৩. ছ্যাঁচড়া
কোনো এক আষাঢ়ের সকালে জন্ম হয়েছিল ইন্দুবালার। মায়ের মুখে শুনেছিলেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি বেয়ে বৃষ্টির জল ঢুকেছিল আঁতুড় ঘরে। জল থইথই মেঝেতে সদ্য জন্মানো শিশুটি সাঁতার কাটছিল যেন। ঠাম্মা কোলে তুলে নিতেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “এমন চাঁদপানা মুখ তুই পেলি কোত্থেকে এই বংশে”? সোহাগ করে নাতনির নাম রাখলেন ইন্দুবালা। তারও বছর পাঁচেক পরে মাঘের কুয়াশা ভরা ধান ক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে বাবার হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। শুধু এইটুকু মনে আছে ফুল ফুল ছাপ একটা ফ্রক পরেছিলেন। গায়ে ছিল মায়ের বোনা সোয়েটার। মাথায় উলের টুপি। ঠাম্মার কাছে শোনা রূপকথার রানী বলে মনে হচ্ছিল সেদিন নিজেকে। ঠাকুরদার টোলটা তখনও চলছে টিম টিম করে। সেই টোলে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত এইসব টুকটাক শিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন সেখানে পড়া হলো না। আমের গাছে মুকুল ভরিয়ে, সরস্বতী পুজোয় হাতেখড়ি দিয়ে দাদুর বড্ড তাড়াতাড়ি ছিল হয়তো এক্কেবারে চলে যাওয়ার। শিশিরে ভিজেছিল টোলের রাস্তাটা। সেদিন কেউ আর দাওয়া ঝাঁট দেয়নি। উঠোন লেপেনি। পাশের মুকুল ভর্তি বুড়ো আমগাছটা কাটা হয়েছিল দাদুর সৎকারের জন্য। ঠিক এর পরেই দুটো গাঁ পেরিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। পড়াশুনোয় তাঁর বেজায় মন ছিল। দাদু সেই ছোট্টবেলাতেই তাঁকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইয়া বড় বাড়ি। সামনে কত কত গাড়ি। বেণী দুলিয়ে, শাড়ি পরে ইন্দুবালা কলেজ করছে। এমন একটা ঝাপসা ছবি যেন আলপনার মতো আঁকা থাকতো মনে। ওইটুকুনি মেয়ে এত সব কিছু যে বুঝতো তেমনটা ঠিক না। শুধু অনেক দূরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতো। এক্কা-দোক্কা, লুকোচুরি, খেলনা বাটির বয়েস পার করে ইন্দুবালা প্রবেশ করলেন এবার হাইস্কুলে। সেখান মেয়ে বলতে হাতে গোনা ওই কজন। মাঝের পাড়া, পুবের গাঁ আর কলাপোতা মিলিয়ে মেয়ের সংখ্যা তেমন একটা ছিল না। থাকবেই বা কী করে? সবাইকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিতো না বাড়ির লোকজন। ছেলের পালের মধ্যে মেয়ে বসবে শুনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো অনেকের। ইন্দুবালার মা’র পছন্দ ছিল না স্কুলটা। কোনোদিনই। বাড়িতেই তো পড়াশুনা করা যায়। অনেক বার সে কথা বলেছেন স্বামীকে। কিন্তু যার বাবার টোল ছিল, যে নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কালে পড়াশোনা করেছে; কিন্তু ভাগ্যের ফেরে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এসে সংসারে হাত লাগিয়েছে, সে তার মেয়েকে পড়াবে না তা হতে পারে। তাই লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়াটা চলছিল ইন্দুবালার দিনের অন্যান্য কাজের মতোই। সেটাও অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মায়ের খানিকটা চিল চিৎকারেই হোক, আর চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যাওয়ার কারণেই হোক কোনো এক সূত্র ধরে বাবা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বনগ্রামের এক বন্ধুকে। কন্যার বিবাহ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করিতে চাই। ভালো পাত্ৰ থাকিলে জানাইও’। সেখান থেকে উত্তর পেতে দেরি হয়নি। ছেলে একেবারে ‘মাস্টার। নিজেদের দোতলা বাড়ি। বনেদী বংশ। বন্ধুর বিশেষ পরিচিত। শুধু একটু খুঁত আছে। “খুঁত?” ঠাম্মা সেদিন বাড়িতে তালের ভাপা পিঠে করেছিলেন। গ্রামে অষ্ট প্রহরের জন্য বাড়িতে ছিল নিরামিষ রান্না। হাঁড়িতে সেদিন বসেছিল আতপ চালের খিচুড়ি। আলুগুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। বাগান থেকে ইন্দুবালা তুলে এনেছিলেন অসময়ের কাঁচা টমেটো। নামানোর আগে ঠাম্মা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন হরিমতির দুধে তোলা বাড়ির ঘি। কলাপাতায় ঘিয়ের গন্ধ ওঠা খিচুড়ি খেতে বসে ‘দোজবরে’ শব্দটা জীবনে প্রথম শুনেছিলেন ইন্দুবালা। ছাদনা তলায় ছেলেকে দেখে ডাকাত মনে হয়েছিল তাঁর। ইয়া গোঁফ, বাবরি চুল। চোখ লাল টকটকে। দাঁতগুলো খয়েরের ছোপে মলিন। নিশ্বাসে দুর্গন্ধ। ছেলে বরণ করে এসে এই প্রথম মা বাবার হাত ধরে জানতে চেয়েছিলেন “সব খবর নিয়ে দিচ্ছো তো মেয়েকে? গা দিয়ে যে গন্ধ বেরোয়। সবাই ফিসফিসাচ্ছে। বলছে মাতাল বর”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসর ঘরে কড়ি খেলা শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই বউয়ের পাশে দোজবরে স্বামী ঘুমে ঢলে পড়লে ইন্দুবালা ভালো করে তাকিয়েছিলেন লোকটার মুখের দিকে। হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিক। নাক ডাকার চোটে বাইরে এসে বসেছিলেন ইন্দুবালা। চারিদিকের অন্ধকারে সেই শেষবারের মতো জোনাকিগুলো যখন আলো জ্বালিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরলো তখন নিজেকে আর সামলাতে পারেননি তিনি। ভেঙে পড়েছিলেন। একটা মেয়ে তার যাবতীয় শেষ স্বপ্নটুকু নিয়ে কাঁদছে। তার সাক্ষী কোনো কাছের মানুষ ছিল না সেদিন। কোনোদিনই অবশ্য থাকেনি ইন্দুবালার পাশে কেউ। কিন্তু জামগাছটা ছিল। তুলসীতলা ছিল। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠে আমগাছটা যেন ডালপালা নেড়ে বলেছিল “কাঁদিস না ইন্দুবালা। একটুও কাঁদিস না। এটা তোর নিয়তি”। এরপর ইন্দুবালার আর কোনোদিন বসা হবে না নিজের বাড়ির এই দাওয়ায়। ফেরা হবে না জন্মভূমিতে। কলাপোতা গ্রামটা সশরীরে মুছে যাবে তার ভৌগোলিক স্থাবর অস্থাবর সব কিছু নিয়ে। ইন্দুবালার শুধু মনে রয়ে যাবে এক অলৌকিক অনুভূতি। দেশ নামের স্পর্শ না করা এক স্বপ্নকে।
মেয়ের হাত থেকে কনকাঞ্জলি নিয়ে মা আর ফিরে তাকাননি। নিয়মও ছিল না। এক রাতের মধ্যেই তিনি বুঝেছিলেন কার হাতে মেয়েকে তুলে দিলেন শেষ পর্যন্ত। নিজের স্বামীকে বেশি কিছু বলতে পারনেনি। এমনকি দায় চাপাতেও না। কারণ তিনি জানতেন তাঁর মেয়ে দিন-দিন একটা আগুনের গোলা তৈরী হচ্ছে। ওই রূপ এই পাড়া গাঁয়ে, খাল বিল পুকুরের পাশে, শাপলা গন্ধরাজের মতো যত ফুটে বেরোবে, তত বাড়ির বিপত্তি বাড়বে। এমনিতেই রাত বিরেতে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। এগিয়ে গিয়ে দেখেন দরজার হুড়কো ভালো করে দেওয়া আছে কিনা। বাড়িতে আগুন রাখলে তার সাথে যে পর্যাপ্ত জলও রাখতে হয় সেটা মনে করেই হাত পা সিঁধিয়ে যেত তাঁর। পাশের গ্রাম থেকে মনিরুল মাঝে মাঝেই আসতো ইন্দুবালার কাছে পড়া দেখতে। সমবয়সী তারা। এক্কেবারে পছন্দ হতো না মায়ের। ইন্দুবালা সেটা বুঝতেন। কিন্তু মনিরুলকে খুব মিষ্টি লাগতো তাঁর। গুটি আমে সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, চিনি মাখিয়ে খেলে যেমন মনিরুল ঠিক তেমন। লজ্জায় মুখে লাল হয়ে যায় ইন্দুবালার। এইসব কী ভাবছেন তিনি? তড়িঘড়ি বাইরের দাওয়ায় আসন পেতে, কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে বসতে দিতেন মনিরুলকে। এই বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ির বাধ বিচার তেমন না থাকলেও মনিরুলের জায়গা কোনোদিন বাড়ির অন্দরে হয়নি। হতোও না কোনো কালে। যদিও ধর্ম-জাত এইসব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতেন না দাদু। কিন্তু বাবা মা ছিলেন উলটো পথের পথিক। ছুত্সর্গের বাছ বিচার যে কত দূর যেতে পারে তা ইন্দুবালা দেখেছিলেন কলকাতায় এসে। শাশুড়ির সংসারে। তার জীবন থেকে সবাই চলে যাবার পর ইন্দুবালা এই সব এঁটো কাটা পরিষ্কার করেছিলেন দু হাত দিয়ে। তাঁর কাছে মানুষ মানে ছিল জীব। তিনি পেট ভরে খাইয়ে জীবে প্রেম করতেন।
মনিরুলের তখন সদ্য গোঁফ উঠেছে। কেষ্ট ঠাকুরের মতো বাঁশি বাজায়। চোখ গোল গোল করে বাতাবি লেবু গাছের তলায় চন্দ্রবোড়ার বাসার গল্প করে। নৌকায় দাঁড় বেয়ে নিয়ে যায় পাশের গ্রামে। শুধু তাই নয় সুর করে মাঝে মাঝে কবিতাও বলে …
“আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি।
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি
কোন সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি!”
‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এ সাজু আর রুপাইয়ের করুণ পরিণতি বারবার যেন শুনতে চান ইন্দুবালা মনিরুলের কণ্ঠে। জসীমউদ্দিন যে তাঁর বড় ভালোলাগা কবি। বাবার কাছে কত গল্প শুনেছেন। একবার যখন ইন্দুবালা খুব ছোটো, এই গ্রামে এসেছিলেন নাকি কবি। তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে চিড়েভাজা খেয়েছিলেন। ঠাম্মা দিয়েছিল কোঁচড় ভরা নাড়। আমসত্ত্ব। তাল পাটালি। মনিরুলের এইসব গল্প শুনতে ভালো লাগে। আর ইন্দুবালার ভালো লাগতো মনিরুলের গলায়, ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ শুনতে। চোখ ভিজে আসে সাজু আর রূপাইয়ের দুঃখে। ঝি ঝি ডেকে ওঠে। ঠাম্মা চুপ করে সলতে পাকান। ভাই কবিতা শুনতে শুনতে হাঁ করে বসে থাকে সবে সন্ধ্যে নামা কলাপোতার মাটির বাড়ির দাওয়ায়। দূরে আজানের শব্দ ভেসে আসে পাশের বাড়ির সন্ধ্যের শাঁখে। চেয়ে থাকেন ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। কবেকার মনিরুল তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সহজ সরল টানাটানা চোখে তাকায়। আর এদিকের সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা যেন একটুও নড়তে পারেন না বিছানা থেকে। চুপ করে শুয়ে থাকেন। উনি জানেন এই ঘোরটুকু নিয়েই এখনও বেঁচে আছেন। যেদিন এই ঘোর কেটে যাবে, সেদিন তিনিও চিরকালের মতো ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে কোথায় কোন দূরের পথে পা বাড়াবেন।
ধনঞ্জয় নীচ থেকে ডাকছে। তাকে বাজারের টাকা দিতে হবে। ফর্দ করতে হবে। কিন্তু আজ তাঁর যেন কিছুই শুনতে ইচ্ছে করছে না। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। বর্ষার বেলা গড়াচ্ছে, তিনি চুপটি করে শুয়ে আছেন। কারণ ওদিকে মা গ্রামের সেই সন্ধ্যে হয়ে আসা ভালোবাসার পরিবেশে শুধু শুধু তাড়া লাগাচ্ছে। মা বুঝতে পারছেন লক্ষণ ভালো না। আগুনের গোলা হয়ে উঠছে মেয়ে। সবার চোখ তার দিকে। এমনকি এই একরত্তি ছেলেটারও। শেষকালে কিনা মেয়ে বিধর্মী হবে? বাড়ি থেকে পালাবে? কিংবা পাশের গ্রামের স্বর্ণলতার মতো দেহটা ভেসে উঠবে পুকুরে? ছেলেটাকেও তো ছাড়েনি বাড়ির লোকেরা। ধান ক্ষেতে কুপিয়ে রেখে দিয়েছিল। ভাবতে পারেন না আর। একটা ছোট্ট ভুলের জন্য বেঘোরে যাবে দুটো প্রাণ। ছোট্ট ভুল? হ্যাঁ তাই তো। কবে আর কার জীবনে ভালোবাসা অনেক বড় হয়ে এলো? আর যদি আসতোই তাহলে চারপাশটা পালটে যেত না খুব তাড়াতাড়ি? মুখ দিয়ে বেরিয়েই যায় “এবার তুই উঠে পড় মনিরুল। অনেকটা পথ যাবি। তোর মায়েরও তো চিন্তা হয় তাই না?” কথাগুলো বলতে পেরে যেন শান্তি পান ইন্দুবালার মা। মনিরুল গুছিয়ে নেয় তার বই। ব্যাগ। হাতের বাঁশি। লণ্ঠন নিয়ে উঠোনটা পার করে দিয়ে আসেন ইন্দুবালা। দাঁড়িয়ে থাকেন বেড়ার দরজায়। যতক্ষণ না মনিরুল সামনের আলটা পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন কি মনিরুলকে ইন্দুবালা? বেসেছিলেনই তো। না হলে কে লুকিয়ে লুকিয়ে মনিরুলের জন্য নাড় নিয়ে যেত? মুড়ির মোয়া। কুলের আচার। গপ গপ করে ছেলেটা খেত। আর এক টানা গল্প করে যেতো। কত যে গল্প ছিল মনিরুলের ওই ছেঁড়া কাপড়ের ব্যাগে ঠাহর করতে পারতেন না ইন্দুবালা। তাহলে কেন কোনোদিন মনিরুলকে নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলতে পারেননি? ভয় করেছিল তাঁর? নাকি বড় অভিমান করেছিলেন। মনিরুলের ওপরে? মা আসতে বারণ করেছিল মনিরুলকে। তাই বলে সে আর এই পথই মাড়াবে না? স্কুলেও কথা বলবে না? লুকিয়ে লুকিয়ে থাকবে সব সময়? চোখ ফেটে জল আসতো ইন্দুবালার। টিফিন কৌটোতে পড়ে থাকতো আমলকি, নলেন গুড়ে পাকানো রুটি। তারা যে এক সাথে বসে দুজনে খেত। সে কথা কি মনিরুল ভুলে গেছে? খিদে পায় না বুঝি ইন্দুবালার? একদিন স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিল মনিরুল। কারা যেন রটিয়ে দিল কলাপোতার ইন্দুবালার সাথে সাতদিঘি গ্রামের মনিরুলের প্রেম হয়েছে। চিঠিও নাকি পেয়েছে তারা। বাড়িতে বন্দি হলেন ইন্দুবালা। আলের ধারের জানলার কাছে চুপ করে বসে থাকতেন। সন্ধ্যের শাঁখ বাজতো। আজান তার ঠিক সময় মতোই হতো। কিন্তু মনিরুলকে আর আলোর পথে দেখা যেত না। এতটাও কেন ভালোবাসতো মনিরুল ইন্দুবালাকে? যে ভালোবাসার দাম দিতে গিয়ে হারিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে।
বিয়ের অনেকদিন পরে শাশুড়ি যখন আর নেই। স্বামীর বাইরে থাকা এবং নেশার মাত্রা পাল্লা দিয়ে যখন আরও বেড়েছে। সংসারের হাল হয়েছে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর মতো। ইন্দুবালা হিমশিম খাচ্ছেন ছোট্ট দুটো ছেলে আর কোলের মেয়েকে নিয়ে, তখন একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন তাঁর সঙ্গে। সন্ধ্যের আলোতে জীবনের প্রথম প্রেমকে চিনতে একটুও দেরি হয়নি তাঁর। মনিরুলকে আরও সুন্দর লেগেছিল সেদিন। চশমা পরে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে সে। হাতে ছিল একটা চিরকুট। সেখানে পেন্সিলে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল ছেনু মিত্তির লেনের ঠিকানা। এত গল্প করা ছেলেটা এত শান্ত হয়ে যায় কী করে? বাড়ির ভেতরে এনে বসিয়েছিলেন মনিরুলকে। রান্নাঘরে ঢুকে আতিপাতি খুঁজছিলেন কী দিতে পারেন খেতে। অসহায় লাগছিল তাঁকে। বড়। কৌটোর তলানিতে পড়েছিল একটু চিড়ে সেইটুকুই ভাজলেন। সঙ্গে দিলেন চা। মনিরুলেরও বসার সময় ছিল না সেদিন। আত্মগোপন করে আছে যে সে কলকাতায়। পাকিস্তানের ঝানু গুপ্তচর ঘুরছে তাদের পেছনে। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছে সে ইণ্ডিয়ায়। বালিগঞ্জের কোথাও ওরা একটা রেডিও স্টেশন খোলার চেষ্টা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার। ইণ্ডিয়া সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করছে। “একটা স্বাধীন দেশ পেতে চলেছি ইন্দু.. আর কোনো ভাবনা নেই…।” চোখ মুখ যেন জ্বলজ্বল করছে মনিরুলের। ইন্দুবালারও কি ইচ্ছে হচ্ছে না? আজ ওর হাত ধরে যদি সে সত্যিই বেরিয়ে যেতে পারতো। দেশের কাজে। কী ভালোই না হতো! কিন্তু যে চক্রব্যুহের মধ্যে তিনি তখন আটকে পড়েছেন সেখান থেকে বেরোবেন কী করে? একদিকে মাতাল নেশাতুর স্বামী। অন্যদিকে ছোটো ছোটো তিন ছেলে মেয়ে। ইন্দুবালার জগৎ তখন অন্য। মল্লিক বাড়ির বউ তিনি। চলে যাবার আগে ইন্দুবালার হাতে মনিরুল দিয়ে গিয়েছিল ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বইটা। তার প্রথম পাতায় সই করে লেখা ছিল “ইন্দুকে..জসীমউদ্দিন”। চোখে জল ভরে এসেছিল ইন্দুবালার। এমন উপহার আজ পর্যন্ত কেউ তাকে দেয়নি। মনিরুল বলেছিল কবির সাথে দেখা হওয়ার বিস্তারিত গল্প। বলেছিল ইন্দুবালার বাড়ির কথা। তাদের ছোট্ট গ্রাম কলাপোতার কথা। তাল পাটালি আর তিলের নাড়র কথা। কবির চোখে যেন জল দেখেছিল মনিরুল। সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিয়েছিলেন তিনি। এখনও মনে আছে তাহলে সব কিছু মনিরুলের? ভোলেনি সে কিছুই? না, মনিরুল ভুলে যায়নি। মনিরুল ভুলতে পারে না। বিয়েও করেনি সে। করতে পারতো না মণিরুল। রূপাই কি বিয়ে করেছিল আর? কবরে মাথা রেখে মরেছিল সে। মনিরুল মরবে দেশের জন্য। স্বাধীনতার জন্য। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার জন্য। এটা তার ভালোবাসার দিব্যি। এত কথা সেদিন মনিরুল ইন্দুবালাকে বলে আসতে পারেনি। বলে আসা যায় না। কিছুটা সঙ্গোপনে বয়ে বেড়াতে হয়। আর কিছুটা হারিয়ে যায়। মনিরুল সেটা জানতো। এরপর থেকে ইন্দুবালা পাগলের মতো খুঁজে চলতেন স্বাধীন বাংলার রেডিও স্টেশন। পেয়েও যেতেন মাঝে মাঝে। বাঁশির সুরে চিনতে পারতেন মনিরুলকে। হঠাৎই মনে পড়ে যেত কপোতাক্ষের ঘাট। সন্ধ্যেতে বাড়ির দাওয়া। স্কুলের মাঠ। বিশালাক্ষী তলা। মনিরুলকে ভোলা যায় না। মনিরুলকে ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। কিন্তু সেই মনিরুলও সত্যি সত্যি হারিয়ে গিয়েছিল একদিন চিরকালের মতো। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল ইন্দুবালার সাথে। সে তো আরও একটা ভুবন কাঁপানো গল্প। সেদিকে এখন প্রবেশ করলে ইন্দুবালার প্রথম জীবন অধরা থেকে যাবে। সংসারটা আর যে আর ঠিক করে করা হয়ে উঠবে না।
সেই যে এক ভরা বর্ষায় বিয়ে হয়ে ছেনু মিত্তির লেনের স্যাঁতসেঁতে বাড়িটায় ঢুকলেন তারপর তো আর কোথাও যাওয়া হয়নি তাঁর। একটিবারের জন্যেও না। বাপের বাড়ি যাওয়া কঠিন ছিল। খরচ ছিল, ভিসার ব্যাপার ছিল। এক এক করে সব গয়না বিক্রি করে সংসার চালাতে গিয়ে নিজের দেহকে অলঙ্কারহীন করে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা। মায়ের সামনে দাঁড়ালে তক্ষুনি বুঝে যাবে যে। তাই বিয়ের পর একমাত্র গঙ্গাস্নান ছাড়া আর কোথাও যাননি ইন্দুবালা। সেই যে এসে মল্লিক বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন আজও আছেন। কিন্তু তার জন্য কোনো খেদ নেই তাঁর মনে। বিয়ের পরে নতুন বউকে স্বামীর বাড়িতে এসে প্রথম দিনই দেখতে হয় রান্নাঘর ভরা আছে তোলা তোলা খাবারে। ডেকচি ভরা ডাল। কড়া ভরা মাছ। হাঁড়ি ভরা ভাত। দই, মিষ্টি। পেতলের পাত্র থেকে উথলে ওঠা দুধ। চারিদিকে ভরা ভরা সব কিছু। ভরা দেখলে তবেই না গেরস্থের সংসার সব ভরে উঠবে। কোলে-কাঁখে মা ষষ্ঠী কৃপা করবেন বছরের পর বছর। “শ্বশুরবাড়িতে প্রথমে রান্নাঘরে গিয়েই যেন হ্যাংলার মতো চোখ বড় বড় করে সব কিছু দেখো না।” পাখি পড়ানোর মতো শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা। “যা লোভী মেয়ে একটা। হয়তো দেখা গেল রান্নাঘরে ঢুকেই শুক্তোর পাত্র নিয়ে বসে গেল। পাঁচ ভাজা থেকে নারকেলগুলো তুলে তুলে খেতে শুরু করলো। আনারসের চাটনি আর কারোর জন্যে একটুও রইলো না। তখন কি বেইজ্জতিটাই না হতে হবে কুটুম বাড়িতে।” ছোটো ভাই পাশ থেকে বলে “আর রসগোল্লা মা? কলকাতার বড় বড় মিষ্টি। সেগুলো দিদিভাই খাবে না? কিরে খাবি না?” বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা। বয়ে গেছে তাঁর একটা অপরিচিত বাড়িতে গিয়ে শুক্তোর হাঁড়ি নিয়ে বসতে। নারকেল ভাজা খেতে। কত যে আনারসের চাটনি করো? ওই তো গাছেই পচ্ছে ফলগুলো। বয়ে গেছে… বয়ে গেছে… বয়ে গেছে। খাবেন না ইন্দুবালা কিছু। সামনে এসে বাবা, বাছা করলেও নয়। তখন অবশ্য বুঝতে পারেননি এতসব কিছু ইন্দুবালার কপালে জুটবে না কোনোদিন। প্রথম বউ মারা যাবার এক বছরের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে বলে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিল শ্বশুরবাড়ি। এমনকি বিয়েটাও। হঠাৎ হয়ে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনটা। অথচ এইভাবে কলাপোতায় বিয়ে হয়নি ইন্দুবালার। রীতিমতো জাঁক করে তিন গ্রামের মানুষ খাইয়ে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রজমোহন। ঠাম্মা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। বরযাত্রী বলতে বরের সাথে মোটে চারটে মানুষ এসেছে? পুরোহিত, নাপিত আর বরের দুই বন্ধু? ব্যস? বাবা বলেছিল “বুঝতে পারছো না কেন মা পাসপোর্ট ভিসার খরচ নেই? ওদিকেও তো ওদের অনুষ্ঠান আছে নাকি?” কিন্তু এদিকে সত্যিই কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। কোনো লোকজন আসেনি। সানাই বাজেনি। একটা ন্যাড়া বাড়ি দেখে বাবার শুধু চোখ উজিয়ে জল এসেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে মেয়েকে বিদায় জানিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে তক্ষুনি ফিরে গিয়েছিলেন দেশে। মেয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারেননি। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কী মারাত্মক ভুলটা সত্যি তিনি করে ফেলেছেন এই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে যান বাবা-ভাইয়ের সাথে। যেতে পারেননি। তারও বেশ কিছুদিন পরে পোস্টকার্ডে পেয়েছিলেন বাবার মৃত্যু সংবাদ। তখন আর যেতে পারেননি। শাশুড়ি ছিলেন অসুস্থ। গয়না বিক্রি করে যাওয়ার মতো অবলম্বনটুকুও ছিল না। নদীর ধার থেকে বিদায় দিয়ে এসেছিলেন মা-ঠাম্মাকে। বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ির দরজায়। ভাই এসে দিদিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেও জানে কোথায় নিয়ে যাবে তার দিদিকে? আর কীভাবে? ততদিনে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। একের পর এক গ্রাম জ্বলছে। ভাইকে সেবারে ঠিক মতো খাওয়াতেও পারেননি ইন্দুবালা। কবেকার সেই পুরোনো কথা এখনও এঁটুলির মতো আটকে থাকে ইন্দুবালার সাথে। সবাইকে হারিয়ে এখন তিনি একা। তার কলাপোতার ভিটেবাড়ির মতো। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের মতো। বাগানের পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার মতো একা।
এইসব কিছু ভাবলে এখনও চিকচিক করে ওঠে ইন্দুবালার চোখ। মাথা ঢিপ ঢিপ করে। শরীর করে আনচান। মনে হয় প্রেশারের ওষুধ খেতে বুঝি ভুলে গেছেন। বেতের ছোট্ট ঝাঁপি খোলেন। ওষুধ খান। ওপরের জানলা দিয়ে সকালের বাগানটাকে এই ছেনু মিত্তির লেনেও স্বপ্নের মতো মনে হয়। রান্নাঘর ভরা খাবার শাশুড়ি দেখাতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। বুড়ি হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন নতুন বউকে বাড়ির পেছনের বাগানটায়। বলেছিলেন, “চোখ ভরে দেখ বউ। কেমন উপোছাপা হয়ে আছে আমার সংসার। বেধবা মানুষ আমি। শুভকাজে ভাতের হাঁড়ি চাপানোর অধিকার নেই আমার। নিজের সংসারে অমঙ্গল করতেও চাইনে। বাগান থেকে নিজের ইচ্ছে মতো যেটা মনে হয় সেটা তুলে আন গে। নিজের বউভাতের রান্নাটা যে আজ তোকেই করতে হবে”। কেমন যেন চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। এর আগে কলাপোতায় রান্না করেননি এমনটা নয়। জোর করে ঠাম্মা রান্না করাতো নিজের কাছে নিয়ে বসে। কখনও সখনও নিজেরও ইচ্ছে করতো। ভাইকে বলতেন “যা তো কলাপাতা কেটে নিয়ে আয়। আজ চড়ইভাতি হবে”। ভাই আরও কয়েকজনকে জুটিয়ে একগাদা শুকনো খেজুরের পাতা টানতে টানতে নিয়ে চলে আসতো। খেজুরের শুকনো পাতার আঁচে ইন্দুবালা খুদ জাল দিতেন। ছোটো ছোটো আলু কেটে, নতুন ওঠা পেঁয়াজ কুচো করে, লঙ্কা চিরে লাল করে ভাজতেন। সবাই মিলে উঠোনে বসে যেন অমৃত খাচ্ছেন বলে মনে হতো। কিন্তু তাই বলে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই তাকে রান্না করতে হবে? এমনকি নিজের বউভাতের রান্নাটাও? এই যে বাবা বলেছিল ছেলে নাকি মাস্টার? শিক্ষাদীক্ষা আছে। দোতলা পাকা বাড়ি। জমিদারের বংশ। রাজ্যের চাকর-ঝি। “আমাদের ইন্দু খাটের ওপর পা তুলে বসে খাবে”। খুব একটা বেশি দিন লাগেনি নিজের শ্বশুরবাড়ির স্বরূপ চিনতে ইন্দুবালার। যে স্বামীকে ‘মাস্টার’ বলে পরিচয় করানো হয়েছিল মেয়ের বাড়িতে সম্বন্ধ পাতানোর সময়, তিনি মাস্টার ছিলেন বটে তবে তাস, পাশা, জুয়ার। চিৎপুর যাত্রা পাড়াতেও বেশ যাতায়াত ছিল তাঁর। রথের পরে পরেই আর ঘরে মন টিকতে চাইতো না। মুখে বলতেন পালাকার। কিন্তু আদপেই তার ধারে কাছে কোনো কলম কোনোদিন দেখেননি ইন্দুবালা। এমনকি এক ছত্র লিখতেও না। কাজেই স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক যাই বলতেন তাই যে ইন্দুবালা বিশ্বাস করে যেতেন তেমনটা নয়। কিছুটা বিদ্যে তাঁর পেটেও ছিল। শুধু প্রথম যেদিন তাঁর সামনে কাবুলিওয়ালা রতনলালকে পিটলো সেদিনই সব কিছু আরও পরিষ্কার হল। হেন নেশা ছিল না যা স্বামী করতেন না। এপাড়া বেপাড়ায় তাঁর ভালোবাসার মানুষের অভাব ছিল না। শুধু তারা ভালোবাসতো টাকার বিনিময়ে। আর টাকা যেত ইন্দুবালার গয়না বিক্রি করে। কাবলিওয়ালা যখন বাড়ির সামনে অমন বড় মানুষটাকে বেধড়ক জুতো খুলে মারছে কেউ এগিয়ে যায়নি। অন্য শরিকরা মুখ চাপা দিয়ে হাসাহাসি করছিল। শাশুড়ি গিয়েছিলেন গঙ্গা স্নানে। ইন্দুবালা কী করবেন বুঝতে না পেরে মাথায় ঘোমটা টেনে সটান রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কী মনে হয়েছিল কাবলিওয়ালাটার কে জানে। রতনলালকে ফেলে রেখে দু দিনের নোটিশ দিয়ে চলে গিয়েছিল সে। যাবার আগে বলে গিয়েছিল “এমন ছ্যাঁচড়া আদমির সাথে আছিস কী করে মা তুই?” সেদিনই মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অন্য নামটাও জেনে যান ইন্দুবালা। সবাই তাকে অলক্ষ্যে ছ্যাঁচড়া বলে ডাকে। দৈব্যের কী পরিহাস বিয়ের পরে প্রথম দিন শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট বাগানে শাশুড়ি যখন ইন্দুবালাকে একা দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তখন ইন্দুবালা দেখেছিলেন মাচার ওপরে পুঁইশাকের নতুন পাতা ওঠা ডগা। মাথা উঁচু করে যেন আকাশ দেখতে চায় তারা। ঝুড়ি ভরে পুইশাঁক তুলে নিয়ে এসেছিলেন মনের আনন্দে। কারণ তিনি জানতেন বাবা মেয়েকে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি, কাপড় আরও অনেক কিছুর সাথে দিয়ে গেছেন দুটো বড় ইলিশ। ইলিশের মাথা আর পুঁইশাক দিয়ে অসাধারণ ছ্যাঁচড়া রান্না করেছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। অত বড় ডাকাত চেহারার স্বামী আধ কড়াই ছ্যাঁচড়া একা নিজেই সাবাড় করেছিলেন। প্রথম রাতে তাই সোহাগ উঠেছিল তার দিক থেকে মাত্রা ছাড়া। ইন্দুবালা এত সবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যখন ঘাড়ের ওপর ওই দশাসই চেহারা চেপে বসে একটু একটু করে কৌমার্য শুষে নিচ্ছিল তাঁর, তখন একবারের জন্যেও মনিরুলকে মনে পড়েনি ইন্দুবালার। ব্যথায় চোখ বন্ধ করলে উঠোনের জোনাকি গুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন স্পষ্ট। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠের আম তার ডালপালা নেড়ে ফিসফিস করে বলেছিল “নিয়তি…ইন্দুবালা..নিয়তি…”।
সামনের ভটচাজ বাড়ি থেকে গিন্নি তাঁর নাতনি রাকাকে পাঠিয়েছে। সে নাকি এবার সায়েন্স না কীসব নিয়ে পড়ছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। একটা সুন্দর দেখতে ট্যাব তার হাতে। ইন্দুবালা আঁচলে চশমা মোছেন। এগিয়ে আসেন রাকার দিকে। এক্কেবারে মায়ের মুখ বসানো। থুতনি ধরে চুমু খান। “ভালোই হয়েছে। ভাগ্যিস শান্টুর মতো হোসনি। যা দস্যু ছিল ছেলেটা। মেয়েরা মায়ের মুখ পেলে জীবনে শান্তি পায়। জানিস কি সেটা?” রাকা মাথা নাড়ে। এইসব কিছুই সে জানে না। জামশেদপুরে থাকতো। বাবা কলকাতার কলেজে ভর্তি করে দিয়ে বললো এখানেই পড়াশুনো করো। পড়াও হবে আর দাদু-ঠাম্মাকে দেখাও। হাসেন ইন্দুবালা। “তা ভালো। তারা ছাড়া আর ওদের কেই বা আছে বল? তা সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস। অতবড় কলেজ। আমি তোকে কী পড়াবো? ছেলেদেরই আমি পড়াতে পারিনি কোনদিন। সব লোক রাখতে হয়েছিল। ইতু তো দাদাদের কাছেই পড়েছে। আমি কী শেখাবো বলতো তোকে?” আমতা আমতা করে বলেন ইন্দুবালা। এমনিতেই গা টা ম্যাজম্যাজ করছিল বলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আচারের বয়ামগুলো জানলার রোদে রাখেন। মাথার ওপর কাপড়ের সাদা ঢাকনাগুলোকে পালটান। ধনঞ্জয়কে উনুন ধরাতে বলেন। রাকা পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। ভালো লাগে ইন্দুবালার। নিজের নাতি-নাতনিগুলোর থেকেও বয়সে কত ছোটো। বাড়িতে এমন একটা কেউ না থাকলে চলে? কেমন যেন ছেলেগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার কথাও। নাতি নাতনি-নাতবউ ভরা সংসার তাঁর। কী এমন ক্ষতি হতো এই বাড়িটায় সবাই মিলে একসাথে থাকলে? ঠিক আছে। না থেকেছে ভালো হয়েছে বাবা। তারপর সেই তো কাটাকাটি, লাঠালাঠি। কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছে এক সময়ে এই বাড়ির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। ভাগ্যিস উনি বেঁচে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা সেরে গিয়েছিলেন না হলে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরতে হতো। ভালোবাসতেন কি বাবু মাস্টার রতনলাল ইন্দুবালাকে? জিজ্ঞেস করেননি কোনোদিন ইন্দুবালা। স্বামীর সাথে কথা হতো কতটুকু? শুধু শেষ কয়েকদিন বিছানার সাথে যখন মিশে গিয়েছিলেন নিজের মায়ের মতোই, পেটটা ফুলে উঠেছিল বেঢপ। ডাক্তার বলেছিল জল জমেছিল পেটে। অথচ মধ্যরাতে যখন গঙ্গার জল খেতে চেয়েছিলেন, ইন্দুবালা জল গড়িয়ে এনে দেখেছিলেন সব শেষ। বাচ্চাগুলোর তখনও বোঝার বয়েস হয়নি কী ক্ষতি হল তাদের জীবনে। নাকি এই নরক থেকে চিরকালের মুক্তিলাভ!
ইন্দুবালা রোয়াকে নেমে রান্নার বাসনগুলোকে ভালো করে জল ঝরাতে দেন। রাকা অবাক হয়ে জানতে চায় “এই এতকিছু ইউজ হয় তোমার হোটেলে দিদা?” ইন্দুবালা হাসেন। কী আর উত্তর দেবেন ওইটুকু মেয়েকে? দোতলার ঘরে বড় কাঠের সিন্দুকটা দেখালে তো অক্কা পাবে। সব নিজের টাকায় বানানো। হাজার লোককে এখনও এক বেলায় খাওয়াতে পারেন ইন্দুবালা। রান্না ঘরে ঢুকে উনুনের আঁচ দেখেন। রাকা যাই দেখছে তাতেই অবাক হয়ে যাচ্ছে “ওহ মাই গড। কয়লার উনুন? গ্যাস থাকতে এখনও তুমি এইভাবে রান্না করো দিদা? আমার কলেজে বললে সবাই এক্ষুনি ছুটে আসবে দেখতে। ইভ আমাদের ম্যামও।” ঘুরে তাকান ইন্দুবালা। “এই তো বললি কীসব সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস, তাতে উনুন দিয়ে কী হবে? আর তোর কলেজের লোকজনই বা দেখতে আসবে কেন?” রাকা হেসে ফেলে। “তুমিও দিদা। পড়ছি তো হোম সায়েন্স নিয়ে। কুকিং আমার স্পেশাল পেপার। এক্কেবারে হান্ড্রেড মার্শ। উইথ প্র্যাকটিকাল। তাই না তোমার কাছে এসেছি।” ইন্দুবালা এতক্ষণে যেন ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেন। “রান্না নিয়ে পড়ছিস নাকি তুই? সেটা আগে বলবি তো মেয়ে। সায়েন্স টায়েন্স শুনে আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা”। ভটচাজ গিন্নি চালাক চতুর। ঠিক বুঝেই নাতনিকে পাঠিয়েছে ইন্দুবালার কাছে। “বই-পত্তর, আর তোদের ওই কম্পিউটারের থেকে বেশি জানে বুড়ি। শিখে নিতে পারলে আর তোকে ঠেকায় কে”। ততক্ষণে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের প্রথম আঁচ গনগনে হয়ে যায়। আগুনের পাশে পেতলের থালায় সিধে রাখা। আতপ চাল। একটা গোটা পান। কাঁঠালি কলা। একটা আস্ত সুপারি। কোনোদিন মিষ্টি জোটে তো ভালো। না হলে বাতাসা। এতে অগ্নিদেব খুশি হয়। গেরস্থ বাড়িতে অনুষ্ঠানে হাঁড়ি চাপানোর আগে রান্নার ঠাকুররা এইসব চেয়ে চিনতে নিত। এখনও হয়তো নেয়। কিন্তু ইন্দুবালা এই আচার মেনে চলেন প্রতিদিন। মানুষের মুখের অন্ন বিক্রি করেন। যা তা কথা নয়। সামর্থ্য যদি থাকতো সবাইকে বিনা পয়সায় খাওয়াতেন ইন্দুবালা। তেমন খদ্দের যে নেই তা নয়। সেই লিস্টের খাতা না হয় অন্য কোনোদিন খোলা যাবে। ইন্দুবালার ঠাম্মা উনুনের প্রথম আঁচে কয়লার ওপর ছড়িয়ে দিতেন অল্প করে চিনি। এতে আঁচটাও ভালো হয় আর অগ্নিদেবকে তুষ্টও করা হয়। ইন্দুবালা উনুনের পাশে ধূপ জ্বেলে দেন। উনুনের ওপর মুঠো করে ছড়িয়ে দেন চিনি। আঁচের ওপর ধক করে জ্বলে ওঠে আগুন। হাতজোড় করে প্রণাম করেন। “সবার পাতে অন্ন জুগিও ঠাকুর”। রাকা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখে। এইসব তাদের কলেজে শেখায়নি কোনদিন। তাদের তো সব মডিউলার কিচেন। মর্ডান ইকুইপমেন্ট। জল গরম করতে হলে জাস্ট টাইমার দিয়ে দাও। ইন্দুবালা বড় হাঁড়িতে জল বসান। দুমুখো উনুনে আর একটাতে বসান বড় লোহার কড়াই। গরম হয়ে গেলে মুগের ডাল ভাজতে থাকেন। কেমন করে ডাল আন্দাজ করতে হয়। কেমন করে জল। মাথা গুনে ভাতে চালের পরিমাপ ইন্দুবালা শেখান রাকাকে। মনে মনে ভাবেন এইভাবে একদিন তাঁর ঠাম্মা তো তাঁকে রান্না শেখাতো। শুধু কত রকমের ফোড়ন হতো সেগুলো সব মনে রেখে দিতেন। এখনকার রাকা সেগুলো তার ট্যাবে লিখে রাখে চটপট। ছবি তোলে। ভিডিও করে। বাড়ির বাইরে গাড়ি এসে থামে। কেউ মা বলে ডাকে। ইন্দুবালা ঘুরে তাকান। বড় ছেলে, মেজো ছেলে তাদের বউদের নিয়ে এসেছে। যাক বাবার মারা যাবার দিনটা তাদের তাহলে মনে আছে। যদিও মনে থাকার কথা নয়। ইন্দুবালা মনে করিয়ে রাখতেন সেই ছোট্ট বেলা থেকে। রক্তকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা। ছেলেরা এসেছে অবশ্য তারিখটাকে লক্ষ্য করেই। বাবাকে তো তাদের মনে নেই। কিন্তু বিশেষ দিনটা মনে আছে। এই দিনে মা যে ছ্যাঁচড়াটা রান্না করে তা সারা বছর যেন মুখে লেগে থাকে।
ভালো লাগলো “ইন্দুবালার ভাতের হোটেল” দুঃখের দিন যাপনের শেষে ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাঁচার গল্পে ইন্দুবালাকে স্বয়ংসম্পূর্ণা দেখালেন লেখক।