০৫. ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি

০৫.

ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি রবীন্দ্র সরোবরের এক প্রান্তে। গোলপার্ক দিয়ে রবীন্দ্র সরোবরের দিকে গেলে রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল সেন্টারের পরে আসে সাউথ এন্ড পার্কে ঢোকার রাস্তা। তার সঙ্গে প্রায় লাগোয়া যে রাস্তাটা রবীন্দ্র সরোবরের দিকে গেছে সেটা একটু বাদেই আলাদা হয়ে দু-দিকে চলে গেছে। বাঁ-দিকের রাস্তা দিয়ে দুশো গজের মতন গেলেই ক্লাবটা ডানদিকে পড়বে। কলকাতায় এসে ছুটোছুটি করতে হবে বলে একেনবাবু দু-সপ্তাহের জন্যে একটা ভাড়ার গাড়ি নিয়েছেন। গাঁটের পয়সা খরচা করে কখনোই নিতেন না। নিয়েছেন পরস্মৈপদী বলে– ডাঃ গুপ্তের কলকাতা অফিস বিল মেটাচ্ছে।

গাড়িটা রবীন্দ্র সরোবরে ঢুকতেই একেনবাবু ব্ৰজেন রায়কে দেখতে পেলেন। রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। ড্রাইভারকে কাছাকাছি কোথাও পার্ক করতে বলে একেনবাবু গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন।

ব্ৰজেন রায় বেশ অন্যমনস্ক। একেনবাবু কাছে আসা সত্ত্বেও দেখতে পেলেন না।

“নমস্কার স্যার।”

ব্ৰজেনবাবু সচকিত হয়ে হাতের ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, “ও আপনি এসে গেছেন! এর মধ্যেই যে সাতটা বেজে গেছে বুঝিনি। চলুন, কোথাও গিয়ে বসা যাক।”

একেনবাবু এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছেন দেখে বললেন, “ক্লাবের ওদিকে কতগুলো বেঞ্চি আছে, সকালে হাঁটতে এসে মাঝে মাঝে ওখানে বসে একটু জিরিয়ে নিই। বেঞ্চিগুলো এই সময়ে ফাঁকাই থাকে। সেখানে গিয়ে বসবেন?”

“বেশ তো স্যার, চলুন।”

“আপনি হয়তো ভাবছেন, বাড়িতে না দেখা করে এখানে কেন আসতে বললাম।” হাঁটতে হাঁটতে বললেন ডাঃ ব্রজেন রায়।

“তা একটু ভাবছিলাম স্যার। নিশ্চয় কথা বলতে এখানে সুবিধা হবে বলেই ডেকেছেন।”

“এক্সাক্টলি। আমি চাই না মনীষা বা মনীষার মা কথাগুলো শুনুক। নাতিনাতনিরাও এখন অনেক কিছু বোঝে।”

“তা তো বটেই স্যার।”

“ব্যাপারটা কী জানেন, কতগুলো জিনিস আপনার জানা দরকার। মনীষা সেগুলো বলতে পারবে না, কারণ ও নিজেও অনেক কিছু জানে না। যদি জেনেও থাকে, মন থেকে সেগুলো মানে না। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”

“আপনার পয়েন্টগুলো বুঝতে পারছি স্যার, তবে ব্যাপারটা নয়।”

“সেটা স্বাভাবিক, কারণ সেটা আপনাকে এখনও বলিনি।”

“রাইট স্যার।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাঃ ব্ৰজেন রায় বললেন, “বিকাশকে নিয়ে এখন যে সব কেচ্ছা-কাহিনি বেরোচ্ছে তার বেশির ভাগই হয়তো বানানো। খুনের পর যেটা এখনচলছে, সেটা হল ওর ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন। তবে এটাও ঠিক, ও ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ছিল না। কয়েকবার নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে ঝামেলা বাধিয়েছিল। একবার আমাকেও তার জট কাটাতে হয়েছিল– মনীষা সে ঘটনার কথা জানেও না।”

হঠাৎ কথা থামিয়ে কী জানি একটু ভাবলেন ব্ৰজেন রায়। দু-চার পা আরও এগোনোর পরে বললেন, “আসল ব্যাপার কী জানো,” বলেই একটু লজ্জা পেলেন, “এই দেখুন, আপনাকে ‘তুমি’ বলে ফেললাম।”

“কী যে বলেন স্যার, তুমি করেই তো বলবেন।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। কী করব, আমার একমাত্র মেয়ের স্বামী তাকে তো ফেলে দিতে পারি না! আসলে বিকাশকে নিয়ে আমি একটা গিল্টি কমপ্লেক্সে ভুগছি।”

“গিল্টি কমপ্লেক্স স্যার!” একেনবাবু বিস্মিত হয়ে তাকালেন।

 “হ্যাঁ। বিকাশের সঙ্গে মনীষার বিয়ে দিয়েছিলাম অনেকটা জোর করেই। বছর চোদ্দ আগে, বিকাশ তখন সবে এম.বি.এ পাশ করে একটা ব্যাঙ্কে কাজ করছিল অ্যাকাউন্ট এক্সিকিউটিভ হিসেবে। সাধারণ ফ্যামিলির ছেলে, কিন্তু ওর মধ্যে আমি একটা স্পার্ক দেখেছিলাম। আমার ভায়রার বিয়েটাতে আপত্তি ছিল। ও রাঁচিতে থাকত, ওদের কিছুটা চিনত। বিকাশ যখন স্কুল বা কলেজে পড়ে তখন কোনো একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। আমার শালি, স্ত্রী– সবাই ভায়রার পক্ষ নিয়েছিল। আমিই ওদের আপত্তি কানে তুলিনি। ওসব ছেলেবেলার ব্যাপার। ছেলেবেলায় আমিও কিছু পোয়া তুলসী পাতা ছিলাম না। ব্রাইট ছেলে, সুন্দর চেহারা, ভালো কেরিয়ার– আমার সুন্দরী মেয়ের উপযুক্ত পাত্র। এখন বুঝছি মর্নিং শোজ দ্য ডে। মেয়েটা যে এখন এত কষ্ট পাচ্ছে, আমারই গোঁয়ার্তুমিরফল।”

“একটা কথা বলব স্যার…”

“কী?”

“পত্র-পত্রিকার খবরগুলোর তেমন মূল্য নেই। বিকাশবাবুর হত্যাকারী কে এখনও আমরা জানি না। আপনি স্যার অনেক কিছু কল্পনা করে খামোখা কষ্ট পাচ্ছেন।”

“তুমি তাই বলছ?” আন্তরিক ভাবেই প্রশ্নটা করলেন ব্রজেন রায়।

“হ্যাঁ, স্যার।”

একেনবাবুর কথায় কতটা আশ্বস্ত হলেন ব্রজেন রায় বলা শক্ত। এরমধ্যে একটা ফাঁকা বেঞ্চি পেয়ে দু-জনে বসলেন।

“একটা কথা স্যার, আমি মনীষা ম্যাডামকে বলার সুযোগ পাইনি। ডাঃ গুপ্ত আমাকে বলতে বলেছিলেন যে, ওঁর নার্সিং হোম-এ মনীষা ম্যাডামের জন্যে উপযুক্ত একটা পদ উনি রেখে দেবেন। আর কিছু না হোক স্যার, ফাইনানশিয়াল ব্যাপারটা তো উপেক্ষা করা যায় না।”

“তা যায় না।”

“ভালো কথা স্যার, বিকাশবাবুর লাইফ ইন্সিওরেন্স নিশ্চয় কিছুটা ছিল?”

ব্ৰজেন রায় কথাটার উত্তর দিলেন না। বোধহয় অন্য কিছু ভাবছিলেন। একেনবাবু সূত্রটা আবার ধরিয়ে দিলেন। “মনীষা ম্যাডামের এখন যা মানসিক অবস্থা, টাকাকড়ির কথা মনে না আসাই স্বাভাবিক। ধরে নিচ্ছি স্যার, আপনি বা আর কেউ ইন্সিওরেন্সেরএজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এসবে তো সময় লাগে।”

“ও হ্যাঁ, এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে,” ব্রজেন রায় বললেন। “ও আমার একমাত্র সন্তান, টাকাকড়ির জন্যে ওর কোনো সমস্যা হবে না।”

“তা তো বটেই স্যার।”

“আপনাকে আমি সাতসকালে ডাকলাম, তার কারণ এক ভদ্রলোকের আজ সাড়ে আটটার সময় আসার কথা আছে,” বলে ঘড়ির দিকে তাকালেন ব্রজেন রায়।

“তাহলে চলুন স্যার, যাওয়া যাক। আপনার গাড়ি আছে সঙ্গে?”

“না, এইটুকু পথ, হেঁটেই এসেছি।”

“দাঁড়ান স্যার, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।” বলে ড্রাইভারকে মোবাইলে ধরলেন একেনবাবু। কাছেই ছিল সে। ব্রজেন রায়কে ওঁর বাড়িতে নামিয়ে এলোমেলো চিন্তা শুরু হল। ব্ৰজেন রায় হঠাৎ এই কথাগুলো বলার জন্য সাতসকালে কেন ডাকলেন? অকারণে নিশ্চয় নয়! আরও কিছু হয়তো ওঁর মাথায় ছিল, শেষ পর্যন্ত বলেননি। কী হতে পারে সেটা? নাঃ, কিছুই মাথায় এল না…।

পাড়ার মোড়ে যখন গাড়িটা ঘুরছে, তখন দেখলেন গোবিন্দের দোকানে হিং-এর কচুরি ভাজা হচ্ছে। গাড়িটা থামাতে বলে একেনবউদিকে ফোন করলেন। “কচুরি নিয়ে আসছি, ব্রেকফাস্ট বানাতে যেও না।”

কচুরি একেনবউদির প্রিয়। ওই একটা জিনিস কিনলে, ঝামেলা হবার চান্স নেই। বাড়িতে নানান রকমের জিনিস রান্না করলেও, কচুরি একেনবউদি করেন না। গোবিন্দের দোকান থেকেই সেটা আসে। সকালের খাওয়া অনেক সময়েই কচুরি আর চা দিয়ে সারা হয়। আজকের এই কচুরি খাওয়াটা অবশ্য ‘আনপ্ল্যানড’, কারণ একেনবাবু বাড়ি ফেরার সময়টা ছিল অনিশ্চিত।

ড্রাইভারকে বিকেলে আসতে বলে গাড়িটা ছেড়ে দিলেন একেনবাবু।

.

কচুরি খেতে খেতেও ব্ৰজেনবাবুর কথাই মাথায় ঘুরছিল।

“কী এত ভাবছ?” একেনবউদি জিজ্ঞেস করলেন।

“বুঝলে মিনু, ভেরি কনফিউসিং।”

“কী কনফিউসিং?”

“এই রবীন্দ্র সরোবরে আসতে বলে দু-চার মিনিটে কথা সারা।”

“উনি বুড়ো মানুষ, অতশত কি ভেবেছেন?”

“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট, ভেরি গুড পয়েন্ট,” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। “তাও একটু কনফিউসিং।”

“কী বললেন উনি?”

একেনবাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একেনবউদি বললেন, “মানুষের মনে যখন দুঃখভার চাপে তখন কাউকে বলে বুক হালকা করতে হয়। উনি তাই করেছেন। অত হিসেব করেননি কতটা পেট্রল পুড়িয়ে তুমি ওখানে গিয়েছ।”

“না, তোমরা মেয়েরাই এসব ফাইন ব্যাপারগুলো ভালো বোঝে।” একেনবাবু মানলেন। “আই ওয়াজ কনফিউসড, কারণ উনি একজন বড়ো ডাক্তার ছিলেন, ইন্ট্যালিজেন্ট ম্যান।”

“ইন্ট্যালিজেন্ট লোকদের কি দুঃখকষ্ট হতে নেই?”

“না মিনু, ইউ উইন।” বলে একেনবাবু খবরের কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে পড়তে বসলেন। একটু বাদেই রাখাল দত্তের ফোন।

“দুটো খবর আছে স্যার। সেগুলো চা খেতে খেতে বললেই ভালো হয়। বউদি কি রাগ করবেন চা চাইলে?”

“কী যে বল তুমি! আর ভাই পুলিশে চাকরি করতে গেলে অত ভয় করলে কি চলে? চলে এসো।”

“আপনার বাড়ির কাছেই আছি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আসছি।”

ফোনটা নামিয়ে একেনবাবু পত্রিকার পাতা উলটোতে উলটোতে চেঁচিয়ে বললেন, “মিনু এক্ষুনি রাখাল আসছে, চা খাবে।”

“এক্ষুনি মানে?”

“পাঁচ মিনিটের মধ্যে।”

.

রাখাল দত্ত ঘরে ঢুকে বললেন, “বেশিক্ষণ বসতে পারব না স্যার, ডিসি একটা মিটিং ডেকেছেন। তাও ভাবলাম খবর দুটো আপনাকে দিয়েই যাই।”

“কী খবর?”

“এক নম্বর হল, বিকাশ সেন ওয়াজ ইনভলভড উইথ এ কল গার্ল। ইন ফ্যাক্ট, দ্যাট গার্ল গট প্রেগনেন্ট। বিকাশ সেন কুড ভেরি ওয়েল বি দ্য ফাদার।”

এই ধরনের কোনো খবর দিতে হলে রাখাল দত্ত ইংরেজিতেই দেয়, বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে অসুবিধা বোধ করে।

“তা তোমার এই কল গার্লটি কে?”

“মক্ষিরানির নাম মল্লিকা। মাথাফাটা রতনের খাস তালুক, মানে যাদবপুর এরিয়াতে থাকে। বিকাশবাবুর সঙ্গে মাথাফাটা রতনের ইদানীং এই মাখামাখির মূলে হয়তো এটাই। এনিওয়ে আমার লোক গেছে খোঁজখবর করতে। ডিটেলস পেলেই আপনাকে জানাব।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং, আর দ্বিতীয় খবরটা?”

“বিকাশের স্ত্রী মনীষা হ্যাড এ বয়-ফ্রেন্ড। শুধু চেনাজানার ব্যাপার নয়। অন্তরঙ্গতাটা একটু বেশি।”

“এটাও তো দারুণ খবর!”

“এক্সাক্টলি। আমরা ইন্সিওরেন্সের অ্যাঙ্গেলটা দেখতে একটু এগোচ্ছিলাম, তখনই বার হল। বিকাশ আগে যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেখানকার একজন এক্সিকিউটিভ শেখর চৌধুরীর সঙ্গে মনীষা সেনের একটা সম্পর্ক আছে। শেখর চৌধুরী এখন দিল্লিতেপোস্টেড। কলকাতায় আলিপুরে এলে ফাইভ স্টার হোটেলে ওঠেন। সেখানে মনীষা সেন শেখর চৌধুরীর সঙ্গে মাঝে মাঝে রাত কাটিয়েছেন।”

“মাই গুডনেস! আর ইউ শিওর?”

“অ্যাবসলুটলি। হোটেলের সিকিউরিটি ক্যামেরায় ওদের একসঙ্গে রাতে ঢুকতে দেখা গেছে আর সকালেও বেরিয়েছেন একসঙ্গে। রিসেপশনিস্টদের একজন ছবি দেখে মনীষা সেনকে আইডেন্টিফাইও করেছে শেখর চৌধুরীর সঙ্গিনী বলে।”

“আজ সকালের ব্যাপারটা তাহলে একটু যেন পরিষ্কার হচ্ছে,” একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে বললেন।

ইতিমধ্যে চা এসে গেছে, সেই সঙ্গে নিমকি আর সন্দেশ। ওগুলো একেবউদি বাড়িতে সব সময়েই মজুত রাখেন।

“সকালের ব্যাপারটা কী?” চায়ে চুমুক দিয়ে একেনবাবুর দিকে সপ্রশ্নে তাকালেন রাখাল দত্ত।

“আজ সকালে মনীষা ম্যাডামের বাবা ডাঃ ব্ৰজেন রায় আমাকে ডেকেছিলেন। বাড়িতে নয়, রবীন্দ্র সরোবরে একটা ক্লাবের কাছে। বিকাশ সেন যে ছোটোবেলা থেকেই দুশ্চরিত্র লোক সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাচ্ছিলেন। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কেন? কেন নিজের জামাই সম্পর্কে এসব কথা একজন অজানা, অচেনা লোককে অযাচিত ভাবে উনি শোনালেন। নাউ ইট মেকস সেন্স। উনি বোধহয় নিজের মেয়েকেও কিছুটা সন্দেহ করেন। তাই আমাদের ফোকাসটা যেন শুধু বিকাশের ওপরেই থাকে তারই চেষ্টা।”

“বলেন কি স্যার, আমি একটু অবাকই হচ্ছি! ডাঃ রায় এক সময়ে মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন। ভালো কার্ডিওলজিস্ট বলে নাম আছে। এখন বোধহয় পেশেন্ট আর দেখেন না। যখন সোদপুরে পোস্টেড ছিলাম, তখন একবার বাবার হার্টের সমস্যা হওয়ায় ওঁর কাছে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। খুব ভদ্র ব্যবহার। একজন ভালো, অনেস্ট ডাক্তার হিসেবে সুখ্যাতিই শুধু শুনেছি।”

“স্নেহ অতি বিষম বস্তু ভাই।”

“এখন আপনার প্ল্যান কী স্যার?”

“ভাবছি, তোমাদের সুদেব কুন্ডু, মানে মাথাফাটা রতনের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করব। তবে তোমার রেফারেন্স পেলে বোধহয় ভালো হয়।”

“আমি বলে দেব। তবে সাবধান স্যার। আপনাকে আর কী বলব, একটু সাবধানে ডিল করবেন।”

“তা তো বটেই। পারলে আজকেই খবর পাঠিও। আমি কাল সকালের দিকে ওকে ধরার চেষ্টা করব।”

“ঠিক আছে।”

“আরেকটা কাজ তুমি করতে পারবে? এটা কিন্তু সময় লাগবে।”

“বলুন না স্যার।”

“বিকাশ সেন যখন রাঁচিতে স্কুল বা কলেজে পড়ে তখন কোনো একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। ধরে নিচ্ছি সেটা নারীঘটিত… সেটা সম্পর্কে যদি কোনো খবর জোগাড় করতে পারো।”

“পুলিশ কেস-এর ব্যাপার?”

“তা জানি না।”

“সেটা না হলে এই খবর কি আর পাওয়া যাবে! তাও খোঁজ করব স্যার। অর্ধেন্দুদার বাড়ি রাঁচিতে, ওঁর অনেক কানেকশন আছে। ওঁকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি যদি কিছু জোগাড় করতে পারেন।”

অর্ধেন্দুদাকে একেনবাবু চিনতেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার হয়ে অবসর নিয়েছেন।

.

রাখাল দত্ত চলে যাবার পর একেনবউদি বললেন, “তুমি এখন আর পুলিশে চাকরি কর না, পিছনে বিশাল পুলিশ বাহিনী নেই। তার ওপর এখানে ওঁরাও (ওঁরা মানে আমি আর প্রমথ) সঙ্গে নেই, তুমি একা একা এসব গুন্ডা-লোকদের কাছে যাচ্ছ কেন?” (এই কথাটা একেনবউদি সত্যিই বলেছিলেন, না একেনবাবু আমাদের ইগো-বুস্ট করার জন্য বলেছিলেন– বলতে পারব না)।

“আরে মিনু ভেব না। দুটো কথা বলতে যাচ্ছি, তাতে বিপদ হবে কেন? আর যাচ্ছি তো রাখালের রেফারেন্সে।

.

০৬.

মাথাফাটা রতনের ডেরা হল যাদবপুর অঞ্চলে একটা রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে। এসব জায়গার ঠিকানা থাকে না। রাস্তার ধারে জবরদখল জমিতে বাঁশ আর দরমা দিয়ে বানানো অফিস। ওপরে টিনের চালা। পার্টি ফ্ল্যাগের আধিক্যই অফিসটা চেনার একমাত্র উপায়। পাশে চায়ের দোকানের পিছনটা একটা দরমা দিয়ে ঢাকা যাতে পিছনের নালাটা চোখে না পড়ে। দরমা ঘেঁষে জনা তিনেকের বসার মতো ছোটো কাঠের বেঞ্চ। এ ছাড়া লম্বা একটা বেঞ্চ সাইড দেয়ালে গা ঠেকিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বসানো। দোকানের সামনে একটা রং-চটা কাঠের কাউন্টার। সেখানে দুটো বড় বয়াম আর একটা ঝুড়ি। বয়ামে বিস্কুট, কাপ-কেক ইত্যাদি। ঝুড়িতে কিছু শিঙাড়া। কাউন্টারের পাশে একটা গ্যাসের স্টোভে চায়ের কেটলি বসানো। আরও

একটা বড় উনুন দোকানের পিছন দিকে। সেটা বোধহয় শিঙাড়া বা ভাজাভুজির জন্য।

একেনবাবু যখন সেখানে পৌঁছোলেন তখন সকাল দশটা। দোকানের মালিকের কাছে সুদেব কুন্ডুর খোঁজ করতেই ইশারায় দেখিয়ে দিল।

বেশ কয়েকটা গুন্ডা টাইপ লোকের মাঝখানে বসে গোল্ডফ্রেমের চশমা পরা কালো হুমদো লোক। খোঁচাখোঁচা দাড়ি, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গলায় সোনার চেন। সোয়েটশার্টের রঙ ক্যাটকেটে হলুদ, পরনে জিনসের একটা প্যান্ট।

একেনবাবু এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করলেন। “নমস্কার স্যার, আমার নাম একেন সেন। আপনি কি সুদেববাবু?”

“এখানে নতুন?”

“কী করে বুঝলেন স্যার?”

“নইলে প্রশ্নটা করতেন না।” তারপর হাঁক দিয়ে দোকানিকে, “ওরে রেমো, এক কাপ চা দে, বাবু আলাপ করতে এসেছেন। এবার একেনবাবুকে, “থাকা হয় কোথায়?”

“আপাতত স্যার, নিউ ইয়র্কে।”

“নিউ ইয়র্ক? মানে আমেরিকায়!” মাথাফাটা রতনের চোখে অবিশ্বাস। “আপনার চেহারা আর জামাকাপড় দেখে তো তা মনে হচ্ছে না!”

“সালা ঝুট বলছে,” পাশের লোকটা মন্তব্য করল।

একেনবাবু অ্যাস ইউসুয়াল ইস্তিরি ছাড়া কোঁচকানো একটা শার্ট আর ওঁর ফেভারিট রঙচটা ঘিয়ে রঙের প্যান্ট পরেছেন। আমেরিকায় থাকলে সাধারণত চেহারায় একটা জেল্লা আসে যা দেশে গিয়েও কিছুদিন পর্যন্ত থাকে। একেনবাবু শুধু তার ব্যতিক্রম।

“আসলে স্যার আমার চেহারাটাই এই রকম, গন্স গিফট। আপনি কেন স্যার, সবাই ওই একই কথা বলে। তবে নিউ ইয়র্ক যাবার আগে আমি এখানে পুলিশে ছিলাম, রাখাল দত্তের সঙ্গে কাজ করতাম।”

রাখাল দত্ত-র নামটা শুনে মাথাফাটা রতনের আচরণে একটা পরিবর্তন হল।

“ও, তাহলে আপনার কথাই সি-আই-ডি-র বড়োবাবু বলছিলেন।”

রাখাল দত্ত বড়ো না মেজোবাবু তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে একেনবাবু বললেন, “হ্যাঁ। আসলে আমি বিকাশ সেনের মৃত্যু নিয়ে একটু খোঁজখবর করছি। রাখাল বলল আপনি বিকাশ সেনকে চিনতেন।”

মাথাফাটা রতনের ভুরুটা কোঁচকাল। “এ তো পুলিশের ব্যাপার, আপনি ফিল্ডে নেমেছেন কেন?”

চায়ের কাপে সশব্দে চুমুক দিয়ে একেনবাবু বললেন, “কারণটা একটু প্রাইভেটলি বলতে চাই স্যার।”

একেনবাবুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত রতন আরেকবার দেখল। তারপর চেলাদের বলল, “এই সাইডে গিয়ে দাঁড়া তো।”

শুধু চেলারা নয়, দোকানিও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

একেনবাবু গলাটা নামিয়ে বললেন, “নিউ ইয়র্কে বিকাশবাবুর যিনি বস, তিনি চান না যে বিকাশবাবুর খুন নিয়ে বেশি ঝুটঝামেলা হয়। এই যে আপনার সঙ্গে নার্সিং হোমের প্রোটেকশন নিয়ে বিকাশবাবুর যা কথাবার্তা হয়েছে, সেটা পাবলিক যেন জানতে না পারে।”

একেনবাবুর মনে হল কথাটা শুনে রতন একটু যেন বিচলিত। মুখে বলল, “এসব কী বলছেন আপনি!”

“ভুলে যান স্যার, এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়। পরে বিকাশবাবুর বস এসে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি শুধু বলছি ব্যাপারটা যেন চাপা থাকে।”

“আমি কাউকেই কিছু বলিনি।” রতন মুখ ফসকেই বলে ফেলল।

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। পরিবর্তনের যে-রকম হাওয়া বইছে চারিদিকে, পুলিশকে এগুলো বললে নানান ফ্যাসাদ হবে। আপনার থেকে বেশি হবে নার্সিং হোমের মালিকদের।” রতন কী জানি ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “এই বস আসছেন কবে?”

“মাস দুয়েকের মধ্যেই। এলেই যোগাযোগ করবেন আপনার সঙ্গে। আমিই স্যার যোগাযোগ করিয়ে দেব, ঠিক আছে?”

“বেশ। আপনার নামটা কী জানি বললেন?”

“একেন সেন। রাখালবাবু তো আমার নাম বলেছেন আপনাকে!”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বলেছেন।”

“ঠিক আছে স্যার, আমি তাহলে চলি,” বলে এক পা এগিয়ে আবার ঘুরে এসে বললেন, “একটা কথা স্যার, এই নার্সিং হোম নিয়ে কথাবার্তা তো মাত্র এক মাস আগের ব্যাপার, বিকাশবাবু তো আপনার সঙ্গে আগেও একটা ঝামেলা নিয়ে কথা বলেছিলেন– তাই না?”

“ও এক জমির ব্যাপারে।” রতন ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল।

“ওসব স্যার, আপনি পুলিশকে বোঝান। বিকাশবাবু যে নানা ঝামেলা পাকিয়েছেন ওঁর বসের কাছেই আমি শুনেছি। এই তো কিছুদিন আগে একটা মেয়ের সঙ্গে গোলমাল পাকিয়েছিলেন… ওঁর বস সে নিয়েও দুর্ভাবনা করছিলেন।”

রতন কিছু বলল না।

“না স্যার, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। বুঝতে পারছি এ নিয়ে আপনি কিছু বলতে চান না।”

“লোকটা তো মরে গেছে, ওসব নিয়ে আর ভাবছেন কেন?” রতন ইতস্তত করে বলল।

“ভাবছি অন্য কারণে স্যার। বিকাশবাবুর বস খুব লায়ন হার্টেড, মানে খুব বড়ো মনের লোক। বারবার করে আমাকে বলেছেন, বিকাশের কাছে কারো যদি কোনো পাওনা-গন্ডা থাকে, মানে এই ধরনের ব্যাপারে সব কিছু মিটিয়ে দিতে। বিকাশের আত্মার যাতে শান্তি হয়। আপনার কোনো পাওনা না থাকলে তো চুকেই গেল। চলি স্যার।”

একেনবাবু হাঁটা দিতে না দিতেই রতন পিছু ডাকল, “শুনুন!”

একেনবাবু ফিরে তাকালেন।

“মিথ্যে বলব না, বিকাশ সেনের কাছ থেকে দু-হাজার টাকা পেতাম। নার্সিং হোমের ব্যাপারটা আসায় সেটা মাপ করে দিয়েছিলাম।”

“নার্সিং হোমের ব্যাপারটা আসবে, বসই ওটা নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু দু-হাজার টাকা পেতেন কেন?”

এবার রতন যা বলল, তা হল—

মলয় নামে রিজেন্ট পার্কের এক মাস্তান বিকাশ সেনকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল। বিকাশ সেন নাকি ওদের পাড়ায় মল্লিকা নামে একটি মেয়েকে প্রেগনেন্ট করেছে। মোটা অঙ্কের টাকা না পেলে বিকাশ সেনকে ও এক্সপোজ করবে। বিকাশ সেন যখন তাতে রাজি হননি, তখন ভয় দেখাচ্ছিল মল্লিকার বাচ্চার দায়িত্ব না নিলে বিকাশ সেনকে খুন করবে। রতনের এলাকায় থেকে কেউ এ-রকম মাতব্বরি করবে সেটা তো মানা যায় না। তাই রতন চেলাদের দিয়ে মলয়কে একটু কড়কে দিয়েছিল।

“স্যার, এই মল্লিকা ম্যাডামের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?”

“কেন?”

“আমি স্যার, বিকাশবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক সময় অনেক কথা নিজের স্ত্রীকে না বললেও নিজের লাভারকে বলা যায়। যদি স্যার ওঁর সঙ্গে কথা বলে বিকাশবাবুর খুনি সম্পর্কে কিছু কু পাই।”

“আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করবেন, ও কিছু জানে না,” রতন বলল।

“না জানলে তো চুকেই গেল, তবে একটা কথা বলি স্যার, আমি জানি বিকাশবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে আপনি কোনো ভাবেই জড়িত নন, কারণ আপনার সঙ্গে বিকাশবাবুর ডিল হয়েছিল। ওঁর মৃত্যুতে আপনারই ক্ষতি হবার কথা! মুশকিল হল স্যার পুলিশ তো তা জানে না। পুলিশ তো নানান কথা ভাববে।”

“কী ভাববে?”

“সেটা কি স্যার আমাকে বলবে! কিন্তু আমি যদি খুনের কিনারা করতে পারি, আপনার লাভ বই ক্ষতি নেই স্যার।”

রতন কী জানি ভাবল একটু। “ঠিক আছে, কাল এই সময়ে একবার আসবেন।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

বাড়ি ফিরে একেনবাবু দেখলেন একেনবউদি নেই। নিশ্চয় শাশুড়িকে দেখতে গেছে। মা কে কিছুতেই নিজের কাছে এনে রাখতে পারেননি একেনবউদি। কোনো অবস্থাতেই উনি নিজের বাড়ি ছাড়বেন না। এখন নড়াচড়ারও প্রায় ক্ষমতা নেই –তাও। তবে ওঁকে দেখার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা কেউ না কেউ থাকে। বাড়িও একই পাড়ায়। একেনবউদিও দিনের মধ্যে অন্তত তিন-চার বার করে দেখে আসেন, সব ঠিক চলছে কিনা।

একটু বাদেই একেবউদি ঘরে ঢুকলেন।

 “কোথায় গিয়েছিলে?”

“মা-র কাছে।”

“ওটা কী হাতে?”

“দেখো না খুলে।”

 ব্রাউন কাগজে প্যাক করা একটা বড় প্যাকেট। একেনবাবু প্যাকেটটা খুলে দেখেন রশিদের তোলা ছবিটা, বিনয় দত্তের আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে উনি আর বিনয় দত্ত।

“আরে, এটা কোত্থেকে পেলে!” একেনবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন।

“প্রমথ ঠাকুরপো সেদিন ফোন করে ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি বললাম, ‘আমায় তো দেখায়নি!’ তারপর তোমার বাক্স খুলে দেখি একদম নীচে রয়েছে ছবিটা। বাঁধানোর জন্যে দিয়ে এসেছিলাম।”

“শুধু শুধু খরচা করে বাঁধানোর কী দরকার ছিল?”

“কেন, বেশ তো ছবিটা চোর চোর মুখে দাঁড়িয়ে আছ একটা ত্রিভুজ আঁকা ছবির সামনে!”

“এই দেখো, তোমারও ওটাকে ত্রিভুজ মনে হচ্ছে না? সেদিন আর্টিস্টকে কথাটা বলতেই কয়েকটা লোক এত রেগে গেল যে কী বলব! চোখ দিয়েই আমাকে ভস্ম করে ফেলে!”

“ইনিই তো সেই আর্টিস্ট, তাই না?”

“হ্যাঁ, বিনয় দত্ত, খুবই বিখ্যাত।”

“ফটোর দোকানের ছেলেটাও এই নামটাই বলল। ও নিজেও ছবি-টবি আঁকে, চেনে। দেখো তো, প্রমথ ঠাকুরপো কত যত্ন করে এটা পাঠিয়েছেন। আমাকে বললেন তুমি নাকিওঁর বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ পেন্টিং দেখবে বলে গিয়েছিলে! আচ্ছা, ওগুলো কী ধরনের পেন্টিং?”

“কী মুশকিল, আমি জানি নাকি!”

“প্রমথ ঠাকুরপো যে বললেন, তোমার কাছে জেনে নিতে!”

“প্রমথবাবু না সত্যি!” একেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন।

 “তোমার ভাগ্য এ-রকম সব বন্ধু পেয়েছ।”

“সেটা ঠিক,” একেনবাবু মাথা নেড়ে ছবিটা দেখতে দেখতে বললেন, “এক কাপ চা পেলে মন্দ হত না।”

“আমাকে দেখলেই বুঝি চায়ের কথা মনে পড়ে।”

“আরে না, আরো কতকিছু মনে পড়ে, কিন্তু নির্দোষ জিনিসটা দিয়েই শুরু করছি।”

“থাক, বুঝেছি,” বলে একেনবউদি রান্নাঘরের দিকে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন। “ছবিটাকে বাইরের ঘরের দেয়ালে টাঙিও। বেশ হয়েছে ছবিটা।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ টাঙাব।”

কী ঝামেলা! একেনবাবু মনে মনে ভাবলেন, এখন কোথায় হাতুড়ি, কোথায় পেরেক?

.

০৭.

মাথাফাটা রতন কথার খেলাপ করে না। পরের দিন একেনবাবু যেতেই এক চেলাকে বলল, মল্লিকার বাড়ি নিয়ে যেতে।

“যান, ও বাড়িতেই আছে, দেখা করবে। তবে আমাকে বলেছে খুনের ব্যাপারে ও কিছু জানে না। যাওয়াটা আপনার বেকার হবে।”

.

নাকতলার এই অঞ্চলে একেনবাবু আগে আসেননি। বড়ো রাস্তা থেকে বেরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে বেশ কয়েকবার গিয়ে তারপর মল্লিকার বাড়ি। ছোটো গলির মতন রাস্তা, সেখানেও সারি সারি বহুতল বাড়ি। তারই একটার দোতলায় সামনের দিকে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানোর জায়গা নেই।

“এখানে গাড়ি রাখা যাবে না, লোকে এসে ঝামেলা করবে। আমি ওই মোড়ে দাঁড় করাচ্ছি,” বলে ড্রাইভার একেনবাবুদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এই ড্রাইভারটি নতুন, আজকেই প্রথম এসেছে। তবে হাবভাব দেখে মনে হয় এ চত্বরের হালচাল সব জানে।

দরজায় বেল বাজাতেই পারফিউমের সুগন্ধ ছড়িয়ে যিনি দরজা খুললেন তিনিই মল্লিকা। বয়স হয়তো বছর পঁচিশেক হবে। পরনে নেভি-ব্লু জিনস। শরীরটা একটু ভারীর দিকে। সুস্তনী, হালকা নীল আর কচি সবুজ রঙের টাই ডাই করা সিল্কের টপ। খেয়াল করলে বোঝা যায় মল্লিকা সন্তানসম্ভবা। গলায় ম্যাচ করা নীল-সবুজ পুঁথির নেকলেস। ঘাড় পর্যন্ত চুল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, ঢলঢলে মুখে চোখ দুটো ছোটো একটু যেন বেমানান। সুন্দরী বলা যাবে না, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বেশ একটা অ্যাট্রাকটিভনেস আছে।

একেনবাবুর জন্যেই মল্লিকা অপেক্ষা করছিলেন। রতনের চেলা “এই সেই বাবু,” বলে বিদায় নিল।

“ভেতরে আসুন,” মল্লিকা বললেন।

একেনবাবু নিজের পরিচয় দিয়ে নমস্কার জানিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বিকাশ সেনের মৃত্যুর ব্যাপারে উনি তদন্ত করছেন সেটাও জানালেন।

“হঠাৎ করে চলে এসে বোধহয় ম্যাডামের অসুবিধা করলাম।”

“না না, ঠিক আছে। আসলে আজ শরীরটা ভালো নেই বলে কাজে যাইনি, নইলে এই সময় কাজে থাকি।”

একেনবাবু বসলেন না। তাহলে কি ম্যাডাম, আরেক দিন আসব?”

“না, না, বসুন। চা খাবেন তো?”

“না ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ।”

বাইরের ঘরটা বড়ো নয়, তবে লম্বা। ঢোকার মুখে বেশ চওড়া, কারণ বাঁদিকে খাবার জায়গা, গোটা তিনেক চেয়ার আর টেবিল সেখানে রয়েছে। তারপর ঘরটা সরু হয়ে গেছে, একদিকে রান্নাঘর থাকার জন্য। রান্নাঘরে ঢোকার দরজাটা হল খাবার জায়গা থেকে। বাইরের ঘরটা শেষ হয়েছে একটা জানলার সামনে। জানলা ঘেঁষে নিচু বুকশেলফে কয়েকটা বই আর কিউরিও। বেতের তৈরি গদি-বালিশ দেওয়া সোফাসেট আর সেন্টার টেবিল। খাবার জায়গা শুরু হবার মুখে ডানদিকে একটা প্যাসেজ ভেতরের দিকে চলে গেছে। বাথরুম, বেডরুম ইত্যাদি নিশ্চয় সেই প্যাসেজ দিয়েই যাওয়া যায়।চেয়ারে বসতে বসতে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কাজে যাননি বললেন ম্যাডাম, কোথায় কাজ করেন আপনি?”

ভুরুটা কুঁচকে উঠল মল্লিকার, “কেন বলুন তো?”

“কাজে যাননি শুনে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, সরি ম্যাডাম।”

প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিলেন মল্লিকা। “গড়িয়াহাটে।” তারপর এক মুহূর্ত থেমে বললেন, “সেলস-এর চাকরি।”

কী ভাবে আলোচনাটা আরম্ভ করবেন ভাবছিলেন একেনবাবু। মল্লিকা রাতে কী কাজ করেন, সেটা ওঁর আচরণ বা ব্যবহার থেকে অনুমান করা অসম্ভব। দেখে মনে হয় পাশের বাড়ির ওই বয়সি আর দশ জনের মত। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির শিক্ষিতা মেয়ে, সাজতে গুজতে ভালোবাসে, চাকরিবাকরি করে…

একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমি ম্যাডাম এসেছি…।”

মল্লিকা ওঁকে থামিয়ে দিলেন, “আপনার কথা আমি শুনেছি রতনের কাছে। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আপনি শুধু শুধু এসেছেন।”

রতন’ কথাটা খট করে কানে লাগল একেনবাবুর। সুদেববাবু বা সুদেবদা, অন্তত রতনদা আশা করেছিলেন। মল্লিকার থেকে মাথাফাটা রতন অন্তত বছর দশকের বড়ো হবে। আমেরিকায় এ-রকম নাম ধরে বলা চলে, আজকাল কলকাতাতেও মাঝেমধ্যে শোনেন। তাও কানে লাগে!

“সে তো বটেই ম্যাডাম, জানলে তো আপনি পুলিশকেই সেটা জানিয়ে দিতেন।”

“ঠিক। কিন্তু আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলবেন না প্লিজ, শুনলে নিজেকে বুড়ি বুড়ি লাগে, মল্লিকা বললেন।

“ওটা আমার মুদ্রাদোষ ম্যাডাম, মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাও চেষ্টা করব কথা দিচ্ছি। আমার শুধু কয়েকটাই প্রশ্ন আছে।”

একেনবাবুর বলার ভঙ্গি দেখে মল্লিকার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

 “বলুন।”

“আপনি তো বিকাশবাবুকে চিনতেন ম্যাডাম, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“কতদিনের পরিচয়?”

“মাস ছয়েক আগে একটা পার্টিতে ওই এসে আলাপ করে।”

“আই সি,” একেনবাবু মাথা চুলকে বললেন, “কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, কী ধরনের আলাপ? আপনি কি ওঁকে খুব ভালো করে চিনতেন?”

মল্লিকা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “এতে ঢাকা চাপার কিছু নেই। আমাদের ইন্টিমেট রিলেশন হয়েছিল। ইনফ্যাক্ট ওর জন্যেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। তারপরকী হল জানতে চান?”

মল্লিকার মুখ ভাবলেশহীন। এমনিতেই মহিলাদের সঙ্গে এ ধরনের কথাবার্তায় একেনবাবুর অসুবিধা হয়। এই কথায় তো একেবারে থতোমতো!

“মানে…।”

“মানে, সেটা জেনেই ও অদৃশ্য হয়। ফোন করলে ফোন ধরত না। দেখা করতে চাইলে দেখা করত না। ভাবটা আমাকে চেনেই না। তখন বুঝলাম, হি জাস্ট ওয়ান্টেড টু ইউজ মি… এন্ড অফ স্টোরি।”

“সরি ম্যাডাম।” একেনবাবু আর কী বলবেন ভেবে পেলেন না।

মল্লিকা বোধহয় একেনবাবুর এই চুপ হয়ে যাওয়াটা উপভোগ করলেন। তারপর নিজের থেকেই বললেন, “আমার সম্বন্ধে আপনি কী শুনেছেন জানি না, আমি সত্যিই বিকাশকে ভালোবাসতাম। ভেবেছিলাম ও-ও আমাকে ভালোবাসে।”

ইতিমধ্যে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছেন একেনবাবু। “উনি আপনাকে এভাবে..” ‘ডাম্প’ শব্দটা প্রায় মুখে এসে যাচ্ছিল, সেটা আটকে বললেন, “ছেড়ে চলে গেলেন, আর আপনি চুপচাপ সহ্য করলেন ম্যাডাম?”

“তাছাড়া উপায়?”

একেনবাবু মাথা চুলকে বললেন, “আমি একটু কনফিউসড ম্যাডাম, আমি তো শুনেছিলাম আপনি বিকাশবাবুকে খুন করবেন বলে ভয় দেখাচ্ছিলেন।”

“আমি! কার কাছে শুনেছিলেন?”

“মানে শুনেছিলাম মলয়বাবু..” কোত্থেকে শুনেছেন সেটা একেনবাবু বিশদ করলেন না।

“মলয় আমার বন্ধু, সে আমার কষ্ট দেখে বিকাশকে বলেছিল আমার টেক কেয়ার করতে। বিকাশ সেই কথায় আমল না দেওয়াতে হয়তো ভয় দেখিয়েছিল। জাস্ট ভয় দেখানো।”

“আই সি। কিন্তু যেটা ফ্যাক্ট, সেটা হল বিকাশবাবু খুন হয়েছেন।”

এবার মল্লিকা চুপ।

“বিকাশ সেনের কোনো শত্রু ছিল কিনা আপনি জানেন?”

“না।”

“মলয়বাবু যে খুন করেননি আপনি কী করে জানলেন?”

“কারণ খুন করার ছেলে সে নয়।”

“মলয়বাবু কোথায় থাকেন?”

“জানি না।”

“আমি আবার কনফিউসড ম্যাডাম, আপনার বন্ধু কোথায় থাকেন আপনি জানেন না?”

“জানতাম, এখন সেখানে থাকে কিনা জানি না।”

“শেষ কবে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“রতনের দল ওকে খুব মারধোর করায় যখন হাসপাতালে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল, তখন।”

“সেটা কতদিন আগে?”

“প্রায় দিন কুড়ি।”

“তারপর ওঁকে দেখতে যাননি?”

“না, রতন আমাকে ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছে।”

“রতনবাবুকে আপনি কতদিন চেনেন?”

“বেশি দিন নয়।”

“মলয়বাবু ওঁর দলবলের হাতে মার খাবার আগে চিনতেন?”

“না, তবে নাম শুনেছিলাম। এ তল্লাটে সবাই ওর নাম জানে।”

“আই সি, কবে আপনার সঙ্গে রতনবাবুর পরিচয় হয়?”

“মলয় হাসপাতালে যাবার দু-দিন বাদে হঠাৎ রাত্রিবেলায় রতন আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসে। নিজের পরিচয় দিয়ে জোর খাঁটিয়ে আমার সঙ্গে শোয়।”

মল্লিকা এত স্বচ্ছন্দে চোখে চোখ রেখে কথাটা বললেন, যেন গড়িয়াহাট বাজারে কারোর সঙ্গে দেখা হয়েছে সেটাই জানাচ্ছেন। এটা কি শুধু অকপট ভাষণ, না একেনবাবুকে শক দিয়ে অপদস্ত করার চেষ্টা। চক্ষুলজ্জা থাকলে ভদ্রলোক বেশি প্রশ্ন না করে যাতে সরে পড়েন তার ব্যবস্থা।

একেনবাবু নড়েচড়ে চেয়ারে একটু ভালো করে বসলেন। মুখটা একটু নিচু করে গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, “বুঝলাম ম্যাডাম।”

“আর কিছু জানতে চান? তাও কেন রতনের সঙ্গে আমি সম্পর্ক রেখেছি?”

একেনবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করে মল্লিকা বললেন, “রতন আপনাকে কী বলেছে জানি না, আমি কিন্তু রতন বা কারোর রক্ষিতা নই। প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবার পর লাইনের কাজ আমি করি না। রতন মাঝেমধ্যে আসে। জলে থাকলে কুমিরের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে হয়, এই পর্যন্ত।”

“ম্যাডাম, রতনবাবু আমায় কিছুই বলেননি।” মুখটা তুলে মল্লিকার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বেশ দৃঢ় ভাবে একেনবাবু বললেন। “আমি এসেছি অন্য দু-একটা প্রশ্ন করতে।”

“আপনি তো এর মধ্যেই অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললেন, আর কী প্রশ্ন?” মনে হল মল্লিকা একটু বিরক্ত।

“মলয়বাবুকে রতনবাবুর লোকেরা কেন মেরেছিলেন?”

“জানি না।”

“মলয়বাবু আপনার বন্ধু ম্যাডাম, তিনি রতনবাবুর দলের হাতে মার খেলেন, অথচ আপনি রতনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন না কথাটা?”

“না, সাহস হয়নি। ধরে নিয়েছিলাম আমার জন্যে।”

“কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আপনাকে কিন্তু খুব ভিতু বলে মনে হয় না।”

“তাহলে কী মনে হয়?” চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটা করলেন মল্লিকা।

মল্লিকার প্রশ্নের ফাঁদে পা দিলেন না একেনবাবু। উত্তর না দিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করলেন, “বিকাশবাবুর সঙ্গে রতনবাবুর কোনো গণ্ডগোলের কথা আপনি শুনেছেন?”

“না। বরং বিকাশ মারা যাওয়ায় ওর ক্ষতি হয়েছে, কথায় কথায় ক’দিন আগে রতন বলেছিল। এবার আমি আপনাকে একটা সিরিয়াস প্রশ্ন করি?”

“করুন, ম্যাডাম।”

“আমি বিকাশের স্ত্রী না হতে পারি, কিন্তু বিকাশের সম্পত্তিতে তো অধিকার ওর অবৈধ সন্তানেরও আছে। সেই অধিকার থেকে আমার বাচ্চা কেন বঞ্চিত হবে? আপনি তো আমেরিকায় থাকেন– বড়ো বড়ো লোকদের চেনেন, এ ব্যাপারে একটা কিছু করতে পারেন না?”

“আমি বড়ো বড়ো লোকদের চিনি ম্যাডাম!” একেনবাবু একটু অবাক হয়েই বললেন।

 “বিকাশের বস তো আপনার বন্ধু।”

মল্লিকা ইতিমধ্যে রতনের কাছ থেকে একেনবাবু সম্পর্কে নিশ্চয় অনেক কিছু শুনেছেন। কী শুনেছেন সেটা জানার আর চেষ্টা করলেন না একেনবাবু। বললেন, “এটা তো সিভিল কেস। আপনার সন্তান জন্মাবার পর সিভিল কোর্টে গিয়ে এর ফয়সলা করতে হবে।”

“আমি নিজে টাকা চাই না, কিন্তু আমার বাচ্চার যা প্রাপ্য সেটা সে পাবে না কেন?” একই প্রশ্ন আবার করল মল্লিকা।

‘ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট ম্যাডাম। রতনবাবুর সঙ্গে এই নিয়ে আপনার কোনো কথা হয়েছে?”

“না।”

“আপনার বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন কেউ জানেন বিকাশবাবুর সঙ্গে আপনার এই রিলেশনের ব্যাপারটা?”

“আমার সঙ্গে আমার আত্মীয়স্বজনের কোনো যোগ নেই।”

মল্লিকার কাছ থেকে আর বিশেষ কিছু জানা গেল না। বেশ ঘোড়েল শক্ত মেয়ে, এটুকুই বুঝলেন একেনবাবু। মলয়ের একটা ঠিকানা মল্লিকার কাছ থেকে পেলেন। তবে সেখানে মলয়কে পাওয়ার সম্ভাবনা কমই।