৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি

৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি

সক্ষমতা নিজের অন্তর থেকে আসে,
ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ তা দিতে পারে না

রাষ্ট্রপতি পদগ্রহণ আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। ইন্ডিয়া ২০২০ কে রূপদান করার ক্ষেত্রে এটা একটা মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। আমি বিশ্বাস করি দেশের সকল নাগরিকের যেমন, সংসদ-অভিমুখী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, প্রশাসক, শিল্পী, লেখক এবং দেশের যুবসমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অর্জন করা সম্ভব। এই মিশন বা লক্ষ্যের প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করানোর জন্য মুখোমুখি আলোচনাই সবচেয়ে শ্রেয় উপায়, যা অন্যের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও এর সঙ্গে সম্মিলিত করতে সাহায্য করবে।

রাষ্ট্রপতি পদ আমায় এই সুযোগ দিয়েছিল। আমি সরাসরি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, বিশেষত যুবসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে দেশের জন্য এই লক্ষ্য কার্যে পরিণত হওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পারছিলাম।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার ভূমিকার এটা একটা অতিরিক্ত উদ্দেশ্য ছিল। সাংবিধানিক ভূমিকানুযায়ী সরকার এবং বিধানমণ্ডলের প্রতিটি কার্য যাতে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সম্পাদিত হয় সে-ব্যাপার রাষ্ট্রপতি সুনিশ্চিত করবেন। সরকারের প্রতিটি কার্য ভারতের রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। সংসদে বিল ও অধ্যাদেশ পাশ হলে সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর অনুমোদনের জন্য আসে। এবং তাঁকে নিশ্চিত হতে হয় যে, সেই আইন সংক্রান্ত নথি সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের মঙ্গলসাধনে সক্ষম। তাঁকে আরও দেখতে হয় যে, পক্ষপাতদুষ্ট কার্যে পরিণত হওয়ার মতো কোনও পূর্বদৃষ্টান্ত যেন স্থাপিত না হয়।

আমি রাষ্ট্রপতি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির মধ্যে যাব না। যদিও এগুলো সংবিধান, ঐতিহ্য এবং পূর্বদৃষ্টান্ত দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট, আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি শুধু দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হয়ে না থেকে আরও অনেক কিছু করার অপেক্ষা রাখেন।

সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করবার সুযোগ আছে, সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে অনুঘটকের কাজ করে উন্নয়নখাতে যেমন অর্জন সম্ভব। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শক্তি ব্যক্তিগতভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, যাতে তারা সংখ্যায় যথেষ্ট না হওয়ার দরুন যে-কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে। রাজ্যপাল এবং তাঁদের রাজ্যসমূহের কার্যকলাপের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ পরামর্শদান এবং সামরিক শক্তির সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাদের অনুকরণীয় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।

উপরন্তু, দেশের প্রধান হওয়ায় তিনি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনকে আরও বেশি মানুষের সহজগম্য করে তোলা যাতে তা মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে। মানুষকে নিজেদের দেশের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করানোর এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত করানোর এই ছিল আমার পদ্ধতি। ফলে, রাষ্ট্রপতি হয়েও আমি মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিলাম এবং এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক বেশি পারস্পরিক প্রভাব বিস্তারকারী ছিল।

প্রথম যে কাজগুলো আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে শুরু করি তার মধ্যে অন্যতম হল ই-গভর্ন্যান্স চালু করা। ওখানে কম্পিউটার ব্যবহার করা হত কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেই প্রণালীকে আরও আধুনিক করার প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে যে-সমস্ত নথি, দস্তাবেজ এবং চিঠিপত্র আসত আমরা একটা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম যে, প্রথমেই সেগুলো ডিজিটাইজ়ড বা আঙ্কিক করা ও তাতে বার কোড বসানো। কাগজের নথিগুলো তারপর মহাফেজখানায় সংরক্ষিত হবে। তারপর থেকে নথি বৈদ্যুতিনভাবে বিভিন্ন সরকারি আধিকারিক, অধিকর্তা, সচিবের দপ্তরে, রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্বানুসারে পাঠানো হত।

আমার এমন এক প্রক্রিয়ার স্বপ্ন ছিল যার দ্বারা রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সমস্ত রাজ্যপালের দপ্তর এবং নানা মন্ত্রকের সঙ্গে সুরক্ষিত মেসেজিং নেটওয়ার্কের দ্বারা, সঙ্গে G২G ই-গভর্ন্যান্স অপারেশনে সক্ষম ডিজিটাল সিগনেচার সংযুক্ত থাকে। আমরা প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করেছিলাম এবং সেটা প্রয়োগের জন্য তৈরি ছিল। আশা করা যায় একদিন আমার স্বপ্ন সত্যি হবে। যখন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের নয়টি বিভাগে আমরা বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স প্রয়োগ করলাম, পরীক্ষা করে দেখলাম এটা সত্যি কার্যকারিতা সহায়ক কি না। সাধারণত নাগরিকদের কাছ থেকে দরখাস্ত পাবলিক-১ বিভাগে দাখিল হত। একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কুড়িটা দরখাস্তের সাধারণত সাতদিন সময় লাগত, কিন্তু বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স চালু হওয়ার পর দেখা গেল চল্লিশটা দরখাস্তের ফয়সালা মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। আমি আশা করি বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে গেলে এই ব্যবস্থাগুলি যে কেউ দেখতে পাবেন।

রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের প্রথম দিকে আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রাতরাশকালীন আলোচনায় রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো, যাতে আমি সেখানকার উন্নয়ন অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারি। ২০০৩ সালে এই বৈঠক ১১ মার্চ থেকে ৬ মে এই তিন মাস হয়েছিল। আমার মনে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।

প্রতিটা বৈঠকের উদ্দেশ্য পরিকল্পনামাফিক সাজানো হত। আমি এবং আমার সহযোগীরা তার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নিতাম। আমরা প্রতিটা রাজ্যের সামর্থ্য এবং উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা গবেষণার ব্যবস্থা করতাম। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি পরিকল্পনা কমিশন, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারি বিভাগ, রাজ্যগুলির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দস্তাবেজ থেকে সংগ্রহ করা হত।

তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে গ্রাফিক্স এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে উপযুক্তভাবে পেশ করা হত। বৈঠকগুলোতে সংসদের সদস্যদের জন্য পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানানো হত তিনটি ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়ে। ১. উন্নত ভারতের স্বপ্ন ২. বিশেষ কয়েকটা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উত্তরাধিকার এবং ৩. তাদের মূল দক্ষতা।

উদ্দেশ্য ছিল দেশের উন্নতি অর্জনের জন্য লক্ষ্যের ওপর জোর দেওয়া। এইসমস্ত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর ফলে চতুর্থ দিকটাও তৈরি করা হল— প্রতিটি রাজ্যর জন্য উন্নয়নসূচক নির্বাচন করা হল। সমস্ত দলের সংসদ সদস্যদের প্রস্তুতি এবং নিবেদনের দ্বারা কী অসামান্য সমৃদ্ধসাধন ঘটল। ওঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমৃদ্ধি সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে আমাকে সাহায্য করেছিল।

আমার প্রথম বৈঠক বিহার থেকে আগত সাংসদের সঙ্গে ছিল। প্রেজেন্টেশনের বিষয়ে সদস্যদের উদ্দীপনা দেখে আমি প্রবল উৎসাহিত হয়ে পড়লাম— প্রেজেন্টেশনে বিহার সম্পর্কিত জাতীয় উন্নয়নে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, রাজ্যের মূল দক্ষতা এবং কীভাবে রাজ্যকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব অন্তর্ভুক্ত হয়। সাংসদদের মনে হয়েছিল বৈঠক অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। ফলে আমরা প্রাতরাশকালীন আলোচনা ৬০ মিনিট থেকে বাড়িয়ে ৯০ মিনিট করেছিলাম। আমাদের সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন বৈঠকে মীমাংসা হওয়ার পরেও বা প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে গেলেও অনেক সদস্য তাঁদের নিজেদের রাজ্যে প্রেজেন্টেশনের প্রযোজ্যতা নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এই বৈঠকগুলো নথিবদ্ধ করে রাখা হত।

ব্যক্তিগতভাবে আমি বৈঠকগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। প্রতিটি অঞ্চলের চাহিদা আমার পক্ষে প্রকৃত শিক্ষা ছিল। এই প্রস্তুতি সাংসদদের আয়ত্তাধীন ক্ষেত্র থেকে পরিযোজনের দ্বারা সম্পূরিত হত। অনেক সদস্য আমায় এও বলেছিলেন, এই ধরনের বিস্তৃত প্রস্তুতি তাঁদের পক্ষে খুব কার্যকরী হয়েছিল। আসল কথা হল এই খুঁটিনাটি এবং আলোচনা রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে বা পরবর্তী সময়ে আমার এবং সাংসদদের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগবন্ধন হয়ে উঠেছিল। এখনও, যখন ওঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমাদের কথোপকথন এবং আলোচনা উন্নয়নভিত্তিক হয়ে থাকে।

বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া পরিযোজন-সহ ইন্ডিয়া ২০২০ ক্রমবিবর্তন আমাকে সমাজ সংক্রান্ত রূপান্তরের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে মনোনিবেশ করাত। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে রাজ্যগুলির বিস্তারিত আলোচনা আমাকে উন্নয়নের জন্য পথপ্রদর্শনে অতিরিক্ত নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সাংসদরা অনেক প্রয়োজনীয় ধারণার কথা আমায় জানাতেন। সংসদে অন্ততপক্ষে ন’বার আমি ২০২০ সালে ভারতের স্বপ্ন নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি এবং বারোটা রাজ্য বিধানসভায় কোনও একটা বিশেষ রাজ্যের উন্নয়নের উপায় নিয়ে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে যে ধরনের প্রশ্ন ও পরামর্শ আমার কাছে আসত, তার দ্বারা রাজ্যগুলির উন্নয়নে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তাকে একত্রিত করার রাস্তা তৈরি হত, যেমন কর্মসংস্থান বাড়ানো, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র সক্রিয়করণ, গ্রামীণ অঞ্চলের যোগাযোগের উন্নতিসাধন এবং আমার ডাটাবেস বা তথ্যসংগ্রহে শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষসাধন। আমি সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে যা বক্তব্য রেখেছিলাম তা এই ডাটাবেস-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন আমি জাতীয় এবং রাজ্য বণিকসভা, শিল্প মহল, পরিচালন সংঘ, কারিগরি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতাম তখন কীভাবে ইন্ডিয়া ২০২০ অর্জন করতে পারব সে-বিষয়ে উদাহরণযোগে ব্যাখ্যা করতে এই ডাটাবেস বা সূত্রসংগ্রহ সহায়ক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যুক্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই স্বপ্নের অংশ হিসেবে উন্নয়নের দশটা স্তম্ভের উদ্ভব ঘটেছিল। আজ আমি পেশাদার, বণিকনেতা এবং গবেষকদের উদ্দেশে বলি এই দশ স্তম্ভ অর্জন করতে কীভাবে তাঁরা উদ্ভাবনী ধারণা নিবেদন করতে পারেন, যেমন—

১. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে গ্রামীণ এবং নাগরিক বিভাজন এক ক্ষীণরেখায় অবনমিত হয়।

২. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে শক্তি এবং উৎকৃষ্ট জলের যথাযথ বণ্টন এবং যথেষ্ট অধিগম্যতা থাকে।

৩. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে কৃষি, শিল্প এবং সেবাবিভাগ এক ছন্দে কাজ করে।

৪. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে নৈতিক মূল্য সমম্বিত শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ সংক্রান্ত বা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে কোনও মেধাবী ছাত্রকে অস্বীকার করে না।

৫. এমন এক রাষ্ট্র যা প্রতিভাবান পণ্ডিত, বিজ্ঞানী এবং বিনিয়োগকারীর মূল গন্তব্য হয়।

৬. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় সবাই থাকে।

৭. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে শাসন বিভাগ দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়।

৮. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ উৎপাটিত, অশিক্ষা দূরীভূত এবং নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধ থাকবে না এবং সমাজের কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাববে না।

৯. এমন এক রাষ্ট্র যা সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যবান, সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ, সুখী এবং এক নিরবচ্ছিন্ন বৃদ্ধির পথ অনুসরণ করে।

১০. এমন এক রাষ্ট্র যা অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবাসভূমি এবং যে রাষ্ট্র তার নেতৃত্বের জন্য গর্ববোধ করে।

কীভাবে দেশের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনা করবেন তা এই প্রাতরাশকালীন বৈঠকে নির্ণয় করা হত। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতি ভবন হল একমাত্র স্থান যেখানে দলগত পার্থক্য মুছে গিয়ে সমস্ত সাংসদদের কাছে সম্পূর্ণ অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে ধরা পড়ত।

রাষ্ট্রপতি ভবনে সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও দুটি সভার উদ্দেশে ভাষণের সুযোগ আমি দশবারের বেশি পেয়েছি।

ভাষণ ভাবগম্ভীর পরিবেশে হয়ে থাকে এবং সেন্ট্রাল হলের উপছে পড়া ভিড়ে আমার ভাষণের সময় পিন পতনের নৈঃশব্দ্য বিরাজ করত। সংসদের সঙ্গে আমার দু’ধরনের ভাবের আদানপ্রদান হত। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, পাঁচটা বাজেট বক্তৃতার মতো সম্পূর্ণ সরকারি বক্তৃতা আর অন্যটা হল আমার নিজস্ব ভাবনাচিন্তা, ধ্যানধারণাসমৃদ্ধ বক্তৃতা। সরকারি প্রেজেন্টেশনেও আমি আমার নিজস্ব কিছু ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটাতাম যা আমি আলোচনা করতে চাইতাম। বাজপেয়ীজি এবং ড. সিং আমার পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

দেশের প্রতি সাংসদদের কী ভূমিকা ও দায়িত্ববোধ থাকা উচিত সে বিষয়ে তাঁদের প্রভাবিত করতে আমি এই মঞ্চ ব্যবহার করতাম। ২০০৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক স্মারক অনুষ্ঠানে সাংসদদের উদ্দেশে ভাষণকালে আমি যে বার্তা দিয়েছিলাম তার দ্বারা স্ব-স্ব নির্বাচন ক্ষেত্র, তাঁদের রাজ্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমি বক্তব্য রেখেছিলাম, ‘প্রকৃত মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য আমাদের আন্দোলন আজও অসম্পূর্ণ, আমাদের কাহিনি আজও উন্মোচিত হচ্ছে। সাংসদ এবং বিধানসভা সদস্যদের নতুন লক্ষ্য এবং নেতৃত্বের সঙ্গে অগ্রসর হওয়ার সময় এসে গেছে, যাতে আমাদের রাষ্ট্র শুধুমাত্র আলোকিত, ঐক্যবদ্ধ, সুসংবদ্ধ, সম্পদশালী এবং সমৃদ্ধ হয়ে না থেকে, সর্বোপরি এক সুরক্ষিত রাষ্ট্র, বহিঃশত্রু এবং সীমান্ত অনুপ্রবেশকারীদের কাছে চির অভেদ্য হয়…

রাষ্ট্রের জনগণের ভেতর জাতীয় নেতৃত্ব আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলবে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নতুন নতুন জাতীয় মিশন সূত্রাকারে এবং রূপায়ণের দ্বারা সাহসিকতার সঙ্গে উদ্ভাসিত হবে। ভারতবর্ষ গত ষাট বছরে অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতির প্রাঙ্গণে বহু সাফল্যজনক কৃতিত্বের জন্য যথেষ্ট গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু অতীতের সাফল্যে আমরা আত্মতুষ্ট হয়ে থাকতে পারি না এবং প্রযুক্তি, শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সাম্প্রতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের আহ্বানকেও উপেক্ষা করতে পারি না। অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন। যেমন, স্থায়ী সরকার গঠন করতে বহুদলীয় জোটের উত্থান ঘটাতে হবে যা দ্রুতগতিতে স্থায়ী, দ্বি-দলীয় শাসনব্যবস্থায় পরিণত হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার জন্য এবং অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। মোট অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বদলে সার্বিক জাতীয় উন্নয়নসূচক (ন্যাশনাল প্রসপারিটি ইনডেক্স) না থাকায় আশানুরূপ বিকাশের সময়েও আর্থিক অসমতা বড় প্রকট দেখায়। পৃথিবী জুড়ে জৈব জ্বালানির ভাণ্ডারের দ্রুত ক্ষয়ের ফলে শক্তিক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়া, নতুন ধরনের যুদ্ধের সংকেতের উদ্ভাবন আমাদের নিরাপত্তার প্রতি আতঙ্ক বাড়াচ্ছে…।

আমি আরও বলেছিলাম: যখন আমি আপনাদের দেখি, মাননীয় সাংসদগণ, বিশেষত তরুণ সদস্যগণ, তখন আপনাদের মধ্যে আমাদের দেশের অনেক দূরদর্শী নেতা, যেমন— মহাত্মা গাঁধী, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার পটেল, সুভাষচন্দ্র বোস, ড. অম্বেডকর, আবুল কালাম আজাদ, রাজাজি প্রমুখের শাশ্বত চৈতন্যের সন্ধান পাই। সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে স্থাপন করে আপনারা কি ভবিষ্যৎদর্শী পথপ্রদর্শক হতে পারবেন? ভারতবর্ষের মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আপনি কি অন্যতম একজন হতে পারবেন? হ্যাঁ। হ্যাঁ আপনি পারবেন। আপনি পারবেন যদি, ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের আগে একটা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ, সুখী, শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করার মহান লক্ষ্যে ব্রতী হয়ে সংসদকে আপনার নেতৃত্ব দ্বারা উজ্জীবিত করতে পারেন। বাস্তবে এর রূপায়ণ ঘটাতে, মাননীয় সদস্য, আপনার থাকতে হবে মহৎ উদ্দেশ্য এবং দেশের জন্য আপনাকে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কাজ করতে হবে। ক্ষুদ্র এবং খণ্ডিত কার্যকলাপ থেকে লক্ষণীয়ভাবে অপসারণ করে দেশের জন্য এক মহান, সাহসী এবং তড়িদ্‌গতি মিশন শুরু করার ক্ষেত্রে আপনার উৎসাহর জন্য ইতিহাস আপনাকে মনে রাখবে।

যে সময় আমি ইন্ডিয়া ২০২০ মানসচিত্র হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বিধানসভা এবং সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজেকর্মে নিযুক্ত ছিলাম তখন আর-এক সাংবিধানিক পদাধিকারী রাজ্যপালের দপ্তরকে এই লক্ষ্যে কাজে লাগানোর প্রয়োজন ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাজ্যপালদের সঙ্গে বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

ভারতবর্ষ ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীজির এই নিশ্চয়তার অঙ্গীকারের পশ্চাদপটে ২০০৩ সালের বৈঠক পরিচালিত হয়েছিল। যে রূপরেখার ইঙ্গিত তিনি পূর্ববর্তী বছরে লালকেল্লা এবং সংসদ অভিভাষণে দিয়েছিলেন। ২০০৫ সালের রাজ্যপাল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একই উদ্দেশ্যে ভারতকে সরকারের নেতৃত্বদানের অঙ্গীকারে নিশ্চিত করলেন।

বৈঠকের হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতাগুলো আক্ষরিকভাবে মনে নেই যদিও যা বলা হয়েছিল তা আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি এবং দ্রুত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তরিক অঙ্গীকার প্রকাশের জন্য আজও তা মনে রেখেছি।

বাজপেয়ীজি বলেছিলেন, শাসনব্যবস্থার প্রতিটা অংশ অবশ্যই উন্নয়নের চাহিদা সম্পর্কে অবহিত থাকবে এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাবে যাতে আমাদের লক্ষ্য পূরণের উপলব্ধি যত শীঘ্র সম্ভব ঘটা সম্ভব হয়। একটা সম্মিলিত লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিভাগকে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে কত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় সেটা দেখার পরে আমি এর প্রশংসা করি। … অংশগ্রহণকারী রাজ্যপালগণ কুণ্ঠাহীনভাবে খোলাখুলি বলার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যাতে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী সমস্যা এবং তার সমাধান আলোচনা করতে পারেন।

২০০৫ সালের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি দপ্তরের নির্দেশিত আলোচ্যসূচিভিত্তিক শিক্ষা, সন্ত্রাস, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা এবং ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্সেশন) প্রয়োগ বিষয়ে ড. মনমোহন সিং তাঁর মন্ত্রিসভার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিচালন, উন্নয়নে রাজ্যপালদের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দান করেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতির উৎসাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। আমি এর উল্লেখ করে দেখাতে চাই কীভাবে রাষ্ট্রপতির দপ্তর আমার লক্ষ্যপূরণে প্রভাবশালী মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।

ভারতবর্ষের ট্রায়ালকোর্ট, হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে বিস্ময়করসংখ্যক মামলা-মোকদ্দমা অমীমাংসিতভাবে বকেয়া থাকে। এর সঙ্গে নতুন কোনও মামলা দাখিল করায় সেগুলো সংখ্যার গণনায় লক্ষাধিক হয়ে যায়। যারা এই মামলায় জড়িত তাদের পক্ষে সময় ও অর্থের বিপুল অপচয় এবং ভোগান্তির কোনও সীমাপরিসীমা থাকে না।

২০০৫ সালে, সর্বভারতীয় বিচার বিভাগীয় সংস্কার আলোচনাসভার সঙ্গে বকেয়া আদালত মামলার বিশেষ সূত্রে আমার ভাষণ প্রদানের সৌভাগ্য হয়েছিল, যেখানে আমি জাতীয় অমীমাংসিত মামলা অপসারণ মিশনের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম। বিচারে রায়দানের বিলম্বের কারণগুলো আমি বিশ্লেষণ করেছিলাম, যা হল: ১. যথেষ্টসংখ্যক বিচারালয়ের অভাব; ২. যথেষ্টসংখ্যক বিচার বিভাগীয় আধিকারিকের অভাব; ৩. বিচার বিভাগীয় আধিকারিকরা বিশেষ জ্ঞানসমন্বিত মামলা মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত নয়; ৪. মামলা দায়েরকারী এবং তাঁদের আইনজীবী, যাঁরা বারে বারে মুলতুবির জন্য আবেদন করেন এবং দস্তাবেজ দাখিল করতে বিলম্ব করেন। এই দীর্ঘসূত্রী কৌশল তাঁদের দ্বারা অনুসরণ করা হয়; এবং ৫. শাসন বিভাগীয় কর্মচারীদের ভূমিকা।

আমার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে আমি মানবতার স্পর্শের মাধ্যমে লোক আদালতের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির দ্বারা জাতীয় অমীমাংসিত মামলা হ্রস্বীকরণ মিশন গঠনের দ্বারা; সালিশি বা ফার্স্ট-ট্র্যাক কোর্টের মতো মামলার বিকল্প প্রতিবিধানের সুসমন্বিত কর্মপ্রক্রিয়ার আশ্বাস দানের দ্বারা; ভ্রান্তির সরলীকরণে উৎসাহ দানের পরামর্শ দিয়েছিলাম।

উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি-অধীন মামলায় বিশেষ বিশেষ সূত্রে আমি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তার মধ্যে কালভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল অর্থাৎ, উত্তর প্রজন্মের অপ্রয়োজনীয় মামলার প্রতি নিরুৎসাহের কারণে সেগুলো অদরকারি হিসেবে চিহ্নিত করা।

আমার প্রাথমিক সুপারিশের মধ্যে ই-বিচার বিভাগ শুরু হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে, কাল বিশ্লেষণ করে প্রচলিত মামলা নথিভুক্ত করার জন্য আমি কম্পিউটার চালিত নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছিলাম। কাল বিশ্লেষণের দ্বারা অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা অবশ্যই কমে যাবে। আমাদের একটা ডাটাবেস-এর প্রয়োজন ছিল, যা মামলা নথিভুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তথ্যানুসরণ করবে। এই ধরনের বৈদ্যুতিন অনুসরণ সহজেই অনুসন্ধান, পুনরুদ্ধার শ্রেণিবদ্ধকরণ, তথ্যসমূহের প্রক্রিয়াকরণ, বিচার বিভাগীয় নথি প্রক্রিয়াকরণ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মামলায় নিষ্পত্তি এবং প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সহজে সক্ষম হবে। অভিযোগকারী যে-কোনও সময় মামলাটি কোন পর্যায়ে আছে, কোন বিচারালয়ে এবং কবে শুনানি হবে, বিচারালয় দ্বারা কোন বিষয় উত্থাপিত হবে, সে-সম্পর্কে জেনে সম্পূর্ণভাবে মামলার পক্ষে প্রস্তুত হতে সক্ষম হবে। সামগ্রিক স্বচ্ছতা আনা ছাড়াও বিচারকরাও মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে, মুলতুবি মামলার সংখ্যা খুঁজে বার করে তার ভিত্তি অকিঞ্চিৎকর নাকি গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য তথ্য যা রায়দানে সাহায্য করে সে-সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন।

উপরন্তু, ভিডিও কনফারেন্স ব্যাপকাকারে ব্যবহৃত করা সম্ভব। এই ব্যবস্থা বৃহদাকারে ব্যয়সংকোচন এবং বিচারাধীনের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর গমনাগমনের অনাবশ্যক ঝঞ্ঝাট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব করবে।

যেখানে একাধিক ব্যক্তি মামলায় জড়িত সেখানে ভিডিও কনফারেন্স অত্যন্ত উপযোগী। তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটি (ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) দ্বারা সাক্ষী চিহ্নিতকরণ এবং অপরাধ পুনর্নির্মাণ ক্ষেত্র অতুলনীয়ভাবে লাভবান হয়েছে।

অনেক রাষ্ট্র, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়া ইন্টারনেট বিচারালয় এবং সম্ভাব্য মামলা দায়েরকারীর মামলার আইনসম্মত সংশোধন বিষয়ে পরামর্শদান করতে পারায় আইনমাফিক পরামর্শদান পরিষেবা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। সর্বক্ষেত্রে, আইসিটি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও সেসঙ্গে প্রতারণা মামলা অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে খুব উপযোগী, এই প্রভাব আমাদের বিচারব্যবস্থাকে গতিশীল করবে। পরিশেষে, সময়মতো দেশের নাগরিককে ন্যায়বিচার দিতে বিচারব্যবস্থাকে সক্ষম করে তুলতে নয়টি পরামর্শ দিয়েছিলাম:—

১. বিচারপতি এবং আইনজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যরা মুলতুবি মামলার সংখ্যা কীভাবে সীমিত করবেন তার বিবেচনা করা যেতে পারে।

২. আমাদের বিচারালয়ে ই-বিচারব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে।

৩. মামলাগুলো তাদের তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক আইনানুযায়ী শ্রেণিবিভাগকরণ ও গোষ্ঠীবদ্ধকরণ করা যেতে পারে।

৪. বিশেষ আইনশাখা যেমন, সামরিক আইন, পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়, করসংক্রান্ত এবং সাইবার আইনে দক্ষ ব্যক্তিকে বিচারক পদে গ্রহণ করা যেতে পারে।

৫. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার মান, আইন স্কুলের বিন্যাসে উন্নীত করা যেতে পারে।

৬. অকারণ মুলতুবি এবং তুচ্ছ মামলা দায়ের করার জন্য দৃষ্টান্তমূলক দণ্ডপ্রদান রীতির প্রচলন করা যেতে পারে।

৭. সুপ্রিমকোর্টের প্রস্তাবিত মডেল উচ্চ আদালত এবং জেলা আদালতগুলির অনুসরণ করা উচিত এবং কাজের দিনে বাড়তি সময় এবং শনিবার কাজ করে মীমাংসিত মামলার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।

৮. অতিরিক্ত লোকবল এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিচালন কাঠামো-সহ কর্মক্ষম উপযোগিতা বৃদ্ধি করার জন্য ‘বিচারালয়ে একাধিক অধিবেশন’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন খণ্ডিত ও বর্ধিত সময়ের সঙ্গে (সময়সূচি এমনভাবে বিন্যাস করা উচিত যাতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হয়)।

৯. বকেয়া মামলাগুলোর সময়নির্দিষ্ট মীমাংসার জন্য দু’বছর প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। এরজন্য দরকার একটা জাতীয় অমীমাংসিত মামলা হ্রস্বীকরণ মিশন ন্যাশনাল লিটিগেশন পেন্ডেন্সি ক্লিয়ারেন্স মিশন গঠন করা।

একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে দেখলাম আমাদের বিচার বিভাগ ওইসমস্ত পরামর্শ অনুধাবন করেছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তার প্রয়োগ শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, ভারতে বসবাসকারী স্বামী এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিত বিবাহবিচ্ছেদ মামলা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মীমাংসিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।

সারা বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষ অন্যতম চমৎকার সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী যারা বিশ্বাসী, নির্ভীক এবং নিয়মানুবর্তী। রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি সব সময় তাদের পারিপার্শ্বিক জানতে আগ্রহী ছিলাম— কীভাবে তাদের চালনা করা হয়, তাদের প্রস্তুতি, তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ। এই উপলক্ষে আমি বেশ কয়েক বার সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর ইউনিট পরিদর্শন করেছিলাম। সেখানকার আধিকারিক এবং জওয়ানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফলে আমি সমস্যাসংকুল অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আমি সিয়াচেন হিমবাহের কুমার পোস্টে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, ওটা ছিল পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র এবং ওখানে আমাদের বাহিনী তীব্র শীতের মধ্যে কাজ করে। আমি বিশাখাপত্তনম উপকূলে সাবমেরিন চালনাও পরিদর্শন করেছিলাম আর সুখোই-৩০ এমকেআই-এ বসে শব্দের প্রায় দ্বিগুণ গতিবেগে উড়ান দিয়েছিলাম। এইসব উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল এবং আমি আপনাদের সঙ্গে সেগুলো ভাগ করে নিতে চাই।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল, সিয়াচেন হিমবাহের কুমার পোস্টে অবতরণ করেছিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০০ মি. উচ্চে পোস্টটি অবস্থিত। তখন বরফ পড়ছিল, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৩৫° সেলসিয়াস নীচে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। যখন আমি ফিল্ড স্টেশনে পৌঁছলাম কর্নাটকের নায়েক, পশ্চিমবঙ্গের উইলিয়ামস এবং উত্তরপ্রদেশের সালিম— তিন সেনা এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তাঁদের করমর্দনের উষ্ণতা স্থানটার শৈত্যভাবকে দূর করে দিল। আমার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জাগাল যে এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও যে সমস্ত সৈনিক দেশকে রক্ষা করে চলেছেন তাঁদের হাতে আমাদের দেশ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এই সংকটাকুল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য অসাধারণ নেতৃত্বগুণের প্রয়োজন।

২০০৬ সালে, ১৩ ফেব্রুয়ারি নৌবাহিনীর সাবমেরিন আইএনএস সিন্ধুরক্ষকের সওয়ার চড়ে আমার জলের নীচে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সাবমেরিনটা ৩০ মিটার জলের তলায় নিয়ন্ত্রিত গতিতে চলতে শুরু করেছিল। আমি কন্ট্রোল রুম পরিদর্শন করেছিলাম। ওখানকার কর্মীরা প্রবল উৎসাহে আমাকে চালানোর কৌশল (ম্যানুভারিং) কর্মপদ্ধতি, এবং প্লবতা-নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করে সাবমেরিনের কার্যকলাপ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নৌ-প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ এবং তরুণ নাবিক ও আধিকারিকদের সঙ্গে ভ্রমণ আমার কাছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পর্যালোচনাকালে, আমাকে জলের গভীরে যোগাযোগ, লক্ষ্য চিহ্নিতকরণ এবং উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা দেখানো হল। এরপর সমুদ্রের অন্তঃস্তলে আমাদের বাহিনীর যুদ্ধের সক্ষমতা দেখানোর জন্য আক্রমণ করার অনুকরণে টর্পেডো ছোড়া হয়েছিল। টর্পেডোগুলো বৈশিষ্ট্যজনকভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত হওয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছিল। জলের নীচে যুদ্ধের জটিলতা আমি অনুধাবন করেছিলাম।

সাবমেরিনের নব্বইজন আধিকারিক এবং নাবিকের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল। প্রত্যেকে তাঁর নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। যে কাজ খুব সহজসাধ্য ছিল না, কিন্তু তাঁরা তাঁদের মিশনের চ্যালেঞ্জের জন্য গর্ববোধ করেন। মধ্যাহ্নভোজনে সুস্বাদু নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল এবং পরবর্তী ত্রিশ বছরে নৌবাহিনীর সাবমেরিন পরিকল্পনা নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন উপস্থাপিত হয়েছিল। জলের নীচে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা জলের ওপরে ভেসে উঠলাম ও তীরে ফিরেছিলাম। সার্বিকভাবে ওটা ছিল এক স্মরণীয় পরিভ্রমণ।

২০০৬ এর ৮ জুন, আমি সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমানে এক উড়ানে উড়লাম। আগের রাতে কমান্ডার অজয় রাঠোর আমায় কেমনভাবে উড়তে হবে তার পাঠ দিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন কীভাবে বিমান চালাতে হবে, সঙ্গে অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আয়ত্তে রাখতে হবে। এই কাজটা আমি যখন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলাম, সেই ১৯৫৮ সাল থেকে করতে চেয়েছিলাম। মহাকাশ উপযোগী পোশাক পরার পরে সুখোই টেক অফ করে হু-হু ৭৫০০ মিটার — ২৫,০০০ ফিট উঁচুতে উড়ে চলল, ঘণ্টায় ১২০০ কিমি বেগে। উইং কমান্ডার রাঠোর কয়েকটা পাক ও কৌশলের বুদ্ধি দিলেন। আমার যুদ্ধবিমান চালানোর এক ব্যাপক অভিজ্ঞতা এবং তিনগুণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাছাকাছি শক্তি অনুভব করার অভিজ্ঞতা হল। অবশ্যই ব্ল্যাক আউট থেকে বাঁচার জন্য জি-স্যুট বা জি মহাকাশ উপযোগী পরিধান পরেছিলাম। উড়ান চলাকালীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা যে-সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে এবং যুদ্ধবিমানে একত্রিত করা হয়েছে তা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম। মিশন কম্পিউটার, র‍্যাডার ওয়ার্নিং রিসিভার, ডিসপ্লে প্রসেসর ও দেশে নির্মিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। বায়ুমণ্ডলে বা ভূমিতে কোনও লক্ষ্য স্থির করতে কীভাবে কৃত্রিম আলোকরন্ধ্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত বেতার রশ্মির সাহায্য নেওয়া হয় তা দেখানো হয়েছিল। প্রায় ৩৬ মিনিট ধরে উড়ান চলেছিল, আমার বহুদিনকার স্বপ্ন যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ছত্রী সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশবাহিনী এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার। তাঁদের নিষ্ঠা এবং শৌর্য আমার মনে গভীর ছাপ রেখেছিল।

.

রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে আমি তাদের বোঝার এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। সমস্ত মানুষকে সাধারণ জাতীয় লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করাও আমার পক্ষে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *