২৭. হযরত ইসমাঈল (আ)

হযরত ইসমাঈল ()

হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)-এর বেশ কয়েকজন পুত্ৰ সন্তান ছিলেন যার উল্লেখ পূর্বেই আমরা করেছি। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন সে দু’জন যারা ছিলেন মহান নবী। আবার এ দু’জনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন ইসমাঈল (আঃ)। বিশুদ্ধ মতে যিনি ছিলেন যাবীহুল্লাহ। তিনিই ছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রথম সন্তান। মাতা মিসরের কিবতী বংশের কন্যা হযরত হাজেরা। যারা হযরত ইসহাককে যাবীহুল্লাহ বলেছেন, তারা বনী ইসরাঈল থেকে এ মত প্ৰাপ্ত হয়েছেন। অথচ বনী ইসরাঈলগণ তাওরাত ও ইনজীলের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাবের অপব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা তাদের কাছে রক্ষিত আসমানী কিতাবের বক্তব্যের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। হযরত ইবরাহীম (আ)-কে তার প্রথম পুত্র কুরবানী করার নির্দেশ দেয়া হয়। অন্য বর্ণনা মতে, তার একমাত্র পুত্রকে যবোহ করার আদেশ দেয়া হয়। যেটাই ধরা হোক না কেন, এর দ্বারা হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কেই বোঝানো হয়েছে। তাদের কিতাবে সুস্পষ্টভাবে রয়েছে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) যখন ভূমিষ্ঠ হন, তখন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছিল ছিয়াশি বছর। আর যখন হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্ম হয় তখন, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর বয়স একশ’ বছরের উপরে। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ইসমাঈল (আঃ)-ই খলীলুল্লাহর প্রথম সন্তান। সুতরাং সর্বাবস্থায় তিনিই ছিলেন একক সন্তান। বাহ্যত তের বছরের অধিক কাল পর্যন্ত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন তার একমাত্ৰ সন্তান। এ সময়ের মধ্যে অন্য কোন সন্তানের জন্ম হয়নি। আর তাৎপৰ্যগত দিক থেকে একক এ হিসেবে যে, পিতা ইবরাহীম (আ) শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.) ও তার মা হাজেরাকে নিয়ে হিজরত করেন এবং মক্কার ফারান পর্বতের উপত্যকায় উভয়কে নির্বাসিত করেন। তাদেরকে যখন তিনি রেখে আসেন তখন তাদের সাথে যৎসামান্য পানি ও রসদ ব্যতীত কিছুই ছিল না। এটা তিনি করেছিলেন আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রেখে। আল্লাহ তা’আলা আপন অনুগ্রহ ও করুণার দ্বারা তাদেরকে বেষ্টন করে নেন। বস্তৃত তিনিই প্রকৃত অনুগ্রহকারী, সাহায্যকারী ও অভিভাবক। অতএব, প্রমাণিত হল যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-ই বাহ্যিক ও তাৎপর্যগত উভয় দিক থেকে একক সন্তান। কিন্তু কে বুঝবে এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব এবং কে খুলবে। এই শক্ত গিট। আল্লাহ যাকে গভীর তত্ত্বজ্ঞান দান করেছেন, তিনিই কেবল এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বিভিন্ন গুণাগুণের প্রশংসা করেছেন। যেমন : তিনি ছিলেন। ধৈর্যশীল, সহনশীল, ওয়াদা পালনকারী, সালাতের হেফাজতকারী। পরিবারবর্গকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দানকারী-যাতে তারা আযাব থেকে রক্ষা পায় এবং মহান প্রভুর ইবাদতের দিকে মানুষকে আহবানকারী। আল্লাহর বাণী :

অতঃপর আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তার পিতার সাথে কাজ করবার মত বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহা করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন! আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল

°ंदन।। (७१ ६ ७०७)

তিনি পিতার আহবানে সাড়া দেন এবং ওয়াদা করেন যে, তিনি ধৈর্যশীল হবেন। এ ওয়াদা তিনি পূরণও করেন এবং ধৈর্যধারণ করেন। আল্লাহ বলেন :

স্মরণ কর, আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কথা। ওরা ছিল শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদশী। আমি তাদেরকে অধিকারী করেছিলাম এক বিশেষ গুণের তা ছিল পরলোকের স্মরণ।

অবশ্যই তারা ছিল আমার মনোনীত ও উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (৩৮ : ৪৫-৪৭)

الاخيار . স্মরণ কর, ইসমাঈল, আল-য়াসা-আ ও যুল-কিফলের কথা, ওরা প্ৰত্যেকেই ছিল সজ্জন। (Ꮼb 8 8b ) |

আল্লাহর বাণী :

এবং স্মরণ করা ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল কিফুল এর কথা তাদের প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। তাদেরকে আমি আমার অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। (ミ〉3brQ-bや)

আল্লাহর বাণী :

আমি তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করেছি। যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট প্রেরণ করেছিলাম—ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরদের কাছে। (৪ : ১৬৩)

8 ○○

আল্লাহর বাণী :

তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ঈমান রাখি এবং যা আমাদের প্রতি এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়াকুব ও তার বংশধরদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। (২ : ১৩৬)

অন্য অনেক সূরায় এ জাতীয় বহু আয়াত বিদ্যমান আছে। আল্লাহ বলেন :

তোমরা কি বল যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ ইহুদী কিংবা খৃস্টান ছিল? বল তােমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ? (২ : ১৪০)

এসব আয়াতে আল্লাহ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর উত্তম গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন, তাকে নবী ও রাসূল বানিয়েছেন এবং অজ্ঞ লোকেরা তার প্রতি যেসব মিথ্যা ও অলীক কথা-বার্তা আরোপ করেছে তা থেকে তার মুক্ত থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। মুমিনদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন সেই সব বিধানের উপর বিশ্বাস রাখে যা ইসমাঈল (আ)-এর উপর নাযিল হয়েছিল। নসব-নামা ও বংশ পঞ্জিকার পণ্ডিতগণ এবং মানব জাতির ঐতিহাসিক ঘটনা ও সভ্যতা বর্ণনাকারিগণ লিখেছেন যে, তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম ঘোড়ায় আরোহণকারী ব্যক্তি। এর পূর্বে ঘোড়া ছিল নেহায়েতই একটি বন্য প্রাণী। তিনি তা পোষ মানান ও তাতে আরোহণ করেন। সাঈদ ইব্‌ন ইয়াহয়া উমাবী (র) তাঁর ‘মাগাষী’ গ্রন্থে ইব্‌ন উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা ঘোড়া পুষিবে এবং তার আদর-যত্ন করবে। কেননা এটা তোমাদের পিতা ইসমাঈল (আঃ)-এর মীরাছ বা উত্তরাধিকার। তদানীন্তন আরবরা ছিল বেদুঈন। হযরত ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে দাওয়াত দেন। তারা তার ডাকে সাড়া দেয়। তিনিই সর্বপ্রথম প্রাঞ্জল আরবী ভাষায় কথা বলেন। আদি আরবদের কাছ থেকে তিনি এ ভাষা শিখেছিলেন। তারা হল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পূৰ্বেকার জুরাহুম, আমালিক ও ইয়ামানবাসী আরব যারা মক্কায় এসে বসবাস শুরু করেছিল।

ঐতিহাসিক উমাবী (র) মুহাম্মদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন হুসায়নের পূর্ব-পুরুষগণের বরাতে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন : ‘স্পষ্ট আরবী ভাষায় যিনি সর্বপ্রথম কথা বলেন, তিনি ছিলেন ইসমাঈল (আঃ)। তখন তাঁর বয়স মাত্ৰ চৌদ্দ বছর। আলী ইব্‌ন মুগীরা (র) এ কথা বর্ণনা করার সময় উপস্থিত জনৈক ইউনুস বললেন, : হে আবু সাইয়ার! আপনি সত্য বলেছেন, আবু জারীও আমার কাছে ঠিক এরূপই বর্ণনা করেছেন। ইতিপূর্বে আমরা বলে এসেছি যে, হযরত ইসমাঈল (আ.) যৌবনে পদার্পণ করে আমালিকা সম্প্রদায়ের জনৈকা মহিলাকে বিবাহ করেন এবং পরে পিতার নির্দেশক্রমে তাকে তালাক দেন। উমাবী ঐ মহিলার নাম বলেছেন আম্মারা বিনত সা’দ ইব্‌ন উসামা ইব্‌ন আকীল আল-আমালিকা। তারপর তিনি অপর এক

8VS

মহিলাকে বিবাহ করেন। পিতার আদেশ অনুযায়ী এই স্ত্রীকে তিনি বহাল রাখেন। এই স্ত্রীর নাম সায়্যিদা বিনত মাদাদ ইব্‌ন আমার আল-জুরহুমী। কেউ কেউ বলেছেন, হযরত ইসমাঈল (আ)-এর ইনি ছিলেন তৃতীয় স্ত্রী। এই স্ত্রীর গর্ভে বারজন পুত্ৰ সন্তান জন্মলাভ করেন। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক (র) তাদের নাম বৰ্ণনা করেছেন।

আহলি কিতাবগণ তাদের গ্রন্থাদিতেও এরূপই উল্লেখ করেছেন। তবে তাদের মতে, এই বারজন ছিলেন সমাজপতি যাদের সম্পর্কে পূর্বেই সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। হযরত ইসমাঈল (আ) মক্কা ও তার পার্শ্ববতী জুরহুম, আমালিক ও ইয়ামানবাসীদের প্রতি রসূলরক্ৰপে প্রেরিত হন। মৃত্যুকালে তিনি আপন ভাই ইসহাকের প্রতি ওসীয়ত করে যান। ইসমাঈল (আঃ) তাঁর কন্যা নাসমাকে তার ভাতিজা ঈস ইব্‌ন ইসহাকের সাথে বিবাহ দেন। এই দম্পতির পুত্ৰ সন্তানের নাম রূম। রূম-এর আওলাদদেরকে বানুল আসফার বলা হয়। কারণ, তাদের পিতা ঈস-এর গায়ের রং ছিল গেরুয়া। যাতে আরবীতে সুফির (১৯-২) বলা হয়ে থাকে। অপর বর্ণনা মতে, ঈস্-এর আরও দুই পুত্র ছিল— ইউনান ও আশাবান। ইব্‌ন জারীর (র) এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি।

হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে হিজর নামক স্থানে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ১৩৭ বছর। উমর ইব্‌ন আবদুল আয়ীয থেকে বর্ণিত : ইসমাঈল (আ) মক্কার প্রচণ্ড গরম সম্পর্কে আল্লাহর নিকট প্রার্থীনা করেন। আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাকে জানান যে, যেখানে তোমাকে দাফন করা হবে সে স্থানের দিকে আমি জান্নাতের একটি দরজা খুলে দেব। কিয়ামত পর্যন্ত সেখানে জান্নাতের সুশীতল হাওয়া প্রবাহিত থাকবে।

হেজাষী আরবদের সকলেই নাবিত ও কায়জারের বংশ বলে নিজেদেরকে দাবি করে। পরবর্তীতে আমরা আরব জাতি, তাদের বংশ, গোত্র, সমাজ ও কবীলা ও তাদের কৃষ্টি, সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করব। হযরত ইসমাঈল (আঃ) থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) পর্যন্ত সম্পূর্ণ সময়ের যাবতীয় বর্ণনা এতে থাকবে। হযরত ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম (আ) পর্যন্ত বনী ইসরাঈলের উত্থান-পতন, তাদের নবীদের আলোচনা শেষে উক্ত বিষয়ে আলোচনা করা হবে। অতঃপর বনী ইসরাঈলের যুগ এবং পরে আইয়ামে জাহিলিয়ার ঘটনাবলী এবং সবশেষে বিশ্বনবী (সা)-এর সীরাত মুবারক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *