের অশান্তি হয়। মেজরের বীভৎস নাক ডাকা সে এর আগেও শুনেছে। এখন তো দিব্যি নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছিলেন। সে ঠিক করল পরে একসময় মেজরের মুড ভাল থাকলে কায়দাটা জেনে নেবে।
অর্জুন বলল, পাশেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল। একটা বিলের সন্ধান পেলে ভাল হতো।
বিল? মাই গড। বিল নিয়ে কী হবে।
কালাপাহাড়ের সম্পত্তি দুর্ভেদ্য জঙ্গলে বিলের ধারে শিবমন্দিরের কাছে লুকোনো আছে। শুনলাম এখানে কোনও বিলই নেই।
যত্তসব বাজে কথা। মেজর দাড়িতে হাত বোলালেন, লোকটা যেখানে মন্দির পেত সেখানেই হাতুড়ি চালাত। অসম থেকে ওড়িশা কোনও মন্দির আস্ত রাখেনি। আর সেই লোক একটা শিবমন্দিরের গায়ে সম্পত্তি লুকোবে? ইম্পসিবল।
ব্যাপারটা ভাবেনি অর্জুন। সত্যি তো! কালাপাহাড় মন্দির ধ্বংস করতেন। তিনি কেন বেছে বেছে একটা শিবমন্দিরের পাশে ধনসম্পদ লুকোতে যাবেন? মেজরকে ভাল লাগল অর্জুনের। সহজ সত্যিটা সে এতক্ষণ ভুলে ছিল, যা মেজর অনায়াসে বলে দিলেন।
এই সময় বাইরে ইঞ্জিনের শব্দ হল। সেইসঙ্গে জানালার কাচে আলো এসে পড়ল। অর্জুন উঠে দেখল তিন-চারটে আলো এগিয়ে এসে গেটের সামনে থামল। মেজর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। চাপা গলায় বললেন, ডাকাতগুলো ফিরে এল নাকি?
ততক্ষণে ভানুদাকে দেখতে পেয়েছে অর্জুন। দ্রুত এগিয়ে সদর দরজা খুলতেই তিনটে বাইক আর একটা অটো রিকশা সিঁড়ির নীচে পৌঁছে গেল। থানার দারোগা বাইকে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, ডেডবডিটা কোথায়?
অর্জুনের খেয়াল হল। সে মুখ নামিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল মৃতদেহটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এমনকী দারোয়ানের শরীর থেকে যে রক্ত বেরিয়ে সিঁড়িতে চাপ হয়েছিল, তাও উধাও।
ভানুদা বাইক দাঁড় করি: ছুটে এলেন, ডেডবডিটাকে কি সরিয়েছে কোথাও।
না। আমরা জানিই না। আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছিলাম। তখন তো ওখানেই পড়ে ছিল।
অর্জুন হতভম্ব।
দারোগা নেমে এলেন, স্ট্রেঞ্জ! আপনারা বলতে চান মৃতদেহ হেঁটে অদৃশ্য হল?
ভানুদা ঝুঁকে সিঁড়িটা দেখলেন, ভেজা কাপড় দিয়ে কেউ জায়গাটা মুছেছে।
অর্জন বাগানের দিকে তাকাল। ওরা যখন সব বন্ধ করে বসেছিল তখন। আততায়ীরা নিঃশব্দে মৃতদেহ সরিয়েছে। কিন্তু একটা ভারী শরীরকে বয়ে নিয়ে যেতে অন্তত দুজন মানুষ দরকার। তাদের পক্ষে এত অল্প সময়ে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু সে বাংলোর পেছনে দাঁড়িয়েছিল তাই ওদের পক্ষে সামনের গেট দিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
অর্জুন দারোগাকে বলল, প্লিজ! আমার সঙ্গে চলুন। ওরা বেশি দূরে যেতে পারেনি এখনও।
তৎক্ষণাৎ ছোট দলটা গেটের দিকে ছুটল। মেজর দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, আই অ্যাম হোল্ডিং ফোর্ট, বুঝলে? একজনের তো পেছনে থাকা দরকার।
অর্জুন জবাব দিল না। দারোগাবাবুর হাতে শক্তিশালী টর্চ ছিল। তিনি ভানুদার সঙ্গে আরও দুজন সেপাইকে নিয়ে এসেছেন। শুধু অটোওয়ালা চুপচাপ অটোতে বসে রইল। পাঁচজনের দলটা গেট পেরিয়ে কয়েক পা হাঁটতেই টর্চের আলোয় রক্তের দাগ দেখতে পেল। পথের পাশে পাতার ওপর। টকটকে রক্ত পড়ে আছে। দারোগা উল্লসিত। বাঁ দিকে নেমে পড়লেন। আরও কিছুটা যাওয়ার পর দ্বিতীয় জায়গায় রক্ত দেখা গেল। দারোগা গম্ভীর গলায় বললেন, ওরা এদিক দিয়েই গেছে। বি অ্যালার্ট।
অর্জুন দাঁড়িয়ে পড়ল। দারোগা তার মুখে টর্চ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
অর্জুন মাথা নাড়ল, এটা নিশ্চয়ই মানুষের রক্ত নয়।
তার মানে? দারোগা বিরক্ত হলেন।
দারোয়ান মারা গিয়েছে অনেকক্ষণ। তার শরীর থেকে টাটকা রক্ত এখন এভাবে পড়তে পারে না। আমাদের বিভ্রান্ত করতে কেউ রক্তজাতীয় কিছু ছড়িয়ে দিয়েছে। অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল, ভানুদা আপনি কি ডাক্তার আনতে পারেননি?
ভানুদা মাথা নাড়লেন, গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক অসুস্থ। তাই অটো নিয়ে এসেছি ওঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ডাক্তার থাকলে বলতে পারত এটা আদৌ রক্ত কিনা।