০১. লন্ডন শহর

ব্ল্যাক কফি (এরকুল পোয়ারো)

০১.

লন্ডন শহর।

মে মাসের সকাল। এতক্ষণ হালকা কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন ছিল চারপাশ। ধীরে ধীরে সূর্যের মুখ দেখা দিয়েছে।

রাস্তাঘাটে যানবাহনের ঢল নেমেছে। ব্রেকফাস্ট সেরে মানুষজন চলেছে যে যার কাজে। মোটরকার, পুলকার, সাইকেল, বাসে চেপে ব্যস্ত হাজার হাজার নারীপুরুষ ছুটছে।

হোয়াইট হল ম্যানসন। ছোট্ট ফ্ল্যাটের ব্যালকনি। বেলজিয়াম পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত তুখোড় বড় কর্তা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য দিনের মতো। সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরেছেন। চোখ খবরের শিরোনামে আবদ্ধ।

অনুগত ভৃত্য ভ্যালেট জর্জকে ডেকে এক কাপ হট চকোলেট আনতে বললেন। এটি তার প্রিয় পানীয়। ইতিমধ্যে এক কাপ হয়ে গেছে, এটি দ্বিতীয়।

মাঝে মাঝে পোয়ারোর দৃষ্টি খবরের কাগজ থেকে ছিটকে চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। হোয়াইট হল ম্যানসনের বাসিন্দাদের অনেকেই এই সময় যে যার কাজের দিকে রওনা হয়, আজও তার ব্যতিক্রম হল না। কাছাকাছি স্কুল-কলেজে পড়ান এমন কয়েকজন যুবক-যুবতীও তাদের মধ্যে আছে।

পোয়ারো এবার দৃষ্টি ফেরালেন ঘরের দিকে। জর্জকে দেখতে পেলেন। হট চকোলেটের কাপ তার হাতে।

পোয়ারো কাপ হাতে নিলেন। বললেন–জর্জ, বল ত, আলতো চুমুক দিলেন কাপে, বলছি, কাল রাতে কোন ফোন এসেছিল? আমাকে চাইছিল?

–হ্যাঁ, স্যার। জর্জ বিনীত স্বরে বলল, ইস, বলতে একদম ভুলে গিয়েছি। আসলে আপনি কাল রাতে মিসেস অলিভারের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে চলে গেলেন। আপনার আসতে দেরি হচ্ছিল বলে আমি খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল।

-বেশ, বেশ, কথা না বাড়িয়ে বল, কে ফোন করেছিল? তার নাম বলেছে?

–হ্যাঁ বলছি, একটু সবুর করুন।

 মনিবের ধমক খেয়ে জর্জ কপালে আঙুলের দুটো টোকা দিল। মনে করার চেষ্টা করল। ট্রাউজারের হিপ পকেটে হাত ঢোকাল। পরক্ষণেই বেরিয়ে এল, একটুকরো কাগজ। জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে চশমা বের করল। নাকের ওপর রাখল। চিলতে কাগজটা মেলে ধরল।–হ্যাঁ, এই সেই কাগজ, যেখানে নামটা টুকে রেখেছিলাম। স্যার ক্লড অ্যামরি, ফোন নম্বর দেখে মনে হয় বেশি দূরে নয়, ফারের কাছাকাছি জায়গাটা হবে। উনি আপনাকে ফোনে যোগাযোগ করতে বলেছেন, স্যার। তবে, ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপন, পাঁচকাণ যেন না হয় তাও বলেছেন।

-ধন্যাবাদ, জর্জ। হট চকোলেটের খালি কাপটা জর্জের ট্রে-তে রেখে পোয়ারো বললেন, ওই নাম ও টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটা ডেক্সের ওপর রেখে নিজের কাজে যাও। কাগজটা পড়া বাকি আছে, পরে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করছি।

জর্জ ঘর থেকে চলে গেল। পোয়ারো কাগজের দিকে চোখ মেলে দিলেন। নাহ, কাগজে নতুন কোন খবর নেই। সভ্য মানুষের চরম দুঃখ আর হতাশার একঘেয়ে খবর অ্যাডলফ হিটলারের অত্যাচার–জার্মানির আদালতগুলি আইনকানুনের তোয়াক্কা করে নাৎসী বাহিনীর শাখা দপ্তরে পরিণত হয়েছে বুলগেরিয়ার ফ্যাসিপন্থীরা সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে

এবার একটি দুর্ঘটনার খবর ঘটেছে তাঁর নিজের দেশ বেলজিয়ামে মনস-এর খনির ভেতর শ্রমিকরা কাজ করছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। মৃত্যু হয় বিয়াল্লিশ জন লোকের।

দৈনিক টাইমস-এর পাতা উল্টে পোয়ারো শোক সংবাদ কলমে চোখ রাখল খুব চেনা আর খুব কাছের কয়েকজনের মৃত্যু সংবাদ পড়ে মনটা বিষণ্ণ হল।

কাগজটা ভাজ করে টেবিলের এক পাশ রেখে দিলেন। টুলের ওপর পা দুটো তুলে দিলেন। চিন্তায় আচ্ছন্ন মন। অ্যামরি, স্যার ক্লড অ্যামরি নামটি ঘুরপাক খাচ্ছে। নামটা বড় চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু তোক কে? না, মনে পড়ছে না–জর্জ, ব্যারিস্টার, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বড় কর্তা, নাকি রাজনৈতিক নেতা?

চিন্তাচ্ছন্ন মনে আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে পায়ে এসে ঢুকলেন স্টাডিরুমে। প্রয়োজনে এখানে বসেই তিনি খাওয়া সারেন ও রাত কাটান। ভ্যালেট জর্জ তার মনিবের এই ধরনের জীবনযাত্রার সঙ্গে অভ্যস্ত।

মস্ত এক ডেস্ক, দু’পাশে লম্বা স্টিলের শেলফ। হরেক রকম রেফারেন্স বই থরে থরে সাজানো, পুরোনো কাগজপত্রও স্থান পেয়েছে।

পোয়ারো লাল রেক্সিনে মোড়া মোটা একটা বই টেনে বের করলেন। হু ইজ হু’ বইটা ডেস্কের ওপর রাখলেন, চেয়ার টেনে নিলেন। বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলেন।

একটা পৃষ্ঠায় এসে থমকে গেলেন পেয়েছেন, খুঁজে পেয়েছেন। এতক্ষণ ধরে যার সন্ধান করছিলেন।

মনে মনে নয়, জোর গলায় পড়তে লাগলেন

অ্যামরি, স্যার ক্লড হোর্টিং, জন্ম-২৪ নভেম্বর, ১৮৭৮। শিক্ষা ওয়েসাউথ গ্রামার স্কুল ও কিংস কলেজ, লন্ডন। বিবাহ–১৯০৭। স্ত্রী হেলেন গ্রাহাম (১৯২৯ সালে তার মৃত্যু হয়)। পুত্র সংখ্যা–একটি। ১৯২৭ সালে নাইটহুট উপাধি লাভ। কর্মজীবনে পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক। ১৯০৬ জিইসি ল্যাবোরে টরিজ, ১৯১৬–রয়েল এয়ারফোর্স ফাস্ট (বেতার বিভাগ), ১৯২১–বিমান মন্ত্রণালয় গবেষণা দপ্তর, মোয়ালেজ। বস্তু আর পদার্থকণার ধরনের নতুন পথের ব্যাখ্যাকার দ্য ট্রাভেলিং ওয়েভ সিনিয়র অ্যাক্সিলাটের মনরো’ সম্মানে সম্মানিত, যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষামূলক জার্নালে তার গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে, ঠিকানা–অ্যাবটস ক্লিভ, মার্কেট ক্লিভ-এর পাশে, সারোটি মার্কেট, ক্লিভ-৩১৪। অ্যাথেনিয়াম ক্লাবের সদস্য।

তথ্যগুলি পড়ে পোয়ারোর মনে পড়ে গেল স্যার ক্লডকে–হ্যাঁ, এদেশের, এক নামজাদা পদার্থবিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারি কাগজ হঠাৎ লোপাট হয়ে যাবার ঘটনাটি মনে পড়ে গেল তাঁর। সরকারি গোয়েন্দারা ওইসব দলিলের খোঁজ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্যার ক্লডের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। স্যার ক্লড সরাসরি কোন খবর দেননি, কেবল আভাস দিয়েছিলেন কোথায় পাওয়া যেতে পারে কাগজপত্রগুলি। তার দেওয়া সূত্রের পথ ধরে গোয়েন্দারা অবশ্য হারা নিধির সন্ধান পেয়েছিল। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ও দামী দলিলগুলো অন্য দেশের কাছে পাচার হয়ে গেলে এ দেশের সমূহ বিপদ। তাই এত তৎপরতা।

কদিন আগের দৈনিক টাইমস-এর কথা ভাবলেন তিনি। এক জায়গায় স্যার ক্লড অ্যামরি সম্বন্ধে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। সংক্ষেপে ঘটনাটি ছিল এইরকম–স্যার ক্লড অ্যামরি বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন, তা ভবিষ্যতের যুদ্ধ-বিগ্রহের পক্ষে সাংঘাতিক কিছু একটা হবে। তবে স্যার ক্লডকে নিয়েই যত ঝামেলা। উপযুক্ত নিরাপত্তার অভাব। গ্রামের বাড়িতে ব্যক্তিগত গবেষণাগারে একমনে কাজ করে চলেছেন।

কিন্তু লোকটা বড্ড একরোখা বিড়বিড় করে বললেন পোয়ারো যুদ্ধবিগ্রহ-অস্ত্রশস্ত্র আমার বিষয় বহির্ভূত, তাহলে ……….. বইখানা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলেন, যদি স্যার ক্লড এখন……••••

ভাবনারা অটকে গেল টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছুরিটার দিকে। কাগজ কাটার ছুরি, তবে বেশ লম্বা। ছুরিটা তার জন্মদিনে পাওয়া উপহার। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পুরনো সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস দিয়েছিলেন। নিরাপত্তা সংক্রান্ত বহু সংখ্যক জিজ্ঞাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি পাঠানো মুখবন্ধ খাম নিত্য দিন পোয়ারোর টেবিলে এসে পড়ছে। ওই সরু, লম্বা ছুরি দিয়ে তিনি খামের মুখ কাটেন।

সকাল দশটা–গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িটা সেকথাই বলছে। অর্থাৎ পোয়ারোর পেশাদারী কাজকর্ম শুরু হল। অবশ্য কাজের খাতিরে মাঝে মধ্যে নিয়মের হেরফের করতে হয়েছে। যেমন দ্য বিগ-ফোর’ নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র সম্পর্কে তদন্তের কারণে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। অপরাধের তদন্ত ও তার মূলে আঘাত করাই ছিল তাদের যৌথ প্রয়াসের লক্ষ্য।

তারপর ক্যাপ্টেন ফিরে গেছেন আর্জেন্টাইনে। সেখানে তার খামার আছে। চাষবাস, পোষা পশু পাখি আর বউ-ছেলেমেয়ের নিয়ে দিব্যি আছেন। তবে খবরটা পোয়ারোর কাণে এসেছেকদিন আগে বন্ধু লন্ডনে এসেছেন। ফসল বেচতে তাকে এখানে আসতে হয়।

এসময় বেজে উঠল পুরনো মডেলের টেলিফোন। পোয়ারো রিসিভার তুলে নিলেন। কাণের কাছে রাখলেন। ওপাশ থেকে জর্জের গলা ভেসে এল–স্যার, ক্লড অ্যামরি আপনাকে চাইছেন।

-দশটা না বাজতে বাজতেই……নিজেকেই নিজে কথাটা শোনালেন। তারপর একটু চড়া আওয়াজে বললেন–জর্জ, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলছি, তুমি লাইনটা এঁকে দিয়ে নিজের কাছে যাও। দেখো, ডাকলেই যেন সাড়া পাই।

–হ্যালো, আমি এরকুল পোয়ারো। ধীর কণ্ঠে পোয়ারো বললেন আপনি?

–পোয়ারো। একটি রাশভারি গলা ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠল। আমি, আমি ক্লড অ্যামরি বলছি আপনার সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল আগে, ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?

না, ভুলিনি। সেই সরকারি দলিল খুঁজে বের করার ব্যাপারটা তো। আপনি ছিলেন সেই সময়।

পোয়ারোর মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি।

-হ্যাঁ। শুনুন পোয়ারো, যেজন্য আপনাকে আমি যোগাযোগ করছি, স্যার ক্লডের কণ্ঠে উদ্বেগের আভাস–কঠিন এক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে আমার জীবনে। টেলিফোনের মাধ্যমে সবিস্তারে বলা সম্ভব নয়। আসলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমন এক বিষয় নিয়ে আমি কিছুদিন যাবত গবেষণা করছি। পৃথিবীর বিনাশ ঘটাতে প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা ও মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে, এ যে পরমাণু ব্যবহার করা হয়, তা ধ্বংস করার অস্ত্র আবিষ্কার করাই আমার কাজ। এক ফর্মুলা বের করেছি। শুধু পরমাণু ধ্বংস নয়, এই ফমূলা মানবকল্যাণমূলক কাজেও অত্যন্ত কার্যকরী। তবে বলতে খারাপ লাগছে, আমার পরিবারের কোন একজন ওই ফর্মুলা চুরি করার মতলব করেছে। অন্য দেশকে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামাবে আর নিজের দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে।

একটু থেমে স্যার ক্লড আমায় বলতে শুরু করলেন–মিঃ পোয়ারো, আপনি যদি আমার বাড়ি আরটস ক্লিভে একবার আসেন, তাহলে ভাল হয়। আপনার হাতে ওই ফর্মুলা আমি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই। লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিভাগের কোন বড়কর্তার হাতে তুলে দেবেন। আপনার ওপর আমি ভরসা করতে পারি। আসুন উইক এন্ডে। আমার নিমন্ত্রণ রইল।

নিজের গুণাবলীর প্রশস্তি কে না শুনতে পছন্দ করে। পোয়ারোও এর ব্যতিক্রমী নন। ঘাড় ফেরালেন। আয়নায় তার মুখের প্রতিচ্ছবি চুলবিহীন মস্ত এক টাকওয়ালা মাথা, চকচকে চওড়া গোঁফ গর্বে তার বুক ফুলে উঠল। স্যার ক্লড অ্যামরি! যশস্বী বিজ্ঞানী, তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করা কি কম কথা! তার ওপর উপরি পাওনা ওই ফর্মুলা প্রতিরক্ষা দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া–এ কাজে দেশপ্রেমের ছোঁয়া আছে, রোমাঞ্চকর ব্যাপার।

ঠিক আছে, স্যার ক্লড, আয়নার দিক থেকে ঘাড় ঘোরালেন, এই উইক এন্ডেই যাব। শনিবার বিকেল নাগাদ আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাব। রবিবার থেকে পরদিন সোমবার লন্ডনে ফিরে আসব। এই সময় আপনার জিনিসটা দিয়ে দেবেন। যাকে দিতে বলবেন, তাকেই দিয়ে দেব। আর কিছু?

-না, আর কিছু নয়। সাক্ষাতে সব কথা হবে। অনেক ধন্যবাদ, মিঃ পোয়ারো। আজ রাখছি, গুড ডে।

–গুড ডে, স্যার ক্লড। ঘটাং করে ক্রেডেলের ওপর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন খুঁদে গোয়েন্দা। ভৃত্যের খোঁজ করলেন।

জর্জ সামনে এসে দাঁড়াল।

-শোনো জর্জ, ড্রাই ক্লিনিং-এ এক্ষুনি যাও। আমার ভারী টুইডের স্যুট, ডিনার জ্যাকেট আর দুটো ট্রাউজার্স কাঁচতে দিয়ে এস। শুক্রবার রাতের মধ্যে ওগুলো আমার চাই, অন্যথা যেন না হয়। ওদের কথাটা বলে আসবে। ওখান থেকে এসে আমার পুরনো সার্ভিস রিভলভার দুটোর নলকে পরিষ্কার করে রেখ। ভুল যেন না হয়।

জর্জ ঘাড় নেড়ে বিদায় নিল।

পোয়ারো টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। নাম্বার ডায়াল করলেন ওপ্রান্ত থেকে সাড়া এল, চেনা গলা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস? আমি বলছি, হারে বাপু হা, এরকুল পোয়ারো। ক্যাপ্টেন, তুমি আমার খোঁজ খবর রাখ না জানি, কিন্তু তুমি যে ফসল বেচতে লন্ডনে এসেছ, সে খবর আমার কাছে আছে। শহর থেকে এসময় লোকে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য গ্রামে ঘুরতে বেড়াতে যায়। প্রকৃতি এই সময় নবসাজে ফুলে ফলে সেজে ওঠে, যেন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ। এই শনিবার শহরে যাচ্ছি। অন্যবারের মতো নিশ্চয়ই তুমি আমার সঙ্গী হবে, তাই তো?

.

০২.

শুক্রবার। একটু আগে সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশে একটি দুটি তারার ভিড় শুরু হয়েছে।

অ্যারটস ক্লিভ। স্যার ক্লডের পৈত্রিক বাড়ি। একতলায় পূর্বদিকের ঘরটি তার স্টাডি। তিনি চুপ করে বসে আছেন।

ক্লডের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল বাটলার ট্রেডওয়েল।–মাফ করবেন, স্যার ক্লড। ডিনারের ঘণ্টা বেজে গেছে। আপনি যাচ্ছেন না দেখে ডাকতে এলাম মনে হয় আওয়াজ শুনতে পাননি।

-ট্রেডওয়েল, তোমার অনুমান ঠিক। মাথা না তুলে স্যার ক্লড বলতে থাকলেন। ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঘণ্টাধ্বনি কানে পৌঁছয়নি। বাড়ির অন্যান্যরা নিশ্চয়ই ডিনার টেবিলে পৌঁছে গেছে। তুমি যাও, আমি হাতের কাজটা সেরে যাচ্ছি।

ট্রেডওয়েল নিঃশব্দে বিদায় নিল।

স্যার ক্লডের বুকের খাঁচা থেকে উঠে এল স্বস্তির নিঃশ্বাস। উঠে দাঁড়ালেন। ডেক্স-এর ড্রয়ার টানলেন। হাতে তুলে নিলেন একটা নোটবুক, টেলিফোন নম্বর লেখা। পাতা ওল্টালেন। হ্যাঁ, এই নম্বর। ফোনের বোতাম টিপলেন–হ্যালো এক্সচেঞ্জ? ৩১৪ নম্বর মার্কেট ক্লিভ থেকে বলছি, লন্ডনের এই নম্বরে কথা বলতে চাই।

ফার-লন্ডন শহর থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে, দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান। এ অঞ্চলটা আগে অজ পাড়া গাঁ ছিল। ধীরে ধীরে কলকারখানা গড়ে উঠেছে, বেড়েছে মানুষের বসতি। এমন কি কয়েকটি বড় বড় অট্টালিকাও তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ভারিক্কী চেহারা লাভ করেছে। ফার-এর মার্কেট ক্লিডেলের গায়ে এখন গরীব তকমা পড়েছে।

স্যার ক্লড অ্যামরির পিতা-পিতামহ ছিল এখানকার জমিদার। সেই কোন কালে তারা এখানে প্রাসাদসম অট্টালিকা গড়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন অ্যাবটস ক্লিভ। তাদের শিল্প সৌন্দর্যের তারিফ করতে হয়। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। সর্বত্র। মস্ত ফটক। নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে বাড়িতে ঢোকার দরজা পর্যন্ত। পথের দুপাশে নানা রকম গাছ আর ঝোপঝাড়। বাড়ির পেছনে ঢালু লন দীর্ঘ বারান্দার নীচ দিয়ে চলে গেছে। লনের শেষে বাগান, অযত্ন ও অবহেলায় আজ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

স্যার ক্লড অ্যামরি খাবার ঘরে এসে ঢুকলেন। ডিনার টেবিলের একপ্রান্তের চেয়ারে বসলেন। তার হোটবোন ক্যারোলিন অ্যামরি। অবিবাহিতা। দাদার-স্ত্রী মারা যাবার পর এসংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাই বিয়ে করে ঘর-সংসার করা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি, ক্যারোলিনা মনে মনে তাই ভাবেন। আসলে তিনি বহুবল্লভা, নিত্য নতুন পুরুষসঙ্গীকে প্রেম নিবেদন করেন।

ক্যারোলিন বসেছেন দাদার মুখোমুখি অন্যপ্রান্তের চেয়ারে। রিচার্ড–স্যার ক্লডের একমাত্র ছেলে। সে বাবার ডানদিকের আসনে, তার পাসে ক্লডের ভাইঝি বারবারা। ডঃ কারেলি বর্তমানে অ্যামরি পরিবারের অতিথি, জাতে ইটালিয়ান, একটু তফাতে। এডওয়ার্ড রেনর–স্যার ক্লড-এর সেক্রেটারি, ক্যারোলিনের ডানপাশে বসেছে। লুসিয়া-ক্লডের পুত্রবধূ, রিচার্ডের স্ত্রী, রেনরের পাশের চেয়ারটিতে তাকে দেখা যাচ্ছে।

স্যার ক্লড দুপুর ও রাতের খাবার মুখ বুজে খেয়ে নেন–এটা তার স্বভাব। আজও তার অন্যথা হল না। অথচ অন্য সাতজনের মুখেও নেমেছে ঘোর অমানিশা। কোন কথা না-বলে যে যার খাওয়া সেরে নিলেন।

পুরুষ মানুষের সঙ্গ না পেলে ক্যারোলিনের আবার পেটের খাবার হজম হয় না। পারিবারিক অতিথি ডঃ কারোলির কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরের সঙ্গে ফস্টি-নষ্টি শুরু করলেন।

এডওয়ার্ড নিরীহ গোবেচারা গোছের মানুষ। নোংরা ইয়ার্কি তার পছন্দ হয় না। হঠাৎ বিষম খেল। এক গ্রাস ঢক্‌ করে খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ক্যারোলিনের কাছে ক্ষমা চাইল।

পিসিমার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন বদরসিকতা, বিশেষ করে ওই গোবেচারা মানুষটার সঙ্গে, রিচার্ড মোটেও সহ্য করতে পারছিল না। সে বারে বারে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছিল, অর্থাৎ পিসিমাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা কর। কিন্তু বেচারী লুসিয়া, ব্যাপারটা এখন আর তাই হাতের মধ্যে নেই, অতএব চুপ করে থাকতে হল।

ডিনারের শেষে ডেসার্ড পরিবেশনের পালা। ট্রেডওয়েল এগিয়ে এল। ঠিক এই সময় স্যার ক্লড বাটলারকে উদ্দেশ্য করে সবাই যাতে শুনতে পায়, এমন কণ্ঠস্বরে বললেন ট্রেডওয়েল, ম্যাকসনের গ্যারেজে একবার ফোন কর। রাত আটটা পঞ্চাশের ট্রেনে লন্ডন থেকে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক আসবেন। স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।

এখুনি ফোন করছি, স্যার ক্লড। ডেসার্ডের পাত্র টেবিলের মাঝখানে রেখে ট্রেডওয়েল কয়েক পা পিছনে সরে গেল।

ঠিক এই সময় লুসিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল–কিছু মনে করবেন না, দুঃখিত, আমাকে এবার উঠতে হচ্ছে। কথা শেষ করে কোন দিকে না তাকিয়ে লুসিয়া পা ফেলে এগোল। ঘটে গেল এক সংঘর্ষ–ট্রেডওয়েল ও লুসিয়া।

লুসিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে পথ ছেড়ে দিল। ট্রেড-ওয়েল ডিনার হল থেকে বেরিয়ে গেল।

লুসিয়াও সেখান থেকে অদৃশ্য হল। সিঁড়ি টপকে নেমে এল নীচে, বসার ঘরে। স্যার ক্লড-এর স্টাডিরুম এর পাশেই। মাঝের দরজা দিয়ে ঢোকা যায়। এ ঘরে আছে ফায়ার প্লেস, বেশ বড় সড়ো। ম্যান্টেলপিসে রাখা দম দেওয়া ঘড়িটা বনেদিয়ানার পরিচায়ক, রয়েছে ফুল রাখার একটা পাত্র, অবশ্য ফুলের পরিবর্তে রয়েছে মোমবাতি আর কাগজের টুকরো, যা ফায়ার প্লেসের কাঠে আগুন ধরাতে ব্যবহার করা হয়।

বসার ঘরকে লাইব্রেরী বলা চলে। ঢাউস সাবেকি একটা বইয়ের শেলফে অসংখ পুরনো আমলের বই সাজিয়ে রাখা আছে। শেলফের ওপারের তাকে একটা খালি টিনের বাক্স। ডেক্সের ওপর টেলিফোন, সামন টুল, বসে কথাবলার জন্য। খানিক দূরে ছোট টেবিলের ওপর পুরনো একটা গ্রামোফোন ও কিছু রেকর্ড। সাবেকি কফি টেবিলও রয়েছে। একটা বড় মাপের টেবিল রয়েছে, কয়েকটা ছাপানো বই একপাশে সাজানো। দুটো সাদামাটা চেয়ার, আর একটা আরামকেদারা রয়েছে জানলার পাশে, মন চাইলে পা ছেড়ে আরাম করা যায়। ছোট্ট একটা চারা গাছ বোতল-টবে সাজিয়ে ছোট টেবিলের ওপর রাখা। এই হল অ্যামরি পরিবারের বসার ঘরের আসবাবপত্রের বর্ণনা। এখানে সবকিছুই সাবেকি, কিন্তু প্রাচীন বা অ্যান্টিক বলা যায় না।

রিচার্ড অ্যামরির স্ত্রী লুসিয়া চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক সুন্দরী তরুণী। ঘন কালো ডগা ছাঁটা চুলগুলো কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। অত্যন্ত চাপা তার চোখের চাউনি, যা আবেগে অবর্ণনীয় ভাবে জ্বলছে।

ত্রস্ত চরণে সে বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে এল। ফ্রেমে বাঁধানো জানলার পর্দা সরাল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাতের কালো আকাশের দিকে, অসংখ্য তারা মিটিমিটি জ্বলছে।

ইতিমধ্যে ডিনার হল থেকে পিসিমা ক্যারোলিন বেরিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সোজা বসার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ফায়ার প্লেসের আগুনে ঘরে আবছা আলোর সৃষ্টি হয়েছে।

ক্যারোলিন দ্রুত পায়ে লুসিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে একপ্রকার জোর করে জানলা থেকে সরিয়ে আনলেন। একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। বললেন এখানে শান্ত হয়ে বসো, ক্যারোলিন বুঝি লুসিয়ার মা, এমনই শাসনের সুরে বললেন–দুমিনিট সময় দাও, দেখবে সুস্থ লাগবে।

-সত্যিই তাই, পিসিমা, লুসিয়ার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সুর, কিন্তু মুখে বিষণ্ণতার ছোঁয়া ওটা আর হবে না। ইংরাজি তার মাতৃভাষা নয়, তার আনাড়ি কথা শুনলেই বোঝা যায়।

তোমার ফিটের অসুখ আছে জানি। তুমি বেরিয়ে আসতেই আমার সন্দেহ হল। তাই তো পেছন পেছন সোজা এখানে চলে এলাম, ক্যারোলিন বলতে থাকলেন, এসে দেখলাম সত্যিই তাই। ভাগ্যিস আমি এসে পড়েছিলাম, যেভাবে আকাশের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিলে…… টেনে হিঁচড়ে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে বাধ্য হলাম। লুসিয়া, সোনা আমার বিশ্বাস কর, কোন কুমতলবে আমি এখানে আসিনি।

–পিসিমা, ওভাবে বলবেন না, লজ্জিত হল লুসিয়া। ভাগ্যিস আপনি টের পেয়েছিলেন, তাই ছুটে এলেন, নয়তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকতে হত আমায়। তবে একটা কথা আমি বুঝে পাই না, কেন যখন-তখন আমি ভিরমি যাই বলুন তো?

কথা বলতে বলতে লুসিয়া তার হাতব্যাগ থেকে রুমাল বের করল, ওতে ওষুধ মাখানো আছে। নিজের চোখে মুখে ভাল করে রুমালটা দিয়ে মুছে নিল, আবার সেটা সম্মুখে রেখে বলল–পিসিমা, আপনি এখন নিশ্চিন্তে ওপরে যান। আমিও আসছি।

তুমি আমায় এড়িয়ে যেতে চাইছ, ক্যারোলিনের গলায় কতৃত্বের সুর, বিকেলবেলাতেই আমি লক্ষ্য করেছি, তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে, বেশ ভালোরকম, বুঝেছি ইটালি! হাতব্যাগটা পাশে সরিয়ে রেখে লুসিয়া বলল–ইটালি–তা?

–এ আর নতুন কথা কি হল, বাছা, ক্যারোলিনের স্নেহের হাতের পরশ তখন লুসিয়ার গায়ে মাথায় খেলে বেড়াচ্ছে, নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘর-সংসার করছে, মন তো খারাপ হবেই। আমি কি তা জানি না?

–পিসিমা, আপনার ধারণা ভুল। আপনি কিছু জানেন না লুসিয়া বেশ জোরালো কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, ইটালির জন্য মন আমার খারাপ হয় না। আমি সে দেশের কথা ভুলে গিয়েছি, কখনো মনে পড়ে না।

লুসিয়ার কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। সে তখনও চেঁচিয়ে বলে চলেছে ইটালির প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নেই। ইংল্যান্ড আমার কাছে স্বর্গসমান। এখানে কোন কিছুর অভাব নেই আমার। আপনার মতো দয়ালু আত্মীয়দের আমি পেয়েছি, স্নেহ-ভালবাসার জোয়ারে আমি সর্বদা ভাসছি। আমার আদরযত্নের প্রতি আপনাদের সজাগ দৃষ্টি আছে। একমাত্র এই দেশ ছাড়া। নাটক-উপন্যাসে স্বর্গসুখের অপূর্ব বর্ণনার কথা পড়েছি বটে, কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাচ্ছি।

–বাঃ, কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মেপে মেপে কথা বল তুমি, এমন শোভনীয় আচরণ, নিশ্চয়ই তোমার মায়ের সুশিক্ষার ফল। এই পরিবারের একজন হতে পেরে তুমি যে সত্যিই নিজেকে সুখী বলে মনে কর, তাও আমার অজানা নয়। তবে এখানে একটা জিনিসের অভাব! মা বলে ডাকার মতো কেউ নেই তোমার।

–ছাড়ুন না, পিসিমা, লুসিয়া ক্যারোলিনকে থামিয়ে দিল। বলল, মায়ের সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাই না। ওসব বাদ দিন।

বেশ, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, এ বিষয়ে কোন কথা কখনও বলব না, আমতা আমতা করে বলতে থাকেন ক্যারোলিন–তোমায় দুঃখ দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই, মিথ্যে বলছি না। বিশ্বাস কর। লুসিয়া…… মানে…..তুমি যদি চাও, আমার কাছে ভাল স্মেলিং সল্ট আছে, নিতে আরো।

ধন্যবাদ, পিসিমা। ওসব লাগবে না, লুসিয়া সহজভাবে বলে চলল, শরীর আমার ভালই আছে, চিন্তা করবেন না।

-খুব ভাল স্মেলিং সল্ট, বুঝেছ। ক্যারোলিন বলতে থাকেন, সুন্দর ছোট্ট একটা শিশিতে কড়া আঁঝের জিনিস। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন স্যাল অ্যামোনিয়া সম্ভবত। স্টিরিট অব সল্ট মনে হচ্ছে। তবে যাইহোক না কেন, তোমার ওই স্নানের জলে গোলা জিনিস নয় এটা।

লুসিয়া নীরব হল, কেবল ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল।

 ক্যারোলিন বিষয়ান্তরে চলে এলেন। এপাশ-ওপাশ ছড়িয়ে পড়া গদিগুলোকে স্বস্থানে গুছিয়ে রাখতে রাখতে তিনি বললেন–এই তো আজ সকালেও তুমি বহাল তবিয়তে ছিলে, হঠাৎ কোথা থেকে ঠাণ্ডা লাগালে যে, নাকি ওই ইটালিয়ান ডঃ ক্যারোলিনকে হঠাৎ দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের দেশের কথা। তাই হয়তো শরীরটা খারাপ হয়েছে। তোমার।

এসব কথাবার্তার মাঝখানে ও ঘরে এসে ঢুকল রিচার্ড। পিসি ক্যারোলিন ভাইপোকে দেখতে পাননি। কিন্তু লুসিয়া তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল। নিশ্চয়ই পিসির বলা কথাগুলো রিচার্ড শুনেছে। কি যে হবে এবার। ভয়ে তার বুকটা ধড়াস করে উঠল, দু’চোখ কেঁপে কেঁপে উঠল।

ক্যারোলিন বলল–কি হল, বাছা? আবার নিশ্চয়ই শরীর খারাপ হচ্ছে?

দরজা বন্ধ করার আওয়াজ হল। ক্যারোলিন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। রিচার্ডকে দেখতে পেলেন। বছর তিরিশের এক যুবক, মাঝারি উচ্চতা, বাদামি বর্ণের চুলে মাথা ঢাকা, পেটানো চেহারা, নিয়মিত ব্যায়ামের ফল–এক সুপুরুষ ইংরেজ। এক সময় সামরিক বাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত ছিল। ক্যারোলিন জানে, এই ইংরেজ যুবক তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না, তাই যতটা সম্ভব তিনি তাকে এড়িয়ে চলেন।

–পিসিমা, এ কেমন তোমার ব্যবহার। খাওয়া শেষ না করে উঠে এলে, রিচার্ড কৈফিয়তের সুরে বলে চলল, বাবার খাওয়া এখনও শেষ হয়নি, আর তুমি তো খুব ভাল ভাবেই জানেনা, খাওয়া শেষ না করে উঠে যাওয়া বাবার একেবারে পছন্দের নয়। এসব কথা তোমাকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যাও, ওপরে যাও। আমি আছি লুসিয়ার কাছে। ও খুব শিগগির ভাল হয়ে উঠবে।

-বাঃ, খুব ভালই হল। তুমি এসে গেছ, আমার আর থাকার দরকার নেই বল। ক্যারোলিন উঠে দাঁড়ালেন এবার আমাকে যেতেই হচ্ছে। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন রিচার্ড, আমার খাওয়া শেষ না করে এভাবে চলে আসা ছাড়া, তার গলায় তিক্ততা ঝড়ে পড়ছে, ওঁর গবেষণার কাছে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, তার সবকটিই কিন্তু তোমার বাবার অপছন্দের, বিশেষ করে ওই অচেনা অজানা অতিথিটি, বলা নেই কওয়া নেই এসে জুটেছেন, তাকে তো একেবারেই নয়।

লুসিয়া আর রিচার্ড চুপ, হাড় জ্বালানো মহিলা ক্যারোলিন, কান ভাঙিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন।

তুমি পৃথিবীর এই প্রান্তে ঘর-সংসার পেতে বসেছ, যোগাযোগ না-থাকলে ওই লোকটা, মানে ডঃ ক্যারোলি জানবেন কি করে? চাপা হিসহিসানি কণ্ঠস্বর ক্যারোলিনের অ্যাবটস ক্লিভের কাছাকাছি কোন সরাইখানাতে উঠেছেন খবর পেয়েই তুমি তাকে নিয়ে এলে জামাই আদর করে। ডঃ ক্যারেলিও তোমার পিছু পিছু ঢুকে পড়লেন, আমার দাদার অতিথি হয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন, নড়বার নাম নেই।

বজ্জাত পিসিমার এমন অপমানসূচক মন্তব্য শুনে লুসিয়া মনে মনে রেগে গেল, কিন্তু তা প্রকাশ করল না। বলল–সত্যি ঠিকই বলেছেন, পিসিমা, অবাক হবার মতোই ঘটনা।

–যাই বল বাপু, তোমার ওই, ইটালিয়ান বন্ধুটি দারুণ সুদর্শন, তাই কিনা?

–পিসিমা, ভুল, ভুল। আপনার সবটাই ভুল, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেল লুসিয়ার আপনি সেই থেকে ডঃ ক্যারোলিকে আমার বন্ধু বলে চালিয়ে যাচ্ছেন, আগেও বলেছি, আবার বলছি, ওনার সঙ্গে আমার কোনরকম বন্ধুত্ব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে, তা অনেক দিন আগের কথা। সেই খাতিরেই ওঁকে নেমতন্ন করে এখানে এসেছি। ওঁর সঙ্গে কথা বলে খুশি হয়েছিলেন গৃহকর্তা স্বয়ং, তার অনুরোধ ফেলতে পারেননি ডঃ ক্যারোলি। ব্যাস, এই পর্যন্ত। এব্যাপারে, আপনার সঙ্গে আর কোন কথা বলতে চাই না।

রিচার্ড নীরবে সব শুনছিল। বুঝল, ক্যারোলিন ও লুসিয়ার মধ্যে ঝগড়া বাঁধতে দেরি নেই। ক্যারোলিনকে ভেজানো দরজা খুলে দিয়ে ওপরে চলে যেতে ইঙ্গিত করল।

তবু আমি দেখেছি, কিছু কিছু বিদেশী নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশের বাইরে পা বাড়ালে প্রথমে চেনা-জানা বন্ধুর খোঁজ করে, খাওয়া-থাকার খরচটাতে বাঁচল। ক্যারোলিন বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন। থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালেন–তবে আমাদের লুসিয়ার কথা আলাদা, বিদেশী বটে, তবে পুরোপুরি ইটালিয়ান এখন আর নেই। ব্রিটিশ আর ইটালিয়ান–আধাআধি।

ক্যারোলিন লাইব্রেরি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখলেন।

উফ, কি মতলববাজ মহিলা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিচার্ড ঘরের দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এল। লুসিয়ার পিঠের ওপর হেলান দিয়ে বসল। বলল–পিসিমা খুব জ্বালাচ্ছিলেন, তাই না, লুসিয়া?

রিচার্ড, এই পরিবারে যেদিন আমি বউ হয়ে এসেছি, সেদিন থেকেই লক্ষ্য করেছি, আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা না বললে ওনার শান্তি হয় না। আমি ইটালিয়ান বলে হয়তো আমাকে সহ্য করতে পারেন না। ইটালিয়ানরা কেন যে ওনার দুচোখের বিষ, বুঝে পাই না।

–এসব হল হিংসা, জ্বালা, বুঝেছ লুসিয়া। সামান্য হেসে রিচার্ড বলতে থাকে, অনেক মহিলা আছে, যাদের বিয়ে হয়নি, সে আশাও নেই, কমবয়সী বিবাহিত মেয়েদের দেখলে তাদের গা রি-রি করে জ্বলে–ঈর্ষায়। পিসিমার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে গেছে। আর একটা কারণ হতে পারে, ছোটবেলায় আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আমার পিসি এসে এই সংসারের হাল ধরেছিলেন। তিনিই এ বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী। তুমি আসার পর থেকে তার মনে সম্ভবত একটা আশঙ্কা সর্বদা তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

–এই বোধ হয় গদিচ্যুত হলাম।

রিচার্ড একটু থামল, আবার বলতে শুরু করল–তবে আমি নিশ্চিত, পিসিমার চটে যাওয়ার পেছনে অন্য আর কারণ আছে। পিসিমাকে একবার ইটালিতে যেতে হয়েছিল লিওনার্ডো ডা ভিসির ওপর গবেষণামূলক কাজ করতে। ওইসব এক ইটালিয়ান গাইডের প্রেমে পড়েন, লোকটি তার থেকে বয়সে অনেক ছোট ছিল। প্রেম পেকে যখন রসপূর্ণ হয়েছে, ঠিক সেই সময় তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। মনমরা হয়ে পিসিমা ফিরে এসেছিলেন। এসব মা-ই শুনিয়ে ছিলেন।

রিচার্ড আবার থামল, দম নিল। আবার শুরু করল–আমারও নিজের ওপর কম রাগ হয়, লুসিয়া বাবার কথা মেনে চাকরিতে স্বেচ্ছা অবসর দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বাবার ইচ্ছানুযায়ী তার গবেষণার কাজে সাহায্য করতে শুরু করলাম। ভাবলাম, এর ফলে আর্থিক দিক থেকে উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এখন দেখছি সব ভুল, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার নিজস্ব পরিচয় বলতে কিছু নেই। না আমি এক ফৌজী ইঞ্জিনিয়ার, না আছে বাবার মতো বৈজ্ঞানিক প্রতিভা, গবেষণার কাজে এক্কেবারে অনুপযুক্ত।

কথা শেষ করে রিচার্ড স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এল। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। চার চোখের মিলন ঘটে গেল।

লুসিয়া, বল, কিভাবে তোমায় সাহায্য করি? কিছু প্রয়োজন? আমি এখন তোমার কাছেই থাকব।

-তাই বুঝি! লুসিয়ার ঠোঁটে কাষ্টহাসি। কিন্তু রিচার্ড, ডিনার টেবিল থেকে খাওয়া ফেলে চলে আসা বাবার অপছন্দ, পিসিমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে, অথচ তুমি নিজের বেলায় ভুলে গেলে? যাও, ডিনার হলে গিয়ে খাওয়া শেষ করে নাও।

আমি খাওয়া সেরেই এসেছি তোমার কাছে, কিছুক্ষণ গল্প করব। রিচার্ড মুচকি হেসে বলল–ওভাবে না বললে পিসিমাকে এ ঘর থেকে নড়ানো যেত?

–কিন্তু রিচার্ড, লুসিয়া আলগোছে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল, আমি যে একা থাকতে চাই, তাই এঘরে চলে এসেছি। আমার শরীরের কথা ভেব না, ভাল আছি, বিশ্বাস কর।

লুসিয়ার মাথার পাশের ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটা খোলার জন্য রিচার্ড এগিয়ে এল, জানলা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হল। ঘেমে নেয়ে একশা। শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে, ফিরে এল স্বস্থানে–ধু! এ যেমন-তেমন ছিটকিনি নয়। তারপর চুপ। ভাবনার আলোড়ন-বুঝেছি, নিরাপত্তার কারণে বাবা বিশেষ ছিটকিনির ব্যবস্থা করেছেন, চাবিটা নিজের কাছেই রেখেছেন।

লুসিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল–বাদ দাও, জানলাটা বন্ধই থাক।

 রিচার্ড টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। চেয়ার টেনে বসল। টেবিলে কনুই রেখে সামান্য ঝুঁকল–আমার বাবা, আশ্চর্য মানুষ বটে। চব্বিশ ঘণ্টা আবিষ্কারের নেশায় মশগুল। পারমাণবিক অস্ত্র শুরু থেকে নতুন মানের মজবুত ছিটকিনি, আর কি বাকি আছে কে জানে। ভাবনার অন্ত নেই।

-তোমার বাবা কতরকমের আবিষ্কার করেছেন, নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ রোজগারও করেছেন? লুসিয়ার অন্যমনস্ক কণ্ঠস্বর।

–কি বলছ, লুসিয়া! প্রচুর নয়, কাড়ি কাড়ি। কিন্তু টাকা কড়ির প্রতি তেমন লোভ নেই। রিচার্ডের নীরস কণ্ঠস্বর, সবই বিজ্ঞানীরা বোধহয় একই ধাতু দিয়ে গড়া, অর্থ, বিষয় সম্পত্তির প্রতি আসক্তি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক কম। মানুষ যেসব জিনিস অকেজো ভেবে ফেলে দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরা সেগুলো কুড়িয়ে কাড়িয়ে নিয়ে আসছেন, সর্বক্ষণ গবেষণা করে চলেছেন।

-তাহলে উনি যে সে মানুষ নয় বল?

নিশ্চয়ই, রিচার্ড জোর গলায় বলে উঠল, আমি আমার বাবাকে বর্তমান বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন বলে মনে করি। তবে ওঁর একটা দোষ আছে–নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দেন। আমার সঙ্গে উনি যে আচরণ করে চলেছেন, আমি তা সহ্য করতে পারছি না। বিরক্ত ধরে গেছে।

–ঠিকই বলেছ, রিচার্ড, লুসিয়া স্বামীকে সমর্থন করল, নয়তো কেউ নিজের ছেলেকে বিনা কারণে বাড়িতে বন্দী রাখতে পারে, যেন জেলের কয়েদি।

একথা আগেই তোমায় বলেছি, রিচার্ড বলে চলল–বাবা বললেন চাকরিটা ছেড়ে দিতে। তাঁর গবেষণার কাজে সহযোগিতা করতে। তাহলে শুরু করা কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করা সম্ভব হবে। আর অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটবে আমাদের। রিচার্ড কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি এনে বলে চলল বাবা ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভেবে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আর এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে। আমি কি ছাই ওইসব মৌলিক গবেষণার কিছু বুঝি। সামান্য এক ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম ব্যাপারে মাথা ঘামানো কি চাট্টিখানি কথা! তবে একটা রক্ষে, স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছিলাম, মেয়াদ এখনও ফুরোয়নি। চাইলে যে কোন সময় কাজে যোগ দিতে পারি। দরকার পড়লে ওরাও ডাকতে পারে।

–টাকা। প্রচুর টাকা। কাড়ি কাড়ি টাকা, বিড়বিড় করে উঠল লুসিয়া। তারপর অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলতে থাকল–টাকা, টাকা আর টাকা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মূলে আছে অহোরাত্রি ছুটে মরছে–আরো টাকা! আরো টাকা!

-লুসিয়া, জালে আটকে পড়া মাছি দেখেছ তুমি? রিচার্ডের গলায় বিষণ্ণতার সুর। পিষে মেরে ফেলা মাছি? আমার অবস্থাও ঠিক তাই, অসহায় এক মাছি!

রিচার্ড! লুসিয়া স্বামীর দিকে তাকাল, ব্যাকুলতা ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠে আমার দিকে ভালভাবে তাকাও। কি মনে হয় তোমার? আমি কি খুব ভাল আছি? তোমার মতোই অসহায় এক মাছি।

স্ত্রীর কথা শুনে রিচার্ড চমকে উঠল। অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হল।

রিচার্ড, আমায় রক্ষা কর। কথা বলতে বলতে লুসিয়া উঠে দাঁড়াল। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে সে আবার বলল–চল, আমরা পালিয়ে যাই, দূরে অনেক দূরে, এবাড়ির দমবন্ধ করা পরিবেশ যেখানে নেই। দয়া কর, রিচার্ড!

–কি বলছ! পালিয়ে যাব? তোমাকে নিয়ে? কিন্তু কোথায়? কত দূরে সেই জায়গা? রিচার্ডের কথায় ফাঁকা হতাশার সুর।

–যেখানে তুমি বলবে। পৃথিবীতে কি এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে আমরা নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে দিন কাটাতে পারি। কিন্তু এ বাড়ি নয়, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় হওয়া যায়, ততই মঙ্গল। রিচার্ড, আমাকে সর্বদা ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে। ভালভাবে তাকাও। কি মনে হয়, আমি কি খুব ভাল আছি? তোমার মতোই অসহায় এক মাছি।

স্ত্রীর কথা শুনে রিচার্ডের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল, অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হল।

রিচার্ড, আমাকে বাঁচাও, লুসিয়া উঠে দাঁড়াল, চাপা উত্তেজনার আবেগে কাঁপছে তার শরীর আমি বাঁচতে চাই। এই দমবন্ধকরা পরিবেশে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল, দোহাই তোমার।

ঘাড় ঘুরিয়ে লুসিয়া পেছন দিকে কি যেন দেখাল। তারপর আবার বলল–অশুভ কালোছায়ারা সর্বদা এ বাড়ির যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বাস কর।

রিচার্ডের বোধহয় কথা হারিয়ে গেছে। খানিক বাদে জানতে চাইল কিন্তু লুসিয়া, যেখানেই যাই না কেন টাকার প্রয়োজন। সে টাকা কোথায় পাব। প্রচুর টাকা চাই। লুসিয়া, তুমি তো ভাল ভাবেই জান, পুরুষ মানুষ যতই সুদর্শন হোক না কেন, পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে কোন মেয়ের কাছে কদর পায় না। কি ঠিক বলেছি তো?

–কি যা-তা বকছ? লুসিয়া চমকে উঠল, আসল কথাটা খুলে বল তো।

-বেশ, তাই হোক। তুমি যখন রিচার্ড নিজেকে গুটিয়ে নিল–না না, কিছুই বলার নেই আমার।

আর এখানে থাকা ঠিক হবে না বুঝে রিচার্ড উঠে দাঁড়াল, পা বাড়াতে গিয়ে বাধা পেল। ততক্ষণে লুসিয়ার দুটি হাত চেপে বসেছে রিচার্ডের কাঁধে। তাকে চেপে ধরে জোর করে আগের জায়গায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল–রিচার্ড, লক্ষ্মী সোনা–স্বামীর চোখের দিকে তাকাল, নীলনয়না লুসিয়া তখনও মুখ খুলছে না।

রিচার্ডের বিরক্তি ভরে এক ঝটকায় কাঁধ থেকে স্ত্রীর হাত দুটো সরিয়ে দিল।

–রিচার্ড, কোনরকম শব্দটা বের করে স্তব্ধ হয়ে গেল লুসিয়া, কে যেন তার মুখ টিপে ধরেছে, মনে হল।

লুসিয়া, তুমি ভেবেছ, আমার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, গোবর পোরা, গবেট, কোনও দিকে চোখকাণ নেই, তাই তো। বোঝা গেল রিচার্ড ধীরে ধীরে তার রাগ প্রকাশ করছে। পলকহীন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল ডিনারে বসার আগে তোমার ওই পুরনো বন্ধু এক টুকরো কাগজ তোমার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন, কেউ না লক্ষ্য করুক, ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায়নি।

একটু থামল রিচার্ড, তার মাথায় এখন রক্ত চড়ে গেছে–তুমিও তালবাহানা শুরু করলে, চোখেমুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুললে যে, এখনই জ্ঞান হারাবে। ডিনার টেবিল ছেড়ে উঠে এলে, রিচার্ডের গলার স্বর তখন উঁচু পর্দায় চলে গেছে। আসলে ব্যাপারটা ছিল এইরকম–তোমার ওই পুরনো বন্ধু, যিনি আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে ঢুকেছেন, ওই চিলতে কাগজে তিনি কি লিখেছেন, তা জানা-না-পর্যন্ত তোমার স্বস্তি হচ্ছিল না। তখন তুমি উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছ। কিন্তু একদিকে আমি, আর অন্যদিকে আমার পিসিমা যে তোমাকে সবসময় গোয়েন্দার দৃষ্টিতে নজর রেখে চলেছেন, তাদের সামনে তো পড়া সম্ভব নয়। তাই অসুস্থতার ভান করলে, ডিনার টেবিলে ছেড়ে পালিয়ে এলে এঘরে, তোমার পেছন স্মেলিং সল্ট নিয়ে পিসিমাও ছুটে এলেন, তোমাকে সুস্থ করতে হবে তো, খানিকবাদে আমি এসে পড়লাম। আমি যে এঘরে ঢুকে পড়ব, তা তোমাদের দুজনের কেউই আন্দাজ করতে পারোনি।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রিচার্ড থামল। লুসিয়া বুঝতে পারল, তার আচরণে স্বামী দেবতাটি ক্ষেপে গেছে, অপমানের জ্বালায় জ্বলছে।

রিচার্ড, লুসিয়া কঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি আজে বাজে কথা বলছ? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। সত্যি বলছি রিচার্ড, ডঃ কারোলির সঙ্গে আমার কোন গোপন সম্পর্ক নেই। দিনরাত ওঁর কথা ভাবতে যাব কেন? বিশ্বাস কর আমায়, মিথ্যে বলছি না। এসব ভুল ধারণা মন থেকে ত্যাগ কর।

–কথা বাড়িও না। কঠিন কণ্ঠ রিচার্ডের। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে ঘৃণা কারোলি ওই কাগজে কি লিখেছে, আমি শুনতে চাই। বল, তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছি।

-কিন্তু না, বিশ্বাস কর তুমি। কাগজে কিছুই লেখা ছিল না।

-না না, কেবল মুখের কথা বিশ্বাস করব না, রিচার্ড হাত বাড়িয়ে বলল, নিজের চোখে দেখতে চাই। দাও, কাগজটা আমায় দাও। দেখি তোমার কথা সত্যি কিনা দাও, দাও, দেরি কর না।

কোথায় পাব ওটা? অসহায়তা ঝরে পড়ল লুসিয়ার কথাগুলিতে। ওটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিয়েছি, আমার কাছে নেই।

–লুসিয়া! রিচার্ড গর্জে উঠল, মুখে বাঘের নিষ্ঠুর হাসি। কেন খামোখা মিথ্যে কথা বলছ, লুসিয়া, আমি নিশ্চিত ওটা তোমার কাছেই আছে। দাও, দিয়ে দাও ওটা।

স্ত্রীর খুব কাছে এসে দাঁড়াল রিচার্ড, হাত বাড়াল।

লুসিয়া নীরব, কি যেন ভাবল, মুহূর্ত খানেক পরে বলল–তার মানে তুমি আমায় বিশ্বাস করছ না।

-যদি মনে করি, ওটা ছিনিয়ে নিতে পারি। রিচার্ড তখন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। দাঁতে দাঁতে পিষে বলল–আমার এই পেশীবহুল চেহারাটা দেখেছ তো। কিন্তু না, গায়ের জোর তোমার ওপর খাটাব না, এ আমার নীতিবিরুদ্ধ। বরং…….. রিচার্ড কথা শেষ করল না।

রিচার্ডের হিংস্র চাউনি লুসিয়াকে ভিত করল। আঁতকে উঠে তফাতে সরে গেল।

 রিচার্ড তাকাল লুসিয়ার চোখের দিকে, মিনতি ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ একভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইল রিচার্ড। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিল না, তোমাকে মারধোর করা সম্ভব নয়, সে কাজ আমার নয়।

লুসিয়ার দিকে কঠিন চোখে তাকাল রিচার্ড–তবে……… তবে তোমার ওই বন্ধু উঃ কারোলিকে আমি ছাড়ছি না। উচিত শিক্ষা দেব। আমার দু-চারটে ঘুসিই যথেষ্ট। মুখ থেকে : আসল কথা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসবে। আমার বাড়িতে বসে আমার স্ত্রীর সঙ্গেই ফষ্টিনষ্টি। মজা করা বের করছি।

-না না, ওসব করতে যেও না। লুসিয়া আঁতকে উঠল। বোঝা গেল, দারুণ ভয় পেয়েছে সে দোহাই রিচার্ড, শান্ত হও। ওর গায়ে হাত দিও না, মারধোর করো না।

-বাঃ, চমৎকার, পুরনো প্রেমিকের জন্য দরদ উথলে উঠছে। রিচার্ড ব্যঙ্গের স্বরে বলতে থাকল–ডঃ কারোলিকে আমি মারবই, তাতে তোমার কি?

বাড়াবাড়ি কর না রিচার্ড। চাপা গর্জন শোনা গেল লুসিয়ার কথায়–উনি আমার প্রেমিক নন, কোনকালে ছিলেন না।

-আ-হা-হা! রেগে যাচ্ছো কেন? স্ত্রীকে শান্ত করতে রিচার্ড তৎপর হল। লুসিয়ার কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে বলল–হয়তো উনি এখনও তোমার প্রেমিক হয়ে ওঠেন নি, হয়তো উনি……..

রিচার্ড তার কথা শেষ করতে পারল না। বাইরে কারা যেন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। রিচার্ড ঝট করে স্ত্রীর কাছ থেকে সরে এল, ফায়ার প্লেসের দিকে পা বাড়াল, সিগারেট ধরাল, দৃষ্টি দরজার দিকে মেলে দিল। লুসিয়া ততক্ষণে ভাল মানুষের মতো রিচার্ডের খালি চেয়ারটা দখল করেছে।

দরজা ঠেলে ঢুকলেন দুই মহিলা ক্যারোলিন অ্যামরি আর রিচার্ডের বোন বারবারা অ্যামরি।

কুড়ি-একুশ বছরের সদ্য তরুণী আধুনিকা বারবারার হাতে ঝুলছে সুন্দর একটি ব্যাগ। কোনদিকে না তাকিয়ে সে সটান এসে দাঁড়াল লুসিয়ার সামনে লুসিয়া, তোমার খবর কি? শরীর ভালো আছে তো?

.

০৩.

লোক দেখানো হাসির ঝিলিক ঠোঁটে ছড়িয়ে লুসিয়া জবাব দিল–হ্যাঁগো সোনা, আমার শরীর ঠিক আছে, কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

-সত্যি? তাই বুঝি? বারবারা রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলো বলল।

খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ভাই রিচার্ডকে লক্ষ্য করে চাপা গলায় বলল–সুখেই আছ। তোমাদের মতলবটা বুঝতে পেরেছি। তাই দু’জনে এঘরে এসে ঢুকেছ।

ননদের রসিকতাপূর্ণ ইঙ্গিতটার অর্থ বুঝতে দেরি হল না লুসিয়ার। সে শুকনো হাসি হেসে ঘাড় কাত করল।

বারবারা! এসব কি মজা হচ্ছে? পিসি ক্যারোলিন ধমকে উঠলেন–কি যে অসভ্যতা করিস, ভাল লাগে না।

–আমার কথাগুলো অসভ্যের মতো শোনাচ্ছে, বারবারা উত্তর দিল, বিয়ের পরে মা হওয়া মামুলি এক দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হবে বলেই নারী জাতির জন্ম। এই সহজ সত্যি কথাটা কেন তুমি মেনে নিতে পারছ না, পিসিমা?

–আবার ফাজলামো! ক্যারোলিন আবার ধমকে উঠলেন। বর্তমান যুগের মেয়েরা এত নোংরা রসিকতা করতে কোথ থেকে শিখেছে, কে জানে। আপন মনে বলে চললেন পিসিমা–আমরা বাপু, তোদের মতো বয়সে এত ফাজিল হয়ে উঠতে পারিনি, কখন কার পেটে বাচ্চা আসবে তা দূর অস্ত।

এসময় রিচার্ড নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

–দিলি তো তোর দাদাকে রাগিয়ে, ক্যারোলিন আবার ধমকে উঠলেন, আহা বেচারা, পুরুষ মানুষ, নিজের বউয়ের সামনে এমন খোলমেলা আলোচনা সহ্য করতে পারে। তাই তো গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সত্যি বারবারা, তোর যে কবে জ্ঞান গম্যি হবে, কে জানে।

শোনো পিসিমা, বারবারা মৃদু হেসে বলতে লাগল, কিছু মনে করো না, অবশ্য মনে করলে আমার বয়ে গেল, রানী ভিক্টোরিয়ান যুগে যা করেছ, তাই আঁকড়ে ধরে বসে আছে। দুনিয়া কি সেই মান্ধাতা আমলে পড়ে আছে? এখন এগিয়ে যাবার সময়, সামনের দিকে সবাই ছুটছে–এসব খবর কি রাখ?

–মেনে নিলাম তোর কথা। তবে সেকাল-একাল নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। অতএব পছন্দ অপছন্দের দ্বন্দ্বও নেই, জেনে রাখিস তুই।

-এ নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার, পিসিমা। বারবারা হেসে উঠল–কিন্তু তোমাদের জমানায় মানুষ কি ভাবে বাবা-মা হয়, এ প্রশ্নের উত্তরে ছোট ছেলেমেয়েদের বলা হত, কোন দেবদূত বা সারস পাখি বেঁচি গাছের ঝোপে বাবা-মায়ের জন্য বাচ্চা রেখে যায়। সত্যি, তোমাদের কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতে হয়, তাজ্জব হতে হয়। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পিসিমা, বাস্তব না-হলেও তোমাদের ওই ব্যাখ্যা আজও শুনতে ভাল লাগে। ভারী মিষ্টি।

বারবারা, থামবি! ক্যারোলিন কৃত্রিম ধমক দিলেন। তারপর মুচকি হেসে লুসিয়াকে ইশারায় দেখিয়ে বলল–বেচারি, ওর জন্য আমার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, কেমন আছে ও, জানার জন্য মনটা আনচান করছিল, তাই তো আবার ছুটে আসতে হল। আর এসে অব্দি তুই আমার সঙ্গে মজা করে চলেছিস। এমন করে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলিস না, ভাল হবে না বলে রাখছি।

সত্যিই তো, লুসিয়ার কান্না ভেজা গলা। শেষ পর্যন্ত চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। দুই মহিলাকে লক্ষ্য করে বলল ধরা গলায় এ বাড়ির প্রত্যেকে আমার সঙ্গে কত সুন্দর ব্যবহার করে। ভাগ্যিস রিচার্ডের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, তোমার কাছে আশ্রয় পেলাম, দয়ামায়া কাকে বলে বুঝতে শিখেছি। বলতে দ্বিধা নেই, তোমাদের আশ্রয়ে এসে সামান্য ভালবাসার পরশ পেয়ে আমি কৃতার্থ হয়েছি। আমার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাব কি করে, বুঝতে পারছি না।

-বাছা, কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আর লাভ নেই, অনেক দেখিয়েছ। নীচু স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে ক্যারোলিন এগিয়ে এলেন লুসিয়ার কাছে। আদরের ছোঁয়া রাখলেন তার মাথায়-গায়ে–জানি, জীবনের প্রথম দিকটা মেয়েদের মা-মাসির স্নেহ ভালবাসায় দিন কাটে, কিন্তু তুমি ওই সময় একাকী বহু দূরে, বিদেশে দিন কাটিয়েছ। ফলে লেখাপড়া দুরে থাক, সহবত শিক্ষা কিছুই হয়নি তোমার, একথাই বলতে চাইছ তো? যাক, ওসব ভেবে চোখের জল ফেলে কাজ নেই।

লুসিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তার দৃষ্টি আটকে আছে পিসিমার দিকে। পিসিমা তার হাত ধরলেন। সযত্নে সোফায় বসালেন। ছড়িয়ে পড়ে থাকা গদিগুলোকে নিজের সুবিধামতো সাজিয়ে আয়েস করে পাশে বসলেন। সোনা, মুখ ভার করে থেকো না। তোমার মনের মধ্যে কি ঝড় চলছে, আমি কি বুঝতে পারছি না? যাক, তোমার ঘাড় থেকে ইটালি নামক ভূতটাকে তাড়াও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। লক্ষ্মীটি, আর মন খারাপ করে থেকো না।

লুসিয়ার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে তাকাতে বারবারা ফোড়ন কাটল–ওর এখন একটু ড্রিঙ্কস হলে ভাল হয়। যে সে নয়, কড়া। তার কথায় রুক্ষ্মতার প্রকাশ সহানুভূতি দেখানো চুলোয় দিয়ে একাল-সেকাল নিয়ে পড়ল–পিসিমা, আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছ? কি হাল! একালের হয়ে সেকালের পরিবেশের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে ড্রিঙ্কস বলতে তো ওই ডিনারের আগে হুইস্কি, নয়তো পরে ব্রান্ডি। এর বাইরে ককটেল নামে যে একটা পানীয় আছে, এ বাড়ির লোকেরা তো জানে না। আর রিচার্ডকে দেখ, ভাল করে একটা ম্যানহাটান ককটেল তৈরি করতে অক্ষম সে। সে কেবল হুইস্কিই চিনেছে। ডিনারের আগে এডওয়ার্ড রেনরকে হুইস্কি সার্ভ করতে বলবে, আর নিজেও তাই গিলবে। স্যাটনিস হুইস্কার জান? খানিকটা লুসিয়ার পেটে পড়লেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

-স্যাটনিস হুইস্কার? সেটা আবার কি? ক্যারোলিন ভুরু কুঁচকে অবাক মুখে তাকালেন–এমন বিদঘুঁটে নাম, না বাবা, জীবনে শুনিনি।

–এটা ঘরে তৈরি করা একটা পানীয়। বারবারা সবজান্তার মতো হেসে উঠল। ব্র্যান্ডি আর ক্রি ডি মেছে–দুটো সমান পরিমাণে নিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। এর পর দিতে হয় কিছুটা শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। পুরো মিশ্রণটা খুব ভাল করে ঝাঁকালেই তৈরি হবে এক ককটেল, তাকে স্যাটনিস হুইস্কার বলে, বুঝেছ? শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো না দিলে পানীয়ের ঝাঁঝ হবে না। জম্পেশ মাল তৈরি করতে হলে তাই চাই শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। দেখবে কেমন ঝাঁঝ ও ঝাল। সত্যি, দারুণ এক ককটেল!

–থাম দিকি, বারবারা, তোর বকবকানিতে মাথা ধরে গেল। বিরক্তিতে ক্যারোলিন বলে উঠলেন–বাবার মুখে শুনেছি, শরীর সতেজ রাখার জন্য টনিক জাতীয় কিছু খেতে হয়, অ্যালকোহল মোটেও নয়। আমার বাবা……..

ক্যারোলিনের কথা থামিয়ে দিয়ে বারবারা হো হো করে হেসে উঠল, বড় বড় চোখে তাকাল তোমার বাবা, মানে সিনিয়ার অ্যালগারলনের কথা বলছ? থাক, পিসিমা, তার কথা ঢাক ঢোল পিটিয়ে আর নাই-বা বললে। এ এলাকার কাকচিলও জানে, নেশা জমানোর জন্য ওনার তিনটি বোতল পরপর চাই-ই, আর আমরা জানব না!

ক্যারোলিনের মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে। তবুও কি ভেবে নিজেকে সংযত করলেন। এদৃশ্য দেখে বারবারা খুশিতে ফেটে পড়ল। মুচকি হাসি দেখা দিল তার ঠোঁটে।

আর লুসিয়া? আহা বেচারি, গোমড়া মুখ, শূন্য দৃষ্টি। সে একবার ক্যারোলিনকে লক্ষ্য করল, তারপর বারবারাকে দেখল। ধীরে ধীরে মুখ খুলল, আমতা আমতা করে বলল সেই থেকে তোমরা কি বলছ বল তো? আমি তো আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

-বাছা, তোমাকে নিয়েই তো আমার যত চিন্তা। পিসিমা আলগোছে লুসিয়ার চিবুক তুলে ধরলেন, তারপর বারবারাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–বারবারা ওর যা অবস্থা, কিছু একটা খাইয়ে না দিলে হবে না। খানিকটা স্যালবোলাটাইল হলেও চলত। আমার কাছে এক শিশি ছিল, কিন্তু ওই শয়তানি ঝি-টা। সকালে ঘর ঝাঁট দিতে এসে ফেলল মেঝেতে, ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

–এত চিন্তা করছ কেন তুমি? বারবারা বলে চলল–তোমার স্যালবোলাটাইল নেই তো কি হয়েছে, হাসপাতালের গুদোম ঘর আছে, যাও, খোঁজ কর, কিছু একটা পেয়ে যাবে মনে হয়।

–হাসপাতালের গুদোমঘর? আবার অবাক হতে হল ক্যারোলিনকে কি বলছিস, স্পষ্ট করে বলতো।

-আরে এডনার ধনভান্ডারের কথা বলছি, বারবারা জবাব দিল, হাতড়ে দেখ, ঠিক কিছু মিলবে।

-এতক্ষণে তোর সুবুদ্ধির দোর খুলেছে দেখছি, পিসিমা খুশি হলেন, লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন–ও, তুমি তো আবার এডনাকে চেনো না। বারবারার বড় বোন এডনা। সে এখন ইন্ডিয়াতে আছে তার স্বামীর সাথে খুব ভাল মেয়ে, নিখুঁত তার কাজকর্ম। এডনা চলে যাবার তিনমাস পর তুমি এখানে এসেছ।

-সত্যি, তা যা বলেছ, নিখুঁত কাজ। পিসিমার পেছনে লাগার মতো একটা অস্ত্র বারবারার হাতে এসে গেছে, এ সুযোগ আর কি ছাড়ে?–খাঁটি মেয়ে বলেই তো ইন্ডিয়াতে যেতে না যেতেই সন্তানের মা হয়েছে–একটা নয়–দু-দুটো। ইন্ডিয়াতে বৈচিগাছের ঝোপ নেই বলেই আমার ধারণা, তবে সারস পাখি আছে। নিশ্চয়ই বাচ্চা দুটোকে কোন জাম গাছের নীচে ঘাসের বিছানায় সারাস পাখি রেখে গিয়েছিল তাই তো?

-মুখটা বন্ধ কর, বারবারা। ক্যারোলিন ধমকে উঠলন, লাগাম ছাড়া মুখ, কিছু আটকায় না। চোখ ফেরালেন লুসিয়ার দিকে হা, যে কথা বলছিলাম। ঘরে বসে সময় খরচ করা এডনার ধাতে ছিল না। সে তাই এখানকার কাউন্টি হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে যোগ দিল। তার দৌলতে সারা টাউন হলটা হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধ একদিন শেষ হল, এডনা কাজ ছাড়ল না। বিয়ের আগে পর্যন্ত সে কাজ চালিয়ে গেছে। এমনকি এখানকার কাউন্টি হাসপাতালের ডিসপেনসারিতেও তার ডাক পড়েছিল। ধীরে ধীরে ওর অসুখ-বিসুখ সারিয়ে তোলার একটা প্রাথমিক ধ্যানধারণার জন্ম হয়েছিল। কোন ওষুধ, কোন বড়ি, কোন রোগে লাগবে, এ জ্ঞানটা ও ইন্ডিয়াতে গিয়ে কাজে লাগাতে পারবে বলে আমার ধারণা। তারপর কি হল? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এডনা চলে গেল, কিন্তু ওর যত ওষুধের শিশি পড়ে রইল এ বাড়িতে। কিন্তু সেগুলো গেল কোথায়?

-আমি বলছি, বারবারা বলতে শুরু করল, ওগুলো একটা কালো টিনের বাক্সে ভরে তুলে রাখা হয়েছিল চিলেকোঠার ঘরে। পারিষ্কার মনে আছে আমার। ইন্ডিয়ায় যাবার আগে এডনা সেগুলো নামিয়ে নিয়ে এল। নিজেদের বাক্স প্যাটরা গোছগাছ করল। আর ওটা তুলে রাখল ওখানে। আঙুল তুলে সে বইয়ের তাকটা দেখিয়ে দিল, সেই থেকে একইভাবে পড়ে আছে, কেউ হাত দেবার প্রয়োজনও মনে করেনি। কোনটা প্রয়োজনীয়, কোনটা নয়, সব বোঝাই হয়ে আছে।

কথা শেষ করে বারবারা উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা টেনে নিয়ে এল বইয়ের তাকের কাছে। উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে নামিয়ে নিয়ে এল কালো টিনের বাক্সটা।

–ওষুধ আমার প্রয়োজন নেই, লুসিয়া আঁতকে উঠে বলল, আমি ভালই আছি, বিশ্বাস কর।

লুসিয়ার কথায় আমল না দিয়ে বাক্সটা নীচে রাখতে রাখতে বলল–বেশ, তোমার কথাই সই। তবে কষ্ট করে এতদিন পরে এটাকে যখন নামালাম, তখন একবার খুলে না দেখলে চলে।

টিনের বাক্সের ঢাকনা ইতিমধ্যে খুলে গেছে। বারবারা হাত ঢোকাল। দু-আঙুলের ফাঁকে একটার পর একটা শিশি তুলে ধরল। শিশির পায়ে সাঁটানো লেবেলগুলো দেখে তার চোখ ছানাবড়া। ফিসফিসিয়ে বলল–বাব্বাঃ এতে যেমন তেমন ধনভান্ডার নয়। এটা আয়োডিন……….এটা কি……….. ফ্রায়ার্স বালমাস……. ক্যাস্টর অয়েল নাকি?

আবার সে বাক্সের ভেতর হাত ঢোকাল–কয়েকটা বাদামি রঙের কাঁচের টিউব। বারবারা হাসতে হাসতে বলল–এ যে মারাত্মক ওষুধ। মানুষ মারতে ওস্তাদ অ্যাস্ট্রোপিন…….মরফিন ….স্ট্রিকনিন। ক্যারোলিন পিসিমা, তুমি কোথায়? খুব সাবধান, আমার পেছনে লেগো না। তাহলেই সর্বনাশ। এই যে, স্ট্রিকনি দেখছ, কফিতে কয়েকফোঁটা মিশিয়ে দিলে আর রক্ষা নেই। বুকের যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মতো দাপাদাপি করবে, অভিনয় করে দেখাল সে, তারপর সব শেষ–মৃত্যু!

ভাইঝির ভেংচিকাটা কথাবার্তা শুনে ক্যারোলিনের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

নাঃ, শুধু খেটেই মরলাম, লাভ হল না কিছু। নামিয়ে রাখা শিশি আর টিউবগুলো স্বস্থানে রাখতে রাখতে বারবারা ফিসফিসিয়ে বলল–এমন কিছু নেই, যা খেয়ে লুসিয়া চাঙ্গা হতে পারে।

এমন সময় বসার ঘরের দরজা খুলে গেল। একে একে সকলে এসে ঢুকলেন–প্রথমে বাটলার ট্রেডওয়েল। তার পেছন গৃহকর্তা স্যার ক্লড অ্যামরি, পেছনে তার সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর এবং পারিবারিক অতিথি ডঃ কারোলি।

-হ্যালো, মি. রেনর বারবার তার সামনে এসে পড়ল বারবারা, শিশি আর টিউবগুলো রাখতে রাখতে বাক্সটা দেখিয়ে সে বলল–এগুলো সব বিষ! কোন কৌতূহল আছে? দেখবেন নাকি একবার?

রেনর এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। বছর তিরিশের এক সাধারণ চেহারার শান্ত গোবেচারা যুবক।

ডঃ কারোলি এবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, গায় তামাটে বর্ণ, ইভনিং স্যুটটা ভালই মানিয়েছে তাকে। বারবারার দিকে একটু ঝুঁকে জানতে চাইলেন–এগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছেন কেন, মিস অ্যামরি?

তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার ক্লড, ভৃত্যের উদ্দেশ্যে বললেন ট্রেডওয়েল, একটু আগে তোমাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সেটা করেছ?

–আজ্ঞে, করেছি স্যার ক্লড। কথা শেষ করে ট্রেডওয়েল সেখান থেকে প্রস্থান করল।

ডঃ কারোলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্যার ক্লড বললেন–কিছু মনে করবেন না, আমায় এবার যেতে হবে, দরকারি কাজ আছে, কয়েকখানা জরুরি চিঠি লিখে আজ রাতেই পাঠাতে হবে।

কথা শেষ করে স্যার ক্লড সেক্রেটারি রেনরকে সঙ্গে নিয়ে লাগোয়া স্টাডিতে ঢুকে পড়লেন। দরজার কপাট বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। বারবারার হাতে ধরা ওষুধের টিউবটা ছিটকে পড়ল কারণটা কেউ জানে না।