৯. শিরোনামকারী
ইংল্যাণ্ড সফর (১৯৩০) থেকে ফিরে আসামাত্র ডনকে ঘিরে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়। সফরকালে একটি পত্রিকায় তার আত্মজীবনী ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। অস্ট্রেলীয় দলের ম্যানেজার এটা পছন্দ করেননি। তিনি অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডকে ব্যাপারটা জানান। অমনি রটে যায় ডনের সঙ্গে বোর্ডের ঝগড়া হয়েছে। রটনা এমন জায়গায় পৌঁছোয় যে, বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয় যে এসব মিথ্যা, অন্যায় কথা। দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকেরা ঝগড়া পাকাবার জন্যই এসব রটাচ্ছে।
ইংল্যাণ্ড থেকে জাহাজে অস্ট্রেলীয় দল অ্যাডিলেডে পৌঁছোয়। যে সম্পত্তি-দালালের অফিসে ডন চাকরি করত তার ব্যবসায়ে মন্দা পড়ায় সেটা ছেড়ে দিয়ে সিডনিতে ক্রীড়া সরঞ্জামের এক প্রতিষ্ঠানে সেচাকরি নিয়েছিল। তারা জাহাজেই টেলিগ্রাম করে ডনকে বলে তাড়াতাড়ি সিডনিতে চলে এসো। ডন জাহাজ থেকে অ্যাডিলেডে নেমে বিমানে সিডনি পৌঁছোয় দলের সকলের আগে।
সকলের আগে দেশে ফিরেছে, তার ওপর সফরের প্রধান নায়ক সুতরাং সাংবাদিকরা, ফোটোগ্রাফাররা ঝাঁপিয়ে পড়ল। এরপরই ডনের প্রতি ক্রিকেট জগতের প্রথম ঈর্ষা প্রকাশ পেল। রটনার মধ্য দিয়ে এই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা হল, প্রশংসা ও স্তুতি নিজে সবটা দখল করার জন্যই ডন সবার আগে দেশে ফিরেছে। ওকে বলা হল ‘প্রশংসা-শিকারি’।
ব্যাপারটা কিন্তু আদপেই তা নয়। ডন বরাবরই প্রচার জিনিসটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজের ব্যাটিং, ফিল্ডিং এবং পরে অধিনায়কত্ব সম্পর্কে রচনা পাঠ করেই সেখুশি, তার বেশি আর কিছু সেচায়নি। তার পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সমালোচনা সেঅকুন্ঠে মেনে নেয়, যদি তা বিদ্বেষপ্রসূত না হয় এবং যুক্তিপূর্ণ হয়। তার খেলা যে জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, এটা বোঝার মতো বোধ তার ছিল। সুতরাং সমঝদারদের সঙ্গে নিজের খেলা নিয়ে আলাপ করতে তার আপত্তি হত না। কিন্তু কোনো সাংবাদিক যদি তার সম্পর্কে বেফাঁস কিছু লিখত, তাহলে ডন তার সঙ্গে আর কখনো কথা বলত না।
মাঠের বাইরে ডন নিজের জীবনকে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপাররূপে গণ্য করত। তার বন্ধুবান্ধব, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, পছন্দ-অপছন্দ, মতামত এইসব তার ব্যক্তিগত জীবনের এক-একটি অংশ, এগুলি নিয়ে কথা বলায় তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। সাংবাদিকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করেও এ সম্পর্কে তার মুখ খোলাতে পারেনি, ব্যক্তিগত প্রশ্ন বা রাস্তায় বেরোলে ছবি তোলা, ডন রীতিমতো ঘৃণা করত। ডন কিছুতেই ভেবে পেত না সাফল্যের জন্য তাকে কেন এইভাবে দাম চোকাতে হবে। কিন্তু ডন এটাও বুঝতে পারেনি, লোকে ডন ব্র্যাডম্যানের বিষয়ে যতটা জানতে চায়, ততটুকু তারা পাচ্ছে না। অবশ্য খবরের কাগজ তার সম্পর্কে যথেষ্ট খবরই তাদের দিচ্ছিল।
ডনের সম্পর্কে প্রকাশিত খবরগুলি বিশ্লেষণ করে একজন তিন মাস সময়ের মধ্যে নিম্নোক্ত খবরগুলি পেয়েছেন :
ডন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে।ডন ইংল্যাণ্ডে বসবাস করতে যাচ্ছে।
ডন ইংরেজ মেয়ে বিয়ে করবে।
ডন মঞ্চে নামছে।
হলিউড ফিলম ডন অভিনয় করবে। রক্তাল্পতা ডনের খেলা শেষ করে দিচ্ছে।
ইংলিশ কাউন্টিতে ডন খেলবে।
এর একটাও সত্য প্রমাণিত হয়নি! এরপরই খবরের কাগজে ডনকে নিয়ে আর এক ঝড়ের খবর বেরোল। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগ ক্রিকেটের অ্যাক্রিংটন ক্লাব ডনকে প্রস্তাব দেয় তাদের ক্লাবে খেলার জন্য। খবরটা অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশ হওয়া মাত্র সেখানে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যেন কোনো দেশ পারমাণবিক ফর্মুলা চুরি করার চেষ্টা করছে।
ইংল্যাণ্ডের কী স্পর্ধা, ডনকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে চায়! খবরের কাগজে নানান খবর, অজস্র চিঠি ছাপা হতে লাগল। এক কাগজ লিখল, ‘ডন মনস্থির করে ফেলেছে; সেযাবেই!’ অন্য কাগজ জোর দিয়ে লিখল, ‘ডন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, অস্ট্রেলিয়াতেই থাকবে।’ তাড়া তাড়া চিঠি আসতে লাগল ডনের কাছে; উপদেশ, পরামর্শ আর অনুনয়ে সেগুলো ভরা। কেউ লিখল, দেশত্যাগ করলে তাকে দেশদ্রোহী বলা হবে; কেউ লিখল, নিজের আখেরটা আগে গুছিয়ে নাও। যে যা-ই বলুক কান দিয়ো না। যদি যেতে চাও তো চলে যাও।
আসলে ডন ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে, সেকী করবে। তার অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ ছিল না, তবে প্রস্তাবটায় কর্ণপাত করতেও তার আপত্তি ছিল না। চারিদিকে লেখালেখি হইচই-এর ফলে ডনের কাছে বহু পালটা প্রস্তাব এল। ক্রিকেট সম্পর্কে খবরের কাগজে লেখা ও বেতারে আলোচনা করার একটি প্রস্তাব পেয়ে সেতা নিয়ে নিল। এর অর্থ ডন দেশেই থেকে যাচ্ছে, অতএব জাতীয় সংকটও কেটে গেল।
১৯৩০-৩১ মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে অস্ট্রেলিয়া সফরে। দলটা খুব শক্ত ছিল না, জিতেছিল শুধু শেষ টেস্টটি ভিজে উইকেটে। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রত্যেকটিই ইনিংস ও ১০০ রানেরও বেশি ব্যবধানে। মাত্র পঞ্চম টেস্ট ছাড়া ডন আর কোনো ম্যাচে এক বারের বেশি ব্যাট করেনি। তাতেই সেতিন বার নিজেকে আলোচনার বিষয় করে ফেলল, তৃতীয় টেস্টে ২৩৩ ও চতুর্থে ১৫২ রান এবং পঞ্চম টেস্টে শূন্যরান করে। ফাস্ট বোলার গ্রিফিথের একটি মন্থর বলকে লেগে ঘোরাতে গিয়ে ডন বোল্ড হয়।
টেস্ট সিরিজ শেষে অ্যালান কিপ্যাক্সের নেতৃত্বে একটি দলের সঙ্গে ডন উত্তর কুইন্সল্যাণ্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলস সফর করে। ব্ল্যাকহিথে লিথগো দলের বিরুদ্ধে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির প্রদর্শনী ম্যাচে ডন ২২ বলে শতরান করে তিনটি আট বলের ওভারে! আসলে করেছিল ২৫৬ রান, তাতে ছিল ১৪টি ছয় ও ২৯টি চার। প্রথম ওভারেই ৩৮ রান করার পর ডন তিন ওভারে যুক্ত হওয়া ১০২ রানের মধ্যে নিজে করে ১০০ রান। প্রথম ওভারে ডনের স্কোর— ৬, ৬, ৪, ২, ৪, ৪, ৬, ১। দ্বিতীয় ওভারে— ৬, ৪, ৪, ৬, ৬, ৪, ৬, ৪। তৃতীয় ওভারে তার জুড়ি ওয়েণ্ডেল বিল ১ রান নেওয়ার পর ডন ৬, ৬, ১ রান করে। ওয়েণ্ডেল বিল তারপর ১ রান এবং ওভারের বাকি বলে ডন ৪, ৪, ৬ করে। মোটামুটি মিনিট পনেরোর মধ্যেই এই তিন ওভারের ব্যাপারটা সম্পন্ন হয়।
এই হচ্ছে সেই ডন, যার খেলা দেখতে লোক পাগল হয়। যেখানে খুশি বল মেরে পাঠায়। যত খুশি বোলার বদল হোক, ডন যেখানে মনে করবে সেখানেই বল পাঠাবে। লিথগো দলের হতভাগ্য বোলারদের মধ্যে ছিল বব নিকলসন। সেই মরসুমের শেষে ১৯৩২-এর ৩০ এপ্রিল ডনের বিয়ের দিন বব সিডনিতে এসে বিয়ের আসরে গান গেয়েছিল। ডনের ব্যাটিং তাকে মুগ্ধ করেছিল।
একবার সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার ফ্লিটউড স্মিথ বল করেছিল ডনকে। নাগাড়ে বল, করে যাচ্ছে অফব্রেক বল আর ডন মিড অফ এবং এক্সট্রা কভার পয়েন্টের মাঝের ফাঁক দিয়ে সেগুলো বাউণ্ডারিতে পাঠাচ্ছে।
অবশেষে ডন বোলারকে বলল, ‘ব্যাপার কী, ফাঁকটা বন্ধ করছ না কেন? যত বার অফব্রেক দেবে তত বারই যে আমি ওই ফাঁকটা দিয়ে বল পাঠাব।’
ডনের পক্ষে তা সম্ভব, তাই একজন ফিল্ডসম্যান রাখা হল সেই ফাঁকে। মুচকি হেসে বোলার বলল, ‘এবার কী করবে?’
‘এবার,’ একগাল হেসে ডন বলল, ‘এবার তোমায় গ্যালারিতে পাঠাব।’ এবং পাঠিয়েও ছিল।
চ্যাটসউডে গর্ডন দলের বিরুদ্ধে ডন ১৭১ মিনিটে ২০১ রান করে। দ্বিতীয় শতরানটি ৪৫ মিনিটে। একটা হাফভলি বলে সেওভার বাউণ্ডারি মেরেছিল পয়েন্ট দিয়ে। একজন ফিল্ডার বলল, এটা মিস হিট থেকে হয়ে গেছে। পরের ওভারে ডন একইভাবে বল মেরে পয়েন্ট থেকেই ছয় রান পায়। মাঠটা অবশ্য ছোটো ছিল।
লর্ডসে ১৯৪৮-এ ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি দেখল দুই ফিল্ডারের মাঝ দিয়ে ডন বার বার বল ড্রাইভ করে যাচ্ছে। ফাঁকটা বন্ধ করার জন্য সেএকজন ফিল্ডারকে সরিয়ে আনল। ডন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে শুধু দেখল। পরের বলটি সেভাবলেশহীন মুখে ঠিক সেই জায়গাটিতেই পাঠাল, যেখান থেকে ফিল্ডারটিকে সরিয়ে আনা হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ পেলে বিশেষ কোনো মার ডন আবার মেরে দেখাতে পারত।
দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট দল ১৯৩১-৩২ মরসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে। অস্ট্রেলিয়া সহজে পাঁচটি টেস্টেই জেতে প্রধানত ডনের জন্য। চারটি টেস্টে খেলে সেচারটি শতরান করে : ২২৬, ১১২, ১৬৭ ও ২৯৯ নট আউট। অন্য দুটি ম্যাচেও দুটি শতরান করে সফরকারীদের বিরুদ্ধে : ১৩৫, ২১৯। সিরিজে চারটি টেস্টে তার গড় ছিল ২০১.৫ রান। ডন পঞ্চম টেস্টেও দলে ছিল। ফিল্ড করতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং রুমে পা মচকে যাওয়ায় ব্যাট করতে পারেনি। ক্ল্যারি গ্রিমেট দলে থেকেও ব্যাট করেনি। করার দরকার হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৬ ও ৪৫ রানে আউট হয়। আয়রনমঙ্গার ২৪ রানে ১১ উইকেট নেয়। এই সিরিজে ৮০৬ রান করার পর ডন বিনীতভাবে বলেছিল, ‘খারাপ ফিল্ডিংয়ের জন্যই রান পেয়েছি।’
ডন একদিন এক খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে; তখন ঢুকছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার স্যান্ডি বেল। ডনের অপস্রিয়মাণ চেহারার দিকে তাকিয়ে বেল মন্তব্য করে : ‘এই সফরে এই প্রথম আমি এর পিঠ দেখলাম!’
কুইন্সল্যাণ্ডের ‘কুকটাউন ইন্ডিপেণ্ডেন্ট’ নামে এক খবরের কাগজ এই টেস্ট সিরিজ চলাকালে ডনকে পরলোকে পাঠিয়ে দেয়। তারা লেখে : ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের পরলোকগমনে অস্ট্রেলিয়া আজ শোকাহত। ব্রিসবেন টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ডন ব্র্যাডম্যান আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে শনিবার মারা গেছেন।’
খবরটি পড়ে ডন খুব হেসেছিল। খুব কম লোকেরই নিজের মৃত্যুসংবাদ পাঠের ভাগ্য হয়। এই সময় সেজনপ্রিয়তার তুঙ্গে আরোহণ করেছিল। ট্রেনে কোথাও গেলে প্রত্যেক স্টেশনে দলে দলে ক্রিকেটপাগলরা তার নাম ধরে কামরায় কামরায় খোঁজাখুঁজি করে, রাস্তায় বেরোলে ভিড় জমে যায়। নীরব, নির্বিবাদী ডনের পক্ষে এই বীরপূজা সামলাতে যে ধকল সহ্য করতে হচ্ছিল, তাতে মানসিক দিক থেকে তার ক্ষয় হত।
বাওরালের লোকেরা তাকে উপহার দেয় সোনার ঘড়ি ও চেন। এক মোটর গাড়ির প্রতিষ্ঠান দেয় নতুন একটি স্পোর্টস কার। এই সময় সারা অস্ট্রেলিয়ার চোখে ডন ছিল ভগবানের প্রায় সমতুল।
ডন আবার খবরের কারণ হল ১৯৩২-এর এপ্রিলে বিয়ে করে। বধূ জেসি মেঞ্জিস সিডনিতেই ব্যাঙ্কের চাকুরিয়া। ডনের গ্রাম বাওরালের কাছেই মিটাগং-এর মেয়ে। স্কুল থেকেই দুজনের ভাব। এই মিটাগংয়েই ডন প্রথম শতরান করেছিল ছাত্রাবস্থায় এবং ব্যাটটি ভুলে ফেলে রেখে এসেছিল।
অত্যন্ত সুখের বিবাহ হয়েছে ডনের। পরে সেবলেছিল, ‘এমন অনেক সময় জীবনে এসেছে যখন ওকে ছাড়া আমার পক্ষে চলা একদমই সম্ভব হত না।’ বিয়ের পরই উত্তর আমেরিকা সফরে ডনের সঙ্গে জেসিও যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই সফরের উদ্যোক্তা ছিলেন আর্থার মেইলি। আমেরিকানরা প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিল দলে ডন না থাকলে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই ক্রিকেট সম্পর্কে। মেইলিও ডনকে বলে, তোমাকে যেতে হবেই। ডন দেখল, এই সফরে খেলতে হবে মজা করে সুতরাং আপত্তির আর কারণ কী!
প্রথম খেলা ভ্যাঙ্কুভার আইল্যাণ্ডে ১৮ জনের এক দলের বিরুদ্ধে। ওরা করে ১৯৪। অস্ট্রেলীয়রা ৮ উইকেটে ৫০৩। ম্যাককেব করে ১৫০। অধিনায়ক রিচার্ডসন ও ডন ৭ মিনিটে তোলে ৫০ রান। ঝোপঝাড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় ছয়টি বল। পরের ম্যাচে ডন ছয়টি উইকেট পায় আট বলের এক ওভারে, কিন্তু হ্যাট্রিক হয়নি।
নিউ ইয়র্কে ডন খুশি হয়েছিল রাস্তায় বেরিয়ে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না, অটোগ্রাফের বই এগিয়ে দিচ্ছে না। আর খুশি হয়েছিল বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় বেব রুথের সঙ্গে আলাপ করে। ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান যা, বেসবলে বেব রুথ তাই। যুক্তরাষ্ট্রে ওরা মজা করেই ক্রিকেট খেলেছে। কোনো ম্যাচে হয়তো আম্পায়ার খেলা ফেলে রেখে কথা বলতে চলে গেল বাউণ্ডারির ধারে; কোনো ম্যাচে দুই আম্পায়ারের একজন ছয় বলে অন্য জন আট বলে ওভার দিয়েছে; কোনো ম্যাচে বিপক্ষ দলে ১৬ বা ১৭ জন করে খেলেছে। একটি খেলায় আম্পায়ার ছিল চিউইং গামের ব্যবসায়ী। মাঠেই সেখেলোয়াড়দের মধ্যে তার ব্যাবসা সামগ্রীর নমুনা বিতরণ করে এবং হাওয়ায় বেল পড়ে যাচ্ছে দেখে স্থানীয় ব্যাটধারীরা চিউইং গাম দিয়ে স্টাম্পের ওপর বেল আটকে রাখে। একজনকে স্টাম্প আউট করা হলে বেলটি আঠায় ঝুলতে ঝুলতে যতক্ষণ-না ভূমি স্পর্শ করেছে ততক্ষণ আম্পায়ার আউট দেওয়া থেকে নিবৃত্ত ছিল। একটি খেলায় অসমান খারাপ পিচ সম্পর্কে অনুযোগ করায় স্থানীয় কতৃপক্ষ পিচে জল ঢেলে দেয় যাতে বল আর না লাফায়।
একবার বিপক্ষের ১৭ জন ব্যাট করে ও ১৪ জন বল করে। সান ফ্রান্সিসকোয় একটি ম্যাচে বিপক্ষের ১৫ জন ২০ রানে আউট হয়। ডন কয় বার মাত্র বল ছুঁয়েছিল— তিনটি ক্যাচ ধরা ও চারটি রান আউটের জন্য।
আড়াই মাসে অস্ট্রেলীয় দলটি ছয় হাজার মাইল অতিক্রম করে। ডন ৫১ ইনিংসে করে ৩,৭৭৯ রান। ক্রিকেট উচ্চ পর্যায়ের ছিল না, কিন্তু ডনের জীবনের অন্যতম সুখের কাল ছিল এই আড়াই মাস। কিন্তু ঝড় যে আসছে, তার পূর্বাভাস ঘুণাক্ষরেও ডন তখন জানত না। বছর ঘোরার আগে ক্রিকেটের ইতিহাসের সবথেকে প্রলয়ংকর ঘটনার কেন্দ্রে সেএসে গেল। ঝড়ের নাম : ‘বডিলাইন’।