১০
রাত্তিরবেলা রাজবাড়িতে ভূরিভোজ খেয়ে রাখালরা সেখানে ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা তারা বাড়ির পথ ধরল। তাদের মনে দারুণ ফুর্তি, তারা অনেক রকম উপহার পেয়েছে। তারা লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে। কানুর ফুর্তি সবচেয়ে বেশি, কারণ সে শ্রীধারার মন পেয়েছে আবার।
মাঠের মধ্যে রাস্তার ধারে সেই বৃদ্ধটি তখনও একই জায়গায় শুয়ে আছে, সেই একই রকম ভাবে চেঁচাচ্ছে, জ্বলে গেল, বুক জ্বলে গেল, একটু জল দাও, বুক জ্বলে গেল।
একজন রাখাল বলল, আঃ, এই বুড়োটা কি এ রকম চ্যাঁচাতেই থাকবে? মরবেও না?
আর এক জন বলল, বোধহয় এইটাই ওর সাধনার অঙ্গ। সাধুদের তো এ রকম অনেক কিছু বায়নাক্কা থাকে।
সুবল বলল, কাল আমি ওকে ভেবে ছিলাম অপয়া। কিন্তু কাল ওকে দেখে গিয়েছিলাম বলেই বোধহয় আমাদের এত সুফল হল।
কানু বলল, দাঁড়া, আমি ওর জল তেষ্টা মিটিয়ে দিচ্ছি!
সবাই বারণ করল, যাসনি কানু, যাসনি, ও অভিশাপ দেবে!
কানু বলল, দেখিই না, কেমন অভিশাপ দেয়!
কাছাকাছি একটা পুষ্করিণী থেকে একটা মৃৎভাণ্ডে খানিকটা জল নিয়ে কানু এগিয়ে গেল সেই বৃদ্ধের দিকে। তখনও কানু জানে না, এই প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সে তার জীবনের এক বিরাট পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে।
বৃদ্ধের চুল-দাড়ি সব পাকা, পরনে টকটকে লোহিত বর্ণের এক টুকরো বস্ত্র, সে বাণবিদ্ধ পশুর মতন ছটফট করছে, তার কশের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফেনা।
কানু তার কাছে এসে বলল, এই নিন, আপনার জন্য আমি জল এনেছি!
ছটফটানি থামিয়ে বৃদ্ধ রক্তবর্ণ চোখে তাকাল কানুর দিকে। তারপর কর্কশ ভাবে বলল, কাছে আসবি না। ছুঁবি না আমাকে, ছুঁবি না, তা হলে শাপ দেব—
কানু বলল, আপনার কাছে না এলে আপনাকে জল পান করাব কী করে?
ছুঁবি না আমায়, দূর হয়ে যা! অভিশাপ দেব—
কানু একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু বৃদ্ধকে জল পান করাবার গোঁ তার মাথায় চেপেছে, সে নিবৃত্ত হল না। আবার এগিয়ে গেল।
বৃদ্ধ বলল, কাছে আসবি না! সাবধান! একবার অভিশাপ দিলে আর ফেরানো যাবে না।
কানু বলল, আপনি চিৎকার করে জল চাইছেন, আপনাকে জল দেওয়া আমার কর্তব্য। আপনি অভিশাপ দেবেন কি দেবেন না—সে আপনার কর্তব্য, বুঝে দেখুন!
জলের পাত্রটি নিয়ে কানু বৃদ্ধের মুখের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল।
ছুঁবি না আমায়। আগে তোর পরিচয় দে।
আমি বৃন্দাবনের নন্দ ঘোষের নন্দন, আমার নাম কৃষ্ণ, আমি ধেনুপালক…
তুই একটা মিথ্যুক! তোর হাতের জল খেলে আমি মহাপাতকী হব।
কানু প্রথমে অবাক হল। লোকটা তাকে মিথ্যুক বলে কোন সাহসে? এর মধ্যে মিথ্যেটা কোথায়!
তারপরই তার রাগ হল। বৃদ্ধের এতটা বাড়াবাড়ি সহ্য করা যায় না।
সে বলল, দেখো বুড়ো। যদি স্বেচ্ছায় এই জল খেতে চাও তো খাও! নইলে আমি জোর করে তোমার চোয়াল ফাঁক করে তারপর মুখের মধ্যে জল ঢেলে দেব, কিংবা তোমায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ফেলে দেব পুষ্করিণীতে।
বৃদ্ধ এবার হাত তুলে কানুকে থামতে বলে নিজেই উঠে বসল। তারপর একেবারে বদলে গিয়ে, খুব শান্ত ভাবে বলল, আমি তিন দিন ধরে এখানে শুয়ে চিৎকার করছি, এর মধ্যে কেউ আমাকে জোর করে জল পান করাতে আসেনি।
আপনিই বা অভিশাপের ভয় দেখাচ্ছিলেন কেন?
তৃষ্ণার্তকে জলদান মানুষের কর্তব্য কিংবা করুণা। তা কতখানি প্রবল? অলীক ভীতির কাছে তা তুচ্ছ হয়ে যায়। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষই আত্মরক্ষণে যত্নবান। নির্ভীক ভাবে পররক্ষণের কাজ একজন বা দু’জনই পারে।
হঠাৎ বৃদ্ধের মুখে এ রকম গুরুগম্ভীর কথা শুনে কানু চুপ করে বসে রইল।
বৃদ্ধ তখন মুচকি হেসে নিজেই ভাণ্ডের সবটুকু জল পান করে তৃপ্তিসূচক আঃ শব্দ করলেন, তারপর বললেন, হে বাসুদেব, আমি তোমারই প্রতীক্ষায় এখানে ছিলাম।
কানু আরও অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
বৃদ্ধ বললেন, আমি সান্দীপনি ঋষি। তোমারই জন্য আমি এসেছি।
আপনি আমাকে বাসুদেব বলছেন কেন? আমার নাম তো—
বৃদ্ধ র্ভৎসনার দৃষ্টিতে বললেন, ছিঃ!
বৃদ্ধের অভিশাপে কানু পুড়ে ছাই হয়ে যায়নি কিংবা ভেড়া বা গাভী হয়ে যায়নি দেখে অন্য রাখালরা ভরসা করে এবার কাছে চলে এল। বৃদ্ধ তাদের বললেন, তোমরা যাও, এই যুবকের সাথে আমার কিছু গূঢ় কথা আছে।
তারা যেতে চায় না। কানুকে ফেলে রেখে তারা যাবে কেন। বৃদ্ধ গম্ভীর ভাবে বললেন, যাও! এর জন্য ভয় পেয়ো না। এর সঙ্গে আমার এমন কথা আছে যা তোমাদের সামনে বলা যাবে না!
তারা চলে গেলে, সান্দীপনি মুনি কৃষ্ণের জানু স্পর্শ করে বললেন, তুমি আত্মবিস্মৃত, তুমি নিজের পরিচয়ও জানো না! বাসুদেব, তুমি পৃথিবীতে অনেক বড় কাজের জন্য জন্মেছ, সামান্য যোষিৎ-সংসর্গে নিমজ্জিত হয়ে থাকা তোমায় মানায় না!
কানু বলল, আপনি কী বলছেন, আমি এখনও বুঝতে পারছি না!
বৎস, তুমি কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছ। তোমার বাবা-মা কংসের কারাগারে পচছে। এবার তুমি তাদের উদ্ধার করে তোমার পুরুষকার প্রমাণ করো।
আমার বাবা-মা কংসের কারাগারে? কালও তো দেখে এসেছি বৃন্দাবনের ঘোষপল্লিতে—
ওরা নয়! নন্দ আর যশোদা তোমার পালক পিতা-মাতা মাত্র! তোমার মা রাজপুত্রী দেবকী, তোমার বাবা বিশিষ্ট গোষ্ঠী-নেতা বসুদেব। তুমি ক্ষত্রিয়। গোপবালকের ছদ্মবেশ ছেড়ে এবার বাইরে এসো।
কানু বিমূঢ় হয়ে গেল। নন্দ-যশোমতী তার বাবা-মা নয়? এ-কথা এত দিন কেউ তাকে বলেনি? সে ঝিম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।
সান্দীপনি মুনি আবার বললেন, তোমার জন্মরহস্য বিশেষ কেউ জানে না। তোমার জন্মরাত্রেই তোমাকে কারাগার থেকে লুকিয়ে এনে গোকুলে যশোদার কোলের কাছে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। যশোদা তখন ঘুমন্ত, কিছুই জানতে পারেনি। সেই রাত্রে যশোদারও একটি কন্যাসন্তান হয়েছিল, তোমার বদলে সে-ই কংসের জল্লাদদের হাতে প্রাণ দেয়। এবার তুমি সেই অত্যাচারের শোধ নাও, ধরণীকে পাপমুক্ত করো। তুমি এখানে সামান্য নারীর রূপের মোহে ভুলে আছ। কিন্তু পৃথিবীতে তোমার আরও অনেক বড় কাজ আছে। আর কালবিলম্ব না করে তুমি মথুরায় চলো। রাজা কংসও এত দিনে তোমার কথা টের পেয়ে গেছে, তুমি আর বেশি দিন আত্মগোপন করে এমনিতেও থাকতে পারবে না।
অনেকক্ষণ বাদে কানু নিচু গলায় প্রশ্ন করল, আমাকে কি আমার এই পালক পিতা-মাতাদের ছেড়ে যেতে হবে?
তোমাকে আরও অনেক কিছুই ছেড়ে যেতে হবে।
কিন্তু এত স্নেহ, এত ভালোবাসা।
স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা—এসব বন্ধন তোমার জন্য নয়। তুমি যে নির্দিষ্ট! তুমি মহৎ কাজের জন্য নির্বাচিত।
কানু তবু সবকিছু অস্বীকার করার শেষ চেষ্টায় বলল, যদি আমি না যাই? কে আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারে? যদি আমি এখানেই রাখাল হয়ে সুখে থেকে যাই বাকি জীবন? রাজচক্রান্ত, হানাহানি এ-সবের মধ্যে যদি নিজেকে না জড়াই কখনও?
ঋষি বললেন, তা আর হবার উপায় নেই, কানু! সেইজন্যই মথুরা থেকে আমি এসেছি তোমার বিস্মৃতি ভাঙাতে। তোমার অন্তরাত্মা জ্বালিয়ে দিতে। তুমি জোর করে এখানে থেকে যেতে পারো, কিন্তু সুখে আর কখনও থাকবে না। তোমার ভেতর সব সময় ধিকিধিকি আগুন জ্বলবে। তুমি কিছুতেই ভুলতে পারবে না যে তুমি বন্দি পিতা-মাতার সন্তান। রাজরক্ত রয়েছে তোমার শরীরে, তোমার ওপর একটা মহৎ কাজের ভার ছিল…
আরও অনেকক্ষণ ঘোর-লাগা অবস্থায় বসে রইল কানু। সান্দীপনি মুনি যুদ্ধবিদ্যা থেকে শুরু করে রাজ্য-পরিচালনা পর্যন্ত নানা বিষয়ে শ্লোক ও মন্ত্র শোনাতে লাগলেন তার কানে।
এরপর ঘটনা অতি দ্রুত ঘটতে লাগল।
সেদিন গৃহে ফিরে আসতে আসতেই কানু দেখল একটি রাজপতাকালাঞ্ছিত রথ দাঁড়িয়ে আছে তাদের কুটিরের সামনে। মহার্ঘ পোশাকে ভূষিত এক রাজদূত গম্ভীর ভাবে পায়চারি করছে সেখানে। উঠোনে অনেক ভিড়। রোহিণী, বলরাম এবং অন্যান্য গোপদেরও দেখা যাচ্ছে।
রাজদূত কানুকে দেখে সবিনয়ে বলল, আমি সংবাদবাহী অক্রূর। রাজা কংস আপনাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি রথ নিয়ে এসেছি।
কানু চমৎকৃত হয়ে গেল। মাত্র এই এক-দু’ দণ্ড আগে সে জেনেছে তার জন্মরহস্য, আর এর মধ্যেই রাজা কংসের দূত এসে গেছে। গতকাল যদি অক্রূর আসত, কানু হয়তো দূর থেকে ওই রথ দেখেই পালিয়ে বনের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকত। কিন্তু আজ আর উপায় নেই। কংসের মুখোমুখি হওয়াই তার নিয়তি।
যশোমতী ব্যাকুল ভাবে ছুটে এসে কানুকে জড়িয়ে ধরে বলল, না কান, তুই কিছুতেই যাবি না! কোথাও যাবি না! আমি তোকে আগলে রাখব! দুরাচার কংস কত বার তোকে মারবার চেষ্টা করেছে। আমাকে না মেরে সে কিছুতেই তোকে নিতে পারবে না।
ঘরের দাওয়ায় বসে নীরবে চোখের জল ফেলছে নন্দ। সে জানে, আর কোনও উপায় নেই। কয়েক দিন আগে তাকেও হাজিরা দিতে হয়েছে রাজা কংসের দরবারে। কংস বৃন্দাবনের প্রত্যেকটি পুরুষকে নিয়ে গিয়ে জেরা করেছে। রাজা কংস জেনে গেছে কানুর প্রকৃত পরিচয়। সেই দিন নন্দও জানল যে কানু তার নিজের সন্তান নয়! মুখ ফুটে যশোদাকে বলতে পারেনি এ-কথা!
কানু যশোমতীকে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, মা, ডাক যখন এসেছে, আমাকে যেতেই হবে!
যশোমতী আরও শক্ত করে তাকে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, না, না, না, কেউ তোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। তুই গেলে আমার মরা দেহের ওপর দিয়ে যেতে হবে!
রোহিণী এসে যশোমতীকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে কঠোর ভাবে বললেন, ছিঃ, বোন! এমন ব্যাকুল হলে কি চলে? তোমাকে আমি বলেছিলাম না, একদিন কানুকে ছাড়তেই হবে। সে তো সারা জীবন রাখালি করার জন্য জন্মায়নি।
যশোমতী বলল, কেন, ছাড়তে হবে কেন? তুমি তা বলবার কে? কানু আমার ছেলে, আমি তাকে ছাড়ব না।
কানু তোমার ছেলে নয়!
অ্যাঁ? কী বললে?
যশোমতী তক্ষুনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যাবে দেখে রোহিণী তাড়াতাড়ি বললেন, কানু শুধু তোমার একার ছেলে নয়, সে সকলের। সে আমাদের সকলের কত বড় গর্ব। সে কংসের বিজয়ে যাচ্ছে।
কানু যশোমতীর হাত ধরে বলল, মা, আমি তোমার! তুমি আশীর্বাদ করো, আমি ঠিক জয়ী হব!
রোহিণী বললেন, কানু তো একা যাচ্ছে না। বলরামও ওর সঙ্গে যাবে। ওদের আরব্ধ কাজ নিষ্পন্ন করার সময় এসেছে। ওরা দুই ভাই জগৎ জয় করবে!
ধীর সুস্থির বলরাম কানুর কাছে এসে বলল, চল কানু, তুই আর আমি পাশাপাশি থাকলে ভয় কী? পাগলা হাতিও আমাদের আটকাতে পারবে না!
রথের অশ্ব দুটো অস্থির হয়ে মাটিতে ক্ষুর ঠুকছে। অক্রুর আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্ণয় করছে সময়। বেলা বেড়ে যাচ্ছে। অনেক দূরের পথ।
কানু বুঝল, আর দেরি করে লাভ নেই। গুরুজনদের প্রণাম করে সে বিদায় নেবার জন্য তৈরি হল!
তখন সুবল কোথা থেকে দৌড়ে এসে বলল, দাঁড়া কানু, তুই মথুরায় যাবিই যখন, তখন এত সামান্য বেশে যাবি কেন? তুই তো আমাদের রাজা! রাজার মতন যাবি!
সুবল কানুকে রাজা সাজাতে লাগল। পীত বস্ত্রের বদলে আজ পরিয়ে দিল সুদৃশ্য মখমলের পোশাক। গলায় ঝুলিয়ে দিল মুক্তামালা। বাহুতে বেঁধে দিল সুবর্ণ-তাবিজ। কোমরবন্ধে ঝুলিয়ে দিল তলোয়ার। কিন্তু মাথায় পরাল সেই ময়ূর পালকের মুকুট।
রাজবেশে কানু প্রণাম করল যশোমতীকে। তার কম্পিত শরীর ধরে বলল, মা, চোখের জল নয়, আজ আশীর্বাদ দাও মা!
তারপর নন্দ, রোহিণী এবং অন্য বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে কানু বলরামকে সঙ্গে নিয়ে রথে উঠতে গেল।
শেষ মুহূর্তে সুবল কানুকে জনান্তিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, কানু, তুই তো শ্রীমতী রাধিকার জন্য কিছু বলে গেলি না? তোকে আমি কী সান্ত্বনা দেব? তাকে যে আমি তোর হয়ে কথা দিয়ে এসেছি!
গলায় বাষ্প এসে গিয়েছিল, অতি কষ্টে তা সংযত করে কানু বলল, রাধাকে বলিস, আমার কাজ শেষ করে আমি ঠিক ফিরে আসব। আমি রাধার কাছে ফিরে আসব। দেখা হবে সেই যমুনার তীরে, তমাল গাছের তলায়, পূর্ণিমা রাত্রে…
ঘর্ঘর শব্দে রথ চলে গেল বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরার দিকে।