“যারা মুসলমানদের কাছে হাতিয়ার সমর্পণ করেছে তারা ছিল বুজদিল-বেগায়রত। তারা তাদের বেটীদের দুশমনের হাতে তুলে দিয়েছে। তোমরা কি তোমাদের কন্যাদের জংলী-বর্বরদের হাতে তুলে দেবে?”
“এখন আমি স্বাধীন, এখন আমি মুক্ত!” একথা বলতে বলতে মেরীনা যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল তারেক ইবনে যিয়াদ সেদিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তিনি হয়তো চিন্তে করছিলেন, হুজুর (স) স্বপ্নে যে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন তা পূর্ণ করার জন্যে আল্লাহ্ তায়ালা অলৌকিক বহু ঘটনার অবতারনা করেছেন। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুশমন ইহুদী সম্প্রদায়ের এক ইজ্জত হারা রমণী তার নিজ গোত্রের এক যাদুকর হত্যা করেছে, যে মুসলমানদেরকে পরাজিত করার জন্যে যাদুর মাধ্যমে চেষ্টা করেছিল। তারেক গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলেন এরি মাঝে বাহিরে কয়েকজনের কথা-বার্তা শুনতে পেলেন আর দারোয়ান সামনে দন্ডায়মান হলো।
দারোয়ান : কয়েকজন ব্যক্তি সিপাহু সালারের সাথে মুলাকাত করতে চায়। সম্মতি ফিরে পেয়ে তারেক জবাব দিলেন, এ মহলে যে বাদশাহ্ ছিল সে মৃত্যু বরণ করেছে, এখন কোন বাদশাহ্ নেই যে, মুলাকাতের জন্যে ইযাযতের প্রয়োজন হবে। তাদেরকে আসতে দাও।
দারোয়ান দরজা খুলে দিলে তিনজন একটা টেবিল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, তিনজনই তারেকের ফৌজী লোক।
তারেক : এটা কি?
ফৌজ : সিপাহ্ সালার! এটা টেবিল। শহরের পশ্চাৎ দরজা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ী বের হলো। আমরা গাড়ী থামানোর নির্দেশ দিলে গাড়োওয়ান দ্রুত ঘোড়া হাকাল, এতে আমাদের সন্দেহ হলো। আমরা তাদের পিছু ছোঁড়া নিয়ে ছুটলাম। কিছুদূর গিয়ে গাড়ী থামালাম। তাতে তিন পাদ্রী ছিল। তাদের কাছে ছিল এ টেবিল। এটা স্বর্ণের তৈরী। পাদ্রীদেরকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা গাড়ী থামাতে বলার পরেও কেন তারা তা থামাল না? তারা অনুনয় বিনয় করে বলল, এটা অত্যন্ত পূত-পবিত্র ও বরকতময় এ জন্যে অন্য মাযহাবের লোকের হাতে পড়ুক এটা তারা চাচ্ছিল না। আমরা তাদেরকে আমাদের সাথে নিয়ে এসেছি।
তারেক : তাদেরকে ভেতরে আসতে বল।
তিন পাদ্রী ভেতরে প্রবেশ করল।
তারেক : এটা যদি স্বর্ণের হয় তাহলে তো এর কিমত অনেক। তোমরা ধর্ম গুরু এ অনন্য তোমাদেরকে সম্মান করি, তবে এ টেবিল তোমরা ফেরত পাবে না।
পাত্রী : এটা পূর্ণ স্বর্ণের তৈরী। তার চতুর্পাশে খচিত রয়েছে হিরা, মনি-মুক্তা মতি। মূল্যবান এ জন্যে আমরা এটা নিয়ে পলায়ন করছিলাম না, এটা একটা পবিত্র স্মৃতি। এটা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর টেবিল। স্পেনের পূর্বেকার কোন বাদশা। জেরুজালেম আক্রমণ করলে তিনি এটা সেথাকার প্রধান উপাসনালয়ে পেয়েছেন। তারপর হতে এটা ধারাবাহিকভাবে স্পেনের বাদশাত্মদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে সর্বশেষ রডারিকের কাছে ছিল। একে ক্ষমতার উৎস ধারা জ্ঞান করা হয়।
তারেক : এখন তো স্পেনের মুকুট ও সিংহাসন আমাদের কজায় ফলে এ টেবিলও আমাদের দায়িত্বে থাকবে।
তারেক পাদ্রীদেরকে তা ফেরত না দিয়ে মালে গণিমত হিসেবে নিজের কাছে। রেখে দিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদের আশে-পাশে যেসব সালার ছিল তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমীরুল মু’মিনের জন্যে এর চেয়ে চিত্তাকর্ষক হাদিয়া আর কি হতে পারে। আমি নিজে গিয়ে এ টেবিল খলীফাতুল মুসলিমীনের খেদমতে পেশ করব।
পাদ্রী : আমরা সিপাহ্ সালারকে সতর্ক করা ভাল মনে করছি। এ পর্যন্ত কোন বাদশাহ এর মালিক দাবী করেনি। সকলেই বলেছে এর মালিক হযরত সুলায়মান। আর হযরত সুলায়মান ছিলেন জিনেরও নবী তাই এর হেফাজতকারী হলো জিন। যদি সিপাহসালার বা অন্য কেউ এর মালিকত্বের দাবী করে তাহলে সে হবে লাঞ্চিত ও তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এতে সুলায়মান (আ)-এরই মালিকত্ব থাকবে। আমরা মুসলমান আর মুসলমানরা সোনা-হিরা-মতিকে নিজের মালিকানায় রাখে না। তোমরা এখন যেতে পার। শহর থেকে পলায়ন করার কোন প্রয়োজন নেই। তোমাদের গীর্জা-উপাসনালয়ে যাও। তোমাদেরকে এবং তোমাদের গীর্জার কোন অসম্মানি করা হবে না।
পরের দিন সকালে তারেক ইবনে যিয়াদ ফজরের নামাজ সমাপন করে শাহী মহলের দিকে ফিরে যাচ্ছেন এরি মাঝে ইদ্রীস আবুল কাসেম নামে এক ফৌজী কমান্ডার দৌড়ে এসে বলল,
ইবনে যিয়াদ! আপনি কি জানেন, মুসা ইবনে নুসাইর আমীরে আফ্রিকা আঠার হাজার ফৌজ নিয়ে স্পেনে এসেছেন?
তারেক জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কবে এসেছেন? তিনি কোথায়? আমার প্রত্যাশা ছিল তিনি আমার সাহায্যে অবশ্যই আসবেন।
আবুল কাসেম : স্পেনে আসা তার প্রায় এক বছর হয়ে গেল। কয়েকটি শহর যা আপনি ছেড়ে দিয়েছিলেন তা তিনি কজা করেছেন।
তারেক খুশীতে আটখানা হয়ে ধ্বণী দিলেন, মুসা ইবনে নুসাইর জিন্দাবাদ! তিনি আমার কাজ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন তাকে আমি আমীর নয় আমার বাবা মনে করি।
আবুল কাসেম : আপনি যে সব শহর বিজয় করে রেখে গিয়েছিলেন তাতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে ছিল তিনি খবর পেয়ে তা খতম করে শহর নিজ হেফাজতে রেখেছেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ মুসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বললেন, মুসা ইবনে নুসাইরকে স্বয়ং আল্লাহ্ এখানে পাঠিয়েছেন। তিনি আমার মদদে এসেছেন, এখন আমি চিন্তামুক্ত। অল্প কিছু দিনের মাঝেই পুরো স্পেন ইসলামী পতাকা তলে এসে যাবে।
আবুল কাসেম ও তারেক যখন মুসার তা’রীফে লিপ্ত সে সময় মুসা মেরীদা শহরের অদূরে তাবুতে বসে সর্বশেষ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার তাবুতে কুরাইশ গোত্রের দু’জন সম্মানিত ব্যক্তি রয়েছেন একজন আলী ইবনে উবাই অপরজন হায়াত ইবনে তামিমী।
মুসা ইবনে নুসাইর : আমি এমন অবাধ্যকে ক্ষমা করতে পারি? আমি তার কাছে নির্দেশ পাঠিয়ে ছিলাম, সে যেখানে আছে সেখানেই যেন থাকে, সামনে যেন অগ্রসর না হয়। কিন্তু সে আমার নির্দেশ অমান্য করে তার ফৌজকে তিন ভাবে ভাগ করে বড় বড় শহরগুলো বিজয় করে নিজে টলেডোতে গিয়ে বসে আছে।
হায়াত ইবনে তামিমী : অন্তত: টলেডো আপনার বিজয় করা দরকার ছিল। এখন তো খবর ছড়িয়ে যাবে যে, বর্বররা স্পেন বিজয় করেছে।
মুসা : আমি আরবদেরকে স্পেন বিজয়ী হিসেবে অবহিত করতে চাই। আমি তারেক ইবনে যিয়াদকে সিপাহ্ সালার পদ হতে অপসারণ করব।
আলী ইবনে উবাই : আরেকটা বিষয় লক্ষ্য রাখবে ইবনে নুসাইর! তারেকের কাছে যেসব মূল্যবান গণীমতের সম্পদ রয়েছে তা তুমি তার থেকে নিয়ে নিবে এবং তুমি নিজে তা খলীফার দরবারে পেশ করবে তানাহলে সে নিজেই এগুলো পেশ করে খলীফার আস্থাভাজন হয়ে যাবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ যাকে পিতা মনে করতেন সে মুসা ইবনে নুসাইর তার মদদে আসার জন্যে ভীষণ খুশী। তার আশা, অর্ধ স্পেন বিজয় করার দরুন মুসা তাকে প্রাণ খুলে অভিনন্দন ও মুবারকবাদ জানাবেন।
মুসা ইবনে নুসাইরের তিন ছেলে, আব্দুল্লাহ, মারওয়ান ও আব্দুল আজীজ। বড় ছেলে আব্দুল আজীজকে তিনি আফ্রিকাতে তার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। আর বাকী দু’জনকে নিজের সাথে রেখেছিলেন, স্পেনে এসে যখন বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে দেখতে পেলেন তখন তিনি তার বড় ছেলেকে স্পেনে নিয়ে আসা সমীচীন মনে করলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর মেরীদার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মেরীদা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর সৌন্দর্যে টলেডোকেও হার মানিয়ে ছিল। তার এ সৌন্দর্যের স্রষ্টা ছিল রুমী বাদশাহ্। রুমী তাকে কেবল সুন্দরের মহিমায় সুশোভিতই করেনি বরং তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করে ভীষণ মজবুত। সৈন্যদেরকে দিয়েছিল পর্যাপ্ত ট্রেনিং। মেয়ীদা শহর ছিল প্রাচুর্যে ভরা।’
মেরীদার দিকে মুসা ইবনে নুসাইর পূর্বেই গোয়েন্দা বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, তারা ফিরে এলে তিনি তাদের থেকে বিস্তারিত তথ্য সগ্রহ করলেন। গোয়েন্দার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, “সেথাকার লোকদের মাঝে কেমন যুদ্ধ স্পৃহা রয়েছে? নিজেই জবাব দিলেন, না থাকাটাই স্বাভাবিক, মানুষের কাছে হয়তো দৌলত থাকে তানাহলে স্পৃহা থাকে। দুটো এক সাথে থাকে না কারণ দৌলত মানুষকে বিলাসী বানায়।”
গোয়েন্দা : না আমীরে মুহতারাম! মেরীদা শহরের মানুষের কাছে দুটোই আছে। আমি ছদ্মবেশে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী হয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলাম। একটি সরাইখানা কয়েকটি গীর্জাতে অবস্থান করেছি। তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, মুসলমানরা তো সারা মূলক কজা করে নিয়েছে; এ শহরও দখল করে নিবে এখন কি করা?
আমীরে মুহতারাম! তারা সকলে আমাকে একই জবাব দিয়েছে, “মেরদা শহরবাসীর রয়েছে আত্ম মর্যাদা, তাদের আছে সাহসীকতা ও বীরত্ব। গীর্জা-ইবাদত খানায় যেসব লোক রয়েছে, তাদের লম্বা দাড়ি ও ঢিলা-ঢালা পোষাকই কেবল দেখনা এরা প্রত্যেকে হলো যুদ্ধবাজ। এরা নিজেদের গীর্জার পবিত্রতা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করে দেবে। তবে জীবন দেয়ার আগে তার সম্মুখে যে মুসলমান আসবে তাকে সে অবশ্যই খতম করবে। সাধারণ মানুষও প্রাণপণ লড়াই করবে। মুসলমানরা এ শহর সে সময় নিতে পারবে যখন একজন খ্রীস্টানও জীবিত থাকবে না।”
আমীরে মুহতারাম! শহরের কোন মানুষের মাঝে আমি বিন্দুমাত্র ভয় ও ভীতির ছাপ দেখিনি।
***
মেরীদার দিকে রওনা হবার পূর্বে মুসা ফৌজদের উদ্দেশ্যে এক তেজস্বী বক্তৃতা দিলেন, যাতে সৈন্যরা স্পৃহা-উদ্দীপনায় নতুন প্রাণ ফিরে পেল। পথিমধ্যে তিন সন্তানকে লক্ষ্য করে বললেন,
“আমার প্রিয় বৎস! আমার প্রতিটি কথা ওসীয়ত মনে করে গুরুত্ব দিয়ে শ্রবণ কর। আমার শরীরের দিকে লক্ষ্য কর, তা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। কেবল আত্মিক শক্তি আমাকে এখানে নিয়ে এসে লড়াই করাচ্ছে। জীবনের অর্ধেকের চেয়ে বেশী সময় কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। মনে কর আমার শারীরিক শক্তি তোমাদের তিনজনের মাঝে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন আমি যে কোন সময় ইন্তেকাল করতে পারি। তোমরা আমাকে দাফন করার পর আমার নাম জিন্দা রাখবে। আমি তোমাদেরকে এক মুলক বিজয় করে দিয়ে যাচ্ছি। এ যুদ্ধই আমার জীবনের শেষ যুদ্ধ। হতে পারে এ যুদ্ধেই আমি ইন্তেকাল করতে পারি। এ উত্তরাধিকারীকে তোমরা ধরে রাখবে। আব্দুল আজীজ! তোমাকে আমি এখনই বলছি, তুমিই হবে স্পেনের প্রথম আমীর। তোমার ব্যাপারে আমি খলীফার থেকে অনুমোদন নিয়ে নেব।
আব্দুল আজীজ : শ্রদ্ধেয় বাবা! স্পেনের আমীর হবার হকদার কি ইবনে যিয়াদ নয়? সেই তো স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে এবং এখন সে স্পেনের প্রাণকেন্দ্র টলেডোতে অবস্থান করছে।
মুসা : বৎস! যা আমি জানি তা তোমরা জান না। আমি যা চিন্তে করি তা তোমরা কর না। এখন আমার এ উপদেশ হৃদয়ংগম কর, কোন অবস্থাতেই পশ্চাৎ পদ হবে না। এ রাজ্যে এত পরিমাণ প্রাচুর্য, ধন-দৌলত ও সৌন্দর্য রয়েছে যা তোমরা ইতিপূর্বে কখনো দেখনি। তুমি এখন যুবক আর যৌবন হয় অন্ধ। তুমি যদি বিচ্যুত হও তাহলে সব হারাবে। স্পেন বিজয়ের জন্যে যেসব শহীদ জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের অভিশাপ তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে।
আব্দুল আজীজ : এমনটি হবে না আব্বাজী! এমনটি হবে না।
মুসা : এখন খুব ভাল করে ফিকির কর, মেরীদা সহজে হাতে আসবে না। তা হাতে আনতে বহু জান-মাল কুরবানী করতে হবে।
“আমরা কুরবানী দিতে প্রস্তুত আছি” তিন সন্তান দৃপ্তভাবে জবাব দিল।
মেরীদাতে একটা মহল ছিল, তাতে বাদশাহর প্রতিনিধি অবস্থান করত। এখন সেখানে অবস্থান করছে রাজিলী নামে বাদশাহর এক নিকট আত্মীয়। রাজিলী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে রডারিকের মৃত্যুর পর ইঞ্জেলা নামে তার এক যুবতী স্ত্রীকে মেরীদাতে নিয়ে গিয়েছিল।
রডারিক তার মহলে যেসব রমণীদেরকে রেখেছিল তারা প্রত্যেকে একে অপরের চেয়ে ছিল সুন্দরী, কিন্তু ইঞ্জেলা এত বেশী সুন্দরী ছিল যে সাধারণত মহিলাদের মাঝে এমন দেখা যায় না। সে ছিল অদ্বিতীয়।
সে তো সুন্দরী ছিলই অধিকন্তু তার কথা-বার্তা ও চাল-চলনের মাঝে এমন আকর্ষণ ছিল যে সকলের মন-হৃদয় মুহূর্তের মাঝে জয় করে নিত। সদা তার ঠোঁটে থাকতো মুচকী হাসি। সে মুখে যা বলত তার চেয়ে অনেকগুণে বেশী বলত নয়ন যুগলে। রাজিলী পূর্ব হতেই এ রমণীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। রডারিকের মৃত্যু খবর পাওয়া মাত্র সে টলেডোতে এসে ইঞ্জেলাকে বলেছিল,
“এখানে তোমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সিংহাসনের দাবীদার রজমাত। আর তার মা হলো একচ্ছত্র রানীর দাবীদার। অন্যান্য বিবিদেরও সন্তান রয়েছে তারাও দাবীদার। আমি শুনতে পেলাম তোমার ব্যাপারে তারা অভিযোগ তুলেছে তুমি বিভিন্ন জেনারেলদের সাথে আতায়াত করে নাকি তখত দখল করতে চাচ্ছ। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি তুমি এখান থেকে অতি তাড়াতাড়ি অন্যত্র চলে যাও।”
ইঞ্জেলা : কোথায় যাব?
আমার সাথে মেরীদা চল।
সেখানে গিয়ে আমি কি করব? সেখানে আমার অবস্থানই বা হবে কি?
রডারিকের মৃত্যুর পর স্পেনের তখত হয়েছে চূর্ণ-বিচূর্ণ। মুসলমানরা দ্রুত টলেডোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। মেরীদার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই মজবুত। আমরা সেখানে আমাদের হুকুমত কায়েম করব। তুমি সব ধরনের চিন্তা বাদ দিয়ে আমার সাথে চল। তোমার অন্য কোন অভিপ্রায় থাকলে তা পরিত্যাগ কর।
পরের দিন সকালে বিপুল পরিমাণ মনি-মুক্তা, সোনা-দানা তার নিজস্ব দাস দাসীসহ এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মেরীদার দিকে রওনা হলো। সে কি নিয়ে গেল কি রেখে গেল ভার বিন্দুমাত্র কেউ কোন খোঁজ নিল না। সকলেই মনে করল একজন দাবীদার কমে গেল।
সেখানে পোঁছার অল্প কয়েক দিনের মাঝে ইঞ্জেলা সেখানে অন্যান্য জেনারেল ও হাকীমদের মন জয় করে ফেলল। প্রত্যেকেই ইঞ্জেলাকে নিজের মনে করতে লাগল।
রাজিলী : ইঞ্জেলা! এখানের প্রত্যেক জেনারেল ও হাকিম তোমার আশেক। তাদের সকলের ধারণা তুমি তাদের সাথে শাদী করবে।
ইঞ্জেলা : এটা কি আমার সফলতা না যে আমি আশেক তৈরী করতে পেরেছি। আর সকলেই খাব দেখা শুরু করেছে যে তারা আমার স্বামী হবে।
আমিও খাব দেখছিনা তো?
হৃদয় কাড়া মুচকি হেসে ইঞ্জেলা জবাব দিল, তুমি খাব দেখবে কেন? তুমি কি দেখছনা, তুমি ছাড়া তাদের মাঝে কে আমার কাবেল? তাদের মত বৃদ্ধদেরকে খাবেন্দ হিসেবে কবুল করব? তোমাকে আমি মেরীদার বাদশাহ্ বানাব আর আমি হবো তোমার রানী।
“তাহলে আমি কি বিশ্বাস রাখব যে তুমি কেবল আমার? আবেগে অভিভূত হয়ে রাজিলী জিজ্ঞেস করল।”
“তোমার ছাড়া আর কার? আমি রানী হতে চাই, তুমি কি আমাকে রানী বানাতে পারবে”
তুমি কি ফালতু প্রশ্ন করলে। তুমি ছাড়া রানী হবে কে!
তুমি কি খবর পেয়েছ গ্রানাডা ও কর্ডোভা মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। আর মুসলমানদের আরেকটা ফৌজী দল স্পেন এসেছে?
“তা শুনেছি এবং আমার কাছে এ খবর পৌঁছে যে, সে নয়া ফৌজি দল আমাদের এ শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।”
তুমি কি মুসলমানদের হাত থেকে এ শহরকে রক্ষা করতে পারবে?
হ্যাঁ ইঞ্জেলা! আমি অবশ্যই তা পারব। মুসলমান ফৌজ এখানে মরার জন্যে এসেছে।
“এমন কথা টলেডোতেও শুনেছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম মুসলমান ফৌজ টলেডোকে অবরোধ করার জন্যে শহরে পৌঁছতেই শহরবাসী ফটক খুলে দিয়ে মুসলমানদেরকে স্বাগতম জানিয়েছে। তুমি কি এমন বীরত্ব দেখাতে পার যে এখানে সৈন্য বাহিনী তোমার নেতৃত্বে শহরের বাহিরে নিয়ে গিয়ে মুসলমানদের ওপর এমন আক্রমণ করবে যে তারা হয়তো পালিয়ে যাবে বা খতম হয়ে যাবে?”
তুমি অপেক্ষা কর, দেখ কি করি।
তুমিও দেখতে পাবে, আমি কিভাবে অন্তর-মন, আমার শরীর তাবৎ কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করে তোমার রানী হয়ে যাই।
বস্তুত: ইঞ্জেলা সব জেনারেলদের সাথেই এমন কথা বলে পাগল বানিয়ে রেখেছিল।
***
“হামলাকারীরা আসছে”
“তৈরী হয়ে নাও”
“সতর্ক হয়ে যাও”।
এ আওয়াজ শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। মানুষের মাঝে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল। তবে সে হুলস্থূল ভয়-ভীতির কারণে নয়, নয় পলায়নের জন্যে। বরং তারা সকলে প্রস্তুত হচ্ছিল যুদ্ধের জন্যে।
বহুদিন ধরে তারা যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছিল। তীর-বর্শা তৈরি করছিল। ইঞ্জেলা আসার পরে স্পৃহা উদ্দীপনা আরো বেড়ে গিয়েছিল। ইঞ্জেলার কানে খবর পৌঁছা মাত্র উম্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শহরের অলি-গলিতে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “যারা হাতিয়ার সমার্পণ করে মুসলমানদের হাতে নিজেদের শহর তুলে দিয়ে গোলাম হয়েছে তারা বুজদিল আত্মমর্যাদাহীন। তারা তাদের বেটীদেরকে সোপর্দ করে দিয়েছে। তোমরাও তোমাদের বেটীদেরকে বর্বরদের হাতে অর্পণ করে দিবে?”
প্রত্যেক জায়গায় জনতা দল জবাব দিল, “না…, না, আমরা আমাদের ইজ্জত রক্ষার্থে জীবন বিলিয়ে দিব।”
“ভুলে যেওনা, এটা গ্রানাডা-কর্ডোভা নয়, এটা রেমীদা। এটা প্রধান ধর্মগুরুর শহর। আজ গীর্জার ইজ্জত তোমাদের হাতে। ক্রসের ইজ্জত-আব্রু তোমাদের কাছে। ক্রসে ঝুলানো ঈসা মসীহের পবিত্র আত্মা দেখছে তোমরা কি খৃস্টবাদ রক্ষার্থে জীবন বিলিয়ে দাও না কি নিজের জীবনকে বেশী মহব্বত কর। তোমরা যদি এখানে মুসলমানদেরকে পরাজিত করতে পার তাহলে যেসব শহর মুসলমানরা কজা করেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারে তোমরা অগ্রসর হতে পারবে। স্পেন হতে মুসলমান বিতাড়িত করার সৌভাগ্য তোমাদের হবে। আর তোমরা যদি হীনমন্য হয়ে বসে থাক তাহলে তোমাদের ইবাদতগাহ্ মসজিদে পরিণত হবে। তোমাদের ইবাদত খানার এমন বেহুমতি থোক এটা কি তোমরা কামনা কর?
স্বমস্বরে জবাব এলো না- না…।
ইঞ্জেলা ফৌজদের মাঝে গিয়েও এ ভাষণ পেশ করল। মানুষের মাঝে পূর্ণ জোস-স্পৃহা জাগ্রত হলো। তারা পাগল পারা হয়ে ওঠল।
সুন্দর কোন রমণী যদি পুরুষদেরকে আহ্বান করে তাহলে পুরুষের মাঝে উম্মাদনা সৃষ্টি হওয়াটা যেন কুদরতের ফায়সালা।
***
মুসা ইবনে নুসাইর তো এ প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলেন যে, শহর অবরোধ করবেন কিন্তু গোয়েন্দারা এসে খবর দিল মেরীদা ফৌজ শহরের বাহিরে যুদ্ধ করার জন্যে বাহিরে চলে এসেছে এবং এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলেছে, শহরের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। মুসা দূর থেকে দেখতে পেলেন ফৌজ বাহিরে প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে আছে।
মুসা তার ফৌজকে বেশ দূরেই অবস্থান করালেন, পুরো ফৌজ ক্লান্ত-শ্রান্ত তাই তিনি তাদেরকে বিশ্রাম করার কথা বললেন। আর নিজে তার তিন সন্তান ও দু’একজন জেনারেল সাথে নিয়ে শহরের আশে-পাশে পর্যবেক্ষণের জন্যে চলে গেলেন। পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি লড়াইয়ের প্লন তৈরী করবেন।
শহরের পশ্চাতে টিলা, ঘন গাছ-পালা ছেয়ে ছিল। তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা কিন্তু সে রাস্তা দিয়ে শহরের কাছে যাওয়া বড় মুশকিল। মুসা সে রাস্তা দিয়েই সম্মুখে অগ্রসর হবার জন্যে ঘোড়া হাঁকালেন।
কিছু দূর অগ্রসর হতেই একটা তীর এসে গাছের গোড়ায় পড়ল। মুসা ঘোড়া থামালেন। আবার একটা তীর এসে ঠিক তার সামনে মাটিতে বিদ্ধ হলো। মুসা ঘোড়া ফিরিয়ে দ্রুত ফিরে এলেন। তীর দু’টো হয়তো দূর থেকে এসেছিল তাই মুসা বা তার ঘোড়ার শরীরে বিদ্ধ হয়নি বা হয়তো তীরন্দাজ মুসাকে সতর্ক করে দিল সম্মুখে অগ্রসর হবে না।
ঐ পাহাড়ী এলাকায় ফৌজ লুকিয়ে ছিল। শহরের সম্মুখ ভাগে যে ফৌজ রয়েছে তার চেয়ে বেশী ভয়াবহ এ ফৌজ।
মুসা : আমার প্রিয় সাথীরা! আমরা বড় মুশকিলে পড়ে গেলাম। তবুও আমাদের আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে, তাঁর রহমতের আশা ছাড়া যাবে না।
মুসা তার সন্তান ও সালারদের সাথে শহরের পশ্চাতেই ছিলেন। তারা ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এরি মাঝে হঠাৎ করে হৈ চৈ শুনতে পেলেন, কিসের হৈ চৈ তা তিনি ভাল করে বুঝতে পারলেন, এটা লড়াই এর শোরগোল। ঘোড়ার পদাঘাতে জমিন কাঁপছিল।
মুসা দ্রুত অশ্ব হাঁকিয়ে তার লস্করের দিকে রওনা হলেন তার সন্তানরা ও সালাররা তাকে অনুসরণ করল। শহরের পশ্চাৎ হতে সম্মুখে আসতেই তিনি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পেলেন। মেরীদার যে ফৌজ শহুরের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেছে। মুসলমানরা এ হামলার জন্যে বিলকুল প্রস্তুত ছিল না। সোয়াররা ঘোড়া হতে জিন খুলে এদিক সেদিক পানির তালাশে ঘুরছিল। পায়দলরা শুয়ে পড়েছিল আর ফৌজের জন্যে তৈরী হচ্ছিল খানা। তারা দুশমনকে আসতে দেখে, যে যে অবস্থায় ছিল ঐ অবস্থাতেই হাতিয়ার ধারণ করেছিল। সোয়ারীরা ঘোড়ার পিঠে জিন বাঁধার অবকাশ পায়নি তারা তীর ও বর্শা হাতে পায়দল বাহিনীর সাথে শরীক হয়েছিল।
মুসলমান তীরন্দাজরা কামান-ধনুক নিয়ে অগ্রভাবে চলে গেল। তারা আক্রমণকারীদের ওপর বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। হামলাকারীদের অগ্রভাগে ছিল ঘোড় সোয়ার। ঘোড় সোয়ার যখন একেবারে কাছে চলে এলো তখন তীরন্দাজরা জীবন বাঁচানোর জন্যে সরে পড়ল। পায়দল বাহিনী তাদের মুকাবালা করল, কিছু সোয়ারীকে তারা জখম করল কিন্তু নিজেরা ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মুসলমানরা জীবন বাঁচিয়ে মুকাবালা করছিল।
মেরীদার এ বাহিনী স্থির হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে আসেনি ফলে তারা অতর্কিত হামলা করে ডানে-বামে চলে গেল।
মুসা ইবনে নুসাইর যখন পৌঁছলেন তখন লড়াই শেষ। প্রবল তুফানের পরে যেমন সব লন্ড ভন্ড হয়ে পড়ে থাকে, ফৌজের অবস্থা ঠিক তেমনি ছিল। দুশমন ও মুসলমান ফৌজের আহতরা কাতরাচ্ছিল। কিছু মৃত্যু মুখে ঢলে পড়েছিল।
মেরীদা ফৌজ যেখানে ছিল সেখানে পৌঁছে গেল এবং তারা গগন বিদারী ধ্বনী দিতে লাগল।
এক ঘোড় সোয়ার মুসলমানদের কাছে এসে বলল,এটা গ্রানাডা-কর্ডোভা নয়। এটা মেরীদা। তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। তারপর সে দ্রুত ফিরে গেল।
প্রথম দিন আক্রমণের পর এভাবে আক্রমণ চলতে লাগল। মুসা বুঝতে পারলেন এটা তাদের কৌশল। তিনি তার ফৌজকে চার ভাগে ভাগ করে শহরের চারদিকে পাঠিয়ে দিলেন। মুসলমানদের মত ঈসায়ী লস্করও ভাগ হলো। মুসলমানদের কোন ফৌজ সামনে অগ্রসর হলে ঈসায়ী ফৌজ সামনে এসে মুকাবালা করে মুসলমানদেরকে হয়তো পিছু হটিয়ে দিত বা নিজেরা আক্রমণ করেই পিছু হটে যেত। এভাবে প্রতিদিন আক্রমণ হতে লাগল যার ফলে মুসলমানরা শহর পূর্ণ মাত্রায় অবরোধ করতে পারল না।
আবাল-বৃদ্ধ বনিতা, নারী-পুরুষ ধনী-গরীব নির্বিশেষে জীবন বাজিরেখে লড়তে লাগল। পাদ্রীরা গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সাত-আট মাস এভাবে লড়াই চলতে লাগল। উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হলো। মুসা সামনে অগ্রসর হওয়া বন্ধ রাখলেন। অন্যান্য জেনারেলদের সাথে সলা-পরামর্শ করলেন।
মুসাঃ আমি মেনে নিতে পারছি না, এত দিনের খাদ্য-সামগ্ৰী শহরের মাঝে মওজুদ রয়েছে। নিশ্চয় কোন রাস্তা দিয়ে বাহির হতে খাদ্যাদি শহরে প্রবেশ করছে। সে রাস্তার সন্ধান পেলে তা বন্ধ করে দিয়ে শহর অবরোধ করতাম।
আব্দুল আজীজ ইবনে মুসা : আমরা শহরের চারদিকে ঘুরে দেখেছি, এমন কোন রাস্তা পাইনি যা দিয়ে বাহির থেকে রসদ-পত্র আসতে পারে।
মুসাঃ কোন রাস্তা অবশ্যই আছে। আমরা প্রথম দিন পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যে রাস্তায় গিয়ে ছিলাম আমাদের সামনে দুটো তীর এসে পড়ে ছিল, ঐটাই রসদ আসার রাস্তা বলে মনে হয়। আজ রাতে কয়েকজন সেদিকে গিয়ে দেখবে সে পথ দিয়ে শহরে রসদ-পত্র প্রবেশ করে কিনা।
“আমি আজ রাতে সেদিকে যাব।” মুসার ছেলে আব্দুল্লাহ্ বলল।
মুসা : তোমার সাথে আরো কয়েকজনকে নিয়ে যাবে আর পায়ে হেঁটে যাবে ঘোড়ায় চড়ে গেলে পদ ধ্বণীতে তারা টের পেয়ে যেতে পারে। সাথে দোভাষী নিয়ে যাবে।
রাত্রে আব্দুল্লাহ বেশ দূরে ঘুরে শহরের পশ্চাতে সে পাহাড়ী রাস্তায় পৌঁছে গেল। রাস্তার পাশ দিয়েই নদী বয়ে চলেছে। আব্দুল্লাহ্ খুব সতর্কতার সাথে ধীর পদে সামনে এগুতে লাগল। ঘন গাছ-পালা, চাঁদনী রজনী, নদীর কুলকুল ধ্বনী শুনা যাচ্ছে। এর মাঝ দিয়ে আব্দুল্লাহ্ তার সঙ্গী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুদূর অগ্রসর হতেই মানুষের আওয়াজ শুনতে পেল। আব্দুল্লাহ তার সাথীসহ উঁচু ঘাসের মাঝে লুকিয়ে পড়ল।
দুতিন জন ব্যক্তি পরস্পরে কথা-বার্তা বলতে বলতে আসছিল। তাদের পদ ধ্বণী শোনা গেল। কিছুদূর এসে তারা দাঁড়িয়ে গেল। আব্দুল্লাহ্ দোভাষীকে জিজ্ঞেস করল, তারা কি বলছে?
দোভাষী : তারা কিসতির ব্যাপারে কথা বলছে। তারা বলছে আজও যদি কিসতি না আসে তাহলে সবাই ক্ষুধায় মারা যাবে।
দোভাষী আব্দুল্লাহকে বলল, রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। এ রাস্তা দিয়েই শহরে রসদপত্র পৌঁছে।
আব্দুলাহ : তুমি মাথা নিচু করে ঝুঁকে ঝুঁকে পিছনে গিয়ে আমাদের সাথীদেরকে আসতে বল, তারা যেন ঝুঁকে ঝুঁকে নিচু হয়ে এখানে আসে।
তাদের কাছে খবর পৌঁছা মাত্র তারা আব্দুল্লাহর কাছে উপস্থিত হলো। আব্দুল্লাহ্ তার সাথী মুজাহিদদেরকে বলল, এ দুজন লোককে পাকড়াও করতে হবে। তারপর সে তরজুমানকে বলল, তুমি তাদের কাছে এমনভাবে যাও যেন তুমি অনেক দূর থেকে এসেছ ফলে তুমি খুবই ক্লান্ত।
তারা তোমার দিকে লক্ষ্য করলে আশে-পাশের কোন গ্রামের নাম বলে সেখানে যাবার রাস্তা জিজ্ঞেস করবে তারপর যুদ্ধের আলাপ করতে করতে এদিকে নিয়ে আসবে।
স্পেনী দোভাষী অত্যন্ত চালাক ছিল। সে আস্তে আস্তে তাদের দিকে রওনা হলো। তার পদ ধ্বণীতে তারা তার দিকে ফিরে তাকাল। গোভাষী দু’তিন কদম চলেই বসে পড়ল, ভাবটা এমন যেন অনেক দূর থেকে আসার কারণে একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত।
দোভাষী স্পেনী ভাষায় বলল, “অনেক দূর থেকে এসেছি ভাই! একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে রাস্তা বাতিয়ে একটু সাহায্য কর ভাই!”
তারা দু’জন তার কাছে এলো। দু’ভাষী দাঁড়িয়ে তাদের সাথে আলাপ করতে করতে আল্লাহর কাছে এসে গেল, মাত্র কয়েক গজ দূরে। আব্দুম্নাহ তার ফৌজদেরকে ইশারা করা মাত্র তারা পশ্চাৎ দিক হতে ঐ দু’জনকে পাকড়াও করে ফেলল। তারপর আব্দুল্লাহ তাদের দুজনকে সাথে নিয়ে নিজেদের ক্যাম্পে চলে এলো।
মুসা ইবনে নুসাইর গভীর ঘুমে। তাকে জাগ্রত করে আব্দুল্লাহ বিস্তারিত বর্ণনা দিল। অন্যান্য জেনারেলরাও এসে জমা হলো। দু’স্পেনী ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল।
মুসা ইবনে নুসাইর : ভয় পেওনা, তোমাদেরকে হত্যা করা হবে না। মেরীদা বিজয়ে আমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদেরকে আযাদ করে দেয়া হবে। তোমরা বল শহরে রসদ-পত্র কোন পথে পৌঁছে এবং শহরের ভেতরে খাদ্য সামগ্রী কি পরিমাণ আছে?
এক স্পেনী বলল, আমরা দরিয়া পাড়ে রসদ বহনকারী কিন্তী দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা দু’জন ফৌজি অফিসার। দশ বার দিন পরপর শহরের খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য আসবাব পত্র রাত্র বেলা নৌকাযোগে আসে, আমরা নৌকা থেকে মাল নামিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে শহরে নিয়ে যাই। দু’তিন দিন পূর্বে নৌকা আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসেনি, না জানি কি অসুবিধা হয়েছে।
মুসা : শহরে কি রসদপত্র বিপুল পরিমাণে মওজুদ রয়েছে।
স্পেনী : যৎসামান্য রয়েছে। যদি আজকে রাত্রে কিস্তী না আসে তাহলে শহরে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেবে।
মুসা : ঐ রাস্তা ছাড়া শহরে রসদ পৌঁছার অন্য কোন রাস্তা আছে কি?
স্পেনী : রাস্তা তো কয়েকটা কিন্তু আপনার ফৌজের অবস্থানে ঐ একটা রাস্তা ছাড়া সব বন্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়ী এলাকা এবং নদীর পাড়ে হবার দরুন রাস্তাটা বেশ নিরাপদ। যদি এ রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শহরে দুভক্ষ দেখা দেবে।
মুসা : এদের দুজনকে নিয়ে যাও। এদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
দু’স্পেনীকে নিয়ে যাবার পর মুসা ইবনে নুসাইর তাবু থেকে বেরিয়ে আসমানের সেতারার দিকে তাকিয়ে রাত অনুমান করলেন। রাতের শেষ প্রহর। মাল বোঝায় কিস্তী যেখানে পৌঁছে সেখানে পাঁচশত ঘোড় সোওয়ার ও দেড় হাজার পায়দল পৌঁজ তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছার নির্দেশ দিলেন।
মুসা : তার ছেলে আব্দুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আব্দুল্লাহ! তুমি এই সৈন্য বাহিনীর সাথে যাও। ঐ জায়গা তুমি দেখে এসেছে। রসদ আটকাতে হবে। লস্করকে এমনভাবে নিয়ে যাবে যাতে দুশমন জানতে না পারে। যদি তোমার ওপর আক্রমণ হয় তাহলে আমি পাল্টা আক্রমণের ব্যবস্থা করব। তুমি অতি সত্বর রওনা হয়ে যাও, সুবহে সাদেকের পূর্বে সেখানে পৌঁছতে হবে। মেরিদার লোক খাদ্য ব্যতীত জীবিত থাকতে পারবে কিন্তু শরাব ছাড়া তারা অন্ধ ও উন্মাদ হয়ে যাবে।
আব্দুল্লাহ অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত পাঁচশত ঘোড় সোওয়ার ও দেড় হাজার পায়দল বাহিনী নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
যখন মেরিদা শহরে বড় গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল এবং মুসলমানদের ক্যাম্পে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান-ধ্বনে ধ্বনিত হল তখন আব্দুল্লাহ তার বাহিনী নিয়ে যেখানে মাল বোঝায় কিন্তী পৌঁছে সেখানে উপস্থিত হল। আবদুল্লাহ তার সৈন্যবাহিনীকে বিন্যস্ত করে দিল। পুব দিগন্তে প্রভাত রবি উঁকি মেরে উঠল।
স্পেনীদের যে দু’জন ফৌজী অফিসার কিসতীর খবর নিতে এসেছিল তারা সকাল হবার পরও ফিরে না যাবার দরুন তার খোঁজে আরেক জনকে পাঠান হলো। এ ব্যক্তি ঘোড় সোয়ার ছিল। সে যখন নদীর পাড়ে পৌঁছল তখন তার কাঁধে একটা তীর বিদ্ধ হলো। সে তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে খবর দিল ঘাট মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে।
তার সংবাদ মুতাবেক একটা ঘোড় সোয়ার বাহিনী প্রেরণ করা হলো। এ বাহিনী পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে নদী পাড়ে পৌঁছা মাত্র তাদের ওপর তীর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তীর বিদ্ধ হয়ে পলায়ন করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না।
রাত্রে চারটি বড় বড় কিসতী এসে ঘাটে ভিড়লে মুসলমানরা তা কজা করে নিল। এক কিসতী মেষ-বকরীতে পূর্ণ। বাকী গুলোতে আটা-মাখন, ঘি, ডাল, তরিতরকারী ও শরাবের ড্রামের স্তূপ। আব্দুল্লাহর হুকুমে শরাবের ভ্রামগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হলো। মুসাকে সংবাদ দেয়া হলো বাকী সামান ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্যে।
সাত-আট দিনের মাঝেই শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো তাদের শরাবের জন্যে। খানা-পিনার অভাবে মানুষ শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু শরাব পানকারী যদি শরাব না পায় তাহলে সে পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়। শহরের ফৌজ ও সাধারণ জনগণের অবস্থাও ঠিক এমনই হয়ে পড়েছিল। তারা পরস্পরে মারামারি, হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের লড়াই এর স্পৃহা ক্রমে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
স্পেনী ফৌজরা ঘাট দখলে আনার জন্যে দ্বিতীয়বার হামলা করল কিন্তু মুসা তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এত মজবুত করে ছিলেন যে, তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। তৃতীয়বার আর চেষ্টা করল না।
***
রাজিলী : ইঞ্জেলা! বল, এখন কি তুমি ফৌজের মাঝে স্পৃহা-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারবে।
ইঞ্জেলা, হ্যাঁ এটা আমি জানি যে, শক্তিশালী দুশমনের মুকাবালা করা যায় কিন্তু ক্ষুধা-ক্লিষ্টের মুকাবালা শক্তিশালী দুশমনও করতে পারে না। তবুও আমি আগের মত মানুষের মাঝে উৎসা-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যে চেষ্টা করব।
রাজিলী : বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য কর ইঞ্জেলা! সকলে ক্ষুধার্ত। আমি অনেক চিন্তা-ফিকির করে দেখলাম, এখন আর মেরীদাকে রক্ষা করা সম্ভবপর নয়। ক্ষুধার্ত, প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করেছে। ফৌজরা শব চাচ্ছে। জনগণকে ভুখা রেখে ফৌজের পেট ভরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এর ফল এই দাঁড়াচ্ছে যে, তারা এখন ফৌজদের ভাল নজরে দেখছেনা। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, চল আমরা রাত্রে এখান থেকে চলে যাই। আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি শহরের ফটক রাত্রে আমাদের জন্যে খোলা থাকবে।
ইঞ্জেলা : যাবে কোথায়? এমন কোন শহর কি আছে যা মুসলমানরা হস্তগত করেনি?
রাজিলী : আমি তোমাকে ফ্রান্স নিয়ে যাব।
ইঞ্জেলা : না, আমি এখনই যাব না।
রাজিলী : তাহলে তুমি কি জান পরিণাম কি হবে? মুসলমানদের সিপাহসালার বা অন্য কোন সালার তোমাকে তার দাসীতে পরিণত করবে। আর তুমি রানী হবার স্বপ্ন দেখছ। চল এখনই সময়। আমরা এখান থেকে চলে যাই। ফ্রান্স গিয়ে আমরা শাদী করে সেখানে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করব। যে পরিমাণ ধন-দৌলত আমি সাথে নিচ্ছি তা দেখে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে।
ইঞ্জেলা মুচকি হাসল।
রাজিলী : তুমি কি কোন জবাব দেবে না?
ইঞ্জেলা : দু’তিন দিন অপেক্ষা কর।
সকাল বেলা ইঞ্জেলা ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে শহরে বেরুলে শহরবাসী তাকে ঘিরে ধরল। কিছুদিন পূর্বেও সে মানুষের কাছে গেলে তারা তার আগমনে জয়ের ধ্বনী তুলত। আর আজ তাকে বিদ্ধ হতে হচ্ছে নানা প্রশ্নবানে।
“ফৌজ বাহিরে কি করছে?”
“ফৌজরা হামলা করে অবরোধ কেন ভাঙছে না?”
“আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে ক্ষুধার্ত রেখে ফৌজের উদর পূর্তি করছি।”
“আমরা ভুখা, খাদ্য সংগ্রহ করে দাও, লড়াই করব।”
এ ধরনের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে জায়গায় জায়গায় হতে হলো। সে জেনারেলদের কাছে গেলে তারা তাকে বলল, ফৌজের খাদ্য শেষ হয়ে গেছে, তারা ঘোড়া জবাই করে খাওয়া শুরু করেছে। রাজিলীকে বল, শহর মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিক।
ইঞ্জেলা রাজিলীর কাছে গিয়ে বলল, তুমি শহরের ফটক খুলে দেয়ার নির্দেশ দাও। কিন্তু এতে রাজিলী সম্মত হলো না।
ইঞ্জেলা : তুমি কি ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চাচ্ছ? মুসলমানরা যখন জানতে পারবে আমাদের ফৌজ ক্ষুধার্ত, লড়াই করার কাবেল নয় তখন তারা হামলা করে শহরে প্রবেশ করে লুটতরাজ করবে, যুবতী লাড়কীদেরকে নিজেদের মন মতো ব্যবহার করবে আর শহরবাসীকে করবে ব্যাপকভাবে হত্যা।
ঐতিহাসিকরা লেখেন তারপর এক জেনারেল চারজন ফৌজসহ সফেদ ঝান্ডা নিয়ে কেল্লা হতে বেরুলেন। মুসা তা দেখে দু’জন সালার ও দোভাষীকে সাথে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে স্পেনী জেনারেলের সাথে করমর্দন করলেন।
স্পেনী জেনারেল সন্ধির জন্যে কতগুলো শর্ত দিল কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন,
পরাজিত কি তোমরা হয়েছ না আমরা হয়েছি? আমরা শর্ত পেশ করব তোমরা নও। তোমরা যদি আমাদের শর্ত না মন তাহলে তোমাদের ফৌজ কচু কাটা হবে।
স্পেনী জেরারেল : আপনার শর্ত কি?
মুসা : তোমাদের ফৌজ হাতিয়ার সমর্পণ করবে, তামাম ফৌজ আমাদের কয়েদী হবে। আমরা নয় মাস অবরোধ করে রেখেছি, আমাদের বহু জীবনের ক্ষতি হয়েছে, আমরা তার মূল্য আদায় করব। শহরে যত স্বর্ণ রোপা আছে তা চাই সরকারী হোক বা জনগণের তা আমাদের কাছে অর্পণ করতে হবে। যেহেতু উদ্দেশ্য পরিস্কার বুঝা যাচ্ছেনা তাই বড় বড় অফিসারকে আমাদের কাছে যুদ্ধপন হিসেবে রাখতে হবে। ফিরে যাও, যদি শর্ত গ্রহণীয় হয় তাহলে তামাম ফৌজকে একত্রিত করে হাতিয়ার জমা কর আর বড় বড় অফিসারদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস।
স্পেনী জেনারেল ফিরে গেল। মুসা তার ফৌজকে হামলার জন্যে প্রস্তুত থাকতে বললেন।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই সে জেনারেল পঞ্চাশজন সম্ভ্রান্ত পুরুষ ও সমপরিমাণ রমণী সাথে নিয়ে ফিরে এলো।
জেনারেল : এদের সকলকে আপনি পন হিসেবে রাখতে পারেন। তবে এদের সাথে সাধারণ কয়েদীর মত ব্যবহার না করার জন্যে আপনার কাছে আবেদন করব, এরা সাধারণ জনতা নয় বরং সকলে বড় অফিসার। তাছাড়া শাহী খান্দানের লোকও রয়েছে। ফৌজ তাবৎ হাতিয়ার একত্রিত করেছে আপনি শহরে প্রবেশ করতে পারেন।
মুসা : আমরা এদেরকে সম্মানের সাথে রাখব। তুমি তো জানই আমরা পণ কেন চেয়েছি।
স্পেনী জেনারেল : আমি একজন জওয়ান আওরতের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই, তার নাম ইঞ্জেলা। বাদশাহ রডারিকের বিধবা বিবি। আপনার কাছে তার কোন গুরুত্ব নেই কিন্তু সে আমাদের কাছে পূজনীয়।
মুসা : সে তোমাদের বাদশাহুর বিধবা পত্নী এ জন্যে?
স্পেনী জেনারেল : এ জন্যে নয় সিপাহ্ সালার! এ রমণীই আমাদের ফৌজ ও জনসাধারণের মাঝে স্পৃহা-প্রেরণা জাগিয়ে তুলে ছিল। তারা যে প্রাণ পণ লড়াই করেছে এ রমণীরই বদৌলতে। আমাদের যদি রসদ বন্ধ না হয়ে যেত তাহলে আপনি এ শহরের কাছেও আসতে পারতেন না। আপনি হয়তো তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিবেন। সেই আপনাকে এত দীর্ঘ দিন অবরোধ করে রাখতে বাধ্য করেছে এবং আপনার অনেক জীবনের ক্ষতি করেছে। এজন্যে দাবী নয় আবেদন করছি, সে রমণীর সম্মান যেন ভূলণ্ঠিত না হয়।
মুসা : এরূপ আওরতকে আমরাও বড় মনে করি। আমরা তার সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখব। এদের মাঝে কে সে মহিলা, তাকে দেখতে চাই।
জেনারেলের ইশারাতে কালো পোষাক পরিহিতা, নেকাবে মুখ চাকা এক রমণী সামনে এলো। রমণীদের মাঝে তার চেহারাতেই কেবল নেকাব ছিল।
মুসা : আমরা তার চেহারা নেকাব ছাড়া দেখতে চাই।
রমণীঃ আমি আমার চেহারা কেবল তার সামনে নেকাব মুক্ত করব যে আমাকে শাদী করবে। আর আমি শাদী তার সাথে করব যার অবস্থান ও সম্মান হবে শাহান শাহ্। আমি কারো দাসী বা রক্ষিতা হবো না, কেবল বিবি হতে চাই। আমার সাথে যদি জবরদস্তি করা হয় তাহলে আমার ও তার জিন্দেগীর শেষ দিন হবে। আমি রানী ছিলাম, রানী হতে চাই, আর আপনি নিজেই ওয়াদা করেছেন আমার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করবেন।
মুসা : আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকব। আমাদের মনযোগ পুরো স্পেনের দিকে। এক খুব সুরত আওরতের দিকে নয়। আমরা তোমার সাহসীকতা ও ইজ্জতের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখব। তুমি কারো দাসী-বাদীতে পরিণত হবে না।
মুসলমান ফৌজ শহরে প্রবেশ করল। মুসা প্রথমে নির্দেশ দিলেন, মেরীদা শহরবাসী ও ফৌজের জন্যে খানা তেরী করার জন্যে। যেন লক্ষ্য রাখা হয়, কেউ ক্ষুধার্ত না থাকে আর যে সরদ আটক করা হয়েছে তা যেন বাজারে দিয়ে দেয়া হয়।
প্রশাসনিক কার্য সম্পাদনের জন্যে মুসা ইবনে নুসাইর আরবী হাকিম নিয়োগ করলেন আর তাদের অধিনে নিয়োগ দিলেন খ্রীস্টান কর্মচারী। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন প্রত্যেকের থেকে তার সামর্থ অনুপাতে কর উসুল করার জন্যে। কাউকে যেন বাধ্য না করা হয় যে তার বিবি বাচ্চা ভুখা থাকে। এদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে বিশেষ ভাবে হুকুম দিলেন।
শহরের একটি ময়দানে ফৌজ ট্রেনিং হচ্ছে। মুসা সে ট্রেনিং প্রত্যক্ষ করছেন। এরি মাঝে তাকে খবর দেয়া হলো, শহরের প্রধান পাদ্রী এসেছে এবং জিজ্ঞেস করছে সিপাহ্ সালার কখন দরবারে বসবেন তখন সে সাক্ষাৎ করতে আসবে।
মুসা লক্ষ্য করলেন, প্রধান পাদ্রী তার আরো কয়েকজন সহযোগীসহ ময়দানের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুসা তাকে আহ্বান করলেন।
প্রধান পাদ্রী : আমীরে আলা দরবারে কখন বসবেন? আমি কিছু আবেদন নিয়ে আপনার সাথে মুলাকাত করতে চাই।
মুসা মৃদু হেসে বললেন, আপনি যখন এসে গেছেন তখন এখানেই দরবার বসিয়ে দিচ্ছি। আমরা সকলে আল্লাহর দরবারে দন্ডায়মান, বান্দার কোন দরবার থাকে না। এখানেই বসা যাক, একথা বলেই মুসা সেখানেই বসে পড়লেন। প্রধান পাদ্রী মাটিতে বসতে ইতস্ত: করছিল।
মুসা : বসুন। এটাই আমাদের তরীকা। যেখানে কোন অভিযোগ শোনা যায়, কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, আমরা সেখানে বসেই তার সমাধান করি।
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “যখন যে অবস্থায় আমাকে আহ্বান করবে আমি তা শ্রবণ করব।”
আল্লাহর এ ফরমানের পর বান্দার কি অধিকার থাকতে পারে দরবারের জন্যে নির্দিষ্ট সময় ও স্থান নির্ধারণ করার। এমনটি যদি আমি করি তাহলে পাপী হবো। আমি ফেরাউন নই, বাদশাহও নই। আপনি তো কওমের নেতা। আপনার কওমের যে কোন ব্যক্তি যদি আমাকে রাস্তার মাঝে দাঁড়াতে বলে তাহলে আমি অবশ্যই দাঁড়াব।
প্রধান পাদ্রী : আপনি খোদার বিধানের পাবন্দ বলে মনে হচ্ছে। আমি আপনার কাছে আবেদন করতে যাচ্ছি, আমাদের গির্জাগুলোর যেন কোন অসম্মানী না হয় এবং আমাদের ইবাদতের ওপর যেন কোন পাবন্দী না লাগে।
মুসাঃ এর প্রতি আমি অবশ্যই লক্ষ্য রাখব। ইসলামের নির্দেশ, কোন মুলক বিজয় করলে সেখানের ধর্ম ও ইবাদত খানার সম্মান যেন রক্ষা করা হয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন আপনাদের উপাসনালয়ের সম্মানপূর্ণ মাত্রায় রক্ষা করা হবে। তবে এ নির্দেশ আপনকে দেব যে গির্জাতে যেন হুকুমতের বিরুদ্ধে কোন কথা না বলা হয় এবং আপনারা আপনাদের ধর্মের কোন প্রচার-প্রসার করতে পারবেন না।
পাদ্রী : আপনি কি ইসলামের তাবলীগ করবেন?
মুসা : কোন প্রয়োজন হবে না। এতদিন হলো এ মুলক আমাদের অধিনে এসছে আপনি কি কোন অভিযোগ শুনেছেন বা কোন খবর আপনার কাছে পৌঁছেছে যে, কোন মুসলমান সিপাহী বা কোন অফিসার কোন রমণীর ইজ্জত আক্রর ওপর আঘাত হেনেছে?
না।
কোন মুসলমান কারো ঘরে প্রবেশ করে কিছু চেয়েছে।
না
কেউ কোন অনিষ্ট সৃষ্টি করেছে।
না।
মুসা : আমরা যা করছি এটাই ইসলামের তাবলীগ। আপনার নসীহত আমাদের এ তাবলীগের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আপনার ওপর আরেকটা হুকুম জারি করছি তাহলো, কোন ইহুদী বা খ্রীস্টান যুবতী রমণীকে আপনারা জোরপূর্বক যাজিকা বানাতে পারবেন না। আমরা জানি ইবাদত খানায় তাদের সাথে কি ব্যবহার করা হয়। মনে রাখবেন আমরা কোন শাহী হুকুম, শাহী প্রতাব নিয়ে এখানে আসিনি। আমরা এসেছি এক আদর্শ নিয়ে। আমরা মানুষের মুখবন্ধ করবার জন্যে আসিনি বরং তাদের মুখ খুলবার জন্যে এসেছি। তাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা রয়েছে আমি যদি ভুল পথে চলি তাহলে তারা আমাকে বাধা প্রদান করতে পারবে। পাদ্রী হয়তো আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু মুসার বক্তব্য ও ব্যবহার তাকে মুখ বন্ধ করে দিল। সে উঠে সম্মান জানিয়ে চলে গেল।
***
এক রাত্রে একাকী আব্দুল আজীজ তার বাবাকে বলল, বাবা! ইঞ্জেলা নামী ঐ লাকী আমার খুব পছন্দ যাকে আপনার সম্মুখে পেশ করা হয়েছে।
মুসা : তার চেহারায় নেকাব ছিল। পাতলা নেকাবের কারণে সুন্দরী মনে হয়েছে হয়তো বাস্তবে তেমন সুন্দরী নাও হতে পারে।
আব্দুল আজীজ : আমি তার চেহারার সৌন্দর্যের প্রতি লক্ষ্য করছিনা। তার, সাহসীকতা আমাকে প্রভাবান্নিত করেছে। আপনার সাথে সে যেভাবে কথা বলেছে স্পেনের কোন জেনারেলও এমনভাবে বলতে পারবে না। আমি তার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। এখানের প্রতিটি জেনারেল তাকে শাদী করার জন্যে পাগল পারা ছিল। কিন্তু সে সকলকে বলেছে তোমরা আগে মেরীদা রক্ষা কর। হামলাকারীদেরকে চিরতরে খতম করে দাও। সে সকলের মাঝে যুদ্ধস্পৃহা জাগিয়ে ছিল। আমার এমন একজন বিবিই দরকার।
মুসা : আমার প্রিয় বৎস! তার সাথে তোমার শাদীর ইয়াজত আমি দেব। আর আগে তুমি তাকে ভাল করে যাচাই-বাচাই করে নাও। সে শাহী খান্দানের। তুমি তো জান শাহী খান্দানের লোক কেমন হয়। এমন যেন না হয় তার পেট থেকে আমার যে বংশ পরমপরা সৃষ্টি হবে তা যেন আমাদের লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
মেরীদার মহলে ইঞ্জেলাকে পৃথক এক কামরাতে থাকতে দেয়া হয়েছিল। তার জন্যে খাদেমাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। একদিন খাদেমা তাকে খবর দিল এক আরব সেনাপতি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে।
ইঞ্জেলা : বৃদ্ধ না যুবক!
খাদেমা : যুবক, আপনার সমবয়সী।
ইঞ্জেলা : ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
আব্দুল আজীজ : আমি সিপাহ্ সালারের বেটা। সিপাহ সালার মুসা ইবনে নুসাইর আমীরে আফ্রিকা আর বর্তমানে আমীরে উন্দুলুসও। তারপরে আমি হবো আমীরে উন্দুলুস।
“এখানে আপনার আগমনের হেতু?”
আব্দুল আজীজ : “এত বড় অজ্ঞা?” তুমি কি এখনো নিজেকে স্পেনরানী জ্ঞান করা।
ইঞ্জেলা : স্পেনের রানী না হতে পারি কিন্তু নিজের অন্তরের রানী তো বটে। এটা এমন এক সালতানাত যা আমার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। স্মরণ রেখ সালার! একজন বাদশাহর বিধবা রমণী। শাহী খান্দানে পয়দা হয়েছি। এজন্যে আমার মাঝে ও সাধারণ মহিলাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ মহিলারা তো তোমাদের মত সালারদের দাসী হওয়াকেও ধন্য বলে জ্ঞান করে।
আব্দুল আজীজ : আমি তোমাকে দাসী-বাদী বানাতে আসিনি! বাদশাহর বিবি ছিলে আবার বাদশাহরই বিবি হবে।
ইঞ্জেলা : তুমি কি আমাকে শাদী করতে চাও?
আব্দুল আজীজ : হ্যাঁ। আমি বাবার থেকে ইযত নিয়েছি। তোমাকে যদি দাসী-বাদী বানানোর ইচ্ছে থাকত তাহলে এখানে এভাবে রানী হয়ে থাকতে না।
ইঞ্জেলা : আমি বিবি হব না কি রানী?
“নেকাব সরিয়ে দিলে সহীহ জওয়াব পাবে।”
ইঞ্জেলা কেবল চেহারার নেকাবই নয় মাথার কাপড়ও সরিয়ে দিল। আব্দুল আজীজ এ যুবতীর ব্যাপারে যাকে জিজ্ঞেস করে ছিল তারা বলেছিল তার বয়স প্রায় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি। কিন্তু তাকে দেখতে মনে হয় যোড়শী ললনা, সে এত অনিন্দ্য সৌন্দর্যের মহিমায় উদভাসিত যে তাকে প্রথমবার যেই দেখে সেই বিস্ময় অভিভূত হয়ে পড়ে। তার চোখে রয়েছে সম্মোহনী যাদু। কথায় রয়েছে মধুময় এমন এক অস্বাভাবিক ক্ষমতা, তাতে যে কেউ হয়ে যায় পাগল পারা। পরিণত হয় তার অনুগত দাসে।
নেকাবহীন ইঞ্জেলার চেহারা দেখে আব্দুল আজীজ চমকে উঠল। ইঞ্জেলার চোখে-মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ছিল।
অকস্মাৎ আব্দুল আজীজের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, তুমি রানী হবে, এ মুলকের রানী… আমার অন্তর রাজ্যের রানী।
ইঞ্জেলা : বিধি মুতাবেক কি শাদী হবে?
আব্দুল আজীজ : ইসলামী কানুন মুতাবেক শাদী হবে। আর তুমি…
ইঞ্জেলা : আমি ইসলাম কবুল করব না। তবে ইসলামী কানুন মুতাবেক শাদী কবুল করে নেব।
আব্দুল আজীজ তাকে বারবার বলল, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর কিন্তু সে তা মানল না বরং বলল আমি পরে ইসলাম গ্রহণ করব। আব্দুল আজীজ মেনে নিল এবং ইঞ্জেলা যে ইসলাম গ্রহণ করেনি তা গোপন রাখল।
পরের দিন আব্দুল আজীজের শাদী ইঞ্জেলার সাথে হয়ে গেল। আব্দুল আজীজ সৌন্দর্যের মোহে অন্ধ হয়ে পড়ল কিন্তু সে বুঝতে পারলনা কিছু দিন পরেই এ আওরাত তাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন করবে যাতে ইতিহাস থ… মেরে যাবে।
দেড় বছর পূর্বে মেরীদার মত একটি বড় শহর ইসাবালা মুসা জয় করে সেখানে প্রশাসনিক কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইহুদিদেরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পূর্বেই বলা হয়েছে স্পেনে ইহুদিরা ছিল নির্যাতিত-নিপীড়িত। এ কারণে তারা রডারিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গোপনে তারেককে সাহায্য করে ছিল। এর প্রতিদান হিসেবে তারেক তাদেরকে বড় বড় পদ প্রদান করে ছিলেন আর তাদের ওপর যে অযথা টেক্স ছিল তা মওকুফ করে ছিলেন। মুসাকে তারা সাহায্য করেছিল তাই মুসাও তাদেরকে পদে বসিয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর এবং তারেক ইবনে যিয়াদ একথা ভুলে গিয়েছিলেন যে ইসলাম ও মুসলমানের বড় দুশমন ইহুদীদের চেয়ে আর কেউ নেই।
ইহুদীরা তাদের আসলরূপ প্রকাশ করা শুরু করল। সর্ব প্রথম ইসাবালাতে তাদের ষড়যন্ত্রের বিজ বপন করল। সেখানে তারা দু’জন ধর্মগুরু ও চারজন ইহুদী এক ঘরে গোপন বৈঠকে বসল।
ধর্মগুরু : আমাদের এক উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেছে। রডারিক উৎখাত করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের সাথে মিলে আমরা তা করেছি। এখন আমাদের আসল উদ্দেশ্যে আসা দরকার। আর আপনারা জানেন আমাদের সে মূল উদ্দেশ্য হলো জেরুজালেম পূনরুদ্ধার করা। খৃষ্টবাদের রাজত্ব খতম করা আমাদের মাকসাদ ছিল তা আমরা মুসলমানদের হাতে করিয়েছি। তার বিনিময়ে আমরা বড় বড় পদ দখল করেছি। একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মুসলমানরা আমাদের দুশমন। আর এ দুশমন কখনো শেষ হবে না। আপনারা লক্ষ্য করছেন দিন দিন ইসলাম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে এটা রোধ করা আমাদের একান্ত দায়িত্ব। আর এ কাজ খ্রীস্টানদের সাথে মিলে করতে হবে। স্পেনকে আমরা ইসলামের কবরস্থান বানাব।
ইহুদী জাতি সৃষ্টিগতভাবে ধোকাবাজ, ষড়যন্ত্রকারী ও ফেত্নাবাজ। তাদের সে ষড়যন্ত্র শুরু হলো।
সে সময় ইসাবালার হাকিম ও কেল্লাদার ছিলেন দামেস্কের অধিবাসী আৰু বকর। তিনি এক বিকেলে বাগানে পায়চারী করছিলেন। এমন সময় এক নওজোয়ান খুব সুরত লাড়কী চুল উসক-খুসক, গায়ে জীর্ণ-শীর্ণ পোষাক। সে আবু বকরকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝল যে তার ওপর অনেক জুলুম-নির্যাতন হয়েছে। আবু বকর তার থেকে জানতে চাচ্ছিলেন সে নির্যাতনকারী কে? কোন মুসলমান নয়তো? লাভূকী কাঁদতে লাগল। আবু বকর তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে লাগলেন। সে আবু বকরের হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেল। মেয়েটির কাছে একটা ঝুড়ী ছিল। তাতে কয়েকটি আপেল ও অন্যান্য ফল ছিল। সেখান থেকে একটা আপেল সে আবু বকরকে দিয়ে ইশারা করল খাবার জন্যে।
আবু বকর মনে করলেন, গরীব মেয়ে তাকে সম্মান করে শুকরিয়া আদায় করতে চাচ্ছে তাই তিনি সে আপেল খেলেন। মেয়েটি সালাম করে চলে গেল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আবু বকর নিজ ঘরে ফিরে আসছেন, পথি মাঝে তার মাথা ঘুরা শুরু হলো। বাড়ীতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তার অবস্থা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছুক্ষণ পূর্বে কি কিছু খেয়েছিলেন?”
আবু বকর লাড়কীর অবস্থা বলে তার থেকে একটি আপেল খেয়ে ছিলেন বললেন।
ডাক্তার : আপেলের ভেতর হয়তো কোন বিষাক্ত কিছু ছিল বা কৌশলে তার ভেতর বিষাক্ত কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আবু বকর ঐ মেয়ের কথা বলে বারবার পরিতাপ করতে লাগলেন।
ডাক্তার ঔষধ দিলেন, কিন্তু প্রাণ রক্ষা করতে পারলেন না।
মুসাকে সংবাদ দিলে তিনি নতুন হাকিম নিযুক্ত করলেন।
আবু বকরের ইন্তেকালের দুতিন দিন পরে ফৌজের এক নায়েবে সালার ঔ মেয়ের হাতে কিছু খেয়ে মারা গেল।
দু’তিন দিন পর একজন মুসলমান উপরস্থ কর্মকর্তা রাত্রে একাকী পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, পিছন দিক থেকে তাকে খঞ্জর মেরে কতল করা হলো। সকালে রাস্তায় তার লাশ পাওয়া গেল। এভাবে কয়েক দিনের মাঝে ত্রিশজন মুসলিম কর্মকর্তা মারা গেল। কেউ মরলো বিষপানে কেউ তলোয়ারের আঘাতে কেউ বা খঞ্জরে।
মুসাকে খবর দেয়া হলো কয়েক দিনের মাঝে ত্রিশজন হাকিম মারা গেছেন। লোক কর দিতে বাহানা শুরু করেছে। কয়েদীদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। খবর পাওয়া গেছে কিছু কয়েদী হাতিয়ার সগ্রহ করে পালিয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি যদি সামাল না দেয়া হয় তাহলে বিদ্রোহ হবার সমূহ সম্ভানা।
ইহুদীরা গোপনে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে খ্রীস্টানদের কথাই কেবল সকলের মাথায় আসছিল ইহুদীদের কথা কেউ চিন্তাই করতে পারত না। ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে ইহুদী ও ঈসায়ী লাড়কীদের ব্যবহার করা হতো।
সংবাদ পাওয়া মাত্র মুসা তার বড় ছেলে আব্দুল আজীজকে সাত আটশত ফৌজ নিয়ে ইসাবালাতে রওনা হবার নির্দেশ দিলেন। আর বললেন, কেবল বিদ্রোহ দমনই নয় বরং ষড়যন্ত্রকারীদেরকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
মুসা : ষড়যন্ত্রকারীদের সর্বনিম্ন শাস্তি মৃত্যু দন্ড। আমার সন্দেহ হচ্ছে এ ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে ইহুদীরা।
ইহুদীরা! আব্দুল আজীজ আশ্চর্য হয়ে বলল, তারা তো আমাদের পক্ষে রয়েছে।
মুসা : ইহুদীরা তারা নিজেরা নিজেদের সাথে রয়েছে। তারা অন্য কারো সাথে থাকে না। তুমি সকলের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখবে। কাউকে সন্দেহের উর্ধ্বে জ্ঞান করবে না।
আব্দুল আজীজ তার খ্রীস্টান স্ত্রী ইঞ্জেলাকে নিয়ে সাত শত ফৌজসহ ইসাবালাতে পৌঁছলো। পৌঁছেই গোয়েন্দা বাহিনীকে নির্দেশ দিল দু’ একদিনের মাঝে বের করতে হবে বিদ্রোহ কিভাবে শুরু হলো এবং এর পিছনে কাদের হাত রয়েছে। জংগী কয়েদী যারা শ্রমিক হিসেবে ছিল তাদেরকে একত্রিত করে জিজ্ঞেস করতে লাগল কে কে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। কয়েদীরা ভয় পেয়ে অস্বীকার করল। আব্দুল আজীজ দু’জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিল তারা যেন যে কোন উপায়ে এটা উদঘাটন করে। তারা কয়েদীদেরকে লোভ দেখিয়ে পরিশেষে চার জনকে নির্দিষ্ট করল। তিনজন খ্রীস্টান, একজন ইহুদী। হাতিয়ার একটা গির্জাতে জমা করা হচ্ছিল। তাদেরকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হলো মূল ব্যক্তিদেরকে বের করার জন্যে, তারা দু’জনের নাম বলল, তাদেরকেও গ্রেফতার করা হলো।
ইঞ্জেলা দেখল আব্দুল আজিজ এত পেরেশান যে রাত্রে ঘুম পর্যন্ত আসতে পারে না।
এক রাত্রে ইঞ্জেলা তার স্বামীকে পেরেশান অবস্থায় বিন্দ্ৰি দেখে বলল,
সকল সৈন্য সামন্ত্র বিদ্রোহীদেরকে খতম করার জন্যে দিবা-রজনী ছুটে বেড়াচ্ছে তার পরও তুমি এত পেরেশান কেন?
আব্দুল আজীজ : তুমি কি জান বিদ্রোহের একটা স্ফুলিঙ্গ গোটা মুলক জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে পারে? মুলককে এর হাত থেকে বাঁচান আমার দায়িত্ব। তুমি তো জান এ মুলকের জন্যে আমরা কত জান কুরবানী করেছি। শহীদের রূহের কাছে এবং আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাব দিহি করতে হবে। সেদিন আমার চোখে ঘুম আসবে যেদিন বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ব্যক্তিকে আমার সামনে কতল করা হবে।
ইঞ্জেলা : আমাকেও ইযাজত দাও আমি এ ব্যাপারে কিছু কাজ করি।
তুমি কি করবে?
আগামীকাল বড় গির্জাতে গিয়ে পাদ্রীকে বলব, আমি এক মুসলমানের সাথে শাদী করেছি কিন্তু খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করিনি। তার পর যা করি তা তুমি জানতে পারবে।
আব্দুল আজীজ তাকে অনুমতি দিল।
পরের দিন সকালে সে গির্জাতে চলে গেল। বড় পাদ্রী তাকে দেখে তো আশ্চর্য হয়ে গেল।
পাদ্রী : আমি তো শুনেছি তুমি এক মুসলমান ফৌজী কমান্ডারের সাথে শাদী করেছ। এখন আবার গির্জাতে তোমার কি কাজ?
ইঞ্জেলা মৃদু হেসে বলল, গির্জাতেই তো আমার কাজ, গির্জার ইজ্জত রক্ষার্থে আমি যে কাজ করেছি আপনারা সকল পুরুষ মিলেও তা করতে পারেননি কথা বলেই সে পাদ্রীর হাত ধরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
ইঞ্জেলার মুচকি হাসিতেই ছিল যাদু। তারপর অট্টহাসি দিয়ে তা মহা যাদুতে পরিণত করল। পাদ্রীর হাত ধারণ করাতে পাদ্রী একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল।
পাদ্রী : তাহলে তুমি অন্য কোন অভিপ্রায়ে ঐ সালারের সাথে শাদী করেছ?
ইঞ্জেলা : হ্যাঁ। সর্ব প্রথম আপনার থেকে হলফ নেব যে আপনি আমার সকল কথা গোপন রাখবেন। গির্জাতে ইবাদতের বাহানায় আপনার কাছে এসেছি। আমাকে একজন বন্ধু মনে করে কথা বললেন, বাদশাহর বিধবা ও বিজয়ী সালারের পত্নি জ্ঞান করবেন না।
পাদ্রী : কি বলছ তুমি! আমি গির্জাতে বসেছি, তুমি যদি বল তাহলে কুমারী মরিয়ামের তাসবীরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কসম খেয়ে বলব যে,…
না ফাদার! ইঞ্জেলা তাকে বাধা দিয়ে বলল, আপনার এ কথাই আমার কাছে হলফের মত। আমি বলছিলাম যে, আমি ঐ সালারের সাথে শাদী ঠিকই করেছি কিন্তু নিজ ধর্ম ত্যাগ করিনি। সে আমার এমন পাগল হয়েছিল যে আমার শর্ত মেনে নিয়েছে। তাকে খুশী করার জন্যে বলেছিলাম কিছু দিন পরে আমি ইসলাম গ্রহণ করব।
পাদ্রী হেসে বলল, এটা তোমার সৌন্দর্যের মহিমা ইঞ্জেলা
তাই যদি হয় তাহলে এদ্বারা আমি আরো ফায়দা লুটতে চাই। আমার স্বামী বিদ্রোহের আগুন নির্বাপনের জন্যে এসেছে আর আমি সে আগুন আরো প্রখর করবার জন্যে এসেছি। আমি জানি যেসব লোক ধরা পড়েছে তারা মূল হোতা নয়। মূল হোতা কারা তাদেরকে বাঁচানোর জন্যে আমার জানা প্রয়োজন তারা কারা।
“তুমি কি তোমার স্বামীকে তাদেরকে ক্ষমা করার জন্যে বলবে?”
“না ফাদার! আমার স্বামী কাউকে ক্ষমা করে না, তার অবস্থা তো এমন যে তার কাছে গিয়ে কেউ যদি কারো নাম পেশ করে তাহলে তাকে কতল করবে। আমি এখান থেকে সকলকে বেরিয়ে যাবার ইন্তেজাম করব।”
“প্রথমে তুমি আমাকে তো রক্ষা কর। বিদ্রোহের ব্যাপারে এ গির্জাও শামিল।”
“তা আমি জানি, আমার ব্যাপারে আপনার আত্মবিশ্বাস হওয়া দরকার যে আমি ঐ সালারের সাথে শাদী এ কারণে করেছি যাতে ইসলামী হুকুমতকে অন্তঃসার শূন্য। করে তা চিরতরে খতম করতে পারি। তা আমি কিভাবে করব সে প্রশ্ন আমাকে করবেন না। শুধু এতটুকু বলছি যে আমি আমার স্বামীর বাবাকে আমার আশেক। বানিয়ে তার সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলব তারপর এমন নাটক তৈরী করব যে তার বাপ-বেটা পরস্পরে খুন খারাবী করে মরবে।”
“তোমার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।”
ইঞ্জেলা তার যৌবনের সৌন্দর্য ও মায়াবী চোখের চাহনিতে পাদ্রীকে যাদুগ্রস্ত করে ফেলল।
পাদ্রী : এ বিদ্রোহের বাগডোর তুমি যদি তোমার নিজের হাতে নাও তাহলে হয়তো আমরা কামিয়াব হতে পারি।
ইঞ্জেলা : আমরা কামিয়াব হবো এবং আমাদের কামিয়াব হতেই হবে। যদি না হতে পারি তাহলে আমি জানি খ্রীস্টবাদ ও আমাদের অবস্থা কি হবে। আপনি আপনার সাথে যারা রয়েছে তাদের সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবেন। তারা কি আগামীকাল এসময় এখানে আসতে পারবে?
পাদ্রী : হ্যাঁ, তারা সকলে আসবে।
ইঞ্জেলা : কাল আমিএ সময় এখানে আসব।
ইঞ্জেলা উঠে দাঁড়ালে পাদ্রীও দাঁড়াল। ইঞ্জেলা দু’হাত প্রসারিত করে দিল। পাদ্রী হয়তো আশা করেনি ইঞ্জেলা এতদূর এগুবে। পাদ্রী ইঞ্জেলার বাহু মাঝে চলে গেল। ইঞ্জেলা তাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে পাদ্রীর ওষ্ঠে চুমু দিল।
ইঞ্জেলা : আমি এ গির্জারই যাজিকা হবো কিন্তু স্পেন আজাদ করার পর… এটাই আমার জীবনের আখিরী মিশন।
ইঞ্জেলা পাদ্রীর বাহু থেকে মুক্ত হয়ে প্রস্থান করল। পাদ্রী স্থির দাঁড়িয়ে রইল যেন সে এখনও ইঞ্জেলার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে।
পরের দিন নির্ধারিত সময় ইঞ্জেলা এসে উপস্থিত হলো। গির্জার বাহিরে আট দশজন পাহারারত ছিল। সন্দেহভাজন কেউ এসে গেলে তারা যেন ভেতরে সংবাদ পৌঁছায়।
বার-তেরজন উপস্থিত হয়ে ছিল এরা সকলে ছিল বিদ্রোহের গোপন লিডার। তাদের মাঝে দু’জন ইহুদী ছিল।
এক ইহুদী কথা বলা শুরু করল, মালেকা ইঞ্জেলা। আমরা আপনাকে এটা জানানো জরুরী জ্ঞান করছি যে, আপনি যদি আমাদেরকে ধোকা দেন তাহলে আমরা গ্রেফতার হয়ে কতল হবো কিন্তু জেনে রাখেন আপনিও বাঁচতে পারবেন না। আমরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি, আমাদের লোকেরা আপনাকে তিলে তিলে ধুকে ধুকে মারবে।
ইঞ্জেলা : আপনারাও কতল হবেন না, আমাকেও নির্যাতিত হয়ে মরতে হবে না। আমার ধারণী ফাদার আমার ব্যাপারে আপনাদেরকে সব কিছু খুলে বলেন নি।
ইহুদী : সবকিছু বিস্তারিত বলেছ, তারপরও আমরা কিভাবে তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি। তুমিএকজন মুসলমান কমান্ডারের বিবি। স্বাভাবিকভাবেই তুমি তোমার স্বামীর বিশ্বস্ত হবে।
ইঞ্জেলা : আমার বিশ্বস্ততা গির্জার সাথে। আমার স্বামী আমার প্রতি চরম বিশ্বাসী। সে আমার প্রতি এত উম্মাদ যে আমি তাকে যে কোন কথা বিশ্বাস করাতে পারি।
অন্য একজন বলল, আমার মনে হয় তুমি খাব দেখছ। তোমার এ স্বামী অন্য আরেকটা শহর বা মুলক কয়েকদিন পরে বিজয় করবে তারপর সেখানে তোমার মৃত কোন সুন্দরীকে পছন্দ হবে তাকে শাদী করে নিবে আর তখন তুমি হবে উচ্ছিষ্ট।
ইঞ্জেলা : সে সময় আসার পূর্বেই আমাদের বিদ্রোহ সফল হবে। আপনি কি জানেন না যে, গ্রানাডা ও অন্যান্য শহরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। আমাদের এ বিদ্রোহের আগুন আরো ছড়িয়ে দিতে হবে। এটা আপনাদের কাজ। আমি দায়িত্ব নিয়েছি উপযুক্ত সময়ে বিষ প্রয়োগ করে বা অন্য কোন পন্থায় আমার স্বামীকে আমি কতল করব। কিন্তু এখন তার চোখে ধূলো দিয়ে আপনাদের সকলকে গ্রেফতারের হাত থেকে বাঁচাব। যথা সম্ভব দ্রুত এ শহর ত্যাগ করে আপনাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে কারণ যে সব লোক গ্রেফতার হয়েছে তাদের কেউ, তার জীবন। বাঁচানোর জন্যে আপনাদের নাম বলে দিতে পারে। আপনারা এখান থেকে গিয়ে বসে না থেকে ঘরে ঘরে বিদ্রোহের আগুন পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।
ইহুদী : এটা তো করতেই হবে। মুসলমানদের কাছে এত ফৌজ নেই যে ছারা সমগ্র দেশের বিদ্রোহ দমন করতে পারবে। এখানে একটা কথা আমি বিশেষভাবে বলছি তাহলো, যেখানেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে তা ইহুদীরা করেছে। আমরা ক্ষমতায় বসতে চাই না তবে আমরা চাই রাজদরবারে খ্রিষ্টানদের মান সম্মান যেমন রয়েছে ইহুদীদের তেমন প্রতিষ্ঠিত হোক।
এক খ্রীস্টান লিডার বলল, তার চেয়েও তোমরা বেশী সম্মান পাবে। তোমরা যে কাজ করতে পার খ্রীস্টানরা তা করতে পারে না। ইহুদীদের প্রতিদান আশাতীত মিলবে।
ইঞ্জেলা : আপনারা নিশ্চিন্তে কাজ করুন। অধিকার ও সম্মানের প্রশ্ন পরে। এখন সকলে এ শহর হতে বেরুবার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমি আপনাদেরকে বলে। দিচ্ছি কিভাবে আপনারা বের হবেন,
“আপনারা সকালে বনিক বেশে খচ্চরের ওপর মাল নিয়ে রওনা হবেন। শহরের ফটকে জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আমরা কর্ডোভার ব্যবসায়ী। নিজেদের মাল বিক্রি করে এখান থেকে মাল নিয়ে যাচ্ছি।
ইঞ্জেলা তাদের সকলকে একটা জায়গায় একত্রিত হবার জন্যে বলল।’
পরের দিন বিদ্রোহীরা নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়ে রওনা হবার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে হঠাৎ তারা দেখতে পেল চল্লিশ-পঞ্চাশজন ঘোড় সোয়ার তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রমে সোয়ারীরা কাছে এসে তাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল।
ঘোড় সোয়ারের কমান্ডার বলল,তোমরা সকলে বন্দী। খামুশ হয়ে আমাদের সাথে চল।
তাদের সকলকে নিয়ে আব্দুল আজীজের সম্মুখে উপস্থিত করা হলো।
“তাদের সকলকে কতল কর।” আব্দুল আজীজ হুকুম দিল। হুকুম পালন করা হলো। আর এর সাথেই বিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত হয়ে গেল।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে লক্ষ্য করে বলল, এখন আমার ওপর আস্থা এসেছে তো। আমি আমার কওমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে থোকার ফাঁদে ফেলে কতল করালাম। তোমার সাথে শাদী করে তোমার ধর্ম গ্রহণ করিনি তাতে কি হয়েছে। আমার ধর্মতো তোমার মহব্বত ভালবাসা। আমি তো তোমাকে পূজা করি।
আব্দুল আজীজ তো আগে থেকেই ইঞ্জেলার জন্যে এমন পাগল পারা ছিল যে শাদী করার পরেও তাকে খ্রীস্টান থাকার অনুমতি দিয়েছে। এখন এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার পর আব্দুল আজীজ তার গোলাম হয়ে গেল।
আব্দুল আজীজ বিদ্রোহের অপরাধে নব্বইজন ইহুদী-খ্রীস্টানকে কতল করেছিল।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে বিস্তারিত বলেছিল যে, এ বিদ্রোহের আগুন ইহুদীরা জ্বালিয়ে ছিল এবং তারা মুসলমানদেরকে দুশমন জ্ঞান করে। মুসলমানদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার সুবাদে ইহুদীদেরকে জায়গীর দেয়া হয়েছিল তা ছিনিয়ে নেয়া হলো। খ্রীস্টানদের রাজত্বে তাদের যে অবস্থান ছিল সে অবস্থানে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হলো।
যেখানেই বিদ্রোহের খবর পেত আব্দুল আজীজ নিজে সেখানে গিয়ে শক্ত হাতে তা দমন করতে লাগল। এভাবে সে বিজয়ী শহরগুলো বিদ্রোহ মুক্ত করল।