৩
রাজা কংসের এক খুড়তুতো বোনের নাম দেবকী। তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বসুদেবের। কংস বিয়ের পরও বোনকে কাছ-ছাড়া করেনি। ভগ্নীপতিকে ঘরজামাই করে রেখেছে। রাজপ্রাসাদে নয় অবশ্য, কারাগারে, সেখানে দেবকী-বসুদেবের যত্নআত্তির কোনও অভাব নেই, অনেকগুলি রক্ষী তাদের দেখাশুনো করে। কিন্তু কারাগারের বাইরে এক পা-ও যেতে পারে না।
দেবকী ছাড়াও বসুদেবের আর এক স্ত্রী আছে, তার নাম রোহিণী। একমাত্র পুত্রকে নিলে রোহিণী থাকে আভীরপল্লিতে। স্বামী-সঙ্গ-বঞ্চিতা রোহিণী বড় একটা কারওর সঙ্গে মেশেন না। তাঁর দুঃখ নিয়ে তিনি একলা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছেন বছরের পর বছর।
একদিন সেই রোহিণী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এলেন যশোমতীর বাড়িতে। রোহিণীর ছেলেটির ফুটফুটে ফরসা রং, চেহারায় বেশ একটা নাদুসনুদুস ভাব। চলেও খানিকটা হেলেদুলে। এমনিতে সে বেশ হাসিখুশি ধরনের। কিন্তু হঠাৎ একবার রেগে উঠলে তাকে আর সামলানো যায় না। তার এখন বছর তেরো বয়স।
সেই সময় গোরুগুলোকে মাঠে চরাতে নিয়ে যাবার জন্য গোয়াল থেকে বার করছিল কানু। মশা তাড়াবার জন্য গোয়ালঘরে ধুনো দেওয়া হয়েছিল, সেই ধুনোর ধোঁয়ার মধ্যে কানু যেন একেবারে মিশে রয়েছে।
কানু এখন দ্বাদশবর্ষীয় কিশোর। হাত-পা রীতিমতন সবল। শ্রাবণ মাসের মেঘের মতন গায়ের রং, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। কপাট বুক, খাঁজ-কাটা কোমর, বয়সের তুলনায় তাকে দেখায় অনেক বড়। সে আগে দুরন্ত ছিল, এখন দুর্দান্ত হয়েছে। তাকে নিয়ে যশোমতীর সব সময় ভয়।
যশোমতী সপুত্র রোহিণীকে দেখে একটু অবাক হয়েছে। রোহিণী তো কখনও কারওর বাড়িতে আসে না। রোহিণী রোগা হয়ে গেছে অনেক, মাথার চুলগুলোতে জট বেধে গেছে, কেমন যেন তপঃক্লিষ্ট চেহারা।
যশোমতী কানুর জন্য জলখাবারের পুঁটলি বেঁধে দিচ্ছিল, রোহিণীকে দেখে আসন পেতে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।
গোরুগুলো নিয়ে কানু বেরিয়ে আসার পর রোহিণী তাকে ডেকে বললেন, বাছা, এদিকে একটু শুনে যাও তো!
কানু কাছে আসতে রোহিণী স্নেহের সঙ্গে তার মস্তক আঘ্রাণ করলেন। তারপর নিজের ছেলের দিকে দেখিয়ে বললেন, বাছা কানু, ইটি তোমার বড় ভাই হয়, একে প্রণাম করো!
কানু আর যশোমতী দু’জনেই অবাক। বৃন্দাবনের সব বালকই সবার ভাইয়ের মতন। এতে নতুন কিছু নেই। তবে রোহিণীর কথার মধ্যে কেমন যেন একটা হুকুমের সুর আছে।
যাই হোক, মাতৃসমা এক নারী আদেশ করেছেন বলে কানু ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেলল।
রোহিণী আবার বললেন, আজ থেকে যখন তোমরা গোষ্ঠে ধেনু চরাতে যাবে, তখন একেও সঙ্গে নিয়ে যাবে!
বিস্ময় ভেঙে যশোমতী বলল, বাঃ কী সুন্দর ছেলেটি তোমার দিদি! কনকচাঁপার মতন গায়ের রং, মুখখানি যেন চাঁদের টুকরো। স্বয়ং চাঁদ যেন এসে জন্ম নিয়েছে তোমার ঘরে। কী নাম তোমার ছেলের?
রোহিণী বললেন, এর নাম সঙ্কর্ষণ। ডাকনামও আছে দুটো। কেউ বলে বলরাম, কেউ বলে বলাই।
যশোমতী বলল, বাঃ, বলাই নামটাই তো সুন্দর। আমার কানুর সঙ্গে বেশ মিলে যাবে। কানাই আর বলাই! আমার ছেলে জন্মাবার কয়েকদিন পরেই তো গর্গ সাধু এসে উপস্থিত! গর্গ সাধুকে চেনো তো দিদি? আমি ভাবলাম যাক, ভালোই হল। সাধুবাবাকে বললাম, আমার ছেলের একটা নামকরণ করে দাও। সাধু অমনি বললেন, নাম রাখো শ্রীকৃষ্ণ। আমরা তো এমন নাম আগে কক্ষনও শুনিনি। ছেলের গায়ের রং একটু ময়লা, তা বলে নামও সেই রকম রাখতে হবে? যাই হোক, সাধুর কথা তো আর ফেলতে পারি না! কিন্তু অত খটমট নাম তো সব সময় উচ্চারণ করা যায় না, তাই আমরা বলি কানাই, কখনও বলি কানু।
.
রোহিণী ভূমির দিকে চক্ষু রেখে বললেন, আমি জানি, গর্গমুনি আমার ছেলেরও নামকরণ করে গেছেন। কিন্তু বোন, গর্গমুনি তোমাকে আর কিছু বলেননি?
যশোমতী থতমত খেয়ে বলল, না তো! মানে সাধু তো অনেক কথাই বলে ছিলেন, উনি বেশি কথা বলতে ভালো বাসেন, তুমি কোন কথাটা বলছ দিদি?
রোহিণী উত্তর দেবার আগেই হইহই করে উপস্থিত হল ছেলের দঙ্গল। যে-যার বাড়ির গোরু নিয়ে এসেছে মাঠে চরাবার জন্য। তারা চেঁচামেচি জুড়ে দিল, এই কানু, যাবি না? আয়! সূয্যি যে মাথায় চড়ল! কানু চঞ্চল হয়ে গোরুগুলির দড়ির বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, মা, যাই? খাবারের পুঁটলি কই, দাও!
রোহিণী তাঁর ছেলেকে বললেন, বলাই তুমিও সঙ্গে যাও! ছোটভাইকে চোখে চোখে রাখবে।
বলাইয়ের হাত ধরে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল কানু। যশোমতীর চোখে শঙ্কার ছায়া। প্রতি দিনই ছেলে বাইরে যাবার সময় তাঁর এই রকম ভয় হয়। অতি দুরন্ত ছেলে, তায় বাইরে আবার শোনা যাচ্ছে নাকি কালীদহে মস্ত বড় একটা অজগর সাপ এসেছে।
যশোমতী ছুটে গেল উঠোনের বেড়ার ধারে। কাতর গলায় বলল, কানু, সাবধানে থাকবি কিন্তু! তুই ধেনুগুলোর আগে আগে কিছুতেই যাবি না! ওরে পরানের পরান নীলমণি, আমার শপথ রইল, মনে থাকে যেন! পথে অনেক তৃণাঙ্কুর আছে, দেখে দেখে যাস কিন্তু। আর কারু নামে যে বড় ধেনুটা আছে, সেটা খেপে গেলে তুই যেন তার শিং ধরে থামাতে যাস না! মনে থাকে যেন! মাঠে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসবি, গায়ে বেশি রোদ্দুর লাগাসনি, তা হলে আমারও গা পুড়ে যাবে!
কানু অতি শান্ত ছেলের মতো জননীর প্রতিটি অনুরোধের উত্তরেই বলতে লাগল, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা।
মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে ধেনুর পাল নিয়ে ছেলেরা চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
যশোমতী আবার আস্তে আস্তে ফিরে এল আঙিনার কাছে। যোগাসনের ভঙ্গিতে মেরুঁদাড়া সোজা করে বসে আছেন রোহিণী। চোখের দৃষ্টি তীব্র। দেখেই কী রকম যেন গা ছমছম করে যশোমতীর। ঘরের মধ্যে গিয়ে একটা কাঁসার রেকাবিতে কয়েকটা মিষ্টি সাজিয়ে, পাথরের গেলাসে জল ভরে এনে রোহিণীর সামনে রাখল। তারপর বিনীত ভাবে বলল, দিদি, তুমি গর্গসাধুর কথায় কী বলছিলে?
রোহিণী বললেন, যাক, তিনি যখন কিছু বলেননি, তখন এখন আর বলার দরকার নেই।
কী কথা দিদি, কোনও গোপন কথা?
সময় হলে জানবে!
রোহিণী দিদি, হঠাৎ এতদিন বাদে তুমি আমাদের বাড়িতে এলে, তোমার ছেলেকে বললে কানুর দাদা— এর মানে কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
রোহিণী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন যশোমতীর দিকে। তারপর ধমক দেবার সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কিছুই জানো না?
যশোমতী থরথরিয়ে উত্তর দিল, না, কিছুই বুঝলাম না। এর মধ্যে কি কোনও গুহ্য কথা আছে? আমার ভয় করছে, এই দেখো, আমার বুক কাঁপছে। কত বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি ছেলেকে—
রোহিণী এবার একটু নরম হলেন। যশোমতীর বাহু স্পর্শ করে বললেন, ভয় নেই বোন! তুমি, আমি, আরও অনেকে একটি খুব বড় কার্যসাধনের নিমিত্ত হয়ে আছি। আমি ভেবেছিলাম, তুমি তার কিছু কিছু জানো। জানো না যখন, তখন এখন আর জেনে কাজ নেই। জানালে, তোমার অবস্থাও আমার মতন হবে, এমনি শুকনো কাঠ হয়ে যাবে। তার চেয়ে, তুমি রসে-বশেই থাকো। তোমার স্নেহসুধা উছলে দাও! সেই চরম সময় তো একদিন আসবেই—
এদিকে গোপপল্লি ছাড়াতে-না-ছাড়াতেই কানু নিজমূর্তি ধরল। গায়ের উড়নিটা জড়িয়ে বাঁধল কোমরে। সেখানে ছোরার মতন গুঁজে নিল তার আড়বাঁশিটা। তারপর কারু নামে যে বিশাল বলীবর্দটি ধারালো শিং নিয়ে, মাথা নেড়ে নেড়ে, কান লটপটিয়ে আগে আগে যাচ্ছে, সেটির শিং চেপে ধরে লাফিয়ে তার পিঠে চড়ে বসল কানু। জিভ উলটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ইঃ! ইঃ-রে-রে-রে-রে—
বলীবর্দটির পেটে হাঁটুর চাপ দিতেই সেটা জোর কদমে দৌড়োল। অন্যদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল অনেকখানি। অন্য রাখালরা চেঁচাতে লাগল। যাসনে, যাসনে, ওরে কানু, যাসনে— । কে শোনে কার কথা।
একেবারে যমুনার ধারে একটা উঁচু ঢিবির সামনে এসে থামল কানু। লাফ দিয়ে নীচে নামল। অন্যরা এখন অনেক পেছনে পড়ে আছে। অদূরেই ঘন সবূজ তৃণভূমি। সেই তৃণভূমির গা ঘেঁষেই ভাঙছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে যমুনার ছোট ছোট ঢেউ। ঢিবিটার ওপরে উঠলে দেখা যায়, ডান পাশে, খানিকটা দূরে বড় কদমগাছটার নীচে খেয়াঘাট। আজ বুঝি হাটবার, তাই খেয়াঘাটে এখন বেশ ভিড়, মাথায় পসরা নিয়ে গোপিনীরা দাঁড়িয়ে আছে পার হবার অপেক্ষায়।
অন্য রাখালরা এসে পৌঁছোবার পর গোরুগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হল ঘাসবনে। যার যার জলখাবারের পুঁটুলি সব জড়ো করে রাখা হল এক কদমতরুর তলায়। যমুনায় নেমে ওরা হাত-মুখ ধুল। তারপর সুদাম বলল, আজ কী খেলা হবে রে?
এক এক দিন এক এক রকম খেলা জমে। কোনও দিন দেব-দৈত্যি, কোনও দিন গজ-কচ্ছপ, কোনও দিন শুম্ভ-নিশুম্ভ, কোনও দিন নাগযজ্ঞ। শ্রীদাম বলল, আজ ভাই রাজা-প্রজা খেলা হোক। এই খেলাটায় মারামারি নেই। অন্য দিন আমি বড্ড মার খাই!
সুবল বলল, ঠিক আছে, সেই খেলাই হোক। আমি তবে রাজা হব।
কানু তাকে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, যা রে! তোর তো চেহারাই প্রজার মতন, তুই কী করে রাজা হবি?
মধুমঙ্গল বলল, তা হলে কে রাজা হবে?
কানু নিজের বুক বাজিয়ে বলল, আমি! তা ছাড়া আবার কে?
সবাই হইহই করে উঠল। অনেক জনের অনেক রকম কথা, ঠিক বোঝা যায় না। সুবল চেঁচিয়ে বলল, না ভাই, কানু কেন রোজ রোজ রাজা হবে? আমরা বুঝি বানের জলে ভেসে এসেছি? কানু কি আমার মতন ভেলকি দেখাতে পারে? সে কি আমার মতন নানা রকম সাজতে পারে?
কানু তার উদ্দেশে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, তা হলে তুমি বহুরূপী সেজে রথের মেলায় ভেলকি দেখাও গে! রাজা সাজার অত শখ কেন? যে সবাইকে জয় করে, সেই রাজা হয়!
আহা, তুই যেন আমাদের সবাইকে জয় করে বসে আছিস আর কী!
কানু আবার নিজের বুকে গুম গুম করে কিল মেরে বলল, কোন প্রতিযোগিতায় কে আমার সঙ্গে জিততে পারে, আয় দেখি!
রাখাল বালকদের মধ্যে অংশুমানকেই সবচেয়ে লম্বা-চওড়া দেখায়। তার পাশে দাঁড়ানো মধুমঙ্গলের পেটটি কিছু নাদা হলেও গায়ে বেশ শক্তি। নবাগত বলরামের শক্তি যে কতখানি তা কেউ জানে না!
কোমরে গোঁজা আড়বাঁশিটা হাতে নিয়ে কানু বলল, আমি এটাকে যমুনায় ছুড়ে দেব, দেখি কে এটা আগে তুলে আনতে পারে!
বাঁশিটা সজোরে ছুড়ে দিল কানু, সেটা অনেকখানি দূরে গিয়ে ঝপ করে জলের মধ্যে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাঁচ-সাত জন রাখাল বালক।
যদিও এদের মধ্যে কানুই সবচেয়ে ভালো সাঁতার জানে, তবু সাবধানের মার নেই। যাতে হঠাৎ কেউ তার থেকে আগে-না চলে যায়, সেইজন্যে সে ডুবো সাঁতারে গিয়ে শ্রীদামের পা ধরে টান লাগাল, মধুমঙ্গলের ঘাড় ধরে চুবুনি খাইয়ে দিল। তারপর বাঁশিটা নিয়ে সগর্বে ফিরে এল সবার আগে!
সুবল বলল, আচ্ছা দেখি, এই কদমবৃক্ষটির একেবারে মগডালে সবচে আগে কে উঠতে পারে?
কথা শেষ হতে-না-হতেই ছেলেরা লাফিয়ে উঠে গাছের ডাল ধরল। কানু তো সকলের আগে উঠবেই, তবু সাবধানের মার নেই। সুদাম কানুর থেকে একটা উঁচু ডালে পা দিতেই কানু সে ডালটায় হাত দিয়ে ধরে এমন ঝাঁকুনি লাগাল যে সুদাম বেচারা পা পিছলে পড়ে যেতে যেতে কোনওক্রমে নীচের ডালটা ধরে জীবন বাঁচাল। আর অংশুমান গায়ের জোরে কানুকে ঠেলে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেই কানু একটা লাল-পিঁপড়ের বাসা ভেঙে ছেড়ে দিল তার গায়। তারপর হাসতে হাসতে সে গিয়ে মগডালে উঠে বসল।
তাতেও শান্তি নেই। সেইখান থেকে কানু চেঁচিয়ে বলল, এবার যে-যেখানে আছি সেখান থেকে এক লাফ দিয়ে মাটিতে নামতে হবে, কে কে পারবে?
এ-কথায় সব রাখালই শিউরে উঠল। এত উঁচু থেকে লাফালে হাত-পা ভাঙবে নিশ্চিত। কানু বসে আছে সবচেয়ে উঁচুতে। তার মুখেই এই প্রস্তাব।
কানু বলল, আমি গুনছি—চন্দ্র, পক্ষ, নেত্র, চতুর্বেদ।
তারপর সত্যি সে লাফ দিল। সে একাই শুধু। ঘন পাতাওয়ালা কদম গাছের ডালপালায় গুঁতো খেতে খেতে সে নীচে পড়তে লাগল।
তবু ভাগ্য যে নীচের মাটি বৃষ্টি-ভেজা নরম ছিল। কানু সেখানে ধপ করে পড়ার পর সবাই ছুটে এল তার কাছে। বলরাম এসে কানুর মাথাটা কোলে তুলে নিল। কিন্তু কানু মিটিমিটি হাসছে। তার লাগেনি।
অন্য দুটো খেলায় কানু কৌশল করে জিতেছে বলে যদিও কারওর কারওর প্রতিবাদ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এরপর কেউ আর মুখে রা কাড়ল না। এবার সবাই বুঝে গেছে যে, অন্তত সাহসে কানুই সবার সেরা।
বলরাম গম্ভীর ভাবে বলল, কা-ক্কানুই রাজা হ-বে!
সব রাখালরা চোখাচোখি করল। এতক্ষণে তারা ধরতে পেরেছে, বলরাম কেন এত কম কথা বলে। সে একটু তোতলা।
উঁচু ঢিবিটার ওপর এক জায়গায় আরও কিছু মাটি ফেলে সিংহাসন বানানো হল। সেখানে বসানো হল কানুকে।
মধুমঙ্গল বলল, আমাদের রাজার মুকুট কোথায়?
সুবল বলল, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
সুবল হাতের কাজ বেশ ভালো জানে। ছদ্মবেশ ধারণেও বেশ ওস্তাদ। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে লতাপাতা পাকিয়ে তার সঙ্গে কদমফুল জুড়ে বেশ একটা মুকুট বানিয়ে ফেলল।
কিন্তু সেটা পছন্দ হল না কানুর। সে বলল, আমার ময়ূরের পালকের মুকুট চাই।
যমুনা তীরে ময়ূরের পালকের অভাব কী? একটু জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে কয়েকটা টাটকা পালক নিয়ে এল সুবল। সেগুলোকে গোল করে, লতার বাঁধন দিয়ে বেশ একটা মজবুত ধরনের মুকুট তৈরি হয়ে গেল।
সুবল যখন সেটা কানুর মাথায় পরাচ্ছে, তখন কানু আস্তে আস্তে বলল, খুব ছোটবেলায় একজন আমার মাথায় এ রকম একটা ময়ূর পালকের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল।
কে?
কী জানি! তার নাম মনে নেই, মুখ মনে নেই। শুধু মনে আছে তার হাত দু’খানির কথা, আর গায়ের গন্ধ।
কী রকম হাত?
তোর মতন এ রকম কেঠো কেঠো আর শক্ত নয়। কী সুন্দর নরম আর রাঙা রাঙা। ঠিক যেন করমচার মতন। আর গায়ের গন্ধে যেন চন্দনের সুবাস। মনে হয় যেন সেই গন্ধ আমার কতকালের চেনা। যেন আমার আগের জন্ম, তারও আগের জন্মে ওই গন্ধ পেয়েছি।
আহা রে কানু, তোর যে দেখছি চক্ষু বুজে আসছে!
সঙ্গে সঙ্গে কানু পূর্ণ চোখ মেলে কটমট করে তাকিয়ে বলল, এবার আমি হুকুম জারি করছি, সবাই মন দিয়ে শোনো! প্রজারা, সবাই দেখে এসো, আমাদের গোষ্ঠরাজ্যে কোনও শত্রু ঢুকেছে কিনা! আগে দক্ষিণ দিকে যাও।
সব রাখাল বালক ছুটল দক্ষিণ দিকে।
একটু পরে তারা ফিরে এসে দেখে কানু দিব্যি খাবারের পুঁটলি খুলে সিংহাসনে বসে খাওয়ায় মন দিয়েছে! তাদের দেখে কানু আবার হুকুম দিল, দক্ষিণ দেখে এসেছ? এবার উত্তর দিকে যাও। সবাই যাবে।
রাখালরা উত্তর দিকও ঘুরে এসে দেখল, কানু তখনও খাচ্ছে। নিজের পুঁটুলি ছাড়াও আরও তিন-চার জনের খাবার শেষ করেছে। তা দেখে হইহই করে উঠল সবাই। কানু হাসতে হাসতে বলল, তোরা আর একটু দেরি করতে পারলি নে? তা হলে সব ক’টা পুঁটুলি শেষ করতাম!
সুবল বলল, এবার তুই সত্যিই খাঁটি রাজা হয়েছিস রে কানু! প্রজার অন্ন মেরে রাজা নিজের পেট মোটা করে!
কানু বলল, তোদের বিপদ-আপদ হলে আমিই তো লড়াই করব। তাই আমার গায়ের জোর করে নিচ্ছি।
এমন সময় ঘাসবনের দূর প্রান্তে একটা বিশ্রী হ্যাঁক্কো-হ্যাঁক্কো-হাঁক্কো ধরনের কলরব শোনা গেল। সকলে উৎকর্ণ হল এবং বুঝতে দেরি হল না।
এদিকে মাঝে মাঝে বুনো গাধার খুব উৎপাত হয়। এদের বড় বড় দাঁত, গায়েও খুব জোর। গোরু বা মানুষ সামনে যাকেই পায় অমনি ঢুঁসো মারে আর শক্ত পায়ের চাঁট দেয়। গোরুগুলো বড্ড ভয় পায় এদের।
রাখালরা চেঁচিয়ে বলল, রাজামশাই, ওই তো শত্রু এসেছে। ওই তো শত্রু!
কানু লাফ দিয়ে উঠে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিতে গেল।
তার আগেই বলরাম বলল, তু-তুই থাক কানু, আমি দেখছি!
বলরাম তিরবেগে ছুটে গেল ঘাসবনের মধ্যে। তারপরেই দেখা গেল সে একটা বুনো গাধার দু’ পা ধরে মাথার ওপর তুলে বনবন করে ঘোরাচ্ছে। অতবড় একটা প্রাণীকে ও রকম ভাবে উঁচু করে তোলা—সকলে স্তম্ভিত হয়ে দেখল বলরামের কতখানি গায়ের জোর। বলরাম গাধাটাকে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল জলের মধ্যে।।
তখন কানুও সদলবলে ছুটে গেল। শুরু হল ঘাসবনের মধ্যে এক খণ্ড যুদ্ধ। গোঁয়ার গাধাগুলো শুধু সামনেই এগিয়ে আসে, সহজে পিছু হটতে জানে না। কানু লাঠির বাড়ি মেরে মেরে তাদের ক্ষতবিক্ষত করে দিতে লাগল। অন্য রাখালরাও তাদের পাচনবাড়ি দিয়ে পেটাতে লাগল ধপাধপ শব্দে। শেষ পর্যন্ত গাধাগুলো রণে ভঙ্গ দিল, বলরাম ও কানুর হাতে প্রাণও দিয়ে গেল কয়েকটি।
পরিশ্রান্ত রাখালরা আবার ফিরে এল ঢিবিটার কাছে। যেটুকু খাবার অবশিষ্ট ছিল, ভাগ করে খেতে বসল সবাই। কানু এই অবসরে তার বাঁশিতে ফুঁ দিল। সত্যি বড় মিষ্টি সুর তুলতে শিখেছে ছেলেটা, সারাদিন সে যত দুরন্তপনাই করুক, সন্ধ্যাবেলা শ্মশানের ধারে এক সাধুর কাছে ঠিক নিয়মিত সে বাঁশি শিখতে যায়। তার সুরের লহরী ছড়িয়ে পড়ছে বহু দূর পর্যন্ত। এমনকী তার বাড়িতে যশোমতীর কানে গিয়েও পৌঁছোয়। সেই বাঁশির শব্দ শুনে মা যশোমতী খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে।