২. প্রথম শতরান
বারো বছর বয়সে ডন ব্র্যাডম্যান বাওরাল হাই স্কুলের প্রথম টিমের কনিষ্ঠতম সদস্য হয় এবং ‘সত্যিকারের’ পিচে জীবনে প্রথম খেলতে নামে। অস্ট্রেলিয়ার জেলাগুলিতে যেরকম পিচ হয়ে থাকে কংক্রিটের ওপর ম্যাটিং ঢাকা। সিডনিতে এসে গ্রেড ক্রিকেট খেলার আগে পর্যন্ত ডন কখনো ঘাসের পিচে খেলেনি। অস্ট্রেলীয় আবহাওয়ায় ঘাসের পিচ রক্ষণাবেক্ষণের যা খরচ, গ্রামের ক্লাবগুলির পক্ষে তা সামলানোর সাধ্য ছিল না।
প্রথম একাদশের পক্ষে প্রথম খেলাতেই ডন মিটাগং স্কুলের বিরুদ্ধে শতরান করে। মোট ১৫৬ রানের মধ্যে ডনের রান ১১৫ নট আউট। বলা বাহুল্য, ডন খুশিতে ডগমগ। পরের দিন হেড মাস্টারমশাই গোটা টিমটাকে মাঠে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কাল তোমাদের মধ্যে একজন শতরান করেছে শুনলাম। ভালো কথা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, খেলতে গিয়ে সেখানে স্কুলের একটা ব্যাট ফেলে রেখে দিয়ে আসতে পার।’ ডনের শতরানটা একদমই মাঠে মারা যায়।
ডন স্কুলের হয়ে আর একটি মাত্র খেলায় নেমেছিল। রান ছিল ৭২ নট আউট। অর্থাৎ আউট না-হয়ে ১৯৭ রান করে দুটি খেলায়। আজকের দিনে হলে নিশ্চয়ই এইরকম ছেলে সঙ্গে সঙ্গে স্কুল কোচ বা গেমস মাস্টারের নজরে পড়ত এবং তার খেলার বিকাশ যাতে ঘটে তার ব্যবস্থা হত। কিন্তু ডনের আমলে স্কুলে স্কুলে তখন খেলা নিয়ে এখনকার মতো মাতামাতি ছিল না।
ক্রিকেট সবচেয়ে প্রিয় হলেও ডন কিন্তু স্কুলের হয়ে টেনিস ও রাগবি খেলেছে আর অ্যাথলেটিকসে ১০০ গজ থেকে আধ মাইল পর্যন্ত সব ক-টি পাল্লার দৌড় চ্যাম্পিয়ন হয়। গ্রামের ছেলেদের মতোই সেঅনেক দূর দূর হেঁটে শিকার করত, নদীতে মাছ ধরত। সাঁতার শিখতে গিয়ে দু-বার প্রাণান্তকর ব্যাপার ঘটায় আর জলে নামতে যায়নি, পড়ার মধ্যে অঙ্কটাই ডনের ভালো লাগত, তারপরই বিজ্ঞান।
তেরো বছর বয়সে ডন বাওরাল ক্রিকেট টিমের স্কোরার হয়, মামা জর্জ হোয়াটম্যান যেহেতু অধিনায়ক তাই ডনের এই পদপ্রাপ্তি। ২৫-৩০ মাইলের মধ্যে যেসব গ্রাম, তাদের সঙ্গেই ম্যাচ খেলা হত। টিমের সঙ্গে ডনও যেত, লরিতে কেরোসিন কাঠের একটা বাক্সের ওপর বসে।
একদিন ওরা খেলতে গেছে ছয় মাইল দূরে মস ভেল নামে একটা জায়গায়, সেদিন বাওরাল টিমের একজন আসেনি, দশ জন খেলোয়াড় আর ডন ছাড়া বাওরালের সঙ্গে বাড়তি একটি লোকও নেই। ‘ডন, খেলবি নাকি?’ মামা জিজ্ঞাসা করলেন। ডন তো খেলার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়েই।
ডনকে ব্যাট করতে পাঠানো হল দশ নম্বরে, ওকে দেখে দর্শকরা তো হেসেই খুন। হাফপ্যান্ট-পরা একটা ছেলেকে প্রায় তারই সমান উচ্চতার ব্যাট হাতে গম্ভীরভাবে মন্থর গতিতে উইকেটের দিকে যেতে দেখে (সারাজীবন ব্র্যাডম্যান সর্বদা উইকেটে যেত মন্থরভাবে) মস ভেলের এক সমর্থক চিৎকার করে বলে, ‘ওরা এখন দেখছি খোকাদের খেলাচ্ছে।’
দয়াপরবশ হয়ে মস ভেলের বোলার প্রথম বলটি দেয় শিশুদের উপযোগী করে। একঘণ্টা পরে দেখা গেল অপ্রতিভতায় এবং পরিশ্রমে রক্তিম মুখে বোলারটি তার যাবতীয় অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি ঢেলে বল করে যাচ্ছে আর ছেলেটি তাকে পেটাচ্ছে। ডন সেদিন বড়ো রান করতে পারেনি ব্যাটের আকারের জন্য। মস ভেল টিমেরও সেদিন লজ্জা রাখার জায়গা ছিল না। তারা ডনকে আউট করতে পারেনি। ডন ৩৭ রানে অপরাজিত থাকে। ম্যাচটি পরের শনিবারেও গড়ায়। ডনকে দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেন করতে পাঠানো হয়, এবারও খেলা শেষে অপরাজিত থাকে ২৯ রানে।
সিড কুপিট নামে বাওরাল টিমের একজন এরপর ডনকে একটি ফাটা পুরোনো ব্যাট উপহার দেন। গর্বে বুক ফুলে উঠল ডনের। বড়োদের সাইজের এবং তার পক্ষে খুব ভারী হলেও জীবনে এই প্রথম নিজস্ব একটা ব্যাট তার হল। ব্যাটটার তলার দিক থেকে তিন ইঞ্চি কেটে দেন ডনের বাবা। প্রত্যেক ম্যাচে ডন ব্যাটটাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। কিন্তু বাওরাল দলের আর কেউ অনুপস্থিত হয়নি, ব্যাটটা বওয়াই সার হত।
ঠিক এই সময়ই গিলিগ্যানের ইংল্যাণ্ড দল পঞ্চম টেস্ট খেলতে সিডনিতে আসে ১৯২১ সালের ফেব্র¦য়ারি মাসে। ডনের বাবা ক্রিকেট খুবই ভালোবাসেন। ঠিক করলেন, সিডনিতে গিয়ে প্রথম দু-দিনের খেলা দেখবেন। ডন বায়না ধরল, সেও দেখতে যাবে। নিয়ে অবশ্য যেতেই হল। জীবনে প্রথম ডন সিডনি ক্রিকেট মাঠ দেখল। দেখে অভিভূত হল। অস্ট্রেলিয়ার তখনকার সেরা ব্যাটসম্যান চার্লি ম্যাকার্টনিকে ১৭০ রান করতে দেখল। পরবর্তীকালে প্রায়শই ডনের সঙ্গে ম্যাকার্টনির তুলনা করা হত। এই খেলাতেই সেপ্রথম চাক্ষুষ দেখল ফ্র্যাঙ্ক উলি, প্যাটসি হেনড্রেন, টেড ম্যাকডোনাল্ড, জনি টেলর, ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংকে। এদের নিয়েই দল গড়ে সেবাড়ির পেছনে টেস্ট ম্যাচ খেলত। তার হিরোদের আরও কাছ থেকে দেখার জন্য ডন সিডনি প্যাভিলিয়নে উঁকিঝুঁকিও দিয়েছিল। তখন সেজানত না কয়েক বছর পর তাকে দেখার জন্য ছেলেরা এইভাবেই প্যাভিলিয়নে উঁকি দেবে।
তখন পর্যন্ত ডনের জীবনে, এই টেস্ট ম্যাচ দেখাটাই প্রচন্ডতম ঘটনা। বাবাকে সেতখনই বলেছিল, ‘এই মাঠে না-খেলে আমি ছাড়ব না।’ বাবা শুনে অবশ্যই হেসে উঠেছিলেন। সিডনি মাঠে ডন এরপর যে-খেলাটি দেখে, তাতে সেও একজন অংশগ্রহণকারী। ডন এরপর যত প্রথম শ্রেণির খেলা দেখেছে তা দর্শক হিসেবে নয়, অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় হিসেবে। জর্জ ব্র্যাডম্যান তাঁর ছেলের বহু ইনিংস সিডনি মাঠে দেখেছেন, এমনকী ১৯৪৯-এ এই মাঠে ডনের শেষ খেলাটিও।
স্কুলের পড়া ছেড়ে ডন এরপর চাকরি নেয় বাওরালেই পার্সি ওয়েস্টব্রুক নামে সম্পত্তি বেচাকেনার এক দালালের অফিসে। বাওরালে খেলার পক্ষে বয়সটা তখন খুবই কম, মাত্র ১৬। অন্য আর কোনো টিমও নেই যেখানে সেনিয়মিত খেলতে পারে, তাই ডন এই সময় মন দেয় টেনিসে। মামার একটা কোর্ট ছিল। সেখানে এক বছর সেশুধু টেনিসই খেলে। পরের বছরও টেনিসে মন দেয় বটে কিন্তু রক্তে রয়েছে ক্রিকেটের ডাক, সুতরাং বাওরাল ক্রিকেট টিমে খেলার সুযোগ পেতেই ডন টেনিস ছেড়ে দেয়।
ডনের প্রথম ইনিংস স্কোরারকে খুবই খুশি করে। প্রথম বলেই সেআউট হয়ে যায়। ডনের পক্ষে এই ব্যর্থতা ভালোই হয়, কেননা পরাজয়কে সেকখনোই মেনে নিতে পারেনি। পরাজয় তাকে আরও কঠিন, আরও দৃঢ় করে তোলে। ওর ক্রিকেট জীবনটাই এইভাবে কেটেছে। যদি কোনো বোলার এক ইনিংসে অল্পেই ওকে আউট করে থাকে, তাহলে অন্য ইনিংসে সেই বোলারকে বার বার বাউণ্ডারিতে আছড়ে পড়তেই হবে। প্রথম বলে আউট হওয়ার লজ্জা আর রাগ কাটাতে সেক্রিকেটে মনপ্রাণ ঢেলে দেবে ঠিক করল।