১৮. শেষ সফর
অধিনায়কের থেকে যদি দলে তার অধীনস্থ কয়েক জনের খেলার বয়স বেশি হয় তাহলে অধিনায়কের যে কী অসুবিধা হয় সে-অভিজ্ঞতা ডনের আছে। কিন্তু ১৯৪৮-এর ইংল্যাণ্ড সফরের জন্য দলে ৪০ বছর বয়সি ডনই সর্বজ্যেষ্ঠ। দলের কেউ তার বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এমন ভয় নেই। স্বচ্ছন্দ মুক্ত মেজাজে সেতার সৃজনশীল ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত বিচারবোধকে প্রয়োগ করতে পারবে। ডন এমনটিই চেয়েছিল। এমন একটি দল, যাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রশ্নাতীত হবে, যারা তাকে পিতার মতো অনুভব করবে, উপদেশে কান দেবে, নির্দেশ মেনে চলবে এবং প্রশ্ন তুলবে না।
ডনের ধারণা, যে ক-টি দলের সঙ্গে সেইংল্যাণ্ড সফর করেছে, টেকনিক্যাল দিক থেকে ১৯৪৮ দলটিই তার মধ্যে সেরা। দলে আছে দুজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান বার্নেস ও মরিস, তার সঙ্গে বিল ব্রাউন; তারপর ডন নিজে, হ্যাসেট, হ্যামেন্স, হার্ভে, অলরাউণ্ডার মিলার ও লক্সটন; বোলার লিণ্ডওয়াল, জনসন, ম্যাককুল, রিং ও টোশাক; উইকেট-কিপার ট্যালন ও স্যাগার্স।
অস্ট্রেলীয় দলকে নিয়ে জাহাজ ১৯ মার্চ নোঙর তুলল পারথ বন্দর থেকে, ইংল্যাণ্ডের টিলবেরি বন্দরে পৌঁছোল ১৬ এপ্রিল। এর মাঝে তাদের সই করতে হয়েছে দলের ৫ হাজার গ্রূপ ছবিতে। খেলেছে কলম্বোয়। বোম্বাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি অ্যান্টনি ডি মেলো, বিজয় মার্চেন্ট প্রভৃতি ব্যক্তিরা জাহাজে এসে ডনকে ভারতীয় ব্লেজার ও দলের অন্যান্য সদস্যদের টাই উপহার দেন। জাহাজে তার দলের অন্যান্যদের সঙ্গে ট্যাকটিকস বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও আর একটি ব্যাপার ডন তাদের মনের গভীরে গেঁথে দেয়—এই দল অপরাজিত থাকার ক্ষমতা রাখে।
এ পর্যন্ত কোনো অস্ট্রেলীয় দল সফরে অপরাজিত থাকেনি। ডন চেয়েছিল ১৯৪৮ সফরে অপরাজিত থাকতে। তার বিদায় মরসুমটিকে স্মরণীয় করে রাখতে।
যথারীতি লাঞ্চ, ডিনার, বক্তৃতা, সংবর্ধনা ইত্যাদির পালা শেষ হয়ে ক্রিকেট শুরু হল। শুধু শেষ হল না চিঠির জবাব এবং স্বাক্ষর দেবার পালা।
১৯৩৮ সফরে টেস্ট ম্যাচ বাদে অন্য সব ম্যাচে টস করার সময় ডন ‘টেইল’ ডেকেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রতিটি টেস্টে। ১৯৪৮ সফরে সেস্থির করে টেস্টসমেত সব ম্যাচেই ‘হেড’ ডাকবে। উরস্টারের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ। ডন ‘হেড’ ডাকল এবং টসে হেরে গেল। গত তিনটি সফরে উরস্টারে প্রথম খেলায় ডন দ্বিশত রান করেছে, এবারে করল ১০৭। লেস্টারসের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে ৮১। পরের ম্যাচ ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে, ডন খেলল না। শরীরের কথা ভেবে এবং ক্ষমতা মজুত রাখার জন্য ডন এই সফরে অনেকগুলি ম্যাচ খেলেনি বা একটি ম্যাচে দুই ইনিংসে খেলা এড়িয়ে গেছে। তখনও তার পিঠে ব্যথা রয়েছে।
ইংল্যাণ্ডের আবহাওয়ায় ও মাঠে বেডসার কেমন বল করে এটা জানতে ডন উদবিগ্ন ছিল। ওভালে সারের বিরুদ্ধে ১৪৬ করার পর ডন বোল্ড হয় বেডসারের বলে। হুবহু সেই ধরনেরই বল, যা গত বছর অ্যাডিলেড টেস্টে তাকে ০ রানে ফিরিয়ে দিয়েছিল। লেগ স্টাম্পে পড়ে ছিটকে আসে অফ স্টাম্পে। হ্যাসেটও শতরান করার পর বেডসারের ঠিক এই বলেই বোল্ড হয়। সঙ্গে সঙ্গে ডন অনুভূতিবশেই বুঝে যায়, টেস্ট ম্যাচে এই বোলারটিই অস্ট্রেলিয়ার ভয়ের কারণ হবে।
সাউথ এণ্ড-এ এসেক্সের সঙ্গে খেলা। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনে তুলল ৭২১। একদিনে এত রান আজও বিশ্বরেকর্ড। ডন করে ১৮৭ রান। দ্বিতীয় দিনে এসেক্সকে দু-বার আউট করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া বুঝিয়ে দেয়, ব্যাটিংয়ে ও বোলিংয়ে এই দল অসাধারণ ক্ষমতা ধরে। লর্ডসে এমসিসি-র বিরুদ্ধে ডন করল ৯৮ এবং ইনিংসে পরাজিত হয় এমসিসি। ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে বৃষ্টিভেজা উইকেটে দুই ইনিংসে ডনের উইকেট পায় ল্যাটা স্পিনার ১৯ বছরের হিলটন। ডন করে ১১ ও ৪৩। হিলটনের এটি প্রথম ম্যাচ খেলা। সারা ইংল্যাণ্ডে মাতামাতি শুরু হল ছেলেটিকে নিয়ে। কয়েকটি কাগজ লিখল, এখুনি একে টেস্ট খেলানো হোক। হিলটন পরে চারটি টেস্ট খেলে ১৪ উইকেট পায় গড় ৩৩.৬৪ রানে—দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের বিরুদ্ধে। তারপর ওকে সবাই ভুলে যায়। এরপর ডন নটিংহামের বিরুদ্ধে ৮৬ ও সাসেক্সের বিরুদ্ধে ১০৯ করে। এবার নটিংহামে প্রথম টেস্ট ম্যাচ।
নটিংহামের আকাশে মেঘ, উইকেট তাজা ঝকঝকে। প্রথম টেস্ট ম্যাচের শুরুর মুহূর্তে ডন টস হেরে ড্রেসিং রুমে এসে বলল, ‘এটা বোধ হয় জীবনের সবথেকে পয়া হার হয়েছে।’ চমৎকার উইকেট, বাতাসে বৃষ্টির আমেজ। শুরুতেই মিলার উড়িয়ে দিল হাটনের মিডল স্টাম্প। দিনের শেষদিকে ইংল্যাণ্ড ইনিংস শেষ হল ১৬৫ রানে।
দ্বিতীয় দিনে মরিস ফিরে আসার পর ডন খেলতে নামে। হ্যাসেটের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে যখন তার ব্যাটিং প্রস্ফুটিত হচ্ছে, ইয়ার্ডলি তখন রক্ষণাত্মক ফিল্ড সাজিয়ে রক্ষণাত্মক বল করতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ডনের রান তোলা বন্ধ করা। বোলারদের অধিকাংশ বল লেগ-স্টাম্পের বাইরে। ওরা ছেড়ে দিতে লাগল। খেলা চলল মন্থর গতিতে, রান উঠেছে আরও মন্থরে। মিডিয়াম পেসার বার্নেটের একটা ওভারে ডন শুধু ব্যাট তুলে বলের দিকে তাকিয়ে থাকে, খেলার চেষ্টা না করে। বল লেগ-স্টাম্পের এক ফুট বাইরে দিয়ে যায়। চায়ের আগে ১৫ মিনিট ডন একটিও রান করল না। দর্শকরা বিরক্ত হয়ে তার উদ্দেশ্যে চেঁচামেচি-বিদ্রূপ করতে থাকে।
তৃতীয় দিনে নতুন বল নিয়ে ইংল্যাণ্ড শুরু করল ১৩০ রানে অপরাজিত ডনের বিরুদ্ধে। আরও ৮টি রান করার পরই লেগ-স্টাম্পের উপর বেডসারের ইন-সুইং বল গ্লান্স করে ব্যাকোয়ার্ড শর্ট লেগে হাটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসে। বলটি ডন না খেললেও পারত। কিন্তু লেগ-সাইডে ফিল্ড সাজিয়ে, লেগ-স্টাম্পে মিডিয়াম পেস ইন-সুইং—অধুনা প্রচলিত এই পদ্ধতির বলকে ডন তীব্র অপছন্দ করে। তার মতে এই ধরনের বলই খেলাকে একঘেয়ে নিষ্প্রভ করে দেয়। তাই বেডসারের বলটিকে সেশাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এরপর প্রতিটি খেলায়ইংরেজ বোলাররা এইভাবে বল করে ডনের উইকেট পাওয়ার চেষ্টা করে।
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ হয় ৫০৯ রানে। ইংল্যাণ্ড দ্বিতীয় বারে করে ৪৪১। জেতার জন্য ৯৮ রান তুলতে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হয় মরিস ও ডনকে। এবারও বেডসার-হাটন জুড়ি ডনকে আউট করে এবং শূন্য রানে। ইংল্যাণ্ডে টেস্ট ম্যাচে এই প্রথম তার শূন্য রান।
লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগে ডন একটি ম্যাচ খেলে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে। সফরে ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এটি দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাতে ডন খেলেনি। প্রায় হারের মুখে এসে অস্ট্রেলিয়া সে-খেলায় ৪ উইকেটে জিতেছিল। জয়ের জন্য যখন ৬০ রান দরকার তখন তাদের ষষ্ঠ উইকেট পড়ে ৩১ রানে। হার্ভি ও ট্যালন শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে ৬৩ রানে পৌঁছে দেয়। এবারের খেলা অমীমাংসিত থাকে। ডন করে ৫৪ ও ৮৬।
লর্ডসে ডন টসে জিতল। ইংল্যাণ্ডে দুটি সিরিজে অধিনায়কত্ব করে এই এক বারই মাত্র ডন টসে জেতে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০ রানের ইনিংসে সেদিল মাত্র ৩৮ রান। আবার সেআউট হয় বেডসারের বলে হাটনের হাতে। ইংল্যাণ্ড ৪০৯ রানে দ্বিতীয় টেস্ট হেরে গেল।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের আগে ডন একটি মাত্র ইনিংস খেলে। ওভালে সারের বিরুদ্ধে ১২৮। খেলার শেষে ডন উইম্বলডনে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জন ব্রমউইচকে ফাইনালে হারতে দেখল আমেরিকার বব ফকেনবার্গের কাছে।
যথারীতি বৃষ্টি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যাণ্ড যখন ৩১২ রানে এগিয়ে এবং হাতে সাতটি উইকেট, তখনই বৃষ্টি নেমে দেড় দিন খেলা বন্ধ থাকে। অস্ট্রেলিয়া খেলার বাকি সময় ব্যাট করে কাটিয়ে দেয়। এই টেস্টে ডনের রান ৭ ও অপরাজিত ৩০। ইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংসে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ড করার সময় ডিক পোলার্ডের প্রচন্ডভাবে পুল করা বল সিড বার্নেসের বুকে লাগে। বার্নেস প্রাণে বেঁচে যায় সে-যাত্রা।
দুটি টেস্টে জয় ও একটি অমীমাংসিত। ‘রাবার’ হারবার ভয় থেকে মুক্ত অস্ট্রেলিয়া লিডসে চতুর্থ টেস্ট জিতল ৭ উইকেটে। এই ম্যাচে ৩১ উইকেটে সংগৃহীত হয় ১,৭২৩ রান—টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ বৃহত্তম মোট রান। পঞ্চম বৃহত্তম চতুর্থ ইনিংস রানও (৪০৪-৩ ডি:) হয়েছে এই টেস্টে। ডনের প্রিয় হেডিংলি মাঠ। ইয়র্কশায়ারের ক্রিকেটপাগলরা ভোলেনি এই মাঠে ডনের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলি— ১৯৩০-এ ৩৩৪, ১৯৩৪-এ ৩০৪, ১৯৩৮-এ ১০৩। ইংল্যাণ্ডের ৪৯৬ রানের ইনিংসের পর ডন যখন ব্যাট করতে আসে দর্শকরা তুমুলভাবে অভিনন্দন জানায়। ডন রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। যখন মাঠে নামল তখন প্রচন্ড কলরব, তারপর একটু কমে গিয়ে আবার উত্তাল হয়ে ফেটে পড়ল ডন যখন ক্রিজে পৌঁছোয়। টুপি তুলে সেনাড়ল; অভিনন্দন তখনও অব্যাহত। দেশের বাইরে সেএমন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাগতধ্বনি কখনো পায়নি। বুকের মধ্যে বাষ্প ঠেলে উঠল। ডন ব্যাট তুলে তাদের অভিনন্দন জানায়। ৩৩ রান করে পোলার্ডের বলে বোল্ড হয়ে সেফিরে আসে। ফেরার পথে তার কানে এল : ‘ঘাবড়াও মাত, আর একটা ইনিংস আছে।’
লিডসে ওরা ডনকে জানে। কোনোভাবেই দ্বিতীয় ইনিংসে ওর শতরান করা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। ওরা বন্যার মতো এল এবং বাউণ্ডারি লাইন ছাপিয়ে মাঠে উপচে পড়ল ডনের প্রতিশোধ নেওয়া দেখতে। আম্পায়ার দুজন ব্যর্থ হল দর্শকদের ঠেলে লাইনের ওপারে পাঠাতে। পুলিশও পারল না।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৩৮ রানে পিছিয়ে থাকার পর ইংল্যাণ্ড ৮ উইকেটে ৩৬৫ রান তুলে ইনিংস ছেড়ে দেয় ৪০৪ রান ৩৪৫ মিনিটে তুলে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ জেতার সুযোগ দিয়ে। চতুর্থ ইনিংসে চারশো রান! ইংল্যাণ্ডের মাঠে টেস্ট ম্যাচে এর আগে কোনো দল তুলতে পারেনি।
চতুর্থ দিনে ইংল্যাণ্ড চারশো রানে এগিয়ে, রাত্রে ডন ডায়েরিতে লিখল, ‘জেতার জন্য আমাদের ৪০০ রান তুলতে হবে এবং আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আমরা হেরে যাব।’
দেখে মনে হচ্ছে উইকেটের দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং দারুণ স্পিন ধরবে। ভারী রোলার চালিয়ে উইকেট ভেঙে দিলে অস্ট্রেলিয়া বিপদে পড়বে এই বিশ্বাসে খেলার শেষ দিনে পাঁচ মিনিট ব্যাট করে ইয়ার্ডলি ইনিংস ঘোষণা করে। এই ভারী রোলার ব্যবহারের সিদ্ধান্তটিই অস্ট্রেলিয়াকে সুবিধা করে দেয়। ভারী রোলার কখনোই উইকেট ভাঙে না। কেননা ক্রিকেট পিচ শক্ত হয় এবং সেটি খেটেখুটে তৈরি করা। মাটি সহজে আলগা হয় না। রোলারের ওজন নির্দিষ্ট এবং তার ভার পিচের উপর চারিয়ে থাকে। ভারী রোলারে পিচ তো ভাঙেই না বরং জমিকে চেপে বসিয়ে দিয়ে সহজ করে দেয় ব্যাটিংয়ের পক্ষে। ইয়ার্ডলির সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল, সেটা ম্যাচের ফলই বলে দিল। এর উপর, উইকেট ভালো হয়ে যাওয়া ছাড়াও স্পিন ধরল অতি মন্থরগতিতে। দলে লেকার ছাড়া খাঁটি স্পিন বোলারও কেউ ছিল না এবং ১৯৪৮-এ লেকার যথেষ্টই কাঁচা ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ৫৭ রানে হ্যাসেট ফিরে আসতেই ভিড় সরিয়ে পুলিশ ডনকে পথ করে দিল মাঠে নামার জন্য। উত্তাল অভিনন্দন মাঠে ভেঙে পড়ল।
ডন চটপট রান তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মরিস এবং সেলাঞ্চের আগের আধ ঘণ্টায় তুলল ৬২ রান। ডনের যখন ৫০, পয়েন্টে ইয়ার্ডলিকে ক্যাচ দিয়ে অব্যাহতি পায়, ৫৯ রানে ক্যাচ দিয়েছিল স্লিপে, দু-বারই কম্পটনের বলে, এরপরই ক্র্যানস্টনকে বাউণ্ডারিতে হুক করেই ডন পাঁজর চেপে ধরে। আবার ফাইব্রোসাইটিস তাকে ধরেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খেলা শুরু করল। হুক করে আবার চার এবং আবার যন্ত্রণা! পোলার্ড তার বুকে মালিশ করে দিল, ইংল্যাণ্ডের একজন ছুটে গিয়ে জল আনল। মাঠের চারধারে তখন নিঝুমতা নেমে এসেছে। শুরু করল ডন আবার। তবে যতটা সম্ভব মরিসকে খেলতে সুযোগ দিয়ে, যন্ত্রণাটা কমার জন্য সময় নিল সেএবং ১৪৭ মিনিটে এইভাবেই সেশতরানে পৌঁছোল। এটি তার জীবনের ১১২তম এবং টেস্টের ২৯তম শতরান।
দ্বিতীয় উইকেটে মরিস (১৮২) ও ডন তুলল ৩০১ রান। নীল হার্ভে যখন বাউণ্ডারিতে বল পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রান তিন উইকেটে ৪০৪ করল, ডনের রান তখন ১৭৩। অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেটে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ জিতল। এরপর ম্যাঞ্চেস্টারের ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে ডন ১৩৩ রানে অপরাজিত থাকে।
ওভালে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। সফরের শেষ এবং ডনের জীবনেরও। অধিনায়ক হিসাবে ১৯৩৮-র প্রথম সফরে এই মাঠেই ডন নিষ্ঠুর এবং জঘন্যভাবে হেরেছিল। এই মাঠ থেকেই তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পায়ের গোছের হাড় ভাঙায়। এই মাঠেই ইংল্যাণ্ড বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড করে এক ইনিংসে ৯০৩ রান। এ সবই দশ বছর আগের কথা।
টেস্ট শুরুর কয়েক দিন আগে লণ্ডনে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। উইকেট ভিজে বটে কিন্তু নির্জীব। অথচ প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড আউট হয়ে গেল ৫২ রানে। দুই অঙ্কের রান এক জনই মাত্র করে—লেন হাটন। ইনিংসে শেষ আউট হয় ৩০ রানে। লিণ্ডওয়ালের ছয় উইকেট ২০ রানে। নিজের দেশে এত কম রানে ইংল্যাণ্ড কখনো আউট হয়নি। ১৩০ মিনিটে ইনিংস শেষ।
অস্ট্রেলিয়ার ১১৭ রানে ডন ব্যাট হাতে মাঠে নামল। তুমুল অভিনন্দনে ওভাল ফেটে পড়ল। হঠাৎ ডনের মনে এল ১৮ বছর আগে এই মাঠেই শেষ টেস্ট খেলতে নামা জ্যাক হবসের কথা। ঠিক এইভাবেই তাঁকে সেদিন সংবর্ধিত করেছিল অস্ট্রেলীয়রা। ডনও ছিল তাদের মধ্যে। ওভালে তার প্রথম টেস্ট খেলা। সেই একই দৃশ্য আবার আজ।
ইয়ার্ডলি ‘থ্রি চিয়ার্স’ দেবার জন্য দলের সবাইকে ডেকে আনল উইকেটে। ডনের সৌভাগ্য কামনা করল সেএবং হাজার হাজার দর্শক, যাদের মধ্যে অনেকে ১৫ ঘণ্টা আগে থেকে লাইন দিয়ে টিকিট কেটেছে ডনের শেষ টেস্ট ম্যাচ দেখতে।
ডন, কঠিন নির্দয় ডন ব্র্যাডম্যানের হৃদয়, শীতল পেশাদারি মস্তিষ্ক সম্ভবত এই প্রথম বিচলিত হল সাধারণ মানুষের মতো। অতিমানব নয়, যন্ত্র নয়, সেযে আর পাঁচজনের মতোই আবেগবশীভূত তা এই প্রথম প্রমাণিত হল। জীবনে এই প্রথম সেহারাল একাগ্রতা, অভিনিবেশ। এই মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস শুরু করার অনুপযুক্ত। নটিংহাম, লিডস, ম্যাঞ্চেস্টার এবং লর্ডস মাঠে জীবনের শেষ খেলায় ডন শতরান করেছে। ওভালে নয় কেন?
বোলার ওয়ারউইকাশায়ারের এরিক হোলিজ। কিছুদিন আগে সেতার লেগব্রেক ও গুগলি বলে অস্ট্রেলিয়ার আট জনকে আউট করেছে এক ইনিংসে। প্রথম বলটি ডন খেলল যন্ত্রবৎ, অনেকটা আন্দাজেই। দ্বিতীয় বলটি গুগলি, নিখুঁত লেংথে। ডন ফরোয়ার্ড খেলল, ব্যাটের ভিতরে কানায় লেগে বল… মহাকাব্যের উপযুক্ত পরিণতি দেওয়ার জন্য এই মহাখেলোয়াড়ের অফ-স্টাম্পের বেলটি ফেলে দিল।
মাঠে মহাশ্মশানের নৈ:শব্দ্য। স্বপ্নোত্থিতের মতো ডন স্টাম্পের দিকে তাকিয়ে; বিশ্বাস করতে পারছে না তার খেলোয়াড় জীবনের শেষ পরিণতি। শুধু একটি বার ব্যাট চালিয়ে বাউণ্ডারিতে বল পাঠালেই টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংস পিছু গড় রান হত ১০০। মাত্র চারটি রান দরকার ছিল।
শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে ইনিংস ও ১৪৯ রানে। খেলাশেষে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হল ওভাল প্যাভিলিয়নের সামনে, তারা ডনকে দেখতে চায়। ডন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কিছু বলতে হবে।
আপনারা কাগজে যা-ই পড়ুন-না কেন, নিশ্চিত করেই বলছি এইটিই আমার শেষ টেস্ট ম্যাচ। এতে আমার ব্যক্তিগত অবদান এত কম, যার জন্য দুঃখবোধ করছি। এর দুটি কারণ— আমাকে দেওয়া অভিনন্দনের বিপুল দাক্ষিণ্য এবং দ্বিতীয়ত, আমাকে যে চমৎকার বলটি করা হয়েছিল।
ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি বলল, ‘ডনকে গুড-বাই বলার সঙ্গে সঙ্গে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারকেই আমরা বিদায় জানাচ্ছি।’
এরপর জনতা গেয়ে উঠল—‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো।’
ডন ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু-একটা সেলুকোতে চাইছে।
ডন পর পর তিনটি ইনিংসে— জেন্টলমেন, সাউথ অফ ইংল্যাণ্ড ও লেভিসন গাওয়ারস একাদশের বিরুদ্ধে তিনটি শতরান করে সফর শেষ করে। সফর শেষ করবে অপরাজিত থেকে, যা কোনোদিন কেউ পারেনি। সিরিজে ৪-০ জয়ের পরও ডন প্রতিটি খেলা টেস্ট ম্যাচের গুরুত্ব দিয়ে খেলে।
ডন লর্ডসে জেন্টলমেন অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৫০ করল। সফরে পূর্ণ ফল ২,০০০ রান। চার বার ইংল্যাণ্ড সফরে প্রতি বারই দু-হাজার রান, কোনো দেশের কেউ পারেনি। এই খেলার মধ্যেই ডনের জীবন ৪০ বছর অতিক্রম করে। খেলার শেষে দর্শকরা প্যাভিলিয়নের সামনে জড়ো হয়ে গান ধরে— ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ ডন মনে মনে তখন বলেছিল—যেভাবে খেলা উচিত বোধ হয় সেইভাবেই ক্রিকেট খেলেছি, নয়তো এই ভালোবাসা কেন পাব!
হেস্টিংসে সাউথ অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৪৩। স্কারবরোয় শেষ খেলায় তিন ঘণ্টায় ১৫৩ করে বেডসারের বল হাটনের মাথার উপর তুলে দিয়ে ডন ছুটতে ছুটতে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডনের শেষ নিষ্ক্রমণ। একটি যুগের প্রস্থান। চারটি সফরে ইংল্যাণ্ডে তার ১২০তম ইনিংসে ৯,৮৩৭ রান। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডন শেষ খেলায় শেষ ওভারটি নিজে বল করে। এরপর অবশ্য স্কটল্যাণ্ডের অ্যাবারডিনে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির খেলায় ডন দেড় ঘণ্টায় ১২৩ রান করে।
ডন দারুণ খুশি। জীবনের সেরা বাসনা পূর্ণ হয়েছে। ইংল্যাণ্ড সফরে অপরাজিত অধিনায়ক থাকার মর্যাদা সেপেয়েছে। ৩১টি ম্যাচে ২৩ জয় (১৫টি ইনিংসে), ৮ অমীমাংসিত। টেস্ট বাদে কোনো দল ৩০০ রানের ইনিংস করতে পারেনি। টেস্ট খেলোয়াড় বাদে কেউ পারেনি তাদের বিরুদ্ধে শতরান করতে। সফরে অস্ট্রেলিয়া করেছে ১৫,১২০ রান, বিরুদ্ধে হয়েছে ১০,৯৩২ রান। সাত জন অস্ট্রেলীয় হাজার রান পূর্ণ করে। ২৭ রানের জন্য পারেনি লক্সটন। ডন সফরে করে ২,৪২৮ রান, ৮৯.৯২ গড় এবং ১১টি শতরান।
শুরু হল সম্মান বর্ষণ। ইয়র্কশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার, হ্যামশায়ার ও অন্যান্য ক্লাব ডনকে আজীবন সাম্মানিক সদস্য করল। ইংরেজ নয় এমন একজনকে এই প্রথম ইয়র্কশায়ার এই সম্মান দিল। লণ্ডনের রবিবাসরীয় ‘দ্য পিপল’ সংবাদপত্র ডনের জন্য তহবিল খুলল। সব শ্রেণির মানুষ যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারে তাই দানের পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয় এক শিলিং। তারা বিরাট বিদায়-ভোজের ব্যবস্থা করল। তাতে এল ইংল্যাণ্ডের সাত জন প্রাক্তন ও নয় জন কাউন্টি অধিনায়ক। অতিথিসংখ্যা দুশো। তাদের মধ্যে অনেকেই মাঠে ডনের বিরোধিতা করেছে। দেখা গেল লিণ্ডওয়ালের পাশে বসে আছেন হ্যারল্ড লারউড!
তহবিলের অর্থে তৈরি বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘ওয়ারউইক ভাস’-এর প্রতিকৃতি ব্রিটেনের ক্রিকেটপ্রেমীদের তরফ থেকে ডনকে উপহার দেওয়া হল এই সংবর্ধনা-ভোজে। নিরেট রুপোর তৈরি ২১ ইঞ্চি উচ্চ এই ভাস যার নকল, সেই আসলটি কিন্তু শ্বেতপাথরের এবং গোলাকৃতি। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুট, ব্যাস ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নির্মিত। স্যার উইলিয়াম হ্যামিলটন নেপলসে চতুর্থ ফার্দিনান্দের রাজদরবারে তৃতীয় জর্জের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ১৭৭০ সালে রোম থেকে ১২ মাইল দূরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে এই ভাসটি পান। এর গাত্রে কতকগুলি অর্ধপশু-অর্ধমানব মুখ খোদাই করা। মুখের একটি নিখোঁজ। হ্যামিলটন ঠিক করেন তাঁর স্ত্রী লেডি হ্যামিলটনের মুখ সেখানে বসাবেন। এক ইটালির ভাস্করকে তিনি নিযুক্ত করেন। লোকটি রগচটা, ততোধিক লেডি হ্যামিলটনও; ফলে খিটিমিটি ঝগড়া দুজনের মধ্যে বেঁধে যায়। শোধ নেওয়ার জন্য ভাস্করটি লেডি হ্যামিলটনের সুন্দর মুখটি নিখুঁত খোদাই করে কান দুটি করে দেয় গাধার। অতঃপর গৃহশান্তি বজায় রাখতে হ্যামিলটন বাড়ি থেকে ভাসটি বিদায় করতে বাধ্য হন। তিনি মামাতো ভাই ওয়ারউইকের আর্ল-কে সেটি দান করেন।
তহবিলের যে-অর্থ ভাসটি তৈরির পরও রয়ে যায়, ডনের অনুরোধে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন পার্কে ছোটোদের জন্য কংক্রিট ক্রিকেট পিচ তৈরির জন্য তা ব্যয়িত হয়।
এই সময় একটা ব্যাপার কাগজে সামান্য ঝড় তোলে। বামোরালে ষষ্ঠ জর্জ অস্ট্রেলীয় দলকে রাজপরিবারের সঙ্গে চা-পানের নিমন্ত্রণ করেন। কাগজে ছবি বেরোল ডন ইংল্যাণ্ডের রাজার সঙ্গে কথা বলছে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে। হইচই পড়ে গেল ডনের অসৌজন্য ভঙ্গি নিয়ে। কাগজে চিঠি বেরোল। অপ্রতিভ ডন শুধু এইটুকু বলল, ‘এরকম ক্ষেত্রে লোকে হাত দুটো নিয়ে করে কী?’
জাহাজে অস্ট্রেলিয়া রওনা হওয়ার আগে ডন চিঠি পেল ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব ফিলিপ নোয়েল বেকারের কাছ থেকে:
অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত আর কোনো দল এইরকম নিরবচ্ছিন্ন বিস্ময়কর ক্রিকেট সাফল্য লাভ করেনি। আপনার সাফল্য শুধু মাঠেই নয়। আর কোনো খেলায় কোনো সফরকারী দল আপনার দলের মতো জনপ্রিয় হয়নি, এত সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া উভয়েই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকল। আশা করি আপনি যা করেছেন সেজন্য নিশ্চয়ই গর্ববোধ করছেন।
বলা বাহুল্য, ডন মনের নিভৃতে গর্ববোধ করেছে।