০৯. গোধূলির সময়

গোধূলির সময় রাখালরা বাড়ি ফিরছে, কোথা থেকে কানু এসে হাজির। সারা দিন তার পাত্তা ছিল না। সে কখন আসে, কখন চলে যায়, তার ঠিক নেই। বলরামই আজকাল বেশির ভাগ যশোমতীর ধেনুগুলির দেখাশুনো করে। নির্বিরোধ বলরাম কানুর কোনও ব্যবহারেই আপত্তি করে না!

রাখালরা সবাই অবাক।

সুবল বলল, তোর কি দিনরাতের জ্ঞানগম্যিও চলে গেছে রে, কানু? দেখছিস না দিনমণি অস্তাচলে যাচ্ছেন? তুই বুঝি ভেবেছিস, এখন প্রভাত হল?

কানু অদ্ভুত ধরনের হেসে বলল, তাই তো, এখন প্রভাত নয় বুঝি? তা হোক না সন্ধ্যা, এখন আবার গোষ্ঠে যেতে ক্ষতি কী?

কী করবি গোষ্ঠে গিয়ে?

কেন, খেলব?

অংশুমান বলল, সারা দিন ওঁর জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি—তখন দেখা নেই, এখন উনি এলেন খেলতে। তোর যদি এত শখ থাকে, তা হলে একা খেল গে যা!

সুদাম বলল, আজ বুঝি শ্রীরাধিকে আসেননি, তাই বাছার আমার খেলার কথা মনে পড়ল!

কানু বলল, সে আজ আসেনি, কাল আসেনি, অনন্ত কাল আসেনি!

তাই তো, বড় ভাবনার কথা! আমাদের বলিসনি কেন, বৃন্দের কাছে সন্দেশ পাঠাতুম!

কানু হঠাৎ কারু নামের বিরাট চেহারার বৃষটির ল্যাজ মুচড়ে দিল। সেটা চমকে গিয়ে, খুরের ধাক্কায় মাটি ছিটকিয়ে লাফিয়ে উঠল। তার ভয়াল শিংসুদ্ধ মাথাটা ঘুরে গেল এদিকে-ওদিকে। তা দেখে অন্য গাভীরাও ভয় পেয়ে ছটফট করে উঠল।

সব রাখালরা হা-হা করে উঠল। আরে কানু, করিস কী। করিস কী?

কিন্তু কানু মজা পেয়ে গেছে। সে দৌড়ে দৌড়ে অন্য ধেনুদেরও ল্যাজ মুচড়ে দিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল, ইঃ-রে-রে-রে-রে!

ধেনুদেরও মধ্যে একটা হুলস্থূল পড়ে গেল। কোনওটা এদিক-ওদিক ছুটে যায়, কোনওটা একে-তাকে ঢুঁস মারতে আসে। কানু সেগুলিকে আরও খেপিয়ে দেয়, কোনওটার শিং ধরে দৌড় করায়, কোনওটার কর্ণ মর্দন করে।

রাখালরা প্রথমে দিশেহারা, পরে একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কানু আগে কোনও দিন এমন কাণ্ড করেনি! ধেনুগুলিকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। আজ এমন নির্দয় ভাবে ওদের কষ্ট দিচ্ছে কেন? অবলা প্রাণীগুলি পর্যন্ত যেন বিমূঢ় হয়ে গেছে। ছেলেটা কি সত্যি পাগল হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত!

রাখালরা সে-সব ধেনুগুলি সামলাল অতি কষ্টে। অভিমানরুষ্ট গলায় তারা বলল, দেখো ভাই কানু, শ্রীরাধিকা আসেনি, সে কি আমাদের দোষ? তবে আমাদের এই বিড়ম্বনা কেন?

কানু বলল, সে আজ আসেনি, কাল আসেনি, অনন্তকাল আসেনি!

সেজন্য আজ আমরা আর কী করব? কাল বরং সন্ধান নেওয়া যাবে!

কানু বলল, আজ আমরা খেলা করি আয়!

আমাদের এখন খেলায় মন নেই ভাই। সারা দিন রোদে কাটিয়েছি, এখন আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর জ্বলছে!

রাখালরা সত্যিই বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিচ্ছে দেখে কানু বলল, আয়, তোদের মধ্যে কেউ আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করবি?

কানুর সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নামার ইচ্ছে কারওরই নেই। কেই-বা এই সন্ধ্যাবেলা হাত-পা ভাঙতে চায়! কানুর যেমন অদ্ভুত শখ।

কেউ কোনও উত্তর না দিয়ে হাঁটতেই লাগল।

কানু আহত ভাবে বলল, কী রে, তোরা খেলবিও না, লড়বিও না?

রাখালরা তখন প্রায় পল্লির কাছাকাছি এসে পড়েছে। কানু তেড়ে ছুটে গেল তাদের দিকে। এক এক জনকে ঠেলে ফেলে দিতে লাগল মাটিতে, কারওর উড়নি, কারওর পাচনবাড়ি কেড়ে নিল। কানু আজ দারুণ অস্থির।

মাটিতে কয়েক পাক গড়াগড়ি দিয়ে রাখাল ছেলেরা আবার উঠে দাঁড়াল। এখনও তারা ক্রুদ্ধ হয়নি, তবু দুঃখিত অভিযোগে বলতে লাগল, কানু, কেন আমাদের জ্বালাতন করছিস? আমরা তোর কাছে কী দোষ করেছি?

কানু বলল, কেন তোরা খেলবি না? কেন তোরা লড়বি না?

তবু কেউ লড়তে রাজি নয়। তবু কানু তাদের টানাটানি করতে ছাড়ল না। এক এক জনকে তুলে তুলে ধরাশায়ী করতে লাগল। শুধু বলরামকে ছাড়া। বলরাম এসব দেখেশুনেও একটিও কথা বলেনি। শুধু এক পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

কয়েক জন অকারণ মার খাওয়ার বদলে কানুর সঙ্গে লড়তে গেল। এবং অচিরেই কয়েক আছাড় খেয়ে উঃ আঃ করতে লাগল বসে বসে। কানু হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, তোরা কেন আমার সঙ্গে ভালো করে লড়তে আসিসনি?

কানুর ঘামে-ভেজা মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। মুখে অন্য রকম একটা দ্যুতি। চোখ দুটো অন্য দিনের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। সে আজ দুর্দান্ত চঞ্চল।

সমস্ত রাখালরা যখন কাবু হয়ে কোঁকাচ্ছে, তখন কানু কোমরে গোঁজা আড়বাঁশিটা বার করল। তার চাঞ্চল্য একটুও কমেনি। সে বাঁশিতে এক দারুণ ফুঁ দিল।

এমন সুর কানু নিজেও আগে কখনও তোলেনি। এ যেন এক পাগলের বুকফাটা আর্তনাদ। তবু তার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দ আছে। বিস্মিত বিহ্বল রাখালদের মাঝখানে নেচে নেচে কানু বাজাতে লাগল সেই প্রাণ-মাতোয়ারা বাঁশি।

যে-হেতু লোকালয় খুব কাছেই, তাই সেই তীব্র বাঁশির নাদ শুনে একে একে খুলে যেতে লাগল বিভিন্ন গৃহের ঝরোকা। অনেকেই বেরিয়ে এল বাইরে। প্রথমে তারা দূর থেকে বাঁশি শুনল। তারপর আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এল। আরও কাছে। বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগল কানুকে। একে যেন তারা কেউ চেনে না। এমন বাঁশির সুরও তারা কখনও শোনেনি। সে বাঁশি শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। শরীর দোলে সাপের ফণার মতন। এক সময় তারা সকলেই মন্ত্রমুগ্ধবৎ সেই বাঁশির সুরে গা-ভাসিয়ে নাচতে শুরু করল। তখন দেখা গেল, তারা সকলেই নারী।

এক সময় কানু ঈষৎ অহংকারের সঙ্গে জনান্তিকে সুবলকে জিজ্ঞেস করল, আমার বাঁশি শুনে শুধু নারীরাই আসে কেন? পুরুষরা কোথায়?

সুবল শ্লেষের সঙ্গে বলল, কেন ভাই, নারীদের প্রতিই তো তোমার আসক্তি, পুরুষের খোঁজে কী প্রয়োজন? তারা এলে তো তোমার ব্যাঘাতই হত!

কানু বলল, সে-কথা নয়। তারা আসেনি কেন?

রাজা কংসের হুকুমে সমস্ত পরিবার-প্রধানরা আজ মথুরায় গেছে। তুই তো আজকাল প্রজাতি বা প্রদেশের কোনও খোঁজই রাখিস না। তাই জানিস না, রাজা কংসের অত্যাচার আজকাল আবার কত বেড়েছে। কত রকম অনুজ্ঞা আর অনুশাসন।

কানু বেশি খেয়াল করল না সুবলের কথা। এখন অনুযোগ শোনার দিকে তার মন নেই। সে হাঁটতে শুরু করল বনের দিকে। এক সময় বনের মধ্যে পৌঁছে ও দেখল, সমস্ত গোপিনীরা তাকে অনুসরণ করে এসেছে। ক্রমশ তাদের দল বাড়ছে। কানুর বাঁশির সুরে তাদের অঙ্গে দোলা লেগেছে। সুখে আবিষ্ট হয়ে নাচছে তারা বনের মধ্যে। সকলেই মধুর স্বরে বার বার বলছে, কানহাইয়া, আমার কাছে এসো। ওগো মুরলীমোহন, তুমি একবার সামনে এসে এই অধীনাকে ধন্য করো।

কানু আবার ফিসফিসিয়ে সুবলকে জিজ্ঞেস করল, এত গোপিনীই যখন এসেছে, তখনও, তবুও, রাধা এল না কেন?

সুবল বলল, কী জানি ভাই! সে তত্ত্ব তো তোমারই ভালো জানবার কথা!

আমি জানি না, সে কেন এল না!

হয়তো এত গোপিনী এসেছে বলেই সে আসেনি!

কেন? এরা এসেছে বলে সে আসবে না কেন? এরা আর সে কি এক? সে-ই তো আমার একমাত্র পুরস্কার। সে কেন এল না? বল সুবল, তুই শিগগির উত্তর দে, রাধা কেন এল না?

এ তো দেখছি মহা জ্বালাতন! এত সব কথা আমি জানব কী করে? আজ লক্ষ্মীপুজোর দিন, হয়তো ওদের বাড়িতে কোনও ব্রত-পার্বণ আছে—তা ছাড়া জানিস তো ওর ননদিনী কত কুটিলা!

কানুর আর কিছুই ভালো লাগল না। সে আরও জোরের সঙ্গে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সকলকে খেপিয়ে দিতে চাইল। নাচের নেশায় সকলেই যখন প্রায় উন্মাদ, সেই সময় কানু কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি পালিয়ে গেল বনের মধ্যে। ছুটতে ছুটতে, একলা, বনের মধ্যে আরও ক্রমশ একলা হতে হতে কানু এক সময় হারিয়ে গেল গভীর থেকে গভীরতর বনে।

ক’দিন ধরে রাধার দেখা নেই, তার কোনও সংবাদ নেই, সংকেতকুঞ্জ শূন্যতায় হা হা করে। কানু বার বার স্নানের ঘাটে যায়, খেয়ার ঘাটে যায়, কদম্বতরুর তলায় গিয়ে বসে থাকে, তবু রাধাকে দেখে না। কানুর ইচ্ছে করে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিতে। ক্রুদ্ধ সিংহের মতো সে বনের মধ্যে একা একা গজরায়।

পরদিন দুপুরবেলা কানুকে আবার আবিষ্কার করল সুবল। নিঃসঙ্গ যমুনাতীরে। কদমগাছের নীচে। দীর্ঘশ্বাসবহুল মলিন মুখ নিয়ে বসে আছে। কালীয়দহের পাড়ে রাধাকে প্রথম দেখার পরের মতন ঠিক একই অবস্থা।

সুবল প্রথমেই বলল, আমি পাকা খবর নিয়ে এসেছি। রাধা এখন আয়ানের বাড়িতে নেই।

কানু চকিতে মুখ তুলে বলল, কোথায়?

সুবল বলল, রাধা গেছে তার বাপেরবাড়ি। কেউ বলছে, আয়ানই সেখানে তাকে পাঠিয়েছে। আবার কেউ বলছে, রাজা বৃষভানু মেয়ের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে শুনে নিজেই তাকে লোক পাঠিয়ে নিয়ে গেছেন। আবার এমন কথাও শুনছি সখীদের মুখে যে, কানু একসঙ্গে অনেক গোপিনীর সঙ্গে লীলা করছে বলেই রাধা অভিমান করে গোকুল ছেড়ে চলে গেছে ব্রজপুরীতে।

হতেই পারে না!

কী হতে পারে না?

রাধা আমার ওপর রাগ করে কখনও যাবে না। সে তো জানে, তাকে এক দিন না দেখলে আমার চোখে দুনিয়া ছারখার হয়ে যায়! সে কি আমাকে এতটা শাস্তি দিতে পারে? তাকে নিশ্চয়ই জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সে যাই হোক, রাধা যে বৃষভানুপুরীতে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

কানু বলল, আমি বৃষভানু রাজার আলয়ে যাব?

সুবল তার হাত ধরে টেনে বলল, আরে পাগল, বোস বোস, এখুনি কোথায় যাবি তুই?

কানু বলল, আমি বৃষভানু রাজার আলয়ে যাব।

যাব বললেই কি যাওয়া যায়? সেখানে তোকে ঢুকতে দেবে কেন?

ঢুকতে দেবে না?

কেন দেবে? আমরা রাখাল ছেলে, ইচ্ছে করলেই কি হুটহাট করে রাজার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারি?

আমি দ্বার ভেঙে ঢুকব!

তা তুই পারিস! কিন্তু তা হলেও সান্ত্রী আর প্রহরীরা তোকে ঘিরে থাকবে। দ্বার ভেঙে ঢুকে কি আর রাজনন্দিনীর দেখা পাওয়া যায়?

.

কানু একটুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর সুবলের যুক্তি মেনে, তাকেই অনুনয় করে বলল, ভাই সুবল, তুই তো অনেক রকম কলাকৌশল দেখাতে পারিস, আমাকে দু’-একটা শিখিয়ে দে না!

সুবল বলল, তাতে অনেক সময় লাগবে। ওসব জাদুবিদ্যা কি আর এক-আধ দিনে শেখা যায়!

তবে আমাকে কোনও একটা ভান শিখিয়ে দে। কিংবা আমাকে অন্য রকম কিছু সাজিয়ে দে!

তুই কী সাজতে চাস?

আমি নাপতেনি সেজে রাধার পায়ে আলতা পরাতে যেতে পারি, কিংবা চুড়িওয়ালি সেজে গিয়ে রাধার হাতে চুড়ি পরাব!

তুই এর একটাও পারবি না। ধরা পড়ে যাবি।

তা হলে একটা উপায় বলে দে।

চল, আমি তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি!

সুবল জাদুবিদ্যা আর নাট্যরঙ্গ বেশ ভালোই জানে। এর জন্য তার বেশ কিছু সাজসরঞ্জাম আর বাদ্যযন্ত্রও আছে। সঙ্গীও আছে তিন-চার জন। তারা সবাই মিলে সাজপোশাক বদলে নাটুয়া সাজল, মুখে লাগাল শন আর পাটের দাড়িগোঁফ। তারপর ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে চলল বৃষভানু রাজার পুরীর উদ্দেশে।

বৃন্দাবনের মাঠ পার হয়ে তারা যখন ব্রজের দিকে যাচ্ছে, তখন দেখল পথের ধারে এক জন সাধুর মতন লোক চিত হয়ে শুয়ে আছে আর চিৎকার করছে, জল, একটু জল, জ্বলে গেল, বুক জ্বলে গেল…

সুবল তাই দেখে বলল, লোকটা এখনও মরেনি, আশ্চর্য তো!

কানু বিস্মিত ভাবে বলল, লোকটা কে?

কী জানি! ভিনদেশি সাধু। ক’দিন ধরেই শুয়ে শুয়ে ওই রকম চ্যাঁচাচ্ছে।

তা কেউ ওকে জল দেয় না কেন?

ও নেবে না, মহা পাজি, ও-সব ওর ভান। দেখবি?

সুবল রাস্তা ছেড়ে নেমে গেল লোকটার দিকে। খানিকটা কাছাকাছি যেতেই বৃদ্ধ চোখ ঘুরিয়ে দেখল সুবলকে, তারপর ধমক দিয়ে বলল, এই, কাছে আসবি না। ছুঁবি না আমাকে, ছুঁবি না, তা হলে শাপ দেব—

সুবল আবার দৌড়ে পিছিয়ে এসে বলল, দেখলি! ওর কাছে না গেলে ওকে কেউ জল দেবে কী করে? শাপ দেবার ভয় দেখায়? দূর দূর, এই অপয়াটাকে দেখলাম, এখন আমাদের কাজ হলে হয়!

কেউ আর মাথা ঘামাল না বুড়োকে নিয়ে, রাজবাড়ির দিকে ছুটে চলল। তখন সবে সূর্যাস্ত হচ্ছে, সারা আকাশে ছড়িয়ে গেছে পাকা সোনার রং। সেই রং গায়ে মেখে চলে গেল এই আনন্দ-উচ্ছল তরুণেরা।

রাজবাড়ির দ্বারে সান্ত্রী এসে বাধা দেবার আগেই সুবল গিয়ে বলল, আমরা ভিনদেশি নাটুয়া। আমরা রাজার মনোরঞ্জন করতে এসেছি। আমরা ক্ষুধার্ত, রাজা অনুগ্রহ করলে আমরা আজ রাজপুরীর প্রসাদ খাব।

সান্ত্রী বলল, রও, তোমরা এখানে রও, আমি আগে রাজাকে জিজ্ঞেস করে আসি।

ব্রজপুরে প্রৌঢ় রাজা-রানির নিস্তরঙ্গ জীবন। সন্ধ্যার সময় আমোদ-প্রমোদের উপকরণ সবই চিরাচরিত হয়ে গেছে। নতুন কৌতুকের সংবাদ পেয়ে রাজা খুশি মনেই সম্মতি দিলেন।

সুবলের দল মহা উৎসাহে রাজসভা মণ্ডপের মধ্যে মঞ্চ নির্মাণ করতে লেগে গেল। মঞ্চের পেছনে একটা গুপ্ত ঘরও বানাল নিজেদের সাজ পরিবর্তনের জন্য। কানুকে বসিয়ে রাখল সেই ঘরে।

সভামণ্ডপে জ্বালা হয়েছে অনেকগুলি ঝাড়বাতি। তাদের স্বর্ণময় দণ্ডে আলো পড়ে যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মাথার ওপরের চন্দ্রাতপে হিরে-মুক্তোর চুমকি বসানো। মঞ্চের ঠিক সামনেই রাজা বসেছেন পাত্রমিত্রদের সঙ্গে নিয়ে। তাঁর পেছনে রাজবাড়ির অন্য পুরুষরা। খবর পেয়ে বাইরে থেকে কিছু লোক এসে পেছনে ভিড় করেছে। দু’ পাশের অলিন্দে অতি সূক্ষ্ম বস্ত্রের যবনিকার আড়ালে বসেছে বাড়ির মেয়েরা। জননী কৃত্তিকার পাশে বসেছে রাধা আর তার সখীরা। তাদের রূপের ছটা ওই যবনিকা ভেদ করে আসে।

যথা সময়ে সংকেত দিয়ে রঙ্গ শুরু হল। প্রথমে একেবারে শূন্য মঞ্চ, আড়ালে নানা রকম বাদ্য বাজছে। হঠাৎ হুড়মুড় করে বৃহৎ একটা বরাহ ঢুকে পড়ল মঞ্চে! এবং ক্রুদ্ধ গর্জন করতে লাগল। মঞ্চের ওপর একটি বন্য বরাহ দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল দর্শকরা। বুঝতে সময় লাগল যে, ওটা একজনের সাজ।

বরাহের সামনে দুটি তীক্ষ্ণ দাঁত। সেই দাঁত দিয়ে সে মঞ্চের ভূমিতে আঘাত করল। তারপর ঘাড় শক্ত করে এমন চাপ দিল যে একটু বাদেই মনে হল, শুধু মঞ্চ নয়, গোটা সভাগৃহ এমনকী সম্পূর্ণ মেদিনীই দুলছে ওই বরাহের দাঁতের ধাক্কায়। তখন সবাই বুঝল, এটা বরাহ অবতারের অভিনয়। সবাই সাধুবাদ দিল।

এরপর সুবল মঞ্চের পেছনের গুপ্ত ঘরে এসে অচিরেই বরাহের সাজ বদলে এক বামনে রূপান্তরিত হল। কী করে তার দীর্ঘ শরীরটাও খর্ব করে ফেলল, সেও এক বিস্ময়। এদিকে মধুমঙ্গল সেজেছে বলিরাজা। মঞ্চের ওপর বলিরাজা ও সেই বামনের যুদ্ধ শুরু হল। এক সময় সেই বামন অদ্ভুত কৃতিত্বের সঙ্গে বলিরাজার মাথার ওপর এক পা রেখে এমন চাপ দিল যে বলিরাজা সশরীরে ঢুকে গেল মঞ্চের নীচে! এই বামন অবতারের রূপ দেখেও সকলে সাধুবাদ দিল।

পরের দৃশ্যে অংশুমান সাজল হিরণ্যকশিপু। সে বালক প্রহ্লাদবেশী শ্রীদামের ওপর নানা অত্যাচার করছে এমন সময় মঞ্চে সদর্পে প্রবেশ করল নৃসিংহ অবতার। কী সাংঘাতিক তার রূপ! নীচের অর্ধেকটা মানুষের মতন, উপরের অংশ যেন প্রকৃত সিংহ, কেশর-ভরতি বিরাট মাথা, ভাঁটার মতন জ্বলন্ত চোখ, হাত দু’টিও সিংহের থাবা। সে অবলীলাক্রমে হিরণ্যকশিপুকে কোলে তুলে নিয়ে তার বুক চিরে দিতে লাগল। এমনই অপরূপ ভেলকি যে সত্যিই মনে হল হিরণ্যকশিপুর বুক চিরে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। সেই সঙ্গে সিংহের হিংস্র গর্জন।

সভামণ্ডপে প্রথমে কিছু অস্ফুট ধ্বনি শোনা গেল। তারপর রীতিমতন ভয়ার্ত চিৎকার। রাজা বৃষভানু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, থাক থাক, আর নয়! নাটুয়ার দল, তোমরা চমকপ্রদ খেলা দেখিয়েছ। কিন্তু আর দরকার নেই, আমার লোকেরা ভয় পাচ্ছে।

সুবল তখন সিংহের মুখোশ খুলে ফেলে দুই হাত জোড় করে বলল, মহারাজ, আমাদের আর একটা মাত্র খেলা বাকি আছে, সে-খেলাতে ভয়ের কিছু নেই। তাতে শুধু একটা গীত শুনবেন। সেটা দেখাতে পারি?

রাজা বললেন, তাই হোক।

মঞ্চে যবনিকা ফেলে সুবলরা আড়ালে চলে গেল। একটু পরে যখন যবনিকা উঠল, তখন দেখা গেল, মঞ্চের ওপর একটা কৃত্রিম কদম গাছ, তার নীচে রাখালরাজার বেশে দাঁড়িয়ে আছে কানু। তার মাথায় শিখিপুচ্ছের মুকুট, কপালে রক্ত চন্দনের ফোঁটা, গলায় গুঞ্জাফুলের মালা, পীত রঙের কটি-বসন আর উত্তরীয়। কী অপূর্ব মনোহর তার রূপ! অভিনয়ে অপারগ বলে কানুর লজ্জামাখা মুখখানি নীচের দিকে করা। সে আড়বাঁশিটা নিয়ে আস্তে আস্তে ফুঁ দিল। এবার রাখালরা তাকে ঘিরে একটা গান গাইবে!

কিন্তু গান আর শুরু হল না। অলিন্দে রীতিমতন একটা আলোড়ন পড়ে গেছে। যবনিকার আড়ালে নারীরা শশব্যস্ত। জননী কৃত্তিকার কোলে মাথা ঢলে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে রাধা। তাকে সবাই অন্দরমহলে সরিয়ে নিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। খবর পেয়ে রাজাও উঠে গেলেন। চলে গেল অন্যরাও। অভিনয় থেমে রইল।

সোনার করঙ্ক থেকে জল ছেটানো হতে লাগল রাধার চোখে-মুখে। তবু তার কোনও সাড়া নেই। তার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। চোখ দু’টি নিষ্পলক। অনেকগুলি ব্যাকুল মুখ ঝুঁকে আছে তার দিকে। নানা রকম সম্বোধনে জাগাবার চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে। কিন্তু সে যেন আর এ-পৃথিবীতে নেই।

ডাকা হল রাজবৈদ্যকে। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, নাড়ির গতি ঠিক আছে, শ্বাস সুস্থির আছে, গায়ের বর্ণ অবিকৃত আছে, তবে এ কী রোগ?

তাঁর বটিকা রাধার মুখের কশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। মুখ খুলছে না। ওষুধই যদি পেটে না যায়, তা হলে চিকিৎসা হবে কী করে?

তখন ডাকা হল দেয়াসিনীকে। সে এল তার জড়িবুটির পুঁটলি নিয়ে। সে-ও রাধাকে পরীক্ষা করে বলল, একে তো ভূত-প্রেতে পায়নি। আমার চিকিৎসায় এর কোনও ফল হবে না। যদি হত কোনও ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো, ঠিক আমার মন্তরের জোরে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে বার করতুম—কিন্তু এ তো অন্য অসুখ, এ-অসুখ আমি চিনি না!

এদিকে মঞ্চের ওপর তখনও দাঁড়িয়ে আছে সুবলরা। ফাঁকা মণ্ডপ। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছে না। কানু ভাবছে, এত পরিশ্রম করে কী লাভ হল? এত করেও তো তার দেখা পাওয়া গেল না।

এক সময় বৃন্দাকে যেতে দেখে সুবল দৌড়ে তার কাছে এসে বলল, ভাই বৃন্দে, সবাই কোথায় গেল? আমাদের খেলা আর কেউ দেখবে না!

বৃন্দা মুখঝামটা দিয়ে বলল, না। কেউ দেখবে না। এখন বাড়ি যাও। আমার সই অসুখে পড়েছে!

সুবল ব্যগ্র ভাবে বৃন্দার হাত চেপে ধরে বলল, রাধার অসুখ? কী অসুখ, আমাদের একটু বলে যাও!

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বৃন্দা বলল, নিলাজ, আবার কথা বলতো আসো! কেন তোমরা এখানেও এসে কানুর ওই রূপ দেখালে আমাদের রাধাকে!

সে তো কানুরই অসুখ সারাবার জন্য।

বৃন্দা আর কোনও কথা না বলে চলে যাচ্ছিল, সুবল আবার তার পেছনে পেছনে গিয়ে বলল, তুমি অন্দরমহলে রাজাকে গিয়ে বলল, আমি শ্রীরাধার রোগ সারিয়ে দিতে পারি। আমি নিদান জানি!

এক সময় অন্দর থেকে সুবলের ডাক পড়ল। সে গিয়ে দেখল মণিময় পালঙ্কে চিত হয়ে শুয়ে আছে রাধা। তার চোখ খোলা, কিন্তু পলক নেই। হেম বৰ্ণ ঈষৎ পাণ্ডু হয়ে গেছে। চুল ও বসন জলের ছিটেয় ভেজা।

সুবল গিয়ে রাধার শিয়রের কাছে দাঁড়াল। তারপর ঘরের মধ্যে সমাগত কৌতূহলীদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলল, আপনারা একটু নিভৃতি দিন।

ঘরটি জনমুক্ত হলে সে রাধার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এক দেশে জন্মেছিল চম্পক, আর এক দেশে নীলকমল। তবু স্রোতে ভাসতে ভাসতে একদিন ওদের দেখা হয়ে গেল। ওদের মিলনই ছিল নিয়তি।

রাধা একটুও নড়ল না।

সুবল আবার বলল, এক আঙুল মালা গাঁথে, আর এক আঙুল বাঁশি বাজায়। এখন মালাও গাঁথা হয় না, তাই তমালের নীচে কেউ আর বাঁশিও বাজায় না!

এবার রাধার শ্বাস একটু দ্রুত হল, কিন্তু চোখের পলক পড়ল না।

সুবল আবার বলল, কেউ কনকশয্যায় শুয়ে কাঁদে। কেউ ভূমিশয্যায়। কিন্তু চোখের জল এক।

রাধা এবার চোখের পলক ফেলে সুবলের মুখে দৃষ্টি ন্যস্ত করল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, সে আমাকে আর মনে রাখেনি।

তবে, সে এখানে এসেছে কেন?

শুধু আমায় দুঃখ দিতে।

শ্ৰীমতী, তুমি নিজের দুঃখটা বড় করে দেখলে, তার দুঃখটা দেখলে না? জীবনটা বড় ছোট, আর যারা ভালোবাসে, তাদের সময় আরও দ্রুত চলে যায়।

আমায় সে কালসীমার বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। আমি জানি না, কেন আমাদের গৃহের দ্বার বন্ধ হয়ে গেল। সে কেন দ্বার ভেঙে আসেনি? আমি জানি না, কেন গোকুল থেকে আমাকে এখানে আনা হল। সে কেন আমার পথ রোধ করল না?

তোমার একদিনের অদর্শনেই তার কাছে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, সে আর কিছুই দেখতে পায়নি। তোমরা দু’জনেই অভিমানী, ভালোবাসাই এমন অভিমানের জন্ম দেয়!

সে কি আর কোনও দিনও আমার কাছে আসবে?

সে তো তোমার কাছেই এসেছে।

রাধা ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, আমি যাব— ।

কোথায় যাবে?

তার কাছে।

সুবল তাকে বাধা দিয়ে বলল, এখন না। এখানে তোমাদের দু’জনের দেখা হলে লোকনিন্দা হবে। তুমি তোমার গলার মালা থেকে একটি ফুল ছিঁড়ে দাও কানুর জন্য! আজ থেকে ঠিক দু’দিন বাদে পূর্ণিমা, সেই পূর্ণিমার রাতে তুমি যমুনার ধারে তমালের নীচে এসো। সে আসবে। তুমি সংকেতের জন্য একটা ছোট দীপ জ্বেলে রেখো—

রাধা বলল, আমি আমার সমস্ত দীপ জ্বেলে রাখব। আর কেউ দেখবে না। শুধু সে দেখবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *