৭. চন্দ্রপুলি
ধনঞ্জয় বাজার থেকে এনেছে গোটা দশেক নারকেল। কিলোটাক খোয়া ক্ষীর। দশ কেজি মতো চিনি। আরও অনেক কিছু। ইন্দুবালা ফর্দ করে দিয়েছিলেন। সেগুলো দেখে দেখে সে নিয়ে এসেছে। কিন্তু না নিয়ে আসা জিনিসও আছে তার মধ্যে অনেক। যেমন ইন্দুবালা ফর্দে লেখেননি ছোটো এলাচের কথা। সেটা মুখে বলে দিয়েছিলেন। ভুলে গেছে ধনঞ্জয়। জোয়ানের কথা বলেছিলেন। একবার নয়, অন্তত বার তিনেক–সেটাও আনেনি। একটু দাঁড়িয়ে গেলে এগুলোও সব লিখে দিতে পারতেন ইন্দুবালা। কিন্তু সে সময়টাও ধনঞ্জয় দেয়নি। তাড়াতাড়ি বাজারে বেরিয়েছে সে। নেশায় টান পড়েছে যে তার। আগের রাত থেকে গুড়াকু ফুরিয়েছে। কাজেই তখন তার প্রাণ সংশয়ের অবস্থা। দিনে অন্তত বার আষ্টেক গুড়াকু দিয়ে দাঁত না মাজলে মেজাজ ভালো থাকে না ধনঞ্জয়ের। সকালে উঠে কৌটো কেঁখে যেটুকু পেয়েছে তাতেই কাজ চালিয়েছে। কিন্তু যত বেলা বেড়েছে তত মনে হয়েছে হাত পা যেন চলতে চাইছে না আর। মাথা ঝিমঝিম করছে। এইসব কাটাতে ধনঞ্জয় তাই বার দুয়েক জর্দা খেয়েছে। উলটো দিকে ভুবনের পানের দোকান থেকে কাঁচা সুপারি খেয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গুড়াকুর নেশা বেড়েছে বই কমেনি। তাই কোনো মতে সে মায়ের কাছ থেকে ফর্দ নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে বাজারের দিকে। এদিকে ইন্দুবালা যে সমানে বলে চলেছেন আরও কী কী আনতে হবে, কী কী লেখা হয়নি খাতায় সেগুলো কিছুই প্রায় কানে ঢোকেনি ধনঞ্জয়ের। যেন হাওয়ায় ভেসে বেরিয়েছে সে। ফল হয়েছে মারাত্মক। ভুলে যাওয়া জিনিসপত্রের তালিকা অনেক। তার মধ্যে আছে ছোটো এলাচ, লবঙ্গ, জোয়ান, গোল মরিচ, আরও কত কী! এদিকে বয়েস বেড়েছে ধনঞ্জয়ের। ইন্দুবালারও ধিকি ধিকি করে অনেক। দুজনের বাক যুদ্ধ শুরু হলে থামানোর কেউ নেই। রান্নার কোনো জিনিস কিনে আনতে ভুলে গেলেই ইন্দুবালা প্রচণ্ড রেগে যান।
তাঁর হাতের কাছে সব ঠিকঠাক মতো থাকা চাই। রান্নার সময় এটা নেই ওটা নেই তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। এই নিয়ে সকালে ধনঞ্জয়ের সাথে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়েছে। ছোটোখাটো ঝগড়াও। সপাটে ইন্দুবালা বলে দিয়েছিলেন “মুখের ওপর কথা বলবি না ধনা”। এটা যে কতবার দিনে বলেন আর কতবার যে নিজেই ধনঞ্জয়কে ডেকে কথা বলেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যেকদিন নিজে খেতে বসার আগে এখনও পর্যন্ত ধনঞ্জয়কে খাওয়ান। হ্যাঁ, নিজে বসে থেকে। সবার খাওয়া হলে তারপর ইন্দুবালা ভাত নিয়ে বসেন। আজকাল খাবারেও রুচি নেই। ভালো লাগে না কিছুই। সব কিছু ফেলে রেখে একদলা আচার দিয়ে কোনোমতে ভাতগুলো খান। এইসব ধনঞ্জয় জানে না। জানলে আর রক্ষে থাকবে না। ইন্দুবালার ভালো-মন্দ সব কিছুর ওপর প্রচণ্ড নজর ধনঞ্জয়ের। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ছেলেদের ফোন করে মাথা খারাপ করে দেবে। তারাও ধনাদা বলতে প্রাণ। এতকাল একটা লোকের থাকা মানে বাড়ির সাথে, বংশের সাথে শিকড় গজিয়ে যাওয়া। নিজের সন্তানদের থেকেও বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করেন ইন্দুবালা তাকে। তবুও কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, কথা বন্ধ হয় দিনে বেশ কয়েকবার। না
হলেই বিপত্তি ঘটে। ধনঞ্জয় বার বার তখন জিজ্ঞেস করে, “হাঁ গো মা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? বড় খোকাকে ফোন করি? ডাক্তার ডাকুক।” এর উত্তরে ইন্দুবালা মুখ ঝামটা দিলে ধনঞ্জয় ভাবে, না বুড়ি ঠিক আছে। সুস্থ আছে। কোনো অসুবিধে কিছু নেই।
পুজো এলেই ইন্দুবালার মন ভালো থাকে না। কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যান। পইপই করে ধনঞ্জয় বলেছিল, “খুকি ডাকছে এত করে, ঘুরে এসো।”ইন্দুবালার একমাত্র মেয়ে ইতু থাকে ব্যাঙ্গালোরে। এ বছরেই তাদের সেখানকার পাট উঠবে। জামাই চলে যাবে ইউক্রেনে। মেয়ে তার ছেলেপুলে নিয়ে এসে উঠবে দিল্লির শ্বশুরবাড়িতে। তারপর সেখান থেকে সোজা স্বামীর কাছে। তাই ওরা বারবার বলেছিল একবার আসতে। বিশেষ করে জামাই সুকান্ত। “একবার আসুন মা। অনেকদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।” আবদার করেছিল। ছোটো খোকা ধরিয়ে দিয়েছিল হাতের ফোনটা। সেখানেই তিনি ভিডিও কলে দেখতে পাচ্ছিলেন জামাইকে, খুকিকে, তাদের ছেলেপুলেদের। সবাই চাইছিল ইন্দুবালা যেন ওদের ওখানে যান। একটু থেকে আসেন ওদের সংসারে। খুকি কেঁদেছিল, “সেই কবে বিয়ে দিয়েছ একবার দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এবার বাইরে চলে যাচ্ছি আবার কবে
দেখা হবে …” কথা শেষ করতে পারেনি খুকি। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে বলে দিয়েছিলেন, “এবার ছুটি দে না তোদের মাকে। আর ধরে রাখিস না। এই তো তুই, ছোটো খোকা, বড় খোকা সবাই কেমন মিলেমিশে আছিস। সেইভাবেই থাকবি। আমাকে ছেড়ে দে।” খুকি এরপরে একটুও কথা বলতে পারেনি। তার কান্না আরও বেড়েছিল। জানতো তার মা কোনদিন আসবেন না তার কাছে। দাদাদের কাছেই যায়নি। তার কাছে আসবে কেন? কিন্তু এবার যে চলে যাচ্ছে সে অনেক দূর। হুট করে মায়ের কিছু হলে আসতে তো তিন দিন চলে যাবে।
ফোন রেখে দেওয়ার পরে ছোটো খোকা সুদীপ বেশ কড়া করেই বকে দিয়েছিল ইন্দুবালাকে। একমাত্র তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সুদীপই একটু শাসন করে ইন্দুবালাকে। বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা ঘটলে, মনোমালিন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে দাদা, বোন যখন কেউ পারে না সামাল দিতে মাকে তখন সব শেষে আসে সুদীপ। ছোট খোকা এসে বেশি কিছু করে না। হোটেলের রান্না ঘরে একটা মোড়া নিয়ে চুপ করে বসে থাকে গ্যাঁট হয়ে। শুধু নজর রাখে ইন্দুবালাকে পুলিশ ইন্সপেক্টারের মতো। যদিও অনেক ছোটো থেকে সে তার দাদা বা বোনের চেয়ে এই ঘরে কাটিয়েছে অনেকটা সময়। রান্না করতে ভালোবাসে সুদীপ। মায়ের অনেক রান্না তার জানা। বাড়ির লোকজনও বেজায় খুশি হয় তার রান্না খেয়ে। অনেকে বলে ইন্দুবালার রান্নার হাত নাকি এই ছেলেই পেয়েছে। একটু বড় হওয়ার পরে সুদীপের খুব ইচ্ছে ছিল হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার। ইন্দুবালা সেসব হতে দেননি। কে যেন তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভালো করে পড়ে, সরকারি পরীক্ষায় বসে বাঁধা চাকরির কথা। হয়তো কালেক্টার অফিসের বাবুদের দেখে তাঁর মাথায় আসতে পারে। কাজেই সুদীপকে সরকারি পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। চাকরি করতে হয়েছিল মায়ের কথা শুনেই। তিন ভাইবোন কেউই মায়ের অবাধ্য ছিল না। তারা একটু সময়ের জন্যেও মাকে কষ্ট দেয়নি। যা বলেছেন ইন্দুবালা তাই করেছে। এমনকি বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেও মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু সুদীপ তাও মাঝে মাঝে এসে গায়ের ওপরে পড়ে থেকেছে। হম্বিতম্বি করেছে। আরও দুটো বেশি কাজের লোক রাখতে বলেছে। টেবিলগুলো সানমাইকা দিয়ে ঠিক করতে বলেছে। মিস্ত্রি নিয়ে এসে বসে থাকলেও ইন্দুবালা নিজের হোটেলে তাকে নাক গলাতে দেননি। তিনি জানেন ভালোবেসেই করছে সে। তবুও তাঁর রক্তরা যেন আর এই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া জালে না জড়ায় আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। আর তত দুই ছেলে, মেয়ে সবাই খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের চিলেকোঠা, আচারের বয়াম, নীচে রান্না ঘরে ঝুড়ি চাপা দেওয়া মাছের ডিমের বড়া। মায়ের কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো নাড়, নিমকি, কুচো গজা। এর থেকে তাদের যে নিস্তার নেই। সুদীপ মোড়াটা এগিয়ে আরও উনুনের ধারে নিয়ে এসেছিল। “দাও দেখি মৌরলা মাছগুলো ভাজি”। ইন্দুবালার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়। বাইরের কাপড়ে, স্নান না করে তুই রান্না ঘরে বসিস কী করে?” সুদীপ বলে “যাই তাহলে স্নান করে আসি। রান্না করতে দেবে তো?” ইন্দুবালা বলেন “কক্ষনও না। নিজের কাজ করোগে যাও।” রান্নার সময়ে কেউ যদি তাকে বিরক্ত করে মোটেই সহ্য হয় না তাঁর। সেটা সুদীপ জানে। আর জানে বলেই সে ইচ্ছে করেই আজ এইসব করছে। “টক করবে না ঝোল? আর একটু বড় সাইজের কেনা উচিত ছিল মা তোমার।” সকালে মাছগুলো দেখে ইন্দুবালার মনে হয়েছিল একবার। টকের জন্য আর সামান্য বড় হলে ভালো হতো। নিজের মনের কথাগুলো যেন পড়ে ফেলছে ছোটো ছেলে। লছমী বলতো “ওটাকেই তুই বেশি ভালোবাসিস মা।” ইন্দুবালা বলতেন, “ধুর ওইভাবে ভালোবাসা ভাগ হয় নাকি। একটাকে বেশি আরেকটাকে কম। বলতে পারিস আমি কাউকেই ভালোবাসি না।” লছমী চোখ বড় বড় করে বলেছিল “আচ্ছা? তাই তুই ওদের জন্য এতো কিছু করিস তাই না?” ইন্দুবালাও চুপ করে থাকার মানুষ ছিলেন না। জীবনটাকে যে দেখে ফেলেছেন অনেকটা, “কর্তব্য করি রে লছমী। এইটুকু যদি ওরা মনে রাখতে পারে, তাই অনেক।” মনে রেখেছিল সন্তানরা। ভোলেনি কেউই। ছোটোবেলায় সুদীপ যখন এসে দাঁড়াতো মায়ের সামনে। বায়না করতো একসাথে বাজার যাওয়ার। ইন্দুবালার মোটেই সেগুলো প্রশ্রয় দিতেন না। “যখন যা বলবো সেটাই করবে। বাড়তি কাজের তো দরকার নেই। সেই সময়টা পড়াশুনা করো”। ছেলেটা লুকিয়ে চুরিয়ে তবুও চলে যেত ধনঞ্জয়ের সাথে। বাজার করতো। ইন্দুবালা অবাক হয়ে যেতেন অত ছোট্ট ছেলের গুছিয়ে বাজার করা দেখে। পরীক্ষার পরে অন্যান্য বন্ধুরা যখন নানা খেলায় মেতে আছে; দাদা, বোন সবাই আঁকার ক্লাসে, তখন সুদীপ রান্না ঘরে। মায়ের সাথে পোস্ত বড়া করেছে। প্রচণ্ড রেগে গেলেও, চিৎকার চেঁচামেচি করলেও ছোটো খোকাকে নিরস্ত করতে পারেননি। মাছের টকে বড় না ছোটো মাছ সেই দিকে আলোচনা না এগিয়ে, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে এসে বসলেন
ইন্দুবালা ছোটো খোকার সামনে। তিনি জানেন এই ছেলে সহজে ছেড়ে দেওয়ার নয়। ইতুর বাড়ি যাওয়ার ফয়সালাটা সেরেই তারপর এখান থেকে উঠবে।
“কী চাস কি তুই?”
“পুজোয় খুকির কাছ থেকে ঘুরে এসো। ততদিন আমি হোটেল চালাবো”।
“তোর অফিস?”
“বন্ধ থাকে মা।”
“এর আগে কোনোদিন হোটেল চালিয়েছিস?”
“দেখেছি তো তোমাকে। তাছাড়া ধনাদা আছে। কিরে পারবো না?”
ধনা মাথা নাড়লে কড়া চোখে তাকান ইন্দুবালা।
“তুই পুজোতে এখানে পড়ে থাকবি…আর ছেলে মেয়ে বউ এরা কী করবে?”
“সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি সামলে নেবো।”
“আমাকে করুণা করছিস তাই না?”
“যাহ বাব্বা…করুণার ব্যাপার এলো কোথা থেকে?”
“আমার হোটেল নিয়ে তোমাদের কাউকে ভাবতে হবে না। যাও বেরিয়ে যাও এক্ষুনি বাড়ি থেকে।”
“যাবো না। তুমি কী করবে করে নাও।”
কেন খুকির বাড়ি ইন্দুবালা যাবেন না তাই নিয়ে অশান্তি চরমে উঠেছিল। সুদীপের বউ পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। “কেন তোমরা মাকে জোর করছো? যেতে চাইছেন না যাবেন না। মিটে গেল। তুমি দাদাভাই দেখা করে এসো না ইতুর সাথে। আমি আর দিদিভাই না হয় দিল্লিতে গিয়ে ওদের সি অফ করবো।” ইন্দুবালার ছোটো ছেলের বউ খুব একটা এই বাড়িতে আসে না। পালা পার্বণে নমস্কার, খাওয়া দাওয়া ছাড়া বড় একটা ঘেঁষতে দেখেন না। কিন্তু খোঁজ রাখে ইন্দুবালার সে। দিনে অন্তত একবার ফোন করে। কী কী রান্না করলেন ইন্দুবালা, নতুন কিছু হল কিনা সব। তার সাথে কথা না হলেও ধনঞ্জয়ের সাথে তো হয়ই। বড় ছেলের মেয়ে সুনয়নী যখন বিদেশ থেকে অতদিন পরে এলো, সেই খবর প্রথমে পেয়েছিল এই ছোটো ছেলের বউ নন্দিতা। সেই সবাইকে জড়ো করে। বড় ছেলে, বউমারা রাগ মিটিয়ে আবার সুনয়নীকে টেনে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। ছোটো খোকা যা রগচটা। এই বউ সামলে রেখেছে তাকে সব দিক থেকে। তাই মুখে কিছু না বললেও ছোটো বউকে সমীহ করেন ইন্দুবালা। আর সেও বেশ দূর থেকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। আর দেখাবেই বা না কেন। ইন্দুবালার সাথে তার যে আছে এক অন্তরের যোগ। সে অনেকদিন আগের কথা। নন্দিতা তখন কলেজের গণ্ডি সবে পেরিয়েছে। মল্লিক বাড়ির যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার সাথে বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছিল না মোটেই। মেয়ের সাথে বাবা-মায়ের মুখ দেখাদেখি যখন বন্ধ হবার যোগাড়, খবর কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে যখন বাড়ির সামনে ছেলের বাড়ির লোকজন এবং ছেলেরাও লাইন দিতে শুরু করেছে নন্দিতাকে দেখবে বলে। সেই রকমই একদিন সে সটান চলে এসেছিল এই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সুদীপ নামের যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার মায়ের সাথে কথা বলতে। সদর দরজা হাট করে ভোলা ছিল। ওটাই যে হোটেলে ঢোকার রাস্তা সে জানতো না। ঘরের মধ্যে ঢুকে খাবারের কাঠের পংক্তিগুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে ডান হাতে পড়ে রান্নাঘর। সেই ঘরে ঢুকে নন্দিতা দেখেছিল সন্ধ্যের আঁচে চিঁড়ের পায়েসের দুধ জাল দিচ্ছেন ইন্দুবালা। কয়লার আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে আছে ভদ্রমহিলার সারা মুখ জুড়ে। এত শান্ত কেউ হতে পারে নন্দিতা ভাবতেও পারেনি। কারণ এমন মানুষের সংস্পর্শে সে এর আগে আসেনি। সব খুব একটা যে গুছিয়ে সেদিন বলতে পেরেছিল নন্দিতা তেমনটাও নয়। ইন্দুবালা এটুকু বুঝেছিলেন, তাঁর ছেলেকে ভালোবাসে এই মেয়েটি। বিয়ে করতে চায়। বাড়ির লোক দিতে চাইছে না বলে সোজা ছেলের মায়ের কাছে চলে এসেছে। তাও ছেলেকে না জানিয়ে অনেক আঁটঘাট বাঁধা বন্ধের চিন্তা না করেই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন নন্দিতার মুখের দিকে ইন্দুবালা। তাঁর কোনোদিন সাহস হয়নি বাড়িতে বলার যে, ভালোবাসেন মনিরুলকে। বিয়ে করতে চান। পালিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে স্বর্ণলতাকে মরতে হয়েছিল পুকুরে ডুবে। মনিরুলকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল কপোতাক্ষের তীরে। তাদের সবার প্রতিনিধি হয়েই কি মেয়েটা এই সন্ধ্যেবেলায় তাঁর কাছে এসেছে? চিড়ের পায়েসটা শেষ করে জানতে চেয়েছিলেন, তাকে ভালোবাসে তো তাঁর ছেলে? থাকতে পারবে তারা দুজনে সুখী হয়ে? মেয়েটা ঘাড় নেড়েছিল। আর ইন্দুবালা সেই সন্ধ্যের প্রথম আঁচে চিড়ের পায়েস নামিয়ে অল্প একটু অগ্নিকে উৎসর্গ করে বাটি ভরে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছোটো বউয়ের দিকে। বলেছিলেন, “চিন্তা করো না। আমি বড় খোকাকে চিঠি লিখছি দিল্লিতে। সে এলে তাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাবো। কথা বলে আসবো তোমার বাবা মায়ের সাথে।” অবাক হয়েছিল মেয়েটি। এতো নির্বিবাদে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিলেন সব কিছু ইন্দুবালা? কোনো প্রশ্ন করলেন না কোথায় থাকে নন্দিতা। কী জাত? বাবা মায়ের পরিচয়। আদৌ কিছু পড়ে কিনা। দু সপ্তাহ পরে ইন্দুবালা চলে গিয়েছিলেন বড় খোকা আর খুকিকে নিয়ে নন্দিতার বাড়ি। নন্দিতা অবাক হয়ে গিয়েছিল ওই একলা একটা ভাতের হোটেল চালানো মেয়েমানুষের কথা শুনে। যে মহিলাকে না দেখেই তার বাবা মা হতচ্ছেদা করেছে। সেই মহিলাই রাজি করিয়ে নিলেন বাড়ির লোককে। শুধু তাই নয় এক সপ্তাহের মধ্যে বাবা-মা বিয়ের পাকা কথা বলার জন্যে চলে এলেন ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সেই থেকে নন্দিতা আরও অনেক কাছের হতে পারতো ইন্দুবালার। কিন্তু বিয়ের পরে কিছু দিন ছেনু মিত্তির লেনে থেকেই সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চিরকালের জন্য একা হয়ে যান। তখন তাঁরা সেই একাই একটা জগতের মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসেন। ইন্দুবালার সেই নির্জন জগৎ হলো তাঁর ভাতের হোটেল। জোর করে তাই সেখানে প্রবেশ করতে চায়নি নন্দিতা। সুদীপকেও বুঝিয়েছিল তার মতো করে।
বউয়ের কথা মতো সুদীপ ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলিয়েছিল খুকির। ভেবেছিল খুকি ঠিক রাজি করিয়ে নিতে পারবে মাকে। উলটে মা-ই কাঁদিয়ে ছাড়লো খুকিকে। কেমন যেন মেনে নিতে পারে না সুদীপ। দুই ভাইয়ের বোন অন্ত প্রাণ যে! “সব কিছুর একটা লিমিট আছে মা। খুকিকে এইভাবে না বললেও পারতে।” ভারী ফ্রেমের চশমায় ছোটো খোকাকে কেমন যেন মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অল্প বয়সের মতো লাগে ইন্দুবালার। হাব ভাব, ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলা। ঠাকুরের কৃপায় শুধু স্বভাবটা বাবার মতো না। চলে যাচ্ছিল রেগে মেগে সুদীপ। ইন্দুবালা খেয়ে যেতে বললেন। থেকে যেতেই হলো সুদীপকে। মুখের ভাতকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস তার নেই। মাকে অসম্মান করা তো নয়ই। তাছাড়া অনেক দিন সে মায়ের হাতে মাছের টক খায়নি। ছোটো ছেলে এসেছে। বলে ইন্দুবালা সেদিন জম্পেশ করে বেঁধেছিলেন মুড়ি ঘন্ট। সুদীপ বড় ভালোবাসে যে। গরম মশলার হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল সারা ঘরটা জুড়ে। আসন পেতে বাবু হয়ে বসে খেতে ভালো লাগে সুদীপের। যদিও বাত ধরতে শুরু করেছে তারও। রান্না ঘরের মেঝেতে থালার পাশে যখন বাটিগুলো সাজিয়ে দিলেন ইন্দুবালা, চোখে জল এল ছোটো খোকার। খেতে খেতে বিষম খেলে বার দুয়েক ষাট ষাট বললো তার মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বারবার মনে মনে সুদীপ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো তার মা যেন এইভাবেই রয়ে যায় চিরটা কাল। ভর দুপুরে এক পেট খেয়ে, ইন্দুবালার দোতলার ঘরে খাটের ওপর টানটান হয়ে ঘুমিয়ে সন্ধ্যের সময় যখন বাড়ি যাবে বলে নীচে নামলো সুদীপ, তখন সত্যি তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ওই সন্ধ্যেতেই ইন্দুবালার উনুনে নতুন আঁচের কয়লা পড়েছিল। তার সত্তর পেরেনো মা কতকগুলো নাতির বয়সী ছেলে মেয়ের আবদার মেটাচ্ছিল। আর সুদীপের সেই মুহূর্তে খুব হিংসে হচ্ছিল ছেলে মেয়েগুলোকে। সেও যদি তার মায়ের চারপাশে এইভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তার স্ত্রী নন্দিতা ঠিকই বলে “তোমাদের থেকেও মা ভালোবাসেন ওই হোটেলটাকে। ওর থেকে মাকে আলাদা করার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। তাহলে আর বেশি দিন রাখতে পারবে না মাকে।” ইন্দুবালা ছোটো খোকার হাতে ধরিয়ে দেন খাবারগুলো। ছোটো বউমা, নাতি নাতনিরা খাবে। রাতে ফোন করে বোনকে সুদীপ বোঝাতে পেরেছিল “মা যেমন আছে থাকতে দে। পারলে তোরা বিদেশ যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাস। সেটাই ভালো হবে”।
অনেক রাতে শুতে এসে ইন্দুবালা ভেবেছিলেন ছোটো খোকাকে বললে সে কি থেকে যেতো আজকে? কতদিন তো দুই ছেলে, মেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমোননি তিনি। তালপাতার পাখা নেড়ে নেড়ে বাতাস করেননি। বড় খোকাকে তো ডেকে নেওয়া যেত ফোন করেই। দুই ছেলেকে পাশে নিয়ে ইন্দুবালা শুয়ে আছেন। নিজের ভাবনাতেই কেমন যেন খটকা লাগে তার। যা তিনি সন্তানদের ছোট্ট বেলাতেই করেননি আজ কেন সেগুলো করতে চাইছেন? তাহলে এই কি তাঁর সত্যিকারের শেষের সময়? ছ্যাঁৎ করে ওঠে গা টা। তিনি না থাকলে এই বাড়িটার কী হবে? কী এক বিষণ্ণতা যেন ঘিরে ধরে ইন্দুবালাকে। এমন পাথর কেন হয়ে গেলেন তিনি? এই বাড়িটায় থাকতে থাকতেই এমনটা হলো কি? আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গেলেন এই বাড়িটার সাথেই? কোথাও কোনোদিন তাঁর যাওয়া হল না। সেটা কি নিজের ইচ্ছেতেই? নাকি সত্যি তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। চিলেকোঠার ছাদ থেকে বাড়ির পেছনের বাগান। হোটেলের রান্নাঘর। খাবার ঘর। রাস্তার ওপারে কাশী মুদির দোকান। বড়জোর রেল লাইনের ধারে সকালের বাজার। এইটুকু ভৌগোলিক আলোছায়ার মধ্যে ইন্দুবালা নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলেন। কেন রেখেছিলেন? তাহলে বাইরে যেতে ভয় করতো কি তাঁর? ধুর কী সব ভাবছেন। ফুরসত পেতেন না অন্য কোথাও যাওয়ার। প্রাপ্তবয়েস না হওয়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদেরও কোথাও যেতে দেননি তিনি। আগলে রেখে ছিলেন কঠিন কঠোর শাসনে। কারণ তিনি জানতেন এই মল্লিক বাড়ির রক্ত খারাপ। একটু আলগা দিয়েছো কি সবাই মাস্টার রতনলাল মল্লিক তৈরী হবে। ইন্দুবালা তাই তাঁদের কবেকার খুলনার বাড়িতে বসা দাদুর টোলটাকে ওপরের ঘরে গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এক পুব বাংলার বিধবা যখন হোটেল চালাচ্ছে তখন তাঁর বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কচি গলায় পড়ার আওয়াজ। “ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় বেগুনী রঙের শাড়ি…চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই…তেপান্তরের পার বুঝি ওই…”। বড় খোকা হেরিকেনের আলোয় পড়ছে সহজ পাঠ। ছোটো খোকা স্লেটে লিখছে অ আ ক খ। আর পুঁচকে মেয়েটা কাঁথায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে অকাতরে। জাগলেই দাদারা কেউ না কেউ তাকে দুধ খাইয়ে দেবে। আর ইন্দুবালা তখন দুটো গনগনে উনুনের সামনে। কোনোটাতে ফুটছে সোনা মুগের ডাল। কোনোটাতে বা ভাত। এটা ছিল খুব চেনা একটা ছবি। ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের অনেক দিনের খদ্দের যাঁরা তাঁদের কারও কারও মনে থাকার কথা। গরিবের একমাত্র হাতিয়ার লেখাপড়া। সেটা যদি তাঁর সন্তানরা করে উঠতে পারে তাহলে এই যে দিন রাতের পরিশ্রম করছেন ইন্দুবালা তা সার্থক হয়।
বোনকে বেশ খানিকটা বড় করে তুলেছিল দাদারাই। তাই মেয়ে মায়ের থেকেও দাদাদের ন্যাওটা বেশি। সেই ছোটো থেকেই। দাদারাও খুকি বলতে প্রাণ। তিনজনের বড় হয়ে ওঠাটা একে অন্যকে অবলম্বন করে। তার মাঝে খাড়া হয়ে বট গাছের মতো আছে যেন মা। ঝুরির সাথে বট গাছের যেমন সম্পর্ক ঠিক তেমনি ছিল ইন্দুবালার সাথে ছেলে মেয়েদের সম্পর্ক। মা আছে জানলে ওরা নিশ্চিন্ত হতো। আর ইন্দুবালা নিশ্চিন্ত হতেন ওদের সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখে। খুব যে হুজ্জতি ওরা করতে তেমনটা নয়। সেই সময়ও ওরা পেত না। ছোটো থেকেই ওরা জেনে এসেছে ওদের মা বাবা একজনই। আর তিনি হলেন ইন্দুবালা। যার আবার একটা হোটেল আছে। সেই হোটেল না চললে ওদের ভাতও জুটবে না। কেমন করে যেন ফুস মন্তরের মতো কানে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ইন্দুবালা। তাই ছোটো থেকেই ওদের চাহিদা ছিল খুব কম। মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। ওরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিল ওদের দেখে নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়তো তাঁর। নিজেও তো ভাইকে একদিকে দিদি আর একদিকে মায়ের মতো বড় করে তুলছিলেন। তবুও যেটুকু স্নেহ পরশ শীতের হিমের মতো তাঁদের গায়ে লেগে থাকতো এই বাচ্চাগুলোর কপালে তাও জোটেনি। সেই স্নেহ কোমলতা ইন্দুবালা নিজের শরীরের অন্তঃপুরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কখনও কোনো দুর্বলতার মুহূর্তেও তিনি প্রকাশ করেননি। ইন্দুবালাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি তাঁর তিন ছেলে মেয়ের কেউই। শুধু তারা দেখেছে মায়ের অমানুষিক পরিশ্রম। নিয়মের একটু এদিক ওদিক হতে দেননি তিনি। ছোটো, বড় নানা অনুশাসনে মানুষ হয়েছে প্রদীপ, সুদীপ আর ইতু। পান থেকে চুন খসার জো ছিল না। মিথ্যে কথা বলা ছিল আরও অপরাধের। কোনো দিন অবশ্য তা বলতে হয়নি তাদের। চোখের দিকে তাকাতেই মা কেমন যেন বুঝে যেত মনের কথা সব। নিয়মিত ছেলেদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন ইন্দুবালা। ঠিক মতো পড়ছে কিনা। বড় ছেলেও সামলাতে অনেকটা। কিন্তু সেও তো তখন অনেক ছোটো। শুধু স্কুলের ভরসাতেই বাচ্চাদের লেখাপড়া ছেড়ে দেননি ইন্দুবালা। বাড়িতে এক সময়ে তাঁকে পড়াতেন বাবা। তারও আগে দাদু। কিন্তু এখানে তাঁর বাচ্চাদের কে পড়াবে? ইন্দুবালার হাতে সময় নেই একটুও। তা সত্ত্বেও বর্ণপরিচয় নিজেই পড়িয়েছিলেন ছেলেদের। আর ছেলেরা পড়িয়েছিল বোনকে। স্কুলে ভর্তি করার অনেক আগেই বাড়িতে রেখেছিলেন পড়ানোর জন্য মাস্টার। খোঁজ নিয়েছিলেন ছেনু মিত্তির লেনে পুব দিকে যে স্কুলটা আছে সেটা নাকি কর্পোরেশানের স্কুল। ওখানে পড়তে টাকা পয়সা তো লাগেই না তার ওপরে আবার কোন এক সংস্থা থেকে দুপুর বেলা বাচ্চাদের ভাত খেতে দেয়। ওই স্কুলের এক অঙ্কের স্যার মাঝে মাঝেই ইন্দুবালার হোটেলে খেতে আসতেন। ইন্দুবালা তাঁর কাছ থেকে সব নিয়ম নীতি শুনে স্কুলে চলে গিয়েছিলেন নিজেই। দুই ছেলেকে সেই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। প্রথম দিকে ধনা গিয়ে দিয়ে আসতো তাদের। কয়েকদিনের পরে নিজেরাই যেতে শিখলো।
ছেলেদের হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ঘরের কাজ। রান্না-বান্না। কাপড় কাঁচা। বাসন মাজা। বড়টা অতটা গুছিয়ে করে উঠতে না পারলেও ছোটোটি শিখেছিল খুব মন দিয়ে। তার ওইসব বেশ ভালো লাগতো। বড়টা আগলে রাখতে শিখেছিল ভাই বোনকে। কখনও কখনও মাকেও। কাজ না পারা নিয়ে বড় খোকা কম মার খেয়েছে ইন্দুবালার কাছে? ধনঞ্জয়ের আবার এইসব কিছু সহ্য হতো না। “ওইটুকু ছোটো ছোটো হাতে ছাই ঘাঁটবে মা?” ইন্দুবালার জবাব ছিল, “না হলে পদ্ম হবে কী করে?” ইন্দুবালা ছেলে মেয়েদের সামনে যে কঠোর কঠিন অনুশাসন রেখেছিলেন আমাদের বাঙালি ঘরে সেটা বড় একটা দেখা যায় না। কেন এমন কঠোর হয়েছিলেন ইন্দুবালা? তাঁকে তো এমন অনুশাসনের মধ্যে বড় হতে হয়নি। একটা নয় একাধিক কারণ এর পেছনে ছিল। তিনটে নদী পেরিয়ে যেদিন তিনি কলকাতায় এসে এই মল্লিক বাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন থেকেই বুঝেছিলেন তার ভাগ্য কলাপোতায় যেমন টিমটিম করে জ্বলছিল এখানে এসে বুঝি তা নিভলো। কলকাতার বাবুরা বিকেলে গলায় পাউডার মেখে তাস পেটায়। রাতে বউ পেটায়। ভোরে সোহাগ করে। আর গোটা দিন পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে ঘুমোয়। কিংবা চিৎপুরে কোনো মনের মানুষের বাড়িতে মাছের তেল চচ্চড়ি খেয়ে গা-হাত-পা মালিশ করায়। ইন্দুবালার এই বাড়িতে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা ছিল। জীবনের নানা চড়াই উতরাই বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ইন্দুবালাকে করে দিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যদি কোনোদিন কোনো সন্তান আসে তাঁর জীবনে তাহলে এই বাড়ির কোন পূর্ব পুরুষের ছায়া তিনি তাদের ওপর পড়তে দেবেন না। বড় ছেলে যখন পেটে শাশুড়ি তখন সবে তাঁর চলৎশক্তি হারাতে বসেছেন। তাও তাঁর খানদানি মেজাজে তখনও বয়সের জং পড়েনি। নাতির মুখ যে বুড়ি দেখতে পাবেন সেই আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। কাজেই বাড়িতে পিতৃপুরুষের মুখে জল দেওয়ার লোক এসেছে শুনে তিনি আহ্লাদিত হয়েছিলেন। কিন্তু নাতিকে তেল মাখানো ছাড়া বড় বেশি সোহাগ করার সময় পাননি। ছোটো ছেলে যখন হলো শাশুড়ি বিছানা নিলেন। আর মেয়েকে দেখে যাওয়ার অবকাশ তাঁর হয়নি। যে বাড়িতে মা ষষ্ঠী বিরূপ বলে দোজবরে ছেলের আবার বিয়ে দিয়েছিলেন সেই বাড়ির উঠোন জোড়া বাচ্চাদের কলকাকলি শুনে যাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু মনে মনে এক পরম শান্তির গিঁট দিয়েছিলেন তিনি। এক গুষ্টি ঘটির মাঝে এক বাঙাল মেয়ে নিয়ে আসার দূরদর্শিতার বাহবা দিতে দিতে বুড়ি চোখ বুজেছিলেন। মাস্টার রতনলাল মল্লিক পরলোকে গিয়েছিলেন তারও কিছুদিন পরে। ইন্দুবালা নিজে হাতে মুখাগ্নি থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধ শান্তি তো করে ছিলেনই এমনকি এখনও পর্যন্ত প্রত্যেক মহালয়ায় বাড়িতে পুরোহিত ডেকে বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির স্বর্গীয় আত্মীয়স্বজনদের জলের ব্যবস্থা করেন। নিজে দিতে পারেন না বলে পুরোহিতকে দিয়ে দেওয়ান। ছেলেমেয়েদের সেই দিকে ঘেঁষতে দেন না একটুও। বড় হলেও না। এই নিয়ে তাদের অনেক প্রশ্ন ছিল। সব জবাব থেমে যেত ইন্দুবালা যখন বলতেন “আগে মরি তারপর নিজেরাই সব সামলিও”। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ছেলেরা মল্লিক বাড়ির শেকড়ের উৎস সন্ধানে নিজেরা যখন আগ বাড়িয়ে গেছে আশেপাশের আত্মীয়স্বজনের সাথে মিশতে তখন হোঁচট খেয়েছে বারে বারে। তারা বুঝতে পেরেছে মা কেন তাদের বাড়ির চারপাশের জমাট অন্ধকার থেকে এইভাবে দূরে রেখেছে। কেন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে। খুলনার কোন এক অখ্যাত অজ গাঁ কলাপোতা। বাবার থেকে তারা না-দেখা মামার বাড়ির গ্রামটাকে যেন বেশি করে চেনে। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাদের কাছে বাবা হিসেবে কাগজে কলমে পরিচয় ছাড়া আর কিছুই কোনো দিন ছিলেন না। মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার মতো শ্বশুরবাড়ির কোনো দূর সম্পর্কের বদ আত্মীয় এসে সম্পত্তি বাগাতে চেষ্টা করেছে। ছেলেদের উস্কিয়ে দিয়েছে। লোভ দেখিয়েছে। ইন্দুবালা নিজে সেই সব ফাটল মেরামতি করেছেন। এখানে এইগুলো হয়তো বিস্তারে বলা যেতে পারতো তাহলে আর পাঁচটা ঘরের কূটকচালির মতো শোনাতো ব্যাপারটা। লাউয়ের খোসা পোস্ত দিয়ে ভাজার স্বাদটা আর থাকতো না। গরম ভাতও হয়ে যেত জুরোনো। ছোটো থেকে বাচ্চারা এই ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে বেরোয়নি খুব একটা। বাবা বাছা করে আদর করেনি তাদের কেউ। মামার বাড়ি থেকে আসেনি তাদের জন্য কোনোদিন পুজোর জামা। কিংবা বাবার দিকের কোনো কুটুম পয়লা বৈশাখে পাঠায়নি মিষ্টির হাঁড়ি। অথচ তারা জানতো খুলনা বলে একটা জায়গা আছে। কলাপোতা বলে একটা গ্রাম। সেই গ্রামে একটা বড় উঠোনওয়ালা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে একটা তুলসী মঞ্চ আছে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে আছে মায়ের স্কুল। একটা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য তাদের মামা, দিদা সবাই শহীদ হয়েছে। তাদের মা আসলে শহীদ পরিবারের মেয়ে।
আদর আহ্লাদে ইন্দুবালা বড় করেননি ছেলে মেয়েদের ঠিকই তাই বলে ভাব ভালোবাসা ছিল না বললে কথকের পাপ বাড়বে। ইন্দুবালার ভালোবাসা সেই ছোট্ট থেকে ছেলে মেয়েরা বুঝে গিয়েছিল অন্যরকম ভাবে। তাদের জন্য বড় বড় বয়ামে, কাঁচের শিশিতে, অ্যালুমিনিয়ামের কৌটোয় ইন্দুবালা যত্ন করে কত কিছু যে খাবার করে রাখতেন। কোনটাতে নাড়ু, কোনটাতে মুড়ির মোয়া, চিড়ে ভাজা, কুচো নিমকি, গজা। আরও কত কী যে! আজ তা নিজেও মনে করতে পারেন না। বড় ছেলে যেবার বি এ পরীক্ষা দিল সেবার নিজে গিয়ে কালীঘাটের মায়ের কাছে পুজো দিয়ে এসেছিলেন। বলে এসেছিলেন কোনোদিন নিজের জন্য তিনি কিছু চাননি কিন্তু ওকে দাঁড়াবার জায়গাটুকু করে দিও মা। ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছিল। ইন্দুবালা জানতেন একটাকে দাঁড় করাতে পারলে বাকিগুলোও ঝপঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। বড় ছেলে প্রথম চাকরির মাইনে সবটাই মাকে মানি অর্ডারে পাঠিয়ে ছিল দিল্লি থেকে। ইন্দুবালা খুশি হয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করেননি। টাকা তো তিনি নেননি। বরং কয়েক মাসের মধ্যে ছেলের বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিলেন। বাকি দুটো কথা শোনাতে এলে ইন্দুবালা তাদের মুখের ওপর সোজাসাপটা বলে দিয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এবার নিজেদের পথ দেখতে হবে। তাঁর চারপাশে থেকে ভিড় বাড়ানো বরদাস্ত করবেন না তিনি। বড় রুক্ষ মনে হয়েছিল সেদিন কি ইন্দুবালাকে? তা তো হয়েছিলই। কিন্তু তিনি জানতেন প্রথম থেকে দূরে না সরালে আর কোনোদিনই যে ওরা নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারবে না। নিজের সংসার হবে না। মাথা গোঁজার জায়গাও।
আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল ইন্দুবালার। জীবনটা তো তারও অনেকদিন আগেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ধনঞ্জয় শাপশাপান্ত করলো। “কেমন মা তুমি? ছেলে মেয়েদের দূর করে দিলে? মরার সময় জল পাবে না দেখে নিও”। ভর সন্ধেবেলায় ধনঞ্জয়ের কথাটা বুকে বড় বেজেছিল। কিন্তু ইন্দুবালা জানতেন তাঁর দুই কূলে কেউই মরার আগে জল পায়নি। তিনিও যে পাবেন সেই আশাও করেন না। ইন্দুবালা তাই প্রতি বছর মহালয়ায় পিতৃপক্ষে কালো তিলের সাথে গঙ্গাজল উৎসর্গ করেন। কলাপাতার ডোঙায়, কুশের আংটি পরে পিতামহ থেকে শুরু করে মাতামহ, শ্বশুর বাড়ির তিনকূলের কেউই বাদ পড়ে না। এমনকি মনিরুল, সেই কবেকার একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া নিজের প্রথম প্রেমকে পর্যন্ত সারাদিন নির্জলা থেকে ইন্দুবালা জল দেন। প্রথম প্রথম লোকজনের খুব চোখ টাটিয়ে ছিল। “মেয়ে মানুষ আবার তর্পণ করবে কি গো?” আত্মীয় কুটুমরা যাঁরা তখনও সাপে নেউলের মতো পেছনে পড়েছিল, কথা শোনাতে ছাড়েনি। ইন্দুবালা কারোর কথা কিছু শোনেননি। একটা লম্বা নামের তালিকা তৈরী করে চারপাশের অসংখ্য পরিচিত অপরিচিত আত্মার মুখে কালো তিল আর গঙ্গা জল কুশের আংটি পড়ে ঢেলে গেছেন। “তোমরা যারা জল পাওনি জল খাও। ইন্দুবালাকে ক্ষমা করে দিও।” গড় হয়ে প্রণাম করে শেষে এই কথাগুলো বলতেন তিনি। কাজেই যাদের কাছে মহালয়া ছিল সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ, “জাগো তুমি জাগো…” গানের ধুয়ো। ইন্দুবালার কাছে ছিল সেটা মৃত্যুর উৎসব। অতি প্রিয়জন থেকে শুরু করে অচেনা লোকদের আবাহন করা। এক বিস্মৃত স্মৃতির পথে নিরন্তর পরিক্রমণ। মনটা ঝুপ করে খারাপ হয়ে যায় ইন্দুবালার। ধনঞ্জয় সেটা বুঝতে পারে। বিরক্ত করে না তখন সে একটুও। নিজে নিজে উনুন ধরায়। সবজি কাটে। আটা মাখে। ইন্দুবালা নীচে নামেন অনেক দেরি করে। মহালয়ায় ইন্দুবালার হোটেলের মেনু সাদা তিলের বড়া, নারকেল ডাল, কুচো মাছের চচ্চড়ি আর চালতার চাটনি। মেসের ছেলে মেয়েগুলো হাপুস হুপুস করে খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে চলে যায়। চাঁদপানা মুখগুলো আবার কয়েকদিন দেখতে পাবেন না ইন্দুবালা। সবাই বাড়ি যাবে যে পুজোর ছুটিতে। যাওয়ার আগে কেউ প্রণাম করে। কেউ আবার বা আদর করে জড়িয়ে ধরে। কেউ চুমু খায়। কেউ আবার সেলফি তোলে। দিদাকে তারা নাকি খুব মিস করবে। “ভালো থেকো তুমি। আর পুজোয় একদম ভালো ভালো রান্না করো না। তাহলে ওই ধনাদাই সব খাবে”। কত কী সব কলবল করতে করতে বেরিয়ে যায় ওরা। আরও ফাঁকা হয়ে যায় ইন্দুবালার চারপাশ।
কিচ্ছুটি মুখে না দিয়ে ইন্দুবালা ওপরের ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসেন। কাদের জন্য তার এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে? সব্বাইকে নিয়ে থাকলে আজ এই নিশুতি রাতে বাড়ি গমগম করতো। কোনো ঝগড়া নেই, ঝাঁটি নেই, মনের কোনো মালিন্য নেই। তবুও ছেলে মেয়েগুলোকে এত দূরে সরিয়ে রেখে কি পেলেন তিনি? একা বাঁচার সুখ? কার ওপর অভিমান করে একা হয়ে গেলেন তিনি? বাবা? মনিরুল? মাস্টার রতনলাল মল্লিক? নাকি অদৃষ্ট? দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। রাতগুলোতে দুচোখের পাতা এখন আর এক করতে পারেন না। ঘুম যেন তাঁর থেকে দূরে পালায়। সাত পাঁচ চিন্তা মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে কপোতাক্ষের ঘোলা জলের মতো। ঠিক এইরকম সময়ে ইন্দুবালার যেটা হয় তিনি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। কাজ করতে হয় তাঁকে। প্রচুর কাজ। মনে পড়ে যায় দশটা নারকেলের কথা। কিলোটাক ক্ষোয়া ক্ষীর। কেজি খানেক চিনি। ধনঞ্জয় মাঝরাতে শুনতে পায় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খড়খড় আওয়াজ। চোর ঢুকলো নাকি পুজোর আগে রান্নাঘরে। একটা বড় গামলা নিয়ে গেলেও তো অনেক। পা টিপে টিপে এগিয়ে দেখে দরজা হাট করে খোলা। রান্নাঘরের মেঝেতে সব কিছু সাজিয়ে নিয়ে নারকেল কুরছেন ইন্দুবালা। খিঁচিয়ে ওঠে ধনঞ্জয়। “নিজে তো শান্তি পাবেই না। আমাকেও শান্তি দেবে না তুমি?” ইন্দুবালা মুখ না তুলেই বলেন “তুই শুতে যা ধনঞ্জয়। আর যাওয়ার সময় রান্না ঘরের দোরটা দিয়ে যা”। ধনঞ্জয় যেতে চায় না। “কাল সকালে এইসব নিয়ে বসলে হতো না? এই এতো গুলো নারকেল এখন কুরবে? বাটবে?” ইন্দুবালা বলেন “আমার ঘুম আসছে না।” ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “তা আসবে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছো?” ইন্দুবালা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেন না। অনেকবার তাকে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও সে ওষুধ খাননি। তাঁর মনে হয় একবার খেলে আর যদি কোনোদিন ঘুম না ভাঙে? এই তো কয়েকদিন পরেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বেন চিরকালের জন্যে। তার আগে ওষুধ খেয়ে কী হবে? তার চেয়ে এই ভালো। সারা রাত ধরে কাজ করবেন। ধনঞ্জয়ের মেজাজ তিরিক্ষে হয়। “ওঠো তো এবার। যাও ঘরে যাও। ঘুম না আসে তো ছেলে মেয়েরা পুজোয় কত কী পাঠিয়েছে সেগুলো দেখো গিয়ে। প্যাকেট পর্যন্ত খোলার সময় হয়নি তোমার।” প্রত্যেক বছর ছেলের বউরা কত দামি দামি শাড়ি দেয়। সেগুলো পরা হয় না তেমন ইন্দুবালার। আলমারি ঠাসা হয়ে পড়ে থাকে। বড় নাতনি সুনয়নী আলমারি খুলে একবার অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত এত কাপড় তার ঠাম্মি জমিয়ে রেখে দিয়েছে? ইন্দুবালা হেসে বলেছিলেন “একটা সময় ছিল দুটো কাপড়ে সারা বছর চালিয়েছি। এখন ওগুলো দেখেও সুখ। কোথাও কি যাই যে পরবো?” সুনয়নী তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কোথাও না সিনেমা দেখতে। “যাবে ঠাম্মি? একবার চলো না। কী বিশাল বড় মল। তার মধ্যে সিনেমা হল। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো দোতলায়। মোটা গদিওয়ালা সিটে হেলান দিয়ে বসবে।” ইন্দুবালা যাননি। লছমীও তাকে বলেছিল সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে সেবার। টিকিট কেটে এনেছিল। কিন্তু কলকাতা তখন জ্বলছে। সিনেমার হলের সামনে থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল তিনটে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। বোম পড়েছিল। কারা যেন বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। একটা বড় মিছিলের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। কোন রকমে বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছিলেন ওরা। তারও অনেক পরে অলোকরা ভাত খেতে এলে বুঝেছিলেন কলকাতার পরিস্থিতি। না হলে এই ছেনু মিত্তির লেনে দিন দুনিয়ার খবর তিনি পাবেন কী করে? ধনঞ্জয় আবার ঘ্যানঘ্যান করে। “ঘুম না এলে সেলাই-ফোঁড়াই করো। সেটাও ভালো না লাগলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি গরম জল করে হট ব্যাগে ঢেলে দিচ্ছি। পিঠে নিয়ে শোও আরাম পাবে”। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে তাকান ধনঞ্জয়ের দিকে। এই সময়ে তাঁর একটুও ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না। “আমি কী করবো না করবো সব তুই বলে দিবি নাকি ধনা?” ইন্দুবালার এই চাহনি ধনঞ্জয় চেনে। মনে যা ভেবেছে তাই করবে। সে দাঁড়ায় না। রান্নাঘরের দোর এঁটে চলে যায়। নারকেল কুরতে কুরতে কোথা থেকে ইন্দুবালা যেন বাতাসে পান শিউলি ফুলের গন্ধ। চোখ বন্ধ করলে হরি বোষ্টমীর গান ভেসে আসে। “যাও গিরিরাজ আনিতে গৌরী… উমা আমার কত কেঁদেছে”। ঠাম্মার হাতে সিধে। মায়ের চোখ জলে ভরো ভরো। কপোতাক্ষের ধার ধরে কাশ ফুলের মাঠ পেরিয়ে আসছে ঢাকির দল। বাবা এনেছে নতুন শাড়ি ইন্দুর জন্য। লাল পাড়ের ওপর ডুরে কাটা। কখন সেটা পরবে ভেবেই আর ঘুম আসছে না তার। ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে অধিবাসের ঘট বসে গেছে। মহালয়াতে পুজোও হয়েছে কাঁসর ঘন্টা পিটিয়ে। তিনটে গ্রাম পেরিয়ে ঠাকুর গড়তে আসা কুমুদ পালের তখনও চোখ আঁকা হয়নি মা দুর্গার। তাঁর ছানাপোনাদের। অনেকের সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ইন্দুবালাও চণ্ডীমণ্ডপে থামের সামনে। টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। কুমুদ পাল তোরজোড় করছে কাজ শুরু করার। ঠিক সেই সময়ে কেউ একজন খোঁচা মারে ইন্দুবালাকে। সে বিরক্ত হয়। পেছন ফিরে দেখে অতসী। স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। তারই দিকে তাকিয়ে। “মুখে বল না অতসী ওমন খোঁচাচ্ছিস কেন?” অতসী ফিসফিস করে বলে, “বাড়ি চল। মেয়েদের ন্যাংটা হঠাকুর দেখতে নেই। মা বলেছে”। ইন্দুবালা বলে “তোর মা বলেছে যখন তুই যা না। আমি এখন চোখ আঁকা দেখবো। তারপর দুগগার শাড়ি পরাও”। অতসী মুখ বাঁকায়। “এইজন্যে সবাই তোকে ঢুলুনি বলে। ব্যাটাছেলেদের গায়ে পড়া। ওই দ্যাখ কে এসেছে। ডাকছে তোকে”। ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। দূরে অন্ধকারে বড় জাম গাছটার নীচে টিপ টিপ জোনাকির আলোর মধ্যেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিরুল। যদিও মনিরুল তাকে ডাকছে না একটুও। অনেক দূর থেকে সে দেখছে ঠাকুরের রঙ করা। তার সমবয়সী অনেক মুসলমান ছেলে এইসব দেখা হারাম বলে এই পথ মাড়ায় না বড় একটা। কিন্তু মনিরুলের কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগে। ওই টানা টানা চোখ দুটোতে লাল কালির কাজল পরানো। কোন মায়া যেন তাকে ডাকে। ঠিক তার ইন্দুবালার চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে যায় তখন। ভাবতে অবাক লাগে তার একটা মাটির তাল কীভাবে হয়ে ওঠে ঠিক রক্ত মাংসের মানুষের মতো। তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। ঘরের মেয়ে বলে পুজো করা হয় তাকে। হনহন করে এগিয়ে আসে ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। এত রাতের আঁধারে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার রাগটা যেন চড়াং করে মাথায় ওঠে। “এখানে কী করছিস তুই?” মনিরুল যে তৈরী ছিল না এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য। সে ভেবেছিল তাকে যদি দেখতে পায় ইন্দুবালা, তাহলে হয়তো ভালো লাগবে তার। কিন্তু যেভাবে ইন্দুবালা ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো তার সামনে ব্যাপারটা একটুও সুবিধের বলে মনে হলো না মনিরুলের। এমনিতেই হিন্দু পাড়ায় পুজোর সময়ে চণ্ডীমণ্ডপের সামনে ঘোরাঘুরি অনেকেই পছন্দ করে না। এমনকি তার ধর্মের মাতব্বর লোকজনও না। কাজেই বেশ ঝুঁকি নিয়েই আসে মনিরুল। তার ওপরে আবার ইন্দুবালার রাগ। আমতা আমতা করে বলে, “ঠাকুরের রঙ করা দেখছিলাম ইন্দু।” ইন্দুবালা আরও রেগে যায়। “তোর আবার ঠাকুরের রঙ করা দেখার কী আছে? আমি যা করবো তোকেও তাই করতে হবে মনিরুল?” রাগলে মেয়েটার নাকটা ফুলে ওঠে। মনিরুলের সেটা দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু এখন একটুও তাকাতে পারছে না সে ইন্দুবালার মুখের দিকে। সবে গোঁফ ওঠা ছেলেটা মাথা নীচু করেই বলছে “তোর খারাপ লাগবে জানলে আসতাম না”। ইন্দুবালা আরও ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে “আসবি না”। চলে যাচ্ছে মনিরুল আস্তে আস্তে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে। ইন্দুবালাও ফিরে যাচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপে। কিন্তু সে দেখতে তো পাচ্ছে না মনিরুলের চোখে তখন শরতের জলে ভরা মেঘ। দু চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। সবে ওঠা দাড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে ভালোবাসার অভিমানে। জোনাকিগুলো ফিসফিস করে বলছে “ভালোবাসিস নাকি মনিরুল তুই ইন্দুকে…?”
ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে ততক্ষণে মা দুগগার চোখ আঁকা হচ্ছে। কুমুদ পাল তার শিল্পী হাতের ছোঁওয়ায় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। কপোতাক্ষের মাটির ঠাকুরও যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে একটু একটু করে। কিন্তু এইসব তখন আর ভালো লাগছে না ইন্দুবালার দেখতে। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে তার। বাড়ি চলে যাচ্ছে ইন্দুবালা। কেন অমন করে বলতে গেল সে মনিরুলকে? কী ক্ষতি হতো মনিরুল দুগগার চোখ আঁকা দেখলে? সবাই তো দেখছিল। ওই অতসীটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ইন্দুবালাকে বলে কিনা ছেলে ঢলানি? যত রাগটা সে অতসীর দিকে নিয়ে যেতে চায় তত রাগ গড়িয়ে আসে নিজের দিকে। ঠিক করলো কী ইন্দুবালা? নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে অমন করে বললো সে? প্রত্যেক বছরই তো মনিরুল চণ্ডীমণ্ডপে আসে। ওদের সাথেই ঠাকুরের রঙ করা দেখে। এবার কেন মনিরুলকে তার অন্যরকম মনে হচ্ছে? কেন বারবার মনে হচ্ছে এইসব কিছু আসলে মনিরুলের জন্যে করছে সে। মা দুর্গার চোখ আঁকা দেখে এসে ভেবেছিল সে একটা বড় চিঠি লিখবে মনিরুলকে। এবার যদি মনিরুল সেখানেই এসে গেল তাহলে লিখবে কী করে? আর যদি লেখেও তাহলে কী থাকবে সেই চিঠিতে! এমন কিছু তো আর নেই যা দেখেনি মনিরুল! “আমি তোকে ওইভাবে বলতে চাইনি মনিরুল। আমি আসলে আমার আনন্দগুলো তোকে লুকিয়ে চিঠিতে লিখতে চেয়েছিলাম”। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা অন্ধকারে আমলকি গাছটার নীচে। এইসব কী ভাবছে সে? নিজের গোপন আনন্দগুলো লিখতে চায় মনিরুলকে? ভালোবেসে ফেললো নাকি ছেলেটাকে? অন্ধকারে পুকুর পাড়ের সেই আমলকি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেই যেন নিজের মুখ চাপা দেয় ইন্দুবালা। কী বলছে সে? এক মুসলমান ছেলের সাথে এক হিন্দু মেয়ের বিয়ে? এই গ্রামের কেউ হতে দেবে না। কোনোদিন না। ঠিক সেই সময়ে ঝোঁপ থেকে বুড়ো তক্ষকটা যেন বলে উঠছিল ঠিক ঠিক। এই নিস্তব্ধ রাত্রে পুকুরে জলের মধ্যে ঢেউ তুলে সেই কবে রিয়াজকে ভালোবাসতে গিয়ে মরে যাওয়া স্বর্ণলতা ভেসে উঠে বলেছিল “সাবধান ইন্দু… সাবধান..ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না…।” প্রচণ্ড ভয়ে সেই আঁধার রাতে ছুটেছিল ইন্দুবালা। প্রথম ভালোবাসার আবিষ্কার যেন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল গোটা পথ জুড়ে।
খিড়কির দরজা খুলে তার মনটা অবশ্য ভালো হয়ে গেল। ঠাম্মা উঠোন জুড়ে বসে নারকেল কুরছে। আর একদিকে দুধ জ্বাল দিচ্ছে কাঠের উনুনে। “কী করবে ঠাম্মা?” ঠাম্মা হাসে “দ্যাখ না কী করব”। ইন্দুবালা নাছোড়। না আমাকে বলতেই হবে কী করছো তুমি”। ঠাম্মা বলে “ওই বারকোষটা তোল তো ইন্দু”। এগিয়ে যায় ইন্দুবালা। বারকোষ তোলে। তার নীচে সাজানো ছোটো ছোটো ছাঁচ। কোনোটা ময়ূর। কোনোটা পান পাতা। কোনোটা আলপনার নক্সা। ইন্দুবালার মুখটা যেন এই অন্ধকারে আরও আলো হয়ে ওঠে। “তুমি চন্দ্রপুলি গড়বে ঠাম্মা?” সরাসরি কোনো উত্তর দেয় না ইন্দুবালার ঠাম্মা। “মা দুগগাকে দেখেছিস তো দিদিভাই? কেমন এক চালার নীচে স্বামী সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে আছে। ওই শান্তিটাই বড় জিনিস। ওটা না থাকলে জীবনে কিছুই থাকবে না”। ইন্দুবালা নড়ে চড়ে বসে। “অশান্তির কী হলো ঠাম্মা? আমি কি কিছু করেছি?” ঠাম্মা নারকেল বাটতে বাটতে বলে “না তুই কেন করবি দিদিভাই। মানুষ করে। মানুষ মানুষের নামে বদনাম রটায়। এতো রাতে সোমত্ত মেয়ে বাইরে থাকলে বাড়ির অমঙ্গল হয়। গাঁয়ের লোকে দু চার কথা বলে”। ইন্দুবালার চোখ ফেটে জল আসে। “আমি কিছু করিনি ঠাম্মা। মনিরুলকে চলে যেতে বলেছিলাম।”। মেয়ের সরলতা দেখে ঠাম্মা কী করবে বুঝতে পারে না। বাড়ির ভেতরে যাতে আওয়াজ না যায় তাই তক্ষুনি ইন্দুবালার হাতে ধরিয়ে দেয় হাতাখানা। “দুধটা আস্তে আস্তে ঘন হয়ে উঠছে দিদিভাই। যতক্ষণ না ক্ষীর হচ্ছে নাড়তে হবে। তলায় লেগে গেলেই মুশকিল। ধরা দুধের গন্ধ হলে চন্দ্রপুলি কেউ খাবে না যে”।
নারকেল কোরা হয়ে গেছে ইন্দুবালার। এই বয়সে দশটা নারকেল কোরা চাড্ডিখানি কথা নয়। ঘামছেন তিনি। এবার বাটতে হবে শিলে ফেলে পুরোটা। মিহি করে। যাতে একটু এবড়ো খেবড়ো কুচি না পড়ে মুখে। জিভে দেওয়ার সাথে সাথে যাতে গলে যায় চন্দ্রপুলি। দিনের বেলা হলে ধনঞ্জয় জোর করে মিক্সিতে বাটতে বলতো। কিন্তু ইন্দুবালা জানেন প্রাচীন এক শিলায় নারকেল বাটা আর যন্ত্রে বাটার মধ্যে অনেক তফাত থাকে। পাথরের ওই স্বাদটা কি তিনটে স্টেনলেস স্টিলের ব্লেড দিতে পারে? কখনোই না। ইন্দুবালা তাঁর শ্বশুরবাড়ির সেই কবেকার ভারি শিলখানা পাতেন। বাটতে বসেন। আর ওই দিকে তখন কবেকার যুগ এফাল ওফাল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে বড় খোকা, ছোট খোকা তার কোলে আবার খুকি। “আমরাও খাবো মা”। ইন্দুবালা বলেন “আগে হোক। তারপর খেও। এখন ঘুমিয়ে পড়ে যাও”। কিন্তু কেউ যেতে চায় না। তিনজনেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালা বুঝতে পারেন এরা এখান থেকে কেউ নড়বে না। মায়ের জেদ আর ধৈর্য দুটোই তারা পেয়েছে যে। বড় ছেলেকে উনুনে দুধটা নাড়তে দিয়ে ছোটো ছেলেকে এলাচ ছাড়াতে বলেন। মেয়েটা কোলে ঢুললেও বারবার জেগে উঠছে। ছোটোর দিকে তাকিয়ে দাদ-দা বলছে। ও বাবা বলতে শেখেনি। কারণ বাবাকে ও দেখেনি। তাছাড়া এই বাড়িতে বাবা বলে কেউ কাউকে ডাকে না। তাই ওই শব্দটা আপাতত ওর জীবন থেকে উধাও। দুধ উথলে ওঠার মতো হলে বড় খোকা ফুঁ দেয়। ইন্দুবালা বকেন। “ওইভাবে মুখের হাওয়া দিতে আছে? ঠাকুর খাবে না?” ছোটো খোকা “এলাচ ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, “তাহলে আমরা কখন খাবো মা?” মেয়েটা কোল থেকে “মা…মা..” বলে ডেকে ওঠে। ইন্দুবালা নারকেল বেটে চলেন। রাত বাড়তে থাকে। ঘন দুধ ক্ষীর হলে তার মধ্যে ওই নারকেল বাটা চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়তে থাকেন। যতক্ষণ না মণ্ডটা শক্ত হয়। ছেলে দুটো ততক্ষণ বসে থাকে। রান্নাঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঢোলে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কাদা। ছোটো ছোটো ছাঁচে পুরগুলো পোরেন ইন্দুবালা। বড় কাঁসার থালায় ভর্তি হতে থাকে ময়ূর, নক্সাকাটা নৌকা, পাঁপড়ি মেলা ফুল, জলের মধ্যে হাঁস, পদ্মপাতার আলপনা আরও কত কত কী! ঘুম থেকে তুলে দেখান দুই ছেলেকে। মেয়েটার তো তখন অত বোঝার বয়েস হয়নি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ছেলে দুটো। অবাক হয়ে। আর ইন্দুবালার ঠিক সেই মুহূর্তে কান্না পায়। ভীষণ কান্না। ফাঁকা রান্না ঘরে থালা ভরা চন্দ্রপুলি নিয়ে সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা মুখে কাপড় খুঁজে হাহাকার করেন। পাছে ধনঞ্জয় শুনতে পায়। ছেলেদের ফোন করে ডাকে। ওরা যদি জেনে যায় ওদের মা সত্যি কত ভালোবাসে। ইন্দুবালা জানতে দিতে চান না তাঁর এই ভালোবাসা কাউকে। যাঁদেরই ভালোবাসতে গেছেন তারাই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। এটা যে অভিশাপ তাঁর জীবনে। উনি এই বয়সে সন্তান শোক পেতে চান না।
ঠাম্মা তাকিয়ে থাকে ফর্সা হয়ে আসা আকাশের দিকে। কাঠের উনুন প্রায় নিভে গেছে। উঠোনখানা ভর্তি হয়ে আছে হাতে গড়া ঠাম্মার চন্দ্রপুলিতে। “মেয়ে মানুষের এত কান্না কিসের? বুকে পাথর না বসাতে পারলে মেয়ে মানুষ হয়েছিস কী জন্য তুই? যা সাজি ভরে শিউলি ফুল তুলে নিয়ে আয়তো দিদিভাই। বোধনের পুজোতে লাগবে। সঙ্গে কয়েকটা চন্দ্রপুলি নিয়ে যা। যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস। জীবনে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই রে”। ইন্দুবালা শাড়ির আঁচলে বাঁধে চন্দ্রপুলি। সাজি নিয়ে সারা রাত না ঘুমোনো চোখে কন্যে চলে ফুল তুলতে। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছে সে? এ তো ভটচাজ পাড়া নয়। বিশালক্ষ্মী তলা পেরিয়ে সে যাচ্ছে মোক্তার পাড়ায়। কেন যাচ্ছে সে? অনেক ভোরে মোক্তার পাড়ার মাঠে শিউলি গাছটার নীচে কারা যেন সাদা চাদর মেলে বসে থাকে। সেই চাদরের টুকরোগুলো কুড়িয়ে সাজিতে ভরতে ভালো লাগে ইন্দুবালার। শরতের এই ভোরেও কেমন যেন হেমন্তের হাওয়া দিচ্ছে। শিরশির করছে গা। চারিদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা শিউলি গাছটার সামনে এসে। কে ওখানে দাঁড়িয়ে? কে? এগিয়ে আসে মনিরুল। “এতো ভোরে এখানে কী করছিস?” কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিল মনিরুল। যদিও সে জানতো এই গাছেরই ফুল কুড়োতে আসবে ইন্দুবালা। তাকে আসতেই হবে। সারা রাত তো ঘোরের মধ্যে এঁকেছে ইন্দুবালার চোখ। কাজল দিয়ে। টানা টানা। ইন্দুবালা ডাকে “মনিরুল…”। দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটা। এগিয়ে আসে ইন্দুবালা। মনিরুল বিড়বিড় করে। কোনো এক শরৎ সকালে জীবনের প্রথম ভালোবাসার জন্য মিথ্যে কথা বলে “আমি জানতাম না তুই এখানে আসবি…। আমি তো…।” ইন্দুবালা হাত দিয়ে চাপা দেয় মনিরুলের ঠোঁট। যেন ছ্যাঁকা লাগে মনিরুলের। এতো তাপ কীসের? ইন্দুবালার হাত কাঁপছে। সে তাকিয়ে আছে মনিরুলের দিকেই। “আমাদের ঠাকুর ঘরে নবদ্বীপ থেকে আনা অনেক পুরোনো একটা কেষ্ট ঠাকুর আছে। ঠাম্মার শাশুড়ি তার শাশুড়ির ঠাকুর সেটা। তুই তার মতো চোখ কেন পেলি রে মনিরুল? সারাক্ষণ আমার চোখে ভাসে।” আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়েছিল ঠোঁটের ওপর থেকে হাতটা। বাড়ি ফিরে কতবার সেই হাত নিজের ঠোঁটের উপর রেখেছিল ইন্দুবালা। তার আগে শাড়ির খুঁট খুলে মনিরুলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সারা রাত ধরে তার আর ঠাম্মায় মিলে করা চন্দ্রপুলি। “ঠাম্মা বলেছে যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস”। আর একটাও কথা না বলে, একটাও শিউলি ফুল না কুড়িয়ে খালি সাজি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল মেয়ে। সেবার ইন্দুবালা বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিল পুজোটা। ধুম জ্বরে দশমীর সকালে দেখেছিল তার জানলার কাছে রাখা আছে এক মুঠো শিউলি ফুল। ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিল, “মা দুগগা বললো যাকে ভালো লাগে তাকে দিও”। সেদিন মনিরুলের হাতের লেখা চিনতে একটুও দেরি হয়নি ইন্দুবালার। দুজনের ভালো লাগা কোনো এক শরতের সকালে চন্দ্রপুলি আর শিউলি ফুলে মিলে গিয়েছিল। তারও অনেক দিন পরে কোনো এক শরতের মন কেমন করা দিনে কপোতাক্ষের পলি কাদা মেখে পড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা মনিরুলের দেহ। সে বছর সেই গ্রামে কোনো দুর্গাপুজো হয়েছিল কিনা জানেন না ইন্দুবালা। সেই বছর তো যুদ্ধ। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন সবার চোখে। সেই চোখগুলো খুঁজে খুঁজে গঙ্গা জলে কালো তিল দিয়ে তর্পণ করেন ইন্দুবালা। পুজোতে তাই মন ভালো থাকে না তাঁর। পুজো কাটে বিষণ্ণতায়।
সকালে উঠে ধনঞ্জয় দেখে কাঁচের বয়ামে ভর্তি করে রাখা আছে চন্দ্রপুলি। ইন্দুবালা তখন কুচো গজা ভাজছেন। ঠিক করে রেখেছেন ওবেলায় লবঙ্গ লতিকা করবেন। ধনঞ্জয় বুঝতে পারে না এটা কি ইন্দুবালার পাগলামো না জেদ? “সারা রাত এইসব করে তুমি তো মরবেই। তোমার ছেলেরা আমাকে জেলে দেবে।” ইন্দুবালা কুচো গজা ছাঁকনি দিয়ে তুলে চিনির রসে ভিজিয়ে দিয়ে বলেন, “আহা ধনা তুই ওইভাবে বলিস না। ছেলে-মেয়েগুলো বিজয়ার পরে এসে একটু মিষ্টি মুখ করবে না? ওই যে চাঁদা তুলতে এসেছিল নন্টু পিন্টু। বাজারের লোকগুলো। কালেক্টার অফিসের বাবুরা। এদের একটু দেবো না হাতে তুলে?” হোটেল যবে থেকে শুরু হয়েছিল সেই বছর পুজো থেকেই বিজয়ার মিষ্টি শুরু করেছিলেন ইন্দুবালা। সেই সময়ে লছমী থাকতো। হাতে হাতে কাজগুলো করে দিত মাঝে মাঝে। দুই ছেলে, মেয়েও সাহায্য করতো অল্প স্বল্প। একটু বড় হলে তারা ঠাকুর দেখার নাম করে কেটে পড়তো যে যার মতো। শুধু ইন্দুবালা থেকে যেতেন একা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী কেটে যেত তাঁর রান্নাঘরে বিজয়ার মিষ্টি তৈরীতে। তাঁর না ছিল নতুন কাপড় পরা। না ছিল প্যাণ্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়া। সেসব তিনি বিয়ের আগে কলাপোতার কপোতাক্ষে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন অনেক দিন আগেই।
দশমীর সন্ধ্যেতে বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে এক এক করে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। বড় খোকা আসে। ছোটো খোকা। তাদের বউরা। নাতি-নাতনি সবাই। প্রণাম করে। একতলা থেকে দোতলা সবাই হইচই করে দাপিয়ে বেড়ায়। মায়ের হাতে তৈরী চন্দ্রপুলি, কুচোগজা, লবঙ্গ লতিকা, নিমকি সবাই পেট পুরে খায়। ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যায়। ওরা সবাই গল্প করে। ওদের মাঝে বসেই ইন্দুবালা চুপ করে শোনেন সেই গল্প। কোথায় কোন ঠাকুর কত বড় হলো। কে প্রাইজ পেলো। তাঁতের সবচেয়ে দামি শাড়িটা পরতে গিয়ে বড় বউয়ের কী হলো? নাতি নাতনিরা কীভাবে পুজো কাটালো। কোথায় কত লোক হলো। অঞ্জলি দিতে গিয়ে পুরোহিত কেমন বাজে করে মন্ত্র পড়ছিল। ছোটো বউরা কোন রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে গিয়ে একেবারে মুখে তুলতে পারেনি এইসব। তার মধ্যে খুকি ব্যাঙ্গালোর থেকে ভিডিও কল করলে ওদের নিজেদের মধ্যে গল্প আরও বাড়ে। সবাই সবার সাথে কথা বলে। কিন্তু ওদের সবার মধ্যে বসে থেকেও ইন্দুবালার কিছু গল্প করার থাকে না। ছেলেরাও একবারের জন্যেও জানতে চায় না তাদের মা কোথাও গিয়েছিল কিনা। অঞ্জলি দিয়েছে কিনা। তারা জানে তাদের মায়ের ধর্ম কর্ম সব ওই একটিই। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। ঠাকুরের আপ্ত বাক্য যা সারা জীবন ধরে মেনে চলেছেন, “জীবে প্রেম’। আর কে না জানে খাওয়া ছাড়া প্রেম সম্পূর্ণ হয় না? তাই ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ নামের এক নির্জন দ্বীপে ইন্দুবালা সেই ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে রাখেন। সবাই আসে তাদের ভালোবাসা ভাগ করে নেয়। কিন্তু ইন্দুবালার কিছু ভাগ করার থাকে না। তিনি শুধু অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে। যারা বুঝতে পারে তারা একটু বেশি আনন্দ পায়। আর যারা খাবারের সাথে মজে থাকে তারা শুধু রসনায় মজা পায়। ভেতরের মানুষটার নয়।
অনেক রাতে শুতে এসে প্রতি বছরের মতো এই বছরেও ইন্দুবালা তার হিসেবের খাতা টেনে নেন। একটা সাদা পাতায় লাল কালিতে লেখেন ‘শুভ বিজয়া। সেটা যে কাকে লেখেন, কেন লেখেন আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।
আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি একটা ঘোরের মধ্যে ।
সবাইকে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ।।
সত্যি আচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছেন লেখক। এক কথায় অসাধারণ।