০১. রাজনৈতিক অবস্থা

রাজনৈতিক অবস্থা

ভূমিকা

হিজরী ৭ম শতাব্দীতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেক বিপ্লবাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৫৬ হিজরী/১২৫৮ খৃঃ সনে তাতারীরা বাগদাদ আক্রমণ করে এবং প্রায় বিশ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে(১) তাতার রাজবংশের উর্ধতন পুরুষ হালাকু খান।(২) ২ লাখ যোদ্ধা নিয়ে হালাকু খান এই অভিযান পরিচালনা করে। শহরের পর শহর ও জনপদ ধ্বংস করে সে সদলবলে বাগদাদে এসে পৌছে। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্যে বাদগাদে তখন মাত্র দশ হাজারের অধিক অশ্বারোহী সৈনিক ছিল না। অন্যান্য সৈনিক নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবার পর এরাই কেবল অবশিষ্ট রয়েছিল। তাদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকা থেকে উৎখাত হওয়ার পর তাদের অবস্থা এতই করুণ হয়ে দাঁড়ায় যে, বাজারে ও মসজিদের দরজায় দরজায় ভিক্ষাপ্রার্থী হয়। তাদেরকে লোকজনের করুণা ভিক্ষা করতে দেখা যায়।(৩)

উষীর ইব্‌ন আলকামী মুহাম্মদ ইব্‌ন আহমদ ইব্‌ন মুহাম্মাদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন আবী তালিবকে কেন্দ্র করে সন্দেহ আবর্তিত হয়ে থাকে। ইব্‌ন আলকামী ছিল খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহর উষীর।(৪) তাতারদের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা ও হালাকু খাঁর সাথে তার ঘনিষ্ঠতাই এ সন্দেহের কারণ।

(১) খিলাফত

তাতাররা বাগদাদের শেষ আব্বাসী খলীফা মুসতাসিমকে হত্যা করে বাগদাদে আব্বাসী খিলাফতের অবসান ঘটায়।(৫) তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণে সক্ষম সকল নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক ও বৃদ্ধকে তারা হত্যা করে। বাগদাদে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় বিশ লাখ।(৬) কতক বিধর্মী, একদল ব্যবসায়ী এবং ইব্‌ন আলকামীর গৃহে আশ্রয় গ্রহণকারী লোকজন ও অল্প কিছু লোক ব্যতীত বাগদাদের কেউই রক্ষা পায়নি। একাদিক্ৰমে ৪০ দিন এই হত্যাযজ্ঞ চলে।

খলীফা মুসতাসিমের সাথে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল আব্বাস আহমদ এবং মেজো পুত্ৰ আবুল ফযল আবদুর রহমান নিহত হন। তিন বোনসহ তাঁর ছোট ছেলে মুবারক বন্দী হন। রাজধানী থেকে প্রায় এক হাজার কুমারী মেয়েকে বন্দী করা হয়। নির্যাতনের ভয়াবহতা এত করুণ ছিল যে, রাজধানী থেকে এক একজন আব্বাসী লোককে ধরে আনা হত। অতঃপর তার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী-পরিজনসহ সবাইকে খিলাল কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হত। অতঃপর তাদের সম্মুখে বকরী জবাই করার মত তাকে জবাই করে দেয়া হত। তার কন্যা ও দাসীদের মধ্য থেকে যাদেরকে পছন্দ হত বন্দী করে নিয়ে যেত। এ পর্যায়ে তিন বছর পর্যন্ত খিলাফতের মসনদ খলীফা-শূন্য ছিল।

খলীফা মুসতানসির বিল্লাহ-এর ভাই এবং বাগদাদের শেষ খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহর চাচা। তিনি বাগদাদে বন্দী ছিলেন। পরে মুক্তি পেয়েছিলেন। এরপর তিনি মিসর, সিরিয়া ও আরব উপদ্বীপের কর্তৃত্বের অধিকারী যাহিরের নিকট যান।(৭) সেখানকার কাজী সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তারপর যাহির, তার উষীরবর্গ ও অন্যান্য প্রশাসক তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তার ভাই মুসতানসির বিল্লাহ-এর নাম অনুসারে তাকে মুসতানসির বিল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এটি ৬৫৯ হিজরীর ঘটনা। তখন তিনি মালিকুয যাহিরকে ‘সুলতান’ মনোনীত করেন। তাকে কালো জুব্বার খেলাত গলায় মালা এবং তাঁর পায়ে স্বর্ণের মল পরিয়ে দেয়া হয়। সচিব (রঈসুল কুত্তাব) খলীফার পক্ষ থেকে ‘সুলতান’ মনোনয়নের ঘোষণাপত্ৰ পাঠ করে শুনালেন।(৮) এরপর খলীফা বাগদাদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। সুলতান তাকে দশ লাখ স্বর্ণমুদ্রা উপঢৌকন স্বরূপ প্ৰদান করেন।(৯)

৬৬০ হিজরী সনের ৩রা মুহাররাম তাতারদের হাতে খলীফা নিহত হন। মালিকুয যাহিরের সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং এক বছর যাবত খলীফার পদ শূন্য থাকে। অবশেষে ৬৬১ হিজরী সনের(১০) ২রা মুহাররাম হাকিম বি-আমরিল্লাহ আবুল আব্বাস আহমদ ইব্‌ন আবী আলী আল কাবী ইব্‌ন আলী ইব্‌ন আবী বকর ইব্‌ন মুসতারশিদ বিল্লাহ-এর বংশ পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার হাতে বাইয়াত সম্পন্ন হয়। ৪০ বছর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ৭০১ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন। অতঃপর তার পুত্র মুসতাকফী বিল্লাহ খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি রীতিমত খিলাফতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ৭৩৭ হিজরী সনে সুলতান নাসির মুহাম্মদ ইব্‌ন কালাউন তাকে বন্দী করে এবং জনসাধারণের সাথে তার মেলামেশা নিষিদ্ধ করে দেয়। নজরবন্দী অবস্থায় ৭৪০ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়।

এরপর মুতাযিদ বিল্লাহ খিলাফতের মসনদে আসীন হন। ৭৬৩ হিজরী পর্যন্ত তার খিলাফত অব্যাহত থাকে। তারপর মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ খলীফা নিযুক্ত হন। খলীফার দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার বর্ণনা স্বরূপ আমরা উল্লেখ করছি যে, খলীফা মুসতাকর্ষকী বিল্লাহ তাঁর পরবর্তী খলীফারূপে তাঁর পুত্র আহমদ আবী রাবীকে মনোনীত করে যান। কিন্তু সুলতান নাসির তাতে বাদ সাধেনি। বরং আবী রাবী-এর ভ্রাতুষ্পপুত্র আবু ইসহাক ইবরাহীমকে তিনি খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি খলীফাকে আল ওয়াছিক উপাধি প্ৰদান করেন। কায়রোতে এক জুমু’আর নামাযে তিনি খলীফার পক্ষে খুতবা দেন। অতঃপর মানসূর এসে ইবরাহীমকে বরখাস্ত করেন এবং আবুল কাসিমকে খলীফা নিযুক্ত করেন। মনসুর তাকে মুসতানসির বিল্লাহ উপাধি দেন।

যাহোক, কায়রোতে অবস্থানকালে আব্বাসী খলীফাগণ বাগদাদে অবস্থানের তুলনায় ভালই ছিলেন। চরম দুরবস্থার দিনেও সুলতানগণ কায়রোর খলীফাদেরকে দেশান্তরিত করতেন। কিংবা বরখাস্ত করতেন মাত্র। কিন্তু অঙ্গ কর্তন কিংবা হত্যা করা পর্যন্ত তা গড়াতো না। ঘটনা পরম্পরায় এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রথম দু’জন খলীফা তাদের নেতৃত্বে তাতারদের হাত থেকে বাগদাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য খলীফা এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি। বিধায় এবং সুলতানগণ কর্তৃক মনোনয়ন ব্যতীত তাদের নিজস্ব কোন মান-মর্যাদা না থাকায় তাদের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এ সময়ে খিলাফতের পদবীটি একটি প্রতীকী ও ক্ষমতাহীন পদারূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে। অবশেষে ১৫১৭ খৃঃ সুলতান সালীম উছমানী কায়রো আগমন করেন এবং খিলাফতের পদ অধিকার করেন। তিনি দাবি করেন যে, শেষ খলীফা তার সমর্থনে ঐ পদ থেকে ইস্তেফা দিয়েছেন।

(২) সুলতানী শাসন

৬৭৬ হিজরী থেকে ৭৭৬ হিজরী পর্যন্ত মিসর, সিরিয়া ও মক্কা-মদীনায় ২১ জনের অধিক সুলতান রাজত্ব করেছেন। এ থেকেই সুলতান পদবীটির অস্থিরতা ও দুর্বলতার দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সুলতানগণ উচ্চপদস্থ আমীর-উমারা ও তুকী সেনাধ্যক্ষদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। সুলতান পদবীটিও খলীফা পদের ন্যায় নামসর্বস্ব হয়ে পড়ে। উভয় পদই তখন নেহাৎ প্রতীকী রূপ ধারণ করে। প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় আমীর-উমারা ও নায়েবদের হাতে। সুলতানগণ তাদের ক্রীড়নকে পরিণত হন। তারা যাকে ইচ্ছা ক্ষমতায় বসাত আর যাকে ইচ্ছা অপসারিত করত। অনেককেই নিতান্ত অল্প বয়সে সুলতান পদে বসানো হয়েছে। সুলতান মনসুর সালাহউদ্দীন মুহাম্মদ ইব্‌ন মুযাফফর হাজী সুলতান পদে আসীন হয়েছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। ১১ শা’বান ইব্‌ন হুসায়ন যখন সুলতান হন তখন তাঁর বয়স ১০ বছরের বেশি ছিল না। ১২ আশরাফ নিহত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, নাসির মুহাম্মদকে সুলতান পদে বসানো হবে। তখন তিনি ৮ বছরের বালক মাত্ৰ।(১৩) এমনও দেখা যেত যে, কোন কোন আমীর রাতে গৃহবন্দী হয়ে ঘুমোতেন। আর ভোরে তিনি সুলতান পদে আসীন হতেন। আবার রাতে ঘুমোতেন নতুনভাবে গৃহবন্দী হয়ে। যেমন ঘটেছিল হুসায়ন নাসিরের ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাকে মিসরের সুলতান পদে অধিষ্ঠিত করে। এরপর তাদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হয়। ফলে শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং হুসায়নকে ঐ প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ইতিপূর্বে বন্দী ছিলেন।(১৪) পরিস্থিতি এমন অসহনীয় পর্যায়ে পৌছে যে, এখন গায়ে উকুন ভর্তি ও নোংরাদেহী কোন ক্রীতদাসও যদি সুলতান পদে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখতো তাহলে অনায়াসেই তাও বাস্তবায়িত হতো, যেমন ঘটেছিল সুলতান কুতুয্যের ক্ষেত্রে।(১৫)

(৩) প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা

তাতারদের ধ্বংসলীলা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে ফিরিঙ্গীদের (ইউরোপীয় খৃষ্টানদের) সাথে গোপন আলোচনার পথ খুলে দেয় এবং অবশিষ্ট আব্বাসী খিলাফত ও স্বাধীনতা রক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। বাগদাদ ও দামেশকে সংঘটিত মহা ধ্বংসযজ্ঞের পর বিজয়ীদের জন্যে অন্ধকারের সূচনা হয়। তাতার রাজারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং সুন্নত অনুসারে জীবন যাপনে প্রয়াসী হয়। তাদের রাজন্যবৰ্গও এতদঞ্চলের রাজাদের ন্যায় হয়ে যায়। তারা আলোচনা সভা অনুষ্ঠান করতেন। তারা কখনো রোমানদের সাথে যুদ্ধ করতেন আবার কখনো রাজত্বের খাতিরে সন্ধিও করতেন। অতঃপর উপহার-উপঢৌকন বিনিময় করতেন।

দ্বিতীয় ঘটনা : জনপদসমূহকে ক্রুসেড আক্রমণের প্রভাবমুক্ত করা। এ সূত্রে রাজা যাহির বায়সার্স কায়সারিয়্যাহ, আরসূর্ণ, ইয়াফা, শাকীফ, এন্টিয়ক, তাবারিয়্যা, কাসীর, কুর্দীদের দুর্গ, আক্কা দুৰ্গ, গারীন ও সাফসীতা দুর্গ উদ্ধার করেন। মারকাব, বানিয়াস, এন্টারতোস অঞ্চল আধাআধি ভাগে ভাগ করে নেন। যেমনটি সাইফুদ্দীন কালাউস ত্রিপোলী শহর এবং আশরাফ খলীল ইব্‌ন কালাউন আক্কা অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিলেন। সূরা ও সায়দা অঞ্চল দু’টির কর্তৃত্ব আশরাফের হাতে সোপর্দ করে। অতঃপর তিনি আক্রমণ চালিয়ে ফিরিঙ্গীদের কবল থেকে উপকূলবর্তী অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।

তৃতীয় ঘটনা : ৭৩৬ হিজরীতে তাতারদের পতন। তাতার রাজা আবু সাঈদ খায়বান্দা ইব্‌ন আরগুন ইব্‌ন আবাগা ইব্‌ন হালাকু ইব্‌ন তুল ইব্‌ন চেঙ্গস খান-এর মৃত্যুর সাথে সাথে তাতারদের পতন ঘটে। তাঁর সম্পর্কে ইব্‌ন কাহীর (র) মন্তব্য করেছেন, “তিনি ছিলেন তাতার রাজদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, সর্বোত্তম পন্থার অনুসারী এবং সুন্নত অনুসরণে সর্বাধিক দৃঢ়। তার শাসনামলে আহলুস সুন্নাহ সম্প্রদায়ের উন্নতি হয় এবং রাফেষীগণ লাঞ্ছিত হয়। তার পিতার শাসনামলে এর বিপরীত ঘটেছিল। তার পরে তাতারী শাসন অক্ষুন্ন রাখার জন্যে কেউ মাথা তোলেনি। বরং তারা নিজেরা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়ে ছত্ৰভঙ্গ হয়ে যায়।(১৬) ইব্‌ন কাসীর (র) অন্যত্র বলেছেন, “রাজা আবু সাঈদ তাঁর পিতা খরবান্দার পরে শাসনভার গ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়সে তিনি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি ন্যায়বিচার ও সুন্নত প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেন। ফলে সকল প্রকারের বিশৃংখলা, অনাচার ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্তিমিত হয়ে পড়ে।(১৭) অবশ্য কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে আমরা উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে গণ্য করি না। এতদ্বারা আমরা সে সকল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বুঝাচ্ছি যা বিভিন্ন গোত্র ও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ও ফিরিঙ্গীদের মধ্যে স্থাপিত হয়। এর একটি হল দামেশক অধিপতি সালিহ ইসমাঈল কর্তৃক সায়দা ফিরিঙ্গীর নিকট সাকীফ আরানুন দুর্গ অর্পণ করা। খতীব শায়খ ইযযুদ্দীন ইব্‌ন আবদুস সালাম ও মালোকী সম্প্রদায়ের শায়খ আবু আমর ইব্‌ন হাজেব সুলতানের এই সন্ধি ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। ফলে সুলতান এদের দু’জনকে কারারুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে ছেড়ে দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখেন।(১৮)

এ বিষয়ে অপর একটি ঘটনা হচ্ছে দুই মিত্ৰ শক্তির উত্থান। এক পক্ষে ছিল ফিরিঙ্গীরা, দামেশক অধিপতি সালিহ, কুর্ক অধিপতি নাসির দাউদ এবং হিমস অধিপতি মনসুর। অন্য পক্ষে ছিল খারিযিমিয়্যাহ ও মিসর অধিপতি সালিহ। আইয়ুব।(১৯) ফিরিঙ্গী ও তাদের মুসলিম মিত্রদের মধ্যে অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়।

পরবর্তী সময়ে মৈত্রী সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রথম পক্ষে আসে ফিরিঙ্গীরা ও মিসরীয় সৈন্যগণ আর দ্বিতীয় পক্ষে থাকেন সিরিয়া অধিপতি ও বাগদাদের আকবাসী খলীফা। খলীফা। তখন মিসরের সুলতান ও সিরিয়ার সুলতানের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্যে শায়খ নাজমুদ্দীন বাদরাঈকে প্রেরণ করেন। তখন উভয় পক্ষের সৈন্যগণ প্ৰচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তিনি উভয় পক্ষের মাঝে বিরোধ মীমাংসা করে সন্ধি স্থাপন করে দিলেন। মিসরীয় সৈনিকগণ তখন ফিরিঙ্গীদের (ইউরোপীয় খৃস্টানদের) দিকে ঝুকে পড়েছিল এবং যুদ্ধে ফিরিঙ্গীদের সাহায্য কামনা করেছিল। তারা ফিরিঙ্গীদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে, ফিরিঙ্গীরা যদি তাদেরকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সাহায্য করে তবে বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের হাতে সোপর্দ করা হবে।(২০)

অন্যান্য আরও কতক গোত্র ফিরিঙ্গীদের প্রতি আসক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। যেমন ঘটেছিল সুলতান আশরাফ খলীলের ক্ষেত্রে। পূর্ব থেকেই ফিরিঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাসরাওয়ান পর্বত ও জুরাদের দিকে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

তার সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্বে ছিলেন বুনন্দার। আর তার সহযোগিতায় ছিল শানকার আল-আশকার।(২১) মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকগণ ফিরিঙ্গীদের সাথে উপহার-উপঢৌকন বিনিময় করতেন। ফিরিঙ্গী রাজার দূত যখন আশরাফের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিল, তখন তার সাথে ছিল সাদা পশম বিশিষ্ট্র একটি বিরল প্ৰজাতির ভালুক, যার লোম ছিল সিংহের লোমের ন্যায়।(২২) ফিরিঙ্গীদের ও কতক শাসকের মধ্যকার এই সুসম্পর্কপূর্ণ মৈত্রী ও উপঢৌকন বিনিময় ছিল অনেকটা বিরল ঘটনা। তার তুলনায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদী তৎপরতা ছিল অনেক বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী। প্রকাশ থাকে যে, এসব সম্পর্ক স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজত্ব দখলের লড়াইয়ে আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে বহিঃশত্রুর সাহায্য গ্রহণ ও শক্তি সঞ্চয় করা। সুতরাং এসব মৈত্রী চুক্তি ছিল একান্তই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

(৪) অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা

সে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল ভয় ও ত্ৰাস। সে ভীতি ও ত্রাসের উৎস ছিল তাতাররা। বছরের পর বছর ধরে উত্তাল তরঙ্গের মত তারা হানা দিতে থাকে।

ইব্‌ন কাছীর (র) মানুষের এই সন্ত্রস্ত ভাবকে এভাবে বর্ণনা করেছেন : “সংবাদ প্রচারিত হল যে, তাতাররা সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা মিসরেও হানা দেবে। ফলে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এবং তারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। তারা পালাতে থাকে মিসরের ছোট ছোট শহর, কুরক, শূবাক ও সংরক্ষিত দুর্গগুলোর দিকে। উট বিক্রি হতে লাগল হাজার দিরহামে, গাধা পাঁচশ’ দিরহামে এবং গৃহের আসবাবপত্র ও খাদ্য-সামগ্রী পানির দরে বিক্রি হতে লাগল। শহরে ঘোষণা দেয়া হল-কেউ যেন পরিচয়পত্র ছাড়া পথে বের না হয়। পরে সংবাদ এল যে, মিসরের সুলতান শক্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সিরিয়া অভিমুখে বের হওয়ার পর পুনরায় মিসর ফিরে এসেছেন। এতে ভীতি আরো বহুগুণ বেড়ে গেল এবং অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ল। এদিকে খাদ্যাভাব, অতি বর্ষণ, প্রচণ্ড শীত, ক্ষুধা ও আকালের কারণে পশুপাল দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে পড়ে।”(২৩)

তাতারদের ত্রাস এই ভীতিকে আরও তীব্রতর করে তোলে। তারা লাখ লাখ লোককে জবাই করে। বাড়িঘর ও প্রাসাদ-অট্টালিকা ধ্বংস করে, ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং গাছপালা নিমূল করে। তাতারদের ‘কাতীআ’ অঞ্চলে উপস্থিতি ইব্‌ন কাসীর (র) এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “তাতাররা যখন দামেশকের নিকটবতী ‘কাতীআ’ অঞ্চলে পৌছে, তখন কাতীআ ও তার আশে-পাশে কোন লোক ছিল না। শহর ও দুর্গসমূহ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। বাড়িঘর ও পথে-ঘাটে ভিড় জমে গেল। শহরে তখন কোন শাসক ছিল না, চোর-ডাকাতরা শহরে ও বাগ-বাগিচায় ঢুকে পড়ে। তারা সবকিছু ভেঙ্গে-চুরে দুমড়ে-মুচড়ে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং যতটুকু পারল লুটপাট করে নিয়ে গেল। খুব্বানী, গম ও সকল শাক-সবজি সময়ের পূর্বেই কেটে তুলে নিয়ে যায়।”(২৪)

এ ভীতি তাতারদের সৃষ্ট সন্ত্রাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাতাররা এবং ফিরিঙ্গীরা উভয় দলই এই ধ্বংসযজ্ঞে কাধে কাধ মিলিয়ে অংশগ্ৰহণ করে | তাতাররা যা করেনি ফিরিঙ্গীরা তা ষোলকলায় পূর্ণ করে। তারা ৭৬৭ হিজরীতে আলেকজান্দ্ৰিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে এবং ৪০০০ লোককে বন্দী করে এবং সাধ্যমত ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে সমুদ্রপথে নিয়ে যায়। চারদিকে তখন শুধু ক্ৰন্দন, আর্তনাদ, হাহাকার, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ ও আশ্রয় প্রার্থীনা, হৃদয়বিদারক আহাজারী যা দেখে চােখ অশ্রুসজল হয়। আর কান বধির হয়ে যায়।(২৫) ভয় শুধু বহিরাগত শক্ৰদের পক্ষ থেকে ছিল না, অভ্যন্তরীণ অশান্তি ও বিপর্যয়ের ভয়ও ছিল। উদাহরণ স্বরূপ হাম্বলী সম্প্রদায় ও শাফিঈ সম্প্রদায়ের মধ্যে আকীদা সম্পর্কিত বিষয়ে সংঘটিত দাঙ্গাহাঙ্গামার উল্লেখ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দামেশকে পর্যন্ত গড়ায় এবং উভয় পক্ষ নায়েবে সুলতান টাংকর’-এর দপ্তরে উপস্থিত হয়। তিনি তাদের মধ্যে আপস রফা করে দেন।(২৬)

নিরীহ মানুষদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার ক্ষেত্রে উগ্ৰপন্থী দলগুলোর প্রভাব ছিল। এসকল দলের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করার ব্যাপারে গভর্নরদের কোন গরজ ছিল না। তবে শাংকল মাংকল একবার হুরান অঞ্চলে ওদের একটি দলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে তাদের খণ্ডিত শিরাগুলো বুসরার প্রাচীরের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।(২৭)

এ সময়ে শুধু অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গুপ্তঘাতকদের ভীতি ছিল তা নয় বরং তখন একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটেছিল। কখনো কখনো দলে দলে পঙ্গপাল উড়ে এসে ক্ষেত-খামার ও ফলমূল, বৃক্ষের পাতা খেয়ে নিঃশেষ করে দিত। তখন পত্র-পল্লবহীন গাছগুলো লাঠির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকত। মানুষের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। আর মৃত্যু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাথে সাথে ভূমিকম্পে মানুষের বাড়িঘর ও যানবাহন ধ্বংস এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল। এর সাথে প্ৰলয়ঙ্করী বন্যা ও প্লাবন দেখা দেয়। ফলে শহর ও নগর ধ্বংস হয় এবং প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। নীলনদ থেকে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার উঠে পানিতে শহর-নগর ডুবে যায় এবং বহু লোকজন মারা যায়। প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এটি সংক্রামিত হতে থাকে শহর থেকে শহরে, নগর থেকে নগরে। ফলে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং এতে মানুষের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।

————————

(১) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২১৫।

(২) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬২।

(৩ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩।

(৪) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৫

(৫) আল মুসতাসিম বিল্লাহ : আবু আহমদ আবদুল্লাহ ইব্‌ন আল-মুসতানসির বিল্লাহ। জন্ম ৬০৯ হিজরীতে, খিলাফতের বায় আত ৬৪০ হিজরীতে। নিহত ৬৫৬ হিজরীতে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর। খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন ১৫ বছর।

(৬) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২১৬।

(৭) যাহির হল রুকনুদ্দীন বায়বার্স আল বুন্দুকদারী। সুলতান মালিক মুযাফফর কুতুযকে হত্যার পর লোকজন তাঁকে আল-মালিকুয যাহির উপাধি প্ৰদান করে। ৬৫৮ হিঃ সনে তিনি মিসর গমন করেন এবং সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক বছরের মধ্যে সিরিয়ার শাসন ক্ষমতা একে একে নাসির উদ্দীন ইব্‌ন আমীয তারপর হালাকু এবং তারপর মুযাফফর কুতুয্যের হাত বদল হওয়ার পর যাহির বায়বার্সের হাতে এসে স্থির হয়। অবশ্য আল মুজাহিদ নাম নিয়ে সানজার তাঁর সাথে প্রথমে অংশীদারিত্ব নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাহির-ই একচ্ছত্র সুলতানাতের অধিকারী হন।

(৮) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২৪৫।

(৯) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৫।

(১০) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫০।

(১১) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ-১৪, পৃঃ ২১৯৷

(১২) প্রাগুক্ত, খঃ ১৩, পৃঃ – ৩১৯।

(১৩) প্রাগুক্ত, খঃ ১৩, পৃঃ – ৩৫৪।

(১৪) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২১৯৷

(১৫) প্রাগুক্ত, খঃ ১৩, পৃঃ ২৩৫।

(১৬) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৮২৷৷

(১৭) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৭৯।

(১৮) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ১৬৬।

(১৯) প্রাগুক্ত, খঃ ১৩, পৃঃ ১৭৫ – ১৭৬।

(২০) প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৬।

(২১) প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৪৬, ৩৪৭।

(২২) প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫১।

(২৩) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫, ১৬।

(২৪) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪।

(২৫) প্রাগুক্ত, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৮।

(২৬) ইব্‌ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৭৭৷

(২৭) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৭, ২৭৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *