০৬.
দীপেন চাইনিজ খাবার কিনে এনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বুঝতে পারছিলাম অনিন্দ্যর মৃত্যু ওকে খুবই নাড়া দিয়েছে। আমাদেরও খারাপ লাগছিল, কিন্তু চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস-এর ডাক উপেক্ষা করা যায় না। দীপেন খুব অল্পই খেল। খেতে খেতেই একেনবাবু দীপেনকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, অজয়বাবু সম্পর্কে আপনি কী জানেন?”
“অজয়কে খুব ভালো করে চিনি বলব না। তবে এখানে এসে ওর বাড়িতেই প্রথম গিয়েছি। ওর স্ত্রী অনিন্দিতা যে দীপান্বিতার সঙ্গে কলেজে পড়ত বলেছিলাম বোধহয় আপনাকে।”
“হ্যাঁ স্যার, মনে হয় বলেছিলেন। তা কী করেন অজয়বাবু?”
“ইন্টারনেট সিকিউরিটির একটা কোম্পানিতে কাজ করে শুনেছি।”
“আচ্ছা, আপনি স্যার সেদিন এও বলেছিলেন… আপনার ফ্যামিলি বিরক্ত হন ওঁদের সঙ্গে মিশতে…।”
“ফ্যামিলি?”
“মানে তোর স্ত্রী দীপান্বিতা।” আমি বললাম, “একেনবাবু স্ত্রী-কে ফ্যামিলি বলেন।”
“ও আচ্ছা। আসলে দীপান্বিতা বেশি হই-হুঁল্লোড় পছন্দ করে না। শুনেছিলাম, বিচিত্রা ক্লাবের মধ্যেই অজয়দের একটা এক্সক্লিউসিভ গ্রুপ আছে। ওদের পার্টি, আড্ডা সব সেই গ্রুপের মধ্যে, আর পার্টিগুলো একটু ওয়াইল্ড হয়। মদ-টদ খেয়ে কে যে কী করে ঠিকঠিকানা নেই।”
“কার কাছ থেকে শুনেছিলেন স্যার?”
“অনিন্দ্যই কথায় কথায় একদিন বলেছিল।”
“অনিন্দ্যবাবু কি ওই গ্রুপে ছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে অনিন্দ্য অন্যদের সঙ্গেও আলাদা ভাবে মিশত। ইন ফ্যাক্ট, এখানে এসে অনিন্দ্যর বাড়িতেই আমরা সবচেয়ে বেশি গেছি। ট্যালেন্টেড ছেলে ছিল। রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসত। খুব ভালো স্কেচ করত। আমার আর দীপান্বিতার স্কেচ করেছিল একদিন। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমাদের মুখটা এত সুন্দর করে আঁকল যে অবিশ্বাস্য!” বলতে বলতে চোখটা ওর সজল হলে উঠল।
“ওর নেগেটিভও নিশ্চয় কিছু ছিল স্যার।”
“তা ছিল, কাণ্ডজ্ঞান একটু কম।”
“মানে স্যার?”
“পেটে কথা রাখতে পারত না। যেটা বলার নয়, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেটা বলে ফেলত। বিশেষ করে পেটে একটু মদ পড়লে তো কথাই নেই। দীপান্বিতা তাতে অনেক সময়ে বিরক্ত হত, কিন্তু জানত ওর মনটা ভালো ছিল। সেইজন্য আমাদের যাতায়াতটা বন্ধ হয়নি।”
“আর কিশোরবাবু? তিনিও কি ওই গ্রুপের মধ্যে ছিলেন?”
“কোন গ্রুপ?”
“অজয়বাবুদের।”
“হ্যাঁ। কিশোরকে আমি তেমন চিনি না, তবে ও অনিন্দ্যর খুব ভালো বন্ধু ছিল, আর ভালো ছবি তুলত।”
“হ্যাঁ, উনিই স্যার অনিন্দ্যবাবুর ডেডবডি আবিষ্কার করেছিলেন।”
“অজয় তাই বলল। আরও বলল, আপনি তদন্ত করছেন এই মার্ডারের। একটু আগে ওর সঙ্গে থানায় কথাও বলেছেন।”
“তা একটু সাহায্য করছি স্যার।”
“অজয় কিন্তু খুব নার্ভাস, আপনি ওর আর অনিন্দ্যর ঝগড়া নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন দেখে।”
“আরে না স্যার ঝগড়া তো সব সময়েই হয় বন্ধুদের মধ্যে।”
“তা না, অজয় বলল, সবাই একটু হাই হয়েছিল ত্রিদিবের বাড়িতে, সেইজন্য খুন-টুন করার কথা তুলেছিল… আসলে ড্রাঙ্ক হলে কে যে কী বলে! ওর খুব চিন্তা আপনি সেটা কী ভাবে নিয়েছেন। এমনিতে ও আমাকে ফোন করে না। আজ এই নিয়ে দু-বার। বাপি আর প্রমথ আমার ছেলেবেলার বন্ধু আর আপনারা সবাই একসঙ্গে থাকেন জেনেই ফোনটা করেছিল মনে হয়।”
“উনি খামোখা ভয় পাচ্ছেন স্যার। তবে আরও দুয়েকটা প্রশ্ন ছিল… ওঁর সঙ্গে দেখা হলে ভালোই লাগত। আর থানায় প্রশ্ন করছি না বলে কথা বলতে উনি হয়তো রিল্যাক্স বোধ করবেন।”
“দাঁড়ান, দেখছি বাড়িতে আছে কিনা।” বলেই দীপেন ওয়াশরুমে গেল মুখ ধুতে। একটু বাদেই ফিরে এসে বলল, “অজয়কে ধরার চেষ্টা করলাম। একটা জরুরি দরকারে কাজে গেছে। অনিন্দিতা, মানে ওর স্ত্রী আপনাকে বিশেষ করে আসতে বলল। ও ভীষণ নার্ভাস, কিশোর ছাড়া একমাত্র অজয়কেই পুলিশ জেরা করছে দেখে!”
অজয়ের অ্যাপার্টমেন্ট খুব একটা দূরে নয়। আসলে মিডলসেক্স কাউন্টির ইস্ট ব্রান্সউইক, ব্রান্সউইক, র-ওয়ে ইত্যাদি শহরগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে একের পিঠে এক হয়ে রয়েছে। অনিন্দিতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পুজোয় দেখা হয়েছিল। চেহারাটা আবছা মনে ছিল। পুজোয় শাড়ি পরেছিলেন, আজকে জিনস আর মেরুন রঙের ট্যাঙ্ক টপ। প্রসাধন ছাড়াই আকর্ষণীয় চেহারা, তবে বোঝা যাচ্ছে খুবই নার্ভাস।
“অজয়কে ফোন করে বললাম আপনারা আসছেন। এমনিতে সোমবার ওর কাজের চাপ বেশি… তারওপর সকালে পুলিশ স্টেশনে যেতে হল। তাও চেষ্টা করবে আসতে।”
“না না, তার কোনো দরকার নেই ম্যাডাম।”
ম্যাডাম’ শুনে সবার যা রিয়্যাকশন অনিন্দিতার সেটাই হল।
প্রমথ বলল, “ওঁকে ঠেকাতে পারবেন না। শিশু বয়সের অভ্যাস।”
একটু যেন হাসলেন অনিন্দিতা। তারপর একটু থেমে থেমেই বললেন, “আপনারা বোধহয় ওকে সন্দেহ করছেন।” বলেই একেনবাবুর দিকে এক ঝলক তাকালেন।
“আরে কী মুশকিল ম্যাডাম, এতটুকু নয়! প্রশ্ন তো করতেই হয়।”
“হ্যাঁ ও বলল, অনিন্দ্যর সঙ্গে ওর ঝগড়া নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন।”
“তা চেয়েছিলাম, ম্যাডাম।”
“আসলে আমাদের পার্টিতে কেউ কেউ একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলে। অজয়ও ব্যতিক্রম নয়। তখন সাধারণ ব্যাপারও অসাধারণ হয়।”
“আপনি কি জানেন ম্যাডাম ব্যাপারটা কী?”
“আমি ঠিক জানি বলতে পারব না, তবে অনুমান করছি।”
“অনুমানটাই বলুন ম্যাডাম।”
দেখলাম অনিন্দিতা ইতস্তত করছেন। “দেখুন আমার এটা বলতে অসুবিধা নেই, কিন্তু অজয়ের পক্ষে এটা কারোর কাছ থেকে শোনা অত্যন্ত হার্টফুল।”
“ম্যাডাম, বুঝতে পারছি খুবই পার্সোনাল ব্যাপার, বললেও চলবে।”
“না, আমি বলব। অজয়ের কাছে এটা অসম্মান হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলে অজয়ের এই রাগের কারণটার অন্য রকম মানে করে ওকে এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হবে।” …হঠাৎ অনিন্দিতা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, নির্বাক হয়ে থাকাই ভালো।
একটু চুপ করে একটা বড় শ্বাস নিয়ে অনিন্দিতা শুরু করল, “আমার শ্বশুরমশাইয়ের মেয়েদের ব্যাপারে একটা দুর্নাম ছিল। অজয় একজনকে মাসিমা বলত, পরে জেনেছি তিনি ছিলেন শ্বশুরমশাইয়ের রক্ষিতা। মাসিমা বাড়িতে আয় হয়ে এসেছিলেন আমার অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করতে। অজয়ের বয়স যখন বছর পাঁচেক শাশুড়ি মারা যান। শাশুড়ির মৃত্যুর পরও মাসিমা বাড়িতে থেকে অজয়কে বড়ো করেন। আমার বিয়ের আগে আমাদের বাড়ির ধারণা ছিল উনি শাশুড়িমায়ের দূর সম্পর্কের দিদি বা বোন। যাহোক এসব কথা এখানে কারোর জানার কথা নয়। সেদিন পার্টিতে সবাই একটু ড্রাঙ্ক হয়েছিল। হঠাৎ কে আলোচনা শুরু করল মনে নেই… বিষয়টা হল, কেউই জোর করে বলতে পারে না কে তার আসল বাবা। শুধু তার মা-ই জানে ছেলের আসল বাবা কে। খুবই সিলি কথাবার্তা… হাসিঠাট্টা দিয়েই শুরু হয়েছিল। এমন সময়ে কে জানি বলল, “যাক, আসল মা কে জানলেই তো হল। কিছুর মধ্যে কিছু নয়, অনিন্দ্য হঠাৎ অজয়কে বলল, কিন্তু অনেকে তো জানে না তার আসল মা কে? সেক্ষেত্রে?” অজয় বলল, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’
অনিন্দ্য বলে উঠল, “মাসিমা যদি মা হয়?” এই নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু। কে জানি অজয়কে এর মধ্যে বোঝাবার চেষ্টা করল, “তুই এটা পার্সোনালি নিচ্ছিস কেন, তোর বাপ নিয়ে তো প্রশ্ন তুলছে না?’ এরপর আর তর্কাতর্কি নয়, রীতিমতো চিৎকার, গালাগাল আর ধাক্কাধাক্কি! আমরা মেয়েরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ত্রিদিব আর অরিন্দম দেখছিলাম ওদের সামলাবার চেষ্টা করছে। এই আস্তে, কী হচ্ছে মেয়েদের সামনে! কে কার কথা শোনে!
এরপর অজয় যখন অনিন্দ্যকে প্রায় টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, ত্রিদিব অরিন্দমকে পাঠাল ওদের সামলাতে। খানিক বাদে দেখি অনিন্দ্য একা ঘরে এসে ওর কোটটা নিয়ে কাউকে কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।”
“অজয়বাবু তখন কোথায় ছিলেন ম্যাডাম?”
“দরজার ঠিক বাইরে। অরিন্দম তখনও অজয়কে শান্ত করছে।”
“তখনই কি অজয়বাবু বলেছিলেন, “আই উইল কিল দ্যাট স্কাউন্ড্রেল?”
“হ্যাঁ, যখন অনিন্দ্য দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।”
“কিশোরবাবু তখন কোথায় ছিলেন?”
“কিশোর পার্টির ছবি তুলছিল। ও খুব ছবি তুলতে ভালোবাসে, আমাদের সঙ্গেই বসেছিল। ত্রিদিবও আমাদের সঙ্গে ছিল। ও হোস্ট, হোস্টের দায়িত্ব পালন করছিল।”
একেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ম্যাডাম, আপনি যে কথাটা আমাদের বললেন। এটা কি এখানে আর কেউ জানে?”
“কোন কথাটা?”
“এই অজয়বাবুর মাসিমার ব্যাপারটা।”
“কারোরই তো জানার কথা নয়,” অনিন্দিতা বলল, “এখানকার সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় এদেশে এসে।”
“আমি তো শুনেছিলাম দীপান্বিতা ম্যাডাম, মানে দীপেনবাবুর স্ত্রী আপনার সঙ্গে কলেজে পড়তেন?”
“ও হ্যাঁ, কিন্তু ও আমাকে চিনত বিয়ের আগে। এসব নিয়ে ওর সঙ্গে কোনো কথা আমার হয়নি।”
দীপান্বিতার প্রসঙ্গ আসায় দীপেন দেখলাম অস্বস্তি বোধ করছে।
“তোমাকে কি দীপান্বিতা কিছু বলেছিল এ বিষয়ে?” অনিন্দিতা প্রশ্ন করল দীপেনকে।
“না, না, আমি কিছুই জানি না,” ব্যস্ত হয়ে জবাব দিল দীপেন, “দীপান্বিতা কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে।”
একেনবাবু দীপেনের উত্তর শুনে অনিন্দিতাকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আপনাদের ক’টা গাড়ি ম্যাডাম?”
অনিন্দিতা অবাক হয়ে তাকাল প্রশ্নের পারম্পর্য বোঝার চেষ্টা করতে।
“ক’টা গাড়ি!”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। এখানে, মানে নিউ জার্সিতে তো শুনেছি সবারই দুটো গাড়ি। এখানে বাস-টাস তো বেশি চলে না।”
“হ্যাঁ, আমাদের দুটো গাড়ি।”
“কোনটা অজয়বাবু চালান?”
“মার্সিডিজটা অজয় চালায়। একসঙ্গে কোথাও গেলে ওটাই আমরা নিই। আমি নিজে ছোটো গাড়িটা চালাই– সুবারু।”
“ম্যাডাম আপনার বাড়ির ঠিক সামনে তো দেখলাম একটা মার্সিডিজ।”
“ও হ্যাঁ, অজয় আজকে ছোটো গাড়িটা নিয়ে গেছে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাডাম। পুলিশের একজন হয়তো একবার আসবে। তবে আমাকে যা বলেছেন, তা আবার বলার দরকার নেই। আমি শুধু একবার কিশোরবাবুর কাছে যাব। উনি কি খুব দূরে থাকেন?”
“না, না, একেবারেই না। আজকে ওকে পাবেনও, অফিস যায়নি। একটু আগেই আমার সঙ্গে কথা হল। আপনি একবার ফোন করুন না, যাতে বাড়িতে থাকে। ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। থ্যাঙ্ক ইউ, আমরা আজ আসি।”
একেনবাবুর পিছন পিছন আমরা বেরিয়ে এলাম। একেনবাবু কিশোরকে ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আসতে পারেন কিনা। উত্তর নিশ্চয়, হ্যাঁ।
একেনবাবু আমাদের বললেন, “এক সেকেন্ড স্যার, আমি আর্মান্দো সায়েবকে একটা ফোন করছি।” বলে আমাদের থেকে একটু আড়ালে গিয়ে আর্মান্দোর সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন। ফিরে এসে দীপেনকে বললেন, “আপনার তাড়া নেই তো স্যার, তাহলে চলুন, কিশোরবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।”
“না, না, চলুন। এমনিতেই কিছু করবার আজ মন নেই।”
.
০৭.
কিশোর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ও-ও মনে হল সকাল থেকেই বিধ্বস্ত হয়ে আছে। বার বার বলল, “কী যে হল, কিছু বুঝতে পারছেন একেনবাবু?”
“কনফিউসিং তো বটেই স্যার। তবে কি না আমি এসেছি, আপনার কাছে কিছু ছবি দেখতে।”
“মানে?”
“মানে স্যার, আমি শুনেছি আপনি খুব ভালো ফটোগ্রাফার। যেখানেই যান ছবি-টবি তোলেন।”
“ভালো ফটোগ্রাফার কিনা জানি না, ছবি তোলা আমার বহুদিনের হবি। এখন তো মোবাইলেও ভালো ছবি তোলা যায়। ভালো ক্যামেরারও দরকার হয় না।”
“আমি স্যার ছবি-টবি সে-রকম বুঝি না, আমি এসেছি শুধু পার্টির ছবি দেখতে?”
“কোন পার্টির?
“অরিন্দমবাবুর অ্যানিভার্সারির পার্টি। তুলেছিলেন ছবি সেখানে?”
“হ্যাঁ, তুলেছি… এই তো, বলে আলমারি থেকে ডিজিট্যাল ক্যামেরাটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, প্রায় চল্লিশটা ছবি তুলেছিলাম সেদিন।”
“সব ছবি আপনি তুলেছেন?”
“সব। এই ক্যামেরা আমি কাউকে ধরতে দিই না। কোনটে দেখতে চান?
“প্রথম দিকের ছবিগুলো। যদি অজয়বাবুর কোনো ছবি থাকে সেখানে?”
“আছে।” বলে ক্যামেরা থেকে খুঁজে খুঁজে ছবিগুলো বার করতে থাকল। প্রায় পাঁচটা ছবি। আলাদা নয়, গ্রুপের মধ্যে। ডার্ক স্যুট পরা অজয়, খুব সুন্দর ছবি। এগুলোকে একটু বড়ো করা যায় না?”
“কেন যাবে না? নিন, এইটে ক্লিক করতে থাকুন, আর এই বাটনটা ছবিকে সেন্টারিং করার জন্য। আর এইটে নেক্সট, এইখানে ক্লিক করলে পরের ফ্রেমের ছবিটা দেখতে পাবেন।”
“ক্যামেরাটা ধরব স্যার… মানে আপনি যে একটু আগে বললেন…।”
কিশোর এক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝল। তারপর একটু হেসেই বলল, “সেটা ছবি তোলার ব্যাপারে, ছবি দেখার ব্যাপারে নয়।”
প্রমথও একেনবাবুকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। একেনবাবু ঠিক কী দেখতে চান, বুঝলাম না। কিন্তু খুব মন দিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকলেন। মাঝে মাঝে এত ম্যাগ্নিফাই করে ফেলছিলেন যে ছবির ছবিত্ব বলে কিছু থাকছিল না। হঠাৎ ছবি দেখা বন্ধ করে জিজ্ঞস করলেন, “ভালো কথা স্যার, অজয়বাবু নাকি কিছুক্ষণের জন্য পার্টি ছেড়ে বাইরে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। সিগারেট এখনও ছাড়তে পারছে না। মাঝে মাঝেই ওকে ধুয়ো গিলতে হয়, বারণ করলেও শোনে না।”
“কতক্ষণ বাইরে ছিলেন উনি?”
“এক্সাক্টলি বলতে পারব না। না দাঁড়ান, বেরোনোর আগে আমাকে বলে গিয়েছিল। তখন সম্ভবত সাড়ে আটটা। তার একটু আগেও হতে পারে। কারণ আমার মনে আছে, হিলটনের কনভেনিয়েন্ট স্টোর-এ পায়নি। তাই ওকে বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি যেতে। স্টপ এন-গো, ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়। যদি সিগারেট ওখানে না পায় তাহলে আরও দূরে যেতে হবে।”
“কখন ফিরেছিলেন?”
“সাড়ে ন’টার অনেক আগেই হবে। কারণ অরিন্দমদের নাই অ্যানিভার্সারির কেক কাটিং ঠিক সাড়ে ন’টার সময় হবে প্ল্যান ছিল।”
“আপনার ঠিক মনে আছে, সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিলেন?”
“সেটাই ধারণা, কিন্তু জোর করে বলতে পারব না, একটু অনুমান করছি। তাড়াতাড়ি ওকে যেতে বলেছিলাম, এটুকু মনে আছে। আর সাড়ে ন’টার আগে ফিরেছিল।”
“ঠিক আছে কেক কাটার ছবিগুলো দেখান।”
“নেক্সট বাটনটা ক্লিক করতে থাকুন পেয়ে যাবেন।”
“ও হ্যাঁ, তাই তো স্যার।”
একেনবাবু ক্লিক করে করে ছবিগুলো দেখছেন, মাঝে মাঝে খুট খুট করে এনলার্জ করছেন। আমার কিছুই করার নেই। সময় কাটাবার জন্য কিশোরের বইয়ের র্যাকের দিকে মন দিলাম। কিশোর মনে হল ট্র্যাভেল বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক। সারা র্যাক জুড়েই ট্র্যাভেল-এর বই। আমি ইজরায়েল ট্র্যাভেল-এর বইটা তুলে পাতা উলটোতে থাকলাম। একটু বাদে শুনি একেনবাবু জিজ্ঞেস করছেন, “আচ্ছা স্যার, এই ছবিগুলো কি আমায় ইমেল করতে পারেন?”
“সবগুলো?” কিশোরের গলায় একটু যেন বিস্ময়।
“সবগুলো তো অনেক সময় লাগবে। আপনি বরং ত্রিদিববাবুর, অরিন্দমবাবুর, অজয়বাবুর ছবিগুলো পাঠান। প্রথম দিকের আর কেক কাটার পরের দিকের।”
“আপনার ইমেল অ্যাড্রেসটা বলুন।”
অ্যাড্রেস বলা মাত্র কিশোর খুট খুট করে ছবিগুলো সিলেক্ট করে জিজ্ঞেস করল, “কী রকম রেসলুশন চান?”
“যত বেশি হয়, ততোই ভালো।”
“ঠিক আছে।” একটু বাদেই বলল, “চলে গেছে সব।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।”
“আর আপনার সময় নষ্ট করব না। শুধু আর কয়েকটা প্রশ্ন, আপনি কি সারাক্ষণই পার্টিতে ছিলেন?”
“হ্যাঁ।
“শেষবার, মানে আজকে সকালটা বাদ দিলে… কবে গিয়েছিলেন অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে?”
“দিন দশেক আগে।”
“অজয়বাবু আর অনিন্দ্যবাবুর ঝগড়ার পর যাননি?”
“না, অফিসের কাজে দিন তিনেকের জন্য মিশিগান যেতে হয়েছিল। ফিরেছি বৃহস্পতিবার। ক্লান্ত ছিলাম, তবে ফোনে কথা হয়েছিল। তখনই বলল ও শুক্রবার পার্টিতে আসবে না। আমি অনেক বোঝানোর পর বলল, ঠিক আছে আসবে।”
“ঝগড়ার কারণটা জানতেন স্যার?”
“ফ্র্যাঙ্কলি না। সিলি কথাবার্তা হচ্ছিল। হঠাৎ অজয় চটে যায়। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়, কিন্তু অতো রেগে যাবার কী কারণ বুঝিনি।”
“ও আরেকটা কথা স্যার, ত্রিদিববাবু আর অরিন্দমবাবুর নম্বরটা জানি না। আপনি একটু দেবেন?”
“নিশ্চয়।” কিশোর ফোন থেকে বার করে দুটো নম্বরই দিল।
“জানি না, আজ ওঁদের পাব কিনা…”।
“অরিন্দমকে পাবেন না। দু-দিনের ছুটি নিয়ে ওরা খুব ভোর বেলায় ওয়াশিংটন ডিসি তে গেছে। আমি যখন অনিন্দ্যর খবর জানাতে ফোন করেছি, তখন ওরা মেরিল্যান্ডে। তবে ত্রিদিবকে অফিসে পাবেন। ওর অফিস কাছেই। বাড়িও অফিস থেকে দূরে নয়। ও সাতদিনই কাজ করে।”
“অফিসটা কোথায়?”
“আমি অফিস বিল্ডিংটা জানি, অনেকগুলো অফিস ওখানে। ঠিক কোনটা জানি না।” দীপেন বলল।
“চেনার কোনো অসুবিধা নেই।” কিশোর বলল। “রিসার্ভ পার্কিং স্পেস-এ যেখানে অ্যালফা রোমিও গাড়ি দেখবেন, তার সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেই প্রথম অফিস হল ত্রিদিবের।”
অ্যালফা রোমিও নামটা বোধহয় একেনবাবু আগে শোনেননি। আমি বললাম, “খুব এক্সপেনসিভ গাড়ি, এই অঞ্চলে বেশি নেই।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, এখন চলি, পরে কথা হবে।” বলে কয়েক পা গিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন।
“কাল পার্টি থেকে কখন ফিরলেন স্যার?”
“রাত সাড়ে এগারোটায়।”
“একা?”
“হ্যাঁ, একাই। মানে অজয় আমার সঙ্গে ছিল। অরিন্দম আর কেতকী খুব সকালে ডিসি চলে যাবে বলে আগের দিনই অজয় আর আমাকে বলে রেখেছিল পার্টির শেষে ক্লিন আপ-এ হেল্প করতে। আমরা তাই থেকে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে অজয়কে নামিয়ে বাড়ি ফিরি।”
“অনিন্দিতা ম্যাডাম?”
“ও অন্য কারো কাছ থেকে রাইড নেয়। সবাই তো আমরা কাছাকাছি থাকি।”
“তা তো বটেই স্যার।” বলে চলে যাবার জন্য আবার পা বাড়ালেন। তারপর একটু মাথা চুলকে আবার ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আপনার তো স্যার আজ অফিস ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আপনি তো স্যার যাননি?”
“আসলে আমি অফিসেই যাচ্ছিলাম। অনিন্দ্যকে কেন গত রাতে ফোনে ধরতে পারিনি মাথায় ছিল। তাই অফিস যাবার পথে ওর বাড়িতে থেমেছিলাম। তারপর ওই ভয়াবহ দৃশ্য! প্রথমে পুলিশে ফোন করি, তারপর অফিসেও জানিয়ে দিই যে আসতে পারব না… বন্ধু খুন হয়েছে।”
“আপনি জানতেন স্যার যে, অনিন্দ্যবাবু খুন হয়েছেন!”
“মানে?”
“আত্মহত্যাও তো হতে পারে স্যার?”
কথাটা শুনে কিশোর কেমন জানি হতবাক হয়ে গেল!
“মানে, আমি…।”
“ঠিক আছে স্যার, আপনি আপনার অনুমানের কথা বলেছেন, তাই তো?”
কিশোর মাথা নাড়ল।
কিশোরবাবুকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে একেনবাবু বেরিয়ে এলেন। আবার আর্মান্দোকে ফোন করলেন– এবারও আড়ালে গিয়ে। মনে হল বোধহয় দীপেনকে জানাতে চান না কথাগুলো। আমার আর প্রমথর কাছে এভাবে কিছু গোপন করেন না।
বিকেল প্রায় চারটে। একেনবাবুকে বললাম, “এরপর বেশি দেরি করলে টানেল বা হাইওয়ে যাই নিই না কেন ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ব।”
“না না স্যার, আমরা দীপেনবাবুর বাড়ি থেকে সোজা বেরিয়ে পড়ব।”
“কালকে এখানে আসবেন কী করে, আমার কিন্তু কালকে ক্লাস!”
“স্যার, কালকের কথা কালকে। এখন তো বাড়ি যাই।”
দীপেন চা খেয়ে যেতে বলল। কিন্তু ওকে ‘না’ বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ফেরার পথে প্রমথ বলল, “সত্যি গা জ্বলে যায়, গণ্ডমূর্খ ব্যাটা ত্রিদিব অ্যালফা রোমিও চড়ছে, আর আমাকে বাপির এই ঝাড়ঝাড়ে টয়োটাতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে হচ্ছে!”
“দেখছেন একেনবাবু, আমার গাড়িতে যাচ্ছে আবার গালমন্দও করছে।”
“এই গাড়ি স্যার কিছুমাত্র খারাপ না। ফাংশানাল স্যার, গাড়ি তো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবার জন্য। দিব্যি তো চলে এলাম স্যার নিউ জার্সিতে, এখন আবার ফিরেও যাচ্ছি।”
“থাক, আর বাপিকে তেল মারতে হবে না। কাল থেকে আপনি অন ইওর ওউন, বাপির ক্লাস আছে।”
“জানি তো স্যার, ওদের বলে দিয়েছি। ওরা আজকের আসার খরচাও দেবে।”
“বাঃ। ওটা আবার কেঁপে দেবেন না, বাপিকে দিয়ে দেবেন।”
“কী যে বলেন স্যার, ঝাঁপব কেন?”
“না, এই প্রসঙ্গটা আগে তোলেননি বলে একটু সন্দেহ হচ্ছিল।”
প্রমথটা ইদানীং প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমি ধমক দিলাম, “তুই চুপ করবি?”
“বেশ করব। তোরই উপকার করছিলাম। না চাইলে করব না।”
“আচ্ছা একেনবাবু, লুকিয়ে লুকিয়ে আর্মান্দোর সঙ্গে কী কথা বলছিলেন? আর লুকিয়ে লুকিয়ে কেন? আমাদের বিশ্বাস করেন না?”
“কী যে বলেন স্যার, আপনাদের বিশ্বাস না করলে আমার চলে?”
“ধ্যাত্তেরিকা, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে হয় না। উত্তরটা দিন।” প্রমথ ধমক লাগাল।
“কয়েকটা জিনিস স্যার। এক হল ম্যাডাম অনিন্দিতার কাছ থেকে অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা নিয়ে একটু পরীক্ষা করা… অনিন্দ্যবাবুর গায়ে লাগা বুলেট ওই হ্যান্ডগান থেকে বেরিয়েছিল কিনা, আর…।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” আমি একেবুকে থামিয়ে দিলাম। “আপনি কি অজয়কে সন্দেহ করছেন?”
“মোটিভ তো একটা আছে স্যার, কিন্তু কত জোরদার সেটা জানি না।”
“সেটা তো এক, আর?”
“আর স্যার জানতে, অনিন্দিতা ম্যাডামের মনে আছে কিনা, কতক্ষণ অজয়বাবু পার্টি ছেড়ে বাইরে ছিলেন।”
“হাউ অ্যাবাউট কিশোর? ওকি ধোয়া তুলসি পাতা?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“কিশোরবাবু তো কিছু করেছেন বলে মনে হয় না।”
“কারণ?”
“ওই যে ছবিগুলো দেখলাম।”
“তাতে কী হল?”
“চল্লিশটা ছবি স্যার, তিন-চার মিনিট অন্তর অন্তর তোলা পার্টির ছবি। নিজেই ছবি তোলেন। আমি টাইম স্ট্যাম্পগুলো দেখেছি স্যার। উনি ক্লিয়ার। কোথাও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের জন্য যাননি।”
“কয়েকটার মধ্যে মাত্র দুটোর উত্তর পেলাম। আর কী জিজ্ঞেস করলেন আর্মান্দোকে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“ও হ্যাঁ, গাড়িগুলোও একটু চেক করতে বললাম। “স্টপ-এন-গো’-র সিকিউরিটি ক্যামেরাও চেক করতে বললাম– ক’টার সময় অজয়বাবু ওখানে পৌঁছেছিলেন বা আদৌ ওখানে গিয়েছিলেন কিনা দেখতে।”
“গাড়ি চেক করতে! তার মানে কী?
“স্যার সব কিছুরই কি মানে হয়! বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!”
“আপনি মশাই সামথিং।”
আমাদের বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। আজকের পুরো দিনটাই গেল। আমার তবু ক্লাস ছিল না। প্রমথকে ওর ল্যাব ফাঁকি দিতে হল। সেটা এমন কোনো বিরাট ব্যাপার নয়। উইক এন্ডে ও যা কাজ করে সেখানে একদিন না যাওয়াটা কিছুই নয়। তাও খোঁটা দিল একেনবাবুকে। “আমার একটা দিন তো নষ্ট করলেন, কাজ যে কী এগিয়েছেন কিছুই তো বুঝলাম না!”
“এগুলো কি স্যার একদিনে হয়, গোয়েন্দাগিরির কাজ তো ঘড়ি ধরে চলে না।”
“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, বাপির আর আমার কাজ শুধু ঘড়ি ধরে হয়। টাইম পাঞ্চ করে কলেজে ঢুকি আর টাইম পাঞ্চ করে বেরোলেই হয়ে যায়?”
“কী যে বলেন স্যার, আপনারা বিদ্বান লোক, আপনাদের কাজ তো সব মাথার মধ্যে।”
“থাক আর কথা ঘোরাতে হবে না। আপনি কথার উত্তরটা দিলেন না। এখন পর্যন্ত কাউকে সন্দেহ হয়?”
“আজকে কিছুটা জানতে পারব স্যার। তখনই জানাব স্যার।”
“সেটা তো জানি তখন কী বলবেন।”
“কী বলব স্যার?”
“বলবেন, আমি আর বাপি সন্দেহের ঊর্ধ্বে!”
“প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন একেনবাবু।
“একটু কফি কর তো, বাজে না বকে,” আমি প্রমথকে ধমকালাম।
“তুই কর না, অর্ডার না দিয়ে!”
“আমি করলে তোরা কেউই মুখে দিতে পারবি না।”
“এই জ্ঞানটা অন্তত হয়েছে,” বলে প্রমথ কিচেনে গেল।
এমন সময় একেনবাবুর ফোন।
“হ্যান্ডগানটা পেয়েছেন স্যার? ওটাই ব্যবহার করা হয়েছে? ব্যালিস্টিক রেজাল্ট কবে পাবেন?… ‘স্টপ-এন-গো’-র সিসিটিভি চেক করেছেন স্যার? গাড়ি?…”
অর্থাৎ আর্মান্দো বা জ্যাকের সঙ্গে কথা বলছেন। একটু বাদেই কথা শেষ করে ফিরে এলেন।
“কী বলল আপনার চিফ জ্যাক?”
“চিফ জ্যাক না স্যার, মিস্টার আর্মান্দো। অনিন্দিতা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনিন্দিতা ম্যাডামই হ্যান্ডগানটা বার করে পুলিশকে দিয়েছেন। গ্লক ১৯ হ্যান্ডগান-এ বারুদের গন্ধ লেগেছিল। বোঝাই যাচ্ছে ওটা ব্যবহার করা হয়েছিল দু-একদিনের মধ্যে। কিন্তু কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি ম্যাডামের আঙুলের ছাপ ছাড়া। তবে বডিতে যে গুলি লেগেছে, সেটা এই হ্যান্ডগান থেকে ছোঁড়া হয়েছে কিনা, সেটা বার করতে ব্যালিস্টিক টেস্ট করতে হবে, সময় লাগবে।”
“তার মানে তো কুকীর্তিটা অজয়ই করেছে।”
“কে জানে স্যার…”
“কে জানে স্যার’ মানে?”
“মানে হ্যান্ডগানটা অজয়বাবুর, সম্ভবত সেটা ব্যবহারও করা হয়েছে, কিন্তু প্রমাণ করতে হবে অজয়বাবু অকুস্থলে ছিলেন এবং তিনিই গুলি করেছেন।”
“কী উলটোপালটা বকছেন মশাই? অজয়ই তো অদৃশ্য হয়েছিল পার্টি থেকে… হয়নি?”
“তা হয়েছিলেন স্যার। কিন্তু উনি তো বলেছেন মিনিট কুড়ি-পঁচিশের জন্য। এরমধ্যে অনিন্দ্যবাবুর বাড়ি গিয়ে খুন করে ফিরে আসতে অন্তত আধঘণ্টা লাগা উচিত।”
“সেটা তো ওর কথা?” আমি বললাম। “আর কেউ কি জোর দিয়ে বলেছে মাত্র কুড়ি পঁচিশ মিনিটের জন্য বেরিয়েছিলেন?”
“তা নয়। তবে ‘স্টপ-এন-গো’-র সিসিটিভিতে ওকে দেখা গেছে ন’টার মিনিট দশেক আগে। আর উনি পার্টিতে ফিরে এসেছিলেন সাড়ে ন’টার একটু আগে –এটা আমরা জানি।”
“কিন্তু উনি তো ‘স্টপ-এন-গো’ থেকে অনিন্দ্যর বাড়িতে গিয়ে মার্ডার করে ফিরে আসতে পারেন। পারেন না?”
“সহজেই পারতেন স্যার, যদি ‘স্টপ-এন-গো’ অনিন্দ্যবাবুর বাড়ির দিকে পড়ত। কিন্তু ওটা উলটো দিকে। তাই এক্ষেত্রে টাইমিংটা খুব টাইট!”
“এটা আপনি কী করে বলছেন! অনিন্দ্য খুন হয়েছে ঠিক কখন, সেটা কি আপনি জানেন?”
“না স্যার। আসলে এক্সাক্ট টাইম অফ ডেথ খুব সহজে বলা যায় না। তবে ন’টার সময় কুকুরটা তো বাইরে ছিল না।”
একেনবাবুর কথাটা প্রথমে ধরতে পারলাম না। তারপর প্রতিবেশীর ন’টার সময়ে খুশ-কে না দেখার কথা মনে পড়ল।
“তাহলে?”
“দাঁড়ান স্যার, আগে কফিটা খাই আর ইমেল খুলে দেখি কিশোরবাবুর ছবিগুলো এসেছে কি না।”
“মাথামুণ্ডু কী পাবেন ছবিতে?”
“কে জানে স্যার… অনেক সময় হঠাৎ কিছু চোখে পড়ে যায়…।”
.
০৮.
একেনবাবুকে আর প্রশ্ন করে লাভ নেই। মনে হল উনি অজয়কে হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিতে একটু যেন উদগ্রীব। ওঁর মাথায় কী ঘুরছে ‘দেবা ন জানন্তি’। আমি আমার নিজের ইমেল নিয়ে বসলাম। সোমবারে এত ইমেল আসে! বেশির ভাগই, কলেজ সংক্রান্ত… অত্যন্ত বোরিং। এই সময়টাতে প্রমথর বানানো কড়া কফি মিরাকলের কাজ করে। দুর্দান্ত কফি বানিয়েছে আজকে। প্রমথও আমার পাশে বসে ওর ল্যাপটপ খুলে বসল। একেনবাবু কফি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
কফিতে কয়েক চুমুক মাত্র দিয়েছি, একটু বাদেই একেনবাবুর গলা শুনতে পেলাম। একটু যেন উত্তেজিত! “গাড়িতে ছাপ পেয়েছেন? চমৎকার। গাড়িটা ধোওয়া হয়েছিল কবে?..দিন চারেক আগে? ব্যাস এবার ম্যাচ করে কি না দেখুন। অজয়বাবু আর সেই সঙ্গে ত্রিদিববাবু আর ম্যাডাম অনিন্দিতাকে জেরা করুন। গুড ওয়ার্ক মিস্টার আর্মান্দো।… হ্যাঁ হ্যাঁ গাড়ি পাঠিয়ে দিন কালকে সকালে, আমি যাচ্ছি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার, রহস্যের সমাধান এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”
“মনে তো হচ্ছে স্যার। তবে ম্যাচ না করা পর্যন্ত তো সঠিক বলা যাচ্ছে না।”
“কী ম্যাচ করা পর্যন্ত? হ্যান্ডগানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তো শুধু অনিন্দিতার পাওয়া গেছে!” প্রমথ বলল।
“আরে না স্যার, উনি তো সারাক্ষণই পার্টিতে ছিলেন!”
“তাহলে?”
“বলছি স্যার, কিন্তু এগুলো এখনও প্রিলিমিনারি থিঙ্কিং। কয়েকদিন লাগবে কনফার্ম করতে।”
“ক্রিপ্টিক্যালি না বলে একটু বিশদ করে বলুন।”
“বলছি স্যার। কিন্তু আরও এক কাপ কফি হলে ভালো হয় স্যার। এটা শেষ হয়ে গেল!”
“জ্বালিয়ে খান মশাই আপনি! ঠিক আছে রান্নাঘরে আসুন। সাসপেন্সে রেখে আমাদের টেনশন বাড়ানো চলবে না।”
রান্নাঘরে একেনবাবু শুরু করলেন। “আমি মন দিয়ে এনলার্জ করে কিশোরবাবুর তোলা ছবিগুলো কেন দেখছিলাম জানেন?”
“মুখের এক্সপ্রেশন দেখতে?”
“না স্যার, কারোর কোট বা শাড়িতে লোম লেগে আছে কিনা দেখতে। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, খুশ-এর গা থেকে অসম্ভব লোম ঝরে। কালো কোট হলে তো লাগবেই এমনিতেই ওগুলো প্যান্ট বা জামায় লেগে যায়। কালো কোট পরা সত্ত্বেও অজয়বাবু কোটে কিন্তু আমি লোম খুঁজে পাইনি। কিন্তু দেখুন এই ছবি..” বলে একেনবাবু ল্যাপটপ খুলে একটা ম্যাগ্নিফায়েড ছবি দেখালেন। সত্যিই কিছু কিছু বাদামি-কালো লোম লেগে আছে একটা ডার্ক-রু কোটে।… এটা হল ত্রিদিববাবুর কোট। ছবিটা ছোট করতেই ত্রিদিবকে দেখতে পেলাম। এর মধ্যে আমার কাছে শুনে মিস্টার ফার্নান্দো অজয়বাবুর গাড়ি পরীক্ষা করেছে, সেখানে কিছু পায়নি। কিন্তু ত্রিদিববাবুর অ্যালফা রোমিও-তে ড্রাইভার-সিটের পাশের জানলায় কুকুরের নাকের ছাপ পেয়েছে।”
“কুকুরের নাকের ছাপ?”
“হ্যাঁ স্যার, কুকুরের নাকের ছাপ। ওটা মানুষদের ফিঙ্গার প্রিন্টের মতো একটা আইডেন্টিফায়ার। প্রায় ৮০ বছর ধরে ক্যানাডাতে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে হারানো কুকুরদের খুঁজে বার করতে। ত্রিদিববাবুর গাড়ি দিন চারেক আগে ধোয়া হয়েছে। সুতরাং এটা একটা ফ্রেশ প্রিন্ট। এটার সঙ্গে যদি খুশ-এর নাকের ছাপ মিলে যায়, তাহলে প্রমাণ করা যাবে ত্রিদিববাবু অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারণ খুশ গাড়ি দেখলেই জানলায় মুখ ঠেকিয়ে অভ্যর্থনা করে।”
“তাতে হলটা কী? বাপির গাড়িতেও তো ওই স্টুপিড নাকের ছাপ মিলবে! আর বাপির প্যান্টেও নিশ্চয় কিছু লোম পাওয়া যাবে, তাই না?” প্রমথ বলল।
“আমার প্রশ্ন, অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা ত্রিদিববাবু পেলেন কী করে?” আমি যোগ করলাম।
“আপনারা ঠিক প্রশ্নই করছেন। এখন আমি কী ভাবছি বলি স্যার… অজয়বাবু কি ত্রিদিববাবুকে হ্যান্ডগানটা ধার দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে কেন? কিন্তু আরও একজন দিতে পারেন, তিনি হলেন অনিন্দিতা ম্যাডাম। তিনি ভালো করেই জানতেন হ্যান্ডগানটা কোথায় আছে, চট করে কেমন আর্মান্দো সাহেবকে বার করে দিলেন! কিন্তু অনিন্দ্যবাবু খুন হলে অনিন্দিতা ম্যাডামের লাভটা কী? তখনই আমার মনে পড়ল দীপেনবাবুর কথা। দীপেনবাবুর স্ত্রী অনিন্দিতাকে চিনতেন দীর্ঘকাল ধরে। একটা ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন অনিন্দিতা সম্পর্কে আমার শুনে মনে হয়েছিল উনি ওয়াইল্ড পার্টি ভালোবাসেন, গায়ে পড়া টাইপ, ফ্লার্ট করেন… পরকীয়াতে উৎসাহ দেন কিনা অবশ্য বলেননি। তবে দীপেনবাবুকে ওঁদের দুজনের কাছ থেকেই দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। মনে হয় সেটা গৌরবে বহুবচন স্যার… আসলে অনিন্দিতার কাছ থেকেই দূরে থাকতে বলেছিলেন। এখন ভেবে দেখুন স্যার, ত্রিদিববাবু একজন সুদর্শন কৃতি ব্যাবসাদার। অজস্র টাকার মালিক, স্ত্রী নেই। ত্রিদিববাবুর অফিসে অনিন্দিতা কাজ করতে যান। সেখানে তাঁর প্রেমে পড়া বিচিত্র নয়। ত্রিদিববাবু এদেশের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা সিটিজেন নিশ্চয় হবেন… এখানে যখন ব্যবসা করছেন। অজয়বাবুকে দেশে ফিরতেই হবে, কারণ আর এক বছর মাত্র ভিসার মেয়াদ। ওঁদের ছেলেপুলে নেই। সুতরাং ম্যাডামের পিছুটান বলতে একমাত্র অজয়বাবু। তখনই আমার মনে হল স্যার এই খুনের সঙ্গে অনিন্দিতা ম্যাডামেরও জড়িত থাকা অসম্ভব নয়। অজয়বাবুর সঙ্গে অনিন্দ্যবাবুর ঝগড়ার মূলেও অনিন্দিতা ম্যাডামই ছিলেন। অজয়বাবুর বাবা সম্পর্কে যে কথাগুলো আমাদের বলেছেন, সেগুলো নিশ্চয় ত্রিদিববাবুকে অনিন্দিতা ম্যাডামই জানিয়েছিলেন। আর সেটাই ত্রিদিববাবু অনিন্দ্যবাবুকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু অনিন্দ্যবাবুকে কেন? কারণ ওঁরা দুজনেই জানতেন অনিন্দ্যবাবু পেটে কথা রাখতে পারেন না। মদ পেটে পড়াতে যা জানেন সেটা হুড়হুড় করে বলতে শুরু করেন। সেটাই। ঘটল, আর তাতে অজয়বাবু অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। এই নিয়ে দরজা বন্ধ করে ওঁদের মধ্যে প্রবল তর্কবিতর্ক শুরু হল। শেষে অজয়বাবু বললেন, ‘আই উইল কিল দ্যাট স্কাউন্ট্রেল’! হতে পারে মাতালের উক্তি। কিন্তু সন্দেহের বীজ বেশ ভালো ভাবেই রোপন করা হল। এখন অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা ত্রিদিববাবুকে ব্যবহার করতে দিয়ে যদি অজয়কে খুনি প্রমাণ করা যায়, তাহলে ত্রিদিববাবুর সঙ্গে ওঁর মিলনটা খুবই সহজে হতে পারে। এটা খুব নেগেটিভলি বলছি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য এক্সপ্লানেশন মনে করতে পারছি না।”
প্রমথ বলল, “এই নাকের ছাপের থিওরিটা পেলেন কোত্থেকে?”
“কী মুশকিল স্যার, আপনারাই শুধু রিসার্চ করতে পারেন? গুগুল সার্চ করুন না!”
একটু বাদেই আবার ফোন। আইলীনের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ খুশ-এর নাকের ছাপ নিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মিল পাওয়া গেছে। এক্সপার্টদের ডাকা হচ্ছে।
কাহিনির উপসংহারটা খুবই দুঃখজনক। অনিন্দিতা আর ত্রিদিবকে জেরা জ্যাকই করেছে। একেনবাবু নিজেকে জড়াতে চাননি। দু-জনেই অপরাধ স্বীকার করেছে। আধঘণ্টার জন্য ত্রিদিব পার্টি থেকে অদৃশ্য হয়েছিল। কেউই সেভাবে খেয়াল করেনি, কারণ কাজের জন্যে মাঝে মাঝেই আড্ডা ছেড়ে ফোন নিয়ে বাইরে কথা বলতে যেত। তবে খুনটা খুব পরিকল্পনা করেই করা। হ্যান্ডগানটা অনিন্দিতা ত্রিদিবকে অ্যানিভার্সারি পার্টিতে যাবার আগেই দিয়ে এসেছিল। কাজটা সেরে ত্রিদিব ফেরত দিয়েছিল সেই রাত্রে যখন গাড়ি করে অনিন্দিতাকে বাড়িতে নামিয়ে দেয়। দুজনেই এখন জেলে। অজয় দেশে ফিরে গেছে। এই সবের পরে বিচিত্রা ক্লাবের পুজোয় মনে হয় না আর আমাদের যাওয়া হবে বলে।