৭. লাইব্রেরি-ঘরে সবাই

০৭.

লাইব্রেরি-ঘরে সবাই হাজির ছিল : দীপনারায়ণবাবু, ললিতনারায়ণ, ইন্দর, শশধর–সকলেই। তারাপদও ছিল। চন্দন ছিল না, সবে ঘরে এসে ঢুকল। কিকিরার সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা হল চন্দনের।

সন্ধে উতরে গিয়েছে। রাত বেশি নয়, তবু লাইব্রেরি-ঘরের উঁচু ছাদ, রাশি রাশি বই, ছবি, নানা ধরনের পুরনো জিনিস, বন্ধ জানলা এবং অনুজ্জ্বল বাতির জন্যে মনে হচ্ছিল রাত যেন অনেকটা হয়ে গিয়েছে।

কালো রঙের পায়া-অলা গোল টেবিল ঘিরে সকলে বসে ছিলেন। টেবিলটা প্রায় বুকের কাছাকাছি ঠেকছিল। টেবিলের ওপর পাতলা কালো ভেলভেটের কাপড় বিছানো। শশধর তার মনিবদের সামনে বসতে চাইছিল না, দীপনারায়ণ হুকুম করে তাকে বসিয়েছেন।

চন্দন ফিরে আসার পর কিকিরা ঘরের চারপাশে একবার ভাল করে তাকিয়ে নিলেন। আজ তাঁর একটু অন্যরকম সাজ। গায়ের আলখাল্লার রঙটা কালো, পরনের প্যান্টও বোধহয় কালচে, দেখা যাচ্ছিল না। চোখে চশমা। কাঁচটা রঙিন। তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছিল না।

কিকিরা তারাপদকে বললেন, দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখে আসতে।

তারাপদ দরজা দেখে ফিরে আসার পর কিকিরা তাকে বাতিটা আরও কম। করে দিতে বললেন।

টেবিল থেকে সামান্য তফাতে উঁচু টুলের ওপর একটা বাতি ছিল। তারাপদ মিটিমিটে সেই আলো আরও কমিয়ে দিল। অত বড় লাইব্রেরি-ঘর এমনিতেই প্রায় অন্ধকার হয়েছিল, বাতি কমাবার পর আরও অন্ধকার হয়ে গেল।

 টেবিলের চারধারে গোল হয়ে বসে আছেন : কিকিরা, কিকিরার ডান পাশে দীপনারায়ণ, বাঁ পাশে ললিতনারায়ণ, দীপনারায়ণের একপাশে ইন্দর, ইন্দরের পর বসেছে শশধর। তারাপদ আর চন্দন কিকিরার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে।

সকলকে একবার দেখে নিয়ে কিকিরা প্রায় কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি আমাদের একটা কাজের ভার দিয়ে এই রাজবাড়িতে এনেছিলেন। আমরা এই ক’দিন সাধ্যমত খেটে আপনার কাজ শেষ করে এনেছি। সামান্য একটু কাজ বাকি আছে। কাজটা সামান্য, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি। আপনাদের সকলকে আজ শুধু সেই জন্যেই এখানে ডেকেছি। হয়ত কেউ-না-কেউ আপনারা আমায় সাহায্য করতে পারেন।”

দীপনারায়ণ তাকিয়ে থাকলেন, ললিতনারায়ণ অন্ধ হয়ে যাবার পর চোখে গগলস্ পরেন, তাঁর চোখের পাতা খোলা থাকে, দেখতে পান না। ললিতনারায়ণ সামান্য মাথা ঘোরালেন। ইন্দর কেমন অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে থাকল; শশধর ধূর্ত দৃষ্টিতে।

দীপনারায়ণ বললেন, “কী ধরনের সাহায্য আপনি চাইছেন?”

কিকিরা বললেন, “বলছি। তার আগে বলি, এই লাইব্রেরি-ঘরের কোনো খোঁজই বোধ হয় আপনারা কেউ কোনোদিন রাখতেন না। রাজবাড়ির কেউ এ-ঘরে ঢুকতেন বলেও মনে হয় না।”

দীপনারায়ণ বললেন, “আমরা এক আধ দিন এসেছি; তবে “জয়নারায়ণ প্রায়ই আসত।”

“কেন?”

“ওর বই ঘাঁটা, ছবি ঘাঁটা বাতিক ছিল। পুরনো কিছু জিনিস আছে–ওর পছন্দ ছিল।”

কিকিরা যেন দীপনারায়ণের কথাটা লুফে দিলেন। বললেন, “একটা জিনিস দেখাচ্ছি। এটা কী জিনিস কেউ বলতে পারেন?” বলে কিকিরা পকেট থেকে বড় মার্বেল, সাইজের কাচের একটা জিনিস বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।”এই জিনিসটা ওঁর কাজ করার টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। এই ঘরে।”

দীপনারায়ণরা ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন। আশ্চর্য রকম দেখতে। ঠিক যেন একটা চোখের মণি। অথচ বড়। মণির বেশির ভাগটা কুচকুচে কালো, মধ্যেরটুকু জ্বলজ্বল করছে। কেমন এক লালচে আভা দিচ্ছে। অবাক হয়ে দীপনারায়ণ মণিটা দেখতে লাগলেন। ইন্দর এবং শশধরও দেখছিল। ললিতনারায়ণ পিঠ সোজা করে বসে।

“কী দেখছ তোমরা?” ললিতনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন।

দীপনারায়ণ বললেন, “চোখের মণির মতন দেখতে। মানুষের নয়। মানুষের চোখের তারা এত বড় হয় না, বিন্দুটাও লালচে হতে দেখিনি।”

কিকিরা বললেন, “মানুষের চোখের তারা ওটা নয়, দীপনারায়ণবাবু।” বলে পকেটে হাত দিয়ে ছোট-মতন একটা বই বার করলেন, পাতাগুলো ছেঁড়া, উইয়ে খাওয়া। বইটা টেবিলের ওপর রাখলেন না। শুধু দেখালেন। বললেন, “এই যে চটিবইটা দেখছেন–এটা ওই মণির পাশে ছিল। বইটা কোন ভাষায় লেখা বোঝা মুশকিল। নেপালি হতে পারে। আমি জানি না। তবে এর পেছন দিকে পেনসিলে ইংরেজিতে সামান্য ক’টা কথা লেখা আছে। তাই থেকে আমরা ধারণা হল, আপনাদের কোনো পূর্বপুরুষ বইটা পেয়েছিলেন। বই আর মণি। এই বইয়ে ওই মণির কথা লেখা আছে। লেখা আছে যে, মণিটা হিমালয় পাহাড়ের জঙ্গলে পাওয়া হায়না ধরনের কোনো জন্তুর। এই জন্তুদের চোখের অলৌকিক এক গুণ আছে।”

দীপনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, “অলৌকিক গুণ! মণিটার অলৌকিক গুণ কেমন করে থাকবে? এটা তো জ্যান্ত কোনো পশুর নয়?”

কিকিরা বললেন, “আপনি একটু ভুল বললেন। মণিটা জ্যান্ত পশুরই ছিল–এখন সেটা আলাদা করে তুলে রাখা হয়েছে।”

ললিতনারায়ণ বললেন, “আমি কখনো শুনিনি, রাজবাড়িতে এমন একটা জিনিস আছে!”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “রাজবাড়িতে অলৌকিক কিছু কি নেই রাজাসাহেব?”

দীপনারায়ণ তাড়াতাড়ি বললেন, “থাকতে পারে। কিন্তু মণিটার অলৌকিকত্ব কী?”

কিকিরা বললেন, “এর অলৌকিকত্বর কথা ছোট করে লেখা আছে পেনসিলে। কোনো মানুষ, যে নরহত্যা করেছে, পাপ কাজ করেছে, এমন কি প্রবঞ্চনা করেছে–সে যদি এই মণির ওপরে হাত রাখে মণিটা তার হাতের ছায়াও সহ্য করবে না–ছিটকে বেরিয়ে যাবে।”

দীপনারায়ণ কেমন একটা শব্দ করে উঠলেন। শশধর কিকিরার দিকে তাকাল। ইন্দর কেমন বোকার মতন তাকিয়ে হেসে উঠল। ললিতনারায়ণ মাথা নাড়তে লাগলেন।

“অসম্ভব”, ললিতনারায়ণ বললেন, “অসম্ভব। আমাদের বাড়িতে এরকম ভুতুড়ে কোনো জিনিস ছিল না। আমি শুনিনি।”

কিকিরা বিনীত গলায় বললেন, “আপনি শোনেননি, জানেন না–এটাই আমার জানার কথা, রাজাসাহেব। আপনি চোখে দেখতে পান না। মণিটা দেখতেও পাচ্ছেন না। তবু আপনাকে এখানে আনার উদ্দেশ্যই ছিল–যদি সব কথা শুনে কিছু সাহায্য করতে পারেন।”

ইন্দর হাসতে হাসতে বলল, “ভূতুড়ে গল্প শোনার জন্যে আমরা এখানে আসিনি। …শুনে ভালই লাগল। আমি চলি।”

কিকিরা বাধা দিয়ে বললেন, “যাবার আগে চোখে একবার দেখে যাবেন না?”

“কী দেখব?”

“মণিটা সত্যি সত্যি নড়ে কিনা?”

“পাগলের মতন কথা বলবেন না।”

“একটু পরীক্ষা করে দেখলে ক্ষতি কী!..এই লাইব্রেরি-ঘরে জয়নারায়ণ মারা গিয়েছিলেন। তিনি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, না কেউ তাঁকে খুন করেছিল–এটা একবার দেখা যেত।”

ঘরের মধ্যে সবাই যেন কেমন চমকে গেল। একেবারে চুপচাপ। শশধর আর ইন্দর কিকিরার দিকে অপলকে তাকিয়ে। চমকটা কেটে গেলে দু জনেই যেন জ্বলন্ত চোখে কিকিরাকে দেখতে লাগল।

ইন্দর বলল, “খুন? কে বলল?”

 কিকিরা বললেন, “বলার লোক আছে।”

খেপে উঠে ইন্দর বলল, “খবরদার, আবার যদি ও কথা শুনি, জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। রাজবাড়ির বদনাম করতে এসেছেন আপনি!”

কিকিরা বললেন, “না। আমি রাজা দীপনারায়ণের কথায় এসেছি।”

ইন্দর অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।”ননসেন্স। আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।” বলে সে দীপনারায়ণের দিকে তাকাল। “আপনি কোথা থেকে একটা ইডিয়েট, পাগলকে ধরে এনেছেন? ওকে তাড়িয়ে দিন। কথা বলতে জানে না।”

দীপনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, “বসো। চেঁচামেচি করো না। উনি যা। বলছেন সেটা আমিও বিশ্বাস করি না কিন্তু যা বলছেন সেটা পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কিসের? মণিটা যদি বাজেই হয়বাজেই থাকবে। নিশ্চয় নড়বে না।”

শশধর বলল, “রাজাসাহেব, আপনি ওঁর কথা বিশ্বাস করছেন?”

দীপনারায়ণ কোনো জবাব না দিয়ে কিকিরাকে বললেন, “কেমন করে হাত রাখব আপনি বলুন?”

কিকিরা নিজের ডান হাত মণিটার ওপর বিঘতখানেক উঁচুতে তুলে রাখলেন। মণিটা স্থির হয়ে থাকল। নড়ল না।

দীপনারায়ণ বললেন, “আমি রাখছি।”

দীপনারায়ণ মণির ওপর হাত রাখলেন উঁচু করে, নড়ল না।

নিশ্বাস ফেলে দীপনারায়ণ বললেন, “ইন্দর, তুমি রাখো।”

ইন্দর যেন ঘামতে শুরু করেছিল। তার মুখ কঠিন। শক্ত চোখে কিকিরার দিকে তাকাল। বলল, “বেশ, আমি হাত রাখছি যদি দেখা যায় মণিটা নড়ল না, ওই লোকটাকে আমি দেখে নেব।”

ইন্দর যেন রাগের বশে টেবিলে হাত দিয়ে মণিটা তুলে নিতে যাচ্ছিল। কিকিরা হাত ধরে ফেললেন। বললেন, “না না, ছোঁবেন না। ওপরে হাত রাখুন, আমরা যেভাবে রেখেছি।”

ইন্দরের হাত কাঁপছিল। ডান হাতটা সে তুলে রাখল।

খুবই আশ্চর্যের কথা মণিটা এবার নড়তে লাগল ধীরে ধীরে। ইন্দর অবাক। তার চোখের পাতা পড়ছে না। মুখে আতঙ্ক। হাতটা সে সরিয়ে নিল অন্য পাশে, চোখের মণিটাও গড়াতে গড়াতে তার হাতের দিকে চলে গেল। আবার হাত সরাল ইন্দর, মণিটাও গড়িয়ে গেল।

আচমকা খেপে উঠে ইন্দর চেঁচিয়ে উঠল। প্রায় লাফ মেরে গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল কিকিরার। চন্দনও পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

দীপনারায়ণ হাতের ঠেলা দিয়ে ইন্দরকে বসিয়ে দিলেন। বললেন, “গোলমাল করো না। বসো!” বলে পকেট থেকে রিভলবার বার করে সামনে রাখলেন। হাতের কাছে।

ইন্দর রিভলবারের দিকে তাকাল। তার মুখ রাগে ক্ষোভে ভয়ে উত্তেজনায় কেমন যেন দেখাচ্ছিল। ইন্দর থামল না, চেঁচিয়ে বলল, “আপনি আমাকে খুনি বলতে চান? কোথাকার একটা উন্মাদ…”

দীপনারায়ণ ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ করো।”

কিকিরা শশধরের দিকে তাকালেন।

শশধর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ধূর্ত চোখে আতঙ্ক।

কোনো উপায় নেই, শশধর যেন সাপের ফণার দিকে হাত বাড়াচ্ছে এমনভাবে হাত বাড়াল। তার হাত কাঁপছিল থরথর করে।

মণিটা এবারও নড়তে লাগল, গড়িয়ে গেল; শশধর যেদিকে হাত সরায়, সেদিকে গড়িয়ে যায় মণিটা। ভয়ের শব্দ করে হাত সরিয়ে নিল শশধর। চোখ যেন ভয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে, দীপনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাজাসাহেব, আমি নিদোষ; আপনি বিশ্বাস করুন।

দীপনারায়ণ কোনো কথা বললেন না, রিভলবারের ওপর হাত রাখলেন।

কিকিরা তাঁর বাঁ-পাশে বসা ললিতনারায়ণের দিকে তাকালেন। বললেন, “ললিতনারায়ণবাবু, আপনি কি একবার হাত রাখলেন?”

ললিতনারায়ণ বিন্দুমাত্র উত্তেজনা দেখালেন না। বললেন, “রাখব।”

“আপনার সামনেই টেবিল-হাতটা সামনের দিকে একটু বাড়িয়ে দিন।”

ললিতনারায়ণ বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।

মণিটার ঠিক ওপরেই হাত রাখলেন না ললিতনারায়ণ, অথচ সামান্য সময় মণিটা স্থির থেকে পরে তাঁর হাতের দিকেই গড়িয়ে আসতে লাগল। দীপনারায়ণ দেখছিলেন। কিকিরা ললিতনারায়ণকে হাত সরাতে বললেন। ললিতনারায়ণ হাত সরালেন-মণিটাও সরে এল। টেবিলের চারদিকে হাত ঘঘারাতে লাগলেন ললিতনারায়ণ-মণিটাও গড়াতে লাগল।

হঠাৎ বাঁ হাত উঠিয়ে নিয়ে ললিতনারায়ণ ডান হাত দিয়ে কিকিরার বাঁ হাত চেপে ধরলেন। তারপর হেসে উঠে বললেন, “এসব জোচ্চুরি কতদিন ধরে চলছে? হাত হঠাও।”

কিকিরা বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলেন না। বাঁ হাতটা সকলের সামনে মেলে ধরলেন। বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনার কাকা জোচ্চুরিটা ঠিকই ধরেছেন। আমার এই হাতে একটা শক্তিশালী চুম্বক ছিল। আর ওই কাচের মার্বেলটার তলায় লোহা দেওয়া আছে। এই ভেলভেটের তলায় যা আছে–সেটাও পাতলা কাঠ। কোনো সন্দেহ নেই এটা ম্যাজিকের খেলা। ধাপ্পা। কিন্তু রাজাসাহেব, আপনার অন্ধ কাকা কেমন করে আমার হাত নাড়া বুঝলেন সেটা একটু ভেবে দেখুন। আপনারা কেউ একবারও সন্দেহ করেননি–আমার বাঁ হাত নিচে ছিল-টেবিলের তলায়। এবং বাঁ হাতে চুম্বক ছিল। আপনার অন্ধ কাকা কেমন করে সেটা লক্ষ করলেন? আমি একবারও তাঁর পা ছুঁইনি। তাঁর যদি দৃষ্টিশক্তি না থাকত তিনি কিছুতেই এই অন্ধকারে আমার হাত নাড়া দেখতে পেতেন না। উনি আগাগোড়াই এটা লক্ষ করেছিলেন; এবং আমার জোচ্চুরি ধরবেন বলে ডান হাত না বাড়িয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। উনি কি বাঁ হাতে কাজ করতে অভ্যস্ত? তা নয়। আগেই আমি সেটা লক্ষ্য করে নিয়েছি। ললিতনারায়ণ অন্ধ নন। অন্ধ সেজে রয়েছেন।”

“কে বলল আমি অন্ধ নয়?” ললিতনারায়ণ বেপরোয়াভাবে বললেন।

কিকিরা বললেন, “আপনি যে অন্ধ নন সেটা আজ স্পষ্ট হল। আরও যদি শুনতে চান–তা হলে বলব, আমি দূরবীন তাগ করে আগেই একদিন দেখেছি, আপনি আপনার মহলে ছাদে দাঁড়িয়ে কোনো চিঠি বা কাগজ পড়ছিলেন। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। আজ তা প্রমাণিত হল। আপনি যথেষ্ট চালাক। সন্দেহ এড়াবার জন্যে আগে থেকেই অন্ধ সেজেছেন।”

কিকিরা চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

.

ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত অবস্থা। দীপনারায়ণ চমকে উঠেছিলেন। তারাপদ আর চন্দন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। ইন্দর যেন কোনো ভূত দেখেছে সামনে। শশধর কাঁপছিল।

দীপনারায়ণ রিভলভারটা তুলে নিলেন।

কেউ কোনো কথা বলছিল না।

ললিতনারায়ণ চোখের গগলস খুলে ফেললেন। বয়স হলেও তাঁর চেহারা। এখনও মজবুত। চোখ দুটি তীব্র দেখাল। বললে, “জয়কে কেউ খুন করেনি। সে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।”

কিকিরা বললেন, “খুনের প্রমাণ আছে।”

“কী প্রমাণ?”

“দীপনারায়ণবাবু, ছোরার বাক্সটা একবার দেবেন?”

দীপনারায়ণ চেয়ারের তলায় ছোরার বাক্স রেখেছিলেন। সতর্ক চোখ রেখে বাঁ হাতে বাক্সটা তুলে দিলেন। চাবিও!

কিকিরা বাক্সটা নিলেন। চাবি খুলে ছোরার বাঁটটা বার করলেন। বললেন, “এর ফলাটা কে খুলে নিয়েছে ললিতনারায়ণবাবু?”

“ছোরার বাঁটটা আপনি চুরি করেও আবার সিন্দুকে রেখে এলেন কেন?”

ললিতনারায়ণ চুপ। দু হাতে মুখ ঢাকলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “ছোরাটা আমার ঘরে যে কদিন ছিল–আমি ঘুমোতে পারতাম না সারা রাত। ভয় করত। দুঃস্বপ্ন দেখতাম। জয় আমার পাশে-পাশে যেন ঘুরে বেড়াত। তা ছাড়া ইন্দর আমায় শাসাচ্ছিল। বলছিল, ছোরাটা তাকে দিয়ে দিতে। বিক্রি করে সে আমায় অর্ধেক টাকা দেবে। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম না। ছোরার বাঁটটা পেলে ও পালাবে। কোনো উপায় না দেখে, মাথা ঠিক রাখতে–পেরে-বাক্সটা আবার দীপনারায়ণের সিন্দুকে রেখে আসি চুরি করে। আমার পাপ আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।”

ললিতনারায়ণের দু চোখের তলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মানুষটা।