০৫. সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা

০৫.

যেন চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঘটে গেলো সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ, সকলের দৃষ্টি এখন স্থির-নিবদ্ধ মার্স্টানের প্রাণহীন দেহের দিকে। কারোর মুখে কথা নেই। কিন্তু সকলের মনে একটাই প্রহ্ন কেবল কিভাবে তার মৃত্যু হলো।

ডঃ আর্মস্ট্রংই প্রথম বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে দ্রুত ছুটে গিয়ে মার্স্টানের স্পন্দনহীন ডান হাতখানি তুলে নিয়ে নাড়ি টিপে ধরলেন। না, কোনো সাড়া নেই। স্তব্ধ নিঃসাড়।

মাথা নাড়লেন তিনি গভীর দুঃখের সঙ্গে, মার্স্টান মৃত।

আরেক দফা সাত-জোড়া চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মার্স্টানের দিকে। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, অমন তরতাজা, হাসিখুশিতে প্রাণোচ্ছল যুবক হঠাৎ কি করে মারা যেতে পারে। বোধহয় ডঃ আর্মস্ট্রং-এর হিসেবে কোথাও ভুল হয়ে থাকবে। তাদের ধারণা মার্স্টান মরেনি বেঁচে আছে সে এখনো।

ডাঃ আর্মস্ট্রং আর একবার ভাল করে পরীক্ষা করলেন মার্স্টানকে চোখের পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, তার ঠোঁটে নীল রঙের দেখতে পেয়ে কি মনে করে ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকা তার মুখের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে কিসের যেন ঘ্রাণ নিলেন। সব শেষে তার মদের গ্লাসের একটা ভাঙ্গা টুকরো কাঁচ তুলে নিলেন নিজের হাতে তিনি।

তবে কি মার্স্টান দম আটকে মারা গেছে? একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলো ম্যাকআর্থার।

দম আটকে মারা গেছে কি না জানি না, উত্তরে আর্মস্ট্রং বলে মনে হয় হঠাৎ তার নাড়ির স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে এসেছিল। তারপর তিনি কি মনে করে সেই গ্লাসের গায়ে লেগে থাকা অবশিষ্ট তরল পদার্থের এক ফোঁটা হাতে আঙুলে নিয়ে অতি সন্তপর্ণে জিভে ঠেকালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ভাব বদলে গেলো।

তার মুখের ভাব বদলে যাওয়াতে ছজোড়া চোখ চিন্তাক্লিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছু একটা শোনার জন্যে।

আপনারা যা ভাবছেন ঠিক তা নয়, মার্স্টানের মৃত্যু দম আটকে গিয়ে হয়নি। শুধু তাইনয়, তার মৃত্যু একেবারে স্বাভাবিক নয়।

সে কি? চমকে উঠলো ভেরা তার মানে আপনি বলতে চান ঐ হুইস্কিতে–

হ্যাঁ, ঠিক তাই, হুইস্কিতেই ছিলো তার মৃত্যুর পরওয়ানা। জোর দিয়ে বলতে না পারলেও তবু বলছি সম্ভবত পটাসিয়াম সায়ানাইডের প্রতিক্রিয়াতেই, তার মৃত্যু ঘটে থাকবে।

পটাসিয়াম সায়ানাইড? এই প্রথম কথা বললেন ওয়ারগ্রেভ। তার হুইস্কির সঙ্গে মেশানো ছিল।

তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এবার লম্বার্ড জানতে চাইলো, মার্স্টান যখন নিজেই সকলের ড্রিঙ্কস্ পরিবেশন করেছিল, সে নিশ্চয়ই নিজে তার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে থাকবে। তাই কি?

যুক্তিটা ঠিক গ্রহণযোগ্য না হলেও কতকটা দায়সারা গোছের ঘাড় নাড়লেন ডঃ আর্মস্ট্রং আপাতঃ দৃষ্টিতে সেই রকম তো মনে হচ্ছে।

তবে কি এটা আত্মহত্যা? মৃত মার্স্টানের দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরালেন, ব্লোর তাজ্জব ব্যাপার তো।

না, না উনি আত্মহত্যা করতে যাবেন কেন, অমন হাসিখুশিতে ভরা সুন্দর যুবক শুধু শুধু নিজেকে শেষ করতে যাবে কোন্ দুঃখে? প্রতিবাদ করে উঠলো ভেরা।

ভেরার কথাটা যেন লুফে নিলেন ডঃ আর্মস্ট্রং তাহলে আপনারাই বলুন আত্মহত্যা ছাড়া আর হঠাৎ এভাবে মৃত্যুর পিছনে অন্য আর কিসের সম্ভাবনাই বা থাকতে পারে?

অন্য আর কিই বা সম্ভাবনা থাকতে পারে? ভাবতে পারছে না কেউ। আর ভাববেই বা কি করে? একই বোতলের হুইস্কি থেকে তো আমরা সবাই খেয়েছি। তাছাড়া নিজের হাতে সকলকে মদ পরিবেশন করছিল। অতএব এর থেকেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এটা একটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

কিন্তু এর পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, কেনই বা সে আত্মহত্যা করতে যাবে?

আমারও হিসাব মিলছে না, আর্মস্ট্রং-এর উদ্দেশে বললেন ব্লোর, ডঃ আর্মস্ট্রং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্স্টানের আত্মহত্যা করার কথা চিন্তাই করা যায় না।

এ প্রশ্নটা তখন থেকে আমকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে তাকে সমর্থন করে বললেন আর্মস্ট্রং কিন্তু সঠিক উত্তরটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।

আর্মস্ট্রং এবং লম্বার্ড দুজনে ধরাধরি করে মার্স্টানের মৃতদেহ রেখে এল তার ঘরে। তার মৃতদেহ সাদা চাদরের ঢেকে ফিরে এলো একতলায় তারা। বসবার ঘরে সকলে তখন স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন, ভয়ে আতঙ্কে কেউ কারোর দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছিলো না।

ওদিকে রাতও তখন বেড়ে চলেছে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এমিলিই প্রথম কথাটা তুললেন, রাত অনেক হলো এবার শুয়ে পড়া উচিত।

এমিলিকে সমর্থন করলেন ওয়ারগ্রেভ, তা যা বলেছেন, এরপর বসে থাকার কোনো মানে হয় না।

রগার্সের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন আর্মস্ট্রং তা তোমার স্ত্রী এখন ভাল আছে তো রগার্ল?

হ্যাঁ, বেশ ভালই আছে স্যার। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

বেশ তো ঘুমোক না। রাতে আর জাগিও না।

ঠিক আছে স্যার তাই হবে। রগার্স বলে, আপনারা শুয়ে পড়লে ফটক বন্ধ করে আমিও শুতে চলে যাবো। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় রগার্স। আর তারা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন যে যার ঘরে যাওয়ার জন্য।

এতোবড়ো প্রাসাদের আনাচে কানাচে কোথাও এতটুকু অন্ধকারের চিহ্নমাত্র দেখা গেলোনা, চারিদিক আলো আলোকিত প্রাসাদ। কেউ যে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকবে, সেরকম অন্ধকারের অবকাশ ছিলো না কোথাও। আর এই আলোয় আধিক্যটাই হয়েছে সব চেয়ে বেশী আতঙ্কের, ভয়ের কারণ। অন্ধকারে বিপদ আছে বটে, তবে আলোয় মৃত্যুর হাতছানি যে আরো বেশী ভয়ঙ্কর….

শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার ঘরে প্রবেশ করে চটপট দরজা বন্ধ করে দিলো এমনভাবে যেন বাইরের আলোটা তাদের তাড়া করে ফিরছিলো।

শোয়ার উদ্যোগ করতে গিয়ে একের পর এক স্মৃতি মনে পড়তে থাকলো ওয়ারগ্রেভের মনে….

সিটন-এডওয়ার্ড সিটন। তার সুন্দর মুখখানি যেন তার চোখের সামনে ভাসছে এখনো। মাথা ভর্তি চুল। নীল চোখ, মায়াবী দৃষ্টি, অমন একটা আকর্ষণীয় চেহারা কি ভোলা যায় সহজে। একবার দেখলেই মজে যেতে হয়। তা মজে ছিল জুরীরাও তার চেহারায়–অমন সুন্দর চেহারার মানুষের কোনো অন্যায় যেন অন্যায়ই নয়, জুরীদের মনে এই কথাটাই যেন গেঁথে গিয়েছিল।

আর সরকার পক্ষের উকিল নিলিনও কি কমতি ছিলো, তাকে বাঁচানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে পড়েছিল সে। তাছাড়া তার উকিল ম্যাথিও সেই সুযোগে তার মক্কেলের সমর্থনে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। সাওয়াল-জবাবের সময় আগাগোড়া মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব সময় তার বক্তব্যের মধ্যে একটা করুণ আবেদনের ছাপ রেখে গিয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, জুরীদের মন গেলো গলে। সিটনের নির্দেশিত উপলব্ধি করতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ রইলো না তাদের মনে।

আবার তখন কি চিন্তা। জুরীরা বেঁকে বসলে আসামীর বিরুদ্ধে রায় দেবে কি করে? তাই প্রতিটি জেরা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনে নোট লিখতে হলো আমাকে। প্রয়োজনীয় নথিপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হলে আমাকে। তবু জুরীরা আমাকে দারুণ ভাবিয়ে তুললো, মামলা বুঝি কেঁচিয়ে গেলো, তীরে এসে আমার তরী বুঝি ডুবে গেল।

তবে যার শেষ ভাল, তার সব ভাল বলে একটা প্রবাদ আছে। সেটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলে শেষ পর্যন্ত। রায় দেওয়ার সময় চমকে দিলাম সকলকে। আসামীর বিরুদ্ধে একটা মোক্ষম অস্ত্র হানলাম। আর তাতেই আসামী পক্ষের উকিল এবং সিটনের সমর্থক জুরীরা ও সরকারপক্ষের উকিল সবাই ধরাশায়ী। তাদের সেই দুরাবস্থা দেখে নিজের মনে বললাম, আরে বাবা আমি হলাম গিয়ে অতি বিচক্ষণ বিচারপতি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কি কোনো দাম নেই। আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না কেউ। কেমন, এবার সবাই জব্দ তো…

বাঁধানো দাঁতের সেটটা খুলে ফেলে গ্লাসের জলে ধীরে ধীরে ডুবিয়ে রাখলেন ওয়ারগ্রেভ। এই মুহূর্তে তার দন্তহীন মুখটা ভয়ঙ্কর বিশ্রী একটা আকার ধারণ করলো, ঠোঁট দুটো ঝুলে পড়লো সামনের দিকে, তোবড়ানো গাল কুঁচকে যাওয়া চোয়াল, ঝুলে পড়া থুতনী সব মলে একটা বীভৎস রূপ যেন বিশীর্ণ মুখ। সেই কুৎসিত মুখে অতি কঠিন, অতি নির্মম, অতি নিষ্ঠুর হাসির একটা সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠতে দেখা গেলো। আর সেই সঙ্গে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো। তার মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো কয়েক মুহূর্তের জন্য এবং তারপরেই ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি।

ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের তলায় রান্নাঘরে জমে উঠেছিল এক মুকাভিনয়ের নাটক। অভিনেতা নজন আর দর্শক মাত্র একজন রগার্স।

তাজ্জব ব্যাপার তো? এই খানিক আগে কাঁচের আলমারিতে দেখে গেলাম দশজন মুকাভিনেতা অর্থাৎ মোট দশ দশটি পুতুল। আর এখন তাদের মধ্যে একটি উধাও। রইলো এখন নটা।একটি পুতুল গেলো কোথায়? ডান গজালো নাকি তার।

ওদিকে ম্যাকআর্থারের চোখে ঘুম নেই। ঘুম আজ আর আসবে না বোধহয়। তার মন এখন আচ্ছন্ন আর্থার রিচমকে ঘিরে। অনিন্দ্যসুন্দর এক যুবক। মনে পড়ে যায় তার উচ্ছ্বাসে ভরপুর যৌবনের কথা। সত্যি ভাললাগার মতোই চেহারা ছিলো ছোকরার। তাকে দেখে আমার স্ত্রীর মাথা ঘুরে গেলো, তার হাবভাব দেখে আমার অন্তত সেইরকমই মনে হয়েছিল।

এক ছুটিতে জিদ ধরলো রিচমণ্ড আমার বাড়িতে যাবে। অগত্যা সঙ্গে করে নিয়ে এলাম তাকে। প্রথমে আমার আপত্তি ছিলো কে জানে নেসলির যদি পছন্দ না হয় তাকে। যাই হোক রিচমণ্ডকে তার মনে ধরতে দেখে আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটলো।

তা রিচমণ্ডকে আদর আপ্যায়নের সেকি ঘটা নেসলির। ছুটির কটা দিন রিচমণ্ডকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে লেসলি, একটা মুহূর্তের জন্যও তার সঙ্গ ছাড়েনি সে। হাসি-ঠাট্টা-গল্প মশগুলে কেটেছে রিচমণ্ডকে নিয়ে। অনেকদিন পরে লেসলির মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখে আমার দুচোখ জুড়িয়ে গেছে। সন্তানহীনা লেসলি যেন এতোদিনে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে রিচমণ্ডকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে।

মাতৃস্নেহ কথাটা এখন ভাবলে গা ঘিনঘিন করে উঠে। ছিঃ ছিঃ আমি তখন কি বোকাই না ছিলাম। একবারও বুঝতে পারিনি মায়ের আদরের নামে যে রিচমণ্ডকে বুকে জড়িয়ে ধরার পিছনে লেসলির ছেনালিপনার তাগিদ ছিলো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চেয়েছিল সে।

অথচ এই লেসলিকে আমি কতোই না ভালবাসতাম, বিশ্বাস করতাম তাকে আমার পতিব্রতা স্ত্রী হিসেবে। বিদেশে যেখানেই থাকতাম শয়নে-স্বপনে তার কথা ছাড়া অন্য কোন নারীর কথা ভাবতে পারতাম না। সে ছিলো আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম। কিন্তু আমার সেই ভুল ভাঙ্গতে বেশী দেরি হল না।

আমি তখন বিদেশে আমার কর্মক্ষেত্রে। একদিন লেসলি চিঠি লিখলো আমাকে ও রিচমণ্ডকে দুজনকেই। আমার নাম লেখা খামটা জামার ভেতরের চোরা পকেটে পুরে চুপিচুপি এসে ঢুকলাম আমার তাবুতে।

সযত্নে খামের মুখ খুলে চিঠিটা বার করে পড়তে গিয়ে প্রমেই হোঁচট খেলাম। চিঠিটা আমার নয়, রিচমণ্ডকে লেখা। খাপে ভরবার সময় ভুল করে চিঠি অদল-বদল হয়ে থাকবে হয়তো। ওঃ কি মধুর একটা সম্ভাষণ, অমন একটা গভীর অনুরাগপূর্ণ সম্ভাষণ দিয়ে আমাকে কখনো চিঠি লেখেনি লেসলি। আর ভাষারই বা কি ব্যঞ্জনা। চিঠির প্রতিটি লাইনে প্রেমের ছড়াছড়ি। চিঠি তো নয়, যেন একটা প্রেমের কবিতা। লেসলির প্রেমের কবিতা পড়তে গিয়ে রাগে দুঃখে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকলো। বুকের পাঁজরগুলো এক এক করে ভেঙ্গে যেতে থাকলো যেন। একটা বোবা কান্নায় বুকটা আমার হাহাকার করে উঠলো। এরই নাম প্রেম। এরই নাম জীবন। যাকে আমি বিশ্বাস করে আমার প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবেসে এসেছি সেই কি না আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো, চরম আঘাত দিলো আমার নিঃস্বার্থ প্রেমের ওপর। জীবনটাই যেন একটা বিরাট ফকি। মানুষের ছদ্মবেশে কতকগুলো জানোয়ার যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। ওৎ পেতে বসে আছে। রক্ত-পিপাসু পশুর মতো, সুযোগ পেলেই যেন তারা মানুষের সৎ ইচ্ছে, সৎ প্রবৃত্ত গুলোকে পদদলিত করে একেবারে নষ্ট করে দেবে।

যেমন করলো লেসলি। আর এই দ্বিচারিণী, বিশ্বাসঘাতিনীকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে এসেছি এতোদিন ধরে? ভাবতেও ঘৃণা হয়। কি করবো আমি এখন আমার সামনে এখন একটাই পথ খোলা আছে–প্রতিশোধ, তাদের দুজনের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমি যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম না তখন।

তা সুযোগটা এসে গেলো কদিন পরেই। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে একজনকে পরীক্ষা করে দেখে আসতে হবে। এসব ব্যাপারে একজন সাধারণ সৈনিকই যথেষ্ট। কিন্তু তা না করে রিচমণ্ডকেই পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। এখানে কাজটা গৌণ গৌণ নয়, আমার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো রিচমকে যে ভাবেই হোক একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনরকমে পাঠাতে পারলে হয়, তাহলে চিরদিনের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে দ্বিচারিণী লেসলির ওপরেও চরম আঘাত হানা যেতে পারে, তার হাত দিয়ে রিচমণ্ডের উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা আর কখনো বেরুবে না। এবং হোও তাই, অন্যদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে তার ফেরা আর হলো না। সে তার প্রেমিকা লেসলিকে ভালবাসতে আর কখনো ফিরে আসবে না। কদিন পরে শত্রুপক্ষের গুলিতে তার নিহত হওয়ার দুঃসংবাদ এসে পৌঁছালো। হ্যাঁ, এইরকমই তো আমি চেয়েছিলাম। খবরটা পেয়ে আমার কোন দুঃখ হলো না বরং মনটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেলো।

রিচমণ্ডের মৃত্যুর ব্যাপারে কেউ মাথা ঘাটালো না, কারণ তারা বেশ ভাল করেই জানতো, যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে জীবিত অবস্থা ফেরার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে। বেশ নিশ্চিন্তে কটা দিন কাটলো। একদিন কাজকর্ম সেরে তাবুতে ফিরছি, পথে আর্মিটেজের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। যেচে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। বেশ বুঝতে পারলাম, তার চোখ দিয়ে মুঠো মুঠো ঘৃণা ঝরে পড়ছিলো। ভাবলাম, রিচমণ্ডের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলো সে মনে হয় রিচমকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর উদ্দেশ্যটা। সে অনুমান করতে পেরেছে। আর তাতেই তার রাগ ও ঘৃণা আমার ওপর। কিন্তু যাই বুঝে থাক না কেন, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। যেমন ভাবেই তুমি লোককে বোঝাও না কেন, আমার চালাকিটা কেউ ধরতে পারবে না ধরার সাধ্যও নেই কারোর। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যে কেউ মারা তো যেতেই পারে? কে পাঠিয়েছে কেন পাঠিয়েছে, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে যাবে না।

একদিন ফিরে এলাম ইংলণ্ডে। লেসলি সব শুনে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। তার সেই কান্না দেখে আমার গা-পিত্তি জ্বলে যেতে লাগলো তাকে মুখে কিছু প্রকাশ করলাম না। বজ্জাত মেয়েছেলেটাকে প্রাণে আঘাত না করে তাকে মারবো। তাকে তিলে তিলে দগ্ধে মারবো।

কিন্তু পনের বছর পরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আর্মিটেজ কি তার সন্দেহের কথা কারোর কাছে প্রকাশ করে দিলো? আর বললেই বা কি এসে যায়। এতদিন পরে তখন কে আবার তা নিয়ে জল ঘোলা করতে উঠে পড়ে লাগলো?

বছর তিন পরে লেসলি মারা যায় ডবল নিউমোনিয়ায়। তার চিকিৎসার ত্রুটি আমি করিনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে চলে আসি ডিভনে। ছোট খাটো একটা বাড়ি কিনলাম। তার আগেই স্বেচ্ছায় চাকরী থেকে অবসর নিয়েছিলাম। বেশ সুখেই কাটছিল আমার দিনগুলি। বছর তিনেক পরে হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম, প্রতিবেশীরা কেউ আর আমার সঙ্গে কথা বলছে না, তবে কি আর্মিটেজ তার সেই সন্দেহের কথাটা এদের জানিয়ে গেলো, আর তাতেই কি তাদের এই অকস্মিক পরিবর্তন। যাই বলুক, তাতে আমার ভারী বয়ে গেলো, আমার সঙ্গে কে কথা বললো না বললো তো বয়েই গেলো, একা একা বেশ আছি আমি।

তা-এই দ্বীপে এসেও ভেবেছিলাম, বেশ সুখেই কাটবে কটা দিন। ভেবেছিলাম পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-চৈ করে কটা দিন আনন্দ মুখর হয়ে উঠবে। কিন্তু মাঝখান থেকে সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটা। সব ভণ্ডুল করে দিয়ে গেলো। তা জবাবের মতো একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছি বটে। ওসব ঘেঁদো অভিযোগ তোলা হয়েছে, আমার মতো তারা কেউ দোষী নয়। সব বাজে কথা, সব ধাপ্পা, স্রেফ ধাপ্পা। অতিথিদের নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে এসে তাদের সঙ্গে এ কি রসিকতা বাপু। আর এ সব বড়লোকী চাল ছাড়া আর কিছু নয়। বাজে ধাপ্পা দিয়ে সৎ মানুষগুলোকে অস্বস্তির মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে মিঃ ওয়েন হয়তো আড়াল থেকে মজা দেখতে চাইছেন। এই আর কি।

আরে এই দ্বীপের মানুষগুলোও যেন কেমন। কেউ কারোর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে চায় না, মিশতে চায় না। কথা না বললো তো বয়েই গেলো আমার। একা একা করে। মাত্র একদিনেই যেন মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে রয়েছি এই দ্বীপে…তা আমরা যেন কবে ফিরবো? হ্যাঁ আগামীকালই তো ফ্রেড নারীকটের লঞ্চ এলেই সবার আগে গিয়ে, আমি উঠে বসবো তার লঞ্চে। আর অন্যেরা যা খুশি করুক আমি ফিরেও তাকাতে যাব না কারোর দিকে।

কিন্তু এ-দ্বীপ ছেড়ে চলে না গেলে কেমন হয়। মন্দ হয় না। এমন একটা নির্জন দ্বীপে লোকালয়ের থেকে অনেক দূরে দিনগুলো বেশ ভালই কাটবে বলে মনে হয়। শহরের স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোর ভীড়ে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে আবার ফিরে যেতে ভাল লাগে না।

খোলা জানালা পথে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। এখানকার আকাশ কেমন নির্ভাবনাময় আকাশের কেমন সংসার নেই, নেই চিন্তা-ভাবনা। আকাশের মতো হতে ইচ্ছে হয়। দূরের ঐ পাহাড়, সমুদ্র অরণ্য, এই প্রাসাদ সব কিছুই থাকবে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে। হ্যাঁ এই দ্বীপেই থেকে যেতে চাই আমি চিরদিনের জন্য, এখানে থেকেই আমি আমাদের পরিণতি দেখে যেতে চাই নিজের চোখে।

ভেরার চোখ থেকেও ঘুম যেন আজ নির্বাসন নিয়েছে। অন্ধকার যেন তাকে গিলতে আসে, তাই ঘরের আলো জ্বেলে রেখেছিল সে।

একা হলেই মন চলে যায় তার সুদুর অতীতে। বিশেষ করে আজ স্মৃতির পাতা উল্টাতে গিয়ে বারবার একটা মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে–সেই মুখখানি হুগোর

হুগো, আমার প্রিয়তম, তুমি আজ কোথায়? কত দিন দেখিনি তোমায়। আজই এই মুহূর্তে তোমাকে বেশী করে মনে পড়ছে কেন বলো তো। কাছে নেই তবু যেন তুমি আমার পাশটিতেই আছে, জড়িয়ে আছে আমার বুকের মধ্যে।

কর্ণওয়ালা। মনে পড়ে তোমার কর্ণওয়ালের সেই ভাললাগা দিনগুলির কতা? সেই মধুর দিনগুলি কি ভোলা যায়।

আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, পাহাড়ের পাশেই ধু-ধু বালিয়াড়ি, সামনে অথৈ জল জলের কলকল শব্দ, মিসেস হ্যামিল্টন, আর সিরিল…

আধো আধো স্বর আবদার করতে সিরিল জলে সাঁতার কাটবার জন্য। তোমার ইচ্ছে নয় যে, ওর সেই আবদারে সাড়া দিই। তোমার চোখে চোখ পড়তেই তুমি মাথা নাড়তে। আমি যেন ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতাম সিরিলকে। ঘুমিয়ে পড়তো ও। তারপর বেরিয়ে পড়তাম তোমার সঙ্গে বেড়াতে।

এমনি একটা দিনের কথা মনে পড়ছে আজ। সেদিন চাঁদ উঠেছিল আকাশে। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির ওপর জ্যোৎস্নার আলো লুটোপুটি খাচ্ছিল। ভিজে বাতাসে জলের সোঁদা সোঁদা গন্ধ মাতাল করা হাওয়া। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিলাম হাতে হাত রেখে গায়ে না ঠেকিয়ে। মনে মনে ভাবছিলাম আমরা, আমাদের চলার পথ যদি শেষ না হয় কখনো। আর তখুনি হঠাৎ..হ্যাঁ, হঠাৎই তুমি একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলে আমাদের পথে চলার সাময়িক বিরতি ঘটিয়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলে তুমি আমাকে। আমি মুখ তুলে তাকালাম তোমার চোখের দিকে, বুঝি…বা কোনো কিছুর প্রত্যাশার জন্য। তোমার চঞ্চল চোখ দুটি কি যেন বলার মধ্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল তখন। খানিক পরেই তোমার মুখখানি নেমে আসে আমার কানের কাছে, ফিসফিসিয়ে তুমি আমাকে শুধোলে, আমি, আমি তোমাকে ভালবাসি ভেরা

এরই জন্য কি আমি অপেক্ষা করছিলাম। তা না হলে তোমার সেই আবেগভরা কথাটা কেনই বা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে? আবেগে চোখ বুজে এলো আমার। অস্ফুটে, বলেই ফেললাম, জানি, জানি গো সজনী, তোমার এই স্বপ্নের কথাটা শুনে আজ আমার রজনী যাবে ভাল।

কিন্তু ভেরা।

বেশ তো একটা আবেগ এনে দিয়েছিলে তুমি আমায়। তোমার মুখ থেকে আমার বাণী শুনে ভেবেছিলাম সজনী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখবো আজ রজনীতে। লক্ষ্মীটি সেই স্বপ্নটা তুমি আমার ভেঙ্গে দিও না

আমার যে আরো কিছু বলার ছিল ভেরা, তুমি তখন বলে যাচ্ছিলে, হয়তো তোমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে ভেরা, তোমাকে আর কোনদিনও বিয়ে করতে পারবো না। আমি এক কপর্দকশূন্য পুরুষ। মরিস মারা যাওয়ার পর তোমার মতো আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি–বিত্তবান হওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল আমার। এখন আর সেই সম্ভাবনাটা নেই। তার মৃত্যুর তিন মাস পরে জন্ম নিলো সিরিল। সিরিল ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হতো।

তোমার দুঃখটা আমি বুঝি, একটুও বাড়িয়ে বলোনি তুমি। সিরিল নামে এই শিশু ভাইপোটি তোমার সব স্বপ্ন, সব সম্ভাবনা ভেঙ্গে রেণু রেণু করে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে।

জন্মের মুহূর্ত থেকেই সিরিল রুগ্ন। তার শরীরে কোনো বাড়-বাড়ন্ত ছিলো না। হাত-পায়ের জোরও ছিলো না, অনেকটা জবুথবুর মতো। মরতে কেন যে জন্ম নিলো সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।

আমি সাঁতার কাটবো, তুমি আমাকে জলে নিয়ে চলল।

তুমি সাঁতার কাটবে এই রুগ্ন শরীরে, পঙ্গু হাত-পা নিয়ে? আর স্রোতের কি টান দেখবো?

আমি তোমার কোনো অজুহাত শুনবো না। তুমি আমাকে জলে নিয়ে চলো

বেচারা জানতো না যে, সেই জলের মধ্যেই ছিলো তার মৃত্যুর হাতছানি।

ঘুম আসছে না দেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো ভেরা। ফায়ারপ্লেসের তাকের ওপর রাখা শিশি থেকে তিনটে ঘুমের বড়ি বার করে ভেরা তার মুখে চালান করে দিলো। এবার নিশ্চয় ঘুম নেমে আসছে তার চোখে ভাবলো ভেরা। আর চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ার জন্য আট-দশটা ঘুমের বড়িই যথেষ্ট, আত্মহত্যা করার জন্য পটাসিয়াম সায়ানাইডের প্রয়োজন হবে না তার। মার্স্টানের মতো বোকা নয় সে। আজকের দিনে বিষ খেয়ে কেউ আত্মহত্যা করে না কি।

হঠাৎ দেওয়ালে টাঙ্গানো সেই কবিতাটির দিকে চোখ পড়ে গেলো ভেরার

 দশটি কালোমানিক, দশটি কালো হীরে।

এক ঢোকে জল খেতে গিয়ে একজনের দম এল না আর ফিরে।

 শিউরে উঠলো ভেরা, আতঙ্কের বিরাট শরীরটা। মুহূর্তে কুঁকড়ে যেন এতটুকু হয়ে গেলো। আচ্ছা মার্স্টানও তাতে। দম আটকেই মারা গেছে তাই না? আশ্চর্য। কবিতাটির

কিন্তু আত্মহত্যাই বা করতে গেলে সে কোন দুঃখে? না, না, এত কষ্ট পেলেও আমি কখনোই আত্মহত্যা করতে পারবো না। আমার এ-জীবনের অনেক দাম। আর সবাই মরুকগে, আমি কিন্তু বাঁচতে চাই, আমি ঠিক বেঁচে থাকবো, বাঁচার জন্যই তো এই জীবন,

.

০৬.

 ডঃ আর্মস্ট্রংকে ঘুমের জন্য খুব একটা আরাধনা করতে হলো না। একটু পরেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তিনি।

একটা বিরাট অপারেশন থিয়েটার…হাত দুখানা অবশ হয়ে আসছে, যে কোনো মুহূর্তে ছুরিটা খসে পড়তে পারে হাতের মুঠো থেকে। তীব্র আলোয় চিকমিক করে উঠলো ইস্পাতের ফলাটা। রোগীর অপারেশনের কথা ভুলে গিয়ে তিনি এখন ভাবছেন, এমন একটা ধারালো ছুরি হাতে পেলে কাউকে খুন করতে একটুও অসুবিধে হবে না।

খুন। হ্যাঁ খুন তাতে। আমি আগেই করে ফেলেছি। ঐ তো মেয়েটির স্পন্দনহীন দেহখানি পড়ে রয়েছে অপারেশন টেবিলের ওপর। সঙ্গে কাপড়ে ঢাকা রয়েছে তার মুখ। কিন্তু কাকেই বা আমি খুন করেছি? কে, কে ঐ মেয়েটি, লর্সকে একবার জিজ্ঞেস করবো? কিন্তু কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। তবে কি ও কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে…মেয়েটিকে আমি খুন করেছি?

আর মুখটাই বা ঢাকলো কে? খোলা থাকলে চিনতে পারতাম, আমি কার ঘাতক। কি যে সব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেললাম।

আমার মনের ভাবনাটা বুঝি টের পেয়ে থাকবে ছোকরা ডাক্তারটি। ধীরে ধীরে মৃত মেয়েটির মুখের ওপর থেকে কেমন সরিয়ে দিচ্ছে চাদরটা, সম্পূর্ণ করে সরিয়ে দিতেই চমকে উঠলাম, একি। আরে এ যে দেখছি আমাদের এমিলি ব্রেন্ট? উঃ কি বীভৎস চেহারা হয়েছে ওঁর মুখের। দুচোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে গনগনে আগুন। কিন্তু উনি তো এখনো মরেননি, হা হা ঐ তো ঠোঁট নাড়ছেন, উনি কি যেন বলতে চাইছেন-আমরা এসে দাঁড়িয়েছি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, নাহি ভয়, নাহি ভয়–অভয় বাণী শুনিয়ে আবার হাসছেন উনি, এক চিলতে। ভয়ঙ্কর বিদ্রূপ মাখানো সেই হাসি। অসহ্য। নমি, ইথারের শিশিটা আমার হাতে তুলে দাও, ওঁকে ঘুম পাড়াতে হবে। জাগ্রত অবস্থায় কেউ কাউকে খতম করতে পারে নাকি।

ইথারের শিশির ছিপি খুলে এমিলির ফাঁক হয়ে যাওয়া মুখের ভেতরে ঢালতে গিয়ে আর এক দফা চমক লাগলো। আজ যেন একটার পর একটা অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। একটু আগের দেখা এমিলি এখন হয়ে গেলো মার্স্টান। তোমরা কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা শুরু করে দিলে শেষ পর্যন্ত?

বড় জোরে জোরে হাত-পা খিচছে সে। এমন করলে খুন করবো কি করে। ওকে সবাই মিলে শক্ত করে ধরে থাকো। যতক্ষণ না আমি ছুরি চালাই, না ঠিক হচ্ছে না, হ্যাঁ, এই ভাবে নমি তুমি ওর হাত দুটো ধরো, আর ডাক্তার তুমি ধরো পা দুটো। ধ্যাৎ, তোমাদের দ্বারা কিস্সু হবে না। আমাকেই সামলাতে হবে দেখছি। যেই না ওর হাত-পা একটু কায়দা করে ধরতে যাবো, একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে ছিটকে পড়লাম। প্রচণ্ড ঝাঁকুনির দরুণ ঘুম ভেঙে গেলো ডঃ আর্মস্ট্রং-এর। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন আর্মস্ট্রং। স্বপ্নভঙ্গ হতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি বিছানার ওপর।

তখন ঘরের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছিলো ভোরের প্রথম আলো। তার এই আলোয় তিনি দেখতে পেলেন রগার্স দাঁড়িয়ে আছে তার শিয়রে। তার ফ্যাকাসে থমথমে, চোখের দৃষ্টি তার ঝাপসা, উৎকণ্ঠায় আবিষ্ট, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল।

কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে বোধহয় কোথাও হিসেবে গরমিল হয়ে গেছে। সেটা পরের ভাবনা, পরে ভেবে দেখবো।

ব্যাপার কি বল-তোরগার্স। সাত সকালে তুমি এখানে কি মনে করে?

সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার, আমার স্ত্রীর ঘুম আর ভাঙ্গছে না। সকাল থেকে কতো ডাকাডাকি করলাম, কিন্তু সাড়া দেওয়ার নাম নেই।

সে কি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন আর্মস্ট্রং, ফিতে আটলেন ড্রেসিং গাউনের। তারপর রগার্সকে অনুসরণ করে দ্রুত পায়ে নেমে চললেন নিচে সিঁড়ি বেয়ে।

বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়েছিল মিসেস রগার্স? যন্ত্রণার লেশমাত্র ছিলো না তার মুখে। শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে সে যেন, সকলের রোদে উদ্ভাসিত তার সুন্দর মুখখানি।

তার বরফ ঠাণ্ডা হাতখানি তুলে নিয়ে নাড়ি টিপলেন ডঃ আর্মস্ট্রং, স্পন্দহীন দেহ। সন্দেহ মুক্ত হওয়ার জন্য চোখের পাতা টেনে দেখলেন। তারপর তাকালেন রগার্সের মুখ-পানে তার চোখে চিন্তার ছাপ পড়ে।

তবে কি স্যার আমার ইথেল–?

হ্যাঁ, রগার্স, শান্ত সংযত স্বরে বললেন আমস্ট্রং, তোমার, স্ত্রী আর বেঁচে নেই, মৃত সে।

মারা গেছে? যেন নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো রগার্স তাহলে কি ও হার্টফেল করে।

সব মৃত্যুই হার্টফেল করে হয়। আর তোমার স্ত্রীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর আগে। কিন্তু কেন যে বন্ধ হল, সেটাই আমার কাছে বড় বিস্ময়। একটু থেমে আমস্ট্রং আবার মুখ খুললেন, আচ্ছা রগার্স তোমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছিল ইদানিং?

কেন, খুব ভালই তো ছিলো। তবে মাঝে মধ্যে হাঁপানির টানটা একটু বাড়লে কষ্ট পেতো। অবশ্য তার জন্য ডাক্তার ওষুধ করতে হয়নি কোনোদিন।

ঘুমের ওষুধ-টষুধ খাওয়ার কি অভ্যাস ছিলো তোমার স্ত্রীর?

না স্যার, ঐ যে বললাম, ওষুধ-টষুধ এমনিতেই খুব কম খেতো সে, আর ঘুমের ওষুধ তো একেবারেই নয়।

রগার্সের কথায় ঠিক বিশ্বাস হলে না আর্মস্ট্রং-এর, ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র নেড়ে-চেড়ে দেখলেন, কিন্তু কোথাও ঘুমের ওষুধের একটা খালি শিশি পর্যন্ত পেলেন না।

নিচু গলায় বললে রগার্স, জানেন ডাক্তারবাবু গতকাল রাতে আপনার সেই ওষুধ খাওয়ার পর আর কিছুই খায়নি ও, এমন কি একফেঁটা জল পর্যন্ত নয়।

সকাল নটার সময় প্রাতঃরাশের ঘণ্টা পড়লো। তার আগেই সকলের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। জোড়ায় জোড়ায় গুল্প গুজবে মেতে উঠেছিল তারা। জেনারেল ম্যাকআর্থার এবং ওয়ারগ্রেভ প্রাসাদের উদ্যানে পায়চারি করতে করতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

ওদিকে ভেরা আর লম্বার্ড তখন প্রাসাদের পিছনের পাহাড়ের ওপর ওঠার চেষ্টা করছিল। একটা টিলার ওপর ওঠার মুখে ব্লোরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো তাদের।

লঞ্চের আশায় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন ব্লোর। তাদের সঙ্গে দেখা হতেই নিরাশ হয়ে বললেন তিনি লঞ্চের কোনো পাত্তা নেই। তারপর আকাশ পানে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, নির্মেঘ আকাশ, আজও যথেষ্ট পরিষ্কার।

সে আর কতক্ষণ, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো লম্বার্ড, বিকেলেই কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আকাশ, ঝড় উঠবে দেখবেন।

ব্লোর বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চুপ করে গেলেন প্রাসাদ থেকে ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনে।

কব্জি-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো লম্বার্ড নটা বাজে প্রাতঃরাশের ঘন্টা পড়লো। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, চলুন এবার, যাওয়া যাক প্রাসাদের দিকে।

পাহাড় বেঁকে নামতে গিয়ে ব্লোর মুখ খুললেন, মাস্টার্ন কেন যে আত্মহত্যা করতে গেলো, আমার মাথায় আসছে না। সারাটা রাত ধরে চিন্তা করার পরেও কেন জানি না আমি এর কোনো সমাধান খুঁজে পেলাম না।

ভেরা একা একা এগিয়ে গিয়েছিল। লম্বার্ড এবং ব্লোর হাঁটছিল পাশাপাশি। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো লম্বার্ড, আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে দেখেছেন?

অন্য কিছু মানে কি হতে পারে, এ নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি বৈকি। যেমন-তেমন ছেলে নয়–এই মাস্টার্ন। ওর চলা-ফেরা-কথা-বার্তা শুনে আমার ধারণা, যথেষ্ট সম্মানিত ও পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে তো বটেই, পড়াশোনাও করেছে প্রচুর ও। এ হেন ছেলে আত্মহত্যা করতে যাবে কোন যুক্তিতে বলুন?

বসবার ঘর থেকে ত্রস্তপায়ে বেরিয়ে এসে ভেরার কাছে জানতে চাইলেন এমিলি, লঞ্চের কোনো হদিশ পেলেন?

না কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না। ভেঙ্গে পড়লেন এমিলি হতাশ ব্যঞ্জক উত্তর শুনে। বিমর্ষ মুখে তাদের সঙ্গে ঢুকলেন ডাইনিংরুমে।

অঢেল খাবারের আয়োজন। ম্লান-বিষণ্ণ মুখে তাদের খাওয়ার তদারকি করতে থাকে রগার্স। এই কয়েক ঘণ্টায় তার চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে, মুখ ফ্যাকাশে সাদা হয়ে কাছে স্ত্রী বিয়োগে। সেটা লক্ষ্য করে হঠাৎ এমিলি জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনারা লক্ষ্য করেছেন, আজ রগার্সকে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে, ওর শরীর ভাল আছে তো?

হ্যাঁ, শরীর তো ভাল তবে

তবে কি?

 প্রাতরাশ শেষ হওয়ার পর সব বলবো। এ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে পরামর্শ করাও দরকার?

 সকলের প্রাতঃরাশ শেষ হলে এক এক করে সকলের আগ্রহান্বিত মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন আর্মস্ট্রং। মনে মনে বিড়বিড় করেই বললেন, এটা একটা দুঃসংবাদই বটে। খাবারের তৃপ্তিটুকু উপভোগ করতে গিয়ে যাতে আপনারা বাধার সম্মুখীন না হন, তাই আগে বলিনি। জানেন, রূপালির স্ত্রী মারা গেছে।

সেই মুহূর্তে ঘরে যেন বাজ পড়লো। স্তব্ধ হতবাক হয়ে গেল সকলে। সকলের স্থির দৃষ্টি তখন আমস্ট্রং-এর ওপর। কারোর মুখে কথা নেই। হঠাৎ সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে। তারই মাঝে অকস্মাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো ভেরা এ আপনি কি বলছেন ডক্টর? আশ্চর্য। এখানে আসার পর চব্বিশ ঘণ্টাও কাটলো না, এরই মধ্যে দু-দুটো মৃত্যু?

আর্মস্ট্রং-এর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ, এ যে দেখছি ভয়ঙ্কর বিস্ময়। তা মৃত্যুর কারণটা নির্ণয় করতে পেরেছেন ডাক্তার?

এখুনি ঠিক বলা মুশকিল

অর্থাৎ পোস্টমর্টেম না হওয়া পর্যন্ত বলা মুশকিল, এই তো?

হ্যাঁ, ঠিক তাই। এক্ষেত্রে ভাল করে না জেনে-শুনে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারছি না।

আমার মনে হয় তাদের কথার মাঝে বাধা দিয়ে এবার ভেরা বললো, হয়তো মিসেস রগার্সের নার্ভ দুর্বল ছিলো। তার ওপর গতকালের অমন আকস্মিক ঘটনায় হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর তাতেই তার মৃত্যু ঘটে থাকবে।

তা না হয় মানলাম, কিন্তু– ভেরার যুক্তিটা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না আর্মস্ট্রং। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে মানুষ পাগল হয়ে যায়, কিন্তু কখনোই সে মরে না।

বিবেক, বিবেকদের দংশনেও তো মৃত্যু হতে পারে না? এবার এমিলি তার ধারণার কথা প্রকাশ করলো।

এখানে বিবেকের প্রশ্ন আসে কি করে? এবারেও এমিলির যুক্তি ঠিক মেনে নিতে। পারলেন না ডঃ আর্মস্ট্রং।

কেন গতকাল রাতে গ্রামোফোন রেকর্ডে সেই সব অভিযোগের কথাগুলো এরই মধ্যে আপনি ভুলে গেলেন? এমিলি আরো বলে সেই যে, স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে তাদের পুরনো মনিবকে হত্যা করার অভিযোগ প্রতিধ্বনিত হলো রেকর্ডে। হয়তো এটা তারই প্রতিক্রিয়া–হয়তো সেই অভিযোগটা একেবারেই মিথ্যে নয়, সত্যি সত্যিই তারা হয়তো খুন করে থাকবে তাকে। সে খবর চাপা ছিলো, এতোদিন পরে তাদের সেই কু-কীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়াতে বিবেকের দংশনই মিসেস রগার্সকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে থাকবে হয়তো।

না, না এটা ঠিক নয়, জোরে জোরে মাথা নাড়লেন আর্মস্ট্রং। আপনার কল্পনার কথা বাস্তবে মিলিয়ে ফেলার অযথা চেষ্টা করবেন না মিস্ ব্লেন্ট। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিবেক-টিবেক বলে কিছু নেই। ধরা যাক, মিসেস রগার্সের হার্ট অত্যন্ত দুর্বল ছিলো।

আপনি যাই বলুন না কেন, এমিলি নিজের বক্তব্য জোরালো ভাবে সমর্থন করে বললেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, তিনিই পাপীকে তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করে তার কর্তব্য পালন করেছেন।

এমিলির কথায় ব্লোর যেন একটু আঘাত পেলেন, ছিঃ মিস্ ব্লেন্ট, আপনি কি যা তা বলছেন?

কেন, আমি কি এমন ভুল বলেছি। ব্লোর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন এমিলি পাপের ফল তো ভুগতেই হবে পাপীকে। ঈশ্বরের নিখুঁত বিচারে পাপীর যে রেহাই নেই, ও আমি একান্ত ভাবে বিশ্বাস করি।

রেহাই যে একেবারেই নেই জোর দিয়ে তা বলা যায় না। গালে হাত রেখে বললেন ব্লোর, কতো পাপীই না আমাদের সঙ্গে মিশে আছে, আমরা তাদের কজনকেই বা চিনি।

অতো সব বিশ্লেষণে আমাদের কাজ নেই, প্রসঙ্গটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন ব্লোর, এখন আমাদের জানতে হবে, কাল রাতে কি খেয়েছিলেন মিসেস রগার্স।

 কিসসু নয়, বললেন আর্মস্ট্রং।

অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি না।

তার স্বামী, রগার্স নিজে আমাকে বলেছেব্যঙ্গ করে বললেন আর্মস্ট্রং এর পরেও কি অবিশ্বাস করবেন?

কে কে বলেছেন বললেন–তার স্বামী রগার্স? একটা কেমন তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ পেলো ব্লোরের কথায়, সে তো বলবেই?

আর্মস্ট্রং এবং লম্বার্ড দুজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকালেন ব্লোরের দিকে।

আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন ব্লোর বড় বিচিত্র এই পৃথিবী, তার চেয়েও বিচিত্র বোধ হয় মানুষের মন, কার মনে কি আছে বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। এই কালকের সেই ঘটনার কথাই ধরুন না কেন–আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে ক্ষোভ প্রকাশ করলাম, পাগলের কাণ্ড বলে উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু যদি একটু তলিয়ে দেখা যায়, সেটা নিছক কারোর পাগলামি বলে আদৌ মনে হবে না। তাহলে এর থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি, রগার্স ও ওনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয়। এও হতে পারে সত্যিই তারা তাদের বৃদ্ধা মনিবকে খুন করেছিল। এতোদিন এই জঘন্য ঘটনার কথা চেপে গিয়েছিল তারা। কিন্তু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন ব্লোর, যাকে আমরা কাজ পাগল বলে কোনো আমল দিতে চাইছি না, যে যখন সেই সত্যটা প্রকাশ করে দিলো, তখন প্রথমেই ভয় পেয়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললোরগার্সের স্ত্রী। রগার্সও আতঙ্কিত হয়ে উঠলো মনে মনে। তার আশঙ্কা হলো, এবার বোধহয় আর রেহাই নেই, তার সেই দুষ্কৃতির কথা দুর্বল মুহূর্তে যদি তার স্ত্রী প্রকাশ করে দেয়, তখন তার আর বাঁচার পথ থাকবে না। অতএব

অতএব তার স্ত্রীর মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ করা, প্রয়োজন। কিন্তু কি ভাবে?

কেন উপায় তো খুব সহজ। স্ত্রীর কোন পানীয়র সঙ্গে কিছু একটা মিশিয়ে তার পক্ষে তাকে এমন ভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখলো, যা এ জীবনে ঘুম আর কখনো ভাঙ্গবে না।

বাঃ আপনি চমৎকার গল্প বানাতে পারেন তো মিঃ ব্লোর, আমস্ট্রং-এর মুখে শ্লেষের হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো, তবে আপনাকে বলে রাখি মৃতের ঘরে খালি চায়ের কাপ কিংবা জলের গ্লাস আমি দেখতে পাইনি।

চোখে না পড়ারই তো কথা। রগার্স কি এতই বোকা? সে তার কাজ হাসিল করার পরেই পাতটি ধুয়ে মুছে যেখানে রাখার ঠিক রেখে দিয়ে থাকবে।

তাদের আলোচনার মাঝে বাধা দিয়ে বললেন ম্যাকআর্থার, মিঃ ক্লোরের ধারণার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে কথা হচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার ভাবতে গিয়ে কেমন অবাক লাগে তাই না?

চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। নিজের জীবনের কাছে ও-রকম নিষ্ঠুর ব্যবহার-ট্যবহার করেই থাকে সবাই। তখন মানবতার প্রশ্ন-টশ্ন বলতে কিছু থাকে না। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন ব্লোর।

প্রাসাদের বাইরে পথের ওপর পায়চারি করছিলেন ব্লোর ও লম্বার্ড। এক সময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো লম্বার্ড, লঞ্চের কি ব্যাপার বলুন তো? এখনো এসে পৌঁছলো না

আর পৌঁছবে না রহস্যময় হাসি হাসলেন ব্লোর মানে এখানে আসতে দেওয়া হবে না। সেই বদ্ধ পাগলটার এটাও একটা পাগলামি বলে ধরে নিতে পারেন।

আমারও তাই ধারণা হঠাৎ অন্যের কণ্ঠস্বর শুনে পিছন ফিরে তাকালেন দুজন, ম্যাকআর্থার সখেদে আরো বললেন, লঞ্চ আসার সম্ভাবনা নেই। সেই সঙ্গে এই অভিশপ্ত দ্বীপ থেকে ফিরে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই আর। শেষ দিকে গলা ভারী হয়ে এলো, মুখের সামান্য হাসিটুকুও মুছে গেলো, চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত হলো। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ম্লান বিষঃ গলায় বললেন তিনি, এখানে অপার শান্তি, এই ভাল। জীবনের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছি আমরা, আমরা জেনেছি, কেউ আর ফিরবো না এখান থেকে, ফিরতে পারি না–

তারপর তিনি আর দাঁড়ালেন না, সেখানে বালিয়াড়ির পথে এগিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে। ঢল নেমেছে সমুদ্রের দিকে। একটু পরেই তার শরীরটা দৃষ্টির আড়ালে চলে

বিরক্তি প্রকাশ করলেন ব্লোর, ফিরবো না বললেই হলো। আলবাৎ ফিরবো আমরা। ফিরে যাওয়ার জন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। মাস্টার্ন মিসেস রগার্সের মতো চিরদিন এখানে চির ঘুমে ঘুমিয়ে থাকার জন্য তো আমরা আসিনি।

হ্যাঁ, বটেই তো। বটেই তো, লম্বার্ডের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। এক পলকে ব্লোরকে একবার দেখে নিয়ে লম্বাৰ্ড আবার বললো, অন্যদের কপালে যাই ঘটুক না কেন, আপনার পরমায়ু কমিয়ে আনবে, এমন দুঃসাহস কার আছে শুনি।

তার বিদ্রূপটা ধরে ফেলেছেন ব্লোর। তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলেন তিনি এ আমার ব্যক্তিগত সমস্যা মিঃ লম্বার্ড। অতএব ভাবনা আমাকেই ভাবতে দিন। অহেতুক আমার ব্যাপারে মাথা ঘামানোটা একেবারেই পছন্দ নয়, মনে থাকে যেন।

আহত স্বরে বললো লম্বার্ড, হ্যাঁ মনে থাকবে। কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

প্রাসাদের ভেতরে একা একা থাকতে গিয়ে আমস্ট্রং-এর যেন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তাই তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রথমেই চোখে পড়লো ব্লোর আর লম্বার্ড কি একটা ব্যাপারে, যেন জোর তর্ক চালাচ্ছে, এবং ওয়ারগ্রেভ একা একা পায়চারি করছেন অদূরে। আশেপাশে অন্য কারোর টিকিও দেখা গেলো না।

একটু সময় কি ভেবে ওয়ারগ্রেভের দিকে এগিয়ে গেলেন ডঃ আর্মস্ট্রং। ঠিক সেই সময় পথের মধ্যে ছুটে এসে দাঁড়ালোরগার্স। সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাসে মুখ, উদভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি।

খুব জরুরী দরকার। একবার প্রাসাদের ভেতরে আসবেন, এখুনি?

কেন আবার কি হলো রগার্স?

কাল থেকে একটার পর একটা অদ্ভুত সব ঘটনা কেমন ঘটে যাচ্ছে। এ সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে আমি বোধহয় সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবো।

কেন এখন আবার নতুন করে কি ঘটলো?

নতুন করে ঠিক নয়, কালকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলতে পারেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, সদ্য আমার স্ত্রী মারা গেছে বলে বোধহয় আমার মাথার গোলমাল হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ডাক্তারবাবু আমি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। তবে এর পরে নতুন করে অবাক হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটলে আমার মাথার গোলমাল হয়ে যাবে দেখবেন।

ভনিতা না করে কি হয়েছে চটজলদি বলেই ফেলো না।

হ্যাঁ, বলবো বলেই তো এসেছি, প্রাসাদে প্রবেশ করে সোজা রগার্সের শোওয়ার ঘরে চলে এলেন আর্মস্ট্রং তারপর বললো সে। কাঁচের শোকেসের ঐ পুতুলগুলো দেখতে পাচ্ছেন, চিনামাটির সুন্দর সুন্দর পুতুলগুলো ভাল করে তাকিয়ে দেখুন ভাল করে দেখতে পাচ্ছেন তো?

হুঁ মাথা নেড়ে সায় দিলেন আমস্ট্রং। আমরা এখানে যখন আসি তখন ওখানে দশ-দশটি সুন্দর সুন্দর পুতুল দেখেছিলাম।

হ্যাঁ, আমরাও দশটি পুতুল দেখেছিলাম বৈ কি।

 কিন্তু জানেন ডাক্তারবাবু, গতকাল আপনাদের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে শোয়ার আয়োজন করছিলাম হঠাৎ নজরে পড়লো দশটা পুতুলের মধ্যে একটা কম। অর্থাৎ নটা মাত্র পুতুল আছে। কাল ভেবেছিলাম, বোধহয় গুনতে আমি ভুল করে ফেলেছি। হয়তো আমার সেই ভুলটা ভেঙ্গে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি, তবে আজ আর সেই ভুলটার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছি না। কিন্তু না, আপনার আজ প্রাতঃরাশ সেরে চলে যাওয়ার পর ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি আর এক অদ্ভুত ঘটনা–এবার নটা পুতুল দেখতে পেলাম না, মাত্র আটটি। কি আশ্চর্য। আমার নিজের চোখকে অস্বীকার করবো কি করে? আপনিই বলুন নটার বদলে আটটা পুতুল দেখলে কে না অবাক হবে?

.

০৭.

প্রাতঃরাশের পর এমিলি ও ভেরা আবার সেই পাহাড়ের চূড়াটার ওপর গিয়ে উঠে বসলো। উদ্দেশ্য লঞ্চ আসছে কিনা দেখার জন্য।

আগের চেয়ে বাতাসের তীব্রতা বেড়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল ঢেউ-এর পর ঢেউ উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভেঙ্গে পড়ছে আবার নতুন করে গড়ে উঠছে, সমুদ্র তীরে এসে আছড়ে পড়ছে, ফেনলি জলরাশি ছড়িয়ে পড়ছে ধূসর বালিয়াড়ির ওপর।

দুজনেরই দৃষ্টি চলে যায় দূরে, বহু দূরে, সমুদ্রের গভীরে, কিন্তু কোথাও লঞ্চের চিহ্ন চোখে পড়ল না তাদের। ওপারে স্টিকল হ্যাঁভেনের গ্রামগুলো এপার থেকে সারি সারি পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছিল। আকাশটা যেন সেই পাহাড়গুলোর চূড়ায় মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে।

আশাহত হয়ে নিচু গলায় বললেন এমিলি, লঞ্চের ঐ চালকটার কি যেন নাম-হা মনে পড়ছে ফ্রেড, ফ্রেড নারাকটকে দেখে গতকাল মনে হয়েছিল, সমঝদার নোক, তার ওপর নির্ভর করা যায়, কিন্তু আজ দেখো, কি রকম অবিবেচকের মতো কাজ করলো বস, এখনো তার পাত্তাই নেই।

ভেরাও কম অবাক হয়নি। এবং আতঙ্কিত বটে। তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে, যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে, ভয়ে আশঙ্কায় ততই যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। কোনো রকমে একটা কৃত্রিম স্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে রাখার প্রয়াস রয়েছে তার হাবভাবে, চালচলনে, যাতে আর পাঁচজনের সামনে প্রকাশ না পায়।

শান্তনার বাণী শোনা গেলো তার মুখে ঘাবড়াচ্ছেন কেন লঞ্চ ঠিক আসবে একটু পরেই। আসা মাত্র দেরী না করে এক লাফে উঠে পড়বো লঞ্চে। এখান থেকে যতো তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া যায়, ততই ভালো।

সে আর বলতে। জায়গাটা যেমন অদ্ভুত, এখানকার সব কিছুই কেমন যেন বিচিত্র ধরনের এতটুকু সাদৃশ্য নেই পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে। এমিলি একটু থেমে বলতে শুরু করলো খুব ঠকিয়েছে সে আমাকে। ভাল করে দেখলে ঠিক ধরা যেত, চিঠিটা জাল ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ এখানে আসার আগে একবারও খেয়াল হয়নি, চিঠিটা ভুয়োও হতে পারে।

হ্যাঁ, আমিও একবার ভুলেও এ-দিকটার কথা চিন্তা করে দেখিনি।

আমরা সবাই কেমন বোকা বনে গেছি ঐ পাগলটার কাছে। আমাদের সবাইকে আকাট মুখ-সুখ ভেবেছে সে। তা না হলে আমরা সবাই এক সঙ্গে ভুল করবোই বা কেন?

আচ্ছা মিস ব্লেন্ট আপনি যা বললেন তা সত্যি? সত্যি সত্যিই কি রগার্সরা তাদের মনিবকে হত্যা করেছিল?

কি যেন ভাবলেন এমিলি কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর যেন স্বগোক্তি করলেন হ্যাঁ, সত্য বৈকি। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। তা তোমার কি মনে হয় ভেরা?

আমি এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি

এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া-নেওয়ারই বা কি আছে। যেভাবে রগার্সের বৌ জ্ঞান হারালো, রগাস যেভাবে কফির ট্রে হাত থেকে ফেলে দিলো, তাতেই তো ওদের মনের কথা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। আর পরে রগার্স যে সব কথাগুলো বলে গেলো, শুনে তোমার কি একবারও সন্দেহ হয়নি। কথাগুলো বানানো। ডাহা মিথ্যে বলেছে সে। যাইহোক, ওরা যে সত্যিই অপরাধী, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

হ্যাঁ, আপনার অনুমাণ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। রগার্সের বৌ-এর মুখের ভাব দেখে আমারও কেন জানি না মনে হয়েছিল, একটা অপরাধবোধ যেন তাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল। সব অপরাধীরাই বোধহয় এতো ভীতু হয়ে থাকে, তাদের অতীত অপরাধ বুঝি এভাবেই তাদের পঙ্গু করে তোলে।

এ ব্যাপারে সেই নীতিকথাটা মনে পড়ে যায়–এ জন্মের পাপের শাস্তি তোমাকে এ-জন্মেই মাথা পেতে গ্রহণ করতে হবে। রগার্সের জীবনে সেটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো।

বেশ তো তাই যদি হয়, ভেরা মন্তব্য করলো, তাহলে আর বাকী লোকদের কপালে কি রকম শাস্তি ঘটতে পারে?

তুমি কি বলতে চাইছো একটু স্পষ্ট করে বলবে?

নিশ্চয়ই! দ্বিধার জড়তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে ভেরা উত্তর দেয়, আমাদের নামেও তো অভিযোগ আনা হয়েছে। রগার্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি সত্যি বলে তুমি মনে করো, তাহলে আমার তোমার ও অন্যদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলিও তো কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে এমিলির দিকে তাকালো ভেরা তার প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করার জন্য।

উত্তর না দিয়ে কিছুটা সময় ভেরার দিকে তাকিয়ে রইলেন এমিলি, তারপর মাথা নাড়লেন হ্যাঁ আমি জানি, তুমি কি বলতে চাইছে, যেমন লম্বার্ডের কথাই ধরা যাক না কেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঐ শয়তানটা একজন আদিবাসীকে হত্যা করেছে। তবে লম্বার্ড নিজেই তার দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং তার ব্যাপারটা এখানেই ইতি টানা যেতে পারে। এখানে একটু থেমে হঠাৎ কি যেন মনে পড়েছে এমনি একটা ভাব দেখিয়ে এমিলি আবার বলতে শুরু করলেন। তবে এ কথাও ঠিক যে, সব অভিযোগই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কিছু অভিযোগ আছে, যা শোনা মাত্র বলে দেওয়া যায়, মিথ্যে, ভুয়ো কিংবা বানানো ছাড়া আর কিছু নয়। এই যেমন মিঃ ওয়ারগ্রেভের কথাটা ধরা যাক না কেন, তিনি একজন স্বনামধন্য বিচারপতি, তিনি যদি বিচারে কোনো অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করে থাকেন, তাতে তার অপরাধটা কোথায়? মিঃ ব্লোরের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। আর আমার ব্যাপারটা একটু থেমে কি যেন ভাবলেন তিনি, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, কাল আমি চুপ করেছিলাম। অতোগুলো পুরুষ মানুষের সামনে মেয়েলী ব্যাপারে মুখ খুলি কি করে, বিশ্বাস করো, আমি কোনো দোষ করিনি, আমি নির্দোষ। বেট্রিস টেলরসকে একরকম যেচেই চাকরীটা দিয়েছিলাম। ঘরোয়া কাজ। তবে তার কাজে কোনো খুঁত ছিলো না। কিন্তু

কিন্তু কি?

কদিন যেতে না যেতেই তার আসল রূপ প্রকাশ পেতে থাকলো। সে যে অতি হীন চরিত্রের মেয়ে, ব্যাভিচারিণী, সেটা তখনি বোঝা গেলো-বহু পুরুষের সঙ্গে তার অবাধ মেলামেশা। তার সেই অবৈধ প্রণয়, বহু পুরুষ-ভোগ্যার ফল ফলালো অচিরেই। এমন এক নীতি জ্ঞানহীন দুশ্চরিত্র মেয়েকে ক্ষমা করার কথা মনেই এলো না। তাই বিদায় করে দিলাম তাকে। বিতাড়িত বেট্রিস গেলো তখন তার বাবা-মায়ের কাছে। কিন্তু তারাও তাকে ক্ষমা করতে পারলো না, আশ্রয় মিললো না সেখানে তার। তারপর–

তারপর তার কি হাল হলো?

তারপর আর কি? এ সব মেয়েদের যা হয়ে থাকে তাই হলো শেষ পর্যন্ত। বিবেকের দংশন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো সে। একটা পাপ ঢাকতে গিয়ে আর একটা পাপ করে বসলো সে।

আত্মহত্যা? চমকে উঠলো ভেরা, তার মৃত্যুর খবর শুনে আপনি নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পেয়েছিলেন, মনে মনে নিশ্চয় আপনার অনুশোচনা হয়েছিল।

দুঃখ? তা কেন হবে? আর অকারণ নিজেকে অপরাধীই বা ভাবতে যাবে। কেন?

না, মানে–অমন কঠোর না হয়ে তাকে যদি ক্ষমা করতেন, তাহলে হয়তো সে আত্মহত্যার পথটা বেছে নিতো না।

জোরে জোরে মাথা নাড়লেন এমিলি, বেট্রিসের ব্যাপারে আমার করার কিছু ছিলো না। সে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। হ্যাঁ, আমি এখানে উপলক্ষ্য মাত্র। ঈশ্বরই বিচার করবেন তার পাপের।

তারপর আর একটা কথাও বললেন না এমিলি, তার দৃষ্টি তখন গিয়ে পড়লো সমুদ্রের দিকে, তখন তার মুখে আর কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। ঈশ্বরের ওপর পাপ পুণ্য বিচারের ভার সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে অটুট মনোভাব নিয়ে বসে রইলেন তিনি।

হঠাৎ তার সেই পরিবর্তন দেখে দারুণ ভয় পেলো ভেরা, চমকে উঠলো।

ওদিকে একটা চেয়ারের ওপর অর্ধশায়িত অবস্থায় আধবোজা চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ওয়ারগ্রেভ। অদূরে লম্বার্ড ও ফ্লোর নিঃশব্দে পায়চারি করছেন পাশাপাশি।

ওয়ারগ্রেভের সামনে এসে দাঁড়ালেন ডঃ আর্মস্ট্রং। তিনি তখন ভাবছিলেন আলোচনার প্রয়োজনের কথা, কিন্তু কার সঙ্গেই বা আলোচনা করবেন, সেটাই তো একটা চিন্তার বিষয়। ওয়ারগ্রেভ। বিচারক তিনি, সূক্ষ, ন্যায়-নীতি, অপরাধ-নিরপরাধ, এসব ব্যাপারে তার বিচারের নিরীখে বহু মামলার নিষ্পত্তি তিনি করেছেন, কিন্তু এ-ব্যাপারে তিনি যে কতটা কাজে লাগতে পারেন, সেটা বলা মুশকিল। বরং লম্বার্ডকেই বেছে নেওয়া যেতে পারে, যোগ্য লোক সে, বয়সে তরুণ, চটপটে, কথা-বার্তায় তুখোড় মেধাবী অতএব

কথাটা ভাবামাত্র ইশারায় তিনি তাকে কাছে ডেকে বললেন শুনুন, মিঃ লম্বার্ড আপনার সঙ্গে জরুরী আলোচনা ছিলো।

জরুরী আলোচনা। হেসে বললো লম্বার্ড, বেশ তো, ওদিকটায় চলুন, ফাঁকা। আছে–

অপেক্ষাকৃত একটু ফাঁকা। জায়গায় এসে একটু ইতস্তত করে বললেন আর্মস্ট্রং দেখলেন তো চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চোখের সামনে কি সব ঘটনা ঘটে গেলো, এ-ব্যাপারে আপনার কি ধারণা?

মিসেস রগার্সের এই আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়? ব্লোর যে, কাহিনী শোনালেন, বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় আপনার?

না? সব বাজে কথা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো লম্বার্ড, জোর করে একটার সঙ্গে আর একটা সূত্র মেলানো হয়েছে।

আপনি যথার্থই বলেছেন। আপনার যুক্তি আমি সমর্থন করি।

ধরে নেওয়া যাক, অমন একটা জঘন্য অপরাধ করা সত্ত্বেও এতোদিন ওরা বেশ নিশ্চিন্তেই ছিলো। কিন্তু আজই হঠাৎ ভেঙ্গে পড়লো কেন? তাছাড়া আরো একটা কথা আছে–তারা যে তাদের মনিবকে খুন করেছে তার কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। এক্ষেত্রে তাদের অপরাধীই বা ভাবি কি করে বলুন।

হ্যাঁ, সে কথাও ঠিক। তবে এ-ব্যাপারে আজ সকালেই রগার্সের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। রগার্সের বক্তব্য হলো, তার মালকিন মিস ব্রাডির হার্টের অসুখ ছিলো। আমি একজন চিকিৎসক আমি জানি, এই সব রোগের সাময়িক উপশমের জন্য এ্যামাইল নাইট্রাইট ওষুধ ব্যবহার করা হয়, রোগীর যখন শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তখন এই ওষুধের এ্যাম্পুল ভেঙ্গে নাকের কাছে মেলে ধরলে তার শ্বাস কষ্টের উপশম হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই, কিন্তু ভুলক্রমে কিংবা একটু অসাবধানতাবশতঃ যদি একফোঁটা সেই তরল পদার্থ তার পেটে চলে যায়, তাহলে আর নিস্তার নেই। রোগীর মৃত্যু হতে বাধ্য।

অবাক বিস্ময়ে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ডঃ আর্মস্ট্রং-এর বিশ্লেষণ শুনছিল লম্বার্ড। তার কথা শেষ হতেই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে উঠলো সে, দারুণ চমৎকার একটা পরিকল্পনা তো।

তাই তো বলছি মিঃ লম্বার্ড। একটা সিগারেট ধরিয়ে আর্মস্ট্রং তার কথার জের টেনে বললেন, কতই না সহজ, কোনো ঝামেলা নেই, থাকবে না কোনো প্রমাণ কিংবা চিহ্ন। এর জন্যে ব্যবহার করতে হবে না আর্সেনিক কিংবা সায়ানাইড। কোনো রকমে এক ফোঁটা এ্যামাইল নাইট্রাইট রোগীর পেটে পৌঁছে দিতে পারলেই হলো, ডাক্তারের বাবার ক্ষমতা নেই তার জীবন ফিরিয়ে দেওয়া।

আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাকস্থলীতে সেই ওষুধের চিহ্ন আবিষ্কৃত হলেও সন্দেহের কিছু থাকতে পারে না। অজুহাত হিসাবে বলা যেতে পারে, নাকে শোঁকাতে গিয়ে এক ফোঁটা তরল পদার্থ অসাবধানতাবশতঃ চলে গেছে, এতে দোষ কোথায় বলুন? সে তো আর ইচ্ছে করে

কিছুক্ষণ গভীর চিন্তার পর লম্বার্ড বললো, তাহলে এখন একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া গেলো।

কোন্ কোন্ ব্যাপারে?

এমন কতগুলো অপরাধ আছে, যা খালি চোখে ধরা যায় না। তবে একটু যদি তলিয়ে দেখা যায়। সত্য প্রকাশ পাবেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রথমে রগার্স দম্পতি এবং পরে স্বনামধন্য বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে এ-প্রসঙ্গে।

আচমকা ধাক্কা খাওয়ার মতো করে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন আমস্ট্রং তাহলে এবার বলেই ফেলি মিঃ লম্বার্ড, তখন ওয়ারগ্রেভ আমাদের যে গল্পটা বললেন, আপনি সেটা বিশ্বাস করেন?

ওঁর মতো ধড়িবাজ লোকের কথায় বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। এই ধরুন না কেন, এডওয়ার্ড সিটনকে এমন কায়দা করে তিনি সরিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশই থাকতে পারে না। নিজের সাফাই গেয়ে তিনি তো বলেই দিয়েছেন, বিচারকের আসনে বসে আমি আইনের দাসত্বগিরি করেছি মাত্র, এর মধ্যে অন্যায় কিছুই থাকতে পারে না। বাঃ বাঃ চমৎকার অজুহাত, শেষ দিকে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো লম্বার্ডের ঠোঁটে।

সিগারেট টান দিতে গিয়ে সেই মুহূর্তে আর্মস্ট্রং যেন সেই কোন্‌ সুদুর অতীতে তার হাসপাতালে চার দেওয়ালে ঘেরা অপারেশন টেবিলের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। স্বগোতোক্তি করলেন, খুন। হা এ ভাবেই নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে অবশ্যই খুন করা যায় বৈকি। একটা কেন হাজারটা। খুন–

কিন্তু ডঃ আর্মস্ট্রং। লম্বার্ডের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন আর্মস্ট্রং। এই নিগার দ্বীপে আমাদের সকলকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে কি থাকতে পারে মিঃ ওয়েনের?

সেটা তো আমার প্রশ্ন। আর্মস্ট্রং-এর মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে, রগার্সের স্ত্রীর মৃত্যুটা আরো যেন ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। একটা ছন্দ বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মধ্যে, কিছুতেই তার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি তার স্বামী তাকে খুন করলো? নাকি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করলো সে।

আত্মহত্যা? অসম্ভব! বিশেষ করে মার্স্টানের মৃত্যুর পর মিসেস রগার্সের মৃত্যুটাকে কিছুতেই আত্মহত্যা বলে ধরে নেওয়া যায় না। মাত্র বারো ঘন্টার মধ্যে দুদুটো আত্মহত্যা, ভাবা যায় না, একরোখা যুবক, জীবনে যে কাউকে ভয়ডর করলো না, সত্য-মিথ্যা জানা নেই, তার বিরুদ্ধে দুটো বাচ্চাকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে জেনে আত্মহত্যা করবে সে? না হিসেবে বড্ড বেশী গরমিল দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া এখানে সে সায়ানাইটই পেলে কোথা থেকে। এ ত আর চকোলেট বিস্কুট নয় যে, পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে।

হ্যাঁ, এ প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছে বৈকি! এর একটা উত্তরই আমি খুঁজে পেয়েছি, হতে পারে।

হতে পারে কেউ তার মদের গ্লাসে সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়ে থাকবে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে, অতি সন্তর্পণে, আর এভাবেই অতি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তাকে খুন করে থাকবে সে। হ্যাঁ, হা, অবশ্যই খুনই হন মার্স্টান, নিষ্ঠুর খুন।

যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আর্মস্ট্রং লম্বার্ডের যুক্তিগ্রাহ্য মতামত শুনে। তাই উৎসাহিত হয়ে তিনি এবার জানতে চাইলেন, আর মিসেস রগার্সের মৃত্যুটা?

বলবো, সব বলবো, সিগারেটে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিয়ে লম্বার্ড তার কথার জের টেনে বললো, মার্স্টানের মৃত্যু আর রগার্সের মৃত্যুর মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আমি খুঁজে পেয়েছি। আপাত দৃষ্টিতে এ-দুটো মৃত্যুই নিছক আত্মহত্যা বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। তবে এর পিছনে একটা রহস্য অবশ্যই লুকিয়ে আছে। আর সেই রহস্য।

.

০৮.

 এই রহস্যের প্রসঙ্গে একটা ঘনটার কথা আমার মনে পড়ে গেলো। খানিক আগে রগার্স আমাকে ডেকে নিয়ে যায় তার রান্নাঘরে। আপনার বোধ হয় জানা নেই সেই দশটি চীনামাটির পুতুল আর সেই বিত্তবানদের খেয়ালী কবিতার কথা? তারপর সেই দশটি পুতুলের কাহিনী সংক্ষেপে বললেন আর্মস্ট্রং।

সব শোনার পর লম্বার্ড তো থ। অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগলো লম্বার্ডের। কি আশ্চর্য! ছিলো দশটি কালো মানিক, এখন রইলো আট। এ যে দেখছি ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাকেও হার মানায়।

দশটি, কালো মানিক, দশটি কালো হীরে।

আর এক দফা চমকানোর পালা লম্বার্ডের। বড় অদ্ভুত ব্যাপার তত। কবিতাটির সঙ্গে ঘটনার কি অদ্ভুত মিল রয়েছে। মার্স্টানের মৃত্যু হলো দম বন্ধ হয়ে। আর রগার্সের বৌ সেই যে রাত্রে ঘুমলো, সে ঘুম আর ভাঙলো না তার।

তাহলে?

তাহলে আবার কি! এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আমরা এক বদ্ধ পাগলের শিকার হতে চলেছি। হয়তো আমাদের কারোর আর রেহাই নেই। এক এক করে আমাদের দশজনকেই সেই পাগলটার হাতে প্রাণ হারাতে হবে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কি অদ্ভুত তার দূরদর্শিতা।

কিন্তু সেই পাগলটাই বা কোথায়? আমাদের এখনে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে সে নিজেই তো গরহাজির। এই নির্জন দ্বীপে আমরা দশজন ছাড়া আর কেউ নেই, রগার্সও তাই বলেছে। তাহলে?

রগার্স আমাদের ভুল তথ্য পরিবেশন করেছে। কিংবা এও হতে পারে, ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে সে আমাদের ভুল পথে চালিত করতে চেয়েছে।

না মিথ্যে সে বলতে পারে না, তার হয়ে সাফাই গাইল আর্মস্ট্রং। দেখলে না, ভয়ে আতঙ্কে লোকটা একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছে। মিথ্যে বলার মতো মনের দৃঢ়তা এখন তার নেই।

গভীর ভাবে চিন্তা করলো লম্বার্ড। তারপর জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো যে লোকটার কি রকম আক্কেল দেখুন, বেলা গড়িয়ে যেতে চললো, অথচ লারে কোনো পাত্তা নেই। এটা তো তার একটা চালাকি। তার পরিকল্পনা মাফিক এক এক করে আমাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় কাউকে এই দ্বীপ থেকে পালাতে দেবে না সে।

তার কথা শুনে আর্মস্ট্রং যে একেবারে বোবা বনে গেলেন। লম্বার্ডের মুখের দিকে বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থেকে তার বক্তব্যটা উপলব্ধি করতে চাইলেন।

যাই হোক, সে নিজেকে যতো চতুরই ভাবুক না কেন, সে একটা মারাত্মক ভুল করে বসে আছে শুরুতেই। একটা ছোট দ্বীপে যে আমাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। আর দ্বীপটাও মোটামুটি ফাঁকা নির্জন। চলুন দ্বীপটা ঘুরে দেখে আসি। বাছাধন যেখানে থাকুন না কেন, এখানকার এই ছোট্ট জায়গায় তাকে ঠিক আমরা খুঁজে বার করতে পারবো। চলুন যাওয়া যাক–

কিন্তু অমন একজন বিপজ্জনক লোকের সঙ্গে

আরে মশাই যতোই সে বিপজ্জনক লোক হোক না কেন, এতো ভয় পেলে কি চলে? তাছাড়া সে তো রক্তে মাংসে গড়া একজন লোক তো বটে! তার মতো একজন বিপজ্জনক লোকের সঙ্গে কি ভাবে মারাত্মক হয়ে উঠতে হয়, সে কৌশল আমার জানা আছে। তবে আমি আপনি ও মিঃ ব্লোর, এই তিনজন ছাড়া অন্য কাউকে জানাবার দরকার নেই। পরে প্রয়োজন হলে অন্যদের জানালেই চলবে।

পুতুল দুটি উধাও হওয়ার কাহিনী শুনে ব্লোর তো আকাশ থেকে পড়লেন যেন। তেমনি অবাক হয়ে তিনি বললেন, আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, সায়ানাইড মার্স্টানের গ্লাসে মেশানো হল কি করে?

এ প্রশ্ন আমারো প্রত্যুত্তরে বললো লম্বার্ড, তবে এ ব্যাপারে আমার অনুমান এই রকম জানালার ওপর মদের গ্লাস নামিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হয় বাইরের থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে তার গ্লাসে সায়ানাইড ফেলে দিয়ে থাকবে। আর মারাত্মক বিশ মেশানো সেই মদ পান করেই তার মৃত্যু ঘটে থাকবে।

বিশ্বাস করতে পারছেন না ব্লোর। তাই বা কি করে সম্ভব। আমাদের এতগুলো লোকের দৃষ্টি এড়িয়ে

তখন আমরা কি ঠিক মতো নজর রাখতে পারছিলাম? লম্বার্ড যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলো, আমরা তো তখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিলাম যে, কোথায় কি ঘটেছে, তা দেখার অবসর কোথায় তখন আমাদের।

কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তার কথায় সায় দিলেন ডঃ আর্মস্ট্রং সেই অদৃশ্য মানুষের কঠোর আদেশ শুনে আমরা তখন কেউ আর স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না। সেই অবস্থায়

যাই হোক, গতশ্চ-শোচনা নাস্তি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন ব্লোর এখন আমাদের ভবিষ্যতে যা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে সেটা দমন করার জন্য আগে-ভাগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে কেউ আর সেই বদ্ধ পাগলটার শিকার না হতে পারে। আচ্ছা আপনাদের কারোর কাছে পিস্তল আছে?

হ্যাঁ আছে বৈকি। ট্রাউজারের হিপ পকেটের উঁচু হয়ে ফুলে থাকা অংশটার প্রতি ব্লোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো লম্বার্ড।

হাসলেন ব্লোর, ওটা কি আপনি সব সময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ান?

হুঁ, তবে খুব একটা ঝামেলায় না পড়লে বের করি না।

 ঝামেলা কি এখানে নেই? মৃদু হাসলেন ব্লোর আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। ওৎ পেতে কোথায় কোন্ পাথরের আড়ালে সে যে বসে আছে, আমরা কেউ জানি না। অথচ তার মাথার পোকাগুলো কিলবিল করে উঠলেই যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আমাদের কারোর উপর। কোনো পাগল যদি একবার ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে তাহলে আর রক্ষা নেই।

সব পাগলই ভয়ঙ্কর হয় না, দৃঢ়স্বরে বললেন আর্মস্ট্রং এমন কিছু কিছু পাগল আছে, যাদের দেখলে মনেই হয় না তারা পাগল বা উন্মাদ। তবু দেখা যাক, আসল পাগলকে ঠিক চিনে বের করা যায় কিনা।

তারা তিনজন তাদের অভিযান শুরু করলেন অতঃপর। ছোট্ট দ্বীপ হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পথ যায় ফুরিয়ে। তিনজনের দৃষ্টিই সতর্ক, ছোট খাটো পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু করে সমুদ্রের প্রান্ত সীমানা পর্যন্ত। কিন্তু তেমন সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না তাদের। গুহা কিংবা ঝোপঝাড় কিছুই নেই, যেখানে সেই উন্মাদটা লুকিয়ে থাকতে পারে। নিরাশ হয়ে অবশেষে তারা এসে নামলেন সমুদ্রের দক্ষিণ পূর্ব দিক বরাবর। মনে আছে, গতকাল লঞও এসে থেমেছিল এখানেই। জেটির সামনে এসে থামকে দাঁড়ালেন তারা তিনজন। জেনারেল ম্যাকআর্থারকে অদূরে নিশ্চল স্ট্যাচুর মতো বসে থাকতে দেখে। দূর মহা দিগন্তে চলে গেছে তার দৃষ্টি। দূর থেকে তাকে দেখে মনে হলো, যেন এক ধ্যানমগ্ন যোগী। বেগতিক সমস্ত দুঃখ শোক ভুলে গিয়ে তিনি যেন এখানে এসে বসেছেন পরম শান্তির অন্বেষণে।

সঙ্গী দুজনকে অপেক্ষা করতে বলে ব্লোর একা এগিয়ে গেলেন ম্যাকআর্থারের কাছে। তার পায়ের শব্দ হলে, কিন্তু তাতে এতটুকু বিচলিত হলেন না ম্যাকআর্থার। তেমনি নিশ্চল–হয়ে বসে রইলেন।

তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইচ্ছে করে কাশলেন ব্লোর, তাতেও তার কোনো ভাবান্তর না হওয়াতে তিনি এবার সরাসরি বলেই ফেললেন বাঃ খাসা একটা জায়গা বেছে নিয়েছেন তো আপনি।

তাতে কাজ হলো। ধীরে ধীরে ব্লোরের দিকে মুখ ফেরালেন ম্যাকআর্থার। সময় ক্রমেই কমে আসছে মিঃ ব্লোর। এ সময় আমি একটু একা থাকতে চাই, দয়া করে আপনি যদি

অপ্রস্তুত হলেন ব্লোর। কৈফিয়াত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, আপনাকে বিরক্ত করে বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় আমার নেই। বেড়াতে বেড়াতে এসে পড়েছি এখানে, তাই আর কি।

আপনাদের কারোরই বোঝার ক্ষমতা নেই? অনুযোগ করলেন ম্যাকআর্থার একা থাকতে আমার ভাল লাগে। নিঃসঙ্গতা আমার বড় প্রিয়।

এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। ফিরে চললেন ব্লোর তার সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। তারপর তারা তিনজন এগিয়ে চললেন সামনে পাহাড়ের দিকে। চলার পথে উষ্মা প্রকাশ করলেন ব্লোর, বিচিত্র স্বভাবের লোকটা, মানুষের সঙ্গে কি ভাবে কথা বলতে হয় তাও শেখেনি।

কেন কি আবার হলো? জিজ্ঞেস করলো লম্বার্ড।

দেখুন না লোকটা বলে কি, সময় নাকি খুব অল্প, আমাদের কারোর নাকি বোঝার ক্ষমতা নেই। তার ভাবখানা এই যে আমার উপস্থিতিতে বিরোক্তবোধ করছে সে, অতএব

দারুণ অসামাজিক লোক তো আনমনে বলে উঠলেন আর্মস্ট্রং সত্যিই ভদ্রতা জানে না লোকটা।

বুঝি সময় তাদেরও সংক্ষিপ্ত। লম্বা লম্বা পা ফেলে পাহাড়ের চূড়ার ওপর উঠে এলেন তারা।

দূরে, বহুদূরে সমুদ্রের ওধারে আবছায়ায় মতো সারি সারি পাহাড় ভেসে উঠলো। চোখের সামনে। আর সেই পাহাড়গুলোর আড়ালে রয়েছে বহু পরিচিত সেই গ্রাম, অতি প্রিয় গ্রাম স্টিকলহ্যাভেন। এলোমেলো বাতাস, জলের ঢেউগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে। অশান্ত সমুদ্র যে কোনো মুহূর্তে ঝড় উঠতে পারে লণ্ড ভণ্ড করে দিতে পারে নিগার আইল্যান্ড। যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা সেই লোকের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না।

ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো লম্বার্ডের। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেলো তো। দূরের ঐ গ্রামের মানুষগুলোর চোখে এখানকার কোনো সংকেত ধরা পড়বে না, কি বিশ্রী কাণ্ড বলুন তো।

রাত্রে মশাল নেড়ে সংকেত পাঠালে ওরা নিশ্চয় দেখতে পাবে, অন্য দুই সঙ্গীর সমর্থন পাওয়ার আশায় কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকালো ব্লোর কি বলেন?

তাতেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না, বোঝালো লম্বার্ড, মিঃ ওয়েন কি অতো বোকা ভেবেছেন? দেখুন গিয়ে আগে থেকেই গ্রামের লোকদের বুঝিয়ে রেখেছেন তিনি, আমরা মশাল জ্বেলে স্ফুর্তি করবো। ওরা যেন অন্য কিছু ভেবে সাড়া না দেয়।

এটা তো আপনার ধারণা মাত্র।

হতে পারে, তবে একেবারে অযৌক্তিক নয়। দেখুন গিয়ে গ্রামের লোকদের তিনি। শাসিয়ে রেখেছেন এক এক করে আমাদের সকলকে খতম না করা পর্যন্ত গ্রামের কেউ যদি দ্বীপের দিকে এগোয় তাহলে তার অবস্থাও ঠিক আমাদের মতো হবে।

হ্যাঁ সবই সম্ভব ঐ বদ্ধ পাগলটার পক্ষে। হতাশ ভাবে তাকিয়ে বললেন আর্মস্ট্রং এখন কোনো কিছুতেই অবিশ্বাস করার মতো মনের জোর যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি।

হঠাৎ লম্বার্ড প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠলো, একটা দড়ি পেলে কাজ হতো। দড়ি বেয়ে নীচে নেমে ওদিকটা দেখে আসতাম একবার। ওদিকটাই সেই বদ্ধ পাগলটার লুকোবার একমাত্র জায়গা বলে আমার মনে হয়। তা আপনারা কেউ একটা দড়ির সন্ধান দিতে পারেন।

মতলটা বেশ ভালই। ছটফট করে উঠলেন ব্লোর, কি আশ্চার্য কাছে তো দড়ি টড়ি কিছু নেই, দেখি প্রাসাদে পাওয়া যায় কিনা। একটু দাঁড়ান, আমি যাবো আর আসবো। বলেই তিনি ছুটলেন প্রাসাদ অভিমুখে।

এই ফাঁকে আকাশের দিকে তাকালো লম্বার্ড। আকালো মেঘের ঘন ঘটা। বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। একটু পরেই ঝড় উঠতে পারে।

এবার সে তার দৃষ্টি নামিয়ে এনে ফেললো আর্মস্ট্রং এর মুখের ওপরে। কি মনে করে বললো সে, কি ব্যাপার আপনার মুখে কথা নেই যে। আবার কি ভাবছেন?

ভাবছি, ম্যাকআর্থারের কথা ভাবছি। লম্বার্ডের দিকে পলক-পতনহীন চোখে তাকিয়ে বললেন ডঃ আর্মস্ট্রং মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি লোকটা উন্মাদ…বেলা যে যায় যায়…… রোদ্দুরের রঙ বদল হতে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলো ভেরা। মিস্ ব্লেন্টের সঙ্গ বড় একঘেয়ে লাগছে এখন। সকালে তার সেই মনের দৃঢ় ভাবের কথা মনে পড়তেই তার প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব গড়ে উঠলো। মুখের সেই কাঠিন্য, চোখের দৃষ্টিতে অকরুণ তীক্ষ্মতা এখন সবই বুজরুকি বলে মনে হচ্ছে। মুখে তিনি যতোই ঈশ্বরের নাম নিন না কেন। উনি নিজেই তো এক ঘোর পাপী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তো মিথ্যে নয়। একটি গর্ভবতী নারীর জীবন নষ্ট করে দেওয়ার অর্থ হলো দু-দুটো জীবনের ইতি টেনে দেওয়া, এটা কি তার কম অন্যায় নয়, কম পাপ নয়। এই যে উনি এখন নির্বকার চিত্তে চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে উল বুনছেন, দেখে মনে হয় যেন, তিনি একজন নিপাট ভালমানুষ। ভাল মানুষ না ছাই, ও সব ভে, স্রেফ ভেক্‌ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।

আর ঐ যে ওপাশে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এই অবেলায় বসে বসে ঝিমুচ্ছেন, ঐ বৃদ্ধ লোকটাও কি কম শয়তান, কম পাপী। কল্পনা করে নেয় ভেরা, এডওয়ার্ড সিটন যেন ওয়ারগ্রেভের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আসামীর কাঠগড়ায়, ন্যায় বিচারের আশায়। জ্বলজ্বলে চোখ, দীর্ঘ সুঠাম চেহারা। বেচারা! বিচারের রায় বেরুনোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে ঐ শয়তান বিচারপতির জন্যই অসময়ে তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে।

মিস্ ব্লেন্টের সঙ্গ এড়িয়ে একা একা হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে এসে পৌঁছালো সমুদ্রের ধারে। তার পায়ের শব্দ কানে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেরালেন ম্যাকআর্থার। শান্ত সংযত চাহনি। ভেরা বিস্মিত, তার সেখানে উপস্থিতির কথা জানতেন নাকি ম্যাকআর্থার?

ভেরার অনুমান আন্দাজ করে নিয়ে ম্যাকআর্থার বলে উঠলেন, এসো ভেরা আমি তোমাকেই প্রত্যাশা করছিলাম এতোক্ষণ।

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে প্রশ্ন চোখে তাকালো তার দিকে, এমন নির্জন সমুদ্র প্রান্তে একা একা বসে থাকতে ভাল লাগে বুঝি আপনার?

হ্যাঁ, লাগে বৈকি। এখানে এক প্রত্যাশায় বসে থাকার একটা আলাদা আমেজ আছে যা অন্য কোথাও পাবে না তুমি।

প্রত্যাশা? কার! কিসের?

শেষের সেই দিনটির প্রত্যাশা। যেদিন পড়বে মোর পায়ের চিহ্ন এ সমুদ্রতটে–সেই সেই দিনটির প্রত্যাশা। জানো ভেরা আমরা যেদিন জন্মাই, ঠিক সেই দিন থেকেই শেষের দিনটির প্রত্যাশায় আমরা সবাই বসে থাকি। তুমি, আমি সবাই, কি ঠিক বলি নি?

কি যা তা বকছেন? শেষে আপনার মাথা কি খারাপ?

না ভেরা আমার মাথা ঠিকই আছে। আমি তোমাকে একটা নিষ্ঠুর সত্য কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি মাত্র। তুমি যতোই আশাবাদী হও না কেন, জেনে রেখো–এই দ্বীপ থেকে কোনোদিনও আমাদের মুক্তি হবে না। আমার বিলীন হয়ে যাবো একদিন, যাবো ফিরে সেই শান্তির নীড়ে।

শান্তি, কিসের শান্তি? একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় কোনো রকমে কান্নাটাকে দমন করে বললো ভেরা, আপনার কোনো কথারই অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তাহলে শোন ভেরা, লেসলী, হ্যাঁ আমার স্ত্রী লেসলীকে আমি সত্যি সত্যি খুবই ভালবাসতাম। ওকে আমার জীবন সঙ্গিনী হিসাবের পেয়ে আমার আনন্দের সীমা ছিলো না। ওকে আমার প্রাণের থেকেও বেশী ভাল লাগতো বলেই বোধহয় অতো বড় একটা ভুল করে বসলাম।

ভুল, কি রকম ভুল?

সব বলবো তোমাকে শুধু তোমাকেই আমার মনের কথা সব খুলে বলতে পারি। মৃত্যু আমার শিয়রে। তাই আজ আর কোনো কিছুই গোপন করবো না, সব বলবো তোমাকে। জানো ভেরা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও রিচমণ্ডকে আমি ইচ্ছে করেই পাঠিয়েছিলাম যুদ্ধ ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, হা, মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়ার অর্থই হলো আমি নিজে খুন করেছি। ছুরির আঘাতে নয় পিস্তলের গুলিতে নয় স্রেফ হুকুম। তখন একবারটি আমার মনে হয়নি, এ অন্যায়, এ পাপ, এ পাপের শাস্তি আছে, আছে প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা কিন্তু আমার ভুল ভেঙে গেছে, আজ মনে হচ্ছে

কি মনে হচ্ছে?

মনে হচ্ছে যা করেছি, যা ভেবেছি সব মিথ্যে, তাসের ঘরের মতো ক্ষণস্থায়ী। আমার সব চালাকী ধরে ফেলে থাকবে লেসলী হয়তো। না বলে চলে গেলো যে আমার কাছ থেকে, জিজ্ঞেস করারও সুযোগ দিয়ে গেলো না সে। আমি এখন একা নিঃসঙ্গ, দিন আর কাটতে চায় না। কবে যে আসবে আমার সেই শেষের দিনটা

নীরবে সব শুনে গেলো ভেরা স্থির অবিচল থেকে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাকআর্থার নিজেই আবার বললেন, তোমার তো ভাল লাগার কথা ভেরা, তুমি কেন কথা বলছো না? দেখবে, শেষের কদিন কতো সুখের, কতো আনন্দের, যার সঙ্গে আগের আগের কোনো দিনের সঙ্গে তুলনা হয় না।

হঠাৎ রেগে উঠে দাঁড়ালো ভেরা। তার চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ে পড়লো, তীক্ষ্মস্বরে বললো, তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

ম্যাক আর্থারের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, অনেক কিছুই, তোমার সম্পর্কে আমার অজানা তো কিছু নেই ভেরা।

সব বাজে কথা। আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না আপনি। না, কিসসু নয়।

সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন ম্যাক আর্থার যেন পরম নিশ্চিন্তে, আর কিছু বলার নেই তাঁর চোখে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখা গেলো। এক সময় নীরবে চোখ বুজলেন তিনি, আর তখনি তার মনে হলো, ঐ তো কে যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে নিঃশব্দে চুপি চুপি। কে, কে ও? লেসলি?

চোখ না খুলেই একান্ত অন্তরঙ্গ সুরে ডাকলেন তিনি, লেসলি আমার প্রিয়তমা লেসলি তুমি এসেছো? আমি যে তোমারি অপেক্ষায় প্রহর গুণে চলেছি

দড়ি হাতে ফিরে এসে দেখলেন ব্লোর, লম্বার্ড নেই সেখানে, একা দাঁড়িয়ে আছেন আর্মস্ট্রং। মিঃ লম্বার্ডকে দেখছি না, তিনি কোথায়?

জানি না তো, ভ্রু কুঁচকে বললেন আর্মস্ট্রংদেখুন গিয়ে নতুন কোনো মতলব উতলব এসেছে আবার মাথায়। সেটা খতিয়ে দেখতে চলে গেলো বোধ হয়। এখানকার সব ব্যাপার আর সমস্ত লোকগুলোর রকম-সকম কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা কম নয়।

দুশ্চিন্তা কি শুধু আপনার একার, আমাদের সকলেরই।

আমি তো অস্বীকার করছি না। আসলে আমি চিন্তিত ম্যাক আর্থারের ব্যাপারে।

 কেন তাকে নিয়ে আপনার আবার দুশ্চিন্তা কিসের?

দুশ্চিন্তা কিসের জানতে চান? কি জানি কেন, আজ সকাল থেকে তাকে দেখে আমার মনে একটা সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

সন্দেহ?

 হ্যাঁ, সন্দেহ বৈকি। তাহলে কথাটা বলেই ফেলি। আমার ধারনা ম্যাকআর্থারই সেই উন্মাদ, যাকে আমরা সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছি।

আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক নই, ডাঃ আর্মস্ট্রং মাথা নেড়ে বললেন, তবু বলবো এতো তাড়াতাড়ি এমন একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে, এখনই আসা ঠিক হবে না।

তা অবশ্য ঠিক। আর আমিও তাকে ঠিক খুনী বলে ঠাওর করছি না। ঐ রকম ধরনের আর কি।

বিচিত্র কিছু নয়। হয়তো দেখা যাবে আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে থেকে কলকাটি নাড়ছে। এই সময় লম্বার্ডকে ফিরে আসতে দেখে আর্মস্ট্রং প্রসঙ্গ বদল করে বলে উঠলেন ঐ তো মিঃ লম্বার্ড এসে গেছেন।

একটা বড় পাথরের টুকরোর সঙ্গে দড়িটা শক্ত করে বেঁধে দড়িটা নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে সেটা দুহাতে ধরে নিচে ঝুলে পড়লো লম্বার্ড। এবং অচিরেই গিয়ে হাজির হলো নিচে।

তা দেখে ব্লোর আর থাকতে না পেরে মন্তব্য করলেন, লোকটা খুব একটা সুবিধের নয়। চালচলন যেন কেমন।

একটু বেপরোয়া গোছের। ভয় ডর নেই, এই তো?

ভয় তো আমার এখানেই। বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে এ পর্যন্ত কত খারাপ কাজই না করেছে। তার হিসেব কেউ আপনারা জানেন না বলে তো আমার মনে হয় না। ক্লোরের চোখে মুখে একটা ঘৃণার ভাব ফুটে উঠতে দেখা গেলো। একটু থেমে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ডঃ আর্মস্ট্রং, আপনি কি সঙ্গে পিস্তল, জাতীয় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন?

না তো, অবাক চোখে তাকালেন আর্মস্ট্রং তা পিস্তল আমি এখানে আনতে যাবো কিসের আশঙ্কায়?

তা তো নিশ্চয়ই। তা তো নিশ্চয়ই। আমিও তো তাই মনে করি। বললেন ব্লোর কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার দেখুন, মিঃ লম্বার্ড একটা পিস্তল ঠিক সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

হয়তো সেটা তার অভ্যাসও তো হতে পারে।

সেটা তার অভ্যাসের দোহাই দিচ্ছেন? বিশেষ কোনো গণ্ডগোলের জায়গায় পিস্তল কেন বন্দুক সঙ্গে নিয়ে আসুন না কেন আপনি, তাতে সন্দেহ করার কিছু থাকবে না। কিন্তু এখানে এই নির্জন দ্বীপে পিস্তলের কি প্রয়োজন হতে পারে, আমি তো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।

কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আর্মস্ট্রং এর, মুখে তার কোনো উত্তর যোগালো না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে নিচ থেকে উপরে উঠে এলো লম্বাৰ্ড দড়ি বেয়ে। তার মুখে হতাশার ছাপ। কোনো লাভই হলো না শুধু যাওয়া আসাই সার হলো। কেউ নেই নিচে। একান্তই যদি থেকে থাকে সে, তাহলে আমার ধারণা ঐ প্রাসাদের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।

প্রাসাদের ভেতরে চিরুনী-তল্লাসী চালানো হলো। কিন্তু লুকিয়ে থাকার মতো গোপন ফাঁক ফোকর চোখে পড়ল না। একতলায় তল্লাসী চালিয়ে তারা তিনজন দোতলায় উঠতে গিয়ে দেখলো, পানীয়ের ট্রে হাতে নিয়ে প্রাসাদের উদ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রগার্স। তাকে ঐ ভাবে দেখে মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো লম্বার্ড, লোকটা মানুষ নাকি জানোয়ার। বউটা সবে মারা গেলো অথচ তার কোনো দুঃখ বোধ নেই? কেমন সহজ ভঙ্গিমায় কাজ করে চলেছে একের পর এক।

পেটের তাগিদে মশাই, স্রেফ পেটের তাগিদে। কাজের বিনিময়ে টাকা পাচ্ছে সে, আমাদের দেখা শোনা করার জন্যই তাকে এখানে চাকরী দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। তাছাড়া স্ত্রী বিয়োগের শোকে অভিভূত হয়ে কাজে ঢিলে দিলে আপনরাই কি তাকে রেহাই দিতেন? বলে হাসলেন আর্মস্ট্রং।

দোতলায় ঘরগুলোতে উঁকি মেরেও কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না সেই বদ্ধ পাগলটার। এরপর তিনজন এসে দাঁড়ালেন সিঁড়ির মুখে।

তিনতলায় ওঠার একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ব্লোর বলে উঠলো, ঐ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে দেখা যাক ওটাই বাকি থাকে কেন।

থাক কোনো লাভ হবে না, বাধা দিয়ে বললেন আমস্ট্রং ওখানে রগার্সের ঘর। গিয়ে দেখা যাবে তার স্ত্রীর মৃতদেহ শায়িত রয়েছে সেখানে। যেখানে কোনো বদ্ধ পাগলও থাকতে পারে না।

অতঃপর তারা তিনজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলেন। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আর্মস্ট্রং এর একটা হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন ব্লোর, শুনতে পাচ্ছেন, ওদিকে কার পায়ের শব্দ?

তিনজনেই কান পেতে শুনলেন, মৃদু পদসঞ্জারে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে ওপরের ঘরে। তিনজনই স্তন্ধ, হতবাক। বিস্ময়ের ঘোরটা কোনো রকমে কাটিয়ে উঠে আর্মস্ট্রং প্রথমে মুখ খুললেন রগার্সের ঘরে কে যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে? চলুন দেখা যাক কে–কে হতে পারে সে।

নিঃশব্দে পা ফেলে তিনজন ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে দরজায় কান পাততেই শব্দটা যেন এবার আগের চেয়ে আরো একটু স্পষ্ট হলো। মনে হলো চোরের মতো কে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু।

অধৈর্য হয়ে দরজায় লাথি মারলো ব্লোর, দরজা খুলে যেতেই প্রায় এক সঙ্গে তিনজনে ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতরে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তাঁরা।

ঘরের মধ্যে তখন আর কেউ নয়, স্বয়ং রগার্স, আচমকা দরজায় ধাক্কা পড়তে দেখে সেও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পরবর্তী ঘটনাটা দেখার অপেক্ষায়। হাতে তার একরাশ পোষাক

সরাসরি রগার্সের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলেন ব্লোর। মাথা নিচু করে কোনো রকমে আমতা আমতা করে বললেন, নিচ থেকে শুনতে পেলাম ওপরে কে যেন অতি সন্তপর্ণে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই সন্দেহ নিরসন করতে ছুটে এলাম ওপরে।

ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা বলুন তো, অতি বিনয়ের সঙ্গে বললো রগার্স, দোষ তো আমারই স্যার, এখানে আমার আগে আপনাদের অনুমতি নিয়ে আসা উচিত ছিলো আমার। নিচে অতিথিদের ঘরগুলো তো ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। ভাবলাম মৃতদেহ আগলে পড়ে থেকে কি লাভ, তাই আমার জিনিষপত্র নিয়ে উঠে এলাম।

সে তো বেশ ভাল কথাই রগার্স। এবার মুখর হলেন আর্মস্ট্রং এখন থেকে আমরা তোমাকে আমাদের কাছে কাছেই পাবো।

তেমনি মাথা নিচু করে অভিবাদন জানালো রগার্স। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে।

সঙ্গী দুজনের দিকে ফিরলেন আর্মস্ট্রং এর পর আর কি জানার থাকতে পারে? ঘুরে ফিরে সবই তো দেখা হলো। চলুন এবার নিচে যাওয়া যাক।

ঘরের মধ্যে আর একটা ঘর। দরজার কাছে ছুটে গিয়ে শিকল ধরে টানাটানি করতে লাগলেন ব্লোর। দুচারবার টানাটানি করতেই শিকল খুলে গেলো। ঘরের ভেতরটা অন্ধকারে ডুবেছিল। আবছায়া অন্ধকারে তিনজন দেখলেন, সেখানে কারো অস্তিত্ব নেই, আছে শুধু ঘর ভর্তি কালি ঝুলি আর মাকড়সার জাল। তারা তিনজন কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে যখন বেরিয়ে এলেন, তখন চেনাই যায় না তাদের, কালি ঝুলি মেখে একাকার।

মাকড়সার জাল হাত দিয়ে সরাতে সরাতে বললো লম্বার্ড, দেখা গেলো এই দ্বীপে আমরা জীবিত আটজন অতিথি ছাড়া অন্য আর কারোর অস্তিত্ব নেই এখানে।

.

০৯.

ভুল, আমরা তাহলে শুরু থেকে ভুল করেই এসেছি। মন্তব্য করলেন ব্লোর। দুটো মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমরা বড় বেশী ভয় পেয়ে গেছি।

ভয় পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়, চিন্তিত ভাবে বললেন আর্মস্ট্রং, এ্যান্টনি মার্স্টানের মৃত্যু আমি কিছুতেই আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে পারছি না।

কেন, এটা তো একটা অঘটনও হতে পারে।

অঘটন? সরাসরি প্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকালো লম্বার্ড।

বলছিলাম কি, আর্মস্ট্রং এর দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললেন, ব্লোর এই ধরুন ডঃ আর্মস্ট্রং-এর ঘুমের ওষুধ দেওয়ার ব্যাপারটা

সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন লম্বার্ড আপনার একথা বলার অর্থ কি জানতে পারি?

ওষুধের নামটা আমরা জানতে পারি।

 ট্রায়োনস্ট। এ ওষুধে রোগীর শরীরে কোনো ক্ষতি করে না।

কিন্তু ভুল করে আপনি যদি ডোজটা একটু বেশী দিয়ে ফেলে থাকেন। হা, ভুলের কথা বলছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল করে থাকে। তাই যদি আপনিও

না, না, জোরে মাথা নেড়ে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বললেন আর্মস্ট্রং, ভুল আমি করি নি, ইচ্ছে করেও নয়।

আরে কি আরম্ভ করলেন আপনারা? ধমক দিয়ে উঠলো লম্বার্ড, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক শুরু করে দিলেন।

না, আমি তর্ক করতে চাই না, ব্লোর কৈফিয়েতের সুরে বলেন, ভুল সব মানুষেরই হয়ে থাকে।

সাধারণ মানুষের কথা আমি জানি না, সামান্য একটু হেসে বললেন আর্মস্ট্রং তবে ডাক্তারদের ভুল করার এক্তিয়ার আছে।

হ্যাঁ তা তো থাকবেই। বিদ্রূপ করে বললেন ব্লোর, সেই না দেখা অভিযোগকারীর কথা ঠিক বলে ধরে নিলে মনে হয়, এ রকম ভুল আপনি বোধ হয় আগেও করেছেন অনেকবার।

মুহূর্তে আর্মস্ট্রং এর মুখটা সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মনে হলো, কেউ বুঝি ব্লটিং পেপার দিয়ে তার মুখের রক্ত শুষে নিয়েছে। তাঁর সেই দুরবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসতে থাকেন ব্লোর।

সহ্য করতে পারেন না লম্বার্ড। ব্লোরের উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ম ঝাঁঝালো সুরে বললেন তিনি, আপনি মশাই আচ্ছা লোক তো। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে লজ্জা করে না আপনার? গলাবাজি করে ওঁর নামে যা তা বলে গেলেন, কিন্তু আপনিও কমতি কিসের শুনি?

আপনি চুপ করুন। ধমকে উঠলেন ব্লোর আগ বাড়িয়ে আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। আমিও আপনার অনেক দোষ ত্রুটির কথা জানি।

কি কি জানেন আমার ব্যাপারে আপনি? উত্তেজিত হয়ে বললেন লম্বার্ড।

রামো, রামো, আপনার হাব-ভাব দেখে ভেবেছিলাম, আপনি বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে আপনার মতো নির্বোধ আর কেউ নেই, এখানে, অন্তত এখন এই দ্বীপে।

আমাকে বোকা প্রতিপন্ন করে আপনার আসল উদ্দেশ্যর কথাটা কিন্তু চেপে রাখতে পারবেন না মিঃ লম্বার্ড। শেষের সুরে প্রশ্ন করলেন, ব্লোর বলুন কেন আপনি পিস্তল সঙ্গে এনেছেন? আপনার উদ্দেশ্যের কথা আপনি গোপন রেখেছেন এই তো?

হ্যাঁ ঠিক তাই। গোপন রাখার কারণ একটা অবশ্যই আছে।

 কারণটা কি বলবেন?

শুনবেন? তাহলে বলি শুনুন, মিঃ ওয়েনের আমন্ত্রণ, পেয়ে আমি এখানে আসি নি। আসলে আমি এসেছি একজন ইহুদীর নির্দেশে, নাম তার আইজ্যাক মরিস। তার অনুমান এখানে নাকি বিপদের সম্ভাবনা থাকতে পারে। তারই উপদেশ মতো সঙ্গে একটা পিস্তল আনতে বাধ্য হয়েছি আমি বুঝলেন?

ওসব কথা কাল বলেন নি কেন?

আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেলো তো। বিরক্ত হয়ে বললেন লম্বার্ড, আপনাদের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় আমিই কি জানতাম, একটার পর একটা অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাবে।

বেশ তো, বলার কথাটা এখনিই বা আপনার মনে হলো কেন?

 এখন বুঝে গেছি, আমাদের বাঁচার আর কোনো পথ নেই। মিঃ ওয়েনের পাঠানো একশো গিনির লোভে পড়ে এই সর্বনাশা জালে জড়িয়ে পড়েছি। এই জাল ছিঁড়ে পালাবার কোনো উপায় নেই দেখে শেষ পর্যন্ত সব খুলে বললাম। একটু থেমে কি ভেবে যে আবার বলতে শুরু করলো, মাস্টার্ন ও রগার্সের স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু দশটি পুতুলের মধ্যে দুটি উধাও হয়ে যাওয়া, এ সবের অর্থ আপনারা বুঝতে পারছেন কিনা জানি না, আমি কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমরা সবাই এক কঠিন জালে জড়িয়ে পড়েছি। আর যে লোকটা আমাদের ধরার জন্য কৌশলে এই জালটা বিছিয়ে রেখেছে, তার হাত থেকে রেহাই আমরা পেতে পারি না কখনো।

ওদিকে মধ্যাহ্ন ভোজের ঘন্টা পড়লো ঢং, ঢং ঢং…….

খাবার টেবিলে তিনজনে বসতেই নিচু গলায় বললো রগার্স খাবারের বিশেষ আয়োজন করতে পারিনি। বুঝতেই পারছেন, ঘরে যা ছিলো তাই দিয়েই আপনাদের আহারের ব্যবস্থা করেছি কোনো রকমে।

জিনিসে ভর্তি ভাড়ার, ভাববেন না, টিনের খাবারও আছে প্রচুর। তারপর স্বগোতোক্তি করলো রগার্স এখনো নারীকটের কোনো পাত্তাই নেই। কেন যে সে এলো না, সেই জানে আর জানেন ঈশ্বর।

এমিলি ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনে বসে বিড় বিড় করে আপন মনে বললেন, বাতাস ঝড়ের পূর্বাভাস, সমুদ্রের অশান্ত ঢেউগুলো যেন আক্রোশে ফুঁসছে।

তারপর ঘরে ঢুকলেন ওয়ারগ্রেভ। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে একটা চেয়ার দখল করে ঝাপসা চোখে উপস্থিত সকলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।

ব্যস্ত সমস্ত ভাবে ঘরে এসে ঢুকলো ভেরা। অনেক দেরী করে ফেললাম। আপনারা, নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন।

তার কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন এমিলি, আচ্ছা, জেনারেল ম্যাকআর্থার এখনো এলেন না কেন বলুন তো?

উনি তো এখন বসে আছেন অনেক দূরে, সেই সমুদ্র তীরে। ওখান থেকে খাবার ঘণ্টা তিনি হয়তো শুনতেই পান নি। তাছাড়া আজ সকাল থেকেই ওঁকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল, কথাবার্তায় অসংলগ্নতা–

তাহলে, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন রগার্স, আমি যাই ওঁকে ডেকে নিয়ে আসি। তাকে বাধা দেন আর্মস্ট্রং। না, আমই যাচ্ছি রগার্স, তুমি বরং এদিকটা সামলাও ততক্ষণে। এই বলে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

বাইরে তখন ঝড়ের তাণ্ডবলীলা চলছিল, বাতাসে তীক্ষ্মতা, সমুদ্রের ঢেউগুলো প্রচণ্ড ক্রোধে আছড়ে পড়ছিল বালির ওপর। খাবার টেবিলের সামনে পাঁচটি প্রাণীর অধীর প্রতীক্ষা, কারোর মুখে কথা নেই, সবার চোখে একটা বোবা চাহনি, তারই মাঝে অজস্র প্রশ্ন, কি কি হতে পারে ম্যাকআর্থারের? কেন তিনি এখনো আসছেন না।

ভেরাই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করলো, ঝড় আসছে…।

আশ্চর্য। ট্রেনের সেই অদ্ভুত লোকটাও তো এই কথা বলেছিল, মৃদু হেসে বললেন ব্লোর, ঝড় আসছে–বুঝতে পারি না আগে থেকেই লোকগুলো কি করে যে টের পেয়ে যায়।

খাবার ভর্তি ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো রগার্স, দরজার দিকে ফিরে তাকিয়ে চমকে ওঠার মতো করে বলে ওঠলো সে, ঐ তো, কে যেন দৌড়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

রগার্সের অনুমানই ঠিক, সবাই কান পেতে শুনলো বাইরে প্রাসাদের উদ্যানে দ্রুত পায়ের শব্দ, ঠিক যেন দৌড়ে কেউ

ব্যস্ত হয়ে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। সবার ভয় আর বিস্ময় ভরা চোখের দৃষ্টি পড়ে রইলো দরজা প্রান্তে।

ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আর্মস্ট্রং। অনেকটা পথ ছুটে আসার জন্য হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। উদভ্রান্ত দৃষ্টি তার চোখে, ভয়ে আড়ষ্ট তার মুখখানি।

কি হয়েছে ডাক্তার? পাঁচজনেই প্রায় একই সঙ্গে প্রশ্ন করে বসলেন।

 জেনারেল ম্যাকআর্থার–কথাটা শেষ করতে পারলেন না আর্মস্ট্রং ভয়ে আতঙ্কে ঠোঁট কাঁপছে তার।

তবে, তবে কি তিনি মারা গেলেন শেষ পর্যন্ত? আচমকাই যেন সেই কঠিন শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো ভেরার।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। মাথা নিচু করে চোখ বুজলেন আর্মস্ট্রং।

আর তখনি এক অখণ্ড নীরবতা থমথম করতে থাকলো ঘরটা। এ ওর দিকে তাকালো নীরবে কারোর মুখ থেকে একটি কথাও বেরুলো না।

ঝড়ে দ্বীপটা বুঝি উড়ে যাবে। তবু সেই ঝড় মাথায় করে ছুটতে হলো সমুদ্রের ধারে। কিছুক্ষণ পরেই ম্যাকআর্থারের মৃতদেহটি বয়ে নিয়ে এলেন ব্লোর আর আর্মস্ট্রং। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগলেন ওরা। হলঘরের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাকি পাঁচজন।

আর ঠিক তখনি প্রচণ্ড জোড়ে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামলো বৃষ্টি। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো তীব্র বাতাসের দাপটে তীরের মতো এসে বিধতে থাকলো জানলার শার্সিগুলোতে।

তারই মাঝে প্রায় সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে এক সময় খাবার ঘরে এসে ঢুকলো ভেরা, নিঃশব্দে। শূন্য ঘর চেয়ার গুলো সব ফাঁকা টেবিলের ওপর খাবারের প্লেটগুলো সাজানো অভুক্ত। জানালার শার্সিতে বৃষ্টির ফোঁটার চটপট শব্দ। আর সেই শব্দটাকে ছাপিয়ে হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে চকিতে দরজার দিকে ফিরে তাকালো ভেরা, তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো রগার্সের অবয়ব।

কৈফিয়ত দিতে গিয়ে ভয় বিজড়িত কণ্ঠে বললো ভেরা, আ-আমি রাখতে এসেছিলাম–

জানি, আপনি কি দেখতে এসেছিলেন, রগার্স যেন তার মুখের কথাটা এক রকম লুফে নিয়ে বললো হা ঐ তো রাখুন না, একটা পুতুল কেমন কমে গেছে। আটটার পরিবর্তে এখন, বলবো। মাথার পিছনে ভারী জাতীয় কোনো কিছুর আঘাতে মারা গেছেন ম্যাকআর্থার।

একটা চাপা গুঞ্জন উঠলো কোন কিছুর মধ্যে। ওয়ারগ্রেভের পরবর্তীয় প্রশ্ন সেই ভারী জাতীয় জিনিষটা খুঁজে পেয়েছেন?

না।

তাহলে আপনার প্রমাণ

 ধারণা তো নয়, আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত, কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

এবার একটু নড়ে চড়ে বসলেন ওয়ারগ্রেভ, যেমন করে বিচারক বসেন তার চেয়ারে। সারাটা সকাল কাটিয়েছেন অলস ভঙ্গিতে, এখন তার আলসেমি চলে না। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে হয়।

উপস্থিত সকলের মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলার পর এক সময় তাঁর দৃষ্টি স্থির হলো লম্বার্ডের মুখের ওপর, আপনারা হয়তো বুঝতে পারেন নি, আমি কিন্তু সকালে উদ্যানে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আপনাদের সকলের গতিবিধি লক্ষ্য করেছি। আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয়, তাহলে বলি, সেই অজ্ঞাত আততায়ীটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আপনি। বলুন আমি ঠিক বলেছি কি না?

মাথা নেড়ে সায় দেয় লম্বার্ড, হ্যাঁ আপনার অনুমান যথার্থ।

আর আপনাদের এও সন্দেহ যে, মার্স্টান কিংবা রগার্সের স্ত্রী কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না। সকলের অলক্ষ্যে মিঃ ওয়েনেই তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছে চিরদিনের মত।

হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি একমত, এবার উত্তর দিলেন ব্লোর, আর আমারে এও ধারণা মিঃ ওয়েন একজন বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

অবশ্যই সে, তাকে সমর্থন করলেন ওয়ারগ্রেভ তবে তার উন্মত্ততার বিশ্লেষণের প্রয়োজন এখন নেই। এখন সব থেকে জরুরী প্রয়োজন হলো সময় থাকতে থাকতে তার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা।

কিন্তু এই দ্বীপে আমরা ছাড়া আর তো কেউ নেই এখন। ভয়ে ভয়ে বললেন আর্মস্ট্রং, তাহলে আগের তিনজকে কি করে হত্যা করলো সে, আর আমরাই বা কি ভাবে তার হাতে খুন হতে পারি?

এ প্রশ্নের উত্তরও আমি মোটামুটি একটা ভেবে রেখেছি।

ম্লান হেসে বলতে থাকেন ওয়ারগ্রেভ, সকালবেলা এই যে আপনারা আততায়ীর সন্ধানে বেরোলেন যদি একবার ঘৃণাক্ষরেও আমাকে বলতেন তাহলে বোধহয় আপনাদের পরিশ্রম লাঘব হতে পারতো। তবে এ সবের পরেও আমি বলছি এই দ্বীপেই আছেন মিঃ ওয়েন। শুনলেন না, আমাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ সে খুঁজে বের করেছে, তার মতে আইনের মার প্যাঁচে আমরা নাকি কৌশলে শাস্তি এড়িয়ে গেছি। তাই বোধহয় সে নিজেই শাস্তির ভার তুলে নিয়েছেন। হ্যাঁ তার হাতে থেকে কেউই তাদের অপরাধের শাস্তি এড়াতে পারবে না আর শাস্তি দানের একটা অভিনব পন্থাও তিনি খুঁজে নিয়েছেন। আমাদের দলে মিশে গিয়ে এক এক করে সে তার কাজ হাসিল করে চলেছে। আর তাই আমরা তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি না।

না, না এ অবাস্তব ধারণা, কখনোই তা সম্ভবপর নয়। প্রতিবাদ করে উঠলো ভেরা।

অবাস্তব। অসম্ভব। এখন আমাদের সামনে এ সব কথার কোনো অস্তিত্ব নেই মিস ক্লেথন। ভেরার দিকে ফিরে বললেন ওয়ারগ্রেভ এখন সব কিছুই সম্ভব। আমাদের এই বিপদের সময় এ নিয়ে অযথা তর্কে যাওয়া উচিত নয়। আমি আবার বলছি, আমাদের দশজনের মধ্যেই একজন মিঃ ওয়েন অন্য পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই আততায়ী। অবশ্য আমরা এখন আর দশজন নই মোট সাতজনে ঠেকেছি। তাই মাস্টার্ন, মিসেস রগার্স ও জেনারেল ম্যাকআর্থারকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়? একটু সময় থেকে সকলের মুখের দিকে চকিতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি এবার জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে আপনারা একমত তো?

দ্বিধাবোধটা কাটিয়ে উঠতে যা একটু সময় লাগলো, হুঁ। তবে ভাবতে অবাক লাগে।

এর মধ্যে অবাক হওয়ার কি আছে ডঃ আর্মস্ট্রং দৃঢ়স্বরে বললেন ব্লোর, আমি তো একটা আন্দাজ

আপনার বক্তব্য পরে শুনবো মিঃ ব্লোর হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ, আগে এক এক করে সকলের অভিমত জেনে নিই, আমার বক্তব্যে তাদের সায় আছে কিনা, তারপর আপনারা

আপনার বক্তব্যে আমার পুরোপুরি সায় আছে, উলের ওপর থেকে চোখ তুলে বললেন এমিলি, আপনার বক্তব্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আর এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের মধ্যেই একজন খুনী বদ্ধ পাগল।

না আমি একমত হতে পারছি না, প্রতিবাদ করলো ভেরা আমার বিশ্বাস নেই।

আর মিঃ লম্বার্ড আপনার কি অভিমত? তার দিকে ফিরলেন ওয়ারগ্রেভ।

আপনার বক্তব্যে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে।

বাঃ আমি তো এই চাইছিলাম। তৃপ্ত হয়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ এবার প্রকৃত অপরাধীকে প্রমাণ স্বরুপ চিহ্নিত করার পালা। এখন আপনারা খুব চিন্তা ভাবনা করে বলুন তো আমাদের মধ্যে কোনো বিশেষ ব্যক্তির এমন কোনো দোষ ত্রুটি কিংবা তার সন্দেহজনক চাল-চলন দেখেছেন কি, যাতে করে অপরাধী বলে মনে হয়। হা মিঃ ব্লোর আপনি এখন আপনার কি একটা আন্দাজের কথা বলবেন বলেছিলেন না।

আন্দাজ বলতে পারেন, আবার নিছক একটা কৌতূহলও বলতে পারেন। আমি জানতে চাই, মিঃ লম্বার্ড সঙ্গে পিস্তল কেন এনেছেন?

কারণটা তো আমি আপনাকে আগেই বলেছি, বিশ্বাস হয় নি? ঠিক আছে আবার বলছি রুক্ষস্বরে, পিস্তল সঙ্গে আনার ঘটনাটা সংক্ষেপে বললো লম্বার্ড।

প্রমাণ দেখান, শুধু বানানো গল্প ফেঁদে বসলেই চলবে না, ভ্রু কুঁচকে কৈফিয়ত চাইলেন ব্লোর প্রমাণ চাই।

প্রমাণ চাইছেন? তাদের কথার মাঝে বাধা দিয়ে ওয়ারগ্রেভ বললেন, কেবল মিঃ লম্বার্ড একাই যে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হবেন তা নয়, অনেক ব্যাপারে আমরাও প্রমাণ দিতে অসমর্থ হতে পারি। অতএব আমাদের মুখের কথাটাই বিশ্বাস করে নিলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এখানে একটু থেমে ওয়ারগ্রেভ কি যেন ভেবে আবার বলতে শুরু করলেন, এক কাজ করা যাক, কারোর সন্দেহজনক কার্যকলাপের সন্ধান না করে বরং দেখা যাক, কাকে কাকে আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। সাতজনের মধ্যে দুজনকে বাদ দেওয়ার পর শেষ ব্যক্তি যিনি অবশিষ্ট থাকবেন, তিনিই হবেন অপরাধী তাকেই সেই অজ্ঞাত আততায়ী বলে আমরা ধরে নেবো।

এ ব্যাপারে প্রথমেই আমি একটা কথা বলতে চাই, নিজের সাফাই চাইলেন আর্মস্ট্রং। আমি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। তাই আপনারা নিশ্চয় আমাকে সন্দেহের তালিকা থেকে–

তাকে বাধা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ওয়ারগ্রেভ, দেখুন ডঃ আর্মস্ট্রং আপনি যদি ঐ দোহাই দেন, তাহলে আমিও বলবো, আমিও কিছু কম স্বনামধন্য নই। তবু তা সত্ত্বেও আপনার মতো আমাকে আপনাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ একবারও করবো না। চিকিৎসক বিচারপতি এমন কি পুলিশও পাগল হতে পারে। পাগলামি হচ্ছে একটা জঘন্য রোগ। এ রোগে কখন কে যে আক্রান্ত হতে পারে, আগে থেকে কেউ বলতে পারে না।

তাহলে শুরুতেই, একটা কাজ আমরা নিশ্চয়ই করতে পারি লম্বার্ড পরামর্শ দেয়, মহিলা দুজনকে আগে থেকেই আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে রাখতে পারি, কি বলেন আপনারা?

তার মানে আপনি বলছেন, মেয়েদের কখনো পাগলামি রোগ হয় না, কিংবা তারা খুন করতে পারে না?

না, জোর দিয়ে সেরকম কথা তো আমি বলিনি, একটু ইতস্ততঃ করে লম্বার্ড বলে তবে আপাত দৃষ্টিতে দেখে মনে হয়–

আর্মস্ট্রং-এর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওয়ারগ্রেভ জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই বলুন, ম্যাক আর্থারের মৃত্যু ঘটেছে মাথায় তীব্র আঘাতে, সে আঘাত কোনো মহিলার পক্ষে করা সম্ভব না অসম্ভব?

অসম্ভব নয়। মাথা দোলালেন আর্মস্ট্রং।

তাতে শক্তি প্রয়োগের দরকার হয় কি?

না, একেবারই নয়।

ধন্যবাদ, ওয়ারগ্রেভ আরো বলেন, আগের দুজনের মৃত্যু ঘটেছে বিষ বা ঘুমের পিল খেয়ে, এটা প্রয়োগ করতে একটুও শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয় না।

লম্বার্ডের মুখে আর কথা যোগালো না।

ওদিকে অল্প আক্রোশে চিৎকার করে উঠলো ভেরা, দেখছি আপনার মাথাটাই একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি, আপনিই উন্মাদ। অপ্রকৃতিস্থ।

ভেরার দিকে তাকালেন বরফ ঠাণ্ডা চোখে। কোন রাগ নয়, অভিনয় নয়, তার সেই অদ্ভুত চাহনির সামনে পড়লে অতি কঠিন প্রকৃতির লোকের শরীরও বুঝি অবশ হয়ে যেতে বাধ্য। এবং হোও তাই, চমকে উঠল ভেরা, উঃ লোকটা কি সাংঘাতিক। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে গিলে ফেলবে। শুরু থেকেই দেখছি, আমাকে ও একেবারে পছন্দ করে না।

নির্বিকার চিত্তে বললেন ওয়ারগ্রেভ, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না মিস্ ক্লেথন। আমি আপনার ওপর আদৌ দোষ চাপাতে চাইনি। কথা প্রসঙ্গে বলতে হলো বললাম তাই। তারপর এমিলির দিকে ফিরে তাকেও বোঝাতে চাইলেন তিনি মাফ করবেন মিস্ ব্লেন্ট, আপনার বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ আমি আনতে চাইনি। আসলে কি জানেন, সন্দেহের তালিকা থেকে আমরা যে কেউই বাদ নই, সেটাই আমি বোঝাতে চাইছি।

ওঁর কথায় বিন্দুমাত্র সূক্ষেপ করলেন না এমিলি, এমন কি চোখ তুলে তাকালেনও না পর্যন্ত, উলের কাঁটায় একটার পর একটা ঘর তুলতে থাকলেন তিনি। অনেকক্ষণ পরে আপন মনে ফিসফিসিয়ে বললেন, আপনার কথাটা অত্যন্ত খাঁটি সত্য। আমরা সকলেই সকলের কাছে একেবারে অপরিচিত, তাই এ ওর বিরুদ্ধে সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে নিজের সমর্থনে বলতে পারি, আমার ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। যে আমি একটা নগণ্য জীবও হত্যা করিনি, সেই আমি তিন তিনটি মানব জীবন নষ্ট করবো। এটা কি ভাবা যায়? হ্যাঁ আমি বারবার বলবো, আমাদেরই একজন মনুষ্যত্ব হারিয়ে শয়তান বনে গেছে। এখানকার সব অন্যায় ঘটনার মূলে সে।

উত্তম কথা, কোনো সমস্যাই আর রইলো না তাহলে। আমরা সবাই সন্দেহভাজন ব্যক্তির এক একজন।

কিন্তু রগার্স? প্রশ্ন করলো লম্বার্ড? তাকে আমরা

আমরা কি? জানতে চাইলেন ওয়ারগ্রেভ, চুপ করে রইলেন কেন, বলুন।

তাকে আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়, যায় না?

না যায় না, আর কোন্ যুক্তিতেই বা বাদ দেবো বলুন।

প্রথমতঃ আমাদের মতো অতো চালাক চতুর নয় সে। দ্বিতীয়তঃ এক্ষেত্রে তার স্ত্রীও শিকার হয়েছে।

ভ্রু কুঁচকে উঠলো ওয়ারগ্রেভের। আমার দীর্ঘ বিচারকের জীবনে এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা ঘটতে আমি দেখেছি! যেখানে স্ত্রী হত্যার দায়ে আপাত দৃষ্টিতে মুখ-সুখ সরল গোবেচারা স্বামীটি অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বিচারের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বামীর দোষ প্রমাণিত হতে দেখা গেছে।

আপনার অভিজ্ঞতার কথা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। আর হয়তো এও সত্য যে, সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের অভিযোগ মাফিক অতীতের অপরাধের ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে রগার্স তার স্ত্রীকে হত্যা করে থাকবে। কিন্তু তার স্বপক্ষে আমার একটা কথা বলার আছে রগার্স বদ্ধ উন্মাদ নয়। অতএব বাকী দুটি হত্যার জন্য কি করেই বা আমরা তাকে দায়ী করতে পারি বলুন?

মিঃ লম্বার্ড, আপনি তার স্বপক্ষে যে যুক্তি দেখালেন তার পাল্টা যুক্তি অনেক এসে যেতে পারে, তাতে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়বে। তাই ধরা যাক, রগার্স ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সেই অজ্ঞাত অভিযোগকারীর অভিযোগ মিথ্যা। তারা সত্যিই মিস এ্যান্ডিকে খুন করেনি। আর তাই যদি হয়, তাহলে অভিযোগ শুনে জ্ঞানই বা হারালো কেন মিসেস রগার্স? আগে থেকেই স্ত্রী অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণের ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছিলো সে। সেই অজ্ঞাত কণ্ঠস্বর শুনে জ্ঞান হারানোটা একটা নিছক কাকতালীয় ব্যাপার, অন্য কিছু নয়।

ঠিক আছে, অগত্যা স্বীকার করে নিলাম আমাদেরই কেউ একজন মিঃ ওয়েন। যুক্তি খুঁজে না পেয়ে অবশেষে মানতে বাধ্য হলেন লম্বার্ড, আর এও মেনে নিচ্ছি, আততায়ী পুরুষ, কিংবা মহিলাও হতে পারে।

অর্থাৎ আমাদের সকলের চোখে আমরা সকলেই অপরাধী। এখানে নারী-পুরুষ, সম্মান প্রতিপত্তির ধুয়ো তুলে কাউকেই আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি না। প্রকৃত ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সত্যকে উদঘাটন করার চেষ্টা করবো। প্রয়োজন বোধে আমরা এক বা একাধিক ব্যক্তিকে বাদ দিতে পারি। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে জানার চেষ্টা করবো, আমাদের মধ্যে কে, কে মার্স্টানের পানীয়ের মধ্যে সায়ানাইড প্রয়োগ করেন নি, রগার্সের স্ত্রীকে অধিক মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ান নি, কিংবা জেনারেল ম্যাকআর্থারের মাথায় পিছন থেকে আতর্কিত আঘাত করেন নি।

তাকে সমর্থন করলেন ব্লোর। হ্যাঁ, ঠিক এই ভাবেই আমরা প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বার করতে পারবো। তবে মার্স্টানের ব্যাপারটা নিয়ে আপাততঃ আলোচনার না করলেও চলবে। কারণ আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, জানালার বাইরে থেকে আমাদের মধ্যে কেউ একজন অলক্ষ্যে তার পানীয়ের মধ্যে সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়ে থাকবে। রগার্স সেই সময় ঘরে ছিলো কিনা ঠিক খেয়াল করতে পারছি না। তবে সে ছাড়া বাকী আটজনের মধ্যে যে কোনো একজন এ কাজ করতে পারে। কিছু সময় নীরব থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, এবার মিসেস রগার্সের কথায় আসা যাক। তাকে ওপরের ঘরে ধরাধরি করে নিয়ে যান ডঃ আর্মস্ট্রং, ও তার স্বামী রগার্স। এই দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন এক ফাঁকে তাকে অধিক মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিতে পারে।

কথাটা শোনা মাত্র চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন আর্মস্ট্রং, থরথর করে কাঁপছিল তার সারা শরীর। শূন্যে ঘুষি উঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি, এ অন্যায়, এ ষড়যন্ত্র। এ সব আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না। আমি আবার বলছি, রগার্সের স্ত্রীকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি পিলও বেশী খাওয়াইনি আমি।

আঃ থামবেন ডঃ আর্মস্ট্রং। বিরক্তিতে ফেটে পড়লেন ওয়ারগ্রেভ, জানি, নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে আপনার ভাল লাগবে না। কিন্তু তা বললে তো চলবে না। এখন তোত আপনাকে অনেক অপ্রিয় সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, এ কথা তো আপনার আগেই জানা উচিত ছিলো। এক্ষেত্রে কেবল আপনার ও রগার্সের পক্ষেই মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মিসেস রগার্সের ঘুম আর না ভাঙানো সহজ, যা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একেবারে যে অসম্ভব নয়, তাও আমি বলবো না, আরো বিশদ ভাবে আলোচনা করলে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হতে পারে। আপনারা দুজন ছাড়া অবশিষ্ট থাকেন মিঃ লম্বার্ড ইন্সপেক্টর ব্লোর, মিস্ ভেরা ক্লেথন, মিস্ এমিলি আর আমি। এখন দেখতে হবে মিসেস রগার্সের হত্যার ব্যাপারে এই পাঁচজনের সকলকেই কি আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব? না, আমার সিদ্ধান্ত হলো, তা কখনোই সম্ভব নয়।

তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো ভেরা, কিন্তু আমার কথা আলাদা কেননা সেই সময় মিসেস রগার্সের ধারে কাছে আমি ছিলাম না। এ কথা আপনাদের কোরই অজানা থাকার কথা নয়।

শান্ত ভাবে চোখ তুলে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ, আপনার কথা আমি অস্বীকার করছি না। ভুল আমারো হতে পারে, তবে ভুল শুধরে দেওয়ার ভার আপনাদের ওপর। সেই সময় আমরা ঠিক কে কোথায় ছিলাম বুঝিয়ে বলা যাক এখন–আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই অসুস্থ মিসেস রগার্সকে নিয়ে আমরা আটজন কেউ না কেউ একটা না একটা কাজে ব্যস্ত থাকলেও মিস্ ব্লেন্ট কিন্তু উঠলেন না তার চেয়ার থেকে, তার পরবর্তী গতিবিধির ওপরে নজর রাখার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমাদের কারোরই ছিলো না।

সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠলেন এমিলি যততো সব আজগুবি চিন্তা ভাবনা।

তাঁর কথায় ভ্রূক্ষেপ করলেন না ওয়ারগ্রেভ, তিনি তার কথার জোর টেনে বলে চললেন, মিস ব্লেন্ট, মনে আছে আপনি এখন সংজ্ঞাহীন মিসেস রগার্সের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছিলেন। কি, ঠিক বলছি তো?

কেন মনুষত্ব, প্রকাশ করাটা কি কোনো অপরাধ?

আমার প্রশ্ন তা নয়, উত্তরে বললেন ওয়ারগ্রেভ, যা যা ঘটেছিল সেই সময়, তারই একটা চিত্র আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি, দোষগুণের বিচার আপনাদের ওপর। হ্যাঁ যা বলছিলাম, তারপর রগার্স ঘরে ঢোকে ব্রান্ডির গ্লাস হাতে নিয়ে। এমনো তো হতে পারে ঘরে ঢোকার আগেই ব্রান্ডির গ্লাসে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এনেছিল সে। রোগিনীকে সেই ব্রান্ডি খাওয়ানো হলো। একটু পরে ডঃ আর্মস্ট্রং ও রগার্স ধরাধরি করে তাকে নিয়ে উঠলেন ওপরতলায়। রগার্সের ঘর থেকে চলে আসার আগে ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে এলেন।

হ্যাঁ, সেই সময়কার হুবহু ঘটনার সঠিক চিত্ৰই আপনি তুলে ধরেছেন, তার কথা সমর্থন করে মৃদু হেসে বললেন ব্লোর, তাহলে, দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে আপনি, আমি, মিঃ লম্বার্ড ও মিস্ ক্লেথনকে অনায়াসেই আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়।

দেওয়া যায় নাকি? প্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ওয়ারগ্রেভ।

কেন, এর মধ্যে আবার কিন্তু কি থাকতে পারে?

হ্যাঁ, থাকতে পারে বৈকি। নিজের কথা সমর্থন করে মৃদু হাসলেন ওয়ারগ্রেভ। সেই সময়কার দৃশ্যটার কথা একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করুন তো মিঃ ব্লোর। হ্যাঁ, আমিই আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মিসেস রগার্স শুয়ে আছেন বিছানায়। ভিতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ। ডঃ আর্মস্ট্রং এর দেওয়া ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়া তখন শুরু হয়ে গেছে। চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে সে তখন। আর ঠিক সেই সময় দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দ। টলতে টলতে কোনো রকমে দরজা খুলে দিলো সে। আগন্তুক ঘরে ঢুকলেন না, হাতটা ভেতরে সামান্য একটু বাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, এই ট্যাবলেটটা খেয়ে নিন ডঃ আর্মস্ট্রং পাঠিয়েছেন। মিসেস রগার্স ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে আগন্তুকের সামনেই সেটা গিলে ফেললেন। কি, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না তো?

ব্লোর মুখে কথা নেই।

তবে মুখ খুললো লম্বার্ড, হ্যাঁ, একটু বাড়ানো হলো বৈকি। সম্ভব অসম্ভব বলে তো একটা কথা আছে। রগার্স তখন ঘরে, দরজায় শব্দ হলো অথচ সে জানতে পারলো না?

জানবেই বা কি করে? কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন আর্মস্ট্রং, সে তো তখন নিচে ঘর দোর সাফ করতে ব্যস্ত, ছিলো। সেই ফাঁকে সে কেউ তার কাজ হাসিল করে অনায়াসে ফিরে আসতে পারে, কাক পক্ষীও টের পাবে না।

তাছাড়া তাদের কথার মাঝে মন্তব্য করলেন এমিলি, ডঃ আর্মস্ট্রং এর দেওয়া ওষুধে মিসেস রগার্সের অবস্থা তখন দারুণ কাহিল। সে অবস্থায় ভাল মন্দ বিচার করবে কি করে বলুন?

দেখুন মিস্ ব্লেন্ট, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন আর্মস্ট্রং, কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে অনেক কিছু জানতে হয়। আর আমাদের ডাক্তারী শাস্ত্রটাই বিচিত্র ধরনের। আপনার অভিযোগ ঠিক নয় এই কারণে যে, ঘুমের ওষুধ খেলেই রোগী যে কাহিল হয়ে পড়বে তা নয়। ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হতে যথেষ্ট সময় লাগে, চটজলদি বোঝা যায় না।

ডাক্তারী শাস্ত্র দেখাচ্ছেন? আড়চোখে একবার আর্মস্ট্রং-এর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো লম্বার্ড, তা আপনাদের শাস্ত্রে বুঝি এসব কথাও আজকাল লেখা থাকে?

ডঃ আর্মস্ট্রং যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন, কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। হাতের ইশারায় থামতে বললেন ওয়ারগ্রেভ,

অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোই সার হবে। কেবল, কাজের কাজ কখনোই হবে না। তবে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত যেটুকু জেনেছি, তাতে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। মিসেস রগার্স একজন মহিলা তার শয্যাপার্শ্বে স্বাভাবিক নিয়মে মিস্ ব্লেন্ট ও মিস্ ক্লেথনের থাকার কথা। ওঁরা না থেকে যদি আমি মিঃ ব্লোর কিংবা লম্বার্ড থাকতেন, তাহলে অবাক হওয়ার পরিবেশ গড়ে উঠতো তখনি। বলুন, ঠিক কিনা?

বিস্মিত ব্লোর অবাক চোখে তাকালেন, কি রকম? সে কি রকম।

গালে হাত রেগে চিন্তামগ্ন যোগীর মতো বললেন ওয়ারগ্রেভ তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমরা সকলেই সন্দেহের আওতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নই। এবার জেনারেল ম্যাকআর্থারের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করা যাক। ঘটনাটা আজই সকালের, টাটকা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এখন আপনারা কোনো কিছু গোপন না করে স্পষ্ট করে বলুন, আজ সকালে কার কি অ্যালিবাই ছিলো। প্রথমেই আমি নিজের কথা বলছি, আমার অ্যালিবাই তেমন জোরালো কিছু নয়। সারাটা সকাল আমি প্রাসাদের উদ্যানে বসে কাটিয়েছি, আপনারা যারা প্রাসাদে ছিলেন, তারা নিশ্চয়ই তা লক্ষ্য করেছেন। আর মাঝে মধ্যে আপনারা যখন কেউই আমার চোখের সামনে ছিলেন না, তখন কিছু সময়ের জন্য আমি একেবারে একলা হয়ে যাই। তাহলে এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, সেই একাকী থাকাকালীন সময়ে সমুদ্রের ধারে হেঁটে গিয়ে জেনারেল ম্যাকআর্থারকে খুন করে আবার প্রাসাদে ফিরে আসা সম্ভব কিছু নয়। এখন আপনারাই আমার ব্যাপারটা বিশদভাবে ভেবে দেখুন। আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে আমাকে কখনোই বাদ দেবেন না, যতক্ষণ না একেবারে সন্দেহমুক্ত হচ্ছেন, বুঝলেন?

আর আমার বিষয়টা অন্যমনস্ক ভাবেই বললো ব্লোর ডঃ আর্মস্ট্রং ও মিঃ লম্বার্ডকে জিজ্ঞেস করুন ওঁরা বাতলে দেবেন, কেন না সারাটা সকাল আমার কেটেছে ওঁদের দুজনের সঙ্গে।

তার মুখের কথাটা যেন লুফে নিলেন আর্মস্ট্রং আপনি কিন্তু একবার প্রাসাদে গিয়েছিলেন দড়ি আনতে।

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম বৈকি, অস্বীকার করবো না। প্রাসাদে গিয়েছি, দড়ি নিয়ে আবার ফিরে এসেছি আপনাদের কাছে।

কিন্তু যতখানি সময় লাগার দরকার তার থেকে একটু বেশী সময়ই নিয়েছিলেন আপনি? বলে হাসলেন ডঃ আর্মস্ট্রং।

বাঃ দড়িটা খুঁজে বার করতে একটু সময় লাগতেই তো পারে।

আর্মস্ট্রং কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়ারগ্রেভ বললেন মিঃ ব্লোরের অনুপস্থিত থাকাকালীন সময়ে আপনি ও মিঃ লম্বার্ড, এক সঙ্গেই ছিলেন, নাকি….।

হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জোর দিয়ে বললেন আর্মস্ট্রং তবে কিছু সময়ের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মিঃ লম্বার্ড। অবশ্য আমি তখন আমার জায়গা ছেড়ে এক চুলও নড়িনি।

লম্বার্ডের দিকে মুখ ফেরালেন ওয়ারগ্রেভ। উদ্দেশ্য তার অ্যালিবাইটা জেনে নেওয়া।

সেটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো লম্বার্ড, আমি গিয়েছিলাম ছোট্ট একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে। দেখতে গিয়েছিলাম, এখন থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে হিলিওগ্রাফ পদ্ধতিতে ওপারে স্টিকলহ্যাভেনে কোনো খবর টবর পাঠানো যায় কিনা। তার জন্য অবশ্য বেশীক্ষণ সময় নিইনি, মাত্র মিনিট দুয়েক হবে। তারপরেই আবার ফিরে যাই ডঃ আর্মস্ট্রং-এর কাছে।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন আর্মস্ট্রং। হুঁ, অতি অল্প সময়ের জন্য উনি আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। আমার ধারণা, এতো অল্প সময়ে তাঁর পক্ষে ম্যাকআর্থারকে খুন করে আবার ফিরে আসা অসম্ভব।

তা আপনার ঘড়ি দেখেছিলেন কি? হেসে হেসেই প্রশ্নটা করলেন ওয়ারগ্রেভ।

মুখটা শুকিয়ে গেলো আর্মস্ট্রং-এর না তো।

আমার হাতে ঘড়িই ছিলো না, দেখবো কি করে? ব্যাপরাটা হাল্কা ভেবে নিলো লম্বার্ড।

জেনে রাখুন, দু, এক মিনিট বললে, সঠিক সময়টা বলা হয় না। তাপর এমিলির দিকে মুখ ফেরালেন ওয়ারগ্রেভ মিস ব্লেন্ট, এবার আপনার বলার পালা।

ভেরা আর আমি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠেছিলাম। উত্তরে এমিলি বলেন, তারপর ফিরে এসে প্রাসাদের উদ্যানে বসে উল বুনতে শুরু করি।

আমি তো সেখানেই বসেছিলাম একটা আরাম কেদারায় বললেন ওয়ারগ্রেভ, বুঝি বা একটু অবাক হয়ে কই আপনাকে তো দেখতে পাইনি সেখানে।

না দেখার কথা। ঝড়ে হাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য পূর্ব দিকের দেওয়াল ঘেঁষে আমি বসেছিলাম।

দুপুরে খাবার ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত ছিলেন সেখানে?

আর মিস্ ক্লেথন, আপনি, আপনি কোথায় ছিলেন?

সকালে আমি আর মিস্ ব্লেন্ট পাহাড়ে উঠেছিলাম। সেখান থেকে ফিরে আমি একা একা যাই সমুদ্রের ধারে। সেখানে মিঃ ম্যাকআর্থারের সঙ্গে কিছু সময় কাটাই গল্প-গুজবে।

কখন। জিজ্ঞেস করলেন ব্লোর, তার সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়ার আগে না পরে?

ঠিক বলতে পারবো না। তবে তখন তাকে যেন একটু অস্বাভাবিকই লাগছিল। কেঁপে উঠলো ভেরার গলার স্বর।

অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিক বলতে কি রকম? একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারগ্রেভ।

তার কথাবার্তাগুলো কেমন যেন বললেন, আমাদের বাঁচার আয়ু নাকি ফুরিয়ে আসছে, আমরা কেউ নাকি এখান থেকে জীবিত অবস্থায় আর ফিরে যেতে পারবো না। আরো বললেন তিনি নাকি শেষ দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন। তাঁর অমন সব অস্বাভাবিক কথা শুনে আমি ভীষণ ভয় পেলাম, পড়ি মড়ি করে ছুটে পালিয়ে এলাম তার কাছ থেকে।

তাই বুঝি। তারপর?

প্রাসাদে ফিরে এলাম। খাবার ঘন্টা পড়ার আগে আর এক চক্কর বাইরে ঘুরতে বেরোই। আর খাবার ঘণ্টা শুনেই আবার ফিরে আসি প্রাসাদে। মিঃ ম্যাকআর্থারের বিষাদে ভরা কথা শুনে আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই অভিশপ্ত দ্বীপ থেকে সত্যি, সত্যি যদি আর না ফিরি–

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেন ওয়ারগ্রেভ, এখন তাহলে বাকী রইলো এখানকার শেষ ব্যক্তিটি রগার্স। কিন্তু তার কাছ থেকে খুব বেশী কিছু জানা যাবে বলে তো আমার মনে হয় না।

ওয়ারগ্রেভের অনুমাণই ঠিক। রগার্স যা বললো, সংক্ষেপে এই রকম; প্রাসাদে রান্নাবান্না এবং টুকিটাকি অন্য আরো কাজে এতোই ব্যস্ত ছিলো যে প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে কোথাও যাওয়ার একটুও ফুরসত পায়নি। খাবার ঘন্টা বাজিয়ে অপেক্ষা করেছে সে খাবার ঘরে। তারপরের ঘটনা তো সকলের সামনেই ঘটেছে। তবে একটা ব্যাপারে ভয়ঙ্কর বিস্মিত সে। তার নাকি স্পষ্ট মনে আছে সকালে খাবার ঘরের আলমারিতে আটটি পুতুল থাকতে দেখে। কিন্তু ঘণ্টা খানেক পরে ফিরে গিয়ে সে দেখে, সেখানে রয়েছে মোট সাতটি পুতুল, অর্থাৎ একটি উধাও।

রগার্স তার বক্তব্য শেষ করা মাত্র ঘরের মধ্যে নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা। কারোর মুখে কথা নেই। কথা নেই ওয়ারগ্রেভের মুখেও, নিচু হয়ে আধ বোজা চোখে তিনি তখন ভেবে চলেছেন আকাশ পাতাল।

কেবল দেওয়াল ঘড়িতে তখন শব্দ হচ্ছিল টিক্ টিক্ টিক……বিচার তো শেষ। এখন উনি কি রায় দেন উনিই জানেন, আর জানেন ঈশ্বর।

তার কথার রেশ মেলাতে না মেলাতেই শুরু করলেন ওয়ারগ্রেভ তাঁর রায় দান করার পালা। মাথাটা ঝুঁকে পড়লো তার মাথার কাছে। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর তার–তিন তিনটি মৃত্যুর ঘটনাই আমরা বিশদ ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলাম। আপাত দৃষ্টিতে একেকটা মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো বিশেষ ব্যক্তির ওপর আমাদের সকলের সন্দেহ ঘনীভূত হলেও আসলে আমরা কেউ পুরোপুরি সন্দেহ মুক্ত নই। অবশ্যই একটা ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই, আসল খুনী আমাদের উপস্থিত সাতজনের মধ্যেই একজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে কে সেই খুনী? তাকে চিহ্নিত করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ আমাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও। এই রকম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমার একটাই উপদেশ প্রত্যেককেই সতর্ক হয়ে থাকতে হবে, এখন থেকে আমাদের দায়িত্ব আমাদের নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হবে, এ ছাড়া বাঁচার আর কোনো রাস্তা নেই।

আমি আপনাদের আর একবার সাবধান করে দিচ্ছি আমাদের আততায়ী ভয়ঙ্কর এক উন্মাদ। কখন যে সে কাকে আক্রমণ করে বসবে, আগে থেকে তা অনুমান করা কঠিন। তাই আবার বলছি, সর্তকতার সঙ্গে, বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই অজ্ঞাত খুনীর মোকাবিলা করুন। একটু থেমে ওয়ারগ্রেভ আবার বলতে থাকেন, শুনুন, আমার আরো বলার আছে আমরা যখন কেউই সন্দেহ মুক্ত নই, তখন আমাদের এক মাত্র কাজ হবে সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা। অর্থাৎ কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করবেন না।

থামলেন তিনি অতঃপর। তার শেষ কথাগুলো ঘরের মধ্যে গমগম করতে থাকলো। কাজীর বিচার যেন আজকের মতো এখানেই শেষ। বিচার মুলতুবী রইলো ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীর কি দাঁড়ায় সেই দিনটির অপেক্ষায়।