২০. প্রবাদ এবং মানুষটি
ক্রিকেটের ইতিহাসে কোথায় কোন ক্রিকেটারের স্থান হবে, তাই নিয়ে তর্ক চলবে যতদিন ক্রিকেট বেঁচে থাকবে।
ডনের স্থান কোথায় হবে?
যেকোনো ব্যাটসম্যানের থেকে সেবেশি প্রথম শ্রেণির দ্বিশত ও ত্রিশত রান করেছে।
একদা সর্বোচ্চ রান ছিল তারই—অপরাজিত ৪৫২। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে শতরান করেছে, এক দিনে করেছে ৩০০ রান। পর পর ছয় ইনিংসে ছয়টি শতরান আছে তার।
টেস্ট ক্রিকেটে তার থেকে বেশি রান আছে অন্যের, কিন্তু গড় ৯৯.৯৪? ধারেকাছে কেউ নেই। টেস্টে আশি ইনিংসে ৬,৯৯৬ রান এবং দশ বার অপরাজিত থাকার সুবাদে এই গড়। মাত্র চার রান অর্থাৎ বাউণ্ডারিতে এক বার বল পাঠালেই তার টেস্ট গড় ১০০ হত। ওভালে তার শেষ টেস্ট ম্যাচে হোলিজের বলটি না ফসকিয়ে যদি কোনোভাবে বাউণ্ডারিতে পাঠাতে পারত…
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৩৮ ইনিংসে তার মোট রানসংখ্যা ২৮,০৬৭। ইনিংসপিছু গড় ৯৫.১৪ রান। এতে আছে ১১৭টি শতরান। ইংরেজ ছাড়া আর শুধু সোবার্সই মাত্র ডনের মোট রানসংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।
সারাজীবনে ডনের রানসংগ্রহের গড় হার ঘণ্টায় ৪২-এরও বেশি। বহু ক্ষেত্রে হারটা ৬০ রানেরও বেশি। একটিতে সেঘণ্টায় গড়ে ৯৪.১ হারে রান তুলেছে।
ডন ছিল বিশ্বের দ্রুততম ফিল্ডারদের একজন। প্রচন্ডভাবে বলকে তাড়া করে ছুটত, শূন্যে ক্যাচ তুলে নিত, অবিশ্বাস্য গতিতে উইকেটে ফিরিয়ে দিত।
বিরাট এবং শ্রদ্ধেয় অধিনায়ক ছিল।
ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি, ১৯৪৮-এ ডনের এক বিদায় সভায় ওঁর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার’। এই বিশেষণটিকে নিয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হবে এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চয়ই খুব কম। অনেকের মতে ডন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। জ্যাক হবসের ভক্তরা দাবি করেন ভিজে উইকেটে ডনের ব্যাটিংক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এজন্যই হবসের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে না। ডনের অনুগামীরা বলবেন, তাতে কী হয়েছে, শেষপর্যন্ত তো ডনই বেশি রান করেছে। ডনের টেস্ট গড় প্রায় ১০০, আর হবসের ৫৬.৯৪। তারা দেখাতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হবস প্রতি ছয় ইনিংসে একটি শতরান করেছে, ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ডনের শতরান প্রতি তিন ইনিংসে।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টর ট্রাম্পারকে অনেকেই চিরকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে থাকেন। ডন-অনুগামীরা বলবেন, ট্রাম্পারের গড় মাত্র ৩৯.০৪ এবং নয়-বার উইকেটে গিয়ে একটি শতরান করেছেন।
বস্তুত এভাবে তুলনা করার কোনো সার্থকতা নেই। ট্রাম্পার খেলেছেন ১৮৯৪ থেকে ১৯১৪; হবস ১৯০৫ থেকে ১৯৩৪ আর ডন ১৯২৭ থেকে ১৯৪৮।
ডন কখনো ট্রাম্পারকে খেলতে দেখেনি। ট্রাম্পারের আর ব্র্যাডম্যানের যুগের যোগসূত্র হবস। এই সময়ের মধ্যে পিচ এবং বোলিং টেকনিক বদলেছে, ফিল্ড সাজানোতেও পরিবর্তন ঘটেছে। তা ছাড়া ট্রাম্পার ও হবস ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান, ডন নামত তিন নম্বরে। তর্কের সময় সাধারণত এই কথাটা ওঠে যে, হবস ও ট্রাম্পার আরও ‘সম্পূর্ণ’ ব্যাটসম্যান। ডনের থেকে তাদের স্ট্রোকে পালিশ আরও বেশি। তবে সবাই স্বীকার করেন ডনই বৃহত্তম রান সংগ্রাহক। ওর উচ্চ রানের ইনিংসগুলি এমনই ও প্রায়শ ভয়ংকরভাবে গড়ে উঠত যে একসময় নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন :
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর সমগ্র খেলার জীবনে, যদি ম্যাচ খেলার আগে ওকে কিনে নেওয়ার বা আপোশ করার কোনো আইনানুগ উপায় থাকত তাহলে অধিকাংশ বোলারই ওকে কিনে ফেলত বা ব্যাট করবে না এই শর্তে ১০০ রান উপহার দিত।
দুঃখের কথা, ডন যন্ত্রের মতো রান তুলত এই ধারণাটাই বেশি চালু রয়ে গেছে। বিপুল হারে রান সেঅবশ্যই উৎপাদন করেছে, কিন্তু রানগুলির পিছনে ছিল কল্পনা, চিন্তা ও দুঃসাহস; এটা অনেকেই মনে রাখে না।
ডন ক্রিকেট ব্যাট তুলে রাখার পর থেকেই মাঠে মাঠে দর্শকসংখ্যা হ্রাস পায়। দর্শনির অঙ্ক কমে যায়। তারপর ইংল্যাণ্ডে যত অস্ট্রেলীয় দল সফরে গেছে, কেউ আর ভক্তবৃন্দের সেই পরিমাণ চিঠি পায়নি— ডন ও তার দল যত পেয়েছিল।
গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে। কোনোরকম সুযোগ বা সুবিধা নিয়ে ডন ক্রিকেটে আসেনি। নিজেই খেলা শিখেছে, একাকী। কিন্তু ক্রিকেটে সেনিয়ে আসে তোলপাড়-করা চাঞ্চল্য,প্রবল প্রেরণা আর একাগ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সফরে হোটেলের ঘরে টাইপরাইটার নিয়ে বসে সেএক-এক বারে ষাটটি চিঠির জবাব দিত।
ইংল্যাণ্ডে ১৯৪৮-এর সফরে এক ক্রিকেট ব্যাটপ্রস্তুতকারী কয়েক হাজার ব্যাটে সই দেওয়ার জন্য ডনের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রস্তুতকারী এজন্য কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ধরে নিয়েছিল। একদিন ভোরে ডন ব্যাট তৈরির কারখানায় হাজির হয়ে, গা থেকে কোটটি খুলে, ব্যাট নিয়ে বসল। মাঝে চা খাওয়ার জন্য থামা ছাড়া, ডন সেইদিনই কাজটা শেষ করে দেয়।
বলা হয় ডন নির্দয়ভাবে খেলত। কঠিনভাবেই ডন খেলেছে, কিন্তু হীনতা কখনো প্রশ্রয় পায়নি। বলা হত ডন অসামাজিক। ল্যাঙ্কাশায়ার সম্পাদক তাকে ক্লাবের সদস্যপদ দিয়ে যে-চিঠি লেখেন তাতে বলা হয় :
আমার কমিটি একথাটাও নথিভুক্ত করে রাখতে চায় যে, আপনার ব্যক্তিগত মাধুর্য, সৌজন্য, প্রীতিপূর্ণ সখ্যতা, সম্পূর্ণ দক্ষতা ও বিনয়গুণেই আজ ক্রিকেট এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
ডনের মনের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু বহু খেলোয়াড় তাকে বন্ধু হিসেবেই পেয়েছে। ১৯৫২-৫৩-তে জ্যাক চিথামের দক্ষিণ আফ্রিকা দল যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে ডন তাদের কাঁচা খেলোয়াড়দের নেটে নিয়ে গিয়ে, কতকগুলো স্ট্রোক কীভাবে করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছিল। বহু সময় ডন চিঠি লিখে খেলোয়াড়দের ত্রুটি জানিয়ে দিত, যাতে তাদের সাহায্য হয়। ১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া সফরে ডেনিস কম্পটনকে তার কতকগুলো ত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। অথচ তখন দ্বিতীয় টেস্ট চলছে এবং ডন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক। অমরনাথ বলেছিলেন :
ওঁর বিরুদ্ধে খেলতে ভালোবাসি এবং আমার সব খেলোয়াড়দেরও এই অভিমত কারণ উনি বিরাট খেলোয়াড় ও আদ্যন্ত ভদ্রলোক। প্রায়ই খেলার পর ব্র্যাডম্যান আসতেন এবং ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে কী কী ত্রুটি ঘটছে এবং কীভাবে সেগুলো শোধরানো যায় আমাদের খেলোয়াড়দের তা বলতেন।
ডন ক্রিকেটকে ভালোবাসে। খেলা ফেলে ক্রিকেট ভাঙিয়ে সেটাকার পিছনে কখনো ছোটেনি। ১৯৩৬-এ তাকে টোপ দেওয়া হয় টেস্ট ম্যাচ খেলার বদলে যদি রিপোর্ট লেখে তাহলে সেহাজার পাউণ্ড পাবে। ডন প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯৩৬-এ মরসুমশেষে তার কাছে প্রস্তাব আসে, নিউজিল্যাণ্ডে ক্রিকেট সম্পর্কে দিনে পনেরো মিনিটের দুটি বক্তৃতা যদি দেয়, তাহলে সপ্তাহে ১০০ পাউণ্ড ও যাবতীয় খরচখরচা পাবে। ডন যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য সপ্তাহে এক হাজার পাউণ্ডের প্রস্তাবেও ডন সাড়া দেয়নি। ১৯৪৮-এ ইংল্যাণ্ডের সংবাদপত্রগুলি আরও বেশি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল, ডন খেলার জন্য তাও অগ্রাহ্য করেছিল।
বাওরালের শৈশব থেকে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্র ‘ক্যানবেরা টাইমস’ ১৯৪৮-এ ডনের অবসর নেওয়ার সময় যে-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তা থেকে উদ্ধৃত করে বলা যায় :
এই সুদীর্ঘ সময়কালে তিনি লক্ষ লক্ষ কন্ঠ থেকে উল্লাসধ্বনি নি:সৃত করিয়েছেন এবং কোনো ধ্বনিতেই হিংস্রতা বা অসদিচ্ছা জড়িয়ে ছিল না। যদি হিসাব সম্ভব হয় তাহলে দেখা যাবে হিটলারের দাবিকৃত বা সংগঠিত যত ধ্বনি উত্থিত হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসধ্বনি ততটাই পেয়েছেন ব্র্যাডম্যান। হিংস্রতার মানবটি নিজের ধ্বংস নিজ হাতেই করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও মারা যাচ্ছে এবং তার কাজের জন্য কষ্টভোগ করছে।
কিন্তু এমন কোনো নারী, পুরুষ বা শিশু নেই যে ব্র্যাডম্যানের খেলার জীবন থেকে সহানুভূতি ও প্রেরণা ছাড়া আর কোনো ক্লেশ পেয়েছে। বিশ্ব-ইতিহাসে বরণীয়রূপে যাচাই হওয়ার এইটাই কষ্টিপাথর।
আর ডন বলেছে :
আমার জন্মের বহু আগে থেকেই ক্রিকেট খেলা চলেছিল, আমার মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরও খেলা চলবে। ঠিক যেভাবে একজন পিয়ানোবাদক বিঠোফেনের রচনাবলি ব্যাখ্যা করে, সেইভাবেই আমার বোধ-বুদ্ধি-ক্ষমতা অনুসারে ক্রিকেটের চরিত্রকে জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করার সুযোগ খেলার জীবনে পেয়েছিলাম।
…ভবিষ্যতে যে-মানুষেরা আমাদের ভাগ্যকে পথ দেখিয়ে দিয়ে যাবে, তাদের দরকার হবে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধ। তাদের সজাগ থাকতে হবে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে।
সন্দেহ নেই, ক্রিকেটের আইন এবং এই খেলার পরিচালন পদ্ধতি বিশ্বের কাছে এক বিরাট দৃষ্টান্ত। এই উত্তরাধিকারটি সম্পর্কে আমাদের সকলের গর্ববোধ করা উচিত…
এবং ক্রিকেট গর্ববোধ করে তার ডনের জন্য। বিশ্বের কাছে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধের বিরাট দৃষ্টান্ত ক্রিকেটের ডন।