কালীঘাটের পট
প্রথম প্রস্তাব
‘আমরা বিশ্বকর্মার পুত্র বটি, আমরা বাঙালির ছেলে কর্মদোষে ছোট হয়ে পড়েছি।’ বীরভূম জেলার পানুড়িয়া গ্রামের পটুয়া ছবিলাল চিত্রকরের কথা, শহরের কোনো শিক্ষিত সমালোচকের কথা নয়। ছোট্ট কথার মধ্যে অনেক বড় কথা বলা হয়েছে। বাংলার পটুয়ারা বাঙালির ছেলে এবং বিশ্বকর্মার পুত্র, কর্মদোষে ছোট হয়েছে সমাজে। কালীঘাটের পট যারা এঁকেছে তাদেরও পরিচয় তা—ই। তারা বাঙালির ছেলে, বাংলার মাটিতেই তাদের পটশিল্পের বিকাশ হয়েছে। ‘কলকাতা কালচার’—এর সংস্পর্শে তাদের অবনতি ও বিলুপ্তি ঘটেছে। কলকাতার লিথোগ্রাফিক প্রেস বটতলার খোদাইশিল্পী ও কালীঘাটের পটুয়াদের নির্মূল করে দিয়েছে।
কালীঘাটের পট ও পটুয়াদের সম্বন্ধে কোনো কথা বলার আগে মনে হয়, পট কী? পটুয়ারা কারা? কোথা থেকে তারা কলকাতা শহরে এল এবং কেনই বা কালীঘাটের মন্দিরের আশপাশে বাসা বাধল? কেন তারা সমসাময়িক বতটলার শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দেয়নি? কেনই বা বাঙালির ছেলে এবং বিশ্বকর্মার পুত্র হয়েও অবশেষে তাদের অমন শোচনীয় অধঃপতন হল? কেন তারা পটের বিষয়বস্তু ও অঙ্কনরীতির বৈশিষ্ট্য ছেড়ে বিদেশি ইংরেজ ও ফরাসি শিল্পীদের অনুকরণ করল? এবং কেন শেষ পর্যন্ত কালীঘাটের সেই বিখ্যাত পটুয়াপাড়ার সমস্ত খ্যাতি অবলুপ্ত হয়ে গেল? কালীঘাটের পট ও পটুয়া প্রসঙ্গে এই ধরনের অনেক প্রশ্ন মনে জাগে। প্রশ্নের উত্তর চাই।
‘পট্ট’ বা ‘পট’ বলতে কাপড় বোঝায়। তুলি দিয়ে ছবি আঁকাকে বলে ‘চিত্রলিখন’। পটুয়ারা তাই পট আঁকা না বলে ‘পটলেখা’ বলে। এককালে আমাদের দেশে কাপড়ের উপর ছবি আঁকার রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এইজন্য ‘পটকার’ বা ‘পট্টিকার’ বলতে তন্তুবায় ও চিত্রকর উভয়কেই বোঝাত। বাংলা দেশে সাধারণত দুই শ্রেণির পট দেখা যায়, (১) একচিত্রের ছোট ছোট চৌকো পট, (২) সারবন্দিভাবে আঁকা বহুচিত্রের ‘দিঘল—পট’ বা ‘জড়ানো পট’। আট—দশ হাত থেকে বিশ—পঁচিশ হাত দীর্ঘ কাগজের উপর (কাপড়ের উপরে পরে অর্থাভাবে আর আঁকা হত না) সাধারণত কোনো পৌরাণিক কাহিনি চিত্রিত করে পটুয়ারা সুর সহযোগে সেই কাহিনিকাব্য আবৃত্তি করত, এবং পট দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। দীর্ঘ পটের দুই প্রান্তে দু’টি বাঁশের দণ্ড লাগিয়ে একটিতে পট জড়িয়ে রাখা হত। চব্বিশ পরগনা, বীরভূম, বর্ধমান প্রভৃতি জেলায় কিছুদিন আগেও পটুয়ারা এইভাবে গান গেয়ে, পট দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত এবং গ্রামের লোকের আর্থিক সাহায্যে জীবনধারণ করত। আজ আর তাদের দেখা যায় না। ‘বীরভূমের ইতিহাস’ লেখক গৌরীহর মিত্র লিখেছেন : ‘পল্লীতে পল্লীতে তখন পটুয়াগণ ভগবল্লীলার নানাবিধ পট চিত্রিত করিয়া তদন্তর্গত বিষয় গানের দ্বারা সাধারণ লোক ও মহিলাগণের আয়ত্ত করিতে যথেষ্টরূপ সহায়তা করিত। এই পটুয়াগণই আমাদের পল্লীগ্রামের চিত্রশিল্পের অন্যতম প্রধান রক্ষক।’
পুরাণকাররা বলেন, ব্রাহ্মণবেশী বিশ্বকর্মার ঔরসে গোয়ালিনিবেশী ঘৃতাচীর গর্ভে চিত্রকরদের আদিপুরুষের জন্ম। তাঁদের ন’জন পুত্রসন্তান হয়েছিল—মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবায়, কুম্ভকার, কাংস্যকার, সূত্রধর, স্বর্ণকার ও চিত্রকর। সুতরাং পটুয়ারা শুধু একা নন, বাংলার অন্যান্য শিল্পীরাও তাঁদের সগোত্র। চিত্রকরদের সম্বন্ধে আরও বলা হয়েছে—
ব্যতিক্রমেণ চিত্রাণাং সদ্যশ্চিত্রকরস্তথা।
পতিতো ব্রহ্মশাপেণ ব্রাহ্মণানাঞ্চ কোপতঃ।।
চিত্রকররা চিত্রাঙ্কনের ব্যতিক্রম করায় কুপিত ব্রাহ্মণের শাপে পতিত হয়েছে বেশ বোঝা যায়, বাংলা দেশের আদিম অধিবাসীদের মধ্যেই পটুয়া চিত্রকরদের উৎপত্তি হয়েছিল। তারপর আর্যভাষাদের এ দেশে আগমনের পর এবং হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমাজে তারা পতিত হয়েছে। এই ইতিহাসই নানারকম কিংবদন্তির অন্তরালে আত্মগোপন করে আছে।
সমাজে পতিত হবার ফলে পটুয়াদের অস্তিত্ব একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। অবশ্য এই জাতিভেদ তাদের বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দিয়েছে, কারণ একদিন যে পটলিখনের সাংস্কৃতিক প্রয়োজন ছিল পরবর্তীকালে সেই পটশিল্পের পেশা হয়ে প্রতিপন্ন হওয়ায় অনেকে জাতিগত ও বংশগত পেশা ছেড়ে অন্য কোনো বৃত্তি গ্রহণ করেছে। এইভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের উগ্রতার যুগে পটুয়াশ্রেণি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেছে। তবু যতদিন পর্যন্ত প্রাচীন গ্রাম্য সমাজের কাঠামোটিতে ভাঙন ধরেনি, অর্থাৎ প্রায় ব্রিটিশ পূর্ব যুগ পর্যন্ত, ততদিন পটুয়াদের অস্তিত্বও একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি। ব্রিটিশ যুগে গ্রাম্যসমাজের কাঠামোটি যখন ভাঙতে আরম্ভ করল, তার আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা নষ্ট হয়ে গেল, তখন পটুয়াশ্রেণির যেটুকু অস্তিত্ব ছিল তা—ও ক্রমে লোপ পেয়ে যেতে লাগল। ১৮৭২ সালের লোকগণনায় যোগী (তন্তুবায়) ও পটুয়াদের বিভিন্ন জাতি বলে গণ্য করা হয়, এবং তাতে দেখা যায় যে তখনও, অর্থাৎ আজ থেকে ৭৫ বছর আগেও চব্বিশ পরগনায় প্রায় ৮২,৯০৩, বীরভূমে ২৯৯৯, বর্ধমানে ৭৭৫১ জন যোগী ও পটুয়া স্বজাতি পেশায় নিযুক্ত ছিল।
কিন্তু কলকাতা শহরে কালীঘাটে পটুয়ারা এল কোথা থেকে এবং কেন এল?
আগে বটতলার কথা বলেছি। কিন্তু বটতলাই শুধু কলকাতার সংস্কৃতিক্ষেত্র জাঁকিয়ে বসে ছিল না। কালীঘাটও ছিল। উত্তরে বটতলা এবং দক্ষিণে কালীঘাট, এই ছিল কলকাতার দুই প্রধান সংস্কৃতিকেন্দ্র, বিশেষ করে অষ্টাদশ—ঊনবিংশ শতাব্দীতে। কলকাতা ও তার আশপাশের মধ্যে কালীঘাটই হল প্রাচীনতম। বটতলা তার অনেক পরে গজিয়ে উঠেছে। বিপ্রদাসের ‘মনসাবিজয়’ (১৪৯৫ খ্রিঃ অঃ) এবং কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডী’ কাব্যে (১৫৭৭ খ্রিঃ) কালীঘাটের উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে ‘চিৎপুর’, ‘কলকাতা’র কথাও আছে। কিন্তু চিৎপুর বা কলকাতা তখন গ্রাম ছিল, বটতলায় বট গাছটিও হয়তো ছিল, তবে বটতলা বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। কথিত আছে, প্রতাপাদিত্য খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায় কালীঘাটের মন্দির প্রথম নির্মাণ করেন। বর্তমান মন্দির তৈরি করেন বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের সন্তোষ রায়, ১৮০৯ সালে। এই মন্দিরের আশপাশেই বিভিন্ন বৃত্তির লোকদের সমাবেশে ধীরে ধীরে একটা বাজার গড়ে ওঠে। স্বর্ণকার, কুম্ভকার, শঙ্খকার প্রভৃতির সঙ্গে চিত্রকর পটুয়ারাও এই সময় আসতে থাকে, সম্ভবত ষোড়শ—সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই। উত্তর কলকাতায় গোবিন্দপুর থেকে সুতানুটি, অর্থাৎ চিৎপুর—বটতলা পর্যন্ত প্রধানত শেঠ—বসাকদেরই বাস ছিল এবং তাঁদের হাটবাজার ছাড়া আর কিছু ছিল না। কলকাতার তখন অন্যতম গন্তব্য স্থান ছিল কালীঘাটের কালী মন্দির। চৌরঙ্গি ও ভবানীপুরের অধিকাংশই তখন জঙ্গলীকার্ণ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লোকলয়ের চারদিকে বন্য জন্তুদেরও বসবাস ছিল। পথঘাট বিশেষ ছিল না। থাকলেও, জঙ্গলাকীর্ণ চৌরঙ্গির ভিতর দিয়ে কালীঘাট—অভিমুখী তীর্থযাত্রীদের পায়ে—হাঁটা একটি অরণ্যপথ তৈরি হয়েছিল। পথের আশপাশে বন্য জন্তু ও চোর—ডাকাতরা ওঁত পেতে থাকত যাত্রীদের উপর হামলা করার জন্য। দলবদ্ধ হয়ে গ্রাম্য তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে যাতায়াত করত।
গ্রামের এই তীর্থযাত্রীদের জন্যই কালীঘাটের পটুয়ারা পট আঁকত (লিখত বলা উচিত), শহরের লোকদের জন্য নয়। গ্রামে তাদের প্রতিষ্ঠা ও পসার ক্রমে কমে আসছিল, গ্রামের লোকজনের আর্থিক সঙ্গতিও আর ছিল না তাদের বাঁচিয়ে রাখার মতন। গ্রাম্য সমাজের মধ্যে বা গ্রাম্য সীমানার মধ্যে পট লিখে, গ্রাম্য দেবালয়ে ছোট ছোট চৌকো পট বিক্রি করে, গ্রামের লোকের বাড়ি—বাড়ি দীর্ঘ পট দেখিয়ে পালাগান করে ভিক্ষা চেয়ে দিন আর কাটছিল না, কোনোরকমে বেঁচে থাকাও সম্ভব হচ্ছিল না। একে ব্রাহ্মণ্যপ্রধান গ্রাম্য সমাজে তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই, তার উপর শাস্ত্রকারদের কঠোর অনুশাসন মেনে পট বা চিত্র আঁকারও তারা বিরোধী। বংশানুক্রমে যেরকম বলিষ্ঠ সাবলীল ভঙ্গিতে, বাধাবন্ধনহীন কল্পনার সাহায্যে পটুয়ারা চিরদিন অবলীলাক্রমে পটচিত্র এঁকেছে, সেইভাবেই তারা আঁকতে চায়—তা সে দেবদেবীর মূর্তিই হোক, আর জন্তুজানোয়ার বা যে—কোনো বিষয়ের ছবিই হোক। শাস্ত্রীয় অনুশাসনের কাছে বাংলার পটুয়ারা তাদের যুগযুগান্তের ঐতিহ্যগত তুলি—কলমের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়নি এবং এই ‘ব্যতিক্রম’—এর (‘বিদ্রোহই’ বলা উচিত) জন্যই ব্রাহ্মণের অভিশাপে তারা পতিত হয়েছে।
গ্রাম থেকে শহরে আনার প্রয়োজন দেখা দিল। জাতিভেদ—কলুষিত গ্রাম্য সমাজের ক্রমিক অবনতি এবং আর্থিক দুর্গতি হল তার কারণ। গ্রামের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ছেড়ে জীবিকার জন্য পটুয়াদের কোনো বৃহত্তর ক্ষেত্রে যাবার প্রয়োজন হল, গ্রাম্য দেবালয়, গ্রাম্য তীর্থ ছেড়ে কোনো বৃহত্তর তীর্থস্থানে। তা না হলে অবশ্য বংশগত বৃত্তি ছাড়তে হয়, পট আঁকা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু দিনমজুরি করতে হয়। অনেকে তা—ই করল, বংশবৃত্তি ছেড়ে ভিন্নবৃত্তি অবলম্বন করল বা দিনমজুর হয়ে গেল। যারা তা করল না এবং করতে পারল না, রং—তুলি—কাপড়—কাগজ ছেড়ে হাল—বলদ বা হাতুড়ি ধরতে পারল না, তারা হয় কায়ক্লেশে গ্রামের মধ্যেই পট এঁকে বেঁচে রইল, অথবা শহরে ও বৃহত্তর তীর্থস্থানের দিকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এইভাবেই গ্রাম্য পটুয়ারা এসেছে কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে। কালীঘাটের বিখ্যাত ‘পটোপাড়া’র (পটুয়াদের পাড়া) এবং কলকাতার অন্যান্য স্থানের পটুয়াতোলা ইত্যাদি উৎপত্তিও হয়েছে এইভাবে। এই পটুয়াদের বংশধরই কলকাতার শহরবাসীরা পরে ‘কালীঘাটের পটুয়া’ নামে দেন এবং তাঁদের আঁকা পটচিত্রকে ‘কালীঘাটের পট’ বলেন।
.
দ্বিতীয় প্রস্তাব
বালিঘাটা এড়াইল বেণিয়ার বালা।
কালীঘাটে গেল ডিঙ্গা অবসান বেলা।।
মহাকালীর চরণ পূজেন সদাগর।
তাহার মেলান বেয়ে যায় মাইনগর।।
শ্রীমন্ত সদাগরের বাণিজ্যযাত্রার কথা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম বর্ণনা করেছেন। বেলেঘাটা এড়িয়ে ‘বেণিয়ার বালা’ কালীঘাটে যখন পৌঁছলেন তখন বেলা অবসান প্রায়। মহাকালীর চরণ পূজা করলেন সদাগর। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাণিজ্যযাত্রাকালে বাঙালি বণিকরা কালীঘাটের কালী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন। হয়তো বণিকদের ছাড়াও অন্যান্য যাত্রীদের ডিঙা কালীঘাটের গঙ্গার ঘাটে এসে ভিড়ত। শাঁখারি, কাঁসারি ও আরও সব কারিগরদের মতন কালীঘাটের পটুয়ারাও নানা রকমের পট বেচে কিছু পয়সা পেত। তবে গঙ্গার উপর দিয়ে নৌকাপথে খুব বেশি যাত্রীর সমাগত হত না তখন। নৌকাপথ ছাড়াও আরও দু’একটি পথ ছিল কালীঘাট যাবার। প্রধানত কালীঘাটের তীর্থযাত্রীরাই পায়ে হেঁটে সেই পথ তৈরি করেছিলেন। গঙ্গার পূর্বদিকে কলকাতার মধ্যে চৌরঙ্গির ভিতর দিয়ে কালীঘাট পর্যন্ত একটি পথ, আর—একটি গঙ্গার পশ্চিমদিকে বড়িশা—বেহালা থেকে কালীঘাটের মন্দিরের উল্টোদিক পর্যন্ত পথ। ঘাটে—খেয়া পার হয়ে মন্দিরে আসতে হত, কারণ কালীঘাটের ব্রিজ তৈরি হয়েছে ১৮২২—২৩ সালে। বড়িশা—বেহালা তখন এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু স্থান। স্থানীয় জমিদার (কলিকাতা, গোবিন্দপুর, সূতানুটি প্রভৃতি গ্রামের) সাবর্ণ চৌধুরীদের বাসস্থান বড়িশায় এবং বাঙালি ভুঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের বসন্ত রায়ের পরিবারের বাস বড়িশার কাছাকাছি সরশুনায়।
এঁরাই কালীঘাট মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুতরাং সরশুনা—বড়িশা থেকে কালীঘাট পর্যন্ত যাতায়াতের পথ তখন নিশ্চয় ছিল এবং সেই পথ দিয়ে গঙ্গার পশ্চিম পারের অনেক তীর্থযাত্রী খেয়া পার হয়ে কালী মন্দিরে আসতেন। চৌরঙ্গি—কালীঘাটের পথেও যাত্রীরা আসতেন। দক্ষিণে বারুইপুর, সোনারপুর, গড়িয়া, টালিগঞ্জের পথেও যাত্রীরা আসা—যাওয়া করতেন। কিন্তু পথগুলি শুধু পায়ে—হাঁটা গ্রাম্য নয়, অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পথ ছিল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ, তার উপর আশপাশে বন্য জন্তু ও চোর—ডাকাতের উপদ্রব। সুতরাং বিশেষ পালপার্বণ ছাড়া যাত্রীদের পক্ষে কালীঘাটের মন্দিরে আসা হত না। তবু আশপাশের অন্যান্য গ্রাম্য দেবালয়ের চেয়ে কালীঘাটের প্রাধান্য তখন বেশি এবং যাত্রী—সমাগমও বেশি। তাই কালীঘাটকে কেন্দ্র করে কারিগর ও কারুশিল্পীদের বাজার জমে উঠল, যেমন এ দেশের সব তীর্থস্থানে জমে উঠেছে। সেই বাজারে গ্রাম্য যাত্রীদের কাছে দু’এক পয়সায় পট বিক্রি করে কালীঘাটের পটুয়ারা তখন স্বচ্ছন্দে জীবনধারণ করত। শুধু যে বাজারে পট তারা বিক্রি করত তা নয়, কালীঘাটের আশপাশে তখন গ্রাম্য পরিবেশ ছিল। ডিহি চক্রবেড়ে, ভবানীপুর, রসা ইত্যাদি গ্রাম। দীর্ঘ পট দেখিয়ে, গান গেয়ে, গ্রামে গ্রামে ঘুরেও হয়তো তারা জীবিকা অর্জন করত। না—করাটাই আশ্চর্য, কারণ পট বিক্রির চেয়ে পট দেখিয়ে, গান গেয়ে জীবিকা অর্জন করাই ছিল তাদের বংশানুক্রমিক পেশা।
ষোড়শ—সপ্তদশ শতাব্দীর কালীঘাটের পটুয়াদের আঁকা সেইসব পট আজও কেউ দেখেছেন কি না জানি না, এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর কালীঘাটের পটের আসল বা প্রতিলিপি কোনোটাই আজ আর চোখে পড়ে না। না পড়লেও ক্ষতি নেই, কারণ সেই সময়কার বাঙালি পটুয়াদের আঁকা পট দেখেই অনেকটা বোঝা যায় কালীঘাটের পটুয়ারা কী আঁকত। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বন করে দেবদেবী, দৈত্যদানব, পশুপক্ষীর মূর্তি তারা আঁকত। তা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হল পটুয়াদের আঁকা বৈষ্ণব চিত্রাবলি।
নদিয়া, বর্ধমান, চব্বিশ—পরগনা প্রভৃতি জেলায়, কলকাতা ও কালীঘাটের চতুর্দিকে তখন বৈষ্ণবধর্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার জোয়ার এসেছিল। বৈষ্ণবধর্মের এই প্রভাব বাঙালি পটুয়াদের উপরেও প্রচণ্ডভাবে পড়েছিল। তারই প্রভাবে পটুয়ারা শুধু দেবদেবীর মূর্তি নয়, শ্রীচৈতন্য, অদ্বৈতাচার্য, নিত্যানন্দ, হরিদাস, রূপগোস্বামী, জীবগোস্বামী প্রভৃতির মূর্তিচিত্র আঁকতে আরম্ভ করে। এই ধরনের অনেক মূর্তিচিত্র স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেন একসময় অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংগ্রহ করেছিলেন। এইসব বৈষ্ণব গুরু ও আচার্যদের মূর্তিচিত্রগুলি লক্ষ করলে দেখা যায়, শুধু বলিষ্ঠ লীলায়িত রেখা নয়, টানা টানা ভাবাবিষ্ট আয়ত চোখ ও মুখাবয়ব তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে আমাদের এই বাঙালি পটুয়াদের তুলি যেন একটা স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। বাংলার বৈষ্ণবধর্ম বাঙালি পটুয়ার তুলির উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা এখনও কেউ বিশেষ বিচার করে দেখেননি। গতিশীলতাই যে চিত্রের প্রাণ, এ শিক্ষা বাঙালি পটুয়ারা তাদের পূর্বপুরুষ বাংলার আদিম শিল্পীদের কাছ থেকেই বংশানুক্রমে পেয়েছে। তারপর বৌদ্ধ, হিন্দু ও বৈষ্ণবধর্মের যুগে সেই চিত্রকে তারা ভাবমণ্ডিত করেছে। বৈষ্ণব যুগে তারা যে মূর্তিচিত্র আঁকতে সিদ্ধহস্ত ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ইংরেজ শিল্পীদের কাছ থেকে যে কালীঘাটের পটুয়ারা সামাজিক মূর্তিচিত্র আঁকতে শিখেছিল তা মনে হয় না। জন্তুজানোয়ারের চিত্রও তার অনেক আগে থেকেই তারা আঁকতে পারত। ইংরেজ ও ফরাসি শিল্পীদের কাছ থেকে কালীঘাটের পটুয়ারা কেবল পটচিত্রের একটি নতুন বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছিল, সেটি হল সমসাময়িক সমাজের ব্যঙ্গচিত্র। এছাড়া তাদের আঁকা মূর্তির মধ্যে পরে বিলেতি ঢঙের ছাপও পড়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই কালীঘাটের পটুয়াদের অধঃপতন হয়েছে এবং ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে তারা এগিয়ে গেছে। নাগরিক জীবনের সংস্পর্শে এসে তারা সমসাময়িক রুচি ও ফ্যাশনের স্রোতে ভেসে গেছে। সে কথা পরে বলছি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝির পর থেকেই কালীঘাটের মন্দির ও তার পরিপার্শ্বের রূপ দ্রুত বদলাতে থাকে বলে মনে হয়। আমাদের চাঁদ সদাগর, শ্রীমন্ত সদাগরদের যুগ তখন কেটে গেছে। ঘরে বসে বাঙালির ছেলেরা রূপকথার মতন সেই বাঙালি সদাগরদের কাহিনি শুনছে। ইংরেজ সদাগরের যুগ এসেছে এবং নতুন একশ্রেণির বাঙালি জমিদার ও বেনিয়ানদের। কালীঘাটের মন্দিরে মানত ও পূজার্চনার ধুমধামও বেড়েছে। ইংরেজ সদাগরদের হাতে কাঁচা পয়সা, তার উপর সদ্য তাঁরা রাজসিংহাসন পেয়েছেন। বাঙালি সমাজের সঙ্গে তাঁরা নতুন মিশছেন, তাঁদের আদবকায়দা, রীতিনীতি, এমনকি ধর্মকর্ম পর্যন্ত তাঁরা অনুসরণ করছেন। ওদিকে নতুন একশ্রেণির বাঙালি জমিদার, বেনিয়ান, দেওয়ান, মহাজনদের হাতেও কাঁচা পয়সা আসছে। সুতরাং পূজা—মানতের ধুমে কালীঘাট বেশ সরগরম হয়ে উঠছে।
১৮২৮ সালে কালীঘাট সম্বন্ধে পাদরি ওয়ার্ড সাহেব লিখছেন: ‘আমি শুনেছি পঞ্চাশ বছর আগে মহারাজা নবকৃষ্ণ কালীঘাটে পুজো দিয়েছিলেন প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে। আমি এমন ইংরেজদেরও দেখেছি, যাঁরা দশ হাজার টাকা খরচ করে কালীঘাটে পুজো দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মচারী একটি মামলায় জিতে তিন হাজার টাকা খরচ করে পুজো দিয়েছিলেন কালীঘাটে। কোম্পানির আমলে শুধু মহারাজা নবকৃষ্ণ নন, আরও অনেক বাঙালি দেওয়ান, জমিদার এবং কৃষ্ণনগর থেকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত কালীঘাটে জাঁকজমক করে পুজো দিতেন। ১৮২২ সালে মহারাজা গোপীমোহন দেব যখন পুজো দিতে এসেছিলেন, তখন মন্দিরের চারদিকে পুলিশ রেখে লোকের ভিড় ঠেকাতে হয়েছিল। কালীঘাট যে তখন কীরকম সরগরম ছিল তা এইসব পূজার্চনার ধুম থেকেই বোঝা যায়। শুধু পূজার্চনা নয়, তখনও লোকে কালীঘাটে মানতের জন্য জিহ্বাবলি, আঙুলবলি দিয়ে আসত এবং গঙ্গাজলের জন্য বহু দূর থেকে মুমূর্ষু বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কালীঘাটের গঙ্গাঘাটে নিয়ে আসা হত। সুতরাং কালীঘাট আর বটতলা এক নয়। কালীঘাটের বাজার যখন জমজমাট, বটতলার আশপাশে তখন টপ্পা আর কবিগানের সুর শোনা যাচ্ছে শুধু। তা ছাড়া বটতলার চেয়ে কালীঘাটের আভিজাত্য ও জাঁকজমক তখন অনেক বেশি। পাল্কি, জুড়িগাড়ি ও দোলদার ছক্কড়ের সমাগম তখন কালীঘাটে যেমন হত, তেমন আর কোথাও হত না। কালীঘাটের পটুয়াদের তখন স্বর্ণযুগ। ইংরেজরা, বাঙালি রাজা—মহারাজা, দেওয়ান—বেনিয়ান ও সাধারণ তীর্থযাত্রীরা তখন পট কিনতেন, আজকালকার সমঝদারদের মতন সংগ্রহ করার জন্য নয়, দু—এক পয়সায় নানা রকমের পট পাওয়া যেত বলে। আর পট কিনত সাধারণ গ্রাম্য তীর্থযাত্রীরা। তারাই ছিল কালীঘাটের পটুয়াদের সবচেয়ে বড় পেট্রন। কোনো বাঙালি রাজা—মহারাজার ঘরে সে যুগের সেসব কালীঘাটের পট একটিও নেই, কারণ তার শিল্পমূল্য তাঁদের কাছে নগণ্যই ছিল বলা চলে। তাঁরা পট কিনেছেন, দু’দিন পরে আবর্জনাস্তূপে ফেলে দিয়েছেন। ইংরেজরাও তখন তা বহন করে ইংলন্ডে নিয়ে যাননি। কালীঘাটের পটুয়ার আসল পট তাই আর দেখবার কোনো উপায় নেই।
কালীঘাটের পটুয়াদের যখন স্বর্ণযুগ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া (১৮২০—২৫ সাল) পর্যন্ত, তখন ব্রিটিশ, ফরাসি প্রভৃতি বিদেশি শিল্পীরা অনেকে কলকাতা শহরে এসেছিলেন। তাঁরা সব বড় বড় ইংরেজ ও বাঙালি বাবুদের পোর্ট্রেট এবং সামাজিক চিত্র আঁকতেন। তাঁদের মধ্যে মঁসিয়ে ও মাদাম বেলনস, মঁসিয়ে স্যাভিঞাক, ফ্যানি পার্কস, ড্যানিয়েল প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। ফ্যানি পার্কসের ‘Wanderings of a Pilgrim in search of the Picturesque’ (কলকাতা, ১৮৫০), মাদাম বেলনসের ‘Twenty four plates illustrative of Hindoo and European manners in Bengal’ (লন্ডন, ১৮৩২), কোলসওয়াদি গ্র্যান্টের ‘An Anglo-Indian Domestic Sketch’ (কলকাতা, ১৮৪৯) ইত্যাদি গ্রন্থের মধ্যে এই জাতীয় প্রচুর ছবি আছে। এঁরা যে শুধু আঁকতেন তা—ই নয়, ছবি ছেপেও প্রকাশ করতেন। ছবি ছাপার জন্য ১৮২০—২২ সালের মধ্যে কলকাতায় লিথোগ্রাফিক প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ছবি ও ছবির বই ছাপা হতে থাকে। প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্বোক্ত দু’জন ফরাসি শিল্পীর চেষ্টায়। বিদেশি শিল্পীদের আঁকা ছবি যখন সস্তায় ছাপা হয়ে বাজারে বেরুল তখন থেকেই কালীঘাটের পটুয়া, বটতলার শিল্পীদের দুর্দিন ঘনিয়ে এল! অর্থাৎ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে বিদেশিদের নকল করার প্রবৃত্তি তাদের মধ্যে জাগল। কালীঘাটের পটুয়ারা সস্তায় সামাজিক চিত্র আঁকতে আরম্ভ করল, গ্রাম্য সাধারণ লোকদের জন্য নয়, তীর্থযাত্রীদের জন্যও নয়, প্রধানত কলকাতার বিকৃতরুচি নব্যবাবুদের জন্য। কালীঘাটের পট সস্তা বটতলার সাহিত্যের আসরে নেমে এল, তার সমস্ত অতীতের ঐতিহ্য ছেড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামঝির পর রেলপথ যখন তৈরি হল, কলকাতায় যাতায়াতের সুবিধার ফলে কালীঘাট—যাত্রীর ভিড় যখন ক্রমে বাড়তে লাগল, তখন কালীঘাটের পটুয়ারাও সস্তায় বেশি ছবি বিক্রির প্রলোভন বোধহয় সামলাতে পারল না। বিদেশি শিল্প, লিথোগ্রাফিক প্রেস, নব্য বাঙালিবাবুদের বিকৃত—রুচি এবং রেলপথে বহু যাত্রীর সমাগম—সব একসঙ্গে মিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির পর থেকে কালীঘাটের পটুয়া ও তার পটকে অবনতির পিচ্ছিল পথে টেনে নিয়ে গেল। বিশ্বকর্মার পুত্র বাঙালির ছেলে, কালীঘাটের পটুয়ারা কবে কোন প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণের অভিশাপে সমাজে পতিত হয়েছিল জানি না, তবে এই আধুনিক যুগে বাণিজ্য, ছাপাখানা, বিদেশি আদর্শ ও এ দেশি বিকৃতরুচি বাবুদের চাপে যে তারা নির্মূল হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
তৃতীয় প্রস্তাব
সেই কালীঘাটও নেই, সেই পটুয়াও নেই, কালীঘাটের পটও নেই আর। পুরুষানুক্রমে যাঁরা কালীঘাটে বাস করছেন, পটুয়াদের যাঁরা পট আঁকতে ও পট বেচতে দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে যে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ—আলোচনা হয়েছে, তাঁরা সকলেই তা—ই বলেছেন। তাঁরা যে শুধু কালীঘাটের বাসিন্দা তা—ই নন, কালী মন্দিরের পুরোহিত পূজারি। আজকের পূজারি বা পুরোহিত নন, সাতপুরুষের পূজারি। তাঁদের কথা অগ্রাহ্য করা যায় না।
কালীঘাটের জাতপটুয়া যারা তাদের আজ আর চিহ্ন নেই কোথাও। অকারণে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে লাভও নেই। যা নেই তা নিয়ে বাঁধাবুলির জাবর কাটাও বৃথা। কিচ্ছু নেই, পোকায় কাটা পটের একটা টুকরো পর্যন্ত নেই কোথাও। পটুয়াপাড়া থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত আদিগঙ্গার পাড়াটাকে তোলপাড় করে ফেলেও কিছু পাওয়া যায়নি, পটের ‘প’ পর্যন্ত না। যা খুঁজেছিলাম, হয়তো তা খ্যাপার ‘পরশপাথর’ খোঁজার মতন, তাই পাইনি। আজকালকার অধিকাংশ পূর্ববঙ্গের পটুয়াদের মধ্যে কালীঘাটের জাতপটুয়াদের দু’চারজন বংশধর বোধহয় শেষ বাতিটি জ্বলিয়ে বসে আছে আদিগঙ্গার পাড়ে। প্রায় নিভ—নিভ বাতি। কেউ উকিলের মুহুরি, কেউ কারখানার মজুর, পালপার্বণে প্রতিমা গড়ে, দৃশ্যপট আঁকে, কিন্তু পট আর আঁকে না। একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে, দুঃখ করে তারা বলে, দুর্গম বস্তির দেড় হাত চওড়া অন্ধকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে, এক হাতে ল্যাম্পো নিয়ে, আর—এক হাতে পোষা দেশি কুকুরটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে একজন বললে: ‘আসল কালীঘাটের পট পাবেন না কোথাও।’ আসলই চাই, নকল কী হবে? দ্বিতীয়জন বলল : ‘পট আনিয়ে দিতে পারি; আর যদি বলেন তো নতুন এঁকেও দিতে পারি।’ ‘কোথা থেকে আনিয়ে দেবে?’ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল ‘কাছাকাছি ডায়মন্ডহারবারের কাছে একটা গ্রাম থেকে। আর যদি দেরি করেন তো মেদিনীপুর ও বীরভূম থেকে জড়ানো পট এনে দিতে পারি।’ এদের মধ্যে একজন বেশ গম্ভীর চালে বলল : ‘কত পট এর মধ্যে এঁকে দিলাম, আনিয়েও দিলাম। অমুক লোকেরা তো প্রায় এসে নিয়ে যেতেন, এখনও মধ্যে মধ্যে নিতে আসেন।’ খ্যাতনামা দু’একজন সংগ্রাহক ও কলা—সমালোচকের নাম করল তারা। আমরা বললাম: ‘দরকার নেই, আমরা কলেক্টরও নই, আর্ট—ক্রিটিকও নই, তোমাদের পূর্বপুরুষদের আঁকা আসল পট যদি কিছু থাকে, তা—ই দেখতে চেয়েছিলাম।’ দেখা হল না বটে, কিন্তু এইটুকু পরিষ্কার বোঝা গেল যে, চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পটুয়ারা কালীঘাটে এসেছিল এককালে, হয়তো—বা শ্রীমন্ত সদাগরদের বাণিজ্যযাত্রার কালে।
কলকাতা শহরে একাধিক সংগ্রাহকের কাছে কালীঘাটের পট দেখেছি এবং পটুয়াদের কাছ থেকেই এমন দু’একটি দোকানেরও সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে পট বিক্রি করা হয়। একখানা কালীর পটের দাম আড়াইশো টাকা। মনে হয়, যারা পট এঁকেছিল এবং এখনও আঁকছে, তারা যদি আড়াইটা টাকাও পেত। পটুয়াটি নিজেই বলল : ‘দেখতে পারেন, তবে কিনবেন না যেন, পাঁচ টাকায় অনেক ভাল পট পাবেন।’ দুঃখ হল এই ভেবে যে, কালীঘাটের পট ও পটুয়ার আজ অস্তিত্ব নেই বললেই হয়। তার কদর এত বেড়েছে এবং জাতপটুয়ার আসল পটের বদলে তার বংশধরদের দিয়ে ফরমায়েশি নকল পট আঁকিয়ে নিয়ে তথাকথিত ‘দুষ্প্রাপ্য দ্রব্য’র ব্যবসায়ীরা দিব্যি ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। অথচ আজকের সমঝদারদের সমাদরের শতাংশের একাংশও যদি কালীঘাটের পটুয়ারা মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও পেত, তাহলে বাংলা দেশের লোকসংস্কৃতি ও শিল্পকলার ইতিহাসে আজ এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে হত।
কালীঘাটের প্রাচীনতম পুরোহিত পরিবারের মুখ থেকে শুনেছি, পটুয়ারা প্রথমে কালী মন্দিরের আশপাশে থাকত, তারপর ধীরে ধীরে উত্তরদিকে পটুয়াপাড়া অঞ্চলে সরে যায়। স্বামী—স্ত্রী, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পট আঁকত, শুধু পুরুষরা নয়। মন্দিরের পাশে পট সাজিয়ে তারা রোজ বেচতে বসত। খুব বেশি মূল্য হলে এক পয়সা থেকে চার পয়সার বেশি দাম নয়। কিনবে কে? গ্রামের তীর্থযাত্রীদের পয়সা কোথায়? ভদ্রলোকেরা কোনোদিনই পটের মূল্য বুঝতেন না। একশো বছর আগেও নব্যবাবুদের কাছে পট ও পটুয়া অস্পৃশ্য ছিল। তখন বাবুদের কাছে বিদেশি প্রিন্ট ছবির সমাদর বেশি। আর সবচেয়ে বড় বাবু যাঁরা তাঁরা মোগল শিল্পীদের ছবির ‘কপি’ রাখতেন দেয়ালে ঝুলিয়ে। শোভাবাজারের রাজবাড়ির নাচঘরে আজও তা ঝুলে রয়েছে। যুগটাই ছিল মোগলাই ও ইংরেজি কালচারে মুর্গমসল্লমের যুগ—বাংলার পুঁটি মাছ, পট—পটুয়া—পুতুল তখন অবজ্ঞার রসাতলে দ্রুত নেমে যাচ্ছে।
পূজনীয়াদের মুখ থেকে পটুয়াদের গল্প শুনেছি। কথাপ্রসঙ্গে তাঁরা বলেন : ‘এই পটের একটুখানি আদরও যদি কয়েকটা দিন আগে হত। কালীঘাটের পট কিন্তু মেয়েরাও আঁকত। আমরা তো মেয়েদেরই আঁকতে দেখেছি বেশি। অদ্ভুত তাদের আঁকার ক্ষমতা। জলচৌকির সামনে বসে পটুয়াদের ঘরের মেয়েরা পট আঁকত—কয়েকটা বলিষ্ঠ তুলির টানে এক—একখানা পট শেষ করে ফেলত। ভুসোকালিই বেশি, রংও তারা নিজেরা তৈরি করে নিত। অনেক সময় পাঁঠার ঘাড়ের চুল দিয়েও তারা তুলি তৈরি করে নিত। সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা তন্ময় হয়ে দেখতাম। কী আশ্চর্য দক্ষতা। সামনে দাঁড়িয়ে পুরুষ—পটুয়াদের আঁকা দেখিনি, তারাও অবশ্য ওস্তাদ আঁকিয়ে। কিন্তু মেয়ে—পটুয়ারা তাদের তুলনায় কোনো অংশেই কম ওস্তাদ ছিল না। আজও মেয়েরা পুরুষ—পটুয়াদের সঙ্গে প্রতিমা গড়ে, দৃশ্যপট আঁকে—কিন্তু আগেকার সেইসব পট আর কেউ আঁকে না।’
যা খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গেলাম। কালীঘাটের পটুয়াদের মধ্যে মেয়ে—পটুয়াদের এই প্রাধান্য থেকে তাদের বহুযুগবিস্তৃত অতীত ইতিহাসের একটু আভাস পাওয়া যায়। শুধু তা—ই নয়, বাংলার শিল্পকলায় সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণির ঘরের মেয়েদের যে মূল্যবান দান আলপনাচিত্র, কাঁথাশিল্প, হাঁড়ি—কলসি—সরাচিত্র প্রভৃতিতে দেখা যায়, তারও একটা ঐতিহাসিক উৎসের হদিশ পাওয়া যায় এইখানে। প্রথম মনে হয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম শিল্পীদের কথা, মেয়ে—পুরুষ উভয়েই শিল্পী, বরং ঘরের মেয়েদেরই প্রাধান্য বেশি। সাঁওতাল পরগনা ও ছোটনাগপুর অঞ্চলে সাঁওতাল—হো—মুন্ডাদের মধ্যে আজও দেখা যায়। বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর হল এই আদিবাসী—প্রধান অঞ্চলের সীমান্ত জেলা এবং ঝাড়খণ্ড, জঙ্গলখণ্ড, মল্লভূমি (বিষ্ণুপুর), বীরভূম—সবই একদিন জঙ্গলাকীর্ণ আদিবাসীপ্রধান অঞ্চলে ছিল। ধীবর, ব্যগ্রক্ষত্রিয়, গোপ ও মাহিষ্যদের মধ্যে স্বাধীন রাজা ও রাজ্যের যেসব কাহিনি শোনা যায়, তার মধ্যে বাস্তব ইতিহাসের বিরাট একটা কঙ্কাল সমাধিস্থ হয়ে আছে। তখনই ছিল বাংলার পটুয়াদের আসল স্বর্ণযুগ। কিন্তু কে সেই কঙ্কাল খুঁড়ে বার করে তাদের বিস্তৃত ইতিহাস রচনা করবে? তারপর উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ—ক্ষত্রিয়রা নতুন করে রাজা দখল করেছেন, এবং তাঁদের অভিশাপে শুধু বাংলার পটুয়ারা নয়, সকল শ্রেণির লোকশিল্পীরা সমাজে পতিত হয়েছে। বীরভূমের ছবিলাল চিত্রকরের কথাই ঠিক। তাঁরা হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি আঁকে, লোকাচার মানে, আবার মুসলমানদের মতন নামাজও পড়ে। কালীঘাটের পটুয়ারাও তা—ই করত। কালীঘাটের পটুয়ারা বাংলার এই পটুয়াদেরই আত্মীয় ও বংশধর। তাদের ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। যতদিন না লেখা হবে ততদিন বাংলার শিল্পকলার ইতিহাস রচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। কলকাতায় বসে আজ আর সেই ইতিহাস লেখা যাবে না। কলকাতার বাবুদের রুচি, ইংরেজ শিল্পী ও লিথোগ্রাফিক প্রেস পটুয়াদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।