৩৫. ফিরআউন ও তার বাহিনী ধ্বংসের বিবরণ

ফিরআউন ও তার বাহিনী ধ্বংসের বিবরণ

বাদশাহ ফিরআউনের আনুগত্য স্বীকার এবং আল্লাহর নবী ও তাঁর রাসূল মূসা ইবনে ইমরান (আ.)-এর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়ে মিসরের কিবতীদের যখন তাদের কুফারী, অবাধ্যতা ও সত্য বিমুখতায় অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে লাগল; আল্লাহ তা’আলা তখন মিসরবাসীর নিকট বিস্ময়কর ও সুস্পষ্ট প্রমাণাদি পেশ করেন এবং তাদেরকে এমন সব অলৌকিক ঘটনা দেখান যাতে চোখ ঝলসে যায় এবং মানুষ হতবিহবল হয়ে পড়ে। এতদসত্ত্বেও তাদের কিছু সংখ্যক ব্যতীত কেউ বিশ্বাস স্থাপন করেনি; অন্যায় থেকে প্রত্যাবর্তন করেনি; জোর-জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকেনি এবং কেউ কেউ বলেন, তাদের মধ্যে মাত্র তিন ব্যক্তি ঈমান এনেছিলেন। একজন হচ্ছেন ফিরআউনের স্ত্রী, কিতাবীরা তার সম্বন্ধে মোটেও অবহিত নয়। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন ফিরআউনের সম্প্রদায়ের মুমিন ব্যক্তিটি যার নসীহত প্ৰদান, পরামর্শ দান ও তাদের বিরুদ্ধে দলীলাদি পেশ করার বিষয়টি ইতিপূর্বেই সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয়জন হচ্ছেন উপদেশ প্রদানকারী ব্যক্তিটি যিনি শহরের দূর প্রান্ত থেকে ছুটে এসে মূসা (আ)-কে তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘হে মূসা (আ)! ফিরআউনের পারিষদবর্গ আপনাকে হত্যা করার জন্য সলাপরামর্শ করছে। সুতরাং আপনি বের হয়ে পড়েন। আমি আপনার একজন মঙ্গলকামী বৈ নই। এটি আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর অভিমত। যা ইব্‌ন আবু হাতিম (র) ও বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর অভিমত হল, এরা তিনজন হচ্ছেন জাদুকরদের অতিরিক্ত। কেননা জাদুকরগণও কিবতীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, ফিরআউনের সম্প্রদায় কিবতীদের মধ্য হতে একটি দল ঈমান

এনেছিল। জাদুকরদের সকলে এবং বনী ইসরাঈলদের সকল গোত্রই ঈমান এনেছিল। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় :

অর্থাৎ-’ফিরআউন ও তার পারিষদবৰ্গ নির্যাতন করবে। এ আশংকায় তার সম্প্রদায়ের একদল ব্যতীত আর কেউই তার প্রতি ঈমান আনেনি। যমীনে তো ফিরআউন পরাক্রমশালী ছিল এবং সে অবশ্যই সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা ইউনুস : ৮৩)

আয়াতাংশ • • • •-তে • সর্বনামটিতে ফিরআউনকেই নির্দেশ করা হয়েছে। কেননা, বাক্যের পূর্বাপর দৃষ্টি তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার কেউ কেউ নিকটতম শব্দ মূসা (আ)-এর

প্রতি নির্দেশ করে বলে বলেছেন। তবে প্রথম অভিমতটিই বেশি স্পষ্ট। তাফসীরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর তারা ঈমান এনেছিল গোপনে। কেননা, তারা ফিরআউন ও তার প্রতিপত্তি এবং তার সম্প্রদায়ের অত্যাচার, অবিচার ও নিষ্ঠুরতাকে ভয় করত। তারা আরো ভয় করত যে, যদি ফিরআউনের লোকেরা তাদের ঈমানের কথা জানতে পারে তাহলে তারা তাদেরকে ধর্মচু্যত করে ফেলবে। ফিরআউনের ঘটনা আল্লাহ বৰ্ণনা করেছেন আর আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আল্লাহ তা’আলা বলেন :

অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই দেশে তো ফিরআউন পরাক্রমশালী ছিল। সে ছিল স্বৈরাচারী, হঠকারী ও অন্যায়ভাবে দাম্ভিক।’ আবার সে তার প্রতিটি কাজে, আচরণে ও ব্যবহারে ছিল সীমালংঘনকারী। বস্তৃত। সে ছিল এমন একটি মারাত্মক জীবাণু যার ধ্বংস ছিল অত্যাসন্ন; সে এমন একটি নিকৃষ্ট ফল যার কাটার সময় ছিল অত্যাসন্ন, এমন অভিশপ্ত অগ্নিশিখা যার নির্বাপন ছিল সুনিশ্চিত।

তখন মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেনঃ

‘হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহতে ঈমান এনে থাক, যদি তোমরা আত্মসমৰ্পণকারী হও তবে তোমরা তারই উপর নির্ভর কর। তারপর তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করো না এবং আমাদেরকে তোমার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় হতে রক্ষা কর।’ (शूनां शैऎनून * by8-by७)

অর্থাৎ মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা, আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থীনা এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট আশ্রয় গ্ৰহণ করার জন্যে হুকুম দিলেন। তাঁরা তা মান্য করলেন। তাই আল্লাহ তা’আলাও তাদেরকে তাদের বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করলেন।

আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন

অর্থাৎ-’আমি মূসা (আ) ও তার ভাইয়ের নিকট প্রত্যাদেশ করলাম, মিসরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ স্থাপন কর, তােমাদের গৃহগুলোকে ইবাদত গৃহ কর, সালাত কায়েম কর এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা ইউনুস : ৮৭)

অন্য কথায় আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ) ও তাঁর ভ্রাতা হারূন (আ)-কে ওহী মারফত নির্দেশ দিলেন যেন তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্যে কিবতীদের থেকে আলাদা ধরনের গৃহ নিৰ্মাণ করেন

যাতে তারা নির্দেশ পাওয়া মাত্ৰই-ভ্ৰমণের জন্যে তৈরি হতে পারে এবং একে অন্যের ঘর সহজে চিনতে পারে ও প্রয়োজনে বের হয়ে পড়ার জন্যে সংবাদ দিতে পারে।

আয়াতে উল্লেখিত আয়াতাংশ 1144.1 بيوتكم قبلة% এর অর্থ হচ্ছে, ‘তােমাদের গৃহগুলোকে ইবাদত গৃহ কর।’ কেউ কেউ বলেন, ‘এটার অর্থ হচ্ছে গৃহগুলোতে বেশি বেশি সালাত আদায় করবে।’ মুজাহিদ (র), আবু মালিক (র), ইবরাহীম আন-নাখায়ী (র), আর রাবী (র), যাহব্যাক (র), যায়িদ ইব্‌ন আসলাম (র), তাঁর পুত্র আবদুর রহমান (র) ও অন্যান্য তাফসীরকার এ অভিমত পোষণ করেন। এ অভিমত অনুযায়ী আয়াতাংশের অর্থ হবে : তারা যেসব অসুবিধা, ক্লেশ, কষ্ট ও সংকীর্ণতায় ভুগছে তা থেকে পরিত্ৰাণ পাবার জন্যে অধিক হারে সালাত আদায় করে আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থীনা করা।

যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন ৪

واشئويثؤا بالضثر والضلوة . অর্থাৎ— ‘ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থীনা করা।’ (সূরা বাকারা : ৪৫) হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল (সা) যখন কোন কঠিন বিষয়ের সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি সালাত আদায় করতেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে—ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের অত্যাচারের ভয়ে মসজিদ বা মজলিসে প্রকাশ্য ইবাতদ কষ্টসাধ্য হওয়ায় গৃহের নির্দিষ্ট স্থানে তাদেরকে সালাত আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। প্রথম অর্থটি অধিক গ্রহণযোগ্য। তবে দ্বিতীয় অর্থটিও অগ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।

সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর (র) আয়াতাংশ ‘{{{‘; 4.323 1315 16 এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটার অর্থ হচ্ছে, তোমরা তোমাদের বাড়িগুলোকে মুখোমুখি করে তৈরি কর।’

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ— মূসা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ফিরআউন ও তার পরিষদবৰ্গকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছ যা দিয়ে হে আমাদের প্রতিপালক! তারা মানুষকে তোমার পথ থেকে ভ্ৰষ্ট করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের সম্পদ বিনষ্ট কর, তাদের হৃদয় কঠিন করে দাও। তারা তো মৰ্মসুদ শান্তি প্ৰত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না। তিনি প্রতি উত্তরে বললেন, তোমাদের দুজনের প্রার্থীনা গৃহীত হল। সুতরাং তোমরা দৃঢ় থাক এবং তোমরা কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করবে না। (সূরা ইউনুস : ৮৮-৮৯)

উপরোক্ত আয়াতে একটি বিরাট অভিশাপের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলার শত্রু ফিরআউনের বিপক্ষে মূসা (আ) আল্লাহ তা’আলার আযাব-গযব অবতীর্ণ হবার জন্যে বদদুআ করলেন। কেননা, সে সত্যের অনুসরণ ও আল্লাহ তা’আলার সহজ সরল পথ থেকে বিমুখ ও বিচুত ছিল। আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত সৎ, সহজ-সরল পথের বিরোধিতা করত, অসত্যকে আঁকড়ে ধরেছিল, ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য প্রমাণ এবং যুক্তিগ্রাহ্য দলীলাদি দ্বারা সুপ্রমাণিত বাস্তবতাকে সে অস্বীকার, অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করত। মূসা (আ) আরয করলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ফিরআউন, তার সম্প্রদায় কিবতী ও তার অনুসারী এবং তার ধর্মকর্মের অনুগামীদেরকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ প্ৰদান করেছ, তারা পার্থিব সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং তারা অজ্ঞ তাই তাদের এসব সম্পদ, শোভা যথা দামী দামী কাপড়-চোপড়, আরামপ্রদ সুন্দর সুন্দর যানবাহন, সুউচ্চ প্রাসাদ ও প্রশস্ত ঘরবাড়ি, দেশী-বিদেশী সুপ্রসিদ্ধ খাবার-দাবার, শোভাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনপ্রিয় রাজত্ব, প্রতিপত্তি ও পার্থিব হাঁকডাক ইত্যাদি থাকাকে বিরাট কিছু মনে করে।

আয়াতে উল্লিখিত। &U14: LA 04.JI (4% আয়াতাংশের অর্থ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) ও মুজাহিদ (র) বলেন, আয়ােতাংশে উল্লেখিত U., ) এর অর্থ ধ্বংস করে नiv3।

আবুল আলীয়া (র), আর রাবী ইব্‌ন আনাস (র) ও যাহাহাক (র) বলেন,এটার অর্থ হচ্ছে—এগুলোকে, এদের আকৃতি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবে নকশা খচিত পাথরে পরিণত क: प्ल९3 |’

কাতাদা (র) বলেন, এটার অর্থ সম্পর্কে আমাদের কাছে যে বর্ণনা পৌঁছেছে তা হচ্ছে—’তাদের ক্ষেত-খামার সব কিছুই পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।’ মুহাম্মদ ইব্‌ন কা’ব (র) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে তাদের চিনি জাতীয় দ্রব্যাদি পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, এটার অর্থ এও হতে পারে যে, ‘তাদের সমুদয় সম্পদ পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।’ এ সম্পর্কে উমর ইব্‌ন আবদুল আয়ীয (র)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তিনি তার একটি দাসকে বললেন, ‘আমার কাছে একটি থলে নিয়ে এস। নির্দেশানুযায়ী সে একটি থলে নিয়ে আসলে দেখা গেল থলের মধ্যকার ছোলা ও ডিমগুলো পাথরে পরিণত হয়ে রয়েছে।’ বর্ণনাটি ইব্‌ন আবু হাতিম (র)-এর।

আয়াতাংশ :J$’) 5 ك واشكث علي قلوبهم فلا يومئوا خشی ریز والغذاب তাফসীর প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে, তাদের অন্তরে মােহর করে দাও। আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত ধর্ম ও নিদর্শনাদিকে ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় কর্তৃক অমান্য করার দরুন মূসা (আ) তাদের প্রতি আল্লাহ, তাঁর দীন ও তাঁর নিদর্শনাদির পক্ষে ক্রুদ্ধ হয়ে যখন বদদুআ করলেন, আমনি আল্লাহ তা’আলা তা কবুল করেন এবং আযাব-গষৰ অবতীর্ণ করেন।

যেমন-নূহ (আ)-এর বদদু’আ তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহ তা’আলা কােল

করেছিলেন। যখন তিনি বলেছিলেন :

‘হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও

না। তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির।’

যখন মূসা (আ) ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের প্রতি অভিশাপ দিয়েছিলেন, তার ভাই হারূন (আঃ) তাঁর দু’আর সমর্থনে ‘আমীন’ বলেছিলেন এবং হারূন (আ)ও দু’আ করেছেন বলে গণ্য করা হয়েছিল, তাই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ—’তোমাদের দুজনের দু’আ কবুল হল। সুতরাং তোমরা দৃঢ় থাক এবং তোমরা কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করবে না।’ (সূরা ইউনুস : ৮৯)

তাফসীরকারগণ এবং আহলি কিতাবের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বনী ইসরাঈল তাদের ঈদের উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে শহরের বাইরে যাবার জন্যে ফিরআউনের নিকট অনুমতি প্রার্থীনা করলে ফিরআউন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে অনুমতি প্ৰদান করল। তারা বের হবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগল এবং পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের সাথে বনী ইসরাঈলের একটি চালাকি মাত্র, যাতে তারা ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের অত্যাচার-অবিচার থেকে মুক্তি পেতে পারে।

কিবাতীরা আরো উল্লেখ করেছে যে, আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে কিবতীদের থেকে স্বর্ণালংকার কার্জ নেয়ার জন্যে হুকুম দিয়েছিলেন; তাই তারা কিবতীদের থেকে বহু অলংকারপত্র কার্জ নিয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারে তারা বের হয়ে পড়ল ও বিরামহীনভাবে অতি দ্রুত পথ অতিক্রম করতে লাগল – যাতে তারা অনতিবিলম্বে সিরিয়ার অঞ্চলে পৌছতে পারে। ফিরআউন যখন তাদের মিসর ত্যাগের কথা জানতে পারল, সে তখন তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হল এবং তাদের বিরুদ্ধে তার রাগ চরম আকার ধারণ করল। সে তার সেনাবাহিনীকে প্ররোচিত করল এবং বনী ইসরাঈলকে পাকড়াও করার ও তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যে তাদের সমবেত করল।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন ৪

. আমি মূসা (আ)-এর প্রতি ওহী অবতীর্ণ করেছিলাম। এই মর্মে : আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বের হয়ে পড়; তোমাদের তো পশ্চাদ্ধাবন করা হবে। তারপর ফিরআউন শহরে শহরে লোক সংগ্ৰহকারী পাঠাল এই বলে যে, এরা তো ক্ষুদ্র একটি দল; ওরা তো আমাদের ক্ৰোধ উদ্রেক করেছে এবং আমরা তো সকলেই সদা সতর্ক। পরিণামে আমি ফিরআউন গোষ্ঠীকে বহিষ্কৃত করলাম ওদের উদ্যানরাজি ও প্রস্রবণ থেকে এবং ধনভাণ্ডার ও সুরম্য সৌধমালা থেকে। এরূপই ঘটেছিল এবং বনী ইসরাঈলকে এসবের অধিকারী করেছিলাম। ওরা সূর্যোদয়কালে তাদের পশ্চাতে এসে পড়ল। অতঃপর যখন দু’দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা বলল, ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।’ মূসা বলল, ‘কখনই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথ-নির্দেশ করবেন। তারপর মূসার প্রতি ওহী করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর, ফলে এটা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল। আমি সেখানে উপনীত করলাম। অপর দলটিকে এবং আমি উদ্ধার করলাম মূসা ও তাঁর সঙ্গী সকলকে। তৎপর নিমজ্জিত করলাম। অপর দলটিকে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই মু’মিন নয়। তোমার প্রতিপালক- তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (সূরা শু’আরা : ৫২-৮০)।

তাফসীরকারগণ বলেন, ফিরআউন যখন বনী ইসরাঈলকে পিছু ধাওয়ার জন্যে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বের হল তখন তার সাথে ছিল একটি বিরাট সৈন্যদল। ঐ সৈন্যদলের ব্যবহৃত ঘোড়ার মধ্যে ছিল একলাখ উন্নতমানের কালো ঘোড়া এবং সৈন্য সংখ্যা ছিল ষোল লাখের উর্ধের্ব। প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলাই সম্যক জ্ঞাত।

কেউ কেউ বলেন, শিশুদের সংখ্যা বাদ দিয়ে বনী ইসরাঈলের মধ্যেই ছিল প্ৰায় ছয় লাখ যোদ্ধা। মূসা (আ)-এর সাথে বনী ইসরাঈলের মিসর ত্যাগ ও তাদের আদি পিতা ইয়াকুব (আ) বা ইসরাঈলের সাথে মিসর প্রবেশের মধ্যে ছিল চারশ ছাব্বিশ সৌর বছরের ব্যবধান।

মোদা কথা, ফিরআউন সৈন্যসামন্ত নিয়ে বনী ইসরাঈলকে ধরার জন্যে অগ্রসর হল এবং সূর্যোদয়ের সময়ে তারা পরস্পরের দেখা পেল। তখন সামনাসামনি যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এ সময়ই মূসা (আ)-এর অনুসারিগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমরা তাহলে ধরা পড়ে গেলাম।’ তাদের ভীত হবার কারণ হল, তাদের সম্মুখে ছিল উত্তাল সাগর। সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া তাদের আর কোন পথ বা গতি ছিল না। আর সাগর পাড়ি দেয়ার শক্তিও ছিল না। তাদের বাম পাশে ও ডান পাশে ছিল সুউচ্চ খাড়া পাহাড়। ফিরআউন তাদেরকে একেবারে আটকে ফেলেছিল। মূসা (আ)-এর অনুসারীরা ফিরআউনকে তার দলবল ও বিশাল সৈন্যসামন্ত সহকারে অবলোকন করছিল। তারা ফিরআউনের ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ছিল। কেননা, তারা ফিরআউনের রাজ্যে ফিরআউন কর্তৃক লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছিল। সুতরাং তারা আল্লাহর নবী মূসা (আ)-এর কাছে তাদের অবস্থা সম্পর্কে অনুযোগ করল।

তখন আল্লাহর নবী মূসা (আ) তাদেরকে অভয় দিয়ে বললেন : کلاران مُچئی ربى

৩৫,১৫, … অর্থাৎ—‘কখনও না; নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার প্রতিপালক রয়েছেন, তিনি

আমাকে পরিত্রাণের সঠিক পথ-নির্দেশ করবেন।’ মূসা (আ) তাঁর অনুসারীদের পশ্চাৎভাগে ছিলেন। তিনি অগ্রসর হয়ে সকলের সম্মুখে গেলেন এবং সাগরের দিকে তাকালেন। সাগরে তখন উত্তাল তরঙ্গ ছিল। তখন তিনি বলছিলেন ৪ আমাকে এখানেই আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর ভাই হারূন (আ) এবং ইউশা। ইব্‌ন নূন যিনি বনী ইসরাঈলের বিশিষ্ট নেতা, আলিম ও আবিদ। মূসা (আ) ও হারূন (আ)-এর পরে আল্লাহ তা’আলা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন ও তাকে নবুওত দান করেন। পরবর্তীতে তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা আসবে। মূসা (আ) ও তাঁর দলবলের সাথে ফিরআউন সম্প্রদায়ের মুমিন বান্দাটিও ছিলেন। তারা থমকে দাড়িয়েছিলেন আর গোটা বনী ইসরাঈল গোত্র তাদের ঘিরে দাড়িয়েছিল। কথিত আছে, ফিরআউন সম্প্রদায়ের মুমিন বান্দাটি ঘোড়া নিয়ে কয়েকবার সাগরে ঝাপ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠল না। তাই তিনি মূসা (আ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর নবী (আঃ)! আমাদেরকে কি এখানেই আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে? মূসা (আ) বললেন, ‘হ্যা’। যখন ব্যাপারটি তুঙ্গে উঠল, অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল, ব্যাপারটি ভয়াবহ আকার ধারণ করল; ফিরআউন ও তার গোষ্ঠী সশস্ত্র সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ক্রোধাভরে অতি সন্নিকটে এসে পৌছাল; অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়াল; চক্ষু স্থির হয়ে গেল এবং প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল, তখন ধৈর্যশীল মহান শক্তিমান, আরশের মহান অধিপতি, প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলা মূসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর কাছে ওহী প্রেরণ করলেন : JL…… এ’….। ৬ *(?)। অর্থাৎ নিজ লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত কর। যখন তিনি সাগরে আঘাত করলেন, কর্থিত আঁছে তিনি সাগরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর হুকুমে বিভক্ত হয়ে যাও।’ যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ-আমি মূসার প্রতি ওহী করলাম, আপনি লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর, ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল। (সূরা শু’আরা : ৬৩)

কথিত আছে, সমুদ্রটি বারটি খণ্ডে বা রাস্তায় বিভক্ত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রের জন্যে একটি করে রাস্তা হয়ে গেল, যাতে তারা নিজ নিজ নির্ধারিত রাস্তায় সহজে পথ চলতে পারে। এ রাস্তাগুলোর মধ্যে জানালা ছিল বলে কেউ কেউ মত প্ৰকাশ করেন, যাতে তারা একদল অন্যদলকে অনায়াসে রাস্তা চলার সময় দেখতে পায়। কিন্তু এই অভিমতটি শুদ্ধ নয়। কেননা, পানি যেহেতু স্বচ্ছ পদার্থ তাই তার পিছনে আলো থাকলে দৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয় না। সুতরাং একদল অন্যদলকে দেখার জন্যে জানালা থাকার প্রয়ােজন হয় না। যেই সত্তা কোন বস্তুকে সৃষ্টি করতে শুরু হয়ে যাও বললে সাথে সাথে তা হয়ে যায়, সেই সত্তার মহান কুদরতের কারণেই সমুদ্রের পানি ছিল পর্বতের মত দণ্ডায়মান। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা সমুদ্রে বিশেষ ধরনের বায়ু প্রেরণ করেন যার ধাক্কায় পানি সরে রাস্তাগুলো শুকিয়ে যায়, যাতে ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর খুর না আটকিয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ—’আমি অবশ্যই মূসা (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলাম এ মর্মে, আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বেরিয়ে পড় এবং তাদের জন্যে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এক শুকনো পথ নির্মাণ কর। পশ্চাৎ হতে এসে তোমাকে ধরে ফেলা হবে এরূপ আশংকা করো না এবং ভয়ও করো না। অতঃপর ফিরআউন তার সৈন্য-সামন্তসহ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল, তারপর সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করল আর ফিরআউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছিল এবং সৎপথ দেখায়নি।’ (সূরা তা-হা : ৭৭-৭৯)।

বস্তৃত পরম পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালকের আদেশে যখন সমুদ্রের অবস্থা এরূপ দাঁড়াল বনী ইসরাঈলকে নিয়ে সমুদ্র পার হবার জন্যে মূসা (আ)-কে নির্দেশ দেয়া হল, তখন

দৃষ্টি ঝলসিয়ে দেয় ও তাদের অবাক করে দেয়। আর এরূপ দৃশ্য মু’মিনদের অন্তরসমূহকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। যখন তারা এরূপে সমুদ্র পার হবার জন্যে সমুদ্রে অবতরণ করেন, নির্বিঘ্নে তাঁরা সমুদ্র পার হলেন এবং তাদের শেষ সদস্যও সমুদ্র পার হলেন। আর যখন তারা সমুদ্র পার হলেন, ঠিক তখনই ফিরআউনের সৈন্য-সামন্তের প্রথমাংশ ও অগ্রগামীদল সমুদ্রের কিনারায় পৌঁছাল। তখন মূসা (আ) ইচ্ছে করেছিলেন যে, পুনরায় সমুদ্রে লাঠি দিয়ে আঘাত করবেন যাতে সমুদ্রের অবস্থা পূর্ববৎ হয়ে যায় এবং ফিরআউনের দল তাদেরকে ধরতে না পারে ও তাদের পৌছার কোন বাহনই না থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সমুদ্রকে এ অবস্থায় ছেড়ে দিতে মূসা (আ)-কে নির্দেশ দিলেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ- তাদের পূর্বে আমি তো ফিরআউন সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছিলাম এবং তাদের নিকটও এসেছিল এক সম্মানিত রাসূল। সে বলল, ‘আল্লাহর বান্দাদেরকে আমার নিকট প্রত্যার্পণ কর। আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল এবং তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না। আমি তোমাদের নিকট উপস্থিত করছি স্পষ্ট প্রমাণ। তোমরা যাতে আমাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে না পার, সে জন্য আমি আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালকের শরণ নিচ্ছি। যদি তোমরা আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন না কর, তবে তোমরা আমার নিকট থেকে দূরে থাক।

তারপর মূসা তাঁর প্রতিপালকের নিকট নিবেদন করল, ‘এরা তো এক অপরাধী সম্প্রদায়।’ ‘ আমি বলেছিলাম, ‘তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বের হয়ে পড়; তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে। সমুদ্রকে স্থির থাকতে দাও, ওরা এমন এক বাহিনী যা নিমজ্জিত হবে। ওরা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ, কত বিলাস-উপকরণ, ওতে তারা আনন্দ পেতো। এরূপই ঘটেছিল এবং আমি এ সমুদয়ের উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। আকাশ এবং পৃথিবী কেউই ওদের জন্যে অশ্রুপাত করেনি এবং ওদেরকে অবকাশও দেয়া হয়নি। আমি তো উদ্ধার করেছিলাম বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি হতে ফিরআউনের; সে তো ছিল পরাক্রান্ত সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আমি জেনে-শুনেই ওদেরকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম এবং ওদেরকে দিয়েছিলাম নিদর্শনাবলী—যাতে ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। (সূরা দুখান : ১৭-৩৩)

আয়াতাংশ 16:46, 24 491 973.15 এর অর্থ হচ্ছে সমুদ্রকে তার অবস্থায় স্থির থাকতে দাও, তার ব্যত্যয় ঘটায়ো না। এ মতটি আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা), মুজাহিদ (র), ইকরিমা (র), রাবী (র), যাহাহাক (র), কাতাদা (র), কা’ব আল-আহবার (রা), সোমাক ইব্‌ন হারব (র) এবং আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম (র) প্ৰমুখের।

সমুদ্রের সেই স্থিতাবস্থায়ই ফিরআউন সমুদ্রের তীরে পৌছলো, সবকিছু দেখল এবং সমুদ্রের আশ্চর্যজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল। আর পুরোপুরি বুঝতে পারল যেমন পূর্বেও বুঝত যে, এটা মহাসম্মানিত আরশের মহান মালিক প্রতিপালকেরই কুদরতের লীলাখেলা। সে থমকে দাঁড়াল, সম্মুখে অগ্রসর হলো না এবং বনী ইসরাঈল ও মূসা (আ)-কে পিছু ধাওয়া করার জন্যে মনে মনে অনুতপ্ত হল, তবে এ অবস্থায় অনুতাপ যে তার কোন উপকারে আসবে না, সে তা ভাল করে বুঝতে পারল। তা সত্ত্বেও সে তার সেনাবাহিনীর নিকট তার অটুট মনোবলের কথা ও আক্রমণাত্মক ভাব প্রকাশ করল। যে সম্প্রদায়কে সে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল, ফলে তারা তার আনুগত্য স্বীকার করেছিল, যারা তাকে বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তার অনুসরণ করেছিল নিজ কুফরীতে লিপ্ত ফাসিক ও ফাজির না।ফসের প্ররোচনায় তাদেরকে উদ্দেশ করে সে বলল, ‘তোমরা একটু লক্ষ্য করে দেখ, সমুদ্র আমার জন্যে সরে গিয়ে কিরূপে পথ করে দিয়েছে—যাতে আমি আমার ঐসব পলাতক দাসদেরকে ধরতে পারি-যারা আমার আনুগত্য স্বীকার না করে আমার রাজত্ব থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করছে। মুখে এরূপ উচ্চবাচ্য করলেও অন্তরে সে দ্বন্দূের মধ্যে ছিল যে, সে কি তাদের পিছু ধাওয়া করবে, নাকি আত্মরক্ষার্থে

পিছু হটে যাবে? হায়! তার হটে যাবার কোন উপায় ছিল না, সে এক কদম সামনে অগ্রসর হলে কয়েক কদম পিছু হটবার চেষ্টা করছিল।

তাফসীরকারগণ উল্লেখ করেন, এরূপ অবস্থায় জিবরাঈল (আ) একটি আকর্ষণীয ঘোটকীর উপর সওয়ার হয়ে আত্মপ্ৰকাশ করলেন এবং ফিরআউন যে ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল তার সম্মুখ দিয়ে সমুদ্রের দিকে ঘোটকীটি অগ্রসর হল। তার ঘোড়াটি ঘোটকীর প্রতি আকৃষ্ট হল এবং ঘোড়াটি ঘোটকীর পিছু পিছু ছুটতে লাগল। জিবরাঈল (আঃ) দ্রুত তার সামনে গেলেন এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। ঘোড়া ও মাদী ঘোড়াটি ছুটতে লাগল। ঘোড়াটি সামনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল। ঘোড়ার উপর ফিরআউনের আর নিয়ন্ত্রণ রইল না। ফিরআউন তার ভাল-মন্দ কিছুই চিন্তা করতে সক্ষম ছিল না। সেনাবাহিনী যখন ফিরআউনকে দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তারাও অতি দ্রুত তার পিছনে সমুদ্রে ঝাপ দিল। যখন তারা সকলেই পরিপূর্ণভাবে সমুদ্রে ঢুকে গেল এবং সেনাবাহিনীর প্রথম ভাগ সমুদ্র থেকে বের হবার উপক্রম হল আল্লাহ তা’আলা মূসা (আঃ)-কে আদেশ করলেন; তিনি যেন তার লাঠি দিয়ে পুনরায় সমুদ্রে আঘাত করেন। তিনি সুমন্দ্রে আঘাত করলেন। তখন সমুদ্র পূর্বের আকার ধারণ করে ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীর মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো। ফলে তাদের কেউই আর রক্ষা পেল না, সকলেই ডুবে মরল। আল্লাহ তা’আলা বলেন, :

অর্থাৎ— এবং আমি উদ্ধার করলাম মূসা ও তার সঙ্গী সকলকে। তারপর নিমজ্জিত করলাম অপর দলটিকে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই মু’মিন নয়। তোমার প্রতিপালক- তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (সূরা শু’আরা : ৬৫-৬৮)

অর্থাৎ তিনি তার পছন্দনীয় মু’মিন বান্দাদের উদ্ধারের ব্যাপারে পরাক্রমশালী। তাই তাদের একজনও ডুবে মারা যাননি। পক্ষান্তরে তার দুশমনদেরকে ডুবিয়ে মারার ব্যাপারেও তিনি পরাক্রমশালী। তাই তাদের কেউই রক্ষা পায়নি। এতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার অসীম কুদরতের একটি মহা নিদর্শন ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আবার অন্যদিকে রাসূল (সা) যে মহান শরীয়ত ও সরল-সঠিক তরীকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, তার সত্যতার জ্বলন্ত প্রমাণও বটে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন

অর্থাৎ—আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করলাম; এবং ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্যসহকারে সীমালংঘন করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে নিমজ্জামান হল তখন বলল, আমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে। নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমৰ্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। এখান! ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্বন্ধে গাফিল। (সূরা ইউনুস : ৯০-৯২)

অন্য কথায়, অত্র আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কিবতী কাফিরদের প্রধান ফিরআউনের ডুবে মারার বিবরণ দেন। উত্তাল তরঙ্গ যখন তাকে একবার উপরের দিকে উঠাচ্ছিল এবং অন্যবার নিচের দিকে নামাচ্ছিল এবং ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনী কিরূপ মহাসংকট ও দুৰ্ভেদ্য মুসীবতে পতিত হয়েছিল তা বনী ইসরাঈলরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল যা তাদের চোখ জুড়াচ্ছিল ও হৃদয়ের জ্বালা প্রশমিত করছিল। ফিরাউন যখন নিজের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করল; সে কোণঠাসা হয়ে পড়ল এবং তার মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল তখন সে বিনম্র হল; তওবা করল এবং এমন সময় ঈমান আনয়ন করল, যখন তার ঈমান কারো উপকারে আসে না।

যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ—যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে তারা ঈমান আনবে না। যদি তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে- যতক্ষণ না তারা মর্মসুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সূরা ইউনুস : ৯৬-৯৭)

আল্লাহ তা’আলা এ প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ করেছেন :

অর্থাৎ-তারপর তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন বলল, আমরা এক আল্লাহতে ঈমান আনলাম এবং আমরা তার সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদেরকে প্ৰত্যাখ্যান করলাম। ওরা যখন আমার শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করল, তখন ওদের ঈমান ওদের কোন উপকারে আসল না। আল্লাহর এই বিধান পূর্ব থেকেই তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে এবং এ ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সূরা মুমিন : ৮৪-৮৫)

অনুরূপ মূসা (আ) ফিরাউন ও তার গোষ্ঠীর ব্যাপারে বন্দ দুআ করেছিলেন, যাতে আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্পদ ধ্বংস করে দেন এবং তাদের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা মােহর মেরে

দেন, যাতে তারা মর্মন্তদ শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করার পূর্বে ঈমান না আনতে পারে। অর্থাৎ তখন তাদের ঈমান তাদের কোন কাজে আসবে না। আর এটা হবে তাদের জন্যে আক্ষেপের কারণ। মূসা (আ) ও হারূন (আঃ) যখন এরূপ বন্দ দু’আ করছিলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ قد أجيمث شوشكم – 3 RR65Fة

অর্থাৎ—’তোমাদের দু’জনের দু’আ কবুল হল।’ এ প্রসঙ্গে নিম্নে বর্ণিত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। ইমাম আহমদ (র) আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন ফিরআউনের উক্তি :

‘আমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই।’ (সূরা ইউনুস : ৯০)

এ প্রসঙ্গে জিবরাঈল আমাকে বললেন, (হে রাসূল!)। ঐ সময়ের অবস্থা যদি আপনি দেখতেন! সমুদ্রের তলদেশ থেকে কাদা নিয়ে তার মুখে পুরে দিলাম, পাছে সে আল্লাহ তা’আলার রহমত না পেয়ে যায়। এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিয়ী (র) ইব্‌ন জারীর (র) ও ইব্‌ন আবু হাতিম (র) প্রমুখ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিয়ী (র) হাদীসটি হাসান পর্যায়ের বলে মত প্রকাশ করেছেন। আবু দাউদ তাবলিসী (র) ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইব্‌ন আবু হাতিম (র) ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন।

আল্লাহ তা’আলা যখন ফিরআউনকে ডুবিয়ে দিলেন, তখন সে তার আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করল এবং উচ্চৈঃস্বরে বলল?

المُنگ انته لا الله الاً الئین المُتُبث به بشؤا اشرائيل. রাসূল (সা) বলেন, জিবরাঈল (আঃ) তখন আশঙ্কা করছিলেন যে, আল্লাহ তা’আলার রহমত আল্লাহ তা’আলার গযবের উপর প্রাধান্য না পেয়ে যায়। তিনি তখন তার পাখা দ্বারা কাল মাটি তুলে ফিরআউনের মুখে ছুড়ে মােরল যাতে করে তার মুখ ঢাকা পড়ে যায়।

ইব্‌ন জারীর (র) অন্য এক সূত্রে আবু হুরায়রা (রা) থেকে এ মর্মের হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবরাহীম তায়মী (র), কাতাদা (র), মাইমুন ইব্‌ন মিহরান (র) প্রমুখ হাদীসটি মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন।

কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, জিবরাঈল (আঃ) বলেছেন, ‘আমি ফিরআউনের মত অন্য কাউকে এত বেশি ঘূণা করি নাই যখন সে বলেছিল J.I.S| 244 5 6 অর্থাৎ ‘আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠতম প্ৰতিপালক।’

। আয়াতাংশে উল্লেখিত প্রশ্নটি)541 66, 4,%عُظَسيك قبل وكتلتا ومِنَ المفسدين. অস্বীকৃতি বোঝাবার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। আর আল্লাহ তা’আলা যে তার ঈমান কবুল করেননি। এটি তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা জানতেন যে, যদি তাকে পুনরায়

দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হত তাহলে সে পুনরায় পূর্বের ন্যায় আচরণ করত। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য কফিরের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, যখন তারা জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে তখন বলে উঠবে :

‘তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে আগুনের পার্শ্বে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত। তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সূরা আনআম : ২৭)

জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলবেন

‘না, পূর্বে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের নিকট প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তা-ই করত এবং নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।’ (সূরা আন’আম : ২৮)

আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) প্রমুখ মুফাসসির বর্ণনা করেছেন যে, বনী ইসরাঈলের কেউ কেউ ফিরআউনের মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছিল এবং তারা বলেছিল, ফিরআউন কখনও মরবে না; এ জন্য আল্লাহ তা’আলা সমুদ্রকে নির্দেশ দেন, যাতে ফিরআউনকে কোন একটি উচু জায়গায় নিক্ষেপ করে। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ পানির উপরে। আবার কেউ কেউ বলেন, মাটির একটি ঢিবির উপরে। তার গায়ে ছিল তার বর্ম যা ছিল সুপরিচিত যাতে

কুদরতের পরিচয় পেতে পারে।

অর্থাৎ-‘আজ আমি তোমার দেহটা রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্যে নিদর্শন হয়ে থাক।’ তোমার পরিচিত বৰ্মসহ তোমাকে রক্ষা করব যাতে তুমি বনী ইসরাঈলের কাছে শক্তিমান আল্লাহ তা’আলার কুদরতের একটি নিদর্শন হয়ে থাক।’ এ জন্যই কেউ কেউ আয়াতাংশটিকে নিম্নরূপ পাঠ করেছেন বঁ। এ141র্ব ৩ × 6 & _ অর্থাৎ—’যাতে তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার একটি নিদর্শন হয়ে থাক। আয়াতাংশের অর্থ নিম্নরূপও হতে পারে। ‘তোমাকে রক্ষা করেছি। তোমার বর্মসহ যাতে তোমার বর্ম তোমার পরবর্তী বনী ইসরাঈলের জন্যে তোমাকে চেনার ব্যাপারে এবং তোমার ধ্বংসের ব্যাপারে একটি প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।’ কোন অর্থটি সঠিক, আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী আশুরার দিন ধ্বংস হয়েছিল।

ইমাম বুখারী (র) তাঁর কিতাব সহীহ বুখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা শরীফ আগমন করলে, দেখলেন ইহুদীরা আশুরার দিন সিয়াম পালন করে থাকে। (কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে) তারা বলল, এটা এমন একটি দিন যেদিনে ফিরআউনের বিরুদ্ধে মূসা (আ)-এর বিজয় সূচিত হয়েছিল।

অর্থাৎ- মূসা (আ) সম্পর্কে বনী ইসরাঈল থেকে তোমরা (মুসলমানরা) বেশি হকদার। কাজেই তোমরা ঐ দিন সিয়াম পালন কর। বুখারী ও মুসলিম শরীফ ব্যতীত অন্যান্য হাদীস গ্রন্থেও এ মর্মের হাদীসটি পাওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *