০৬. প্রমথ যেতে পারল না

০৬.

প্রমথ যেতে পারল না। আমি আর একেনবাবু যখন গিয়ে পৌঁছোলাম তার আগেই মনে হল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট পৌঁছে গেছেন। বেশ কিছু পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখে সন্দেহ হল, একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে! সন্দেহটা ভুল নয়। হোহাটেলের লবিতে ঢুকতেই পুলিশ আটকাল। ভাগ্যক্রমে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের এক চেলা, নামটা মনে নেই, একেনবাবুকে চিনতেন। তিনিই আমাদের ঢুকতে দিলেন। দোতলায় ব্রজদুলালবাবুর স্যুইট।

সেখানে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “ইয়োর বিজনেসম্যান ফ্রেন্ড ইজ নো মোর। এক ঘণ্টা আগে কেউ ওকে মার্ডার করেছে। স্ট্যান্ড-টু-ডেথ! আমার দু-জন কলিগ তোমাদের এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করবে।”

“নিশ্চয় স্যার, যতটুকু জানি নিশ্চয় বলব।”

.

এই ফ্লোরে মনে হল অনেকগুলো স্যুইট। আমাদের তারই একটাতে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিয়ে গেলেন। খানিক বাদেই সাধারণ পোশাকে দু-জন ঘরে ঢুকলেন। তাঁদের একজন ডেভ বলডুইন, এফবিআই-এর ফিল্ড অফিসার। দ্বিতীয় জন হলেন ৩০নং প্রিসিঙ্কট-এর ক্যাপ্টেন ল্যারি স্টকটন। আমাদের আলাদা আলাদা বিবৃতি নেওয়া হল পাশের একটা ছোটো ঘরে। প্রথমে একেনবাবুর, তারপর আমার। আমাকে প্রশ্ন করলেন ল্যারি। ব্রজদুলালবাবুর সঙ্গে আমার আর একেনবাবুর কী কী কথা হয়েছে তা আদ্যোপান্ত জানতে চাইলেন। তারপর প্রশ্নের বাঁকটা একটু অন্যদিকে গেল। ব্রজদুলালবাবুর বিয়ে কতদিন হয়েছে, ওঁর স্ত্রীর কোনো বন্ধুদের চিনি কিনা, মিস্টার শ্রীবাস্তব সম্পর্কে কিছু জানি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

বুঝতে অসুবিধা হল না, ওঁরা ব্যাপারটা পরকীয়া অ্যাঙ্গেল থেকেও দেখছেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যারি বুঝতে পারলেন পরকীয়া অ্যাঙ্গেল যদি কিছু থেকেও থাকে, আমার কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। আমি ওঁদের দুজনের কাউকেই চিনি না। আর একেনবাবুও মিস্টার শ্রীবাস্তবের সঙ্গে শুধু একবারই ফোনে কথা বলেছেন।

ওঁদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরের ঘরে এসে চোখে পড়ল একজন যুবক ও যুবতী শঙ্কিত মুখে সোফায় বসে আছে। একেনবাবু নেই। যুবকটি আমাকে দেখে উঠে এল।

“আপনি কি মিস্টার একেন সেন?”

“না।”

বলতে বলতেই দেখি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একেনবাবু ঘরে ঢুকছেন।

বললাম, “যাঁকে খুঁজছেন, ইনিই হচ্ছেন সেই একেনবাবু।”

“আপনিই একেনবাবু!”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আমি শ্রীবাস্তব, ব্রজদুলালবাবু ছিলেন আমার বস।”

“বুঝতে পেরেছি স্যার, আপনার সঙ্গেই তো ফোনে কাল কথা হল।”

“ঠিক। আসলে আপনার ওপর স্যারের খুব আস্থা ছিল। সুকন্যা, মানে স্যারের স্ত্রী খুব ভয় পাচ্ছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এই মার্ডার কেসে যদি ওকে জড়িয়ে ফেলা হয়! পুলিশ নানান ভাবে ওকে জেরা করছে। আমাকেও করছে।” গলার স্বরটা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে শ্রীবাস্তবের।

সোফায় বসে থাকা যুবতীটিই নিশ্চয় সুকন্যা, ব্রজদুলালবাবুর স্ত্রী। হাতে ছোট রুমাল, ঘন ঘন চোখ মুছছেন। অসহায় ভীত সন্ত্রস্ত চেহারা। সুন্দরী ঠিক নন, কিন্তু শোকাচ্ছন্ন চেহারাতেও সেক্সিনেসটা ঢাকা পড়েনি।

“কী মুশকিল স্যার, পুলিশ তো এগুলো করবেই তদন্তের স্বার্থে। এতে ভয় পাবার তো কিছু নেই!” একেনবাবু একটু জোর গলাতেই বললেন, যাতে সুকন্যার কানে যায়।

“তাও আপনি যদি ওর সঙ্গে একটু কথা বলেন। আসলে সুকন্যা শুধু স্যারের স্ত্রী নয়, আমি ওকে চিনি বহু দিন ধরে।”

“কথা তো নিশ্চয় বলতে পারি স্যার। কিন্তু এই তদন্তে আমার তো কোনো হাত নেই।”

“তা জানি, কিন্তু ও যদি জানে ওর স্বার্থ আপনি দেখবেন, তাহলে মনে ভরসা পাবে।”

“স্বার্থ তো দেখেন স্যার উকিল। ঠিক আছে স্যার, আমি নিশ্চয় কথা বলছি ওঁর সঙ্গে। তার আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে কী বললেন জানি না, কিন্তু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দেখলাম সম্মতি দিলেন। একেনবাবু এসে ব্রজদুলালবাবুর স্ত্রীকে নমস্কার করে বললেন, “ম্যাডাম, আমার নাম একেন সেন, আমি আপনার স্বামীর পরিচিত।”

ব্ৰজদুলালবাবুর স্ত্রী সুকন্যা ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, “আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনি প্লিজ ওঁকে কে হত্যা করল বার করুন। আমার খুব ভয় করছে। আমার মনে হচ্ছে এরা আমাকে আর সুধীরকে সন্দেহ করছে।”

“সুধীর কে ম্যাডাম?”

 উনি সুধীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শ্রীবাস্তব, ওকে আমি সুধীর বলে ডাকি।”

“এটা কেন ভাবছেন ম্যাডাম?”

“যে-ভাবে আমাদের প্রশ্ন করছে, তাতে তো সে-রকমই মনে হচ্ছে। ওঁর অফিস এখানে থাকলেও অফিসের কাউকেই তেমন ভাবে আমি চিনি না। আপনার ওপর ওঁর অনেক আস্থা ছিল। আমার তরফ থেকে আপনি এই তদন্তের ভার নিন। প্লিজ।”

একেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন। “বেশ, ম্যাডাম, নিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে কিছু প্রশ্ন আমার করতে হবে। এখন তো করা যাবে না। এখানে পুলিশদের কাজ শেষ হোক, তারপর কথা বলব।”

সুকন্যার শুকনো মুখ দেখে একেনবাবু আশ্বস্ত করলেন, “আপনি ভয় পাবেন না ম্যাডাম। এরা দোষীদেরই ধরবে, নির্দোষীকে নয়।”

একেনবাবুর কথায় মনে হল সুকন্যা একটু স্বস্তি পেয়েছেন।

“এখন আমরা আসছি ম্যাডাম। মিস্টার শ্রীবাস্তবের নম্বর আমার কাছে আছে, আমিই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।”

.

সকালবেলায় আজ ভালো করে ব্রেকফাস্টও খাওয়া হয়নি। সুকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লবিতে নেমে একেনবাবুকে বললাম, “কি মশাই, হোটেলের কফিশপ-এ একটু কিছু খেয়ে নিলে হত না?”

“খেপেছেন স্যার, এই হোটেলে খাওয়া মানে তো টাকার শ্রাদ্ধ! তার চেয়ে চলুন বাইরে ছোটোখাটো কোনো জায়গায় যাই। একটা ডানকিন ডোনাটের দোকান দেখলাম স্যার। সস্তায় ভালো ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায় ওখানে।”

“ভালো কতটা হবে জানি না। কিন্তু আপনি যখন বলছেন সস্তা, সেটা মানতে আমি রাজি।”

আমরা যখন বেরোচ্ছি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও আমাদের সঙ্গ নিলেন।

 “আপনি স্যার ওঁদের সঙ্গে থেকে গেলেন না যে!”

“আরে না, এটা তো হল ল্যারির সমস্যা, মার্ডারটা ওর এরিয়াতে ঘটেছে। আর এফবিআই তো আছে সাহায্য করতে। ওদের এখনও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। মার্ডার ভিক্টিমের স্ত্রীকে আরেকটা সুইট-এ সরিয়ে দেবে, ঘরটা সিল করবে, দুয়েকটা স্টাফকে প্রশ্ন-টশ্ন করবে। আমি ভাবলাম অফিসে ফেরার আগে তোমাদের সঙ্গে একটু গল্প করে যাই।” তারপর মুচকি হেসে বললেন, “তুমি তো মনে হচ্ছে বিজনেসম্যানের ইয়ং উইডোর হয়ে খুনির খোঁজ করবে!”

“আসলে স্যার, ম্যাডাম ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন ওঁকে সাসপেক্ট করা হচ্ছে ভেবে।”

“তা ঠিক। কিন্তু সাসপেক্ট করাটা কি খুব ভুল? তোমাদের এই বিজনেসম্যান একজন মধ্যবয়স্ক লোক। স্ত্রী কমবয়সি যুবতী, যার সঙ্গে বিজনেসম্যানের ইয়ং অ্যাসোসিয়েটের সম্পর্কটা মনে হয় বেশ ঘনিষ্ঠ। বিজনেসম্যান না থাকলে দু-জনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ-ডিনার করে। হাবেভাবে ওদের অন্তরঙ্গতা খুব স্পষ্ট, হোটেলের অনেকেই সেটা কনফার্ম করেছে।”

“ওঁরা কি স্যার নিজেদের বন্ধু-সম্পর্কটা অস্বীকার করছেন?”

“তা নয়, কিন্তু একে অন্যের বিষয়ে উত্তর দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। বোঝাই যাচ্ছে ওদের এই রাঁদেভগুলো বিজনেসম্যানের অজান্তে হয়েছে।”

“ইন্টারেস্টিং স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু স্যার খুনটা হয়েছে কী ভাবে? আপনি তো বললেন স্ট্যান্ড-টু-ডেথ।”

“ঠিক, বিজনেসম্যান যখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন, তখন কেউ সামনে এসে বুকে ছুরি মেরেছে।”

“মাই গড ঘরে ঢুকল কী করে? ছুরিটা পাওয়া গেছে?”

“না, আততায়ী কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চায়নি, ওটা নিয়েই অদৃশ্য হয়েছে।”

“ম্যাডাম তখন কোথায় ছিলেন?”

“ওঁর বক্তব্য সকালে স্নান শেষ করে নীচে কফিশপে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন স্বামীর দেহ চেয়ারে হেলানো অবস্থায়। বুকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হি ওয়াজ ডেড। দেখেই উনি চিৎকার করতে শুরু করেন। একজন পোর্টার করিডর দিয়ে যাচ্ছিল। সে এসে ব্যাপারটা দেখে রিসেপশনে ফোন করে। সেখান থেকেই কেউ পুলিশে খবর দেয়।”

“ক’টা নাগাদ ঘটেছিল ব্যাপারটা?”

“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই ডানকিন ডোনাট-এ গিয়ে তো এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না! তুমি বরং আমার অফিসে চলো, তোমার সঙ্গে একটা ডিল করি।”

“ডিল?”

“আগে চলো তো আমার অফিসে। ডোনাট আর কফি না হয় আমার অফিসেই খাবে।”

.

মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে পৌঁছোলাম। সবার জন্য কফি আর ডোনাট-এর অর্ডার দিয়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, “হ্যাঁ যে ডিল-এর কথা বলছিলাম… তোমাকে আমি এই মার্ডারের ব্যাপারে যা জানি সব জানাব, যাতে তুমি তোমার ক্লায়েন্ট, মানে ওই উইডো লেডিকে সাহায্য করতে পারো। তার বদলে তুমি আমাকে সাহায্য করবে আইডিয়াল জুয়েলরির জুয়োচক্র-জট খোলার ব্যাপারে। আমি এ ব্যাপারে বিশেষ এগোতে পারছি না, এদিকে চাপ আসছে উপর থেকে। ডিল?”

“হ্যাঁ স্যার, ডিল। আমার ক্ষমতায় যা কুলোয় সবটুকু করব।”

“গুড, তাহলে এই মার্ডারের ব্যাপারে যতটুকু উদ্ধার হয়েছে বলি..” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট শুরু করলেন, “যেটা তোমাকে আগেই বলেছি, বিজনেসম্যানের স্ত্রীর বিবৃতি অনুসারে খুন হবার সময়ে তিনি ঘরে ছিলেন না, স্নান করে নীচে কফি শপ-এ খেতে গিয়েছিলেন। এটা ঠিক, সকালে উনি মৃতের বিজনেস অ্যাসোসিয়েট শ্রীবাস্তবের সঙ্গে কফিশপ-এ ব্রেকফাস্ট করেছিলেন। এটাও সম্ভবত ঠিক, উনি স্নান করেই কফি শপে গিয়েছিলেন, কারণ শাওয়ার স্টল ভিজে, কার্টেন ভিজে, এবং র‍্যাকে রাখা তোয়ালে ভিজে। অর্থাৎ সেটা ব্যবহার করা হয়েছিল সকালে। কিন্তু এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে না, খুনের সময়ে উনি ঘরে ছিলেন না।

রুম-সার্ভিসের অর্ডার দিয়েছিলেন বিজনেসম্যান নিজে। গত আট-দশদিন ধরে বিজনেসম্যানই ব্রেকফাস্টের জন্য রুম-সার্ভিস নিচ্ছেন, সুতরাং সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণত অর্ডার করেন ফ্রায়েড এগ, টোস্ট, সসেজ আর হ্যাঁশ ব্রাউন। এদিনও সেটাই করেছিলেন। সঙ্গে টমাটো জুস আর কফি। রুম সার্ভিসের যে স্টাফ খাবার দিয়ে গেছে, সেও ঘরে আর কাউকে বা অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। বিজনেসম্যান অন্যান্য দিনের মতো একাই বসার ঘরে ছিলেন। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে যখন ও চলে আসছে, বিজনেসম্যান দরজাটাকে ‘আন-লকড’ রেখে যেতে বলেন! রুম সার্ভিসের ছেলেটির মনে হয়েছিল কারোর জন্য উনি অপেক্ষা করছেন… দরজা খোলার জন্য খাওয়া ছেড়ে যাতে ওঁকে উঠতে না হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ডোর-ল্যাচটা ও খুলে রেখেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, কার জন্য বিজনেসম্যান অপেক্ষা করছিলেন? লোকটি কি তোমার ক্লায়েন্ট, মানে ওই ইয়ং উইডোর ফিঁয়াসে না অন্য কেউ!”

কথাটা শুনে আমার একটু অবাক লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়ং উইডোর জন্যেও তো হতে পারত?”

“মনে হয় না। প্রতি সকালেই বিজনেসম্যানের স্ত্রী নীচে খেতে যান, এই রিকোয়েস্ট রুম-সার্ভিস স্টাফকে আগে কখনো করেননি।”

এমন সময়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের টেবিলের একটা ফোন বেজে উঠল।

“আমাকে এখুনি ছুটতে হবে। পুলিশ চিফ এমার্জেন্সি মিটিং ডেকেছেন।”

.

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাবার পর কফি আর ডোনাট এল। সেগুলো সদ্ব্যবহার করলাম। আজ আমার কোনো ক্লাস ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল রিসার্চ প্রজেক্টের একটা কাজ। ঘণ্টা দুয়েকের বেশি লাগার কথা নয়। একেনবাবুকে সেটা বলতেই উনি বললেন, “ঠিক আছে স্যার, আমিও সেই ভাবেই আপনার অফিসে আসব। আপনার কাজ শেষ হলে একসঙ্গে হোটেলে গিয়ে সুকন্যা ম্যাডামের সঙ্গে আরেকটু কথা বলব।”

আমি ‘না’ আর করলাম না। মনে হচ্ছে একটা ইন্টারেস্টিং কেসে জড়িয়ে পড়ছি। প্রমথটা সব অ্যাকশন মিস করছে। পরে গল্প শুনে আফশোস করবে।

আমার কাজ শেষ হতে না হতেই দেখি একেনবাবু অফিসে এসে হাজির। এসে বললেন, “চলুন স্যার, সুকন্যা ম্যাডাম ঘরেই আছেন। ওঁর নতুন ঘরের নম্বরটা দিয়েছেন।”

.

০৭.

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছোলাম সুকন্যা তখন একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন। দূর-সম্পর্কের মাসি, নিউ ইয়র্কে ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন। একেনবাবু ঠিক করলেন ওঁদের ডিস্টার্ব না করে শ্রীবাস্তবের সঙ্গে একটু কথা বলবেন।

শ্রীবাস্তব নিজের ঘরে ছিলেন না। হোটেলের বিজনেস সেন্টারে বসে কতগুলো কাগজপত্র দেখছিলেন। খোঁজখবর করে সেখানে গিয়ে পৌঁছোতে আমাদের দেখে অবাক হয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন।

“ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, কিন্তু ঘরে বোধহয় ওঁর মাসি বসে আছেন, তাই ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি।”

“নিশ্চয়।”

“আচ্ছা, ব্ৰজদুলালবাবুকে কিছুদিন আগে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল, সে ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?”

“আমার ধারণা অনেকটাই জানি। উনি পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে একটা কাফলিংক কিনেছিলেন আইডিয়াল জুয়েলরি থেকে। স্যার ছিলেন একজন সিরিয়াস কাফলিংক কালেক্টর। একদিন এক বিজনেস মিটিং-এ কাফলিংকের কথা উঠতে একজন দোকানটার কথা বলেন। সেটা শুনে জায়গাটা আমি দেখে এসেছিলাম। ছোটো দোকান, কিন্তু কাফলিংকের বেশ ভালো কালেকশন। পরে স্যারকে নিয়ে আমি একদিন ওখানে গিয়েছিলাম। এরমধ্যে স্যার নিজেই একদিন যান। ফিরে এসে আমাকে বলেন আইডিয়াল জুয়েলরির নামে একটা পঁচিশ হাজার ডলারের ব্যাঙ্ক চেক কাটতে। চেকটা আমাদের কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকেই কাটতে হয়, কারণ এদেশে স্যারের নিজের অ্যাকাউন্ট নেই। তবে টাকাটা নেওয়া হয় স্যারের ডিসক্ৰিশানারি ফান্ড থেকে। এই কাফলিংক নিয়ে পরে একটা সমস্যা হয়। যে মেয়েটি কাফলিংক বিক্রি করেছিল, স্যার-এর সঙ্গে তোলা তার কয়েকটা ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়ে একজন কাফলিংকটা ফেরত চায়। ফেরত না পেলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। স্যার ভীষণ ভয় পেয়ে যান। কী করা যায়, এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনাও হয়। আমি বলেছিলাম কাফলিংক ফেরত না দিতে, স্যার রাজি হন না। শেষে দুজনে মিলে ব্ল্যাকমেলারের কথা মেনে পোর্ট অথরিটির টার্মিনালে তার জানানো নির্দিষ্ট জায়গায় ওটা দিয়ে আসি।”

“দাঁড়ান স্যার, ছবিগুলো কী ভাবে দেখিয়েছিল?”

“ছবিগুলো এসেছিল একটা খামে।”

“কোন ঠিকানায়? হোটেলের?

“না, স্যারের নামে আমাদের এখানকার অফিসের ঠিকানায় কেউ এসে দিয়ে গিয়েছিল।”

“ইন্টারেস্টিং। একটা কথা স্যার, যে ছবিগুলো ওরা দেখিয়েছিল, সেগুলো কি আপনার কাছে আছে?”

শ্রীবাস্তব কী জানি ভাবল, তারপর বলল, “স্যার জীবিত নেই, তাই এগুলো দেখাতে বোধহয় এখন আর কোনো বাধা নেই।”

পাশে রাখা ফাইল ফোল্ডার থেকে তিনটে ছবি এগিয়ে দিল।

প্রথম ছবিতে ব্রজদুলালবাবু একটি সুন্দরী মেয়েকে কিছু দিচ্ছেন,… মনে হচ্ছে টাকা। দ্বিতীয় ছবিটা একটু ঝাপসা। মেয়েটি উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে আছে। বিছানার একদিকে একটা আলো, অন্যপাশে একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল। ব্রজদুলালবাবুর পিছনটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটির বুকে চুমু খাচ্ছেন। তৃতীয় ছবিটা আরও ঝাপসা… মেয়েটিকে জড়িয়ে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় যিনি শুয়ে আছেন, তাঁকে দেখতে অনেকটা ব্রজদুলালবাবুর মতোই।

“দুটো ছবি কিন্তু খুব ঝাপসা… এগুলো তো বানানোও হতে পারে স্যার।”

“আমারও তাই মনে হয়েছিল, কিন্তু স্যার ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। উনি ইদানীং ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। প্রায়ই ভুলে যান একটু আগে কী করেছেন… মাঝেমাঝেই একটা কনফিউশন আর ডিজওরিয়েন্টেশনের মধ্যে থাকেন। স্যারের মনে হয়েছিল কোনো একটা ঘরে ঢুকে হয়তো এগুলো করেছিলেন!”

“আপনার কী মনে হয় স্যার?”

“আমার বিশ্বাস এগুলো কারসাজি করে বানানো। স্যারকে নিয়ে নানান গসিপ হয়, কিন্তু আমি যতদিন ওঁকে চিনি, অনৈতিক কিছু করতে দেখিনি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন জীবনের বেশিদিন বাকি নেই।”

“তার মানে? এটা ঠিক বুঝলাম না।”

“স্যার ক্যানসারে ভুগছিলেন, সেটা ব্রেইন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বড়োজোর আর মাস ছয়েক বাঁচতেন, হয়তো বা আরেকটু বেশি। বেশিদিন উনি থাকবেন না আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এইভাবে হঠাৎ শেষ হয়ে যাবেন ভাবিনি।” শেষ কথাটা বলতে বলতে শ্রীবাস্তবের গলা ধরে এল।

“এগুলো কি আপনি পুলিশকে জানিয়েছিলেন?”

“না। পুলিশ শুধু প্রশ্ন করেছে আর তার উত্তর চেয়েছে। ওঁদের ফোকাস ছিল আমার আর সুকন্যার ওপরে, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে।”

“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক মানে?”

“আপনি সুকন্যার স্বার্থ দেখছেন, সেক্ষেত্রে আমি কিছু লুকোব না। আমি সুকন্যাকে ভালোবাসি সুকন্যার সঙ্গে স্যারের বিয়ে হওয়ার আগের থেকেই। নানান কারণে আমাদের বিয়েটা হয়নি। স্যার যখন সুকন্যাকে বিয়ে করেন, তার আগেই ওঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। আমরা জানতাম একদিন দু-জনেই দুজনকে পাব, শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সুকন্যাকে ভুল বুঝবেন না, স্যারকে ও বঞ্চনা করেনি। আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়নি, বিশ্বাস করুন। স্যারও আমাদের ভালোবাসার কথা জানতেন। আমাকেও স্নেহ করতেন।.. আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করছেন না?”

“কী যে বলেন স্যার, তবে এটা মানতে অনেকেরই অসুবিধা হবে।”

“সেটাই। পুলিশের ধারণা এই খুনের সঙ্গে সুকন্যা আর আমি যুক্ত!”

“আসলে কি জানেন স্যার, ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যুতে আর্থিক ভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা তো আপনার আছে, মানে ম্যাডামের অ্যাঙ্গেল থেকে।”

“আমরা সেটা জানি। কিন্তু সেই সন্দেহ দূর করব কী করে সেটাই জানি না!”

“ট্রু স্যার, ভেরি ট্রু। কিন্তু সন্দেহই তো যথেষ্ট নয়।” মাথা চুলকোলেন একেনবাবু।

“তার মানে?”

“শুনুন স্যার, মোটিভের সঙ্গে মিনস এবং অপরচুনিটিও দরকার। আপনি যে মৃত্যুর সময় ওঁর ঘরে ছিলেন সেটা প্রমাণ করতে হবে, ব্রজদুলালবাবুকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা খুঁজে বার করতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে খুন করানো হলে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারটা বার করতে হবে, তাই না? সেটা কি পুলিশ পারবে স্যার?”

শ্রীবাস্তব চুপ করে রইলেন। একেনবাবু ওঁর টিমে না বিপক্ষ দলে শ্রীবাস্তব বোধহয় সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

“একটা কথা স্যার, সুকন্যা ম্যাডাম এই ছবিগুলোর কথা জানেন?”

উত্তরটা দিতে শ্রীবাস্তব একটু অস্বস্তি বোধ করল। “হ্যাঁ, ছবিগুলো হঠাৎ করেই ওর নজরে এসেছিল।”

“কী ভাবে স্যার?”

“আমার এই ফাইল ফোল্ডারে মেসি-জ থেকে কেনা কাটলারি সেট-এর একটা রিসিট ছিল। সেটটা কিনে আনার পর ওর পছন্দ হয়নি। ফেরত দেবার জন্য যখন দোকানের রিসিট খুঁজছিল, আমিই বলেছিলাম স্যারের পার্সোনাল ফোল্ডারে ওটা রয়েছে। আমার খেয়াল ছিল না, ছবিগুলোও ওখানেই রাখা আছে।”

“দেখে কি রিয়্যাকশন হল স্যার?”

“ভীষণ রেগে গিয়েছিল! এত রাগতে আগে ওকে দেখিনি। স্যার আন-ফেইথফুল, এটা ও মানতে পারছিল না। আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম ছবিগুলো জাল। স্যার যে আইডিয়াল জুয়েলরিতে কাফলিংক কিনতে গিয়েছিলেন, মেয়েটা সেখানকারই সেলসগার্ল। নিশ্চয় ওখানেই দু-জনের ছবি তুলে এগুলো কেউ ফটোশপ করেছে। ভাবছে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা পাবে।”

“উনি কি সেটা মেনে নিয়েছিলেন?”

“প্রথমে মানতে চায়নি, পরে শান্ত হয়েছিল।”

“কাফলিংকটা যে আপনারা ফেরত দিয়েছিলেন, সেটা ম্যাডাম জানেন?”

“না।”

“কেন স্যার?”

“ওরা যে কাফলিংকের জন্য ব্ল্যাকমেল করছে ও জানত না। ও খুবই বুদ্ধিমতি, কাফলিংক ফেরত দেওয়া হয়েছে শুনলে দুয়ে-দুয়ে এক করে বুঝে যেত ছবিগুলো বানানো নয়।”

“এবার বুঝলাম, স্যার। পুলিশকে এগুলো দেখিয়েছেন?”

“না।”

“কেন নয় স্যার? কেউ যে ব্রজদুলালবাবুকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল, সেটা তো পুলিশের কাছে একটা দরকারি তথ্য।”

“আসলে ছবিগুলোর বিষয়টা প্রকাশ্যে আনতে চাইনি। পুলিশকে জানালে ওরা হয়তো স্যারকে হত্যা করার আরও একটা মোটিভ খুঁজে পেত… স্বামী অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে কিছু করছে… হত্যা করার সেটাও তো একটা মোটিভ হতে পারে।”

“ভালো কথা স্যার, বিয়ের আগে সুকন্যা ম্যাডাম কী করতেন?”

“মাসাজ থেরাপি করত। এক বছর ডাক্তারিও পড়েছিল, বাবা মারা যাওয়ায় টাকাকড়ির অভাবে আর পড়তে পারেনি।”

“ব্রজদুলালবাবু তো সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন, ম্যাডাম কি তখন হোটেলেই থাকতেন?”

“না, না, ওর জন্য একটা লিমো ঠিক করা ছিল। ইচ্ছেমতো বেড়াত, বাজার-টাজার করত। মিটিং না থাকলে আমিও গেছি ওর সঙ্গে। রাত্রে আমরা সবাই ঘুরেছি একসঙ্গে। স্যারের চিন্তা ছিল যাতে ও একা একা বোর্ড না হয়।”

একেনবাবু এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কেউ কি ব্রজদুলালবাবুর খোঁজ করেছিল গত দু-একদিনের মধ্যে?”

“গতকাল অফিসে একজন ফোন করেছিল। স্যার ব্যস্ত ছিলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দরকার?’ লোকটা বলল, তোমার বসের একটা কাফলিংক ফেরত দেবার কথা ছিল, কিন্তু দেননি। লোকটার গলার স্বর আর বলার ভঙ্গিতে আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাফলিংক?’ লোকটা বলল, তোমার বস সেটা ভালো করে জানেন।’ আমি বললাম, “সেটা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে দিয়ে এসেছি।’ লোকটা বলল, ‘লায়ার!’ আমিও ফোনটা কেটে দিলাম।

“এগুলো তো সব আপনার পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। আপনি তো চান পুলিশ আসল খুনিকে ধরুক। চান না?”

শ্রীবাস্তব কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইল।

এমন সময়ে শ্রীবাস্তবের মোবাইলে কেউ ফোন করল। “হ্যালো,” বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ওঁরা আমার সঙ্গে কথা বলছেন। ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ফোনটা বন্ধ করে বললেন, “সুকন্যা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আমরা এখনই যাচ্ছি।” বলে একেনবাবু উঠে পড়লেন।

হলওয়ে দিয়ে যেতে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন মশাই?”

“ভাবছি স্যার।”

“কী ভাবছেন?”

“প্রেম আর জেলাসি অতি বিষম বস্তু, স্যার। অথবা শ্রীবাস্তব অতি ঘোড়েল একটি লোক… আমাদের ঘোল খাওয়াবার চেষ্টা করছেন।”

.

০৮.

আমরা যখন দরজায় নক করলাম, সুকন্যা একাই ঘরে ছিলেন।

একেনবাবু বললেন, “সরি ম্যাডাম। আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করব। এর মধ্যেই। আমরা শ্রীবাস্তব স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, খুব হেল্পফুল ম্যাডাম। আপনি তো ওঁকে ভালো করে চেনেন?”

কথাটা শুনে সুকন্যার ভুরু একটু যেন কোঁচকাল। “হ্যাঁ, সুধীর আমার ভালো বন্ধু।”

“শ্রীবাস্তব স্যার বললেন আপনার স্বামী একটা দামি কাফলিংক কিনেছিলেন কয়েকদিন আগে। আপনি কি সেটা জানতেন ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ, আমি জেনেছিলাম, কারণ তার জন্য ২৫ হাজার ডলারের একটা ব্যাঙ্ক চেক কাটতে হয়েছিল। এই নিয়ে সুধীরের সঙ্গে যখন ওঁর কথা হচ্ছিল আমি ঘরে ছিলাম।”

“একটা কাফলিংকের জন্য অতগুলো টাকা! আমি ম্যাডাম কল্পনা করতে পারি না।”

“এর থেকেও দামি কাফলিংক উনি কিনেছেন। কাফলিংক জমানো ছিল ওঁর নেশা। একজন কাউন্টের কাফলিংক উনি ১০০ হাজার ডলার দিয়ে কিনেছিলেন।”

“সেই কাফলিংকটা এখন কোথায় ম্যাডাম?”

“কলকাতায়।”

“আমি বলছি, এই নতুন কেনা কাফলিংকের কথা।”

“ঠিক জানি না। সুধীরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল ও-ও জানে না।”

“অত দামি একটা কাফলিংক উনি কোথায় রাখতে পারেন?”

“অনেক সময় দামি এবং দরকারি জিনিস উনি কোম্পানির সেফ-এ রাখেন। সুধীরই কাজটা করে। সেই জন্যেই আমার অবাক লাগল সুধীর জানে না।”

“একটা কথা ম্যাডাম, আপনি কি সুধীরবাবুর ফোল্ডারে কয়েকটা ছবি দেখেছিলেন… মানে আপনার স্বামী আর একটি মেয়ের?”

সুকন্যা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। “আজেবাজে বানানো ছবি! আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো আগেও হয়েছে… নতুন কিছু নয়।”

“কবে দেখেছিলেন মনে আছে ম্যাডাম?”

“দিন দুই আগে।”

“তারপরে আপনি হোটেলের বাইরে গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, একটা কাটলারি সেট ফেরত দিতে গিয়েছিলাম।”

“একা?”

“না, ওঁর অফিসের একটি মেয়ের সঙ্গে।”

“আর কোথাও যাননি?”

“না।”

“মিস্টার শ্রীবাস্তব, মানে সুধীরবাবুকে আপনার স্বামী কতদিন চিনতেন ম্যাডাম?”

“বছর দুয়েক।”

“যদ্দুর জানি ম্যাডাম, আপনার সঙ্গেও তো স্যারের পরিচয় বছর দুয়েক। তাই না?”

“না, আমি তার আগে থেকে চিনতাম। ওঁর সঙ্গে সুধীরের পরিচয় হয় আমাদের বিয়ের পর।”

“অল্পদিনের পরিচয় হলেও সুধীরবাবুর ওপর আপনার স্বামীর খুব আস্থা ছিল মনে হয়। তাই না, ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ।”

“সুধীরবাবুও আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করতেন।”

“করত।”

“এই প্রশ্নটার জন্য কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে সুধীরবাবুর সম্পর্কটা ঠিক কিরকম ছিল?”

সুকন্যা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, মুখটা থমথমে। তারপর খুব আস্তে আস্তে কিন্তু খুব সুস্পষ্ট ভাবে বললেন, “আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসি। ভুল বুঝবেন না, আমার স্বামীকে আমি ঠাকাইনি। তিনিও এই সম্পর্কের কথা জানতেন। আমি যখন ওঁর জীবনে আসি, তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত। শরীরের নানান ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। ওঁকে সেবা করতে এসেই ওঁর জীবনে জড়িয়ে পড়ি। আমি জানতাম ওঁর আয়ু বছর দুই আড়াইয়ের বেশি নয়। যদিও উনি মানতেন না… মনের জোরে চলতেন… আপনি আমাকে কী ভাবছেন জানি না, কিন্তু…।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয়। এবার বলুন তো, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

“না, আমি পুলিশকেও সেটা জানিয়েছি। সে-রকম কাউকে আমি মনে করতে পারি না।”

“আপনার স্বামী যখন খুন হন আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

“আমি নীচে কফিশপে ছিলাম। ওখানেই আমি আর সুধীর ব্রেকফাস্ট করি। আমার স্বামী একা ব্রেকফাস্ট খেতে পছন্দ করতেন, তারপর দেশের অফিসে অনেকের সঙ্গে কথা বলতেন।”

“আই সি। আচ্ছা, আপনার স্বামী কি কাউকে এক্সপেক্ট করছিলেন সকালে?”

“আমাকে কিছু বলেননি। অন্যান্য দিন সুধীর সকালে আসে। ওঁর সঙ্গে কাজের দুয়েকটা কথা হয়। ও ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে, আমি আর সুধীর নীচে কফিশপ-এ খেতে যাই। কিন্তু আজ সকালে সুধীর ফোন করে বলল, ওর আসতে একটু দেরি হবে। আমি যেন সোজা কফিশপ-এ চলে আসি, ও সেখানে মিট করবে। আমার স্বামী যখন ব্রেকফাস্ট অর্ডার করছেন তখনই আমি বেরিয়ে যাই। তারপর কে এসেছে কোনো ধারণাই নেই।”

“আর একটা প্রশ্ন ম্যাডাম… আপনি যখন কফিশপে-এ গিয়ে পৌঁছোলেন, তার কতক্ষণ বাদে মিস্টার শ্রীবাস্তব সেখানে আসেন?”

“বেশিক্ষণ নয়, মিনিট কয়েকের মধ্যেই।”

“মিনিট কয়েক মানে কি দু-মিনিট, পাঁচ মিনিট, না তার বেশি?”

“মিনিট দুয়েকই হবে, তার বেশি নয়।”

“ম্যাডাম, আপনি পান খেতে ভালোবাসেন?” হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে সুকন্যা অবাক হয়ে তাকালেন।

সামনে কাচের কফি টেবিলে একটা প্লেটে গোটা দুই সাজা পান লবঙ্গ দিয়ে আটকাননা।

একেনবাবু পানগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার ফ্যামিলিও খুব ভালোবাসেন। মানে আমার বেটার হাফ, ম্যাডাম। তবে এখানকার পানে দেশের স্বাদ নেই।”

“হ্যাঁ, একটু অন্যরকম ঠিকই।”

“তবে নেই-মামার থেকে কানা-মামা ভালো। এই রকম ফাইভ স্টার হোটেলে যে পান পাচ্ছেন, সেটাই তো দারুণ ব্যাপার!”

“হ্যাঁ, লাকিলি আমিনার সঙ্গে পরিচয় হল, ও প্রতিদিন আমার জন্য পান নিয়ে আসে লেক্সিংটন স্ট্রিটের একটা দোকান থেকে।”

“আমিনা!”

“বাংলাদেশের মেয়ে, এখানে হাউস কিপিংয়ের কাজ করে।”

একেনবাবু জুলু জুলু চোখে পানের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সুকন্যা জিজ্ঞেস করলেন, “খাবেন একটা পান?”

“আরে না ম্যাডাম। মাত্র দুটো তো আছে!”

“তাতে কী হয়েছে! আমিনাকে বললেই আরও কয়েকটা নিয়ে আসবে।”

আর বলতে হল না। একেনবাবু একটা মুখে পুরে চোখ বুজে চিবোতে চিবোতে বললেন, “বাঃ, দারুণ টেস্ট ম্যাডাম!”

“আপনিও একটা নিন না!” সুকন্যা আমাকে বললেন।

“থ্যাঙ্কস, আমি পান খাই না।”

.

হোটেল থেকে ফেরার পথে একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করলেন।

“স্যার, আপনি আপনার লোকদের একটু খোঁজ করে দেখতে বলবেন, পোর্ট অথরিটির ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’ ডিপার্টমেন্ট-এ কোনো সাফায়ার ডায়মন্ড-এর কাফলিংক জমা পড়েছে কিনা। জমা পড়লে আমাকে জানাবেন।”

“আপনার মাথায় কী ঘুরছে বলুন তো?” আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।

“আসলে আমি একটু কনফিউসড স্যার। কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে… কিছুই পরিষ্কার বুঝতে পারছি না!”

“আমি কিন্তু বুঝতে পারছি ছবিগুলোর মধ্যে দুটো ছবি ফেক।”

“কী করে বুঝলেন স্যার?”

“ব্রজদুলালবাবু ফুলের আশেপাশে এলেই অ্যালার্জিতে কাবু হন। আর বিছানা পাশে ফুলদানিতে অতগুলো ফুল, কিন্তু তাও মেয়েটির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি চালাচ্ছেন!”

“মন্দ বলেন নি স্যার। তবে কিনা আমরা জানি না, ফুলগুলো সত্যি ফুল না প্লাস্টিকের।”

এটা আমি ভাবিনি, তাই চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “পোর্ট অথরিটিতে কাফলিংকের খোঁজ করছিলেন কেন?”

“কয়েকটা পসিবিলিটি আছে। একটা হল, কাফলিংকটা শ্রীবাস্তববাবু ভুল জায়গায় ফেলেছিলেন আর ক্লিনার সেটা লস্ট আর ফাউন্ড-এ জমা দেয়। সম্ভাবনাটা ক্ষীণ, কিন্তু অনেস্টম্যান তো এদেশে আছে স্যার। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, শ্রীবাস্তববাবু কাফলিংকটা নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। তার বদলে হাবিজাবি কিছু বালতিতে ফেলেছেন, ব্রজদুলালবাবু দূর থেকে তা দেখেননি। সেক্ষেত্রে কেউ ফোন করে বলতেই পারে যে কাফলিংক তারা পায়নি।”

“কিন্তু শ্রীবাস্তব গল্পটা আমাদের করতে যাবে কেন?”

“সেটাই ভাবছি স্যার। হয়তো পুলিশই ঠিক পথে এগোচ্ছে স্যার, খুনটা করেছেন মিস্টার সুধীর শ্রীবাস্তব।

“কিংবা সুকন্যা।”

“সবই সম্ভব স্যার। সুকন্যা ম্যাডাম তো স্যার সুধীরবাবুর প্রেমে হাবুডুবু। তাঁকে তাড়াতাড়ি আপন করে পাবার ইচ্ছে, সেই সঙ্গে যোগ করুন আনফেইথফুল বুড়ো স্বামীর আচরণ। খুব যে রেগে গিয়েছিলেন, সে তো সুধীরবাবুই জানালেন। ম্যাডাম ডাক্তারি পড়তেন, ছুরির ব্যবহার নিশ্চয় জানতেন।”

“কল্পনাই যখন করছেন, তাহলে ফারাকেই বা বাদ দিচ্ছেন কেন। তাকেও তো সুকন্যা খুন করতে পারে।”

“অপরচুনিটিটা নেই স্যার, অন্তত আমাদের যা বলেছেন, সেটা সত্যি ধরলে।”

“সত্যি যে বলেছে, তার প্রমাণ কী?”

“ঠিক স্যার, ভেরি কনফিউসিং। “

একেনবাবুর অন্য কী একটা কাজ ছিল, উনি বাড়িতে ঢুকলেন না। বাড়ি ফিরে দেখি প্রমথ মহোদ্যমে রান্না করছে। আমাকে দেখা মাত্র হুকুমে হুকুমে প্রাণান্ত করল। তার ফাঁকে ফাঁকেই সারাদিন কী কী হয়েছে শুনল। ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট-এর জন্য এগুলো সব মিস করছে… তারজন্য বিশ্বসুন্ধু সবার বাপান্ত করল। টিপিক্যাল প্রমথ!

.

০৯.

পরদিন সকাল সকাল দুটো ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষ করে যখন অফিসে ফিরলাম, একেনবাবু আমার ঘরে।

“কী ব্যাপার, কাল কোথায় ছিলেন গভীর রাত পর্যন্ত?”

উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলেন “আপনার কি আর ক্লাস আছে স্যার?”

“না, কেন?”

“তা হলে চলুন।”

“কোথায়?”

“সুকন্যা ম্যাডামের কাছে।”

“ব্যাপারটা কী?”

“হোটেলের লন্ড্রি রুমে তোয়ালে জড়ানো রক্তমাখা ছুরি পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা ওটা দিয়েই ব্রজদুলালবাবুকে খুন করা হয়েছে। কাজ শেষ করে ছুরিটা তোয়ালের মধ্যে ঢুকিয়ে লন্ড্রিট দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মিস্টার শ্রীবাস্তবকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মিনিট পাঁচেকের জন্য মিস্টার শ্রীবাস্তবের কোনো অ্যালিবাই নেই। আর নেই খুব ক্রিটিক্যাল সময়ে, সুকন্যা ম্যাডামের সঙ্গে খেতে আসার আগে! ম্যাডাম সুকন্যা ভীষণ বিচলিত… আমাদের ডেকেছেন।”

“আমাদের’ মানে তো আপনাকে, বহুবচন লাগাচ্ছেন কেন! কিন্তু দোষী ধরা পড়লে আপনি আর কী করবেন?”

“রাইট স্যার। ও আরও একটা ব্যাপার, পোর্ট অথরিটির লস্ট এন্ড ফাউন্ড অফিসে কোনো কাফলিংক পাওয়া যায়নি।”

“আপনি কি ভেবেছিলেন কিছু পাওয়া যাবে?”

“না স্যার, পাওয়া গেলে অবাকই হতাম, তখন একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হত।”

 একেনবাবু ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন বুঝলাম না। কিন্তু এ নিয়ে আর প্রশ্ন করলাম না।

.

হোটেলে সুকন্যার ঘরে পৌঁছোনোর আগেই দেখলাম একটি ভারতীয় চেহারার মেয়ে ট্রলিতে অজস্র তোয়ালে, চাদর, ইত্যাদি নিয়ে হলওয়েতে হাঁটছে… বোঝাই যাচ্ছে হোটেলের হাউসকিপিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করে।

“একটু চান্স নিই, স্যার,” বলে একেনবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, “আমিনা?”

একেনবাবুর ডাক শুনে মেয়েটি চমকে ফিরে তাকাল।

 “আপনি আমিনা?” একেনবাবু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

 কেমন জানি ভীত মুখে বলল, “হ্যাঁ, আমারে খোঁজেন?”

“আপনাকেই খুঁজছি, ম্যাডাম।”

“নো ম্যাডাম, আই হাউসকিপার।”

“বাংলায় বলুন, আমরা বাঙালি।”

বাংলা শুনে মনে হল আমি একটু স্বস্তি পেল। “আমি এখানে কাজ করি স্যার।”

(আমিনার বাংলাদেশি উচ্চারণ আমি লিখতে পারব না, আমি আমার মতো করে কথাগুলো লিখছি।)।

“সেটা আমি জানি। আপনার কথা সুকন্যা ম্যাডাম বলেছেন। আপনি তো ওঁর জন্য পান কিনে আনেন প্রতিদিন।”

“হ্যাঁ, ম্যাডাম পান ভালোবাসেন।”

“আপনি থাকেন কোথায়?”

“প্যাটারসনে।”

“কদ্দিন এখানে চাকরি করছেন?”

“প্রায় মাস পাঁচেক হল। আপনি কি পুলিশের লোক?”

“সেটা কেন মনে হচ্ছে?”

“আপনাকে তো দেখলাম পুলিশের সাহেবদের সঙ্গে।”

“আমি ম্যাডাম সুকন্যার জন্য কাজ করছি… ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে।”

“খুব ভালো লোক ছিলেন স্যার।”

“আপনাকে পুলিশ প্রশ্ন করেছিল?”

“না। আমি তো ইংরেজি ঠিক জানি না, উত্তরও দিতে পারতাম না।”

“আপনি কি এখন কাজে যাচ্ছেন?”

“না, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে।”

“বেশ, তাহলে দুয়েকটা প্রশ্ন করি। যেদিন ব্রজদুলালবাবু মারা গেলেন সেদিন আপনি সকালে গিয়েছিলেন ঘর পরিষ্কার করতে?”

“না। সাহেব আর ম্যাডামদের ঘর আমি পরিষ্কার করি দশটা নাগাদ। তবে সামনের একটা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম।”

“ক’টা নাগাদ?”

“সাড়ে আটটার সময়।”

“আপনি কি দরজা বন্ধ করে ঘর পরিষ্কার করেন?”

“না, সব সময় দরজা খুলে রেখে পরিষ্কার করতে হয়।”

“সেখান থেকে কি ব্রজদুলালবাবুর দরজা দেখা যায়?”

“না, ঘরটা স্যারের পাশের ঘরের উলটোদিকে।”

“হলওয়েতে কাউকে দেখেছিলেন? মিস্টার শ্রীবাস্তব বা আর কারোকে?”

“শ্রীবাস্তব স্যার নিজের ঘরে ছিলেন… ওঁর কম্পিউটারে কিছু একটা কাজ করছিলেন। আমাকে বলেছিলেন একটু পরে এসে ঘরটা পরিষ্কার করে যেতে।”

“সেটা বুঝলাম। তারমানে আর কাউকে দেখেননি?”

“না, একজনকে দেখেছিলাম তোয়ালে হাতে, মনে হয় একজন গেস্ট।”

“সাহেবের ঘর থেকে কিছু শুনেছিলেন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে, তাই ঠিক বুঝিনি।”

“মনে করার চেষ্টা করুন… যে কোনো কথা, অর্থ না জানলেও চলবে।”

“একটা লোকের গলা শুনছিলাম। ধমকের সুরে কিছু বলছিল কী একটা খালিন বা ওরকম কিছু। উত্তরে স্যার কিছু বলছিলেন। কিন্তু ওই কথাটাই বার কয়েক শুনেছিলাম। তারপরেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাই, আর কিছু শুনতে পাইনি।”

“ঘর পরিষ্কার করার পর কি আপনি শ্রীবাস্তবের ঘরে গেলেন?”

“না। আমার ম্যানেজার ফোন করে বললেন তিন তলায় আরেকটা ঘর পরিষ্কার করতে। সেটা করে যখন দোতলায় নামি, তখন দেখি স্যারের দরজা খোলা … অনেক পুলিশ। আমি ভয় পেয়ে ওখানে আর দাঁড়াইনি।

“ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হল কখন?”

“দুপুরবেলা আমাকে শ্রীবাস্তব স্যার ফোনে ডাকলেন। বললেন ম্যাডামকে নতুন রুম নম্বরে গিয়ে পান দিয়ে আসতে।”

“পান পেলেন কোথায়?”

“আমার কাছে থাকে স্যার। আমি খুব পান খাই।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা, আপনি তো স্যার আর ম্যাডামের ঘর পরিষ্কার করছেন বেশ কিছুদিন, আপনি ওঁদের ঘরে দামি কিছু পড়ে থাকতে দেখতেন?”

 “স্যার, আমি কোনো দামি জিনিস ছুঁই না। যদি কিছু চোখে পড়ে, দামি বলে মনে হয়, ঠিক যেখানে দেখি সেখানে রেখে দিই।”

“আপনি কোনো কাফলিংক দেখেছিলেন?”

“ওই কথাটাই তো শুনেছিলাম স্যার, আমিনা উত্তেজিত হয়ে বলল। খাফলিন’… কী স্যার ওটা?”

“বোতামের মতো দেখতে। হাতের আস্তিনে থাকে।” একেনবাবু আমার শার্টের বোতামের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। তবে খুব সুন্দর আর বড়ো আঙটির মতো দেখতে হয়।”

“হ্যাঁ স্যার, একটা আধখোলা খামের মধ্যে আঙটির মতো কয়েকটা বোতাম আর একটা খোলা বাক্স বাইরের টেবিলে দেখেছিলাম। আমি ম্যাডামকে বলেছিলাম। ম্যাডাম সেটাকে ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন।”

“ঝোলা ব্যাগ?”

“ক্লজেটে একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকত। স্যার নিজের জিনিস এদিক-ওদিক ফেলে ছড়িয়ে রাখতেন আর ভুলে যেতেন, ম্যাডাম আমাকে চোখে কিছু পড়লে ঝোলা ব্যাগে রাখতে বলতেন। পরে সেখান থেকে স্যারকে বার করে দিতেন।”

“সেই ঝোলা ব্যাগটা কোথায়?”

“ম্যাডামের নতুন রুমে। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আমি ওটা রেখে এসেছি।”

“চমৎকার, তাহলে চলুন ম্যাডামের ঘরে ওটা এখনও আছে কিনা দেখি।”

ঘরে সুকন্যা পাংশু মুখে বসে আছেন। একেনবাবু ঢুকেই বললেন, “ম্যাডাম, দুর্ভাবনা করবেন না। আমি একটা জিনিস ক্লজেটে রেখেছে, সেটা এখনও আছে কিনা আগে দেখি।”

সুকন্যার হতভম্ব মুখ দেখে বুঝলাম ওঁর কোনো ধারণাই নেই, কী নিয়ে কথা হচ্ছে।

ক্লজেটে ঝুলন্ত কাপড়ের ঝোলা হাতড়ে আমিনা একটা খাম বার করল। তারমধ্যে থেকে বেরল একটা বাক্স, ভেতরে দুটো কাফলিংক। কারুকার্য করা গিল্টি সোনার, মধ্যিখানে একটা হিরের চোখ। একেনবাবুর চোখে উত্তেজনা। ফোন করলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিশ্চয় খুব কাছেই ছিলেন, কয়েকমিনিটের মধ্যেই এফবিআই র ফিল্ড অফিসার ডেভ বলডুইনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। কাফলিংকটা দেখেই ডেভ বলে উঠলেন, “বিঙ্গো! কোত্থেকে পেলেন?”

“ব্রজদুলালবাবুর ঘরেই ছিল, হাউস কিপার সরিয়ে রেখেছিল।”

“এটাই সেই স্পাই-কাফলিংক?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন ডেভকে।

 ডেভ মন দিয়ে কাফলিংকের মুখটা পরীক্ষা করে বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে। এখুনি এটাকে ল্যাব-এ পাঠাচ্ছি, ছবিগুলো প্রিন্ট করতে।”

“আপনি স্যার, ছবিগুলো একবার হাউসকিপার আমিনাকে দেখিয়ে দেবেন। ও মনে হয় সাহায্য করতে পারবে খুনিকে আইডেন্টিফাই করতে। তবে বাংলা জানে এমন কাউকে ডাকবেন, ও ভালো ইংরেজি বোঝে না।”

“অতি অবশ্য, অতি অবশ্য।” তড়িঘড়ি সবাই বিদায় নিলে একেনবাবু সুকন্যাকে বললেন, “ম্যাডাম মনে হয় এখন আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

.

১০.

কয়েকদিন বাদে আমাদের ডাক পড়ল এফবিআই-এর ফিল্ড অফিসে। ডেভ বলডুইন হলেন হোস্ট। ওদের কনফারেন্স রুমের টেবিলে কফি, ডোনাট, কেক, ফুটস ইত্যাদি সাজানো। সেখানে ল্যারি স্টকটন আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও হাজির। ল্যারি আর ডেভ-এর করমর্দনে একেনবাবুর হাত মুচড়ে যাবার জোগাড়। ল্যারি বললেন, “স্পাই ক্যামেরার ভিডিও থেকে প্রায় সবাইকেই শনাক্ত করা গেছে। হাউস কিপিং-এর আমিনা দেখিয়ে দিয়েছে হলওয়েতে সাড়ে আটটার সময় তোয়ালে হাতে কাকে ও দেখেছে। কাঁচা-পাকা চুল, মোটা ভুরু, নাকের ওপর একটা বড়ো আঁচিল. আইডিয়াল জুয়েলরির মালিক। তোয়ালে জড়ানো যে ছুরিটা পাওয়া গেছে তার হাতল থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি ঠিকই। ভালো করেই আততায়ী সেটা মুছেছে, কিন্তু ফরেন্সিক এক্সপার্টদের টাচ-ডিএনএ-এর যে টেকনিক আছে, সেটা আততায়ী জানে না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা কী?”

উত্তরটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দিলেন। “আমাদের শরীরের চামড়া থেকে সবসময়েই স্কিন সেল ঝরছে। তোয়ালেতে তার কয়েকটা পাওয়া গেলেই সেগুলো থেকে পিসিআর অ্যানালিসিস করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা যায়। তবে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি, লোকটা সব স্বীকার করেছে।

আমি জানি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একেনবাবুর আগেই কথা হয়েছে… কিন্তু ড্রামাটিক এফেক্ট-এর জন্য ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, “একেন, এঁদের এবার বুঝিয়ে বলো কী ভাবে কাফলিংকটা পেলে?”

“কী যে বলেন স্যার, আমি একা কেন, এঁরা সবাই না থাকলে কি আর হত?”

“আরে বিনয়টা ছেড়ে বলো।”

“আসলে স্যার, এক সেট নয়, দু-সেট কাফলিংক এর মধ্যে জড়িত ছিল। একটা দামি, আরেকটা সস্তা। দামিটা ছিল কার্টিয়ের কোম্পানির স্যাফায়ার ডায়মন্ড কাফলিংক, যেটা কেনাই ছিল বিজনেসম্যান ব্রজদুলালবাবুর উদ্দেশ্য। কিন্তু দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে প্রথম দিন সেটা কিনতে পারেননি। একটা সস্তা কাফলিংক আন-অফিশিয়ালি ক্যাশ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। কথা ছিল পরের দিন দোকান খুললে ব্যাঙ্ক চেক নিয়ে এসে দামি কাফলিংকটা কিনবেন, তখন ওই সস্তা কাফলিংকটা ফেরত দিয়ে সেই ক্যাশ টাকাটা নিয়ে নেবেন। বলা যেতে পারে ওটা ছিল খানিকটা আর্নেস্ট মানি। ব্রজদুলালবাবু ওই সস্তা কাফলিংকটা আর ফেরত পাঠালেন না। তিন-চারশো ডলার ওঁর কাছে কিছুই নয়! কিন্তু কাফলিংকটা সস্তা হলেও ওর মধ্যেই স্পাই ক্যামেরা ঢোকানো হয়েছিল। আপনাদের এক এজেন্ট কয়েকদিন আগে ওটা কিনে তার মধ্যে মাইক্রো-ক্যামেরা ঢুকিয়ে মালটা ফেরত দিয়েছিল। আইডিয়াল জুয়েলরি রিটার্ন গুডস নেয় না, কিন্তু ম্যাডাম ফারা নিয়েছিলেন আপনাদের ফিল্ড অফিসারের চার্মে মোহিত হয়ে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সেটাই আমাকে বলেছেন। নিশ্চয় সেটা সম্ভব, আমার কিন্তু ধারণা মালিকের অনুমতি নিয়েই ম্যাডাম ফারা ফেরত নিয়েছিলেন… খুব বেশি দামের জিনিস তো নয়! আর ওতে যে স্পাই ক্যামেরা ঢোকানো হয়েছে মালিক প্রথমে হয়তো সন্দেহ করেননি। সন্দেহ থাকলে ওটাকে নষ্ট করতেন।

“দ্বিতীয় এজেন্ট যখন পরের দিন দোকানে গেলেন ওই কাফলিংকটার খোঁজে, তখনই মনে হয় সন্দেহের শুরু। দ্বিতীয় এজেন্টের আসল পরিচয় হয়তো ওরা জানত। ওটা এমন কোনো স্পেশাল কাফলিংক নয়, কিন্তু ঠিক ওটাই এই এজেন্টের কেন দরকার? এদিকে ম্যাডাম ফারাও পড়লেন মুশকিলে। তিনি তো জানতেন দোকানে ওটা নেই। ব্রজদুলালবাবুকে কাঁচা রসিদ দিয়ে ক্যাশে বিক্রি করেছিলেন। মালিক শুধু জানতেন ওটা ফেরত এসেছে এবং বিক্রিরও কোনো রেকর্ড নেই। মোটমাট ম্যাডাম ফারা ধরা পড়ে সবকিছু স্বীকার করলেন। উনি যে মালিকের অজান্তে ওটা ব্রজদুলালবাবুকে দিয়েছেন সিসিটিভিতেই দেখা গেল! মালিকের গ্যাং মেম্বাররা তখন সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত… কাফলিংকে স্পাইং ডিভাইস আছে, পুলিশের হাতে পড়ার আগেই যে করে হোক ওটাকে উদ্ধার করতে হবে। কে কাফলিংকটা প্রথমে কিনেছিল, তাকে খুঁজে বার করা হল সিসিটিভি-র ছবি থেকে। ম্যাডাম ফারার সঙ্গে তাঁর হয়তো পরিচয়ও হয়েছিল। তবে কী ভাবে ওই প্রথম এজেন্টকে এতো তাড়াতাড়ি খুঁজে বার করা হল, আই হ্যাভ নো ক্ল। একটা সম্ভাবনা, দ্বিতীয় এজেন্টের পরিচয় ওরা জেনে গিয়েছিল বলে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করছিল। হঠাৎ করে প্রথম এজেন্ট তার সঙ্গে দেখা করতে আসায় খুনের কাজটা সহজ হয়ে যায়। ম্যাডাম ফারাকে হত্যা করা হল উনি পুলিশের হয়ে কাজ করছেন সন্দেহে। বাকি রইল বিজনেসম্যান ব্রজদুলালবাবুর কাছ থেকে কাফলিংকটা দ্রুত উদ্ধার করা। তখনই ব্ল্যাকমেল শুরু হল। ব্রজদুলালবাবু ভাবলেন দামি কাফলিংক ফেরত চাইছে। না, ওরা চাইছিল সস্তা কাফলিংকটা। তাই কাফলিংক ফেরত দিয়েও মুক্তি পেলেন না। আমি ভাগ্যক্রমে ওটা পেলাম হোটেলের হাউস কিপিং লেডি আমিনার জন্য। তিনি ওটা যত্ন করে সরিয়ে

ডেভ বলডুইন বললেন, “একটা জিনিসই বুঝলাম না, দুটো কাফলিংক চাইলেই তো চুকে যেত… দুটোই যখন বিজনেসম্যানের কাছে ছিল!”

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম স্যার। মনে হয় গ্যাং-এর সবাই তখন এতো ভীত ও উত্তেজিত, কুইক অ্যাকশন নিতে গিয়ে সবদিক খেয়াল রাখতে পারেনি। ভাগ্যিস পারেনি স্যার।”

“তোমার জন্যেই জুয়োচক্রটা আবিষ্কার হয়েছে। আইডিয়াল জুয়েলরির মালিকই এটার মূল পাণ্ডা।” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন। “কিন্তু একেন তোমাকে এবার একটা প্রশ্ন করি। আইডিয়াল জুয়েলরি নিয়ে এফবিআই-এর এত মাথাব্যথা কেন… অনুমান করতে পারো?”

“আপনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন স্যার!”

“আরে না, বলো না।”

“আপনিই তো স্যার বলেছিলেন জাল টাকা সংক্রান্ত।”

“কিন্তু কী সেটা?”

“আমার ধারণা স্যার, এই জুয়োচক্র চালিয়ে বাজে টাকা এক্সচেঞ্জ করা হচ্ছিল ভালো টাকার সঙ্গে।”

ডেভ বলডুইনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “কী ভাবে?”

“খুবই সহজ স্যার। যারা বাজি ধরছে তারা দিচ্ছে ভালো টাকা, জিতলে দেওয়া হচ্ছে নকল টাকা। হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।”

“বুঝলাম না,” আমি বললাম। “বাজি জিতে নকল টাকা পেলে তো লোকেরা কমপ্লেন করতে পারে পুলিশের কাছে।”

“স্যার অপরাধ করতে গিয়ে টাকা খোয়ালে কি কমপ্লেন করা যায়। নিউ ইয়র্ক সিটির আইন অনুসারে তো স্যার এগুলো হচ্ছে ইল্লিগ্যাল বেটিং… তাই কি না!” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দেখলাম গর্ব গর্ব মুখ করে ল্যারি আর ডেভের তাকাচ্ছেন… ভাবটা কী বলেছিলাম!