রাধাকৃষ্ণ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: নভেম্বর ১৯৭৬
অম্লান দত্ত
শ্ৰদ্ধাস্পদেষ্ণু
১
গাছগুলোর মাথায় এসে পড়েছে নতুন সূর্যের আলো, কিন্তু নীচে এখনও অন্ধকার। রাতের ঘুম এখনও ভাঙেনি, এর মধ্যে ভোর এসেছে। বাগানে শিশিরভেজা কুসুমকলি সবেমাত্র ফুটি ফুটি, বাসা থেকে পাখিরা মুখ বার করে ভাবছে, ডাকবে কি ডাকবে না, এ কি পূর্ণচাঁদের জ্যোৎস্না না দিনমণির আলো? গোয়ালে গোরুগুলো শিং নেড়ে নেড়ে মশা তাড়াচ্ছে। এই সময় দূরে শোনা গেল ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ।
সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল গোয়ালিনী যশোমতীর। তড়িঘড়ি উঠে পড়ল। তার স্বামী তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন, বুকের কাছে জড়িয়ে আছে তাদের একমাত্র শিশুটিকে। শিশুটির ঠোঁটে হাসির লেখা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে হাসে।
ছোট্ট মাটির ঘরটি হাঁড়ি-সরায় ঠাসাঠাসি। ঘরের চাল থেকেও ঝোলানো রয়েছে ঝিঁক। চোখ মুছতে মুছতে যশোমতী এসে দাঁড়াল গবাক্ষের কাছে। কান খাড়া করে রইল। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই, ঘোড়র ক্ষুরের শব্দই এগিয়ে আসছে ক্রমশ। একটি নয়, অনেক।
পক্ষিমাতার মতন ব্যাকুল হয়ে যশোমতী প্রায় ছোঁ দিয়ে ছেলেকে তুলে নিল বুকে। রাজার সৈন্য আসছে তার ছেলেকে কেড়ে নিতে। কী করে লুকোবে, কোথায় লুকোবে এই সাত রাজার ধন এক মানিক? শিশুটি এখনও জাগেনি। যদি হঠাৎ জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করে? যদি সেই কান্নার শব্দ বাইরে পৌঁছোয়?
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে যশোমতী স্বামীর কপালে হাত রেখে বলল, ওগো, ওঠো! ওঠো!
তার স্বামীর নিদ্রা সহজে ভাঙে না।
তখন যশোমতী হাত জোড় করে প্রার্থনার সুরে বলল, ওগো ঘুমঠাকরুন, তোমার পায়ে ধরে মিনতি করি, আমার পতিকে এখন ছেড়ে যাও। আবার রাত আসুক, তখন আবার তুমি এসো। এখন আমি ওঁর চোখ খুলে দিলে অপরাধ নিয়ো না। নিয়ো না।
চৌপাইয়ের তলায় মাটির সরায় জল রাখা ছিল। সেই জল আঁজলা ভরে নিয়ে যশোমতী ঝাপটা মারল তার স্বামীর চোখে। একবার, দু’বার, তিনবার। এদিকে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ বেশ জোর।
নন্দ গোয়ালা বিরক্তিসূচক উঃ শব্দ করে চোখ মেলল। তারপর দেখল, পরমান্ন-ভরা সোনার থালায় পিঁপড়ে ধরার মতন তার স্ত্রীর শান্ত, সুন্দর মুখ-ভরা উদ্বেগ। ছেলে তার পাশে নেই, মায়ের কোলে। কনুই ভর দিয়ে অর্ধেক শরীর উঁচু করে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? বাছার গায়ের আবার তাপ বেড়েছে?
ওগো না! কান পেতে শোনো! তারা আসছে!
নন্দ শুনল। তড়াক করে এক লাফে উঠে পড়ে, দরজার কোণ থেকে সড়কিখানা হাতে নিয়ে বলল, আসুক। আমার ঘর থেকে কেউ আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে পারবে না।
যশোমতী আরও ভয় পেয়ে গেল। একা নন্দ সড়কি হাতে রাজার সৈন্যদলের সঙ্গে লড়বে নাকি? রাজা উগ্রসেনের নিজের হাতে গড়া এই সৈন্যবাহিনী দেখে স্বয়ং মহাবল জরাসন্ধ পর্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন। একথা কে না জানে এই সৈন্যরা কত নৃশংস।
শেষ পর্যন্ত যুক্তি মানল নন্দ। সত্যি, গোঁয়ারতুমিতে কোনও লাভ নেই। যদিও তারা স্বামী-স্ত্রী নিরপরাধ, তবু রাজার উৎকট খেয়াল থেকে শিশুপুত্রকে বাঁচাবার জন্য তাকে পালাতেই হবে।
পুজোর জন্য স্থলপদ্ম আহরণ করতে গিয়ে মেয়েরা যেমন অতি সাবধানে ফুলগুলো কোঁচড়ে রাখে, তেমন সাবধানে শিশুটিকে কোলে নিয়ে নন্দ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পেছনের উঠোন পার হয়ে, লিচু আর জামরুল বাগানের মধ্য দিয়ে সে দৌড়োতে লাগল। দৌড়োতে দৌড়োতে পার হয়ে গেল আরও কত বাগান, তারপর ঘোর বন, তবু সে থামল না।
যতক্ষণ স্বামী-পুত্রকে দেখা যায়, ততক্ষণ যশোমতী দাঁড়িয়ে রইল দরজায়, তারপর ফিরে এল জানলার কাছে। বাইরে থেকে তাকে দেখে মনে হয়, ঠিক যেন কাঠের পুত্তলি, যদিও তার বুকের মধ্যে ঝড় বইছে।
এখন অনেক ঘোড়ার শব্দ, মাঝে মাঝে চিঁহি চিঁহি ডাক, অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা, সৈনিক পুরুষদের হাস্যকৌতুক সবই স্পষ্ট শোনা যায়। ক্রমে, রাজপথে ধুলো উড়িয়ে তারা দৃশ্যমান হল, তাদের সোনার জল করা ঝকমকে শিরস্ত্রাণ দেখলে মনে হয় ঠিক যেন নদীর জলের সকালের সূর্যকিরণ। তাদের কোমরবন্ধে তলোয়ার, পাশে গোঁজা বর্শা, তাদের দৃষ্টি বাজপাখির মতন। রাজা উগ্রসেনের আমলে এই সেনাবাহিনী দেখলে বুকে ভরসা জাগত, মনে হত বাইরের যে-কোনও শত্রুকেই এরা দমন কবতে পারবে। উগ্রসেনের ছেলের আমলে এদের দেখলেই তরাসে বুক কাঁপে, কখন কার সর্বনাশ করবে তার ঠিক নেই।
একটু বাদেই ঘোষপল্লির বিভিন্ন বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল, সৈন্যরা নানান বাড়িতে ঢুকে, জিনিসপত্র তছনছ করে খুঁজে দেখছে কোনও অল্পবয়সি শিশু আছে কিনা। যারা পেরেছে, আগেই তারা নন্দর মতন কোলের ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে। যাদের ঘুম ভাঙেনি, তাদের কপাল পুড়ল। সৈনিকের নিষ্ঠুর হাত মা-বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল শিশুপুত্র। কী অদ্ভুত খেয়াল হয়েছে নতুন রাজার, শিশুরক্ত না দেখলে তৃপ্তি হয় না!
যশোমতীর ঘরেও এল ওরা। যশোমতী একটাও কথা বলল না, দরজা ছেড়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা এসে খাট-বিছানা উলটেপালটে, হাঁড়ি-সরা ভেঙে তন্ন তন্ন করে দেখল। একটা হাঁড়িতে ভরা ছিল ক্ষীরের লাড্ডু, সেগুলো নিয়ে লোফালুফি করতে করতে বেরিয়ে গেল তারা। তখন যশোদা বুকের কাছে হাত জোড় করে বিড়বিড় করতে লাগল, কত দূরে; কত দূরে গেছে ওরা? ওদের কেউ দেখেনি তো? হে ঠাকুর, তুমি ওদের দেখো।
এদিকে কত দূরে যে ছুটে চলেছে নন্দ, তার খেয়াল নেই! অশ্বারোহী সৈনিকদের নাগালের বাইরে যেতে হবে। এক সময় হাঁপাতে হাঁপাতে হাত পা অবশ্য হয়ে এল। চারদিকে ঘোর জঙ্গল। এখানে কেউ দেখতে পাবে না। ছেলেকে কোলে রেখেই নন্দ একটা বড় গাছের গুঁড়ির কাছে বসল।
ছেলে জেগে উঠেছে এর মধ্যে। পিট পিট করে চাইছে। রীতিমতন দিনের আলো ফুটে গেছে, এক্ষুনি ছেলে কিছু খেতে চাইবে। নন্দরও খুব খিদে পেয়েছে। খিদের জ্বালায় ছেলে যদি কাঁদতে শুরু করে এখানে কী খাওয়াবে ছেলেকে! এখানে কোনও গাছের ফল কি বিশ্বাস করে খাওয়ানো যায়? নন্দ গাছগুলোকে চেনবার চেষ্টা করল। কয়েকটা গাছ চেনা, কয়েকটা অচেনা। কদম ফুলে ভরা গাছটি চেনা যায়, একটু দূরে দেখা যায় কয়েকটা বেল আর নারকেল গাছ, সবচেয়ে উঁচু গাছটি পিয়াল। একটি গাছের গা থেকে ভারী সুন্দর গন্ধ আসছে, এটাই কি চন্দনগাছ? আর ওই যে গাছের গুঁড়ির রং একেবারে কালো, এটার নাম কী? লোকমুখে সেও তমাল গাছের নাম শুনেছে, এই কি সেই তমাল? হবেও বা।
ছেলে আর কোলে থাকতে চাইছে না, ছটফট করছে। নন্দ তাকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হল। দু’-আড়াই বছর বয়স। এর মধ্যেই গুট গুট করে দিব্যি দৌড়োদৌড়ি করতে পারে। নন্দ চোখে চোখে রাখল, ছেলে খেলতে লাগল এদিক-ওদিক। ঘন জঙ্গল হলেও, আসবার পথে দু’-একটা ভাঙাচুরো বাড়ি চোখে পড়েছে। হয়তো একসময়ে এখানে কোনও নগর ছিল, কোন রাজার খেয়ালে একদিন ধ্বংস হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে একটা মিষ্টি কুলকুল শব্দ। নিশ্চয়ই নদী আছে কাছাকাছি কোথাও!
নন্দর মাথায় একটা চিন্তা এল। গোকুল ছেড়ে এখানে এসে বাড়ি বানিয়ে থাকলে কেমন হয়? রাজার সৈন্যরা কি আর এদিকে আসবে? এ-জায়গাটা ভারী সুন্দর, থাকার পক্ষে বেশ। কাছাকাছি নদী যখন আছে, তখন গোচারণের তৃণভূমিও থাকবে অবশ্যই। ফেরার সময় ভালো করে দেখে যেতে হবে তো!
দুপুরের আগে ফেরা নিরাপদ নয়। এর মধ্যে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। ছেলেটা এখনও কান্না জুড়ে দেয়নি। রোজ সকালে উঠে দুধ-ননি খাওয়া তার অভ্যাস। নতুন জায়গায় এসে দিব্যি খেলায় মেতে উঠেছে। কোথা থেকে একটা ময়ূরের পালক কুড়িয়ে পেয়ে খলখল করে হাসছে। নন্দ সতর্ক চোখে তাকাল। ময়ূর অতি হিংস্র পাখি। বাচ্চা ছেলে দেখলে চোখ ঠুকরে দেয়।
ছেলে একটা ঝোপের আড়ালে চলে যেতেই নন্দ উঠে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরল। সেই সময় দূরে কর্কশ শব্দে একটা ময়ূর ডাকল। নন্দ আর আকাশের দিকে তাকাবারও সময় পেল না; হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামল।
সে কী অঝোর বৃষ্টি! কোথায় লুকিয়ে ছিল এত মেঘ, দিব্যি তো রোদ খটখট করছিল। আকাশ জুড়ে যেন লক্ষ ভাল্লুকের দঙ্গল হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে একটা ঘন পাতাওয়ালা গাছের নীচে আশ্রয় নিল নন্দ। কিন্তু সে-বৃক্ষও বেশিক্ষণ আশ্রয় দিল না। এক সময় সেখানে দ্বিগুণ বেগে জল পড়ে। ভিজে-নেয়ে একশা হয়ে গেল বাপ আর ছেলে। নন্দ ছেলেকে মুড়ি দিয়ে রেখেছিল নিজের গায়ের উড়নি দিয়ে। সেই ভিজে ত্যানা বার বার সরিয়ে ছেলে বৃষ্টির জলে হাত ঘোরায়। এখনও এক বারও কাঁদেনি। তবু নন্দর বুকের মধ্যে খুব যাতনা হয়, ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে বার বার। এইটুকু ছেলে, জলে ভিজে যদি সান্নিপাতিক হয়। স্নেহের যদি কোনও অলৌকিক ক্ষমতা থাকত, তা হলে নন্দ তার শিশুপুত্রের মাথার ওপর চন্দ্রাতপ খাটিয়ে দিত এখনই।
.
নন্দরা ইন্দ্রের পূজারী। একবার তার ইচ্ছে হল, হাত জোড় করে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে বর্ষণ বন্ধ করে দেবার জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু হাত উঠল না। খরা-অজন্মার বৎসরের বিভীষিকার কথা তার মনে পড়ে। ইন্দ্রদেব সদয় হয়েই বৃষ্টি দিয়েছেন। মাঘ মাস শেষ হয়ে গেছে, এখন বৃষ্টি হলে রাজা এবং দেশের পুণ্য হয়। হায় রাজা! তার কোপন স্বভাবের জন্যই আজ নন্দকে চোরের মতন পালিয়ে এসে এই আশ্রয়হীন অরণ্যে ছেলেকে নিয়ে ভিজতে হচ্ছে।
প্রায় এক দণ্ড পরে বৃষ্টির তেজ কমতে লাগল একটু একটু করে। গাছতলা ছেড়ে নন্দ ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল, উড়ুনিটা নিংড়ে মাথা মুছে দিল ছেলের। বড় দীন গলায় জিজ্ঞেস করল, খুব খিদে পেয়েছে, না রে?
ছেলে বলল, খুব আর একটু!
নন্দ বলল, এই তো এখুনি বাড়ি যাব, তোর মা তোকে খেতে দেবে, দুধ, ননি, সর, মোয়া, নারকেলনাড়ু—আর কী খাবি?
ছেলে বলল, আর জল খাব!
নন্দ বলল, আহা রে, আহা রে, এত বৃষ্টিতে ভিজেও জলের তেষ্টা মিটল না! দেখি কপালটা? একটু যেন গরম গরম? নাকি মনের ভুল!
ছেলের ডান হাতের আঙুল ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করিয়ে নন্দ সবেমাত্র বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করেছে, এই সময় একটু দূরে শুনতে পেল গান। রিনরিনে কচি গলা। একটি নয়, তিন-চার জনের। এখানে এ-বিজন বনে কে গান করে? এখানে কি অপ্সরারা গোপনে খেলা করতে আসে? অপ্সরাদের চোখের সামনে পড়ে গেলে যদি কোনও অপরাধ হয়!
ক্রমে দেখা গেল চারটি মেয়ে হেলে দুলে নাচতে নাচতে আসছে বনের পথে। তাদের ন’-দশ বছরের বেশি বয়স নয়, পিঠের ওপর চুল খোলা, কাঁচা সোনার মতন বর্ণ, গন্ধরাজ ফুলের মতন মুখশ্রী। যেন সত্যিই চারটি অপ্সরা কিংবা বনবালা।
মেয়ে চারটি হঠাৎ নন্দকে দেখে ভয় পেয়ে বলল, ওমা!
নন্দ কণ্ঠস্বরে অনেকখানি কাকুতিমিনতি মিশিয়ে বলল, ভয় পেয়ো না, বাছারা, কিচ্ছু ভয় নেই।
ওরা আড়ষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
নন্দ ওদের আরও একটু আশ্বস্ত করার জন্য বলল, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে এই পথে যাচ্ছিলাম। আমার নাম নন্দ গোপ, আমার ছেলের নাম কানু। তোমরা এই বনের মধ্যে দিয়ে কোথায় যাচ্ছ? তোমরা কি মানবী, না দেবী?
মেয়েরা এবার ফিক করে হাসল। এ-ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, এই, তুই বল না, এই, তুই বল না!
তারপর ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে ফুটফুটে, যার মুখখানিকে পদ্ম বলে ভুল করে মৌমাছি এসে বসতে পারে, সে কোকিলজয়ী কণ্ঠে বলল, আমি বৃষভানু রাজার মেয়ে, আমার নাম রাধা। আর এরা আমার সখী। আমরা যমুনায় ব্রত পারণ করতে যাচ্ছি।
নন্দ উৎফুল্ল হয়ে বলল, ওমা, তুমি বৃষভানুদাদার মেয়ে! এর মধ্যে কত ডাগরটি হয়েছ! তোমার বাবাকে আমার কথা বোলো, উনি চিনতে পারবেন।
নন্দর আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। সে আরও বলল, আমিই তো তোমার বাবা আর মায়ের বিয়ে দিয়েছি!
কানু ততক্ষণে বাবার হাত ছাড়িয়ে মেয়েদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মেয়ের কোঁচড়ে বাতাসা আর ফুটকড়াই ছিল, ঠিক তা নজর করে সেদিকে হাত বাড়িয়েছে। মাটিতে পড়ে গেল কয়েকটি বাতাসা।
নন্দ তা দেখে বড় লজ্জা পেল। তবু লজ্জার মাথা খেয়ে বলল, আমার বাছার বড় খিদে পেয়েছে, ওকে দু’টি বাতাসা দেবে মা?
এক সখী বলল, এ যে আমরা ব্রতের জন্য নিয়ে যাচ্ছি। ব্রত না হয়ে গেলে কী করে দেব?
কানু তবু কেড়ে নেবার জন্য হাত বাড়াচ্ছে। তা দেখে রাধা বলল, আহা দুটো বাতাসা দে, বৃন্দে! ব্রতে কি আর সব লাগে!
ঝপ করে সে কানুকে কোলে তুলে নিল।
নন্দ ব্যস্ত হয়ে বলল, দেখো, দেখো, রাখতে পারবে না, বড় দুরন্ত ছেলে।
রাধা বলল, আহা, এইটুকু ছেলেকে কোলে রাখতে পারব না।
আদর করে সে কানুর গালে একটু হামি দিয়ে বলল, ইস, কী সুন্দর ছেলেটি, টানা টানা চোখ, তিলফুলের মতন নাক! দ্যাখ দ্যাখ বিশাখা, কী রকম খট খট করে হাসছে!
অন্য সখীরাও আদর করল কানুকে। কানুর এক হাতে তখনও সেই ময়ূরপালকটি ধরা। রাধা সেই পালকটা গোল করে মুড়ে কানুর মাথায় পরিয়ে দিল। তারপর বলল, কী সুন্দর মানিয়েছে না? ঠিক যেন স্বর্গের রাজপুত্তুর!
ছেলের প্রশংসায় সব সময়ই গর্ব হয় নন্দর। সে একটা তৃপ্তির শ্বাস নিয়ে বলল, তোমাকে দেখেও আমার আজ বড় আনন্দ হল, মা! অনেক দিন যাইনি তোমাদের পাড়ায়। তোমার বাবাকে আমার কথা বোলো। যদিও এখন এ-দেশের রাজা কংস, তবু তোমার বাবাকেও আমরা রাজা বলি। বড় মানুষ না হলে রাজা হওয়া যায় না, তোমার বাপ সত্যিকারের বড় মানুষ। তোমার মা কেমন আছেন?
ভালো।
যেমন লক্ষ্মী শ্রীময়ী তোমার মা, তেমনটিই তুমি হয়েছ। জানো, আমি একবার কান্যকুব্জে তীর্থ করতে গেছি, রাজপথে একটি কিশোরীকে দেখলাম, যেন স্বয়ং লক্ষ্মী। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। লোকের কাছে খোঁজ করে জানলাম, ও হচ্ছে ভলন্দরের রাজকন্যা। অমন রূপবতী মেয়ে আমাদের এ-দেশঘাটে একটিও দেখিনি। মনে মনে ভাবলাম, আহা, এমন মেয়েকে যদি আমাদের ওদিকে বউ করে আনা যায়! বুক ঠুকে গেলাম ভলন্দর রাজার দরবারে। সরল ভাবে বললাম, হে রাজন, আপনার কন্যা কলাবতীকে আপনি আমাদের রাজ্যে সম্প্রদান করুন। ব্রজের রাজা সুরভানুর ছেলে বৃষভানু অতি সুযোগ্য পাত্র। রাজকুমার বৃষভানু রূপেগুণে অদ্বিতীয়। যেমন তার উদার হৃদয়, তেমনই পরাক্রম! তাই শুনে ভলন্দররাজ বললেন, আপনি যখন বলছেন, চলুন একবার চোখে দেখে আসি ছেলেটিকে। যদি ললাটলিখন থাকে সেখানেই আমার মেয়ের বিয়ে হবে! তারপর সত্যি সত্যি রাজপুত্রী কলাবতীর সঙ্গে যুবরাজ বৃষভানুর পরিণয় হয়ে গেল। তা হলে দেখলে মা, তোমার বাবা-মায়ের বিয়েতে আমিই ঘটকালি করে ছিলাম?
একটু থেমে, রাধার মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে নন্দ বলল, ভাবছি আর একটা বিয়েতেও আমি ঘটকালি করব!
বয়স্ক লোকেরা গল্প শুরু করলে সহজে থামে না। রাধার সখীরা চঞ্চলা হয়ে উঠেছে। একজন রাধাকে একটু ঠেলা দিয়ে বলল, ও লো রাই, জল সইতে যাবি নে? সূর্য যে মাথার ওপর উঠল!
নন্দ ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, মা, তোমরা ক’টি বালিকা যে এই বনপথ দিয়ে যাও, তোমাদের ভয় করে না? দুষ্টু লোকের তো অভাব নেই! তা ছাড়া আছে কংসের সৈন্যরা।
রাধা বলল, আমরা তো এদিক দিয়ে প্রায়ই যাই। আমাদের তো কেউ কিছু বলে না।
নন্দ বলল, তুমি মা রাজার ঝিয়ারি, তোমার নাম শুনলেই সবাই সমীহ করবে। আমি সামান্য গোয়ালা, তাই সব সময় আতঙ্কে থাকি! বড় উৎপাত শুরু করেছে কংসের সেনারা। তবে শুনেছি, ওরা শুধু পুরুষ-শিশুদেরই ধরে নিয়ে যায়, মেয়ে-শিশুদের কিছু বলে না! আমার কানুকে যে কত কষ্টে রক্ষা করি! এমন প্রতাপ রাজা কংসের যে ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানোরাও তাকে ভয় পায়। কতবার কত প্রেতিনি, ডাকিনী, দানো পাঠিয়েছে আমার কানুকে মারবার জন্য! ভাবছি এবার গোকুল ছেড়ে চলে যাব! এই বনের মধ্যে এসে ঘর বানিয়ে থাকলে কেমন হয়।?
রাধা বলল, আসুন না, তা হলে আমাদের বাড়িরও কাছাকাছি হবে।
এখান থেকে ব্রজপুরী কতটা দূর?
এক ক্রোশ খানেক!
এ-জায়গাটার নাম কী?
এ-বনকে তো সবাই বৃন্দাবন বলে।
বাঃ সুন্দর নাম! আমি বললে আমার প্রতিবেশীরাও আমার সঙ্গে চলে আসতে রাজি হবে। এখানেই হবে আমাদের গয়লাপল্লি।
বিশাখা উতলা হয়ে বলল, ও রাই, চল না! কত দেরি হল যে!
নন্দ বলল, হ্যাঁ মা, আর তোমাদের আটকাব না। এই কানু, চল বাড়ি যাবি না? দিব্যি কোলে চড়ে বসে আছিস যে! নাব!
আর একবার শিশু কৃষ্ণের মুখ চুম্বন করে কোল থেকে নামিয়ে দিল বালিকা রাধা।