৯. আমার গুজরাত পরিদর্শন
দেবদূত মুক্ত কারণ তার আছে জ্ঞান,
অজ্ঞানতার জন্য পশুও মুক্ত,
এই দুই-এর মাঝে সংগ্রাম করে মানবসন্তান।
—রুমি
আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি, উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ হল আমাদের এমন এক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে যেখানে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ নির্মূল হবে এবং অশিক্ষা দূরীভূত হবে। এর পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন এমন এক সমাজের উদ্ভব ঘটানো যেখানে নারী এবং শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ থাকবে না এবং সমাজের কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাববে না। আমি রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করার ঠিক পরেই প্রথম গুরুতর দায়িত্বভার হিসেবে ২০০২ সালের অগস্ট মাসে যখন গুজরাত পরিদর্শনে গেছিলাম তখন এই চিন্তাগুলো আমার মনের মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে ওই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল এবং তার দরুন হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু রাজনৈতিক সংকটাকুল পরিবেশের অনন্যসাধারণ পরিস্থিতিতে পরিদর্শনে যাওয়া হয়েছিল ফলে এটা একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর দায়িত্বভার ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার লক্ষ্য হল কী হয়েছিল বা কী হচ্ছে তা দেখা নয় বরং কী হওয়া উচিত সেদিকে মনোনিবেশ করা। যা হয়েছিল তা ইতিমধ্যেই বিচারবিভাগ এবং সংসদে এক আলোচ্য বিষয়, এবং এখনও সে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে হয়ে চলেছে।
যেহেতু এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনও কোনও রাষ্ট্রপতি কোনও অঞ্চল পরিদর্শন করতে যাননি, ফলে এই সংকটকালে আমার পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। মন্ত্রী এবং আমলাতান্ত্রিক মহল পরামর্শ দিয়েছিলেন, ওই সময়ে আমার গুজরাত যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। রাজনীতি তার প্রধান কারণ। যদিও আমি স্থির করেছিলাম যাওয়া এবং রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার প্রথম পরিদর্শনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছিল।
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী আমায় শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে আপনার গুজরাত যাওয়া কি খুব জরুরি?’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘আমার বিবেচনায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যাতে আমি কোনওভাবে যন্ত্রণা লাঘবে সহায়তা করতে পারি এবং ত্রাণব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে পারি। আর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অভিভাষণে যে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম, যা আমার লক্ষ্যও ছিল সেই মানসিক সমন্বয় গঠনেও সাহায্য করতে পারি।’
এ প্রসঙ্গে অনেক ধরনের আশঙ্কার কথা প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল আমার গুজরাত গমন মুখ্যমন্ত্রীর বয়কট করা উচিত যাতে আমি শীতল অভ্যর্থনা পাই, এবং বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু যখন আমি গাঁধীনগরে পদার্পণ করলাম, আশ্চর্য হলাম দেখে যে শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নন, তাঁর সমগ্র মন্ত্রিসভা, বিরাটসংখ্যক বিধানসভার সদস্য, আধিকারিক এবং জনতা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। আমি বারোটা জায়গায় পরিদর্শনে গেছিলাম— তিনটে ত্রাণশিবির এবং দাঙ্গাবিধ্বস্ত ন’টি অঞ্চল— যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি ছিল। মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরিদর্শনকালে আগাগোড়া আমার সঙ্গে ছিলেন। একদিক থেকে তিনি আমায় সাহায্যই করেছিলেন, যেহেতু তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন যেখানে যেখানে আমি গিয়েছিলাম সর্বত্র যে অভিযোগ ও আর্জিগুলো পেয়েছিলাম সেগুলো সম্পর্কে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হস্তক্ষেপ করার পরামর্শ দিতে পেরেছিলাম।
কোনও এক ত্রাণশিবিরের একটা দৃশ্যের কথা আমার মনে পড়ে। ছ’বছরের একটা বাচ্চা কাছে এসে আমার দু’হাত ধরে বলেছিল, ‘রাষ্ট্রপতিজি, আমার বাবা আর মাকে আমি চাই’—শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ আমি জেলা কালেক্টরদের সঙ্গে একটা বৈঠক ডেকেছিলাম—ছেলেটির শিক্ষা এবং কল্যাণভার সরকার কর্তৃক গৃহীত হবে মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে আমাকে আশ্বাসদান করেছিলেন।
যখন অহমদাবাদ ও গাঁধীনগরে ছিলাম, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলা ও তাঁদের সমস্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগতভাবে জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
এরকম একটা সম্মেলনে প্রায় ২০০০ জন অহমদাবাদবাসী আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য গুজরাতি ভাষায় জানাচ্ছিলেন, আমার এক বন্ধু তা অনুবাদ করছিলেন। আমাকে প্রায় ৫০টা প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ১৫০টা আর্জি জানানো হয়েছিল।
অহমদাবাদে দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমার পরিদর্শন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। অক্ষরধামে আমি প্রমুখ স্বামীজি মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তিনি আমায় স্বাগত জানিয়েছিলেন। ওই পুণ্যাত্মার সঙ্গে আমি মানসিক ঐক্য অর্জনের এবং গুজরাত দেশ মহাত্মা গাঁধী, সর্দার বল্লভভাই পটেল এবং বিক্রম সরাভাই-এর মতো মহান ব্যক্তিত্বদের জন্ম দিয়েছে সেই রাজ্যের ক্ষতস্থানে শান্তির প্রলেপ দেওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম।
আমি সাবরমতী আশ্রমেও গিয়েছিলাম। ওখানে অনেক আশ্রমবাসীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। দেখেছিলাম ওদের চোখে-মুখে তীব্র মর্মবেদনার ছায়া—এমনকী প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার কাজকর্ম যেন বিষাদাক্রান্ত হৃদয়ে ওরা করে চলেছিল। অক্ষরধামেও আমি একই আবেগের সম্মুখীন হয়েছিলাম। যখন আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম কেন, তখন উপলব্ধি করেছিলাম এই দুটো প্রতিষ্ঠানই তাদের মানবজাতির প্রতি সহজাত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং তাদের ধর্মীয় পরিবেশ সমাজে আনন্দ, শান্তি এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করার দরুন এই উদ্ভূত বেদনাজনক পরিস্থিতি যা নিবারণ করা সম্ভব ছিল, সেটা গ্রহণ করতে পারছিল না। আমি একথা বলি, যেহেতু আমাদের জন্মভূমিতে উন্নত মানবসভ্যতা উদ্ভূত হওয়ার ঐতিহ্য আছে এবং যেখানে মহান মনীষীরা জন্মগ্রহণ করে উন্নতমস্তকে অবিচলরূপে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির আদর্শস্বরূপ প্রতিভাত, সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত বিয়োগান্তক ঘটনার মতো বুদ্ধিবৈকল্য কখনও হওয়া উচিত নয়।
এই সফরে আগাগোড়া একটা চিন্তা আমার মন থেকে কখনও যাচ্ছিল না। অনেক মানুষের উন্নতি ঘটাতে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে আমাদের হাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। উন্নয়ন আমাদের সম্পাদ্য কার্যাবলি হওয়া উচিত নয় কি? যে-কোনও ধর্মবিশ্বাসী নাগরিকের আনন্দের সঙ্গে বাঁচার মৌলিক অধিকার আছে। কারও অধিকার নেই মানসিক একতাকে বিপন্ন করে তোলার, কারণ আমাদের রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হল মনের ঐক্য, আর এ কারণেই আমাদের দেশ অতুলনীয়। তা হলে বিচারই-বা কী আর গণতন্ত্রই-বা কী? দেশের প্রতিটি নাগরিকের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে, কোনও ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য অর্জন করার অধিকার আছে। গণতন্ত্র যে সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাকে অর্জনের জন্য যথার্থ এবং সত্পথে বিপুল পরিমাণে সুযোগের অধিকার পেতে হবে। সংবিধানের মূল বিষয়বস্তু তাই। এবং এ সমস্তই একটি প্রকৃত প্রাণস্পন্দিত গণতন্ত্রে জীবনযাত্রাকে সামগ্রিক ও অর্থপূর্ণ করে তোলে— মানবজীবনের বিশ্বাস এবং জীবনশৈলীর সহিষ্ণুতার মধ্যেই যার সারাৎসার।
মানসিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে আমাদের সকলের কাজ করা খুব প্রয়োজনীয় বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি এবং অন্যের জীবনযাত্রা বা ধর্মের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি বা এই মনোভাবের বিভিন্নতা মানুষের বিরুদ্ধে যখন নীতিহীন হিংসার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের সবাইকে পরিশ্রম করতে হবে এবং ব্যক্তির অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টায় সক্রিয় হতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই ভিত্তিকে আমি আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্য বলে মনে করি যা আমাদের দেশের পরমাত্মা।
দু’দিনের সফরসূচির শেষে প্রচারমাধ্যম আমার কাছ থেকে একটা বার্তা আশা করেছিল, তাই এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এক বক্তব্যের মাধ্যমে আমার মনোভাব প্রকাশ করেছিলাম যে, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য যাবতীয় দ্বন্দ্বকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য এক ঐকান্তিক আন্দোলনের এবং মানসিক সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন আছে।
.
প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজের ভাষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসের অনুশীলন করার মৌলিক অধিকার আছে। আমরা কোনওভাবে তা বিঘ্নিত করতে পারি না।