৮. কচু বাটা
বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে ইন্দুবালার জীবনে। যেগুলো আগে ছিল না। কিন্তু এখন আছে। সারাদিন এক নাগাড়ে কাজ করে বেড়ানো মানুষটার এখন বেলার দিকে একটু ঝিমুনি ধরে। ইদানিং ভাত খেয়ে উঠলে হয়। তখন ইন্দুবালার আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। শরীর যেন আর চলে না। তার সাথে কলকাতার বাতাসে উত্তরের শিরশিরানি খেললে শরীরটা একটু রোদ চায়। হাত-পাগুলো মনে হয় রোদে পোহাই। কিন্তু সেই ফুরসত কি আছে ইন্দুবালার? তাঁর হোটেলে আসা মানুষগুলো তো সবে ভাত খেয়ে যে যার কাজে গেছে। দুপুরের পড়ন্ত রোদে তার একটা হিসেব রাখার আছে। কজন খেলো। কজন এলো না। কারা আবার ওবেলা আসবে। কাদের বাড়িতে পাঠাতে হলো। কাদের শুধু ঘন্ট আর পোস্তোর বড়া অর্ডার হলো। কতটা বাঁচলো। কতটা না। এইসব বিস্তারিত লেখালেখির একটা খাতা ইন্দুবালার আছে। সেই একাত্তর সন থেকে। এটা যদি হিসেবের খাতা হতো তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এখানে টাকার অঙ্কে কিছু মেলানো থাকে না। যা থাকে তাতে আরও নানান কিছু যোগ হয়। এত পুরনো এক জাদা খাতা এতদিনে শেষ হয়ে যাবারই কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। তার কারণ বছর বছর ইন্দুবালা সেই খাতার সঙ্গে আবার পাতা জোড়েন। মোড়ের মাথায় গণেশ বাইণ্ডিং থেকে আগে হারান আসতো। পয়লা বৈশাখের আগের দিন সেই খাতায় বড় ঝুঁচ ঢুকিয়ে ফুটো করে জোড়া হতো পাতা। সেলাই করে আবার খাতার গায়ে জামা করে দিতেন ইন্দুবালা। সেই নতুন জামা আবার পরের বছরে পালটে যেত। গেলবার হারান চোখ বোজার পর তার ছেলে শিব আসে। ইন্দুবালা নিজে সেই খাতা নাড়া চাড়া করতে পারেন না এখন আর। ওপরের ঘরে টেবিলের ওপরে রাখা থাকে। প্রতিদিন সেই খাতায় ইন্দুবালা নানা কিছু লিখে রাখেন। তার সাথে ফুল তোলা নক্সা। সোয়েটারের মাপ। দিদা বলে ঝাঁপিয়ে পড়া ছেলে-মেয়েগুলোর ফোন নাম্বার, আরও কত হিজিবিজি।
ধনঞ্জয় বলে ওটা নাকি চিত্রগুপ্তের খাতা। বুড়ি পরপারে গিয়েও হিসেব মেলাবে। কিন্তু কী হিসেব, সেটা ধনঞ্জয় জানে না। বড় নাতনি সুনয়নী একবার দেখেছে সেই খাতায় আছে নানা রান্নার কথা। কিছু কিছু ইন্দুবালার কথাও। সেই যে গেলবার সে বিদেশ থেকে এসে তার ঠাম্মার কাছে থাকলে বেশ কয়েকমাস তখন এটা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখেছে মেয়ে। আর অবাক হয়েছে। এতো সুন্দর গুছিয়ে লিখতে পারে তার ঠাম্মি? একটা সাদা কালো ছবিও পেয়েছিল সে খাতাটার মধ্যে। ইন্দুবালার বিয়ের আগের ছবি। কোনো এক নড়বড়ে স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। তাঁকে দেখালে বলেছিলেন কলাপোতা থেকে নৌকা করে টাউনে গিয়ে কোনো এক স্টুডিওতে তুলেছিলেন ছবিটা। এই ছবি দেখেই নাকি তাঁর শাশুড়ি শেফালীরানীর পছন্দ হয়েছিল। সুনয়নী জানতে চেয়েছিল “আর দাদু? তিনি কিছু বলেননি?” ইন্দুবালা কোনো উত্তর দেননি নাতনির কথার। “কাজের সময় বিরক্ত করিস না” বলে বড়জোড় একটু ধমকে দিয়েছিলেন। সুনয়নী এই বাড়িতে তার দাদুর ছবি দেখেনি। এমনকি বাবা, কাকা, পিসি কারও কাছেই নয়। “কেমন ছিল দাদুকে দেখতে ঠাম্মি? কেন দাদুর ছবি একটাও নেই বাড়িতে?”পাগল করে দিত মেয়েটা প্রশ্ন করে করে। এমনকি বিয়ের একটা ছবি পর্যন্ত নেই কেন? আশ্চর্য হতো সুনয়নী। এটা কিছুতেই সে বুঝতে পারতো না থাকবে কী করে? সেই অজ গাঁয়ে কি আর ফটোগ্রাফার ছিল? খুলনা শহর থেকে কিংবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতে হতো তাদের। ইন্দুবালাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবার আর একটুও খরচ করার মতো অবস্থা ছিল না তখন। ছেলেকে পণ না দিতে হলেও মেয়ের গয়না গড়ার ছিল। ইণ্ডিয়াতে মেয়েকে পাঠানোর খরচ ছিল। তার সাথে আশেপাশে গ্রামের মানুষদের আপ্যায়ন, খাতির যত্নে কম খরচ হয়েছে নাকি? কাজেই কোনো ছবি ওঠেনি। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে এসেও না। বউভাত হয়নি। লোকজন আসেনি। তাহলে আর ছবি উঠবে কোথা থেকে? ফুলশয্যার দিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তার পরদিন বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আবার বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শাশুড়ি কতবার বলেছিলেন ছেলেকে, “রতন বৌমাকে নিয়ে একটা ফটো তুলে আয় বাবা”। আজ যাবো কাল যাবো বলে আর যাওয়া হয়নি রতনের। নিমতলা শ্মশানে যেদিন মড়ার খাট ধরে বসেছিলেন ইন্দুবালা, একটি সিঁড়িঙ্গে মতো লোক গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসে বলেছিল “কি গো মা ছবি তুলবে নাকি? শেষ স্মৃতি বলে কথা”। লছমীর মুখ ঝামটায় পালানোর পথ পায়নি সে। কাজেই ইন্দুবালার এই বাড়িতে তাঁর স্বামীর কোনো ছবি নেই। আলতা ছাপ পায়ের চিহ্ন নেই। যাবতীয় যা কিছু তিনি সেই শ্মশানেই অস্থির সাথে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার বংশরাই তো ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। ঠাম্মা, দিদা, মা বলে ডেকে চলেছে। জানতে চাইছে মাস্টার রতনলাল মল্লিকের ছবির কথা। এইসব কিছু ওই খাতায় লেখা নেই। ইন্দুবালা লেখেননি। নিজের মনের রাগ, দুঃখ, অভিমান, কষ্ট সেগুলো বড় আপনার। নিজের কাছেই রেখে দিতে হয়। না হলে যে মানুষটাকে তার বংশের কেউ দেখলো না জানলো না তার সম্পর্কে খারাপ কথা তাদের মনে বাজবে। ইন্দুবালা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের কাছে তার বাবার কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। নিন্দা মন্দও না। এই বাড়ির রেওয়াজ মেনে শুধু মৃত্যুদিন পালন হয়েছে। শাশুড়ির আমলে ব্রাহ্মণ খাওয়ানো হতো। সবাই চলে যাওয়ার পর ইন্দুবালা সেইসব প্রথা তুলে দিয়েছেন। অনেক দিন পরে সুনয়নী প্রশ্ন করলে একবার ভেবেছিলেন সব বলবেন। তারপর ভাবলেন থাক। যা মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এসেছেন তার দিকে ফিরে তাকাবেন না। ওটা নিজের কাছে খুব সংগোপনে থাক।
খাতাটা এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল সুনয়নীর সারাদিন সেটা নিয়ে বসে থাকতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো সব কিছু। দেখতো। নোট রাখতো তার আই প্যাডে। ঠাম্মিকে যেন একটু একটু করে চিনতে পারছিল সে। বারবার মনে হয়েছিল কেন আগে তার ঠাম্মিকে সে এত কাছ থেকে দেখেনি। কেন আরও অনেক অনেক কথা জানতে চায়নি। সবটা যে পেরেছিল তা নয়। কিন্তু সুনয়নী এটা বুঝেছিল তার চারপাশে দেখা মানুষগুলোর থেকে ইন্দুবালা কতটা আলাদা। চিন্তায়, ভাবনায়, জীবনে চলার পথে। এই খাতাটা নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল তার। একদম যেমন আছে এই জাবদা খাতাটা ঠিক সেই ভাবে যদি তাকে ছাপানো যায়। তাহলে তো একটা সময়ের ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। যে ইতিহাসের কথা কোন পাঠ্য বইতে লেখা থাকে না। এমনকি সমাজ ইতিহাসের গভীরে যাঁরা উঁকি দেন সেই সব গম্ভীর প্রবন্ধেও না। তার চেয়ে এই খাতাটা ছাপা হলে একজন একলা মহিলার পথ চলাটা বেশ পরিষ্কার ধরা পড়বে সময়ের নিরিখে। নিজের মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল সুনয়নী তার ঠাকুমাকে। এমনকি এটাও বলেছিল যেগুলো পছন্দ নয় সেগুলো রাখা হবে না বইটাতে। ইন্দুবালার একটুও পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। “হিসেবের খাতা কার কোন কাজে লাগে দিদিভাই? তুই আর নাড়াঘাঁটা করিস না ওটাকে। একেই যা অবস্থা।” সুনয়নী তবুও হাল ছাড়েনি। শেষ খড়কুটো আঁকড়ে থাকার মতো বলেছে, “অন্তত রান্নাগুলো ছাপাই। সবাই তো ভুলে গিয়েছে ঠাম্মি। তোমার মতো ছাঁচড়া কেউ রান্না করতে পারে? সেটাই না হয় জানুক লোকজন।” ইন্দুবালা হেসেছেন মেয়ের কথা শুনে। “ছ্যাঁচড়ার কথা কেউ পড়বে না দিদিভাই। তুই বরং তার লেখা পড়ার বই বার কর। সবাই পড়বে।” নাতনি থামতে চায় না। বারবার ফোন করে। বন্ধুদের দেখাবে বলে বায়না করে। ইন্দুবালা একদিন নিরুপায় হয়ে বলে দেন, “আমি আগে মরি, তারপর না হয় যা খুশি করিস তোরা”। এরপর আর কোনো কথা বলা যায় না। মোক্ষম বার্তাটা তাই এক্কেবারে শেষেই দ্যান। ইন্দুবালার হোটেলে যে কটা জিনিস সেই পুরোনো আমল থেকে রয়ে গেছে এই খাতা খানাও তার মধ্যেই পড়ে। সেটাকে কী করে তিনি বাইরের লোকের হাতে তুলে দেন? সুনয়নী পড়ছে পড়ুক। কিন্তু তার সাথে তার বন্ধু বান্ধবরাও পড়বে? রাজ্যের যত লোক জেনে যাবে ওই খাতাটার মধ্যে কী আছে। ওমা তাই কখনও হয় নাকি? ওর পাতায় যে জিরান দেওয়া আছে মনিরুলের বকুল ফুল। লছমীর বাড়ির তেজপাতা। তিন ছেলে-মেয়ের হাত ছাপ। অলোকের ফেলে যাওয়া নিষিদ্ধ ইস্তেহারের একটা পাতা। আরও যে কত কী, তা না দেখলে কল্পনাও করা যাবে না। অলোক খুব সুন্দর শিস দিয়ে একটা গান করতো। কীসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজে লাফিয়ে হই পার’। গানটাও লেখা আছে সেখানে। চোখ বন্ধ করেন ইন্দুবালা। সুরটা খোঁজার চেষ্টা করেন। পারেন না। কারেন্ট অফের সেই রাতগুলোকে হাতড়ান। কোথায় তারা? যে দিনগুলোকে ইন্দুবালা নিজেই ফিরে পান না, সেইসব কিছু তিনি দুহাত উজিয়ে দিয়ে দেবেন কী করে? থাকবার বলতে এইটুকুই তো তাঁর নিজের। স্মৃতির বিসর্জন মানে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া।
ধনঞ্জয় ছাদ থেকে কাপড় তুলতে এলে বুড়িকে দেখে মায়া হয় তার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বুড়ি ঝিমোচ্ছে। মাথা নেমে এসেছে পায়ের কাছে। একটা বালিশ নিয়ে রোদটায় শুলে কী হয়? সারা জীবন কারোর কথা কোনোদিন শুনলো না। দুপুরের পর কতবার সে বলেছে “ওগো মা একটু এলিয়ে এসো দিকিনি গা খানা বিছানায়”। বুড়ি কথা শোনেননি। এত কাজ কাজ করে মাথা খায় বুড়ি যে কারো দম ফেলার সময় থাকে না। ঘর থেকে বালাপোশটা এনে বুড়ির গায়ে চাপা দেয় ধনঞ্জয়। যত্ন করে পায়ের ওপর দিয়ে টেনে দেয় তা। মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। যার সব থাকতেও কেউ নেই। যার ঘর আলো করা সংসার। দুই ছেলে, মেয়ে তাদের সব বাচ্চারা। হইহই করে মাথায় করে তুলে রাখতো তোমাকে। এইভাবে কেন এত কষ্ট করে আছো মা? একবার মুখ ফুটে বললেই তোমার সন্তানরা চলে আসবে তোমার কাছে। যা চাইবে তাই দেবে। রাজরানী হয়ে থাকবে মা। এক বিশাল সংসারের মধ্যমণি হয়ে। ভালো লাগবে না তখন? চাল ধুতে ধুতে ইন্দুবালা ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন, “ওরকমটা সবার মনে হয় রে ধনা। বোঝাকে বেশিক্ষণ মানুষ ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে রাখতে পারে না। মনে হয় কতক্ষণে নামাবে সে মাটিতে। আমি কারো বোঝা হতে চাইনা রে”। ধনঞ্জয় কী বুঝেছিল কে জানে, শুধু সেদিন আর আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে যায়নি। বুড়ি নিজেই তার কাজ খুঁজে নিয়েছিল বিস্তর। যত খাটছিলেন ইন্দুবালা হোটেলকে নিয়ে, তত তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিকে। এবেলার রান্না কোনদিন ওবেলা কাউকে খাওয়াননি তিনি। কোনো খাবার নষ্ট হতে দেননি কোনোদিন। বেঁচে যাওয়া খাবার কোথায় কোথায় যাবে তারও একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা তৈরী করে ফেলেছিলেন। সেইসব মানুষগুলো আজও অনেক আশা নিয়ে বসে থাকে।
রান্নাঘরের উনুনটা এখনও আগের মতো নিজের হাতেই পরিষ্কার করেন। মাঝে মাঝে ধনঞ্জয় করে না এমনটা নয়। কিন্তু নিজে করলে সুখ পান ইন্দুবালা। যত্ন করে মাটির প্রলেপ বোলান উনুনের গায়ে। আজকের উনুন? কত জন্ম জন্মান্তর ধরে মল্লিক বাড়ির লোকজন এই উনুনে চাল ফুটিয়ে দুবেলা ভরপেট খেয়েছে। রান্না তো আর শুধু রান্না নয়। যেন অগ্নিকে উপাসনা। আঁচের একটু এদিক ওদিক হলে সব ভণ্ডুল হবে। নড়ে চড়ে বসে বুড়ি। বালাপোশের গরমে আরাম পেয়েই হোক কিংবা ঝিমিয়ে পড়া দুপুরে ঘুমন্ত আঁচের কথা ভাবতে ভাবতেই হোক ইন্দুবালার ঘুম কাটে। সামনে দেখেন হাঁ করে চুপটি করে বসে আছে ধনঞ্জয়। মুখের দিকে তাকিয়ে। ইন্দুবালা হাসেন। “এখনও বেঁচে আছি রে ধনা। মরিনি। এই দ্যাখ শ্বাস প্রশ্বাস চলছে এখনও”। বিকেলের শেষ আলো তখন জানলার ওপর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ইন্দুবালা হুড়মুড় করে উঠতে যান। “আমার না হয় ভিমরতি ধরছে তাই বলে তোর কোনো আক্কেল জ্ঞান থাকবে না? বেলা যে পড়ে এলো। কাজ কত বাকি তার কি খেয়াল আছে?” ইন্দুবালা চাটাই গোটান। বালাপোশ ভাঁজ করেন। ধনঞ্জয় সুড়সুড় করে সরে পড়ে সেখান থেকে। বসে থাকলে বুড়ির গজগজ কানে শেলের মতো বিধবে। তখন আবার দুটো কথার উত্তর না দিয়ে ঝগড়া না করে স্বস্তি পাওয়া যাবে না।
ইন্দুবালার কাজের কোনোদিন শেষ বা শুরু বলে কিছু নেই। সারাদিনটাই পড়ে থাকে কাজের জন্য। দুপুরে সব খদ্দের খেয়ে চলে গেলে আনাজ দেখে, মিলিয়ে কী কী আনতে হবে আর না হবে তার একটা ফর্দ করার থাকে। রাতের রান্না কী হবে তাও ভাবতে হয়। সেই মতো ধনঞ্জয়কে নানা কিছু বলার থাকে। কী কী ভেজাতে হবে। ছোলা, মটর, বাদাম, হিঙ, কিসমিস, কাজু। কী কুটনো কাটতে হবে। কোন রান্নাটা গ্যাসে হবে আর কোনটা উনুনে। কয়লা আর গ্যাস ঠিক আছে কিনা। মানে যার যেমন দিনের বরাদ্দ সেটাই আছে কিনা। মাঝপথে ফুরিয়ে যাওয়াটা অলুক্ষুণে। কাজেই আগে ভাগে সব দেখে রাখা চাই। ইন্দুবালা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই। যদি কোনোদিন ইন্দুবালার সাথে সারাদিন ঘুর ঘুর করা যায়, তাঁর হেঁশেলে উঁকি দেওয়া যায় তাহলে একটা দিনলিপি লেখার ইচ্ছে করবে। এমন যে কেউ করেনি সেটাও বলা যায় না। অনেক কাগজেই ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের কথা ছাপা হয়েছে। তার সাথে তার বড় বড় দুটো উনুন, গ্যাস, সেই প্রাচীন শিলনোড়া, মশলা রাখার বাক্স, পেল্লাই সাইজের ভাতের ডেকচি, হাঁড়ি, কড়াই, রান্নার ছবি, খাবারের ছবিও ছাপা হয়েছে। শুধু যদি এটা হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। এমনটা তো অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। এই শহরে তার উদাহরণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি। কিন্তু যেটা হয়নি সেটা হলো একদল মানুষ সে বুড়ো থেকে শুরু করে ছেলে মেয়ে বাচ্চাকাচ্চা সমেত এতো হুজুগ একটা ভাতের হোটেলকে নিয়ে খুব কমই হয়েছে। যারা অনেক দূরে থাকে বা অনেক কাছে, যারা কলেজে পড়ে, হোস্টেল বা মেসে থাকে, যারা অফিস করে, ব্যবসা করে মানে যারাই ইন্দুবালার সংস্পর্শে একবার এসেছে তারা আবার ইন্দুবালাকে যেন দুচোখে হারায়। ফলে এই যুগে চ্যাটাং ট্যাটাং করে কথা বলা ছেলে মেয়েগুলো ফেসবুকে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের একটা কমিউনিটি পর্যন্ত খুলে ফেলেছে। সেখানে যেমন প্রতিদিনের মেনু আপডেট হয় ঠিক তেমনই রান্নার ছবি থাকে। তার সাথে সেই রান্নার গল্প। এমনকি সেই দিন ইন্দুবালার মেজাজ কতটা উনুনের আঁচের সাথে ওঠানামা করছে সেটাও। কত কত মানুষ যে এই পেজ লাইক করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইন্দুবালার কাছে তাদের ভাত খাওয়ার কথা লিখেছে। গল্প লিখেছে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্বজন-পরিজন ছেড়ে চলে আসা এক অচেনা অজানা শহরে শুধুমাত্র একটা ভাতের হোটেল কীভাবে তাদের বাড়ির কথা, মায়ের কথা, ঠাম্মার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে সেই নিয়ে ভুরি ভুরি লেখা আছে। কমেন্ট আছে। জাঁকিয়ে চলছে গ্রুপটা।
ইন্দুবালা এতো কিছু জানেন না। তাঁর ইচ্ছেও করে না এইসব নিয়ে মাতামাতি করতে। হোটেলে অনেক কাজের মধ্যে তিনি অন্য কিছু যেন ভাবতেও পারেন না। তবুও কি ভাবতে হয় না তাঁকে? হয়। এই ফেসবুকের পেজ হওয়ার পর থেকে নানা রকমের বিপদ নানা দিক থেকে আসতে থাকে। এই যেমন সেদিনকে সবে রোদে পা ছড়িয়ে একটু ঝিমোতে বসেছেন অমনি সামনের মেসের নতুন মেয়েটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চশমার ভেতর থেকে গোল গোল চোখ করে বললো “তুমি কচু বাটা কেন আর করো না ঠাম্মা?” ইন্দুবালা ঝিমোচ্ছিলেন। ঘোর লাগা চোখে বোঝার চেষ্টা করেন কী বলছে মেয়েটা। “কোথায় থাকো? খাওয়া হয়েছে? খিদের পেটে কচু খাবে কেন? ধনাকে বলো ভাত গরম করে দেবে। আর অবেলায় ভাত খেতে ইচ্ছে না করলে রুটি করে দেবে। চাও যদি বেগুন পোড়াও খেতে পারো। অল্প করে কুলের তেল দিয়ে মেখেছি। গন্ধ হয়েছে বেশ”। মেয়েটা আরও চোখ গোল গোল করে বলে “ধুর তুমি কি সব ভুলে যাও নাকি ঠাম্মা? এই তো খেয়ে গেলাম। রুটি না খেলেও বেগুন পোড়া ছাড়বো তুমি ভাবলে কী করে? খেয়েছি। কী করে যেসব অদ্ভুত জিনিস মাথা থেকে বার করো বেগুন পোড়ায় কুলের তেল। জাস্ট ফাটাফাটি”। ইন্দুবালা হাসেন।
বড় বড় বয়ামে কুল জিরানো থাকতো তেল দিয়ে। ঠাম্মার যে কত রকমের আচারের আহ্লাদ ছিল। প্রত্যেক ঋতুতে আলাদা আলাদা ফল। তাদের আচার। তার সাথে তেল। সেই তেল আবার রান্নার সাথে মেশানো। “সে অনেক ঝক্কি ঝামেলার কাজ। আমি অত পারি না। তা কোথায় থাকো তুমি?” মেয়েটা হাত তুলে দেখায় “ওই তো রাস্তার ওই দিকের মেসে থাকি। সঞ্চারী। খাতায় যে নাম লিখলাম”। ইন্দুবালা এগোন রান্নাঘরের দিকে। “বাহ সুন্দর নাম তো সঞ্চারী। কে রেখেছিল, মা?” সঞ্চারী বলে “ধুর…মা রাখবে কোথা থেকে? সে তো জন্মের দিনই মারা গেছে”। থমকে দাঁড়ান ইন্দুবালা চৌকাঠের কাছে। ঘুরে তাকান মা মরা মেয়েটার দিকে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বাবা দিয়েছিল নাম। তা বাবাও এখন আর নেই। একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল। চলে গেছে। মামা-মামীর কাছে থাকি। মানে ওরা আমাকে দেখে। লোকাল গার্জেন। এমনিতে আমার কেউ নেই জানো। কিন্তু অনেক অনেক বন্ধু আছে। এখন তো কলেজ। তাই মেসে থাকতে হয়”। বকবক করে সরলতায় ভরা চোখ মেয়েটা। ইন্দুবালা কিছু বলেন না। এগিয়ে যান রান্নাঘরের দিকে আস্তে আস্তে। পেছনে থাকে সঞ্চারী।
প্রত্যেকদিন এই হোটেলে যারা খায় তাদের একটা মাসিক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। নিজেরাই খাতায় নাম লেখে। নিজেরাই হিসেব রাখে। ওই দেনা পাওনার হিসেব ইন্দুবালাকে কোনো দিন মেলাতে হয়নি। কোনো দিনই না। তাঁর পয়সা মেরে দিয়ে পালানোর লোকের সংখ্যা হাতে গোনাও যাবে না। ইন্দুবালা মনেও রাখেন না। দু মুঠো ভাত খেয়ে যার ইচ্ছে হয় পয়সা দেবে। যার ইচ্ছে না হয় দেবে না। ঠাম্মার কথাগুলো আজও তাঁর কানে বাজে। মহাভারতের সেই কবেকার পুরোনো বইটা খুলে গড়গড় করে পড়ে চলতো। “বনপর্বে যুধিষ্ঠির কী বলছে জানিস? শোন ইন্দু। সব তো আমাদের ঘরের কথাই লিখে গেছে। মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হল মোদ্দা কথায় অপর মানুষের সেবা করা। সেই সেবা কেমন? যেমন ধর যুধিষ্ঠির শুধু বলছেন না। মনে করিয়ে দিচ্ছেন” অন্ধকারে প্রদীপ জ্বলছে টিম টিম করে। কাঠের উঁচু পাটাতনের ওপরে রাখা কবেকার মহাভারত। ধূপ দানিতে ধূপ, মাটির ধুনুচিতে ধুনো সব জ্বলছে। বারকোষে রাখা সন্ধ্যামণি ফুল। ঠাম্মা সেই ঘোর লাগা পরিবেশে যুধিষ্ঠিরের কথা উচ্চারণ করছে, “সাধুগণের গৃহে তৃণ, ভূমি, জল, ও সুশৃতবাক্য এই চারি দ্রব্যের কোনোকালেই কোনো অপ্রতুল থাকে না। গৃহস্থ ব্যক্তি পীড়িত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্ত ব্যক্তিকে আসন, তৃষিত ব্যক্তিকে পানীয়, ক্ষুধিত ব্যক্তিকে ভোজন ও অভ্যাগত ব্যক্তির প্রতি নয়ন, মন ও প্রিয় বচন প্রয়োগ এবং উত্থান পূর্বক আসন প্রদান করিবে। ইহাই সনাতন ধর্ম।” ঠাম্মা যেন বারবার মনে করিয়ে দিত মানুষকে সেবা করে আরাম পাওয়া যায়। মনের আরাম। ইন্দুবালা কি সেই জীবে প্রেম করছেন না? কোথায় করছেন? এটা কি জীবে প্রেম? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই ঘোর কাটে, “কি গো ঠাম্মা কচুবাটা করবে কিনা বলো”। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা নাছোড়। ইন্দুবালা রাতের আনাজ মিলিয়ে দেখছিলেন। রোদটা আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঘুরছে। এবার ছাদের আলসের মাথায় চড়ে এক্কেবারে হারিয়ে যাবে। আর দেখা যাবে না। “ওইদিকের বড় ঝুড়িখানায় দেখতে গোটা বিশেক আলু আছে কিনা?” সঞ্চারী গোনে ঠিক বাচ্চাদের মতো করে। ইন্দুবালা মশলার বাক্স হাঁটকান। দেখে নেন সব ঠিক করে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বিশটারও বেশি আলু আছে”। ইন্দুবালা বিড়বিড় করেন, “তাহলে আনাতে হবে আরও। সর দেখি ধনাকে বলি”। সঞ্চারী হাত ধরে নেয় ইন্দুবালার। “বললে না তো কচুবাটা করো না কেন এখন?” ইন্দুবালা বঁটিখানা নিয়ে এসে আলুর খোসা ছাড়াতে বসেন। “ওইসব আমি করেছি নাকি কোনোদিন? তোর পড়াশুনো নেই? যা গিয়ে পড়তে বোস। আমাকে কাজ করতে দে”। সেই মেয়েও ছাড়বার নয়। “কচুবাটা করোনি মানে? এই দেখো ফেসবুকে একজন লিখেছে নারকেল আর কাঁচা লংকা দিয়ে তোমার হাতের কচুবাটা যে খায়নি সে তো ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের কিছুই জানে না”। এবার একটু বিরক্ত হন ইন্দুবালা। “এইসব আবার কে লিখেছে? তোরাই বা এইসব লিখতে বলিস কেন?” মেয়েটা অবাক হয়। “আমরা লিখতে বলেছি নাকি? এই যে দেখো অমলেন্দুবাবু কৃষ্ণনগরে থাকেন। কলেজে ফিজিক্স পড়ান। তিনি লিখেছেন। এখানে থেকে পড়ার সময় এইট্টিজে রোজ ভাত খেতে আসতেন তোমার হোটেলে। চিনতে পারছো?” ইন্দুবালা মেয়েটার ফোনের মধ্যে থেকে একটা অস্পষ্ট মুখ দেখেন। “এতো কিছু কি মনে থাকে দিদিভাই? কত লোকতো আসে। কত লোক চলে যায়। মেয়েটা শুনবে না। “ওসব জানি না কিছু। কচুবাটা খাওয়াতে হবেই হবে। আমি আজই লিখে দিচ্ছি ফেসবুক পেজে তুমি আবার কচুবাটা খাওয়াচ্ছো আমাদের। বুঝলে?”
ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের নোনাধরা সিমেন্টের কালো বোর্ডটা যে কবে থেকে ফেসবুকের বোর্ড হয়ে গেছে ইন্দুবালা সেটা জানেন না। জানার কথাও না। এখনকার ফোন ইন্দুবালা ব্যবহার করেন না। তাঁর আছে সেই কবেকার ল্যাণ্ড লাইন। সরকারের ফোনের ব্যবসা লাটে উঠলেও ইন্দুবালা সেই ফোনে আজও কাজ চালান। ছেলেরা, মেয়েরা ওই ফোনেই মায়ের খবর নেয়। ইন্দুবালা দুটো কথা বলে শান্তি পান। তবে এই এখনকার ছেলে মেয়েদের ফোন ব্যবহার না করলেও তিনি বুঝতে পারেন এর মাহাত্ম কী! ওখানে কিছু লেখা হয়ে গেলেই গোটা বিশ্বের লোক জানতে পারবে। আর ঠিক তখন থেকেই বাড়বে উৎপাত। সেই কবেকার পুরোনো ল্যাণ্ড লাইন ফোনটা আবার বাজতে থাকবে। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। বাড়ির সামনে ভিড় হবে। দশ জনের বদলে একশোজন ভাত খেতে চলে আসবে। পাড়ার লোক বিরক্ত হবে গাড়ি রাখার জায়গা পাবে না বলে। ধনঞ্জয় বড় খোকা, ছোট খোকা, খুকি সবাইকে ফোন করবে। নালিশ জানাবে। আর কেউ না আসুক বড় খোকা এসে বসে থাকবে ঠায়। নজর রাখবে। তাকে নজরে রাখার জন্য তার বাড়ি থেকে বউ ফোন করবে। ছেলে ফোন করবে। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এইসব ভেবেই শীত আসা সন্ধ্যেয় ইন্দুবালা ঘামতে শুরু করেন। আগে এমন হতো না। কেউ খেতে চাইলেই ইন্দুবালার আনন্দ হতো। এখনও হয়। কিন্তু এত বড় হয়ে যায় ব্যাপারটা সব কিছু ইন্দুবালা যেন সামলাতে পারেন না। তবুও বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না বুড়ির। এখনও সাধারণ দিনে ভাতের হোটেলে পাত পড়ে কম করে তিনশো মানুষের। বুড়ি এই বয়সে উনুনের সামনে এসে যখন কড়াই পেতে দাঁড়ান সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা মেনে গড় করে অনেকে।
“কী হলো? কিছু বলছে না যে?” সঞ্চারী তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালার মুখে হাসি ফোটে। “কোথা থেকে আমার ঠাম্মার মতো অমন চোখ পেয়েছিস বলতো? আর অমন পাড়া গেঁয়ে বিধবাদের মতো চুল কেটেছিস কেন?” সঞ্চারী বলে “ইশ। পাড়াগেঁয়ে বিধবাদের মতো লাগছে নাকি? কত টাকা দিয়ে চুল কেটেছি জানো? শুনলে মামা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। কেন খারাপ লাগছে দেখতে?” ইন্দুবালা হাসেন। “মোটেই না। মিষ্টি লাগছে। মামা না হয় চুল কাটার দাম জানতে পারলো না। কিন্তু এই যে দিন নেই রাত নেই মেসের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ফস ফস করে সবাই মিলে সিগারেট টানা হয় সেটার কথা জানে তো?” মেয়েটা জিভ বার করে। “তুমি কি সব খেয়াল রাখো ঠাম্মা?” ইন্দুবালা হাসেন। “একদিন সময় করে নিশ্চয়ই কচুবাটা খাওয়াবো দিদিভাই। কিন্তু আজকে ওই সব তোমাদের কি সব পেজ-টেজে লিখোনা কিছু কেমন?” মেয়েটা বলে “কেন লিখলে কী হবে?” ইন্দুবালা বোঝান। “আগে ওই নরম কচুটাকে আমায় পেতে হবে তো। সেই শহর কি আছে? বললেই কেউ ছাই গাদায় হওয়া একটা কচু গাছ অমনি উপড়ে নিয়ে চলে আসবে? আর যে সে কচু হলে তো হবে না। সেই মানকচুর ভেতরে দুধে টইটম্বুর হতে হবে। গাছ দেখলে বুঝতে হবে গর্ভিনী সে। অনেক তরিজুত করে তাকে তুলতে হবে। রান্না করতে হবে। তবেই না অনেক দিন পর তুইও আমাকে মনে রাখবি? তখন হয়তো কোনো বিদেশ বিভুই থেকে আমার কথা লিখবি”। এই ভর সন্ধ্যে নামার আগে এক অচেনা মেয়ের চোখ চিক চিক করে ওঠে। “আমি কোথাও যাবো না ঠাম্মি। কোথাও না। আমি শুধু ওই মেসবাড়িটায় থাকবো আর তোমার রান্না খাবো”। ছুট্টে চলে যায় সঞ্চারী। অমন ছলছল চোখ করে একদিন ইন্দুবালাও বলেছিল সে কলাপোতা ছেড়ে কোথাও যাবে না। কোনোদিন না। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন। ঠাম্মা বলেছিল “মেয়েদের প্রাণ হল কই মাছের জান। কত কী যে করতে হবে আর দেখতে হবে জীবনে। এই ছোট্ট গ্রামটায় আমার মতো কেন পড়ে থাকবি বলতো?” সবে শীত আসা সন্ধ্যেয় কবেকার ঠাম্মার মুখ মনে করায় এক অচেনা ছোট্ট মেয়ে। কার বেশ ধরে এসে তুমি আমার কাছে আজ খেতে চাইছে ঠাম্মা? আমি যে বড় বুড়ি হয়ে গেছি। তোমার ইন্দু যে আগের মতো আর নেই গো। চোখ থেকে জল পড়ে। ধনঞ্জয় ঘরে এলে বুড়ি চোখ মোছে। “একটু পরে দেওয়া যেত না আঁচটা? ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেল যে ধনা”।
লছমীও মাঝে মাঝে এমন ছলছল চোখে তাকাতো। কী হয়েছে জানতে চাইলে কিছুতেই বলতো না। স্বামীটা যে তার কোথায় পালিয়েছিল কেউ জানে না। অতগুলো বাচ্চা নিয়ে লছমী সেই কতদূর থেকে মাছ নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করতো। ইন্দুবালা বুঝতে একজন একা থাকা মানুষই বুঝতে পারে আর একজনের একার লড়াইয়ের মর্ম। ওরা যেন দুজনে দুজনের পরগাছা হয়ে জড়িয়ে থাকতো একে অপরকে। খুব টানাটানির সময়ও কিছুতেই লছমীকে টাকা পয়সা দেওয়া যেত না। ইন্দুবালার হোটেল শুরু হবার পর লছমীর কোচড়ে বেঁধে দিত তার ছেলে মেয়েদের জন্য খাবার। লছমী নেবে না কিছুতেই। ইন্দুবালা বলতো এক মা তার সন্তানদের দিচ্ছে। তুই নিবি না তো? লছমী তার প্রতিদানে ফিরিয়ে দিয়ে যেত অনেক কিছু। মাছ ছাড়াও কচু, মেটে আলু যেগুলো চট করে বাজারে পাওয়া যেত না। কবে সে যেন একবার নিয়ে এলো কোথা থেকে জোগাড় করে চুইঝাল। ইন্দুবালার সেদিন যেন সারাদিন ঘোরের মধ্যে কাটলো। এক টুকরো খুলনাকে যেন লছমী বয়ে নিয়ে এলো আঁচলে করে। ইন্দুবালা কিছুটা রান্না করলেন চুইঝাল দিয়ে। একটু তুলে রাখলেন। আর বাকিটা বসিয়ে দিলেন নারকেল গাছের কাছে। ভাবলেন একবার যদি চুইঝাল গাছটা বেঁচে যায় তাহলে তিনি সেটাকে নারকেল গাছে ওঠাবেন। আর সব রান্নায় চুইঝালের মিষ্টি গন্ধে ভরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। বাঁচেনি গাছটা। সেও হয়তো বুঝেছিল উদ্বাস্ত হয়ে বাঁচার দায় অনেক।
একটা সময় ছিল যখন লছমী নানা রকমের খবর রাখতো। কার বাড়িতে কচু হয়েছে। কার বাড়িতে লাউ। কে কুমড়ো শাক ফেলে দিতে চায়। সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আসতো লছমী। এই হোটেল মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে লছমীর অবদান কম নয়। ও না থাকলে আজ এই হোটেল হতোই না। এক মাছওয়ালী কেমন যেন ইন্দুবালার মনের কথা সব জেনে যেতো। টের পেত ইন্দুবালা কী ভাবছে। “তুই কি ঝাড়ফুক তুকতাক জানিস লছমী?” বারান্দায় পা ছড়িয়ে বেলা শেষে বাড়ি যাওয়ার আগে গল্প করতো সে। “ওইসব জানলে সেই কোথা থেকে এসে মাছের টুকরি নিয়ে দোরে দোরে ফিরি মা?” ইন্দুবালা ভাবেন তাও ঠিক। তাঁর গল্প লছমী জানে। কিন্তু লছমীর গল্প তাঁর তো জানা নেই। এমনকি লছমী কোথায় থাকে সেটাও জানেন না ইন্দুবালা। “এই লছমী তোর বাড়ি কোথায় রে?” লছমী হাসে। “কেন তুই যাবি?” ইন্দুবালা বলেন “হাঁ যাবো। তুই আগে বল কোথায় থাকিস?” লছমী বলে “শোনো তাহলে। এখান থেকে ইস্টেশন”। ইন্দুবালা বলেন “মানে শিয়ালদা?” লছমী ঘাড় নাড়ে। “হ্যাঁ গো। সেখান থেকে ক্যানিং লোকালে চড়ে একেবারে লাস্ট স্টেশনের আগে তিনটে স্টেশন। ওখান থেকে আবার রিক্সাভ্যান। চল যাবি আজকে?” হাসে লছমী। ইন্দুবালা বলেন “আজ তো যাবো না। তোকেও যেতে দেবো না। এতো দূর থাকিস তুই? একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। তার ওপরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। থেকে যা লছমী। এই শীতের দিনে নাই বা এতটা দূরের পথে বাড়ি গেলি?” লছমী অবাক হয়ে বলে “হাই রাম। কী বলছিস তুই মা? বাড়ি না গেলে মাছ আনবো কী করে? মাছ না আনলে খাবো কী? তুই হোটেল চালাবি কী করে?” লছমী সেই শীতের বাদলে বেরিয়ে যায়।
অনেক সকালে এসে দরজা হাটকায় লছমী, “মা..ওই মা..এখনও তুই শোয়ে আছিস?” ইন্দুবালা বেরিয়ে দেখেন মাছের সাথে একটা মস্ত মানকচু। “তুই এটার কথাই বলেছিলিস না মা?” ইন্দুবালা অবাক হয়ে যান। “এটাকে কোথায় পেলি তুই?” লছমী বলে যায় “সে অনেক বড় গল্প আছে মা। বাজার ফেরতা পথে বলবো।” লছমী চলে যায়। দুই ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে ইন্দুবালা কচু কাটতে বসেন। সেগুলোকে জলে ভেজান। কুরনি নিয়ে এসে টুকরোগুলো কুরতে বসেন। ধনঞ্জয় নেয়ে ধুয়ে এসে ভীষণ চোটপাট করতে শুরু করে। কোনো সহজ রান্না তোমার হেঁশেলে নেই না? একে কচু। তার ওপর এই নারকেল। কী হবে শুনি?” ইন্দুবালা গম্ভীর হয়ে বলেন, “কয়লার বস্তার মুখ ঢেকেছিলি কাল রাতে? সব তো জলে চিপসে হয়ে গেছে। রান্না হবে কী দিয়ে? লছমী কচু না আনলে লোকগুলো ফিরে যেত। অনাচ্ছিস্টি হতো। এখন কথা না বাড়িয়ে উনুন ধরাও গে। দেখো ঠাকুরের কৃপায় ভাতটা হয় কিনা”। ধনঞ্জয় কথা বাড়ায় না। নিজে ভুল করেছে। কয়লার বস্তা ঢাকেনি। ভিজে গেছে সব। মাথা নীচু করে উনুন ধরাতে চলে যায় ধনঞ্জয়।
ইন্দুবালা কুরনিতে কচু আর নারকেল কোরান। সেই কচু আর নারকেল সরষে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বড় শিলটায় বাটতে থাকেন। চারপাশটা ভরে উঠতে থাকে এক বুনো গন্ধে। অনেকদিন পর খুলনার কলাপোতা যেন হাতছানি দেয় তাঁকে। ইন্দুবালাকে ডাকে বোসপুকুরের পাশে বাঁশঝাড় পেরিয়ে কচু বন। শীতের অবেলার বৃষ্টি। মাথায় দুটো বড় কচুপাতা নিয়ে দুই ভাইবোন কচু তুলতে যায়। গা হাত পা চুলকোয়। মা বকে। ঠাম্মার কাঁদো কাঁদো মুখটা আজও কেমন যেন মনে পড়ে যায় ইন্দুবালার। জ্বরের পরে স্বাদহীন মুখে খেতে চেয়েছিলেন কচুবাটা। মাকে বলেননি। জানেন এই বাদলায় কিছুতেই তিনি ইন্দুবালাকে পাঠাবেন না। ইন্দুবালাকে ডেকে বলেছিলেন “নিয়ে আসবি নাকি ইন্দু? বোসেদের বাগান থেকে একটা কচু তুলে?” ইন্দু না বলতে পারেনি। ভূতের ভয় ছিল তার। তাই ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু ইন্দু চিনবে কী করে ভালো মানকচু? সেসব তো অনেক দিন আগেই ঠাম্মা নিজে হাতে করে শিখিয়েছে। “চারপাশ থেকে ছড়ার মতো পাতা যার বেরিয়েছে। ফুলের মতো হয়ে আছে গাছ। সে জানবি গর্ভবতী। মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছে সন্তানকে। তার মধ্যে টইটম্বুর দুধ। গোড়ায় ডেউ পিঁপড়েগুলোকে দেখেছিস? লোভীর মতো কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে?” ঠাম্মা বড় শাবল নিয়ে এসেছিলেন। ভিজে মাটিতে তাড়াতাড়ি বসে যাচ্ছিল শাবল। উঠে আসছিল ঘন কৃষ্ণকায় মাটি। গর্ত যত গম্ভীর হচ্ছিল দেখা যাচ্ছিল শিকড়টাকে। যেখানে লুকিয়ে রেখেছে তার খাবার। একটু পরেই মাটি খুঁড়ে গর্ত করে কচু বের করা হল। গায়ে শক্তি ছিল বুড়ির। সেই কচু কেটে বেটে গাঁ সুষ্ঠু লোক খেলো। আর আজ ঠাম্মার জ্বর। তাকে মা একটু কচু বেটে দিতে পারছে না? ভাইটা পাশে দাঁড়িয়ে খালি গা চুলকোচ্ছে। কচুর রস লেগে লাল হয়ে গেছে তার হাত পা। চুলকোতে চুলকোতে ফুলে গেছে হাতের ওপর দিকটা। তার সাথে মা গাঁ মাথায় করছে চিল চিৎকার করে। “বুড়ির মরার সময় এল, নোলা গেল না”। ইন্দুবালা চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢোকে। পিঁড়ি পেতে বসে। কচু কেটে, কুরে বাটতে বসে। কচুর ওপর ছড়িয়ে দেয় কাঁচা তেল। অনেক দিন পর দুপুর বেলা ধোঁয়া ওঠা ভাতে কচুবাটা খেতে বসে ঠাম্মার চোখে জল। সেটা কাঁচা লঙ্কা সর্ষের তেলের? নাকি আনন্দের বুঝতে পারে না ইন্দুবালা। খাওয়া হয়ে গেলে এক পরিতৃপ্তির মুখ নিয়ে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালাকে। তার হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে কীসব বিড়বিড় করে বলেন। আশীর্বাদ করেন। ঠাম্মা কি জানতো একদিন ইন্দুবালাকে এই হাত দুটোই বাঁচিয়ে দেবে? তারই কি ডাল সাঁতলানোর প্রস্তুতি সেরে রাখছিল ঠাম্মা?
বিকেলের দিকে চাদর গায়ে দিয়ে ইন্দুবালাকে বেরোতে দেখে পথ আটকায় ধনঞ্জয়। “চললে কোথায় শুনি?” ইন্দুবালা বলেন “হেতালের মাকে একটু বলে আসি। যদি একটু কচি কচু পায়”। ধনঞ্জয় রেগে যায়। “সেটা কাল সকালে বললেও হবে। এক্ষুনি সন্ধ্যে নামবে। রাতে ভালো দেখতেও পাও না। আমি হোটেল ছেড়ে বেরোতে পারবো না। একা কী করে যাবে শুনি?” ইন্দুবালা ধনঞ্জয়ের নাক ফোলানো দেখে হাসেন। “জানিস না আমার যে একজোড়া বেড়ালের চোখ আছে। রাতেও দেখতে পায় ভাল”। ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “কচুবাটা করতেই হবে? যে যা বলবে তোমাকে তাই করতে হবে? না বলতে পারো না তুমি, তাই না?” ইন্দুবালা বলেন, “ওমা সে কী কথা! মেয়েটা মুখ ফুটে একটু কচুবাটা খেতে চেয়েছে, না বলবো কী করে?” ধনঞ্জয় চিৎকার করে। “তুমি কিন্তু বলেছিলে লছমী মারা যাওয়ার পরে এই বাড়িতে কচুবাটা হবে না”। কেমন যেন ধাক্কা খান ইন্দুবালা। সন্ধ্যে নামছে সবে শীত আসা শহরে। ছেনু মিত্তির লেনে যে কটা পুরোনো বাড়ি রয়ে গেছে, যেগুলো এখনও ফ্ল্যাট হয়ে যায়নি সেগুলোর জানলা বন্ধ। অনেক উঁচু উঁচু
ফ্ল্যাটগুলোতে বাইরে থেকে বোঝা যায় না সেখানে মানুষ থাকে কিনা। কিংবা থাকলেও প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। মাঝে মাঝে কাপড়জামা জানলা কিংবা বারান্দায় ঝুললে বোঝা যায় ওখানে কেউ বাস করে। ইন্দুবালার এই মুহূর্তে নিজেকে বড় একা মনে হয়। কবেকার লছমীর কথা মনে পড়ে যায়। সারাক্ষণ চারপাশে যাদের সাথে কথা বলেন তাদের মধ্যে যে লছমী নেই সেটাই ভাবতে পারেন না তিনি। চান না। কেন তিনি এতদিন বেঁচে আছেন এই ভাবনা মাথায় চাগাড় দেবার আগেই হনহন করে হাঁটতে থাকেন ইন্দুবালা হেতালের মায়ের ঝুপড়ি ঘরের দিকে।
বাজার থেকে ফেরার পথে লছমী বলে “কই মা দাও দেখি ভাত খাই তোমার কচুবাটা দিয়ে”। শীতের বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে লছমী। ইন্দুবালা আলমারি থেকে নিজের একটা কাপড় বের করে দেন। লছমীর বারণ করা সত্ত্বেও গরম জল করে দেন স্নানের জন্য। আসন পেতে গরম ভাত খেতে দেন লছমীকে। কচুবাটা দিয়ে ভাত মেখে লছমী মুখে তোলে। “এটা কী করেছিস মা?” অবাক হয়ে তাকায় ইন্দুবালার দিতে। “ভালো লাগেনি তোর?” ভয়ে ভয়ে জানতে চান ইন্দুবালা। লছমী বলে “ভালো মানে বহুত ভালো”। শুধু কচুবাটা দিয়ে সব ভাতটা খেয়ে নেয় লছমী। কত দিন পরে তাকে এইভাবে বসে কেউ খাওয়ালো। কতদিন পর? বয়েস যখন বারো কি চোদ্দ শাদি হয়ে গিয়েছিল তার। ইন্দুবালা অবাক হন “এত ছোটোবেলায়?” লছমী বলে “তা নয়তো কি? বাপ তো মেয়েকে বিদাই দিতে পারলে বাঁচে। গ্রামে তো আর আমার বয়সী একটা মেয়েও ছিল না। তারপর বাবা চারটে ভইষ সওদা করে টাকা দেয় আমার মরদকে। তখন রাজি হয় সে। তোমার কত সওদা হয়েছিল মা?” ইন্দুবালা হাসেন। সবটা তো আর বাবা বলেনি। তবে গা ভর্তি গয়না পরিয়ে দিয়েছিল মা। সেই গয়নার আজ একটাও নেই। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাত দিয়েই সব খরচ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। লছমীরও কোনো গয়না নেই। মন খারাপ করে বসে থাকে দুজনে। গয়নার জন্য কি শুধু? মোটেই না। “কবে তুই শেষ তোর গ্রামে গেছিস লছমী?” লছমী বলে “তাও বছর দশ আগে। বাবা মা কলেরায় মারা গেল। তারপর কমলা নদীতে বান এলো। ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। সব কুছ। আমাদের গাঁওটা আছে জানি। কিন্তু আর কার কাছে যাবো মা?” লছমীর গল্পে ইন্দুবালাও যেন কেমন খুঁজে পান নিজেকে। বিয়ের পরে একবারও যাওয়া হয়নি কলাপোতায়। কার কাছে যেতেন? কেউ ছিল না সেই পোড়া ভিটেয়। সেদিন ইন্দুবালা লছমীকে আর যেতে দেননি। পরের দিন বনধ। অনেক করে বলেছিলেন থেকে যা না লছমী। সারা রাত দুজনে গল্প করবো। সত্যি করেও ছিলেন তাই। কত কত যে গল্প দুজন দুজনের জন তুলে রেখেছিলেন তার হিসেব ওই জাবদা খাতাও দিতে পারতো না। “তুই যদি আমাদের গাঁও কি দরওয়াজার কাহানী শুনিস না মা তাজ্জব বনে যাবি”। ইন্দুবালা অতশত হিন্দি জানেন না। লছমীর সাথে থেকে একটু একটু করে কয়েকটা শব্দ বোঝেন। “গাঁও কি দরওয়াজা সে আবার কী রে?” শুনে লছমী জিভ কেটেছিল লম্বা করে। “হাই রাম! তুই গাঁও কি দরওয়াজা জানিস না মা? তাহলে শোন। গাঁওয়ের বাইরে একটা ছাউনি করে রাখা থাকে। সেখানে এসে বসে দূর গাঁও থেকে আসা মেহমান। রাম দুলার ওখানে বসেই ভজন করে। বরাতির থাকা হুয়া মেহমান ওখানেই রাতে নিন্দ যায়। ছররা সিং ওখানেই রাতে ছাগলগুলোকে বেঁধে রাখে। আরও কত কী যে হয়! ওখানেই তো আমাদের মুখিয়া তার মেয়ের শাদিতে দশ গাঁওয়ের লোককে বৈঠ কর খিলালো। ওটা যখন দূর থেকে দেখতে পেতাম না মা, মনে হতো আমার গাঁও চলে এসেছি। আর যাবার সময় মনে হতো এই যে ছেড়ে যাচ্ছি আবার কখন ফিরতে পারবো?” মাঝরাতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ইন্দুবালা হালকা করে দেন। “আরে আমাদের জলসত্রের মতো। বিশালাক্ষ্মী তলায় ছিল তো। দূরের অচেনা অজানা পথিক তেষ্টার জল পেয়ে বিশ্রাম করতো। বোষ্টম বোষ্টমী ওখানেই সিধে পেয়ে দুটো চালে ডালে ফুটিয়ে খেত। গাঁয়ের বুড়োরা আচ্ছা জমাতো ওখানেই”। দুটো মেয়ে তাদের দুজনের সবচেয়ে ভালোলাগা জায়গা দুটোর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে উঠে ইন্দুবালা দেখেন লছমী নিজে উনুন ধরিয়েছে। আটার বড় বড় গোল গোল লেচি বানিয়েছে। তার মধ্যে ছাতু দিয়ে উনুনের আঁচে সেঁকছে। দিশি টমেটো সেদ্ধ করেছে। তার মধ্যে ধনে পাতা, কাঁচা লঙ্কা এইসব দিয়ে একটা চাটনি করেছে। “তোকে আমার কমলা গাঁওয়ের একটা খানা খাওয়াবো মা”। ইন্দুবালা চেখে দেখেছেন অন্যরকম স্বাদ তার। শুকনো পিঠে যদি এইভাবে করা যেত? ছাতুর বদলে নারকেলের পুর। “কী বলে রে এই খাবারটাকে লছমী?” লছমী জানতে চায় “আগে বলো ভালো লাগছে কি? আমার মরদ এক সাথে কত খেয়ে নিতো। বাচ্চারা আমার এই লিট্টি খাওয়ার জন্য বসে থাকে মা। আর চাটনি? পসন্দ হয়নি?” খুব ভালো লেগেছে ইন্দুবালার। “লছমী আমি তোর এই কমলা গাঁওয়ের চাটনিটা নিয়ে নিলাম রে। লিট্টি তো আর তোর মতো বানাতে পারবো না। চাটনিটা চেষ্টা করে দেখতে পারি”। সেদিন বিকেলে বাস ট্রেন চলার পরে লছমী চলে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেল ইন্দুবালার একটা না দেখা কমলা গ্রামকে। তার পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা কমলা নদীকে। নদীর ধারে ছট পুজো, হোলিকে।
আজ যেন মনে হচ্ছে হেতালের মায়ের দোকানটা বড্ড বেশি দূরে। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে আনতে পারলে ভালো হতো। রাগ করে এইভাবে ছুটে বেরিয়ে আসা মোটেই উচিত হয়নি ইন্দুবালার। যদি রাস্তায় পড়ে যান তাহলে একটা কাণ্ড ঘটবে। ঠিক যেমন হয়েছিল লছমীর। বুঝতে পারেনি ট্রেন আসছে। মাথায় ছিল মাছ ভর্তি ঝুড়ি। তাড়া ছিল বাজারে আসার। সেদিন আবার কালেক্টার অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন কচুবাটা খেতে আসবেন। লছমীর ঝুড়িতে ছিল মাছ। কাঁধের বস্তার বোঁচকায় ছিল বড় কচু, দিশি ছোট টমেটো, খুব ঝাল লঙ্কা, ধনে পাতা। অনেক ভোরে, কুয়াশার মধ্যে অন্যমনস্ক লছমী বুঝতে পারেনি ট্রেন এসে পড়েছে খুব কাছেই। পার হতে পারেনি লাইন। ছিটকে পড়েছিল মাছের ঝুড়ি। কাঁধের বস্তা। দেহ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওই হাসিখুশি মুখটা। অনেক বেলায় খবরটা এসেছিল। ইন্দুবালা তখন কালেক্টার অফিসের লোকজন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। ভেবেছিলেন লছমী আসেনি হয়তো শরীর খারাপ করেছে। কিন্তু মনে মনে দুশ্চিন্তাও করেছেন এমন কথার খেলাপ তো লছমী করে না। সব ভাবনা চিন্তা চাপা দেওয়ার জন্য ইন্দুবালা আরও রান্নার পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। কচুবাটার জায়গায় ঢুকে পড়েছে ছ্যাঁচড়া। সবাই যখন গরম গরম ভাত দিয়ে খাবে এতসব রান্না ঠিক সেই সময়ে রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলো দয়ারাম। লছমীর সাথেই আসতো সে। তার পাশে বসেই মাছ বিক্রি করতো। দুজনের যত ঝগড়া ছিল তত ভাব। শুকনো মুখে দয়ারামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাঁক করে উঠেছিল বুক। “কী হয়েছে রে দয়ারাম? ওরকম শুকনো মুখ কেন তোর?” দয়ারাম বসে পড়েছিল দোরগোড়ায় মাথায় হাত দিয়ে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেছিল পুরো ঘটনাটা। চুপ করে শুনেছিলেন ইন্দুবালা। নিজের মনের ভেতরের তোলপাড় কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। নিজের সব সময় ভেবে এসেছেন এই হোটেলের যদি কেউ অংশীদার থেকে থাকে তাহলে সে হলো লছমী। তার সেই প্রথম দিনের টাকায় হোটেল শুরু না হলে কোনদিন ইন্দুবালা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। শান্তভাবে সবাইকে খাইয়ে, স্নান করে নতুন কাপড় পরলেন ইন্দুবালা। দয়ারামকে নিয়ে নিজে গেলেন মর্গে। সেখানে একবার শেষ দেখা দেখবেন ভাতে কাপড়ে তাঁকে বাঁচিয়ে যাওয়া বিহারের সেই কোন অজ কমলা গ্রামের মেয়েটিকে। যার বাবা মা বিয়ে দেওয়ার নামে পণ দিয়ে বেচে দিয়েছিল কোনো এক নেশাখোর মানুষের কাছে। লছমী চুপ করে শুয়ে ছিল মর্গের মেঝেতে তার হাসি হাসি মুখ নিয়ে। শুধু গলার কাছে। ছিল একটা চওড়া সেলাই। বসে পড়েছিলেন ইন্দুবালা ঠিক লছমীর পাশে মর্গের মেঝেতেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মৃত সখীর। “এমন তো কথা ছিল না রে। উনুন ধরিয়ে বসেছিলাম তোর জন্যে। তুই এলি না। কথা রাখলি না”। এত শুকনো চোখেও জল পড়ে ইন্দুবালার। ভেপসে ওঠা মর্গটাও যেন শোকের সজীবতা পায়।
লছমীকে দেখেই কাজ শেষ হয়ে যায়নি ইন্দুবালার। পুলিশের কাছে যে ফর্ম থাকে অশনাক্ত বডির সনাক্তকরণের সেইসব কিছু ফর্মালিটি করতে হল তাঁকেই। বাজারের একগাদা গরীব গুর্বো লোকের সাথে ভদ্রঘরের এক বিধবাকে দেখে পুলিশের লোকজন একটু অবাক হয়েছিল বটে তবে বিস্তারিত প্রশ্ন করার অবকাশ ছাড়েনি। লছমী যে তাঁর আত্মীয় হয় পুলিশের কাছে বলেছিলেন ইন্দুবালা। “ঠিক কি ধরনের আত্মীয় যদি একটু বলেন দিদি?” জানতে চেয়েছিল লোকাল থানার ওসি বিষ্ণুপদ হাজরা। ইন্দুবালা বলেছিলেন “বোন..”। ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিল ওসি, “একজন বিহারী বাঙালির বোন?” ইন্দুবালা সরাসরি তাকিয়ে বলেছিলেন “কেন হতে পারে না? আমার আপনার রক্তের হিসেব কার কাছে লেখা আছে স্যার? রক্তের আত্মীয়তাই কি সব?” ওসি কথা এগোয়নি। এমনিতে বেশি মাল কড়ি পাওয়া যাবে না এদের কাছে। ফর্মে সই করে ছেড়ে দিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় ইন্দুবালা দেখেছিলেন দরজার কাছে পড়ে আছে কচুটা, ঝুড়িটা। আইডেন্টিফিকেশানের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। কাউকে কিছু না বলে কচু আর ঝুড়ি দুটোই নিয়ে এসেছিলেন ইন্দুবালা। যিনি কোনোদিন তাঁর স্বামীর একটা ছবি বাড়িতে রাখেননি তিনি তাঁর সখীর শেষ চিহ্নটুকু নষ্ট হতে দেননি।
দয়ারামকে সব খরচ দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। লছমীর অন্ত্যোষ্টি, শ্রাদ্ধ সব কিছু। এমনকি লছমীর ছেলেকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের দশ হাজার টাকা। মায়ের জায়গায় ব্যবসা শুরুর জন্য। বাড়ি ফিরে খুব হালকা লেগেছিল তাঁর। খুব কাছের মানুষ চলে গেলে যেমন চারপাশ ফাঁকা হয়ে যায়। লছমী চলে যাওয়ার পরেও তাই মনে হয়েছিল। কিছু খাননি সেদিন সারাদিন। পরের দিন সকালে স্নান করে, উনুন ধরিয়ে কচু বাটতে বসেছিলেন। সেদিন হোটেলের মেনু ছিল গরম ভাত, কচুবাটা আর দেশি কাঁচা টমেটোর চাটনি। পরে সেটা নাম বদল করে রেখেছিলেন লছমী চাটনি। চাটনি হয়ে গেলে তার ওপরে ছড়িয়ে দিতেন গন্ধরাজ লেবুর সুবাস। প্রথম ভাত নামার পরেই শাল পাতার থালায় তুলে নিয়েছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। কচুবাটা আর চাটনি পাশে দিয়ে বাগানের নারকেল গাছটার তলায় রেখে এসেছিলেন। মাটির গ্লাসে ছিল জল। গড় হয়ে প্রণাম করে সেই খোলা বাগানে লছমীকে অনুরোধ করেছিলেন শেষবারের মতো ভাত খেয়ে যেতে। আর পেছন ফিরে তাকাননি। বাগানের দরজা বন্ধ করে ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন আজকের পর থেকে কচুবাটা রান্নাটা বন্ধ তাঁর হোটেলে।
তাহলে এখন হঠাৎ এই অবেলায় অচেনা এক মেয়ের অনুরোধে ইন্দুবালা রাজি হয়ে গেলেন কেন আবার সেই রান্না করতে? কে জানে কার মধ্যে দিয়ে কে বারবার এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে। সেদিনে বিকেলে বাগান থেকে এসে ধনঞ্জয় বলেছিল, “মা শালপাতার থালা পরিষ্কার। একটা ভাতও নেই। শুধু কি তাই? জলটা পর্যন্ত খেয়ে গেছে গো”। ইন্দুবালা ধমকে ছিলেন ধনঞ্জয়কে। “ওইভাবে বলতে নেই ধনা। মানুষ মারা গেলে ঈশ্বর হয়ে যান”। এখনও কাঁচা মাছ আসলে প্রথমে ওই লছমীর ঝুড়িতেই রাখা হয় সব। তারপর সেখান থেকে সব ধুতে যায়। ভাজতে যায়। কিছু কিছু অদ্ভুত সংস্কার ইন্দুবালা আজও মনে মনে মেনে চলেন।
সেদিন হেতালের মায়ের দোকান বন্ধ ছিল। কাজেই ইন্দুবালাকে বেশ কয়েকদিন পর পর নতুন কচুর জন্য বাজারে হেতালের মাকে বলে রাখতে হলো। সেই বউটি অনেক খুঁজে পেতে সোনারপুর পেরিয়ে আরও কোন অজ গাঁয়ের থেকে কচু এনে দিলে ইন্দুবালা পরপর কয়েকদিন কচুবাটা করেলেন। ঝামেলা হলো বিস্তর। চারপাশের লোকজন তো এলোই। কৃষ্ণনগর থেকে এলেন সেই অধ্যাপক অমলেন্দু। সঞ্চারী পরিচয় করিয়ে দিলো। কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। “চিনতে পারছেন না আমাকে দিদি?” যখন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো তখনও বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। চশমা খুলতেই ঝন্টুকে চিনতে পারলেন তিনি। এমন জ্বর বাধিয়ে ছিল ছেলেটা নিজে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন ইন্দুবালা। “তোর মনে আছে লছমীকে ঝন্টু? ওই যে ঝুড়ি করে মাছ দিয়ে যেতো আমাকে?” ঝন্টু মনে করার চেষ্টা করে, পারে না। ধনঞ্জয় খ্যাচ খ্যাচ করে। কচুর ডাঁই পড়ে আছে। সেগুলো কখন কাটা হবে, বাটা হবে কে জানে। ঝন্টু তার ব্যাগ থেকে কৃষ্ণনগরের সরভাজা বার করে দেয়। ইন্দুবালা সবাইকে বসতে বলেন। কচি কচুকে ভালো করে ধুয়ে, কুরে, নারকেল, সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মিহি করে বেটে ওপরে ছড়িয়ে দেন কাঁচা সরষের তেল। গরম ভাতে সেই কচুবাটা নিমেষে শেষ হয়। সবাই হাপুস হুপুস শব্দ তোলে। কচি দেশি টমেটোর চাটনি লোকজন চেটেপুটে খায়। অনেকদিন পরে পড়ন্ত বেলায় রান্না ঘরের দরজায় লছমী এসে দাঁড়ালে ইন্দুবালা একটুও অবাক হন না। শুধু বিড়বিড় করে বলেন তোকে আজ আর কেউ মনে রাখেনি রে লছমী। লছমী হাসে। কোনো কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। কী বলতে চাইছে লছমী ইন্দুবালাকে? বিদায় বেলার আমন্ত্রণ?
ইন্দুবালার কেমন যেন শীত করে। তড়িঘড়ি দোতলায় ওঠেন। ধনঞ্জয়ের বেড়ে দেওয়া ভাতের থালা সরিয়ে রেখে কিচ্ছুটি না খেয়ে বারান্দায় একচিলতে রোদে আচার, কাসুন্দি আর বড়ির পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। পশ্চিম দিকে পাটে যাওয়া বেলাশেষের একটু রোদ এসে পড়ে তাঁর পরিতৃপ্ত শঙ্কাহীন মুখে।
khub khub bhalo laglo.
One of the best bengali novellas of the era.
এক্কেবারে হৃদয় ছুয়ে গেলো।
চোখের সামনেই যেনো ভাসছিলো ছেনু মিত্তির লেনের সেই দোতলা বাড়িটা,কলাপোতা গ্রাম।আর সেই অসংখ্য না দেখা না খাওয়া খাবার ও।
❤️
Khub khub valo
অসাধারণ! মনে হল যেন পৌষের ভোরে উঠানের চুলার পাশে বসে পেট ভরে খেজুরের গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খেলাম!!!
অনেক যত্নে অনেক নিপুনতায় আর পরম মমতায় ধিমে আঁচে প্রস্তুত এই লেখা বাংলা সাহিত্যের এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
পাখিদের স্মৃতি কিছু রীতিনীতি
ফণীমনসা ও জানে,
বাগানের স্মৃতি নজরুল গীতি
বালিকার কানে কানে।
পাখিদের স্মৃতি কিছু রীতিনীতি
ফণীমনসা ও জানে,
বাগানের স্মৃতি নজরুল গীতি
বালিকার কানে কানে।
বিকেলের স্মৃতি গোপন পিরিতি
গোপনেই রাখা থাকে,
মানুষের স্মৃতি বহু বিস্মৃতি
শ্মশান বন্ধু টানে।
ঘন মেঘে ঢাকা সুহাসিনী রাকা
তুমি কি গো সেই মানিনী,
অসাড় আষাঢ়ে অকুল পাথারে
স্মৃতির ও বিলাসে ভাসিনি,
ঘন মেঘে ঢাকা ..
কাঁটার মুকুটে ঈশ্বর প্রীতি
নদীর দুকূলে নৌকোর স্মৃতি,
অ্যালবাম জুড়ে অচেনা মুখেরা
তারাও তো ছিল কারুর স্মৃতিতে,
অসীম বন্ধুপ্রীতি,
ক্ষিদের স্মৃতিতে খুদের গন্ধ
প্রাচীন অর্থনীতি।
ঘন মেঘে ঢাকা সুহাসিনী রাকা
তুমি কি গো সেই মানিনী,
অসাড় আষাঢ়ে অকুল পাথারে
স্মৃতির ও বিলাসে ভাসিনি,
ঘন মেঘে ঢাকা ..
বৃষ্টির স্মৃতি যুদ্ধ বিরতি
ভিজে ওঠে অবরোধে,
রাস্তার স্মৃতি সারমেয় ভীতি
জেগে থাকে অপরাধে।
তোমার যাওয়ার পথ ভরেছে
স্মৃতিদের হাহা রবে,
বহু রাত একা জেগেছে প্রকৃতি
চোরের উপদ্রবে।
ঘন মেঘে ঢাকা সুহাসিনী রাকা
তুমি কি গো সেই মানিনী,
ভিড়ে মিশে থাকা, স্মৃতিদের পাখা
পরাজিত এক বাহিনী।
তোমার যাওয়ার পথ ভরেছে
স্মৃতিদের হাহা রবে,
বহু রাত একা জেগেছে প্রকৃতি
চোরের উপদ্রবে।