৮. মোমবাতি ও মথ

৮. মোমবাতি ও মথ

বাতিদান ভিন্ন হতে পারে
আলোকশিখা কিন্তু একই,
পার্থিব আনন্দ তুমি পৃথিবীকেই ফিরিয়ে দাও,
তুমি আমার অন্তরস্থ আত্মায় থাকো।

১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি এয়ারবোর্ন সারভিল্যান্স মঞ্চ ভেঙে পড়া আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ভিন্ন এক দিক, বিষাদের দিক তুলে ধরেছিল। বন্ধু অধ্যাপক অরুণ তিওয়ারির সঙ্গে আমার আলাপচারিতায় এই পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পর্কে, যা পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্য লাভ করেনি, আমার মনোভাব ফুটে উঠেছিল। যাঁরা এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের প্রতি এ আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

অরুণ তিওয়ারি (এ টি): জীবনের আবশ্যকীয় বিষয়গুলির সাধারণত অবস্থান্তর এবং ঐকান্তিক মুহূর্তে জেগে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এদের সামনে নিয়ে আসা যায়। আত্মা যখন ভেতরে প্রবিষ্ট হয় এবং অহংবোধকে ছাপিয়ে যায় বিশেষত তখনই এর জাগরণ ঘটে। ফ্রাঞ্জ কাফকা এ-বিষয়ের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত বই ‘মেটামরফোসিস’ লিখেছিলেন।

এ পি জে: আমি সেটা দেখতে পাই। এসএলভি ৩-এর প্রথম উড়ানের অসাফল্যের পরবর্তী পর্যায় এবং অগ্নির প্রথম পরীক্ষামূলক উড়ানের উৎক্ষেপণপূর্ব জটিলতা আমার নিজেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে বাধ্য করে। কিন্তু ১৯৯৯-এর আরাকোনাম দুর্ঘটনা আমার কাছে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, আমার অহং বোধের প্রতি যা করেছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতেও।

এ টি: আপনি কখনও এই নিয়ে আলোচনা করেননি। কাজের সমুদ্রে আপনি যে বিশাল যন্ত্রণার হিমবাহ নিমজ্জিত রাখেন আমি তার চূড়াটুকুমাত্র দেখতে পাই—আপনি কি সেই দুঃখ আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন?

এ পি জে: মনঃকষ্ট ভাগ করে নেওয়ার চাইতে এক বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় যে আটজন তরুণ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করলেন তাঁদের আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। দেশের অবশ্যই এই প্রশংসিত নায়কদের সম্বন্ধে জানা উচিত। তাঁদের পরিবার যে যন্ত্রণাভোগ করেছে তা যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ টি: স্যার, আপনি কি ১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি এয়ার বোর্ন সার্ভেলেন্স মঞ্চের (এএসপি) দুর্ঘটনার কথা বলছেন?

এ পি জে: হ্যাঁ, এএসপি (Airborne Surveillance Platform) আরাকোনামের গভীর জঙ্গলে ভেঙে পড়েছিল।

এ টি: এই ঘটনাটি নিয়ে আমি একবার কে রামচন্দের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি ছিলেন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমায় বলেছিলেন অ্যাভ্রো বিমানটি বায়ুবাহিত নজরদারিতে রোটোডোমের মতো চূড়ায় উত্তরণ করেছিল, বেলা দুটো নাগাদ উড়ান শুরু করে, ১০,০০০ ফিট ওপরে উঠে গিয়েছিল এবং চেন্নাই উপকূলের দিকে উড়ে চলেছিল। আরাকোনাম আর চেন্নাই-এর উপকূলের মধ্যে র‍্যাডার পরীক্ষা হয়েছিল। এই পরীক্ষামূলক মিশনে লক্ষ্য বিমান ছিল AN-32 বিমান, যা অ্যাভ্রো-র ১৫ মিনিট আগে উড়েছিল। র‍্যাডারের কার্যকারিতা সমুদ্র এবং ভূমি, উভয় অঞ্চলে পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল। বিমানে কর্মরত মিশনের কর্মীদের উচ্চমানের কম্পাভূ বা VHF (very high frequency) যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেরিত র‍্যাডারের কার্যকারিতা রিপোর্ট অত্যন্ত ভাল ছিল। দেড় ঘণ্টা উড়ান পরীক্ষার পর লক্ষ্য বিমান আরাকোনামে বেলা ৪টে নাগাদ অবতরণ করে। পরবর্তীকালে এএসপি বিমানে তার গতিমুখ চেন্নাই থেকে আরাকোনামের দিকে স্থাপিত করেছিল এবং বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে উচ্চতা ১০,০০০ ফিট থেকে ৫০০০ ফিটে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। যখন বিমানটি অবতরণক্ষেত্র থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে এবং উচ্চতা ৩০০০ ফিট থেকে ৫০০০ ফিট তখন রোটোডোম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিমানটি স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলে এবং আটজন যাত্রী-সহ ধ্বংস হয়ে যায়।

এ পি জে: আমি তখন সাউথ ব্লকে আমার দপ্তরে প্রতিরক্ষা গবেষণা পরিষদের বৈঠকে ছিলাম, সেসময় আমাকে দুর্ঘটনার খবর দেওয়া হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ আমি বেঙ্গালুরু ছুটে গেছিলাম শোকাতুর পরিবারের পাশে থাকার জন্য। বিমানবাহিনীর প্রধান এ ওয়াই টিপনিসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অল্পবয়সি স্ত্রীদের আর্ত ক্রন্দন এবং বাবা-মায়েদের হতভম্ব অবস্থা দেখা আমার পক্ষে নিদারুণ অভিজ্ঞতা। এক মহিলা তাঁর শিশুসন্তানকে আমার কোলে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এই নতুন প্রাণকে কে বাঁচিয়ে রাখবে?’ অন্য আর-একজন মহিলা বললেন, ‘কেন আপনি আমাদের সঙ্গে এরকম করলেন মি. কালাম?’

এ টি: রামচন্দ নিহত আধিকারিকদের তালিকা তৈরি করে আমায় দিয়েছিলেন—স্কোয়াড্রন লিডার পি ভেঙ্কটরামন বিমানটির চালক ছিলেন।

ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ার পি ইলাঙ্গো এবং র‍্যাডার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার কে পি শাহু— এঁরা তিনজনেই ক্যাবস (সেন্টার ফর এয়ারবোর্ন সিস্টেমস)-এর র‍্যাডার প্রসেসিং সায়েন্টিস্ট।

ডি নরসিংহস্বামী এবং সিগন্যাল প্রসেসিং সায়েন্টিস্ট আই জয়াকুমার ERDE (Electronics Research and Development Establishment)-এর এবং স্কোয়াড্রন লিডার এন ডি সেসু, আর ভাটনগর এবং এস রবি বিমানবাহিনীর অন্যান্য আধিকারিকগণ।

এ পি জে: কোনও অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি, পরিবারের সুবিধার্থে কর্তৃপক্ষ কফিন বানিয়ে কমিউনিটি কক্ষে রেখে দিয়েছিলেন।

এ টি: হায় ঈশ্বর!

এ পি জে: ওই সুতীব্র যন্ত্রণাময় মানসিক অবস্থায় আমায় যে বিদায়কালীন ভাষণ দিতে হয়েছিল তাতে আমি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম।

এ টি: এই ঘটনা আমায় মনে করিয়ে দেয় পাঁচটি সন্তানহারা এক মায়ের উদ্দেশে লেখা আব্রাহাম লিঙ্কনের এক চিঠির কথা। ওই মায়ের পাঁচটি সন্তান গৃহযুদ্ধে বীরের মরণ আলিঙ্গন করেছিল।

‘আপনার অভাববোধের যন্ত্রণা এতটাই দুর্বহ যে, সেক্ষেত্রে আমার সান্ত্বনা বাক্যের যে-কোনও শব্দ যে কতটা দুর্বল ও নিষ্ফল হয়ে দাঁড়াবে তা আমি অনুভব করি। কিন্তু যে প্রজাতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেছে তারজন্য ধন্যবাদজ্ঞাপনের মধ্যে যে সান্ত্বনা আছে তা আপনার হৃদয়কে আর্দ্র করা থেকে আমি নিজেকে নিরস্ত করতে পারি না।

আমি প্রার্থনা করি স্বর্গীয় পিতা আপনার প্রিয় বিয়োগের নিদারুণ যন্ত্রণার তীব্রতা লাঘব করুন এবং আপনার হৃদয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মধুর স্মৃতি বজায় রাখুন এবং স্বাধীনতার বেদিতে যে অমূল্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার পবিত্র গর্ব অবশ্যই একান্ত আপনার।’

এ পি জে: বিধবা স্ত্রীদের বিলাপসূচক ক্রন্দনধ্বনি, নিশ্চল বাবা-মা, আমার কোলে এক নিষ্পাপ শিশু এবং প্রতীকী কফিনের সৎকারের স্মৃতি রাষ্ট্রপতি ভবনেও আমাকে তাড়া করে ফিরত। যে কয়েক জন মানুষ চারদিকে রাজনীতি ও সরকারি দপ্তরের রীতিনীতি সংক্রান্ত আচরণবিধির অধীনে চলেন তাঁরা কার্যক্ষেত্রে এবং গবেষণাগারে মানুষকে যে যন্ত্রণা এবং মর্মবেদনা ভোগ করতে হয় তা কি উপলব্ধি করতে পারেন?

এ টি: এর থেকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?

এ পি জে: মোমবাতি হওয়ার ভান কোরো না, আলোক দ্বারা আকৃষ্ট মথ হও। সেবার মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তা জানো। দেখা যায় রাজনীতির বহিরাঙ্গের সঙ্গে আমরা জুড়ে যাই এবং তাকে রাষ্ট্র গড়ে ওঠা বলে ভুল করি। আত্মত্যাগ, পরিশ্রম এবং সাহসিকতা যে কদাচিৎ দেখা যায় বা দেখি, দেশ প্রকৃত অর্থে তা দিয়ে গড়ে ওঠে।

.

এয়ারবোর্ন সারভেল্যান্স মঞ্চ ভেঙে পড়া আমার জীবনের অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা। আমি যে কত গভীরভাবে বেদনার্ত ছিলাম এই কথোপকথনের বিস্তারিত বিবরণের মাধ্যমে তা প্রকাশিত। সেইসঙ্গে জটিল মিশনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে এ যে এক দীর্ঘ কঠিন যাত্রা, কথোপকথন সে ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু এই ধরনের বিপর্যয় আমাদের দৃঢ় হতেও সাহায্য করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *