০৬. এগারো, বারো, খোঁড়া চাই আরও
এরকুল পোয়ারো সারা রাত জেগে কাটিয়েছেন। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন তিনি। তাই ভোর হতেই তিনি বিছানা ছাড়লেন। ভোরের আলোয় বাইরের পরিবেশ চমৎকার লাগছে। তিনি পায়ে পায়ে বাগানে গিয়ে হাজির হলেন।
গোলাপের ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন। নিখুঁত জ্যামিতিক পদ্ধতি দেখে তিনি অভিভূত। মাঝে মাঝে রাখা পাথরের খণ্ডগুলি বাগানের শোভা বর্ধন করেছে। বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজদের বলল তৈরির ইচ্ছা তিনি অনুভব করলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বাগানের একপাশে চলে এলেন।
সেখানে একজন মহিলা ও একজন মালি গোছের লোককে দেখতে পেলেন। মহিলার পরনে টুইডের কোট ও স্কার্ট। সম্ভবত তিনি ওই মালিকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। মালির মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেই কথাগুলো তাকে খুশি করতে পারেনি। পোয়ারো ভাবলেন মালিটি বোধহয় কোদাল রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিল।
মালিটি আবার কোদাল চালাতে লাগলেন। পোয়ারো নিঃশব্দে মালির কাছে এগিয়ে গেলেন। সে পেছন ফিরে মাটি কাটছিল। তাই সে পোয়ারোকে লক্ষ্য করেনি। এই সুযোগে তিনি মালীকে ভালো করে জরিপ করতে চাইলেন।
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–সুপ্রভাত।
সে কোদাল না থামিয়ে কর্কশ গলায় বলল–সুপ্রভাত, স্যার।
পোয়ারো লোকটির আচরণে অবাক হলেন। তিনি এর আগে এমন অনেক মালির সঙ্গে কথা বলেছেন তারা সবাই হাতের কাজ বন্ধ করে কথা বলতেই বেশি উৎসাহিত হয়। কিন্তু এ অন্য ধরনের। তাঁর মনে সন্দেহ জাগলো। তিনি দাঁড়িয়ে লোকটির কাজ দেখতে লাগলেন। মালির হাত ওঠা নামার মধ্যে তিনি চেনা কিছু যেন খুঁজতে চাইলেন। নাকি তিনি রহস্য সন্ধানী বলে সবার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন? অথবা তিনি কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছে।
ভাবতে ভাবতে তিনি আবার চলা শুরু করলেন। এবার এসে দাঁড়ালেন দেয়ালের ধারে বড় একটা ঝোঁপের পাশে। সেই মালিকে লক্ষ্য করলেন, তার মুখ পরিশ্রমে ক্লান্ত ও ঘামে ভেজা, মনে মনে ভাবলেন, কি অদ্ভুত?
পোয়ারো ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলেন। পোশাকে লেগে থাকা দু-একটা শুকনো পাতা ফেলে দিলেন। এরপর আপন মনে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। এভাবে এখানে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে মালির ভূমিকায় দেখবেন তা পোয়ারো ভাবেননি। এই যুবকটি মিস নেভিলকে বলেছিলেন যে সেক্রেটারির কাজ করে। শেষপর্যন্ত ও কিনা অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মালি হল।
চিন্তাক্লিষ্ট মনে তিনি বাড়ির দিকে এগোলেন। তখন একটা ঘন্টাবাজার শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। পথে মি. ব্লাস্ট ও হেলেনের সঙ্গে তার দেখা হল। তাঁরা দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
হেলেনের আইরিশ ঘেঁষা কিছু কথা পোয়ারোর কানে গেল। তিনি বলছেন–অ্যালিস্টেয়ার, তুমি মহৎ। তাই তুমি দয়া করে আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছ। কিন্তু তোমার ওই আমেরিকান আত্মীয়রা আমাকে পছন্দ করেন না। আমি তাদের কাছে অনাহুত। সেইজন্য এই সপ্তাহে তোমার নিমন্ত্রণ আমি রাখছি না।
ব্লাস্ট বললেন জুলিয়ার কথাবার্তার ধরনই ওরকম। তবে কখনো অন্তর থেকে বলে না।
হেলেন মস্ট্রেসর ধীরে ধীরে জবাব দিলেন–ওর ব্যবহারে আমি অপমানিত বোধ করি। আমি এসব সহ্য করব না। একজন আমেরিকান মহিলার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি আশা করিনি।
হেলেন আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলেন। এরকুল পোয়ারো এগিয়ে গেলেন মি. ব্লাস্টের সামনে। তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়েছেন। কোনো মহিলাকে নিয়ে যেমন হয়ে থাকে।
তিনি বিমর্ষ চিত্তে বললেন–মেয়েরা সত্যিই ঈর্ষাপরায়ণ হন। তাইনা মঁসিয়ে পোয়োররা। সুপ্রভাত। ভারী চমৎকার আবহাওয়া, বাগানটা ঘুরে দেখলেন?
কথা বলতে বলতে দু’জনে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। ক্লান্ত স্বরে ব্লাস্ট বললেন আজ স্ত্রীর কথা বড় বেশি মনে পড়ছে।
ডাইনিং রুমে এসে তাঁরা বসলেন। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন মিসেস অলিভেরা।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট রাগত কণ্ঠে বললেন–জুলিয়া তোমার ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি কেন হেলেনকে আঘাত করেছ?
মিসেস অলিভেরা গম্ভীর স্বরে বললেন–হেলেন মিথ্যে কথা বলেছে।
মি. ব্লাস্ট তাঁর কথায় ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।
এবার পোয়ারো বললেন–আপনার একজন তরুণ মালিকে দেখলাম, মনে হয় সে নতুন। কাজে যোগ দিয়েছে সম্প্রতি।
–হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। ওই তরুণকে তিন সপ্তাহ আগে নিয়োগ করা হয়েছে। আমার তিন জন মালি ছিল। তার মধ্যে একজন বার্টন। সে চলে যাওয়ায় এই ছেলেটিকে রেখেছি।
আপনি কি বলতে পারবেন ও আগে কোথায় থাকত?
–না, আমি বলতে পারব না। ম্যাক অ্যালিস্টার ওকে বহাল করেছে। তবে ম্যাক ওর কাজে সন্তুষ্ট নয়। সে ওকে তাড়াতে চায়।
–ওর নাম শুনেছেন?
–শুনেছি, তবে ঠিক মনে নেই।
–ওকে কত টাকা পারিশ্রমিক দেন?
–যতদূর মনে হয় দু’পাউণ্ড পনেরো শিলিং হবে।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে বললেন–হুঁ।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট অবাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় কাগজ হাতে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল মিস অলিভেরা। কথায় ইতি টেনে তাঁরা দুজনেই তাঁর দিকে তাকালেন।
জেন তীব্র স্বরে বলে উঠল–মনে হচ্ছে তোমাকে খতম না করে ওরা শান্তি পাচ্ছে । তোমার রক্তপাত ঘটানোর জন্য কিছু লোক উন্মুখ হয়ে আছে।
অ্যালিস্টেয়ার হেসে বললেন–আজও ওই ভদ্রলোকের বিতর্কের খবর বেরিয়েছে। তুমি তা পড়ে বিচলিত হয়েছ। উনি ঠিক করছেন। আচরিটনের অর্থনীতি সম্বন্ধে ওঁর অগাধ জ্ঞান। ওঁকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে ইংল্যাণ্ডকে কপর্দকশূন্য করতে বেশিদিন সময় লাগবে না।
জেন বিরক্ত হয়ে বলল–তোমার চিন্তাধারা বড় সেকেলে। নতুন কিছু ভাবো, কাকা।
–পুরোনোকে বজায় রেখে যদি কিছু করা যায় তাহলে আমার সমর্থন আছে।
–তা যে সম্ভব সেকথা তুমি কখনো ভাবোনি। তোমার ধারণা এতে ভালো কিছু। হতে পারে না। চেষ্টা করে দেখে না।
–যারা পরীক্ষায় বিশ্বাসী তারা কখনো দেশের উপকার করতে পারে না।
কিন্তু গতানুগতিক জিনিস নিয়ে তুমি কি করে সুখী থাকতে পারো, অ্যালিস্টেয়ার কাকা?
এ দেহে যা আছে তাতেই আমি সুখী, সোনা।
জেন আবেগতাড়িত হয়ে বলল–আসলে, আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মের দরকার নতুন পৃথিবী। আর তুমি ইচ্ছে করলেই সেটা গড়া যায়।
অ্যালিস্টেয়ারকে অপ্রস্তুতে ফেলে জেন বিদায় নিল। তিনি বিস্ময়ের সুরে বললেন–দিনে দিনে জেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে। এসব ভাবনা ওর মাথায় কে ঢোকাচ্ছে?
জুলিয়া অলিভেরা অপ্রতিভ হয়ে বললেন–জেনের কথায় কিছু মনে করো না। ওর ছেলেমানুষি বুদ্ধি এখনও যায়নি।
বুঝলাম, তবে ওকে আমি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম।
তাঁকে কিছুটা বিভ্রান্ত বলে মনে হল এরকুল পোয়ায়োর।
জুলিয়া অলিভেরা উঠে দাঁড়ালেন। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তিনি অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট বলে উঠলেন–এদের কথাবার্তা আমার সব গোলমাল করে দিচ্ছে। এসব কথার অর্থ আমার বোধগম্য হচ্ছে না মঁসিয়ে পোয়ারো।
সব সময় ওরা আমার বিরুদ্ধচারণ করে চলেছে। ওরা নিজেরাও জানে না নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবী আসলে কি? তাই ওরা আমাকে বোঝাতে পারে না। কেবল ফাঁকা বুলি।
তিনি একটু হেসে বলেলেন, ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে, এই পৃথিবীতে আমিই শেষ প্রাচীন স্তম্ভ।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন–আপনাকে যদি মেরে ফেলে, তাহলে?
–মেরে ফেলবে! অতই সহজ কাজ নাকি! তাহলে একদল মূক বার বার পরীক্ষা চালাবে আর তাতেই স্থায়িত্ব ধ্বংস হবে, পচন ধরবে অর্থনীতির, তার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে আমাদের দেশ ইংল্যাণ্ডের সামাজিক ব্যবস্থা।
পোয়ারো বললেন আমি আপনার মতে একমত, মি. ব্লাস্ট আমিও চাই স্থায়িত্ব। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের বক্তব্য তিনি উপলব্ধি করলেন এবং মনে মনে শঙ্কিত হলেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ও এরকুল পোয়ারো বেলা বাড়তে বেরিয়ে পড়লেন বাগান দেখতে। দু’জনে কেয়ারি করা পথ ধরে হাঁটছেন। মাঝে-মধ্যে ব্লাস্ট সোৎসাহে নিজের বাগান করার শখ সম্পর্কিত কিছু কথা বলছেন। নানা ধরনের গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। পোয়ারাও আগ্রহের সঙ্গে তা শুনছিলেন। তবে কড়া রোদ তাঁকে সোয়াস্তি দিচ্ছিল না। শান্ত, নিস্তেজ দুপুর।
ব্লাস্ট বাগানের এক পাশ দেখিয়ে বললেন–ওদিকের উইলিয়ামগুলো কি চমৎকার ফুটেছে দেখুন। এত সুন্দর রঙের ফুল এর আগে আমি দেখিনি।
দুম! দুপুরের শান্ত পরিবেশ গুলির শব্দে খানখান হয়ে গেল। হাওয়ার বেগে কি যেন ছুটে গেল।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট পেছনে ঘুরলেন। গাছের মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে উঠলেন। সেই শব্দ অনুসরণ করে ঝোঁপের দিকে তাকাতে তাদের নজরে এল দু’জন মানুষ। একজন আমেরিকান উচ্চস্বরে বলছেন–হতভাগা, শয়তান, তোকে ধরে ফেলেছি। বন্দুকটা ফেলে দে বলছি।
একজন অন্যজনকে দুহাতে জাপটে ধরে ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। সকালের দেখা সেই তরুণ মালি একজন দীর্ঘকায় আমেরিকানের হাত থেকে পালাবার চেষ্টা করছিল।
এরকুল পোয়ারো ওই আমেরিকান ভদ্রলোকের গলার স্বর শুনেই চিনতে পেরেছিলেন, তার অনুমান বৃথা যায়নি। ওই গলার স্বর হাওয়ার্ড রেইকসের। ফ্রাঙ্ক কার্টার তীব্র কণ্ঠে বলল–ছেড়ে দাও বলছি। আমি গুলি করিনি।
হাওয়ার্ড রেইকস ব্যঙ্গ করে বললেন–তাহলে তুমি কি পাখি মারতে গুলি ছুঁড়েছ? নাকি মজা করছিলে?
হাওয়ার্ড এবার অ্যালিস্টেয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, মি. ব্লাস্ট, এই লোকটা আপনাকে গুলি ছুঁড়তে সচেষ্ট হয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমি দেখি এবং ওকে জাপটে ধরে ফেলি।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য চিৎকার করে বলল, উনি মিথ্যে কথা বলছেন। আমি ঝোপ ছাঁটছিলাম। তখন একটা গুলির শব্দ শুনতে পাই। আর দেখি বন্দুটা আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি স্বভাববশত সেটাকে তুলে নিই। সঙ্গে সঙ্গে উনি আমায় পাকড়াও করেন।
হাওয়ার্ড রেইকসও নাছোড়বান্দা। লোকটিকে ছেড়ে দেবেন না সহজে। তিনিও সমস্বরে বললেন–আমি মিথ্যে বলছি না তুমি বলছ? আমি দেখেছি তোমার হাতে বন্দুক। এটা থেকেই গুলি ছুঁড়েছ তুমি। তিনি এরকুল পোয়ারোকে বন্দুকটা দিয়ে বললেন, আপনি বন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখুন তো। মনে হয় ওটার মধ্যে আরও কিছু কার্তুজ এখনও আছে।
পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আপনার অনুমানই ঠিক।
অ্যালিস্টেয়ার ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–তোমার নামটা যেন কি?
পোয়ারো বলে উঠলেন–আমি বলছি। এর নাম ফ্র্যাঙ্ক কার্টার।
সে তিরিক্ষি মেজাজে বলল–প্রথম থেকেই আপনি আমাকে অনুসরণ করছেন। গত রবিবারও নানারকম প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করেছিলেন। কেন মিথ্যে আমাকে দোষারোপ করছেন? আমি ওঁকে গুলি ছুঁড়িনি।
পোয়ারো বললেন তাহলে কে গুলি ছুঁড়েছে বলে তোমার মনে হচ্ছে? এখানে আমরা ছাড়া আর কে আছে?
গুলির শব্দ জেন অলিভেরার কানে গিয়েছিল। সে ছুটে এল। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ, সে হাওয়ার্ডকে দেখে বলল–তুমি? এখানে?
হাওয়ার্ড শান্তস্বরে বলল–হ্যাল্লো জেন, এক্ষুনি তোমার কাকাকে এই ছেলেটি গুলি ছুঁড়েছিল। আমি বাঁচালাম।
জেন থতমত খেয়ে বলল–তুমি বাঁচালে?
মি. ব্লাস্ট ইতস্তত করে বললেন–আমার ত্রাণকর্তা হিসেবে আপনি সর্বদা ঠিক সময়েই এসে হাজির হন, তাই না। আপনার পরিচয়?
জেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল–ওর নাম হাওয়ার্ড রেইকস। ও আমার বন্ধু।
ওহ। আপনিই জেনের বন্ধু। ধন্যবাদ, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
সেই মুহূর্তে সেখানে এসে হাজির হলেন জুলিয়া অলিভেরা। তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন একটা গুলির শব্দ শুনলাম। অ্যালিস্টেয়ার তুমিও নিশ্চয়ই শুনেছ? ভ্রু কুঁচকে হাওয়ার্ড রেইকসের দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি? তুমি এখানে কেন? তোমার সাহস তো কম না।
জেন আমতা আমতা করে বলল–ও এখানে এসে না পড়লে অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে রক্ষা করা যেত না, না।
মিসেস অলিভেরা বিকট চিৎকার করে বললেন–কি? কে এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে? আমি–আমি তাকে…….।
জেন ফ্র্যাঙ্ককে দেখিয়ে বলল–এই লোকটা।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের প্রচণ্ড রাগ হল। সে দাঁত খিঁচিয়ে বলল–মিথ্যে কথা। আপনারা কেন আমাকে বিশ্বাস করছেন না বলুন তো?
মিসেস অলিভেরার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর অপলক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে নিলেন। এবার বললেন প্রিয় অ্যালিস্টেয়ার, এসব কি হচ্ছে? ভগবানের অশেষ দয়া তোমাকে জীবিত রেখেছেন। আমার শরীর কেমন করছে, মাথা ঘুরছে। একটু ব্রাণ্ডি খাওয়াতে পারেন?
ব্লাস্ট তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন–অবশ্যই। বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক। ব্লাস্ট তাঁর হাত ধরে এগিয়ে গেলেন। যেতে যেতে পোয়ারোকে বললেন আপনারা ওকে নিয়ে বাড়িতে আসুন। আমি পুলিশে খরব দিচ্ছি। পুলিশ এলে ওকে তাদের হাতে তুলে দেব।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলা দিয়ে একটিও শব্দ বেরোল না। তাছাড়া তার হাত-পা থর থর করে কাঁপছিল।
হাওয়ার্ড রেইকসের চোখে নিষ্ঠুর হাসির ঝিলিক। তিনি তাকে টানতে টানতে নিয়ে চললেন।
হাওয়ার্ড রেইকস এবার পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বললেন–কি গোয়েন্দা মশাই, আপনার কি কিছু বলার আছে? আপনাকে এবার চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন মি. ব্লাস্ট। তিনি যে বেঁচে আছেন তাতে আপনার কৃতিত্ব নেই।
এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–এই নিয়ে দুবার আপনি মি. ব্লাস্টকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালেন, তাই না। মি. রেইকস?
–কি বলতে চাইছেন?
–আমি বলতে চাইছি, কিছুদিন আগেও আপনি এভাবে একটি লোককে পাকড়াও করেছিলেন। সে মি. ব্লাস্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল, তাই তো?
হাওয়ার্ড ঢোক গিলে বললেন–ইয়ে হ্যাঁ–মানুষের উপকার করা আমার স্বভাব।
পোয়ারো তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তবে এটা অন্যরকম। সেদিন যে লোকটিকে গুলি ছুঁড়তে দেখেছিলেন সে গুলি ছোঁড়েনি। আপনি ভুল করেছিলেন।
ফ্র্যাঙ্ক কর্কশ স্বরে বলল, এখনও উনি ভুল করেছেন।
রেইকস তাকে ধমকে থামিয়ে দিলেন।
পোয়ারো নিজের মনে বললেন–কি আশ্চর্য কাণ্ড, আমি ভাবতে পারছি না।
এরকুল পোয়ারো নৈশ ভোজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। পোশাকে সজ্জিত হয়ে তিনি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টাই ঠিক করতে করতে ভাবলেন, ব্যাপারটা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বচ্ছ। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকেও বিশ্বাস করা যায় না। ও গ্ল্যাডিসকে যা বলেছে তা সবই মিথ্যে। ও বলেছিল সে সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই কাহিনির মধ্যে সত্যতা নেই। ফ্র্যাঙ্ক যে স্বভাবের মানুষ তার পক্ষেই এইরকম মিথ্যাচার করা সম্ভব। তাই হাতে হাতে ধরা পরার পর বার বার একটা কথা বলছে, সে গুলি করেনি, তাকে ইচ্ছে করে ফঁসানো হচ্ছে। এছাড়া বলার মতো তেমন জোড়ালো কোনো যুক্তি নেই তার কাছে।
এদিকে হাওয়ার্ড রেইকস? অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে দু-দুবার গুলি করার মুহূর্তে তার হাজির হওয়া। ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সে বলতে পারে, এখানে সে এসেছিল তার প্রেমিকা জেনের সঙ্গে দেখা করতে। আর এই গল্পের মধ্যে কোনো অযৌক্তিকতা নেই।
আর এটাও সত্যি কেউ গৃহকর্তার প্রাণরক্ষা করলে তাকে তো সমাদর করতেই হয়। তাই তাকে বাড়িতে থাকতে দিতে আপত্তি করা উচিত নয়। সেইরকম মি. ব্লাস্ট কৃতজ্ঞতা বশত তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আর এতেই মিসেস অলিভেরার আপত্তি। এমনিতেই রেইকস তাঁর অপছন্দের পাত্র। তাই অসন্তোষ প্রকাশ করলেও মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এরকুল পোয়ারো সন্ধ্যে থেকেই হাওয়ার্ড রেইকসকে লক্ষ্য করেছেন। সে বন্ধুসুলভ আচরণ করেছে। তার মধ্যে কোনো ধবংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ পায়নি। রাজনীতি নিয়েও সরব হয়নি। তার ব্যবহার কাউকে রুষ্ট করেনি। সে সারাক্ষণ ভদ্র মানুষের মুখোশ পরে থেকেছে।
রাতে পোয়ারো বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা করছিলেন। এমন সময় দরজায় ঠুক চুক শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। তিনি সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–কে ওখানে? ভিতরে আসুন।
পোয়ারোর সায় পেয়ে হাওয়ার্ড রেইকস ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।
পোয়ারোর ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন আমাকে দেখে চমকে উঠেছেন মনে হয়। সারা সন্ধ্যা আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করেছেন। আপনার সন্ধিহান চোখের দৃষ্টিতে আমি চিন্তার কালো মেঘ দেখতে পেয়েছিলাম।
–তাতে আপনার উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
–আমি জানি আপনার মনে আমার সম্বন্ধে কৌতূহল আছে। হয়তো ইতিমধ্যে অনেক কিছু জেনেছেন। তাই একটু উৎকণ্ঠা তো হতেই পারে।
–তা যদি হয় আপনার অসুবিধা কোথায়?
–আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে সব কথা বলব। সেদিনের ঘটনাটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়েছে। সেদিন যখন মি. ব্লাস্ট ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আমি সেখানে ছিলাম। আর সেই মুহূর্তে লোকটি তার দিকে গুলি ছোঁড়ে। সেটা আমার নজরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমি লোকটির ওপর লাফিয়ে পড়ি ও ধরে ফেলি। লোকটি আমার জানা। তার নাম রাখলাম। সে খুব ভালো ছেলে। দোষের মধ্যে সে অল্পতেই রেগে যায়। আর রাগলে তার জ্ঞান থাকে না। সে ভারতীয়। ভারতের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে সে তা অনুধাবন করেছে। যাই হোক ওই দুজন সম্মানীয় ব্যক্তির সেদিন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই গুলি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি ওই ভারতীয় ছাত্রটিকে পালানোর সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলাম। তাই ময়লা জামা কাপড় পরা একটি তরুণকে জাপটে ধরে নাটক করেছিলাম। কিন্তু আশা ফলবতী হয়নি। আপনাদের পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারিনি। তারা আমার থেকে বেশি চালাক। সুতরাং রামলালকে ধরতে বেশি কসরৎ করতে হয়নি ওদের। এটাই প্রকৃত ঘটনা। বুঝেছেন গোয়েন্দা মশাই?
এরকুল পোয়ারো বললেন–আর আজকের ঘটনার কি জবাবদিহি করবেন?
মি. রেইক গ্রীবা ফুলিয়ে বললেন–আজকের ঘটনা অন্য রকমের। এখানে রামলাল নেই। আছে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। সেইই গুলি ছুঁড়েছিল। বন্দুকসহ ওকে আমি পাকড়াও করেছি। ও দ্বিতীয়বার গুলি ছোঁড়ায় সচেষ্ট হয়েছিল। আমি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করি।
পোয়ারো বললেন মি. ব্লাস্টের নিরাপত্তার জন্য আপনি খুব ভাবেন?
রেইকস দরাজ হাসি হাসলেন।
–আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? মানছি আমি মি. ব্লাস্টের নীতির পক্ষপাতী নই। ওনার বেঁচে থাকা সকলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। মানুষের উন্নতির জন্য ওনাকে মেরে ফেলা উচিত। তবে আপনি ভাববেন না ওনার ওপর আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। উনি ইংরেজ হলেও চমৎকার মানুষ। এসব কথা ভেবেই আমি ওনাকে দু-দুবার রক্ষা করেছি।
নীতি ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
–সেকথা আমি অস্বীকার করছি না। আমার মনে হল আপনাকে সব কথা বলা উচিত। তাই বললাম, মন ভোলানো হাসি হেসে হাওয়ার্ড রেইকস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
গ্রামের গির্জা। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সকালের প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এসেছেন। নিমন্ত্রণ কর্তার আহ্বানে এরকুল পোয়ারোও এসেছেন গির্জায়। মিসেস অলিভেরা ও তার মেয়ে জেন কৌশলে তাদের সঙ্গী হয়েছেন। হাওয়ার্ডও বাদ যায়নি। সেও এসেছে।
হাওয়ার্ড রেইকস অবিশ্বাসের সুরে বলল–মি. ব্লাস্ট, আপনিও তাহলে নিয়ম করে গির্জায় আসেন?
অ্যালিস্টেয়ার মিষ্টি হেসে বললেন–আমি গ্রামের মানুষ। তাই এখানকার মানুষদের মতামতকে মর্যাদা দিই। কথাটা শুনে পোয়ারো মাথা নেড়ে বিজ্ঞের হাসি হাসলেন।
মিসেস অলিভেরা ভরাট গলায় আবৃত্তির সুরে প্রার্থনা করছেন–হে পরমপিতা, আমাকে শয়তান মানুষ থেকে রক্ষা করুন, বদ মানুষ থেকে উদ্ধার করুন।
মিসেস অলিভেরার বক্তব্য পোয়ারো অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি ভাবলেন, এক্ষেত্রে হাওয়ার্ডকে শয়তান ও বদ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিশ্চয়ই।
গির্জায় কয়ার বয়রা প্রার্থনা সংগীত গাইছে, হিংস্র সাপের মতো তাদের জিভ লকলক করছে, অ্যানাকোণ্ডার বিষ তাদের ওষ্ঠে।
সেই সঙ্গে জুলিয়ার তীক্ষ্ণস্বর আরও তীব্র হয়ে উঠল–সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের, বিশ্বাসঘাতকদের সংস্রব থেকে আমাকে দূরে রাখো। দুষ্টকে দমন করার সহাস দাও আমাকে…।
এরকুল পোয়ারো তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন–হে প্রভু, আমাকে সকল প্রলোভন থেকে দূরে রাখো, আমাকে শক্তি দাও চক্রান্তকারীদের পাতা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার…।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ গেল একটা গর্তের দিকে। সেই গর্তটা তার পায়ের কাছেই রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই তাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। খুব কৌশলে গতটা খোঁড়া হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা একেবারে পাকা।
তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন বাহ্যিক জ্ঞান শূন্য হয়ে। কে যেন সম্মোহনি শক্তিতে সম্মোহিত করেছে। ইত্যবসরে প্রার্থণা গীত সঙ্গে হয়েছে। প্রার্থনাকারীরা সবাই আসন গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পোয়ারো মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জেন অলিভেরা ওই দৃশ্য দেখে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। এরকুল পোয়ারো সম্মোহিতের মতো বসে পড়লেন।
একজন বৃদ্ধ যাজক পাঠ শুরু করলেন বাইবেল থেকে। তিনি বললেন, স্যামুয়েলের প্রথম বইয়ের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ থেকে আজ পড়ব।
বৃদ্ধ যাজকের কোনো কথাই এরকুল পোয়ারোর কানে ঢুকছিল না। তিনি গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। যার মধ্যে কিছু টুকরো ঘটনা ঘূর্ণির একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
একটা জুতোর বকলস, ননম্বর সাইজের মোজা, ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেডের গোয়েন্দা কাহিনি, মি. মর্লের অভিনীত অংশ, মি. অ্যামবেরিওটিসের চালচলন এবং সব শেষে বিকৃত একটা মুখ–এ সব যেন স্বপ্নের মতো তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছে।
এই প্রথম পোয়ারো ঘটনাটা সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে পারলেন।
যাজকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর তার চমক ভাঙলো। তিনি শুনতে পেলেন, তুমি প্রভুর আদেশ অমান্য করেছ তাই তিনি তোমাকে রাজা হিসেবে পরিত্যাগ করলেন….।