০৬. দোতলার যে ঘরটিতে হরিপদবাবু ছিলেন

দোতলার যে ঘরটিতে হরিপদবাবু ছিলেন তার দরজায় তালা দেওয়া। হোটেলে কোনও লোকজন নেই। এমনকী কর্মচারীদেরও দেখা যাচ্ছে না। রায়বাবুর পকেটে চাবি ছিল। তিনিই দরজা খুললেন। জানলা বন্ধ। তাই আলো জ্বালা হল প্রথমে। শ্রীকান্ত বক্সি জানলা খুলে দিলেন। মাঝারি আকারের ঘর। মাঝখানে একটা ডাবলবেড, চাদর ছাড়া। টেবিলে কিছু কাগজপত্র, ব্যাগ ছড়ানো আছে। অমলদা বললেন, বডি নিয়ে যাওয়ার পর ভাল করে খুঁজে দেখা হয়েছে?

রায়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজব? ক্ল? কোনও দরকার নেই। লোকটা ওই দরজা দিয়েই ঢুকেছিল। হরিপদ সেন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলেন। চুপচাপ ভেতরে ঢুকে সোজা ওঁর পিঠে দশ ইঞ্চি শার্প সরু ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। কাজ শেষ করে ওই দরজা দিয়েই চলে গেছে।

অমলদা চট করে শ্রীকান্ত বক্সির দিকে তাকালেন। তিনি তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। অমলদা বললেন, এ কথা তো আপনি আমাকে জলপাইগুড়িতে বলেননি?

আমি তো তখন পুরো ঘটনাটা জানতাম না।

অমলদা একটু ভাবলেন, ভদ্রলোক, মানে খুনি ওই দরজা দিয়ে ঢুকলেন কী করে? হরিপদবাবু কি দরজা খুলে রেখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন?

ঠিক তাই। রায়বাবু বললেন, অনেক লোক হোটেলে এলেও কেয়ারলেস হয়ে থাকে।

মাথা নাড়লেন অমলদা, হরিপদবাবুর সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য আলাপ হলেও আমি জোরগলায় বলতে পারি, তিনি দরজা খুলে ওইভাবে শুয়ে থাকার মানুষ নন।

রায়বাবু একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে খুনি ঢুকল কী করে?।

সেটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করা যেতে পারে। কথাগুলো বলতে বলতে অমলদা পুরো ঘরটা একবার পাক মেরে এলেন। তাঁর নজর ঘরের মেঝের ওপর ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি দেওয়াল আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এ ঘরের সমস্ত হাতের ছাপ নিয়ে নিয়েছেন মিস্টার রায়? নিলে আমি আলমারিটা খুলতে পারি। আমাকে যখন একজন পার্টি করেছেন তখন এটুকু সাবধানতা অবলম্বন করতেই হচ্ছে।

রায়বাবু বললেন, ফিঙ্গার প্রিন্টের লোককে সন্ধের আগে পাওয়া যাচ্ছে না।

অমলদা বললেন, তা হলে রুমাল ব্যবহার করছি।

পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে ডান হাতে নিয়ে তার আড়ালে আঙুল ঢেকে আলমারি খুললেন অমলদা। হ্যাঙারে একজোড়া শার্ট-প্যান্ট ঝুলছে। নীচের তাকে একটা ভোলা ফাইল। ফাইলটা সম্ভবত সাদা ফিতেয় বাঁধা ছিল। ফিতেটা হেঁড়া। হাঁটু গেড়ে বসে ফাইলের কাগজপত্র দেখতে-দেখতে অমলদা বললেন, একেবারে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। অর্জুন, তুমি ততক্ষণে বাথরুমটা দেখে এসো।

রায়বাবুকে অমলদার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে অর্জন বাঁ দিকের দরজা ঠেলে বাথরুমে ঢুকল। শুকনো বাথরুম। একটা নীল তোয়ালে ঝুলছে। আয়নার নীচে নতুন সাবানকেসে অল্প ব্যবহার করা সাবান ছাড়া আর কিছু নেই। বাথরুমে কোনও সন্দেহজনক জিনিস চোখে পড়ল না। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল অমলদা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। টেবিলের দুধারে দুটো চেয়ার। একটা সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ে আছে। মাঝখানের অ্যাসট্রেতে গোটা দুয়েক সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। অমলদা বললেন, মিস্টার রায়, পোস্টমর্টেম যিনি করবেন তাঁকে বলবেন যেন পরীক্ষা করে দ্যাখেন হরিপাবুর সিগারেটের নেশা ছিল কি না। এটা খুব কড়া সিগারেট। শখে পড়ে যারা সিগারেট খায়, তাদের পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়।

রায়বাবু অ্যাসট্রেটাকে সযত্নে সরিয়ে রাখলেন। অর্জুন দেখল ভদ্রলোকের চোখ-মুখের পরিবর্তন হয়েছে। বেশ সমভাব ফুটে উঠেছে। টেবিলে আর কিছু পেলেন না অমল সোম। কিন্তু টেবিলের নীচে ঝুঁকে কিছু একটা দেখেই সোজা হলেন। চারপাশে আর-একবার নজর বুলিয়ে বললেন, আপনি বললেন এ-ঘরের কোনও জিলিসে হাত দেওয়া হয়নি, তাই না?

নিশ্চয়ই। রায়বাবু মাথা নাড়লেন।

হরিপদবাবুর চটি কিংবা জুতো কোথায়?

এতক্ষণে খেয়াল হলো অর্জুনেরও। এতক্ষণ শুধু সে লক্ষ করছিল খুনি কোনও ব্লু রেখে গিয়েছে কি না। সে কারণেই হরিপদবাবুর ব্যবহৃত জিনিসের প্রতি নজর ছিল না।

ঘরের কোথাও ভদ্রলোকের চটি বা জুতো খুঁজে পাওয়া গেল না।

অমলদা বললেন, ব্যাপারটা তো খুবই অস্বাভাবিক। খুনি ওঁকে খুন করে যেতে পারে কিন্তু চটি বা জুতো নিয়ে যাবে কেন? গতকাল আমি হরিপদবাবুর পা দেখেছি। এমন কিছু মূল্যবান বস্তু ছিল না। আর ভদ্রলোক নিজে ওই প্রয়োজনীয় জিনিস দুটো বাইরে ফেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবেন এটা ভাবা যাচ্ছে না।

রায়বাবু বললেন, সত্যি তো, ওগুলো গেল কোথায়?

অমলদা বললেন, আপনার লোকজনকে বলুন একটু খুঁজে দেখতে। এই হোটেলের আশেপাশে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু শিলিগুড়ি শহরের ডাস্টবিন বা রাস্তা থেকে যারা বাতিল জিনিসপত্র কুড়োয়,তাদের জানিয়ে রাখুন।

অমলদা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র অন্যান্যরা তাঁকে অনুসরণ করল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অমলদা জিজ্ঞেস করলেন, হোটেলের কর্মচারীদের জেরা করে কিছু জানতে পারলেন?

রায়বাবু মাথা নাড়লেন ডিটেলসে জিজ্ঞেস করিনি। এমনিতে সবাই বলছে কেউ কিছু জানে না।

আমি একটু কথা বলার সুযোগ পাব?

তা হলে তো আপনাকে থানায় যেতে হয়।

যেতে তো হবেই। আপনি আমাদের জেরা করবেন বলেছিলেন। রায়বাবু জিভ বের করলেন, ছি-ছি। ওভাবে বলবেন না। হরিপদবাবুকে জীবিত অবস্থায় আপনি দেখেছিলেন, উনি হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কীভাবে জলপাইগুড়িতে গিয়ে আপনাকে মিট করবেন, তাই আপনার একটা স্টেটমেন্ট নেওয়া আমার কর্তব্য।

সেটা অবশ্যই নেওয়া উচিত।

হোটেলটিকে আবার তালাবন্ধ করে রায়বাবু ওঁদের নিয়ে জিপে উঠলেন। রাস্তায় কোনও কথা হল না। থানায় গিয়ে রায়বাবু ওঁদের সমাদর করে বসালেন। নিজের চেয়ারে বসেই পুলিশি গলা ফিরে পেলেন যেন, হরিপদ সেনকে আপনি আগে চিনতেন?

না কস্মিনকালেও নয়। অমলদা মাথা নাড়লেন।

উনি সেই কলকাতা থেকে আপনার কাছে কেন এলেন?

গুপ্তধনের খোঁজে।

মানে? রায়বাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেল। ওঁর পূর্বপুরুষ কালাপাহাড়ের সহচর ছিলেন। কালাপাহাড় উত্তর বাংলার কোথাও অনেক সোনা-হিরে মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন। ওঁর পূর্বপুরুষ সেটা জানতেন। হরিপদবাবু চেয়েছিলেন আমরা সেটা উদ্ধার করে দিই। এই অনুরোধই তিনি করেছিলেন।

কোথায় ওগুলো পোঁতা হয়েছিল তিনি আপনাকে জানিয়েছিলেন?

না। তিনি জানতেন না।

স্ট্রেঞ্জ! উত্তর বাংলার কোথায় খুঁজবেন আপনি? পাগল নাকি?

তবু আমি কেসটা নিয়েছিলাম। এব্যাপারে ভদ্রলোক বেঁচে থাকলে সাহায্য পেতাম।

দেখুন মিস্টার সোম, আপনার এই গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না।

প্রথমত গল্প নয়, ঘটনা। বিশ্বাস করানোর দায়িত্ব আমার নয়।

বেশ। তারপর কী হল?

আমি ওঁকে আজ দেখা করতে বলেছিলাম।

উনি শিলিগুড়িতে থাকতে গেলেন কেন? জলপাইগুড়িই তো ভাল ছিল।

সে-কথা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন শিলিগুড়িতেই উনি ভাল থাকবেন। মনে হচ্ছে, মানে এখন অনুমান করছি, শিলিগুড়িতে কারও সঙ্গে দেখা করবেন ঠিক ছিল, যেটা আমাকে বলেননি।

কার সঙ্গে?

সম্ভবত যে লোকটি ওঁকে খুন করেছে তার সঙ্গেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।

হঠাৎ রায়বাবুর যেন কিছু মনে পড়ল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হরিপদবাবুর পূর্বপুরুষ কার সহচর বললেন?

অমলদা বললেন, কালাপাহাড়।

অদ্ভুত ব্যাপার? কালাপাহাড় মানে সেই ঐতিহাসিক চরিত্র?

হ্যাঁ। রায়বাবু উঠে একটা আলমারির পাল্লা খুললেন। বাঁ দিকের তাক থেকে একটা খাম বের করে তা থেকে একটা কাগজ টেনে আনলেন। বেশ রহস্যময় মুখ করে এগিয়ে এসে কাগজটাকে টেবিলের ওপর মেলে ধরলেন।

একটা প্যাডের পাতার গায়ে রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। পাতাটা কোঁচকানো। বোঝা যাচ্ছে ওই কাগজ দিয়ে কিছু মোছা হয়েছিল। প্যাডের পাতায় কেউ অনেকবার কালাপাহাড় শব্দটা লিখে গেছেন নানান ঢঙে। তার ওপর শুকনো রক্ত চাপা পড়েছে।

অমলদা জিজ্ঞেস করলেন, এই কাগজটাকে কোথায় পাওয়া গিয়েছে?

হরিপদবাবুর শরীরের ওপরে।

আপনি তখন যে বললেন ঘরের কোনও জিনিস সরানো হয়নি?

এটাকে জিনিসের মধ্যে ধরিনি। আমি কিন্তু হরিপদবাবুর ব্যবহৃত জিনিসের কথা বলেছিলাম।

ছুরিটা কোথায়?

ছুরি?

যেটা দিয়ে ওঁকে খুন করা হয়?

সেটা তো খুনি নিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই কাগজটা দিয়েই ছুরি মুছেছে।

এখনও পোস্টমর্টেম হয়নি। আপনি কী করে তখন বললেন দশ ইঞ্চির ছুরি ছিল?

এতদিন পুলিশের চাকরি করছি, উন্ড দেখে আন্দাজ করতে পারব না?

চুপ করে রইলেন অমলদা খানিক। তারপর বললেন, প্যাডের কাগজটা

অবশ্যই হরিপদবাবুর। খুনি ছুরি মুছতে প্ল্যান করে পকেটে কাগজ নিয়ে আসবে না। কিন্তু ঘরের কোথাও আমি প্যাড দেখতে পাইনি। সেটা গেল কোথায়।

রায়বাবু মাথা নাড়লেন, ঠিক কথা! এটা আমার মাথায় আসেনি।

শ্রীকান্ত বক্সি এতক্ষণ বেশ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম অমলবাবুর এব্যাপারে দারুণ মাথা খোলে।

অমলদা হাত নাড়লেন, আমাকে কি আর কোনও প্রশ্ন করবেন।

না। তবে, হ্যাঁ। আপনি কালাপাহাড়ের নাম বললেন। ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু এই কাগজে সেই নামটা লেখা থাকবে কেন?

হয়তো হরিপদবাবু লিখেছিলেন অন্যমনস্ক হয়ে। অমলদা হাসলেন, মাথায় যেটা ঢোকে সেটা আমরা অনেকেই অন্যমনস্ক অবস্থায় কলমে ফুটিয়ে তুলি। তবে দেখতে হবে ওই কাগজের রক্ত এবং হাতের লেখা হরিপদবাবুর কি না।

রক্তটা ওঁর কি না বের করতে অসুবিধে হবে না। হাতের লেখা মেলাব কী

করে?

হোটেলের খাতায় নিশ্চয়ই ওঁর হস্তাক্ষর পাওয়া যাবে। তাকিয়ে দেখুন বাংলার সঙ্গে ইংরেজি অক্ষরেও কালাপাহাড় লেখা হয়েছে। ক্যাপিটাল লেটারে যখন নয় তখন লেখাতে কিছুটা মিল পাওয়া যাবেই। যাক, এবার আমাকে হোটলের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। অমলদা উঠে দাঁড়ালেন।