৭. ফরাসি বৈজ্ঞানিক ভিকতর জ্যাকমোঁর চিঠি ১৮২৯-৩০

ফরাসি বৈজ্ঞানিক ভিকতর জ্যাকমোঁর চিঠি ১৮২৯-৩০

জ্যাকমোঁর চিঠি

[১৮২৯ সালের এপ্রিল মাসে জ্যাকমোঁ ভারতবর্ষে পন্ডিচেরিতে এসে পৌঁছল। কলকাতায় আসেন মাসখানেক পরে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ১৮৩০ সালে ২৬ আগস্ট চীন—ভারত সীমান্তের শিবির থেকে তিনি তাঁর পিতাকে যে চিঠি লেখেন, তার মধ্যে প্রসঙ্গত কলকাতা শহরে প্রথম উপস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দেন। তা দেওয়ার কারণ হল, কলকাতা থেকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিখানি পিতার হাতে পৌঁছয়নি, বোধহয় সমুদ্রপথে খোয়া গিয়েছিল। কাজেই দীর্ঘদিন পরে হলেও পিতার চিঠিতে তিনি কলকাতার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে চিঠি থেকে কেবল কলকাতার প্রসঙ্গটুকু উল্লেখ করা হল।]

সুদূর ভারত—চীনের সীমান্ত থেকে আবার আমাকে কলকাতা শহরে ফিরে যেতে হচ্ছে। কলকাতার বিবরণ দিয়ে যে চিঠি আগে লিখেছিলাম তা তোমার হাতে পৌঁছয়নি জেনে দুঃখিত হলাম। ৫ মে ১৮২৯ তারিখে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের ঘাটে আমাদের তরী ভিড়ল। তরীটি অবশ্য ‘হিজ মোস্ট ক্রিশ্চান ম্যাজেস্টির’ একটি ‘লগ’ (log)। তরী থেকে যথারীতি কামানের অভিনন্দন—ধ্বনি করা হল। পরদিন প্রাতঃকালে মহানগরে পদার্পণের ব্যবস্থা করলাম। পন্ডিচেরি থেকে যে পর্তুগিজ ভৃত্যটিকে সঙ্গে এনেছিলাম, তাকে বললাম একটি পাল্কি ঠিক করে আনতে। পাল্কি আসার পর আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত করে তরী থেকে বিদায় নিলাম। পাল্কির ছোট্ট খোপটির মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে বেয়ারাদের বললাম, ‘পির্সন সাহেবকা ঘরমে।’ বাজারি হিন্দুস্থানি ভাষা বটে, কিন্তু এইটুকু রপ্ত করতে পন্ডিচেরি থেকে কলকাতা পর্যন্ত সারা পথ আমাকে তা আওড়াতে হয়েছে।

হনহন করে পাল্কি চলল বেহারাদের কাঁধে ভর দিয়ে। দেখতে দেখতে পিয়ারসন (তদানীন্তন অ্যাডভোকেট—জেনারেল) সাহেবের বৃহৎ প্রাসাদতুল্য কুঠির কাছে পৌঁছলাম। বেশি দূরে নয়, নদীর খুব কাছেই সাহেব থাকতেন। পাল্কি থেকে নেমে দেখি, সামনে দু’দিকে সারবন্দি হয়ে ভৃত্যশ্রেণি দণ্ডায়মান, বিশাল প্রশস্ত সিঁড়ির দুইপাশে। সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরে উঠে, ভৃত্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিরাট একটি হলঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। হলঘরটি সাহেবের বৈঠকখানা। তার মধ্যে তিনজন মহিলা সেজেগুজে প্রসাধন করে বসে আছেন, আর একজন পক্বকেশ ভদ্রলোক রয়েছেন হালকা রঙের সুতির পোশাক পরে। বিচিত্র রকমের ঝলমলে সব হাতপাখা দিয়ে ভৃত্যরা তাঁদের হাওয়া করছে। তাঁদের কাছে দূত আমার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাদনের ভঙ্গিতে ঘরে প্রবেশ করলাম। কালো পোশাকে ঢাকা আমার লম্বা চেহারা দেখে হঠাৎ তাঁরা বজ্রাহতের মতন নির্বাক হয়ে গেলেন। তাঁদের বোধহয় মনে হল, ভূতের আবির্ভাব হয়েছে। তার উপর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এখানকার এইসব তাজ্জব দৃশ্য দেখে আমার বাকশক্তিও রহিত হয়ে গেল। মাতৃভাষা আমার ফার্সি, চর্চিত ভাষা ইংরেজি। কাজেই ইংরেজির ভিত পাকা নয়, হঠাৎ ‘শক’ পেয়ে তা একেবারে গুলিয়ে গেল। কৃষ্ণবেশ ভূতটিকে দেখে যখন তাঁরা হতভম্ব হয়ে গেলেন, তখন ভূতের মুখ দিয়েও কিছুক্ষণ কোনো কথা বেরুল না। উত্তেজক কোনো পদার্থ পান করলে যদি আমার বাকতরী পাল তুলে বয়ে যেত, তাহলে অর্থের বিনিময়ে না—হয় তা—ও এক গ্লাস পান করে নিতাম। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই যখন বাকনিঃসরণ হল না তখন গৃহস্বামীর সবিনয়ে বললাম, ‘আগে একটু—আধটু ইংরেজিতে কথা বলেছি স্যর, কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে যেন সব ভুলে গেছি। এই মহাসঙ্কট থেকে আপনারা আমাকে উদ্ধার করুন।’ শুভ্রকেশ ভদ্রলোকটি তা—ই করলেন, মহিলা তিনজনও উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন তরুণীর দেখলাম উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। আশ্চর্য ব্যাপার। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাকশক্তি স্ফুরণ হল। নদীর স্রোতে ছোট মাছের মতন ইংরেজি ভাষায় সাঁতার দিতে লাগলাম। অনর্গল ধারায় ইংরেজির প্রবাহ আরম্ভ হল।

ড্রয়িং রুমে বসে ছিলেন মিস্টার পিয়ারসন, মিসেস পিয়ারসন, তাঁদের কন্যা ও তাঁর সঙ্গিনী বা গবর্নেস। আমার পরিচয়পত্রগুলি যথারীতি তাঁদের দেখালাম। দেখেশুনে তাঁরা আমাকে একজন মাননীয় অতিথি হিসেবেই গ্রহণ করেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোনো পত্র আমার কাছে আছে কি না। একটি বড় প্যাকেটভরা পকেট দেখিয়ে আমি বললাম, এগুলি সবই পরিচয়পত্র। তারপর সেগুলি খুলে একে—একে নাম পড়তে লাগলাম। প্রথমে মিস্টার, ডক্টর, মার্চেন্ট, ক্যাপ্টেন প্রভৃতি থেকে আরম্ভ করে, ধীরে ধীরে জজ, প্রধান জজ ও কাউন্সিলের সদস্যদের নাম করে শেষে লেডি বেন্টিঙ্ক ও গবর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নাম পাঁচবার উচ্চারণ করলাম। শ্রোতাদের উপর নামের ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া লক্ষ করে এই চালাকিটুকু আমাকে করতে হল। নাম যত উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে আমার মুখ দিয়ে ধ্বনিত হতে থাকল, ততই আমার মাননীয় শ্রোতারা চক্ষু বিস্ফারিত করে আমার দিকে এগুতে থাকলেন। আমার ভৌতিক মূর্তি মানুষের রূপ ধারণ তো করলই, অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁদের চোখের সামনে বিরাট গণ্যমান্য পুরুষের আকারে পর্যবসিত হল।

বেলা এগারোটা বাজতে পিয়ারসন সাহেব আমাকে বললেন, ‘আমার সুপ্রিমকোর্টে যাবার সময় হয়েছে, আর আমি দেরি করতে পারছি না। আপনি যাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চান তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। তবে আমার মেয়ে রইল, সে আপনাকে যত দূর সম্ভব এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।’ এই কথা বলে তিনি আমায় করমর্দন করে চলে গেলেন। মিস পিয়ারসন বললেন যে সর্বপ্রথম আমার লাটপ্রাসাদে যাওয়া উচিত। আমাকে না জানিয়েই তিনি লেডি বেন্টিঙ্কের কাছে একখানি চিঠিও পাঠিয়ে দিলেন। ভব্যতা অনুযায়ী চিঠির উত্তর সোজা আমার কাছেই এল, ‘এ—ডি’, দিয়ে গেলেন মিনিট পনেরোর মধ্যে এবং বলে গেলেন যে লেডি বেন্টিঙ্ক আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার জন্য একটা ভাল কোচগাড়ির মোতায়েন ছিল, তার সামনে ও পিছনে পদাতিকের দল তৈরি হয়েছিল দৌড়বার জন্য। গাড়িতে চড়ে লাটপ্রাসাদে পৌঁছলাম, ‘এ—ডি’ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে সোজা লেডি উইলিয়ামের নিজের ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। দেখে মনে হল তাঁর বয়স পঞ্চাশ হবে, একটা সময় যে খুবই সুন্দরী ছিলেন তা—ও বোঝা যায়, তবে এখন আর যৌবনের কোনো জলুস নেই। লর্ড আশলে আমাকে তাঁর পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হল। তারপর তাঁর চিকিৎসক ও একজন অতিথি এলেন তাঁকে জলযোগের ঘরে আহ্বান করে নিয়ে যাবার জন্য। চিকিৎসক ভদ্রলোকটিকে তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর স্বামীর কাছে পাঠালেন, নবাগত অতিথির বার্তা জানিয়ে। কয়েক মিনিটের পরে আমি জলযোগের ঘরে প্রবেশ করে তাঁর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়েছি, এমন সময় ঠিক সামনের দিক থেকে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে সচিববৃন্দ ও কাউন্সিলের দু’জন সদস্য। সেদিন কাউন্সিলের বৈঠক ছিল। লেডি উইলিয়াম সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতন আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। গবর্নর—জেনারেল বেন্টিঙ্কের ডানদিকে আমি বসলাম, খাবার দেওয়ার সময়টুকুর মধ্যে তিনি আমার পাঁচখানি পরিচয়পত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের চারদিকে সকলে উঠে দাঁড়ালেন এবং উইলিয়াম তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। লেডি উইলিয়ামকে আবার তাঁর কক্ষে আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম এবং তাঁর কাছে রাত্রি আটটায় খেতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম।

পিয়ারসনরা এদিকে আমার এত দেরি দেখে বেশ একটু বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁদের গৃহে ফিরে দেখি, বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর দু’খানি আমার থাকার জন্য তাঁরা ঠিকঠাক করে রেখেছেন। লর্ড ও লেডি বেন্টিঙ্কের আদর—আপ্যায়নের গল্প বলার জন্য যখন আমি ঘরে গিয়ে বসলাম, তখন একদল ভৃত্য পাখা হাতে করে হাওয়া দিয়ে আমাকে ঠান্ডা করার জন্য মক্ষিকার মতন ঘিরে ধরল। অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে নিস্তার পেলাম। বিকেল পাঁচটার সময় পিয়ারসন সাহেব কোর্ট থেকে ফিরে এসে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলেন এবং তাঁর পেশা ও সাংসারিক জীবনের কাহিনিও অনেক বললেন। আমিও আমার কথা বললাম, এবং শেষে সেদিন সন্ধ্যায় লেডি উইলিয়ামের ডিনারের নিমন্ত্রণের কথাও সসংকোচে জানিয়ে দিলাম। আমার মতন একজন গণ্যমান্য অতিথি পেয়ে তিনি বেশ খুশিই হয়েছেন বলে মনে হল। ছ’টা বাজতে গাড়িতে করে স্ত্রী—কন্যাসহ আমাকে নিয়ে তিনি বেড়াতে বেরুলেন। সূর্যাস্তের পর গাড়ি করে একচক্র ঘুরে আসা কলকাতার ইয়োরোপীয় বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক কর্ম। ডিনারের সময় হলে তাঁরা বাড়িতে ফেরেন। ফিরে এসে পোশাক—পরিচ্ছদ পাল্টে গাড়ি করে আবার লাটপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করলাম।

লেডি উইলিয়ামের ড্রয়িং রুমে নিমন্ত্রিতদের সমাবেশ হয়েছিল। আমিই অবশ্য প্রধান অতিথির সম্মান পেলাম, এবং লেডি উইলিয়ামের পাশের আসনটিতে খেতে বসলাম। চারদিকে যা আয়োজন দেখলাম তা সবই রাজকীয় ও এশিয়াটিকে, কেবল ডিনারটি ফরাসি স্টাইলের। ফ্রান্সের মতন এখানেও দেখলাম, পরিমিত মাত্রায় সুস্বাদু সুরাপানের ব্যবস্থা রয়েছে, এবং সোনালি বর্ডার দেওয়া লাল পাগড়ি মাথায়, সাদা পোশাক—পরা লম্বা দাড়িওয়ালা ভৃত্যরা সেই পানীয় পরিবেশন করছে। লর্ড উইলিয়াম আমাকে পান করতে অনুরোধ করলেন, আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে লেডির সঙ্গে পান করার অনুমতি চেয়ে তা গ্রহণ করলাম। লেডি উইলিয়াম নানাবিধ বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপে প্রবৃত্ত হলেন। ডিনারের দ্বিতীয় দফা খাদ্য পরিবেশনের আগে, আগ্রহ জাগানোর জন্য একজন ইটালিয়ান পরিচালিত চমৎকার জার্মান অর্কেস্ট্রাবাদন আরম্ভ হল, মোজার্ট ও রসিনির সিম্ফনি দিয়ে। দূর থেকে সেই সিম্ফনির মধুর ঐকতান, চারদিকের ঘরের মধ্যবর্তী বড় বড় স্তম্ভের পাশ দিয়ে বিচ্ছুরিত মৃদু আলোর আভাস, ডিনার টেবিলের উপরের আলোর ঝলমলানি, তার উপর বিচিত্র রঙের ফল—ফুলের সমারোহ, ফুলের সৌরভের সঙ্গে মিশ্রিত শ্যাম্পেনের সুগন্ধ—এসব মিলে পরিবেশটিকে যে কী অপরূপ করে তুলেছিল তা বর্ণনা করা যায় না। একটা নেশার আমেজ অনুভব করতে লাগলাম। সত্যি যে আমার কোনো নেশা হয়েছিল তা নয়। লেডি উইলিয়ামের সঙ্গে একদিকে যেমন খেতে খেতে ফরাসি ভাষায় শিল্প—সাহিত্য, চিত্রকলা ও সংগীত বিষয়ে আলোচনা করেছি, অন্যদিকে তেমনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় ফরাসি রাজনীতি নিয়েও আলাপ করেছি। লেডি উইলিয়ামের ড্রয়িং রুমে ফিরে গিয়ে কফি পান করেছি পাঁচ—ছ’কাপ। কথায় কথায় তাঁদের তরুণ চিকিৎসক ভদ্রলোকটিকে শারীরবিদ্যার নূতন তথ্যাদি সম্বন্ধে বেশ মাতিয়ে তুলেছি। এতক্ষণ কথাবার্তার মধ্যে আমি যে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী তা জানাবার কোনো সুযোগ পাইনি। এই অবকাশে, অন্তত বিদায় নেবার আগে, সেটা জানানো দরকার বলে মনে হল।

পরদিন পিয়ারসনের ঘোড়া দু’টিকে সারাদিন ঘুরিয়ে বেশ হয়রান করে ফেললাম। সকলের বাড়ি—বাড়ি ঘুরতে হল দেখা করার জন্য। সেদিনে সব শেষ হল না, পরের দিনও লাগল। গবর্নর—জেনারেলের ভোজসভায় যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁদের কাছেও একবার করে হাজরে দিতে হল। দিন পনেরো পর লর্ড উইলিয়াম বললেন, তাঁর সঙ্গে ব্যারাকপুরের বাগানবাড়িতে গিয়ে থাকতে। যাবার সময় লেডি উইলিয়াম অনুরোধ করলেন, তাঁর সঙ্গে হাতির পিঠে চড়ে যেতে। অনুরোধ রক্ষা করতে হল। হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া মানে চলন্ত পাহাড়ের মাথায় চড়ে যাওয়া। আমি ও লেডি বেন্টিঙ্ক দু’জনে সেই চলন্ত পাহাড়ের মাথায় বসে গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। ব্যারাকপুরের লাটপ্রাসাদের পাশে সুন্দর একটি বাংলোতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সারাদিন আমি সেখানেই থাকতাম, এবং আমার নিজের কাজকর্ম করতাম। মধ্যে মধ্যে বেলা দুটোর সময় মধ্যাহ্নভোজনের পর লেডি উইলিয়ামের ড্রয়িং রুমে বসে বৃষ্টি, ব্যাং—ব্যাঙাচি ও আবহাওয়া সম্বন্ধে গল্প করতাম। সারা বিকেলটা নিঃশব্দে কেটে যেত। সন্ধ্যার পর ডিনার খেয়ে কিছুক্ষণ সঙ্গীত শোনা হত। একটি বড় সোফায় একপাশে আমি এবং আর—একপাশে লর্ড বেন্টিঙ্ক বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করতাম। আমার আলোচ্য বিষয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে কিছুদিন আমি কাটিয়েছি। ওঁর ছিল ভারতবর্ষ। রাত প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত কথাবার্তা বলে আমি আমার বাংলোতে ফিরে যেতাম। এইভাবে কলকাতা শহরে আমার প্রথম কয়েকটা দিন কেটেছে।

[এই চিঠিখানির মধ্যে ভিকতর জ্যাকমোঁ তাঁর কলকাতায় আসার প্রথম কয়েকটা দিনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে লিখিত অন্যান্য চিঠিতে এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছাড়াও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই বিষয়গুলির যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদানমূল্য আছে বলে তার কিছু এখানে সঙ্কলন করে দেওয়া হল।]

এক বন্ধুর কাছে (Victory De Tracy) ১৮২৯, ১ সেপ্টেম্বর তারিখে কলকাতা থেকে তিনি লিখছেন :

এখানকার হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, লোকে এখানে ‘বাঁচার মতো বাঁচতে’ বা জীবনটাকে উপভোগ করতে আসে না। এখানকার সর্বস্তরের সমাজে এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। এখানে লোকে আসে কিছু একটা লাভ করার উদ্দেশ্য নিয়ে, তারপর তাই নিয়ে জীবনটাকে অন্য স্থানে উপভোগ করতে চায়। কলকাতা শহরে কোনো লোকের অবসর বলে কিছু নেই, সকলে সবসময় কর্মব্যস্ত। এই কর্মব্যস্ততার সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছেন এখানকার গবর্নর—জেনারেল, তারপর ধাপে ধাপে রয়েছেন চিফ জাস্টিস, অ্যাডভোকেট—জেনারেল প্রভৃতি। একমাত্র এই শ্রেণির উচ্চস্তরে সমাসীন ব্যক্তিরাই কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে একটু—আধটু লেখাপড়া করার অবসর পান। বাকি সকলে, বিশেষ করে যাদের বিদ্যাচর্চার কৌতূহল বা প্রতিভা বলে কিছু নেই, তাঁরা নির্বিকার আলস্যে কালাতিপাত করেন। এককথায় তাঁদের সমাজের আবর্জনা বলা যায় (জ্যাকমোঁ কলকাতার সাধারণ ইয়োরোপীয় সমাজের কথা বলছেন—বি)। অথচ কলকাতায় ইয়োরোপীয় বাসিন্দাদের তুলনায় নানা রকমের সাহিত্য—রাজনীতি বিষয়ে সাময়িকপত্র যথেষ্ট আছে বলা চলে। কিন্তু সেদিকে কারও বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

একজনমাত্র ব্যক্তি এশিয়াতে এসে ইয়োরোপের মানসম্ভ্রম রক্ষা করে চলেন দেখেছি, তিনি উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তিনি আজ মোগল বাদশাহের সিংহাসনে বসেও যে সহজ মানুষের মতন সাধারণ পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে সেপাই—সামন্ত না নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরা করেন, এবং গ্রামাঞ্চলের ছাতি বগলে করে পথ চলেন, তার জন্য এখানকার গোঁড়া ইংরেজরা বলাবলি করেন যে কোম্পানির ভারত—সাম্রাজ্য আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে। জীবনে অনেক বিপর্যয়, রাষ্ট্রবিপ্লব ও রক্তপাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে, কিন্তু তার মধ্যেও তিনি তাঁর মনুষ্যত্ববোধটিকে জাগ্রত রাখতে পেরেছেন। কূটনীতির পঙ্কিল আবর্তনের মধ্য দিয়েও তাঁকে জীবন কাটাতে হয়েছে, কিন্তু তার জন্য তাঁর মনের সারল্য এতটুকু নিষ্প্রভ হয়নি। প্রায় এক সপ্তাহ তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়েছে এবং সেই কয়েকদিনের মধুর স্মৃতি আমি ভুলতে পারব না কখনও। লেডি উইলিয়ামও খুবই অমায়িক ও মিষ্টভাষী মহিলা। তাঁর সঙ্গে ফরাসি ভাষায় নানা বিষয়ে আলাপ করতে পেরে আমি যে আনন্দ পেয়েছি তা বলা যায় না।

এই হল এখানকার ইয়োরোপীয় উচ্চসমাজের পরিচয়। যা—ই হোক, আমি অবশ্য ইংরেজদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত উদার ব্যবহার পেয়েছি। এবারে আমার নিজের কাজের খবর বলি। কলকাতায় এসে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত লেখাপড়ার কাজ ভাল করে আরম্ভ করতে পারিনি। কত বিষয় যে পড়বার, অনুসন্ধান করবার ও জানবার আছে তার ঠিক নেই। যার কাছ থেকে যা সাহায্য পাবার তা পেয়েছি ও পাচ্ছি। আমার বিরাট বসবার ঘরটির দেওয়ালগুলি ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রে ঢাকা। শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে প্রায়ই আমাকে যাতায়াত করতে হয়। কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে আমার জ্ঞাতব্য বিষয়ে যতরকম এই প্রকাশিত হয়েছে, কলম হাতে নিয়ে তা পড়া প্রায় শেষ করে ফেলেছি। অর্থাৎ নোট করে পড়েছি। এখন আমার বিশেষ গবেষণার বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কাজ করতে অসুবিধা হবে না।

সমস্ত কাজকর্ম ও পড়াশোনার মধ্যেও নিয়মিত প্রতিদিন কাশীর একজন পণ্ডিতের কাছে হিন্দুস্থানি ভাষা শিখতে আরম্ভ করেছি। এর আগে উইলিয়াম জোন্সের ফার্সি ব্যাকরণ আমার পড়া হয়ে গেছে। তাতে হিন্দুস্থানি শেখার সুবিধা হয়েছে আমার। ফার্সির সঙ্গে হিন্দুস্থানির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। মনে হয় ভাষাটা ফার্সি ও সংস্কৃতের একটা বিচিত্র সংমিশ্রণ। এই ভাষা রপ্ত করতে বেশ সময় লাগছে এবং তাতে আমার গবেষণাকাজের কিছুটা ক্ষতিও হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। এ দেশের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এ ভাষা জানা দরকার, তা না হলে সবসময় দোভাষী নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কলকাতার ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’ একটি বিশাল মনোরম উদ্যান, গঙ্গাতীরে সুন্দর পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির বিচিত্র গাছপালার এরকম বৃহৎ ল্যাবরেটরি বোধহয় আর কোথাও নেই। সারা ভারতবর্ষ সুদূর হিমালয় প্রদেশ, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চল থেকে নানা রকমের গাছপালা সংগ্রহ করে এনে এখানে লাগানো হয়েছে। একজন ড্যানিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এই বাগানের ডিরেক্টর। বিশ্বের প্রথম উদ্ভিদ বিজ্ঞানী মনে করে এ দেশের লোক তাঁকে খুব সম্মান করেন। তিনি বেশ মোটা বেতনও পান। প্রায় দু’বছরের ছুটি নিয়ে সম্প্রতি তিনি দেশে গেছেন, বাগানের দায়িত্ব এখন একজন কাউন্সিলের সদস্যের উপর রয়েছে। তিনি আমাকে বাগান থেকে গাছপালা বিষয়ে জ্ঞান সঞ্চয়ের সর্ববিধ সুযোগ দিয়েছেন। মাস দেড়েকের মধ্যে ভারতবর্ষের সব রকমের গাছপালা সম্বন্ধে একটা চলনসই জ্ঞানলাভ করতে পেরেছি বাগান থেকে। তার উপর বাগানের ডিরক্টেরের বাংলোর সঙ্গে চমৎকার একটি গাছপালা বিষয়ে বইপত্রের লাইব্রেরি থাকাতে আমার কাজকর্মের ও গবেষণারও খুব সুবিধা রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *