১. কলকাতায় তখনো শীত

০১.

কলকাতায় তখনো শীত ফুরোয়নি। মাঘের শেষটেষ। পাড়ায়-পাড়ায় সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় চলছে। আর মাত্র দিন দুই বাকি। এমন সময় আকাশ ঘুটঘুটে হয়ে আচমকা এক ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! এমন বৃষ্টি যেন শ্রাবণ-ভাদ্রতেই দেখা যায়। এক রাত্রের ঝড়বৃষ্টিতেই কলকাতার চেহারা হল ভেজা কাকের মতন। সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় জলে ভেসে যায় আর কি! ছেলের দল আকাশের এই কাণ্ড দেখে মহাখাপ্পা। কাণ্ড দেখেছ, বৃষ্টি আসার আর সময় হল না! বুড়োরা অবশ্য খনার বচন আউড়ে বলতে লাগল যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।

পুজোর ঠিক আগের দিন দুপুর থেকে আকাশ খানিকটা নরম হল। মেঘ আর তত ঘন থাকল না, হালকা হল, ফেটে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে উড়ে যেতে লাগল। ঝিরঝির এক-আধ পশলা বৃষ্টি আর হাওয়া থাকল। মনে হল, কাল সকালে হয়ত রোদ উঠবে।

বিকেলের দিকে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে চন্দনরা এল কিকিরার বাড়ি। কিকিরার সঙ্গে চন্দনদের এখন বেশ ভাব। বয়েসে কিকিরা অনেকটাই বড়, নয়ত তিনি হয়ত গলায় গলায় বন্ধু হয়ে যেতেন তারাপদ আর চন্দনের। ঠিক সেরকম বন্ধু তো কিকিরা হতে পারেন না, তবু সৰ্কটা বন্ধুর মতনই হয়ে গিয়েছিল। কিকিরা তারাপদদের স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। আর তারাপদরাও কিকিরাকে যথেষ্ট মান্য করত, পছন্দ করত; রবিবার দিনটা তারা কিকিরার জন্যে তুলে রেখেছিল। বিকেল হলেই দুই বন্ধু কিকিরার বাড়ি এসে হাজির হত, গল্পগুজব, হাসি-তামাশা করে, খেয়েদেয়ে রাত্রে যে যার মতন ফিরে যেত।

দিনটা ছিল রবিবার। চন্দন আর তারাপদ কিকিরার বাড়ি এসে দেখে এক ভদ্রলোক বেশ দামি ছাতা আর কালচে রঙের নাইলনের বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের চোখমুখ দেখলেই মনে হয়, মানুষটি বেশ বনেদি। পুরোপুরি বাঙালি চেহারাও যেন নয়, চোখের মণি কটা, ভুরুর রঙও লালচে, লম্বা নাক, থুতনির তলায় ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

ভদ্রলোক যাবার সময় চন্দনদের একবার ভাল করে দেখে নিলেন।

উনি চলে গেলে দরজা বন্ধ করে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন, “এসো, এসো–আমি ভাবছিলাম আজ বুঝি তোমরা আর আসবে না।”

চন্দন বলল, “আসব না কেন, আজ আপনি আমাদের আফগান খিচুড়ি খাওয়াবেন বলেছিলেন।”

কিকিরা বললেন, “আফগানি খিচুড়ি, মুলতানি আলুর দম।..বৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিল–তোমরা বোধ হয় আফগানি ভুলে গেছ।”

চন্দন বলল, “খাওয়ার কথা আমি ভুলি না।”

কিকিরা বললেন, “ভেরি গুড। যাও ঘরে গিয়ে বসো, আমি বগলাকে চায়ের জল চাপাতে বলি।”

পায়ের জুতো জলে-কাদায় কদাকার হয়ে গেছে। ছাতা রেখে, জুতো খুলে তারাপদ বাথরুম থেকে পা-হাত ধুয়ে এল। চন্দনও। এই বাড়িতে কোথাও তাদের কোনো সঙ্কোচ নেই। যেন সবই নিজের।

ঘরে এসে বসল দুজনে। বাতি জ্বলছে। যে-রকম মেঘলা দিন, বাতি বিকেল থেকেই জ্বালিয়ে রাখতে হয়। চন্দন কোণের দিকে চেয়ারে বসল। এই চেয়ারটা তার খুব পছন্দ। সেকেলে আর্মচেয়ার। বেতের বুনুনির ওপর কিকিরা পাতলা গদি বিছিয়ে রেখেছেন। হাত পা ছড়িয়ে, গা ডুবিয়ে দিব্যি শোয়া যায়। চন্দন বেশ আরাম করে বসে তারাপদকে ডেকে সিগারেট দিল, নিজেও ধরাল। কিকিরাকে যখন চিনত না চন্দনরা, এন্তার সিগারেট খেয়েছে। চেনাজানা হয়ে যাবার পর ওঁর সামনে সিগারেট খেতে লজ্জাই করত কিন্তু কিকিরা ঢালাও হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন–”নো লজ্জা-শরম, খাও। তোমরা তো সাবালক ছেলে।”

চন্দন আরাম করে সিগারেট টানতে টানতে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল। কিকিরার মতন এই ঘরটাও বড় বিচিত্র। পাড়াটাও কিছু কম বিচিত্র নাকি। ওয়েলিংটন থেকে খানিকটা এগিয়ে এক গলির মধ্যে বাড়ি। পার্ক সাকাসের ট্রামে উঠলেই সুবিধে। কিংবা পঁচিশ নম্বর বালিগঞ্জের ট্রামে উঠতে হয়। নানা জাতের মানুষ থাকে এপাশে। লোকে যাকে বলে অ্যাংলো পাড়া, সেই ধরনের। তবে শুধু অ্যাংলোই থাকে না, চীনে বেহারী বোম্বাইঅলাও থাকে। কিকিরার বাড়ির নিচের তলায় মুসলমান করিগররা দরজিগিরি করে, কেউ কেউ টুপি বানায়। পুরনো আমলের বাড়ি। বোধ হয় সাহেব-সুবোতেই তৈরি করেছিল। কাঠের সিঁড়ি মস্ত উঁচু ছাদ, কড়িবরগার দিকে তাকালে ভয়। হয়। কিকিরার এই দোতলার ঘরটি বেশ বড়। ঘরের গা লাগিয়ে প্যাসেজ। তারই একদিকে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। কাজ চলার মতন বাথরুম। এক চিলতে পার্টিশানকরা ঘরে থাকে বগলা, কিকিরার সব্যসাচী কাজের লোক।

চন্দনরা যতবার কিকিরার ঘরে এসেছে, প্রায় বারেতে দেখেছে একটা-না-একটা নতুন জিনিস আমদানি করেছেন কিকিরা। এমনিতেই ঘরটা মিউজিয়ামের মতন, হরেক রকম পুরনো জিনিসে বোঝাই, খাট আলমারি দেরাজ বলে নয়, বড় বড় কাঠের বাক্স, যাত্রাদলের রাজার তরোয়াল, ফিতে-জড়ানো ধনুক, পুরনো মোমদান, পাদরি টুপি, কালো আলখাল্লা, চোঙঅলা সেকেলে গ্রামোফোন, কাঠের পুতুল, রবারের এটা সেটা, অ্যালুমিনিয়ামের এক যন্ত্র, ধুলোয় ভরা বই–আরও কত কী। কাচের মস্ত বড় একটা বল-ও রয়েছে, ওটা নাকি জাদুকরের চোখ।

চন্দন বলল, “তারা, কিকিরা নতুন কী আমদানি করেছেন বল তো?”

তারাপদ একটা বাঁধানো বইয়ের মতন কিছু নাড়াচাড়া করছিল, বলল “কী জানি! চাঁদু, এই জিনিসটা কী রে?”

চন্দন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বই বলেই মনে হল তার। চামড়ায় বাঁধানো। তারাপদ মামুলি বই চিনতে পারছে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। চন্দন বলল, “কেন, বই।”

মাথা নেড়ে তারাপদ বলল, “বই নয়।”

“মানে?”

“বইয়ের মতনই অবিকল দেখতে। বই নয়। বাক্স।”

“বাক্স? কই দেখি।”

তারাপদ এগিয়ে এসে জিনিসটা দিল। হাতে নিয়ে দেখতে লাগল চন্দন। সামান্য ভারী। একেবারে বাঁধানো বইয়ের মতন দেখতে। আগেকার দিনে মরক্কো-চামড়ায় যেরকম বই বাঁধানো হত, বিশেষ করে বিদেশি দামি বইটই, সেই রকম। বই হলে পাতা থাকত। এর চারদিকই বন্ধ। ঘন কালো রঙের চামড়া দিয়ে মোড়া। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বোঝার উপায় নেই, কার্ডবোর্ড না পাতলা টিনের ওপর বোর্ড দিয়ে আগাগোড়া বাক্সটা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোনো চাবির গর্তও চোখে পড়ল না।

চন্দন বাক্সটা নাড়াচাড়া করছে, এমন সময় কিকিরা ঘরে এলেন।

বাক্সটা হাতে তুলে নিয়ে দেখাল চন্দন।”এটা কি আপনার লেটেস্ট আমদানি?”

কিকিরার নিজের একটি বসার জায়গা আছে। নিচু সোফার মতন দেখতে অনেকটা, তার চারধারে চৌকো, গোল, লম্বা নানা ধরনের কুশন। রঙগুলোও বিচিত্র; লাল, কালো, সোনালি ধরনের। মাথার দিকে একটা বাতি। গোল শেড, শেডের গায়ে নকশা।

কিকিরা বসলেন। হেসে বললেন, “ঘণ্টাখানেক আগে হাতে পেয়েছি।”

“মনে হয়, চোরাবাজার, না হয় চিতপুর, কিংবা কোথাও পুরনো জিনিসের নীলাম থেকে কিনে এনেছেন।”

কিকিরা মাথা নাড়তে লাগলেন। তাঁর পোশাক বলতে একটা ঢলঢলে পাজামা, পায়ে চটি, গায়ে আলখাল্লা। আলখাল্লার বাহার দেখার মতন, যেন কম করেও দশ বারো রকমের কাপড়ের ছাঁট সেলাই করে কিকিরার এই বিচিত্র আলখাল্লা তৈরি হয়েছে।

তারাপদ নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসেছে ততক্ষণে।

কিকিরা যেন খানিকটা মজা করার জন্যে প্রথমে কিছু বললেন না–শুধুই মাথা নাড়তে লাগলেন। শেষে মজার গলায় বললেন, “নো থিফমার্কেট, নো চিতপুর। সিটিং সিটিং রিসিভিং।”

চন্দন হেসে ফেলল। বলল, “ইংলিশ রাখুন। এটা কী জিনিস? বাক্স?”

কিকিরা চন্দনের দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন, “স্যান্ডাল উড, ওই পদার্থটি নিয়ে আমার কাছে এসো। ম্যাজিক দেখাব।” চন্দনকে মাঝে মাঝে কিকিরা ঠাট্টা করে স্যান্ডাল উড বলে ডাকেন।

উঠে গেল চন্দন। কিকিরা তারাপদকে ডাকলেন, “ওই টিপয়টা নিয়ে এসো তো।”

কিকিরার সামনে টিপয় এনে রাখল তারাপদ। মাথার দিকের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন কিকিরা। বাক্সটা হাতে নিয়ে একবার ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, “তোমরা চৌকোনা টিফিন বাক্স কিংবা পানের কৌটা দেখোনি? এটাও সেই রকম। তবে এর কায়দাকানুন খানিকটা আলাদা, একে জুয়েলবক্স বলতে পারো।” কিকিরা কথা বলতে বলতে বাক্সর সরু দিকের একটা উঁচুমতন জায়গা বুড়ো আঙুল টিপতে লাগলেন।

তারাপদরা দেখতে লাগল। যদি এটা কোনো বাঁধানো বই হত তা হলে বলা যেত-বইয়ের যেটা পুটের দিক–যেখানে পাতাগুলো সেলাই করা হয়–সেই দিকে শিরতোলা বা দাঁড়া-ওঠানো একটা জায়গায় কিকিরা চাপ দিচ্ছিলেন। বার কয়েক চাপ দেবার পর তলার দিকে পুটবরাবর পাতলা কিছু বেরিয়ে এল সামান্য। কিকিরা তার আলখাল্লার পকেট থেকে হাতঘড়ির চাবির মতন একটা চাবি বার করলেন। বললেন, “এই দেখো চাবি।”

হাতে একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস থাকলে হয়ত আলপিনের মাথার সাইজের ফুটোটা দেখা যেত। আশ্চর্য, বাক্সর ডালা খুলে গেল। যেন স্প্রিং দেওয়া ছিল কোথাও ওপরের ডালা লাফিয়ে উঠল একটু।

চন্দন আর তারাপদ অবাক।

কিকিরা যেন আড়চোখে চন্দনদের মুখের ভাবটা দেখে নিলেন। হাসলেন মিটমিটে চোখে। তারপর ওপরের ডালাটা পুরোপুরি তুলে ধরলেন।

ঘাড় মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন কিকিরা। চন্দন আর তারাপদ প্রথমটায় যেন কিছুই বুঝতে পারল না। কী ওটা? মেয়েদের গয়নার মতন মনে হচ্ছে। চকচক করছে। কত রকমের পাথর! দুজনেই ঝুঁকে পড়ল। বাক্স থেকে বিঘতখানেক তফাতে মাথা রেখে হাঁ করে দেখতে লাগল। ভেলকি না ভোজবাজি? চোখের পলক আর পড়ে না।

ধীরে ধীরে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল চোখে, মাথায় ভাসা-ভাসা একটা ধারণা জাগছিল। না, মেয়েদের গয়নাগাটি নয়। অন্য কিছু। কিন্তু কী?

তারাপদ বলল, “কী এটা?” কিকিরা বললেন, “একে বলে কিডনি ড্যাগার।”

“ড্যাগার? মানে ছোরা?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু ছোরা কোথায়? ওটা তো গয়নার মতন দেখতে।”

 কিকিরা হাত বাড়িয়ে বাক্সটা তুলে নিলেন। বললেন, “যেটা গয়নার মত দেখছ, সেটা হল ছোরার বাঁট। দেখেছ একবার ভাল করে বাঁটটা? কত রকমের পাথর আছে জানো? দামি সবরকম পাথর রয়েছে। বাজারে এর দাম কত হবে আন্দাজ করতে পারো?”

চন্দন মুখ তুলেছিল। তারাপদও হাঁ করে কিকিরাকে দেখছে।

 কিকিরাও মুগ্ধ চোখে সেই পাথর বসানো, কারুকর্ম করা বাঁটটা দেখছিলেন। নীলচে ভেলভেটের ওপর রাখা হয়েছে বাঁটটা। গয়নার মতনই কী উজ্জল, সুন্দর দেখাচ্ছে।

কিকিরা বললেন, “বাঁটটা দেখছ, ছুরিটা দেখতে পাচ্ছ না তো! ওটাই তোত সমস্যা।”

“সমস্যা?” চন্দন বলল।

“ব্যাপারটা তাই। বাঁটটা আছে, ছুরির দিকটা নেই!…ওটা জোগাড় করতে হবে।”

কিকিরার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তারাপদরা বুঝতে পারল না। কিসের ছুরি, বাঁটটাই বা কোথা থেকে এল? কিকিরা কত টাকা খরচ করে এটা কিনলেন? অত টাকাই বা পেলেন কেমন করে? বড়লোক মানুষ তো কিকিরা নন।

একেবারে পাগলামি কাণ্ড কিকিরার। পুরনো জিনিস কেনার কী যে খেয়াল ওঁর-তারাপদরা বুঝতে পারে না।

চন্দন বলল, “আপনি এটা কিনলেন?”

“কিনব? এর দাম কত জানো? এখনকার বাজারে হাজার ত্রিশ-চল্লিশ তো হবেই–বেশিও হতে পারে।”

“তবে পেলেন কোথায়?”

কিকিরা এবার রহস্যময় মুখ করে বললেন, “পেয়েছি, তোমরা আসার সময় যে ভদ্রলোককে বেরিয়ে যেতে দেখলে, উনি আমায় এটা দিয়ে গেছেন।”

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ভদ্রলোককে মনে পড়ল। তেমন করে খুঁটিয়ে তো লক্ষ করেনি, তবু চেহারার একটা ছাপ যেন থেকে গেছে মনে।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কে ওই ভদ্রলোক?”

কিকিরা তখনোও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন ছোরার বাঁটটা, যেন তারিফ করছিলেন। কোনো জবাব দিলেন না।

চন্দন বলল, “কিকিরা স্যার, আপনি দিন দিন বড় মিস্টিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন।”

কিকিরা চোখ না-তুলেই রহস্যময় গলায় বললেন, “আমার চেয়েও এই ছোরার ইতিহাস আরও মিস্টিরিয়াস।”

চন্দন হেসে-হেসেই বলল, “আপনার চারদিকেই মিস্ত্রি, স্যার; একেবারে মিস্টিরিয়াস ইউনিভার্স হয়ে বসে আছেন।”

তারাপদ হেসে ফেলল। কিকিরাও মুখ তুলে হাসলেন।

এমন সময় চা এল। চা আর গরম গরম ডালপুরী।

কিকিরা শুধুই চা নিলেন। তারাপদ আর চন্দন যে যার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে খাবার আর চা নিয়ে বসল। চন্দনদের জন্যে প্রতি রবিবারেই কিকিরাকে কিছু না-কিছু মুখরোচক খাদ্যের ব্যবস্থা রাখতে হয়। রান্নাবান্নাতেও হাত আছে কিকিরার।

ডালপুরী খেতে খেতে চন্দন বলল, “তা ইতিহাসটা বলুন?”

 তারাপদরও ধৈর্য থাকছিল না। বলল, “ভদ্রলোক আপনার চেনা?”

কিকিরা বাক্সটা বন্ধ করে রেখেছিলেন আলগা করে। চা খেতে-খেতে বললেন, “ভদ্রলোক আমার চেনা নন, মানে তেমন একটা পরিচিত নন। গত পরশু দিন আগে এক জায়গায় আলাপ হয়েছিল।”

“কী নাম?” তারাপর আবার জিজ্ঞেস করল।

“দীপনারায়ণ। দীপনারায়ণ সিং।”

“কোথায় থাকেন?”

“এখন কয়েক দিনের জন্যে রয়েছেন পার্কসার্কাসে।”

 চন্দন বলল, “ভদ্রলোকের চেহারায় একটা আভিজাত্য আছে।”

কিকিরা বললেন, “রাজ-রাজড়ার বংশধর, চেহারায় খানিকটা রাজ-ছাপ থাকবেই তো।”

তারাপদ বলল, “আপনার এই ক্রমশ আর ভাল লাগছে না কিকিরা, স্পষ্ট করে বলুন ব্যাপারটা।”

কিকিরা আরাম করে কয়েক চুমুক চা খেলেন। তারপর বললেন, “আগে কোনটা শুনবে, বংশের ইতিহাস, না ছোরার ইতিহাস? দুটোই দরকারি, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা বোঝা যাবে না। আগে বংশের ইতিহাসটা বলি, ছোট করে।” কিকিরা একটু থামলেন, তাঁর জোব্বা থেকে সরুমতন একটা চুরুট বের করে ধরালেন। ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন, “দীপনারায়ণের চার পুরুষের ইতিহাস শুনে তোমাদের লাভ হবে না। আমার আবার ওই বাবার বাবা তার বাবা–ওসব মনে থাকে না। সোজা কথাটা হল, আগেকার দিনে যারা ধন-সম্পত্তি গড়ে তুলতে পারত তারা এক-একজন রাজাগজা হয়ে উঠত সমাজে। দীপনারায়ণের কোনো পূর্বপুরুষ মুসলমান রাজার আমলে এক সেনাপতির সৈন্যসামন্তর সঙ্গে বিহার বাংলা-ওড়িশার দিকে হাজির হন। সৈন্যসামন্তরা যুদ্ধটুদ্ধ সেরে যখন ফিরে যায় তখন আর তাঁকে নিয়ে যায়নি। কেন নিয়ে যায়নি–তা জানা যায় না। হয় কোনো দোষ করেছিলেন তিনি, না হয় কোনো রোগটোগ হয়েছিল বড় রকমের। সেই পূর্বপুরুষই ওদিকে একদিন দীপনারায়ণদের বংশ স্থাপন করেন। তারপর দু পুরুষ ধরে মস্ত জমিদারি গড়ে তুলে, জঙ্গলের মালিকানা কিনে নিয়ে অনেক ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বে ছোট বড় রাজার তো অভাব ছিল না বাপু, দীপনারায়ণের বাপ-ঠাকুরদাও সেই রকম ছোটখাট রাজা হয়ে বসেছিলেন। দীপনারায়ণের বাবার আমলে সাহেব কোম্পানিরা কতকগুলো জায়গা ইজারা নেয়। মাটির তলায় ছিল সম্পদ-মিনারেলস। দীপনারায়ণের বাবা আদিত্যনারায়ণ ইজারার টাকাতেই ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে যান। ভদ্রলোক মারা যান শিকার করতে গিয়ে বন্দুকের গুলিতে।…এই ছোরাটা হল তাঁর–আদিত্যনারায়ণের। এ-দেশি ছোরা এরকম হয় না, এ-ছোরা বিদেশি। হয় তিনি বিদেশ থেকে তৈরি করে আনিয়েছিলেন–না হয় এদেশের কোনো বিদেশি কারিগর তাঁকে ছোরাটা তৈরি করে দিয়েছিল। আগেকার দিনে য়ুরোপ-টুরোপ-এ যখন তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ হত, তখন এই রকম সব ছোরাছুরি কোমরে গোঁজার রেওয়াজ ছিল। আদিত্যনারায়ণ অবশ্য কোমরে গুঁজতেন না। রাজবাড়িতে নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। রাজবংশের ওটা পবিত্র সম্পদ।”

তারাপদ আর চন্দন মন দিয়ে কথা শুনছিল কিকিরার। চন্দন তার ডালপুরী শেষ করে ফেলল। তারাপদ ধীরে-সুস্থে খাচ্ছে।

কিকিরা বললেন, “এই ছোরাটাকে দীপনারায়ণেরা বিগ্রহের মতন মনে করেন, মান্য করেন। তাঁদের বিশ্বাস এই ছোরার দৈবশক্তি রয়েছে। কিংবা দৈবগুণ বলতে পারো। আমরা সোজা কথায় যাকে বলি মন্ত্রঃপূত, এই ছোরাও তাই। দীপনারায়ণ বলেছেন, কখনো কোনো কারণে যদি কেউ প্রতিহিংসার বশে, কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে এই ছোরা দিয়ে আহত করেন, খুন করেন–তা হলে এই ছোরার মুখ থেকে রক্তের দাগ কোনোদিনই, হাজার চেষ্টাতেও উঠবে না। আর প্রতিদিন, একটু একটু করে, ছোরাটা ভোঁতা হয়ে যাবে, ছোট হয়ে যাবে।”

তারাপদ বলল, “সে কী!”

 চন্দন অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গাঁজাখুরির আর জায়গা হল না। দীপনারায়ণ আপনাকে ব্লাফ ঝেড়েছে।”

কিকিরা চন্দনকে দেখতে-দেখতে বললেন, “সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। আগে দীপনারায়ণ যা বলছেন সেটা শোনা যাক।”

“কী বলছেন তিনি?” চন্দন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের গলায় বলল।

 কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ বলছেন, গত এক মাসের মধ্যে তাঁদের পরিবারে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণ খুন হয়েছেন।”

তারাপদ আঁতকে উঠে বলল, “খুন?”

কিকিরা বললেন, “এই ঘটনা ঘটে যাবার পর–খুবই আশ্চর্যের কথা–এই ছোরার বাক্স থেকে কেউ ছোরার ফলাটা খুলে নিয়েছে, শুধু বাঁটটা পড়ে আছে।”

চন্দন বলল, “তার মানে আপনি বলতে চান, দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছে এই ছোরা দিয়ে? খুন করে ফলাটা খুলে নিয়েছে?”

মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ তাই মনে করেন। তাঁর ধারণা, যে জয়নারায়ণকে খুন করেছে সে এই ছোরা রহস্যটা জানে। জানে যে, ছোরার ফলা থেকে রক্তের দাগ মুছবে না–হাজারবার জলে ধুলেও নয়। তা ছাড়া ছোরার ফলাটা ক্রমশই ক্ষয়ে আসবে। কাজে-কাজেই পুরো ফলাটাই সরিয়ে ফেলেছে।”

“কিন্তু আপনি কি বলতে চান–এই ছোরার বাঁট থেকে ফলাটা খুলে ফেলা যায়?”

“যায়,” মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “তোমরা ভাল করে ছোরাটা দেখলে বুঝতে পারতে বাঁটের নিচের দিকে সরু ফাঁক আছে। ওই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ফলা গলিয়ে–দু দিকের স্প্রিং টিপলে ফলাটা আটকে যায়।”

চন্দন এবার একটু চুপ করে থাকল। চা খেতে লাগল।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কিডনি নাম হল কেন?”

কিকিরা বললেন, “ছোরার ওপর দিকের গড়নটা মানুষের কিডনির মতন। দু দিকে দুটো বরবটির দানা বা বিচির মত জিনিস রয়েছে, অবশ্য বড় বড় দানা, প্রায় ইঞ্চিটাক। এটা দু রকম কাজ করে। স্পিংয়ের কাজ করে, আবার ছোরা ধরার সময় ধরতে সুবিধেও হয়।

চন্দন রসিকতা করে বলল, “বোধ হয় মানুষের কিডনি ফাঁসাবারও সুবিধে হয়–কী বলেন কিকিরা? নামটাও তাই কিডনি ড্যাগার।”

কিকিরা কোনোরকম উচ্চবাচ্য করলেন না।

সামান্য চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পরিষ্কার হয়ে নিই। রাজবাড়ির পুরনো ইতিহাস এখন থাক। আসল ব্যাপারটা কবে ঘটেছে, কিকিরা?”

“মাসখানেক আগে।”

“রাজবাড়িতে?”

“হ্যাঁ। রাজবাড়ির লাইব্রেরি-ঘরে।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“তা কেমন করে বলব! কেন খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সেটাই তো জানার জন্যে এত–!”

চন্দন পাকা গোয়েন্দার মতন ভুরু কুঁচকে বলল, “রাজবাড়িতে কে কে থাকে?”

“রাজপরিবারের লোকরা। দীপনারায়ণের এক অন্ধ কাকাও আছেন-ললিতনারায়ণ। আদিত্যনারায়ণের বৈমাত্র ভাই।”

“জন্মান্ধ?”

“না, মান্সঙ্কয়েক হল অন্ধ হয়েছেন। খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে।”

“বোগাস। ওরকম শোনা যায়, আসলে অন্য কোনো রোগ ছিল চোখের।”

“কাকার কেমন বয়েস?”

“ললিতনারায়ণের বয়স ষাটের কাছাকাছি। জয়নারায়ণের বছর বত্রিশ।”

“দীপনারায়ণ নিশ্চয় বছর-পঁয়তাল্লিশ হবেন?”

“আর একটু কম। বছর চল্লিশ। দীপনারায়ণের পর ছিলেন তাঁর বোন। তিনি এখন শ্বশুরবাড়ি মধ্যপ্রদেশে থাকেন।”

তারাপদ চা খাওয়া শেষ করে মুখ মুছল। বলল, “ছোরাটা থাকত কোথায়?”

“রাজবাড়িতে, দীপনারায়ণের ঘরে, সিন্দুকের মধ্যে।”

“কবে দীপনারায়ণ জানতে পারলেন ছোরার ফলা চুরি হয়েছে?”

কিকিরার চুরুট নিবে গিয়েছিল। চুরুটটা আঙুলে রেখেই কিকিরা বললেন, তা জয়নারায়ণ খুন হবার আট-দশ দিন পরে।”

“কেন? অত দিন পরে জানলেন কেন?”

কিকিরা বললেন, “জয়নারায়ণ যে ভাবে খুন হয়েছিলেন, তাঁকে যে ভাবে লাইব্রেরি ঘরে পাওয়া গিয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল, ওটা দুর্ঘটনা। পরে একদিন আচমকা ছোরার বাক্সটা খুলতেই তাঁর চোখে পড়ে, ছোরার বাঁট আছে, ফলাটা নেই। তখন থেকেই তাঁর সন্দেহ।”

চন্দন বলল, “পুলিশকে জানিয়েছেন দীপনারায়ণ?”

“না। পুলিশ দুর্ঘটনার কথা জানে। অন্য কিছু জানে না। দুর্ঘটনায় জয়নারায়ণ মারা গেছেন এই কথাটাই ছড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ওই জঙ্গল-অঞ্চলে কোথায় পাচ্ছ তুমি থানা পুলিশ কলকাতার মতন। ওসব জায়গায় ডেথ সার্টিফিকেটও নেই, পোস্টমর্টেমও নেই। তার ওপর রাজবাড়ির ব্যাপার।”

তারাপদ বলল, “দীপনারায়ণের কথা আপনি বিশ্বাস করেছেন?”

 কিকিরা বললেন, “বিশ্বাস-অবিশ্বাস আমি কোনোটাই করিনি। আমার কথা হল, কোনো দলেই ঝুঁকবে না। একেবারে মাঝামাঝি থাকবে। যখন দেখবে বিশ্বাসের দিক টানছে তখন বিশ্বাসের দিকে টলবে, যদি অবিশ্বাসের দিক টানে তবে অবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকবে। আমার হল চুম্বকের কাঁটা–যেদিকে টানবে সেদিকে ঝুঁকব।”

চন্দন বলল, “আপনি যাই বলুন আমি বিশ্বাস করি না, কোনো ছোরার ফলার ওসব গুণ থাকতে পারে! এ একেবারে গাঁজাখুরি। ব্লাফ।”

কিকিরা চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। আস্তে-আস্তে টানলেন। তারপর বললেন, “স্যান্ডাল উড়, আমাদের এই জগতে কত কী অদ্ভুত-অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে তার সব কি আমরা জানি। জানলে তো ভগবান হয়ে যেতুম।”

“আপনি তা হলে বিশ্বাস করছেন যে এমন ছোরাও আছে যার গায়ে রক্তের দাগ পড়লে মোছে না? আপনি বিশ্বাস করছেন, ইস্পাতেও ক্ষয় ধরে?”

মাথা নেড়ে নেড়ে কিকিরা বললেন, “আমি বিশ্বাস করছি না। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে তারা কেন করে, সত্যিই তার কোনো কারণ আছে কিনা সেটা আমি খুঁজে দেখতে চাই।”

চন্দন চুপ করে থেকে বলল, “বেশ, দেখুন।…আপনি তা হলে গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন?”

“মাথা খারাপ নাকি তোমার। আমি হলাম ম্যাজিশিয়ান। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান। গোয়েন্দারা কত কী করে, রিভলবার ছেড়ে, নদীতে ঝাঁপ দেয়, মোটর চালায়; আমি তো রোগা-পটকা মানুষ, পিস্তল রিভলবার জীবনে হাতে ধরিনি।..তা ওসব কথা থাক। কথা হচ্ছে আগামী পরশু কি তরশু আমি তারাপদকে নিয়ে একবার দীপনারায়ণের রাজবাড়িতে যাচ্ছি! তুমি কবে যাচ্ছ?”

চন্দন অবাক হয়ে বলল, “আপনি যাচ্ছেন তারাপদকে নিয়ে?” কিকিরা বললেন, “দিন দশ-পনেরো রাজবাড়ির ভাত খেয়ে আসব। মন্দ কী।”