১৫. গ্রন্থনগরী কলকাতা

গ্রন্থনগরী কলকাতা

প্রথম প্রস্তাব

‘কলকাতা কালচারের’ গোড়াপত্তন হয় গ্রন্থ দিয়ে, যন্ত্র দিয়ে নয়। অবশ্য, ‘যন্ত্র’ বলতে যদি পণ্য—উৎপাদনেরই যন্ত্র বোঝায় শুধু। কিন্তু মুদ্রাযন্ত্রও যন্ত্র এবং যন্ত্রযুগের সমস্ত যন্ত্রের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র; সামান্য একটি নড়বড়ে মুদ্রাযন্ত্র গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে, আর কোনো যন্ত্র তা পারে না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের নগর পাণ্ডুলিপির নগর, আধুনিক নগর ছাপাখানার ও ছাপা বইয়ের নগর। ‘মেশিন—মেড গুডস’ নয়, ‘মেশিন—মেড বুকস’ই আধুনিক নাগরিক কালচারের বনিয়াদ, আমাদের ক্যালকাটা কালচারেরও।

হুগলী শহরে ১৭৭৮ সালে এবং কলকাতা শহরে ১৭৮০ সালে মুদ্রাযন্ত্র প্রথম স্থাপিত হয়। জানি না তার আগে আর কোনো যন্ত্র কলকাতায় এসেছিল কি না, এবং এলেও মুদ্রাযন্ত্রের মতন যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল কি না। ১৮২৫—২৬ সালে আমরা কলকাতা শহরের গঙ্গাতীরে ধানভাঙা কল ও গমপেষাই কলের বিচিত্র কীর্তিকলাপের সংবাদ পাই। সারাজীবন ঢেঁকি আর জাঁতা দেখেছেন যাঁরা, তাঁরা ভিড় করেছেন গঙ্গাতীরে এই ধানভাঙা আর গমভাঙা কল দেখার জন্য। কলের আশ্চর্য কীর্তির কথা ঘোষণা করে তখনকার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, হইচই পড়ে গেছে শহরে। কল এসেছে, বিলেত থেকে কল, ইংরেজদের কলের কীবা মহিমা। ‘ওই যন্ত্রে প্রতিদিন কেবল দুইজন লোক ১০ মন তণ্ডুল প্রস্তুত করিতে পারে, তাহার একজন কল লাড়ে’—এই হল ধানকল। ঢেঁকিতে আধ মনের বেশি ধান ভানতে তিন—চারজনকে হয়রান হয়ে যেতে হয়, তা—ও আবার সমস্বরে শিবের গীত গেয়ে এনার্জি আহরণ করতে হয়। ধানকলে তা হয় না। আর গমভাঙা কলের তো কথাই নেই। ‘এই কলের দ্বারা গম পেষা যাইবে ও ধান ভানা যাইবে ও মর্দনের দ্বারা তৈলাদি প্রস্তুত হইবে এবং এই সকল কার্য ত্রিশ অশ্বের বলধারী বাষ্পের দুইটা যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হইবে।’ এহেন ইংরেজের কল দেখার জন্য লোকের ভিড় তো হবেই—’এতদ্দেশীয় অনেক লোক আশ্চর্য বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন’—

এবং পত্রিকার সম্পাদক সকলকে দেখতে যাবার অনুরোধ করছেন—’আমরা আপনাদের সকল মিত্রকে এই পরামর্শ দিই যে তাহারা এই অদ্ভুত যন্ত্রবাষ্পের দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার মন গম পিষিতে পারে তৎস্থানে গমন করিয়া তাহা দর্শন করেন।’

এই ধানভাঙা কল ও গমপেষা কলের অনেক আগে বইছাপা কল এসেছিল কলকাতা শহরে। হিকি সাহেব ও গ্লাডউইন সাহেব যখন বইছাপা কল বসান কলকাতা শহরে তখন তা দেখবার জন্যে লোকে ভিড় করেছিল কি না, কোনো সাময়িক পত্রিকায় তার বিবরণ পাওয়া যায় না। পাওয়া সম্ভবও নয়। কেন নয়, কথাটা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। বইছাপা কল যখন প্রথমে এল, তখন তার আগমনবার্তা ঘোষণা করবে কে, তাকে অভিনন্দন জানাবে কে? কোনো ছাপা সাময়িক পত্রিকা বা কাগজের তখনও জন্ম হয়নি। তার জনক যে মুদ্রাযন্ত্র, তারই তো প্রথম আবির্ভাব হল। সুতরাং তাকে অভ্যর্থনা করার কেউ ছিল না তখন এবং তার আগমন—সংবাদ জানানোও তখন সম্ভব ছিল না। শহরেও লিপিকররা হাতে লেখা পত্র মারফত নিশ্চয়ই দেশের লোককে সেসংবাদ জানাবার চেষ্টা করেননি। চেষ্টা করলেও জানাতে পারতেন কি না সন্দেহ, কারণ একমাত্র হাতে লেখা প্রাচীরপত্র শহরময় দেয়াল ও গাছের গায়ে লটকে দিয়ে তাঁরা হয়তো বইছাপা কলের খবরটা লোককে জানাতে পারতেন। কিন্তু ‘প্রাচীরপত্র’র আইডিয়াও আধুনিক। সুতরাং তাঁরা তা জানাননি এবং বইছাপা কল নিঃশব্দেই এসেছিল কলকাতা শহরে। তারপর প্রথম ছাপা বই ও ছাপা পত্রিকা যখন বাইরে প্রকাশ হল, তখন ধীরে ধীরে লোকমুখে গুঞ্জিত হতে থাকল বইছাপা কলের কথা এবং তা দেখবার জন্য লোকের ভিড়ও হল। প্রথম বইছাপা কল, প্রথম ছাপা বই ও ছাপা পত্রিকা যাঁরা দেখেছিলেন কলকাতায়, তাঁদের সেই বিস্ময় আজ আমরা কল্পনাতেও বুঝতে পারব না। দিব্যচক্ষে দেখা যায়, কলকাতা শহরের তখনকার বৈষ্ণব—বৈষ্ণবী স্ত্রী—পুরুষ লিপিকারেরা বোধহয় সবার আগে এই বইছাপা কল দেখতে গিয়েছিলেন, হিকি সাহেব ও গ্লাডউইন সাহেবের ছাপাখানায়। দুঃখের বিষয় তার প্রত্যক্ষ বিবরণ কেউ লিপিবদ্ধ করে যাননি। অন্তত হিকি সাহেব তাঁর বিখ্যাত ‘গেজেট’—এ বা গ্লাডউইন সাহেব ‘ক্যালকাটা গেজেট’—এ নিশ্চয়ই পরে এ সম্বন্ধে কিছু লেখেননি, কারণ এই ধরনের বিবরণ তাঁদের গেজেটে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

খুঁজে না পেলেও ক্ষতি নেই। ধানভাঙা ও গমভাঙা কল বা অন্যান্য নানা রকমের কল কলকাতা শহরে ও তার উপকণ্ঠে পৌঁছনোর অনেক আগে, মুদ্রাযন্ত্র বা বইছাপা কল যে এ দেশে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮২৫—২৬ সালের মধ্যে আমরা কলকাতা শহরে একাধিক ছাপাখানার খবর পাই। তার মধ্যে শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের প্রেস, শাস্ত্রপ্রকাশ প্রেস, শিয়ালদহের পীতাম্বর সেনের প্রেস, সিন্ধুযন্ত্র মির্জাপুরের সম্বাদতিমিরনাশক প্রেস, মুনশি হেদাতুল্লার প্রেস, চোরবাগানের রামকৃষ্ণ, মল্লিকের প্রেস, বহুবাজারের লেবেন্ডিয়ার সাহেবের প্রেস, আরপুলির হরচন্দ্র রায়ের প্রেস, এন্টালির পিয়ার্স সাহেবের প্রেস, শাঁখারিটোলার বদন পালিতের প্রেস, মহেন্দ্রলাল প্রেস, ধর্মতলার রামমোহন রায়ের ইউনিটেরিয়ান প্রেস, বঙ্গদূত প্রেস, সমাচার চন্দ্রিকা প্রেস, ফেরিস এন্ড কোম্পানির প্রেস, সংস্কৃত যন্ত্র, হিন্দুস্থানি প্রেস, কলেজ প্রেস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ধানকল, গমকল, পাটকল, কাপড়ের কলের অনেক আগে হিকি সাহেব, গ্লাডউইন সাহেব, রামমোহন রায় মির্জাপুরের ব্রাহ্মণ, গুজরাটি ব্রাহ্মণ লললুলাল, বাঙালি ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, চোরবাগানের রামকৃষ্ণ মল্লিক, শাঁখারিটোলার বদন পালিত ও মহেন্দ্রলাল, বিশ্বনাথ দেব, মুনশি হেদাতুল্লা প্রভৃতির বইছাপা কল বাংলার ও বাঙালির নবজীবনকেন্দ্র কলকাতা শহরকে গ্রন্থনগরীতে পরিণত করেছিল। কলকাতা শহর যদি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মহাকেন্দ্র হয়, তাহলে ধানকলের চাল, পাটকলের পাট বা কাপড়ের কলের কাপড়ের অনেক আগে, বইছাপা কলের বইপত্র সেই জাগরণের সঞ্চার করেছে বলতে হবে। প্রাসাদপুরী কলকাতা নয়, বা কলকারখানার চিমনির ধোঁয়ায় ঢাকা কলকাতা নয়, ছাপাখানার ছাপা বইপত্রের কলকাতা, গ্রন্থনগরী কলকাতাই আমাদের নবজাগরণের আদি তীর্থস্থান। গৌড়, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা হল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির রাজনগর বা তীর্থনগর—প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কালচারের প্রতীক। কলকাতা শহর ছাপাখানায় ছাপা গ্রন্থনগরী—আধুনিক কালচারের প্রতীক।

আধুনিক কালচারের তীর্থস্থান কলকাতা মহানগরকে যাঁরা গ্রন্থনগরী রূপে গড়ে তুলেছেন, ছাপা বই ও পত্রিকা দিয়ে, তাঁদের মধ্যে সবার আগে দু’জন বাঙালি নাম করতে হয়—পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যর। একজন বাঙালি কর্মকার, আর—একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ—আধুনিক ইতিহাসের এ এক আশ্চর্য রাখিবন্ধন। এ ছাড়া খিদিরপুরের ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অবাঙালি বাবুরাম ও লললুর নামও করা উচিত। কিন্তু আনুমানিক ১৮০৬—০৭ সালে এই ছাপাখানা স্থাপিত হলেও, প্রধানত দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দি ও সংস্কৃত বই সেখান থেকে ছাপা হত। তবু ভারতীয় ভাষায় ছাপার জন্য একজন ভারতীয় প্রতিষ্ঠিত কলকাতা শহরের প্রথম ছাপাখানা এই ‘সংস্কৃত যন্ত্র’। তার আগে পঞ্চানন কর্মকার অবশ্য উইলকিন্স সাহেবের কাছে কাজ শিখে বাংলা ছাপার হরফ তৈরি করেছেন এবং তাতে বইও ছাপা হয়েছে, কিন্তু সাহেবদের প্রেস থেকে। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন কলকাতার ‘ফেরিস এন্ড কোম্পানির প্রেস’ থেকে। তার আগে তিনি শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটারের কাজ করেন। কলকাতা থেকে তাঁর প্রথম ছাপা বাংলা বই ভারতচন্দ্রর ‘অন্নদামঙ্গল’—১৮১৬ সালে প্রকাশিত হয়। গঙ্গাকিশোরের ছাপা এই ‘অন্নদামঙ্গল’ই প্রথম সচিত্র ছাপা বাংলা বই। কয়েকখানি ধাতুখোদাই ও কাঠখোদাই চিত্র ছিল বইখানির মধ্যে, খোদাই করেছিলেন শিল্পী রামচাঁদ রায়। বইয়ের সংখ্যা ও কাটতি বাড়াতে গঙ্গাকিশোর একটি বইয়ের দোকান খোলেন এবং প্রতিনিধি পাঠিয়ে বাইরে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন। বোধ হয়, গঙ্গাকিশোরই প্রথম কলকাতা শহরে বইয়ের দোকান খোলার পথ দেখান। তারপর ১৮১৮ সালে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটি ছাপাখানা করেন—’বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ এবং সেখান থেকে ‘বাঙাল গেজেটি’ নামে বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। গঙ্গাকিশোরের এই ‘বাঙাল গেজেটি’ই বাঙালি প্রবর্তিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বলে অনুসন্ধানীরা স্বীকার করেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কম্পোজিটার গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যর কাছে আমরা অনেক দিক থেকে ঋণী। তিনিই প্রথম সচিত্র বাংলা বইয়ের মুদ্রাকর ও প্রকাশক, প্রথম বইয়ের দোকানদার ও ব্যবসাদার এবং প্রথম বাংলা সংবাদপত্রের বাঙালি প্রবর্তক। আর পঞ্চানন কর্মকার তো বাংলা ছাপার হরফের অন্যতম স্রষ্টা। সুতরাং আজকাল বাংলা কম্পোজিটার, বাংলা হরফনির্মাতা, মুদ্রাকর, প্রকাশক, গ্রন্থব্যবসায়ী, গ্রন্থকার ও সাংবাদিক, সকলের কাছে সর্বাগ্রে বরণীয় হলেন এই দু’জন বাঙালি—পঞ্চানন কর্মকার, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। যে ছাপাখানা ও ছাপা বইপত্র থেকে আধুনিক কলকাতা কালচারের জন্ম ও বিকাশ হয়েছে, বাঙালিদের মধ্যে তার আদি ও অন্যতম প্রবর্তক এই দু’জন। দুর্ভাগ্যবশত এঁরা কেউ মুনশি থেকে মহারাজা হননি, বেনিয়ানি ও মচ্ছুদ্দিগিরি করে লক্ষপতি ‘বাবু’ হননি, অথবা ইংরেজ প্রভুদের মোসাহেবি করে রাতারাতি হঠাৎ জমিদার বা তালুকদার হননি, তাই এঁদের স্মরণ করা দূরে থাকুক, স্মৃতিরক্ষা বা স্মৃতি উৎসবের কথা চুলোয় যাক, নাম পর্যন্ত আমরা ভুলে গেছি। আমরা নব্যকালচারের বড়াই করি, খ্যাতনামা যুগ—প্রবর্তকের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু কর্মকার ও কম্পোজিটার বলে পঞ্চানন ও গঙ্গাকিশোরের নামও করি না। তার মানে, আমরা নিজেদের কালচার্ড বলি, কিন্তু কালচারের ইতিহাসের খবর রাখি না।

একটা কথা এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কলকাতা শহরে বইপত্র ছাপা শুরু হবার পর থেকে আমরা যখন অর্ধবর্বর মধ্যযুগ থেকে আধুনিক সভ্য যুগে পদার্পণ করি, তখন ইয়োরোপবাসী বা ইংরেজরা আমাদের চেয়ে বেশি সভ্য ছিলেন না। যেমন একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমাদের দেশের দাসপ্রথার কথা বিদেশিরা বিদ্রুপ করে উল্লেখ করেন। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষেও ইংলন্ডে নিয়মিত দাম কেনাবেচা চলত, পণ্যের মতন, বিশেষ করে নিগ্রোদের। বিখ্যাত ‘লিভারপুল ক্রনিকল’ পত্রিকার ১৭৬৮ সালের ১৫ ডিসেম্বরের সংখ্যা থেকে একটি বিচিত্র বিজ্ঞাপন তার সাক্ষী হিসেবে তুলে দিচ্ছি :

To be sold

A fine Negro Boy

of about 4 ft. 5 inches high

of a sober, tractable, human disposition.

Eleven or twelve years of Age, talks English

very well and can dress hair in a tolerable way.

১৮০৬ সালে ইংলন্ডে দাস ব্যবসা বন্ধ হয়। যাঁরা নিজেরা দাস কেনাবেচা করতেন এবং কাগজে এরকম প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন দিতেন, তাঁরা যে কেবল কয়েকটা যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে শিল্প বিপ্লব করে ফেলেছিলেন বলে আমাদের চেয়ে বেশি সভ্য ছিলেন তা ভাববার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কলকাতার ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘সমাচার দর্পণ’ ও অন্যান্য পত্রিকায় আমাদের দেশে দাস কেনাবেচার বহু বিজ্ঞাপন ও সংবাদ বেরিয়েছে, কিন্তু তার অধিকাংশই হল নির্মম দারিদ্র্যের চাপে স্ত্রী—পুত্র—কন্যা বিক্রয়ের সংবাদ। মর্মান্তিক সংবাদ সন্দেহ নেই, কিন্তু তখনকার ইংরেজদের কাজে তার জন্য লজ্জিত হবার কোনো কারণ ছিল না। জাতি হিসেবে ইংরেজদের তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে একজন শ্রেষ্ঠ ইংরেজ হোরেস ওয়ালপোল বলে গেছেন :

A gaming, robbing, wrangling, railing nation without principles, genius character or allies; the over-grown shadow of what it was (1771).

আমাদের বক্তব্য হল, এহেন ইংরেজরা যে আমাদের দেশে জাতীয় নবজাগরণের অগ্রদূতরূপে কাজ করেছেন সেটা অতিকথা, রূপকথা ও নিছক কল্পনা কিছু নয়। একই সময় পৃথিবীতে কতকগুলি যুগান্তকারী আবিষ্কার ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা যেমন সজাগ হয়েছেন, তেমনি আমরাও হয়েছি, শুধু ঘটনাচক্রে ইংরেজরা যোগসূত্রের কাজ করেছেন মাত্র। ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের আঘাত অনুভব না করলে শুধু শিল্প বিপ্লব ইংরেজ জাতকে কতটা ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যেত তা নিশ্চয়ই ভাববার বিষয়। এই সময় ইংলন্ডের ছাপাখানার প্রসার হয়, ছাপা বই—পত্রিকার সংখ্যা বাড়ে, অসংখ্য সংঘ গড়ে ওঠে, নগরে নগরে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের বিস্তার হয়। এককথায়, নতুন ভাবধারা প্রচারের জন্য বইছাপা কল যখন অসংখ্য বইপত্র—ইস্তেহার ছেপে ইংলন্ডের কুৎসিত শিল্পনগরগুলিকে গ্রন্থনগরীতে পরিণত করে, তখন ইংরেজ জাতিরও নবজাগরণ শুরু হয়। সেটা বেশি দিনের কথা নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা। এই সময়েই যে ইংলন্ড বই ছাপা ও ছাপার হরফের সংস্কার হয়, তা আগে বলেছি। ঠিক এই সময়েই আমাদের দেশের বড় বড় শহরে মুদ্রাযন্ত্র আসে, যন্ত্রযুগের সবচেয়ে বৈপ্লবিক যন্ত্র। পর্তুগিজ ও ইংরেজরাই তা আনেন, কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়, একটা ঘটনামাত্র। মুদ্রাযন্ত্র তাঁদের আবিষ্কার নয়, জার্মানদের। ইংরেজরা মুদ্রাযন্ত্র বহন করে এনেছিলেন এ দেশে নিজেদের কাজের জন্য। তার চেয়ে অনেক বড় কথা, অনেক বেশি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ কথা হল, এই মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ও ব্যবহারে ইংরেজদের চেয়ে এ দেশের লোক বেশি ছাড়া কম আগ্রহশীল ও তৎপর ছিলেন না। পাদরি সাহেবরা বই ছাপার ব্যাপারে তৎপর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ছাপাখানার এ দেশি কম্পোজিটার ও কারিগররা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে এ পথে এগিয়ে গেছেন। তার প্রমাণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং এরকম আরও অনেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামমাঝির মধ্যে কলকাতা শহরে যতগুলি ছাপাখানা স্থাপিত হয় এবং যতগুলি বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তা প্রধানত এ দেশি বাঙালিদের উদ্যোগে। কলকাতা শহরকে প্রধানত বাঙালিরাই গ্রন্থনগরীতে পরিণত করেন। শুধু রামমোহন রায় বা দ্বারকানাথ ঠাকুর নন, পঞ্চানন কর্মকার, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, বিশ্বানাথ দেব, বদন পালিত, মহেন্দ্রলাল মুনশি হেদাতুল্লা, মহম্মদ দেরাসতুল্লা (‘মহাম্মদি যন্ত্র’র প্রতিষ্ঠাতা) কাজী সফীউদ্দিন (‘সোলেমান প্রেস’—এর প্রতিষ্ঠাতা) এবং আরও অনেকে বাঙালির নবজীবনের অগ্রদূত। আমাদের আধুনিক সংস্কৃতি—প্রাসাদের বনিয়াদ, এমনকি একতলা পর্যন্ত বলা চলে, এঁরাই ইট গেঁথে গড়ে তুলেছেন।

ঐতিহাসিকরা শুধু ইংরেজ শিক্ষাব্রতী ও পাদরিদের কথা, রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথের কথা লিখে গেছেন—ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা এঁদের কথা সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখবেন। না লিখলে নতুন যুগের বাঙালির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। কারণ যখন কলকারখানা বিশেষ গড়ে ওঠেনি, শুধু দু’একটা ধানকল ও গমপেষাই কল এসেছে—যখন রেলপথ, টেলিগ্রাফ হয়নি, আধুনিক ডাকব্যবস্থাও ছিল না—তখন এঁরাই মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, বইপত্র ছেপে প্রকাশ ও প্রচার করে, ঘুমন্ত দেশকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বাঙালির নবজীবনের এঁরাই প্রথম চারণ, প্রথম বৈতালিক—ধর্মতলা, শাঁখারিটোলা, চোরবাগান, শোভাবাজার, বটতলা, মির্জাপুর, শিয়ালদহের ছোট ছোট ছাপাখানার খটাং খটাং শব্দে যাঁরা কলকাতাকে গ্রন্থনগরী তথা জ্ঞানবিদ্যার মহানগরী ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির তীর্থস্থানে পরিণত করেছেন। কলকারখানার ভোঁ তার অনেক পরে বেজেছে।

গ্রন্থনগরী কলকাতা

দ্বিতীয় প্রস্তাব

.

কিন্তু দশ বৎসরাবধি ভারতবর্ষে মুদ্রাঙ্কনকার্য্যের অপূর্বরূপ বৃদ্ধি হইয়াছে এবং কলিকাতা নগরে ভুরি ভুরি ঐ যন্ত্রালয় হইয়াছে। তদধ্যক্ষেরা এইক্ষণে প্রতিযোগিতা রূপে এমত উদ্যোগ করিতেছেন যে কে কত উত্তমরূপে অথচ অল্পমূল্যে গ্রন্থাদি ছাপাইতে পারেন।

সমাচার দর্পণ, ২৩ অক্টোবর, ১৮৩৩

ছাপাখানার দৌলতে কলকাতা শহর যে গ্রন্থনগরী হয়ে উঠেছে, ‘সমাচার দর্পণ’—এর এই মন্তব্য থেকেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়। তখনও কলকাতা শহর প্রাসাদপুরী হয়ে ওঠেনি, বিগত শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা বলছি। কলকারখানার চিমনির ধোঁয়ায় কলকাতার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়নি। প্রয়াগ বারাণসীর মতন প্রাচীন ও মধ্যযুগের নগরের তুলনায় কলকাতা তখনও বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছাড়া কিছু নয়, কারণ তখন কলকাতা ছিল—

পাকা বাড়ি …… ……. ১৪,৬২৩

খোলাঘর …… …… ২০,৩০৪

খড়ের ঘর ….. …… ৩০,৫৬৭

কাঁচা ঘর …. …. ১৯,১৯১

কাঁচাপাকা ঘর …. …. ২,৪১৬

একতলা …. …. ১৫,০৩৪

দোতলা …. …. ১২,১২০

তেতলা …. …. ২,৯৯৮

চৌতলা …. …. ১,০১৯

পাঁচতলা …. …. ২০০

ছয়তলা …. …. ৭

সাততলা …. …. ১

অর্থাৎ ইট পাথরের শহর হিসেবেও মধ্যযুগের তীর্থনগরকে তখনও অতিক্রম করতে পারেনি আধুনিক কলকাতা মহানগর। দেবালয়ের নগর, রাজপ্রাসাদের নগর, কারুশিল্পী ও লোকশিল্পীর নগর, এবং পাণ্ডুলিপি ও লিপিকরের নগর তখনও কল—কারখানার আধুনিক শিল্প—বাণিজ্যের নগরের তুলনায় অনেক বেশি ঐশ্বর্যমণ্ডিত। প্রাসাদ নয়, ছাপাখানাই তখন কলকাতা শহরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং আধুনিকতার অন্যতম প্রতীক। প্রাসাদপুরীর ধনিক বাসিন্দাদের জন্য নয়, কোটিপতি—লক্ষপতি ব্যবসায়ী বা মিল—মালিকদের জন্যও নয়, এমনকি চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মজুরদের জন্যেও নয়—মুদ্রাযন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ও কম্পোজিটারদের জন্যেই প্রধানত কলকাতা শহরের ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্ব তখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আধুনিক কালচারের পীঠস্থানরূপে কলকাতা শহরকে যাঁরা প্রথম রূপায়িত করেছেন, যাঁরা সর্বপ্রথম উদ্যোগী হয়ে কলকাতাকে আধুনিক জ্ঞান—বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত করেছেন, তাঁরা মুদ্রাযন্ত্রের মালিক, ছাপা হরফ নির্মাতা ও ছাপাখানার কম্পোজিটার। নতুন যুগের চিন্তা বিপ্লবের তাঁরাই অগ্রদূত, প্রগতির তাঁরাই পথিকৃৎ। আজ তাঁদেরই প্রথম অভিনন্দন জানাতে হয়। শুধু ইট—পাথর নয়, তার চেয়েও বেশি মুদ্রিত গ্রন্থ দিয়ে কলকাতার ভিত গড়া হয়েছে। আজও কলকাতা শহরের মোট গ্রন্থের সংখ্যা ইটের সংখ্যার চেয়ে কম হলেও, নিশ্চয় গৃহের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

১৮২৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় মুদ্রিত সমাচারপত্রের যে তালিকা ছাপা হয়, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বিগত শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যেই, অর্থাৎ রামমোহনের যুগেই, কলকাত শহর ও তার আশপাশে (প্রধানত শ্রীরামপুরে) ছাপাখানার প্রসার কতখানি হয়েছিল। এই সময় ইংরেজি ভাষায় দৈনিকপত্র প্রকাশিত হচ্ছে—’বেঙ্গল হরকরা ও ক্রনিকল’, ‘জানবুল’, ‘কলিকাতা গেজেট’, সপ্তাহে দুই—তিনবার ‘গবর্নমেন্ট গেজেট’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘বেঙ্গল ক্রাণিকল’, সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘লিটেররি গেজেট’, ‘ওরিয়েন্টাল অবজর্বর’, সাপ্তাহিক দ্রব্যমূল্যের পত্রিকা ‘কলিকাতা এক্সচেঞ্জ প্রাইস করেন্ট’, ‘কলিকাতা উইকলি প্রাইস করেন্ট’, ‘ডোমেস্টিক রিটেল প্রাইস করেন্ট’, ‘শ্রীরামপুরের ইংরেজি—বাংলা ‘সমাচার দর্পণ’, ফরাসি সাপ্তাহিক ‘জামিজাহানুমা’, বাংলা পত্রিকা ‘বঙ্গদূত’, ‘সমাচারচন্দ্রিকা’, ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘সম্বাদ তিমিরনাশক’। মুদ্রাযন্ত্রের রীতিমতো প্রতিষ্ঠা না হলে এতগুলি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় এ সম্বন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে: ‘এতদ্ভিন্ন ইংরাজিতে মাসিক ও ত্রৈমাসিক ও সাম্বৎসরিক অনেক প্রকার সংবাদ সংঘটিত পুস্তক ছাপা হইয়া প্রতিনিয়ত প্রকাশ পায় এবং ক্ষুদ্র যন্ত্রালয়ে অনেকানেক গ্রন্থ ইংরাজি পারস্য ও দেবনাগর ও বাঙ্গলা অক্ষরে মুদ্রাঙ্কিত হয় তাহার সংখ্যা লিখনাতিরিক্ত অতএব পাঠকবর্গ বিবেচনা করিবেন যে এতদ্দেশে ছাপা যন্ত্রের কি পর্যন্ত বিস্তার হইয়াছে ও তদ্দারা নানা দেশীয় সমাচার ও নানাবিধ গ্রন্থ রচনায় লোকের কীদৃক উপকার দর্শিতেছে।’ এবার বিচার করে দেখা যাক, বাস্তবিকই ‘লেকের কীদৃক্ উপকার দর্শিতেছে।’

প্রথমত দেশের লোক চোখ মেলে ছাপার অক্ষরের দিকে দেখতে শিখেছেন। গোড়ার দিকে ছাপার অক্ষর দেখলেই তাঁরা চোখ বুজে থাকতেন। কথাটা আরও একটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। প্রথম প্রথম ছাপাখানায় বইপত্র ছাপা আরম্ভ হল, তখন সেই ছাপা বইপত্র, এমনকি ছাপা অক্ষরকে পর্যন্ত এ দেশের লোক অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য মনে করতেন। বিদেশি ও বিজাতীয় গ্রন্থে বই ছাপা হচ্ছে, তা—ও গোড়ায় দিকে ধর্মগ্রন্থই বেশি, সুতরাং সমস্ত ছাপার ব্যাপরটাকে সকলে পাদরি সাহেবদের ষড়যন্ত্র বলে মনে করতেন। এ দেশের ধর্মনাশের ষড়যন্ত্র। বিধর্মীর খাদ্য, পোশাক—পরিচ্ছদ, ধর্মানুষ্ঠানাদি যেমন, ছাপাখানা ও ছাপা বইপত্রও তেমনি অস্পৃশ্য ও বর্জনীয়। ছাপাখানার নাম শুনলে এবং ছাপা বইপত্র দেখলে তাই দেশের লোক ‘নারায়ণ, নারায়ণ’ বলে চক্ষু মুদ্রিত করতেন, এবং হয়তো আত্মশুদ্ধির জন্য মন্ত্রোচ্চারণও করতেন মনে মনে। মনে করুন, কোনো মুদ্রাযন্ত্র চোখে দেখলে বা ছাপা বই স্পর্শ করলে তিনবার গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসতে হত। আরও মনে হয়, মুদ্রাযন্ত্রে ও মুদ্রণের বিরুদ্ধে এই প্রচারে ধর্মান্ধদের সঙ্গে হয়তো কিছুটা পেশাদার লিপিকাররাও তখন বেকার হবার আশঙ্কায় হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে মুদ্রাযন্ত্রের ছাপা পত্রিকা ও গ্রন্থাদির চাপে সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। সাধারণের গোঁড়ামি ও অজ্ঞতাপ্রসূত কুসংস্কারও দূর হয়ে যায়। ‘বঙ্গদূত’ পত্রের এই মন্তব্যটি থেকে এই কথাই মনে হয়: ‘পূর্বে অস্মদেশীয় লোক কোন পত্র ছাপা অক্ষরে মুদ্রিত দেখিলে নয়ন মুদ্রিত করিতেন যেহেতু সাধারণের সাধারণবোধে ইহাই নিশ্চয়ই ছিল যে বর্ণান্তরীয় লোক ছাপায় কেবল আমাদিগের ধর্ম ছাপায় এক্ষণে সে ভয়ে নির্ভর হইয়া অনেক চক্ষুঃপ্রকাশপূর্বক ছাপার পত্র দেখিয়া থাকেন, যেহেতু যথার্থ তাৎপর্য বোধ করিয়াছেন।’

লোকের যে ‘কীদৃক উপকার দর্শিতেছে’, ছাপাখানা ও ছাপা বইপত্রের বিস্তারের ফলে, এই হল তার প্রথম নিদর্শন। দ্বিতীয় ‘উপকার’ হল সাধারণ গ্রন্থাগার। ছাপাখানার আগের যুগে ‘সাধারণ গ্রন্থাগার’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব পৃথিবীর কোনো দেশে ছিল না, এ দেশের ছিল না। প্রাচীন পুঁথিতে গ্রন্থ ‘ভাণ্ডারের’ কথা যা—ই থাক—না কেন এবং তাতে গ্রন্থদানের পুণ্য ও মাহাত্ম্যের কথা যতই বলা হোক—না কেন, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির যুগে ‘পাবলিক লাইব্রেরি’ বা সাধারণ গ্রন্থাগার বলতে আমরা যা বুঝি, তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কলকাতা শহর সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয় ছাপাখানার বিস্তারের পরে। ১৮৩৫ সালে জন গ্রান্ট সাহেবের সভাপতিত্বে টাউন হলের এক সভায় কলকাতায় সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প করা হয়। ‘একশতজন সাহেব ঐ পুস্তাকলয়ে তিনশত টাকা করিয়া দান করিতে স্বীকার করিয়াছেন অতএব ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্থির হইয়াছে এবং অতি শীঘ্র সাহেব লোকেরা নানা পুস্তক দান করিয়া ঐ আলয়ে প্রেরণ করিতেছেন’ (সমাচার দর্পণ, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৫)। দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে প্রথম উদযোগী প্রধানত কলকাতার সাহেবরা, অবশ্য এ দেশের লোকেরাও পিছিয়ে রইলেন না। চার বছর পরে, ১৮৩৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির এক সংবাদে জানা যায় যে, ‘কলকাতাস্থ কতিপয় বিশিষ্ট ধনী মহাশয়েরা স্বদেশীয় লোকদের উপকারার্থে সাধারণ এক পুস্তকালয় স্থাপন করিতে নিশ্চয় করিয়াছেন’। ওই বছর ২৯ জুনের সংবাদে দেখা যায়—’পুস্তকালয়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে এবং তদ্বিষয়ে অনেক চাঁদা হইয়া অনেক আপাততঃ দান ও বার্ষিক মাসে মাসে দান করণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এই পুস্তকালয়ে এইক্ষণে ১৮০০ সংখ্যক পুস্তক আছে। এতদ্দেশীয়দিগের পুস্তকালয়ে সংস্থাপন দ্বারা সুধীরা করণের যে ইচ্ছা তাহা এইক্ষণে হইয়াছে। ১৮৩৩ সালে এই প্রকার এক পুস্তকালয় সংস্থাপনের উদ্যোগ হইয়াছিল কিন্তু তৎসময়ে দ্বাদশ জনও সাহায্য করেন নাই।’ এই সাধারণ গ্রন্থাগার হল মুদ্রাযন্ত্র ও মুদ্রিত গ্রন্থপত্রাদির কীর্তি। কলকাতা শহরের নতুন জ্ঞান—বিজ্ঞানের পথে বিজয়যাত্রার অন্যতম হাতিয়ার এই ‘সাধারণ গ্রন্থাগার’, পাণ্ডুলিপির শহরের কাছে যা ছিল কল্পনাতীত এবং আধুনিক মুদ্রাযন্ত্রের অন্যতম দান।

এইবার ছাপা বইপত্রাদির সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তির কথা বলা যাক। জ্ঞানের রাজ্য আজকাল আর পুঁথির পাতায়, দেবালয়ের অন্ধকার কক্ষে, গৃহস্থের চালের বাতায় বা রাজার গোপন ভাণ্ডারে সীমাবদ্ধ নেই। পাণ্ডুলিপি—যুগের সোনার খাঁচায় আবদ্ধ জ্ঞানবিচার মুদ্রাযন্ত্রের যুগে মুদ্রিত বইপত্রের ডানায় ভর দিয়ে, মুক্ত আলো—বাতাসের মধ্যে জয়যাত্রা করেছে। তার গতিরোধ করার শক্তি নেই কারও। পাণ্ডুলিপির শহর থেকে বহু দূরের নির্বাসিত গ্রাম নয় আর কলকাতা। কলকাতা এখন গ্রন্থনগরী। বাইরের জগৎ থেকে সমস্ত চিন্তাধারা, নতুন নতুন সংবাদ, ইতিহাস ও ভাবধারা বহন করে নিয়ে আসছে ছাপাখানায় ছাপা বইপত্র। শহরের মধ্যেও নানা বিষয়ে ছাপা বইয়ের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। দু’চারটে মাত্র সাহেবদের দোকানও, তা—ও কেবল বইয়ের দোকান নয়, মদ, জুতো, জুয়েলার, আসবাবপত্রের সঙ্গেও বই আছে। দোকানদাররা মধ্যে মধ্যে নানা জিনিসের সঙ্গে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন, কলিকাতার বাসিন্দারা বইয়ের সংবাদ পান। ছাপাখানার আগে এই বিজ্ঞাপন ছিল না, কোনো সংবাদ—বিজ্ঞাপন দিয়ে কাউকে জানানো সম্ভব ছিল না। এখন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, বিজ্ঞাপন দিয়ে কলকাতাবাসীকে জানানো যায় যে, বিদেশ থেকে ভাল ভাল মদ—মদিরা এসেছে, জামাইকার রম, হল্যান্ডের জিন, কানয়াক ব্রান্ডি, ভাল ভাল লিনেন কেম্ব্রিজের পোশাক, রিংপন লকেট, সোনার ঘড়ি, সোনা—বাঁধানো ছড়ি, সোনা—রুপোর পাতমোড়া টুপি, ইলাস্টিক ব্যান্ডসহ গোল কালো লাল সবুজ বেগুনে টুনি, ঘোড়সওয়ার লেডিদের টুপি, ডেস্ক, বাকসো, ট্রাঙ্ক, ম্যাট্রেস, অপটিকাল ও ম্যাথমেটিকাল যন্ত্রপাতি, হার্পিসকর্ড পিয়ানো অর্গান গিটার ভায়োলিন ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র আর তার সঙ্গে কিছু ছাপানো সংবাদপত্র ও বই, যেমন :

Complete set of Churchill’s Voyages, adorned with copper plates & 8 vols Folio.

Brisbane’s Anatomy of Paintaing.

1 vol, folio

Birch’s History of the Royal Society,

4 vols, 4 to

Halhed’s Gentoo laws, 1 vol, 8 vo Gogul’s arts and sciences,

3 vols, 8 vo.

Bruenonia climents medicinoe, 1 vol. 12 mo.

Hume’s History of England 8 vols. 8 vo.

Harris’s Life of Cromwell, 1 vol, 8 vo.

Raynal’s Revolution of America, 1 vol. 8 vo.

Voltaire’s Age of Lewis XIV and XV, 3 vols.

8 vo,

Voltaire’s Philosophical History, 1 vol, 8 vo,

Voltaire’s Memoirs, 1 vol, 8 vo,   ইত্যাদি।

১৭৮৪ সালের ৭ অক্টোবরের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় অ্যান্ড সাহেবের বিজ্ঞাপন থেকে উদ্ধৃত কয়েকটি বইয়ের নাম, তা—ও বিজ্ঞাপনটি হল—‘Part of the elegant collection lately arrived from London.’

এইভাবে মদ—মদিরা, লকেট—ঘড়ি, ছড়ি—টুপির সঙ্গে বইয়ের বিজ্ঞাপন যাঁরা পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন তাঁরা জানতেন না যে, কী প্রচণ্ড সামাজিক বিপ্লবের পথ তাঁরা সুগম করে দিয়েছিলেন। যাঁরা ব্যবসা করবেন টাকার জন্য, তাঁদের কাছে বইও যা, ব্রান্ডিও তা—ই। তাই নিশ্চিন্ত মনে ‘Ladies and Gentlemen of the Settlement’—এর কাছে যেমন তাঁরা ‘bottled in London’ শেরি—বার্গান্ডি ব্রান্ডির বার্তা জানাতেন, তেমনি লন্ডন থেকে আমদানি ভল্টেয়ারের গ্রন্থাবলি, রেনলের মার্কিন বিপ্লব, গিবনের ‘রোম—সাম্রাজ্যের উত্থান—পতনের ইতিহাস’, হিউমের ‘ইংলন্ডের ইতিহাস’ ইত্যাদি গ্রন্থের কথাও জানাতে ভুলতেন না। মুদ্রাযন্ত্র ও মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে আমেরিকার বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের কাহিনি তখন প্রচারিত হচ্ছে এ দেশের লোকের মধ্যে, কলকাতা শহরে ‘ক্যালকাটা গেজেট’ সম্বন্ধে সিটন—কার সাহেব লিখেছেন—

‘The accounts of the progress of the French Revolution, with all its horrible incidents take up half of the paper.’

কোথায় প্যারিস, আর কোথায় কলকাতা শহর। শুধু বাষ্পীয় জাহাজ নয়, মুদ্রণযন্ত্র ও মুদ্রিত বইপত্র সমস্ত ব্যবধান দূর করে দিয়েছে। গিবন—হিউমের ইতিহাসের সঙ্গে, ভল্টেয়ারের ভাবধারার সঙ্গে কলকাতাবাসীর পরিচয় হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে। বিলেত থেকে আমদানি শেরি—ব্রান্ডি—জিনই যে আমরা পান করেছি তা নয়, গিবন—হিউম—ভল্টেয়ারের ভাবধারায় অবগাহনও করেছি। বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে কলকাতা শহরে, নতুন যুগের ভাববিপ্লব। তরুণ রামমোহনপন্থীরা, ডিরোজিও—রিচার্ডসনের ছাত্র ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দল এই ভাববিপ্লবের আলোড়ন তুলেছেন কলকাতা শহরে, এক হাতে মুদ্রিত গ্রন্থ এবং আর—এক হাতে মদের গ্লাস নিয়ে। রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন : ‘আমি ও আমার সহচরেরা এইরূপ মাংস ও জলস্পর্শশূন্য ব্র্যান্ডি খাওয়া সভ্যতা ও সমাজসংস্কারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শক কার্য মনে করিতাম।’ মদ্যপানের সঙ্গে ভাববিপ্লবের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের প্রমাণ। অন্যত্র তিনি লিখছেন : ‘Cyrus’s travels by Chevalier Ramsay.’ পড়িয়া প্রচলিত হিন্দুধর্মে আমার বিশ্বাস বিচলিত হয়। তৎপরে রামমোহন রায়ের ‘Appeal to the Christian Public in favour of the precepts of Jesus’ এবং চ্যানিং—এর (Channing) গ্রন্থ পাঠ করিয়া ইউনিটেরিয়ান খ্রিস্টিয়ান হই, তৎপরে ঈষৎ মুসলমান হই, পরিশেষে কলেজ ছাড়িবার অব্যবহিত পূর্বে Hume পড়িয়া সংশয়বাদী হই।’ মুদ্রিত গ্রন্থের প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এগুলি—একবার হিন্দু, একবার ইউনিটেরিয়ান খ্রীস্টান, একবার কিঞ্চিৎ মুসলমান, তারপর ঘোর সংশয়বাদী হয়ে আবার হিন্দু—এইভাবে এক একখানা বইয়ের ধাক্কায় এক—একজন বাংলার তরুণ নাকানিচোবানি খেয়েছেন। জানি না, মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপির পক্ষে এইভাবে দেশের তরুণদের মেরুদণ্ড ধরে নাড়া দেওয়া এবং ওষুধের বোতলের মতন ব্রেন ধরে ঝাঁকানি দেওয়া সম্ভব হয়েছে কি না! নিশ্চয়ই হয়নি, তাই মদের ঝিমুনিরই জয় হয়েছে মধ্যযুগে। কিন্তু আধুনিক কলকাতা শহরে তা হয়নি। মদ্য ও মুদ্রিত গ্রন্থ নিয়ে ভাববিপ্লবের সূচনা হলেও, এবং তার অনেকটাই উচ্ছ্বসিত ফেনা ও বুদবুদ হলেও, তার তলানি যেটুকু জমেছে তা গ্রন্থের জন্যেই। শুধু বিলেত থেকে যে বই আমদানি হয়েছে তা নয়, কলকাতা শহরেই ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্যের বই বাংলা ভাষায় প্রায় দেড় হাজার ছাপা হয়েছে, বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝির মধ্যে। লঙের ‘Descriptive Catalogue’ দেখলেই মুদ্রিত বাংলা বইয়ের এই দুঃসাহসিক অভিযানের পরিচয় পাওয়া যায়, বোঝা যায় কেন মদ্য ও মুদ্রিত গ্রন্থের ভাববিপ্লব কেবল ফেনায়িত বুদবুদের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়নি, কিছুটা তার সলিড তলানিও জমেছিল। পরবর্তীকালে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যুগে যখন রেললাইন তৈরি হল, কলকারখানা গড়ে উঠতে লাগল এবং তার ভিতর দিয়ে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের সত্যিকারের গোড়াপত্তন শুরু হল, তখন আমরাও ভাববিপ্লব থেকে সমাজবিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে লাগলাম, আমাদের জাগৃতি—আন্দোলনের বনিয়াদও পাকা হল।

কলকাতা শহর তখন গ্রন্থনগরী থেকে শিল্পনগরীতে পরিণত হয়েছে। মুদ্রণযন্ত্রের পাশে তখন কলকারখানা ও স্টিম ইঞ্জিনের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

.

* এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমার ‘জনসভায় সাহিত্য’ গ্রন্থে করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *