“আমাদেরকে অশ্বপদ তলে পৃষ্ঠ কর, এক মজবুর লাড়কীর চিফাটা আত্মচিৎকার শুনে নাও, তোমার শাহী মসনদও ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হবে, তোমার নাম নিশানাও যাবে চিরতরে মুছে।”
যার মাঝে সাত হাজার সৈন্য, রসদ পত্র ও ঘোড়া সংকুলান হয় এমন বিশাল বিশাল চারটি জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বলছে আর তার লেলিহান শিখা দূর দূরান্ত থেকে দেখা যাবে না এমনটি হতে পারে না। তারেক ইবনে যিয়াদের নির্দেশে জাহাজ চারটিতে অগ্নি সংযোগ করার সাথে সাথে লেলিহান শিখা ক্রমেই বুলন্দ হচ্ছিল। ধোয়া মেঘের ন্যায় আসমানে পৌঁছুতে ছিল। কাছেই জেলে ও মাল্লাদের বস্তি ছিল।
বস্তিবাসীরা একে অপরকে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঐ দেখো, কোন তাজেরের জাহাজে আগুন লেগে গেছে।
“মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রে আগুন লেগেছে, এক বৃদ্ধ জেলে বলল,
একজন জওয়ান মাল্লা বলল, তাড়াতাড়ি চল, বাহিরের কোন তাজেরের মাল জ্বলছে, চল আমরাও কিছু মাল হয়তো সংগ্রহ করতে পারব।
বস্তির-মর্দ, আওরত, বাচ্ছা সকলেই সাগর তীর অভিমুখে ছুটল।
সে সময় তারেক ইবনে যিয়াদ ফৌজের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। মানুষ কাছে এসে ফৌজ দেখে থমকে দাঁড়াল। বস্তিবাসীদের সাথে আগুন দেখে আরো কিছু লোকও এসেছিল। যেদিক থেকে লোক তামাশা দেখার জন্যে, আসছিল সেদিকে মুগীছে রূমী ছিলেন। মুগীছ তার অধিনস্থ ঘোড় সোয়ারদেরকে নির্দেশ দিলেন আগত জনতা দলকে ঘিরে ফেলোর জন্যে যাতে একটা বাচ্চাও পলায়ন করতে না পারে।
হুকুম দেয়ার সাথে সাথে ঘোড় সোয়াররা হুকুম তামিল করল। আগত জনতার মাঝে নওজোয়ান লাড়কী ও জওয়ান আওরতও ছিল। তারা চিৎকার করে পলাতে উদ্যত হল। পুরুষরা রমণী ও বাচ্চাদের বেষ্টনীতে রাখল অপর ঘোড় সোয়ার ফৌজরা তাদের সকলকে ঘিরে রাখল। তারপর তাদের সকলকে হাঁকিয়ে এক পাশে নিয়ে যাওয়া হল।
ততক্ষণে তারেক ইবনে যিয়াদের ভাষণ সমাপ্ত হয়ে ছিল। মুগীছে রূমী ঘোড়া দোঁড়িয়ে এসে তারেকের সামনে থামলেন।
তারেক : তুমি কেন তাদেরকে রুখেছ তা আমি জানি। তাদেরকে ছেড়ে দিলে তাদের মাধ্যমে স্পেনে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে যেত। আমরা তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা করতে চাই। তাদেরকে এখানেই রুখে রাখ আমরা সামনে চলে যাবার পর, তাদেরকে ছাড়বে…..
আর মুগীছ! বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখবে, আওরতের সাথে যেন কোন রকম অসৌজন্যমূলক আচরণ না হয়।
মুগীছ : হা ইবনে যিয়াদ! আমিএ হত দরিদ্র লোকদের অন্তর হতে এখনি ভয় দূর করে দিচ্ছি। তুমি হয়তো জান,এরা হলো স্পেনের মাজলুম মাখলুক। আমি তাদের সাথে এমন আচরণ করব যে তারা আমাদের মদদগার হয়ে যাবে। আমি তাদের থেকে জেনে নেব এখানের ফৌজ কোথায় রয়েছে।
মুগীছে রূমী ছিলেন গোথা কওমের ইহুদী পরিবারের সন্তান। কিছুদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তার মাঝে ইহুদীর কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। ইহুদী মানেই ফেত্নাবাজ, চক্রান্তকারী, শয়তান। মুগীছে রূমীর অন্তর ইহুদীদের সিফত গ্রহণ, করেনি হয়তো একারণেই তিনি ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন। তিনি মুসা ইবনে নুসাইরের জামানার পূর্বেই মুসলমানদের ফৌজে শামিল হয়েছিলেন। তার মাঝে পরিচালনার যোগ্যতা ছিল। যার ফলে খুব তাড়াতাড়ি ফৌজের উচ্চপদ এবং কিছুদিন পরেই সেনাপতি পদে আসীন হয়ে ছিলেন।
উত্তর আফ্রিকাতে বর্বরদের সাথে সর্বশেষ যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে মুগীছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাসু সে বিজয়ের মুকুট মুগীছের মাথাতেই রাখে। মুগীছ স্পেনের অধিবাসী ছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়।
মুগীছ অবরুদ্ধ জনতা দলের কাছে গেলেন।
একজন বৃদ্ধ মাল্লা বলল, হে ফৌজের সর্দার! তোমরা যারাই হও এবং যেখান থেকেই আসনাকেন, বল তোমরাও কি গরীবের ইযযতকে এতো তুচ্ছ মনে কর? আমার মনে হচ্ছে তুমি এখনই আদেশ দেবে আমাদেরকে গ্রেফতার করার আর যুবতী রমণীদেরকে পৃথক করার জন্যে। তুমি কি আমাদের ব্যাপারে এ নির্দেশ দেবে? আমরা তোমাদের কাছে এ জন্যে এসেছিলাম যে তোমাদের একটা জাহাজে আগুন লেগেছে বাকী জাহাজে আগুন না লাগে এ জন্যে তোমাদের সাহায্য করতে পারব।
মুগীছ : আমাদের ব্যাপারে তোমাদের কোন ভয় নাই। আমাদের জাহাজে আমরা নিজেরাই অগ্নি সংযোজন করেছি।
বুড়ো মাঝি : তাহলে তো তোমাদের ব্যাপারে আমাদের ভয় আরো বেশী, তোমরা দস্যু। অন্যের জাহাজ ছিনতাই করে এনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছ, নিজের জাহাজে কেউ কি আগুন লাগায়।
মুগীছ : তুমি আমাদের দস্যু বল বা আরো কিছু বল না কেন, তবে জেনে রাখ তোমাদের কোন লাড়কী ও কোন আওরতকে আমাদের কেউ স্পর্শ করবে না।
বুড়ো মাল্লা : আচ্ছা মেনে নিলাম। তবে একটা কথা তোমাকে বলি হয়তো তা শুনে আমাদের ওপর তোমাদের দয়ার উদ্রেগ হবে, এখানের ফৌজরা আমাদের ইযযতের উপর সবচেয়ে বড় হামলাকারী। আমাদের ফৌজরা যখন এদিকে আসে তখন তারা জোরপূর্বক দু’তিন জওয়ান লাড়কীকে নিয়ে যায় তারপর পরের দিন তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়।
মুগীছ : এখন তোমাদের ইযযত নিরাপদ হয়ে গেল।
মাল্লা : তাহলে আমাদেরকে ঘোড় সোয়ার দ্বারা বেষ্টনী দিয়ে রেখেছ কেন?
মুগীছ : যাতে তোমরা আগেই আমাদের আগমন বার্তা তোমাদের ফৌজের কাছে পৌঁছাতে না পার এ জন্যে। আমরা এখান থেকে চলে গেলে তোমরা নিজ ঘরে ফিরে যাবে। তোমাদের ফৌজকি এখানে আশে-পাশেই কোথাও রয়েছে?
ঐ বুড়োর কাছে আরো কয়েকজন জেলে ও মাঝি এসে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মাঝে থেকে একজন বয়স্ক সামনে অগস্রর হয়ে বলল,
তোমাকে এ ফৌজের সর্দার বলে মনে হচ্ছে….. তুমি যেহেতু আমাদের ইযতের জামানত দিয়েছ, সেহেতু আমরাও তোমাদেরকে এখানের ফৌজের হাত থেকে বাঁচানোর জামানত দিচ্ছি। আমাদের ফৌজ এখান থেকে বেশী দূরে নয়।
বুড়ো মাল্লা মুগীছে রুমিকে বলল, এ এলাকাতে কয়েক জায়গায় ফৌজী চৌকি রয়েছে। সবচেয়ে কাছে চৌকি রয়েছে ছয় মাইল দূরে আর তা এ এলাকার জেনারেলের হেড কোয়ার্টার। এ সকল চৌকিতে যে ফৌজ রয়েছে তার সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার।
জেনারেলের নাম ছিল তিতুমীর, ইতিহাসে যাকে প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ জেনারেল হিসেবে অবহিত করা হয়েছে।
***
তারেক ইবনে যিয়াদ ধারণা করেছিলেন, অতর্কিতভাবে উপকূলীয় ফৌজের ওপর আক্রমণ করে তাদেরকে পাকড়াও করবেন, তার এ ধারণা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। যে সময় মুগীছে রূমী মাল্লা ও জেলেদেরকে শান্তনা দিচ্ছিলেন সে সময় স্পেনের ফৌজের এক সদস্য তাদের জেনারেলকে বহিরাগত ফৌজের আগমন সংবাদ শুনাচ্ছিল। ঐ ব্যক্তি জাবালুত্ তারেকে উপস্থিত ছিল।
সে ফৌজ তার জেনারেলকে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলছিল, আমি চারটি জাহাজ সিওয়াস্তার দিক থেকে আসতে দেখলাম, তারপর তারা সে জাহাজের তাবৎ মাল-সামানা নামিয়ে নিয়ে তাতে অগ্নি সংযোজন করেছে।
জেনারেল আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে?
ফৌজ : আমি নিজ চোখে জাহাজ জ্বলতে দেখে এসেছি। যে ফৌজ এসেছে তা দশ হাজারের কম হবে বলে মনে হলো না।
জেনারেল : তারা যদি ফৌজ হয় তাহলে কোন বিপদ জনক ফৌজ বলে মনে হচ্ছে। তারা নিশ্চয় উম্মাদ ফৌজ কারণ উম্মাদরাই কেবল নিজেদের জাহাজে অগ্নি সংযোজন করতে পারে।
জেনারেল তিতুমীর ঘোড় সোয়ার-পায়দল তাবৎ ফৌজ যেন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি : নিয়ে অতিসত্তর জেনারেলের চৌকির কাছে এসে জমা হয় এ ফরমান দিয়ে সব চৌকিতে কাসেদ পাঠিয়ে দিল।
তার কাছে তাৎক্ষণিক ভাবে যে ফৌজ একত্রিত হল তার পরিমাণ ছিল বার হাজার। তার মাঝে এক হাজার ছিল ঘোড় সোয়ার। আসবাব-পত্র ও অস্ত্র-শস্ত্রের দিক থেকে তারা তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। তাদের সবচেয়ে বড় যে ফায়দা ছিল তা হলো তারা তাদের নিজ দেশে ছিল। সেখানে তাদের অতিসত্তর রসদ ও সাহায্য পাবার সম্ভাবনা ছিল। তারা ছিল বর্ম পরিহিত।
তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজের সংখ্যা ছিল সাত হাজার তার মাঝে মাত্র তিনশত ছিল ঘোড় সোয়ার। বর্ম পরিহিত একজনও ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় কমজোরী তারা ছিল অপরিচিত স্থানে ও বিদেশে, যেখানের আকাশ-বাতাস, মাটি, আগুন-পানি তাবৎ কিছু ছিল তাদের দুশমন। তাদের সাহায্য ও রসদ-পত্র আসার পথও ছিল অনেক দূরবর্তী। আর মাঝখানে ছিল প্রাচীর হিসেবে বার মাইলের এক বিশাল সমুদ্র।
জাহাজ চারটি জ্বলেই যাচ্ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদের সাথে আওপাস, জুলিয়নও এসেছিলেন। এরা দু’জন ছিলেন রাহুবর; তারা স্পেনের সর্ব বিষয়ে ওয়াকিফ ছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তাদেরকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, স্পেনের কোথায় কি রয়েছে, কেল্লা বন্দ শহর কোথায় এবং তার দূরত্ব কতদূর ইত্যাদি। আওপাস ও জুলিয়ন সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছিলেন।
জুলিয়ন : আমাদের প্রথমে মুকাবালা হবে উপকূলবর্তী ফৌজের সাথে। সময়ের পূর্বেই যদি সব ফৌজ একত্রি হয়ে যায় তাহলে আমাদের জন্যে মুশকিল হবে। তাদের এ ফৌজের সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি অধিকন্তু তাদের হাতিয়ারও বেশ উমদা, কিন্তু তারা আমাদের আগমন সংবাদ পায়নি, আমরা এদেরকে পৃথক পৃথকভাবে খতম করব।
মুসলমান ফৌজ জাহাজ থেকে নেমে সামান পত্র গুছিয়ে সামনে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিয়ে ছিলেন এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা হবে তবে তার স্থাপন করা হবে না।
এক ঘোড়া সোয়ার অত্যন্ত দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে তারেক ইবনে যিয়াদ, জুলিয়ন ও আওপাসের কাছে থেমে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হও। স্পেন ফৌজ আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে গেছে, তাবৎ চৌকির ফৌজ একত্রিত হয়েছে। তারা বেশী দূরে নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই এসে যাবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এ ব্যক্তি কে? বর্বর নয়তো?
জুলিয়ন : সে আমাদের লোক। তার নাম হিজি। জুলিয়ন হিজিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কিভাবে এলে?
হিজি : ঘোড়া ও ফৌজ যখন জাহাজে সোয়ার হচ্ছিল তখন আমি মুসলমানদের পোশাক পরে এসে ঘোড়ার হাজাজে সোয়ার হয়ে গেলাম। এখানে এসে দেখলাম ফৌজ জাহাজ থেকে অবতরণ করে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু এখানের ফৌজ যে আমাদের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে বা তারা কোথায় আছে তার দিকে কারো কোন লক্ষ্য নেই। আমিএ এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিফ তাই আগে চলে গেলাম। তারপর ঘোড়া পিছে রেখে চুপি-চুপি সামনে অগ্রসর হয়ে এখানের ফৌজ দেখতে পেলাম। এখানের ফৌজ আমাদের আগমন খবর জানে কিনা এটা জানার জন্যেই আমি গিয়ে ছিলাম।
তারেক ইবনে যিয়াদের মত একজন বিচক্ষণ সিপাহ্ সালার এ বিষয়টা ভুলে যাবেন এটা অসম্ভব ছিল কিন্তু তিনি সমেমাত্র প্রতিরক্ষা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন আর সেখানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হচ্ছিলেন তাই সম্মুখে নজর দেয়ার ফুরসত তার হয়নি।
তারেক ইবনে যিয়াদ প্রাণ খুলে হিজিকে মুবারকবাদ জানালেন। এ হলো সেই হিজি যাকে ফ্লোরিডা প্রাণ দিয়ে ভালবাসত এবং নিজের কাছে পাবার জন্যে ছিল পাগল পারা। ফ্লোরিডার বিরহে উম্মাদ হয়ে তার পিছে পিছে টলেডোতে গিয়ে পৌঁছেছিল। শাহ্ রডারিক ফ্লোরিডাকে বে আব্রু করলে হিজি শাহী আস্তাবল থেকে ঘোড়া চুরি করে পালিয়ে সিওয়াস্তা পৌঁছে ফ্লোরিডার বাবাকে অবহিত করেছিল।
কিছুদিন পূর্বে মুসা ইবনে নুসাইরের আস্থাভাজন হবার জন্যে জুলিয়ন যখন স্পেনের তীরবর্তী এলাকাতে হামলা করেছিলেন তখন ফ্লোরিডা তাদের সাথে যাবার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে রওনা দিয়েছিল কিন্তু তার বাবা জুলিয়ন তাকে যেতে দেননি।
তারপর তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজ যখন রওনা হচ্ছিল তখন জুলিয়ন ও আওপাস তাদের সাথে ছিলেন। ফ্লোরিড়া ভাল করে জানত তার বাবা তাকে যেতে দেবে না তাই সে হিজিকে বলেছিল, সে মুসলমান ফৌজের সাথে যেতে চাই। হিজিকে এ ফৌজের সাথে নেয়া হচ্ছিল না। মুসলমান ফৌজের সাথে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। যদি জুলিয়নের সিপাহী বাহিনী যেত তাহলে হিজি যেতে পারত কারণ তার বাপ ছিল শাহী আস্তাবলের বড় অফিসার।
“তুমি আমাকে মুসলমান ফৌজের লেবাস এনে দাও, তা পরে আমি জাহাজে সোয়ার হয়ে যাব। আমি আমার নিজের হাতে রডারিক থেকে প্রতিশোধ নেব” ফ্লোরিডা হিজিকে লক্ষ্য করে বলেছিল।
হিজি বুঝাচ্ছিল কিন্তু সে উম্মাদের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল, হিজি আশংকা করছিল এ লাড়কী যা বলছে তা হয়তো করেই দেখাবে।
হিজি : ফ্লোরা! আমি তোমার যন্ত্রণা অনুভব করছি কিন্তু তুমি কি একটা বিষয় ভেবে দেখেছ, রডারিক পর্যন্ত পৌঁছে, তাকে যে তুমি হত্যা করতে পারবে তার কি নিশ্চয়তা রয়েছে?
ফ্লোরিডা : আমি মুসলমানদের পুরুষের লেবাসে আসব।
হিজি : আবেগে নয়, গভীরভাবে চিন্তে কর ফ্লোরা! তুমি জখম হতে পার, কতলও হতে পার….. আর যদি তুমি জিন্দা ধরা পড় তাহলে তুমি নিজেই চিন্তে করে দেখ রডারিকের ফৌজরা তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করবে? হয়তো তুমি এমন পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হবে। তখন তুমি কিভাবে কার থেকে তোমার ইযযত হরনের প্রতিশোধ নেবে?
ফ্লোরিডা নিশ্চুপ হয়ে গেল, যেন সে কথা অনুধাবন করতে পেরেছে।
ফ্লোরিডা : তাহলে এটা কর হিজি! তুমি যাও এবং নিজ হাতে পাপিষ্ঠ রডারিককে হত্যা কর। আমি তোমার আমানত ছিলাম, সে তার মাঝে খেয়ানত করেছে। আমার ইযযত, আমার অন্তরের মালিক তুমি। ঐ শয়তান রডারিক অন্তর মন পর্যন্ত অপবিত্র করে দিয়েছে….. বল হিজি! আমার অন্তরে যে আগুন লেগেছে তা কি তুমি পারবে নির্বাপন করতে?
হিজি : হ্যাঁ পারব। আমি তোমার বে আব্রুর প্রতিশোধ নেব। হিজি ফ্লোরিডার নরম-মাংসল হস্ত যুগল নিজ হস্তে নিয়ে চুম্বন করে বুকের ওপর রেখে বলল, তোমার ভালবাসার কসম! তোমার প্রীতি মহব্বতের শপথ! রডারিক আমার হাতেই মরবে।
ফ্লোরিডা হিজির হাত ধরে বলল, তুমি আরো একটা ওয়াদা কর হিজি! রডারিকের মাথা কেটে তুমি নিয়ে আসবে, আমি তার মাথা রাস্তার কুকুরকে দিয়ে খাওয়াব।
হিজি : আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ফ্লোরা। তার মাথা তোমার কাছে, উপস্থিত করব।
হিজি ফ্লোরিডাকে পরম আবেগে বুকে জুড়িয়ে ধরে ফ্লোরিডার যৌবন সুরায় ভরা ওষ্ঠ ধরে ঠোঁট মিলিয়ে নিল। ফ্লোরিডার মসৃণ কপোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু হিজির হাতে পড়ল। হিজিরও নয়ন যুগল আঁসুতে ভরে উঠল।
সুন্দরী-সৌষ্ঠব নওজোয়ান ফ্লোরিডা স্পেনের মত এত বড় মুলকের বাদশাহকে প্রত্যাখান করে শাহী আস্তাবলের এক সামান্য, নওকরকে তার সবকিছু সমর্পণ করেছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদের সৈন্য রওনা হয়ে যাবার পর থেকে প্রতিদিন সকাল সাঁঝে ফ্লোরিডা ইবাদত খানাতে গিয়ে ইবাদত করে কেবল দুটো প্রার্থনা করত। এক. মুসলমানদের যেন বিজয় হয় দুই, হিজি যেন পাপিষ্ঠের মাথা নিয়ে জীবিত ফিরে আসে।
স্পেন ফৌজ একত্রিত হয়েছে এ সংবাদ পাবার সাথে সাথে তারেক ইবনে যিয়াদ তার নিজ ফৌজকে প্রস্তুত হবার হুকুম দিলেন আর তিনি দ্রুতগতিতে জাবালুত তারেকে গিয়ে আরোহন করে চতুর্দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তার সাথে মুগীছে রূমী ছাড়াও সেনাপতি তুরাইফ ইবনে মালেক ছিলেন। তিনি আগেই পছন্দ মত ময়দান যুদ্ধের জন্যে নির্বাচন করে রেখেছিলেন। তিনি এমন এলাকার দিকে ইশারা করলেন যা ছিল সবুজ-শ্যামল বৃক্ষ লতাতে ঢাকা উঁচু টিলা।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে বললেন, তামাম সোয়ারীকে ঐ টিলার উপর পাটিয়ে দাও, আর কমান্ডারদেরকে বল তারা যেন প্রতিটি সোয়ারীকে অশ্বে। প্রস্তুত রাখে এবং নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
তারেক ইবনে যিয়াদ সালারদেরকে ফৌজের নিয়ম শৃংখলা বুঝিয়ে হিদায়াত দিলেন তারপর পর্বত হতে অবতরণ করলেন। যেসব জেলে ও মাল্লাকে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে বলা হলো তারা যেন ঘর থেকে না বের হয়। তীর আন্দাজ কমান্ডারদেরকে বিশেষ হুকুম দিলেন। এরি মাঝে খবর এলো স্পেন ফৌজ চলে এসেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সাথে কিছু সেনাদল নিয়ে সম্মুখে চলে গেলেন। অপর দিক থেকে তিতুমীর সম্মুখে এলো, সে হিফাজত রক্ষীর বেষ্টনীতে ছিল। রক্ষীরা উমদা জংগী ঘোড়ায় সোয়ার ছিল।
তিতুমীর উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কি জন্যে এসেছ?
তারেক জিজ্ঞেস করলেন, সে কি বলছে?
তিতুমীরের কথার তর্জমা করে তারেককে বুঝান হল।
জুরিয়ন : দাঁড়াও ইবনে যিয়াদ! তাকে জওয়াব আমি দিচ্ছি।
জুলিয়ন সামনে অগ্রসর হয়ে তিতুমীরের জবাবে উচ্চস্বরে বললেন, জিজ্ঞেস করছ আমরা কি নিতে এসেছি। আমরা স্পেন নিতে এসেছি।
তিতুমীর রোষে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলল, হে নিমক হারাম! তুই আমাদের জায়গীরদার আর তুই এসেছিস আমাদের মুলুকের উপর হামলা করতে কাদেরকে সাথে নিয়ে এসেছিস? এতে তার নিজস্ব ফৌজ নয়। তুই ইতিপূর্বে এখান থেকে লুটতরাজ করে নিয়ে গেছিস এজন্য তুই মনে করেছিস এখনো সহী সালামতে জিন্দা অপেই যাবি। পরিণাম চিন্তা করে এই বর্বর লসকরকে ফিরিয়ে নিয়ে যা, আমার ফৌজের প্রতি লক্ষ্য কর, তোর ফৌজের চেয়ে দ্বিগুণ। তোর কাছে তো ঘোড় সোয়ার নেই।
জুলিয়ন ও তিতুমীরের মাঝে কি কথা বার্তা হল তা তারেক ইবনে যিয়াদকে, তার ভাষায় বুঝিয়ে বলা হল, তারেক ইবনে যিয়াদ যুদ্ধের দামামা বাজাবার হুকুম দিলেন। দামামা বেজে উঠল, তারেক তার সৈন্যদেরকে হামলা করতে ইশারা করলেন।
তিতুমীরের কাছে রয়েছে মুসলমানদের দ্বিগুণ ফৌজ এবং এক হাজার ঘোড় সোয়ার। এতে সে ছিল আত্বম্ভরী। পায়দল মুসলমান ফৌজ তাকবীর ধ্বনি দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল। তিতুমীর তার মুহাফিজদের সাথে পশ্চাতে চলে গেল। তার নিজে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। বিজয়ের ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস ছিল। অপরদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ স্বীয় হামলাকারী সৈন্যদলের অগ্রভাগে ছিলেন। তিতুমীর তার এক হাজার ঘোড় সোয়ারকে পায়দল বাহিনীর পিছনে রেখেছিল।
উভয় পক্ষের মাঝে মুকাবিলা শুরু হল। মুসলমানদের ভাল করেই জানা ছিল এটা তাদের জীবন মরনের বিষয়। ফিরে আসার কোন মাধ্যম ছিল না। জাহাজ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের ভাষণে তারা নতুন জীবন লাভ করেছিল। তারেক বিপক্ষের সম্মুখ সৈন্যদলের ওপর বীরবিক্রমে আক্রমণ চালিয়ে পিছু হটছিলেন। তার অধিনস্থ কমান্ডাররা পশ্চাদপদ হচ্ছিল। প্রলয়ংকরী যুদ্ধের মাঝে তিতুমীর চিৎকার করে বলছিল, তাদেরকে জিন্দা ফিরে যেতে দিবে না। তারা পলায়ন করছে, পলায়ন করতে যেন না পারে। সবাইকে খতম করে দাও….. তাদের পশ্চাদধাবন কর।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে আরও দ্রুত পিছু হটতে লাগলেন আর দুশমন সৈন্যদল তাদের পিছু পিছু আসল। তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রেখে ছিলেন। মধ্যেবর্তী দলকে তিনি তার নিজের কমান্ডে রেখে ছিলেন। এদের দ্বারাই তিনি হামলা চালিয়ে পিছু হটে আসছিলেন। তাকবীরধ্বনি থেমে গেল এবং মুসলমানরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছল যেখানে ঘনগাছ পালা এবং একদিকে লম্বাটিলা।
স্পেন সৈন্য যখন ঐ গাছের নিচে আসল তখন গাছের প্রতিটি শাখা থেকে তাদের উপর অবিরাম তীর বন্যা বয়ে গেল। মুসলমান তীর আন্দাজরা টিলার উপর লুকিয়ে ছিল তারাও দুশমনের ওপর তীর বর্ষণ শুরু করল। তীর আন্দাজ খুবই কাছে থেকে তীর নিক্ষেপ করছিল এজন্য একটা তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে দুশমন সৈন্যের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছিল।
এই বিশেষ হিদায়েতই স্পেন ফৌজ আসার পূর্বে তারেক ইবনে যিয়াদ তীর আন্দাজ কমান্ডারদেরকে দিয়েছিলেন। দুশমন আসার পূর্বেই তীর আন্দাজদেরকে বৃক্ষে এবং টিলার ওপর প্রস্তুত রাখা হয়েছিল আর তারেক ইবনে যিয়াদের পিছু হটার মাকছাদ এটাই ছিল যে যাতে দুশমনকে তীর আন্দাজদের জালে ফেলা যায়। তার এ কৌশল সফল হয়েছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, “এলান করে দাও দুশমনের ঘোড়া যেন জখম না হয়, আমাদের ঘোড়ার প্রয়োজন রয়েছে, তবে দুশমনের কোন সোয়ার যেন জিন্দা যেতে না পারে।
তার এ নির্দেশ সমস্বরে এলান হতে লাগল।
তিতুমীর তার ফৌজের অবস্থা লক্ষ্য করছিল। তার কাছে তখনও অনেক ফৌজ মওজুদ ছিল। অপর দিকে মুসলমানদের ফৌজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল ডানে অপর দল বামে অবস্থান করছিল। তিতুমীর একই সাথে দু’দলের ওপর হামলা চালাবার হুকুম দিল। তারেকের দেয়া হিদায়াত মুতাবেক উভয় দল আরো বেশী ডানে-বামে সরে গেল যাতে দুশমনের ফৌজ আরো বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
বর্বর মুসলমানরা খুবই খুন পিয়াসু যুদ্ধবাজ ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ হত্যাযজ্ঞ করাই ছিল তাদের পেশা। ইসলাম তাদেরকে যুদ্ধের নব উদ্দীপনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছিল। ফলে তাদের যুদ্ধের ধরণ পালটিয়ে গিয়ে ছিল। তারা প্রথমে নিজেরা পরস্পরে লড়াই করত। স্বয়ং ঈসায়ী ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধের যে স্পৃহা ছিল স্পেন ফৌজের মাঝে তা ছিল না। স্পেন ফৌজ নিজেদেরকে বাদশাহর নওকর মনে করতো আর তারা বেতন-ভাতার জন্যে লড়াই করতো এবং তার জন্যেই জীবিত থাকতে চায়তো। পাদ্রীরাও শাহী খান্দান ও আমীর উজীরদের মত বিলাসী জীবন যাপন করত। স্পেনে বেশ অনেক সংখ্যক ইহুদী বাসিন্দা ছিল কিন্তু খৃস্টানরা তাদেরকে নিজেদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। ইহুদী ললনাদের আরও হেফাজত ছিল না। কোন সুন্দরী-মায়াবী, যুবতী ইহুদী লাড়কী দেখলেই পাদ্রীর হুকুমে তাকে গির্জার সম্পদে পরিণত করা হত। পাদ্রীরা বলত তাকে গির্জা বাসিনী বানান হবে কিন্তু পাদ্রীরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুদের এ কীর্তি ফৌজদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তাই মাল্লা ও জেলেরা মুগীছে রূমীকে বলেছিল সৈন্যরা কোন নজওয়ান খুব সুরত লাড়কী দেখলে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়।
মুসলমানরা স্পেন লস্করের হামলা, অত্যন্ত দৃঢ়তা, সাহষীকতার সাথে প্রতিহত করল। তারা সংখ্যায় কমছিল কিন্তু যুদ্ধ স্পৃহায় ছিল পাগল পারা। তিতুমীরের ধারণা ছিল তার এত বড় বিশাল বাহিনী ক্ষণিকের মাঝে মুসলমানদের এ স্বল্প সৈন্যকে পরাস্ত করে হত্যা করবে। তারেকের দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় তার আশার গুড়ে বালি পড়ল।
তারেক ইবনে যিয়াদ দুশমনের পাশে যে টিলা ছিল তার মাঝে পূর্বেই ঘোড় সোয়ারদেরকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি যে দল নিয়ে হামলা করে পিছু হটে আসলেন সে দলকে কৌশলে ঘোড় সোয়ারদের কাছে নিয়ে গেলেন, তারপর তিনি পায়দল ও ঘোড় সোয়ারদের নির্দেশ দিলেন তারা টিলার আড়াল দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে যেন স্পেন ফৌজের পশ্চাদ হতে আক্রমণ করে বসে।
তারেকের এ কৌশল তিতুমীরের জন্যে অপ্রত্যাশিত ছিল। তার ধারণা ছিল তাদের পশ্চাদ দিক নিরাপদ রয়েছে। পশ্চাদে হামলার নেতৃত্বে তারেক স্বয়ং ছিলেন, আর তার দুই সেনাপতি মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ সম্মুখ হতে অবিরাম গতিতে তীর-বর্শার আক্রমণ করছিলেন।
তারেক তিনশত ঘোড় সোয়ার ও দু’হাজার শার্দুল পায়দল নিয়ে পশ্চাদ দিক থেকে স্পেন ফৌজের ওপর বীরবিক্রমে হামলা করার পর তিতুমীর বুঝতে পারল পিছন দিক হতে তাদের ওপর বিপদ ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মাঝে তার দুহাজার ফৌজ খতম হয়ে গেল আর যারা জীবিত ছিল তারা ভয়াবহ আত্মচিৎকারে নিজেদের অন্যান্য ফৌজের মাঝে গ্রাস সৃষ্টি করছিল। স্পেন ফৌজের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। তারেকের পূর্ব পরিকল্পনা, মুতাবেক মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ তাদের ফৌজ নিয়ে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী স্পৃহা ও বীরত্বে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্পেন সোয়ারীদের ঘোড়া তাদের ফৌজের জন্যে চরম বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারেক নির্দেশ দিয়েছিলেন দুশমনের ঘোড়া জখম না করে সহীহ সালামতে ধরার জন্যে। ঘোড় সোয়ারী জখম হয়ে হয়ে নিচে পড়ছিল আর ঘোড়া লাগামহীন হয়ে দিগবিদিক উম্মাদের ন্যায় ছুটছিল এবং ফৌজকে পায়ের তলে পৃষ্ঠ করছিল। তারেকের তীর আন্দাজরা স্পেন ফৌজের জন্যে আরো বড় মসীবত ডেকে আনছিল। তারা গাছের ওপর হতে অবিরাম তীর নিক্ষেপ করে দুশমনের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছিল।
তিতুমীর তার সারিবদ্ধ ফৌজের মধ্যখানে ছিল। সৈন্য পূর্ণ বিশৃংখল হয়ে গিয়ে ছিল। তার হুকুম কেউ শুনছিল না। তার ফৌজের প্রতিটি সদস্য যার যার মত একাকী পলায়ন করছিল। অর্ধেক সৈন্য খতম হয়ে গিয়েছিল। কোন জখমী সৈন্য পড়লে পায়দল ও ঘোড়ার পদতলে সেও পৃষ্ঠ হয়ে খতম হচ্ছিল।
জুলিয়ন মুগীছে রূমীকে লক্ষ্য করে বললেন, মুগীছ! কয়েকজন জানবাজ ফৌজ পাঠাও, তারা তিতুমীরকে গ্রেফতার করে আনবে।
মুগীছ : যুদ্ধের যে অবস্থা এ পরিস্থিতিতে তার কাছে পৌঁছা যাবে না।
আওপাস : আমাকে চার-পাঁচজন বর্বর দাও, আমি তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে যাচ্ছি।
মুগীছ : আমি আমার হেফাজত রক্ষীর চারজন তোমাকে দিচ্ছি।
আওপাস চারজন ঘোড় সোয়ারী নিয়ে বীর বিক্রমে ছুটে চলল, ঐদিকে তিতুমীরের এক নায়েব তাকে বলল, তিতুমীর! আপনি কি দুশমনের হাতে আত্মাহুতি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? আমাদের তো কিছুই বাকী নেই। সব খতম হয়ে গেছে।
তিতুমীর : তুমি কি এখান থেকে পলায়নের মশওয়ারা দিচ্ছ।
নায়েবঃ ঝান্ডা গুটিয়ে ফেলে গ্রুত পলায়ন করুন। অর্ধেক ফৌজ খতম হয়ে গেছে বাকীরা পলায়নপদ।
তিতুমীর সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিল। মুসলমানদের শক্তিম, স্পৃহা ও লক্ষ্য করছিল। মুসলমানরা তাদের দ্বিগুণ ফৌজকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তাদেরকে হত্যা শুরু করেছে। খোদ তিতুমীরের মাঝেও ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল। এ অবস্থায় তার বাঁচার জন্যে পলায়ন ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সে পলায়নের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল এবং পতাকা বহনকারীকে গুটিয়ে ফেলার জন্যে নির্দেশ দিল।
ঝান্ডা অদৃশ্য হবার সাথে সাথে মুহূর্তের মাঝে ময়দান খালী হয়ে গেল। পড়ে রইল কেবল লাশ আর লাশ। কিছু জখমী ফৌজ পড়ে ছিল তারা উঠার চেষ্টা করছিল কিন্তু লাগামহীন স্পেন ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে তারাও চিরতরে খতম হয়ে গেল।
তারেক ইবনে যিয়াদ : ঘোড়ার বাগডোর হাতে নেও আর মালে গণিমত জমা কর। দুশমনের জেনারেল পলায়ন করেছে।
***
কিছুদিন পর স্পেন বাদশাহ্ রডারিক জেনারেল তিতুমীরের পয়গাম পড়ে গোয় ফেটে পড়ছিলেন। সে সময় তিনি দারুল হুকুমত টলেডোতে ছিলেন না। টলেডো হতে কয়েক দিনের দূরত্ব পামপিলুনা নামক এক শহরে অবস্থান করছিলেন। সেথায় জার্মানের কিছু লোক বসবাস করত। তারা স্পেনের স্থানীয় লোকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহ করিয়ে দিয়ে ছিল। ইতিহাস যেমনিভাবে রডারিককে বিলাস প্রিয় ও অন্যায় প্রবণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ঠিক তেমনিভাবে যুদ্ধের ময়দানে শক্তিশালী দুশমনের জন্যেও বাজ পাখি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার শাহী মর্যাদার ওপর সামান্যতম আঘাতও তার জন্যে ছিল অসহনীয়। বিদ্রোহীদের জন্যে তিনি ছিলেন মালাকুল মওত। পামপিলুনা এলাকাতে বিদ্রোহের খবর পেয়ে কোন জেনারেল না পঠিয়ে নিজে ফৌজ নিয়ে সেথা উপনীত হয়েছেন।
বিদ্রোহীরা মুকাবালা করল কিন্তু রডারিকের রোষ ও আক্রোশ তারা বর্দাশত করতে পারল না। ঐ যুদ্ধে রডারিক জীবিতদেরকে পলায়ন করার সুযোগ দিলেন না। বহিরাগত বিদ্রোহী সর্দারদেরকেও গ্রেফতার করলেন তাদের আরো কয়েকজন সাথীও ধৃত হল। তাদের ওপরই নয় তাদের আওরতদের উপরও চলল নির্যাতনের স্টীম রোলার। বিদ্রোহীদেরকে এমন অমানবিক শাস্তি দেয়া হতো যাতে তারা জীবিতও থাকতে পারত না আবার মৃত্যু বরণ করত না। রডারিক তাদেরকে মৃত প্রায় করে আবার জীবিত করার চেষ্টা করত। যখন তারা বেহুশ হয়ে যেত তখন তাদেরকে এক ময়দানে নিক্ষেপ করে শহরের লোকদেরকে একত্রিত করে একজনকে-এলান করার নির্দেশ দেয়া হত।
“এরা বিদ্রোহী, এরা গাদ্দার, এরা শাহান শাহে উন্দুলুসের ক্রোধ সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিল না। প্রতিদিন এসে তার অবস্থা দেখে শিক্ষা গ্রহণ কর আর শাহানশাহর রোষানলকে ভয় কর।……এরা বিদ্রোহী….. এরা গাদ্দার…..।”
তাদের আওরতদের সাথে আরো ঘূণ্য আচরণ করা হত। রাতে তাদেরকে বিবস্ত্র করে রডারিকের আম দরবারে নাচতে বাধ্য করা হত। এর সাথে সাথে তাদেরকে করা হত বেত্রাঘাত। সে মজলিসে বাদশাহ, ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও ফৌজী অফিসাররা উপস্থিত থাকত। তারা এসব রমণীদের সাথে লজ্জা জনক আচরণ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত। পরিশেষে শরাব পান করে উম্মাদ হয়ে তারা। আওরাতদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেত।
সন্ধ্যেবেলা, দরবারে লোক থৈ থৈ করছে। বিদ্রোহীদের আওরতদেরকে উলঙ্গ করে নাচান হচ্ছে। পনের বছরের এক কিশোরীকে রডারিক তার উরুর ওপর বসিয়ে রেখেছেন, শরাব পানির মত প্রবাহিত হচ্ছে, এরি মাঝে রডারিককে খবর দেয়া হলো টলেডো হতে তিতুমীরের কাসেদ এসেছে সত্তর মুলাকাত করতে চায়।
রডারিকের নির্দেশে কাসেদ অন্দর মহলে গিয়ে বাদশাহর কাছে লিখিত পয়গাম পেশ করল। বাদশাহ সে পয়গাম তার এক মুশিরকে পড়ে শুনানোর জন্যে বললেন এবং তালি বাজালেন সকলে মুহূর্তের মাঝে নিশ্চুপ হয়ে গেল, পরিবেশ হয়ে গেল নিরব-নিস্তব্ধ।
মুশীর উচ্চস্বরে পয়গাম পাঠ করতে লাগল,
শাহান শাহে উন্দুলুসের খেদমতে সালাম ও আদাব। শাহানশাহর এ গোলাম শাহী খান্দানের ইজ্জত ও মুলুকের মর্যাদা রক্ষার্থে সব সময় জীবনবাজী রেখে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছে। যেখানেই বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সেখানে শাহী খান্দানের এ গোলাম মৃত্যুদূত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে এবং বিদ্ৰোইদেরকে মৃত্যুপথের যাত্রী বানিয়েছে, কেউ বলতে পারবেনা তিতুমীর কোন ময়দানে পরাজয় বরণ করেছে। কিন্তু এরা কোন জিন-ভূত যারা আমার অর্ধেক ফৌজ খতম করে দিয়েছে আর বাকী অর্ধেক হয়েছে পলায়নপদ।
রডারিক তার উরুর ওপর বসা কিশোরীকে সরিয়ে দিয়ে ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঠিকভাবে দেখে পড়ছ তো? নিহত হয়েছে আর বাকীরা পালিয়েছে। কোথায়…..? জিন-ভূত-ছিল মানে? তাড়াতাড়ি পাঠ কর।
মুশীর পাঠ করতে লাগল, তারা চারটি জাহাজে এসেছে এবং জাহাজ থেকে অবতরণ করে জাহাজগুলোতে অগ্নি সংযোগ করেছে। আমি সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তাবৎ ফৌজ নিয়ে পৌঁছে ছিলাম। তাদের সংখ্যা আমার ফৌজের অর্ধেক ছিল। তাদেরকে চিরতরে খতম করার জন্যে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু তারা এমনভাবে লড়াই করল যার ফলে আমার ফৌজের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি হল। বৃক্ষ হতে তীর, টিলা হতে তীর আর আশ্চর্যের বিষয় হলো কোন তীরই লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল না। তাদের কোন ঘোড় সোয়ার দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু না জানি আমাদের পশ্চাদ দিক থেকে কোথা হতে এসে পড়ল। তাদের সোয়াররা আমার ফৌজের ওপর এমন
হামলা করল যে তা শামাল দিয়ে পিছনে ফিরার সুযোগই দিল না।
ঐ পয়গামে তিতুমীর যুদ্ধ ও তার ফৌজের করুণ অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করে ছিল তারপর সে যা লেখেছিল তা আজও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত।
তারা কারা এবং কোথা থেকে আসল তা বুঝা গেল না। তবে যারাই হোক এবং যেখান থেকেই আসুক তারা যে অত্যন্ত যুদ্ধবাজ ও ভয়ঙ্কর এতে কোন সন্দেহ নেই। হতে পারে তারা দম্য দল, লুটতরাজ করে ফিরে যাবে তবে তাদেরকে সেখানে খতম করা জরুরী। আমার ফৌজ পনের হাজার আর তাদের ফৌজ ছিল এর অর্ধেক এখন আমার এর চেয়ে আরো বেশী ফৌজের প্রয়োজন। সর্বশেষ এবং জরুরী কথা হলো তাদের সাথে আমাদের জায়গীরদার জুলিয়ন এবং ডেজার ভাই আওপাসও রয়েছে।
রডারিক পেরেশাসন ও আশ্চর্য হয়ে বললেন, জুলিয়ন? আওপাস! তাদেরকে মৃত্যু এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। আমি বুঝেছি। তিতুমীর বুজদিল প্রমাণিতহয়েছে, আমি তাকে জীবিত থাকার সাধ মিটিয়ে দেব। হামলা করেছে কারা,এতটুকু দেখার সুযোগ সে পায়নি…..
জুলিয়ন-আওপাস আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে এসেছে। তার নিজস্ব ফৌজের সাথে বর্বরদের হয়তো নিয়ে এসেছে। তিতুমীরকে ফৌজ দেব না, আমি নিজেই যাব। জুলিয়নের বেটী ফ্লোরিডাকে আমার মহলে নিয়ে আসব। ঐ বদবখতদের জানা নেই আমি গাদ্দারীর কি শাস্তি দেই।
রডারিক হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন এবং বিদ্রোহীদের বিবস্ত্র আওরাতদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা এখন চলে যাও, তারপর সিপাহীদেরকে রডারিক নির্দেশ দিলেন, কাল সকালে বিদ্রোহীদেরকে ময়দানে নিয়ে ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ করে হত্যা করবে আর তাদের আওরতদেরকে রেখে দিয়ে এখানের গির্জার পাদ্রীদের কাছে সমর্পণ করবে।
মহিলারা বুক ফাটা চিৎকার শুরু করল, দুতিন জন বাদশাহর পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল, একজন মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আপনি আমাদেরকে অনেক শাস্তি দিয়েছেন আর শাস্তি দিয়েন না মাফ করেদেন।
এক কিশোরী বলল, বাদশাহ সালামত! আমার বাবার অপরাধের শাস্তি কেন আমাকে দিচ্ছেন? আমি তো কিছুই জানি না আমার বাবা পর্দার আড়ালে কি করেছে। অন্য আরেকজন মহিলা বলল, আমাকে ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ করেন; আমার ভাইকে ছেড়েদিন।
রডারিক ধাক্কা দিয়ে তিনজনকেই সরিয়ে দিল।
সর্বকনিষ্ট কিশোরী বলল, শাহে উলুস! যত পার আমাদের ওপর জুলুম কর, আমাদের অশ্বতলে পৃষ্ঠ কর, একজন নির্যাতিত, নিপীড়িত অসহায় লাড়কীর চিত্ত ফাটা আহ্….. শুনে রাখ। তোমার বাদশাহী মসনদ ও ঘোড়ার পদাঘাতে চুর্মার হবে, মিটে যাবে চির তরে তোমার নাম নিশানা, তোমার ও তোমার বাদশাহীর দিন ঘনিয়ে এসেছে।
রডারিক তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, সাবাস! আমি তোমার সাহসীকতার তারীফ করছি, তুমি এত বড় মুলুকের বাদশাহকে ভয় করনি….. এখানে এসো লাড়কী! আমি তোমাকে ইনয়াম দেব।
লাড়কি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রডারিক : সবার দিকে ফিরে দাঁড়াও। সকলে দেখ এ লাড়কী কত বড় সাহসীনী বীরঙ্গনা। লাড়কী রডারিকের দিকে পশ্চাদ ফিরে দাঁড়াল। দরবারীরা তাকে দেখতে লাগল। রডারিকের তলোয়ার তার শাহী কুরসীর সাথে রাখা ছিল। বাদশাহ ক্ষীপ্ততার সাথে দ্রুত বেগে তলোয়ার কোষমুক্ত করে পশ্চাদ দিক হতে কিশোরীর মস্তকে এমন জোরে আঘাত হানল, এক কোপে মাথা শরীর থেকে পৃথক হয়ে গেল এবং সে কিছুক্ষণ ছটফট করে চিরতরে নিথর হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে বিদ্রোহীদেরকে এক ময়দানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। অপর প্রান্তে পঞ্চাশ-ষাটজন ঘোড় সোয়ারী অত্যন্ত দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা বিদ্রোহীদের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বিদ্রোহীরা তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এদিক-সেদিক ছুটতে লাগল, সোয়ারীরা ঘোড়া ছুটিয়ে অশ্ব পদতলে তাদেরকে চিরতরে খতম করে দিল।
***
এদিকে উত্তর আফ্রিকার দারুল ইমারত কায়রোতে আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের পয়গাম পড়ে আহাম ব্যক্তিদেরকে শুনাচ্ছিলেন।
…. আল-হামুদুলিল্লাহ্, আমরা আমাদের দ্বিগুণ দুশমনের ওপর বিজয়ার্জন করেছি। আমাদের তিনশত ঘোড় সোয়ারের মুকাবালায় এক হাজার ঘেড়. সোয়ার ছিল। স্পেনের প্রতিটি সৈন্যের ছিল লৌহ শিরোস্ত্রান। তাদের হাতিয়ার ছিল আমাদের হাতিয়ারের চেয়ে অনেকগুণ ভাল। আল্লাহ্ তায়ালা ফাতাহ্ হাসিলের তরিকা আমাকে বাতলিয়েছেন। আল্লাহর পক্ষ হতে আমি মদুদ প্রাপ্ত হয়েছি। তীরন্দাজদেরকে বৃক্ষে আর ঘোড় সোয়ার দেরকে টিলার পাশে লুকিয়ে রেখে ছিলাম। তারপর পশ্চাদে হটার থোকা দিয়ে তাদেরকে সম্মুখে অগ্রসর করেছি, তারা এগুতে এগুতে আমার তীর আন্দাজের নাগালে এলে তারা বৃক্ষ হতে দুশমনের ওপর অবিরাম তীর বর্ষণ শুরু করলে তারা পেরেশান হয়ে পড়ে এরি মাঝে পশ্চাদ হতে আমার ঘোড় সোয়ার তাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। এভাবে সাত হাজার আল্লাহর পথের মুজাহিদ পনের হাজার কাফেরের ওপর বিজয়ার্জন করে।
আমি পয়গাম লেখাচ্ছি আর যে দৃশ্য দেখছি সে দৃশ্য আমীরে মুহতারাম ও খলীফাতুল মুসলিমীনেরও প্রত্যক্ষ করার মত। দুশমনের লাশ এত বেশী যে শেষ হচ্ছে না। জংগী কয়েদীর দ্বারা লাশ সরাচ্ছি। যত গর্ত ছিল তাতে লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে, গত শেষ হয়ে গেছে কিন্তু লাশ শেষ হয়নি। বাকি শবদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ছয়শত অশ্ব হস্তগত হয়েছে। মৃত দুশমনের হাতিয়ারের স্তূপ জমেছে।
এখন অতিরিক্ত ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন। খবর পেয়েছি, স্পেন ফৌজ অনেক বেশী এবং সম্মুখে কেল্লাবন্দি শহর। আমি অতিরিক্ত ফৌজের জন্যে ইন্তেজার করে সম্মুখে অগ্রসর হব। আমাদের কামিয়াবীর জন্যে দোয়া করবেন। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আর ফিরে আসব না, কারণ ফিরে আসার কোন রাস্তাই নেই। আমরা যে চারটি জাহাজে এসেছিলাম তা অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করা হয়েছে।”
মুসা ইবনে নুসাইর হর্ষফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, সাবাশ! তোমাকে কোন শক্তি পরাজিত করতে পারবে না।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের বিজয় খবর ও তার জন্যে সাহায্যের আবেদন করে তখনই খলীফা ওয়ালীদ ইবনে মালেকের নামে একটা পয়গাম লিখিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
***
পামপিলুনাতে রডারিক হুকুম জারি করলেন, এখান থেকে টলেডো পর্যন্ত যেন এ ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয় যে, স্পেনে বহিরাগত কওম অনুপ্রবেশ করেছে যারা এত শক্তিশালী ও রক্তপিপাসু যে, তাদের চেয়ে দ্বিগুণ ফৌজকে তারা খতম করে দিয়েছে। রডারিক তার ফরমানে একথাও বলে ছিল যে আক্রমণকারীদের ব্যাপারে যেন মানুষকে ভয় দেখান হয় এবং বলা হয়, তারা দস্যুদল, তারা-তোমাদের ধন সম্পদ ও আওরতদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে আর তোমাদের মুলকে লাগাবে আগুন, তোমাদেরকে করবে হত্যা।
সরকারী কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। তারা প্রত্যেক গ্রাম মহল্লার কর্মচারীর কাছে এ পয়গাম পৌঁছিয়ে টলেডোতে গিয়ে পৌঁছল তারপর প্রত্যেক বস্তি ও গির্জাতে এলান হতে লাগল,
“সমুদ্রের দিক থেকে এক অজ্ঞাত মুলকের এক বড় দস্যুদল ও লুটেরা আমাদের মুলকে প্রবেশ করেছে। তারা আমাদের অনেক বড় ফৌজী দলকে হালাক করে দিয়ে তুফানের মত সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। তারা বাড়ীতে হানা দিয়ে নগদ টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ কবজা করছে আর জওয়ান আওরতদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে তারপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঘরে অগ্নি সংযোগ করছে। তাদের এ ধ্বংসলীলা হতে ইবাদতগাহও রক্ষা পাচ্ছে না। নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চাদেরকে বর্শার আঘাতে হত্যা করছে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।
শাহান শাহেউন্দুলুস, তার ফৌজ নিয়ে ঐ ভয়ানক লস্করের মুকাবালায় বেরুচ্ছেন, বাদশাহ্ রডারিক নির্দেশ দিয়েছেন, যে সকল লোক তীর আন্দাজী, তলোয়ার পরিচালনা করতে পারে তারা যেন ফৌজে শামিল হয়। যারা ফৌজে শামিল হবে তারা ভাতা পাবে অধিকন্তু দস্যু দল থেকে যা করতলগত হবে তারও একটা অংশ থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে তোমাদের জান-মাল, তোমাদের ঘর-বাড়ীও লাড়কীরা নিরাপত্তা পাবে…..।
লোক সকল প্রস্তুত হয়ে যাও। হাতিয়ার ও ঘোড়ায় মোয়র হয়ে নিজের ইজ্জত ও ধন-সম্পদ লুট থেকে বাঁচাও আর তা যদি না কর তাহলে আজই বাল-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে চলে যাও এবং কমজোর বুজদিল হয়ে জানোয়ারের মত দিন গুজরান কর। তারপর যখন ফিরে আসবে তখন নিজেদের ঘর-বাড়ীর আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না।
জওয়ান ও অর্ধ বয়সী লোকেরা অত্যন্ত স্পৃহা ও উদ্দীপনার সাথে গায়ের মুলকী লঙ্করকের মুকাবালার জন্যে তৈরী হতে লাগল। তাদেরকে বলা হলো বাদশাহ্ রডারিক অমুক রাস্তা দিয়ে টলেডো যাবেন; ফৌজে শামিল হতে ইচ্ছুক সে যেন রাস্তায় অপেক্ষমান থাকে।
***
কিছু ইবাদত খানায় এ এলান হচ্ছিল না, সেগুলো ছিল ইহুদীদের ইবাদত খানা। তাদের সংখ্যা বেশী ছিল না। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে স্পেনে ইহুদীরা ছিল অত্যন্ত মাজলুম। কারীগরি, প্রকৌশলী, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ইহুদীদের হাতে কিন্তু তাদের পয়সা ছিল না। তাদের থেকে এত পরিমাণ কর আদায় করা হত যার ফলে তাদের কাছে দু’মুটো খাবারের পয়সা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। তাদের নিম্ন শ্রেণীকে অস্পর্শ মনে করা হত।
স্পেনের শাহী মসনদ যখন ডেজার হাতে আসল তখন সে খ্রীষ্টানদের মত ইহুদীদেরকে পদ মর্যাদা দিয়ে টেক্স কমিয়ে দিল। ইহুদীদের খুব সুরত লাড়কীদেরকে জোরপূর্বক গির্জার অধীনে অর্পন করা হত, ডেজা এ নিপীড়নের পথও বন্ধ করে দিল। কেবল ইহুদীদেরই নয় বরং সর্বসাধারণের জীবন মানও সে উন্নত করল আর এটাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। রডারিক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়ে নিজে শাহী মসনদে বসল। স্পেনের শাহী মুকুট নিজের মাথায় পরেই সে ডেজাকে হত্যা করল।
বহিরাগত শত্রুর মুকাবালায় লোক ফৌজে শামিল হবার ব্যাপারে যখন গির্জায়, শহরের চৌকিতে, গ্রামে-গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে এলান হচ্ছিল তখন ইহুদীদের ইবাদত খানায় অন্যদিক নিয়ে গোপন আলোচনা চলছিল।
ইহুদীদেরকে ফৌজে শামিল হওয়া থেকে কিভাবে বাধা দেয়া যায় এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে একদিন পাঁচ-ছয়জন ইহুদী সর্দার এক ইবাদত খানাতে একত্রিত হলো। তারা কোন অবস্থাতেই রডারিককে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না।
ইহুদীদের এক ধর্মগুরু বলল, রডারিকের ফৌজে শামিল হবার বিষয়টাই। কেবল নয় বরং তাকে কিভাবে ক্ষতি করা যায় সে ব্যাপারেও আমাদের চিন্তে-ভাবনা করতে হবে।
অন্য আরেকজন ধর্মগুরু বলল, আগে থেকেই ফৌজে কিছু ইহুদী শামিল রয়েছে, তাদেরকে কিভাবে বের করে আনা যায় সে ব্যাপারে ভাবার দরকার।
অন্য আরেকজন বলল, আমি অন্যদিক চিন্তে করছি। যারা ফৌজে রয়েছে তাদেরকে ফৌজে রেখে রডারিকের ফৌজের বিরুদ্ধে তাদেরকে লাগানো যেতে পারে।
একজন প্রশ্ন করল, তাদের বিরুদ্ধাচরণের কথা যদি কেউ জেনে যায়?
জবাবে অপর জন, কেউ জানতে পারবে না।
অন্যজন বলল, যদি এটা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমি এর চেয়ে আরো বড় ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে পারব।
সৃষ্টিগতভাবেই ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী। মাটির নিচ থেকে গোড়া কাটার ব্যাপারে তারা যেমন পারদর্শী অন্যকোন কওম এমনটি নয়। তাদের ধর্মগুরু এ ব্যাপারে ফায়সালা করল যে, প্রতিটি ইহুদীর ঘরে এ খবর পৌঁছে দিতে হবে যেন কেউ রডারিকের ফৌজে শামিল না হয়।
***
অর্ধবয়সী এক আওরত। নাম তার মেরীনা। যৌবন ডলে গিয়েছিল কিন্তু লম্বা দেহলতা ও ছন্দময়ী চেহারাতে প্রেমের আবেদন ও আকর্ষণ পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তার প্রতি যারা লক্ষ্য করত তাদেরকে তার যাদুময়ী আঁখি যুগল পাগল করে ফেলত। সে কোন সাধারণ ও মামুলী আওরত ছিল না। তাকে শাহী মহলের বেগমদের মাঝে গণ্য করা হত। সে রডারিকের রক্ষিতা ছিল এবং একমাত্র সেই কেবল যৌবন ঢলে যাবার পরও শাহী মহলে বহাল তবীয়তে বিদ্যমান ছিল। মহলের কোন রমণী ত্রিশ বছরে উপনীত হলেই তাকে গায়েব করে দেয়া হত বা ইনয়াম হিসেবে ফৌজের কোন আলা-অফিসারকে দিয়ে দেয়া হত।
মেরীনা ইহুদী ছিল। ইহুদীদের স্বভাব মুতাবেক সেও ষড়যন্ত্রকারীনি ছিল। একেতো সে ছিল রমণী দ্বিতীয়ত: ছিল অত্যন্ত সুন্দরী ও মায়াবী। অধিকন্তু চক্রান্তকারী সুচতুর ইহুদীর মেধা। এ সকল সিফত ও বৈশিষ্ট্য বলে সে মহলে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। সেজে ছিল শাহী হেরেমের রাণী। তার কৃষ্ণকালো আঁখি যুগল ও বচন ভংগিতে ছিল যাদু পরশ ও সম্মোহনী প্রবল আকর্ষণ। যার হাত থেকে রডারিকও পারেনি বাঁচতে।
সে সময় স্পেনের রাজধানী টলেডোর শাহী মহল হতে এক দেড় মাইল দূরে সবুজ শ্যামলে ঘেরা একটা ঝিল ছিল, সে ঝিলের এক পাশে ছিল গাছ-পালা লতা গুল্মে ঢাকা একটা উঁচু টিলা। সে ঝিলের কাছে কোন পুরুষের যাবার অনুমতি ছিল না কারণ তা শাহী মহলের আওরতদের জন্যে খাছ করে দেয়া হয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে সেথায় আওরতরা সন্তরন, নৃত্য, গান-বাজনা ও আমোদ-প্রমোদের জন্যে যেত।
বিকাল বেলা। সূর্য বিদায়ের জন্যে পশ্চিম দিগন্তে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। ঝিল পাড়ে পঁচিশ-ত্রিশজন রমণী গল্প-গুজব, খেলা-ধুলা, হাসি-তামাশায় মেতেউঠেছে। তাদের মাঝে কিশোরী ও পূর্ণযৌবনা ললনারাও রয়েছে। প্রতিদিনই তারা এ ঝিল পাড়ে এ ধরনের কর্মে লিপ্ত হত। তাদেরকে নেগরানী করত মেরিনা। সে বিকেলেও মেরীনা তাদের নেগরানী করছিল।
ঝিল অদূরে গাছের আড়ালে ললনাদের অশ্ব গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল যার কোচওয়ান ছিল পুরুষ। কোচওয়ানদের একজন দেখতে পেল এক ব্যক্তি ঐ সীমানার ভিতরে এসে গেছে যার কাছে কাউকে আসার অনুমতি দেয়া হয় না। কোচওয়ানরা তাকে ফিরে যাবার জন্যে ইশারা করল কিন্তু সে তার প্রতি লক্ষ্য না করে সম্মুখে অগ্রসর হয়েই চলল, কোচওয়ানরা তাকে বাধা দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালে সে রাস্তা পরিবর্তন করে অগ্রসর হতে লাগল, তাকে বাধা দিতে দিতে সে ঝিল পাড়ে গিয়ে উপনীত হলো। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করল, সে কেবল চোখ দুটো খোলা রেখে মাথা ও মুখমণ্ডল পুরো চাদরে ঢেকে রেখেছিল। সে পা পর্যন্ত লম্বাচোগা পরিহিত ছিল। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করলে সে চিৎকার শুরু করল। ঝিল পাড়ে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত আওরতরা সে আওয়াজ শুনে মনে করল কোন জানোয়ারের আওয়াজ। তারা তার প্রতি তেমন লক্ষ্য করল না। কেবল মেরীনা তার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করল কারণ ইতিপূর্বে কিছু মানুষের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। সে যেহেতু নেগরান ছিল তাই কাপড় পরিধান করে যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল সেদিকে রওনা হল। মেরীনা সামনে অগ্রসর হয়ে দেখল, কোচওয়ানরা পাগলের ন্যায় এক ব্যক্তিকে ধরে টানা-হেঁছড়া করছে আর সে আশ্চর্যজনকভারে চিৎকার করছে। কেবল কোন পাগলের পক্ষেই সম্ভব ছিল সে নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করা। সে মেরীনাকে দেখেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, ঐ যে রানী এসে গেছে। এ কথা বলেই মেরীনার দিকে দৌড় দিল। কোচওয়ানরা তাকে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু দ্রুত দৌড়াচ্ছিল তাই তারা ধরতে পারল না ফলে সে মেরীনার কাছে গিয়ে পৌঁছুল। মেরীনার পদতলে লুটিয়ে পড়ল। মেরীনা কিছুটা পিছে সরে গেল।
সে মাথা তুলে বলল, মেরীনা! আমি আওপাস, তোমার মিলনে এসেছি। কোচওয়ান এসে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে চাইল।
মেরীনা : ছেড়ে দাও। বেচারা পাগল, কারো কোন ক্ষতি করবে না। তোমরা চলে যাও।
আওপাস দুঃখ ভরা স্বরে বলল,আমি পাগল নই মেরীন! পাগল নই! আমি ফরীয়াদি, আমি মাজলুম।
সে ডেজার ভাই আওপাস ছিল, যে ডেজার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করিয়ে তাকে হত্যা করে নিজে শাহী মসনদ দখল করেছে। সে সময় আওপাসের বয়স ছিল সতের-আঠার বছর। আওপাস ছিল গোথা বংশীয়। ডেজা ছিল সর্বশেষ গোথা বাদশাহ্। মেরীনা এক ইহুদী ব্যবসায়ীর বেটী। ডেজার হুকুমতের সময় তার ওমর ছিল ষোল-সতের বছর। আওপাস মেরীনাকে প্রথম দেখাতে ভালবেসে ফেলেছিল কিন্তু মেরীনা তার সে ভালবাসাকে গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছি।
মেরীনা আওপাসকে বলেছিল, এই মরিচিকাকে কেন ভালবাসা বলছ? আমি ইহুদী বেটী হবার পরও এখনও কেন যে শাহী খান্দানের থাবা থেকে বেঁচে আছি তা জানি না। তুমি তোমার গোলামদেরকে হুকুম দাও তারা আমাকে জোর পূর্বক তোমাদের বিলাস বহুল স্বপ্নীল মহলে পৌঁছে দেবে। তুমিতো শাহ্জাদা। বাদশাহর ভাই।
আওপাস : তুমি কি জান না কেন তুমি শাহী খান্দানের হাত থেকে বেঁছে আছ? তোমার কি জানা নেই যে, আমার ভাই মসনদে বসার পর ফরমান জারী করেছেন, কোন ইহুদী লাড়কীকে জোর পূর্বক কোন গির্জায় বা শাহী খান্দানের কারো কাছে সোপর্দ করা গুরুতর অপরাধ। এর বিরুদ্ধাচরণকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। হবে।
আমি বাদশাহর ভাই আর তুমি প্রজা এ কারণে তোমাকে আমি শাহী মহলে নিয়ে যাব না। যেদিন আমি তোমাকে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ করব সেদিন তোমাকে মহলে নিয়ে যাব।….. মেরীনা! আমি তোমাকে পেয়ার করি। মহল থেকে দূরে কোথাও তোমার সাথে আমি সাক্ষাৎ করব।
মেরীনার অন্তরেও আওপাসের মহব্বত জায়গা করে নিয়ে ছিল। তারপর থেকে তারা মহলের বাহিরে কোথাও একত্রে মধুর মিলনে লিপ্ত হতে থাকে। একদিন তাদের মুলাকাতের খবর আপাসের ভাই ডেজার কাছে পৌঁছে।
ডেজা : তুমি যে শাহী খান্দানের সন্তান এ অনুভূতি কি হারিয়ে ফেলেছ? ঐ লাড়কী কে? যার সাথে তুমি মেলা-মেশা কর।
আওপাস : ইহুদী, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক শারীরিক নয় আর আমি তার সাথে বাদশাহর ভাই হিসেবে সাক্ষাৎ করি না।
ডেজা : তুমি কেবল সেই লাড়কীর সাথেই মিলতে পারবে যার সাথে তোমার শাদী দেব। আর সে লাড়কী কে তুমি তো জানই।
আওপাস : আপনি যার সাথে আমার শাদী দেবেন তার সাথে আমি মিলব না। আমি তো ঐ ইহুদী লাড়কীকেই শাদী করব।
ডেজা : তাহলে তুমি এ মুলকের মসনদ ও তাজ থেকে বঞ্চিত হবে। তুমি হয়তো ভুলে গেছ আমার পর এ মসনদে তুমি বসবে। তোমার রাণী গোখা খান্দানের হবে। সে সাধারণ প্রজা ও ইহুদী হবেনা।
আওপাসঃ মসনদ ও মুকুট থেকে বঞ্চিত হব তবুও মেরীনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
বড় ভাই এর সাথে আওপাসের বাদানুবাদ হলো। ডেজা একদিকে বড় ভাই অপরদিকে বাদশাহ। সে এ দু অধিকারে মেরীনার সাথে সাক্ষাৎ না করার নির্দেশ দিল।
যদি সাক্ষাৎ করে তাহলে তাকে কয়েদ খানায় পাঠান হবে। আওপাস এ ধমকীকেও ভয় করল না এবং ভাইকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিল, সে মেরীনার সাথে বেওফায়ী করতে পারবে না।
কিছু দিন পর এক সাক্ষাতে মেরীনা আওপাসকে বলল, ডেজার এক রাজদূত তার বাবাকে বলেছে, সে যেন তার বেটীকে শাহী খান্দানের কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে না দেয় আর মেরীনাকে যেন তাড়াতাড়ি শাদী দিয়ে দেয়।
ডেজা যেহেতু বাদশাহ ছিল তাই মেরীনা নামক ঐ ইহুদী লাড়কীকে ইচ্ছে করলে সরিয়ে দিতে পারত কিন্তু সে ছিল দয়াপ্রবণ ও জনগণের অধিকার সচেতন এ কারণে সে তা করা ভাল মনে করেনি। মেরীনাকে তার বাবা গৃহবন্দি করে রেখেছিল কিন্তু আওপাস রাতের আঁধারে তার সাথে সাক্ষাৎ করত। মেরীনার বাবা তার শাদী ঠিক করেছিল কিন্তু মেরীনা তাতে সম্মত হয়নি।
ডেজা মেরীনাকে তো কোন শাস্তি দেয়নি এমনিভাবে তার বাবাকে কোন প্রকার হুমকি-ধমকি দেয়নি তবে আওপাসকে দিয়েছে কঠিন শাস্তি তারপরও সে মেরীনার সাথে মিলন বন্ধ করেনি, তাইতো বলে প্রেম মানে না কোন বাধা। একদা রাতের আঁধারে তারা পলায়ন করছিল কিন্তু পখিমাঝেই ধরা পড়ে যায়। তারপর থেকে ডেজা আওপাসকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল।
আওপাস তার বাদশাহ ভাই এর জন্যে আর মেরীনা তার বাবার জন্যে এক বড় মসীবত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের প্রেম সাগরে ডুব দেয়া দু’বছর অতি বাহিত হয়েছিল। তাদের প্রেম কাহিনী টলেডো শহরে মানুষের মুখে মুখে অনুরিত হচ্ছিল। এরি মাঝে একদিন হঠাৎ করে শাহী মহলে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। খবর এলো ফৌজ বিদ্রোহ করেছে আর এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে ফৌজী কমান্ডার রডারিক। ডেজা তার দেহরক্ষী দল ও টলেডোতে আরো যে ফৌজ ছিল তাদেরকে নিয়ে বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ দমনের জন্যে রওনা হলো। সে ধারণা করেছিল গিয়েই বিদ্রোহীদেরকে খতম করে ফেলবে কিন্তু বাস্তব অবস্থা ছিল এর বিপরীত। তার জানা ছিল না তার বিরুদ্ধে ফৌজী বাহিনী ও গির্জায় প্রোপাগান্ডা ছড়ান হয়েছিল যে সে নিজ মুলুকের ওফাদার নয় বরং অন্যদেশের বাদশাহর সাথে নিজ মুলুকের ব্যাপারে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
পূর্বেই বলা হয়েছে ডেজা ছিল একজন মানব প্রেমিক বাদশাহ্ আর সে ইহুদীদেরকে স্বসম্মানে বসবাসের ব্যবস্থা করে ছিল এ কারণে ফৌজী অফিসার, জায়গীরদার, আমীর ওমারারা হয়েছিল তার প্রতি অখুশী। পাদ্রীরা তো তার প্রতি হয়েছিল চরম ক্ষীপ্ত। তারা ভোগের জন্যে বেছে নিত ইহুদের নব যৌবনা সুন্দরী ললনা। ডেজা এ রাস্তা করে দিয়েছিল বন্ধ। জায়গীরদার ও ধর্মগুরুরা তার বিরোধী হয়ে যায় ফলে ক্ষমতার মসনদে থাকা হয়ে যায় দুস্কর। ডেজার অবস্থাও এমনটিই হয়েছিল। ডেজা যে ফৌজ টলেডো হতে নিয়ে গিয়েছিল তার দরুন নিজের প্রতি বিশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু ময়দানে গিয়ে সে তার ভুল বুঝতে পারলতাবৎ ফৌজ তার পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সাথে মিলে গেল।
ডেজা রডারিকের হাতে ধৃত হয়ে নিহত হলে তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য পলায়ন করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সিওস্তাতে গিয়ে উঠলে জুলিয়ন তাদেরকে আশ্রয় দিল কারণ জুলিয়ন ছিল ডেজার জামাতা। তা নাহলে সেও তাদেরকে আশ্রয় দিত না। কারণ সে ছিল স্পেনের জায়গীরদার।
***
অন্তত বিশ বছর পর তাদের মিলন ঘটল। মেরীনার নির্দেশ মুতাবেক কোচ ওয়ানরা তাদের গাড়ীর কাছে চলে গেল আর মেরীনা আওপাসকে নিয়ে টিলার ওঁতে গেল। তাদের মিলন ছিল অত্যন্ত আবেগঘণ। দীর্ঘক্ষণ তারা উভয়ে চোখের আঁসুতে আপন আপন হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করছিল। একে যেন অপরের ভেতর প্রবেশ করেছিল।
মেরীনা : তুমি কিভাবে জানতে পারলে আমি টলেডোতে রয়েছি।
আওপাস : এ খবর তো আমি কয়েক বছর আগে থেকেই জানি। জুলিয়নের লোকজন সব সময়ই এখানে আসা যাওয়া করত। তাদের কে যেন আমাকে বলেছিল, যে মেরীনার জন্যে তুমি তোমার ভাইকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলে এবং সিংহাসন হতে বিমুখ হয়ে পড়েছিলে সে মেরীনা রডারিকের হেরেমে রয়েছে। এরপরও তোমার খবরা খবর আমার কাছে পৌঁছত। মেরীনা! এখানে বেশী কথা বর্ণা আমাদের জন্যে সমীচীন নয়, উভয়ের জন্যেই খতা রয়েছে।
মেরীনা : ঠিক বলেছ আওপাস! তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। তুমি অত্যন্ত বিজ্ঞ গোয়েন্দা বলে মালুম হচ্ছে। এখন আমি ঝিলপাড়ে থাকব এটাও তুমি জেনে গেছ।
আওপাস : আমি গোয়েন্দা নই বরং এখানে আমি অভিজ্ঞ গোয়েন্দার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আমাদের গোথা গোত্রের দুজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারা আমাকে প্রথমতঃ বলেছিল যে তুমি এখনও বাদশাহর মহলে রয়েছ। দ্বিতীয়ত: তারা বলেছিল পড়ন্ত বিকেলে মহলের অন্যান্য আওতদের সাথে ঝিলপাড়ে আসা তোমার মামুল। আমি গত পরশুদিন হতে এই বেশে তোমার খোঁজে বনের মাঝে উভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজকে আমাকে গোয়েন্দা খবর দিল তুমি আওরতদের সাথে ঝিল পাড়ে আছ…..। মেরীনা! প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসেছে। রডারিকের থেকে আমি যে প্রতিশোধ নেব তাতো তুমিজান, তোমারও তার থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিৎ। তোমার যৌবনে সে তোমাকে তার উপপত্নী বানিয়ে তোমার জীবন নাশ করেছে। আমিতো বিয়ে শাদী করেছি। বিবি বাচ্চাও রয়েছে।
মেরীনা অত্যন্ত দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলল, ঠিকই বলেছ আওপাস! আমার প্রতিশোধ নেয়া প্রয়োজন। আমি যখন তোমার হতে পারিনি তখন অন্য কারো আর বিবি হতে পারিনি। মাতাও হতে পারিনি। তার পরিবর্তে আমি শয়তানে পরিণত হয়েছি। আমার মাঝে শয়তানের বদঅভ্যাস সৃষ্টি হয়েছে। আর আমি পুরুষদেরকে এবং হেরেমের আওরাতদেরকে আংগুলের ইশারায় নাচান শুরু করেছি। মহলের অফিসার আমীর-ওমারা, উজির-নাজীর আমাকে মুকুট বিহীন ম্রাজ্ঞী বলতে শুরু করেছে।
আওপাস : কথা অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে মেরীনা! তোমার মত আমিও আবেগে ডুবে যাচ্ছি। বিশ বছর পূর্বের সে সব স্মৃতি চারণ করতে ইচ্ছে করছে। কাংখা হচ্ছে জামানা যদি বিশ বছর পিছিয়ে যেত।
মেরীনা : তোমার বিরহের পরে তোমার বিচ্ছেদ বেদনা যে স্বপ্ন আমাকে দেখাচ্ছিল সে কথা আমি তোমাকে বলব, তোমাকে দেখে আমার হৃদয়, সাগরে আবেগের বাধ-ভাংগা ঢেউ উঠেছে।
আওপাস : আপাতত: এখন আবেগ দমিয়ে রাখ মেরীনা! প্রতিশোধের সময় এসেছে।
মেরীনা : আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আক্রমণকারীদের সাথে এসেছ। আক্রমণ কারীরা কারা?
আওপাস : বর্বর। বর্বর মুসলমান। তারপর আওপাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিল জুলিয়ন মুসলশানদেরকে আক্রমণের জন্যে কিভাবে তৈরি করল। আওপাস বলল, মেরীনা। স্পেন ফৌজী বাহিনীতে গোথা ফৌজ যেমনি রয়েছে তেমনিভাবে ইহুদীও রয়েছে। তুমি কি এমন কৌশল অবলম্বন করতে পার, যখন রডারিক ও মুসলমান ফৌজ সামনাসামনি হবে তখন গোথা ও ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে গিয়ে মিলে যাবে।
মেরীনা এমনটি আমি করতে পারি এবং বাস্তব এমনই হবে। এ ব্যাপারে বেশী কথা বলার প্রয়োজন নেই।
আওপাস : আর কোন খবর দিতে পার?
মেরীনা : হ্যাঁ। রডারিক পামপিলুনাতে রয়েছে এবং সৈন্য একত্রিত করছে। সাধারণ জনসাধারণকে ফৌজে শামিল হবার জন্যে বলা হচ্ছে। মুসলমান ফৌজ সংখ্যা কত।
আওপাস : সাত হাজার। তবে এখন কিছু কম রয়েছে কারণ প্রথম লড়াই-এ কিছু মারা গেছে।
মেরীনা! আহা! তারা তো সংখ্যায় খুবই কম। মুসলমানতে সব খতম হয়ে যাবে।
আওপাস মৃদু হেসে বলল, তোমাদের জেনারেল তিতুমীরকে জিজ্ঞেস কর। তুমি যদি মুসলমানদের যুদ্ধ করতে দেখ তাহলে পেরেশান হয়ে যাবে। তারা কুফরের বিরুদ্ধে লড়াই করা জিহাদ বলে। যার অর্থ হচ্ছে পবিত্র যুদ্ধ। মুসলমানরা জিহাদকে ইবাদত মনে করে। আর সে ইবাদতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে তারা আত্মতৃপ্তি হাসিল করে তবে তারা অহেতুক জীবন দান করে না। যেহেতু তাদের মনে বিন্দুমাত্র মৃত্যুর ভয় থাকে না তাই তারা দুশমনের ফৌজী দলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুশমনের জন্যে মৃত্যুদূত হয়ে উঠে। তাদের সেনাপতি এমন কৌশল জানে দুশমনের কোমর ভাঙ্গার পরে তারা তার সে কৌশল বুঝতে পারে। আমার চোখের সামনে মুসলমানদের সাত হাজার ফৌজ তিতুমীরের পনের হাজার ফৌজের যে দুর্দশা করেছে সে সম্পর্কে তুমি তো শুনেছই।
মেরীনা : ভাল করে শুনে রাখ আওপাস! রডারিক যে ফৌজ সংগ্রহ করছে তা এক লাখের কম হবে না।
আওপাস : সে ব্যাপারে তুমি আমাদেরকে ভাবতে দাও। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবেসে থাক এবং সে ভালবাসা যদি এখনও তোমার হৃদয়ে থেকে থাকে তাহলে আমি তোমাকে যে কাজ করতে বলেছি তা কর।
মেরীনা : তা অবশ্যই হবে, তুমি চিন্তে করনা। পাগল বেশে তুমি এখান থেকে চলে যাও।
আওপাস : আমি কয়েক দিনের মাঝেই তোমার কাছে আসছি। একথা বলে আওপাস সেখান থেকে চলে গেল।
***
স্পেনের ইতিহাস বেত্তারা এমন কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেছে যা আশ্চর্যজনকই কেবল নয় অবিশ্বাস্যও বটে কিন্তু যখন দেখি, সে সব বর্ণনা ইউরোপের ঐতিহাসিকরা তৎকালীন লেখকদের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন তখন বিশ্বাস করতে হয়। খ্রীস্টান ঐতিহাসিকদের জন্যে মুসলমানদের বিপক্ষে লেখার দরকার ছিল কারণ স্পেনের বিজয় খ্রীস্টান নয় বরং গোটা খ্রীস্টবাদের ছিল পরাজয়।
তিনজন নির্ভরযোগ্য খ্রীস্টান ঐতিহাসিক তারেক ইবনে যিয়াদ ও রডারিকের ব্যাপারে কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন। স্পেন ফৌজী বাহিনীর জেনারেল তিতুমীরকে পরাজিত করার কয়েক দিন পর তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে যেদিকে যাবেন সেদিকে যাচ্ছিলেন। কেন্দ্র থেকে সাহায্য আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রথম যুদ্ধ ময়দানের কাছেই তাবু স্থাপন করে ছিলেন। যুদ্ধ ময়দান হতে মরদেহ তো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল কিন্তু জমাট বাঁধা রক্তের পাহাড় জমে ছিল ফলে রাতদিন সর্বদা নানা ধরনের জানোয়ার ও সরিসৃপ রক্তপানে ভীড় জমিয়ে ছিল। সাপ-বিচ্ছুতে পুরো এলাকা ভরে গিয়েছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ সম্মুখ এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়ে ছিলেন। পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিলেন জুলিয়ন। তার সাথে মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফও ছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আওপাস কবে নাগাদ ফিরে আসবে? ধরা পড়ে যাবে নাতো?
জুলিয়ন : সে তো এমন আনাড়ী নয় যে ধরা পড়বে। অবশ্যই কিছু একটা করে আসবে। এমন ছদ্দবেশে গেছে কেউ তাকে চিনতে পারবেনা ফলে তার গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাছাড়া কয়েদীদের থেকে আপনিতো শুনতে পেয়েছেন রডারিক টলেডোতে নেই। তামাম আমীর-ওমারা, উজীর-নাজীররাও তার সাথে গিয়েছে এ অবস্থায় আওপাসের জন্যে কাজ করা সহজ হবে।
তারা কথা-বার্তায়, আলাপ-আলোচনার মাঝ দিয়ে জেলে ও মাল্লাদের বস্তি অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদকে বলা হয়েছিল। বহুদূর পর্যন্ত কোন শহর, পল্লী নেই এ কারণে এখানে ফৌজও নেই। তারা আরো অগ্রসর হলো। চতুর্দিক সবুজ শ্যামলে ঘেরা সৌন্দর্য মণ্ডিত পরিবেশ। কুদরতের সে সৌন্দর্যের লীলাতে ছোট একটা বস্তি ছিল যার আশে-পাশে লোক ঘোরা-ফেরা করছিল। তারেক তার সাথীদের সাথে যখন ঐ ব্যক্তির কাছে পৌঁছল তখন লোকগুলো তাদের নিজ নিজ বাড়ীতে চলে গেল।
তারেক : জুলিয়ন! তারা হয়তো জেনে গেছে যে, আমরা তাদের ফৌজ বাহিনীকে পরাস্ত করেছি। তাদেরকে বুঝাবে যে আমরা ঐ বিজয়ী বাদশাহদের মত নই যারা বিজয়ার্জন করার পর তাদের ফৌজরা মানুষের বাড়ী-ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট করে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং লাড়কীদেরকে বে আক্র করে।
জুলিয়ন : ইবনে যিয়াদ! তাদের বুঝানোর প্রয়োজন কি? তোমাদের পক্ষ থেকে এমন কোন কান্ড না ঘটলে তারা এমনিতেই বুঝে যাবে।
তারা এ ধরনের আলাপ-আলোচনা করছিল এরি মাঝে এক বুড়ি আাত বস্তি থেকে বেরিয়ে এসে তারেকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। তারেক তার ঘোড়ী থামালেন সাথীদের ঘোড়াও দাঁড়িয়ে গেল।
বুড়ি : আমাদের ফৌজ বাহিনীকে যে ফৌজ শেকান্ত দিয়েছে সে ফৌজের কমান্ডার কি তোমাদের মাঝে রয়েছে?
জুলিয়নঃ হ্যাঁ বুড়ি মা! ইনি হলেন সে ফৌজী বাহিনীর কমান্ডার। জুলিয়ন তারেকের দিকে ইশারা করে বুড়ির ভাষায় কথাগুলো বলল।
বুড়ি কোন প্রকার ভয়-ভীতি ছাড়াই তারেককে বলল, ঘোড়া থেকে নেমে তোমার মাথা উম্মুক্ত কর।
মুগীছে রূমী স্পেনের ভাষা বুঝতেন, তিনি তারেককে বুঝিয়ে বললেন, বুড়ি কি বলছে।
তারেক অশ্ব হতে অবতরণ করে মাথা আবরণ মুক্ত করলেন।
বুড়ি তারেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সাবাস! তুমি এসেগেছ…..। আমার স্বামী গণক ছিল, তার ভবিষ্যৎ বাণী দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে মরে গেছে। আমাকে বহুবার বলেছে, বাহিরে থেকে একটা কওম আসবে, স্পেন জয় করে তারা দেশ শাসন করবে। তাদের কামান্ডারের আলামত হবে তার মাথা-দাড়ির কেশ হবে স্বর্ণালী আর তার ললাট হবে প্রশস্ত সে ব্যক্তিই হলে তুমি। স্বর্ণকেশী এবং তোমার কপালও চওড়া। আরও একটা নিশানা রয়েছে তোমার কাঁধ আবরণ মুক্ত কর, সেখানে একটা বড় তিলক এবং তার আশে-পাশে কেশ থাকবে।
মুগীছে রূমী তাকে বুঝিয়ে দিলেন বুড়ি কি বলছে তারপর তাকে স্কহ্মদ্বয় উন্মুক্ত করার জন্যে বললেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার কাঁধ আবরণ মুক্ত করতে করতে বললেন, বুড়ি ঠিকই বলেছে, আমার বাম স্কন্ধে তিলক রয়েছে।
তারেক ইবনে যিয়াদের তিলক ও তার আশপাশের কেশ দেখে বুড়ি বলল, স্পেনকে তুমিই জয় করবে। তুমিই হলে সে ব্যক্তি যে এদেশের জনসাধারণকে বাদশাহ্ ও তার কর্মচারীদের নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করবে।
এ ঘটনা তিনজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক লেখেছেন।
তারেক ইবনে যেয়াদ তার সাথীদেরকে বললেন, বন্ধুগণ! আমি তোমাদেরকে এবং পুরো সৈন্যবাহিনীকে আমার স্বপ্নের কথা বলেছি, যার মাঝে রাসূল (স) আমাকে বিজয়ের বাসারত দিয়েছেন। এখন এ বুড়ি সুসংবাদ শুনাল স্পেন বিজেতা আমিই হব। তবে স্মরণ রেখ! আমাদেরকে কিন্তু জীবন বাজী রেখে লড়তে হবে।
***
ঐ রাতেই আওপাস ফিরে এলো। সে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছিল। সে প্রথমে জুলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করল। জুলিয়ন তাকে তারেক ইবনে যিয়াদের তাবুতে নিয়ে গেল সেখানে অন্যান্য সালাররাও ছিলেন। আওপাস তার পুরো কার্যকর্মের কথা বর্ণনা করল। মেরীনার সাথে মুলাকাত ও তার সাথে যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তাও নাল।
তারেক : তুমি কি বিশ্বাস কর যে, ঐ আওরত এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেবে?
আওপাস : তার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। যদি মেরীনা এ কাজ না করে তাহলে অন্যরা করবে। গোথা কওমের কয়েকজন সর্দার সেখানে মওজুদ ছিল তাদের সাথে আমি সাক্ষাৎ করে এসেছি।… তবে ইবনে যিয়াদ ভাল করে একথাটা শুনে নাও যে, রডারিক কমছে কম এক লাখ ফৌজ সাথে নিয়ে আসবে। পিমপুলনা থেকে টলেডো পর্যন্ত সকল লোক ফৌজে যোগ দিচ্ছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এটা তো আমার জন্যে সুসংবাদ। যদি সাধারণ জনগণ ফৌজে শামিল হয় তাহলে তারা ভিড় বাড়িয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ করবে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ ফৌজের মত লড়াই করতে পারবেনা। তারা যুদ্ধ নিয়ম-কানুন ও শৃংখলার ব্যাপারে অজ্ঞ হবে।
আবু জুরয়া তুরাইফ : তারপরও খুশী হয়ে অসচেতন থাকা আদৌ সমীচীন হবে না। আমাদের ফৌজ সংখ্যা কখনও তাদের সমপরিমাণ হবে না। আমাদের জন্যে যদি সাহায্য আসে তাহলে সে সৈন্য সংখ্যাও সাত হাজারের বেশী হবে না।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আমি তোমাদের সকলকে একথা বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থা করছেন, আওপাস টলেডোতে যা করে এসেছে তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতি হাতে করেছেন।
***
আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর খলীফা ওয়ালীদকে তারেক ইবনে যিয়াদের প্রথম বিজয়ের সংবাদ পাঠিয়ে যে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, তার জবাবে খলীফা সাহায্যের জন্যে পাঁচ হাজার ফৌজ পাঠিয়ে ছিলেন। সে পাঁচ হাজার ফৌজের মাঝে সোয়ারী কতজন ছিল আর পায়দল কত ছিল তার সংখ্যা কোন ইতিহাসেই বিস্তারিত পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়টা সকলেরই সামনে ছিল যে প্রয়োজনের তাগীদে ফৌজ সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। তারেকের কাছে সাত হাজার ফৌজ ছিল যার মাঝে প্রথম যুদ্ধে কিছু শহীদ হয়েছিল। পরবর্তী সাহায্যের জন্যে প্রেরিত ফৌজ মিলিয়ে মোট ফৌজ হয় বার হাজার।
এদিকে রডারিকের এলান অনুপাতে মানুষ অত্যন্ত স্পৃহা-আগ্রহ নিয়ে দলে দলে ফৌজী বাহিনীতে শামিল হচ্ছিল। কয়েক দিনের মাঝেই রডারিকের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে ছিল আর এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুশিররা (পরামর্শ দাতাগণ) বলেছিল, আক্রমণকারীদের সংখ্যা মাত্র সাত হাজার এত কম সংখ্যক ফৌজের মুকাবালায় এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য জমা করার কোন প্রয়োজন নেই। এতে একে তো সময় নষ্ট হচ্ছে অপর দিকে খরচ বাড়ছে।
রডারিক শাহী হুংকার দিয়ে বলল, তিতুমীর আক্রমণকারীদেরকে জিন-ভূত হিসেবে অবহিত করেছে, আমি লাখের বেশি ফৌজ নিয়ে যাব যাতে দুনিয়ার অন্য কওমও জানতে পারে যে, স্পেনের বাদশাহ্ কত শক্তিশালী। পরে তাদের দেমাগ থেকে স্পেনের ওপর আক্রমণের ভূত বেরিয়ে যাবে। আমি অসংখ্য ফৌজের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের সাত হাজার ফৌজকে পদতলে পৃষ্ঠ করে মারব। বিশ পঁচিশ হাজার অশ্বারোহী তাদের ওপর দৌড়িয়ে আমি তাদের শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে কিমা বানাব। আমি জিন ভূতকে ভয় পাই না।
রডারিক যে একজন নির্ভীক বীর বাহাদূর লড়াকু ছিল ইতিহাস এ বাস্তবতা স্বীকার করে এবং সে যে জিন-ভূতকে ভয় পেতনী তাও প্রমাণ করে। তার নির্ভীকতা ও বীরত্ব এমন রূপ কথা জন্ম দিয়েছে যা ইতিহাসের একটা অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার এক ঐতিহাসিক ডাশনকশন আওরং তার বই “স্পেনের বিজয়” এর মাঝে এ ঘটনা বিস্তারিত ভাবে লেখেছেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক লেইন পোল এ ঘটনা ড্রশনকশন ছাড়া পূর্বেকার দলীল দস্তাবেজ এর উদ্ধৃতি দিয়ে তার গ্রন্থ “মূর স্পেনে উল্লেখ করেছেন। (ইউরোপের ঐতিহাসিকরা বর্বর মুসলমানদেরকে মুর লেখেছেন)।
আরেকটি ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, “তারেক ইবনে যিয়াদ’ স্পেন আক্রমণ করার কিছুদিন পূর্বে বাদশাহ্ রডারিক টলেডোতে তার দরবারে মসনদে বসে আছে, এমন সময় দু’জন সম্মানিত বৃদ্ধ দরবারে প্রবেশ করল। তারা পুরাতন যুগের আবা কাবা পরিহিত ছিল। তাদেরকে দেখে ধর্মগুরু বলে মনে হচ্ছিল। তাদের শুভ্র দাড়ি ও চাল-চলনে বলছিল তারা উঁচু পর্যায়ের গণক বা পাদ্রী। তারা তাদের কাপড় কোমরবন্দ দ্বারা কোমরের সাথে বেঁধে রেখে ছিল আর তাদের কোমর বন্দের সাথে ছিল চাবির বড় গোছা। রডারিকের মত দাম্ভিক বাদশাহও তাদের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মাঝ থেকে একজন হাতের ইশারায় রডারিককে বসার জন্যে ইশারা করলে রডারিক বসে পড়ল।
এক বৃদ্ধ বলল, হে শাহে উন্দুলুস! আমরা তোমাকে একটা গোপন কথা বলার জন্যে এসেছি। প্রত্যেক নতুন বাদশাহর জন্যেই জরুরী সে গোপন বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া। তুমি নতুন আসনাসীন হয়েছে এবং তোমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
রডারিক : এ গোপন বিষয় সম্পর্কে আমি অবহিত হতে চাই না। আশা করি আর কোন ভূমিকার প্রয়োজন নেই।
বৃদ্ধ : বেশী অস্থির হয়ো না বাদশাহ্! গোপন বিষয় অবগত হবার পরেও ধৈর্য হারা হবে না। তা নাহলে পরে আফসোস করতে হবে। … যখন এ মূলকে হিরাক্লিয়াসের বাদশাহী ছিল তখন সে স্পেন প্রজন্মের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তারপর সে এ টলেডো শহরের বাহিরে একটা বুরুজ নির্মাণ করিয়ে ছিল। তার মাঝে সে কোন যাদু মন্ত্র রেখেছিল। ঐ বুরুজের একটাই লোহার দরজা যা অত্যন্ত শক্তিশালী মজবুত। দুরজাতে সে নিজ হাতে তালা লাগিয়ে ছিল। সে বলেছিল স্পেনের প্রত্যেক নব বাদশাহর জন্যে অপরিহার্য সে শাহী মসনদে বসার কিছু দিন পর এ দরজায় একটা তালা লাগিয়ে তার চাবি আমাদের কাছে অর্পণ করবে। বৃদ্ধ চাবির গোছা দেখিয়ে বলল,এগুলো ঐ তালার চাবি যা হিরাক্লিয়াসের পরেএবং তোমার পূর্বের বাদশাহরা লাগিয়ে ছিল। এবার তোমার পালা। দরজায় তালা লাগিয়ে দাও; আমরা একদিন এসে চাবি নিয়ে যাব।
রডারিক : আমি ঐ বুরুজ দেখেছি। আমি তাকে কোন পুরাতন ইমারত মনে করছিলাম। তোমরা দু’জন কি ঐ বুরুজেই বাস কর?
বৃদ্ধ বলল, না হে শাহে আন্দুলুস! আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। এ চাবি আমাদের বাপ-দাদারা দিয়েছে। এ বুরুজের হেফাজত করা আমাদের খান্দানের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব আমাদের খান্দানের আগত প্রজন্ম পালন করবে।
রডারিক : তোমাদের সে দায়িত্ব আমি এখানেই শেষ করে দেব।
অপর বৃদ্ধ : হে শাহান শাহ! আমাদেরকে তুমি তোমার প্রজা জ্ঞান কর না। বুরুজ খোলার ইরাদা যদি তোমার থেকে থাকে তাহলে তুমি ভাল করে শুনে নাও, পরিণামে তুমি অনুশোচনায় আগুনে পুড়বে। অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণামের শিকার হবে।
ইতিপূর্বে যে সব বাদশাহরা সে দরজা খুলেছে তাদের পরিণাম কি পরিমাণ ভয়াবহ হয়েছিল তা তুমি কোন বিজ্ঞ ইতিহাসবিদকে ডেকে জিজ্ঞেস কর। জুলিয়াস সিজারের চেয়ে জালেম আর শক্তিশালী বাদশাহ্ কে ছিল? সেও ঐ দরজা খোলার চেষ্টা করেনি…। আমরা চলে যাচ্ছি। সাবধান বাদশাহ! আমরা বাস্তব বিষয় বর্ণনা করেছি। তুমি ঐ বুরুজের দরজায় যে তালা লাগাবে কিছুদিন পর আমরা তার চাবি নেয়ার জন্যে আসব।
বৃদ্ধ দু’জন চলে গেল।
***
বৃদ্ধ দু’জন চলে যাবার পর রডারিক ঘোষণা দিল, “রডারিক যদিএ মুলকের বাদশাহ হয়ে থাকে তাহলে এ মুলকের কোন বিষয় গোপন থাকবে না। আমি ঐ বুরুজে তালা তো লাগাবই না বরং তামাম তালা ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখব ভেতরে– কি আছে।
একজন পরামর্শ দাতা বলল, গোস্তাগী মাফ করবেন বাদশাহ নামদার। আমাদের মাঝে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বাদশাহ্ নামদারের সাহসীকতা, বীরত্ব দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শাহান শাহূকে বিপদের হাত থেকে বাঁচান আমাদের একান্ত কর্তব্য। বৃদ্ধ রাহেব বলে গেল বুরুজে হিরাক্লিয়াস কোন যাদুমন্ত্র বন্ধ করে রেখেছে। কোন মানুষ যাদুর মুকাবালা করতে পারে না। আমি শাহান শাহের দরবারে নিবেদন করছি তিনি যেন বুরুজের সিংহদ্বারে তালা লাগিয়ে দেন এবং এ বিষয় যেন ভুলে যান।
রডারিক : এ পরামর্শ যদি তুমি আমাকে দাও তাহলে আমাকে শাহানশাহ বলা ছেড়ে দাও। এ মুলুকের জমিন আমার; এর প্রতিটি রহস্য ভেদ আমার দরকার। ইতিপূর্বে আমি ঐ বুরুজের দিকে কখনো দৃষ্টিপাত করি নাই। এখন যেন মনে হচ্ছে পুরো বুরুজ আমার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পুরোহিত বললেন, শাহান শাহে রডারিক! স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানের পাহাড় শাহ্ রডারিকের নাম শুনে কেঁপে উঠে কিন্তু কিছু অলৌকিক ক্ষমতা এমন রয়েছে যার সামনে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। শাহান শাহ্ যদি আমাকে নিজ ধর্ম গুরু মানেন তাহলে আবেদন করব, শাহান শাহ্ যেন ঐ বুরুজের দরজা না খোলেন।
রডারিক : হিরাক্লিয়াস আমার মতই একজন বাদশাহ ছিল। সে যদি কোন অলৌকিক ক্ষমতা ঐ বুরুজে বন্ধ করে থাকে তাহলে সে ক্ষমতা তার কজাতে ছিল এখন তা আমি আমার কজাতে আনতে পারি। বাদশাহু মুচকি হেসে দরবারে উপস্থিত সকলের প্রতি নয়ন ফিরিয়ে দাম্ভিকতার স্বরে বলল, হে ভীতুর দল! ঐ বুরুজে রোমীয়রা ধনভান্ডার লুকিয়ে রেখেছিল। সেখানে নিশ্চয় অমূল্যবান হিরা মতি পান্না রয়েছে। তাতে ভয় কেবল এটাই যে হয়তো সেখানে বড় ভয়ংকর বিষধর সাপ লুকিয়ে রয়েছে। তোমাদের মাঝে কে কে আছে যারা ঐ বুরুজের গোপন রহস্য উৎঘাটনে আমার সাথে থাকবো।
রডারিক একথা বলে জেনারেলদের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, যেসব জেনারেলরা বাহাদুর হিসেবে খ্যাত ছিল, তারা বাদশাহর নজরে ভীতু বুজদিল হতে চায় না। তারা সকলে একে একে উঠে বলল, আমি শাহানশাহর সাথে আছি। আমি শাহান শাহর সাথে আছি।
যেসব ইতিহাসবিদরা এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন তারা লেখেছেন, পরামর্শ দাতাগণ, বড় পাদ্রীরা এবং তার পরিবারের লোকরা রডারিককে বাধা দিল। কিন্তু সে কারো বাধা মানল না এবং চার-পাঁচ দিন পরে যুদ্ধ সাজে সেজে বুরুজে (দুর্গে) গিয়ে পৌঁছল। তার সাথে এমন দুতিনজন জেনারেল ছিল যারা বেশ কয়েকটা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব-সাহসীকতা দেখিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। তাদের সাথে বিশেষ ঘোড় সোয়ার দল ও তালা ভাঙ্গার জন্যে মিন্ত্রী ছিল।
বুরুজ একটা প্রশস্ত টিলার ওপর ছিল। তার চতুর্দিকে ছিল উঁচু টিলা। বুরুজ মর্মর পাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সৌন্দর্যের জন্যে জায়গায় জায়গায় রোপা খচিত যা আলোতে ঝলমল করে উঠত। ভেতরে যারার জন্যে টিলা কেটে সুড়ংগ রাস্তা বানান হয়েছিল। সে রাস্তা এত প্রশস্ত ও উঁচু ছিল যে ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে অতিক্রম করা যেত। তার প্রবেশদ্বারে লোহার মজবুত দরজা ছিল যাতে বহু তালা লাগান ছিল। এসব তালা হিরাক্লিয়াস থেকে ডেজা পর্যন্ত সকল বাদশাহদের লাগান।
যে দু’জন বৃদ্ধ পাদ্রী রডারিকের দরবারে গিয়েছিল তারা সেখানে বিদ্যমান ছিল। একজন বৃদ্ধ বলল, আমরা তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি।
রডারিক; ওদের থেকে কুঞ্জীগুলো ছিনিয়ে নাও এবং তামাম তালা খুলে ফেল। রডারিকের শক্তিশালী বাহিনীর সাথে বৃদ্ধরা জবরদস্তি করতে পারল না, তাদের থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয়া হলো।
তালা ছিল অসংখ্য, মরিচা ধরা তালাও ছিল। তাছাড়া এটাও জানাছিল না কোন চাবি কোন তালার। সারাদিন তালা খোলার চেষ্টা-তদবীর চলল। সূর্য ডুবার কিছুক্ষণ পূর্বে তামাম তালা খোলে সদর দরজা উন্মুক্ত করা হলো। রডারিক ভেতরে প্রবেশ করল তার সাথে কয়েকজন জেনারেল ও মুহাফেজ গেল। একটু সামনেই বড় প্রশস্ত হল রূম ছিল। তার একটা দরজা ছিল যদ্বারা এক কামরাতে যাওয়া যেত।
ঐ দরজার সম্মুখে কাঁসার নির্মিত মানুষের এক বৃহৎ আকারের মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। তার এক হাতে লোহার মুগোর ছিল আশ্চর্যের বিষয় হলো মূর্তি ঐ মুগোর দ্বারা জমিনের ওপর আঘাত হানছিল। মূর্তির বুকে স্পেনী ভাষায় লেখাছিল, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।”
রডারিক মূর্তিকে লক্ষ্য করে বলল,আমি কোন খারাপ অভিসন্ধিতে আসিনি, কোন জিনিসে হাত লাগাব না। এখানের গোপন রহস্য জানার জন্যে কেবল এসেছি। তারপর যেমনি এসেছি অমনটি চলে যাব, আমাকে বিশ্বাস কর এবং রাস্তা ছেড়ে দাও।
মূর্তির মুগোর মারা বন্ধ হয়ে গেল। যে হাত ওপরে উঠেছিল তা উপরেই রয়ে গেল আর রডারিক সে হাতের নিচ দিয়ে অন্য কামরাতে চলে গেল তার সাথে তার সঙ্গীরাও গেল।
তারা যে কামরায় প্রবেশ করল তা অত্যন্ত খুব সুরত ছিল। রডারিকের মুহাফেজরা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার আলোতে দেয়ালে মূল্যবান, হিরা, মতি, তারার মত ঝলমল করছিল। কামরার মধ্যখানে টেবিলে একটা সিন্ধুক রাখা ছিল তাতে লেখা ছিল,
“এ সিন্ধুকের মাঝে এ দুর্গের গোপন রহস্য সংরক্ষিত রয়েছে কোন বাদশাহ্ ছাড়া কেউ এ সিন্ধুক খুলতে পারবে না তবে বাদশাহূর্কে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, তার কাছে বিস্ময়কর বিষয়ের দ্বার উন্মোচিত হবে, সে বিস্ময়কর বিষয় যে ঘটনা বিপর্যয় হিসেবে বাদশাহর বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটবে।
রডারিক নির্ভীকনে সিন্দুকের ঢাকনা খুলে ভেতরে দৃষ্টিপাত করল, তাতে এক ফুট লম্বা একফুট চওড়া একটা চামড়ার কাগজ পড়েছিল। তামার একটা প্লেট ঐ চামড়ার নিচে আরেকটি প্লেট ছিল তার ওপরে। রডারিক চামড়া টুকরা হাতে নিয়ে দেখল তাতে ঘোড় সোয়ার যুদ্ধাদের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। তারা তীর, কামান ও বর্শাতে সজ্জিত। তাদের চেহারা ভয়ঙ্কর আর তাদের প্রতিচ্ছবির ওপর লেখা রয়েছে, “লক্ষ্য কর হে অবাধ্য ইনসান! এরা এমন সোয়ারী যারা তোমাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তোমার বাদশাহী ভূলণ্ঠিত করবে।”
রডারিক প্রতিচ্ছবির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল তার জেনারেলদের নজরও তার প্রতি নিবিষ্ট ছিল। তারা এমন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল যেন অদূরেই দু’দল ফৌজ লড়ায়ে লিপ্ত হয়েছে।
অশ্ব দৌড়, শব্দ, ফৌজদের চিৎকার ধ্বনি ভেসে আসছিল। কোন বহিরাগত ফৌজ তার মুলুকে হামলা করেছে এবং তারা টলেডোতে পৌঁছে গেছে এটা ভেবে রডারিক ঘাবড়ে গেল কিন্তু তার হতচকিত ক্ষণিকের মাঝেই শেষ হয়ে গেল কারণ সে যুদ্ধ পরিষ্কার তার সম্মুখে দেখছিল।
তারা যুদ্ধ এভাবে প্রত্যক্ষ করছিল যে, কামরার দেয়াল অদৃশ্য হয়ে তার স্থলে মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল। আর সে মেঘের মাঝে অত্যন্ত প্রশস্ত যুদ্ধ ময়দান দেখা যাচ্ছিল। দু’দল ফৌজ সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। একদল ফৌজ ঈসায়ী অপরদল উত্তর আফ্রিকার মুসলমানরা। উভয় দল ফৌজ একে অপরের খুনের দরিয়া বয়ে দিচ্ছে। তলোয়ার তলোয়ারে ও যুদ্ধ হাতিয়ার হাতিয়ারে টক্কর খাচ্ছিল। যুদ্ধের দামামা বাজছিল। পায়দল ও সোয়ারী জখম হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ছিল আর পলায়ন পদ দ্রুতগামী ঘোড়া তাদেরকে জমিনের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিল। এ ভয়াবহ যুদ্ধের ময়দানে তীর-বর্শা উড়ে এসে মানুষের শরীর জখম করছিল। বেদনাদায়ক আর্তনাদে আসমান থরথর করে কাঁপছিল। পায়দল ও ঘোড়ার পদাঘাতে জমিন টলছিল।
অতি ভয়াবহ ঐ হাঙ্গামার মাঝে বারবার এ আহ্বান শোনা যাচ্ছিল, হে আল্লাহর রাসূলের প্রেমিকগণ! কাফেরদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দাও।
“আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন।”
“হে মুসলমানগণ! পশ্চাতে রয়েছে সমুদ্র, পারাপারের মাধ্যম জাহাজ হয়েছে। ভস্মিভূত।”
“আল্লাহর রাসূল বিজয়ের বাশারত দিয়েছেন।”
রডারিক, তার জেনারেলরা ও মুহাফিজগণ এ রক্তঝরা যুদ্ধের মাঞ্জার প্রত্যক্ষ করছিল। নারা, আহ্বান, শোর-গোল ও আত্ম চিৎকার শ্রবণ করছিল। এ দৃশ্যের ওপর-নিচ, ভান-বাম চতুর্দিকে সফেদ বাদল ছেয়ে ছিল। এ ভয়াবহ দৃশ্য ছিল কাল্পনিক কিন্তু বস্তুত বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল। রডারিকের চেহার রং দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। তার জেনারেল ও মুহাফিজদের চেহারায় ভয় ও আতংকের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তাদের সাথে যদি বাদশাহ্ না থাকত তাহলে তারা পলায়ন করত।
খ্রীস্টান ফৌজের ঝান্ডা যা পতপত করে উড়ছিল একে একে সব ভূলণ্ঠিত হতে লাগল। মুসলমানদের পতাকা উড়ছিল। পরিশেষে কাফেরদের ঐ ঝান্ডা যার ওপর ক্রস চিহ্ন ছিল তাও পড়ে গেল, সে ঝান্ডা মাটিতে পড়তেই কাফেরদের মাঝে হা হুতাশ ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। মুসলমানরা তাদেরকে খতম করতে লাগল।
রডারিক খ্রীস্টানদের মাঝে একজন যোদ্ধা দেখতে পেল। সফেদ ঘোড়ার ওপর সোয়ার হয়ে রডারিকের দিকে পিঠ ফিরিয়েছিল। তার মাথায় সে সিরস্ত্রান ছিল তা হুবহু রডারিকের শিরস্ত্রানের ন্যায় ছিল। এমনিভাবে তার যুদ্ধ পোষাকও রডারিকের মত। তার সফেদ ঘোড়াও রডারিকের ঘোড়ার ন্যায়। বিন্দুমাত্রও পার্থক্য ছিল না। ইতিহাস বর্ণনা করে রডারিকের ঘোড়ার নাম ছিল ইলইয়া।
যুদ্ধ দৃশ্যে বাদশাহ্ বেশে রডারিক যে সোয়ারীকে দেখছিল সে হঠাৎ করে অশ্ব থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সফেদ অশ্ব সোয়ারীহীন দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে লাগল।
হঠাৎ রডারিক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং পিছে ফিরে দ্রুত পলায়ন পদ হলো। যে’কামরার সামনে কাঁসার মূর্তি মুগর হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিল সেথায় এসে দেখল মূর্তি নেই। রডারিক ও তার সাথীরা আরো ভীত হয়ে পড়ল। তারা দ্রুত– পদে সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। বাহিরে এসে তারা দেখল ঔ দু’জন বৃদ্ধ পাদ্রী যারা প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিল এবং রডারিককে ভেতরে যেতে নিষেধ করছিল তারা মরে পড়ে আছে। রডারিক সেখান থেকে দূরে চলে গিয়ে পিছে ফিরে দেখল দুর্গ যে বাদলে ঢাকা ছিল তা লেলিহান শিখায় পরিণত হয়েছে আর দুর্গের মর্মর পাথর পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলছে। চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস তীব্রবেগে প্রবাহিত হতে লাগল। দুর্গের লেলিহান শিখার স্ফুলিঙ্গ ওপরে উঠে জমিনে পড়তে লাগল। এ ঘটনা বর্ণনাকারী ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, দুর্গের আগুন জমিনে যেখানে পড়ছিল তা রক্তে পরিণত হচ্ছিল।
রডারিক তার জেনারেল ও মুহাফিজদের সাথে সেখান থেকে দ্রুত বেগে পলায়ন করল।
***
তারপর রডারিক ধর্মগুরু, পন্ডিত ও জায়গীরদারকে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঐ দুর্গের রহস্য কি এবং যে যুদ্ধের দৃশ্য দেখা গেল তার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কি। কেউ তাকে যথাযথ জবাব দিতে পারল না। কেউ তাকে তার বীরত্ব ও বাহাদুরীর তারীফ করল কেউ আবার দুশমনের বিপক্ষে বিজয়ের সুসংবাদ গুনাল। কেবল একজন জাদুকর তাকে কিছু সাফ জওয়াব দিল।
জাদুকর : শাহানশাহর সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। এটা তো কেউ বলতে পারে না যে হিরাক্লিয়াস সে দুর্গ কেন নির্মাণ করেছিলেন। হয়তো হতে পারে তাতে শয়তানের কোন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দুর্গ না খোলাটাই আপনার জন্যে সমীচীন ছিল। লড়ায়ের যে ইশারা আপনি পেয়েছেন তা ভাল ইঙ্গিত বহন করছে না।
রডারিক : আমরা কি সে অশুভ পরিণামের হাত থেকে বাঁচতে পারি না?
জাদুকর : তা একটা তরীকাতেই সম্ভব। তাহলে আপনি যখন কোন যুদ্ধে যাবেন তখন এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য সংখ্যা সাথে নিয়ে যাবেন যাতে দুশমন দেখেই পলায়ন করে, বা যুদ্ধ করা ব্যতিরেকেই আত্মসমর্পণ করে।
এ ঘটনার পর পামপিলুনা এলাকাতে বিদ্রোহ হয়। রডারিক বিশাল ফৌজী বাহিনী নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করে বিদ্রোহীদেরকে চিরতরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং সেখানেই খবর পায় আফ্রিকা স্পেনের উপর হামলা করেছে। তিতুমীর তাকে সংবাদ দিয়েছিল হামলাকারীদের সংখ্যা সাত/আট হাজার। রডারিক বিপুল সংখ্যাক ফৌজ সংগ্রহের ইন্তেজাম করে সেথা হতে দারুল হুকুমত টলেডোর দিকে রওনা হলো।
সে যখন টলেডোতে পৌঁছুল তখন তার ফৌজ সংখ্যা একলাখে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মাঝে হাজার হাজার ছিল অশ্বারোহী। রডারিক টলেডোতে কালক্ষেপণ না করে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে রওনা হলো যেখানে তিতুমীর পরাজিত হয়েছে।
এদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ সাহায্যকারী ফৌজ হিসেবে মাত্র পাঁচ হাজার ফৌজ পেলেন। এতে তার মোট ফৌজ সংখ্যা বার হাজারে উন্নীত হলো।
রডারিকের এক লক্ষ্য ফৌজ মুসলমানদের বার হাজার সৈন্যকে ছিন্ন ভিন্ন করার উম্মাদনায় বাঁধ ভাঙ্গা বানের ন্যায় ধেয়ে আসছিল।
***
পাঁচ হাজার ফৌজ তারেক ইবনে যিয়াদের মদদে এসে উপনীত হলো। এতে ইবনে যিয়াদ আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। সাহায্য আসার পূর্বে তার অপেক্ষায় তিনি এমন পাগলপারা ছিলেন যে রাতে হঠাৎ কোন সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলে মুহাফিজ দলের কামান্ডারকে তলব করে বলতেন এখনই দু’জন সোয়ারী সমুদ্র পাড়ে পাঠিয়ে দাও সাহায্যের জন্যে ফৌজ আসছে কিনা তারা যেন সংবাদ নিয়ে আসে।
দিনের বেলা তিনি সমুদ্র তীরে গিয়ে জাবালুত তারেকের চূড়াতে উঠে উঁচু হয়ে বারবার সমুদ্র বক্ষে গভীরভাবে নয়ন বুলাতেন পরিশেষে যখন ফৌজ আসার কোন আলামত তিনি দেখতেন না তখন তার প্রতিটি কথা ও কাজে গোস্বার ঝলক দেখা দিত। তার সালাররা তাকে শান্তনা দিয়ে বলতেন সাহায্য বাহিনী অনেক দূর হতে। আসবে তো। তাই কিছুদিন দেরী হওয়াটা স্বাভাবিক।
তারেক কয়েকবার একথা বললেন, আমি জানি তাড়াতাড়ি কেন সাহায্য আসছে না। সম্ভবতঃ আমীরে আফ্রিকা কাসেদকে দামেস্কে পাঠিয়ে খলীফার দরবারে সাহায্যের আবেদন করেছেন। দামেস্ক থেকে ফৌজী সাহায্য আসতে আসতে কয়েকটি নতুন চাঁদ উদিত হবে। বুড়া আর জওয়ানের মাঝে এটাইতো পার্থক্য। একদা তারেক বললেন, মুসা ইবনে নুসাইর বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে ফলে হার কাম এখন আরামের সাথে করতে চায়। তার এ কথা তো স্মরণ রাখা দরকার ছিল যে আমি জওয়ান এবং ধৈর্য হারা। সিরিয়া ও আরব থেকে সাহায্য তলব করার কি প্রয়োজন ছিল এবং তার মাঝে কি বুদ্ধিমত্তা লুকিয়ে রয়েছে? বর্বররা তো মরে যায়নি! কেবল শুধু এলান করে দিলেই হতো যে, সমুদ্র পাড়ে ইবনে যিয়াদের সাহায্য প্রয়োজন তাহলে একদিনের মাঝেই হাজার হাজার বর্বর মুসার দরবারে উপস্থিত হতো।
ফৌজী সাহায্যের অপেক্ষায় তারেক দাঁতের উপর দাঁত পিষছিলেন তারপরও সৈন্যের ট্রেনিং পূর্ণদমে চালু রেখেছিলেন। ঘোড় সোয়ারীদের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন। কারণ তিতুমীরের সাথে যুদ্ধের সময় অসংখ্য ঘোড়া হাতে এসেছিল! তারেক পায়দলদের মাঝ থেকে বেছে বেছে অশ্ব দিয়ে বিশেষভাবে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ বেকার বসে থাকার আদমী ছিলেন না। তাছাড়া তাকে এ বিষয়টাও পেরেশান করে তুলেছিল যে, স্পেনের জেনারেল তিতুমীর পরাজিত হয়ে বসে নাই, সে তারেক ইবনে যিয়াদের ইন্তেজার করবে না বরং পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করার মানসে এবং হামলাকারীদেরকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ এ খবর পেয়েছিলেন যে, স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক রাজধানী হতে বেশ অনেক দূরে রয়েছে। সে বিদ্রোহ দমনে গেছে। তার অবর্তমানে তারেক ইবনে যিয়াদ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতম করে। আরো কিছু এলাকা দখল করে কিছু ফৌজও হালাক করতে পারতেন।
পরিশেষে সাহায্যের ফৌজ এসে পৌঁছল। তারেক নবাগত পাঁচ হাজার ফৌজকে মাত্র এক রাত্র বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে সকালেই সম্মুখে অগ্রসর হলেন। তিনি জুলিয়নের কাছে জেনে নিয়ে ছিলেন সামনে কোথায় কি রয়েছে। তাছাড়া তিনি ভাল গোয়েন্দা হিসেবে হিজিকে পেয়েছিলেন যে হিজি ফ্লোরিডার কাছে রডারিকের মাথা কেটে আনার ওয়াদা করেছিল। তারেক তাকে দু’জন আদমী দিয়ে ছিলেন তারা দুশমনের এলাকাতে গিয়ে দেখে আসত দুশমন কোথায় আছে এবং তাদের সংখ্যা কত। যদি কেল্লা থাকে তাহলে তা কেমন মজবুত।
সম্মুখে একটা মজবুত কেল্লা ছিল। তিতুমীর ফৌজের কিছু ফৌজ পলায়ন করে সেখানে আশ্রয় নিয়ে কেল্লাবাসীর সংখ্যাধিক্য করেছিল ফলে কেল্লাবাসী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল এবং খুসী হয়েছিল কিন্তু তিতুমের ফৌজরা কেল্লাবাসীদের যুদ্ধের স্পৃহা কমিয়ে দিয়েছিল। বর্বররা তাদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করে দিয়েছিল। পরাজিত সৈন্যরা একথা কখনও বলত না যে তারা নিজেরা বুজদিল কিন্তু হামলাকারীরা যে অত্যন্ত শক্তিশালী তা প্রচার করত। তিতুমিরের ফৌজরা কেল্লাতে প্রবেশ করতেই আওয়াজ তুলে দিয়ে ছিল,
হামলাকারীরা মানবরূপী জিন, ভূত বৈ কিছু নয়। নিজেদের জীবনের বিন্দুমাত্র পরওয়া করে না। আমরা স্বচোখে দেখলাম তাদের কাছে একটাও ঘোড়া নেই, তারপর জানিনা কোথা থেকে যেন বিপুল সংখ্যক ঘোড় সোয়ার আমাদের পশ্চাৎ হতে এসে উপস্থিত হল। আসমান থেকে আমাদের ওপর তীর বর্ষিত হতে লাগল। একেকটা তীর আমাদের একেকজন আদমীকে হালাক করে দিল।
তারা সংখ্যায় আমাদের অর্ধেকও ছিল না।
আর তাদের ধ্বনী! … যেন বজ্রপাত হচ্ছিল।
এ ভীতি কেল্লা অতিক্রম করে শহরের মানুষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। শহরে প্রার্থনা হতে লাগল ঐ জালেম হামলাকারীরা যেন এদিকে না আসে। এটা এমন বাস্তব বিষয় যে খোদ খ্রীস্টান ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেছেন যেমন লেইনপোল লেখেছেন, “মুসলমানরা সংখ্যায় খুবই কম ছিল কিন্তু তারা অসাধারণ বীর বাহাদুর, সাহসী ও জীবন উৎস্বর্গকারী ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ এমন এক সিপাহসালারের হাতে ছিল যাকে ইতিহাস নির্দ্বিধায় ‘হিরো’ হিসেবে অবহিত করে। যুদ্ধ শক্তি, ভাল অস্ত্র শস্ত্র, সংখ্যার বিপুলতা তো স্পেনের ফৌজদেরও ছিল কিন্তু যে স্পৃহায় মুসলমানরা সজ্জিত ছিল তা স্পেন ফৌজের কাছে ছিল না।”
মুসলমানরা আল্লাহর হুকুমে আর স্পেনবাসীরা বাদশাহর হুকুমে যুদ্ধ করছিল। মুসলমানরা তাকবীর দিচ্ছিল আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ সবচেয়ে বড়। এ ধ্বনী তাদের অন্তরে গভীরতম প্রদেশ থেকে বেরুচ্ছিল। এ ধ্বনীর মাঝে যে ভীতি ছিল তা ছিল আল্লাহর নামের। স্পেনীদের কোন ধ্বনী ছিল না। আর থাকলেও তা ছিল শাহান শাহে উন্দুলুস জিন্দাবাদ। এটা একটা প্রাণহীন ধ্বনী। এটা একটি প্রথাগত তাকবীর, এতে উদ্দীপনা স্পৃহা কিছুই নেই।
***
সবুজ-শ্যামলে ঘেরা। চতুর্দিক কুদরতের সৌন্দর্যের শোভায় সুশোভিত। এখনো প্রভাত আলো পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়নি এমন সময় কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে এক সেপাহী চিৎকার করে বলে উঠল “তারা এসে গেছে” তারপর এ আওয়াজে কয়েকজন সেপাহী একসাথে চিৎকার করে উঠল এ শব্দ আপনা আপনিই পুরো পল্লীতে ছড়িয়ে পড়ল।
কেল্লার জিম্মাদার দৌড়ে গিয়ে প্রাচীরে চড়ে মুসলমান লস্কর আসতে দেখল। সে তিতুমীরের মত বিজ্ঞ জেনারলেকে এ লস্করের কাছে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে দেখেছে। কিছুদিন তিতুমীর এ কেল্লাতে অবস্থান করেছিল এবং এমন আঙ্গিকে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছিল তাতে কেল্লার জিম্মাদারের ভেতর ভীতির সঞ্চার হয়ে ছিল। সে ভীতি সঞ্চারক জীন-ভূতের লস্কর এখন তার সম্মুখে উপস্থিত। কেল্লার জিম্মাদার প্রাচীরের ওপর থেকে হুকুম দিল, কেল্লার দরজা ভালকরে বন্ধ করে দাও এবং প্রতিটি দরজার সামনে পূর্ণ প্রস্তুত থাক। ..
তীর আন্দাজ ও বর্শাওয়ালারা প্রাচীরের ওপর পৌঁছে গেল। দরজা ভেতর থেকে আরো ভাল করে বন্ধ করে প্রতিটি দ্বারে বিপুল সংখ্যক ফৌজ অবস্থান নিল।
মুসলমানরা অতিদ্রুত এসে কেলার চারপাশে অবস্থান নিয়ে কেল্লা ঘিরে ফেলল। তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেনী জবানে এলান করালেন, কেল্লার দরজা খুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ কর। যদি আমাদের একজন ফৌজও মারা যায় আর আমরা যদি দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি তাহলে তোমাদের অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর যদি স্বেচ্ছায় দ্বার খুলে দাও তাহলে সদ্ব্যবহার করা হবে। আমরা অবরোধ লম্বা করব না। আজকের সূর্য অস্ত যাবার পূর্বেই আমরা কেল্লাতে প্রবেশ করব।
কেল্লার দরজা হতে আওয়াজ এলো, তোমাদের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে, পারলে হিম্মত করে নিজেরা দরজা খুলো।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার ঘোষণা পূণরায় দেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না, “তিনি তার নিজের ব্যাপারে ঠিকই বলেছিলেন, “আমি ধৈর্য হারা যুবা।”
তারেক : কেল্লা ভেঙ্গে ফেল।
কেল্লা কিভাবে ভাঙতে হয় মুসলমানরা তা ভাল করে জানত। সাথে সাথে কুড়াল ও হাতুড়ী নিয়ে সদর দরজার কাছে তারা উপস্থিত হলো। ওপর হতে তাদের উপর বর্শা ও তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ হলো কিন্তু বর্বররা তীর-বর্শাকে ভয় করত না। মুসলমানদের তীরন্দাজরা যারা দরজা ভাঙতে ছিল তাদের পশ্চাতে ছিল। তাদের কামান ছিল খুব শক্তিশালী ফলে তীর অনেক দূর পর্যন্ত যেত। তারা দুশমনের তীব্র আন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারীদের ওপর অবিরামগতিতে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। দু’তিনজন দুশমনের তীর আন্দাজ প্রাচীর থেকে নিচে পড়ে গেল। বাকীরা লুকিয়ে পড়ল।
কেল্লার দরজা ছিল চারটি। প্রতিটি দরজাতেই বর্বররা উম্মাদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তীর বর্শার কোন পরওয়া ছিল না। দরজাতে কুড়াল-হাতুড়ী দ্বারা আঘাত হানছিল প্রবল বেগে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসীকতার কাজ ছিল। কোন সিপাহসালার তার ফৌজকে এত ঝুঁকিপূর্ণ ও আশংকাজনক অবস্থার সম্মুখীন করত না কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদের মূলনীতি হলো “স্বয়ং নিজে ভীতি প্রদ হয়ে যাও তাহলে সব ভীতি ও খত্রা দূর হয়ে যাবে।”
তারেকের মূল শক্তি হলো তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাম অন্তরে নিয়ে কাফেরের মুকাবালায় বেরিয়ে ছিলেন। এ দুটো পবিত্র নাম তার অন্তরের মনিকোঠায় দানা বেধে ছিল। একারণেই স্বপ্নে রাসূল (স) তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন “বিজয় তোমাদের জন্যে অপেক্ষমান তবে তা তোমরা পাবে শর্ত হলো আল্লাহর রশি শক্তভাবে ধরে থাকবে।”
এটা তো স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার প্রতিশ্রুতি… যদি তোমরা দৃঢ়পদ থাক তাহলে তোমাদের বিশজন, কাফেরদের দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে আর তোমরা যদি একশত দৃঢ় থাক তাহলে তোমরা এক হাজার কাফেরের বিপক্ষে বিজয়ার্জন করবে। (সূরা আনফাল)
তারেক ইবনে যিয়াদ ঐ সকল অটল-অবিচল ও স্থিতিশীলদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে রাসূলে খোদা ছাড়া কুরআনে কারীমও বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছে।
তারা কেল্লা কজা করে ফেলল। দরজা একটা ভাঙ্গার সাথে সাথে বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যার ন্যায় মুসলমানরা ভেতরে প্রবেশ করল। কেল্লার ফৌজরা মুকাবালা তো করল ঠিকই কিন্তু তাতে উদ্দীপনা ও প্রাণ ছিল না। কেল্লার জিম্মাদার দ্রুত আত্মসমর্পণ করে ভয়াবহ খুন-খারাবীর হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ প্রথমে এলান করার জন্যে হুকুম দিলেন, কেউ যেন পলায়ন না করে। সকলে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে। তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের পূর্ণ হিফাজত করা হবে।
মানুষ ভীত হয়ে পলায়নের রাস্তা খুঁজছিল। লাড়কীদের বাবা-মা তাদেরকে গোপন করছিল। আর যাদের ঘরে ধন-দৌলত ছিল তারা তো সাথে নিয়ে পলায়নের চিন্তা-ভাবনা করছিল। তারেকের হুকুম তাদের পালাবার দ্বাররুদ্ধ করে দিল। তারেকের দ্বিতীয় নির্দেশ ছিল কেল্লার তাবৎ ফৌজকে পৃথক করে আলাদা করে দাঁড় করানোর জন্যে।
তারেক আরো নির্দেশ দিলেন, “আর শহরবাসীকে সতর্ক করে দাও, কেউ যেন কোন ফৌজকে তার ঘরে লুকিয়ে রাখার মত ভুল না করে। কারো ঘর থেকে যদি কোন স্পেনী ফৌজ বের হয় তাহলে সে বাড়ীর পুরো সদস্যকে যুদ্ধ কয়েদী আর তার ঘরের তাবৎ ধন-সম্পদ মালে গণিমত হিসেবে ধার্য হবে।
তামাম ফৌজকে জঙ্গী কয়েদী বানিয়ে তাদেরকে ঐ কেল্লাতেই রাখা হলো।
***
কেল্লা বেষ্টিত শহর হাতে আসাতে এক বড় প্রশস্ত উপত্যাকা তারেক ইবনে যিয়াদের অধিকারে আসল। সবুজ-শ্যামল বনানীতে ঘেরা এলাকা তার অদূরেই। সমুদ্র। তারেক ইবনে যিয়াদ কেল্লাতে অবস্থান করে সমুদ্র পাড়ে তাবু স্থাপন করে ফৌজকে সদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন।
বিজিত কেল্লা হতে এত বিপুল পরিমাণ তীর-বর্শা, ঢাল সংগ্রহ হয়েছিল যা বড় ও দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের জন্যে যথেস্ট ছিল। সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় যা হস্তগত হয়েছিল তা হলো দু’হাজার অশ্ব। এ দু’হাজার ঘোড়া তাদেরকে দিলেন, যারা ছিল শাহ্ সোয়ারা।
তারেক ইবনে যিয়াদ এখন সদা ব্যস্ত। তার কাছে রয়েছে মাত্র বার হাজার লস্কর যার মাধ্যমে এক লাখ ফৌজকে পরাজিত করতে হবে। এক লাখ সৈন্য তো এত বেশী ছিল যে বার হাজার ফৌজকে পদতলে পৃষ্ট করে মারতে পারত। এতবিশাল বাহিনীকে সেকি পরাজিত করতে পারবে? এ প্রশ্ন তারেককে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল।
একদিন তারেক ইবনে যিয়াদের চেহারাতে চিন্তার ছাপ দেখে জুলিয়ন বলল,–
ইবনে যিয়াদ! তোমাকে তোমাদের রাসূল বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাছাড়া স্পেনবাসীদের পক্ষ হতে যে দোয়া পাচ্ছ তাও খোদার দরবারে পৌঁছেছে। তুমি আবার এমনটি বলনা যে যারা মুসলমান নয় তাদের দোয়া-আহ্বান খোদা শুনেন না। খোদা তার অপর বান্দা কর্তৃক নির্যাতিত বান্দার দোয়া (আহ্বান) অবশ্যই শ্রবণ করেন।
জুলিয়নের এ বক্তব্য তারেক ইবনে যিয়াদের এ নির্দেশের ব্যাপারে ছিল যে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন, যাতে জঙ্গী কয়েদীদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হয় আর তার চেয়ে সে বেশী সদ্ব্যবহার করা হয় শহরবাসীদের সাথে এবং নিজেদের কর্ম দ্বারা যেন তাদেরকে আশ্বস্ত করান যায় যে, মুসলমানরা তাদের ইজ্জত-আব্রুর মুহাফিজ এবং প্রত্যেককে তার যোগ্যতানুসারে প্রাপ্য প্রদান করা হবে। তারা যা উপার্জন করবে তা তাদের থাকবে তবে তাদের মান মুতাবেক তাদের থেকে কর উসুল করা হবে।
যে এলাকা তারেক ইবনে যিয়াদ করতলগত করে ছিলেন তাতে কার্ডিজ ছাড়া ও আরো বেশ কিছু ছোট বড় বসতি ছিল। তার মাঝে দু’তিনটি বসতি হামলাকারীদের ভয়ে বিরান হয়ে গিয়েছিল। তারা মনে করে ছিল হামলাকারীরা রডারিকের মত কোন জালেম বাদশাহ্। তাদের ফৌজরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, লুটতরাজ করে জওয়ান লাড়কীদেরকে নিজেদের দাসী-বাঁদীতে পরিণত করবে এবং তামাম গবাদী পশু ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তাই তারা তাদের বাল-বাচ্চা ও গৃহপালিত পশু সাথে নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল। কিন্তু হামলাকারী ফৌজ তাদের ঘর বাড়ীর দিকে ফিরেও তাকাইনি।
জুলিয়ন : এসব লোক সকলেই তোমার সাথে রয়েছে ইবনে যিয়াদ! তারা তোমার বিজয় কামনা করছে। তারা আসমানের দিকে হাত তুলে ফরিয়াদ করছে, যাতে রডারিকের বাদশাহী বরবাদ হয়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ : বিজিত লোকদের সাথে মানবতা দেখান ও সদ্ব্যবহার করা এটা আমার নির্দেশ নয় বরং স্বয়ং আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল (স)-এর হুকুম।
***
বাদশাহ্ রডারিক রাজধানী টলেডোতে অবস্থান না করে এক লাখ ফৌজ নিয়ে সরাসরি অগ্রসর হচ্ছিল। সে প্রথমে বার্তা পাঠিয়ে ছিল টলেডোতে তার আপন মহলে যাবে না, শহরের বাহিরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রওনা হবে। সে যখন টলেডোর উপকণ্ঠে উপনীত হলো তখন বিপুল সংখ্যক সরকারী কর্মচারী ও শুভাকাঙ্খী তার ইন্তেজারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মাঝে তার পরাজিত জেনারেল তিতুমীরও ছিল।
রডারিক : তুমি কি তোমার চেহারা আমাকে দেখানোর উপযুক্ত মনে কর? তোমার চেয়ে অর্ধেক ফৌজের হাতে পরাজিত হয়ে আমার এস্তেকবালে দাঁড়িয়েছ, ধিক তোমাকে!
তিতুমীর : শাহান শাহে মুয়াজ্জম! জেনারেল একাকী যুদ্ধ করে না। আমি আমার ফৌজের আগে পলায়ন করিনি। ফৌজরা প্রথমে পলায়ন পদ হয়েছে। আমার অপরাধ শুধু এতটুকু যে, সেখানে মৃত্যু বা জঙ্গী কয়েদী হবার জন্যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকিনি।
রডারিক তার কথায় আরো গর্জে উঠল এবং তাকে তিরস্কার করল। তিতুমীর কোন সাধারণ জেনারেল ছিল না। স্বয়ং রডারিক তার অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সাহসীকতার তারীফ করত। আর তিতুমীর রডারিকের দুর্বলতার ব্যাপারে ভাল জানত।
তিতুমীর : বাদশাহ নামদার! আপনি মহলে গিয়ে আরাম করুন, এক লাখ ফৌজ আমাকে সোপর্দ করুন। আমি একদিনের মাঝে আক্রমণকারীদের পদতলে পৃষ্ট করে সমুদ্রপাড়ে পৌঁছে যাবো এবং এ হামলাকারীরা যেথা হতে এসেছে সেথায় আপনার পতাকা উড্ডীন করব। আমাকে তিরস্কার করার পূর্বে শাহান শাহ্ আমার কাছে যে পরিমাণ ফৌজ ছিল সে পরিমাণ ফৌজ নিয়ে যান, তাহলে দেখা যাবে বীরত্ব। এক লাখ ফৌজ কোন অযোগ্য-বুজদিল জেনারেলের কাছেও যদি থাকে তাহলে সেও হুংকার ছাড়তে পারে।
তিতুমীরের কাছে হয়তো রডারিক কোন বিষয়ে দুর্বল ছিল তা নাহলে তার এ উদ্ধ্যতোর জন্যে রডারিক জালেম বাদশাহ্ অবশ্যই তাকে শাস্তি দিত। রডারিক চুপ, করে থেকে তিতুমীরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। দেখতে পেল তার শাহী মহলে খুব সুরত আওরত মেরীনা তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রডারিক মেরীনার দিকে লক্ষ্য করতেই সে বাদশাহর সামনে কুর্নিশ করল।
মেরীনা : শাহানশাহ! আমার জন্যে কি নির্দেশ রয়েছে।
রডারিক : তুমি জানো তোমার প্রতি কি নির্দেশ রয়েছে। নতুন কিছু আছে কি?
মেরীনা : হ্যাঁ শাহান শাহ্! কম বয়সী, খুব সুরত অর্ধফোঁটা এক কলি রয়েছে … আমি আপনার সাথে যাব?
রডারিক : ঐ কলি সাথে নিয়ে এসো, তাছাড়া যদি আরো থাকে তাকেও নিয়ে এসো। আওরতদের গাড়ী পিছনে রয়েছে।
মেরীনা শাহ্ রডারিককে গভীর ভাবে লক্ষ্য করে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তাবুর ক্যানভাসযুক্ত দেয়াল দাঁড় করিয়ে তার ওপর শামিয়ানা টাঙিয়ে দেয়া হলো এবং তার মাঝে মখমল বিছিয়ে শাহী কুরসী রাখা হলো যা ছিল তখতে তাউছের ন্যায়। এভাবে অল্প ক্ষণের মাঝে শামিয়ানার নিচে বাদশাহ্ রডারিকের দরবার তৈরী করা হলো। রডারিক অশ্ব হতে অবতরণ করে কাপড়ের জাকজমক পূর্ণ সে দরবারে উপস্থিত হলো। চলতে চলতে রডারিক তার পিছনের এক ব্যক্তির কানে কানে কি যেন বলল!
“সে উপস্থিত রয়েছে শাহান শাহে আলী মাকাম। ঐ ব্যক্তি একথা বলে পিছনে এক ব্যক্তির কাছে চলে গেল।”
রডারিক যার কথা জিজ্ঞেস করেছিল সে সত্তর ঊর্ধ্ব এক জাদুকর। তার দাড়ি লম্বা, দুধের মত সফেদ। কাঁদ হতে টাকনু পর্যন্ত লম্বা চোগাপরিহিত। মাথায় গোল টুপি, গলায় ও হাতে মুর্তির মালা, আরেক হাতে বাদামী রং-এর বড় লাঠি।
ঐ ব্যক্তি ধীরে ধীরে এসে রডারিকের কাছে পৌঁছল। জাদুকরের পোষাক আশাক, বয়স ও চেহারা দেখে সম্মানী মনে হচ্ছিল। কিন্তু রডারিক তার পাশের কুরসীতে বসতে পর্যন্ত তাকে বল না। তাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল।
রডারিক : হে গণক! তুমি কি ভবিষ্যৎ এর ব্যাপারে ভয়াবহ কোন কিছু দেখতে পাচ্ছ?
গণক : হ্যাঁ। বাদশাহ নামদার! দেখছি। অস্পষ্ট মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা দেখতে পাই তা কখনো খুব গাঢ় হয় আবার কখনো তাতে অন্য কিছু দেখতে পাই।
রডারিক : যা দেখতে পাও তা কি?
গণক : বাদশাহ্ নামদার যে দৃশ্য দুর্গের মাঝে দেখেছিলেন, সে দৃশ্য দেখতে পাই।
রডারিক : তোমাকে যে দৃশ্যের কথা বলেছিলাম তা কি তোমার পূর্ণ মাত্রায় স্মরণ আছে?
গণক : তা আমার পূর্ণ মাত্রায় স্মরণ রয়েছে। আপনার এ গোলামের স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত প্রবল।
রডারিক শাহী প্রতাপে বলল, তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছি কেবল তার জবাব দাও। ফালতু কথা শুনার সময় আমার নেই। তোমাকে যা শুনিয়ে ছিলাম যদি স্মরণ থেকে থাকে তাহলে বল, তা বাস্তব রূপ নিবে না তো?
গণক : এক লাখ ফৌজের সামনে কোন হাকীকত টিকবে না। এরা তো সমুদ্রের তরঙ্গ মালার ন্যায় কোন বাধা মানে না।
রডারিক : আরেকটি কথা বল তাহলো এক নওজোয়ান লাড়কীকে আমি খাবে দেখি।
গণক : তাকে কি অবস্থায় দেখেন শাহান শাহ্!
রডারিক : মস্তকহীন অবস্থায় সে এসে আমার সামনে দন্ডায়মান হয়। তারপর পলক ফেলতেই দেখা যায় তার শরীরে মাথা রয়েছে। মিট মিট করে আমাকে দেখতে থাকে। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি… তার কিছুক্ষণ পরে লাড়কীর আওয়াজ শুনতে পাই… “তোমার রাজত্বের ওপরও ঘোড়া দৌড়ান হবে। তোমার নাম নিশানা .জে পাওয়া যাবে না।“ লাকীর ঠোঁট নড়ে না কিন্তু আওয়াজ শুনা যায়।
গণক : শাহানশাহ্ ঐ লাড়কীকে চিনেন কি? এমন কোন লাড়কী আপনার সান্নিধ্যে এসেছে কি?
রডারিক : হ্যাঁ, পামপিলুনাতে আমার সান্নিধ্যে এসেছিল। সে বিদ্রোহী সর্দারের কম বয়সী বেটী ছিল। আমি তাকে কাছে রেখে ছিলাম তারপর একরাতে একটা গোস্তাখী করার দরুন তলোয়ারের এক কোবে তার শিরোচ্ছেদ ঘটিয়েছি।
রডারিকঃ এটা কোন খারাপ ফাল কি না? আর একটা কথা বলি, আমি কাউকে ভয় পাইনা কিন্তু খাবের মাঝে ঐ লাড়কীকে দেখার সাথে সাথে ভয় পেয়ে যাই।
গণক : শাহান শাহ! ফাল ভাল নয়। শিশু-কিশোরদের বদ দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়। ঐ সত্তা যিনি সবাইকেপয়দা করেছেন সবার ইনসাফ করেন।
রডারিক : আমি জানি তোমার হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে যে তুমি সে বদ ফলকে প্রতিহত করতে পারবে। এটা তো ঐ জাদুর প্রভাব যার স্রষ্টা ইহুদীরা আর তুমি কেবল ইহুদীদের গুরুই নও, গণকও বটে। আমি তোমাকে মহলে যে মর্যাদা দান করেছি তার উপযুক্ত কোন ইহুদীকে আমি মনে করি না। তুমি কেবল একক ইহুদী ব্যক্তিত্ব যাকে আমি এত সম্মান দান করেছি।
গণক : এ গোলাম কি এ সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত নয়? এতটুকু ইজ্জত কি তার হক নয়?
রডারিক : নিশ্চয় রয়েছে। আমি তোমাকে এর চেয়েও বেশী ইনয়াম দেব… তুমি ফাওরান এক কাম করে দাও। এমন তদবীর কর যাতে ঐ লাড়কী স্বপ্নে যেন আমার কাছে না আসে, আর আমার অন্তর হতে যেন তার ভয় বিদূরিত হয়, এমন যেন না হয়, যে আমি হামলাকারীদের মুকাবালায় গেলাম আর আমার অন্তরে ভীতি সঞ্চার হলো।
এ ঘটনা যে ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন তারা লেখেন, রডারিক একজন অত্যন্ত সাহসী বাদশাহ ছিল। যুদ্ধের ময়দানে ছিল বীরবাহাদুর। কিন্তু ঐ কিশোরীকে হত্যা করার পর হতে তার মাঝে ভয় বাসা বেঁধে ছিল আর সে হয়ে পড়েছিল ভীতুর ডিম। ঐগণক জাদুতে পারদর্শী ছিল তাছাড়া ভবিষ্যৎ সম্পকে যে খবর দিত এ কারণে রডারিক তাকে মহলে রেখেছিল।
ইহুদীগণক রডারিকের মাথা হতে মুকুট উঠিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখল এবং তার মাথাকে দুহাতে ধরে একটু উঁচু করে বাদশাহর চোখে চোখ রাখল তার পর তার হাতের দুটো আঙ্গুটি বাদশাহর মাথায় বুলাতে লাগল। এ রূপ কয়েক মিনিট করে রডারিকের মাথা ছেড়ে দিল। বাদশাহ্ ডানে-বামে ফিরে দেখল।
রডারিক : আমি বিশেষ একটা কিছু অনুভব করছিলাম।
গণক : আমি জানি শাহানশাহ্! আপনি তা করবেন। এখন আর ঐ লাড়কী বাদশাহ্ নামদারের খাবে আসবে না, চিন্তা-চেতনাতেও না, আর দিল থেকে তার ভয় বিদূরিত হবে।
রডারিক : বাকী কাজ? তুমি বলেছিলে এ ফাল ভাল নয় তার প্রতিকার কিভাবে করবে?
গণক : বাদশাহ নামদার! আপনি কি আমাকে নব যৌবনা লাড়কী ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?
রডারিক : একজন নয় একশ জন দিতে পারব। বল বয়স কত হতে হবে?
বৃদ্ধ গণক : একুশ বছরের কম বয়স হতে হবে। আর ঐ লাড়কী আমার জন্যে নয়। তাকে জীবিত রাখা যাবে না। আজ রাত হবে তার জীবনের শেষ রাত। তার কলিজাসহ শরীর হতে আরো কিছু বের করে তার ওপর জাদুর আমল করব।
রডারিক তাৎক্ষণিকভাবে মেরীনাকে আহ্বান করল।
রডারিক : তুমিএক, লাড়কীর কথা বলেছিলে, বলেছিলে তার বয়স কম অর্ধ ফোঁটা কলি,তার বয়স কত?
মেরীনা : মোল-সতের বছর শাহানশাহ!
রডারিক : তাকে আজ রাতে এ গণকের কাছে অর্পণ করবে।
মেরীনা : আমাকে বাদশাহ্ নামদার তার সাথে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
রডারিক : আমার সাথে তোমার যাবার প্রয়োজন নেই। গণকের নির্দেশ মুতাবেক রাত্রি বেলা ঐ লাড়কীকে নিয়ে উপস্থিত হবে। তারপর রডারিক বৃদ্ধ গণককে লক্ষ্য করে বলল ঐ লাড়কীকে সাথে নিয়ে যাও তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবে সে কি করবে।
মেরীনা বৃদ্ধ ইহুদীর অনুগামী হলো।
***
রাতের প্রথম প্রহর কিছুটা অতিবাহিত হয়ে গেছে। মেরীনা এক খুব সুরত লাড়কীকে নিয়ে বৃদ্ধ ইহুদীর কামরায় প্রবেশ করল। মেরীনা রডারিকের নির্দেশ মুতাবেক যখন ঐ বৃদ্ধ ইহুদীর সাথে মহলে এসেছিল তখন সে বৃদ্ধকে বলেছিল বাদশাহ আপনাকে অত্যন্ত মূল্যবান ইনয়াম দিয়েছে। এ লাড়কীকে তো সে শাহানশাহর জন্যে নির্ধারণ করেছিল আর বাদশাহর সাথে তাকে যাবার কথা ছিল।
বৃদ্ধ গণক : তুমি কি কখনো কোন আওরতকে আমার কামরায় যাতায়াত করতে দেখছো? আমিএ বয়সে নওজোয়ান লাড়কী কি করব। এ লাড়কীকে আমার অন্য কাজে প্রয়োজন। তা রাতে বলল, তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে কারো কাছে তা ফাস করা যাবে না। এ গোপন খবরের মূল্য তোমার জীবন। নিশ্চয় তুমি তোমার জীবন খতম করতে চায়বে না।
ঐ লাড়কী যখন মেরীনার সাথে জাদুকর ইহুদীর কামরাতে প্রবেশ করল তখন ভয়ে চমকে উঠে মেরীনাকে জড়িয়ে ধরল। সম্মুখে একটা টেবিলে তিনটি মাথার খুলি পড়ে ছিল। আর দেয়ালে ছিল মানুষের কংকাল ঝুলান। বৃদ্ধ ইহুদী একটা বাক্সের ঢাকনা খুললে তার মাঝে দুটো সাপ ফনা পেতে উঠলে কিশোরী চিৎকার দিয়ে উঠল।
কামরার মাঝে লাশ পচা দূর্গন্ধ। তবে সেখানে কোন লাশ ছিল না। এ দুর্গন্ধ রসায়নিক দ্রব্যাদির ছিল। সে কামরাতে নানা ধরনের জিনিস পত্র পুড়ান হতো। কামরার সার্বিক অবস্থা ছিল ভীতিকর। মেঝেতে কিছু পুটলা এলোমলো ভাবে পড়েছিল। এ কামরার বৃদ্ধই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বাহিরে বের হয়। সে এ কামরাতে প্রবেশ করা মাত্র তার রূপ পাল্টে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে হিংস্র রূপ ধারণ করল।
বৃদ্ধ ইহুদী আরো একটা কামরা খুলে দিয়ে মেরীনাকে বলল, ঐ লাড়কীকে এ কামরাতে বসিয়ে তুমি চলে এসো। মেরীনা কিশোরীকে ঐ কামরাতে নিয়ে গেল। কামরাটা তুলনামূলক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। একটা পালং, তাতে মূল্যবান ও অত্যন্ত সুন্দর বিছানা বিছান। ফ্লোরে মূল্যবান কার্পেট পাতা। ছাদের সাথে রওশন ফানুস লাগান। তবে অন্য কামরার দূর্গন্ধ এ কামরাতেও রয়েছে।
কিশোরী মেরীনাকে বলল, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে? ইনিই কি শাহানশাহ্ রডারিক? এভো ফৌজের ঐ জেনারেলও নয় যার জন্যে তুমি আমাকে নিয়ে ছিলে। সে তো ফৌজের সাথে চলে গেছে।
মেরীনা : তোমার দ্বারা যে খেলা করাতে চেয়েছিলাম তা বাদশাহর নির্দেশে সম্পূন্ন ভেস্তে গেছে। তোমার সাথে আমিও বাদশাহর সাথে যেতাম কিন্তু যেতে দেয়া হয়নি।
কিশোরী : কেন যেতে দেয়া হয়নি? আমিএ দূর্গন্ধময় কামরাতে এ বুড়ার সাথে থাকব না। তুমি আমার বাবাকে যে টাকা দিয়েছ তা ফিরিয়ে নিবে।
পাশের কামরা থেকে বুড়ো ইহুদী বলল, দ্রুত এসো মেরীনা, তাকে ওখানেই রেখে এসো।
মেরীনা কিশোরীর কানে কানে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে এখান থেকে বের করার কৌশেশ করব।
মেরীনা পাশের কামরাতে বৃদ্ধের কাছে চলে গেল।
***
জাদুকর ইহুদী : আমি জানি তুমি ইহুদী; আর তুমিও হয়তো জান আমিও ইহুদী। তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। বাদশাহর বিজয়ের জন্যে আমিএমন কাজ করব যাতে তুমি ঘাবড়ে যাবে কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না।
মেরীনা : বাদশাহ্ যে পরিমাণ ফৌজ নিয়ে গেছে তাতে তিনি এমনিতেই বিজয়ী হবেন তার জন্যে কোন ইহুদীর কিছু করতে হবে না।
বৃদ্ধ ইহুদী ধমকের স্বরে বলল, আমার কাজে বাধা দেবে না। শাহান শাহ্র জন্যে দুটো বদফাল রয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া খতম করা জরুরী।
মেরীনা : মৃদু হেসে বলল, শুনেছি আক্রমণকারীদের মোট সংখ্যা এগার/বার হাজার। আর বাদশাহর ফৌজ এক লাখ তার মাঝে সোয়ারীই হবে বার হাজারের বেশী। তাই বিজয় আমাদের বাদশাহ নামদারের হবে। ফলে এমনিতেই আপনি ইনয়াম পাবেন।
বৃদ্ধ ইহুদী : আমি যা জানি তুমি তা জান না। যা বলছি তাই কর…।
ঐ লাড়কীর শরীর হতে আমাকে কলিজা বের করতে হবে। শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করার সাথে আমি তার কলিজা বের করব তার পেট হতে আরো দুটো জিনিস বের করতে হবে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। যখন কাজ হয়ে যাবে তখন লাড়কীর লাশ গুম করার দায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকে আর এটা কোন কঠিন কাজ। নয়। এ কামরা হতে এভাবে লাশ গুম হতে থাকে।
বৃদ্ধের কথা শুনে ভয়ে মেরীনা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হলো কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।
বৃদ্ধ : তাকে খুব পিয়ার করে যত্নসহ এখানে নিয়ে এসো, সে যেন কিছু অনুভব করতে না পারে।
মেরীনা অন্য কামড়ায় প্রবেশ করে এদিক-সেদিক দেখতে লাগল সে যা তালাশ করছিল তা পেয়ে গেল তা তুলে নিয়ে কিশোরীকে তার সাথে যাবার জন্যে বলল।
কিশোরী : এখন আমার কি হবে? ঐ দুর্গন্ধময় বুড়োর কাছে রেখে তুমি চলে যাবে?
মেরীনা : আমি কিছু একটা করব। তুমি ভয় পাবে না। আমাকে সাহায্য করবে। দুজনই বৃদ্ধ জাদুকরের কামরায় প্রবেশ করল।
জাদুকর : এসো বেটী! এ টেবিলের উপর একটু বস… আমাকে তোমার বাবার মত মনে কর।
কিশোরী মেরীনার দিকে তাকাল, মেরীনা তাকে ইশারায় টেবিলে বসতে বলল। বৃদ্ধ কিশোরীর কাছে পৌঁছল। সে তাকে উঁকিয়ে শেষ করার চিন্তা-ভাবনা করেছিল। বৃদ্ধ মেরীনার দিকে পিঠ দিয়ে ছিল। মেরীনা অপর কামরা হতে একটা লোহার ডান্ডা লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে ডান্ডা দ্বারা অত্যন্ত স্ববেগে বৃদ্ধের মাথায় আঘাত হানল এমনিভাবে আরেকটি আঘাত হানলে বৃদ্ধ বেহুশ হয়ে পড়ে গেল।
মেরীনা বৃদ্ধকে চিৎ করে তার বুকের ওপর বসে পূর্ণ শক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরল। অল্পক্ষনের মাঝে বুড়ো শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করল। অপর একটি কামরায় কাঠের বিরাট বড় একটা বাক্স ছিল। মেরীনা কিশোরীকে সাথে করে বৃদ্ধের লাশ ঐ কামরায় নিয়ে গেল। বাক্স খুলে তার ভেতর যা কিছু ছিল তা বের করে দু’জন মিলে বাক্সের ভেতর লাশ ভরে তার দরজা বন্ধ করে দিল।
মেরীনা : এখন তার রডারিক বাদশাহ্ বিজয় অর্জন করে ফিরে আসবে। চল্ লাড়কী তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে পড়।
কিশোরী : আমার ভীষণ ভয় লাগছে। এসবের কিছুই তো বুঝলাম না।
মেরীনা : এ বুড়ো যদি না মরত তাহলে তুমি মরতে, ভয় পেওনা, আগামীকাল সকালে তোমাকে আমি অন্যত্র নিয়ে যাব। কারো কাছে খবরদার এসব কিছু বলবে না।
তারা দু’জন সেখান থেকে চলে আসল। মেরীনা কিশোরীকে তার নিজ কামরাতে নিয়ে গেল। মেরীনা তার নিজের জন্যে বড় আশংকা সৃষ্টি করেছিল। রডারিকের বিজয়ের ব্যাপারে সকলে পূর্ণদ্যমে আস্বস্ত ছিল। কারণ তার এ বিশাল ফৌজের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না। রডারিকের বিজয় হলে মেরীনার। বাঁচা সহজ ছিল কারণ রডারিক মনে করত বৃদ্ধ ইহুদী তার বদফাল দূর করে দিয়েছে পরে হয়তো কারো হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু পরাজিত হয়ে আসলে কিয়ামত দাঁড় করিয়ে দিত।
মেরীনা পলায়নের ইরাদা করল। পরের দিন ঐ কিশোরীর সুরত পরিবর্তন করে তাকে তার নিজ বাড়ীতে পাঠিয়ে দিল। আর সে নিজে অন্য এক জায়গায় চলে গেল।
একটা বড় আলীশান প্রাসাদ। সেখানে এক গোথা খান্দানবাস করে। মেরীনা তাদেরকে ইহুদী হত্যাসহ তাবৎ ঘটনা বর্ণনা করল। এক ব্যক্তি বলল, তুমি খুব ভাল করেছ, এক নিষ্পাপ বাচ্চাকে বাঁচিয়েছ তার পর এখন যা হয় তাতে দেখতেই পাবে।
মেরীনা : বর্বরদের সংখ্যা খুবই সীমিত তাই রডারিক যে জীবিত ফিরে আসবে না এ উমিদ করা ঠিক হবে না।
অপর ব্যক্তি বলল, সে ধর জীবিতই ফিরে আসবে তাতে তোমার পেরেশান হবার কিছু নেই, যখন ফিরে আসবে তখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে। তোমাকে সুস্থ-সুন্দরভাবে সিওয়াস্তা পৌঁছে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। তুমি দোয়া কর আওপাস যেন জীবিত থাকে আমরা তোমাকে তার কাছে পৌঁছে দেব।
একদিকে রডারিক জাদু-মন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছিল যেন একলাখ ফৌজের ওপর তার কোন ভরসা নাই। অপর দিকে মুসলমানদের ক্যাম্পে কেবল মাত্র আল্লাহ্ আল্লাহ্ রব ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে বলেছিলেন তাদের মুকাবালায় তাদের চেয়ে আটগুণ বেশী ফৌজ আসছে। একজন মুজাহিদকে আটজনের সাথে মুকাবালা করতে হবে। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর এবং জুময়ার খুৎবাতে যেমনি তার সে স্বপ্ন শুনাতেন যাতে রাসূল (স) বিজয়ের বাশারত দিয়েছিলেন তেমনি কুরআনের ঐ সকল আয়াত পাঠ করে শ্রবণ করাতেন যার মাঝে আল্লাহ্ তায়ালা মুমিনদেরকে বিজয় ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
“বহুবার ছোটদল বড় দলের ওপর বিজয় অর্জন করেছে।” এ আয়াত পাঠ করে তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজদেরকে বুঝাতেন, ছোট দলে ফৌজ সদস্যও তার আমীরের মাঝে কিরূপ গুণাবলী ও কি পরিমাণ ঈমানী শক্তি পয়দা করলে আল্লাহ তায়ালা বড় দলের ওপর বিজয় দান করেন।
“স্মরণ কর! সে সময়ের কথা যখন তোমাদের জন্যে করলাম সাগরকে দ্বিধা বিভক্ত ও তোমাদেরকে দিলাম পরিত্রাণ আর ফেরাউন সম্প্রদায়কে করলাম নিমজ্জিত।”,
তারেক ইবনে যিয়াদ এ আয়াত বারংবার পাঠ করে তার ফৌজী বাহিনীকে শ্রবণ করাতেন। তিনি তার ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন, এ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা সম্বোধন করেছেন বনী ইসরাঈলদেরকে। ফেরআউনের জাদুর চ্যালেঞ্জে মুসা (আ.) এমন মুজেজা দেখিয়ে ছিলেন যার ফলে ছামেরীর ভেলকীবাজী হয়েছিল খতম আর ফেরআউন হয়েছিল হতভম্ব। যখন বনী ইসরাঈল মিশর হতে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের সম্মুখে নিল নদ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে বিশাল নদী পশ্চাদে ফেরআউন ও তার ফৌজ। এহেন পরিস্থিতে মুসা (আ) তাঁর লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত হানলে তা দ্বিভক্ত হয়ে রাস্তায় পরিণত হয়। সে রাস্তা দিয়ে মুসা তার বাহিনী নিয়ে সুন্দরভাবে নদী অতিক্রম করে চলে যান কিন্তু সে রাস্তায় ফেরআউন তার বাহিনী নিয়ে অবতরণ করার সাথে সাথে উভয় দিকের পানি একত্রিত হয়ে ফেরআউনও তার গোটা ফৌজ বাহিনী নিমজ্জিত হয়ে চিরতরে খতম হয়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিয়ে বললেন, “কিন্তু মুহাজিদ ভাইরা! আল্লাহ্ তায়ালা হযরত মুসা (আ)-কে চল্লিশ দিনের জন্যে আহ্বান করেছিলেন। সে আহ্বানে তিনি সাড়া দিলে তার অবর্তমানে ইসরাঈলরা গো বৎসের পূজা শুরু করেছিল যার পরিণাম তাদের বিপর্যয় ডেকেআনে। মুজাহিদ ভাইরা আমার! পরিবেশ-পরিস্থিতি যতই তোমাদের প্রতিকুল হোকনা কেন সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবতে রত থাকবে। এ ধরনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করে তিনি মুজাহিদদেরকে ঈমানী বলে বলিয়ান করে তাদের মাঝে জিহাদের স্পৃহা উদ্দীপনা বৃদ্ধি করছিলেন। তিনি যুদ্ধের জন্যে যে জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন, দিনের বেলা মুজাহিদ বাহিনীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন।
এদিকে রডারিকের বিশাল ফৌজী বাহিনী বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার ন্যায় প্রবল বেগে ধেয়ে আসছিল, তার গতিরোধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না।
***
মেরীনা যে প্রাসাদে গিয়ে উঠেছিল ইতিপূর্বে কয়েক বার সে সেখানে গিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বার তার বেশ-ভূশা পরিবর্তন করে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। টলেডোতে এ ধরনের আরো কিছু প্রাসাদ ছিল, যা দেখে লোকেরা বলতএখানে। সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর লোকরা বাস করে। এসব প্রাসাদে এমনকার্যক্রম শুরু হয়েছিল যা পরবর্তীতে ইউরোপের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। আওপাস যেদিন ঝিল পাড়ে মেরীনার সাথে মিলিত হয়েছিল সেদিন থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। আওপাস সেদিন মেরীনাকে বলেছিল, এখন সময় এসেছে যদ্বারা গোথা ও ইহুদীরা ফায়দা হাসিল করে রডারিককে সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে পারে। আর তার একমাত্র উপায় হলো গোথা ও ইহুদী যেসব ফৌজ রয়েছে চূড়ান্ত লড়াই এর সময় তারা মুসলমানদের সাথে মিলে রডারিকের বিরুদ্ধাচরণ করবে।
মেরীনা ইহুদী ছিল একারণে তার মাথাতে জন্মগতভাবে ষড়যন্ত্রের বীজ ছিল। অধিকন্তু তার অন্তরে রডারিকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন দাউ দাউ করে জুলছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে রডারিক তার প্রেমের ছন্দময় জীবন নস্যাৎ করে ছিল। সে আওপাসের প্রেমে ছিল বিভোর। বিশ বছর পর যখন আওপাসের সাথে মিলন ঘটল তখন তার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের জ্বালা শতগুণে বেড়ে গেল। আওপাসের কথা শুনে সে বলেছিল রডারিকের বুকে খঞ্জর বিদ্ধ করে চিরতরে খতম করবে।
মেরীনা রডারিক থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা শুরু করল। তার কাছে এক অত্যন্ত সুন্দরী লাড়কী ছিল। বাদশাহর খাছ মহলে ছিল তার যাতায়াত। মহলে দু’চার জন ইহুদী ও গোথা কওমের লোক বেশ উপরস্থ পদে সমাসীন ছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে স্পেনে সবচেয়ে মাজলুম ছিল ইহুদী সম্প্রদায়। তাদের অধিকাংশ ছিল গরীব। মেরীনা যে প্রাসাদে গিয়েছিল সেখানে অধিকাংশ লোকছিল গোথা কওমের অধিকন্তু তারা ছিল ডেজার অত্যন্ত ভক্ত। তাদের মাঝে এক ব্যক্তির নাম ছিল জেওয়াজ। সে ছিল ডেজার বাল্য বন্ধু। মেরীনা তার সাথে সাক্ষাৎ করে আওপাসের মুলাকাতের কথাও সে যে আলোচনা করেছে তা বিস্তারিত বলল। জেওয়াজ কোন প্রকার চিন্তা-ফিকির ছাড়াই মেরীনার প্রস্তাব মেনে নিল। সে মেরীনাকে তার বাবা ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে আওপাস মেরীনাকে যা বলেছে তার বিবরণ দিল।
জেওয়াজের বাবা বললেন, প্রস্তাবতো ভাল কিন্তু অত্যন্ত আশংকা জনক। কারণ কেউ এটা মেনে নেবে না যে এত স্বল্প সংখ্যক হামলাকারীরা স্পেনের একলাখ ফৌজকে পরাজিত করতে পারবে… এটা নামুমকিন। ইহুদী ও গোথারা যদি গাদ্দারীও করে তবুও তাদের সংখ্যা কতইবা হবে। পনের-বিশ হাজার না হয় হবে। এরা হামলাকারীদের সাথে মিলে কিইবা করবে? বিজয় হবে রডারিকের। তারপর জানই তো পরিণাম কি হবে? রডারিক একজন গাদ্দারকেও জীবিত রাখবে না আর গোথা ও ইহুদীদের ওপর যে নিপীড়ন চালান হবে তা হবে অতীব ভয়াবহ।
মেরীনা : আওপাসের ধারণা ভিন্ন। সে বলছিল, মুসলমানরা খুবই সাহসী ও বীরবাহাদুর এবং অভিজ্ঞ। তাদের চেয়ে দ্বিগুণ ফৌজ ছিল তিতুমীরের কিন্তু খুব কম সময়ের মাঝে তাদেরকে পরাস্ত করে অর্ধেকের বেশী ফৌজকে করল হালাক আর স্বল্প সংখ্যক ছাড়া বাকীরা হলো মুসলমানদের কয়েদী। আপনারা সলা-পরামর্শ করেন, আওপাস আরেকবার আসবে। আমি তাকে আপনাদের কাছে পৌঁছে দেব।
জেওয়াজের বাবা বললেন, তুমি ইহুদী নেতাদের সাথেও আলোচনা কর।
***
মেরীনা : ইহুদী ধর্মগুরু ও নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ আলোচনার মাঝে দিন রাত কাটাতে লাগল। এক রাতে তিন-চারজন ইহুদী জেওয়াজের প্রাসাদে বসা ছিল। তাদের সাথে তিন-চারজন গোথাও ছিল। তারা সকলেই এ ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করছিল, মেরীনা চুপি চুপি তাদের আলোচনা শ্রবণ করছিল।
এক বৃদ্ধ ইহুদী বলল, আমরা শুধু একটা বিষয় বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই, তাহলে আজ আমরা রডারিকের নির্যাতন-নিপীড়নের স্বীকার এবং পশুর ন্যায় জীবন যাপন করছি। রডারিকের হাত থেকে মুক্তি পাবার প্রত্যাশায় হামলাকারীদেরকে সাহায্য করব। তারপর তারা যদি বিজয় অর্জন করে তাহলে তারা রডারিকের জায়গায় আমাদের ওপর শাসনকর্তা হয়ে বসবে। তারা হলো মুসলমান আমরা হলাম ইহুদী। তখন আমরা তাদের নির্যাতন নিপীড়নের বস্তুতে পরিণত হব। আমাদের অবস্থান, এমন হওয়া দরকার যে, আমরা মুসলমানদেরকে সাহায্য করব যাতে রডারিক পরাজয় বরণ করে তারপর সাথে সাথে মুসলমানদের ওপর অতর্কিতভাবে এমন আক্রমণ করা হবে যাতে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারপর ইহুদী ও গোথারা যৌথভাবে স্পেন শাসন করবে।
আওপাসের তাবৎ পরিকল্পনা নস্যাৎ হচ্ছে বলে মেরীনা অনুমান করতে পারল। সে ঝিল পাড়ে আওপাসের কাছে নিজের ব্যাপারে বলেছিল,
“আমি কারো বিবি হতে পারলাম না, হতে পারলাম না মা, আমি শয়তান হয়ে গেছি। আমার মাঝে শয়তানের স্বভাব চরিত্র দানা বেঁধেছে।” সে ঠিকই বলেছিল।
বৃদ্ধ ইহুদীর কথা তার কানে আসার সাথে সাথে তার মাথায় একটা মিথ্যে ভাবনা উদয় হলো,
মেরীনা বলল, মুসলমানরা এখানে বাদশাহী করবার জন্যে আসেনি। আওপাস আমাকে বলেছিল তারা লুটতরাজ করার জন্যে এসেছে। তাদের ঝুড়িভরে গেলে তারা ফিরে যাবে। আওপাস আমাকে বলেছে সে এবং জুলিয়ন রডারিকের সিংহাসন ভূলণ্ঠিত করার জন্যে তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে এসেছে, তারা মুসলমানদেরকে বলেছে স্পেনের শাহী খাজানাতে এত পরিমাণ ধন-দৌলত সোনা দানা রয়েছে যা হবে বিপুল সংখ্যক উটের বোঝ। আপনারা তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন তারা কোন মুলুকের ফৌজ নয় বরং তারা দস্যুদল।
বৃদ্ধ ইহুদী : তাহলে বলব,তুমি মুসলমানদের ব্যাপারে অবহিত নও। তারা যেখানে যায় স্বল্প সংখ্যক গিয়ে বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেদের অধিনত করে ফেলে। তারা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের মত বিশাল রাজ্যকে খতম করে দিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখ অল্প দিনের মাঝে ইসলামী সালতানাতের কি পরিমাণ বিস্তরণ ঘটেছে। মুসলমানরা অমুসলিম কওমের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে ধর্মীয় দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে।
বৃদ্ধ ইহুদী মুসলমানদের বীরত্ব, বিজয়ের ইতিহাস বর্ণনা করে চলছিল, মেরীনা তাকে থামিয়ে দিল।
মেরীনা : কাবেলে ইহতেরাম বুজুর্গ! আপনি আরবের মুসলমানদের কথা বলছিলেন, স্পেনে যারা এসেছে তারা বর্বর। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হত্যা-লণ্ঠন করাই হলো তাদের পেশা। তাদের সিপাহ্ সালারও বর্বর। এরা যুদ্ধবাজ কওমের মাঝেই বড় হয়েছে। তারা তাদের মুলকে কোন্ বাদশাহী কায়েম করেছে যে তারা আমাদের দেশে বাদশাহী কায়েম করবে?
মেরীনা : তার ছলচাতুরীকে পূর্ণ দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত করে বৃদ্ধ ইহুদীদেরকে নিজের ধারনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলো।
***
দু’তিন দিন পর আওপাস দুনিয়া বিরাগী সন্নাসীর বেশে টলেডোতে মেরীনার সাথে সাক্ষাতের মওকা তৈরী করে নেয়। মেরীনা তাকে ঐ ইহুদী ও গোথা সর্দারদের কাছে পাঠিয়ে দিল। এক ইহুদী পণ্ডিত কি যুক্তি পেশ করেছিল তার জবাবে মেরীনা কি বলেছে তা সে আওপাসের কাছে বর্ণনা দিল।
আওপাস পৌঁছার পর রাত্রে মেরীনাও সেখানে হাজির হলো। গোথা ও ইহুদীদের সর্দাররা সমেবেত হয়েছিল। আওপাস ছিল গোথা আর রডারিক যেহেতু গোথাদের বাদশাহী ভূলণ্ঠিত করেছে তাই আওপাস সহজেই গোথা সর্দারদেরকে আপন করে নিতে পারল। ইহুদিদের বৃদ্ধ ব্যক্তি কেবল নিজেদের ফায়দার কথা বারংবার বলতে লাগল।
আওপাস ইহুদী নেতাদেরকে সম্বোধন করে বলল, গোথারা তাদের রাজত্বকালে ইহুদীদেরকে সম্মান দান করেছিল এং তাদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আপনারা কি তা ভুলে গেছেন? এটা ভুলার কথা নয়। কারণ বেশী দিন আগের কথা নয়। গোথাদের সমমর্যাদা ইহুদেরকে দান করার দরুণই তো আমার ভাই ডেজাকে নির্মমভবে হত্যা করে তার প্রতিদান দেওয়া হয়েছে। আপনারা আমাদের সাথে থাকেন, ইহুদীরা আবার সে রূপ মান-মর্যাদা পাবে। আর বর্বররা লুঠতরাজ করে ধন-সম্পদ গুছিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
পরিশেষে ঐ রাত্রেই পরিকল্পনা করে কাজ শুরু হয়ে গেল। একজন গোথা জেনারেল রাজী হচ্ছিল না। সে রডারিকের অপেক্ষায় অপেক্ষমান ছিল। জেনারেল মূলত বাদশাহর চাটুকার ছিল। মেরীনা জাদু প্রয়োগ করল। সে তাকে এক নব যৌবনা খুব সুরত ললনার ঝলক দেখাল। জেনারেল কাবু হয়ে গেল এবং ঐ ললনীকে তার সাথে যুদ্ধে নিয়ে যেতে চাইল।
মেরীনা : বাদশাহ্ আপনার জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এত সুন্দর লাড়কী সে আপনার কাছে রাখতে দেবে না। বরং আমি লাড়কীকে বাদশাহর কাছে পৌঁছে দেব বাদশাহ সাথে করে নিয়ে যাবে তারপর লাড়কীকে আমি ঠিকমত বুঝিয়ে দেব সে পরে আপনার কাছে চলে আসবে। বাকী আমি আপনাকে যা বললাম তা করার জন্যে প্রস্তুত হোন। রডারিক যদি নিহত হয় তাহলে নতুন বাদশাহকে বলে আপনাকে বিশাল জায়গীরের অধিকারী বানিয়ে দেব।
মেরীনা ঐ ইহুদী তরুণীকে বলেদিল ঐ জেনারেলের প্রতি কোন ভরসা নেই। সে প্রতারণা করতে পারে। মেরীনা ঐ তরুণীর হাতে সুফুফ (চূর্ণ ঔষধ) দিয়ে বলল, রাত্রে জেনারেল কে যখন শরাব পান করাবে তখন শরাবের মাঝে এ সুফ মিশিয়ে দেবে। সুফুফের প্রতিক্রিয়াতে সে মেধাগত ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধের সময় জেনারেলকে অকেজো করে রাখা।
এ সুফুফ যদি রডারিককে পান করান যেত তাহলে ইহুদী ও গোথাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব ছিল না। কেননা সে কোন কিছু পানাহার করার পূর্বে দু’জন ব্যক্তিকে পানাহার করিয়ে তা পরীক্ষা করে নিত। তার একান্ত লোকেরা তার খানা-পিনার ইন্তেজাম করত। ঐতিহাসিকরা লেখেন, সে যে অত্যন্ত জুলুমবাজ ও নির্যাতনকারী ছিল তা জানত। তাই সর্বদা মাজলুমদের প্রতিশোধের আশংকায় থাকত।
***
গোথা ও ইহুদী সর্দাররা আওপাসের সাথে পরামর্শ করে যে পরিকল্পনা করেছিল সে অনুপাতে প্রায় দেড়শত নওজোয়ান তৈরী করা হলো। রডারিক টলেডোতে পৌঁছার পর নওজোয়ানদেরকে তার সামনে পেশ করা হলো যে এরা স্বেচ্ছায় ফৌজে শামিল হতে চায়। এরা সাধারণ ফৌজ নয় জানবাজ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। রডারিককে আরো বলা হলো এরা রাতের যুদ্ধা, রাতের আঁধারে হামলাকারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করবে।
রডারিক যেদিন টলেডোতে পৌঁছুল তার আগের দিন আওপাস ফিরে গিয়েছিল। সেদিন রাতেই গোথা গোত্রের সাথে সম্পর্ক যুক্ত কমান্ডাররা গোপনে বৈঠকে মিলিত হয় তার মাঝে ইহুদীরাও ছিল। তারা নির্জনে সলা-পরামর্শ করে সবাই যার যার মত ফিরে যায়।
পরের দিন রডারিক যখন একলাখ ফৌজীবাহিনী (যার মাঝে কয়েক হাজার ছিল ঘোড় সোয়ার) নিয়ে হামলাকারীদেরকে স্পৈন হতে বিতাড়নের মানসে তুফানের বেগে ছুটছিল তখন সিপাহীরা হামলাকারীদের ব্যাপারে একে অপরের থেকে নানান ধরনের আশ্চর্যজনক কথা-বার্তা শুনছিল।
“তিতুমীরের মত বাহাদুর জেনারেল তাদেরকে দেখেই পলায়ন করেছিল।”
“শোনা যায় তারা মাত্র কয়েক হাজার কিন্তু এক লাখের চেয়ে বেশী শক্তিশালী।”।
“তাদের কোন তীর ব্যর্থ হয় না। বাতাসে তীর ছেড়ে দেয় তারপর তীর নিজেই একজনের বুকে এসে বিদ্ধ হয়।”
“তাদের একজন পায়দল, চারজন-ছয়জন সোয়ারীর মুকাবালা করে এবং একে একে সবাইকে ওয়ার করে ফেলে।”
“স্বয়ং তিতুমীর বাদশাহকে বলেছে তারা আদমী নয়, জিন-ভূত।”
“শোনা যায় তারা কিন্তীতে আসেনি, এত বড় সমুদ্র সাঁতার কেটে এসেছে।”
“আমি তো এমনও শুনেছি যে তারা সাঁতার কাটেনা বরং পানির উপর হেঁটে চলে।”
রডারিকের ফৌজ রওনা হবার পর হতে তাদের মাঝে এ ধরনের নানা কথা আলোচনা হচ্ছিল। একজন একথা শুনে তার সাথে আরো তিন কথা যোগ করে অন্যের কাছে বর্ণনা করত। ফলে ক্রমেই ফৌজের মাঝে ভয়-ভীতি বাড়ছিল। তবে আরো একটা কথা তাদের মাঝে চর্চা হচ্ছিল তা হলো, তারা যেমনিভাবে চরম জালেম ঠিক তেমনিভাবে অত্যন্ত দয়ালু।
ইহুদী ও গোথারা যে পরিকল্পনা করেছিল সে মুতাবেক ফৌজের মাঝে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছিল। আর এসব কথা ফৌজের মাঝে চর্চা করছিল ঐ দেড়শত লোক যাদেরকে বিশেষ যুদ্ধবাজ হিসেবে ফৌজে শামিল করা হয়েছিল। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সৈন্যদের মাঝে এসব কথা আলোচনা করে প্রচার করছিল।
এক ইংরেজ ঐতিহাসিক তার গ্রন্থ “মুসলমানদের ইতিকথা”-তে লেখেছেন, স্পেনের ফৌজের ওপর এটা একটা মানসিক যুদ্ধ ছিল যা তারেক ইবনে যিয়াদ সৃষ্টি করেছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ আওপাসকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন সে যেন স্পেন ফৌজের মাঝে এমন কিছু লোক শামিল করে দেয় যারা মুসলমানদের ব্যাপারে ত্রাস সৃষ্টি করবে। আওপাস ইহুদী ও গোথা সর্দারদের কাছে এ প্রস্তাব পেশ করলে তারা তার বন্দোবস্ত করে দেড়শত লোক রডারিকের ফৌজে শামিল করেছিল।
***
একদিকে মুসলমানদের তাবুতে বিজয়ের জন্যে দোয়া হচ্ছিল অপরদিকে ইহুদী। ও গোথাদের ইবাদতগাহে রডারিকের পরাজয়ের জন্যে প্রার্থনা হচ্ছিল। ইহুদী ও গোথা সম্প্রদায় পরস্পরে আলোচনা করচিল রডারিক যদি নিহত হয় বা পরাজিত হয়, তাহলে রাজত্ব তাদের। কারণ হামলাকারীরা লুটতরাজ করে ফিরে যাবে।
রডারিকের ফৌজ সমুদ্র তীরে পৌঁছে গিয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ খবর পেয়ে ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে একটা পাহাড়ে গিয়ে চড়লেন, সমুদ্র তীরে বহুদূর পর্যন্ত। তিনি মানুষ আর ঘোড়া দেখতে পেলেন। এত পরিমাণ ফৌজ তিনি ইতিপূর্বে আর কোনদিন দেখেননি। তারেককে পূর্বেই বলা হয়েছিল রডারিকের সৈন্য সংখ্যা এক লাখের মত হবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ আসমানের দিকে দু’হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আল্লাহ্! ওগো আমার আল্লাহ! তোমার নামের সম্মান রক্ষা কর। আমরা তোমার নামে কুফুরীর বিপক্ষে লড়াই করতে এসেছি এবং তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি।
তারেক তার ফৌজ, দরিয়া হতে প্রায় এক মাইল পিছে রেখে ছিলেন। আর রডারিকের ফৌজকে সমুদ্রের তীরে আনতে চাচ্ছিলেন। যাতে তাদের পশ্চাদে থাকে সমুদ্র। তারেক তার সৈন্যবাহিনীর মাত্র কয়েক দল সম্মুখে রেখে বাকী সকল সৈন্য রেখেছিলেন পাহাড়ের ভেতর। তারেক লক্ষ্য করলেন রডারিকের ফৌজরা অতিদ্রুত নৌকা দিয়ে পুল তৈরী করছে।
“এদেরকে তো অত্যন্ত চঞ্চল মনে হচ্ছে।” তারেক ইবনে যিয়াদ আওয়াজ শুনতে পেলেন, ফিরে দেখলেন তার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ।
তারেক : আমরা এ ফৌজকে খুব তাড়াতাড়ি বিতাড়িত করব।
তারা যদি যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এমন তেজী হয় তাহলে……। আবু জুরয়া বলতে বলতে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
তারেকঃ তোমরা কি দেখছনা তাদের চঞ্চলতা ও তেজীর কারণ কি? লক্ষ্য কর, তাদেরকে কিভাবে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। তারা স্বেচ্ছায় ও উদ্দীপনায় কাজ করছে না বরং তাদের সালারের দোররা তাদেরকে করাচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানেও তাদের সালার দোররা মেরে লড়াই করাবে?
তারেক ইবনে যিয়াদের দুই সালার গভীরভাবে লক্ষ্য করল, তারা দেখতে পেল তাদের জেনারেল বেত নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে কেউ একটু অলসতা করলে তার পিঠে পড়ছে সপাং সপাং বেতের বাড়ি।
তারেক : যুদ্ধ হয় স্পৃহা-উদ্দীপনায়, বেত্রাঘাতে নয়। যে কওমের কর্তারা তাদের অধিনতদেরকে গোলাম মনে করে আর বাদশাহ হয়ে যায় প্রজাদের জন্যে ফেরাউন সে কওমের ধ্বংস অনিবার্য। উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ কওমকে বিনাশ করে দেয়। আমাদের সিপাহীদের মাঝে প্রেরণা রয়েছে। জেনারেল, সিপাহী সকলের অন্তরে এক আল্লাহএক রাসূল। আমাদের মাঝে সমতার এটাই কারণ। কারো আল্লাহ বড় কারো ছোট এমন নয়, প্রাসাদ হোক ঝুপড়ী, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্ এক, আর বড়ত্ব একমাত্র আল্লাহরই।
আবু জুরয়া তুরাইফ : কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ফৌজ?
তারেক : তোমরা নিজ নিজ জায়গায় চলে যাও। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে বিজয়ের এমন উপকরণ দান করেছেন যার বিন্দুমাত্রও আশা ছিল না। রাসূল (স) এর বাসারত মিথ্যে হতে পারে না, কিন্তু আমি শুধু খাব দেখার আদমী নই। যে আল্লাহকে তালাশ করে সেই আল্লাহকে পায়। আর আল্লাহ্ তাকেই সাহায্য করেন যে প্রচেষ্টা করে। এখন তোমরা নিজেদের অবস্থানে অটল-অবিচল থাক।
সারা রাত রডারিকের সৈন্য একত্রিত হলো। সকাল হবার সাথে সাথে দেখা গেল দরিয়ার তীরে প্রশস্ত ময়দানে একলাখ ফৌজ লড়াই এর প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লেনপোল লেখেন, তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড়ায় আরোহন করে তার ফৌজের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত উঁচু ও দৃঢ় স্বরে বললেন,
“ইসলামের মুজাহিদ ভাইয়েরা! তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পিছনে সমুদ্র। পলায়নের কোন রাস্তা তোমাদের জন্যে ভোলা নেই। তোমাদের সম্মুখে একটাই রাস্তা তাহলো বাহাদুরী ও বিজয়। দুশমনের সংখ্যাধিক্যে ভয় পেওনা। ভয় কর ঐ পরাজয়কে যা তোমাদের জন্যে লাঞ্ছনা-গুঞ্জনা বয়ে আনবে।”
ইউরোপীয়ান একজন ইতিহাসবিদ লেখেন, মুসলমান ফৌজরা বজ্রের মত গর্জে উঠে শ্লোগানে মাতোয়ারা করে তুলল,
“আমরা তোমার সাথে রয়েছি তারেক! আমরা তোমার সাথে রয়েছি।”
স্পেন ফৌজের পক্ষ হতে এলান হলো, “তোমরা যারাই হও ফিরে যাও। স্পেনের শাহানশাহর বাদশাহী এক সমুদ্র হতে অপর সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। তার তলোয়ারের ভয়ে পুরো ইউরোপ প্রকম্পিত হয়। তোমাদের প্রতি তিনি অনুগ্রহ করছেন তোমরা ফিরে যাও তাহলে তার তলোয়ার কোষবদ্ধ থাকবে তা নাহলে তোমরা নিজদের পরিণাম চিন্তে কর।”
তারেক ইবনে যিয়াদকে বুঝিয়ে দেয়া হলো তারা কি ঘোষণা করছে, তারেক ইবনে যিয়াদ তার জবাব বাতলিয়ে দিয়ে বললেন স্পেনী ভাষায় তা এলান করার জন্যে। এলানের জওয়াব দেওয়ার জন্যে আওপাস ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“স্পেনের শাহানশাহকে তারেক ইবনে যিয়াদের সালাম। শাহান শাহে মুয়াজ্জম! আমরা ফিরে যেতে পারি না, আমরা আমাদের তাবৎ জাহাজ-কিস্তি জ্বালিয়ে দিয়েছি। আমরা শাহানশাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যে তিনি আমাদের জন্যে সমুদ্রে নৌকার পুল তৈরী করে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর নির্দেশে এসেছি, এখন স্পেনের বাদশাহর হুকুমে ফিরে যেতে পারি না।”
অপর প্রান্ত হতে বর্বর ভাষায় এলান হলো,
শাহান শাহে রডারিকের মুকাবালার জন্যে সম্মুখে অগ্রসর হলে আল্লাহ তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। তোমরা হলে দস্যু কওম, আমরা তোমাদেরকে শেষবারের মত……
কথা শেষ না হতেই মুসলমানদের কামান হতে তিনটি তীর গিয়ে এলানকারী জেনারেলের বুকে বিদ্ধ হলো। সে ঘোড়া হতে নিচে পড়ে গেলে স্পেনের এক ঘোড় সোয়ার তরিঘড়ি করে মুমূর্ষ জেনারেলকে নিজের ঘোড়ায় উটিয়ে নিয়ে গেল।
***
রডারিক সৈন্য বাহিনীর সম্মুখে ছিল না, তার পতাকা পিছনে দেখা যাচ্ছিল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার ছিল। সে যখন জানতে পারল, মুসলমানরা তার এক জেনারেলকে হত্যা করেছে তখন সে আক্রমণ করার নির্দেশ দিল। যুদ্ধের নিয়ম নীতি ও পরিচালনার ব্যাপারে তার অত্যন্ত সুনাম ছিল। সে যে প্লান বানিয়েছিল তার জেনারেলরা তা পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করে নিয়েছিল।
রডারিক তার জেনারেলদেরকে বলেছিল, দু’তিন দল মিলে আক্রমণ করা হবে। এক সাথে বেশী ভীড় করলে তোমাদের নিজেদের তীরে জখম হয়ে ও নিজেদের ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে তোমরা নিজেরাই মারা যাবে। ভীড়ের মাঝে সিপাহীরা ঠিকমত তীর চালাতে পারবেনা। তাই প্রত্যেক বার হামলা হবে দুতিন দলের মাধ্যমে এবং তাহবে নতুন নতুন দল। দুশমনের সংখ্যা খুবই স্বল্প। তাদেরকে পর্যায়ক্রমে যুদ্ধ করাতে হবে যাতে তারা বিশ্রামের সুযোগ না পায়। যুদ্ধের ক্ষণ দীর্ঘ করতে হবে যাতে দুশমনরা আমাদের তলোয়ারে কিছু খতম হয় আর বাকীরা যেন এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, কোথাও এক জায়গায় জমে লড়াই করা যাবে না। আঘাত হেনেই কেটে পড়বে। কেটে পড়ার সময় এলোমেলো হয়ে যাবে, যাতে করে তোমাদের পিছু পিছু যে দুশমনরা আসবে তারাও যেন এলো-মেলো হয়ে যায়। দুশমনদেরকে পাহাড়ের আড়ালে আনবে তাহলে তাদেরকে তীরন্দাজরা আঘাত হানতে পারবে।
তারেকের প্লান ছিল গেরিলা যুদ্ধের। কারণ এত স্বল্প সংখ্যক বাহিনী নিয়ে রডারিকের বৃহৎ বাহিনীর সাথে এক জায়গাতে স্থির থেকে সামনা-সামনি যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু গেরীলা যুদ্ধ কোন সহজ যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ কেবল বিজ্ঞ জেনারেলই পরিচালনা করতে পারে।
রডারিক হামলার নির্দেশ দিয়ে দিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তিন-চার দলকে সম্মুখে অগ্রসর করলেন, তারা এমনভাবে লড়াই করতে লাগল যেন তারা পলায়নের জন্যে ব্যস্ত। তারা এমনভাবে আস্তে আস্তে পিছু হতে লাগল যে, স্পেন ফৌজ তা বুঝতেও পারলনা। মুসলমানরা একটা পাহাড়ের আড়ালে এসে-ডানে বামে চলে গেল। এরি মাঝে পাহাড়ের চূড়া হতে স্পেনী ফৌজের ওপর বর্শা ও তীর, বৃষ্টির ন্যায় অবিরাম বর্ষণ হতে লাগল। এসকল তীর-বর্শা তিতুমীরের ফৌজ হতে হাসিল হয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ ওঁত হতে তীর-বর্শা নিক্ষেপের কৌশল শিক্ষা দিয়ে ছিলেন।
তারেকের যেসব সৈন্য ডানে-বামে এলো-মেলো হয়ে চলে গিয়েছিল তারা কিছুদূর গিয়ে একত্রিত হয়েগেল। দুশমনরা তীরের আঘাতে যখন পিছু হটতে লাগল তখন ডান-বাম হতে মুসলমানরা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করল। দুশমনরা দিশেহারা হয়ে, এলো-মেলোভাবে পলায়ন করতে লাগল। প্রতিরক্ষার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা অসহায়ভাবে নিহত হতে লাগল।
যুদ্ধ বিশারদ ঐতিহাসিকরা লেখেন, এর দ্বারা মুসলমানদের সিপাহ্ সালারের যুদ্ধ কৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু মুসলমান ফৌজের ব্যাপারে স্পেনী ফৌজের মাঝে যে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল তা তাদের যুদ্ধ মনোবল দুর্বল করে দিয়েছিল।
এদিন রডারিক আরো কয়েকটি দলের মাধ্যমে আক্রমণ করাল এবং ভালভাবে সৈন্যবাহিনীকে বলে দিল মুসলমানরা পিছু হটলে তাদের পিছু পিছু যেন তারা না যায়। এখন মুসলমানদের পিছু হটার প্রয়োজন ছিল না। তাদের ওপর যখন আক্রমণ হলো তখন তারা টিলার মাঝে আশ্রয় নিল এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। স্পেন ফৌজও তাদের মত এলো-মেলো হয়ে গেল। তারপর মুসলমানরা টিলার ওপর থেকে তাদের ওপর এমন আক্রমণ করল যে তাদের অপ্রত্যাশিতভাবে প্রচুর জীবন নাশ হয়ে গেল। মুসলমানরা পিছু হটার কৌশলে তাদের প্রতি আক্রমণ করতে লাগল। তারপর হঠাৎ করে মুসলমানরা সব একত্রিত হয়ে বেষ্টনি দিয়ে স্পেন ফৌজকে ঘিরে ফেলে সম্মুখে বীর বিক্রমে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে এমনভাবে সংকুচিত করে ফেলল যে তারা তলোয়ার চালানোরও সুযোগ পেল না। মুসলমানরা তাদেরকে কচু কাটা করল। সূর্য অস্তমিত হলো। ময়দানে রডারিকের ফৌজের লাশের স্তূপ পড়ে রইল তা দেখে তারা আঁতকে উঠল।
অর্ধ রাত্রি। রডারিকের ফৌজ গভীর নিদ্রায় অচেতন। পাহারাদার ঘুরাফেরা করছে। হঠাৎ এক পাহারাদের বুকে খঞ্জর বিদ্ধ হলো। এভাবে আরো কয়েকজন পাহারাদারের অবস্থা এমন হলো। একদিক পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ হয়ে গেল। ফৌজ তাবু ছাড়া ছিল। ঘোড়া ফৌজের কাছেই বাঁধা ছিল।
পাহারাদার নিহত হবার পর ছয়জন মুসলমান ধীরপদে অত্যন্ত সতর্কার সাথে ঘোড়ার কাছে পৌঁছে ঘোড়ার রশি কেটে দিয়ে খঞ্জর মেরে জখম করে ছেড়ে দিল। প্রায় দেড়শত ঘোড়া তারা এমন করল। ঘোড়া আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে. লাগল এবং মাটিতে যে সব ফৌজ শুয়েছিল তাদেরকে পিষে ফেলল। এভাবে আঘাত প্রাপ্ত ঘোড়া অসংখ্যক সৈন্যকে পদতলে পৃষ্ঠ করে খতম করে দিল।
এ কর্ম সমাপ্ত করে জানবাজ মুজাহিদরা সেখান তেকে অত্যন্ত সুস্থ সুন্দরভাবে ফিরে এলো। তারা যখন তাদের ক্যাম্পে পৌঁছল তখন সেখানে পর্যন্ত রডারিকের ফৌজের শোর-গোল শুনা যাচ্ছিল। তখনও ঘোড়া ছুটাছুটি করছিল। কোন সাধারণ ঘোড়া ছিল না তা ছিল যুদ্ধ ঘোড়া, তাই তাদের সহজে আয়ত্বে আনা সম্ভব ছিল না। রডারিকসহ তামাম ফৌজ জেগে উঠেছিল।
মশাল জ্বালান হলো। একটা ঘোড়াকে খুব কষ্ট করে ধরা হলো। ঘোড়ার পিঠ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। রডারিক পেরেশান হয়ে পড়ল। এ ঘোড়া জখম হলো কি করে। আরো কিছু ঘোড়া ধরে আনা হলো সবগুলোর বদন হতে প্রবল বেগে রক্ত বেরুচ্ছিল।
রডারিক : এটা দুশমনের রাতের কাণ্ড। রাতে যারা পাহারায় ছিল তাদেরকে অশ্বের পিছু বেঁধে টেনে-হেঁছড়ে চামড়া ছুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ কর।
পাহারাদারদের তালাশ শুরু হলো। অনেকক্ষণ পরে তিন জনের লাশ পাওয়া গেল।
***
রাত্রি শেষে যখন দিনের আলো প্রকাশ পেল তখন ময়দানের ভয়াবহতা চোখে পড়ল। ময়দানে কেবল লাশ আর লাশ। ময়দান হতে লাশ না উঠিয়ে রডারিক বড় ভুল করেছিল। আগে থেকে ফৌজের মাঝে আতংক বিরাজ করছিল, ময়দানে বিপুল পরিমাণ মৃতদেহ দেখে সে আতংক তুফান আরো বেড়ে গেল। রডারিকের উচিৎ ছিল রাতেই লাশ উঠিয়ে সমুদ্রে ফেলার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সে হয়তো একথা ভেবে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলমানরা এক রাতে এত পরিমাণ ফৌজ খতম করল কিভাবে। তার ধারনা ছিল, মাত্র কয়েকটি দল আক্রমণ করলেই এ স্বল্প সংখ্যক মুসলমান পলায়ন পদ হবে কিন্তু প্রথম দিনের যুদ্ধে তার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রডারিক তার জেনারেলদেরকে ডেকে বলল, ময়দানে তোমাদের ফৌজের যে পরিমাণ লাশ দেখছ এ পরিমাণ মুসলমানদের লাশ আজকে আমি চাই। তোমাদেরকে আজ অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে।
একজন জেনারেল বলল, আজ আমরা বিপুল সৈন্য নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করব।
তিতুমীর বলল, পাহাড়ের অভ্যন্তরে গিয়ে আমরা তাদেরকে খতম করব। তিতুমীরের উদ্দেশ্যে রডারিক বলল, তোমার মাথায় যদিএতটুকু বুদ্ধিই থাকত তাহলে তুমি তাদের হাতে মার খেয়ে পলায়ন করতে না। তুমি যদি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ কর তাহলে না তুমি জীবিত ফিরে আসবে না তোমার সিপাহী। অন্য জেনালেরকে লক্ষ্য করে বলল, আর তুমি বলছ, বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করবে। তুমি কি কালকে দেখনি? তারা প্রথমে তোমাদেরকে এলোমেলো করেছে তারপর একজায়গায় একত্রিত করে ভিড় সৃষ্টি করে সবাইকে খতম করে দিয়েছে… তুমি কি জানো যে দুশমনের সামনে ভীড় করা লোকসান?
আজ স্বল্প সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করবে, একজন মুকাবালা করবে একজনের। নিজেদের মাঝে এতটুকু দূরত্ব রাখবে যাতে আরামে তলোয়ার চালান যায়। আজকের হামলাতে অর্ধেক সোয়ারী অর্ধেক পায়দল থাকবে।
এদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ কয়েকজন পায়দল সৈন্যদল নিয়ে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি প্রথমে আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন না। প্রথমে দুশমনকে আক্রমণের সুযোগ দিতেন যাতে তাদের কৌশল ও যুদ্ধের প্রক্রিয়া বুঝা যায়।
রডারিকের পরিকল্পনা মুতাবেক তার ফৌজ গতকালের মত দ্রুত বেগে সম্মুখে অগ্রসর হলো না বরং মধ্যম গতিতে সামনে বাড়তে লাগল। তারা সামনে-পিছনে তিন সারিতে সারিবদ্ধ ছিল। প্রথম সারিতে ছিল ঘোড় সোয়ার। তারা মুসলমানদেরকে দেখামাত্র দ্রুত বেগে ধেয়ে আসল। মুসলমান পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল। তারা সকলেই পায়দল ছিল। একজন সোয়ারীও দেখা যাচ্ছিল না। মুসলমানদের পক্ষ হতে যুদ্ধের নাকারা বেজে উঠল। স্পেনী ঘোড় সোয়াররা পূর্ব হতেই বর্শা প্রস্তুত করে রেখেছিল। কিন্তু তারা যখন মুসলমানদের কাছে পৌঁছল তখন মুসলমানরা তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিল। তারা সকলেই হঠাৎ করে বসে পড়ল ইতিমধ্যে তেজবেগে ঘোড়া তাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেল। ঘোড়া থামাতে পারল না। যখন তারা ঘোড়া থামিয়ে পিছে ফিরে আসছিল ততক্ষণে মুসলমানরা দুশমনের পায়দলবাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে পূর্ণদমে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ঘোড় সোয়াররা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারল না কারণ তাদের নিজেদের পায়দল সৈন্যও তাদের সম্মুখে পড়ছিল। ঘোড় সোয়ার যখন আরো সম্মুখে গিয়ে পিছে ফিরে আসছিল তখন একটা বড় টিলার পশ্চাৎ হতে হঠাৎ মুসলমানদের ঘোড় সোয়ার বেরিয়ে রডারিকের সোয়ারীদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসল। আক্রমণ রডারিক বাহিনীর কাছে অকল্পনীয় ছিল। তারা বুঝে ওঠার পূর্বেই মুসলমানদের তলোয়ারে কচু কাটা হলো।
স্পেনীদের অন্য আরেকদল ঘোড় সোয়ার যখন মুসলমান ঘোড় সোয়ারদের দিকে যাচ্ছিল তখন তারা দ্রুত বেগে ঘোড়া ফিরিয়ে যে পাহাড় এবং টিলা হতে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।
স্পেনী জবানে বার বার আহ্বান হতে লাগল ফিরে এসো! ফিরে এসো। পাহাড়ের মাঝে খবরদার যেওনা।
স্পেনী সোয়ার যখন ফিরে আসতে লাগল তখন মুসলমান সোয়ারীরা পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করে তাদেরকে খতম করতে লাগল এবং আক্রমণ করেই তারা দ্রুতপদে পালিয়ে যেতে লাগল।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, উভয় পক্ষের সৈন্যরা বীরত্ব প্রদর্শন করতে ছিল কিন্তু মুসলমানদের মাঝে যে স্পৃহা ছিল স্পেনীদের মাঝে তা ছিল না। মুসলমানরা ছিল বর্বর আর বর্বররা যুদ্ধ-বিগ্রহে ছিল আগ্ৰহী অধিকন্তু ছিল দক্ষ। তাদের হত্যাযজ্ঞের কথা ছিল মাশহুর। ইসলাম গ্রহণের পর কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল, যার ফলে তাদের যুদ্ধ স্পৃহা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
স্পেন ফৌজ মুসলমানদের মুকাবালায় টিকে থাকতে পারল না, তারা পিছু হটতে লাগল। স্পেন সোয়ারীদেরকে মুসলমান সোয়ারীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেরেশান করে তুলেছিল। স্পেনীরা এলো-মেলো হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা একাই কয়েকজন সোয়ারকে খতম করছিল কিছু সোয়ারীকে তো তারা ঘোড়াসহ জীবিত ধরে নিয়ে এসেছিল। মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনীতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল, ক্রমেই যুদ্ধে দামামা-নাকারার আওয়াজ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যুদ্ধের ময়দানের জন্যে বর্বরদের বিশেষ নাকারা ছিল যা তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাজান জরুরী মনে করত।
রডারিকের ফৌজের মাঝে পূর্ব হতেই যে আতংক বিরাজ করছিল তা যুদ্ধের ময়দানের স্পৃহা তাদের খতম করে দিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল।
***
রডারিকের নির্দেশে রাত্রে ক্যাম্পের চতুর্দিকে পাহারা জোরদার করা হলো। তারপরও কিছু জানবাজ মুজাহিদ ক্যাম্পে পৌঁছে বহু সৈন্য হত্যা করে ঘোড়ার ওপর তীর চালিয়ে তা বেকার করে দিয়ে আসল।
সকালে অগ্নিশর্মা হয়ে রডারিক বলল,আজকে হবে শেষ লড়াই। আজ আমি স্বয়ং নিজে অগ্রভাবে থাকব। এক গোথা জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল, গোখা সিপাহীদেরকে আমি এখনো অগ্রে পাঠাইনি, তুমি তোমার গোথা জানবাজদেরকে বলে দাও আমি এখন বিজয়ের একমাত্র ভরসা তোমাদের ওপর করছি। আমার। কওমের বাহিনীরা আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।
এ জেনারেলের সাথেই মেরীনা কথা বলে তার পক্ষে আনতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সে সক্ষম হয়নি পরিশেষে এক সুন্দরী লাড়কীর লোভ দেখিয়ে ছিল। তার সে প্ল্যানও বাস্তবায়ন হয়নি, ইহুদী জাদুকর তাকে জবাই করার জন্যে নিয়ে গেলে তা ভেস্তে গেছে।
যুদ্ধের তৃতীয় দিন গোথারা যুদ্ধের জন্যে সম্মুখে আসল। তাদের পিছনে ছিল অন্য কওমের সৈন্য বাহিনী। পিছনের বাহিনীর সাথে রডারিকও ছিল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার ছিল। মাথার ওপর পতাকা উড়ছিল। চতুরপার্শ্বে ছিল তার মুহাফেজ বাহিনী।
তারেক ইবনে যিয়াদ রডারিকের পতাকা দেখে তার ঘোড়া ছুটিয়ে তার সৈন্য বাহিনীর সম্মুখে চলে গেলেন। তারেকের পিছনে তার রক্ষী বাহিনী গেলে তিনি তাদেরকে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। আর মুগীছে রূমীকে কাছে ডেকে তার কানে কানে কিছু বললেন। মুগীছে রূমী স্পেনী ভাষা বুঝত এবং বলতে পারত। সে তারেক ইবনে যিয়াদের কথা শুনে সম্মুখে চলে গেল।
মুগীছে রূমী এলান করল, “আমরা শাহান শাহে উন্দুলুসকে স্বাগতম জানাচ্ছি, আমাদের সিপাহ্ সালার তারেক ইবনে যিয়াদ বলছেন, বাদশাহ্ রডারিক যদি যুদ্ধের জন্যে এসে থাকেন তাহলে তিনি যেন আমাদের মত রক্ষী বাহিনী ছাড়া একাকি সম্মুখে আসেন।”
রডারিক ঘোষণা করাল, আমার মত কোন বাদশাহ যদি তোমাদের মাঝে থাকত তাহলে আমি তোমাদের সম্মুখে যেতাম। দস্যু সর্দারের সামনে যাওটা বাদশাহ্র মর্যাদাহানী। তোমাদের বাদশাহকে সাথে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ এলান করালেন, “আমরা তোমাকে অচিরেই আমাদের বাদশাহ্র কাছে পৌঁছে দেব। আমাদের বাদশাহ্ আল্লাহ্, আমরা কোন মানুষকে বাদশাহ্ বানাইনা। আমাদের সকলের বাদশাহ্ আল্লাহ এ পয়গাম ও তোমাদের বাদশাহী, চিরতরে খতম করার জন্যে এসেছি।’
গোথা জেনারেলের নাম ধরে আহ্বান করে রডারিক বলল, সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দাও।
গোথা জেনারেল উচ্চধ্বনি দিতে বলল, প্রবল বেগে আগ্রমণ কর হে আহলে গোথা! একথা বলেই সে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিল।
তার নিজস্ব সোয়ারীদের মধ্য হতে এক সোয়ারী পিছন দিক হতে এসে তার পিঠে প্রবল বেগে বর্শার আঘাত হানল। তারপর পিঠ হতে বর্শা বের করে পূনঃবার মারল। জেনারেল ঘোড়া হতে পড়ে গেল। গোথা কওমের সৈন্যরা তলোয়ার কোষবন্ধ করে মুসলমানদের সাথে গিয়ে মিলে গেল। তাদের মাঝে সোয়ারী ও পায়দল উভয়দল ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তো আগে থেকেই জানতেন যে গোথা ও ইহুদীরা তাদের সাথে মিলে যাবে কিন্তু তারেকের ফৌজরা ছিল পেরেশান, এ আবার কেমন হামলাকারী যে তারা তলোয়ার কোষবদ্ধ করে রেখেছে।
তারেক ঘোষণা দিলেন, তাদেরকে ইস্তেকবাল কর, তারা তোমাদের দোস্ত, এখন থেকে তারা তোমাদের সাথী।
অপরদিকে রডারিক হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছিল একি? তারা কোথায় যাচ্ছে? তারা তাদের জেনারেলকে হত্যা করল?
তার এসব প্রশ্নের জওয়াব দেয়ার কেউ ছিল না। এটা ছিল মেরীনা ও আওপাসের গোপন পরিকল্পনার ফসল। গোখাদের সংখ্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা দ্বিমত পোষণ করেছেন, কেউ বলেছেন, বিশ হাজার কেউ পঁচিশ বলে জ্ঞান। করেছেন। আবার কেউ পনের-বিশ হাজার বলে ধারণা করেছেন।
রডারিকের প্রশ্নের জওয়াব দেয়ার জন্যে এক গোথা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উচ্চস্বরে বলল,
আমরা আমাদের বাদশাহ্ ডেজার প্রতিশোধ নেব। স্পেনের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী গোথা কওম। রডারিক! তুমি গোথাদের রাজত্ব খতম করে নিজে ক্ষমতার মসনদে হয়েছ আসীন, এবার দেখবে আমরা আমাদের অধিকার কিভাবে আদায় করি।”
***
লড়াই ছাড়াই যুদ্ধের রূপ পাল্টে গেল। আগের দিন রডারিক প্রবলবেগে আক্রমণ করিয়ে ছিল, কিন্তু প্রতিটি আক্রমণই ব্যর্থ হয়েছে। মুসলমানদের সংখ্যা এক সাথে বিশ হাজার বৃদ্ধি পেল। আর এ সংখ্যা কেবল নামকা ওয়াস্তে ছিল না বরং তাদের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলছিল প্রতিশোধের অনির্বাণ শিখা।
সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে তারেক ইবনে যিয়াদ যুদ্ধ পলিসি পরিবর্তন করলেন এবং গোথাদের মাঝ থেকে একজনকে জেনারেল নিয়োগ করলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে সম্বোধন করে বললেন,
“কে বলবে যে, আমার রাসূলুল্লাহর (স) ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিতহবে না…। আল্লাহর সাহায্য যখন আসে তখন তার বান্দার তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে যায়। আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই তার মাহবুবের সুসংবাদ বাস্তবায়ন করবেন। তোমরা সকল ফৌজুকে বলে দাও তারা যেন আল্লাহর দরবারে মাথা নত রাখে আর দিলে কেবল যেন আল্লাহর নাম স্মরণ করে।
অপরদিকে সমুদ্র তীরে এক জাঁকজমকপূর্ণ তাবুতে রাগে-দুঃখে বাদশাহ রডারিক দাঁতে দাঁত পিষছিল। কখনো সে বসছিল কখনো আবার লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে তাবুর মাঝে পায়চারী করছিল। আবার কখনো মাথা-বুক থাপড়াচ্ছিল। দু’জন জেনারেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পরিশেষে একজন বয়স্ক জেনারেল, রডারিক যাকে অত্যন্ত সম্মান করত, সে কামরায় প্রবেশ করে বলল,
বাদশাহ নামদার! আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। গোখারা প্রতারণা করেছে তাতে কোন অসুবিধা হবে না। আমরা তাদের বংশ নিপাত করে দেব।
মাটিতে স্বজোরে পদাঘাত করে গর্জে উঠে রডারিক বলল, আমাদের বংশই নিপাত হবার পথে। যা বলছ তার কাবেল যদি তোমরা হতে তাহলে প্রথমদিনই এ, লড়াই খতম হয়ে যেত। তোমরা দুশমনের কি ক্ষতি করতে পেরেছ? যারা সংখ্যার দিক থেকে মানুষের পায়ের নিচে পিপড়ার ন্যায়। কিন্তু এ পিপড়া এখন আমাদের অস্তিত্ব বিনাশের পথে। দুশমন কমজোর হবার চেয়ে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠল।… আমার সম্মুখ থেকে বেরিয়ে যাও।
জেনারেল চলে না গিয়ে শুরাতে শরাব ঢালল।
জেনারেল পিয়ালা রডারিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমরা শাহানশাহ্ কে এ অবস্থায় দেখতে চাই না। এ পিয়ালা পান করে নিজেকে সামলে নেন।
রডারিক পিয়ালা নিয়ে স্বজোরে ছুঁড়ে ফেলে তা ভেঙ্গে খানখান করে ফেলল।
রডারিক : তোমরা আমার বুদ্ধিমত্তা খতম করতে চাও, তোমরা আমাকে বাস্তবতা ভুলে যেতে বলছ।
জেনারেল রডারিকের খিমা থেকে বেরিয়ে আওরতদের খিমার দিকে গিয়ে একজন নওজোয়ান সুন্দরী লাড়কীকে সাথে করে নিয়ে এলো যে রডারিকের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। সে লাড়কীকে খিমাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই লাড়কী খিমা হতে বেরিয়ে এলো। রডারিক লাড়কীকে খুব তীব্রভাবে ধাক্কা দিয়ে ছিল ফলে লাড়কী বের হয়ে আওরতদের খিমার দিকে চলে গেল।
***
রডারিক বুড়ো জেনারেলকে আহ্বান করল। জেনারেল দৌড়ে রডারিকের খিমাতে পৌঁছল।
হতাশভাবে রডারিক জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল, সম্ভবত ঐ ইহুদী গণক ব্যর্থ হয়েছে। সে বলেছিল, একজন নওজোয়ান লাড়কীকে জবেহ করলে আমার মন্দ পরিণাম (বদফালী) দূরিভূত হবে। আমি তাকে লাড়কী দিয়েছি। সে হয়তো তাকে জবেহ করেছে… কিন্তু… বেকার হয়ে গেছে…। ইহুদী আমাকে ধোকা দেয়নি তো?
জেনারেল : আমি এখনই এক সোয়ারীকে টলেডো প্রেরণ করছি, সে সংবাদ নিয়ে আসবে।
পরাস্ত আহত সৈনিকের মত হতাশার স্বরে রডারিক বলল, সে কবে পৌঁছবে। আর কবে বা ফিরে আসবে!
হিরাক্লিয়াসের দুর্গ খোলা আমার ঠিক হয়নি। দুর্গের রক্ষক দুজন পাদ্রী আমাকে বাধা দিয়েছিল। তুমি আমার সাথে ছিলে তুমিও আমাকে বুঝিয়ে নিষেধ করেছিলে।
জেনারেল : শাহানশাহ্! পিছনের কথা ভুলে যান এবং সন্দেহ মন থেকে বের করে দেন।
রডারিক : সন্দেহ ও হতাশার হাত থেকে আমি কিভাবে মুক্তি পাব? তুমি কি লক্ষ্য করছে না, দুর্গে আমরা যুদ্ধের যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা প্রতিদিন এখানে প্রত্যক্ষ করছি। মুসলমানদের যে ধ্বনি শুনে ছিলাম তাই শুনছি। আমরা ফৌজকে দুর্গের দৃশ্যের পিছু হটতে দেখছি। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। আমি দেখেছিলাম আমার ঘোড়া আমাকে ফেলে পালিয়ে চলে যাচ্ছে। আর যে লাড়কীকে পামপিলুনাতে হত্যা করেছিলাম সে লাড়কী আবার আমার স্বপ্নরাজ্যে এসে ভীড় করছে।
ঐতিহাসিক লেইনপোল তৎকালের স্পেন ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেছেন, “দুর্গ ও হত্যাকৃত কিশোরী” রডারিকের ওপর প্রেতাত্মার ন্যায় সোয়ার হয়েছিল। যে ইহুদীগণক এর হাত থেকে মুক্তি দেয়ার কথা বলেছিল মেরিনা তাকে হত্যা করেছিল। বিশ-পঁচিশ হাজার গোথা ফৌজ কেবল রডারিকের পক্ষই ত্যাগ করেনি বরং তার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তারপরও তার কাছে বেশ অনেক সৈন্য ছিল কিন্তু সে সব সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। যুদ্ধ ময়দানের কর্তৃত্ব পুরোদমে তারেকের দখলে ছিল। তারেক কোন সন্দেহ ও দুষ্ট আত্মার হাতে গ্রেফতার ছিল না। তার মনে পাপের অনুশোচনা ছিল না; তার দৃঢ় বিশ্বাস তার মনোবলকে আরো বাড়িয়ে ছিল। পক্ষান্তরে রডারিকের অন্তর-মন পাপের প্রায়শ্চিত্তের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। হিসেব-নিকেসের দিন তার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল।
***
যুদ্ধের আঠারতম দিনের সূর্য উদিত হলো। রডারিক তার তামাম ফৌজকে অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে ময়দানে দাঁড় করাল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার। ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে ফৌজের মাঝে এলান করতে লাগল, আজকে যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছাবে। তোমরা যদি দুশমনকে পরাজিত করতে পার তাহলে এত বিপুল পরিমাণ ইনয়াম তোমাদেরকে দেব তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও শাহান শাহ্ রডারিককে স্মরণ করবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : হে গোথা সম্প্রদায় তোমরা যদি আজ পরাজিত হও তাহলে, স্পেন হতে তোমাদের বংশ নির্মূল করা হবে। তোমাদের কোন আওরত ও কোন বাচ্চা রডারিক জীবিত রাখবেনা। আর হে বর্বর কওম! তোমরা কখনো কোন দিন কারো কাছে পরাজিত হয়েছ। তোমরা যদি পরাজিত হও, তাহলে কোথায় যাবে? তোমরা এই প্রথম অন্যদেশে এসেছ। আরবী মুসলমানরা কয়েকটি মূলককে ইসলামী সালতানাতে শামিল করতে সক্ষম হয়েছে। তোমাদের আরবী ভাইরা বলবে যে, বর্বররা অন্যদেশে গিয়ে যুদ্ধ করার কাবেলই ছিল না, এটা তোমরা পছন্দ কর?
বর্বর লস্কর হতে বুলন্দ আওয়াজ উঠল, নেহী তারেক! নেহী! আমরা তোমার সাথে আছি এবং তোমার সাথেই থাকব।
রডারিক : আক্রমণকারীদের ধ্বনীতে ভয় পেওনা। এরা কোন বাদশাহর ফৌজ নয়, এরা দস্যু, ডাকাতের দল।
ফৌজদের স্পৃহা, উদ্দীপনা বাড়াবার উদ্দেশ্যে তারেক বলছিলেন, হে আহলে ইসলাম! বিজয় তোমাদেরই, তোমরা দুশমনের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করতে পেরেছ। আর এটা ভুলে যেওনা যে, এ হাজার হাজার গোথারা তাদের জালেম ও উৎপীড়ক বাদশাহর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে এসেছে। আল্লাহর হুকুম কোন অসহায় বস্তির ওপর জুলুম হলে সেখানে তোমরা সহায়ের হাত বাড়াও। তোমাদের গোথা ভাইদেরকে এ জালেম বাদশাহর হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দাও।
বর্বরদের পক্ষ হতে ধ্বনী উঠল, আমরা জান কুরবানী করেদেব তারেক! আমরা জীবন উৎসর্গ করে দেব।
***
রডারিক হামলা করার নির্দেশ দেয়া মাত্র তার সোয়ারীরা উম্মাদের ন্যায় ছুটে এলো। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সোয়ারীদলকে সামনের কাতারে রেখেছিলেন। যখন দুশমনের সোয়ারী কাছে চলে এলো তখন হঠাৎ করে পায়দল তীর আন্দাজদল সম্মুখ ভাগে চলে গেলো। তারা খুব দ্রুততার সাথে স্পেনীদের ওপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। বর্বরদের কামান ছিল খুব শক্তিশালী। তা হতে নিক্ষিপ্ত তীর খুব দ্রুততার সাথে অনেক দূরে যেত।
বেশ কিছু স্পেনী ফৌজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কিন্তু ঘোড়ার তেজ কমল না। যখন তারা একেবারে কাছে চলে এলো তখন পায়দল তীর আন্দাজ নিজেদের সোয়ারীর পিছনে চলে গেল। মুসলমান সোয়ারী পূর্ব হতেই তৈরী ছিল। উভয় পক্ষের মাঝে মুকাবালা শুরু হয়ে গেল। যখন সোয়ারীরা এলোমলো হয়ে গেল তখন তারেকের ইশারায় পার্শ্বদেশ হতে গোথা দল বেরিয়ে স্পেনীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে বসল।
রডারিক এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখছিল কিন্তু সে আর স্থির থাকতে পারল না। সে পায়দল বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিল।
তারেক এবার বিশেষ পলিসি চালতে লাগলেন। তিনি গোথাদেরকে সামনাসামনি যুদ্ধ করতে বললেন। আর মুসলমান ফৌজকে ডানে-বামে পাঠিয়ে দিলেন। একদিকে মুগীছে রূমী আর অপরদিকে গেলেন আবু জুরয়া তুরাইফ। তারা বহুদূর ঘুরে নিজ নিজ জায়গায় পৌঁছে গেল।
রডারিক পূর্ণ দমে আক্রমনের জন্যে অগ্রসর হচ্ছিল। রডারিকের চতুরপার্শ্বে যে সৈন্য বাহিনী ছিল, মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ তাদের ওপর বীর বীক্রমে আক্রমণ করে বসল। এ হামলাতে স্পেনী ফৌজ পুরোদমে ঘাবড়ে গেল। ব্যাপারটা রডারিক নিজেও বুঝে উঠতে পারল না।
তার সৈন্যরা এ হামলার মুকাবালা করা তো দূরের কথা তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। যারা আত্মসমর্পণ করল তারাই কেবল মুজাহিদদের হাত থেকে রেহায় পেল।..
ইতিহাসবিদরা লেখেন, ঐতিহাসিক যুদ্ধসমূহের মাঝে এটা একটা অন্যতম। এ যুদ্ধে যেমন বীরত্ব প্রদর্শিত হয়েছে তেমনিভাবে মুসলমানদের পক্ষ হতে যে যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে অন্য কোন যুদ্ধে তা খুব কমই পরিলক্ষিত হয়েছে।
এ ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝেও এক ব্যক্তি উম্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে যেন কাউকে তালাশ করছে এমনভাবে ঘুরছিল। এ বাদামী রং এর যুবক সাগর তীর পর্যন্ত এভাবে পৌঁছে ছিল। এভাবে ঘুরে ফিরে যাকে তালাশ করছে তাকে যেন পাচ্ছে না। এ যুবকই হলো হিজি যে রডারিকের মস্তক কর্তন করে আনার ব্যাপারে ফ্লোরিডার কাছে প্রতিশ্রুত বদ্ধ হয়েছিল। রডারিককে তালাশ করছিল।
রডারিকের ঝান্ডা দেখা যাচ্ছিল না। অনেক পূর্বেই ঝান্ডা পতিত হয়েছিল। স্পেনীরা হাল ছেড়ে দেয়ার এটাও একটা কারণ ছিল যে তাদের শাহী ঝান্ডা পড়ে গিয়েছিল, এর অর্থ হলো হয়তো বাদশাহ্ নিহত হয়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে। হিজি সাগর পাড়ে রডারিকের ঘোড়া দণ্ডায়মান দেখতে পেল কিন্তু তাতে রডারিক সোয়ার ছিল না। ঘোড়র কাছেএকটি তলোয়ার পড়েছিল। যার হাতলে মূল্যবান মনি-মুক্তা খচিত। এটা যে রডারিকের তলোয়ার তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে রডারিকের পাদুকাও তলোয়ারের কাছে পড়ে ছিল।
হিজি মহিলাদের তাবুতে চলে গেল। সেখানে রডারিকের হেরেমের রমণীরা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছিল। হিজি তাদেরকে ধমক দিয়ে রডারিকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। তারা সকলে এক জবাব দিল যে তারা কেউ তার ব্যপারে কিছু জানে না।
হিজি দ্রুত এসে রডারিকের তলোয়ার ও জুতা উঠিয়ে তার ঘোড়াতে আরোহন করে দ্রুত বেগে তা হাঁকিয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে লাগল রডারিক নিহত হয়েছে। রডারিক নিহত হয়েছে। এ এলান করতে করতে সে তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছে ঘোড়া ও পাদুকা পাওয়ার ঘটনা বর্ণনা কর।
আঠার দিনের যুদ্ধ শেষ হলো। লেইনপোল লেখেন, আঠার দিনের লড়াই আটশত বছরের স্পেনের রাজত্ব মুসলশানদেরকে প্রদান করে। এছাড়াও আরো কিছু যুদ্ধ মুসলমানদের করতে হয়েছিল। কিন্তু মৌলিক ভাবে যুদ্ধছিল এটাই। যা গালীদের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ।
সকল ঐতিহাসিকই একমত হয়ে লেখেছেন যে, রডারিকের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার সফেদ ঘোড়া, অলংকৃত তলোয়ার ও পাদুকা সাগরের পাড়ে পাওয়া গিয়েছিল। কেউ কেউ মত ব্যক্ত করেছেন, সে সাগরে সলীল সমাধীত হয়ে আত্মহুতি দিয়েছিল। তবে অধিকাংশরা লেখেছেন, সে পলায়ন করার মানসে সাগর পাড়ি দিচ্ছিল, কিন্তু সাগরের উত্তাল তরঙ্গ তাকে অপর পাড়ে পৌঁছাতে দেয়নি।
ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, খ্রীস্টানদের মাঝে পূর্ণমাত্রায় এ বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে, রডারিক নিহত হয়নি বরং সে রূপ-আকৃতি পরিবর্তন করে খ্রীস্টবাদের প্রচারক ও রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে স্পেন অধিবাসীদের মাঝে বদ্ধমূল ছিল। এ যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার স্পেনী ফৌজ হালাক হয়েছিল যার মাঝে উল্লেখযোগ্য জেনারেল ও স্পেনের নওয়াব ও আমীররা ছিল। আর ত্রিশ হাজার হয়েছিল কয়েদী। রন্ডারিকের ফৌজরা মুসলমানদেরকে কয়েদী হিসেবে বেঁধে নেয়ার জন্যে সাথে বড় রশী এনেছিল কিন্তু পরিণামে মুসলমানরা সে রশী দ্বারা রডারিকের ত্রিশ হাজার সৈন্য কয়েদী করেছিল।