মুসা ইবনে নুসাইর বললেন, “জলজ প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এত প্রখর হয় যে, নদী ও সমুদ্রের তলদেশের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিস দেখতে পারে কিন্তু তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে যে জাল পাতা হয় তা সে দেখতে পায় না। আমি দূরদর্শী ছিলাম কিন্তু সুলায়মানের ফাঁদে ফেঁসে গেছি।”
তারেক ইবনে যিয়াদ তো আমীরুল মু’মিনীমের হুকুম অমান্য করার জন্যেও তৈরী হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তার সাথে যেহেতু আমীরে মুসা ছিলেন তিনি তাকে বলেছিলেন, আমীরুল মু’মীনের হুকুম অমান্য করার কোন অবকাশ নেই। এছাড়া বার্তাবাহক আবু নসরও বলেছিলেন তাকে খলীফার শাস্তির হাত তেকে বাঁচার জন্যে। তারেক যখন মুসার আদেশ অমান্য করে ছিলেন তখন তিনি আযাদ ছিলেন আর এখন তিনি মুসার অধীনে।
খলীফার হুকুমের মাঝে যদি নমনীয়তা থাকত এবং তা অগ্রাহ্য করার যদি সামান্যতম সুযোগ থাকত তাহলে মুসা অবশ্যই জবাব দিতেন যে বর্তমানে গোটা স্পেন কজাতে, ফ্রান্স পদতলে এ অবস্থায় দামেস্কে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। দামেস্কে গেলে পুরো বিজিত এলাকা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এ জবাবের যেহেতু অবকাশ ছিল না তাই তিনি দামেস্কে ফিরে যাওয়াই উত্তম জ্ঞান করলেন।
ঐতিহাসিক গিবন লেখেন, মুসা তার ফৌজি বাহিনী নিয়ে ফ্রান্সের মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে সময় ফ্রান্সের বাদশাহ্ ছিল চার্লিস মার্টিন। দামেস্কে ‘ ফিরে যাবার ব্যাপারে যদি পয়গাম না পৌঁছত, তাহলে তারেক ও মুসা দু’বীর বাহাদুর ফ্রান্স বিজয় করেই ছাড়ত। আর আজকে ইউরোপের ধর্ম খৃস্টবাদের পরিবর্তে ইসলাম হত।
মুসা ইবনে নুসাইর যুদ্ধের ময়দানে যেমন অকুতভয় বীর বাহাদুর সিপাহসালার ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে যুদ্ধ ময়দানের বাহিরে তিনি ছিলেন অত্যধিক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ।
নওয়াব জুলকদর জং বাহাদুর তার খেলাফতে উন্দুলুসে লেখেছেন, ইসাবালা অবরোধের ঘটনা, ইসাবালার ফৌজ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুসলমানদের মুকাবালা করল কিন্তু মুসলমানদের বীরত্ব-সাহসীকতায় তারা ঘাবড়িয়ে সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হলো। মুসলমানদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক মুসলমান হতাহত হয়েছিল। তাই মুসা ইবনে নুসাইর সন্ধি প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। শহরের নেতৃস্থানীয় লোক মুসার কাছে এলে তিনি তার শর্ত পেশ করলে শহরবাসী মেনে নিল না। দ্বিতীয়বার আলোচনার তারিখ নির্ধারণ হলো দুদিন পরে। সে সময় মুসার দাড়ি ও মাথার চুল পূর্ণ সাদা। তকালে খেজাব সম্পর্কে কেবল মুসলমানরাই জ্ঞাত ছিল। কারণ খেজাব মুসলমানরাই তৈরী করেছে।
ইসাবালার প্রতিনিধি দল যখন দ্বিতীয়বার আসল, তখন মুসা দাড়ি ও মাথার চুলে খেজাব লাগিয়ে তা লাল বানিয়ে ছিলেন। প্রতিনিধি দলের লোকরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছিল যে মুসার সাদা কেশ লাল হলো কিভাবে। সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা। হলে সিদ্ধান্ত না হয়ে আবার আলোচনায় বসার তারিখ ঠিক হয়।
কয়েকদিন পরে আবার উভয় পক্ষের মুলাকাত হলো। এ সময় তারা এসে দেখল মুসার দাড়ি ও মাথার কেশ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। মুসার বয়স আশি বছরের কাছাকাছি ছিল। তিনি কিছুটা ঝুঁকে চলতেন। এবার তিনি একেবারে নওজোনের মত সোজা হয়ে চলতে লাগলেন। এবারও আলোচনা ব্যর্থ হলো।
মুসা অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়তার সাথে শহরীদেরকে বললেন, এখন তাদের সাথে শহরের ভেতরে সাক্ষাৎ হবে এবং তাদের ফৌজের লাশের ওপর দিয়ে মুসলমানরা শহরে প্রবেশ করবে। এখন আমি নয় আমার তলোয়ার শর্ত ঠিক করবে।
প্রতিনিধি দল চলে গেল এবং তারা পরস্পরে পরামর্শ করতে লাগল, তাদের প্রধান তার সাথীদেরকে বলল, তাদের শর্ত মেনে নাও। মনে হয় ঐ সিপাহসালার মুসার কাছে হয়তো কোন অলৌকিক শক্তি রয়েছে। তোমরা লক্ষ্য কর নাই, সে কি পরিমাণ বৃদ্ধ ছিল? তার দাড়ি ও মাথার একটা চুলও কালো ছিল না, তারপর তার চুল লাল বর্ণ ধারণ করল আজ আবার সে চুলই কালো হয়ে গেছে। এখন সে নওজোয়ানের মত কথা-বার্তা ও চলা-ফেরা করছে। তাছাড়া এটাও লক্ষ্য কর মুসলমানরা দেখতে দেখতে পুরো মুলক কজা করে নিয়েছে।
মুসার তামাম শর্ত মেনে নেয়া হয়েছিল।
***
মুসা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন খলীফার হুকুম তামিল করা উচিৎ। সুতরাং তিনি ও তারেক ইবনে যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে টলেডোতে পৌঁছলেন। সালার মুগীছে রুমিও তাদের সাথে চললেন। মুসা তাকে যাবার জন্যে বলেননি।
আমীরে মুহতারাম! আমি কর্ডোভা বিজয় করেছি। কর্ডোভার গভর্নর অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করছিল। আমাদের ফৌজ অনেক হতাহত হয়েছিল। পরিশেষে গভর্নরকে গ্রেফতার করেছিলাম। আমীরুল মু’মিনীনের দরবারে পেশ করার জন্যে আপনি আপনার সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদী ও অসংখ্য বাদী নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শুধু একজন কয়েদী আমীরুল মু’মিনীনের সমীপে পেশ করব, এটা করার অধিকার আমার আছে কি? মুগীছে রুমী বললেন।
মুসা বললেন, এ অধিকার তোমার অবশ্যই রয়েছে। তারপর তাকে তাদের সাথে যাবার অনুমতি প্রদান করলেন।
টলেডোতে মুসা কয়েকদিন অবস্থান করতে চাইলেন। তাই একজন দ্রুতগামী কাসেদকে দামেস্কে এ পয়গাম দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন, মুসা এবং তারেক চলে আসছে। টলেডোতে মুসা তামাম তুহফা বেছে ঠিক করতে লাগলেন কোনগুলো খলীফার দরবারে পেশ করা হবে এবং কোনগুলো বায়তুল মালে রাখা হবে। এমনিভাবে কয়েদীর মাঝে কাকে খলীফার কাছে নেওয়া হবে তা নির্ধারণ করলেন।
জুলিয়ন ও আওপাস মুসার সাথে ছিলেন। আওপাস মেরীনাকে তালাশ করতে লাগলেন। তাদের দুজনের মধুর স্বপ্নছিল কিন্তু তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল রডারিক। তারেককে ইহুদী যাদুকরের লাশ হাদিয়া দেয়ার পর মেরিনা আত্মগোপন করেছিল। অনেক তালাশের পর আওপাস তার সন্ধান পেল। মেরীনার বাড়ী টলেডোতে ছিল কিন্তু সে তার বাড়ীতে না গিয়ে ছোট একটা উপাসনালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সাদা কাপড় ধারণ করেছিল। মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে রাখত। আওপাসকে দেখে তার ভেতর কোন পরিবর্তন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো না।
আওপাস : এখানে কি করছ?
মেরীনা হালকাভাবে জবাব দিল, উপাসনা, খোদার কাছে পাপের মার্জনা প্রার্থনা করছি। তুমি এখানে কেন এসেছ?
আওপাস : তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছি মেরীনা!
এটা তোমার জায়গা নয়, তুমি শাহী মহলের একজন সদস্য।
ভর্ৎসনার সুরে মেরীনা বলল, শাহী মহল? ঐ মহল যার মাঝে আমার প্রেরণা, কুমারীত্ব, প্রেম-ভালবাসা কুরবানী হয়েছিল?
আওপাস : এখন সে মহলে রডারিক নয়। রডারিকের একজন সদস্যও নেই। এখন মুসলমানরা মসনদে আসনাসীন, সেখানে অন্যায়-অবিচারের লেশমাত্র নেই। কেউ শরাব পান করে না, করা হয় না কোন রমনীর ওপর অত্যাচার নিপীড়ন। মহল এখন সর্ব প্রকার পাপ পঙ্কিলতা হতে মুক্ত।
আমি অপবিত্র আওপাস! বাকী জীবন আমি আমার আত্মা পরিশুদ্ধির জন্যে প্রচেষ্টা করে যাব।
-আমি তোমাকে মুসলমানদের আমীরের কাছে নিয়ে যেতে চাই। আমি তাকে বলতে চাই, এ হলো সে রমনী যে রডারিককে পরাভূত করেছে।
– তারপর মুসলমানদের আমীর আমাকে ইনয়াম দেবে, তুমি এটা বলতে চাচ্ছ তো?
আওপাস! ইনয়াম ও ইকরামের জগৎ আমি পরিত্যাগ করে অন্য জগতে পৌঁছে গেছি। তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই।
আমীর মুসা ইবনে নুসাইর তোমাকে দেখতে চান। তিনি দামেস্কে চলে যাচ্ছেন। তোমার অন্তরে কি আমার প্রেম-ভালবাসা নেই? তোমাকে মহব্বতের দোহায় দিয়ে বলছি, আমার সাথে চল পরে আবার চলে এসো।
মহব্বতের দোহায় দেয়াতে সে আপাসের সাথে রওনা হলো।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, মেরীনার মাঝে পূর্ণমাত্রায় পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তার রূহানী শক্তি হয়েছিল জাগ্রত।
তারেক ইবনে যিয়াদ, জুলিয়ন ও আওপাস বিস্তারিতভাবে মুসাকে বলেছিলেন, মেরীনা কিভাবে রডারিককে পরাজিত করেছিল। সে মেরীনা এখন মুসা ইবনে নুসাইরের সম্মুখে দন্ডায়মান, তিনি মেরীনাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিলেন।
মুসা : বস খাতুন! আমাদের কাছে তুমি অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী, আমরা তার উপযুক্ত প্রতি দান প্রদান করব।
মেরীনা অন্যমনস্ক ছিল যেন সে কোন কথা শুনছে না।
আওপাসকে লক্ষ্য করে মেরীনা বলল, তোমার আমীরকে বল তিনি যেন তার দেশে ফিরে না যান, এ সফর তার জন্যে কল্যাণকর নয়।
যদি আমি চলে যাই তাহলে কি হবে? মুসা মুদৃ হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
মেরীনা : আপনার জন্যে খুবই অমঙ্গল হবে। লাঞ্ছনা-তিরস্কার ভোগ করতে হবে। আরো অন্য গুরুতর কিছুও হতে পারে। আপনি যাবেন না আমীর! আপনি যাবেন না… পরিণাম ভাল মনে হচ্ছে না। আপনার প্রতি লক্ষ্য করে মনে হচ্ছে আপনার আঁখি যুগল আর কোন দিন স্পেন দেখতে পারবে না।
মুসা মৃদু হাসলেন।
বেটী! মুসলমান তার আল্লাহর ওপর ভরসা করে। আল্লাহর কাজের ব্যাপারে কোন মানুষ ভবিষ্যত্বাণী করতে পারে না। কোন মানুষ যদি কারো ভবিষ্যত্বাণী শুনে সে অনুপাতে কাজ করে তাহলে শিরকের গুনাহ হবে।
– আমি কোন ধর্মের কথা বলছি না। আমি হয়তো আপনার ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি এটাও জানিনা কেন যেন এ সফরের পরিণাম ভাল মনে হচ্ছে না। আমি যেন আপনার চারদিকে মৃত্যু ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাচ্ছি।
– তুমি কি কোন উস্তাদের কাছে এ বিদ্যার্জন করেছ?
– না। তবে কেন যেন আমি নিজের থেকেই এমনটি অনুভব করছি। আমি কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় পৌঁছেছি তা আপনাকে বলছি।
– আওপাস তোমার ব্যাপারে সবকিছু বলেছে। তোমার উপর অত্যাচার নিপীড়ন হয়েছে তা আমি জানি।
.– এখন আমি দুনিয়ার এক অন্ধকার কোলে পড়ে রয়েছি। আমি নিপীড়িত ঠিক কিন্তু আমি নিজেকে অপরাধী মনে করি। আমি রডারিকের ছিলাম রক্ষিতা। রডারিককে হাতের মুঠে নেয়ার জন্যে করেছি কৌশল, করেছি ধোকাবাজি। নিজের উপকারের জন্যে করেছি প্রতারনা। এসব অমানবিক কাজের মাঝেই আমার যৌবন খতম করেছি। তার পর আমি স্বজাতি এক যাদুকরকে করেছি হত্যা। তাকে যদি আমি কতল না করতাম তাহলে তার হাতে একজন নিষ্পাপ মেয়ে হত্যা হত। সে রডারিকের বিজয়ের জন্যে সে মেয়েকে জবেহ্ করতে চেয়েছিল।
–এসব আমি শুনেছি। তুমি আমাদের বড় উপকার করেছ। আমি তার প্রতিদান তোমাকে দিতে চাই।
– না শ্রদ্ধেয় আমীর! আমি আপনার প্রতি কোন অনুগ্রহ-উপকার করিনি। যদি অনুগ্রহ করে থাকি তাহলে তা করেছি নিজের ওপর। রডারিক থেকে প্রতিশোধ নেয়া দরকার ছিল তা নিয়েছি। এখন আমার অন্তরে কোন প্রতিদান ও ইনয়ামের বিন্দুমাত্র লোভ নেই। এখন আমি আমার রুইকে পূত-পবিত্র করছি। পুরো স্পেন যদি আমার কদমতলে রেখে দেয়া হয় তবুও যেখানে আছি সেখান থেকে বের হবে না।
আপনাকে আরেকটা বিষয় সতর্ক করে দিচ্ছি, তা হলো আমার প্রতি দয়াপরশ হবেন না। আমাকে নিয়ে এসে শাহী মহলে সুখে শান্তিতে রাখবেন এমন চিন্তা করবেন না। আওপাস আমাকে ভালবেসেছে, তার পুরো বাদশাহী খান্দান মাটিতে মিশে গেছে। রডারিক আমাকে তার মহলে রেখেছে, তারও রাজত্ব হয়েছে ধূলি ধূসর আর সে বিদায় নিয়েছে চিরতরে।… আমি আরেকবার বলছি আপনি এ সফর। বাতিল করুন।
মেরীনা উঠে দরজার কাছে চলে গেল তারপর আবার ফিরে এসে বলল,
– আমীরে মুসলিম! স্পেন অত্যন্ত খারাপদেশ। এর ইতিহাস রক্তঝরা এবং সর্বদা রক্ত ঝরতে থাকবে। এদেশ বড় রহস্যময়। তারপর সে চলে গেল।
মুসা : এ মেয়ের প্রতি আমার আন্তরিত মমতা রয়েছে। সফরের জন্যে দ্রুত তৈরী হও। স্পেনের রাজধানী টলেডো নয় ইসাবালা হবে। দু’একদিনের মাঝে আমাদের ইসাবালার দিকে রওনা হতে হবে।
দু’দিন পরে এক বিশাল কাফেলা ইসাবালার দিকে রওনা হলো। মুসা, তারেকের আগমনের খবর আব্দুল আজিজকে পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে ইঞ্জেলা বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে বলল, আমীরকে ইস্তেকবাল গোটা শহরবাসী করবে। তারা শহরের বাহিরে গিয়ে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগতম। জানাবে।
– না ইঞ্জেলা। আমীরে মুসা এটা পছন্দ করবেন না। আমাদের ধর্ম এভাবে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ইন্তেকবাল করে শাহানশাহী প্রকাশের অনুমতি দেয় না।
— এখানকার লোক মুসলমান নয়। তারা আমীরে মুসা ও সিপাহ্ সালার তারেককে বাদশাহ্ মনে করে। এখন তোমরা যদি তাদের সাথে এমন কর যে তোমরা তাদের মত সাধারণ মানুষ তাহলে তারা তোমাদেরকে ভীতি শ্রদ্ধা করবে না। ফলে তারা বিদ্রোহ করে বসবে। তোমার মহান পিতা একজন সাধারণ মানুষের মত। আসবে। লোকজন তার প্রতি লক্ষ্য করবে না, এটা তার জন্যে অমর্যাদাকর। এ আমি হতে দেব না। ইস্তেকবালের ব্যবস্থা আমি করব।
পরিশেষে আব্দুল আজীজ ইঞ্জেলার কাছে পরাভূত হলো। ইঞ্জেলা পুরো, শহরের মাঝে মুসার আগমনের ঘোষণা করে দিল। লোকজন ইন্তেকবাল জানানোর জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করল। কর্মকর্তাদেরকে তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়া। হলো। ইঞ্জেলা পুরোদমে এর পিছনে লেগে গেল।
দু’জন ঘোড় সোয়ারকে শহর হতে টলেডোর দিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো, মুসা ইবনে নুসাইরের কাফেলা আসতে দেখলে তারা দ্রুত শহরে সংবাদ নিয়ে আসবে।
মুসা ইবনে নুসাইরের আগমনের দিন সমাগত হলো। যে দু’সোয়ারীকে অর্থে পাঠান হয়েছিল, একদিন দ্বিপ্রহরে তারা দ্রুত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে এসে সংবাদ দিল আমীরে আফ্রিকা ও উন্দুলুস প্রায় শহরের কাছে এসে গেছেন। ইঞ্জেলা খবর পাওয়া মাত্র বেরিয়ে এসে বার্তাবাহকদের ঘোড়া নিয়ে তাতে সোয়ার হয়ে ছুটে চললো। সে প্রথমেই যার যা দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিল।
– মুসা ইবনে নুসাইরের কাফেলা বেশ বড় ছিল। সম্মুখভাগে ছিলেন মুসা, তারেক ও মুগীছে রুমী। তার পিছনে ছিল দু’শ আড়াইশ প্ররিতক্ষা ঘোড় সোয়ার। তাদের পশ্চাতে ছিল হাজার হাজার কয়েদী। তাদের মাঝে রডারিকের উচ্চ পর্যায়ের অফিসাররাও ছিল। তবে তাদের মাঝে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল কর্ডোভার গভর্নর, সে ছিল মুগীছে রুমীর বিশেষ কয়েদী। কাফেলার সাথে ঘোড়ার গাড়ীও ছিল, তাতে ছিল বাদী-দাসী।
কাফেলা শহর হতে দেড় মাইল দূরত্বে পৌঁছলে রাস্তার দুপাশে জনতার ভিড় দেখা গেল। শহরবাসীর সামনে মুসলমান লস্কররা সাদা পোষাক পরিহিত হয়ে বর্শার মাথায় সবুজ পতাকা বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সাদা-পোষাক ও সবুজ পতাকা অত্যন্ত মনোরম দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। ফৌজের পিছনে ছিল শহরবাসী। তাদের মহিলা ও শিশু-কিশোরকে সম্মুখে রাখা হয়েছিল। তারা সকলে হাত নেড়ে নেড়ে “আমীরে মুসা ইবনে নুসাইর খোশ আমদেদ, মুসা ইবনে নুসাইর জিন্দা-বাদ” শ্লোগান দিচ্ছিল। জওয়ান লাড়কীদের কাছে ছিল ফুলের ঝুড়ি তারা মুসার চলার পথে ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
মুসা নিচের দিকে চেয়ে মৃদু হাসছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকরা লেখেন, তারেক ও মুগীছে রুমীর চেহারাতে অপছন্দের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
তারপর তারা যখন শহরের সিংহদ্বারে পৌঁছেন তখন সেখানে তাদেরকে যে ইস্তেকবাল করা হলো তার শানই ছিল ভিন্ন। শহরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা তাদের প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মুসা এবং তার সাথীরা ঘোড়া হতে অবতরণ করলে তারা সম্মুখে এগিয়ে এসে মুস্ম, তারেক ও মুগীছে রূমীর সামনে ঝুঁকে তাদের হাত চুম্বন করল।
মোটকথা ইঞ্জেলা মুসাকে অন্যান্য বাদশাহদের মত সম্মান প্রদর্শন করল।
***
রাতে ইঞ্জেলা তার স্বামীকে বলল, আজীজ! তুমি তোমার মহান পিতাকে কেন সাধারণ মানুষ জ্ঞান করছ? তোমার পিতা শাহান শাহ্ আর তুমি হলে শাহজাদা। তোমার বাবাকে আমি শাহান শাহর মর্যাদা প্রদর্শন করছি।
ইঞ্জেলা অসাধারণ সুন্দরী ছিল। তার চেয়েও সুন্দরী রমনী ছিল কিন্তু তার মাঝে এমন এক যাদু ছিল, যার বলে সে রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহকে মোম বানিয়ে ফেলেছিল আর আব্দুল আজীজের মত মর্দে মু’মিনকে হাতের মুঠে নিয়ে নিয়েছিল।
মুসা ইবনে নুসাইর ইসাবালাতে বেশীদিন অপেক্ষা করলেন না। সেখানে তিনি একটা কাজই করলেন তাহলে আব্দুল আজীজকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করে তাকে সর্বোপরি ক্ষমতা প্রদান করলেন। আব্দুল আজীজ যে দিন আমীর নিযুক্ত হলো সেদিন ছিল ইঞ্জেলার জন্যে সবচেয়ে খুশী ও আন্দঘন দিন। এমন আনন্দময় সময় তার জীবনে আর কোনদিন আসেনি। এমন কি সে যখন রডারিকের বিবি হয়েছিল তখনও না। কারণ রডারিকের বিবি সে ঠিকই হয়েছিল কিন্তু রানীর কর্তৃত্ব ছিল অন্যের হাতে। সে রানীর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা পায়নি। এখন সে আব্দুল আজীজের বিবি, রানীর পূর্ণ কর্তৃত্ব তার হাতে।
ইসাবালাতে একত্রিত মালে গণীমত, খলীফার জন্যে তুহফা ও কয়েদীদেরকে দামেস্কে নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত করালেন।
মুসা একদিন ইসাবালা হতে জাবালুত্ তারেকের দিকে রওনা হলেন। তার দূরত্ব ছিল তিনশ মাইলের কিছুটা বেশী। রাস্তাতে কয়েকটি পল্লী ও তিন-চারটি শহর সম্মুখে এলো। কাফেলা যে পল্লী ও শহরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল তারা ইসাবালার মত রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কাফেলাকে ইস্তেবাল করছিল। এর দ্বারা মুসা দেখাতে চাচ্ছিলেন তিনি যেভাবে স্পেন বিজয় করে খলীফার কাছে যাচ্ছেন ঠিক তেমনিভাবে তিনি স্পেনের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন।
কাফেলার সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদী ছিল। এমনিভাবে ঘোড়ার গাড়ীতে ছিল অসংখ্য দাসী-বাদী। এরা ছিল ঐসব রমণী যারা স্বেচ্ছায় মুসলমানদের সাথে যেতে রাজী হয়েছিল। এসব রমণীদের মাঝে ছিল দাসী, আমীর-ওমারা ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা। তারা সকলেই স্বেচ্ছায় মুসলমানদের সাথে যাচ্ছিল। বিপুল পরিমাণ মালেগণিত খচ্চর ও গাড়ীতে বোঝায় ছিল।
বেশি দীর্ঘদিন পর এ কাফেলা জাবালুত তারেক (জিব্রালটাল) এ পৌঁছল। সেখানে জাহাজ-নৌ অপেক্ষমান ছিল। মুসাকে অভিভাদন জানানোর জন্যে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল। স্পেনের বহু নামী-দামী লোক জাবালুত তারেক পর্যন্ত এসেছিল মুসাকে বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপন করার জন্যে।
জাহাজ-নৌকা বহর আফ্রিকা উপকুল কায়রো গিয়ে ভিড়ল। কায়রো মিশর ও আফ্রিকার রাজধানী ছিল। দু’একদিন সেখানে অবস্থান করে মুসার কাফেলা দামেস্কের দিকে রওনা হলো। সেখানে আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কয়েকজন বর্বর সর্দার ও বেশ কয়েকজন মিশরী সে কাফেলাতে শামিল হলো। তারা মুসা ইবনে নুসাইরকে বেষ্টনি দিয়ে এগিয়ে গেল। এখন খচ্চরের পরিবর্তে উটের পিঠে করে মাল-সামান নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। উটগুলোকে রংগিন কাপড়ে নয়নাভিরাম করে সাজান হয়েছিল।
কাফেলা কত দিনে দামেস্কে পৌঁছল তা কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেননি। রাস্তা ছিল কম-বেশী তিন মাসের। তবে এটা পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে মুসা শুক্রবার দিন জুময়ার আজানের স্বল্প কিছুক্ষণ পূর্বে দামেস্কে পৌঁছেন।
দামেস্কের শহর চোখের সামনে ভেসে উঠল। তারেক ও মুগীছে রুমী মুসা। থেকে বেশ পিছনে ছিলেন, তাদের ঘোড়া চলছিল ধীর পদে। তারেক ও মুগীছের চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠেছিল। তার কারণ ছিল দামেস্কের কিছুটা অদূরে মুসার মত এক সম্মানী ও মর্যাদাবান আমীর এমন বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন যা তারেক ও মুগীছ আদৌ প্রত্যাশা করেন নি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুগীছে রূমী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করে কর্ডোভা জয় করেছিলেন এবং সেখানকার গভর্নরকে বন্দি করে মুসার কাছে আবেদন পেশ করেছিলেন সে কয়েদীকে খলীফার দরবারে নিজে মুগীছে রূমী পেশ। করবে বলে। দামেস্কের কাছে এসে মুসার মত পরিবর্তন হলো, তিনি মুগীছকে ডেকে বললেন,
“তোমার সে কয়েদীকে আমার কাছে অর্পণ কর মুগীছ! তাকে আমি নজে খলীফার সম্মুখে পেশ করব।”
-সে তো আমার কয়েদী, “আপনি তো আমাকে অনুমতি দিয়ে ছিলেন, আমি তাকে…”
“আমি বলছি কয়েদী আমাকে সোপর্দ কর। মুসা গর্জে উঠে বললেন, তবে আমি আমীরুল মু’মিনীনকে বলব, কয়েদীকে আমি বন্দী করেছি এবং বহু কষ্টে আমি কর্ডোভা জয় করেছি।
– আমি তোমাদেরকে আমিরুল মু’মিনীনের কাছে যেতে দেব না।
– কেন? আমি কোথাও পরাজিত হয়েছি। পলায়ন করেছি? আপনি যে বিজয় অর্জন করেছেন আঠার হাজার ফৌজের সাহায্যে আমি তা করেছি মাত্র এক হাজারের মাধ্যমে। খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করার অধিকারটুকু কি আপনি আমাদেরকে দেবেন না।
– না তা আমি দিতে পারি না। তোমার মনে রাখা উচি, তুমি যে পরিমাণ মর্যাদার অধিকারী তার চেয়ে অনেক বেশী সম্মান আমি তোমাকে দিয়েছি। তুমি ছিলে ইহুদী কিন্তু আমি তোমাকে আরবী সালারের সম্মান প্রদান করেছি।
– ইসলাম মর্যাদার ক্ষেত্রে শ্রেণী ভেদ করে না। এ কারণেই আমি ইসলাম গ্রহণ করেছিলাম। আপনি যত পারেন আমাকে অসম্মান করেন আমি মুসলমান আছি এবং থাকব তবে আমার কয়েদী আপনার কাছে সোপর্দ করব না।
মুসা একজন সিপাহী ডেকে মুগীছে রূমীর কয়েদীকে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। সিপাহী তাৎক্ষণিকভাবে কর্ডোভার গভর্নর কয়েদীকে উপস্থিত করল।
মুসা মুগীছকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার কয়েদী?
হ্যাঁ এটাই। মুগীছ জবাব দিলেন।
মুসা কয়েদীর পিছনে গিয়ে হঠাৎ তরবারী বের করে প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সাথে সজোরে আঘাত হেনে কয়েদীর শরীর হতে মাথা পৃথক করে ফেললেন।
এ দৃশ্য দেখে তারেক ও মুগীছ দূরে সরে গেলেন।
কাফেলা দামেস্কের দিকে রওনা হলো। তারেক এবং মুগীছ মুসা হতে পৃথক হয়ে পিছনে দু’জন একাকী যাচ্ছিলেন। তাদের দু’জনের অন্তরের ওপর কষ্টের পাথর। চেপে ছিল তা চেহারাতে ফুটে উঠেছিল।
তারেক : ইসলাম এ কারণেই আমীর উমারা ও বাদশাহী ঢংকে চলতে নিষেধ, করেছে। দেখলে! কি পরিমাণ বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ আমীরের মেজাজে কত পরিবর্তন এসেছে।
মুগীছ : আমার আরেকটা বিষয় সন্দেহ হচ্ছে, তাহলে আমার হনে হয়, এ বৃদ্ধের মস্তিষ্ক বিকৃত করার জন্যেই হয়তো এমন শাহী ইস্তেকবালের আয়োজন ইঞ্জেলা করেছিল।
মুসা স্পেনে তার বড় ছেলে আব্দুল আজীজকে আমীর নিযুক্ত করে এসেছিলেন। আর কায়রোতে আফ্রিকার গভর্নর তার অপর ছেলে আব্দুল্লাহকে মনোনিত করেন। পশ্চিম প্রান্তের আমীর অপর ছেলে আব্দুল মালেককে এবং বাকী এলাকার গভর্নর তার ছোট ছেলে মারওয়ানকে নিযুক্ত করেন।
তারেক : মুসা স্পেন ও আফ্রিকাতে তার পারিবারিক বাদশাহী কায়েম করেছে, যদি একজন বর্বরকেও গভর্নর নিযুক্ত করত তাহলেও কিছুটা শান্তি পেতাম।
***
দামেস্কে পূর্বেই সংবাদ পৌঁছে ছিল, স্পেন বিজয়ীরা বিপুল পরিমাণ মালে গণীমত ও বহু সংখ্যক যুদ্ধ বন্দী নিয়ে আসছেন। শহরবাসীরা তাদের ইন্তেকবালের জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শহরের অদূরে ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে ইস্তেকবাল করল। শহরের রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তাদেরকে সম্ভাষণ জানাল।
একটি প্রশস্ত ময়দানে গিয়ে কাফেলা থামল। উটের পিঠ হতে মাল-পত্র নামান হচ্ছিল। এরি মাঝে এক ঘোড় সোয়ার ঘোড়া হাঁকিয়ে এসে পৌঁছল। সে মুসাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে গোপনে এক সংবাদ দিল যাতে কেউ সে সংবাদ না জানে, কিন্তু তা আজ পর্যন্ত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পয়গাম ছিল খলীফার ভ্রাতা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের পক্ষ হতে। বার্তাবাহক ছিল তার বিশেষ দূত।
সোয়ারী বলল, সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক আপনার কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন, খলীফা এমন রোগে আক্রান্ত যে কোন সময় তার ইন্তেকাল হতে পারে। তার সাথে আপনি সাক্ষাৎ করতে যাবেন না এবং তাকে কোন মালে গণীমতও দেবেন না। কিছু দিন অপেক্ষা করুন তার ইন্তেকালের পর সুলায়মান হবেন খলীফা। তখন মালে গণীমত ও দাসী, কয়েদী তার সম্মুখে পেশ করবেন।
মুসা : এটা কি হুকুম আবেদন না পরামর্শ?
দূত : আপনি যা মনে করেন। আমি পয়গাম আপনাকে পৌঁছে দিয়েছি।
মুসা : সুলায়মানকে আমার সালাম দিয়ে বলবে, আমি এ পাপ করতে পারব না যে, সুলায়মানের ভাই এর মৃত্যুর অপেক্ষা করব। আমিরুল মু’মিনীনের নির্দেশে এসেছি তাঁর কাছেই যাব।
আল্লাহ না করুন যদি খলীফার ইন্তেকাল হয়েই যায় তাহলে তার বড় ছেলেও তো তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে সুলায়মান খলীফা নাও হতে পারে। কিন্তু এখন তো খলীফা ওয়ালীদ, আমি তার কাছেই দায়বদ্ধ। যা দেয়ার তাঁকেই দেব আর যা নেয়ার ভার থেকেই নেব। ফলে প্রথমে তার সাথেই সাক্ষাৎ করব।
বার্তাবাহক : না আমীর! আপনি খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। সুলায়মান তার ভাই, তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। খলীফা অসুস্থ, তাঁর সাথে কেউ যেন মুলাকাত না করে এ ব্যাপারে ডাক্তার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
দূত চলে গেল। মুসা নিরাশ হয়ে পড়লেন। তিনি খলীফার সাথে দ্রুত সাক্ষাৎ করার জন্যে উন্মুখ হয়ে ছিলেন।
আল্লাহ্ তায়ালা মুসার উদ্দেশ্য পূর্ণ করলেন, একজন এসে খবর দিল, ডাক্তার নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি জুময়ার নামাজ পড়াতে যাচ্ছেন। তার ধারণা তিনি বেশী দিন জীবিত থাকবেন না, ফলে তাঁর বাসনা শেষ বারের মত ইমামতি করে। সৌভাগ্যশালী হবেন।
তিনি মর্দে হক্ক ও সর্বদিক থেকে ছিলেন মর্দে মুমিন। ইসলামী খেলাফতের বিস্তৃতি ও ইসলামের প্রচার-প্রসারে তিনি ছিলেন সদা প্রচেষ্ট। সিন্ধু বিজয়ের জন্যে তিনিই মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে পাঠিয়ে ছিলেন এবং সর্বোপরি সাহায্য করে ছিলেন। এমনিভাবে তারেককে স্পেন আক্রমণের অনুমতি দিয়ে ছিলেন এবং তার প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে ছিলেন।
খলীফা মসজিদে আসছেন, এ সংবাদ পাওয়া মাত্র মুসা খলীফার জন্যে নির্ধারিত তুহফা মসজিদে পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি মসজিদে চলে গেলেন। অত্যন্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও খলীফা মসজিদে আসলেন। মুসা তার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারেক ও মুগীছও মিলিত হলেন, তাদের মিলনে খলীফা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন।
নামাজান্তে মসজিদেই মুসা খলীফাকৈ তুহফা ও মালে গণীমত পেশ করলেন। এত পরিমাণ অমূল্যবান সম্পদ দেখে খলীফার নয়ন বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। অন্যান্য দর্শকরাও অভিভূত হয়ে পড়ল। তারা এত মূল্যবান জিনিস ইতিপূর্বে আর কোনদিন দেখেনি।
সেখানে খলীফার ভাই সুলায়মানও উপস্থিত ছিলেন। তার চেহারায় রাগ ও ক্ষোভের চিহ্ন ভেসে উঠেছিল। তিনি মুসাকে এমনভাবে দেখছিলেন যে সুযোগ। পেলে জীবিত কবর দেবেন। এসব ধন-দৌলত নিজে কজা করার জন্যেই তো তিনি কয়েকদিন অপেক্ষা করার জন্যে মুসার কাছে পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন।
এরপর মুসা এমন কাজ করলেন যা মুসার মত মহান ব্যক্তির জন্যে আদৌ সমীচীন ছিল না। সকল তুহফা পেশ করা হলে সব শেষে পেশ করলেন সেই আলোচিত টেবিল যাকে পাদ্রীরা সুলায়মান (আ)-এর বলে অভিহিত করেছিল।
মুসা : আমীরুল মু’মিনীন! এ টেবিল টলেডোতে বড় কষ্ট করে পাদ্রীদের থেকে উদ্ধার করেছি এবং আপনাকে বিশেষভাবে পেশ করার জন্যে নিয়ে এসেছি। এটা ছিল সুলায়মান (আ)-এর মালিকত্বে তারপর কিভাবে যেন এটা স্পেনে পৌঁছেছে। খলীফা ওয়ালীদ বিস্ময়াভিভূত হয়ে টেবিল দেখতে লাগলেন। তার চেহারায় মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। মুসার বর্ণনা মুতাবেক তিনি তাকে পবিত্র জিনিস জ্ঞান করলেন।
খলীফা ওয়ালীদ অকস্মাৎ বলে উঠলেন, ইবনে নুসাইর! তুমি আমার জন্যে যে তুহফা নিয়ে এসেছ তার কিমত কেউ পরিশোধ করতে পারবে না। তবে এ টেবিলের ব্যাপারে কি বলল, তুমি নিজেই চাও, কি পুরস্কার তোমাকে দেব।
তারেক ইবনে যিয়াদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন,
আমীরুল মু’মিনীন! ইনয়ামের হকদার আমি। কারণ এ টেবিল মুসা নয় আমার ফৌজরা হস্তগত করেছে। আমীরে মুসা তা আমার থেকে আদেশ বলে সংগ্রহ। করেছেন।
খলীফার চেহারার রং পাল্টে গেল। তার চেহারাতে রাগের চিহ্ন দেখা দিল। খলীফা রাগান্বিত হয়ে ছিলেন কারণ তারেক তার আমীরের ওপর মিথ্যের অভিযোগ করে ছিলেন। মুসার মত ব্যক্তির ওপর মিথ্যের অভিযোগ কেউ বরদাস্ত করতে পারে না।
ইবনে যিয়াদ! খলীফা গম্ভীর আওয়াজে বললেন, তোমার কি অনুভূতি নেই তুমি কত বড় ব্যক্তির ওপর কত বড় অভিযোগ উত্থাপন করেছ? হয়তো তুমিএটাও জান না এ অপরাধের শাস্তি কি… তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে যে এ টেবিল মুসা নয় বরং তুমি সংগ্রহ করেছে।
তারেক : হ আমীরুল মু’মিনীন! একটা নয়, কয়েকটা দলীল পেশ করতে পারব। আমি তাদেরকে ডাকতে পারি যারা এটা সংগ্রহ করেছে এবং ঐ সকল পাদ্রীদেরকেও আহ্বান করতে পারি যাদের থেকে এটা নেয়া হয়েছে।
খলীফা ওয়ালীদ : তোমাকে এত সময় দিতে পারব না। আমার জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই কত দিন জীবিত থাকব। ঐ সকল লোক আসতে আসতে কয়েক মাস লেগে যাবে। তোমার বীরত্ব ও সাহসীকতা দেখে আমি তোমার প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ করতে পারি যে, তুমি আমীরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং নিজ বাড়ীতে চলে যাও। আর যদি এমন না কর তাহলে এ গুরুতর অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করার জন্যে প্রস্তুত হও।
তারেক : আমীরুল মু’মিনীন! এখানেই আমি একটি প্রমাণ পেশ করতে পারি। আপনি এ টেবিলের চারটি পায়া ভাল করে প্রত্যক্ষ করুন, তিনটি পায়া এর এক রকম আর একটা পায়া সাদাসিদা স্বর্ণের।
খলীফা টেবিলের পায়াগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে তা দেখতে পেলেন।
তারেক : এর চতুর্থ আসল পায়া আমার কাছে রয়েছে। যখন আমীরে মুসা টলেডোতে এসেছিলেন তখন সর্বপ্রথম তিনি আমাকে আমার ফৌজের সম্মুখে বেত্রাঘাত করেছেন এবং কয়েদ খানায় পাঠিয়ে ছিলেন, তারপর তারেক বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করলেন। তারেক বললেন, আমি এ টেবিলের কথা মুসার কাছে বললে তিনি তা তার কাছে পেশ করার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার সন্দেহ হলো ফুলে এর একটা পায়া আমি খুলে রেখে দিলাম এবং বললাম এর পায়া তিনটিই। তখন আমার যে সন্দেহ হয়েছিল এখন তা আপনার কাছে প্রকাশ পেল। এর চতুর্থ পায়া আমীরে মুসা টলেডোতে পরে বানিয়ে লাগিয়েছেন। আমিএর আসল পায়া পেশ করছি।
খলীফার অনুমতি নিয়ে তারেক বাহিরে এসে কিছুক্ষণের মাঝেই আসল পায়া নিয়ে গিয়ে তার নকল পায়া খুলে টেবিলে লাগিয়ে দিলেন।
মুগীছে রূমী ওখানেই বসা ছিলেন, বললেন, আমিরুল মু’মিনীন! আতিরিক্ত সাক্ষী পেশ করার জন্যে বেশী সময়ের প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই সাক্ষী যে, এ টেবিল তারেকের কাছে ছিল আমীরে মুসা তা আদেশ বলে তার কাছে নিয়েছেন।, দু’জন অফিসারও সাথে এসেছে তারাও এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
ওয়ালীদ : মেনে নিলাম এ টেবিলের মালিক তারেক ইবনে যিয়াদ।
মুগীছ : আমীরুল মুমিনীন। আমীরে মুসার ব্যাপারে আরো কিছু আমি বলতে চাই, তার জন্যে আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। এ অনুমতি ইসলাম পূর্বেই দিয়ে রেখেছে যে, খলীফা যদি ভুল করে তাহলে রাজ্যের একেবারে নিম্ন পর্যায়ের লোকও তা ধরতে পাররে এবং তার জবাব খলীফার কাছে সে তলব করতে পারে।
খলীফা : তোমার যা বলার তুমি বল, মুগীছ!
মুগীছ : আমীরুল মু’মিনীন! আমি কেবল মাত্র সাতশত সৈন্য নিয়ে কর্ডোভা এবং তার আশে-পাশের এলাকা জয় করেছি। এর ইনয়াম আমাকে আল্লাহ দেবেন। আর আমি জিহাদও তার সন্তুষ্টির জন্যে করেছি। কিন্তু আমীরে মুসা আমাকে বলেছেন, “তুমি প্রথমে ইহুদী ছিলে পরে গোথা কওমে শামিল হয়েছ এবং আরো, পরে ইসলাম গ্রহণ করেছ ফলে তুমি আরবী সালারদের সম মর্যাদার হতে পার না। আমি আপনার খেদমতে পেশ করার জন্যে কর্ডোভার গভর্নরকে আমার কাছে। বিশেষ কয়েদী হিসেবে রেখেছিলাম। কিন্তু দামেস্কের অদূরে এসে মুসা বললেন, সে কয়েদী তাকে অর্পণ করার জন্যে যাতে তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে, সে কয়েদী আমার নয় তার। আমি কয়েদী তাকে দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাকে কতল করেন।
হঠাৎ খলীফা ওয়ালীদের ভাই সুলায়মান চিৎকার করে বলে উঠলেন,
খোদার কসম! আমীরে মুসার এ অপরাধ অমার্জনীয়। তিনি তারেকের টেবিল আর মুগীছের কয়েদী নিজের দাবী করে এটা প্রমাণ করলেন যে, তিনি যে স্পেন বিজয় করেছেন তা আল্লাহকে রাজী করার জন্যে করেননি বরং আমীরুল মু’মিনীনকে খুশী করার জন্যে করেছেন।
মুগীছ : তার এ অন্যায়ও তো কম নয় যে তিনি স্পেনে তার ছেলে আব্দুল আজীজকে এবং আফ্রিকা তিন ভাগে ভাগ করে তার তিন ছেলেকে আমীর নিযুক্ত করেছেন।
খলীফা : আমার আর বেশী কিছু শোনার ক্ষমতা নেই। একদিকে তোমাদের এ বিজয় যা যুগ যুগ ধরে মানুষ স্মরণ রাখবে। আগামী প্রজন্ম তোমাদেরকে নিয়ে গর্ব করবে। তোমাদের কবরের ওপর ফুল দেবে। অপরদিকে তোমরা একে অপরকে ছোট করার কোশেশ করছ। আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে, মুসার মত মহান ব্যক্তি, বুদ্ধিমান-ধীসম্পন্ন আমীর এত নিচে যদি নামতে পারে তাহলে মিল্লাতে রাসূল (স) এর ভবিষ্যৎ কি হবে!
খলীফা ওয়ালীদ অত্যন্ত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তার ছিল আল্লাহর ভয় এবং সর্ব কাজ তার সন্তুষ্টির জন্যে করতেন। তিনি ভীষণ অসুস্থ ছিলেন ডাক্তার তাকে বিছানায় বিশ্রামে থাকতে বলেছিলেন কিন্তু স্পেন বিজেতাদের আগমন বার্তা তাকে মসজিদে নিয়ে এসেছিল। তিনি কেবল মসজিদেই আসেননি বরং জুময়ার ইমামতিও করেছিলেন। তিনি বেশ হাসিখুশী ছিলেন। কিন্তু মুসার হীনতা,ও তারেক-মুগীছের কথা-বার্তায় অত্যন্ত কষ্ট পেলেন ফলে মুহূর্তের মাঝে তার অসুস্থতা বেড়ে গেল।
খলীফা খুব কষ্টে বললেন, এদের সকলকে পঞ্চাশ হাজার করে স্বর্ণ মুদ্রা ইনয়াম দিয়ে দাও। কাউকে বাদ দেবে না।
খলীফার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ডাক্তার তলব করা হলো। ডাক্তার এসে দেখে রাগান্বিত হয়ে বললেন, তোমরা আমীরুল মু’মিনীনকে মেরে ফেলেছ।
তারপর খলীফা ওয়ালীদ আর সেরে উঠলেন না, কয়েক দিনের মাঝেই এ ধরাধাম ত্যাগ করে পরলোকে পাড়িজমালেন।
খলীফা ওয়ালীদ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর বড় ছেলেকে নিজ স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন কিন্তু লিখিতভাবে ফরমান জারি করার অবকাশ মৃত্যু তাকে দেয়নি। এর থেকে সুলায়মান উপকৃত হলেন, তিনি খলীফার পদে আসীন হলেন। খুৎবাতে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হলো। খলীফার মসনদে সুলায়মান আসীন হয়েই তার দরবারে মুসাকে তলব করলেন।
সুলায়মানের কথা অমান্য করাতে এমনিতেই মুসার ওপর রাগান্বিত ছিলেন কিন্তু বিপুল পরিমাণ হাদিয়া-তুহফা ওয়ালীদকে পেশ করতে দেখে সুলায়মানের সে রাগ দুশমনিতে পরিণত হলো।
সুলায়মান : মুসা ইবনে নুসাইর! আজ থেকে তুমি কোন দেশের আমীর নও। তুমি মিথ্যেবাদী ও খেয়ানতকারী। তারপর সুলায়মান দরবার ভর্তি জনসম্মুখে টেবিলের ঘটনা, মুগীছে রূমীর অভিযোগ ও নিজের পক্ষ হতে আরো কিছু অভিযোগ পেশ করে, তাকে কয়েদ খানাতে প্রেরণের নির্দেশ দিলেন।
কৃতকর্মের দিক থেকে সুলায়মান পূর্ণমাত্রায় তার বড় ভ্রাতা ওয়ালীদের বিপরীত। ছিলেন। ওয়ালীদকে যদি দিবালোকের সূর্যের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে তাকে তুলনা করতে হয় নিকষ কালো রাতের সাথে। তিনিই প্রথম খলীফা যিনি আমীরের রূপ ধারণ করেছিলেন। শরীয়তের বিধান মুতাবেক মুসাকে কাজী (বিচারক) এর দরবারে পেশ করা দরকার ছিল তারপর শাস্তি বা ক্ষমা যা করার কাজ করতেন। কিন্তু সুলায়মান বিচার নিজের হাতে নিয়ে তাকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন। তাকে কেবল কয়েক খানাতে পাঠিয়ে সুলায়মান ক্ষান্ত হলেন না বরং কয়েদখানাতে নির্দেশ পাঠালেন তাকে যেন এমন কঠোর শাস্তি দেয়া হয় যাতে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে যায় তবে জীবিত থাকে।
এটা অত্যন্ত গুরুতর অন্যায় নির্দেশ ছিল যার অনুমতি শরীয়ত আদৌ দেয়নি। মুসার বয়স আশির দোড় গোড়ায় পৌঁছে ছিল। কোন প্রকার কষ্ট ভোগ করার। ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু প্রখর রৌদ্রে তপ্ত বালুর ওপর তাকে শুইয়ে দেয়া হতো। কোন সময় প্রচণ্ড রৌদ্রের মাঝে একটা থামের সাথে বেঁধে রাখা হতো। খলীফা, ওয়ালীদ মুসাকে যে মুদ্রা দিয়ে ছিলেন তা সমুদয় এবং মুসার ব্যক্তিগত তাবৎ সম্পত্তি সুলায়মান বাজেয়াপ্ত করেছিলেন যার ফলে তার খান্দানের লোকরা অনাহারে অর্ধহারে থাকতে ছিল, তারা দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্যে মজদুরী করতে লাগল।
এরপরও সুলায়মানের প্রতিশোধের আগুন ঠান্ডা হয়নি। দেড় বছর পরে যখন মুসাকে বিলকুল চেনার উপায় ছিল না। সুলায়মান হজ্জে গিয়ে ছিলেন তখন পায়ে শিকল পরিয়ে মুসাকেও সাথে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। ভিক্ষে করার জন্যে তাকে সাত সকালে কা’বার সম্মুখে বসিয়ে দেয়া হতো। সারাদিন মুসা হাজীদের কাছে ভিক্ষে, চায়তেন সন্ধ্যেবেলা সুলায়মানের লোকরা তাকে সেখান থেকে নিয়ে যেত। সারা দিনের ভিক্ষের পয়সা তার থেকে নিয়ে নেয়া হতো। সুলায়মান তার ওপর জরিমানা নির্ধারণ করেছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল ভিক্ষে করে সে জরিমানার টাকা পরিশোধ করবে, পূর্ণ টাকা শেষ হলে তাকে মুক্ত করা হবে।
এ হলো এক স্পেন বিজেতার পরিণাম। তারেক ইবনে যিয়াদ ও মুগীছে রূমীর সাথে যে ব্যবহার করেছেন তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় কিন্তু মুসার বীরত্ব-সাহসীকতা, বুদ্ধিমত্তা, বিজয় সফলতা এত বেশী ছিল যে তিনি ক্ষমা পাবার যোগ্য ছিলেন। মুসা জীবনের পুরোটা যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়ে ছিলেন।
তিনি বর্বরদেরকে আরবদের তুলনায় নিচু জ্ঞান করেছিলেন ঠিক কিন্তু এটাও তার সফলতা ছিল যে তিনি বর্বরদের মত অবাধ্য কওমকে এক পতাকাতলে একত্রিত করে ছিলেন। বর্বররা কোন দিন কারো আনুগত্য স্বীকার করেনি। মুসাই এক মাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি তাদেরকে দামেস্কের খেলাফতের অনুগত করেছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তারই হাতে গড়া সিপাহ্ সালার ছিলেন যিনি যৎ সামান্য সৈন্য নিয়ে স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে স্পেন অতিক্রম করে ফ্রান্স পর্যন্ত ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন করেছিলেন।
মুসার ব্যক্তিত্ব নিম্নের ঘটনা থেকে ফুটে উঠে।
একদা সুলায়মান মুসাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। সে সময় আমীর ইবনে মহাল্লাব তথায় উপস্থিত ছিল। যে ছিল মুসার মঙ্গলকামী ও সুলায়মানও তাকে মান্য করতেন। সে সুলায়মানকে বলল, মুসাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে। সুলায়মান ইবনে মহাল্লাবের কথা মত তাকে হত্যার হাত থেকে রেহায় দিলেন কিন্তু মাফ করলেন না। মহাল্লাব গোস্বান্বিত হয়ে কয়েদ খানায় গিয়ে দেখতে পেল মুসা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তার মাথা ঘুরছে, তারপর কিছুক্ষণ পরেই মুসা মাটিতে পড়ে গেলেন।
তাকে কুটরীতে নাও, পানি পান করাও। মহাল্লাব নির্দেশ দিল। মুসাকে উঠিয়ে কামরাতে নিয়ে গিয়ে তার মুখে পানি দেয়া হলো এবং চেহারাতে পানির ছিটা দেয়া হলো তখন তিনি সম্বিৎ ফিরে ফেলেন।
। আমাকে চিনতে পারছ ইবনে নুসাইর! মহাল্লাব জিজ্ঞেস করল, মুসা বড় কষ্টে .চোখ খুলে বললেন,হ, তুমি আমার বন্ধু ইবনে মহাল্লাব- তুমি কি আমাকে মুক্ত করতে এসেছ না কি দেখতে এসেছ আমি কবে মৃত্যু বরণ করব?
মহাল্লাব : আজকেই তুমি মৃত্যুবরণ করতে, সুলায়মান তোমাকে কতলের হুকুম দিয়ে ছিলেন। তোমার জীবন আমি রক্ষা করেছি কিন্তু তোমার সে ঘোরতর শত্রু, তোমাকে ক্ষমা করেনি। তোমার বিবেক-বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছিল ইবনে নুসাইর। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তুমি খলীফার আহ্বানে কেন এখানে এলে? তোমার যোগ্যতা ও বীরত্বের নজীর কেউ পেশ করতে পারবে না তোমার নজীর কেবল তুমিই। তুমি জানতে খলীফা অসুস্থ এবং এমন দুর্বল হয়ে পড়েছেন সুস্থতা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়, তুমি এটাও অবগত ছিলে ওয়ালীদের পরে তার ভাই সুলায়মান খেলাফতের মসনদে সমাসীন হবেন আর তিনি তোমার দুশমন। তোমার বিরুদ্ধে তার একটা বাহানার প্রয়োজন ছিল তা তিনি পেয়ে গেছেন।
মুসা : আমি না এলে ওয়ালীদ অত্যন্ত রাগান্বিত হতেন। তার হুকুম ছিল বড় কঠোর।
ইবনে মহাল্লাব : তুমি না আসতে। তুমি একটা মুলক বিজয় করে ছিলে, তারেক ইবনে যিয়াদ, মুগীছে রূমী ও অন্যান্য সালাররা তোমাকে কেবল আমীর নয় তারা নিজের পিতা মনে করত। তাছাড়া তোমার কাছে ছিল একদল যুদ্ধবাজ ও লড়াকু সৈন্য। ধন-সম্পদও কম ছিল না। তারপরও তুমি দামেস্কের জাহান্নামে কেন এলে? স্পেনের স্বাধীন সুলতান হয়ে যেতে, দামেস্ক থেকে কোন খলীফা তোমার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাতেন না। মাঝখানে সমুদ্র ছিল বড় বাধা।
মুসা : ইবনে মহালাব! আমি পাপী তবে আমীরুল মু’মিনীনের নির্দেশ অমান্যকারী পাপী হতে চাইনি। তারেক ইবনে যিয়াদ আমার হুকুম অমান্য করার দরুন তাকে আমি বেত্রাঘাত করে ছিলাম। আমাদের বিজিত প্রতিটি দেশের আমীর যদি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে চলার চিন্তা ভাবনা করে তাহলে ইসলামী সালতানাত হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ, উম্মতে মুহাম্মদের মাঝে আসবে পরিবর্তন আর ইসলাম কেবল মক্কার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
ইবনে মহাল্লাব : ধন্যবাদ ইবনে নুসাইর! আমি যা বললাম তাই তুমি করবে এটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি তোমার অভিপ্রায় জানতে চাচ্ছিলাম। খলীফা সুলায়মানের সাথে যাতে তোমার মীমাংসা হয়ে যায় এ ব্যাপারে এখন আমি চেষ্টা করব।
সে সময় মুসা যা বলেছিলেন তা আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মুসা বললেন, ইবনে মহাল্লাব! জলজ প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এত প্রখর হয় যে, নদী ও সমুদ্রের তলদেশের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিস দেখতে পারে কিন্তু তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে যে জাল পাতা হয় তা সে দেখতে পায় না। আমি দূরদর্শী ছিলাম। কিন্তু সুলায়মানের ফাঁদে ফেঁসে গেছি।
তারপর মহল্লাব মুসা ইবনে নুসাইরের বিজয় গৌরব তুলে ধরে সুলায়মানের কাছ থকে তাকে মুক্ত করার বহুত কোশেশ করল কিন্তু সুলায়মান পাথরের মত তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলেন, মুসাকে ক্ষমা করলেন না।
সে সময় মুগীছে রূমী কতল হলেন। তাকে কে কতল করল তা সুস্পষ্ট জানা না গেলেও, দলীল-প্রমাণ দ্বারা বুঝা যায় সুলায়মানই তাকে কতল করিয়ে ছিলেন।
সুলায়মান খেলাফতের বাগডোর হাতে নিয়েই ইসলামের গৌরবান্বিত ব্যক্তিদেরকে কতল করেছিলেন।
ভারতবর্ষে ইসলামের পতাকা উড্ডীনকারী, সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে সুলায়মান দামেস্কের এ কয়েদখানাতে বন্দী করে অমানবিক নির্যাতন নিপীড়নের পর নির্মমভাবে হত্যা করে ছিলেন।
সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকে সুলায়মান দামেস্কের কারাগারে কতল করে ছিলেন।
ইয়যীদ ইবনে আবু মুসলিম ইরাকের গভর্নরকে সুলায়মান বন্দি করে ছিলেন।
সুলায়মানের কোন বন্ধু থেকে থাকলে তা ছিল ইবনে মহাল্লাব। তার পূর্ণনাম হলো ইয়াযীদ ইবনে মহাল্লাব। ধন-সম্পদ বিনষ্টকারী ও বিলাসী ব্যক্তি ছিল। সে বায়তুল মালের ষাট হাজার দেরহাম তসরফ করেছিল। হাজ্জাজ এ অপরাধে তাকে কয়েদ করেছিলেন, কিন্তু সে কয়েদ খানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর হাজ্জাজের ইন্তেকালের পর সে ফিরে আসে পরে সুলায়মান তাকে পূর্ব পদে বহাল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “মহাল্লাবের সন্তানের প্রতি কেউ চোখতুলে তাকাতে পারবে না।” এ দ্বারা অনুমেয় যে সুলায়মান যেমন দুষ্ট প্রকৃতির ছিলেন তেমনি ধরনের লোককে তিনি বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ এদিক থেকে বড়ই সৌভাগ্যশালী ছিলেন। তিনি সুলায়মানের হাতে নিহত হননি। সম্ভবত এ কারণে যে, তারেক ছিলেন বর্বর, সুলায়মানের সাথে তার কোন খান্দানী দুশমনি ছিল না এবং তার সাথে নেতৃত্বের ব্যাপারে কোন জটিলতা ছিল না যা ছিল হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সাথে। খলীফা মুসা ও তারেককে ইনয়াম দিয়েছিলেন কিন্তু সুলায়মান মুসাকে সে ইনয়াম হতে বঞ্চিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে তারেককে আরো টাকা-পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাকী জিন্দেগী ঘরে বসে অতিবাহিত করুন।
ইতিহাসে পাওয়া যায় না তারেক ইবনে যিয়াদ বাকী জীবন কোথায় কাটিয়েছেন। দামেস্কেই ছিলেন না আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন। ইতিহাস কেবল এতটুকু বর্ণনা করে যে, সুলায়মান তার পরে তারেককে আর কোন লড়াইএ শামিল করেননি। স্পেন বিজেতা যিনি স্পেন সীমান্তে গিয়ে কিস্তী জ্বালিয়ে দিয়ে ছিলেন যাতে ফিরার চিন্তা মাথায় না আসে, তার মত মহান ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে হারিয়ে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা তার নাম কিভাবে বিস্মৃত হবে যাকে স্বয়ং রাসূল (স) স্বপ্নে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তার নাম বিস্মৃত হবার বদলে এমনভাবে, ঝলকে উঠেছে যে আজ ইসলামী জগতের আনাচে কানাচে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ। কোন অমুসলিমও যদি স্পেনের কথা আলোচনা করে তাহলে তারেক ইবনে যিয়াদের নাম- কেবল স্মরণ নয় বরং অকৃপণতার সাথে তাকে জানায় সাধুবাদ।
***
মুসা ইবনে নুসাইর কয়েদ খানায় মৃত্যুর প্রহর গুন ছিলেন। অপর দিকে তার ছেলে আব্দুল আজীজ আমীরে স্পেন, সে মুকের লোকদের অবস্থা পরিবর্তন করছিলেন। আব্দুল আজীজ ছিলেন দুনিয়া বিমুখ, রাসূল কারীম (স)-এর আশেক। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও ইসলামী বিধি অনুপাতে মুসলমান ও খ্রীস্টানদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি করে উভয়কে এক জাতিতে পরিণত করেছিলেন।
স্পেনে বেগার ও গোলামী পদ্ধতি চালু ছিল। সেখানকার খ্রীস্টান ও ইহুদী আমীর-ওমারারা দরিদ্র কৃষক-মজদুরকে অন্ন-বন্ত্রের বিনিময় গোলামের মত ব্যবহার করত।
এসব দরিদ্র লোকরা জমিক্রয় ও বাড়ী বানানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। আব্দুল আজীজ এ নির্যাতন মুলক প্রথার বিরুদ্ধে নির্দেশ জারীর পরিবর্তে ঘোষণা দিলেন, যেসব মজদুর ইসলাম গ্রহণ করবে সে বেগার খাটা ও গোলামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে এবং সে জমি ও বাড়ীর মালিকত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তার এ ঘোষণা এত ফলপ্রসু হলো যে অতিদ্রুত মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। ইহুদী ও খ্রীস্টানদের উপাসনালয় দিন দিন বিরান হতে লাগল। নতুন নতুন মসজিদ তৈরী হতে লাগল। স্পেনের কিছু শহরে সেকালের মসজিদ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
আব্দুল আজীজ স্পেনের নিগৃত-লাঞ্ছিত মানবতা উদ্ধার করলেন। প্রতিটি মানুষকে দিলেন তার প্রাপ্য মর্যাদা। খ্রীস্টানদের ধর্ম, তাদের উপাসনার ব্যাপারে কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করলেন না, তবে পাদ্রীরা ধর্মের আড়ালে যেসব অপকর্মের বীজ বপন করেছিল, তা তিনি খতম করে দিলেন। এমনিভাবে বড় পাদ্রী যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল তা মিটিয়ে দিলেন।
আব্দুল আজীজ ছিলেন স্পেনের প্রথম আমীর। দীর্ঘ দিন যুদ্ধ বিগ্রহের দরুন দেশের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। মানুষজন ঘর-বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আব্দুল আজীজ এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে পালিয়ে যাওয়া লোক ঘর বাড়ীতে ফিরে এলো। আব্দুল আজীজ নওয়াব, জায়গীরদ্বারদের দৌরাত্ম্য খতম করে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য কায়-কারবারের সুব্যবস্থাপনা করার দরুন মানুষের অভাব অনটন বিদূরিত হলো।
আব্দুল আজীজ ছিলেন এক বিজ্ঞ ও আমলদার আলেম। তাবলীগের মাধ্যমে নয় বরং আমল-আখলাকের দ্বারা ইসলামকে সকলের কাছে করে তুলে ছিলেন, গ্রহণীয়। ইসলাম গ্রহণ করাকে মানুষ গৌরবের বিষয় মনে করতে লাগল। নিজে ফজর ও জুময়ার ইমামতি করতেন। কিন্তু তার স্ত্রী ইঞ্জেলা তার জন্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আব্দুল আজীজের মত দৃঢ়চেতা, সাহসী আলেম যখন ইঞ্জেলার কাছে যেতেন তখন চুপসে যেতেন। ইঞ্জেলা খ্রীস্টান হবার দরুন বেপর্দা ঘুরাফেরা করত এবং অধিনতদের ওপর কর্তৃত্ব চালাত। তার দীর্ঘ দিনের আশা ছিল রানী হবার তা সে হয়েছে ফলে রানীর মত হুকুম প্রয়োগ করত।
আব্দুল আজীজের দুর্বলতা ছিল তিনি ইঞ্জেলার প্রেমে ছিলেন পাগল। ইঞ্জেলা তার কথা মালার যাদু বলে, হৃদয় কাড়া আচরণে, আব্দুল আজীজের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করত।
আব্দুল আজীজ ছিলেন সাদাসিধে। রাজা বাদশাহদের মত চলা-ফেরা পছন্দ করতেন না কিন্তু ইঞ্জেলা এমন সব পন্থা গ্রহণ করল যা আব্দুল আজীজের শাহী অবস্থা সৃষ্টি করল। তা এজবে যে কেউ যদি সাক্ষাৎ করতে আসত তাহলে ইঞ্জেলা খাদেম পাঠিয়ে বলে দিত আমীর এখন সাক্ষাৎ করতে পারবেন না পরে এসো। যদি, কোন সেনাপতি, বড় অফিসার আসতেন তাহলে ইঞ্জেলা নিজে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে আলাপ-আলোচনা করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইঞ্জেলা নিজে সিদ্ধান্ত দিত।
স্বামীর বর্তমানে স্ত্রী কর্তৃত্ব খাটাবে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে এ বিষয়টা মুসলমানদের কাছে ছিল নিন্দনীয়। মুসলমানদের মাঝে তো নিয়ম ছিল। যে কোন সময় যে কোন ব্যক্তি গভর্নর, বড় অফিসার এমনকি আমীরুল মু’মিনীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারত। গভীর রাতেও তাদেরকে ঘুম থেকে উঠাতে পারত।
ইঞ্জেলা যে পন্থা অবলম্বন করেছিল তাতে সালার ও শহরের অফিসাররা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। আব্দুল আজীজের কাছে তারা অভিযোগ করলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। একদিকে আব্দুল আজীজের কৃতিত্ব ছিল যে তিনিই ইসলামকে সরকারী ধর্ম বানানোর সাথে সাথে মানুষের অন্তরে বসিয়ে দিয়েছিলেন। দিবা-রজনী মেহনত করে এমন নিয়ম-কানুন চালু করে ছিলেন যাতে সর্ব সাধারণ ফিরে পেয়েছিল ইজ্জত সম্মান। অপর দিকে আব্দুল আজীজের অবস্থা ছিল একজন রমণীকে পিঠে সোয়ার করে সাথী-সঙ্গী, বন্ধু-বান্ধবের হয়ে ছিলেন বিরাগভাজন।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজের জন্যে নিয়মিত দরবারের ব্যবস্থা করে তাতে পূর্ণ পাহারার ব্যবস্থা করল, যা একজন বাদশাহর দরবারে হয়ে থাকে এ বিষয়টাও ছিল ইসলামী নীতির পরিপন্থি।
ইঞ্জেলা গভর্নরদের ওপরও কর্তৃত্ব খাটানো শুরু করল। গভর্নররা সকলে বসে আলোচনা করল বিষয়টা খলীফাকে অবহিত করা হবে কিন্তু কেউ কেউ এতে বাধা দিয়ে বললেন, সরাসরি আব্দুল আজীজের সাথে আলোচনা করলে ভাল হয়। পরিশেষে এটা সিদ্ধান্ত হয়। আব্দুল আজীজ ব্যস্ত থাকার দরুন গভর্নরদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারলেন না, বস্তুত ইঞ্জেলাই তাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়নি। সে সময় ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে আরেকটা পরামর্শ দিল তাহলো, ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে বলল, তুমি হলে মুলুকের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বাদশাহ। আমি লক্ষ্য করছি, মুসলমান গভর্নররা তোমার সম মর্যাদার দাবীদার। তুমি তাদেরকে বল তারা যখন তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে তখন তারা যেন তোমাকে ঝুঁকে সালাম করে। যাতে তাদের অন্তরে তোমার ভীতি জাগরত থাকে। তানাহলে একদিন তারা তোমার আনুগত্য অস্বীকার করে বসতে পারে।
এটা হয় না ইঞ্জেলা। আমি এতদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না। আমাদের আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ একমাত্র আল্লাহর সামনে ছাড়া মানুষ কারো সামনে নত হতে পারে না। একজন মানুষ অপর মানুষের সামনে ঝুকতে পারে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে নত হওয়া বড় গোনাহ্।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে তার কথা মানানোর জন্যে বহুত কোশেশ করল, আব্দুল আজীজ মানলেন না। কিন্তু ইঞ্জেলা এমন রমনী ছিল যে তার কথা মানিয়ে ছাড়ত। এজন্যে সে আব্দুল আজীজের সাক্ষাতে যারা আসত তাদের জন্যে পৃথক একটা ঘর তৈরী করে, সে ঘরের দরজা এমনভাবে তৈরী করল তাতে না ঝুঁকে ঘরে প্রবেশ সম্ভবপর হলো না। আব্দুল আজীজ সে ঘরে বসতে লাগলেন দর্শনার্থীরা এভাবে ঝুঁকে ঘরে প্রবেশ করতে লাগল।
সালার, বড় বড় অফিসার ও গভর্নররা যখন অবস্থা দেখলেন তখন তারা অনুধাবন করতে পারলেন এ দরজার উদ্দেশ্য কি, তাছাড়া দরবারের কর্মচারীরা বলে দিল আমীরের সম্মুখে বুকার জন্যে ইঞ্জেলা এভাবে দরজা তৈরী করেছে। তাদের অন্তরে এমন আঘাত লাগল কেউ তা সহ্য করতে পারলেন না। সকলে বললেন, এতে আমাদেরকে নয় বরং ইসলামের মর্যাদাহানীর জন্যে এ পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সে সময় আব্দুল আজীজ স্পেনের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, একজন নায়েবে সালারের মাধ্যমে দারুল খেলাফত ও বায়তুল মালের জন্যে দামেস্কে পাঠালেন।
নায়েবে সালার দামেস্কে পৌঁছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সম্পদ ও কিছু তুহফা সুলায়মানের দরবারে পেশ করল।
সুলায়মান : স্পেনের কি অবস্থা কেমন চলছে সেখানকার হুকুমত?
সালার : হুকুমত তো ঠিকই চলছে আমীরুল মু’মিনীন! কিন্তু হুকুমতের পরিচালক ঠিকমত চলছে না।
সুলায়মান : পরিষ্কারভাবে সব কিছু খুলে বল। মনে হচ্ছে সেখানে এমন কিছু হচ্ছে যা হওয়া সমীচীন নয়।
সালার; আমীরুল মু’মিনীন! আপনার এ প্রশ্নের জবাব স্পেনে এ সময় যেসব সালার ও গভর্নর রয়েছে তারা দিচ্ছেন। তারা আমাকে এ দায়িত্বও অর্পন করেছেন আমি যেন স্পেনের সকল অবস্থা আপনাকে অবগত করি। স্পেনে এখন এক অমুসলিম রমণী রাজত্ব করছে।
সুলায়মান : এ রমনী সে নয়তো, যে খ্রীষ্টান আওরতের সাথে আব্দুল আজীজ ইবনে মুসা শাদী করেছে সে রমনী হয়তো এখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি?
সালার : সেই আমীরুল মু’মিনীন। তার নাম ইঞ্জেলা। আমীর আব্দুল আজীজ তাকে রানী বানিয়ে রেখেছেন। সে বড় বড় হাকিমদেরকেও আমীরের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয় না। সেখানে বাদশাহদের মত দরবার বসে এবং কর্তৃত্ব চলে ইঞ্জেলার।
সালার সকল বিষয়ের বিবরণ দিল ছোট দরজার কথাও বলল।
সালার : সেখানের একজন অফিসার, কর্মকর্তাও আমীরের ওপর খুশী মন। খুশী অখুশী বড় কথা নয় তবে বড় কথা হলো সেখানের সালার, ফৌজ ও শহরবাসী যে কোন সময় আমীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। তারা সকলেই উত্ত্যক্ত।
খলীফা সুলায়মান আর কিছু শুনতে চাইলেন না। রাগে গর্জে উঠলেন। মুসার খান্দানের কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামান্যতম বাহানার প্রয়োজন ছিল তা তিনি পেয়ে গেলেন। খলীফা আগে থেকেই রেগে ছিলেন, মুসা তার ছেলেকে আমীর নিযুক্ত করে এসেছেন।
সুলায়মান; তুমি চলে যাও। সকলকে বলবে তাদের এ অভিযোগ আমি মিটিয়ে দেব।
***
একদিন আমীরে স্পেন আব্দুল আজীজের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ এভাবে খতম হলো যে, এক সকালে আব্দুল আজীজ ফজর নামাজের ইমামতির জন্যে দাঁড়িয়েছেন। সূরা ফাতিহা পড়ে সূরা ওয়াকিয়া সবেমাত্র শুরু করেছেন এরি মাঝে এক ব্যক্তি সামনের কাতার থেকে দ্রুত সামনে অগ্রসর হয়ে মুহূর্তের মাঝে তলোয়ার বের করে এক কোপে আব্দুল আজীজের শিরুচ্ছেদ করল। কোন নামাজীরা বিষয়টা বুঝে উঠার পূর্বেই ঘাতক আমীরে স্পেনের শির নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
বিশ-পঁচিশ দিন পর মখমল আবৃত চামড়ার থলেতে আব্দুল আজীজের মস্তৃক সুলায়মানের দরবারে এসে পৌঁছল।
সুলায়মান নির্দেশ দিলেন, আমীরে স্পেনের শির কয়েদখানাতে নিয়ে গিয়ে তার বাপ মুসার সম্মুখে রেখে দাও।
সুলায়মানের নির্দেশ মুতাবেক আব্দুল আজীজের মস্তক কয়েদখানায় মুসার সম্মুখে রাখা হলো। মুসা পূর্বেই অমানবিক নির্যাতন, গঞ্জনা ও দুঃখে কণ্ঠে ভেঙ্গে পড়ে ছিলেন। ছেলের মাথা দেখে মুছা গেলেন। চেতনা ফিরে পেয়ে দেখলেন সেখানে মস্তক নেই।
মুসা ছেলের মাথা দেখে বলেছিলেন,
“তারা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করল যে ন্যায় পরায়নতা ও ইনসাফের সাথে দিনে করত রাষ্ট্র পরিচালনা আর রাতের বেলা করত আল্লাহর ইবাদত।… আমার ছেলে কায়েমুল লাইল ও সায়েমুন নাহার তথা রজনীতে সালাত সমাপনকারী ও দিবসে রোজা পালনকারী ছিল।”
মুসার এ কথার সত্যায়ন ইতিহাসেও পাওয়া যায়। কিন্তু আব্দুল আজীজ অনুধাবন করতে পারলেন না যে কোন রমনীকে পিঠে সোয়ার করলে মেধা বুদ্ধিতেও সে সোয়ার হয়। সে এটাও বুঝতে পারলেন না যে রমনীরাই বাদশাহদের সিংহাসন করেছে ভূলণ্ঠিত, বহুদেশ করেছে বরবাদ। এ ভুল আব্দুল আজীজ থেকে হলো কিছু তার জ্ঞাতসারে আর কিছু অজ্ঞাতসারে।
মুসা ইবনে নুসাইর তার ছেলের কর্তিত শির দেখার পর, মাত্র কয়েকদিন জীবিত ছিলেন। ৭১৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি তিনি পরলোকে পাড়িজমান। তার এক বছর পরই সুলায়মানও বিদায় নেন।
জুলিয়ন পুনরায় সিওয়ান্তা (মরক্কো) এর গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
দশম শতাব্দীতে আবু সুলায়মান আইয়ুব নামে একজন বড় আলেম অতিবাহিত হয়েছেন, তিনি জুলিয়নের বংশধর ছিলেন।
এক ইহুদী যাদুকর বলেছিল, স্পেন ভূমি রক্ত চেয়েছে এবং চাইতেই থাকবে, খুন প্রবাহিত হয়েছে এবং হতেই থাকবে। তার একথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মুসা, তার ছেলে কতল হয়েছেন, কতল হয়েছেন মুগীছে রূমী। তারপর মুসলমানদের আটশত বছরের স্পেনের ইতিহাসে রক্তই প্রবাহিত হয়েছে। একের পর এক আমীর হয়েছে নিহত, সিংহাসন হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। এভাবে খুন-খারাবী পরস্পরে চলতে থাকে; যার পরিণামে একদিন স্পেন ইসলামী জগত হতে বেরিয়ে চিরতরে হাত ছাড়া হয় মুসলমানদের।
সমুদ্রসৈকত বইটিতে ক্লিক করলে অন্য বই চলে আসে