ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী
১. কুমড়ো ফুলের বড়া
জানালার কাছে বসন্তের নরম রোদে সার দিয়ে সাজানো আছে কাঁচের বড় বড় বয়াম। মুখগুলো ঢাকা আছে পরিষ্কার সাদা কাপড়ের ফেট্টিতে। বয়ামগুলোকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না তার মধ্যে কী রসদ লুকিয়ে আছে। কিন্তু যারা এই বাড়িতে রোজ ভাত খেতে আসে তারা ঠিক জানে। ভাতের পাতে লেবু, নুন, লঙ্কা দেওয়ার পাশাপাশি উড়ে বামুন ধনঞ্জয় একটু করে শালপাতায় ছুঁয়ে দিয়ে যায় বয়ামের সেই লুকোনো সম্পদ। কামরাঙা, কতবেল, জলপাই কিংবা কোনোদিন পাকা তেঁতুলের আচার। নতুন কাস্টমাররা অবাক হয়ে যায়। আর পুরোনো লোকেরা ভাবে আজ কোনটা পাতে আসবে? শুধু আচারের টানেই না, এই হোটেলে ভিড় লেগে থাকে পুব বাংলার এক বিধবা মহিলার হাতের রান্না খেতে। ইন্দুবালা কবে যে এই ভাতের হোটেল শুরু করেছিলেন আর কেন করেছিলেন নিজেও ঠিক মনে করতে পারেন না। তবু ভাসা ভাসা ছবির মতো মনে পড়ে অনেক কিছু। শুধু সেবার যখন কোলের এক মেয়ে আর ছোট্ট দুই ছেলেকে নিয়ে বিধবা হলেন, সেদিন থেকে বুঝতে শুরু করেছিলেন যারা এতদিন ঘিরে রাখতো তাঁদের, যারা সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো আদায় করে নিয়ে যেত, তারাই এখন ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে। স্বামীর জুয়া আর মদের নেশায় এতদিন যারা আট-কপাটি পর্যন্ত বিক্রি করায় সায় দিয়েছিলো তাদেরও আর দেখা গেল না বড় একটা। বরং সবাই কেমন যেন হারিয়ে গেল চারপাশ থেকে। বলা যায় ছেড়ে চলে গেল।
তখনও খুলনা থেকে মাঝে মাঝে ভাই এসে খোঁজ খবর নিয়ে যেত ইন্দুবালার। মা পোঁটলা করে পাঠাতো ভাজা চিড়ে, মুড়ি, বাড়ির সজনের ডাটা, চুইঝাল। তারপর সেটাও বন্ধ হলো। যুদ্ধ বাধলো। বাড়ির অনেক দিন কোনো খোঁজ পেলেন না। একদিন সকাল বেলায় গাঁয়ের থেকে পালিয়ে আসা এক পাগলাটে লোকের কথায় জানতে পারলেন পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু পাকিস্তানি মিলিটারি খান সেনারা। ভাই বাড়ির লোকজন আর কেউ বেঁচে নেই। এমনকি ভিটেটাও না। বাড়ির সামনের রাস্তাটায় বসে যুদ্ধের বীভৎসতার তাপ পোয়ানো লোকটা বিড়বিড় করে বকছিল। আর ইন্দুবালা তাঁর সমস্ত সত্তা নিয়ে মন দিয়ে শুনছিলেন কয়েকটা প্রিয় মানুষের তাঁর চারপাশ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ইন্দুবালা একা হয়ে পড়ছিলেন। বড় একা। একটা শহরে তিন ছেলে-মেয়ে আর পুরোনো বাড়িতে নিজের শরীরের সমস্ত যৌবন নিয়ে এক্কেবারে একা। না ইন্দুবালা কাঁদেননি। কাঁদার মতো সময় তাঁর ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল না। ভেতর থেকে কেমন যেন শুকনো হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যেদিন উড়লো সে দেশের মাটিতে, এদেশে ইন্দুবালা ছেনু মিত্তির লেনের নীচের ঘর ঝাঁট দিয়ে উনুন ধরালেন। ভাঁড়ারে চাল ছিল বাড়ন্ত। ছেলেমেয়েগুলো খিদের জ্বালায় তারস্বরে কাঁদছিল। পাওনাদারের দল দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। লছমী মাছওয়ালী শেষ বাজারে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল। আর থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নোনা ধরে ক্ষয়ে যাওয়া দোতলা বাড়িটার সামনে। লছমী দেখেছিল একটা বছর পঁচিশের মেয়ে সদ্য বিধবার সাদা ধবধবে শাড়িতে এলোচুলে চুপ করে বসে আছে ধরে ওঠা উনুনটার সামনে। উনুনে গুলের আঁচে ফর্সা মেয়েটার মুখ লাল হয়ে আছে। ওদিকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে চিল শকুনের মতো পাওনাদাররা। লছমীর যেন কী একটা মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে। এই বাড়িতে মাছ বিক্রি করেছে সে বহুদিন। এই বাড়ির নুন খেয়েছে সে। একটুও সময় নষ্ট করেনি লছমী। সোজা এসে দাঁড়িয়েছিল ইন্দুবালার সামনে। গ্যাঁট থেকে দু টাকা বার করে মেঝের ওপর রেখে দিয়ে বলেছিল, “আজ তোমার বাড়িতে দুটো ভাত মুখে দেব মাজি। কছু মনে করো না। বারোটা পঁচিশের ক্যানিং লোকাল ছুঁড়ে গেল যে। এখন দুটো পেটে না পড়লে বাড়ি ফিরতে সাঁঝ হয়ে যাবে। আর শলীল চলবে না মাজি”।
ইন্দুবালা হ্যাঁ না কিছু বলেননি। তাঁদের খুলনার বাড়িতে অতিথিরা কোনোদিন ভাত না খেয়ে যায়নি। আজও তিনি লছমীকে ফেরত পাঠাতে পারলেন না। বলতে পারলেন না তাঁর ভাঁড়ারে ফোঁটাবার মতো চালটুকু নেই। লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে এক আনাও নেই যা দিয়ে তিনি তাঁর দোরে আসা লছমীকে মুড়ি কিনে খাওয়াতে পারেন। সাত-পাঁচ না ভেবে একটু কুণ্ঠা নিয়েই ইন্দুবালা লছমীর দেওয়া টাকাটা আঁচলে বাঁধলেন। উনুনে চাপালেন এক হাঁড়ি জল। ছোটো মেয়েকে দোতলার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে এসে বড় ছেলে প্রদীপকে পাঠালেন সামনের মুদিখানার দোকানে। খিড়কির দরজা খুলে নিজে বাড়ির পেছনের বাগান থেকে নিয়ে এলেন সবে কচি পাতা আসা কুমড়ো শাক। গাছের পাকা লঙ্কা। শাশুড়ির আমলের পুরোনো ভারী শিলটা পাতলেন অনেক দিন পরে। যত্ন করে ধুয়ে সেই কবেকার প্রাচীন হিমশীতল পাথরটার ওপর রাখলেন সর্ষে দানা। শিল আর নোড়ার আদিম ঘর্ষণে খুলনা থেকে পাঠানো মায়ের শেষ সর্ষেটুকু বেটে ফেললেন ইন্দুবালা অল্পক্ষণের মধ্যেই। লোহার কড়াইতে জল মরতে থাকা সবুজ ঘন কুমড়োশাকের ওপর আঁজলা করে ছড়িয়ে দিলেন সর্ষের মণ্ড। কয়লার আঁচে টগবগ আওয়াজে ফুটতে থাকলো কচি শাকগুলো। তার নরম পাতাগুলো। সাঁতলানোর ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাড়িতে। দোতলার ঘরে খুকি চোখ মেলে হাত পা নেড়ে খেলতে থাকলো। ছোটো দুই ছেলে গরম ভাত খাওয়ার বাসনায় থালা নিয়ে এসে বসে পড়লো রান্নাঘরের দরজায়। তখনও লাল লঙ্কা গুলোর গা থেকে ঝাল মিশছে কুমড়ো শাকের হালকা সবুজ মাখো মাখো সর্ষে ঝোলে।
রান্নার পাট শেষ হলে ইন্দুবালা ওপরের ঘরের তাক থেকে পাড়লেন গতবারের তেঁতুলের আচার। আসন পেতে লছমীকে যত্ন করে খাওয়ালেন। ফেরার সময় বাকি পয়সা ফেরত দিতে গেলে লছমী বললো, “এ কীরম বাত হলো মাজি? কাল যে আবার খাবো। হর রোজ পয়সা দেব না কি তোমায়? ওটা তুমি রেখে দাও”। লছমী সেই যে গেল পরের দিন ফিরে এলো আরও তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে। এইভাবে আস্তে আস্তে বাজারের সবাই এসে খাওয়া শুরু করলো ইন্দুবালার নীচের ঘরে। একদিন উড়িষ্যা থেকে এলো ধনঞ্জয়। কেউ তাকে ডাকেনি। কেউ কথা বলেনি। দরজার কাছে শুধু ভাত খাওয়ার জন্য বসেছিল বেচারা। বড় মায়া হয়েছিল তাকে দেখে ইন্দুবালার। ওই বয়সের একটা ভাই ছিল যে তার। যুদ্ধের সময় খান সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি তাকে। আর একটুও মনে করতে চাননি সেসব কথা। অনেকটা ভাত আর ডাল দিলে চেটে পুটে খেয়ে নিয়েছিল সবটা ধনঞ্জয়। ছেলেদের খাইয়ে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে এসে ইন্দুবালা দেখেছিলেন সব কিছু সাফসুতরো। থালা বাটি বোয়া। এমনকি মাটির উনুনটা পর্যন্ত সুন্দর করে ল্যাপা। সেই থেকে ইন্দুবালার সংসারে থেকে গেল উড়িষ্যার কোন এক খরাপীড়িত অজ গাঁয়ের ধনঞ্জয়। সিঁড়ির নীচটা সাজিয়ে নিল তার নিজের মতো করে। সেখানেই থাকতে শুরু করলো সে। একদিন হঠাৎ রান্নার গন্ধে চলে এলেন সামনের কালেক্টর অফিসের বড়বাবু। ইন্দুবালার হাতের রান্না খেয়ে তাঁর কবেকার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়লো। নিদান দিলেন তাঁর অফিসের সবাই এখানে খেতে আসবে। শুধু তাই নয় নিজে থেকে খুশি হয়ে একটা হলুদ রঙের এনামেল বোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন ইন্দুবালার বাড়ির বাইরের দরজার ঠিক ওপরে। সেখানে জলজল করে লেখা থাকলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। পুরসভা থেকে লাইসেন্স হলো। দুই ছেলে বড় হলো। তারা দিব্য লেখাপড়া শিখে সুন্দর বিয়ে করে টুপটাপ সরে পড়লো। মেয়ে গেল জামাইয়ের সাথে পাঞ্জাবে, হিল্লিতে দিল্লিতে ঘুরে ঘুরে সংসার করতে। ইন্দুবালা একা থেকে গেলেন তাঁর ভাতের হোটেল নিয়ে। একদম একা।
একা কেন থাকলেন? তার একটা বিস্তৃত ব্যাখ্যান দেওয়া যেতই। গল্পের পরিসর জটিল করার জন্য প্যাঁচ পয়জার কম ছিল না। কিন্তু তাহলে এক তরফা ইন্দুবালার কথা শুনলে চলতো না। তার সাথে তাঁর দুই ছেলে এবং এক মেয়ের কথাও শুনতে হতো। চার পক্ষের কথা শুনলে মনে হতো বাঙালির চেনা গল্প। মা মানিয়ে নিতে পারছেন না ছেলেদের সংসারে। কেমন যেন পরপর মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ পর্যন্ত সংসারের যে চাবিটা নিজের আঁচলের খুঁটে বাঁধা থাকতো তা যেন চলে গেছে অন্য কারো হাতের মুঠোয়। ওদিকে ছেলেরা বলতো মা বড় বেশি নিজের মতো করে চলতে চাইছে। কারও কথাই শুনছে না। বয়সেরও তো একটা ছায়া নিবিড় শান্তি আছে। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের থেকেই সেসবের কোনো বালাই ছিল না। আর কোনো কালেই তো মেয়ের বাড়িতে বাঙালি মায়েরা থাকতে খুব আহ্লাদিত হননি। সব সময় কিন্তু কিন্তু করেছেন। কাজেই মেয়ের দিকের দরজায় অনেক আগেই খিল তুলে দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। যদিও খোঁজ খবর নেওয়া, এসে দেখাশুনো করা এই সবই তারা করেছে। এমনকি মায়ের নিয়মিত ডাক্তারি চেক-আপও। নাতিরাও আহ্লাদ করে নাত বউ নিয়ে আসে মাঝেমাঝে। ঠামুনের খবর রাখে। কিন্তু বুড়ি নিজে এইসব জাগতিক মায়ার ছেদো বাঁধনে একটুও আটকা পড়তে চান না। একদিনও ভাতের হোটেল বন্ধ হয়নি লছমীর খাওয়ার দিন থেকে। বন্যা, কলেরা, ডেঙ্গু, দাঙ্গা, কারফিউ কোনো কিছুতেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের উনুনে আঁচ নেভেনি। ভাঁড়ারে বাড়ন্ত হয়নি চাল। বাড়ির পেছনের বাগানের কুমড়ো শাক। আজ ইন্দুবালার বয়েস যখন সাতের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে তখন ছেলেরা মাকে এই ব্যবসা বন্ধ করতে বললে, নিজের হাতে রান্না-বান্না না করার ফরমান জারি করলে অশান্তি বাধে কালবৈশাখীর মতো। ফলে বেশ কিছুদিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে দু-পক্ষের। তখন শিব রাত্রির সলতের মতো বিজয়া, পয়লা বৈশাখের নমস্কারটুকু টিকিয়ে রাখে নাতি-নাতনিরা। ছেলেরা দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। ধনঞ্জয়কে বকাঝকা করে মায়ের ঠিক মতো দেখাশুনো করার জন্য। আর ইন্দুবালাও তখন নিজের সামনে একটা পাঁচিল তুলে দেন। অভিমানের আদান প্রদান বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকে। কিন্তু তার মধ্যেই ইন্দুবালার রান্নাঘরে মরশুমি পদের কোনো বিরাম হয় না। সেখানে কৌটো ভর্তি হতে থাকে পৌষের পিঠেতে। বর্ষায় ভাপা ইলিশে। গরমের মুড়ি ঘন্টতে। ধনঞ্জয় সব দিয়ে আসে বুড়ির নাম করা টিফিন কৌটোতে ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকের বাড়ি-বাড়ি। পূর্ণিমায় বুড়ির গাঁটে বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। অমাবস্যায় হাঁটতে পারেন না প্রায়। তবু মলম লাগিয়ে গরম জলের সেঁক নিয়ে রান্না করেন ইন্দুবালা। অতগুলো লোক আসবে। আঙুল চেটে চেটে খাবে। বায়না করবে একটু শুক্তোর জন্য। একটু মাছের মাথা দিয়ে করা ডালের জন্যে। পরিতৃপ্ত চাঁদপানা মুখগুলো দেখতেও ভালো লাগে যেন। এদের খাইয়েও সুখ। ইন্দুবালা তাই কোনোদিন কোনো তীর্থে যাননি। ধম্মে কম্মো করেননি। ঠাকুরের কথামৃতের বাণী মনের মধ্যে আউড়ে গেছেন। নারায়ণ সেবা। জীবে প্রেম।
তবে আজকে পূর্ণিমা, অমাবস্যা গ্রহণের মারপ্যাঁচ না থাকলেও পায়ের ব্যথাটা যেন বড় বেড়েছে ইন্দুবালার। সকালে পাঁজি খুলে আতিপাতি দেখেছেন কোথাও কোনো বক্র দৃষ্টি নেই গ্রহের। তবুও বাড়ির পেছনে বাগানের সিঁড়িটা দিয়ে নামতেই হড়কে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। কবে থেকে ধনঞ্জয়কে বলে যাচ্ছেন ওরে চুন ফ্যাল। একটু নারকেল ঝাঁটা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার কর। তা কে শোনে কার কথা। থাকতো সেই আগের বয়স, কারও কাজের জন্য তিনি বসে থাকতেন নাকি? ওই দশ কেজি চালের ভাত নিজে করেননি এক সময়? ফ্যান গালার সময় বাজারের লোকগুলো এসে দাঁড়িয়ে থাকতো জুই ফুলের মতো ভাত দেখার জন্য। ওই কাঁড়ি কাঁড়ি ফ্যান টেনে তুলে দিয়ে আসতেন না পাড়ার কুস্তির আখড়ায়! ছেলেগুলো খেতো পরিতৃপ্তি করে। মা শিখিয়েছিল ভাত হলো লক্ষ্মী। তার কিছু ফেলা যায় না। কিছু ফেলতে নেই। কত মানুষ ওই ফ্যানটুকু খেয়ে বেঁচে আছে দুবেলা। এইসব বকতে বকতে ইন্দুবালা সিঁড়ি দিয়ে নামেন। খিড়কির দরজা খোলেন। সেখানেই তো সেই শাশুড়ির আমলের একটা ছোট্ট বাগান। একটা আমগাছ। একটা পেয়ারা। একটা লিকলিকে নারকেল গাছ খাড়াই হয়ে উঠেছে। এইসব ছাড়াও কয়েক ছটাক জমিতে ইন্দুবালা সাজিয়ে নিয়েছেন তার রান্নাঘরে কাজে লাগার মতো টুকিটাকি সবজি। যেন ফকিরের ঝুলি। কিছু না কিছু তুমি পাবেই। প্রচণ্ড পা ব্যথা নিয়ে এতটা সিঁড়ি ঠেলে বাগানে এসে ইন্দুবালার মন ভালো হয়ে যায়। গোটা বাগান আলো করে ফুটে আছে কুমড়ো ফুল। তার ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির। এই ভরা বসন্তে এই সুন্দর সকালে শহরের ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যে কোথা থেকে যেন ডেকে উঠলো একটা কোকিল। ইন্দুবালা কুমড়ো ফুলের ওপর হাত বোলালেন। কোথা থেকে যেন পুরোনো কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের এঁদো গলির দোতলা বাড়ির ছোট্ট বাগান হয়ে গেল খুলনার কলাপোতার নিকানো উঠোন। মাটির উনুনে শুকনো খেজুর পাতার জিরানো আঁচ। আর চাটুর ওপর ছ্যাঁক ছুক করে ভাজতে থাকা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া। নামানোর সময় ঠাকুমা তার ওপর যত্ন করে ছড়িয়ে দিতেন অল্প কিছু পোস্তর দানা। পাশে বাটি হাতে করে বসে থাকা ছোট্ট ইন্দুবালা আর তার ভাই। ঝপ করে একটা সকাল নিমেষে পালটে দিল ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনু। এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল তুলে নিয়ে এসে দোকানের সামনের কালো বোর্ডে চক নিয়ে লিখলেন ভাত, ডাল, কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া, সরষে মাছ, জলপাইয়ের চাটনি। ধনঞ্জয় গাঁক গাঁক করে উঠলো তার দেশওয়ালি ভাষায়। রেগে গেলে বাংলা তার ঠিক আসে না। আলুভাজা হওয়ার কথা ছিল। সরষে মাছের জায়গায় পটল আলু ফুলকপির ঝোল হওয়ার কথা ছিল। এইসব কিছু ছেড়ে কিনা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া? ইন্দুবালা কোনো কথা কানে তুললেন না। উত্তর দিলেন না। স্নান করে ধবধবে সাদা কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।
বেলা যত বাড়তে থাকলো চারিদিকের আকাশ-বাতাস ছেয়ে গেল কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া ভাজার গন্ধে। সামনের মেস বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলো আজ বড় তাড়াতাড়ি ভাত খেতে এলো। কালেক্টর অফিসের কেরানিকুল বাড়ি থেকে খেয়ে এসেও দুপুরে চাড্ডি ভাত বেশি খেতে চাইলো। কবেকার খুলনার এক উঠোন রান্না জড়ো হলো ইন্দুবালার হোটেলে। সবার খাওয়ার তারিফ যখন তিনি রান্না ঘরের মধ্যে থেকে পাচ্ছিলেন, ছেলে-ছোকরাগুলো দিদা বলে এসে যখন জড়িয়ে ধরে আদর করে চলে যাচ্ছিল, বাড়ি যখন ম ম করছে গন্ধে ঠিক তখনই তাঁর সেই পড়ন্ত বেলার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ক্যাব। নেমে এলো যে মেয়েটি সেও প্রায় বছর দশেক পরে ফিরছে কলকাতায়। মেয়েটির ছোটো করে কাটা চুল, মেয়েটির হাব-ভাব, মেয়েটির পোশাক, তার বিদেশি লাগেজ, কাস্টমারের ভাত খাওয়ার ছন্দপতন ঘটায়। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। এই সময়ে এই ছেনু মিত্তির লেনে পরী এলো কোথা থেকে? মেয়েটি সটান গটমট করে এগিয়ে আসে। চোখের রোদ চশমাটা মাথার ওপর তোলে। হেলে যাওয়া ক্ষয়টে এনামেলের বোর্ডে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল তার আমেরিকার প্রবাস জীবনে হারিয়ে যাওয়া বর্ণপরিচয়ে পড়তে অসুবিধে হয় না। দরজার সামনে এক ঘর লোকের মধ্যে অস্ফুট স্বরে ডাকে “ঠাম্মি”।
ইন্দুবালা তখন যত্ন করে শেষ কুমড়ো ফুলের বড়াটা ভাজছিলেন চাটুর ওপর। অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে ঘুরে তাকান। তাঁর হাতে বেসনের প্রলেপ। কপালে উনুনের আঁচের বিন্দু বিন্দু ঘাম। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা একটু ঠিক করে এগিয়ে আসেন। ভালো করে দেখেন এক পশলা রোদ ঢোকা রান্না ঘরে মেয়েটার মুখটাকে। “নয়ন না?” জড়িয়ে ধরে সুনয়নী তার ঠাম্মিকে। কোনো শব্দ যেন আর বেরোতে চায় না তার গলা থেকে। শুধু ফোঁপানো কান্নায় বোঝা যায় ভাঙা ভাঙা কথা। “আমায় একটু তোমার কাছে থাকতে দেবে ঠাম্মি?” ইন্দুবালা কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁর বড় ছেলের এই মেয়েটি ঠিক তাঁর মতোই। একরোখা। কারো কথা না শুনে, কাউকে তোয়াক্কা না করে কলেজ টপকে চলে গিয়েছিল বাইরে। কোন এক বিদেশিকে বিয়েও করেছিল মনে হয়। তারপর আর কেউ খবর রাখেনি। মেয়েটা যে এই বাড়ির কেউ ছিল, এই বাড়ির কেউ হয় সে কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল সবাই। শুধু নতুন বছরে একটা করে কার্ড আসতো ইন্দুবালার কাছে। ফুল, লতা পাতা, সূর্য দেওয়া। ইংরাজিতে লেখা থাকতো অনেক কিছু। ইন্দুবালা ওগুলো সাজিয়ে রেখে দিতেন দেওয়ালে। সেই নয়ন? “আমাকে ভুলে যাওনি তো ঠাম্মি? সবাই ভুলে গেছে আমাকে। বাবা, ভাই, কাকু, পিসি সবাই”। ইন্দুবালা নাতনির থুতনি ধরে চুমু খান। তাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন রান্না ঘরের ছোট্ট টুলটায়। সামনের টেবিলে শালপাতার থালায় নিজের হাতে ভাত বাড়েন। মাটির গ্লাসে জল দেন। “আমার ঠাকুমা কী বলতো জানিস নয়ন? দুপুরের অতিথি হলো মেঘ না চাইতে জল। তাকে পেট পুরে না খাওয়ালে গেরস্তের অমঙ্গল হবে। মাঠ ভরা ধান হবে না। গোলা ভরা ফসল উঠবে না। মা লক্ষ্মী বিরূপ হবেন। ভিটে মাটি ছাড়া করবেন”। সুনয়নী ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার যে ভিটে মাটি কিছু নেই আর। সব গেছে। ইন্দুবালা মেয়ের মাথায় হাত বোলান। মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া মুখের সামনে ধরে বলেন, “দ্যাখ তো দিদিভাই মনে পড়ে কিনা কিছু”? সুনয়নীর কিছু মনে পড়লো কিনা বোঝা যায় না। তখন সে তার সদ্য ছেড়ে আসা স্প্যানিশ বয় ফ্রেণ্ডের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যাকুল। কিন্তু ইন্দুবালার মনে পড়লো অনেক কিছু। সুনয়নীর জন্ম হয়েছিল এমনই এক ঝলমলে দুপুরে। সেদিন ছিল বাসন্তী পুজো। তিনি সারাদিন উপোস করেছিলেন। বাটিতে ভেজানো ছিল নতুন ছোলা। কুমড়ো গুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। দয়া গোয়ালিনী দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে পাতা ঘি। ইচ্ছে ছিল কুমড়ো ছক্কা রাঁধার। সেদিনও এমন বিকেল হয়েছিল সব কিছু সারতে। বাড়িতে পাতা ঘি আর হিংয়ের গন্ধ ওঠা কুমড়োর ছক্কায় সারা বাড়ি যখন ম ম করছে। তখনই খবরটা এলো হসপিটাল থেকে। বাড়িতে কত দিন পর নতুন লোক এলো। নাতনির টানাটানা চোখ দেখে ভেবেছিলেন সত্যি ঠাম্মাই বুঝি ফিরে এসেছেন খুলনার কলাপোতার বাড়ির সব মায়াটুকু নিয়ে। চোখ চিকচিক করে উঠেছিল ইন্দুবালার। বড় আদর করে প্রথম নাতনির নাম রেখেছিলেন সুনয়নী।
সন্ধ্যেবেলা ধনঞ্জয় ধূপ দেখাতে এসে দেখলো কালো বোর্ডে লেখা আছে রাতের মেনু। রুটি, কুমড়োর ছক্কা, শিমাইয়ের পায়েস। ধনঞ্জয় আবার খিটখিট করতে পারতো বুড়ির মেনু চেঞ্জ করার জন্য। কিন্তু আজ সে টু শব্দটি করলো না। বরং বটিটা নিয়ে বড় একটা কুমড়ো কাটতে বসলো। আর কেউ না জানুক সে জানে বড় নাতনি সুনয়নী চলে যাবার পর থেকে আর একদিনও এই বাড়িতে কুমড়োর ছক্কা রাঁধেননি ইন্দুবালা।