১৮. বটতলার সাহিত্য
প্রথম স্তবক
মধুরস কথা ভাই জানিবে তাহাতে
বান্ধা বটতলায় তারে দিয়াছি ছাপিতে।
আজেহর আলি
.
শোনা যায়, বউবাজারের এক অশ্বত্থ গাছের তলা ছিল চার্নক সাহেব ও অন্যান্য বণিকদের বিশ্রাম নেবার বৈঠকখানা। বাজারের কাছে, শিয়ালদহ—বউবাজারের মোড়ের মাথায় এই অশ্বত্থের ছায়ায় বসে জব চার্নক কয়েকটি গ্রামকে কলকাতা শহরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই অশ্বত্থ গাছটা আজ নেই, কিন্তু বৈঠকখানা নামটা রয়েছে এবং তার সঙ্গে অক্ষুণ্ণ রয়েছে এই অঞ্চলের সেই ঐতিহাসিক বাণিজ্যধারা। বউবাজারের এই অশ্বত্থ গাছের মতন সেকালের কলকাতায় আর একটি বিখ্যাত বট গাছ ছিল শোভাবাজারে। বাংলা দেশের অনেক দীর্ঘায়ু বট গাছের মতন, শোভাবাজারের বট গাছের একটা বাঁধানো চাতাল ছিল। সেই বাঁধানো বটতলায় কবিগানের আসর জমত প্রায়, নিধুবাবুর টপ্পা সুরে বটতলার পরিপার্শ্ব সরগরম হয়ে উঠত। শুধু তা—ই নয়, ছাপার অক্ষরে নবযুগের বাঙালির সাহিত্যসাধনার উদ্বোধনও হয় এই বটতলার আশপাশের ছাপাখানায়। বাঙালি হিন্দু—মসলমান প্রকাশক যাঁরা এই উদযোগপর্বে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁদের বংশধররা আজও হয়তো কেউ কেউ জীবিত আছেন এবং পুরুষানুক্রমে সেই প্রকাশকের ব্যবসায়ই করছেন। কিন্তু কলকাতার সম্ভ্রান্ত পাঠকরা আজ তাঁদের কোনো খোঁজই রাখেন না। তাঁদের বিজ্ঞাপনও কোনো সম্ভ্রান্ত পত্রিকায় ছাপা হয় না এবং প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনাও কোথাও করা হয় না। পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় ওলকপির বীজ ও রমণী—মনোহর ম্যাজিক আংটির বিজ্ঞাপনের পাশে আজ তাঁদের পরিচয় সীমাবদ্ধ এবং পঞ্জিকার বহুদূরবিস্তৃত গ্রাম্য পাঠকরাই তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। আজ তাঁরা কলকাতা শহরের ভদ্রলোকদের কালচারচক্রের বাইরে চিৎপুরের আনাচ—কানাচে নির্বাসিত।
কলেজ স্ট্রিট ও আজকের বটতলার মধ্যে আসলে ক্রস—কাজিনের সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়াশ্রিত কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের কালচার—অভিযান আজ সমুদ্যত। তার কাছে বটতলা আজ অবজ্ঞাত। যে—কোনো কুৎসিত সাহিত্য ও কদর্য ছাপা আজ কলেজ স্ট্রিটের কালচারবাগীশরা ‘বটতলার সাহিত্য’ বলে বিদ্রুপ করে থাকেন। কিন্তু কলেজ স্কোয়্যার অঞ্চলে হরেক রকমের ‘যৌন সাহিত্য’ ও পত্রিকাদির দিকে চেয়ে বটতলা শুধু মুচকি হাসে, বোবার মতন চুপ করে থাকে, কোনো উত্তর দেয় না। কলেজ স্ট্রিট থেকে বটতলা বেশি দূর নয়, কিন্তু মানসিক দূরত্বটা আজ অনেক বেশি। কলকাতার মধ্যবিত্ত কালচারের স্তরে স্তরে অনেক পলেস্তারা জমেছে, তারই তলার স্তরে বটতলা, উপরের স্তরে বর্তমান কলেজ স্ট্রিট। কলেজ স্ট্রিট যে বটতলারই বংশধর, আজও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বটতলা তাই শুধু বিদ্রুপের পাত্র নয়, তার একটা ইতিহাস আছে এবং একটা বিশেষ কালের সাহিত্যের ইতিহাসে তার একটা ভূমিকাও আছে। বিদ্রুপ করবার আগে কলেজ স্ট্রিটের ‘কালচার্ডদের’ সেটা জানা উচিত নয় কি?
প্রথমে ছাপাখানার কথা বলি, কারণ বাংলা দেশের ইতিহাসে বটতলার ছাপাখানা একটা রোমান্টিক অধ্যায় জুড়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বটতলার অভিযান শুরু হয়েছে বলা চলে। ১৮১৮—২০ সালের মধ্যে বটতলার প্রথম ছাপাখানা করেন বিশ্বনাথ দেব। তার আগে কলকাতায় অবশ্য আরও চার—পাঁচটি ছাপাখানা হয়েছিল এবং লং সাহেব বলেন যে, তার মধ্যে দেশি লোকের অন্তত চারটি প্রেস ছিল। এই চারটি প্রেসই হয়তো ‘হিন্দুস্থানি প্রেস’, ‘বাঙালি প্রেস’, ‘সংস্কৃত প্রেস’ ও ‘বিশ্বনাথের প্রেস’। সে যা—ই হোক, প্রেসের অবস্থা কিন্তু তখন খুব শোচনীয় ছিল। কারণ বাংলা হরফনির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের ছেনিকাটা বাংলা অক্ষর তখনও খুব উন্নত হয়নি। ১৭৯৮ সালের গোড়ার দিকে পঞ্চানন যে প্রথম বাংলা টাইপ—ফাউন্ড্রি কলকাতায় স্থাপন করেন (শুধু বাংলা দেশে নয়, সারা ভারতবর্ষে এই হল প্রথম দেশীয় ভাষায় টাইপ ফাউন্ড্রি), তা ছাড়া আর কোনো টাইপ—ফাউন্ড্রি তখন হয়েছিল কি না সন্দেহ। হলেও, পঞ্চাননের অক্ষরের চেয়ে বাংলা ছাপা অক্ষরের যে আরও উন্নতি হয়েছিল তা মনে হয় না। বটতলার ছাপাখানায় বাংলা বই এই অক্ষরেই ছাপা হত। মুদ্রণযন্ত্র ছিল তখন কাঠের, তা—ও নড়বড়ে, খুব মজবুত নয়। ছাপার সময় মনে হত, এই বুঝি যন্ত্রই খসে পড়ে। আজও চিৎপুর—আহিরিটোলার অলিগলিতে প্রায় এই ধরনেরই ছাপাখানা দু’চারটে খুঁজলে যে পাওয়া যায় না তা নয়। ছেনিকাটা ছাঁচে ঢালা অক্ষর সাধারণত খুব সূক্ষ্ম, সুতরাং অল্পদিনের ব্যবহারেই তা ভেঙে যেত। তা ছাড়া কাগজের কলও তখন এ দেশে হয়নি। ছাপার কাগজও ছিল জীর্ণ—শীর্ণ, মধ্যে মধ্যে ভাতের মাড় দিয়ে জোড়া। কম্পোজিটাররাও তখন খুব ওস্তাদ হননি এবং মাত্র এক টাকায় বড় চারখানা কোয়ার্টো পৃষ্ঠা তাঁরা কম্পোজ করে দিতেন। এহেন গলিতনখদন্ত কাষ্ঠযন্ত্রে, ছেনিকাটা ছাঁচে ঢালা হরফে, হাতে তৈরি জীর্ণ কাগজে বটতলার বই যে এখনকার মতন ঝকঝকে ছাপা হতে পারে না, তা সকলেই বোঝেন। তাই ভুল ছাপা তো হতই, এমনকি বিসদৃশ ছাপা হওয়াও আশ্চর্য নয়। বটতলার ছাপাকে লক্ষ করে একটা বিদ্রুপাত্মক প্রবচন তাই এককালে চালু হয়েছিল। সেই প্রবচনটি হল এই :
‘শবল কাবল ভূষি ভূষি সে কাবল’
হয়তো মনে হবে, এ আবার কী? বটতলার ছাপা, আর কিছু নয়। ‘ক’ অক্ষরের ধারের লেজটা অনেক সময় চাপের চোটে খসে যায়: ‘শ’ ও ‘স’ যদি যথেষ্ট না থাকে তাহলে যথাস্থানে বদলে যদৃচ্ছা ব্যবহার করতেই হয়, ‘র’ অক্ষরে মধ্যের পেটটি কাটা, কিন্তু সেটা ক্ষয়ে যায়; গলিঘুপচির অন্ধকারের মধ্যে বসে ছেনিকাটা ‘ভ’ ও ‘ত’ হরফের পার্থক্য সবসময় বোঝা যায় না এবং ‘ম’ যদি কম পড়ে যায় তাহলে ‘য’ দিয়ে কোনোরকমে তার কাজটা চালিয়ে নিতে হয়। যখন এত কিছু ঘটে এবং এত ব্যাপার করতে হয় তখন—’সকল কারণ তুমি, তুমি সে কারণ’ কপি থেকে ছাপা হয়ে বাইরে প্রকাশিত হয়—’শবল কাবল ভূষি ভূষি সে কাবল’ রূপে। তা হোক, তবু এই ‘ভূষি ভূষি’ ছাপা পড়েই একসময় আমাদের দেশের সাধারণ লোক সাহিতসম্পদের আস্বাদ কী তা বুঝতে পেরেছেন এবং ছেনিকাটা হরফে ভুল—ছাপা কৃত্তিবাস—কাশীরাম—মুকুন্দরাম—ভারতচন্দ্রর কাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত, প্রহ্লাদচরিত, কৃষ্ণমঙ্গল, রাধিকামঙ্গল ইত্যাদি পাঠ করে তাঁদের মনটা সরস ও সংস্কৃত হয়েছে। ১৮২০ সালে ছাপা বাংলা বইয়ের যে তালিকা লং সাহেব দিয়েছেন তাতে দেখা যায় উনিশখানা কাব্যের মধ্যে আটখানা বৈষ্ণব গ্রন্থ, তিনখানা শাক্ত—শৈব ও ভক্তিগ্রন্থ এবং চারখানা আদিরসাত্মক নিবন্ধ, যেমন আদিরস, রতিমঞ্জরী, রতিবিলাস ও রসমঞ্জরী। সুতরাং শুধু আদিরসাত্মক বই বটতলার প্রকাশকরা ছাপতেন ভাবলে ভুল হবে এবং প্রকাশকদের প্রতি অবিচার করা হবে। বটতলার প্রকাশকরা যদি ক্রমে আদিরসের দিকে বেশি নজর দিয়ে থাকেন তাহলে তার জন্য কলকাতার নব্যবাবুদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘খেউড়’ কালচারকেই দায়ী করতে হয় বেশি, প্রকাশকদের নয়। হঠাৎ—গজিয়ে—ওঠা কলকাতার নব্যবাবুদের বিকৃত রুচির খোরাক জোগাতে বাধ্য হয়েছেন বটতলার প্রকাশকরা, তার বেশি তাঁরা কিছু করেননি। তাঁদের আসল লক্ষ্য ছিল ছাপার অক্ষরে গ্রন্থাকারে বাংলা সাহিত্যকে জনসমাজে পৌঁছে দেওয়া এবং রাজদরবার ও পণ্ডিতসভায় সীমাবদ্ধ কারাজীবন থেকে তাকে মুক্ত করা।
ছেনিকাটা হরফে কাষ্ঠযন্ত্রে শুধু যে বই ছাপা হয়েছে বটতলায় তা নয়, পঞ্চানন কর্মকারের সুযোগ্য শিষ্য মনোহর মিস্ত্রী ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণ মিস্ত্রী কাঠখোদাই ব্লকে ছবি পর্যন্ত ছেপে তখন তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এইভাবে বটতলায় অনেকদিন ধরে যেসব ছবি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে, আজও তা দেখলে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা অনেকে চমকে উঠবেন ও লজ্জিত হবেন। এ ছাড়া শোনা যায়, বটতলায় নাকি বিশুদ্ধ হিন্দু মতেও বই ছাপা হত। বিখ্যাত লেখক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম যুগে বটতলার একজন অন্যতম প্রকাশক ছিলেন। তিনি যে শুধু ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ ছেপেছিলেন তা নয়, বিশুদ্ধ হিন্দু মতে ছেপেছিলেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ কম্পোজিটার এই ভাগবতগ্রন্থের টাইপ সেট করেছিল এবং বিশুদ্ধ গঙ্গাজল—সংযোগে ছাপার কালি তৈরি করা হয়েছিল। পুঁথির ধরনে বইখানা ছাপা হয়েছিল এবং পাটা সমতে তার অগ্রিম মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল তেত্রিশ টাকা, ছাপা হবার পর চল্লিশ টাকা। বটতলার তখন কয়েকজন মুসলমান প্রকাশকও ছিলেন, তবে তাঁরা বিশুদ্ধ মুসলমানি মতে কোনো ইসলামধর্মের গ্রন্থ ছেপেছিলেন কি না জানা যায় না।
‘তুমি তুমি’—র বদলে ‘ভূষি ভূষি’ ছাপা হলেও বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে বটতলার প্রকাশকদের একটা অবিস্মরণীয় দান আছে। এই প্রকাশকদের চেষ্টাতেই বাংলা ছাপা বইয়ের দাম ক্রমে আশাতীত পরিমাণে কমে যায়, মাত্র পঁচিশ—তিরিশ বছরের মধ্যে। প্রথমে বই ছাপা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ছিল, ছাপতে খরচ পড়ত যথেষ্ট এবং দামও ছিল বেশি। পরে বটতলার প্রকাশকদের অক্লান্ত চেষ্টায় বাংলা ছাপা বইয়ের দাম অনেক কমে যায় এবং তা বাংলার ঘরে ঘরে হাজার হাজারবাঙালি পাঠক—পাঠিকার হাতে পৌঁছয়। কয়েকটা তার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য বিশ্বনাথ দেবের প্রেসে যখন ছাপা হয় ১৮২৩ সালে, তখন তার দাম ছিল ছয় টাকা। পরে ১৮৫৬ সালে যখন কমলালয় প্রেসে ছাপা হয় তখন দাম হয় মাত্র এক টাকা। কালিদাস কবিরাজের ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ সমাচার চন্দ্রিকা প্রেসে ছাপা (১৮৩১ সালে), দাম দু’টাকা, পরে সুধাসিন্ধু প্রেসে ছাপা (১৮৫৬ সালে), দাম চার আনা মাত্র। কৃত্তিবাসের ‘আদিপর্ব’ রামকৃষ্ণ মল্লিকের প্রেসে ছাপা (১৮৩১ সালে), তিন টাকা, সুধাসিন্ধু প্রেসে ছাপা (১৮৫৬ সালে), মাত্র দুই আনা। পরবর্তীকালে অন্যান্য গাছতলায় অনেক প্রকাশক প্রথমে সুলভে বই ছাপার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, কিন্তু বটতলার প্রকাশকরা সবার আগে সকলের পথপ্রদর্শক। এইদিক দিয়ে বিচার করলে বটতলার প্রকাশকদেরই বাংলা দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রকাশক বলা চলে। বটতলার দৌলতেই বাংলা সাহিত্য প্রথম বাঙালির কাছে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া বটতলার প্রকাশকদের ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান বা ক্যানভাসারও ছিল। আধুনিক বিজ্ঞাপনের কায়দাকানুন তাঁরা জানতেন না, সামান্য যে দু’চারখানা পত্রিকা ছিল তার পাঠকসংখ্যাও এত অল্প ছিল যে, তাতে বিজ্ঞাপন দিলে বিশেষ কাজও হত না। তাই বটতলার প্রকাশকরা ক্যানভাস—এর উপরেই নির্ভর করতেন বেশি। বইয়ের বোঁচকা কাঁধে করে ক্যানভাসাররা শহরে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রাম্য মেলাগুলিরও তখন আজকের মতন অবনতি হয়নি। বটতলার পুস্তক—ক্যানভাসাররা এই গ্রাম্য মেলায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি ও প্রচার করতেন। তাঁদের রোজগারও নেহাত কম ছিল না। লং সাহেব একজন ক্যানভাসারের কথা বলেছেন যাঁর রোজগার ছিল মাসে প্রায় শতাধিক টাকা। গ্রামে গ্রামে বই ফিরি করবার সময় এই ক্যানভাসাররা সস্তা দামে এবং নতুন বইয়ের বিনিময়ে অনেক মূল্যবান পুঁথি সংগ্রহ করে এনেছেন, যা অনেক অনুসন্ধানী স্কলাররাও পরবর্তীকালে করতে পারেননি। বটতলার প্রকাশকরা না থাকলে তাঁদের ক্যানভাসারদের মাধ্যমে এত বড় মূল্যবান কাজটা হয়তো কোনোদিনই করা হত না এবং অনেক পুঁথি চালের বাতায় গোঁজা থেকে নষ্ট হয়ে যেত। বাংলা, সাহিত্যের প্রতি বটতলার প্রকাশক ও ক্যানভাসারদের এই যে আন্তরিক দরদ ছিল, কলেজ স্ট্রিটে আজ তা ক’জনের আছে?
দ্বিতীয় স্তবক
গ্রহন্ত গ্রাহক কারি যে জন হইবে
বটতলা আসিয়া সেই তল্লাস করিবে।
তিনশো পঁয়ত্রিশ নম্বর দোকান মাঝার
তালাস করিলে পাবে আবশ্বক জার।
এক্ষণ মালেক জেই হৈল কেতাবের
তাহারই নামেতে পুঁথি হৈল জাহের।
মফিজদ্দিন আহম্মদ
.
বটতলার প্রকাশকরা নিজেরাই বইয়ের শেষে এইরকম আত্মপরিচয় দিতেন। কবিরা যে দিতেন না তা নয়। গ্রন্থের মালিকানার ব্যাপারে প্রকাশক ও লেখকের মধ্যে কীরকম সম্পর্ক ছিল তা অবশ্যই স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু আন্দাজ করা যায় যে প্রকাশকরাই গ্রন্থের ‘সোল প্রোপ্রাইটর’ ছিলেন। একশো বছর আগের বটতলার প্রকাশকদের জন্য তার খুব দোষ দেওয়া চলে না, কারণ মাত্র কুড়ি—পঁচিশ বছর আগেও কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা এইভাবে মালিকানাস্বত্ব কিনে নিয়ে বইয়ের ব্যবসা করে অনেক লক্ষপতি হয়েছেন। সেইসব প্রকাশকদের গায়ে হয়তো বটতলার ছাপ নেই, হয়তো—বা তাঁরা পরবর্তীকালের কোনো বিখ্যাত প্রকাশক। কিন্তু গাছতলার, যে গাছতলাই হোক, সাংস্কৃতিক আভিজাত্য ভুয়ো। বটতলার প্রকাশকদের মালিকানাস্বত্ব সম্বন্ধে যে সচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়—’এক্ষণে মালেক জেই হৈল কেতাবের, তাহারই নামেতে পুঁথি হৈল জাহের’—সেই পরিচয় কলেজ স্ট্রিট, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, বহুবাজার স্ট্রিটের অনেক প্রকাশকের ‘প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত’ ঘোষণার মধ্যেও অত্যন্ত উগ্রভাবে পাওয়া যায়। অতএব বটতলার প্রকাশকদের এই মালিকানা প্রবৃত্তির জন্য কেবল বটতলার পরিবেশকে দায়ী করে কোনো লাভ নেই।
প্রকাশকদের সঙ্গে লেখকদের ব্যবসায়ের সম্পর্ক যা—ই থাকুক—না কেন, তাদের পরস্পরের মধ্যে যে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখনকার প্রকাশকদের ভাগ্যে লেখকদের প্রশস্তি পাওয়া রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। যদি কেহ পান তাহলে বলতে হবে যে, তিনি খুব ভাগ্যবান। বটতলার প্রকাশকরা কিন্তু এ বিষয়ে খুবই ভাগ্যবান ছিলেন। লেখকদের প্রশস্তি তাঁরা না চাইতেই অকৃপণভাবে পেতেন। শুধু কি টাকার জোরে পেতেন? ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো তাই পেতেন, কিন্তু সবসময় যে আর্থিক পেট্রন হিসেবে পেতেন, তা মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান কাজী সফিউদ্দিন বটতলার একজন অন্যতম প্রকাশক ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে কোনো কবি লিখেছেন :
কাজি সফিউদ্দিন নাম বড়া হোসমন্দ
কাজি দেলেরদ্দির তিনি জানহ ফরজন্দ!
জরুরি করিয়া তিনি কহিল আমায়
আম্বিয়া লোকেরা কেচ্ছা করা বাঙ্গালায়।
কাজটি অসমাপ্ত রেখে কবি মারা যান। পরে যিনি এই কাজের ভার দিলেন, তিনি লিখলেন—
বাকি যাহা ছিল তাহা সায়েরি করিতে
বলিলেন কাজিজি আমার খাতিরেতে।
কিন্তু এর পরে প্রকাশক মামলা—মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লেন, বই ছাপাতে দেরি হতে লাগল। কবি নিজেই সে কথা লিখে দিলেন পাঠকদের জন্য—*
কেতাব ছাপিতে নাহি গাফেলি তাহার
নাগেহালি হরকতে ছিলেন লাচার।
এখন করহ দোত্তা জত দিনরাত
দুস্মন জাহানে জেয়ছা না থাকে তাহার।
করিলেন শুরু ফের কেতাব ছাপিতে
আল্লা যদি করে দের না হবে এহাতে।
আধুনিক গাছতলার প্রকাশকরা হয়তো বলবেন যে, তাঁদের কথাও লেখকরা ভূমিকাতে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু সে লেখা আর এই লেখার মধ্যে পার্থক্য নেই কি? একালের বেলতলা ও সেকালের বটতলার মধ্যে পার্থক্য এইখানে যে, বেলতলার প্রকাশকদের কথা লেখকরা নেহাত অন্নের দায়ে ভদ্রতার খাতিরে উল্লেখ করেন, কিন্তু বটতলার লেখকরা শুধু সেই কারণে করতেন না। বটতলার লেখক ও প্রকাশকদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যেও যে একটা মানবিক সম্পর্ক ছিল, আজকের বেলতলার প্রকাশকদের সে কথা মধ্যে মধ্যে মনে করা উচিত। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, আধুনিক প্রকাশকদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাঁরা রুচিবান, প্রগতিশীল ও ‘হিউম্যান’ এবং প্রকাশনকে কেবল মুদির দোকানের ব্যবসা না মনে করে, একটা মহান সাংস্কৃতিক কর্তব্য বলেও তাঁরা মনে করেন। তাঁরা যে আধুনিক প্রকাশনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আজও আমাদের দেশে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য নয় কি?
বটতলার লেখকরা অবশ্য শুধু প্রকাশকদের কথা বলেই ক্ষান্ত হতেন না, নিজেদের কথাও বলতেন। নিজের কথা অথবা নিজের রচনার কথা বলতে তাঁরা মোটেই লজ্জিত হতেন না। কলকাতার কড়েয়া অঞ্চলের মুসলমান কবি আশরফ পরিষ্কার মুসলমানি বাংলায় জানিয়ে দিচ্ছেন—
কড়ায়্যাতে কসাইর মছজেদ আছে যেথা
মছজেদ সামেল বাটী জানিবেন সেথা।
বাড়িঘর কোথা ফকিরখানাতে গোজরান
এইতক হলে জানইনু মেহেরবান।
.
কড়েয়ার কসাইয়ের মসজিদের সামনের বাড়ি কবি আশরফের বাড়ি। তাতেও যদি কবির বাড়ি খুঁজে বার করতে কষ্ট হয় তাহলে ফকিরখানে ‘গোজরালেই’ তা নিশ্চিত জানা যাবে। কড়েয়ার কবির এই যে সৎসাহস, এ যেন আজকালকার কবি ও লেখকদের নেই বললেই হয়। আধুনিক লেখকরা নাম দিয়ে ধামটা গোপন করতে চান, নামধাম দুইই জানাতে চান না। অবশ্য বটতলার লেখকদের আধুনিক লেখকদের মতন সভাসমিতির ঠ্যালা সামলাতে হত না, এমনকি সমালোচকদের আক্রমণের ভয়ও তখন তাঁদের বিশেষ ছিল না। সুতরাং কড়েয়ার কবির মতন বুক ফুলিয়ে তাঁরা বাড়ির ঠিকানা জানাতে পারতেন। আধুনিক লেখকদের এই ভয়ই সবচেয়ে মারাত্মক ভয়, সুতরাং ঠিকানা গোপন করে তাঁরা যে খুব অন্যায় করেন তা মনে হয় না। দেশের আবহাওয়া বদলালে হয়তো লেখকরা সকলেই আবার বাড়ির ঠিকানা জানাবেন, তার আগে বটতলার কবিদের মতন সৎসাহস দেখানো বোধহয় সম্ভব নয়।
বটতলার প্রকাশকরা আর—একটি কাজ করতেন যাতে পাঠকদের যথেষ্ট উপকার হত বলে মনে হয়। যে বই তাঁরা প্রকাশ করতেন তার মধ্যে কী ‘মূল্যবান’ বিষয়বস্তু আছে তা তাঁরা নিজেরাই পাঠকদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন! এতে পাঠকদের পক্ষে অনেক দুর্বোধ্য রচনার পাঠোদ্ধার করার সুবিধা হত, লেখকরা দুর্নাম থেকে বাঁচতেন এবং পাঠকরাও গলদঘর্ম হতেন না। যেমন কেউ লিখেছেন—
কিবা আছে কেতাবেতে শুন ভাইজান
একে একে কহিতেছি করিয়া বয়ান।
হামদো নায়াত প্রথমেতে কেতাব লিখিল
ঈমানের বয়ান ফের খোলছা কহিল।
আর্বী—বাংলা হরফেতে লিখিলেক সব
পড়িয়া করহ ভাই আমলা এসব।
এ যে ঠিক লেখার ব্যাপার তা নয়, কতকটা হদিশ বলা যেতে পারে। এরকম হদিশ পেলেও অনেক কাজ হয়। আজকাল গদ্যগ্রন্থের পরিচয় অনেক সময় প্রকাশকরা দিয়ে থাকেন, অন্তত বিজ্ঞাপনে তো দেনই। কিন্তু মুশকিল হয় আধুনিক কাব্যগ্রন্থের বেলায়। প্রকাশকরা বিজ্ঞাপনে কিছুই বলেন না, কবিরা তো বলাটাকে অন্যায় বলেই মনে করেন। এর ফলে হয় কী, হয়তো অনেক ‘যুগান্তরী’ কাব্যগ্রন্থ পাঠকের পক্ষে ‘প্রাণান্তকর’ হয়ে ‘অপ্রিয়’ হয়ে ওঠে। তাই বলে আধুনিক প্রকাশকরা যে বটতলার প্রকাশকদের মতন পয়ার ছন্দে কাব্য—পরিচয় লিখে দেবেন, তা কেউ বলবেন না। তবু মনে হয় এমন কিছু আধুনিক কাব্যগ্রন্থ দু’চারখানা দেখা যায় যার শেষে রেফারেন্স নোট ও ‘গ্লসরি’ যোগ করে দিলে পাঠকদের সুবিধা হয়। পয়ার ছন্দে না লিখেও এইভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। তাতে প্রকাশকের বইও বিক্রি হয় এবং কবিরও সুনাম বাড়ে, সুতরাং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বটতলার এই আদর্শকে প্রকাশকদের আজও অনুসরণ করে চলা উচিত।
বটতলায় হিন্দু—মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই প্রকাশক ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট প্রীতির সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়। বটতলায় প্রধানত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান প্রকাশকরা এবং শিয়ালদহ ও মেছুয়াবাজার অঞ্চলে ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রকাশকরা। শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কম্পোজিটার গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং ‘সমাচারচন্দ্রিকা’র সম্পাদক ও বিখ্যাত সাহিত্যিক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বটতলায় হিন্দু প্রকাশকদের মধ্যে অন্যতম। আদিরসাত্মক গ্রন্থ প্রকাশে তাঁরা যথেষ্ট হাত পাকিয়েছিলেন। কেন পাকিয়েছিলেন, সে কথা পরে বলব। প্রকাশনক্ষেত্রে তাঁরা যদি কুরুচির পরিচয় দিয়ে থাকেন, তবে তার জন্য শোভাবাজারের তথা তাৎকালিক কলকাতার তালুকদারি ও বাবু—কালচারই অনেকটাই দায়ী, প্রকাশকরা সম্পূর্ণ দায়ী নন।
একটা কথা বলার দরকার এখানে। বটতলার হিন্দু প্রকাশকরাই ইসলামি বাংলা সাহিত্যের প্রচারে প্রধান পান্ডা ছিলেন। হিন্দু প্রকাশকরা যেমন বহু মুসলমান লেখকদের বই ছেপেছেন, মুসলমান প্রকাশকরাও তেমনি হিন্দু লেখক, এমনকি হিন্দু পণ্ডিতদের দিয়েও অনেক বই লিখিয়েছিলেন। বটতলার কালচারে আর যা—ই থাকুক, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো বিষ ছিল না তার মধ্যে। আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে হয়। বটতলার মুসলমান লেখকদের সংখ্যা হিন্দু লেখকদের চেয়ে বিশেষ কম ছিল না। যা—ই লিখুন—না কেন তাঁরা, মুসলমান লেখকদের তখন বেশ প্রাচুর্য ছিল। পরবর্তীকালে এই মুসলমান লেখকরা কলকাতা শহর থেকে কোথায় অন্তর্ধান করে গেলেন এবং কেন গেলেন? তাঁদের সংখ্যাই বা এত দ্রুত কমে গেল কেন? একদল প্রতিভাবান হিন্দু কবিয়াল যেমন হঠাৎ কিছুদিন কলকাতার সংস্কৃতিমঞ্চ সরগরম করে কোথায় সরে পড়লেন, আর খোঁজ পাওয়া গেল না, তেমনি একদল কড়েয়ার ও মেছুয়াবাজারের বাঙালি মুসলমান কবি হঠাৎ কিছুদিন জাঁকিয়ে কাব্য রচনা করে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন। মনে হয় যেন বাংলার লোকসংস্কৃতির শেষের ‘সেডিমেন্ট’ বা তলানিটুকু নতুন যুগপ্রবাহে কলকাতা মহানগরে এসে জমা হয়েছিল বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত, তারপর তার সমাধি রচিত হয়েছে এই কলকাতাতেই। বটতলা সেই শেষ সাংস্কৃতিক তলানির স্মৃতিটুকু বহন করছে।
.
তৃতীয় স্তবক
The truth is that an artist who demands appreciation from the public on his own terms and on none but his own terms, is either a god or a conceited and impractical fool. And he is somewhat more likely to be the latter than the former… The sagacious artist, while respecting himself, will respect the idiosyncracies of the public.
Arnold Bennet
শিল্পী ও সাহিত্যিক মাত্রেই লোকসমাজে বাহবা কামনা করেন। যশ বৈরাগ্যেণ বড়াই করাটাও আত্মপ্রচারের একটা কৌশলমাত্র। দেশে দেশে, কালে কালে সাধারণের রুচি বদলায়। ভোজনের রুচি, পোশাকের রুচি, শিল্প—সাহিত্যের রুচি। যুগে যুগে শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সেই লোকরুচি পরিতৃপ্ত করে থাকেন, কারণ তা না হলে লোকপ্রিয় হওয়া যায় না। তা যাঁরা করেন না তাঁরা আর্নল্ড বেনেটের ভাষায় হয় দেবতা, না—হয় নিরেট বোকা। পৃথিবীর সমস্ত শ্রেষ্ঠ শিল্পী কমবেশি তা—ই করে এসেছেন। আত্মমর্যাদা একেবারে না বিসর্জন দিয়েও তা করা যায়। ‘পাবলিক’ বলে সে পদার্থকে কেউ কেউ অবজ্ঞা করে থাকেন, তা অবজ্ঞার বস্তু নয়। আসলে কেউ কেউ একেবারে অবজ্ঞা করেন না, করতে সাহসও পান না। শেক্সপিয়র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কেউ তা করেননি। গ্যেটের মতন মহাকবিও তাই বলেছেন—
What were I without thee
O my friend, the public?
All my impressions monologues
Silent all my joys.
মহাকবি গ্যেটের সঙ্গে কলকাতার বটতলার কবির কোনো তুলনা করা শোভন নয়। শুধু এই কথা বলছি যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা যদি যুগধর্মের সেবা করে থাকেন, পরিবর্তনশীল লোকরুচির খোরাক জুগিয়ে লোকপ্রিয় হয়ে থাকেন, তাহলে বটতলার সাহিত্যিকরা তাঁদের কালে তাই করে এমন কিছু গর্হিত কাজ করেছেন বলে মনে হয় না।
অনেক রুচিবান সমালোচক বলেন, বিকৃতরুচি বটতলার সাহিত্যিকরা ও প্রকাশকরা নাকি ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছিলেন। হয়তো তা—ই উঠেছিলেন, কিন্তু ব্যাঙের ছাতাও তো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে না। গজাবার মতন আবহাওয়া থাকা চাই, মরশুম থাকা চাই। বটতলার সাহিত্য একটা মরশুমি ফুল এবং সেটা কলকাতা শহরের বিগত শতাব্দীর বিকৃত বাবু—কালচারের মরশুম। মরশুমটা কীরকম? তখনকার বটতলার পরিবেশ থেকেই বোঝা যায় : ‘শোভাবাজারের বটতলার পশ্চিমাংশে বড় একখানা আটচালা ছিল। নিধুবাবু প্রতিদিবস রজনীতে তথায় গিয়া সঙ্গীত বিষয়ে আমোদ করিতেন। নিমতলা নিবাসী সুবিখ্যাত বাবু শ্রীনারায়ণচন্দ্র মিত্র মহাশয় পক্ষীর দল করিয়া উক্ত প্রসিদ্ধ আটচালায় সর্বদা উল্লাস করিতেন, পক্ষীর দলের নিধুবাবুকে অত্যন্ত মান্য করিতেন। পক্ষীগণ আপন আপন গুণানুসারে নাম পাইতেন।’
শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণর কালেই নাকি ‘পক্ষীর দল’ গজিয়ে উঠেছিল। পক্ষীর দলের সৃষ্টিকর্তা শিবচন্দ্র ঠাকুর নাকি অনেককে কলকাতায় উড়তে শেখান। এঁদের একখানা পাবলিক আটচালা ছিল, সেইখানে এসে সকলে পাখি হতেন, বুলি ঝাড়তেন ও উড়তে শিখতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের কথা। তারপরই বোধহয় পক্ষীর দল ও বটতলার আড্ডা দুইই উঠে যায়। কারণ হুতোম দুঃখ করে বলছেন : ‘এখন আর পক্ষীর দল নাই, গুখুরি ও ঝকমারির দলও অন্তর্ধান হয়ে গ্যাচে, পাখিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু’একটা আধমরা বুড়োগোছের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দলভাঙা ও টাকার খাঁকতিতে মনমরা হয়ে পড়েছেন, সুতরাং সন্ধ্যার পর ঝুমুর শুনে থাকেন। আড্ডাটি মিউনিসিপ্যাল কমিশনারেরা উঠিয়ে দেছেন, এখন কেবল তায় রুইন মাত্র পড়ে রয়েছে।’
দেখা যাচ্ছে, বটতলা তখন কলকাতা কালচারের একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং সেখানে একটা আটচালা ঘরে আজকালকার নানা কৃষ্টিচক্রের বৈঠকের মতন নিয়মিত বৈঠকও বসত। সেই বৈঠকে ও আড্ডায় কলকাতার ফুলবাবু ও হাফ—বাবুরা অনেকেই যোগ দিতেন, নিধুবাবু, হরু ঠাকুরের মতন কবিগায়করাও তার পান্ডা ছিলেন। এই ধরনের একটা কালচারাল আড্ডা অন্তত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যে বটতলায় চলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। শুধু বটতলা নয়, বটতলার লক্ষণীয় হচ্ছে আটচালা ঘরটি এবং তার আড্ডাটি। দুটোই বাঙালি হিন্দু—মুসলমানের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যের প্রতীকস্বরূপ ছিল। কলকাতার কমিশনারেরা আড্ডাটি উঠিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ কুরুচি ও অশ্লীলতার দিক দিয়ে আড্ডাটি চরমে উঠেছিল। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও বটতলার অন্যতম প্রকাশক ভবানীচরণ তাঁর ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে কলকাতার বাবুদের সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘মনিয়া বুলবুল আখড়াই গান, খোষ পোষাকী যশমী দান, আড়ি—ঘুড়ি কানন ভোজন, এই নবধা বাবুর লক্ষণ!’ এ ছাড়া তিনি বলেছেন যে পাশা, পায়রা, পরদার, পোশাক, খানা, বারাঙ্গনা—এসবও বাবুর গুণ। বাবুদের এইসব গুণ ও লক্ষণের সমন্বয়েই বাবু—কালচারের সৃষ্টি। এই কালচারের আবাদ করে বটতলা এককালে যুগধর্ম পালন করেছিল। বটতলার সাহিত্যিক ও কবিরা (এবং প্রকাশকরাও) সমাজের প্রধান শ্রেণির সাংস্কৃতিক রুচির খোরাক জুগিয়ে লোকপ্রিয় হয়েছিলেন।
বটতলার কালচার ও বাবু—কালচার যেমন এক বৃন্তের দুই ফুল, তেমনি অষ্টাদশ শতাব্দীর নদিয়ার বৈষ্ণব—কালচারই হল কলকাতার বাবু—কালচারের যুগ। শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বাঙালির কালচার শেষ পর্যন্ত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর আমলে যে অবনতির কোন চরম সীমায় পৌঁছেছিল তা কল্পনা করা যায় না। বৈষ্ণবরা তখন শতাধিক দল ও উপদলে ভাগ হয়ে গেছেন—নেড়ানেড়ির দল, আউলের দল, বাউলদল, সাহেবধনী, সহজে সম্প্রদায়, বলরাম—ভজা, কর্তাভজা, অবধূত, কিশোর—ভজনী, চূড়াধারী, তিলকদাসী, রাধাবল্লভী, হরিবোলা, সখীভাবক ইত্যাদি নানা রকমের দল বিচিত্র পদ্ধতিতে ভজন করতেন। সাধকভজনের মধ্যে আদিরসের বাঁধভাঙা স্রোত বয়ে চলত। পূতিগন্ধ পাঁকের মধ্যে বাঙালির কালচার তখন হাবুডুবু খাচ্ছিল। পাঁকের মধ্যেও অবশ্য পদ্ম ফুল ফোটে এবং পাঁকাল মাছ থাকে। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদের মতন কবি, অথবা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতন পণ্ডিত, হয়তো সেই ধরনের পদ্ম ফুল ও পাঁকাল মাছ। কিন্তু পাঁকের পরিচয় পদ্মে নয়, তার পঙ্কিলতায় ও পূতিগন্ধে। পাঁক যদি বজবজিয়ে ওঠে, পদ্মের গায়েও পাঁক লাগে। তার প্রমাণ ভারতচন্দ্র নিজে এবং তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘রসমঞ্জরী’ কাব্য। রাজদরবারের কৃত্রিমতা ও কুরুচিপ্রবণতায় পরিপূর্ণ। শুধু রাজদরবারের নয়, বাইরের লোকসমাজেও। বিদ্যা যখন সুন্দরকে কিছুদিন পতিগৃহে থাকবার জন্য লোক দেখাচ্ছে এই বলে—
নদে শান্তিপুর হতে খেঁড়ু আনাইব
নূতন নূতন ঠাঠে খেঁড়ু শুনাইব—
তখন বোঝা যায়, নদে—শান্তিপুরের লোকরুচি খেঁড়ু বা খেউড় শোনার দিকে ঝুঁকেছে। পদাবলি কীর্তন থেকে খেউড়। কীর্তনের মধ্যেই নানা রকমের ঠাট ঢুকেছে এবং তার সঙ্গে রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলার গীতভঙ্গিও বদলেছে। আখড়ায় আখড়ায় কবিগান, পাঁচালি গান, আখড়াই গান, তর্জা গান, ঝুমুর গান পুরোদমে শুরু হয়েছে। আদিরসই তার প্রধান উপজীব্য।
আমাদের কালচারের যখন এই অবস্থা তখন তার কেন্দ্রস্থল ক্রমে স্থানান্তরিত হতে থাকল শান্তিপুর—কৃষ্ণনগর—নবদ্বীপ থেকে হুগলি—চুঁচুড়া—শ্রীরামপুর হয়ে কলকাতার দিকে। অষ্টাদশ—ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি কালচারের ইতিহাস—প্রসঙ্গে এ কথা বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত। হঠাৎ কলকাতা শহরে ব্রিটিশ যুগে কোনো একটা নতুন কালচার গজিয়ে ওঠেনি। বাঙালির সংস্কৃতি—ভাগীরথীর ভাঁটার স্রোত নালানর্দমার ভিতর দিয়ে সুতানুটি—কলকাতা—গোবিন্দপুর ছাড়িয়ে একেবারে টালির নালা পর্যন্ত পৌঁছল। তখন ভগীরথ হল টাকা ও বাণিজ্য এবং তার লেনদেনের মালিকরা। অর্থাৎ এই নতুন কৃষ্টিগঙ্গার ভগীরথ হলেন পর্তুগিজ, ফরাসি, ডাচ ও ব্রিটিশ বণিকরা এবং তাঁদের বাঙালি দালাল, গোমস্তা, দেওয়ান, বেনিয়ান ও মুনশিরা। এঁরাই খাল কেটে কেটে যেন বাঙালির কৃষ্টিগঙ্গার পঙ্কিল ধারাকে নদে—শান্তিপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। এই পঙ্কিল ধারার সঙ্গে এল বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেম, কৃষ্ণলীলার বিকৃত গীতভঙ্গি, কবিগান, পাঁচালি গান, ঝুমুর গান, তর্জা গান—কুরুচিপ্রবণ ও আদিরসাত্মক যা কিছু বিকৃতকলা আছে সব। অবেশেষে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও মহারাজা নবকৃষ্ণ যেন একসন্ধিক্ষণে হাত মেলালেন কলকাতায়। নদে—শান্তিপুরের সঙ্গে সুতানুটি তালুক ও অষ্টাদশ শতাব্দীর লন্ডনের কালচারের মহামিলন হল কলকাতা শহরে। সুতরাং বটতলাও বজবজিয়ে উঠল।
বটতলার সাহিত্যিকদের যেন গুরু হয়ে উঠলেন ভারতচন্দ্র এবং প্রেরণার অফুরন্ত নির্ঝর হল ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘রসমঞ্জরী’। কলকাতার সুতানুটির কবি কালীপ্রসাদের ‘চন্দ্রকান্ত’ কাব্য এবং ‘কামিনীকুমার’, ‘রহস্যবিলাস’, ‘সুকুমারবিলাস’, ‘জীবন—যামিনী’, ‘মধুমালতী’, ‘সতীত্ব—সুধাসিন্ধু’, ‘প্রেমোপদেশ নাটক’, ‘স্ত্রীলোকের দর্পচূর্ণ’, ‘কমলদত্তাহরণ’, ‘প্রেমোল্লাস’, ‘রসিকতরঙ্গিণী’ প্রভৃতি বটতলার সাহিত্য মূলত ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘রসমঞ্জরী’র ধারা বহন করে চলল। এই ধারায় ভেসে গিয়ে যদি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতন সিরিয়াস পণ্ডিতও বিশ বছর বয়সে ‘বাসবদত্তা’ কাব্য লিখতে পারেন—
শুন হে প্রাণ বঁধু
যে সব মধু মধু
হাসিয়া মৃদু মৃদু জানালে
ইত্যাদি ছন্দচাতুর্য দেখিয়ে (ভারতচন্দ্রর ভঙ্গিতে) এবং অক্ষয়কুমার দত্তর মতন কড়া গদ্য ও পাঠ্যপুস্তকের লেখকও যদি ‘অনঙ্গমোহন’ কাব্য লেখার লোভ না সংবরণ করতে পারেন, তাহলে কড়েয়া, মেছুয়াবাজার, ভবানীপুর ও সুতানুটির বটতলার কবিদের আর অপরাধ কী?
‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘রসমঞ্জরী’র স্রোতধারা শুধু যে মদনমোহন—অক্ষয়কুমারের মতন পণ্ডিত ও গদ্যভাবাপন্নদেরই প্রভাবিত করেছিল তা নয়, ইংরেজরাও তার দ্বারা রীতিমতো ঘায়েল হয়ে গিয়েছিলেন। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ ও অন্যান্য পত্রিকায় এইসব আদিরসাত্মক কবিতার ইংরেজি অনুবাদও তাঁরা প্রকাশ করতেন। একটির নমুনা দিচ্ছি :
My Veedya’s beauty fills my head
–I study nought beside;
My Veedya’s name I dwell upon
from morn till even-tide;
She only is my every hope
my wish, my aim, my end;
My orisons to Veedya,
and to her alone ascend.
বিদ্যাসুন্দর কত দূর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, এই ইংরেজি অনুবাদ তার প্রমাণ। কৃষ্ণনগর—শান্তিপুর থেকে যদি লন্ডনকেও তা স্পর্শ করে থাকে, তাহলে বটতলা রেহাই পাবে কেন? এ দেশের নানা স্থানের নানা গাছের তলা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিকৃত ধারা কলকাতা শহরের বটতলায় প্রবাহিত হয়ে এসেছিল। কলকাতার নব্যবাবুরা তাকে আরও বিকৃত করেছিলেন।
কলকাতার কমিশনাররা বটতলার আড্ডাটি উঠিয়ে দিলেন, আটচালাটিও ভেঙে দিলেন। পুরনো বটতলার ‘রুইন’ মাত্র পড়ে রইল, পক্ষীর দলের বাবুদের অশরীরী আত্মা তার মধ্যেই ডানা ঝাপটাতে ও বোল ঝাড়তে লাগল। কিন্তু পক্ষীবাবুরা মনমরা হয়ে ঝুমুর শুনে বেড়ালেও, বাবু—কালচারের ধারা শুকিয়ে গেল না। দমনের ফলে অবদমিত বাবু—কালচার যেন শেষবারের মতন গা—ঝাড়া দিয়ে উঠল। ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম—দশকে বটতলার এক আনা ও ছ’পয়সা সিরিজের পুস্তিকাবলির মধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের
‘কোনের মা কাঁদে আর টাকার পুঁটলি বাঁধে।’
‘আপনার মুখ আপনি দেখ।’
রামকৃষ্ণ সেনের
‘হুড়কো বৌ—এর বিষম জ্বালা।’
গোলাম হোসেনের
‘কলির বৌ হাড়জ্বালানী।’
শেখ আজিমুদ্দিনের
‘কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে।’
অজ্ঞাতনামার
‘জাত গেল পেট ভরল না।’
‘ইয়ং বেঙ্গল ক্ষুদ্র নবাব’ ইত্যাদি।
অবশেষে গভর্নমেন্ট আইন করে এইসব বইয়ের প্রকাশ বন্ধ করে দিলেন। লং সাহেব লিখেছেন যে, আইন করবার আগের বছর এই ধরনের একখানা পুস্তিকা ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ছাপার জন্য তিনজন প্রকাশককেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং সুপ্রিমকোর্টে তাঁদের জরিমানা হয়েছিল তেরোশো টাকা। বটতলার লেখক প্রকাশকরা তারপর থেকেই ভয় পেয়ে সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বটতলার অস্তিত্ব কি তারপরে একেবারে শেষ হয়ে গেছে? আজ কি তার কোনো চিহ্ন নেই?
কলকাতার কমিশনাররা ও বাংলা সরকার ‘বটতলার সাহিত্য’ প্রকাশ আইন করে বন্ধ করে দিয়ে হয়তো ভালই করেছিলেন। কিন্তু বটতলার প্রকাশক ও লেখকরা তো তাঁদের সমর্থনে গ্যেটের মতন বলতে পারেন—
What were I without thee
O my friend, the public?
.
চতুর্থ স্তবক
নির্দিষ্ট সীমারেখায় ঘেরা বটতলার কোনো মানচিত্র নেই, কোনো ইতিহাস বা গেজেটিয়ারও নেই। বাঙালির সংস্কৃতিজীবনের এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের অন্যতম লীলাকেন্দ্র বটতলা চিরদিনই শিক্ষিতের উপেক্ষিত। নির্বিচার অবজ্ঞার বাণবিদ্ধ বটতলা সাহিত্যের আবর্জনাস্তূপে সমাধিস্থ। কে তাকে খুঁজে বার করল? চিৎপুরের আশপাশের অলিগলিতে, আহিরিটোলায়, দর্জিপাড়ায়, জোড়াসাঁকোয়, গরানহাটায়, জোড়াবাগানে, চোরবাগানে, বড়বাজারে, শোভাবাজারে। শুধু তা—ই কেন? শিয়ালদহ, মির্জাপুর, কলুটোলা, কসাইটোলা, বউবাজার, জানবাজার, ঠিক বটতলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে না পড়লেও, সাহিত্যিক সীমানার মধ্যে নিশ্চয় পড়ে। মির্জাপুরের ‘সম্বাদ তিমিরনাশক প্রেস’ ও মুনশি হেদাতুল্লার প্রেস এবং শিয়ালদহের পীতাম্বর সেনের সিন্ধুযন্ত্র থেকেই বটতলার যুগের সূচনা হয়নি কি? সুতরাং বটতলা শুধু তার ভৌগোলিক সীমারেখাতেই আবদ্ধ ছিল না, চিৎপুর রোড থেকে সার্কুলার রোড এবং আরও অনেক দূর পর্যন্ত তার বিস্তার ছিল। সেই কথা ভেবে বটতলার অভিযান ক্রমেই যেন বিশুদ্ধ ‘অ্যাডভেঞ্চার’ বলে মনে হতে লাগল। ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম। সামনেই কয়েকজন বনেদি বটতলার প্রকাশকের দোকান। নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে খেরো—বাঁধানো খাতায়, মেঝেয় বসে, স্বয়ং বৃদ্ধ ‘সোল প্রোপ্রাইটার’ই বোধহয় হিসেব লিখছেন। ফুটপাতের সঙ্গে লাগানো শোকেস ও কাউন্টার, সুতরাং ক্রেতাদের ভিড় ফুটপাতেই। ডাব, শরবত ও দইবড়া ফুটপাতেই রয়েছে, দোকানদার ও খরিদ্দার যাঁর যখন দরকার স্বাধীনভাবে কিনে খাচ্ছেন এবং তার মধ্যে বই কেনাবেচাও চলছে। ‘সোল প্রোপ্রাইটার’র মুখের দিকে চেয়ে প্রথমটা ভয় পেলাম। বাঘ নয়, ভালুক নয়, তবু যেন বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।
সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বললাম: ‘আপনাদের ছাপানো বইয়ের কোনো লিস্ট আছে?’ আমার দিকে না তাকিয়েই ধর মহাশয় বললেন : ‘ছাপানো বই তো আমাদের অনেক রকমের আছে, কীসের লিস্ট চান আপনি বলুন?’ তাই তো, কী বলব? বললাম : ‘কিছু ধর্মগ্রন্থ, কিছু প্রহসন—রঙ্গনাট্যজাতীয় বই, আর অন্যরকম কিছু যা থাকে।’ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম, অর্থাৎ বটতলার সাহিত্য কিছু নগদ টাকায় না কিনলে যে অভিযানের অনেকটাই ব্যর্থ হবে, তা জানতাম। বই কেনার আগে অধিকাংশ ‘সোল প্রোপ্রাইটার’—এর যে ঔদাসীন্য দেখেছিলাম, বই কেনার পরে আর তা দেখিনি। বটতলার সাহিত্য সামান্য যা কিছু সংগ্রহ করেছি তার একটা তালিকা দিচ্ছি :
রুচিতে অরুচি
ঠকাঠকি তরজা
প্রেমের লুকোচুরি
নাস্তানাবুদ
মাগসর্বস্ব
পাশ—করা মাগ
আক্কেল সেলামী
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি
লবোরতন
বিদ্যাসুন্দর (রঙ্গনাট্য)
প্রিয়ার চিঠি (নবদম্পতির প্রথম আলাপ)
দফারফা
বাসরে বিপাক
বটতলার কয়েকটি বিখ্যাত দোকান ঘুরে, সোল প্রোপ্রাইটার বা প্রকাশকদের সঙ্গে আলাপ করে এবং প্রত্যেকের পুস্তক—তালিকা ঘেঁটে দেখেছি, এখনও বটতলার সাহিত্যকে মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় : (১) ধর্মগ্রন্থ—যেমন মহাভারত, রামায়ণ, শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, পুরাণ গ্রন্থ, বৈষ্ণব গ্রন্থ ইত্যাদি। এর মধ্যে বৈষ্ণব গ্রন্থের এখনও প্রাধান্য আছে বলে মনে হল—(২) জাদুবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র, জ্যোতিষ ইত্যাদি গ্রন্থ—যেমন অদ্ভুত ইন্দ্রজাল, কামশাস্ত্র, রাক্ষসী—তন্ত্র, গুপ্তমন্ত্র ইত্যাদি। (৩) বিচিত্র বিষয়শিক্ষার গ্রন্থ—যেমন হোমিওপ্যাথি শিক্ষা, কম্পাউণ্ডরী শিক্ষা, পেটেন্ট ঔষধ শিক্ষা, কবিরাজী শিক্ষা, পশু চিকিৎসা, নাড়িবিজ্ঞান শিক্ষা, কম্পোজিটরী শিক্ষা, ইংরাজী ভাষা, তবলা—তরঙ্গিণী, বেহালা শিক্ষা ইত্যাদি। (৪) উপন্যাস—যেমন জীবন—সঙ্গিনী, মনের মতো মেয়ে, মন নিয়ে খেলা, বৌদিদি, বন্ধুর বৌ, বিয়ে বাড়ি, ফুলশয্যা, একালের মেয়ে, এলো যবে যৌবন ইত্যাদি। (৫) নাটক ও প্রহসন)—যেমন, বিপ্লবী বাঙ্গালী, নীলকুঠি, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা সীতারাম ইত্যাদি ঐতিহাসিক নাটক; নারী—রাক্ষসী, রূপের নেশা, প্রেমের গুলবাগ ইত্যাদি সামাজিক নাটক; মিলন—মন্দির, সরমা, হরিশ্চন্দ্র ইত্যাদি পৌরাণিক নাটক এবং প্রহসন ও রঙ্গনাট্য।
বটতলার বই বিক্রি এখনও যা হয় তা শুনলে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা চমকে উঠবেন। ধর্মগ্রন্থের টান আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি টান জাদুবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র ও হস্তগণনার। টান শহরের চেয়ে গ্রামের দিকে অনেক বেশি। বাংলার গ্রাম্য জীবনে আজও যে জাদুবিদ্যা ও তন্ত্রমন্ত্রের প্রাধান্য অটুট রয়েছে, বটতলার এইজাতীয় বইয়ের একাধিক সংস্করণ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। ধর্মগ্রন্থের টান অনেক বেশি, সুতরাং ধর্মের টানেরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে দেখা যায়। বটতলার শিক্ষা—বিষয়ক গ্রন্থ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক কোনো শিক্ষাতেই কাজে লাগে না, ডি—পি—আই বা শিক্ষা পর্ষৎ কর্তৃক অনুমোদিতও নয় একটিও, তবু অধিকাংশ বাঙালি জনসাধারণের জীবন আজও এই বটতলার বইয়ের শিক্ষাতেই চলেছে। গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার ডাক্তার, কম্পাউন্ডার ও কবিরাজ আজও বটতলার ‘নাড়ীবিজ্ঞান শিক্ষা’ পড়ে রুগির নাড়ি টিপতে শেখেন, পেটেন্ট ঔষধ শিক্ষা পড়ে আজও গ্রামের, এমনকি কলকাতার মতন শহরেও অনেক ডাক্তার—কবিরাজ ‘উপদংশ, প্লীহা, যকৃৎ, আমাশয়, ওলাওঠা, শোথ, অর্থ, পাথুরি, দদ্রু প্রভৃতি রোগে ফলপ্রদ ঔষধ প্রস্তুত করিয়া ব্যবসা চালাইবার সহজ উপায়’ শিক্ষা করেন এবং পুরোদস্তুর ব্যবসাও চালান; ‘বেহালা শিক্ষা’ ও ‘তবলা—তরঙ্গিণি’র সাহায্যে আজও বাংলার গ্রামের অনেক যাত্রার দলের বেহালাবাবু ও তবলাবাবু আসর মাত করে দেন। সুতরাং এসব বইয়েরও বেশ টান আছে দেখলাম, ভাটার টান নয়, জোয়ারের টান বলেই মনে হল। ‘উপন্যাসের’ টান যেমন অন্যত্র আছে, তেমনি বটতলাতেও আছে। কিন্তু বটতলার উপন্যাসের বিষয়বস্তু দেখলে মনে হয়, প্রধানত বিয়ের উপহারের জন্যই যেন সেগুলি লেখা ও ছাপানো। বালিগঞ্জ ও শ্যামবাজারের বাইরেও যে বাংলা দেশের যথেষ্ট ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়, সেইসব বিয়েতেও যে বই উপহার দেওয়া হয়, তা বটতলার উপন্যাসগুলি দেখলেই বোঝা যায়। ‘প্রিয়ার চিঠি’ নাম শুনে হয়তো অনেকে হাসবেন, কিন্তু আজও যদি বাংলা দেশের বহু নবদম্পতি বটতলার এই বই পড়ে প্রথম প্রেমপত্রালাপ অভ্যাস করেন, তাহলে সেটা হাস্যকর মনে না—করাই উচিত। সাম্প্রতিক কলেজ স্ট্রিটের বাংলা সাহিত্যেও এই বটতলার বৈশিষ্ট্য ক্রমে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিবাহের উপহারযোগ্যতা দিয়ে সাহিত্যের সার্থকতা বিচার করা হচ্ছে। বটতলার সাহিত্যের যুগ ফিরে আসছে কলেজ স্ট্রিটের মহাসমারোহে।
বটতলায় আজও কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতিপত্তি হল নাটক ও প্রহসনের। এটাই হল আমার বটতলা অভিযানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। বটতলার প্রহসন ও ছোট ছোট রঙ্গনাট্য আজও সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর চার আনার পুস্তিকামালার ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে, লং সাহেব যে জাতীয় পুস্তিকা ত্রিশ হাজার কপি বিক্রির কথা পর্যন্ত বলেছেন এবং গবর্নমেন্ট একসময় যার মুদ্রণ ও প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই জাতীয় পুস্তিকামালার একটি তালিকা আগে দিয়েছি। অদম্য কৌতূহল নিয়ে কোনো প্রবীণ বটতলার প্রকাশককে জিজ্ঞাসা করলাম : ‘এইসব প্রহসন ও নকশা আজকাল বিক্রি হয় কেমন?’ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন: ‘হয়, তবে আগের মতন আর হয় না।’ তার কারণ তিনি যা বললেন, তার মধ্য দিয়ে আমি বটতলার জট—পাকানো শিকড়ের একটা নতুন হদিশ পেলাম। শীল মহাশয় (প্রকাশক) বললেন : ‘আগে যেসব যাত্রার দল ছিল, অপেরা পার্টি ছিল কলকাতায়, এখন আর তারা নেই। আজকাল সিনেমাই সব সর্বনাশ করে দিয়েছে। আগে যাত্রা হলে, প্রধান নাটক অভিনয়ের শেষে সবসময় একটা প্রহসন ও রঙ্গনাট্য অভিনীত হত। এখন যাত্রার দল অপেরা পার্টি প্রায় সব উঠে গেছে, যাত্রাও গেছে, বিশেষ হয় না, প্রহসনও তেমন কাটতি নেই। যা কিছু নাটক—প্রহসন বিক্রি হয়, তার অধিকাংশই মফস্সলে।’ আরও কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম : ‘যেসব যাত্রার দল অপেরা পার্টির কথা বললেন, সেগুলো কি এই অঞ্চলের ছিল?’ প্রকাশক বললেন: ‘তা ঠিক বলতে পারব না, তবে মনে হয় এই বটতলা অঞ্চলেই বেশির ভাগ ছিল। এখনও দু’চারটে যে নেই তা নয়।’ এইসব যাত্রার দল ও অপেরা পার্টির পরিচয় কিছু কিছু বটতলায় ঘুরে সংগ্রহ করেছি। এখানে শুধু কয়েকটির নাম জানালাম :
রয়েল বীণাপাণি অপেরা
মিনার্ভা অপেরা
চণ্ডী অপেরা
আর্য অপেরা
নিউ নারায়ণ অপেরা
ষষ্ঠী অপেরা
ভাণ্ডারী অপেরা
রঞ্জন অপেরা
শিবদুর্গা অপেরা
নট্ট কোম্পানীর দল
সত্যম্বর অপেরা
গণেশ অপেরা
নিউ বাসন্তী অপেরা
শ্রীদুর্গা অপেরা
বেশ বোঝা যায়, কলকাতা শহরের পক্ষীর দলের বাবুরা এবং তাঁদের বংশধরেরা অন্তর্ধান করবার পরেও বটতলার কালচার বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অ্যামেচার যাত্রার দল ও অপেরা পার্টি অসংখ্য গজিয়ে উঠেছিল বটতলা অঞ্চলে এবং শুধু শখের নয়, পেশাদার দলও ছিল তার মধ্যে। এইসব অপেরা দলই বটতলার সাহিত্যকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। এদেরই কল্যাণে নাটক ও প্রহসনের যে আবাদ হয়েছিল বটতলায়, তাতে সোনা বিশেষ না ফললেও সবটাই তার তামা—পেতল নয়; বটতলার প্রকাশকদের প্রায় সকলের ‘মুকুন্দ দাসের দলে অভিনীত’ নাটকগুলিও আছে দেখলাম এবং শুনলাম যে মফস্সলে আজও এইসব বইয়ের চাহিদা। বটতলার ‘প্রেমের গুলবাগ’ নাটকের নাম শুনেই যা মনে হয় তা ঠিক নয়। আগে তার পরিচয় জানা দরকার : ‘ঐতিহাসিক পঞ্চাঙ্ক নাটক। তরুণ—তরুণীর প্রেমের উৎস। উভয়ে ভালবেসেছিল উভয়কে, কিন্তু তাদের ভালবাসার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারত সম্রাট। তরুণ গেল কারাগারে, তরুণীও করল স্বেচ্ছায় কারাবরণ দয়িতের জন্য। উভয়ের অশ্রুজলে ভেসে গেল কারাগার—উভয়ের সমাধি হল সেখানে—পরস্পর প্রেমের আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে। সেই করুণ দৃশ্যে সম্রাটের কঠোর প্রাণ কেঁদে উঠল, তিনি বললেন—এ কারাগার নয়, সত্যিই প্রেমের গুলবাগ।’ সুতরাং সবসময় বাইরে থেকে নাম দেখে বটতলার বিচার করলে ভুল হবে। এর সঙ্গে অবশ্য ‘নারী—রাক্ষসী’ আছে, শ্রীদুর্গা অপেরায় সগৌরবে অভিনীত: ‘সংসার পথে মা—জাতির এক গ্লানিময় কাহিনি, ইন্দ্রিয়চরিতার্থের জন্য জগতে নারীর পৈশাচিক কর্মের বিকাশ। সব ভেসে যায়—শুধু জেগে ওঠে কামনার কালানল ইত্যাদি।’ কিন্তু তারই পাশে আছে মুকুন্দ দাসের স্বদেশি যাত্রায় অভিনীত ‘নীলকুটী’, আর্য অপেরায় অভিনীত ‘জন্মভূমি’, শিবদুর্গা অপেরায় অভিনীত ‘শৃঙ্খল মোচন’। একটা কথা বার বার মনে হতে লাগল, কোথায় সেইসব অপেরার দল? কী তাদের ইতিহাস? কলকাতার রঙ্গাভিনয়ের ইতিহাসে তাদের দান কী?
বটতলার অভিযান থেকে এইটুকু বুঝেছি, দূর থেকে বেলতলায় বসে বটতলার বিচার করা যায় না। শুধু কলকাতার বাবু—কালচারের প্রতিবিম্ব বটতলা নয়। একসময় হয়তো তা—ই ছিল, কিন্তু তবু বাঙালির জাতীয় কালচারের সঙ্গে যোগসূত্র কোনোদিনই বটতলা ছিন্ন করে দেয়নি। আজও তাই বটতলা বাঙালি জীবনের একদিকের প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে। আমাদের ধর্মকর্ম, আমাদের জাদুবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র, আমাদের কবিরাজি কম্পাউন্ডারি, আমাদের রঙ্গাভিনয় সবকিছুর পসরা সাজিয়ে বসে আছে বটতলা। এখনও তাই মনে হয়, বাংলার জনসমাজে আসল পরিচয় পেতে হলে বটতলায় যেতে হবে, অন্য কোনো গাছতলায় নয়। আজও বটতলার ‘রুইন’ মাত্র পড়ে থাকলেও, আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম ‘মিরর’ বটতলা। সেই আয়নায় মুখ দেখলে লজ্জায় মাথা হেঁট করতে হবে। কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতি সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতির কাছে হাস্যকর ও লজ্জাকর বলে মনে হবে। সংস্কৃতির অগ্রগতির সমস্ত দর্প বটতলার সাহিত্য—দর্পণে চূর্ণ হয়ে যাবে।
.
* এই রচনায় ডক্টর সুকুমার সেনের ‘বটতলার বেসাতি’ প্রবন্ধ (বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ—আশ্বিন ১৩৩৫) থেকে অনেক উপকরণ সংগ্রহ করেছি।